নিগ্রহ

সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়

নিগ্রহ

সংসার, সংসার করে শংকরটা একেবারে জেরবার হয়ে গেল। রুগণ বউ। বাইরে থেকে কিছু বোঝার উপায় নেই। মনে হবে অসাধারণ স্বাস্থ্য। শংকরের চেয়ে শতগুণ ভালো। ভেতরটা নাকি একেবারে ফোঁপরা! ফুলশয্যার মাঝরাতেই সে এক সাংঘাতিক ব্যাপার! শংকর প্রায় খুনের দায়েই পড়ে আর কি। দরজা বন্ধ কর সোহাগের বশে বউকে একটি সুঁই-ফুলের মালা পরিয়েছিল। তিন মিনিটের মধ্যে বউ অনি হাপরের মতো শ্বাস টানতে শুরু করল। মনে হচ্ছে ঘরের সমস্ত বাতাস যেন শুষে নেবে। এমন সাঁ সাঁ শব্দ, বাইরে যারা কান পেতে ছিল তারা সব চিৎকার জুড়ে দিল, ‘ঘরে কী চলছে! কী মেশিন চালালেন শংকরদা।’

শংকরে তখন আর শঙ্কর নেই। তাড়াতড়ি দরজা খুলে বেরিয়ে এল। সবাই অমনি ঘরে ঢুকে, কেউ জানলা খুলছে। কেউ মশারি তুলছে। কেউ পাখার রেগুলেটার ঘোরাচ্ছে। হইহই ব্যাপার। শংকরের বউ অতি কষ্টে বললে, ‘অ্যালার্জি। জুই আর গাঁদা ফুলে আমার অ্যালার্জি আছে ভাই। তিন ফোঁটা চুনের জল আধ কাপ জলে।’ ফুলশয্যা হয়ে গেল রোগশয্যা। সেই থেকে শংকরকে আর দেখতেই হল না, স্ত্রী-র অঙ্গও স্পর্শ করতে হল না। বউ চলে গেল ডাক্তারবাবুদের হাতে। সব স্পেশ্যালিস্ট। হার্ট, লাংস, কিডনি, ইএনটি, আই, ফিমেল ডিজিজ, অস্টিওপ্যাথ, মাঝে মাঝে হোমিওপ্যাথ, নেচারোপ্যাথ। একজন বেরোচ্ছেন তো আর একজন ঢুকছেন। বড় বড় হোটেলে যেমন প্রতিদিনের মেনু থাকে, লেখা থাকে টুডেজ স্পেশ্যাল। খানা টেবিলে বসে। জিগ্যেস করেন, ‘আজকের স্পেশ্যাল আইটেম কী?’ সেইরকম শংকর রোজ সকালে উঠে বউকে জিগ্যেস করে, ‘আজকের খবর?’ খাবারের বদলে খবর। তারপর ভয়ে সিঁটিয়ে থাকে। স্ত্রী অমনি বলেন, ‘বেশ ছিলুম বুঝলে। যেই তুমি ডাকলে, শুনছ সাড়ে ছটা বাজল। আমি অমনি ধড়মড় করে উঠে বসলুম। শরীরটা একটা ঝাঁকুনি খেল তো, আর সঙ্গে সঙ্গে আধকপালে হয়ে গেল। উঃ, মাথাটা যেন ছিঁড়ে যাচ্ছে।’

‘কী হবে এখন?’

‘আর কী হবে! হয়ে গেল। আমার আবার মাথা ধরলে গা গুলোতে থাকে। সারাদিন কিছু আর খেতে পারব না। ওদিকে আলসার। পেট খালি থাকলেই ব্যথা শুরু হয়ে যাবে। পেটে গ্যাস হবে। গ্যাস হলেই ঠেলা মারবে ওপরে। সঙ্গে সঙ্গে চাপ মারবে হার্টে। হার্টে চাপ মারলেই প্রেসার চড়ে। যাবে। প্রেসার চড়লেই হাত, পা অবশ হয়ে যাবে। তোমাকে আমি কতবার বলেছি আমাকে আচমকা অমন করে ডাকবে না।’

‘আমি তাহলে ডাক্তারবাবুকে একবার কল দি। পরে যদি বাড়াবাড়ি হয়।’

মানুষ সকালে ব্রেকফাস্ট করে, চা-বিস্কুট অথবা টোস্ট-চা। শংকরের বউয়ের ব্রেকফাস্ট হল জল, ক্যাপসুল। বিছানা থেকে উঠে আবার বিছানাতেই ফিরে আসা। আজ বিশটা বছর ধরে শংকর এই করে যাচ্ছে। পৃথিবীর যাবতীয় ওষুধের নাম তার কণ্ঠস্থ। যে-কোনও অসুখ সম্পর্কে তার গভীর জ্ঞান। ডাক্তারবাবুরাই এখন তার পরামর্শ নেন। মা দুর্গা কার্তিক আর গণেশকে বললেন,

যে সবার আগে বিশ্ব পরিক্রমা করে ফিরে আসতে পারবে তার গলায় আমার এই মণিমালা। ঝুলিয়ে দোব। কার্তিক অমনি ময়ুরে চেপে বেরিয়ে গেল। গণেশ কিন্তু বসেই রইল। মা বললেন, ‘কী রে! তুই গেলি না।’ গণেশ বললে, ‘ও তো একপলকের ব্যাপার।’ গণেশ গদি ছেড়ে উঠে। মাকে প্রদক্ষিণ করে, গলাটা বাড়িয়ে দিল। একবছর পরে কার্তিককুমার ফিরে এসে অবাক। তা শংকর তার বউকে প্রদক্ষিণ করে ফার্মাকোপিয়া বনে গেছে।

প্রথম প্রথম আমরা শংকরের বউকে জিগ্যেস করতুম, ‘কী কেমন আছ!’ ভদ্রতা করে সে প্রশ্ন। সকলেই সকলকে করে। এখন আর ভুলেও করি না। তাতেও কি নিষ্কৃতি আছে। পা ঘষে ঘষে, পা ঘষে ঘষে এগিয়ে এসে প্রশ্ন করেন, ‘কেমন আছেন ঠাকুরপো?’

তখন পালটা প্রশ্ন করতেই হয়, ‘তোমার খবর কী?’ যেন দোদমার পলতেয় আগুন ছোঁয়ালাম! শব্দের ভয়ে সিঁটিয়ে আছি। সঙ্গে সঙ্গে টেলিপ্রিন্টার চালু হয়ে গেল। ‘আর বলবেন না। বেশ। ছিলুম। হঠাৎ রাস্তায় একটা লরির টায়ার ফাটল। আচমকা শব্দ তো। বুকের কাছটা ধক করে উঠল। সেই যে লাফাল, আর থামছে না। শরীরটা যেন থিম মেরে আসছে। বুকের এই বাঁদিকটায় হাত দিয়ে দেখুন। যেন ভুমিকম্প হচ্ছে।’ হাত দোব কি! ওই জায়গায় হার্ট ছাড়াও মেয়েদের। আরও একটা জিনিস থাকে।

শংকরের অবস্থা দেখলে দুঃখ হয়। অথচ ছেলেটা বউকে ভীষণ ভালোবাসে। সেবা করে বিগ্রহের মতো। আমরা বলি নিগ্রহ। সেবার একটা নেশা আছে। কারণ-সেবা, গঞ্জিকা-সেবা, জীবিকার সেবা, সমাজ-সেবা। রবিবার দেখার মতো অবস্থা। পাজামা হাঁটুর ওপর। হাতে ঝাড়ু, পাশে বালতি, কাঁধে গামছা, দুটো গ্যাস ওভেনের একটায় ভাত, আর একটায় সিঙ্গি মাছের ঝোল। সারা বাড়ি ছত্রাকার। বউয়ের নাকি সুর। ‘শুনচোঁ, আমার বোধহয় দ্বিতীয় ক্যাপসুলটা খাওয়ার

সময় হল।’ সেদিন দুপুরে শংকরকে ডাকতেই বেরিয়ে এল। পরনে একটা সায়া। এ কী! বললুম, ‘তুমি বোধহয় লিঙ্গ ভুল করে ওটা পরেছ!’ শংকর বললে, ‘তাই তো! আমি ভাবছি পাজামার তো। দুটো পা হয়। আর একটা পা গেল কোথায়! তখন থেকে খুঁজেই যাচ্ছি। দেখেছ কী কাণ্ড! আর ভাই, আমার মাথার ঠিক নেই।’

সকল অধ্যায়

১. টক ঝাল মিষ্টি
২. প্রেম বাড়ছে
৩. বড়মামা ও নরনারায়ণ
৪. ফল্গু
৫. ফাটল
৬. যার যেমন
৭. সেই লোকটা
৮. হাত
৯. প্রেম আর ভূত
১০. বত্রিশ পাটি দাঁত – সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
১১. গরুর রেজাল্ট
১২. গোমুখ্যু গরু
১৩. মামার বোমাবাজি
১৪. মসনদ
১৫. বিকাশের বিয়ে
১৬. আলো-অন্ধকার
১৭. হাইওয়ে
১৮. উপলব্ধি
১৯. চরিত্র
২০. দিন চলে যায়
২১. গান্ধারী
২২. সরষে
২৩. শেষ কথা
২৪. সদা আনন্দে
২৫. বিস্কুট
২৬. একটি দুর্ধর্ষ অভিযান
২৭. হতে পারে
২৮. টি ভিং মনোরমাং
২৯. স্বপ্নের দাম
৩০. প্রেমের পুজো, পুজোর প্রেম
৩১. আহারের বাহার
৩২. বিবাহ-মঙ্গল
৩৩. বিদ্যুতের জাদুঘরে
৩৪. জলছবি
৩৫. স্বামী-স্ত্রী সংসার
৩৬. ভূমিকা-২
৩৭. আজ আছি কাল নেই
৩৮. সুন্দরী বউ
৩৯. ট্রাবলসাম প্রাণী
৪০. স্বর্গ এখনও আছে
৪১. মানব অথবা দানব
৪২. বুকপকেটে বিশ্ব ঘোরে
৪৩. কোথায় সে গেল? এখন কোথায় আছে? ভালো আছে তো!
৪৪. কালোয়াত কাল
৪৫. দেশসেবার ঝকমারি
৪৬. মোচার ঘণ্ট
৪৭. প্রশ্নের পর প্রশ্ন
৪৮. কথার কথা
৪৯. ক্ষতবিক্ষত
৫০. জ্ঞান দিতে দিতে অজ্ঞান
৫১. জুতোচোর হইতে সাবধান
৫২. পকেটমারি
৫৩. রাজা
৫৪. পলাশ
৫৫. চারমিনার
৫৬. সোনার বালা
৫৭. যা হয়, তা হয়
৫৮. হাতলের লড়াই
৫৯. আকাশ
৬০. সুখ-অসুখ
৬১. পেয়ালা পিরিচ
৬২. কারুর আসার সময় এগিয়ে আসে, কারুর যাবার সময়
৬৩. ভয় পেলে চলবে না
৬৪. আমার সামনে পথ তোমার সামনে দেয়াল
৬৫. রহস্য
৬৬. কাচ
৬৭. অঞ্জলি
৬৮. অঙ্কই ভগবান
৬৯. পুরুষ বাদ
৭০. লাস্ট টার্মিনাস
৭১. ভয়
৭২. ঝালমুড়ি
৭৩. পায়রা
৭৪. বাঘমারি
৭৫. কুশলের সাইকেল
৭৬. নিশির ডাক
৭৭. গোল
৭৮. খাটে বসে খেলা
৭৯. স্বাগত সাতাশি
৮০. মানভঞ্জন পালা
৮১. মইয়ের বদলে বই
৮২. ঘড়ি
৮৩. কী হল!
৮৪. রুপোর মাছ
৮৫. সোনার পালক
৮৬. ইয়েস স্যার
৮৭. নিগ্রহ
৮৮. ধ্যাততেরিকা সংসার
৮৯. ফানুস
৯০. শেষ চুরি
৯১. একটি মেয়ের আত্মকাহিনি
৯২. কে?
৯৩. গুদোমে গুমখুন
৯৪. ডবল দক্ষিণা
৯৫. ভালোবাসার বিষ
৯৬. কেয়ারটেকার
৯৭. হঠাৎ বৃষ্টিতে
৯৮. গণ্ডির বাইরে
৯৯. আলো
১০০. জোকার

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন