ভূঁতুড়িয়া ষ্টেশন থেকে সুরু করে এই মুহূর্ত অবধি যে অবস্থার মধ্য দিয়ে আমি চলেছি, তার প্রকৃত ব্যাখ্যা কি হতে পারে তা বোধগম্য হওয়া দূরে থাক, আমি যেন ক্রমান্বয়ে এক অভূতপূর্ব কুহেলিকার মাঝখানে গিয়ে পড়ছি। মনের নিভৃতে একবার একটা কথা উঁকি মেরে গেল। এ কি তবে সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগের খেলা চলেছে! যে যুগে বিরাটাকায় প্রাণীসমূহ পৃথিবীতে বিচরণ করতো? আমি কি তবে সেই যুগে ফিরে এসেছি কোনো এক মহাশক্তির যাদু-দণ্ডের পরশে!
এইসব বৃহৎ নভোচরেরা কি তবে টেরাডাকটাইল গোষ্ঠির বংশধর! আর এই গরুগুলো, যাদের দেখলে মনে হয় গরু। কিন্তু তাদের অবয়ব না গরু, না বাঁদর, না কিছুর সমন্বয়ে সৃষ্ট। এ যেন ভগবানের এক অপূর্ব সৃষ্টি নৈপুণ্য। একটা অদ্ভুত ধরনের খেলা। যে খেলা ডাইনোসর আর টাইরোনোসরস যুগে তিনি খেলেছিলেন?
.
আমার জানলার ঠিক নিচেই ওরা গজরাচ্ছিল। একটা গরু ছাদ থেকে নেমে আসা জলের পাইপ বেয়ে উপরের দিকে ওঠবার চেষ্টা করছিল আর সঙ্গে সঙ্গে অপর গরুটি প্রচণ্ড হুঙ্কার দিয়ে প্রথম গরুর ল্যাজ ধরে একটানে মাটিতে ফেলে দিচ্ছিল। এই নিয়ে উভয়ের মধ্যে চলছিল এক প্রলয়ঙ্করী যুদ্ধ। ওদের ঘরোয়। যুদ্ধের ফলে মাটি কাঁপছিল এমন কি বাড়ীটাও দুলে উঠছিল।
হঠাৎ একটা কথা মনে হতেই শরীর হিম হয়ে এল। ওরা আমাকে আক্রমণ করতে আসছে না তো? পাইপ বেয়ে যদি সত্যি সত্যিই উঠে আসে তা হলে ওদের নিঃশ্বাসেই তো আগুন ধরে যাবে জানালা কপাট, সব কিছুতে। তাড়াতাড়ি মুখটা জানলা থেকে সরিয়ে জানলা বন্ধ করতে যাবো এমন সময় দেখলাম, কোথা থেকে ছুটে এলো হরিনারাণ! হাতে সেই প্রকাণ্ড চাবুক।
মুহূর্ত অপেক্ষা না করে হরি সপা-সপ চাবুক চালাতে লাগল গরু দুটির দিকে। হরির চাবুকে যেন আশ্চর্য্য যাদু ছিল। গরু দুটির দৃষ্টি হয়ে এল সচল ও সাধারণ। নিঃশ্বাসে আর দেখা গেল না কোন আগুন! গরু দুটি মাথা নীচু করে চলে গেল। চলে যাবার পূর্ব মুহূর্তে একবার মাত্র মাথাটা ঘুরিয়ে দেখে নিল আমার দিকে।
সেই চাহনীর দিকে অতিবড় সাহসীও চেয়ে থাকতে পারবে না। আমি ঘরের মধ্যে সরে এলাম। তবে, এটুকু বিশ্বাস আমার জন্মেছিল যে, এই ঘরের মধ্যে কেউ আমার ক্ষতি করতে পারবে না। সুতরাং বাইরে যা কিছু ঘটে ঘটুক, আমি ঘর ছেড়ে বাইরে যাবো না।
বিছানার উপর বসে কালো খাতাটার পাতা ওলটাতেই যা যা নজরে পড়ল তাতে বেশ অবাক হয়ে গেলাম। বড় বড় হরকে আমাকে উদ্দেশ্য করেই লেখা হয়েছে:
.
দাদা,
আমি জানি একমাত্র আপনি ছাড়া এটুকু উপকার কেউ করবে না। তাই আপনাকে নিমন্ত্রণ করে এখানে আনতে হয়েছে। সকাল হলেই আপনি মুহূর্ত মাত্র সময় নষ্ট না করে গয়ায় গিয়ে এই খাতায় যে সব নাম ধাম গোত্র লেখা আছে তাদের নামে পিণ্ড-দান করে এইসব হতভাগ্যদের নরক-যন্ত্রনা থেকে মুক্ত করুন। ঘটনাটি ঘটে এমনি এক ঝড়ের রাতে। এইসব হতভাগ্যরা বজ্রাঘাতে মৃত্যু বরণ করে। যে দু’একজন বেঁচে ছিল তারা মৃতদেহগুলিকে কবর দিয়ে এ স্থান ত্যাগ করে চলে যায়। সেই থেকে এই সব হতভাগ্যের দল, রাত্রি হলেই কবর ছেড়ে উঠে পড়ে রক্তের নেশায় পাগল হয়ে। জীবন্ত যা কিছু দেখতে পায় তাদেরই রক্ত শোষণ করতে থাকে। আমিও করেছি। ইলা আমার বাগদত্তা, অন্যান্যেরা আমার চাকর-বাকরের দল।
ইতি হরিনারায়ণ
.
পাতার পর পাতায় যথাক্রমে হরিনারায়ণ, ইলা, ইত্যাদি বহুজনের নাম ধাম গোত্র লেখা রয়েছে। অবিশ্বাস্য ব্যাপার। কি করে সম্ভব কিছুই বুঝতে পারছি না। জলজ্যান্ত মানুষগুলো, যাদের সঙ্গে কথা বলেছি, এমন কি ইলার সান্নিধ্যে তার নিঃশ্বাসের হিমেল অনুভূতিটুকু পর্যন্ত পেয়েছি, এদের পিণ্ডদান করতে নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে এই খাতা মারফৎ। কারণ কি! এরা কি সবাই মৃত? আমি এতক্ষণ যাদের দেখলাম বা দেখছি সবই কি তবে ওদের প্রেত-রূপ?
এক ঝলক ঠাণ্ডা হাওয়া এসে গায়ে আছড়ে পড়লো। জানালা দিয়ে আলোর বন্য। ছড়িয়ে পড়ছে ঘরের মধ্যে। ভোর হয়ে গেছে। আকাশের জমাট মেঘ কখন যে সরে গিয়ে নীল আকাশ ফুটে উঠেছে দেখতে পাইনি।
আমি কালো খাতাটা হাতে নিয়ে ছুটলাম ইলার ঘরের দিকে। আমার বিশ্বাস করতে প্রবৃত্তি হচ্ছিল না যে ইলা সত্য সত্যই প্রেতমূর্তি নিয়ে আমার সামনে উপস্থিত হয়েছিল।
ঘরের দরজাটা খুলে ভিতরে ঢুকতেই দেখতে পেলাম সেই কাঁচের
কফিনটা। সারা অঙ্গে ব্যান্ডেজবাঁধা অবস্থায় শায়িত রয়েছে একটি
মৃতদেহ।
কফিনটার কাছে এগিয়ে যেতেই বিস্ময়ে ফেটে পড়লাম। যেমনটি প্রথমবার দেখেছিলাম ঠিক তেমনি অবস্থায় শুয়ে আছে ইলা। চোখের মণিদুটো স্থির হয়ে আছে। ইলা মৃত। কিন্তু ঠোঁটের কষ বেয়ে লাল রক্তের ধারা গড়িয়ে পড়েছে। একটু ভাল করে লক্ষ্য করতেই বুকটা কেঁপে উঠল। তাজা রক্ত এখনও শুকিয়ে জমাট বাঁধেনি। কফিনের ভিতর কয়েকটি মুরগীর পালক রয়েছে পড়ে। গতরাতে হরি যে মুরগীগুলো ওর কফিনে ঢুকিয়ে দিয়েছিল, এই রক্ত সেই মুরগীগুলোরই!
আমি একছুটে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এলাম। দরজাটা দু’ফাঁক করে খুলে ধরতেই প্রভাতী সূর্যের আলো এসে ঘর ভরিয়ে দিল। শেষবারের মত আর একবার ঘরের মধ্যে তাকাতেই আরও অবাক হয়ে গেলাম। সূর্যের আলো ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই ইলা সমেত কফিনটি অদৃশ্য হয়ে গেছে। ঘরটি একদম ফাঁকা। কেবল মুরগীর কয়েকটি পালক ইতস্ততঃ ছড়িয়ে আছে।
এক লাফে দোতলা থেকে নেমে এসে দাঁড়ালাম উঠোনটার মাঝখানে। দিনের আলোয় তখন পরিষ্কার দেখাচ্ছিল আমার কাছে। দেখলাম পর পর কয়েকটি সমাধি ক্ষেত্র।
কালো খাতার ক্রমিক নম্বর অনুসারে কবর গুলি সাজানো। কবরের ফলকে উৎকীর্ণ নাম ধাম, ইত্যাদির হুবহু নকল আমার হাতের এই কালো খাতায় রয়েছে লেখা।
ইলার সেই অন্তর্ভেদী চাহনি, জানিনা সে দৃষ্টিতে কি ছিল আমাকে যেন আকর্ষণ করছিল। চৌম্বক যেমন লোহাকে সবলে আকর্ষণ করে নিজের কব্জাগত করতে চায় ঠিক তেমনি ধারা এক অনুভূতি শিরায় শিরায় অনুভর করলাম।
হাতে সেই কালো খাতা নিয়ে কবরের ইতিহাস খুঁজতে গিয়ে মনে হল, তাই তো! হিন্দুধর্মের নিয়মানুযায়ী এইসব দেহগুলিকে দাহ করাই ছিল বিধেয়। তবে কেন এইসব মানুষগুলোকে কবরস্থ করা হলো। এর যে কি কারণ হতে পারে বুঝতে পারলাম না। অথচ হরিনারাণকে যে জিজ্ঞাসা করবে। তারও উপায় নাই। সে এখন শায়িত রয়েছে আমারই সামনে ঐ কবরের তলায়।
একে একে সমস্ত কবরগুলির ইতিবৃত্ত জানবার পর ইলার কবরের কাছে দাঁড়ালাম, যদিও এখন সকাল হয়ে গেছে। সূর্যের আলোকে উদ্ভাসিত হয়ে উঠছে চারদিক। তবুও গা’টা ছম ছম করে উঠল। আমি মানসচক্ষে ইলার সেই হিমশীতল চাহনি দেখতে পেলাম।
ইলা মৃত এবং তার দেহ কবরস্থ করা আছে একথা আমি বুঝতে পারছি, তবু মন বলছে হয়তো সে কবর ফুঁড়ে উ.ঠ আসবে, আমার সামনে আলিঙ্গনাবদ্ধ করে বসিয়ে দেবে তার ছুঁচলো দুটি দাঁত। আর তারপর নিঃশব্দে শোষণ করে চলবে আমার দেহের রক্ত। ভাবতেই শিউরে উঠলাম আমি। হরিনারায়ণ না থাকলে হয়তো আমার জীবনে গতরাতের অভিজ্ঞতাই শেষ অভিজ্ঞতা হতো। এখানকার মত সোনালী প্রভাত এ জীবনে আর আসতো না। কিন্তু তবু কেন জানিনা, ইলার প্রতি কেমন যেন একটা দুর্বলতা অনুভব করলাম।
জানি, ইলার সেই অশরীরী দেহ। জানি, ইলা বেঁচে নেই, আছে ঐ মাটির গহ্বরে। কফিনের মধ্যে তিলে তিলে পচনের মধ্য দিয়ে গলে গলে মাটির সঙ্গে মিশে যাবে তার দেহ। হয়ত কয়েকটা হাড় পড়ে থাকবে কবরের তলায়। তবু যেন গত রাতের সম্মোহনী দৃষ্টিকে মনে হচ্ছে জীবন্ত। বড়ই ভয়ানক জীবন্ত সেই দৃষ্টি। একবার দেখলে যেন চোখ ফিরিয়ে নেওয়া যায় না। মানসিক চেতনা হয়ে পড়ে পঙ্গু। নিজের অজ্ঞাতে আত্মসমর্পন করতে হয়।
অদূরেই একটা কোদাল পড়ে রয়েছে দেখতে পেলাম। হাতের কালো খাতাটা মাটিতে রেখে কোদাল দিয়ে কবর খুঁড়তে শুরু করলাম। কেন যে খুঁড়ছি তা জানি না। কিন্তু মনের এক কোনা থেকে নিয়ত কে যেন উৎসাহিত করে চলেছে কবর খোঁড়ার জন্যে।
খানিক মাটি তোলবার পরই কফিনটা বেরিয়ে পড়ল। এক হাত দিয়ে কপালের ঘাম মুছে একটু বিশ্রাম করে নিলাম। তারপর কফিনের ঢাকনা খুলতেই চমকে উঠলাম। হ্যাঁ, ঠিক সেই মুখ। ঠোঁটের কষ বেয়ে গড়িয়ে পড়েছে রক্তের ধারা। প্রভাতের আগে ওই ঘরের মধ্যে যেমনটি দেখেছিলাম ঠিক তেমনি ভাবেই লেগে রয়েছে রক্তের দাগ! যুক্তি দিয়ে কোন ব্যাখ্যাই মনকে নিরস্ত করতে পারল না। কিভাবে এই কফিনের মধ্য থেকে ইলা উঠে এসেছিল গতরাত্রে। আর কেমন করেই বা সে কথা বলেছিল আমার সঙ্গে। মৃত্যুর পরও কি মানুষ কথা বলতে পারে?
এত সুন্দর যার মুখের চেহারা, দেখলে মনে হবে সদ্যফোঁটা একটি গোলাপ যেন। কেমন করে এই নিষ্পাপ রমনীয় মুখ রক্তপান করে তৃপ্তি লাভ করতে পারে? হয়তো সবই সম্ভব এই দুনিয়াতে। মানুষের বৃদ্ধির বাইরেও অনেক কিছু আছে যা মানুষের জানা নাই।
হরিনারাণ বলেছিল এদের মুক্তি দিতে! একমাত্র গয়ায় পিণ্ডদান করলেই এইসব অভিশপ্তরা মুক্তি পাবে। শান্তি পাবে এইসব হতভাগাদের আত্মা। একদৃষ্টে চেয়েছিলাম ইলার মরদেহের দিকে। মেয়েটি ছিল হরিনারাণের বাগদত্তা। বেচারী শান্তি পেলো না। ইহজীবনে পারল না সুখ ভোগ করতে। বিধাতার নিষ্করুণ অভিশাপ! অতৃপ্ত আত্মা মেতে উঠেছে তৃপ্তির নেশায়। সে তৃপ্তি ওদের জৈবিক কোন কামনা বা বাসনা নয়। তাজা তাজা রক্তে ওদের তৃপ্তি। ওরা রক্তের পিপাসায় উন্মত্ত। ভাবতেও কেমন যেন বিশ্রী লাগে ঘুলিয়ে ওঠে সারা গা। শিরশির করে ওঠে শরীরের শিরা উপশিরা, আতঙ্কে হাত পা বরফ হয়ে আসতে থাকে।
রাতের অন্ধকারে যতই ভয় থাক না কেন, দিনের আলোয় সে ভয়টুকু কেটে গিয়েছিল। আমি কবরখানা ছাড়িয়ে বাড়ীটার আশে-পাশে একটু দেখে নেবার জন্যে পা বাড়ালাম। বাড়ীটি অতি জরাজীর্ণ। চারিদিকের দেওয়ালে চূণবালি খসে পড়েছে। বাড়ীর কার্নিশে, এদিকে ওদিকে অশ্বত্থ গাছ মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। বাড়ীর মধ্যেকার চাতাল ছাড়িয়ে গেটের দিকে যেতেই নজরে পড়ল একরাশ কঙ্কাল বিচ্ছিন্নভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। বুঝতে পারলাম, এইসব হতভাগ্যের দল ভুল করে এই পথে পা বাড়িয়ে এইসব প্রেতাত্মাদের খোরাক হয়েছে। শুধু যে মানুষের কঙ্কাল পড়েছিল তা নয়, অন্যান্য পশুপক্ষীর কঙ্কালও দেখা গেল ওদের মধ্যে। মনে মনে হরিনারায়ণকে ধন্যবাদ জানালাম। নতুবা এতক্ষণে হয়ত এইসব বঙ্কালের মাঝেই একটি নতুন বঙ্কালের স্থান হয়ে যেতো। কথাটা ভাবতেই মনটা ভয়ে কুঁকড়ে উঠল।
না আর বীরত্ব দেখিয়ে কাজ নেই! যত শীঘ্র সম্ভব এই প্রেতপুরী ছেড়ে দূরে চলে যাওয়াই উচিত। তা নাহলে রাতের অন্ধকার ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে ওরা জেগে উঠবে। ইলা হয়তো ছুটে আসবে তার সেই রক্ত জল করা চাহনি নিয়ে। চুকচুক করে শুষে নেবে আমার দেহের রক্ত। তারপর ছুঁড়ে ফেলে দেবে ওই কঙ্কালের স্তুপের মধ্যে।
প্রেতপুরীর জীর্ণ গেটখানা আমার হাতের চাপে ক্যাচ ক্যাচ করে খুলে গেল। আমি বাড়ীর বাইরে বেরিয়ে এলাম। হঠাৎ মনে হল আমি যেন মুক্ত, বাড়ীর চৌহদ্দির মধ্যে যতক্ষণ ছিলাম নিজেকে বড় অসহায় মনে হচ্ছিল, আমি ইলা বা অন্য সব মৃত মানুষগুলির প্রভাব ছিল আমার উপর। কিন্তু বাইরে আসার সঙ্গে সঙ্গেই বুঝতে পারলাম আমার উপর কারুর বা কোন অদৃশ্য শত্তির প্রভাব নেই।
আমি ছুটলাম ‘ভুতুড়িয়া’ ষ্টেশনটার দিকে। আজ সন্ধ্যের সেই শেষ ট্রেনটি আমাকে ধরতেই হবে। তা নাহলে আবার নেমে আসবে রাত্রির অন্ধকার। এই রাজ্যের ওই প্রেতপুরীর প্রেতেরা জেগে উঠবে। ভাবতেই মাথাটা ঝিম্ ঝিম্ করে উঠল। আমি ছুটলাম মাঠের মধ্য দিয়ে। কিছুক্ষণ ছুটবার পর খেয়াল হলো, আমি ঠিক ঠিক পথে চলছি তো? ষ্টেশনটা কোন দিকে তাতো আমার জানা নাই গত রাত্রে হরিনারাণের গরুর গাড়ী করে এসেছিলাম। সে পথ চিনে রাখা তো সম্ভব ছিল না। তাছাড়া যে অকল্পনীয় পরিবেশের মধ্য দিয়ে আমি এই পোড়া বাড়ীটায় এসেছি সেই সময়ে কোন সুস্থ মানুষের পক্ষেই অন্য কোন দিকে নজর দেওয়ার সুযোগ ছিল না। ড্রাগন গরু গুলোর বড় বড় রক্তাভ চক্ষু আর নিঃশ্বাসের সঙ্গে আগুনের ঝলক মনে পড়লে হৃৎস্পন্দন স্তব্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম ঘটে।
মাঠের উপর দিয়ে ছুটতে ছুটতে চলেছি আর রোমন্থন করছি গতরাতের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা! নিজের অজ্ঞাতসারে একবার পিছন ফিরে তাকালাম ফেলে ‘আসা সেই প্রেতপুরীর দিকে। আর তারপরই মনে পড়ে গেল, এই যা, −কালো খাতাটা ফেলে এসেছি ইলার কবরের পাশে। দুর্ভাবনায় মনটা খারাপ হয়ে গেল। আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম।
দূরে দেখা যাচ্ছে সেই পোড়ো বাড়ীটা। আশেপাশে অসংখ্য ঝোপঝাড় তার মধ্যে কয়েকটি নারকেল গাছ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে। দিনের আলোতেও দূর থেকে বাড়ীটাকে দেখলে গা ছম্ ছম্ করে ওঠে।
কালো খাতাটা ফেলে রেখে যাওয়াটা কি ঠিক হবে? অনবরত সেই কথাটাই মনের চাপ সৃষ্টি করছিল আমার! অথচ অভিশপ্ত ওই বাড়ীটায় পুনরায় ফিরে যেতে মন সায় দিচ্ছিল না। ফিরে যাওয়ার কথা ভাবতেই একটা হিমেল হাওয়া যেন গায়ের উপর আছড়ে পড়ে শরীর মনকে অবসন্ন করে তুলল।
না, আমি আর ওপথে পা বাড়াতে রাজী নই। ওরা চিরদিন ওদের রাজ্যে বিচরণ করুক। কারও আত্মা মুক্তি পাবে কি পাবে না, সে নিয়ে আমার উতলা হওয়ার কোন কারণ থাকতে পারে না। ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাওাই ভাল। বন্ধুকৃত্য করতে এসে শেষটায় জীবন নিয়ে টানাটানি ভাল নয়। আমি পা বাড়ালাম ষ্টেশনের দিকে।
চলতে চলতে মনে হলো হরিনারাণের কথা। সে আমাকে আমন্ত্রণ করে এনেছিল আর সে সবকিছু ভয়াবহ পরিণতির হাত থেকেও আমাকে রক্ষা করেছে। কেন? আমাকে রক্ষা করার উদ্দেশ্য তার কি ছিল? সে চেয়েছে মুক্তি। সঙ্গে সঙ্গে সে তার সঙ্গীদেরও মুক্তি কামনা করেছে। এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মধ্যে আমাকে হরিনারাণ নিয়ে এসেছে এবং প্রতিমুহূর্তে আগলে রেখেছে তার রক্তপারী সঙ্গীদের কাছ থেকে।
কথাটা ভাবতেই মনে অনেকটা সাহস ফিরে এস। হরিনারাণের
আন্তরিক ইচ্ছাকে কার্যে পরিণত করাই আমার উচিত। যদি বিপদের ঝুঁকি কিছুটা নিতেই হয়, ক্ষতি নেই। আমি ফিরলাম সেই ফেলে আসা বাড়ীটার দিকে।
সূর্যের আলোয় চারিদিক ঝলমলিয়ে উঠছে। ঝিরঝিরে হাওয়ায় শরীরের ক্লান্তি দূর হয়ে গেছে অনেকটা। আমি এসে পৌঁছলাম বাড়ীটার সামনে। লোহার গেটটা হাত দিয়ে ঠেলে বাড়ীর চৌহদ্দির মধ্যে ঢুকতেই মনটা ছ্যাৎ করে উঠল। মনে হল আবার যেন হারিয়ে ফেলেছি নিজেকে। সেই চোখ, সেই মুখ, ছায়াছবির মত ভেসে উঠতে লাগল মানসনেত্রে। আমি এগিয়ে গেলাম কবরখানার দিকে।
অপরূপ বললে হয়তো রূপের ঠিক বর্ণনা করা হবে না। ঈশ্বরের সর্বশ্রেষ্ঠ রং-এর ভাণ্ডার উজাড় করে এক কমনীয় রমনীয় রঙের সমন্বয়ে রাঙিয়ে তোলা হয়েছে ইলাকে। তার সঙ্গে বিশ্বকর্মার নিপুণহাতে তৈরী হয়েছে দেহসৌষ্ঠব। যেখানে যতটুকু প্রয়োজন সেটুকুই স্থান পেয়েছে ইলার শরীরে। মেঘদূত কাব্যে কালিদাসের তন্বী শ্যামা যেন হার মেনে যায়। ইলাকে দেখলে কালিদাস হয়তো তার কাব্যে এক নতুন সংযোজন ঘটাতো, একথা হলফ করেও বলা চলে।
আমার সাহস উত্তরোত্তর বেড়ে যাচ্ছে। বলেই কিন্তু যখনই রাত্রি ঘনিয়ে আসবে তখন হয়তো আমার আর এই সাহস থাকবে না। মনের ভেতর ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার দ্বন্দ্ব। আমি এক পা এক পা করে এগুচ্ছি। কালো খাতাটা যে চাই-ই চাই।
কালো খাতাটা পড়ে আছে ইলার কবরের পাশেই। খাতাটা হাত দিয়ে তুলে নেবার সময় চোখ দুটো নিবদ্ধ হল কফিনটার দিকে। যে কফিনটায় শুয়ে আছে ইলা। বেশীক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না। কৃফিনের দিকে তাকাতেই গতরাতের সেই ভয়াবহ ঘটনাগুলি মানসপটে ভেসে উঠল। কি জানি হয়তো দিনের আলোকেই ইলা কবর থেকে উঠে এসে জড়িয়ে ধরবে। তারপরই তার দু’কষ বেয়ে ঝরবে রক্তের ধারা। যেরক্ত আমারই রক্ত। গা শিরশির করে উঠল। না, আর এক মুহূর্তও এখানে থাক। ঠিক নয়। আমি খাতাটা নিয়ে বেরিয়ে এলাম গেটের বাইরে। তারপর হাঁটতে লাগলাম ষ্টেশনের দিকে।
মৃতদেহগুলি সম্ভবতঃ বেণীদিন আগে কবরস্থ করা হয়নি। এত সতেজ মৃতদেহ, না দেখলে কেউই বিশ্বাস করবে না। অথচ আশ্চর্যের ব্যাপার, কি উপায়ে এই দেহগুলি এমন সুন্দরভাবে পচন থেকে রক্ষা পাচ্ছে ভেবে কূল পাচ্ছি না। তবে কি এরা মৃত নয়? তাই বা কেমনভাবে সম্ভব? জীবন্ত মানুষ কবরের তলায় বেঁচে থাকবেই বা কি করে? একটা মস্তবড় হেঁয়ালী মনকে ঘিরে ধরলো। কিন্তু জট ছাড়াতে সমর্থ হলাম না। হরিনারাণের কথা অনুযায়ী এরা মৃত। কিন্তু বাহ্যিক ক্ষেত্রে চোখের সামনে যা প্রত্যক্ষ করলাম, তাতে প্রতীয়মান হয়, এরা মৃত হলেও যেন মৃত নয়! সে যাই হোক আমার কর্তব্যকর্মটুকু আমি করবো। জীবন্ত অথবা মৃত, এ নিয়ে মাথা ঘামানো উচিত নয়। যে জিনিষের ব্যাখ্যা করা আমার পক্ষে দুঃসাধ্য, সে জিনিষ সম্বন্ধে অযথা চিন্তা করায় কোন লাভ নেই!
মাঝে মাঝে পিহন ফিরে চেয়ে দেখি, আবার হনহন করে হেঁটে চলি। ক্রমেই দূরত্ব বাড়তে থাকে। এখন আর সেই পোড়ো বাড়ীটা দেখলে মনে ভয়ের উদ্রেক হয় না। দূর দিকসীমায় ছায়া ছায়া অস্তিত্ব নজরে আসে। বুক ভরে শ্বাস নিলাম। শরীর ও মন এখন বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠেছে আমার।
সামনেই একটা শাল গাছের বন। রাস্তাটা চলে গেছে তারই মধ্যে দিয়ে, হাঁটতে হাঁটতে জঙ্গলের মধ্য দিয়ে চললাম। বাড়ীটা দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেছে। শাল বনের অপর প্রান্তে যখন পৌঁছলাম তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে। একটা ছোট নদী বয়ে চলেছে বনের প্রান্তঘেষে। আমি জলে নেমে হাতমুখ ধুয়ে কিছুটা জল খেয়ে নিলাম। তারপর আবার নতুন উদ্যমে শুরু করলাম হাঁটতে।
কিন্তু ষ্টেশন কোথায় বা কোনদিক তার হদিস খুঁজে পেলাম না। এমন কি এতদূর পথ হেঁটে আসার সময় একটি মানুষকেও পথের মাঝে দেখতে পাইনি। অথচ সন্ধ্যার আগেই আমাকে হয় ষ্টেশন অথবা রাতের মত একটা আশ্রয়স্থল খুঁজে বার করতে হবে।
আরও খানিকটা চলার পর একটা গ্রাম নজরে পড়ল। আমি সেই গ্রাম লক্ষ্য করে এগিয়ে চললাম। গ্রামের কাছাকাছি একজন চাষীর সঙ্গে দেখা হতেই তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ভুতুড়িয়া’ ষ্টেশনটা কোনদিকে আর কতদূর?
লোকটি অবাক দৃষ্টি মেলে আমাকে নিরীক্ষণ করার পর বললে, সে তো অনেকদূর পথ বাবু? তা আপনি আসছেন কোথা থেকে?
আমি বললাম, পথটা বলে দাও ভাই, আমাকে সন্ধ্যার আগেই পৌঁছাতে হবে। আমি এদিকে বেড়াতে এসে রাস্তা হারিয়ে ফেলেছি।
মুখ দেখে মনে হলো লোকটি যেন বিশ্বাস করতে পারেনি। এই নির্জন পাণ্ডব বর্জিত অঞ্চলে আমার বেড়াতে আসা কথাটা কেমন যেন বেমানান। যাইহোক, লোকটি কথা না বাড়িয়ে বলল, আপনি যদি শাল বনের ভিতরের রাস্তা দিয়ে যান তবে পাঁচ ক্রোশ পথ হাঁটতে হবে। যে পথটা শালবনের মাঝামাঝি গিয়ে বাঁ হাতে ঘুরে গেছে। তবে, সাবধানে যাবেন, সোজা যে পথটা চলে গেছে ও পথে যাবেন না। ওদিকে গেলে কেউ ফিরে আসে না। আমাদের গ্রামের দুজন মানুষ একবার ওই পথে ভুল করে চলে গিয়েছিল, আজও তারা ফিরে আসেনি। এহাড়া আর একটা রাস্তা আছে, ওই বনের ধারে যে নদীটা আছে। ওই নদীর ধার দিয়ে। ও পথট। একটু ঘুরপথে ষ্টেশনে গেছে। কিন্তু রাস্তাটা অনেকখানি, প্রায় আট ক্রোশটাক হবে।
কথাটা শুনে ষ্টেশনের পথ যেমন আবিষ্কৃত হলো সঙ্গে সঙ্গে দুশ্চিন্তায় ছেয়ে গেল মন। সন্ধ্যের আগে এতদূর পথ যেতে পারবো কিনা! তার উপর শরীর ক্লান্ত, অবসন্ন। এমন কি পুনরায় রাস্তা ভুল হওয়াটাও কিছু অস্বাভাবিক না।
লোকটিকে ধন্যবাদ জানিয়ে আমি গ্রামের দিকে এগুলাম। যদি কোন চায়ের দোকান পাওয়া যায় তো কিছু খেয়ে নেওয়া যাবে।
একটি ছোট চায়ের দোকান। নবীন প্রবীণদের একটা ছোট ভিড়। মুড়ি তেলেভাজা, বিস্কুটও বিক্রী হচ্ছে। আমি দোকানের কাছে আসতেই সকলের কৌতূহলী দৃষ্টি পড়লো আমার দিকে। একজন মধ্যবয়স্ক শুধালেন, ‘বাবু মশায়, যাবেন কোথায়? কার বাড়ী।
ওরা আমাকে একটু জায়গা করে দিল বসবার জন্য। আমি বেঞ্চটার উপর বসে বললাম, পথ ভুল করে এ গাঁয়ে চলে এসেছি, যাবো কলকাতায়।
আপনাকে অনেকটা পথ হাঁটতে হবে বাবু, ওদের একজন বললে, নদীর ধার দিয়ে যাবেন। শালবনের ভিতর দিয়ে যাবেন না।
শালবনের রাস্তাটাই তো কম পথ, −আমি বললাম।
ও বনে ঢুকলে কেউ ফিরে আসে না বাবু, −লোকটি ভয়মিশ্রিত কণ্ঠে বললে, নদীর ওপারে ওই শাল বন আর তারও ওপাশে ফাঁকা মাঠের উপরে আছে প্রকাণ্ড এক বাড়ী। পিশাচ আর ডাকিনীদের আড্ডা। জ্যান্তমানুষ পেলে ঘাড় মটকিয়ে রক্ত খায়;
তবে, নদীর এপারে ওরা আসতে পারে না। আমরা সন্ধ্যের সময় নদীর এপারে থেকে, ওদের কান্না শুনতে পাই। গায়ের রক্ত জলকরা সেই কান্না শুনে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা ভয়ে আঁতকে ওঠে।
ব্যাপারটা সবই বুঝতে পারছি কিন্তু ওদের কাছে প্রকাশ করলাম না। সেই অমানুষিক কান্নার উৎস আমি জানি। সারারাত আমি ওদের মাঝেই কাটিয়েছিলাম। বললে ওরা ভয় পাবে, হয়তো অন্যকিছুও ভাবতে পারে।
আমি কিছু জলযোগ করেই বেরিয়ে পড়লাম ষ্টেশনের দিকে। ঘুর পথে না গিয়ে শালবনের মধ্য দিয়েই সর্টকাট করার মনস্থ করলাম।
ছোট্ট নদীর ছোট সাঁকোটা পার হবার সময়ে মনটা একটু চঞ্চল হয়ে উঠল। কিন্তু সবকিছু দুর্বলতা ঝেড়েমুছে ফেলে শালবনের রাস্তা দিয়েই এগিয়ে চললাম গন্তব্যস্থলের দিকে। সন্ধ্যার আগেই পৌঁছতে হবে ষ্টেশনে।
ষ্টেশনে একা একা কাটাতে হবে চিন্তা করতেই গা’টা শিরশির করে উঠল। জনমানবহীন অন্ধকার ষ্টেশনের পরিবেশ স্মরণ করে ভাবনায় পড়লাম। আমার পক্ষে খুব সুখকর হবে না সন্দেহ নেই। আরও জোরে পা চালালাম। সূর্য তখন মাথার উপর থেকে পশ্চিম দিকে হেলে পড়েছে। শালবনের পথ যেন ফুরোতে চায় না। হাঁটছি তো হাঁটছিই। একফালি সরু পথ। মনে হয় এপথ মানুষ সচরাচর ব্যবহার করে না। পরিত্যক্ত পথ হিসাবেই পড়ে আছে। সামনে, পিছনে যেদিকে তাকাই কোন মানুষ নেই। বহুদিন পর আমিই যেন একমাত্র ব্যক্তি যে এইপথ দিয়ে চলেছি পায়ে হেঁটে। বাতাসে শালগাছগুলির পাতা নড়ছে। মনে হচ্ছে ওরা যেন ফিস ফিস করে নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। আমি যেন ওদের ভাষা বুঝতে পারছি। ওরা বলতে চাইছে, হেঁ পথিক, একটু তাড়াতাড়ি করো। তুমি কি বুঝতে পারছো না যে এক মহা অশুভ শক্তির এলাকা দিয়ে তুমি চলেছো। তুমি কি জানো না, সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে জেগে উঠবে এখানকার রক্তপায়ী পিশাচরা। তারা তোমার রক্ত পান করে নিজেদের মৃত-আত্মাকে জীইয়ে রাখবে আরও কিছুদিন। তুমি কি ওদের সেই অমানুষিক কর্ণবিদারক কান্না শোনোনি! যে কান্নার শব্দে তোমার দেহের স্নায়ুগুলি অবশ হয়ে পড়বে। মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কাজকর্মে ঘটবে বিপর্যয়। চিন্তাশক্তি লোপ পায়, সেই নিদারুণ শব্দ তরঙ্গের শিকার হয়ে!
অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম। সম্বিৎ ফিরে পেয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম সূর্য পশ্চিম আকাশের অনেক নীচে নেমে গেছে। লম্বা লম্বা ছায়া বিস্তার করেছে শালগাছগুলি অস্তগামী সূর্যের আলোয়। যেন লক্ষ লক্ষ অশরীরী ধেয়ে আসছে আমার দিকে। আমাকে গ্রাস করার উল্লাসে ওরা কেঁপে কেঁপে নেচে উঠছে। ছায়া ছায়া হাত বাড়িয়ে আহ্বান জানাচ্ছে সন্ধ্যাতারাকে।
গাছেরা হাসছে। দুলে দুলে নেচে নেচে এক একটা গাছ যেন আনেকটা গাছের ওপর গড়িয়ে পড়ছে। আর উভয়ের মিলিত আনন্দ হাসি হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে আকাশে বাতাসে। শাল অরণ্যের চারিদিকে ধোঁয়াসার সৃষ্টি হয়ে অন্ধকারকে স্বাগত জানাচ্ছে। আমি যেন ওদের হাসি শুনতে পাচ্ছি। ওরা আমাকে হাসির মাধ্যমে বিদ্রুপ করছে। বলতে চাইছে, কেমন মজা! এ্যাডভেঞ্চারের মজাটা কেমন লাগছে?
তারপরই যেন গাছেরা সুর পাল্টালো, গাছের পাতারা লাফালাফি দাপাদাপি করে বেহাগের করুণ সুরের রেশ ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ল। মনে হল, ওরা বলছে, তোমার পরিণতির জন্যে আমরা দুঃখিত পথিক! পারতো পালাও, যত তাড়াতাড়ি পারো ততই মঙ্গল!
আমি কখন যে দৌড়াতে আরম্ভ করেছি নিজেই তা জানিনা। থামলাম শালবনের শেষপ্রান্তে যেখানে শালবন শেষ হয়েছে। সামনেই উন্মুক্ত প্রান্তরের উপর দিয়ে চলে গেছে রাস্তাটা। আর হয়তো দু-তিন মাইল পথ হাঁটতে হবে। কিন্তু ওদিকে সূর্য যে অস্তগামী! ট্রেনটা ধরতে পারবো কিনা বুঝতে পারছি না। অথচ এই মুহূর্তে পিছনে ফেলে আসা গ্রামটাতে ফিরে যাওয়াও সম্ভব নয়। ফিরতে গেলে রাতের অন্ধকারে পার হতে হবে ঐ ঘন শালবন। না, একেবারেই অসম্ভব। ট্রেনটা আমাকে ধরতেই হবে। এই অভিশপ্ত পরিবেশ থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পালাতে হবে!
আরও যে কতটা দৌড়েছি খেয়াল ছিল না। দৃষ্টি ছিল পশ্চিমের দূরদিগন্তে অস্তগামী প্রকাণ্ড থালার মত লাল টুকটুকে বিদায়ী সূর্যের দিকে। দিকচক্রবালে তখন তার অর্ধেক দেহ প্রোথিত। বাকী অর্ধেক মুহর্তের মধ্যেই ডুবে যাবে।
সূর্যের শেষ রশ্মিটুকুও মিলিয়ে গেল আকাশ থেকে। আমি এসে পৌঁছলাম ভূঁতুড়িয়া ষ্টেশনে। রেল লাইনের উপর দাঁড়িয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলাম অপসৃয়মান একটি লাল আলোর দিকে। ট্রেনটি মিনিট, দুই তিন আগে ষ্টেশন ছেড়ে চলে গেছে। তারই লাল আলোটুকু দেখতে পাচ্ছি। আশা-ভরসার প্রতীক সেই আলো আমাকে গভীর নৈরাশ্যের মধ্যে ডুবিয়ে রেখে মিলিয়ে যাচ্ছে দূর থেকে দূরান্তরের দিকে।
চারদিক ডুবে গেছে অন্ধকারের মধ্যে। আমি প্লাটফরমের এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে চিন্তা করছি কোনদিকে যাবো। হঠাৎ মনে পড়ল, ষ্টেশনের যেদিক থেকে আমি আসছি সেদিকটা মনুষ্যবর্জিত তেপান্তর হলেও ষ্টেশনের অপর দিকটায় গ্রাম আছে। অবশ্য মাইল দুই তিন পথ হাঁটতে হবে। আমি স্থির করলাম এই দু’মাইল পথ হেঁটে নিকটবর্তী গ্রামে গিয়ে রাতটা কাটাতে হবে। তারপর ভোরের ট্রেনেই কলকাতা রওনা হবো।
কয়েক পা অগ্রসর হয়েছি মাত্র, এমন সময়ে ভেসে এলো সেই তীক্ষ্ণ সুতীব্র একটানা ক্রন্দনধ্বনি। বিহ্বল করে তুললো আমাকে। দু’হাত দিয়ে চপে ধরলাম কান দুটোকে। তাসত্ত্বেও সেই অমানুষিক কান্নার রেশ কানের পর্দায় রন্দ্রনিয়ে উঠতে লাগলো। ভাবলাম, ছুটে পালাই যে দিকে খুশী সেইদিকে। কিন্তু পা দুটি তার সমস্ত শক্তি হারিয়ে তার অক্ষমতা প্রকাশ করলো।
প্রায় এক মিনিট ধরে সেই ধ্বনি আকাশ বাতাস মথিত করে স্তব্ধ হয়ে গেল। আমি একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচলাম। তারপর রেললাইন পার হয়ে ওপাশের গ্রামের খোঁজে যাবার মনস্থ করলাম।
রেললাইন পার হতে গিয়ে নজরে পড়ল, একটা ছায়ামূর্তি এগিয়ে আসছে। আমি থমকে দাঁড়ালাম। মানুষ অথবা হরিনারাণের কোন সহচর বোঝবার আগেই সেই ছায়ামূর্তি আমার খুব কাছাকাছি এসে গেল। অন্ধকারের মধ্যে লোকটির চেহারা ভালো করে দেখতে পাচ্ছিলাম না। আমি অভিভূতের মত দাঁড়িয়ে একদৃষ্টে নিরীক্ষণ করতে লাগলাম লোকটার গতিবিধি।
মাষ্টারমশাই, গাড়ী কি চলে গেছে? −লোকটা কথা বলে উঠল।
মন থেকে একটা গুরুভার নেমে গেল। শরীরে শক্তি ফিরে এলো। বুঝলাম, একজন গ্রাম্য লোক। আমারই মতন ট্রেন ধরতে এসেছে। খুশী হলাম, নিঃসঙ্গতাকে কাটিয়ে উঠতে পেরে। লোকটাকে কিছুতেই ছাড়া চলবে না। ওকে সঙ্গী করেই সারারাত কাটাতে হবে, তা এই ষ্টেশন চত্বরেই হোক অথবা নিকটবর্তী কোন গ্রামেই হোক, ক্ষতি নেই।
বললাম, হ্যাঁ, গাড়ী চলে গেছে, আমিও ধরতে পারিনি।
কথাটা শুনেই লোকটা চঞ্চল হয়ে উঠল, বলল, আমি চললাম বাবু, এদিকটা মোটেই ভাল জায়গা নয়। তেনাদের বড্ড উৎপাত। আমি চললাম।
আরে দাঁড়ান, দাঁড়ান! −আমি ব্যস্তভাবে বললাম। আমি তো রয়েছি, আপনার ভয় কিসের? আমারও তো একটা আস্তানার দরকার। যদি মনে কিছু না করেন তো আপনার সঙ্গে আমিও যাবো। রাতটা তো কাটাতে হবে!
চলে আসুন চলে আসুন। −লোকটি ততোধিক ব্যস্ততার সঙ্গে বললে, একমুহূর্তও দেরী করবেন না। দেরী করে ষ্টেশনে এসে কি ভুলটাই যে করেছি, রাম রাম, রাম রাম!
আমি লোকটাকে অনুসরণ করলাম। সে সভয়ে রাম-নাম উচ্চারণ করে চলেছে। অন্ধকারে রেললাইনের উপর একটা হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলাম। লোকটা তাড়াতাড়ি আমাকে তুলে ধরে বললে, পা চালান বাবু, আমার মনটা ভালো বলছে না। বলতে বলতে, লোকটা হঠাৎ সচকিত হয়ে ওঠে আমাকে ছেড়ে দিয়ে ছুটতে শুরু করলো গ্রামের দিকে। দিগদিগন্ত কাঁপিয়ে তখন শুরু হয়ে গেছে সেই তীক্ষ্ণ ভয়াল আর্তনাদ কান্নার আকারে।
একটা নীলাভহাতিময় অথচ আবছা আলোকে ভরে উঠল চারিদিক। আলোকের উৎস দেখতে না পেয়েও যে দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠল তা যেমনই মর্মান্তিক তেমনি ভয়াবহ!
অদূরে প্রাণভয়ে পলায়মান লোকটার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে ইলা। সেই লাস্যময়ী ভূবন মোহিনী রূপের ছটা। তার চোখ দুটি এক অদ্ভুত উজ্জ্বলতায় চকচক করছে। এতদূরে থেকেও তা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি আমি। বিস্ময়াভিভূত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। ইলা আমার কাছে না এসে ঐ গেঁয়ো লোকটার সামনে দাঁড়াল কেন?
লোকটা হতভম্ব হয়ে গেছিল প্রথমটা। তারপর সেও যেন কৌতুক অনুভব করল। ভুলে গেল পার্থিব অপার্থিব সবকিছু। ধীরপদে এগিয়ে চললো ইলার দিকে।’ ইলাও এগিয়ে আসছিল লোকটার দিকে।
পরক্ষণেই ইলা ঝাঁপিয়ে পড়ল লোকটার উপর। দু’হাতে তাকে জড়িয়ে ধরলো। মুখটা নেমে এলো লোকটার ঘাড়ের কাছে। আমি অসহায়ের মত দাঁড়িয়েছিলাম, হঠাৎ যেন প্রচণ্ড সাহস এসে মন প্রাণকে তাজা করে দিল। আমি ছুটলাম ইলার দিকে, চীৎকার করে বলতে লাগলাম, ছেড়ে দে শয়তানী, ছেড়ে দে!
কাছাকাছি আসতেই ইলা ছেড়ে দিল লোকটাকে। লোকটা ধপাস করে মাটিতে পড়ে গেল। আমি তাড়াতাড়ি লোকটাকে তুলে ধরতে ‘গিয়েই বুঝতে পারলাম লোকটা মারা গেছে। সারাদেহ তার বরফের মতন ঠাণ্ডা। লোকটার শরীরের শেষ রক্তবিন্দুটুকুও শুষে নিয়েছে পিশাচী।
ইলার দিকে তাকিয়ে শিউরে উঠলাম। সে তখন তার জিভ দিয়ে ঠোঁট দুটিকে লেহন করে চলেছে। মুখে-চোখে ফুটে উঠেছে এক অবর্ণনীয় হিংস্রতার ছাপ। চোখ দুটো যেন আগের থেকেও বেশী উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। আমি সভয়ে দু’পা পিছিয়ে এলাম। অবচেতন মনের তাগিদে ছুটে চললাম প্লাটফরমের উপর দিয়ে ষ্টেশনমাষ্টারের ঘরের
দিকে। ইলাও, ছুটে এলো আমার পিছু পিছু। অনুভব করছি আর হয়তো কয়েক’ মুহূর্তের মধ্যেই ইলা ধরে ফেলবে আমাকে।
ধরে যখন ফেলবেই এবং এই নির্জন অন্ধকারে আমাকে যখন ওর শিকার হতেই হবে তখন আর পালিয়ে লাভ নেই। তাছাড়া পালিয়ে যাবোই বা কোথায়? কথাটা মনে হতেই আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম। ইলা তখন আমার খুবই কাছে এসে গেছে। কয়েক হাতের ব্যবধান মাত্র। আমি দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে হাতের কালো খাতাটা নিয়ে সজোরে আঘাত করলাম ইলার মুখে।
হায়! কোথায় ইলা? হাওয়া কেটে কালো খাতাটা শূন্যের বুকেই দাগ কেটে গেল। ইলা অদৃশ্য হয়ে গেল। আমি চোখ দুটো ভাল করে রগড়ে নিয়ে বুঝতে চেষ্টা করলাম। সত্য অথবা আমার মনের বিভ্রম? নীল আলোটাও অদৃশ্য হয়ে গেছে, ফিরে এসেছে পূর্বেকার সেই অন্ধকার ঘেরা পরিবেশ।
যদি মনের বিভ্রমই হয়ে থাকে তবে নিশ্চয়ই সেই গ্রাম্য লোকটির দেখা পাবো না। একটু আগে যার রক্ত শোষণ করেছে শয়তানী। আমি এগিয়ে গেলাম সেইদিকে, যেখানে পড়ে রয়েছে গ্রাম্য লোকটার প্রাণহীন দেহ।
দাদা, কোথায় চলেছো? −কথাটা শুনেই প্রচণ্ডভাবে চমকে উঠলাম। হরিনারাণের কণ্ঠস্বর। অথচ হরিনারাণকে দেখতে পেলাম না। মনে হলো শব্দটা আসছে ষ্টেশনমাষ্টারের ঘরের দিক থেকে।
আবার শুনতে পেলাম, হরিনারাণ বলছে, এভাবে একা একা ঘোরা বিপজ্জনক। তুমি ষ্টেশনমাষ্টারের ঘরে আজ রাতের মত বিশ্রাম করো, কাল ভোরের গাড়ীতেই চলে যেও।
তুমি কোথায় হরিনারাণ? –আমি চেঁচিয়ে উঠলাম, অন্ধকারে তোমাকে দেখতে পাচ্ছি না। দয়া করে সামনে এসো।
তুমি তো আমাদের কথা সবই জেনে গেছে। দাদা। এখন যদি তোমার সামনে দাঁড়াই, তুমি কি তা সহ্য করতে পারবে? -হরিনারাণ বলল।
নিশ্চয়ই পারবো হরি! আমি বেশ জোর গলায় বললাম, যদি গতকাল রাত্রেও তোমার সঙ্গে কাটাতে পেরে থাকি, তবে এখনও পারবো। সৎ আত্মার সঙ্গে সঙ্গদান করতে কোন ভয় নেই। তুমি আমার সামনে এসো।
বেশ, আসছি। তুমি মাষ্টারমশাই-এর ঘরে গিয়ে বসো। ওখানেই তোমার সঙ্গে দেখা হবে। অলক্ষ্যে থেকেই কথাগুলি বলল হরিনারাণ।
ষ্টেশনমাষ্টারের ঘরের কাছে এসেই অবাক হয়ে গেলাম। একটু আগে যে ঘর তালাবন্ধ ছিল, এখন তা উন্মুক্ত। পকেট থেকে দেশলাই বার করে জ্বালতেই টেবিলের উপর একটা হ্যারিকেন দেখতে পেলাম। ভালোই হলো, অন্ততঃ অন্ধকারের মধ্যে রাত্রিযাপন কতে হবে না।
আলোটা জ্বালিয়ে চেয়ারটায় বসতে গিয়েই নজর পড়ল হরিনারাণের দিকে। সে জানালাটার ধারে একটা টুলের উপর বসে রয়েছে।
আমি খুবই দুঃখিত হরিনারাণ, আমি আন্তরিকতার সঙ্গে বললাম, ট্রেনটা ধরবার আপ্রাণ চেষ্টা সত্বেও দেরী হয়ে গেল।
সবই জানি দাদা, মুখ না ঘুরিয়ে হরিনারাণ বললে আমারই ভুল হয়ে গেছে কালো খাতাটার পাশে একটা রাস্তার নক্সা রাখলে তোমার পক্ষে সুবিধে হতো। তাড়াতাড়িতে সেকথা ভুলে গিয়েছিলাম।
ঠিক আছে, ঠিক আছে, তার জন্যে কি! –আমি বললাম হরিনারাণকে।
হরিনারাণ আমার কথার কোন উত্তর না দিয়ে চেয়ে রইল বাইরের দিকে। আমি অবাক হয়ে ভাবলাম, আশ্চর্য! আমার একটুও ভয় করছে না হরিনারাণকে দেখে। যদিও এখন আমার অজানা নয় যে আমার সামনে যে হরিনারাণ বসে আছে সে কোন জীবিত মানুষ না। পরন্তু, একটি মৃত মানুষ। যে দিনের আলোকে কবরের মধ্যে থাকে, রাতের অন্ধকারে উঠে আসে কবর থেকে। আরও আশ্চর্য হচ্ছি ভেবে যে এইসব মৃতেরা সশরীরে কেমন করে কবর থেকে বেরিয়ে আসে। একটু আগেই যে ঘটনা চোখের সামনে ঘটতে দেখলাম সে তো কোন বায়বীয় বা বিদেহী আত্মার কাজ নয়। লোকটার রক্ত শোষণ করা কোন বিদেহী আত্মার পক্ষে সম্ভব নয়। মৃত ইলা তার দেহ নিয়েই উঠে এসে গ্রাম্য লোকটার রক্তপান করেছিল! এ কেমন করে সম্ভব?
হরিনারাণ সম্ভবতঃ আমার মনের কথা বুঝতে পেরেই বলে উঠল, ওইসব ব্যাপার ভেবে কোন লাভ নেই দাদা। অযথা তোমার মস্তিষ্ককে উত্তেজিত করো না। তবে, তোমার কৌতূহল মেটাবার জন্যে বলতে পারি যে কবর থেকে সত্যি সত্যিই ইলা বা আর সবাই উঠে আসে কবর ভেদ করে। ঠিক এই মুহূর্তে যদি কেউ কবরের কাছে যায় তবে সে কোন দেহকেই শায়িত দেখতে পাবে না। রক্তপান করেই দেহগুলিকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হয়েছে। রক্তপান না করলে দেহগুলি গলে পচে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে যাবে। যতদিন পর্যন্ত না ওরা মুক্তি পাচ্ছে ততদিন ওদেরকে বেঁচে থাকতে হবে কোন জীবিত প্রাণীর রক্ত শোষণ করেই। যাই হোক আমি এখন যাচ্ছি, দরকার মনে করলেই এসে হাজির হবো! একটা শুধু অনুরোধ করবো, ঘরের বাইরে বেরিও না। গতরাত্রে আমার কথা না শুনে বিপদে পড়েছিলে, সুতরাং অহেতুক নিজেকে বিপদের মধ্যে জড়িও না।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন