মৃত্তিকার মৃত্যু – ২

অভিরূপ সরকার

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

(১)

রবিবারটা আদিত্য আর কেয়া একসঙ্গে কাটাতে চায়। সোমবার থেকে কেয়ার আবার সেই জাঁতাকল। সেই সকালে ওঠা, ইস্কুল, কোচিং ক্লাশ, হা-ক্লান্ত হয়ে সন্ধেবেলা বাড়ি ফেরা। সপ্তাহে দু-দিন ইস্কুলের পর বেশিক্ষণ কোচিং ক্লাশ থাকে। সেই দু-দিন ফিরতে ফিরতে রাত্তির হয়ে যায়। আদিত্যর অবশ্য তা নয়। গত কয়েক মাস, বলতে গেলে তার হাতে কোনও কাজই নেই। কিন্তু সকালে কেয়া বেরিয়ে গেলে আদিত্য টের পায় বাড়িটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। কিছুক্ষণ পরে সে-ও বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে।

সকালে কেয়া খুব তাড়াতাড়িতে থাকে বলে কিচ্ছু গুছিয়ে যেতে পারে না । আদিত্য রোজই লক্ষ করে সকালে কেয়া ইস্কুলে বেরিয়ে যাবার পর বাড়ির ভেতর তার চিহ্ন এদিক ওদিক ছড়িয়ে রয়েছে। মেঝের ওপর গত রাত্তিরে পরা বাসি রাত্রিবাস যেটা কাজের মাসিকে কাচতে দেওয়া উচিত ছিল কিন্তু দেওয়া হয়নি। যে শাড়িটা পরবে ভেবেছিল কিন্তু পরেনি, সেটাও পাট না করে খাটের একপাশে ফেলে গেছে। বিছানার ওপর ব্লাউজ, অন্তর্বাস, এগুলোও আলমারি থেকে নামানো হয়েছিল, পরা হয়নি। ড্রেসিং টেবিলে এলোমেলো করে রাখা প্রসাধনী। ইস্কুল থেকে ফিরে এসে কেয়া নিশ্চয় আবার সব গুছিয়ে রাখবে, কিন্তু যতক্ষণ না রাখছে ততক্ষণ চারদিকে কেয়ার জিনিসপত্র ছড়ানো অথচ কেয়া নেই। ব্যাপারটা আদিত্যর ভাল লাগে না। আদিত্যর মনে হয়, কেয়ার অনুপস্থিতিতে বাড়িতে থাকার চাইতে আপিসে সময় কাটানো ভাল। মনে মনে প্রার্থনা করে, সন্ধেবেলা সে যখন বাড়ি ফিরবে তার আগেই যেন কেয়া বাড়ি ফিরে আসে।

আজ রবিবারটা এক সঙ্গে কাটানো যেত, অথচ সকালেই আদিত্যকে বেরিয়ে যেতে হল। যখন বাড়ি ফিরল তখন প্রায় তিনটে বাজে। কেয়া না খেয়ে বসে আছে। রবিবার দুপুরে এক সঙ্গে না খেতে পারলে খাবার আনন্দটাই মাটি। তার ওপর কেয়া আজ প্রচুর পরিশ্রম করে কাঁকড়া রান্না করেছে। ভাগ্যিস আদিত্য চানটা সেরে বেরিয়েছিল, তাই বাড়ি ফিরেই খেতে বসতে পারল।

রবিবার বাড়িটা খুব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন লাগে। কেয়া একজন কাজের মাসিকে রেখেছে যে প্রত্যেক রবিবার সকালে এসে সারা বাড়ি ঝাড়পোঁচ করে। আদিত্য ফেরার আগেই মাসি বাড়ি পরিষ্কার করে চলে গেছে। বাড়িতে এখন আদিত্য আর কেয়া একা ।

রবিবার দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর আদিত্য আর কেয়া দাম্পত্যের শারীরিক শর্তটা উদগ্রীব হয়ে পালন করে। এ-ব্যাপারে তাদের আকুলতা এখনও কমেনি। অন্য সময় যে এসব হয় না তা নয়, কিন্তু রবিবার দুপুরটা প্রায় নিয়মে দাঁড়িয়ে গেছে। আদিত্যদের দাম্পত্য প্রায় দু’বছর হতে চলল।

আদিত্য ঘুমিয়ে পড়েছিল। বিকেল পাঁচটা নাগাদ চোখ খুলে টের পেল কেয়া তাকে চা খেতে ডাকছে। তাদের ছোট্ট বাসায় কোনও বারান্দা নেই। বসার ঘরে দুটো বেতের চেয়ার আছে। সেখানে বসলে জানলা দিয়ে রাস্তা দেখা যায়। এটাই তাদের এক সঙ্গে বসে চা খাবার যায়গা। রবিবার বিকেলে রাস্তা প্রায় ফাঁকা রয়েছে। অন্য দিন যে গাড়িগুলো বড়রাস্তার ট্র্যাফিক সিগনাল এড়াবার জন্যে আদিত্যদের বাড়ির সরু রাস্তাটা দিয়ে শর্টকাট করে তারা আজ নেই। রাস্তার মাঝখান দিয়ে একটা খবর কাগজ উড়ে যাচ্ছে। তার পেছন পেছন কয়েকটা শুকনো পাতা। গাছ থেকে কিছু বটফল এসে রাস্তায় পড়েছে। সেগুলোকে মাড়িয়ে একটা হাতে-টানা রিক্সা ঠুনঠুন করতে করতে চলে গেল। এবার ঝড় উঠবে।

কেয়া একটা ট্রেতে দু-কাপ চা আর এক বাটি চানাচুর নিয়ে আদিত্যর পাশে এসে বসল। চানাচুর খাবার জন্য বাটিতে দুটি চামচ। ঠিক সেই সময় বেজে উঠল কেয়ার মোবাইল। চা খেতে খেতে আদিত্য খেয়াল করল কেয়া খুব একটা কথা বলছে না। অনেকক্ষণ ধরে শুনে যাচ্ছে। কেয়ার মুখ দেখে আদিত্য আন্দাজ করল গুরুতর একটা কিছু ঘটেছে।

বেশ কিছুক্ষণ এক-তরফা শোনার পর কেয়া বলল, “তুমি ডাক্তারকে বলো এটা এমার্জেন্সি কেস, এই ভাবে ফেলে রাখা যায় না। একটা মানুষের জীবন-মরণের প্রশ্ন। পুলিশ কখন আসবে তার ঠিক আছে নাকি?’

ওদিক থেকে কী উত্তর এলো বোঝা গেল না। কেয়া আদিত্যর দিকে তাকিয়ে টেলিফোনে বলল, “আমি আমার স্বামীকে বলছি। দেখি ও কী করতে পারে। তুমি এখন রাখো। ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করো। আমরা কিছুক্ষণের মধ্যে পৌঁছে যাচ্ছি।’

মোবাইল নামিয়ে রেখে কেয়া আদিত্যর দিকে তাকাল। আদিত্য কেয়ার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

‘অমলা তরফদার ফোন করেছিল। অমলাদি আমাদের ল্যাবে কাজ করে। নন-টিচিং। ও খুব বিপদে পড়েছে। এমনিতেই মেয়েটা নানা সমস্যায় থাকে। কয়েক বছর আগে স্বামী মারা গেছে। শশুর-শাশুড়ি বেঁচে। তাদের দেখতে হয়। একটাই ছেলে। মানুষ হয়নি। বিপদটা ছেলেকে নিয়ে।’

কেয়া একটু থেমে চায়ের কাপে লম্বা চুমুক লাগাল।

‘ছেলেটা কুসঙ্গে পড়েছে। মানে, যতটা কুসঙ্গে পড়া সম্ভব। মাধ্যমিকের পর স্কুল যাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। অমলাদি মাঝে মাঝেই কান্নাকাটি করত। এখন বলছে, ছেলে নাকি পাতাখোর মানে ড্রাগ-অ্যাডিক্ট। এবং যা হয়, ড্রাগের পয়সা জোটানোর জন্যে ড্রাগ-পেডলিংও করে। পুলিশের হাতে দু-একবার ধরা পড়েছে কিন্তু প্রমাণের অভাবে ছাড়া পেয়ে গেছে। এসব কথা অমলাদি আগে কখনও বলেনি।’

‘বলার মতো কথাও নয়। কিন্তু তার বিপদটা কী?’ আদিত্য একটু অধৈর্য হয়ে জিজ্ঞেস করল।

‘ড্রাগ ওভারডোজ। ঘুম থেকে উঠছিল না। যে ঘরে ঘুমোয় তার দরজা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল। দুপুরবেলা পাড়া-পড়শি দরজা ভেঙে ঢুকে দ্যাখে খাট থেকে মাটিতে পড়ে গেছে। জ্ঞান নেই। মুখ দিয়ে গাঁজলা বেরোচ্ছে। ওদের পাড়াতেই একটা ছোট নার্সিং হোম আছে সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। নার্সিং হোম এখনও অ্যাডমিট করেনি। বলছে এটা পুলিশ কেস। পুলিশ না এলে কিচ্ছু করা যাবে না। তুমি কাউকে বলে-টলে কিছু করতে পারবে?’

‘এদের বাড়িটা কোথায়? কোন থানার আন্ডারে ?’

‘অমলাদির বাড়ি পার্ক সার্কাস। কোন থানা জানি না।’

‘অমলাদির ছেলের নাম কী?’

‘এই রে! তাড়াহুড়োতে ওটা জিজ্ঞেস করতে ভুলে গেছি। অসুবিধে নেই, আমি ফোন করে জেনে নিচ্ছি।’

‘নার্সিং হোমের নাম বলেছে?

‘বেস্ট কেয়ার নার্সিং হোম। পার্ক সার্কাস বাজারের কাছে। অমলাদি বলল, বাজারের সামনের রাস্তাটা ধরে আর একটু সারকুলার রোডের দিকে এগোলে বাজারের বাঁ দিকে পড়বে।’

‘ভালই ডিরেকশন দিয়েছে। শুনে মনে হচ্ছে নার্সিং হোমটা করেয়া থানার আন্ডারে। কিন্তু করেয়া থানায় তো আমি কাউকে চিনি না। লালবাজারের কাউকে দিয়ে বলাতে হবে। তারও আগে প্রশ্ন হল, আমাকে ঠিক কী করতে বলছ?’

‘আমি চাইছি, ছেলেটাকে যাতে ওই নার্সিং হোম ভর্তি করে নেয় তুমি তার একটা ব্যবস্থা কর। ও ওখানে বেশিক্ষণ এমনি এমনি পড়ে থাকলে মরেই যাবে। অমলাদি ভীষণ কান্নাকাটি করছে।’

‘দ্যাখো, নার্সিং হোমদেরও তো কিছু নিয়ম মেনে চলতে হয়। ওদেরও পুলিশি ঝামেলার ভয় থাকে। এটা তো কোনও সাধারণ রুগির কেস নয়। আমার মনে হচ্ছে, যতক্ষণ না পুলিশ ওখানে গিয়ে পৌঁছচ্ছে, নার্সি হোম চিকিৎসা শুরু করবে না। আমি বরং লালবাজারে বলে দেখি যদি করেয়া থানা থেকে তাড়াতাড়ি ওখানে কাউকে পাঠানো যায়।’

‘তাতেই কাজ হবে গো। তুমি বললে কাজ হবে না এটা হতেই পারে না।’ ‘আরে না না। দু-একজন চেনাশোনা ছাড়া আর আমাকে কে পাত্তা দেবে? আচ্ছা দেখছি গৌতমকেই ধরতে পারি কিনা।’

‘আর একটা কথা বলছি। আমার সঙ্গে ওই নার্সিং হোমে একটু যাবে ? অমলাদি একেবারে একা পড়ে গেছে। আমাকে খুব করে যেতে বলছে। আমি ওদিকটা ভাল চিনি না। একা গেলে হয়ত জায়গাটাই খুঁজে পাব না। যাবে একটু আমার সঙ্গে? অমলাদি খুব কান্নাকাটি করছে। মেয়েটা এত দুঃখী। ওর জন্যে খুব খারাপ লাগে।’ ‘ঠিক আছে। যাব। কিন্তু রাত্তিরের রান্নার কী হবে? ঠিক ছিল না দু-জনে মিলে রাত্তিরে রান্না করব?’

‘আজ রাত্তিরে বাইরে খাব। আমি খাওয়াব। জান তো পার্ক সার্কাসে একটা রয়েল হোটেল হয়েছে। আমাদের একজন টিচার বরের সঙ্গে গত সপ্তাহে খেতে গেছিল। বলল, চিৎপুরের রয়েল হোটেলের মতই ভাল। আমরা হস্টেলে মাঝে মাঝে চিৎপুরের রয়েল থেকে চাঁপ আর রুমালি রুটি আনাতাম। দারুণ।’ কেয়ার চোখের কোণে উত্তেজনা ঝিলিক দিচ্ছে।

বেস্ট কেয়ার নার্সিং হোমটা বড়রাস্তার ওপরে নয়। বেকবাগান রো বলে যে মাঝারি রাস্তাটা বাজারের সামনে দিয়ে এজেসি বোস রোড-সার্কাস এভিনিউ-এর দিকে চলে গেছে তার ওপরেও নয়। জায়গাটা ওই অঞ্চলে ঠিকই, কিন্তু একটা গলির মধ্যে। কেয়া একলা এলে চিনে উঠতে পারত না। আদিত্যরা তাদের উবারটা বড়রাস্তার ওপরেই ছেড়ে দিয়েছিল। ছেড়ে দিয়ে ভালই করেছিল। পায়ে হেঁটে না গেলে নার্সিং হোমটা খুঁজে বার করা যেত না। তাও সামনে পুলিশ দাঁড়িয়েছিল বলে চিনতে সুবিধে হল।

এক ঝলক দেখলেই বোঝা যায় জায়গাটা উঁচু দরের নয়। বস্তুত, একটা রং-চটা সাইন বোর্ডে বেস্ট কেয়ার নার্সিং হোম কথাটা লেখা না থাকলে বোঝাই যেত না এটা একটা চিকিৎসালয়। একতলায় গরিব মুসলমানদের জন্যে রুটি মাংসের দোকান। দোকানের সামনেই উনুন, মরা আঁচে বিফ কারি সুসিদ্ধ হচ্ছে। তার এক পাশে ওপরে ওঠার সিঁড়ি। দোতলা-তিনতলা মিলিয়ে নার্সিং হোম। আদিত্য কেয়াকে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে যাচ্ছিল, পাহারাদার পুলিশ কনসটেবলটি পথ আটকাল ।

‘কোথায় যাবেন ?

‘ওপরে। নার্সিং হোমে।’

‘কী দরকার?’

‘আমাদের রুগি ভর্তি আছে।’

‘কত নম্বর ঘরে? কী নাম?’

‘ঘরের নম্বর তো জানি না। রুগির নাম জয় তরফদার।’

‘জয় তরফদার?’ পাহারওলাকে রীতিমত সন্দিগ্ধ দেখাল। ‘যাবার পারমিশন নেই।’

‘আমরা রুগির মায়ের সঙ্গে একটু দেখা করব। উনি মনে হয় ওপরেই আছেন।’ এবার কেয়ার ব্যাকুল গলা ।

‘কারও সঙ্গে দেখা করার পারমিশন নেই। ওপরে পুলিশ এনকোয়ারি চলছে।’ পাহারওলা ভারিক্কি গলায় জানাল।

‘যিনি এনকোয়ারি করছেন তাকে একটু বলবেন আদিত্য মজুমদার এসেছে। আপনাদের ওসির কাছে আমার নামটা বলা আছে।’

‘অপেক্ষা করতে হবে। মেজবাবু ওপরে আছেন। নিচে নামলে তাকে বলবেন।’ ‘মহা মুস্কিল হল দেখছি। এ তো কিছুতেই ওপরে উঠতে দেবে না।’ আদিত্য বিড়বিড় করে কেয়াকে বলল।

‘আশ্চর্য! তোমার নাম শুনেও উঠতে দিল না?’ কেয়া যুগপৎ হতাশ ও ক্রুদ্ধ। ‘বুঝলে না, রবীন্দ্রনাথের কবিতার মত আমার নামটা। গেলেও বিচিত্র পথে হয় নাই সে সর্বত্রগামী।’ আদিত্য মুচকি হেসে বলল। ‘মনে হচ্ছে, একটা ফোন করতে হবে। গৌতম এখানকার ওসির নম্বরটা ফরোয়ার্ড করে দিয়েছিল।’

মিনিট পাঁচেক ফোনাফুনির পর দেখা গেল পুলিশের ইউনিফর্ম পরা এক স্ফীতোদর মাঝ-বয়সী ব্যক্তি ঈষৎ হন্তদন্ত হয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছে। নির্ঘাৎ মেজবাবু। আরও মিনিট দশেক পরে যখন দোতলার একটা ঘরে জয় তরফদারকে জায়গা দেওয়া হয়েছে এবং বাইরে বারান্দার এক পাশে সরে গিয়ে তার মা কেয়াকে ফিসফিস করে কীসব বলছে তখন মেজবাবু শশীধর মিশ্র আদিত্যকে বলল, ‘কেসটা কিন্তু ধামা-চাপা দেওয়া যাবে না স্যার। ব্যাপারটা সিরিয়াস।’

শশীধর অবাঙালি হলেও মোটামুটি পরিষ্কার বাংলা বলে।

‘ধামা-চাপা দেবার প্রশ্নই ওঠে না। আমরা শুধু চাইছিলাম ছেলেটার যেন ঠিক মতো চিকিৎসা হয়। ছেলেটা বেঁচে গেলে তো পুলিশেরও লাভ। ও নিশ্চয় কিছু ইনফরমেশন দিতে পারবে।’

‘ডাক্তার বলছে ছেলেটা বেঁচে যাবে। তবে ডাক্তার এটাও বলল কিছু ড্রাগ আছে যেগুলো থেকে বেশ ভাল মতন মেমরি লস বা ডিমেনশিয়া হতে পারে। ছেলেটা কী ধরনের ড্রাগ নিত আমরা এখনও জানি না। তাই ছেলেটা সুস্থ হয়ে উঠলেও কতটা বলতে পারবে সন্দেহ আছে। তাছাড়া সম্ভবত দলের কথা ও বলতে চাইবে না। ড্রাগ পেডলার হিসেবে পুলিশের খাতায় ওর নাম আছে। আগেও ওকে আমরা ধরেছি, কিন্তু খুব বেশি কথা ওর থেকে বার করতে পারিনি।

‘আপনাদের এদিকে কি ইদানীং কোনও ড্রাগ-পেডলারের দল বেশি করে অ্যাকটিভ হয়েছে ?’

এই অঞ্চলে ড্রাগের সমস্যাটা বরাবরই ছিল। এখানে কয়েকটা অরগানাইজগ্ধডগ্ধ গ্যাং আছে। এরাই ড্রাগ পেডলিং করে। এলাকা দখল নিয়ে খুন-জখম মারামারি লেগেই থাকত। কিন্তু ইদানীং মনে হচ্ছে খুন-জখম, মারামারি কম। যেন খুব হারমোনিয়াসলি ওপর থেকে কেউ ড্রাগ ব্যবসাটা চালাচ্ছে। এই লোকাল দলগুলো মনে হচ্ছে তাদের সাব-এজেন্ট হয়ে গেছে। ফলে একদিকে যেমন মারামারি কমেছে, তেমনি আবার অন্যদিকে ড্রাগ পেডলিং-এর সমস্যাটা বেড়েছে। এটা শুধু এই অঞ্চলে নয়, সারা কলকাতায়। এই নিয়ে কিছুদিন আগে লালবাজারে একটা বড় মিটিং হয়েছিল। বিভিন্ন থানা থেকে রেপ্রেসেন্টেটিভ গিয়েছিল। আমরাও গিয়েছিলাম। পুলিশ এখনও ওই বড় গ্যাংটার ব্যাপারে কোনও ব্লু পায়নি।’

‘আপনি একবার এই জয় তরফদারের বাড়িতে নিশ্চয় যাবেন ?

‘সে তো যেতেই হবে। হয়ত ওর ঘরে এখনও কিছু ড্রাগ মজুত আছে। সেটা বার করতে হবে তো।’

‘আপনি যখন ওখানে যাবেন, আমাকে একটা খবর দেবেন? আমি আপনার সঙ্গে যেতে চাই। চিন্তা করবেন না। আপনার সঙ্গে যাবার পারমিশান আমি ওপরতলা থেকে জোগাড় করে নেব।’

‘ঠিক আছে স্যার। ওপরওলা পারমিশান দিলে আমি বলার কে?’

অমলা তরফদারকে নিয়ে কেয়া এগিয়ে আসছে। আদিত্য এই প্রথম অমলা তরফদারকে ভাল করে দেখার সুযোগ পেল। সাদামাটা চেহারা, পঞ্চাশ পেরিয়েছে। শাড়ি-জামায় ছিরি-ছাঁদ নেই, পায়ে রবারের চটি। হয়ত তাড়াহুড়োতে বাড়িতে যেটা পরে ছিল সেটা পরেই বেরিয়ে এসেছে।

‘আপনাকে দু-একটা প্রশ্ন করতাম। এখন করা যাবে?” অমলা তরফদার আরও এগিয়ে আসতে আদিত্য বলল।

‘বলুন কী বলবেন?” অমলাদির ভ্রুকুঞ্চিত মুখে কিছু উৎকণ্ঠা রয়েছে।

‘কেয়া বলল, আপনার ছেলে জয় মাধ্যমিকের পর পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছিল। সেটা কতদিন আগে হবে?’

‘জয় তিন বছর আগে একবার মাধ্যমিক দিয়েছিল। পাশ করতে পারেনি। কী বলব, আমার কপাল।’

‘তারপর এই তিন বছর কী করছিল?’

‘প্রথম দু-বছর কিছুই করত না। এই এক বছর হল একটা কারখানায় কাজ পেয়েছে। আমাদের বাড়ির কাছেই একটা ছোটখাট কারখানায়।’

‘আপনি জানতেন আপনার ছেলে ড্রাগ-অ্যাডিক্ট?’

অমলাদি উত্তর দিচ্ছে না। মাথা নিচু করে আছে।

আদিত্য আবার জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি জানতেন আপনার ছেলে ড্রাগ-অ্যাডিক্ট?’ ‘একদিনে জানতে পারিনি। একটু একটু করে জেনেছি।’

‘আপনার ছেলে যাদের সঙ্গে মিশত আপনি তাদের চিনতেন?’

‘পুলিশ আমাকে এই প্রশ্নটাই বারবার করে যাচ্ছে। ওদের যেটা বলেছি, আপনাকে সেটাই বলছি। আমার ছেলের যে বন্ধুদের আমি চিনতাম তারা ওর ছোটবেলার বন্ধু।

তারা ছোটবেলায় আমাদের বাড়িতে খুবই আসত। আজকাল আর আসে না। কেনই বা আসবে? ওরা সকলেই এখন কলেজ-টলেজে পড়ে। আমার ছেলে তো লেখাপড়াই করে না। ওরা আমার ছেলের সঙ্গে সম্পর্ক রাখবে কেন? এখন আমার ছেলে কাদের সঙ্গে মেশে আমি কিছুই জানি না।’

‘আজ আপনার ছেলে কি বাইরে বেরিয়েছিল? নাকি বাড়িতেই ছিল?’

‘সকাল থেকে বাড়িতেই তো ছিল। নিজের ঘরেই ছিল। আড়াইটে নাগাদ ওর ঘরের দরজা ভেঙে ঢুকে দেখি এই অবস্থা।’

‘দুপুরে ও কী খেয়েছিল?’

‘আমি আর জয় একসঙ্গে বসে দুপুরের খাওয়া খেয়েছিলাম। ভাত, ডাল, তরকারি, ডিমের ঝোল।’

‘আর সকালে?’

‘সকালে জয় পাঁউরুটি খেয়েছিল। আর ঘুগনি। আমাদের বাড়ির নিচে একটা চায়ের দোকান আছে, ওখান থেকে আনিয়ে নিয়েছিল। আমি মুড়ি খেয়েছিলাম। জয় মুড়ি খেতে পারত না। দু’বেলা জলখাবারে পাঁউরুটি খেত।’ বলতে বলতে অমলা তরফদার কান্নায় ভেঙে পড়ল।

তাকে দেখে আদিত্যর সত্যিই খারাপ লাগছিল।

(২)

খুব ছোটবেলায় প্রত্যেক পয়লা বৈশাখের দিন আদিত্য নতুন জামা পরে মায়ের সঙ্গে মামার বাড়ি যেত। রাত্তিরে বাবা গিয়ে আদিত্যদের নিয়ে আসত। রাত্তিরের খাওয়াটা হত মামার বাড়িতে। আদিত্যর যতদূর মনে পড়ে বাবাকে বাটি ঘুরিয়ে খেতে দেওয়া হত। অন্তত সাত-আটটা বাটি, অর্থাৎ সাত-আটটা পদ। উত্তর কলকাতার বনেদি বাড়িতে জামাই এলে ওই রকম খেতে দেওয়াই ছিল রীতি। আর একটা কারণ বোধহয় ছিল। আদিত্যর মামার বাড়িতে জামাই ষষ্ঠী হতো না। বাবা অবশ্য তাতে খুশিই ছিল। বাবা বলত, জামাই ষষ্ঠীর নামে জামাই পুজোর এই ব্যাপারটা অতি জঘন্য। আদিত্যর দাদু-দিদা তখনও বেঁচে। হয়ত তাঁরা জামাই ষষ্টীর খাওয়াটা জামাইকে পয়লা বৈশাখে খাইয়ে দিতেন। এই দিনটা ছাড়া বাবাকে খুব একটা শ্বশুর বাড়ি যেতে দেখেনি আদিত্য। বিশেষ কোনও উপলক্ষ থাকলে অবশ্য আলাদা কথা।

মা চলে যাবার পর আদিত্যর মামার বাড়ি যাওয়া খুব কমে গেল। অন্তত পয়লা বৈশাখের দিনটা আর যাওয়া হতো না। তার বদলে সে আর বাবা পয়লা বৈশাখে সারাদিন গান শুনত। কী কী গান শোনা হবে বাবা আগে থেকে বেছে রাখত। হয়ত সারা সকাল নানারকম বিলাওল শোনা হল, আলাইয়া, দেবগিরি, ইমনি, শুক্ল। কিংবা সারং, বৃন্দাবনী, গৌড়, শুদ্ধ। আবার কখনও কখনও সারাদিন রবীন্দ্রনাথের গান, রাজেশ্বরী দত্ত, কনক দাস, মালতী ঘোষাল, অমিয়া ঠাকুর, অমিতা সেন থেকে শুরু করে জর্জ বিশ্বাস, কণিকা-সুচিত্রা-শান্তিদেব। খুব নতুনদের গলায় রবীন্দ্রসঙ্গীত বাবা পছন্দ করত না। বলত, আজকালকার ছেলেমেয়েদের গলায় জোয়ারি নেই, শুনব কেন? পয়লা বৈশাখের দিন গান শোনার অভ্যেসটা আদিত্যর এখনও রয়ে গেছে।

আজ আবার পয়লা বৈশাখ ফিরে এসেছে। সকাল থেকে কেয়া রান্নাঘরে। সুভদ্র একটু পরেই এসে পড়বে। দুপুরে এখানে তার নেমন্তন্ন। আদিত্য গান শুনতে শুনতে রূপলেখা দত্ত বা বলা উচিত রূপলেখা দত্ত পরিচয় দিয়ে যে মহিলা অশনি রায়ের সঙ্গে ভাব জমিয়েছিল, তার কথা ভাবছিল। এবং দুটো খুনের কথাও। অশনি রায়ের কথা যদি সত্যি বলে ধরে নেওয়া হয় তাহলে অনেকগুলো প্রশ্ন ওঠে যার আপাতগ্রাহ্য কোনও উত্তর নেই। প্রশ্নগুলো একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে-মড়িয়ে একটা জগাখিচুড়ি পাকিয়ে আছে। জটটা খুব সাবধানে একটু একটু করে ছাড়াতে হবে। প্রথম প্রশ্ন, যদি পুরো ব্যাপারটা অশনি রায়কে ফাঁসাবার একটা চক্রান্ত হয়ে থাকে, তাহলে জানতে হবে অশনি রায় কার পাকা ধানে মই দিয়েছিল যে তার বিরুদ্ধে ওইরকম একটা জঘন্য চক্রান্ত করা হল? যদি আপাতত ধরে নেওয়া হয় অশনি রায়কে ফাঁসানোটা কারও পক্ষে দরকার হয়ে পড়েছিল, তাহলেও প্রশ্ন থেকে যায় ফাঁসানোটা কি অন্যভাবে করা যেত না? তার জন্যে দু-দুটো খুন করার ঝুঁকি নিতে হল? কিংবা হয়ত খুন করাটাই আসল উদ্দেশ্য ছিল, কিন্তু অশনি রায় প্রেক্ষাপটে না থাকলে সরাসরি খুনির ওপর সন্দেহ পড়ত। হয়ত, সেই সন্দেহটা সরানোর জন্যে অশনি রায়কে বলির পাঁঠা করা হয়েছে। সেক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠবে, ওই দম্পতি খুন হবার ফলে কার লাভ হল? কার ওপর স্বাভাবিকভাবে সন্দেহ পড়তে পারত? আরও দু-একটা প্রশ্ন। বলির পাঁঠা হিসেবে অশনিকেই বা বেছে নেওয়া হল কেন? এটা কি নিছক কাকতালীয়, নাকি এর পেছনে অন্য কোনও কারণ ছিল? আরও প্রশ্ন, নকল রূপলেখা দত্ত এখন কোথায়? সে কি বেঁচে আছে? বনানী দাসের ব্যাপারটাও ভাবতে হবে। সে-ই কি তবে অশনিকে জেলে পাঠানোর জন্য দু-দুটো নিরীহ মানুষকে মেরে ফেলল? বিশ্বাস করা শক্ত। তবে মানুষের চরিত্র যে কত বিচিত্র হতে পারে সেটা আদিত্য তার অভিজ্ঞতা থেকে জানে।

‘কিশোরী আমোনকর বিভাস গাইছিলেন। হঠাৎ পঞ্চম থেকে কোমল ঋষভের সিঁড়ি বেয়ে এমন করে ষড়জে এসে নামলেন যে আদিত্য বেশ কিছুক্ষণ রূপলেখা দত্ত, মৃত্তিকা মিত্র, পার্থ মিত্র, অশনি রায়, জোড়া খুন, বনানী সব ভুলে গিয়ে উদাস হয়ে জানলার বাইরে তাকিয়ে রইল। অবশ্য জানলা দিয়ে সে কিছু দেখছিল না, শুধু শূন্য দৃষ্টিতে বাইরে তাকিয়েই ছিল, আর তার মাথার মধ্যে বিভাসের পাঁচটা সুর খেলা করছিল। আদিত্যর হঠাৎ মনে পড়ল কোথায় যেন পড়েছিল, বিভাস রাগটা কিশোরী আমোনকরের এতটাই পছন্দ যে তিনি তাঁর বড় ছেলের নাম রেখেছিলেন বিভাস ।

কলিং বেল বাজছে। নিশ্চয় সুভদ্র এসে গেছে।

‘তোমার তো আজকাল দেখাই পাওয়া যায় না। আগে মাঝে মাঝে ফোন করে চলে আসতে। আজকাল ফোনও কর না, আসও না।’ চায়ের কাপ টেবিলে রেখে কেয়া বলল। আসলে সুভদ্র মাজির চরিত্রে একটা আশ্চর্য স্নিগ্ধতা আছে। কে বলবে পুলিশ অফিসার? তার সঙ্গে নানারকম আবোলতাবোল গল্প করলে কেয়া এবং আদিত্য দুজনেরই মনটা হালকা হয়ে যায়।

‘হালে কাজের চাপটা খুব বেড়েছে বৌদি। অ্যাডিশানাল কমিশানার সাহেব একটা বড় কাজের দায়িত্ব দিয়েছেন। সেটা সামলাতে গিয়ে হিমসিম খেয়ে যাচ্ছি।’

‘বড় কাজের দায়িত্ব পাওয়াটা তো ভাল কথা।’ আদিত্য চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল।

‘কাজটা বেশ কঠিন দাদা। আপনার সাহায্য ছাড়া হবে না। আমি ভেবেই এসেছি আপনার কাছে পরামর্শ চাইব। তার আগে এই অশনি রায়ের কেসটা বলে নিই।’‘এই রে, মাংসটা বোধহয় ধরে গেল। কী রকম যেন গন্ধ বেরোচ্ছে না?’ প্রশ্নের উত্তর শোনার জন্য অপেক্ষা না করেই কেয়া তীর বেগে ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে ।

আদিত্য খাতা বার করেছে। কলম। এই কলমটা তার পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া। পুরোনো পেলিক্যান। কালির পেন। এটা নিয়ে সে বাইরে বেরোয় না। যে পেনটা নিয়ে বাইরে বেরোয় সেটাও অবশ্য কালির। আদিত্য এখনও কালির পেনেই লেখে। পুরোনো অনেক কিছুর মতো এই কালির পেনে লেখার অভ্যেসটাও সে ছাড়তে পারেনি।

‘অশনি রায়ের কেসটা একেবারে প্রথম থেকে শুনতে চাই। মানে, তুমি যেটুকু জান।’

‘কেসটা প্রাথমিকভাবে ইনভেসটিগেট করার দায়িত্ব আমার ওপর পড়েছিল। আমি তখন লেক টাউন থানায় পোস্টেড। আগের রাত্তিরে নাইট ডিউটি ছিল। পরের দিন সকাল আটটা নাগাদ বাড়ি ফেরার তোড়জোড় করছি, এমন সময় ফোন এল বাঙ্গুরের একটা ফ্ল্যাটবাড়িতে স্বামী-স্ত্রী দুজনে খুন হয়েছে। বড়বাবু আমাকেই যেতে বললেন, যাবার মতো তখন আর কেউ থানায় ছিল না। গিয়ে দেখি ভয়ঙ্কর কাণ্ড। চারতলার একটা ফ্ল্যাটে শোবার ঘরে স্বামী-স্ত্রী খুন হয়ে পড়ে রয়েছে। মেঝেটা রক্তে ভেসে যাচ্ছে।’

‘খুনগুলো কে আবিষ্কার করল?’

‘কাজের মাসি। কর্তা গিন্নি দেরি করে ঘুম থেকে ওঠে বলে কাজের মাসির কাছে চাবি দেওয়া থাকত। ভোরবেলা মাসি ফ্ল্যাটে ঢুকে দ্যাখে কর্তা গিন্নি মরে পড়ে আছে । সে তখন সিকিউরিটিকে খবর দেয়। বাড়িটাতে তখনও খুব বেশি লোক আসেনি। চারতলার অন্য দুটো ফ্ল্যাট প্রায় ফাঁকা। দোতলায় মাত্র একঘর বাসিন্দা ।’

‘কীভাবে হয়েছিল খুনগুলো? মানে, কী দিয়ে মারা হয়েছিল দুজনকে?’

‘আশ্চর্য ব্যাপার, দু’জনকে দু’ভাবে মারা হয়েছিল। মাথায় ভারী কিছু দিয়ে আঘাত করে স্ত্রীকে খুন করা হয়েছিল। আর স্বামীকে মারা হয়েছিল গুলি করে। স্ত্রীর মাথায় একটাই আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গিয়েছিল। তাতেই মৃত্যু। হয় পেশাদার কেউ খুনটা করেছিল যে জানে মানুষকে একটা আঘাতে মেরে ফেলতে হলে ঠিক কোথায় আঘাত করতে হয়। আর তা না হলে আঘাতটা দুর্ঘটনাক্রমে এমন আলটপকা জায়গায় পড়েছিল যে মহিলার সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু হয়েছে।’

‘আর অন্য খুনটা?’

‘সেখানেও কিন্তু একটা প্রফেশানাল ফিনিশ ছিল। একটাই গুলি বুকের বাঁ দিক দিয়ে ঢুকে হার্ট ভেদ করে চলে গিয়েছিল।’

‘বন্দুকটা পাওয়া গিয়েছিল?’

‘হ্যাঁ। নাইন এম এম চিনে পিস্তল। আজকাল কালোবাজারে প্রচুর পাওয়া যায়। লাসের পাশে মেঝের ওপর পড়েছিল।’

“ওটা কি চোরাই পিস্তলই ছিল।’

‘তাই তো মনে হয়। বাড়ি থেকে কোনও পিস্তলের লাইসেন্স খুঁজে পাওয়া যায়নি। অশনি রায়ও বলেছিল তার কোনও বন্দুক-পিস্তলের লাইসেন্স নেই ।

‘কারও ফিঙ্গারপ্রিন্ট ছিল পিস্তলের ওপর?

‘ছিল। অশনি রায়ের হালকা ফিঙ্গারপ্রিন্ট পিস্তলের ওপর পাওয়া গিয়েছিল।’ সুভদ্র একটু ইতস্তত করে বলল। ‘কিন্তু ফিঙ্গারপ্রিন্টটা এত হালকা কেন বোঝা যায়নি।’ ‘দ্যাখো, অশনি রায় আমাকে বলেছে, সেই রাত্তিরে ওই বাড়িটাতে ঢোকার পর ক্লোরোফর্ম দিয়ে কেউ তাকে কিছুক্ষণের জন্য অজ্ঞান করে দিয়েছিল। এমন তো হতে পারে সেই সময় খুনী পিস্তলটা নিয়ে এসে অশনির হাতে মুঠো করে ধরিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু যেহেতু অশনি তখন অজ্ঞান হয়ে ছিল, পিস্তলটা খুব শক্ত করে তার হাতে ধরানো যায়নি। তাই ফিঙ্গারপ্রিন্টটা হাল্কা পড়েছিল। এটা তো হতেও পারে, তাই না?’

‘ঠিক এই যুক্তিটাই অশনি রায়ের লইয়ার ব্যারিস্টার অরুণকান্তি ব্যানার্জী দিয়েছিলেন। এটা হওয়া অসম্ভব নয়, তবে এটাই যে হয়েছিল সেকথাও জোর দিয়ে বলা যাবে না। অন্তত ফিঙ্গারপ্রিন্ট এক্সপার্টদের তাই মত।’

‘আচ্ছা, আর ওই মহিলাকে যেটা দিয়ে আঘাত করা হয়েছিল সেটা পাওয়া গিয়েছিল ?’

‘মহিলাকে সম্ভবত একটা সরু, লম্বা কাঁচের ফুলদানি দিয়ে মাথায় মারা হয়েছিল। ফুলদানিটা টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে মাটিতে পড়েছিল। ভাঙা কাঁচে আমরা রক্তের চিহ্ন পেয়েছিলাম। রক্তটা মহিলার। ওর জোড়া আর একটা ফুলদানি ক্যাবিনেটের ওপর ছিল। সেটা দেখে মারণাস্ত্রর চেহারাটা আন্দাজ করা গিয়েছিল।’

‘খুন হওয়া পুরুষ এবং মহিলা সম্বন্ধে পুলিশ কতটুকু জানতে পেরেছিল?’

‘প্রাথমিক তদন্তটা তো আমিই করেছিলাম। আমি যেটুকু জানতে পেরেছিলাম সেটা বলছি।’ সুভদ্র মাজি বুকপকেট থেকে একটা নোটবুক বার করল। ‘যাঁরা খুন হয়েছিলেন তাঁরা ওই ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকতেন, বাড়ির মালিক অন্য লোক। খুন হওয়া পুরুষের নাম পার্থ মিত্র, মহিলার নাম মৃত্তিকা মিত্র। খুন হবার বছর খানেক আগে তাঁরা ওই ফ্ল্যাটে এসেছিলেন। ফ্ল্যাটবাড়িটা তখনও ভাল করে তৈরি হয়নি। এর আগে ওরা বেলেঘাটায় যে বাড়িটাতে থাকতেন সেখানে বাড়িওলা ওদের বাড়ি ছেড়ে দেবার জন্যে খুব তাগাদা লাগাচ্ছিল। তাই তাড়াহুড়ো করে অর্ধেক তৈরি হওয়া এই ফ্ল্যাটটাতে ওদের এসে উঠতে হয়েছিল।’

এই ফ্ল্যাটটার মালিক কে?’

সুভদ্র তার নোটবই-এর দিকে তাকাল। পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে এক জায়গায় থেমে গেল। বলল, “ওই ফ্ল্যাটটি পল্লব সেন বলে এক ভদ্রলোকের। সেন বেকারির মালিক। এক সময় এদের অনেকগুলো বেকারি ছিল। পাঁউরুটি, কেক এইসব তৈরি হত। কলকাতায় বেশ বড় ব্যবসা ছিল এদের। মফস্বলেও ভাল বিক্রি হতো। ওদের কেক-রুটি-বিস্কুট কিন্তু এখন আর তেমন চলে না।”

‘সেন বেকারির কথা জানি। ছোটবেলায় আমাদের বাড়িতে সেন বেকারির আনস্লাইড্ পাঁউরুটি আসত। মাখনের মত নরম। তার স্বাদ এখনও মুখে লেগে আছে। এখন আর ওই রুটি দেখতে পাই না।’

‘আমি তো মফস্বলে বড় হয়েছি। আমাদের মেদিনীপুরেও কিন্তু সেন বেকারির কেক-বিস্কুট বেশ ভাল চলত। এখনও দু-একটা দোকানে পাওয়া যায়।’

‘তা এই পল্লব সেনের সঙ্গে মৃত্তিকা মিত্রদের আলাপ হল কী করে?’ ‘আমি খোঁজ নিয়েছিলাম। মৃত্তিকা মিত্রর স্বামী পার্থ মিত্রর একটা ডিসট্রিবিউটার কম্পানি ছিল। দোকানে দোকানে কেক-পাঁউরুটি-বিস্কুট এইসব ডিসট্রিবিউট করত। বেশ কিছুদিন ধরে সেন বেকারির সোল ডিসট্রিবিউটার ছিল অন্য একটা কম্পানি। কিছুদিন আগে সেই আগের কম্পানিটার সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করে পার্থ মিত্রর কম্পানিকে সেন বেকারির সোল ডিস্ট্রিবিউটার করা হয়েছিল। যখন ঘটনাটা ঘটে সেই সময় পার্থর কম্পানিই সেন বেকারির জিনিসপত্র শহরের এবং মফস্বলের দোকানগুলোতে পৌঁছে দিচ্ছিল। সেই সূত্রে পার্থ মিত্রর সঙ্গে সেন বেকারির যোগাযোগ। কলকাতায় সেনদের একাধিক বাড়ি আছে। এই ফ্ল্যাটটা এবং তার পাশের দুটো ফ্ল্যাট তারা কোনও এক সময় কিনেছিল। একটা ফ্ল্যাটে সেন বেকারি পার্থ মিত্র এবং তার স্ত্রীকে থাকতে দিয়েছিল। পাশের ফ্ল্যাট দুটো গোডাউন হিসেবে ব্যবহার করা হতো। তবে যখন ঘটনাটা ঘটে তখন বাড়িটা পুরো তৈরি হয়নি। তাই অন্য তলাগুলো প্রায় ফাঁকাই ছিল।’ ‘পল্লব সেন ছাড়া সেন বেকারির আর কোনও মালিক নেই? এটা অবশ্য আমি নিছক কৌতূহলবশত জিজ্ঞেস করছি। আসলে সেন বেকারির ব্যাপারে আমার একটা নস্টালজিয়া আছে।’

সুভদ্র আবার তার নোটবই-এর দিকে তাকাল। বলল, ‘বছর আটেক আগে পল্লব সেনের দাদা সৌরভ সেন একটা দুর্ঘটনায় মারা যান। সেই থেকে সৌরভের স্ত্রী মালবিকা সেন সেন বেকারির অর্ধেক মালিক, বাকি অর্ধেকের মালিক পল্লব সেন।’

আদিত্য মনে মনে সুভদ্র মাজির কাজের প্রশংসা না করে পারল না। ছেলেটা সব প্রশ্নেরই উত্তর খোঁজার চেষ্টা করে। আদিত্য আবার একটা কিছু জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল, কেয়া ঘরে ঢুকেছে। মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম।

“আমার কিন্তু এখনও ঘন্টা খানেক লাগবে। তোমরা চা খাবে?’

‘বৌদি এত কষ্ট করে রান্না করছেন, আমার কিন্তু ভীষণ লজ্জা করছে।’ সুভদ্রর গলাটা আন্তরিক শোনাল।

‘যা লজ্জা করার এখন করে নাও। খেতে বসে কোনও লজ্জা করা চলবে না। তোমার দাদার সঙ্গে কথা বল, আমি চা নিয়ে আসছি।’ কেয়া ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

আদিত্য দেখল ঘড়িতে বারোটা পঁচিশ। তেমন কিছু বেলা হয়নি। এক কাপ চা খাওয়া যেতেই পারে।

একটু পরে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে আদিত্য জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা, অশনির বিরুদ্ধে কেসটা পুলিশ ঠিক কী ভাবে সাজিয়েছিল তোমার মনে আছে? মানে, কী কী প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল অশনির বিরুদ্ধে?’

সুভদ্র মাজি একটু ভাবার সময় নিল। কয়েকবার নোটবই-এর পাতা খুলে দেখল। তারপর বলল, ‘প্রথমত, রাজারহাটের যে ক্যাফেটাতে অশনি তার বান্ধবীকে নিয়ে যেত তার ওয়েটার মেয়েটি অশনি এবং মৃত্তিকা দুজনকেই শনাক্ত করেছে।’

‘যে মৃত্তিকা খুন হয়েছে তাকে?’

‘হ্যাঁ, তাকে। তার অনেকগুলো ছবি আমরা ওই ফ্ল্যাটটাতে পেয়েছিলাম। সেটাই ওয়েটার মেয়েটিকে দেখানো হয়েছিল।’

‘ক্যাফেতে আর কোনও কর্মচারি থাকত না?’

‘না। নির্জন জায়গায় ছোট্ট ক্যাফে। ওই মেয়েটিই খাবার দিত আবার ওই মেয়েটিই ক্যাশে বসত। মালিক কালেভদ্রে আসত। এছাড়া একজন কুক ছিল, সে রান্নাঘর থেকে বেরোতোই না।’

‘তারপর? পরের প্রমাণ? ‘

‘পরের প্রমাণ মোবাইলের কল লিস্ট। মৃত্তিকা মিত্রর বাড়ি থেকে একটা মোবাইল পাওয়া গিয়েছিল যেটা থেকে অসংখ্যবার অশনিকে ফোন করা হয়েছিল। দু’জনের মধ্যে বেশ কিছু হোয়াটস্ অ্যাপ মেসেজও বিনিময় হয়েছিল যেগুলো পুলিশের হাতে এসেছে। তাছাড়া খুনের রাত্তিরে অশনি যে ওই ফ্ল্যাটে ঢুকেছিল এবং ঘন্টা খানেক পরে বেরিয়ে এসেছিল সেটা সিসি টিভিতে যেমন ধরা পড়েছে তেমনি বাড়ির সিকিউরিটি ছেলেটাও সেটা দেখেছে।’

‘এই মোবাইলটা কি ডেডবডির পাশেই পাওয়া গিয়েছিল?’

‘যে মোবাইলে অশনির সঙ্গে চ্যাটগুলো ছিল এবং যেটা থেকে সাধারণত অশনির নম্বরে কল করা হতো সেটা কিন্তু ডেডবডির পাশে পাওয়া যায়নি। কিছুদিন পরে পুলিশ সেটা বাড়ির মধ্যেই একটা লুকোনো জায়গায় খুঁজে পায়। হয়ত চ্যাটগুলো ছিল বলেই মোবাইলটা লুকোনো ছিল। কিংবা হয়ত মৃত্তিকা চায়নি তার স্বামী জানুক যে অশনি রায়ের নম্বরটা তার মোবাইলে সেভ করা আছে। আরও দুটো মোবাইল মৃতদেহগুলোর পাশে পাওয়া গিয়েছিল। একটা পার্থ মিত্রর নামে রেজিস্টার্ড। অন্যটা মৃত্তিকর মিত্রর নামে। মৃত্তিকার এই মোবাইলটায় কিন্তু অশনির সঙ্গে কোনও চ্যাট ছিল না। তবে এই মোবাইলটা থেকেও অশনির নম্বরে কয়েকবার ফোন করা হয়েছিল।’ ‘যে মোবাইলে মেসেজগুলো পাওয়া গেয়েছিল সেটার সিমকার্ডটা কার নামে?’ ‘সেটাই বেশ অদ্ভূত। এই লুকোনো মোবাইলটা ছিল রূপলেখা দত্ত বলে একজনের নামে। সিমকার্ডের ঠিকানাটা অবশ্য ভুয়ো।’

‘তার মানে মৃত্তিকা মিত্র রূপলেখা দত্ত সেজে একটা ভুয়ো ঠিকানাযুক্ত মোবাইল থেকে অশনিকে ফোন করত। তার আসল পরিচয় সে অশনিকে জানাতে চায়নি।’

‘আপাতদৃষ্টিতে সেটাই তো মনে হচ্ছে।’

‘পুলিশ কি বলছে দুটো খুনই অশনি করেছে?’

‘না। পুলিশ বলছে, অশনির সামনে মৃত্তিকার সঙ্গে তার স্বামী পার্থ মিত্রর সম্ভবত কথা কাটাকাটি হয়েছিল। নিশ্চয় সেটা অশনির সঙ্গে মৃত্তিকার সম্পর্ক নিয়ে। রাগের মাথায় পার্থ ফুলদানিটা তুলে মৃত্তিকার মাথায় মারে এবং তাতেই মৃত্তিকার মৃত্যু হয়। এর ফলে অশনি পকেট থেকে পিস্তল বার করে পার্থর দিকে গুলি চালায় এবং পার্থ মারা যায়।’

‘পুলিশের গল্পটা তো টাইট শোনাচ্ছে। তোমার তাহলে কেন মনে হল অশনি রায় খুনটা করেনি?’

‘বলতে পারেন, প্রমাণগুলো এত নিশ্ছিদ্র বলেই সন্দেহ হল। এত প্রমাণ রেখে কেউ খুন করে নাকি? অশনিকে খুব মাথা গরম লোক বলেও মনে হয় না। তাছাড়া যে আঘাতে মৃত্তিকা মিত্র মারা যায় সেটা এত প্রিসাইজ যে একজন পেশাদারই ওরকম আঘাত করতে পারে। পার্থ মিত্রর কি সেরকম ট্রেনিং ছিল? তাছাড়া গুলিটাও প্রফেশানাল হাতের কাজ। অশনি কখনও আদৌ বন্দুক চালাতে শিখেছিল, এমন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। সব মিলিয়ে মনে হল, কেউ অশনিকে ফাঁসাবার চেষ্টা করছে না তো? এইসব নিয়ে আমি যেই প্রশ্ন করতে শুরু করলাম অমনি আমাকে কেসটা থেকে সরিয়ে দেওয়া হল। ফলে আমার সন্দেহ আরও গাঢ় হল।’

‘ব্যারিস্টার ব্যানার্জী কি এই কথাগুলোই কোর্টে বলে অশনি রায়কে বেকসুর খালাস করিয়েছিলেন?”

‘আমার সঙ্গে বেশ কয়েকবার ব্যারিস্টার ব্যানার্জীর কথা হয়েছিল। সবই ইনফর্মালি কারণ আমি তার বেশ কিছুদিন আগে কেসটা থেকে সরে গেছি। আমার কতকগুলো কথা উনি ওঁর মতো করে কোর্টে বলেছিলেন। তাছাড়া একটা নতুন এভিডেন্স উনি জোগাড় করেছিলেন। ওই ফ্ল্যাটবাড়ির একটা সিসি টিভি ফুটেজে দেখা যাচ্ছিল বাড়ির পেছন দিকের পাঁচিল টপকে কেউ পালাচ্ছে। সময়টা মোটামুটি খুন হওয়ার সময়ের সঙ্গে ম্যাচও করে যাচ্ছে। ব্যারিস্টার ব্যানার্জী কোর্টে প্রমাণ করলেন কেউ যদি বাড়ির পেছন দিকের বারান্দা দিয়ে বেরিয়ে ড্রেনপাইপ বেয়ে নিচে নেমে যায় তাহলে সে সিসি টিভিতে ধরা পড়বে না। তবে পাঁচিল টপকে বাড়ির বাইরে যাবার সময় সিসি টিভিতে তাকে দেখা যাবে। সবার ওপরে ছিল ব্যারিস্টার ব্যানার্জীর অসাধারণ ওরেটরি। ফলে ডিভিশন বেঞ্চ আসামীকে বেকসুর খালাস করে দিল।’

‘মাংসটা কোথা থেকে কিনেছিলে গো?’ কেয়া ঘরে ঢুকেছে।

‘সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ আর গ্রে স্ট্রীটের মোড়ের দোকানটা থেকে। কেন খারাপ মাংস দিয়েছে?’ আদিত্য ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করল।

‘খারাপ কী বলছো, দুর্দান্ত মাংস দিয়েছে। কী তাড়াতাড়ি সেদ্ধ হয়ে গেল। আমি চানে যাচ্ছি। বেরিয়ে খেতে দেব।’ কেয়া আবার ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

গুরুভোজন হয়ে গেল। এতটাই যে, খাবার পরে সুভদ্র বলল, “আজ আর আমার নতুন কাজটার কথা বলছি না আদিত্যদা। এত খাওয়ার পর কথাই বলতে পারছি না। এই চেয়ারে বসে বসেই একটু চোখ দুটো বন্ধ করছি। আমার সমস্যাটা নিয়ে আরেক দিন আসব।’

(৩)

বাঙ্গুর অ্যাভিনিউ-এ একসময় খুব জল জমত। আদিত্যর মনে পড়ে কয়েক বছর আগেও সে খবর কাগজে ছবি দেখেছে একটা অতিবৃষ্টির পর সারা কলকাতা শহরটা যখন শুকনো খটখটে হয়ে আসছে তখনও বাঙ্গুরে নৌকো চলছে। রাস্তাটা বাটির মতো। দক্ষিণে ভি আই পি রোড থেকে ঝাঁপ খেয়ে নিচে নেমে গেছে। তারপর অনেকটা সমতল। শেষে উত্তর-মুড়োয় পৌঁছে রাস্তাটা যশোর রোডে গিয়ে উঠেছে। উত্তর দিকের তুলনায় দক্ষিণের ঢাল বেশি। তাই ভি আই পি-র দিকটায় বেশি জল জমে। ইদানীং অবশ্য সকলে বলছে, এই অঞ্চলে নিকাশি ব্যবস্থার উন্নতি হয়েছে। বৃষ্টিতে জল জমলেও নাকি তাড়াতাড়ি নেমে যাচ্ছে।

যশোর রোডের দিকটা এ-ব্লক, ভি আই পি-র দিকটা বি। আদিত্য যশোর রোডে বাস থেকে নেমে দেখল রাস্তার মোড়ে একটা বাস গুমটি রয়েছে, একটা পুরোনো কালিবাড়ি। সেসব পেরিয়ে কিছুটা হাঁটলে রাস্তাটা ইংরেজি ওয়াই-এর মতো দু’ভাগ হয়ে গেছে। একটা ফলা নির্জন হয়ে ঢুকে গেছে জনবসতির গভীরে। অন্যটা জমজমাট, দোকান-বাজার সমেত এগোতে এগোতে, ভি আই পি রোডে গিয়ে উঠেছে। দুভাগ হবার জায়গা থেকে জমজমাট দ্বিতীয় রাস্তাটা ধরে আরও কিছুটা হাঁটলে বাঁ দিকে পাশাপাশি দুটো বড় ওষুধের দোকান চোখে পড়বে। তার ঠিক উলটো দিকে চারতলা একটা ফ্ল্যাটবাড়ি। এখানেই তিন বছর আগে মৃত্তিকা মিত্র আর তার স্বামী পার্থ মিত্র খুন হয়েছিল। আদিত্য ঠিকানা মিলিয়ে দেখে নিল।

বাড়িটা সদ্য রঙ হয়েছে, বৈশাখের রোদ্দুরে ঝলমল করছে। চারদিকে সাদা পাঁচিল, তার মধ্যিখানে কালো লোহার গেট। নয়নাভিরাম। গেটে নীল ইউনিফর্ম পরা সিকিউরিটি বসে বসে খবর কাগজ পড়ছে। বুড়ো মানুষ। আদিত্যর উপস্থিতি ঠাহর করে মুখ তুলে তাকাল ।

‘কোথায় যাবেন?’ লোকটা জিজ্ঞেস করল।

‘৪০১-এ যাব। কেউ বাড়িতে আছে?’ আদিত্য সাবধানে জিজ্ঞেস করল। মৃত্তিকা মিত্রর ফ্ল্যাটের নম্বরটা আদিত্য জেনে এসেছিল।

‘মেমসাহেব আছেন। কী দরকার?’

‘একটা এসি বসাতে হবে। কোথায় বসবে একটু দেখে যাব। মেমসাহেব জানেন আমি আসব।’ আদিত্য মুখের পেশি বিন্দুমাত্র কুঞ্চিত না করে ডাহা মিথ্যে বলল। ‘ঠিক আছে। যান। ডানদিকে গেলে লিট্।’ লোকটা আবার খবর কাগজে মন দিল।

সিঁড়ির নিচে লেটারবক্সের সারি। লিফটে ওঠার আগে আদিত্য গুনে দেখল সবসুদ্ধু সাতটা লেটারবক্স, প্রতিটির ওপরে ফ্ল্যাটের নম্বর লেখা। তার মানে, ফ্ল্যাটের সংখ্যাও সাত, দোতলায় তিনটে, ২০১ থেকে ২০৩, তিনতলায় তিনটে, ৩০১ থেকে ৩০৩, আর সমস্ত চারতলাটা জুড়ে একটাই ফ্ল্যাট, ৪০১। ৪০১ নম্বর ফ্ল্যাটটা বাদ দিয়ে আর সব কটা লেটারবক্সের ওপরেই অবাঙালি নাম। ৪০১ নম্বর নামাঙ্কিত লেটারবক্সে কোনও ব্যক্তির নাম নেই, শুধু বড় বড় অক্ষরে লেখা সেন বেকারি।

স্বয়ংচালিত লিফ্ট। আদিত্য লিফটে উঠে চার নম্বর বোতামটা টিপল। লিফ্ট চারতলায় পৌঁছতেই মনে মনে নিজের মুখের ওপর একটা কাঠিন্যের আস্তরণ নিয়ে এল আদিত্য। ৪০১ নম্বর ফ্ল্যাটের মেমসাহেবকে বসে আনার জন্যে এটার দরকার হতে পারে।

দু-বার বেল বাজানোর পরেও দরজা খুলছে না দেখে আদিত্য ভাবছিল কী করবে। ঘড়িতে প্রায় সাড়ে এগারোটা বাজে। হয়ত মেমসাহেব স্নানে ঢুকেছেন। আদিত্য যখন তৃতীয়বার বেল বাজানোর জন্যে কলিং বেলে হাত ঠেকিয়েছে ঠিক তখনই দরজাটা খুলে গেল। ফরসা পুতুল-পুতুল একটি মেয়ে, বয়েস বড়জোর তিরিশ পেরিয়েছে। আদিত্যর অনুমান ঠিক। মেয়েটির মাথায় তোয়ালে জড়ানো, চুল থেকে জল ঝরে পড়ছে। আদিত্যর দিকে মেয়েটি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কিছুটা আশঙ্কাও কি রয়েছে সেই দৃষ্টিতে?

‘আমার নাম আদিত্য মজুমদার। আমি মৃত্তিকা মিত্র, পার্থ মিত্রর মার্ডার কেসটা ইনভেস্টিগেট করছি। এই ফ্ল্যাটটা একবার দেখতে চাই।’ আদিত্য ভারিক্কি পুলিশি গলায় বলল যাতে মেয়েটা ধরে নেয় সে পুলিশের লোক। বেসরকারি গোয়েন্দা শুনলে অনেকেই ঢুকতে দেয় না।

মেয়েটা অবাক হয়ে তাকিয়ে রয়েছে। আদিত্য কী বলছে, মনে হয় বুঝতে পারছে না ।

‘আপনি জানেন বোধহয় তিন বছর আগে এই ফ্ল্যাটে দুটো খুন হয়েছিল। আমি সে ব্যাপারে ইনভেস্টিগেট করতে এসেছি।’

‘ও সেই মার্ডার কেসটা।’ মেয়েটা এতক্ষণে বুঝতে পেরেছে। তার গলায় স্পষ্টতই একটা স্বস্তির আভাস। বোধহয় সে অন্য কিছুর ভয় করছিল। ‘কিন্তু সেই কেসটা তো মিটে গেছে। আগে অনেকবার এখানে পুলিশ এসেছিল। আজকাল তো আর আসে না।’ মেয়েটির গলায় একটা সারল্য আছে।

‘কেসটা হাইকোর্টের সিঙ্গল বেঞ্চে মিটেছে, কিন্তু এবার ডিভিশন বেঞ্চে যাবে। তাই আবার ইনভেস্টিগেশন শুরু হয়েছে। হয়ত নতুন কোনও তথ্য পাওয়া যেতে পারে।’

‘ঠিক আছে ভেতরে আসুন।’ মেয়েটি অনিচ্ছুক গলায় বলল। তার গলায় এখন আশঙ্কার বদলে বিরক্তি। ‘আমরা আর কতবার হ্যারাড্ হব?”

‘বেশিক্ষণ আপনাকে বিরক্ত করব না। কিন্তু বুঝতেই পারছেন এটা আমার কাজ, আমাকে করতেই হচ্ছে।’

মেয়েটি আদিত্যকে একজন পুলিশ অফিসার বলে ধরে নিয়েছে।

‘আপনি বসুন, আমি আসছি।’ আদিত্যকে বসবার ঘরে বসিয়ে মেয়েটি বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেল। খুব সম্ভবত পোষাক পাল্টাতে গেল।

বসার ঘরটা খুব বড় নয়। আদিত্য ভেবেছিল আরও অনেক বড় হবে, যেহেতু পুরো তলাটা জুড়ে একটা ফ্ল্যাট করা হয়েছে। একটা সোফা সেট ঘরের সিংহভাগ দখল করে রয়েছে। বাকি জায়গায় একটা ক্যাবিনেট যার নিচের দিকটায় কিছু ব‍ই দুটো আর্থার হেইলি, কয়েকটা সিডনি শেলডন, তার পাশে গীতবিতান, শরৎচন্দ্র। ক্যাবিনেটের ওপরের অংশে দু’একটা ঘর সাজানোর জিনিস, নটরাজ, গণেশ। সোনালি ফ্রেমে বাঁধানো তিনজনের গ্রুপ ফটো, একটি পুরুষ, একটি মহিলা এবং একটি বালিকা। মহিলাটিকে চিনতে অসুবিধে হয় না, ইনিই একটু আগে আদিত্যকে দরজা খুলে দিয়েছেন। আন্দাজ করা যায় পুরুষটি মহিলার স্বামী এবং বালিকাটি এদের কন্যা। ‘আপনাদের এই ফ্ল্যাটটা কি পুরো চারতলাটা জুড়ে?’ গৃহকর্ত্রী ফিরে আসার পর আদিত্য জিজ্ঞেস করল।

‘না, না। আমাদের ফ্ল্যাটটা খুবই ছোট। পুরো তলাটার রাফলি ওয়ান-থার্ড। নিচের ফ্ল্যাটগুলো যেমন। চারতলার বাকি স্পেশটা অফিসের গোডাউন। এই ফ্ল্যাটটা আসলে আমার স্বামীর অফিস থেকে আমাদের থাকতে দিয়েছে।’ ‘তার মানে আপনার স্বামী সেন বেকারিতে চাকরি করেন?’

‘হ্যাঁ, উনি সেন বেকারির ডিসট্রিবিউশান ম্যানেজার।’

‘এই ফ্ল্যাটটাতে কে কে থাকে?”

‘কে আর থাকবে? আমি, আমার মেয়ে আর আমার স্বামী। তবে আমার স্বামী খুব বেশি সময় থাকে না।’

‘কোথায় যান আপনার স্বামী?”

‘ওকে মাসের মধ্যে কুড়ি-পঁচিশ দিন বাইরে বাইরে ঘুরতে হয়। বেশিরভাগটাই পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে। কখনও কখনও পাটনা বা রাঁচিতেও যেতে হয়। মানে, যেখানে যেখানে সেন বেকারির প্রডাক্ট বিক্রি হয় সেখানে সেখানে গিয়ে সুপারভাইজ করতে হয় মালগুলো ঠিকমতো পৌঁছল কিনা। খুব খাটনির কাজ। আমার মেয়ে তো বাবাকে পায়ই না বলতে গেলে।’

‘আপনার মেয়ে এখন কোথায়?’

‘কোথায় আবার? স্কুলে।’ আদিত্যর প্রশ্নে মেয়েটি যেন অবাক হয়েছে। ‘চারটের সময় স্কুল বাসে ফিরবে।’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। সে তো বটেই। এখন তো ইস্কুলেই থাকার কথা।’ আদিত্য একটু অপ্রস্তুতের হাসি হাসল। তারপর বলল, “ম্যাডাম, আপনার নামটাই তো জানা হল না।

‘আমার নাম অনন্যা, অনন্যা সাহা । ‘

‘আর আপনার স্বামী?’

‘শুভব্রত সাহা।’

‘আপনারা কতদিন এখানে আছেন?’

‘তা প্রায় আড়াই বছর হয়ে গেল।’

‘এর আগে কোথায় থাকতেন?’

‘দমদমে, একটা ভাড়া বাড়িতে।’

‘আপনার স্বামী কি তখনও সেন বেকারিতেই কাজ করতেন ? ‘

‘অনেক আগে আর একটা কম্পানিতে কাজ করতেন। ওখান থেকে সেন বেকারিতে। তারপর যখন ডিস্ট্রিবিউশন ম্যানেজার হলেন তখন আমরা এই কোয়ার্টারটা পেলাম।’

‘বাঃ, সে তো খুব ভাল কথা।’

‘লোকে বলবে ভাল কথা, কিন্তু আমার তা মনে হয় না। ডিসট্রিবিউশন ম্যানেজার হবার পর থেকে আমার স্বামী শুধু যে বাড়িতে কম থাকেন তাই নয়, সব সময় দেখি নানা দুশ্চিন্তা ওর মাথায় ঘুরছে। বাড়িতে যখন থাকে তখন মাঝে মাঝে দেখেছি মাঝরাতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে। জিজ্ঞেস করলে বলে ঘুম আসছে না, তুমি ঘুমিয়ে পড়। আমার মনে হয় আগে আমরা অনেক ভাল ছিলাম। হয়ত টাকা-পয়সার টানাটানি ছিল। কিন্তু সংসারে সুখের অভাব ছিল না। আমি অনেকবার আমার স্বামীকে এই চাকরিটা ছেড়ে দিতে বলেছি। ও বলে, তা হয় না। কেন হয় না, আমি জানি না।’ অনন্যা সাহা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

আদিত্য ভাবছিল, বোধহয় সব এক্সিকিউটিভের বৌদেরই এরকম সমস্যা হয়। তবে সেন বেকারি কী এমন কম্পানি যে সেখানে কাজ করার এত চাপ থাকবে? কিংবা হয়ত ছোট, ডুবন্ত কম্পানি বলেই এত চাপ। সে মুখে বলল, ‘আপনাদের ভেতরের ঘরটা একটু দেখা যাবে? মানে, যে ঘরে খুনটা হয়েছিল?’

অনন্যা সাহা ইতস্তত করছে। ‘শোবার ঘর তো, একটু নোংরা হয়ে আছে। আমি চান করে উঠে পরিষ্কার করতাম। তার আগেই আপনি চলে এলেন। আমি ঘরটাকে একটু গুছিয়ে নিয়ে আপনাকে ডাকছি।’

অনন্যা সাহা ভেতরে চলে গেল। আদিত্য বসে বসে চারদিক দেখছে। ভাবছে। শোবার ঘর একটা নয়। একটা সরু প্যাসেজ রয়েছে। সেটা পেরলে দু-দিকে দুটো শোবার ঘর । প্যাসেজটা আধো-অন্ধকার। সেটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আদিত্য তিন বছর আগেকার সেই খুনের রাত্তিরটাকে পুনর্নির্মাণ করার চেষ্টা করছিল। অশনি রায়ের বয়ান অনুযায়ী এই প্যাসেজটা ধরে কয়েক পা এগোনোর পরে কেউ পেছন থেকে তার মুখে ক্লোরোফর্ম জাতীয় কিছু একটা চেপে ধরে তাকে অজ্ঞান করে দিয়েছিল। সেই সময়ে কিছুটা ধস্তাধস্তি হয়েছিল নিশ্চয়। কিছুটা শব্দও হয়েছিল। তা যদি হয় তাহলে বাড়ির মালিক ও মালকিন, পার্থ মিত্র এবং আসল মৃত্তিকা মিত্র, শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে এল না কেন? নাকি তারা বেরিয়ে এসে দেখল অশনি রায়কে অজ্ঞান করে দেওয়া হচ্ছে। দেখে তারা আবার শোবার ঘরে ঢুকে গেল? তারপর আততায়ী ধীরে সুস্থে শোবার ঘরে ঢুকে তাদের খুন করে চলে গেল? না, অসম্ভব। এটা হতেই পারে না। অশনির কথা যদি সত্যি হয় তাহলে ধরে নিতে হবে সেই রাত্তিরে অশনি রায় এই বাড়িতে ঢোকার আগেই পার্থ মিত্র, মৃত্তিকা মিত্র খুন হয়ে গেছে। তাদের লাশগুলো শোবার ঘরে পড়ে রয়েছে। অশনিকে অজ্ঞান করে আততায়ী পালিয়ে গেল। যাবার আগে অশনির হাতের ছাপটা পিস্তলের ওপর তুলে দিয়ে গেল। কিন্তু সেক্ষেত্রে খুন করার মোটিভ কী? অশনিকেই বা ফাঁসানো হল কেন ?

বরং খুন করার ব্যাপারে অশনি রায়ের মোটিভ বেশ জোরাল। হয়ত অশনি মিথ্যে কথা বলছে। যদি পুলিশের কথাই সত্যি হয় তাহলে ব্যাপারটা ঠিক কী হয়েছিল? পুলিশ বলছে, অশনি বাড়িতে ঢুকে দেখল মৃত্তিকা আর পার্থ ঝগড়া করছে। অশনিকে দেখে পার্থর রাগ আরও বেড়ে গেল। রাগের ঝোঁকে পার্থ দেরাজের ওপর থেকে ফুলদানি তুলে নিয়ে তার বউএর মাথায় আঘাত করল। মৃত্তিকা মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। তাই দেখে অশনি রায় তার পকেট থেকে পিস্তল বার করে গুলি চালাল। পার্থ মিত্রও লুটিয়ে পড়ল। ব্যাপারটা এইরকম হতেও পারত, কিন্তু আদিত্যর একটা ব্যাপারে খটকা লাগছে। অশনি রায়কে বাড়িতে ঢোকার জন্যে কে সদর দরজাটা খুলে দিল? যেহেতু অন্য কেউ বাড়িতে ছিল না, ধরে নিতে হবে, হয় মৃত্তিকা আর না হয় তার স্বামী পার্থ দরজা খুলে দিয়েছিল। যদি পার্থ দরজা খুলে দেয়, সে আদিত্যকে তার বেডরুম অব্দি আসতে দিল কেন? আর যদি মৃত্তিকা দরজা খুলে দেয়, তাহলে অত রাত্তিরে কে বেল বাজাল সেটা দেখার জন্যে কি পার্থ তার বউএর পেছন পেছন সদর দরজা অব্দি আসবে না? এলে, সে কি অশনিকে বেডরুম অব্দি যেতে দেবে? অর্থাৎ একটু তলিয়ে ভাবলে মনে হয়, এই দ্বিতীয় গল্পটাতে যা কিছু হেস্তনেস্ত সদর দরজা দিয়ে ঢুকে এই বসার ঘরটাতেই হয়ে যাবার কথা। বেডরুম পর্যন্ত ব্যাপারটা গড়াল কী করে?

অনন্যা সাহা ফিরে এসেছে। ‘চলুন।’ সে আদিত্যর দিকে তাকিয়ে বলল ।

শোবার ঘরটা খুব বড় নয়। একটা ডবোল খাট ঘরের বারো আনা দখল করে রেখেছে। তাছাড়া রয়েছে একটা ড্রেসিং টেবিল আর একটা শীর্ণকায় দেরাজ, যাকে আধুনিক পরিভাষায় ক্যাবিনেট বলতে হবে। এই ক্যাবিনেটের ওপরেই কি দুটো ফুলদানি সাজানো থাকত? আর তার একটা দিয়ে মৃত্তিকা মিত্রকে খুন করা হয়েছিল?

‘আপনাদের এই ফ্ল্যাটটার ফার্নিচারগুলো কি আপনাদের?’ আদিত্য অনন্যা সাহাকে জিজ্ঞেস করল।

‘না, না। আমাদের নয়। শুভর অফিস আমাদের ফার্নিচার সমেত এই ফ্ল্যাটটায় থাকতে দিয়েছে। মানে ফার্নিশড রেসিডেন্সিয়াল কোয়ার্টার।’

‘বুঝেছি। তার মানে পাঁচ বছর আগে আপনারা যখন এখানে এলেন তখন এই ফার্নিচারগুলো অলরেডি এখানে ছিল?’

‘হ্যাঁ। শুধু ড্রেসিং টেবিলটা পরে এসেছে।’

‘তার মানে হল, খুন হবার সময় সম্ভবত এই খাট এবং ক্যাবিনেট এই ঘরেই ছিল।’ আদিত্য বিড়বিড় করে নিজের মনে বলল।

অনন্যা সাহা উত্তর দিল না। বোধহয় আদিত্যর কথাটা ভাল করে শুনতে পায়নি। আদিত্য ভাবছিল। খাটের একদিকে ক্যাবিনেট, অন্য দিকে একটা ছোট সাইড টেবিল। সাইড টেবিলের দিকটাতে খানিকটা ফাঁকা জায়গা রয়েছে। অন্যদিকে ক্যাবিনেট এবং খাটের মাঝখানে জায়গা খুব কম। কষ্টেশিষ্টে একটা লোক দাঁড়াতে পারে। অশনি রায়ের কথা যদি ঠিক হয়, তাহলে নিশ্চয় ফাঁকা দিকটার মেঝের ওপরেই পার্থ মিত্রর মৃতদেহটা পড়েছিল। কিন্তু ওখানে দাঁড়িয়ে ক্যাবিনেট থেকে সে ফুলদানিটা তুলল কী করে? ক্যাবিনেটটা তো খাটের অন্য দিকে। আর অন্য দিকে জায়গা এত কম যে ওখানে দাঁড়িয়ে ক্যাবিনেট থেকে ফুলদানি তুলে কারও মাথায় আঘাত করাটা শক্ত। তবে অসম্ভব নয়। তাছাড়া খুনি যখন ওই জায়গাটায় দাঁড়িয়েছিল, তখন মৃত্তিকা মিত্র কোথায় ছিল? খাটের ওপর বসে থাকলে খাটে রক্তের চিহ্ন পাওয়া যেত। সেটা কি পাওয়া গিয়েছিল? মৃত্তিকা মিত্রর মৃতদেহটা ছিল খানিকটা বিছানায়, খানিকটা মেঝেতে। কোনদিকের মেঝেতে? ক্যাবিনেটের দিকের নাকি সাইড টেবিলের দিকের ? এইসব ডিটেলগুলো সুভদ্রর কাছ থেকে জেনে নিতে হবে।

ক্যাবিনেটের দিকে ঘরের সঙ্গে লাগোয়া বাথরুমের দরজা। তার পাশে বারান্দায় যাবার দরজা। আদিত্য বাথরুমের দরজাটা খুলে দেখল বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। একদিকে পার্টিশনের আড়ালে শাওয়ার, পার্টিশনের এপাশে কমোড। অন্যদিকে মুখ ধোবার বেসিন, টুথব্রাশ-টুথপেস্ট-শেভিং কিট রাখার জন্য অপরিসর ক্যাবিনেট। আদিত্য বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে বারান্দার দরজা খুলল। বারান্দাটা খুব ছোট। এটা বাড়ির পেছন দিক। বারান্দায় গ্রিল নেই। পাশ দিয়েই ড্রেনপাইপ নেমে গেছে। সুভদ্র ঠিকই বলেছিল। একটু চটপটে লোক হলে অনায়াসে বারান্দার রেলিং টপকে ড্রেনপাইপ বেয়ে নিচে নেমে পালাতে পারে। নিচে সিসি ক্যামেরা ঠিক কোথায় লাগানো আছে? সিকিউরিটিকে জিজ্ঞেস করতে হবে।

ঘরের ভেতরে ফিরে এসে আদিত্য বলল, “আপনাদের অন্য বেডরুমটা কি আপনার

মেয়ের ?’

‘হ্যাঁ। ওটাও কি দেখবেন?’

‘একবার দেখি।’ আদিত্য অন্ধকার করিডোর পেরিয়ে অন্য ঘরটাতে ঢুকল। এই ঘরটা রাস্তার দিকে। বারান্দা নেই, তবে জানলা দিয়ে রাস্তা দেখা যায়। ঘরটা বেশ পরিপাটি করে সাজানো। সিঙ্গল খাট, পড়ার টেবিল, বুককেস।

‘আপনার মেয়ে কোন ক্লাশে পড়ে?’

‘এবার ক্লাশ টেন হল। সামনের বছর মাধ্যমিক।’

আদিত্য আন্দাজ করল মেয়ে মায়ের মতো অগোছালো নয়। নিজের ঘর নিজেই গুছিয়ে রাখে। সে বলল, “আমার আর কিছু দেখার নেই। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আমি এখন আসছি। তবে আপনার স্বামীর সঙ্গে কথা বলার জন্য আবার আমাকে আসতে হবে। আপনার ফোন নম্বরটা বলবেন? আমি আপনাকে একটা মিসড কল দিচ্ছি। প্লিজ আমার নম্বরটা সেভ করে নেবেন। আর আপনার স্বামী কলকাতায় এলে আমাকে একটু জানাবেন। আমার নাম আদিত্য মজুমদার। ওই নামেই আমার নম্বরটা সেভ করবেন। আমি পেশায় একজন বেসরকারি গোয়েন্দা। ‘

বেসরকারি গোয়েন্দা শুনে মেয়েটির মুখের অভিব্যক্তি কতটা পাল্টাল সেটা না দেখেই আদিত্য ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে এসেছে।

নিচে নেমে আদিত্য দেখল সেই বুড়ো সিকিউরিটি তখনও বসে বসে খবর কাগজ পড়ছে। আদিত্যর পায়ের শব্দ পেয়ে সে মুখ তুলে চাইল।

আদিত্য তার দিকে তাকিয়ে কড়া গলায় বলল, “শুনুন, আমি কিন্তু আসলে এসি সারাবার লোক নই। আপনি নিশ্চয় জানেন এই বাড়িতে তিন বছর আগে দুটো খুন হয়েছিল। আমি সেটা ইনভেস্টিগেট করতে এসেছি। কেসটা আবার কোর্টে উঠবে।’

আদিত্য তার প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটরের লাইসেন্সটা পকেট থেকে বার করে দেখাল।

সিকিউরিটিকে বিভ্রান্ত দেখাচ্ছে। কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। কিছুক্ষণ ইতস্তত করে লোকটা বলল, “আপনি কি স্যার সিআইডি?’

আদিত্য ঠিকই আন্দাজ করেছিল। এই লোকটাও তাকে পুলিশ বলে ধরে নিয়েছে। অনিন্যা সাহা যেমন ধরে নিয়েছিল। লাইসেন্সটা কীসের, লোকটার বোঝার কথা নয়। সে লোকটার কথার সরাসরি উত্তর না দিয়ে বলল, ‘ঢোকার সময় আমার আসল পরিচয়টা দিইনি। কথা নানাভাবে লিক হয়ে যায়।’ তারপর একটু থেমে বলল, আমার কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে।’

‘বলুন স্যার।” বুড়োর গলাটা একটু কেঁপে গেছে।

‘তিন বছর আগে যখন এই বাড়িতে খুন হয় তখন কি আপনি এখানে ডিউটি করতেন?’

‘না স্যার। আমি তখন সল্ট লেকের একটা বাড়িতে ডিউটি করতাম।’ ‘এখানে তখন কে ডিউটি করত?’

‘আমি যত দূর জানি সোমনাথ ডিউটি করত। সোমনাথ বাগ। আমাদের কম্পানিতেই কাজ করত।’

‘করত মানে? এখন আর করে না?”

‘না স্যার। সোমনাথ অনেক দিন হল কাজ ছেড়ে দিয়েছে। ঠিক কত দিন ছেড়েছে বলতে পারব না।’

‘এখন কোথায় কাজ করে বলতে পারবেন?

‘না স্যার। তবে আমাদের আপিসে গেলে ওরা হয়ত বলতে পারবে।

‘আপনাদের আপিসের নাম কী?’

‘চাম্পিয়ান সিকিউরিটিজ। সল্ট লেকে আমাদের আপিস ।

“ঠিকানা?”

‘আমি ঠিকানাটা লিখে দিচ্ছি।’

বুড়ো পকেট থেকে একটা জরাজীর্ণ কাগজ বার করে তার থেকে দেখে দেখে হাতের খবরের কাগজের একটা ফাঁকা জায়গায় একটা ঠিকানা লিখল। কাঁপা কাঁপা কাঁচা হাতের লেখা, কিন্তু পড়া যাচ্ছে।

আদিত্য বলল, ‘আপনাদের পেছন দিকে একটা সিসি ক্যামেরা আছে না? একটু দেখব।’

‘পেছন দিকে সিসি ক্যামেরা? কই না তো। পেছন দিকে কোনও সিসি ক্যামেরা নেই তো। অন্তত আমি কখনও দেখিনি। সামনে সিসি ক্যামেরা আছে। আর প্রত্যেক তলায় লিফটের সামনে একটা করে সিসি ক্যামেরা আছে। কিন্তু পেছনে তো কিছু নেই।’ লোকটা বেশ অবাক হয়েছে।

একটু পরে রাস্তায় নেমে আদিত্যর ষষ্ঠেন্দ্রিয় তাকে বলল কেউ তার ওপর নজর রাখছে। মুখ তুলে দ্যাখে চারতলার জানলা দিয়ে অনন্যা সাহা তার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

(8)

গত মঙ্গলবার পয়লা বৈশাখের ছুটি ছিল, আজ শুক্রবার গুড ফ্রাইডের ছুটি। ছুটি মানে অবশ্য কেয়ার ইস্কুল ছুটি। আদিত্য যেহেতু দশটা পাঁচটার চাকরি করে না তার ছুটি বলে কিছু নেই। কেয়া আগে থেকেই বলে রেখেছে শুক্রবার দুপুরে বাইরে খেতে যাবে।

সকালবেলা আকাশে একটু মেঘ ছিল, দু’এক পশলা বৃষ্টি হবার পর রোদ্দুর উঠেছে। তবে বেশিক্ষণের জন্যে নয়। বেলা এগারোটা নাগাদ আকাশ আবার কালো। বেরোবে বলে কেয়া গাড়ি বলে দিয়েছিল। সেটা বারোটার সময় আসার কথা। তার আগেই বৃষ্টি নামল ।

আজকাল কেয়া খুব গাড়ি কেনার কথা বলছে। ছোটখাট একটা গাড়ি। অল্টো বা ওই রকম একটা কিছু। গাড়ি থাকলে আর রোজ রোজ উবার ডাকার ঝামেলায় যেতে হবে না। গাড়ি ভাড়াও করতে হবে না। আজকাল ফেরার সময় উবার পেতে বেশ অসুবিধে হচ্ছে। কেয়া হিসেব করে দেখেছে এখন যা খরচ হচ্ছে গাড়ি কিনলে তার থেকে বেশি খরচ হবে না। গাড়ি কেনার টাকা কেয়া দেবে। আদিত্যর কাজ গাড়িটা কিনিয়ে দেওয়া।

বারোটা বেজে গেল, বৃষ্টির বেগ বেড়েই চলেছে। সাড়ে বারোটা বেজে গেল, দেখতে দেখতে একটা বেজে গেল। গাড়িটা এখনও এসে পৌঁছতে পারেনি। ড্রাইভার ফোন করে জানিয়েছে, গ্যারেজেই আটকে আছে, বৃষ্টি একটু কমলে বেরোবে। রাস্তায় জল জমতে শুরু করছে। এই বাড়িটার একটা মস্ত অসুবিধে হল বৃষ্টির ছাঁট শোবার ঘরের জানলার দিকে হলে শার্শির নিচ দিয়ে জল ঢুকতে শুরু করে। তারপর সেই জল গড়াতে গড়াতে সারা বাড়ি ছড়িয়ে যায়। সৌভাগ্যবশত আজ বৃষ্টির ছাঁট অন্যদিকে। না হলে এতক্ষণে বাড়ির মধ্যে একটা পুকুর তৈরি হয়ে যেত।

আদিত্য ভেবেছিল কেয়াকে নিয়ে আজ দুপুরে রাজারহাটের সেই ক্যাফেটাতে খেতে যাবে যেখানে অশনি রায় নকল মৃত্তিকাকে নিয়ে যেত। রথ দেখা কলা বেচা দুই-ই হবে। ক্যাফের নামটা আদিত্য নোট খাতায় লিখে রেখেছিল। সল্ট অ্যান্ড পেপার গুগল করে দেখল জায়গাটা রবীন্দ্র তীর্থ-র কাছে, মূল রাস্তা থেকে একটা ছোট্ট রাস্তা বেরিয়েছে, সেখানে। বৃষ্টি না পড়লে খুঁজে খুঁজে ঠিক পৌঁছে যাওয়া যেত। এখন এই বৃষ্টির মধ্যে জায়গাটা খুঁজে পাওয়া যাবে কি? অবশ্য তারও আগের প্রশ্ন, আরও কিছুক্ষণ এইভাবে বৃষ্টি হতে থাকলে আদৌ কি বেরোনো যাবে?

আদিত্য বসার ঘরের জানলা দিয়ে তন্ময় হয়ে বৃষ্টি দেখছিল। শহরটা বৃষ্টির হাতে নিজেকে সম্পূর্ণ সঁপে দিয়েছে। একটি নারী যেমন তার পুরুষের হাতে নিজেকে সঁপে দেয়। যেন শহরটার আর নিজের কোনও সত্তা নেই। বৃষ্টি তাকে যেমন করে ব্যবহার করবে সে তেমনভাবে ব্যবহৃত হবে।

‘আজ আর যাওয়া হবে বলে মনে হচ্ছে না।’ কেয়া ঘরে ঢুকে বলল। ‘আমি খিচুড়ি চাপিয়ে দিলাম।’

আদিত্যর ভালই লাগছে। একটা ছুটির দিনে জানলা দিয়ে বৃষ্টি দেখা, খিচুড়ি খাওয়া, ইচ্ছে হলে তারপর একটু ঘুমিয়েও নেওয়া যেতে পারে। এ তো স্বর্গসুখ। বিশেষ করে কেয়া যখন বাড়িতে। কী দরকার বিশ মাইল ঠেঙিয়ে বাইরে লাঞ্চ খেতে যাবার? শুধু একটা কারণে মনটা খচখচ করছে। সল্ট অ্যান্ড পেপার ক্যাফেতে একবার গিয়ে কথা বলার দরকার ছিল। কাজটা হল না। বিবেকের দংশন এড়ানোর জন্যে আদিত্য মোবাইলে একটা নম্বর লাগাল। কিছু কাজ অন্তত এগিয়ে রাখা যেতে পারে।

‘একটা কাজ করে দিতে হবে। হাতে সময় আছে?’ ওপার থেকে সাড়া পাওয়ার পর আদিত্য বলল।

‘নিশ্চয় স্যার। আপনার জন্যে আমার হাতে সর্বদা সময় আছে। বলুন স্যার, কী করতে হবে।’

‘একটা লোকের হদিশ করতে হবে। নাম সোমনাথ বাগ। আগে একটা সিকিউরিটি কম্পানিতে কাজ করত। এখন কী করে, কোথায় থাকে কিচ্ছু জানি না। আগে যে সিকিউরিটি কম্পানিটাতে লোকটা কাজ করত সেটা সল্ট লেকে। ঠিকানাটা আমি তোমাকে হোয়াটস্অ্যাপ করে দিচ্ছি। ওইখানে গিয়েই খোঁজ নিতে হবে। এছাড়া আর কোনও লিড নেই।

“ঠিক আছে স্যার। আমি কয়েকদিনের মধ্যে খোঁজ নিয়ে জানাচ্ছি।’ বিমল গায়েন ওপার থেকে বলল। গত তিনমাস তাকে দেবার মতো কোনও কাজ আদিত্যর হাতে ছিল না।

‘তোমার এমনিতে সব ঠিকঠাক চলছে তো?’

‘আপনাদের আশীর্বাদে আর ঠাকুরের কৃপায় মোটামুটি চলে যাচ্ছে স্যার। শুধু একটা চিন্তা। মেয়েটার বাচ্চা-কাচ্চা হবে। আমার জামাই তো জানেন একটা কেটারিং-এ রান্না করে। খুব ডিমান্ড। অন্য জায়গা থেকেও ওকে বায়না করে নিয়ে যায়। যা বিরিয়ানি বানায় না স্যার, একবার খেলে ভুলতে পারবেন না। তো, সে যাই হোক, জামাই তো বাড়িতেই থাকে না। ভরা পোয়াতি মেয়েটাকে দেখাশোনার জন্যে কাউকে তো বাড়িতে থাকা দরকার। সেরকম কেউ বাড়িতে নেই। আগে ওরা আমাদের পাড়াতেই থাকত। পাড়ার ছেলেকেই তো প্রেম করে আমার মেয়ে বিয়ে করল। পাড়ায় থাকলে গিন্নি রোজ গিয়ে মেয়েকে দেখে আসতে পারত।’

‘কোথায় থাকে তোমার মেয়ে-জামাই?’

‘কোদালিয়া জানেন? দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার কোদালিয়া। ওই সুভাষগ্রাম স্টেশনে নেমে যেতে হয়। ওখানে আমার জামাই-এর কিছুটা জমি ছিল। বাপ-দাদার জমি। ওর ভাগে ছ’-সাত কাঠা পড়েছে। তা সেখানে জামাই একটা ঘর তুলেছে। একটা ঘর, একটা বাথরুম আর একটা টিউবকল। ওখানেই ওরা থাকে।’

‘আশেপাশে জামাই-এর জ্ঞাতিরা কেউ থাকে না?”

‘থাকে। দুই কাকা থাকে। কিন্তু তাদের সঙ্গে জামাই-এর বনিবনা নেই। ওর বাবা মরে যেতে কাকারা অনেকটা জমি হাতিয়ে নিয়েছিল। তাই নিয়ে বিবাদ। হয়ত একদিন কোট-কাছারি অব্দি গড়াবে।’

‘হুঁ, বুঝলাম। তোমার বউকে বল এখন কিছুদিন মেয়ের কাছে গিয়ে থেকে ‘আসতে।’

‘সেটাই ঠিক হয়েছে স্যার। আমি না হয় ক’টা দিন হাত পুড়িয়ে রান্না করে নেব।’ ‘ঠিক আছে। এখন রাখছি। কিছু খবর পেলে জানিও।’

‘জানাব স্যার।’

প্রকৃতির কী আশ্চর্য খেয়াল, বেলা দুটো নাগাদ বৃষ্টি থেমে গেল, আড়াইটের মধ্যে মেঘের আড়ালে রোদ্দুর উঁকি মারছে! একটু পরেই কেয়ার মোবাইলটা বেজে উঠল। ড্রাইভারের ফোন। সে গাড়ি নিয়ে নিচে অপেক্ষা করছে। তাকে বলে দেওয়া যেত আজ আর বেরোনো হবে না, কিন্তু কেয়া বলল তাহলে গাড়ির মালিক ড্রাইভারকে এক দিনের পয়সা দেবে না। ড্রাইভার কেয়াকে তাই বলছে। কেয়ার একে দয়ার শরীর তার ওপর বেরোবার ইচ্ছে ষোলো আনা ৷ অগত্যা জামাকাপড় পালটে আদিত্যকে তৈরি হয়ে নিতে হল। আদিত্য ভাবল, বেরোতেই যখন হচ্ছে তখন সল্ট অ্যান্ড পেপার ক্যাফেতে একবার ঘুরে আসাই যায়।

বৃষ্টি আজকাল ছোট ছোট এলাকায় গণ্ডিবাঁধা থাকছে। এও প্রকৃতির খেয়াল। উল্টোডাঙা পেরিয়ে সল্টলেকে ঢুকতেই খটখটে শুকনো রাস্তা দেখা গেল। যেন বহুদিন এ-চত্বরে বৃষ্টি হয়নি। তবে মেঘেরা আশ্চর্য কেরামতি দেখাচ্ছে। সাদা মেঘ, কালো মেঘ মিলে আকাশে একটা শহর তৈরি করেছে। শহরের পেছনে হালকা পাহাড়ের রেখা। পাহাড়ের ওপরে একটা দুর্গ দেখা যাচ্ছে না? গাড়ি দেখতে দেখতে রাজারহাটে ঢুকে পড়ল।

রবীন্দ্র তীর্থ অব্দি আদিত্যর চেনা। এর পর কোন দিকে যেতে হবে? রাস্তায় একটাও লোক নেই যে জিজ্ঞেস করা যাবে। আরও খানিকটা এগোনোর পর একটা ছোট মোড় পড়ল। মোড়ের মাথায় একটা চায়ের দোকান। খাপরার ছাউনি। যারা চা খাচ্ছে তারা সম্ভবত রাজমিস্ত্রি ও তাদের জোগাড়ে। কাছেই কোনও বাড়ি তৈরি হচ্ছে, সেখানে কাজ করছে। এই মিস্ত্রিরা ক্যাফে-ট্যাফের খবর জানবে বলে মনে হয় না। আদিত্যর জিপিএস ম্যাপ বলছে আরও খানিকটা এগিয়ে বাঁ দিকে বেঁকতে হবে।

মিনিট কয়েক চলার পর জিপিএস বাঁ দিকে বেঁকতে বলল। বাঁক নিতেই একটা মস্ত বড় জলাশয়। সাদা রাজহাঁস চরছে। আর তার উল্টোদিকে, আরে কী আশ্চর্য, ওই তো সল্ট অ্যান্ড পেপার ক্যাফে! ক্যাফের সামনে দুটো গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। তার মানে এত মাইল রাস্তা পেরিয়ে এই নির্জন ক্যাফেতে কেউ কেউ আসে। হয়ত নির্জন বলেই আসে ।

ক্যাফের ভেতরটা ছিমছাম। আদিত্য আর কেয়া জানলার ধারে বসল। জানলা দিয়ে রাজহাঁসদের জলে ওঠানামা দেখা যাচ্ছে।

‘কী সুন্দর জায়গা গো। কী করে জানলে এটার কথা?’ জায়গাটা কেয়ার পছন্দ হয়েছে।

আদিত্য বলেনি সে এখানে রথ দেখার সঙ্গে সঙ্গে কলাও বেচতে এসেছে। ‘একজন এই জায়গাটার কথা বলেছিল। ভাবলাম, গিয়ে দেখা যাক না, কেমন জায়গা।’

‘হাঁসগুলো দেখো। কী সুন্দর। কাদের হাঁস কে জানে।’

‘মনে হয় এই ক্যাফের মালিকই হাঁসগুলোর মালিক। দেখছ না, জলের ধারে লেখা রয়েছে, মেনটেন্‌ড্ বাই সল্ট অ্যান্ড পেপার ক্যাফে।

বেয়ারা এসে দুজনকে দুটো মেনু দিয়ে গেল।

‘আমি কিন্তু কিছু খেতে পারব না। শুধু কফি খাব। অবেলায় বেশি খিচুড়ি খেয়ে ফেলেছি।’ আদিত্য জানিয়ে রাখল।

‘শুধু কফি কেন? একটা মিষ্টি খাও। লেমন টার্ট খাও না একটা।’ ‘তুমি কী খাবে?’

‘আমি খাব একটা ক্যাফে লাতে। আর একটা চকলেট মাড পাই।’ কেয়া অসম্ভব চকলেটের ভক্ত।

‘ঠিক আছে। আমি তাহলে একটা লেমন টার্ট আর একটা কালো কফি, মানে কাফে আমেরিকানো ।

বেয়ারা অর্ডার নিতে এসেছিল। অর্ডার দেবার পর আদিত্য জিজ্ঞেস করল, “এই ক্যাফেটা কতদিন হল হয়েছে?’

‘আমি ঠিক বলতে পারব না। ম্যাডাম বলতে পারবেন।’ বেয়ারা চোখের ইশারায় কাউন্টারে বসা একজন মহিলাকে দেখাল।

ক্যাফের ভেতরটা আধো-অন্ধকার বলে আদিত্য এতক্ষণ ভদ্রমহিলাকে খেয়াল করেনি। সে বলল, ‘ম্যাডামের সঙ্গে একটু কথা বলা যাবে?’

বেয়ারা অবাক হয়েছে। কেয়াও। অবাক ভাবটা সামলে নিয়ে বেয়ারা বলল, ‘আমি ম্যাডামকে জিজ্ঞেস করছি।’

‘তুমি ওই ম্যাডামের সঙ্গে কেন কথা বলতে চাও?’ বেয়ারা চলে যেতেই কেয়া বলে উঠেছে।

‘তোমাকে পরে সব বুঝিয়ে বলব। তুমি শুধু শুনে যাও।’ আদিত্য দেখল বেয়ারার কথা শুনে কাউন্টারের ভদ্রমহিলা তাদের টেবিলের দিকে এগিয়ে আসছেন। ভদ্রমহিলা আধুনিকা। সুন্দরী। বয়েস চল্লিশের কোঠায়।

‘আপনাদের কি কোনও অসুবিধে হচ্ছে? আমি কি কোনও সাহায্য করতে পারি?’ ‘আমাদের কোনও অসুবিধে হচ্ছে না। চমৎকার আপনাদের অ্যাম্বিয়েন্স। খাবার অর্ডার দিয়েছি, এখনও খেয়ে দেখিনি। তবে আমি শিয়োর খাবারটা আপনাদের অ্যাম্বিয়েন্স-এর মতই ভাল হবে। আসলে আমার একটা অন্য প্রশ্ন ছিল।’

‘প্রশ্ন? বলুন কী প্রশ্ন?’ ভদ্রমহিলাকে কি একটু উদ্বিগ্ন মনে হল?

‘আমি আদিত্য মজুমদার আর ইনি আমার স্ত্রী কেয়া।’ আদিত্য দু’হাত জড়ো করে নমস্কার করল।

‘আমি আর আমার স্ত্রী ভাবছিলাম আপনাদের মতো একটা ক্যাফে খুলব। এখানে নয়। আপনাদের সঙ্গে কমপিট করব না।’ আদিত্য চওড়া করে হাসল। ‘রাজারহাটের অন্য দিকে, সিটি সেন্টার টু পেরিয়ে, আমাদের একটা জমি কেনা আছে। সেখানে। জায়গাটা এখানকার মতই ফাঁকা। তবে আপনার যেমন সামনে একটা সুন্দর লেক আছে, আমাদের ওরকম কিছু নেই।’

ভদ্রমহিলা এখনও জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন।

আদিত্য বলল, ‘আমরা এই রাজারহাটে ক্যাফে চালানোর ব্যাপারে আপনাকে দু’একটা জিনিস জিজ্ঞেস করব ভাবছিলাম। মানে, আপনার যদি বলতে আপত্তি না থাকে।’

‘না, না। আপত্তি কীসের? বলুন কী জানতে চান। আচ্ছা তার আগে বলুন, আপনারা কি আগে আমার ক্যাফেতে এসেছেন? আমার কাস্টমারদের প্রায় সকলকেই আমি চিনি। আপনাদের আগে দেখেছি বলে মনে পড়ছে না। কারও কাছে কি আমাদের কথা শুনেছেন? আসলে, আমার ক্যাফের কথা তো খুব বেশি কেউ জানে না, তাই জিজ্ঞেস করছি।’

‘না ম্যাডাম। আমরা আগে কখনও এখানে আসিনি। আমার এক পরিচিত এই ক্যাফেটার কথা আমাদের বলেছেন। এক সময় তিনি এখানে খুব আসতেন। তবে অনেকদিন আসেননি। আপনি কি নাম বললে চিনতে পারবেন ?

‘কী নাম? সব কাস্টমারের নাম অবশ্য আমি জানি না। অনেকের শুধু মুখ চিনি। কী নাম বলুন তো?”

‘অশনি রায়। মনে পড়ছে?”

আদিত্য খুব ভাল করে ভদ্রমহিলার মুখের দিকে লক্ষ রাখছিল। অশনি রায় নামটা শুনে ভদ্রমহিলার মুখে মুহূর্তের জন্যে একটা অভিব্যক্তি খেলে গেল, যাকে সতর্কতা বলা যায়। তারপর ভদ্রমহিলা একটু ম্লান হাসলেন। বললেন, “নিশ্চয় মনে পড়ছে। ও নাম কি ভোলা যায়? আপনি যখন ভদ্রলোককে চেনেন, নিশ্চয় বুঝতে পারছেন কেন ভোলা যায় না। উনি এখন কেমন আছেন?’

‘খবর কাগজে দেখেছেন বোধহয় হাই কোর্টের সিঙ্গল বেঞ্চ ওকে বেকসুর খালাস করে দিয়েছে। উনি বাড়ি ফিরে এসেছেন। তবে মাথাটা সব সময় কাজ করে না।’ বেয়ারা কফি-কেক নিয়ে এসেছে। ভদ্রমহিলা বেয়ারাকে বললেন, ‘আমাকে একটা কফি দাও তো। আমি যেরকম কফি খাই। আর আমার জন্যে একটা চেয়ার এনে দাও।’

“ও হো, আমার নামটাই তো বলা হয়নি। আমার নাম মালা, মালা সরকার।’ ভদ্রমহিলা হাত তুলে নমস্কারের ভঙ্গী করলেন।

‘আমি আদিত্য মজুমদার, ইনি আমার স্ত্রী কেয়া।’ আদিত্য দ্বিতীয়বার নিজের নাম বলে দু’হাত জড়ো করে নমস্কার জানাল। ‘আপনি অশনিবাবু সম্বন্ধে কী যেন বলছিলেন?’ নামটা শুনে ভদ্রমহিলা কি একটু তির্য্যক হাসলেন?

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। বলছিলাম, অশনিবাবু যখন এই ক্যাফেতে আসতেন তখন আমি এখানকার ম্যানেজার ছিলাম। খাবারও সার্ভ করতাম। আমি আর আমাদের কুক ছাড়া আর কোনও কর্মচারি তখন ছিল না। অশনিবাবু তার বান্ধবীকে নিয়ে আসতেন। বান্ধবীর চোখ দুটো কালো চশমা দিয়ে ঢাকা থাকত। ওড়না দিয়ে মুখের আধখানাও ঢাকা থাকত। যেন উনি নিজেকে লুকিয়ে রাখতে চাইতেন। আমার একটু অবাক লাগত। তারপর ভাবতাম আমার কী দরকার? শেষে তো এই কাণ্ড হল। একটা ছবি দেখিয়ে পুলিশ আমাকে জিজ্ঞেস করল ইনিই কি অশনি রায়ের সঙ্গে সল্ট অ্যান্ড পেপার ক্যাফেতে আসতেন? আমি বললাম, হয়ত ইনিই আসতেন, তবে আমি খুব জোর দিয়ে কিছু বলতে পারব না। কারণ ওর চোখ সানগ্লাস দিয়ে ঢাকা থাকত। মুখের অর্ধেকটাও ওড়না দিয়ে ঢাকা থাকত। আর ওরা ক্যাফের ভেতরে একটা অন্ধকার কোণে গিয়ে বসতেন। আমি ভদ্রমহিলাকে খুব ভাল করে কখনই দেখিনি। পুলিশ অফিসার আমাকে ধমক দিয়ে বললেন, আপনি মিথ্যে কথা বলছেন।’

‘আপনি কেন মিথ্যে বলতে যাবেন? মিথ্যে বলে আপনার কী লাভ?’

মালা সরকার কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর থেমে থেমে বললেন, ‘আপনাকে বললাম না, আমি তখন এই ক্যাফেটার ম্যানেজার ছিলাম। কিন্তু মালিক হবার স্বপ্ন দেখতাম। আগের মালিক তখন কলকাতায় থাকত। তাই এই ক্যাফেটা খুলেছিল। কলকাতায় মালিকের অন্য ব্যবসাও ছিল। আস্তে আস্তে সেই ব্যবসাগুলো মালিক দিল্লিতে নিয়ে গেল। এই ক্যাফেটাও বিক্রি করতে চাইছিল। ক্যাফেটা আমার কেনার খুব ইচ্ছে, কিন্তু টাকা কোথায়? একটা ব্যাঙ্ক লোন পাবার চেষ্টা করছিলাম। অশনি রায় তার ব্যাঙ্ক থেকে আমাকে লোনটা পাইয়ে দেবে বলল। ওই খুনের ঘটনাটা যখন ঘটল, লোনটা তখনও স্যাংশন হয়নি, প্রসেসড হচ্ছে। পুলিশ বলল অশনি রায়কে বাঁচাবার জন্যে আমি মিথ্যে কথা বলছি। অশনি রায় ছাড়া পেয়ে গেলে লোনটা আমাকে পাইয়ে দেবে। সেই কারণে আমি অশনি রায়কে বাঁচাবার চেষ্টা করছি। আমি খুব ভয় পেয়ে গেলাম। ভয় পেয়ে বললাম, এই মহিলাই অশনি রায়ের সঙ্গে আসত।

অশনি রায়ের জেল হয়ে গেল। কিন্তু পরে লোনটা আমি পেয়ে গেলাম। এটা নিয়ে আমি অনেক রাত্তির ঘুমোতে পারিনি। লোন নিয়ে ক্যাফেটা কিনলাম। এখন লোনটাও শোধ হয়ে গেছে। অবশ্য হাইকোর্টে অশনি রায়ের উকিল ব্যারিস্টার ব্যানার্জী আমাকে জেরা করে প্রমাণ করে দিলেন অশনির সঙ্গে যে মেয়েটা আসত তাকে কোনও দিনই আমি ভাল করে দেখিনি। অতএব আমার কথার কোনও দাম নেই।’

মালা সরকারের কথা শুনতে শুনতে আদিত্য ভাবছিল এই মহিলা নিজের থেকে এত কথা বলছে কেন? সে মুখে বলল, ‘আপনার ব্যবসার কথাটা শুনতে চাইছিলাম। এদিকে ক্যাফে খুললে প্রসপেক্ট কেমন?’

‘দেখুন, আমার ক্যাফেটা তো ভালই চলে। খুব বেশি কাস্টমার আমার নেই। কিন্তু যারা আছে তারা খুব লয়াল। এখানেই বারবার আসে। বেশিরভাগই কাপল । নির্জনতা চায়।’

কথাগুলো বলে মালা সরকার মুচকি হাসলেন। তারপর বললেন, ‘কিন্তু আপনি এসব কথা জিজ্ঞেস করছেন কেন? আপনি কে এবং কেন এখানে এসেছেন আমি সবই জানি।’

আদিত্য কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। বাধা দিয়ে মালা সরকার বললেন, “আদিত্যবাবু আপনার প্রফেশন এবং এখানে আসার উদ্দেশ্য আমার অজানা নয়। তাই ব্যবসা-ট্যাবসার কথা বললে সময় নষ্ট ছাড়া আর কী হবে?’

আদিত্য হতভম্ভ। তার অবস্থা দেখে কেয়াও হাসছে। অতি কষ্টে আদিত্য বলল, ‘আপনি আমার কথা কী করে জানলেন? ‘

‘অশনি রায় আমাকে দু-দিন আগে ফোন করেছিলেন। উনিই বললেন আপনি এখানে আসতে পারেন। অনুরোধ করলেন আপনাকে যেন সব রকম সাহায্য করি।’ আদিত্য কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল, ‘আপনি তো সবই বলে দিয়েছেন। আমার শুধু একটাই প্রশ্ন আছে। লোনটা ঠিক কবে স্যাংশন হয়েছিল? অশনি রায় জেলে যাবার আগে না পরে?’

‘আমার যতদূর মনে পড়ছে স্যাংশনটা আগেই হয়েছিল। তবে ডিসবার্সমেন্ট হয়েছিল পরে। মানে, প্রথম ভারডিক্টটা বেরোনোর পরে।’

‘ঠিক আছে। আমার আর একটাই কথা বলার আছে। আপনাদের কফি এবং কনফেকশনারি অতি চমৎকার।’

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন