সৈকত মুখোপাধ্যায়
বুধোদা ড্রাইভ করছিল। আমি পাশে বসেছিলাম। বসেছিলাম মানে একটু জড়সড় হয়েই বসেছিলাম। ডায়মন্ড হারবার রোড থেকে ডানদিকে টার্ন নিয়ে আমরা এখন ঢুকে পড়েছি কাঁটাপুকুর মর্গের রাস্তায়, যেটার পোশাকি নাম রিমাউন্ট রোড। রাস্তার একদিকে ভারতীয় সেনার বোমা-বারুদ রাখার গুদাম আর অন্যদিকে ক্যালকাটা পোর্ট ট্রাস্টের অফিসারদের কোয়ার্টারস।
রিমাউন্ট রোড ধরে আমরা যেদিকে যাচ্ছি, সেদিকেই ক্যালকাটা পোর্টের কন্টেনার-ইয়ার্ড। এখন বাজে রাত ন’টা। ইয়ার্ডের দিক থেকে একটার পর একটা বিশাল ট্রাক, স্টিলের কন্টেনারগুলোকে বুকে নিয়ে, হু-হু করে ছুটে আসছে। রাতের কলকাতার রাস্তায় ওরাই রাজা। কাউকে পরোয়া করে না।
ষোলো-চাকা, কুড়ি-চাকার দানবিক ট্রাকগুলো যখন পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে তখন মনে হচ্ছে যেন মাটির কাঁপুনিতেই আমরা গাড়ি-সমেত উড়ে গিয়ে পাঁচিলে ধাক্কা খাব। বুধোদাকে মাঝেমাঝেই রাস্তা ছেড়ে পাশের জমিতে নেমে যেতে হচ্ছে, এমনই তাদের আয়তন।
একবার আড়চোখে বুধোদার দিকে তাকালাম। যথারীতি উদ্বেগবিহীন মুখ। মাঝেমাঝে সন্দেহ হয় লোকটার ব্রেনের জায়গায় একতাল বরফ বসানো নেই তো! মিনিট-দশেক উদ্বেগ সহ্য করার পরে আর থাকতে না পেরে বলেই ফেললাম, ‘এত রাত করে এলে কেন বুধোদা? আমরা দিনের বেলায় আসতে পারতাম তো?’
বুধোদা বলল, ‘কেন? তোর কী অসুবিধে হচ্ছে? রাত দেড়টা অবধি তো এমনিতেই মোবাইল নিয়ে খুটুর-খাটুর করিস।’
মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। বললাম, ‘ট্রাকের চাকার নীচে পাঁপড় হয়ে গেলে আর মোবাইল নিয়ে খেলতে পারব না তো। তাই বলছিলাম।’
বুধোদা হেসে ফেলল। রাস্তার দিক থেকে চোখ না সরিয়েই বলল, ‘ব্যাপারটা কী জানিস, রুবিক। যে ছেলেটার সঙ্গে আজ দেখা করতে যাচ্ছি, সে এক অন্ধকারের জীব। দিনের সবসময়, সব জায়গায় সে স্বাধীনভাবে ঘুরতে পারে না। কাজেই তার সঙ্গে দেখা করতে গেলে তার সুবিধে মতন জায়গায়, তার পছন্দমতন সময়েই আমাদের যেতে হবে।’
বলতে বলতেই বুধোদা জি.পি.এস দেখে খুব দ্রুত দু-চারটে বাঁক নিল। মুহূর্তের মধ্যে কোথায় হারিয়ে গেল অত চওড়া রিমাউন্ট-রোড। আমরা একটা ঘিঞ্জি বস্তির মধ্যে ঢুকে পড়লাম। দু-চারটে নেড়িকুকুর গাড়ির পেছনে ঘেউ-ঘেউ করে তাড়া লাগাল। গাড়ির আওয়াজে রাস্তার ধারে শুয়ে-বসে থাকা কিছু লোক একবার মুখ তুলে আমাদের দেখেই আবার যে-যার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
একটু বাদে বস্তিটাও পেরিয়ে গেলাম। দেখলাম সরু রাস্তাটার ওখানেই শেষ। আমাদের সামনে নদী। তাকে হুগলি বলব না ভাগীরথী, নাকি গঙ্গা, আজও সে ব্যাপারে বেশ কনফিউশনে ভুগি। মোটকথা, আমাদের আর কোনো দিকে এগোবার উপায় নেই।
বুধোদা গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করে নেমে পড়ল। বলল, ‘কী মুশকিল! সেন্ট মাইকেলস চার্চ বলতে তো এই জায়গাটাকেই দেখাচ্ছে। কিন্তু চার্চ-টার্চ তো দেখতে পাচ্ছি না কোথাও।’ আমিও গাড়ি থেকে নেমে বুধোদার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম।
ভারি অদ্ভুত জায়গাটা। আমাদের বাঁ-দিকে, কিছুটা দূরেই, আলোয় আলো হয়ে আছে কলকাতা বন্দর। শয়ে-শয়ে ক্রেন আর জাহাজের মাস্তুল ওদিকের আকাশটাকে ঢেকে রেখেছে—যেন ইস্পাত দিয়ে তৈরি একটা পাইন বন। আর আমাদের ডানদিকে দ্বিতীয় হুগলি সেতু। সে-ও সমান আলোকিত এবং অভিজাত। কিন্তু এই দুই আলোর ছটার মধ্যিখানে আর যা-কিছু, সবই গাঢ় অন্ধকারে ঢাকা।
অন্ধকার নদী, অন্ধকার নদীতীর। এমনকী নদীর ওপাড়ও কোনো আলো দেখতে পাচ্ছি না। সেই অন্ধকারের মধ্যে দাঁড়িয়ে ঢেউয়ের ছলাৎছল শব্দ শুনতে-শুনতে বুধোদাকে জিগ্যেস করলাম, ‘এখন তাহলে কী করবে? লোকটাকে একবার ফোন করবে নাকি?’
বুধোদা বলল, ‘করলাম তো। ধরল না?’
‘তাহলে?’
‘তাহলে আবার কী? ওর জন্যে ওয়েট করতে হবে। চল গাড়িতে উঠেই বসি। বড্ড মশা কামড়াচ্ছে।’
গাড়িতে বসে বুধোদাকে বললাম, ‘তুমি কী যেন চেপে যাচ্ছ, বুধোদা। এটা ঠিক নয়। বাড়ি থেকে বেরোবার সময় বলে এলে একজন এজেন্টের সঙ্গে দেখা করেই ফিরে আসবে। ফেরার পথে খিদিরপুরের কোন বিখ্যাত রেস্তোরাঁয় যেন বিরিয়ানিও খাওয়াবে বললে। আমি লোভে পড়ে চলে এলাম। আর এখন তুমি বলছ, লোকটা নাকি অন্ধকারের জীব। যে লোকেশন দিয়েছিল সেটাও খুঁজে পাচ্ছ না। এসব কী, অ্যাঁ?’
আমার কথাগুলোর মধ্যে একটুও মিথ্যে ছিল না। সত্যিই এইটুকু বলে বুধোদা আমাকে পড়ার টেবিলের সামনে থেকে তুলে নিয়ে এসেছিল।
বুধোদা মানে বোধিসত্ত্ব মজুমদার—আমার পাড়াতুতো দাদা। উত্তরপাড়ায় জি. টি. রোডের ওপরে, গঙ্গার ধারে ওদের দেড়শো বছরের পুরোনো প্যালেসের মতন বাড়ি, যার নাম হেমকুঞ্জ। উল্টোদিকে ব্যানার্জীপাড়ায় আমাদের বাড়ি। ছোটবেলা থেকেই হেমকুঞ্জের মাঠের মতন বড় ছাদটায় আমরা ফুটবল-ক্রিকেট খেলেছি। ওই বাড়ির উঠোনে নাটক করেছি। বুধোদার মাকে আমি জ্যাঠাইমা বলে ডাকি। এককথায় হেমকুঞ্জ আমার দ্বিতীয় বাড়ির মতন।
বুধোদা ছোটবেলা থেকেই ভয়ঙ্কর পড়ুয়া। সারাক্ষণই হয় বইয়ের পাতা আর নাহলে ল্যাপটপের স্ক্রিন থেকে কিছু না কিছু পড়ে যাচ্ছে। ওর সঙ্গে দুটো কথা বললেই বুঝতে পারতাম, পৃথিবীর কত বিচিত্র বিষয়ে ওর ইন্টারেস্ট। তার মধ্যে ইতিহাস এবং ভূগোল আছে, চিত্রকলা এবং ভাস্কর্য আছে। সাহিত্য তো আছেই।
আশ্চর্য ব্যাপার, এই বই-পড়ুয়া বোধিসত্ত্ব মজুমদার কিন্তু আবার চরম অ্যাডভেঞ্চার-প্রিয়। মাত্র কুড়ি-বছর বয়স থেকেই বুধোদা পাহাড় আর জঙ্গলে ঘুরতে শুরু করেছে; তাও আবার একা। জিগ্যেস করলে বলত, ‘সঙ্গে লোক থাকলে প্রকৃতির সঙ্গে যোগাযোগ করা যায় না।’ বল তো, ‘একা যদি কখনও কোনো রাতে পাহাড়ি তৃণভূমির মাঝখানে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকিস রুবিক, তাহলে দেখবি, একটু বাদে তারাগুলো তোর হাতের নাগালে নেমে এসেছে। মহাশূন্যের মাঝখান দিয়ে ওদের ছন্দে বাঁধা যাতায়াতের ফলে একটা সিমফনি তৈরি হয়। তুই পরিষ্কার সেই ঈশ্বরীয় সিমফনি শুনতে পাবি।’
বোধহয় ওর এই জ্ঞানপিপাসা আর অ্যাডভেঞ্চার-প্রিয়তাকে মেলানোর জন্যেই বুধোদা মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে একটা ব্যবসা শুরু করল—অ্যান্টিকের ব্যবসা। নাম দিল মহারাজা কালেকশন্স। ও অবশ্য নিজেকে ব্যবসায়ী বলে না। বলে অ্যান্টিক হান্টার।
অ্যান্টিক-হান্টার বোধিসত্ত্ব মজুমদার।
সহজলভ্য অ্যান্টিকে বুধোদার বিশেষ ইন্টারেস্ট নেই। ওই সব প্রাচীন মুদ্রা আর তিব্বতী থাংকা জোগাড় করার জন্যে ওর কর্মচারীরাই রয়েছে। ও ঘুরে বেড়ায় আরও দুর্লভ, আরও অভাবনীয় কিছুর পেছনে। কখনও অমন অ্যান্টিক শিকারে সফল হয়, কখনও হয় না। কিন্তু ওর নিজের কথাতেই, প্রতিবারই ওর ঝুলিতে একটা জিনিস জমা হয়, যার নাম অভিজ্ঞতা।
শেষ কয়েকবছর ধরে এরকম অ্যান্টিক-শিকারের অভিযানে বুধোদা আমাকে ওর সঙ্গী করে নিয়েছে।
আমার ডাকনাম যে রুবিক, সেটা তো ইতিমধ্যেই উল্লেখ করেছি। ভালোনাম মাল্যবান মিত্র। পড়ি উত্তরপাড়া গভর্মেন্ট স্কুলে, ক্লাস ইলেভেনে। স্কুলের ক্রিকেট টিমের ক্যাপ্টেন। পর্বতারোহণের অ্যাডভান্স কোর্স করেছি। ডানপিটে বলে সুনাম আছে আর সেইজন্যেই সঙ্গী হিসেবে বুধোদার আমাকে এত পছন্দ।
অন্ধকার নদীর দিকে তাকিয়ে থাকতে-থাকতে একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম। পাশ থেকে বুধোদা হঠাৎ বলল, ‘এই দরিয়া নামে ছেলেটাকে আমি কিন্তু অনেকদিন ধরেই চিনি।’
আমি বললাম, ‘দরিয়া? মানে যে তোমাকে আজ এখানে আসতে বলেছে?’
‘হ্যাঁ। নামটা বেশ আনকমন না?’
আমি মাথা হেলালাম। বললাম, ‘আনকমন এবং সুন্দর?’
বুধোদা বলল, ‘এমন সুন্দর নামের মালিকটি কিন্তু বন্দর এলাকার মাফিয়া।’
‘দরিয়া একজন মাফিয়া? তুমি তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছ? কেন বুধোদা?’
বুধোদা বলল, ‘একজন মানুষের তো শুধুমাত্র একটাই পরিচয় থাকে না। দরিয়ার সঙ্গে আলাপ হলে দেখবি, ওর চরিত্রের মধ্যেও অনেকগুলো ভাগ আছে। শুধুই কালো নয়। ধূসর থেকে শুরু করে সাদা অবধি অনেকগুলো শেডস।
‘ওর যখন মাত্র আঠারো-বছর বয়স, তখন ওর বাবা মুম্বাইয়ের কিছু ক্রিমিনালের হাতে খুন হন। অথচ তিনি ছিলেন একদমই সাধারণ খেটে-খাওয়া একজন মানুষ।’
আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘তাহলে খুন হলেন কেন?’
‘সেটা আজ ওর সঙ্গে দেখা হলেই জানতে পারবি। এখন শুধু এইটুকু বলে রাখি যে, সেই কালো-দিনগুলো দরিয়া কোনোদিন ভুলতে পারেনি। একটা কমবয়সি ছেলে আর তার মা অসহায়ের মতন পার্টি অফিস থেকে থানা, সর্বত্র ঘুরে বেড়াচ্ছে, কিন্তু কোথাও কোনো সুবিচার পাচ্ছে না। উপরন্তু যারা ওর বাবাকে খুন করেছিল তারাই দিন-দুপুরে ঘরে ঢুকে আসছে, ওকে আর ওর মাকে খুনের হুমকি দিচ্ছে। তাছাড়া তখন ওদের স্থায়ী কোনো রোজগারও ছিল না। সবদিন ভাত জুটছিল না।
‘এই অবস্থায় বেঁচে থাকার একমাত্র যে-রাস্তা, সেটাই নিতে বাধ্য হল দরিয়া। পোর্ট-এরিয়ায় কোনোদিনই ক্রিমিনালের অভাব নেই। সেরকমই এক লিডারের খাতায় নাম লেখাল। প্রোটেকশনও পেল, পয়সাও পেল। তারপরে আরও সাতটা বছর কেটে গেছে। এখন দরিয়ার বয়স পঁচিশ। ও এখন নিজেই এই কাঁটাপুকুর কন্টেনার-ইয়ার্ডের মাফিয়া-লিডার।’
হঠাৎ বুধোদার ফোনটা ভাইব্রেট করে উঠল। ফোনটা কানে নিয়ে কিছুক্ষণ হুঁ হ্যাঁ করে বুধোদা আমাকে বলল, ‘দরিয়া আসছে। আর পাঁচ-মিনিট লাগবে বলল।’
আমি বললাম, ‘তুমি ততক্ষণে ওর সম্বন্ধে আর যা-যা বলার বলে দাও। একটা লোকের সঙ্গে দেখা করতে এসেছি অথচ তার সম্বন্ধে কিছুই জানি না, এটা বেশ অস্বস্তিকর।’
বুধোদা ওর সেই মার্কামারা ফিচেল হাসিটা হেসে বলল, ‘দরিয়া কিন্তু তোর সম্বন্ধে অনেক কিছুই জানে। এমনকী সপ্তদ্বীপার সম্বন্ধে যে তোর একটু ক্রাশ আছে, সেটাও।’
বললাম, ‘কেউ যদি একটা গ্রহ নিয়ে পড়াশোনা করে তাহলে সেই গ্রহের স্যাটেলাইটগুলোর কথাও জেনে যায়। সেইভাবেই দরিয়া নিশ্চয় আমার কথা জেনেছে। তোমার স্যাটেলাইট হিসেবে। আর সপ্তদ্বীপা একটি বিশুদ্ধ আঁতেল মেয়ে। ওর সম্বন্ধে আমার কোনো ক্রাশ নেই। তুমি বরং দরিয়ার কথাটাই শেষ করো।’
বুধোদা আমার পিঠটা আলতো করে চাপড়ে দিয়ে বলল, ‘বেশ। তাই করি। আমার সঙ্গে দরিয়ার আলাপ তিনবছর আগে। মেটিয়াবুরুজে নবাব ওয়াজিদ আলি শাহের এক বংশধরের বাড়িতে নবাব সাহেবের নিজের হাতে লেখা শায়েরির খাতার একটা পাতা ছিল। বুঝতেই পারছিস, জিনিসটা দুর্মূল্য অ্যান্টিক। খবর পেয়ে সেটা কিনতে এসেছিলাম। দরিয়ার কাছে ডিলটার খবর পৌঁছে গেছিল। ও এসে ওর শেয়ার দাবি করল। সেই থেকেই আলাপ।
‘শেয়ার আর শেষ অবধি দিতে হয়নি অবশ্য। ও নিজেও ছিল খুব ভালো স্টুডেন্ট। বিশেষত ইতিহাস ছিল ওর প্রিয় সাবজেক্ট। আমার কাছে শুনেটুনে আর মাঝখানে একবার হায়দ্রাবাদের সালার-জং মিউজিয়ামে ঘুরে এসে অ্যান্টিকের ব্যাপারটায় এমনই ইন্টারেস্ট পেয়ে গেল যে তারপর থেকে ও নিজেই কাজের ফাঁকে-ফাঁকে অ্যান্টিক খুঁজে বার করতে শুরু করল।
ওর কিছু সুবিধেও ছিল। প্রথমত, এই খিদিরপুর মেটিয়াবুরুজ এসব তো আজকের পাড়া নয়। ইতিহাস এখানকার আকাশে-বাতাসে। তার ওপরে দরিয়া জায়গাটাকে নিজের হাতের তালুর মতন চেনে। ওর নেটওয়ার্কও ছড়িয়ে আছে সর্বত্র। কাজেই আশ্চর্য-আশ্চর্য সব জিনিস ও গত তিন বছর ধরে আমার হাতে তুলে দিচ্ছে। তবে অ্যান্টিক সংগ্রহের কাজটা ও একদমই একটা হবি হিসেবে নিয়েছে।
‘এই তিন বছরে আমি বেশ কয়েকবার ওর সঙ্গে মুখোমুখি বসে কথা বলেছি। ফোনে তো প্রায়ই কথা হয়। এইসব থেকে আমার মনে হয়েছে, দরিয়া ঠিক সাধারণ ক্রিমিনাল নয়। ওর মধ্যে একটা রবিনহুড টাইপের ব্যাপার রয়েছে। এটা সত্যি যে, বন্দর-এলাকার এদিকটায় যত কালাধান্দা আছে, দরিয়াকে লাভের হিস্সা না দিয়ে কেউই সেই ব্যবসা চালাতে পারে না। আবার উল্টোদিকে এটাও ঠিক যে, এখানে যত গরিব-দুঃখী আছে, তারাও কোনো-না-কোনো ভাবে ওর কাছে উপকৃত। শিশু কিংবা মহিলাদের ওপরে অত্যাচারের কথা শুনলে ও নিজের দলের লোকেদেরও ক্ষমা করে না। বোঝাই যায়, নিজের যন্ত্রণাময় কৈশোরের কথাটা ও ভুলতে পারেনি।
‘কিন্তু এটা কোনোদিন ভাবিনি যে, একদিন ব্যক্তিগত কারণে ওকে বোধিসত্ত্ব মজুমদারের সাহায্য চাইতে হবে। কিন্তু সেটাই চাইতে হল। পুরো গল্পটা আমিও জানি না। চল, কোথায় নিয়ে যাবে বলছে, সেখানে গেলেই সব জানতে পারব।’
কী বলব বুঝতে পারছিলাম না। চুপ করে বসেছিলাম আর দেখছিলাম একদিকে বন্দরের আলো আর আরেকদিকে দ্বিতীয় হুগলি সেতুর আলোর মালার মাঝখানে জমে-থাকা চাপ চাপ অন্ধকার। মনে হচ্ছিল, কলকাতার মতন যে-কোনো নগরীর ইতিহাসও তো এই। অনেক বিদ্যা, শিক্ষা, গান, কবিতা, চিত্রশিল্পের আলোর আড়ালে চাপা পড়ে থাকা যন্ত্রণা, অশিক্ষা, উপবাস আর খুনখারাপির অন্ধকার।
হঠাৎই ড্রাইভারের সিটের ওদিকে, অর্থাৎ বুধোদার দিকের বন্ধ দরজার ওপরে কয়েকটা টোকার আওয়াজ পেলাম। কখন যে ওখানে একজন এসে দাঁড়িয়েছে বুঝতে পারিনি। হাতের ইশারায় আমাদের সে বাইরে আসতে বলল। আমরা দুজনেই গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম।
.
এই তাহলে দরিয়া? বন্দর এলাকার ত্রাস! অবাক হয়ে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
আমার অবাক হওয়ার যথেষ্ট কারণ ছিল। বলিউড, টলিউড এমনকী দক্ষিণী সিনেমা-টিনেমাতেও গ্যাংস্টারদের যেমন চেহারা দেখে আমি অভ্যস্ত, তার সঙ্গে দরিয়া নামে ছেলেটির বিন্দুমাত্র মিল ছিল না। এর গায়ে সাদা সাফারি-স্যুট নেই, গলায় মোটা সোনার চেন নেই, চোখে শেডস নেই। এর চুলে অন্তত দু-মাস নাপিতের হাত পড়েনি। গালেও খোঁচাখোঁচা দাড়ি। ছোটখাটো চেহারা। হাইট কিছুতেই পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চির বেশি হবে না। গায়ের রং ফর্সা এবং মুখে এমন একটা শান্তভাব রয়েছে যে অনায়াসে কোনো স্কুলের শিক্ষক হিসেবে চালিয়ে দেওয়া যায়।
পোশাক-আশাকও অতি সাধারণ। একটা হাওয়াই শার্ট এবং ট্রাউজার। ওই আবছা অন্ধকারে কোনোটারই রং বুঝতে পারলাম না। কিন্তু খেয়াল করে দেখলাম পায়ের জুতোদুটো একেবারে আপার রেঞ্জের ব্র্যান্ডেড স্পোর্টস-সু। স্বাভাবিক। চিতাবাঘ তার চারটে থাবার যত্নই সবচেয়ে বেশি করে নেয়। শিকার ধরা আর শিকারির হাত থেকে বাঁচা—দুটো কাজেই তার থাবাই তো ভরসা।
পা দেখে নয়। চিতাবাঘের কথাটা মাথায় এসেছিল দরিয়ার চোখদুটো দেখে। একজন গ্যাংস্টারের যাবতীয় লক্ষণ ফুটে উঠেছিল শুধু ওই দুটো চোখে। চিতার মতনই সতর্ক চঞ্চল দুটো চোখ। একমুহূর্তের জন্যেও দুটো চোখের মণি কোনো একটা জায়গায় স্থির হচ্ছিল না। ফলে আমাদের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকলেও, চারপাশটা যে ওর দৃষ্টিসীমার মধ্যেই ছিল সেটা বেশ বুঝতে পারছিলাম। বাকি ছিল ওর পেছনদিকটা, যেদিকটা দেখা কোনো মানুষের পক্ষেই সম্ভব নয়। তবে সেদিকটা আগলাবার জন্যে একজন ছিল।
বস্তির একটা বাড়ির দেয়ালে হেলান দিয়ে খুব ক্যাজুয়াল-ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে ছিল একটি নর-রাক্ষস। সাড়ে ছ’ফিটের ওপরে হাইট। পরনে কার্গো-প্যান্ট আর টাইট টি-শার্ট। দুটোরই রং মনে হল কালো, যদিও অন্য কোনো ডার্ক কালারও হতে পারে। লোকটা দু-হাতের মধ্যে একটা লম্বাটে ব্যাগ এমনভাবে ধরে রেখেছিল যেভাবে কেউ ব্যাগ ধরে না, বন্দুক ধরে। বোঝাই যাচ্ছিল, অত্যন্ত বিপজ্জনক কোনো আগ্নেয়াস্ত্রই রয়েছে ব্যাগটার মধ্যে।
দরিয়া বুধোদার বাড়িয়ে দেওয়া হাতটা নিজের দুই-হাতের মুঠোয় চেপে ধরে বলল, ‘স্যরি স্যার। অনেক দেরি হয়ে গেল। আসলে গত কয়েকদিন ধরে সারাক্ষণ পেছনে ফেউ লেগে আছে। সেগুলোর চোখকে ফাঁকি দিয়ে আসতে গিয়েই দেরি হয়ে গেল।’
বুধোদা জিগ্যেস করল, ‘পুলিশ?’
দরিয়া হেসে ফেলল। বলল, ‘না, স্যার। আমাদের কম্পিটিটর বলতে পারেন।’
‘ওরা সারাক্ষণই তোমাকে এইভাবে ফলো করে?’
দরিয়া বলল, ‘না স্যার। এখনই করছে। সবই বলছি। তবে একজায়গায় বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকাটা সেফ নয়। চলুন হাঁটতে শুরু করি?’
বুধোদা এগোতে গিয়েও দাঁড়িয়ে পড়ল। একবার চিন্তিত মুখে গাড়িটার দিকে তাকাতেই দরিয়া বলল, ‘গাড়ির জন্যে ভাববেন না। নজর রাখার লোক আছে।’
‘কোথায় আছে?’
দরিয়া হাঁটতে-হাঁটতেই উত্তর দিল, ‘বস্তির পেছনদিকের ঘরগুলো দেখেছেন? অন্ধকার জানলাগুলো দেখতে পাচ্ছেন? চলুন, আমি যখন বলছি চিন্তা করবেন না, তখন চিন্তা করবেন না।’
দরিয়াকে মাঝখানে রেখে আমি আর বুধোদা নদীর দিকেই হাঁটতে শুরু করলাম। পেছন-পেছন সেই নর-রাক্ষস ছায়ার মতন আমাদের ফলো করছিল। আমি মনে-মনে যতরকমের অভিশাপের কথা মনে পড়ছিল তার সবক’টাই বুধোদার ওপরে প্রয়োগ করছিলাম। কী দরকার ছিল আজ এরকম একটা জায়গায় আসবার? প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারব বলে তো মনে হচ্ছে না।
হঠাৎই দরিয়ার কথায় চিন্তাটা অন্যদিকে ঘুরে গেল। ও আমাকেই কিছু বলছে।
‘কী বললেন?’ জিগ্যেস করলাম।
‘আমাকে আপনি-আজ্ঞে করতে হবে না। তুমি করেই বোলো। বলছিলাম, ছোটবেলায় গুপ্তধনের গল্প তো পড়েছ নিশ্চয়ই?’
‘হ্যাঁ, অনেক পড়েছি।’
‘মনে হয়নি, যদি ওরকম একটা গুপ্তধন নিজে খুঁজে পাই, তাহলে বেশ হয়? আমার তো হতো।’
‘আমারও হতো। ইনফ্যাক্ট, এখনো হয়।’
দরিয়া আমার দিকে তাকিয়ে হাসল। অন্ধকারের মধ্যেও ওর সুন্দর দু-পাটি দাঁত ঝলমল করে উঠল। বলল, ‘তাহলে আমাকে একটা থ্যাঙ্কস দাও। আমি আজ তোমাকে একটা গুপ্তধনের গল্প শোনাব। খুঁজে বার করতে পারবে কি পারবে না, সেটা তোমার ক্ষমতার ওপরে নির্ভর করছে। তবে আমার ধারণা, পারবে। স্যারের মুখে তোমার অনেক গুণের কথা শুনেছি?’
বুধোদা বলল, ‘দরিয়া আজ স্পেশালি রিকোয়েস্ট করেছিল যেন তোকে সঙ্গে নিয়ে আসি?’
আমি জোর করে একটু হাসবার চেষ্টা করলাম। মনে মনে বুধোদাকে বললাম, ‘তুমি এবং তোমার দরিয়া দুজনেই নিপাত যাও। গুপ্তধন কিংবা পিঠে গুলি কোনোটাই আমার চাই না।’
দরিয়া বলল, ‘স্যারের মুখে শুনেছ কিনা জানি না, আমার বাবা আজ থেকে সাত-বছর আগে এখানেই খুন হয়েছিলেন। তখন আমার বয়স ছিল আঠারো বছর। তার মাত্র এক-বছর আগে বাবা মুম্বাই থেকে কলকাতায় ফিরেছিলেন। উনি মুম্বাইয়ে ফিশিং-ট্রলারে, মানে মাছ ধরার ছোট জাহাজে কাজ করতেন।
‘আমি নিশ্চিত, মুম্বাই থেকেই বাবার খুনিরা ওঁকে ফলো করে এসেছিল। ওরা বাবার কাছ থেকে কিছু একটা বার করার চেষ্টা করছিল। সেটা কী আমরা জানতাম না। ইনফ্যাক্ট এখনো জানি না। তবে জিনিসটা নিশ্চয় অসম্ভব দামি কিছু হবে। নাহলে সাত-বছর ধরে ওরা মনে রাখত না। সাত-বছর বাদে আবার ফাদার রেনল্ডের পেছন পেছন এখানে ফিরে আসত না?’
আমি আর বুধোদা একসঙ্গেই জিগ্যেস করলাম, ‘ফাদার রেনল্ড কে?’
‘তিনিই একমাত্র মানুষ যিনি মুম্বাইয়ে কী হয়েছিল সেটা দেখেছিলেন। এখন তাঁর কাছেই যাচ্ছি। বাকিটা ওঁর কাছেই শুনবেন।’
মিনিট তিনেক হাঁটার পরে হঠাৎ দরিয়া রাস্তা ছেড়ে ডানদিকে, মানে নদীর দিকে টার্ন নিল। বলল, ‘আসুন স্যার, পৌঁছে গেছি।’
অন্ধকারের মধ্যে খেয়াল করিনি, ওখানে অনেকখানি জংলা জমির মাঝখানে একটা অদ্ভুত শেপের বাড়ি দাঁড়িয়েছিল। বাড়িটা একতলা, কিন্তু এখনকার যে-কোনো দোতলা বাড়ির সমান উঁচু। কোনো এককালে দেয়ালে সাদা চুনকাম করা ছিল। কিন্তু এখন কালচে শ্যাওলার ছোপে সেই সাদা রং ঢাকা পড়ে গেছে আর সেইজন্যেই আরওই অন্ধকারে মিশে গেছে।
বাড়িটার দিকে তাকিয়ে ওটার বয়স আন্দাজ করার চেষ্টা করছিলাম। একশো? উঁহু। আরও বেশি। যেখানে-যেখানে প্লাস্টার খসে গেছে, সেখানে-সেখানে পুরোনো-আমলের পাতলা ইট দেখতে পাচ্ছিলাম। তাছাড়া ওই উচ্চতার ফ্রেঞ্চ-উইন্ডো, প্রতিটি জানলা আর দরজায় অমন কাঠের কপাট, খিলান, পঙ্খের কাজ আর রট-আয়রনের রেলিং—ওসব দেখা যায় কলকাতার প্রথম যুগের প্রাসাদগুলোয়।
বুধোদা মন দিয়ে বাড়িটাকে দেখছিল। একটু বাদে বলল, ‘এই তাহলে সেন্ট মাইকেলস চার্চ?’
দরিয়া উত্তর দিল, ‘হ্যাঁ স্যার।’
একটা চুড়ো থাকার কথা তো। পিনাকল। সেটা কোথায় গেল?’
‘চুড়োটা আমরাও দেখিনি। শুনেছি, উনিশশো-আশি সালে ভেঙে পড়েছিল। তারপর আর সারানো হয়নি। বাকি গির্জাটার হালও খুব খারাপ। যে-কোনোদিন ভেঙে পড়ে যাবে। আসুন স্যার আমার পেছনে-পেছনে। সাবধানে আসবেন। জমিটা পেছল আছে।’
সামনের বিশাল দরজাটা এমনভাবে বন্ধ করা ছিল যে, দেখেই বোঝা যাচ্ছিল বহুবছর ওটা খোলা হয়নি। আমার হাতের চেয়েও বড় লোহার কব্জাগুলো মরচে ধরে জ্যাম হয়ে গিয়েছিল। জায়গায় জায়গায় কাঠের টুকরো ভেঙে পড়েছে। তাছাড়া এই বর্ষাকালে অজস্র বুনো লতা লতিয়ে উঠেছিল দরজাটার গায়ে।
আমরা ঢুকলাম বাড়িটাকে অনেকখানি বেড় দিয়ে পাশের একটা ছোট দরজা দিয়ে। দরজাটা ভেজানো ছিল; একটু ঠেলতেই খুলে গেল।
বুধোদা বলল, ‘তুমি বলছ, এখানে একটা অত্যন্ত দামি জিনিস আছে। সেটার জন্যে মুম্বাই-গ্যাং আবার এখানে হাজির হয়েছে। তাহলে দরজা এভাবে খোলা রয়েছে কেন?’
দরিয়া বলল, ‘ওরা একদফা তল্লাশি সেরে গেছে তো। তাই…।’
‘ওরা মানে?’
‘ওই যে, মুম্বাই গ্যাং। বাবাকে যারা খুন করেছিল।’
‘ও! পায়নি কিছু?’
‘না স্যার। সেইজন্যেই এখানে ওরা আর ফিরবে না বলেই মনে হয়।’
‘তাহলে আমরাই বা এখানে কেন এলাম?’
‘তার কারণ, ফাদার রেনল্ডের দৃঢ় বিশ্বাস, বাবা যদি মুম্বাই থেকে কোনো দামি জিনিস নিয়ে এসে থাকেন, তাহলে সেটা তিনি এই চার্চের মধ্যেই প্রথমে রেখেছিলেন। সূত্র কিছু থাকলে এখানেই থাকবে।
আমারও সেরকমই বিশ্বাস। আট-বছর আগে সেই দিনটায় ফাদার রেনল্ড আর আমার বাবা হাওড়া স্টেশন থেকে সোজা এই চার্চেই এসে উঠেছিলেন। যদিও মাত্র বিশ মিনিটের দূরত্বে আমি আর মা ছিলাম, তবু আমরাও বাবার আসার খবর পাইনি পুরো এক সপ্তাহ। পুরো এক সপ্তাহ এই চার্চে কাটিয়ে, তারপর বাবা বাড়ি ফিরেছিলেন। এসব কথা এতদিন জানতাম না। এখন ফাদার রেনল্ডের মুখে শুনে মনে হচ্ছে, ঠিকই। বাবা জিনিসগুলোকে লুকিয়ে রাখার জন্যে ওই এক সপ্তাহ সময় নিয়েছিলেন।’
বুধোদা বলল, ‘আর যদি তা না হয়? যদি ওই এক সপ্তাহের মধ্যে তিনি সেটা বিক্রি করে দিয়ে থাকেন?’
দরিয়া ম্লান হেসে বলল, ‘তাহলে কি আর মানুষটা গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে কাপড় কাটার চাকরি নিতেন, না আমরাই ওই ভাঙা বাড়িতে পড়ে থাকতাম? তাছাড়া, তারপরেও যখন খুনিরা বাবাকে ক্রমাগত ফলো করে গেছে, তার মানে ওরাও জানত জিনিসটা বাবার কাছেই রয়েছে। কোথায় আছে সেটা বাবা ওদের বলেননি বলেই ওদের হাতে খুন হয়েছিলেন।’
বুধোদা বলল, ‘তোমার যুক্তিতে কোনো ভুল পাচ্ছি না। তবু এখানে ঢোকার আগে তোমাকে একটা কথা পরিষ্কার বলে রাখি। বোধিসত্ত্ব মজুমদার আজ অবধি কোনো চোরাই মালের সন্ধান পেয়ে পুলিশকে জানায়নি এরকম হয়নি। এক্ষেত্রেও যদি দেখি জিনিসটার আসল মালিক তোমার বাবা নন, অন্য কেউ, তাহলে কিন্তু আমি তাকেই ফিরিয়ে দেবার চেষ্টা করব।’
দরিয়া মাথা নীচু করে আস্তে-আস্তে বলল, ‘আমাকে দেখে আমার বাবার সম্বন্ধে কোনো ধারণা করবেন না, স্যার। তিনি ছিলেন সৎ ধর্মভীরু একজন মানুষ। নিজের পরিশ্রমের অন্ন ছাড়া আর কিছু কোনোদিন মুখে তোলেননি।’ বলতে বলতে দরিয়ার গলাটা ধরে এল।
বুধোদা সঙ্গে সঙ্গে ওকে বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে বলল, ‘আমি ওঁকে অসৎ বলতে চাইনি, দরিয়া। আমাকে ভুল বুঝো না। অনেক মূল্যবান জিনিসের উৎস সহজে খুঁজে পাওয়া যায় না। আমি সেই কথাই বলছিলাম।’
হঠাৎ গির্জার ভেতরে একটা আলো জ্বলে উঠল। দেখলাম আমাদের গলার আওয়াজ পেয়েই সম্ভবত এক বৃদ্ধ ভেতরের ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছেন। তিনিই সুইচ টিপে আলো জ্বালিয়েছেন।
ঘরটার উচ্চতা কোনো আধুনিক ঘরের থেকে অনেকটাই বেশি, কিন্তু দৈর্ঘে-প্রস্থে কোনোদিকেই ত্রিশ ফুটের বেশি হবে না। ইতস্তত খান-দশেক ভাঙা আধভাঙা কাঠের চেয়ার পড়েছিল। দেয়ালে কিছু ফ্রেমে বাঁধানো ছবি, তার মধ্যে অনেকগুলোই পেরেক খুলে ঝুলছে। এটাই বোধহয় এই গির্জার প্রার্থনা-কক্ষ।
যেমন সাধারণ গির্জা, তেমনই সাধারণ তার প্রার্থনা-কক্ষ। সারা দেয়ালে নোনার দাগ। কাচের শার্সির অর্ধেক ভাঙা। আর ‘পুলপিট’, অর্থাৎ যে-বেদির ওপরে যিশু কিংবা মা মেরির ছবি, মূর্তি ইত্যাদি থাকে—সেটার হালও খুব করুণ। কয়েকটা মেটালের মোমদান, জলপাত্র আর বাইবেল রাখার ব়্যাক ছাড়া আর কিছুই ছিল না সেখানে।
দেখে মনে হল আজ পরিত্যক্ত হয়েছে বলে নয়, এই গির্জাটার কোনোকালেই তেমন কোনো কৌলীন্য ছিল না। হয়তো কলকাতা বন্দরে যে ভিনদেশি নাবিকেরা নামতো, তাদের প্রার্থনার জন্যে একদিন এই গির্জা বানানো হয়েছিল। সাধারণ মাঝি-মাল্লাদের উপাসনালয়, সে আর অসাধারণ হবে কেমন করে?
ওই সৌম্য বৃদ্ধই নিশ্চয় ফাদার রেনল্ড। শ্বেতাঙ্গ, ছ-ফুটের ওপরে হাইট। মাথা জোড়া টাক। বয়স সত্তর-পঁচাত্তর হবে। চোখের নীল মণিদুটো বয়সের ভারে একটু ঘোলাটে হয়ে গেছে। গায়ে একটা রংচটা স্লিপিং-গাউন। পায়ে রাবারের চটি।
দরিয়াকে দেখে তাঁর মুখে অকৃত্রিম আনন্দের হাসি ফুটে উঠল। পরিষ্কার বাংলায় বললেন, ‘কীরে বেটা, এত দেরি হল যে আসতে। বোধিসত্ত্ববাবু আর রুবিককে তো আবার সেই উত্তরপাড়া অবধি ফিরতে হবে, নাকি?’
দরিয়া মুচকি হেসে বলল, ‘ফিরতেই হবে তার তো মানে নেই। সেরকম হলে দু-পা দূরেই তো তাজবেঙ্গল। সেখানেই ওঁরা রাতটা থেকে যাবেন।’
‘আর তুই কোথায় থাকবি? তাজের উল্টোদিকে?’
ফাদারের রসিকতায় আমরা সকলেই হেসে উঠলাম। তাজবেঙ্গলের উল্টোদিকে যে চিড়িয়াখানা সেটা সবাই জানে। এটাও বুঝলাম, দরিয়ার সঙ্গে ফাদারের সম্পর্কটা প্রায় দাদু-নাতির সম্পর্কের মতোই।
দরিয়াও হাসতে-হাসতে ফাদারের হাতে একটা ওষুধের শিশি ধরিয়ে দিয়ে বলল, ‘ক’দিন থেকে আপনার কাশিটা আবার বেড়েছে। এই কাফসিরাপটা নিয়ে এলাম। খাবেন।’
উনি দরিয়ার মাথায় হাত দিয়ে বললেন, ‘ঈশ্বর তোর মঙ্গল করুন। তবে এ অসুখের একটাই দাওয়াই, বুঝলি? কবরের মাটি। যাই হোক, তুই চেয়ারগুলো ঝেড়েঝুড়ে ভদ্রলোকদের বসা। নিজেও বোস।’
আমরা সবাই বসার পরে দরিয়া ওঁর সঙ্গে ফর্মালি আলাপ করিয়ে দিল, ‘ইনি ফাদার রেনল্ড। ওঁর আসল কাজের জায়গা মুম্বাইয়ে। তবে আমার জন্যেই এখন কিছুদিন এখানে এসে উঠেছেন। কত কষ্ট করে আছেন বুঝতেই পারছেন। জায়গাটা তো জঙ্গল হয়ে পড়েছিল। সাপ-খোপ, বিছে…’
দরিয়ার কথায় বাধা দিয়ে ফাদার বললেন, ‘ওর কথায় কান দেবেন না। আমি আসছি শুনে একদিনের মধ্যে দরিয়া সব জঞ্জাল সাফ করিয়ে দিয়েছে। এমনকী ভেতরের ঘরে গেলে দেখবেন, এই সন্ন্যাসীর জন্যে একটা নরম ফোমের বিছানা অবধি সেট করে দিয়েছে। কী আর বলব। ওর বাপের মতনই দিলদার হয়েছে?’
এই বলে ফাদার রেনল্ড কিছুক্ষণ মাথা নীচু করে বসে রইলেন। তারপর হঠাৎ মুখ তুলে আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘দরিয়া আমাকে একটা দায়িত্ব দিয়েছে। সেটা আর কিছুই না, আপনাদের আজ কেন এখানে ডেকে এনেছি, সেটা ব্যাখ্যা করে বলা।’
বুধোদা বলল, ‘আপনি ডেকেছেন? ফাদার, আমি এতক্ষণ ভাবছিলাম দরিয়া নিজেই…।’
উনি বললেন, ‘না, আমিই ওর মুখে আপনার কথা শুনে ওকে বলেছিলাম, ওহে গর্দভ। বোধিসত্ত্ববাবু তোমাকে ভালোবাসেন বলছ। অথচ তোমার বাবা তোমার জন্যে যে মূল্যবান বস্তুটি লুকিয়ে রেখে গেছেন, তার খোঁজটা ওঁকে দিয়ে করাবার বুদ্ধি তোমার মাথায় আসছে না?
‘তো, তাতে এই গাধাটা বলে কী, ফাদার আমার খুব সঙ্কোচ হয়। জানেন বোধিসত্ত্ব, আমি লোকের মুখে শুনেছি এই দরিয়া নাকি ভালো ছেলে নয়। মানুষ ওকে ভয় পায়। এই সবই হয়তো সত্যি। কিন্তু এটাও সত্যি যে, দরিয়ার ভেতরে আরেকটা দরিয়া রয়েছে, যে একেবারেই অন্যরকম মানুষ।
‘ওই যে পেছনের বস্তিটা পেরিয়ে এলেন, ওই বস্তির প্রায় প্রত্যেকটা বাড়িতে দরিয়া হচ্ছে ভগবান। যতরকম ভাবে পারে, ও ওদের সাহায্য করে। কিন্তু নিজের জন্যে কারুর কাছে কিছু চাওয়া ওর ধাতে নেই। সেটা অবশ্য স্বাভাবিক। আট-বছর আগে ওর বাবাও তো নিজের মুখে বলতে পারেনি, ফাদার আমাকে বাঁচান। আমিই সেদিন ওর বিপদ বুঝে যা করার করেছিলাম।
‘আপনি শুনেছেন নিশ্চয়ই, দরিয়ার বাবা দীনেশ মুম্বাইয়ের এক মাছধরা ট্রলারে চাকরি করত। একেবারেই গতর খাটানোর কাজ। রোদ, বৃষ্টি, হিম-কুয়াশা কিংবা ঝড় সবকিছুর মধ্যে খোলা ডেকে দাঁড়িয়ে মেশিন-চালিত ফিশ-নেট অপারেট করত দীনেশ। গভীর সমুদ্র থেকে প্রথমে সেই বিশাল জাল টন টন মাছ টেনে নিয়ে ট্রলারের গায়ে এসে লাগত। তারপর ক্রেনে করে সেই মাছভর্তি জাল তুলে নেওয়া হতো ট্রলারের ডেকে। অল্প বাছাইয়ের পরে ডেকের নীচের কোল্ড-স্টোরেজে সেই মাছ খালি করে আবার জাল ফেলা হতো সমুদ্রে। সেই কাজটাই করত দীনেশ। একা নয় অবশ্যই, সঙ্গে আরও দশ-বারোজন মাছুয়া থাকত।
‘আমি যখন ধর্মপ্রচারের জন্যে ভারতে এসেছিলাম, তখনই দীনেশের সঙ্গে আমার আলাপ। ও সময়-সুযোগ পেলেই আমাদের চার্চে প্রার্থনা জানাতে আসত। তখন ওর বয়স বোধহয় চল্লিশের একটু ওপরে।
‘আমি নিজেও কয়েকবার ওর আমন্ত্রণে সেই ট্রলারে করে পনেরো-দিন কিংবা একমাসের জন্যে সমুদ্রযাত্রা করেছি। বুঝতেই পারছেন, নিজের চোখে ওকে কাজ করতে দেখেছিলাম বলেই এত ডিটেলে আপনাকে ওর কাজের ধরণটা বলতে পারছি।
‘সে যাই হোক। তখনই একটা কথা বুঝেছিলাম। বুঝেছিলাম কাজ করতে-করতে দীনেশ যেভাবে সমুদ্রকে চিনে নিয়েছে, সেটা অনেক বুড়ো মাছুয়ার কাছেও স্বপ্ন। এত বড় সমুদ্র। তার কোথায় কখন মাছের ঝাঁক জলের ওপরতলায় ভেসে উঠছে সেটা বুঝতে না পারলে তো সারাদিন জাল টানলেও মিলবে লবডঙ্কা। ঋতু অনুযায়ী, হাওয়ার গতিপথ অনুযায়ী, জলের টেম্পারেচার অনুযায়ী মাছেদের গতিপথ বদলে যায়। আর ওই মাছের ঝাঁকের মতিগতি বোঝার কোনো যন্ত্র নেই। অন্তত তখনও অবধি ছিল না। ওটার জন্যে জেলেদের বংশ পরম্পরায় অর্জিত গোপন হিসেবনিকেশের ওপরেই নির্ভর করতে হতো।
‘দীনেশ ছিল এ-ব্যাপারে মাস্টার। এক বৃদ্ধ মেট ওকে নিজের ছেলের মতন ভালোবাসতেন। তিনিই দীনেশকে এসব শিখিয়েছিলেন। তিনি নাকি আবার বহুদিন জাপানের তিমি শিকার করার জাহাজে কাজ করেছিলেন। মোদ্দা কথা হচ্ছে, দীনেশকে নিয়ে তখন বোম্বের বিভিন্ন ট্রলারের মালিকদের মধ্যে টানাটানি চলত। দীনেশ ট্রলারে থাকা মানেই মাছের আমদানি দ্বিগুণ হয়ে যাওয়া। তাতে যে দীনেশ বড়লোক হয়ে গিয়েছিল তা কিন্তু ভাববেন না। বড়লোক হতো মালিকরা। ও হয়তো বাঁধা-মাইনের ওপরে আর দু-এক হাজার টাকা বেশি পেত। তাতেই ও খুশি ছিল। ও কেবলই বলত, ফাদার, যদি দেওয়ার হয় ভগবান আমাকে ঠিক দেবেন।
‘ওই সময়ে টানা পনেরো বছর দীনেশের সঙ্গে আমার যোগাযোগ ছিল। একধরনের বন্ধুত্বই গড়ে উঠেছিল আমাদের মধ্যে। জানতাম কলকাতায় ওর স্ত্রী আর একটা বাচ্চা ছেলে আছে। বছরে দু-বার ও কলকাতা থেকে ঘুরে যেত আর আমার কাছে গল্প করত দরিয়া কত বড় হল, দরিয়া পড়াশোনায় কত ভালো হয়েছে, স্ট্যান্ড করেছে, এইসব। কেবলই বলত, যদি নিজের একটা ট্রলার কেনার মতন টাকা থাকত ফাদার, আর একটা ছোট বাড়ি, তাহলে বউ আর ছেলেকে এখানে নিয়ে চলে আসতাম।
‘জানতাম এটা ওর অসম্ভব স্বপ্ন। মুম্বাইয়ের মতন কস্টলি জায়গায় একটা ট্রলার আর একটা বাড়ি কিনতে গেলে ওর মতন মাছমারাকে লটারির ফার্স্ট-প্রাইজ পেতে হবে। তাছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না।
‘তারপর হঠাৎই একদিন সন্ধেবেলায় ভয়ঙ্কর উত্তেজিত হয়ে ও দৌড়োতে-দৌড়োতে আমাদের গির্জায় এসে ঢুকল। তার আগে দিন পনেরো আসেনি। বলেই গিয়েছিল সমুদ্রে যাচ্ছে, আসতে পারবে না। সেদিন ওর পরনে ছিল ট্রলারের ইউনিফর্ম—ঘামে আর মাছের আঁশটে জলে ভিজে সপসপ করছে। তার আগে কিন্তু কোনোদিন দীনেশ এমন নোঙরা পোশাকে গির্জায় ঢোকেনি। কাজ থেকে ফিরে স্নান করে, পরিষ্কার জামাকাপড় পরে তবেই গির্জায় পা দিত।
‘গির্জায় ঢুকে ও কিন্তু প্রেয়ার হলের দিকে গেল না। চলে এল পেছনের বাগানে, আমাদের যাজকদের থাকার জায়গায়। শুধু তাই নয়, ও সোজা আমার ঘরের দরজা ঠেলে ঢুকে পড়ল। আমি অবাক হয়ে ওকে লক্ষ করছিলাম। দেখলাম ও দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে পাল্লার ফাঁক দিয়ে বাইরে তাকিয়ে কী যেন দেখছে।
‘আমি বললাম, কী হয়েছে দীনেশ?
‘ও বলল, ফাদার। আপনাকে বলেছিলাম না, আমি যদি ভালোমানুষ হই, আমি যদি জীবনে কারুর অমঙ্গল না চেয়ে থাকি, তাহলে ঈশ্বর আমার যা প্রয়োজন তা আমাকে দেবেন। দিয়েছেন ফাদার। ঈশ্বর আমাকে দিয়েছেন। কিন্তু ওরা সেটা আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে চাইছে। আমি বললাম, শান্ত হয়ে বসো তো। বলো কী পেয়েছ। ও বলল, না। আপনাকে বলব না। বললে আপনারই বিপদ বাড়বে। আমি আর আপনার কাছে আসব না। আমি পালাই ফাদার, পালাই।
‘এই বলে যেমন এসেছিল, তেমনই পাগলের মতন বেরিয়ে গেল।
‘তিনদিন বাদে খবর পেলাম, ও বাঁধের ওপর থেকে পড়ে গিয়ে পাথরে লেগে মাথা ফাটিয়েছে। সরকারি এক হাসপাতালে ভর্তি আছে, আমাকে খবর দিতে বলেছে।
‘শুনেই দৌড়ে গেলাম। মাথায় মস্ত এক ব্যান্ডেজ নিয়ে শুয়েছিল। আমি বেডের পাশে বসে হালকা মুডেই বললাম, তুমি তো নেশাভাং করো না। বাঁধের রাস্তা ধরে তোমাদের দু-বেলা যাতায়াত। সেখান থেকে আজ পা পিছলোল কেমন করে?
‘ও বলল, পা পিছলোয়নি তো। ওরা মেরে মাথা ভেঙে দিয়েছে। বলেছে, হাসপাতাল থেকে বেরোলে খুন করবে, যদি জিনিসটা ওদের হাতে তুলে না দিই।’
বুধোদা চেয়ারে খাড়া হয়ে বসল। আমিও। একবার দরিয়ার দিকে তাকালাম। দেখলাম ও মাথা নীচু করে নখ খুঁটছে। অর্থাৎ এই সবই ওর জানা। সম্ভবত ফাদার রেনল্ডের কাছ থেকেই শুনেছে।
বুধোদা বলল, ‘কিন্তু জিনিসটা কী, সেটা কোথায় লুকিয়ে রেখেছেন, সেসব কিছুই দীনেশবাবু আপনাকে বললেন না!’
ফাদার বললেন, ‘আমি জিগ্যেস করেছিলাম। ওর সেই এক-কথা। আপনি জানা মানেই আপনার বিপদ বাড়া। আপনাকে বলব না।’
‘তারপর?’ বুধোদা জিগ্যেস করল।
‘সব শোনার পর আমিই ওকে পালাবার প্ল্যান দিলাম। আমাদের চার্চের একটা প্রোগ্রাম ছিল, শহরের কিছু সরকারি হাসপাতালে গরিব পেশেন্টদের জন্যে ফল, মিষ্টি এইসব পৌঁছে দিতাম। দীনেশ যে হাসপাতালটায় ছিল, সেই হাসপাতালেও প্রতিদিন সকালে খাবার সাপ্লাই করার ঢাকা-ভ্যানটা আসত। আমি ডাক্তারবাবুকে বলে-কয়ে একদিন আগে ওর ছুটি করিয়ে নিলাম। তারপর সকালেই ওকে ভ্যানে চাপিয়ে নিয়ে চলে গেলাম বোম্বে রেলস্টেশনে। সেখান থেকে আমরা নির্বিঘ্নেই কলকাতায় পৌঁছলাম। কোনো সমস্যা হয়নি।’
বুধোদা বলল, ‘আমরা মানে? আপনি দীনেশবাবুর সঙ্গে ছিলেন?’
ফাদার রেনল্ড বললেন, ‘হ্যাঁ, তা তো ছিলামই। অমন আহত অসুস্থ একজন লোক একা অতটা ট্রেনজার্নি করবে কেমন করে?’
বুধোদা বলল, ‘তারপর?’
‘হাওড়া স্টেশনে নেমে দীনেশ বলল, আমি এখন বাড়ি যাব না। কিছুদিন আমাকে আশ্রয় দিন। আর নাহলে কিছু টাকা ধার দিন। কোনো হোটেলে গিয়ে উঠি।
‘আমি বললাম, ঠিক আছে। চলো, তোমার বাড়ির কাছেই তো যাচ্ছি। আমাদের সেন্ট মাইকেলস চার্চ আছে ওখানে। যদিও অ্যাবানডনড, তবু তোমার কাছাকাছি থাকব বলে আমি ওখানকার চাবি নিয়ে এসেছি। ও হ্যাঁ। আমি চাবির একটা ডুপ্লিকেট তোমাকে দিয়ে যাব। তুমি বাড়িটা মাঝেমধ্যে একটু পরিষ্কার-টরিষ্কার করাবে। আমি ওখান থেকে খরচা পাঠিয়ে দেব।
‘ও একটু চিন্তা করে বলল, এক সপ্তাহের বেশি থাকব না ফাদার। এক-সপ্তাহের মধ্যে মাথার ব্যান্ডেজটা খুলে ফেলতে পারব। তাহলে বাড়ির লোকেরা আমাকে দেখে চমকাবে না।
‘আমি শুনে একটু হেসেছিলাম শুধু। আপনি তো নিশ্চয় জানেন বোধিসত্ত্ব, আমাদের মতন পাদ্রিদের দেখতে বোকাসোকা হলেও, আমাদের বুদ্ধির অভাব হয় না। জি. কে. চেস্টারটনের ফাদার ব্রাউনের গল্পগুলো পড়লেই সেটা বুঝতে পারবেন।’
ফাদারের কথা শুনে আমরা তিনজনই হেসে ফেললাম। বুধোদা বলল, ‘ফাদার রেনল্ড! আপনাকে দেখতে অত্যন্ত শার্প। মোটেও বোকাসোকা নয়। কিন্তু এ-প্রসঙ্গ আনছেন কেন?’
ফাদার বললেন, ‘আনছি এই-কারণে যে, দীনেশ ভেবেছিল আমি বিশ্বাস করে নেব মাথায় ব্যান্ডেজ আছে বলেই ও বাড়ি ফিরছে না। আচ্ছা, ও যে ওর সেই দামি জিনিসটি লুকোনোর জন্যে কলকাতার এখানে-ওখানে নিজের কাঁধব্যাগটা নিয়ে সারাদিন ঘুরে বেড়াচ্ছে সেটা আমি বুঝব না? বলুন তো?’
‘তারপর কী হল?’ আমি আর ধৈর্য ধরতে পারছিলাম না।
ফাদার বললেন, ‘ঠিক এক-সপ্তাহের মাথাতেই দীনেশ ব্যান্ডেজ খুলে, চুলটুল কেটে, দাড়ি কামিয়ে হাজির। সাতসকালে বেরিয়ে গিয়েছিল। ফিরল দুপুরে। কয়েকটা বড় মোমবাতি কিনে এনেছিল। ভক্তিভরে ওই পুলপিটের মোমদানিতে সেগুলোকে রেখে জ্বালিয়ে দিল। হাঁটু মুড়ে বসে প্রার্থনা করল। তারপর আমাকে বলল, চলুন ফাদার। আজ দুপুরের খাবারটা আমার বাড়িতেই খাবেন।
‘তাই শুনে আমি লাফিয়ে উঠলাম। বললাম, তুমি বাড়ি যাচ্ছ? তাহলে আমিও সন্ধের ট্রেনটা ধরে নিই দীনেশ। তুমি কিছু মনে কোরো না। মুম্বাই থেকে জরুরি কল এসেছিল, তোমাকে বলিনি। ইথিওপিয়ায় মড়ক লেগেছে। আমাকে একটা টিম নিয়ে সেখানে যেতে হবে। তবে কথা দিচ্ছি, আবার যখন ভারতে ফিরব, প্রথমেই আমি কলকাতায় আসব। তোমার বউ-বাচ্চার সঙ্গে দেখা করে যাব।
‘দীনেশ তাই শুনে কেঁদে ফেলল। আমার সম্বন্ধে অনেক ভালো-ভালো কথা বলল। যারা নিজেরা ভালো, তারা অন্যদেরও ওইরকম ভালোই দেখে।
‘যাই হোক, ইথিওপিয়ায় চলে যাওয়ার পর দীনেশের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। মুম্বাইয়ে ফিরেছি মাত্র গত মাসে। ফেরার পর থেকেই মনে হচ্ছিল দীনেশের সঙ্গে একবার দেখা করে আসি। ভেবেছিলাম, এসে দেখব ও সেই ঈশ্বরের দানের কল্যাণে অবস্থা ফিরিয়ে নিয়েছে। ট্রলার কিনেছে, বাড়ি কিনেছে। স্বপ্নেও ভাবিনি যে এমন দুঃসংবাদ অপেক্ষা করছে আমার জন্যে।’
ফাদার রেনল্ড মুখটা নামিয়ে নিলেন, সম্ভবত চোখের জল আড়াল করার জন্যেই। আমরাও আর কী বলব ভেবে পাচ্ছিলাম না।
কিছুক্ষণ বাদে বুধোদা বলল, ‘ফাদার, কয়েকটা কথা জিগ্যেস করি। আপনার কথা থেকে মনে হচ্ছে, অন্তত কয়েকটা দিন দীনেশবাবুর সেই গুপ্তধন এই চার্চের মধ্যেই ছিল। আপনিও ছিলেন এখানে। আপনার কোনো আইডিয়া নেই, জিনিসটা কী?’
ফাদার রেনল্ড খুব পরিষ্কার গলায় বললেন, ‘না। কারণ, আমার সামনে দীনেশ একবারও ওর সেই কালো কাঁধব্যাগটা খোলেনি। আর ও নিজে থেকে না দেখালে আমি চুরি করে ওর ব্যাগ খুলে দেখব, এ তো অসম্ভব।’
‘ঠিকই। তবু কোনো আইডিয়া? জিনিসটার শেপ, সাইজ?’
ফাদার রেনল্ড যা উত্তর দিলেন তাতে আমাদের তিনজনের কারুরই বুঝতে অসুবিধে হল না যে, ভদ্রলোক ইচ্ছে করলে সত্যিই ফাদার ব্রাউনের মতন ডিটেকটিভ হয়ে উঠতে পারতেন। অসামান্য পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা এবং স্মৃতিশক্তি ওঁর।
উনি বললেন, ‘বাইরে থেকে ব্যাগটা দেখে যা-যা মনে হয়েছিল, বলি। প্রথমত ভেতরের জিনিসটা ভঙ্গুর ছিল না। যদি তাই হতো, তাহলে দীনেশ ওটাকে কাঁধ থেকে মেঝেতে নামানোর সময় সাবধানতা নিত।
‘দুই, জিনিসটার আয়তন ছিল ধরুন তিনটে একপাউন্ড পাঁউরুটির ওপরে আরও তিনটে একপাউন্ড রুটি যদি সাজিয়ে রাখেন, তাহলে যতটা আয়তন হবে, ততটাই। ওর কাঁধব্যাগটায় বড়জোর অতটুকু মালই ধরত।
‘তিন, জিনিসটার ওজন ছিল যথেষ্ট। ব্যাগটা ওঠানো নামানোর ধরন দেখেই বোঝা যেত।’
বুধোদা দাড়ির মধ্যে আঙুল চালাতে চালাতে বলল, ‘আপনি যা যা বললেন, তা নোটের বান্ডিলের সঙ্গে খুব সুন্দর মেলে। তবু ধরে নিচ্ছি নোটের বান্ডিল ছিল না, কারণ তাহলে কাঁধে ওই ব্যাগ নিয়ে দীনেশবাবু ট্রামে বাসে চেপে ঘোরার সাহস পেতেন না। তাহলে কী ছিল এবং সেটা উনি কোথায় রাখলেন?’
আমি বললাম, ‘সোনার বাট হতে পারে কি?’
বুধোদা বলল, ‘অসম্ভব। সোনার মাস-ডেনসিটি নাইনটিন পয়েন্ট থ্রি গ্রাম পার কিউবিক সেন্টিমিটার। যে সীসেকে আমরা প্রচণ্ড ভারী ধাতু বলে জানি, সেই সীসের থেকেও অনেক ভারী হচ্ছে সোনা। ছ’টা ফুল-পাউন্ড পাঁউরুটির মাপের সোনার বাট একজন মানুষের পক্ষে কাঁধে নিয়ে ক্যাজুয়ালি ঘুরে বেড়ানো অসম্ভব। তাছাড়া সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়ে সোনা কোথায় পাবেন উনি? মাছধরার জাল দিয়ে ডুবো-জাহাজের গুপ্তধন তোলা যায় নাকি?’
তারপর বুধোদা ফাদার রেনল্ডকে বলল, ‘আচ্ছা, ফাদার! দরিয়া বলছিল আপনি নাকি বিশ্বাস করেন দীনেশবাবু এই গির্জাঘরের মধ্যেই কোথাও সেই মূল্যবান জিনিসটা রেখে গেছেন। আপনার এমন বিশ্বাসের কারণ কী জানতে পারি?’
‘বলছি। সেদিন সকালে যখন দীনেশ বেরিয়েছিল, তখন ওর কাঁধে সেই কালো ব্যাগটা ছিল। দুপুরবেলায় যখন চার্চে ফিরে এসেছিল, তখনও। দেখে তো মনে হচ্ছিল ভেতরে আগের মতনই ভারী কিছু রয়েছে, মানে ওর সেই সম্পদ।
‘তারপর তো আমাদের মধ্যে বাড়ি ফেরা নিয়ে কথাবার্তা হল। ঠিক হল, দীনেশ ওইদিনই ওর নিজের বাড়িতে ফিরে যাবে আর আমি ফিরব বোম্বেতে। তখন দীনেশ আমার সামনেই ওর সেই কালো ব্যাগটা গোছাতে বসল। তার আগের সাতদিন চার্চে বসবাস করার সময় এখানে-ওখানে যা-যা ছড়িয়ে ফেলেছিল—জামাকাপড়, তেল-সাবান, চিরুনি-টুথব্রাশ এবং ওষুধ—সবই আবার যত্ন করে ব্যাগের ভেতরে গুছিয়ে ভরে নিল। সবটাই ও করল আমার চোখের সামনে এবং বললে বিশ্বাস করবেন না, আমি দেখলাম ব্যাগটা একদম খালি। খালি ব্যাগের মধ্যেই ও জামাকাপড় ইত্যাদি ঢোকাল।
‘সেইজন্যেই বলছি, আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ও এই চার্চেই কোথাও ওর সেই সম্পদ লুকিয়ে রেখে গিয়েছে। হয়তো আমি যখন স্নান করতে বাথরুমে ঢুকেছিলাম, তখনই। ভেবে দেখো, কোনো জিনিস লুকিয়ে রাখার পক্ষে এই পরিত্যক্ত গির্জার চেয়ে ভালো জায়গা আর কী হতে পারে, বিশেষত দীনেশ যখন জানত ওকে গির্জার চাবি আমি দিয়েই যাব?’
.
আমরা যখন পুরো ব্যাপারটা নিয়ে ভাবছি, তখনই ফাদার রেনল্ড এমন একটা কথা বললেন, যা শুনে আমরা তিনজন—অর্থাৎ আমি, বুধোদা আর দরিয়া—খাড়া হয়ে বসলাম। উনি বললেন, ‘আপনাদের এই সোনা নিয়ে জল্পনা শুনতে-শুনতে হঠাৎ একটা কথা স্মৃতিতে ফিরে এল। মনে পড়ল, সেদিন দুপুরবেলায় বাইরে থেকে ফিরেই দীনেশ খুব খুশি-খুশি মুখে বলেছিল, যাক। দরিয়ার সোনা যাতে দরিয়ার হাতেই পৌঁছয় তার ব্যবস্থা করে ফেললাম। মাঝের সময়টা ঈশ্বর সেই সোনার পাহারায় রইলেন।’
বুধোদা খুব সতর্কভাবে বলল, ‘আরেকবার বলুন তো ফাদার! আরেকবার বলুন। দয়া করে একদম যেমনটি উনি বলেছিলেন ঠিক সেইভাবেই বলবেন। কিছু বাদ দেবেন না, কিছু যোগও করবেন না।’
ফাদার রেনল্ড দুই হাতের বুড়ো-আঙুলে দুটো রগ টিপে ধরে, চোখ বন্ধ করলেন। তারপর বললেন, ‘না। কোনো ভুল নেই। ঠিক যা বললাম একটু আগে, তাই। ও বলেছিল—যাক। দরিয়ার সোনা যাতে দরিয়ার হাতেই পৌঁছয় তার ব্যবস্থা করে ফেললাম। মাঝের সময়টা ঈশ্বর সেই সোনার পাহারায় রইলেন। সেইজন্যেই বলছিলাম বোধিসত্ত্ব, আপনি কি সিওর যে জিনিসটা সোনা ছিল না?’
বুধোদা কথাগুলো ওর মোবাইলে রেকর্ড করছিল। ফাদার থামতেই মুখ তুলে বলল, ‘আপনি যা বললেন, তাতে তো এরকম একটা সম্ভাবনা আবার মাথায় উঁকি মারছে। হতে পারে সোনার বাট নয়, অন্য কিছুর ওপরে সোনার আস্তরণ দেওয়া ছিল। তাছাড়া ওই কথাগুলো, ঈশ্বর পাহারায় রইলেন। কোথাকার ঈশ্বর? এই চার্চেরই নয় তো। আপনার অলক্ষ্যে উনি সেদিন এই চার্চেই রেখে যাননি তো সেই গুপ্তধন? ফাদার। আপনি অনুমতি দিন। আমি একবার এই পুরো বাড়িটা ঘুরে দেখি।’
ফাদার রেনল্ড বললেন, ‘সিওর। আমি তো চাই তুমি দেখো। তুমি খুঁজে বার করো। বাড়ি বলতে তো এই দুটো ঘর আর ওয়াশরুম। তবে…’
‘তবে কী ফাদার?’
‘আমার চোখের সামনেই বোম্বে-গ্যাং তিনটে ঘরই যেভাবে তছনছ করে সব দেখে গেল, তোমরা কি তার থেকে বেশি কিছু করতে পারবে?’
‘তবু আমি একবার দেখি। দরিয়া, রুবিক তোমরাও নিজেদের মতন করে দেখো। শুধু চোখ দিয়ে নয়, বুদ্ধি এবং মন দিয়ে দেখো।’
.
তিনটে ঘর খুঁজে দেখতে আমাদের প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট সময় লাগল।
প্রেয়ার-হল এবং তার লাগোয়া ফাদারের থাকার ঘর—এই দুটো ঘরের প্রতিটি জিনিসই খুব মন দিয়ে দেখলাম আমরা। কিন্তু দামি তো দূরের কথা, এমন একটা জিনিসও খুঁজে পেলাম না যেটা কোনো ভাঙা টিনা-লোহার ফেরিওলা অবধি কিনতে রাজি হবে।
প্রেয়ার-হলে কী কী ছিল সে তো আগেই বলেছি। কাঁসা কিংবা পেতলের তৈরি ছ’টা মোমদান। মোমদানগুলোর গায়ে বহু বছরের কলঙ্ক জমেছিল, তাদের ঔজ্জ্বল্য বলতে আর কিছু অবশিষ্ট ছিল না। মোমবাতি-গুলোরও একই দশা। সাদা মোমের ওপরে বহু বছরের ধুলো জমে ক্যান্ডেলগুলোর রং কালো হয়ে গিয়েছিল। তবু বুধোদা সেই মোমদানগুলোই ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখে, দরিয়াকে বলল, ‘এগুলো কি সোনা বা প্ল্যাটিনাম হতে পারে?’
দরিয়া বলল, ‘না স্যার। আমি চেনা জুয়েলারকে দিয়ে টেস্ট করিয়ে নিয়েছি। সবক’টাই সস্তার জিনিস।’
পাশ থেকে ফাদার রেনল্ড বললেন, ‘তাছাড়া এগুলো তো আর দীনেশ নিয়ে আসেনি। বহুবছর ধরে এগুলো চার্চেরই সম্পত্তি।’
বুধোদা এদিক-ওদিক পায়চারি করতে-করতে আপনমনে বলছিল, ‘দেয়ালের ছবির ফ্রেমগুলো টিনের ওপর সোনালি রং করা। যিশুর এই মূর্তিটা প্লাস্টার অফ প্যারিসের। তাছাড়া মোমদানগুলোর সম্বন্ধে যা বললেন, এইসব জিনিসের ক্ষেত্রেও সেই একই কথা খাটে। কোনোটাই দীনেশবাবু নিয়ে আসেননি, সবই এখানে ছিল। তাই তো ফাদার?’
ফাদার রেনল্ড ঘাড় নেড়ে বুধোদার কথায় সম্মতি জানালেন।
তারপর বুধোদা পুলপিটের বাঁ-দিকে বইয়ের ব়্যাকটার সামনে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল। বই বলতে দুটো ইংরিজি বাইবেল আর চারটে বাংলা প্রার্থনা সঙ্গীতের সংগ্রহ। সবই ত্রিশ-চল্লিশ বছরের পুরোনো এডিশন, কলেজ স্ট্রিটে ছাপা। কোনোমতেই অ্যান্টিক নয়। তবু বুধোদা দশ-মিনিট ধরে প্রতিটি বইয়ের প্রত্যেকটা পাতাই শুধু নয়, মলাটের ভেতরে কী আছে তাও চেক করে দেখল। ছাপা অক্ষর ছাড়া আর কিছুই ছিল না।
আর ছিল একটা চামড়ায় বাঁধানো বিশাল খাতা। সেই কুকড়াঝোরার নেকড়ে-মানুষের ঘটনার পর থেকেই আমি জানি, প্রতিটি চার্চে এরকম একটা খাতা থাকে। যতটা অঞ্চলের ওপরে একটা চার্চের এক্তিয়ার, সেই অঞ্চলের মধ্যে খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী সমস্ত পরিবারের প্রতিটি জন্ম-মৃত্যুর রেকর্ড ওই খাতায় লেখা থাকে। বুধোদা খাতাটার শেষ পাতার এন্ট্রিটার দিকে আঙুল দিয়ে দেখাল। দশ-বছর আগের একটা তারিখ। জনৈক স্যামুয়েল অশোক মন্ডল, বোঝাই যাচ্ছে ভদ্রলোক ছিলেন এদেশিয় খ্রিস্টান, ওইদিনে মারা গিয়েছিলেন। তারপর আর কোনো এন্ট্রি নেই, অর্থাৎ চার্চটা তখন থেকেই পরিত্যক্ত।
খাতাটার মধ্যে আরও কিছু তথ্য ছিল। যেমন চার্চকে যদি কেউ টাকা-পয়সা, জামাকাপড় কিংবা কোনো প্রার্থনার সামগ্রী দিয়ে থাকেন, তাহলে দাতার নাম-সমেত তার একটা তালিকা। আমরা সেই তালিকাটাও দেখলাম। মনে হল দান হিসেবে যা-যা এসেছিল, ওই কাঠের ফার্নিচার, নানারকমের মোমদানি আর জলপাত্র কিংবা চেয়ার-টেবিল, সবই এখনো এই-দুটো ঘরেই আছে। কিছুই হারায়নি।
ফাদারের থাকার ঘর আর ওয়াশ-রুমে আরওই কিছু ছিল না। একেবারে সাফ-সুতরো দুটো ঘর। তারপর আমরা দেখলাম দেয়াল এবং মেঝের গাঁথনি। সেও সলিড গাঁথনি। কোনো চোরকুঠুরি-টুঠুরির গল্পই নেই।
সবকিছু দেখার পরে বুধোদা বেশ কনফিডেন্টলি বলল, ‘না ফাদার। এই চার্চের মধ্যে দামি কিছু নেই। মনে হয় দীনেশবাবু বাইরে কোথাও জিনিসটা রেখে এসেছিলেন। সেরকম জায়গার কথা কি তোমার জানা আছে দরিয়া, যেখানে উনি ওই সাত-দিনের মধ্যে গিয়ে থাকতে পারতেন?’
দরিয়া বলল, ‘আমি মাকে জিগ্যেস করে আপনাকে বলব। এমনিতে বহুদিন মুম্বাইয়ে থাকার কারণে কলকাতার বন্ধুদের সঙ্গে বাবার যোগাযোগ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল বলেই জানি। আর আত্মীয় তো আমাদের কেউ নেই-ই। তবু আমি মাকে জিগ্যেস করব।’
আমার মাথায় একটা সম্ভাবনার কথা ঘুরছিল। বললাম, ‘বুধোদা। প্রথমে দীনেশবাবু ওটা যেখানেই রেখে থাকুন, এখনো সেখানেই থাকবে তার তো মানে নেই। দু-দিন পরেই তো উনি সেটাকে বিক্রি করে দিয়ে থাকতে পারেন, তাই না?’
উত্তরটা দিল দরিয়া। বলল, ‘না রুবিক। তাহলে আমাদের অবস্থা বদলে যেত। বাবার সমস্ত ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ছিল মায়ের সঙ্গে জয়েন্টলি। সেই সব অ্যাকাউন্টে একটাও পয়সা বাড়তি জমা পড়েনি। আমাদের দু-কামরার বাড়ি; তুমি দেখলেই বুঝতে পারবে সেখানে টাকা বা জিনিস কিছুই লুকিয়ে রাখার মতন জায়গা নেই। আর সবচেয়ে বড় কথা, বাবা যদি জিনিসটা ডিসপোজ করেই দিতে পারত, তাহলে আজ ওরা হামলা করতে আসত না। ওরা কোনো ভাবে জানে, জিনিসটা এখনো বাজারে বেরোয়নি।’
বুধোদা আপনমনে বলল, ‘কী সেই জিনিস, যার লেনদেনের কথা চাপা থাকে না? সোনা হিরের মতন তুচ্ছ জিনিস তো নয়। এরকম ঘটতে দেখেছি একমাত্র পুরোনো পেইন্টিং-এর ক্ষেত্রে; একটা পিকাসো কিংবা ভ্যান গগ হাতবদল হলেই পুরো আর্টের মার্কেটে খবর ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু মুম্বাইয়ের ফিশিং ট্রলারের জালে তো আর মাতিসের অয়েল পেইন্টিং উঠবে না?’
.
বুধোদার গাড়িতে চেপে যখন আমি, দরিয়া আর ওর সেই বডিগার্ড আবার রিমাউন্ট-রোডের মোড়ে এসে পৌঁছোলাম, তখন ঘড়িতে বাজে রাত এগারোটা। পেটে যদিও ছুঁচোয় ডন মারছিল, তবু বুঝতে পারছিলাম বিরিয়ানি খাওয়ার আশায় আজ চিটেগুড়।
ও মা! রিমাউন্ট-রোডের মুখে গাড়িটা পৌঁছতেই একটা বিদেশি এস ইউ ভি আমাদের ওভারটেক করে সামনে দাঁড়াল। দরিয়া খুব বিনীতভাবে বলল, ‘চলুন স্যার। আমার গাড়িটায় চলুন। আপনার গাড়িটা নাটা চালিয়ে নিয়ে আসছে।’
ওই সাড়ে ছ’ফিটের দৈত্যের নাম যে নাটা এটা শুনে নিশ্চয় হেসেই ফেলতাম, যদি না ও ঠিক আমার পাশেই বসে থাকত আর ওর কোলের ওপরে রাখা আগ্নেয়াস্ত্রের নলটা আমার পাঁজরে খোঁচা না মারত।
বুধোদাও সম্ভবত হাসি চাপবার জন্যেই অতিরিক্ত গম্ভীর স্বরে বলল, ‘কেন দরিয়া? আবার গাড়ি বদলানোর কী দরকার? অনেক রাত হয়ে গেছে। এবার আমরা বাড়ি ফিরব।’
দরিয়া বলল, ‘সেকী! খিদিরপুরে এসেছেন, এখানকার বিখ্যাত বিরিয়ানি না খেয়ে চলে যাবেন? শুনুন স্যার, আমি এখন যার হাভেলিতে আপনাদের নিয়ে যাচ্ছি, তিনি কাঠকয়লার আঁচে দিনে গোনাগুনতি পঁচিশজনের মতন বিরিয়ানি বানান আর এক-সপ্তাহ আগে থেকে বলে না রাখলে বাড়িতে ঢুকতেও দেন না। এঁর পূর্বপুরুষ ছিলেন নবাব ওয়াজেদ আলি শার খাস বাবুর্চি। নবাবি রসুইঘরের সেই গোপন রেসিপিতেই আজও ওখানে বিরিয়ানি আর কাবাব তৈরি হয়। সেই-অর্থে এই বিরিয়ানিও একরকমের অ্যান্টিক আর আপনি তো অ্যান্টিক হান্টার। কাজেই…।’
কাজেই পেট ভরানো এক অ্যান্টিক হান্টিং-এর মধ্যে দিয়ে আমাদের সেদিনের অভিযান শেষ হয়েছিল।
.
পরের দিনটা ছিল রবিবার। সকালে বইখাতা নিয়ে পড়তে বসেছিলাম, কিন্তু পড়া তেমন হচ্ছিল না। বুধোদা কাল খিদিরপুর থেকে উত্তরপাড়ায় ফেরার পথেই ফাদার রেনল্ডের ভয়েস রেকর্ডিং-এর অংশটুকু আমার ফোনে পাঠিয়ে দিয়েছিল। বারবার শুনে সেটা মুখস্থ করে ফেলেছি।
‘যাক। দরিয়ার সোনা যাতে দরিয়ার হাতেই পৌঁছয় তার ব্যবস্থা করে ফেললাম। মাঝের সময়টা ঈশ্বর সেই সোনার পাহারায় রইলেন’।
বুঝতেই পারছি, এটা ছিল দীনেশবাবুর তাৎক্ষণিক আনন্দের অভিব্যক্তি। কোনোমতেই এটা গুপ্তধনের সঙ্কেত নয়। সেইজন্যেই তেমন জটিলতাও নেই কথাগুলোর মধ্যে। দরিয়া ওঁর একমাত্র সন্তান। সেইজন্যেই ওঁর জীবনের যা-কিছু অর্জন, তা সবই আসলে দরিয়ার। ওঁর সোনা মানেই তা দরিয়ার সোনা।
আর উনি ভেবেছিলেন, ওঁর নিজের মাথার ওপরে যদিও মৃত্যুর খাঁড়া ঝুলছে, তবু সেই সোনা ঠিকই দরিয়ার হাতে পৌঁছে যাবে। ওঁর অকালমৃত্যু ঘটলেও দরিয়ার সোনা দরিয়ার হাতেই পৌঁছবে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে সোনাটা আসলে কী? ‘সোনার কেল্লা’ উপন্যাসে ফেলুদা তোপসেকে যে-কথাগুলো বলেছিল, সেগুলোই মনে পড়ে গেল। সোনা মানে তো চকচকে ধাতুটা নাও হতে পারে। সোনার মতন দামি অন্য কিছু হয় যদি!
ঈশ্বর সেই সোনার পাহারায় রইলেন। এই কথাগুলোও কি আক্ষরিক অর্থে নেওয়া উচিত? আমাদের কোনো আত্মীয় যখন বাড়ি ছেড়ে দূরদেশে যাত্রা করে তখন আমরা বলি ‘ঈশ্বর তোমার সঙ্গে থাকুন।’ বলবার সময় কি ভাবি, সত্যিই ঈশ্বর তার পাশে পাশে সারাটা পথ হাঁটবেন? তা তো নয়। ভাবি অদৃশ্য এক ঈশ্বরীয় ক্ষমতা তাকে যাত্রাপথে আগলে রাখবে। এখানেও হয়তো দীনেশবাবু সেইভাবেই কথাগুলো বলেছিলেন। তাঁর গুপ্তধন যেখানেই থাকুক, অদৃশ্য এক মঙ্গল প্রভাব যেন সেই গুপ্তধনকে দুষ্কৃতিদের হাত থেকে রক্ষা করে, এইটুকুই হয়তো চেয়েছিলেন তিনি।
তাহলে আমাদের হাতে সেলফোন ছাড়া আর কী রইল? কিছুই না।
এমনই সমাপতন, এই কথা যখন ভাবছি তখনই আমার মুঠোর মধ্যে ফোনটা বেজে উটল। বুধোদা। সাড়া দিতেই বলে উঠল, ‘একবার আয় তো। জরুরি কথা আছে।’ এই বলে ফোনটা কেটে দিল।
টি-শার্টটা গায়ে গলিয়ে হেমকুঞ্জে হাজির হলাম। বুধোদা যথারীতি ওদের সেই মেহগিনি কাঠের পালঙ্কের ওপরে বালিশে হেলান দিয়ে বসেছিল। চারিদিকে রাশীকৃত বই, ক্যাটালগ আর ছবির প্রিন্ট। আমি ঘরে ঢুকতেই বলল, ‘শোন। দরিয়া একটু আগে ফোন করেছিল। এক ভদ্রলোকের নাম-ঠিকানা দিয়েছে, যিনি ছিলেন এই কলকাতায় ওর বাবার একমাত্র বন্ধু। মানে ওর মা ওকে তাই বলেছেন। তোকে ঠিকানাটা পাঠাচ্ছি।’
মেসেজটা সেন্ড করে বুধোদা মুখ তুলে আমার দিকে তাকাল। বলল, ‘আমাকে একটু বাদেই যেতে হবে এশিয়াটিক সোসাইটি। ওখানে একটা কনফারেন্স আছে। রাত আটটার আগে ফিরতে পারব না। এদিকে ঠিকানাটা তো দেখতেই পাচ্ছিস, দমদমের। কাজেই তোকেই একবার যেতে হবে রুবিক। তুই একবার ভদ্রলোকের সঙ্গে মিট করে আয়। দেখ, কতটা কী ইনফর্মেশন উদ্ধার করতে পারিস।’
বললাম, ‘ওকে। তুমি চিন্তা কোরো না। আমি এক ঘণ্টার মধ্যে খাওয়া-দাওয়া করে বেরিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু বুধোদা…।’
‘কী হল?’
‘এটা কেমন ঠিকানা? তরুণ সরখেল, রেডিও গলি, নাগের বাজার!’
বুধোদা বলল, ‘দরিয়ার মায়ের যেটুকু মনে ছিল সেটুকুই বলেছেন। তার বেশি উনিই বা কী বলবেন বল তো! আমি তো ভদ্রলোকের ফোন-নাম্বারও চেয়েছিলাম। সেটাও দিতে পারেননি। তুই আজ একবার দেখ চেষ্টা করে। নাহলে আমি পরে দেখব কী করা যায়।’
হেমকুঞ্জ থেকে চটপট বাড়ি ফিরে স্নান-খাওয়া সেরে রেডি হয়ে নিলাম। তবে তার আগেই সপ্তদ্বীপাকে ফোন করে জিগ্যেস করলাম, ও আমার সঙ্গে যেতে পারবে কিনা। বুধোদার সামনে যাই বলি, নিবেদিতা গার্লস স্কুলের এই ক্লাস নাইনে পড়া মেয়েটার ওপর সত্যিই ভরসা করা যায়। খুনি ম্যাজিক কিংবা অ্যান্টিক আতঙ্ক তার সাক্ষী। তাছাড়া পার্টিকুলারলি আজকে ও সঙ্গে থাকলে আমার যেটা সুবিধে হবে, সেটা হল নাগের বাজারের ঘন বসতির মধ্যে একটা অ্যাড্রেস খুঁজে বার করার কাজটা একটু সহজ হবে।
সপ্তদ্বীপার বাড়ি বাগবাজারে। শুধু সেইজন্যেই নয়, ইদানিং ও একটা গ্রুপের সঙ্গে সারা উত্তর-কলকাতা জুড়ে পথ-নাটিকা করে বেড়াচ্ছে। তাই দমদমের রাস্তাঘাট ওর চেনা থাকাই উচিত।
যেরকম এক্সপেক্ট করেছিলাম, আমার প্রস্তাব শুনে প্রথমে একটু ভাও নিলেও, দীনেশবাবুর গুপ্তধনের কথাটা শুনেই দীপা ভয়ঙ্কর উৎসাহী হয়ে পড়ল। এতটাই উৎসাহী যে, জিগ্যেস করল সঙ্গে লঙ্কাগুড়োর স্প্রেটা নিতে হবে নাকি। আমিই বুঝিয়ে-সুঝিয়ে নিরস্ত করলাম। পরে অবশ্য মনে হয়েছিল, না করলেই হতো।
বিকেল সাড়ে-চারটের সময় আমরা দুজনে দমদম মেট্রো স্টেশনে মিট করলাম। সেখান থেকে অটোয় নাগেরবাজার পৌঁছনোটাও কঠিন হল না। কিন্তু তারপর রেডিও গলি খুঁজে বার করতে আমাদের ঘাম ছুটে গেল। গুগল ম্যাপেও হদিশ নেই এমন একটা জায়গা সেটা। যাই হোক, শেষ অবধি সাড়ে-পাঁচটা নাগাদ দুজনে সেই গলির মুখে পৌঁছলাম। এর পরের স্টেপ তরুণ সরখেল মশাইয়ের বাড়ি খুঁজে বের করা।
যাকেই জিগ্যেস করি সেই চোখ উল্টে দেয়। এ তো ভারি সমস্যায় পড়া গেল। অবশ্য লোকজনকেই বা দোষ দেব কেমন করে? তারা জিগ্যেস করে ভদ্রলোক কী করেন? আমরা বলতে পারি না। তারা জিগ্যেস করে ভদ্রলোককে দেখতে কেমন? আমরা বলতে পারি না। তাহলে কোন সূত্র ধরে তারাই বা কিছু বলবে?
শেষ অবধি এক ছাপাখানার বৃদ্ধ মালিক আমাদের বললেন, তোমরা কি পুতুল কারখানার মালিক তরুণবাবুর কথা বলছ? বছর পাঁচেক আগেও ওনার জন্যে পুতুলের প্যাকেট ছেপেছি। উনি থাকতেন নন্দীদের মাঠের পাশে। দেখবে, একটা টালির চালের ঘর আছে। পেছনের উঠোনে ওনার প্লাস্টিকের পুতুল বানানোর কারখানা ছিল।
‘থ্যাঙ্কিউ থ্যাঙ্কিউ দাদু’, বলে আমি আর দীপা নন্দীদের মাঠের দিকে দৌড়োলাম। সেই মাঠ ঘিরে এখন যেমন চার-পাঁচতলা ফ্ল্যাটবাড়ি উঠেছে তাতে ভয় হচ্ছিল সেই টালির চালের ঘর কি আর থাকবে? কিন্তু আমাদের কপাল ভালো ছিল। দামি ফ্ল্যাটবাড়িগুলোর মধ্যেই এককোণে মুখ লুকিয়ে বসেছিল একটা জরাজীর্ণ টালির চালের ঘর।
ঘুণধরা দরজাটায় ধাক্কা দিতেও ভয় করছিল, যদি খুলে পড়ে যায়! তবে দু-চারবার নক করতেই ভেতর থেকে এক ভদ্রমহিলা দরজাটা অল্প ফাঁক করে বললেন, ‘কে?’
দীপা আমার হাতে একটা টান মেরে পেছনে সরিয়ে দিয়ে নিজে সেই ফাঁকটুকুর মধ্যে দিয়ে মুখ গলিয়ে বলল, ‘আমি মাসিমা। সপ্তদ্বীপা রায়।’
দীপার একটা সুবিধে আছে, ওর মুখটা এতই ভালোমানুষের মতন যে, সেই মুখের দিকে একবার তাকালেই নাইন্টি-নাইন পার্সেন্ট মানুষ গলে যায়। এক্ষেত্রেও তাই হল। ভদ্রমহিলা দরজা পুরোটাই খুলে দিয়ে বললেন, ‘ব্যাঙ্ক থেকে আসোনি তো?’
দীপা ভারি অবাক হয়ে বলল, ‘না তো। ব্যাঙ্ক থেকে আসব কেন?’
উনি বললেন, ‘আর কেন মা? আমারই কপাল। তিনি তো হঠাৎ করেই চোখ বুজলেন। আমার ঘাড়ে চাপিয়ে রেখে গেলেন তিন-লাখ টাকার ঋণের বোঝা। এখন উঠতে-বসতে দু-বেলা ব্যাঙ্কের লোকেরা তাগাদা দিয়ে আমার প্রাণ ওষ্ঠাগত করে দিচ্ছে।’
দীপা আমার দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল। বুঝলাম ও-ও আমারই মতো ভাবছে, এখানে আর জানার কিছু নেই। তবু আমি বললাম, ‘মাসিমা, তরুণমেসো কি…’
‘চলে গেছেন। ঠিক তিন-বছর হল। তোমরা কোত্থেকে এসেছ বললে না তো।’
বললাম, ‘খিদিরপুরে মেসোর এক বন্ধু ছিলেন, নাম দীনেশবাবু। তার ছেলের নাম দরিয়া। তিনিই আমাদের পাঠিয়েছিলেন একটা ব্যাপারে খোঁজ নেওয়ার জন্যে।’
‘বলো কী ব্যাপার। আমার জানা থাকলে নিশ্চয় বলব।’
‘ইয়ে মানে…’ আমি যতক্ষণ মাথা চুলকোচ্ছি তারমধ্যেই সপ্তদ্বীপা বেশ গুছিয়ে প্রশ্ন করল, ‘আটবছর আগে দীনেশবাবু কি আপনাদের বাড়িতে আসতেন?’
ভদ্রমহিলার চোখদুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বললেন, ‘আট বছর হয়ে গেল নাকি? হ্যাঁ মা, আসতেন বইকি। তিনি তখন সবে বম্বে থেকে ফিরেছিলেন। ওই কারখানার উঠোনে মোড়া পেতে বসে দুই বন্ধু কত গল্প করতেন আর আমাকে ঘড়ি-ঘড়ি চা বানিয়ে দিতে হতো। মনে হচ্ছে যেন এই সেদিনের কথা।’
দীপা বলল, ‘মাসিমা, দীনেশবাবু ওনাকে দিয়ে, মানে আপনার হাজব্যান্ডকে দিয়ে কোনো কাজ করিয়েছিলেন?’
মাসিমার উত্তর দিতে একটুও দেরি হল না। বললেন, ‘তা তো বলতে পারব না। দীনেশ-ঠাকুরপো একটা কালো কাঁধব্যাগ নিয়ে আসতেন। সেটা নিয়েই দুজনে কারখানা ঘরে ঢুকে যেতেন। আমি ওদিকে কোনোদিনই পা বাড়াতাম না, তাই জানি না কী করতেন ওনারা।’
আমরা দুজনে প্রায় একসঙ্গেই বলে উঠলাম, ‘আমরা একবার কারখানা-ঘরটা দেখে আসব?’
এমনিতে এরকম আবদারে কেউ কর্ণপাত করতেন কিনা জানি না, তবে সম্ভবত দীপার বড়-বড় চোখের ম্যাজিকে আর দীনেশবাবুর স্মৃতিতে উনি রাজি হয়ে গেলেন। ঘরের ভেতর থেকে একটা ছোট চাবি নিয়ে এসে বললেন, ‘ভেতরে কিন্তু বিছে সাপ এইসব থাকতে পারে। তিন বছর ঘরটা খোলা হয়নি। তোমাদের ফোনে টর্চ আছে তো? জ্বালিয়ে ঢুকবে।’
বললাম, ‘আলো নেই?’
মাসিমা বললেন, ‘না। ইলেকট্রিসিটি অফিস থেকে কারখানার লাইন কেটে দিয়ে গেছে। আগে তো ওখানে ইলেকট্রিকেই প্লাস্টিক গলানোর মেশিন চলত, ব্লোয়ার চলত। স্প্রে-পেন্টিং হতো। সেসব মেশিনে এখন ধুলো জমছে। বেচতেও পারব না। ব্যাঙ্কের থেকে লোন নিয়ে কেনা তো।’
আমি আর দীপা মোবাইলের ফ্ল্যাশলাইট অন করে কারখানাটায় ঢুকলাম। ঢোকামাত্রই মুখে একগাদা মাকড়শার জাল জড়িয়ে গেল। তবু নাকে রুমাল জড়িয়ে আমরা পুরো ঘরটা তন্নতন্ন করে খুঁজলাম। কিন্তু মাসিমা যে অকেজো মেশিনগুলোর কথা বলেছিলেন সেগুলো বাদে আর কিছুই দেখতে পেলাম না। ও হ্যাঁ, কিছু রং না করা সাদা প্লাস্টিকের পুতুল ডাঁই করে রাখা ছিল একটা তাকের ওপরে। একবার খোলা দরজাটার দিকে তাকিয়ে তারই একটা চট করে আমার ব্যাকপ্যাকে পুরে নিলাম। কী জানি, যদি এটাই কোনো মহামূল্যবান পদার্থ দিয়ে বানানো হয়!
তারপর আমরা মাসিমাকে অনেক ধন্যবাদ-টন্যবাদ দিয়ে আবার রেডিও গলিতে ফিরে গেলাম। ইতিমধ্যে অন্ধকার নেমে এসেছিল। যখন এসেছিলাম তখন খেয়াল করার প্রশ্ন ছিল না, কারণ তখন আকাশে শেষ-বিকেলের আলো ছিল। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি, গলিটার ভেতরে হয় স্ট্রিট-লাইট নেই কিংবা থাকলেও সেগুলো কাজ করছে না। এদিকে পরপর দুটো ভুল টার্ন নেওয়ার পরে দেখলাম গলিটা অবিকল আমাজন নদীর মতন শাখা-প্রশাখায় ভাগ হয়ে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই।
দীপাও দেখলাম ডিরেকশন গুলিয়ে ফেলেছে। সবে পকেট থেকে অগতির গতি মোবাইলটা বার করে জি.পি.এস দেখতে যাচ্ছি, তখনই পেছনে কয়েকটা ভারী পায়ের আওয়াজ পেলাম। ঘাড় ফিরিয়ে দেখবার আগেই দুটো লোক আমার আর সপ্তদ্বীপার গলাদুটো মুঠোর মধ্যে চেপে ধরে একটা বাড়ির দেয়ালে ঠেসে ধরল। এক পলক দেখলাম, তৃতীয় আরেকটা লোক এগিয়ে আসছে।
‘কেয়া মিলা?’ আমার গলাটা টিপে ধরেছিল যে-লোকটা সে রুক্ষ্ম গলায় প্রশ্ন করল। লোকটা জাত-গুন্ডা। অ্যামেচার হলে আমার নাগালের মধ্যে ওকে পেতাম এবং অন্তত একবার চেষ্টা করতাম হাঁটু ভাজ করে পেটে একটা জ্যাব বসাতে। কিন্তু এ পুরো হাতটা স্ট্রেচ করে শরীরটাকে যতটা সম্ভব দূরে রেখেছে।
আমি ওই অবস্থাতেই মাথাটা দু-পাশে নেড়ে বোঝানোর চেষ্টা করলাম, কিছুই পাইনি। ইতিমধ্যে আমার চোখের সামনে কমলা আলোর ফুলকি ছোটাছুটি করতে শুরু করেছিল, যা আসলে চোখের শিরায় উঠে আসা রক্তের স্রোত। বুঝতে পারছিলাম না, এরা আমাদের মেরে ফেলতে চাইছে কিনা। কোনোরকমে হাত দিয়ে আমার ব্যাকপ্যাকটার দিকে ইঙ্গিত করলাম। অর্থাৎ তোমরা যা-খুঁজছ, তা ওর মধ্যেই আছে।
লোকটা গলার চাপটা একটু আলগা করল। তারপর মারাঠি ডায়ালেক্টে তৃতীয় লোকটাকে একটা কিছু বলতেই সে এগিয়ে এসে আমার পিঠ থেকে ব্যাকপ্যাকটা খুলবার চেষ্টা করল।
তারপরেই যে কী ঘটে গেল আমি এখনো ভালো করে মনে করতে পারি না। পরে সপ্তদ্বীপাকে প্রশ্ন করে দেখেছি, ও-ও পারে না। শুধু এইটুকু মনে পড়ে, গলির বাঁক থেকে দ্রুতপায়ে এগিয়ে এল বিশাল চেহারার একটা লোক এবং যে-তিনজন আমাদের অ্যাটাক করেছিল তারা জাস্ট তিনদিকে উড়ে গেল।
নাটা। দরিয়ার বডিগার্ড। ওই চেহারা ভুল হবার নয়। আমার ব্যাকপ্যাকটা মাটি থেকে কুড়িয়ে নিয়ে নাটা চাপা গলায় বলল, ‘মুভ মুভ মুভ। ফলো মি, ফলো মি।’
আমি ওর কথা শুনে এগিয়ে যেতে গিয়ে একটু টলে গেলাম। দেখলাম সপ্তদ্বীপার অবস্থা আরও খারাপ। ও বসে পড়েছে মাটিতে। আর তখনই দ্বিতীয়বার দেখলাম নাটার শক্তির নমুনা। ও জাস্ট আমাদের দুজনকে দু-কাঁধে তুলে নিয়ে দৌড় লাগাল এবং আশ্চর্যজনকভাবে ঠিক আধ-মিনিটের মধ্যে বড়রাস্তায় পৌঁছে আমাদের প্রায় ঠেলেই তুলে দিল একটা দাঁড়িয়ে থাকা বাকেট-কারের মধ্যে। তারপর নিজেই ড্রাইভারের সিটে বসে স্পিড তুলল।
এবার দেখলাম নাটার ড্রাইভিং স্কিল। ঠিক কোন গলিঘুঁজি ধরে যে ও মিনিট পাঁচেকের মধ্যে পাইকপাড়ায় এসে উঠল বুঝতেই পারলাম না। অবশ্য খুব একটা বোঝার মতন অবস্থাতেও ছিলাম না। গাড়ি চালাতে চালাতেই নাটা বোধহয় রিয়ার ভিউ মিররে আমাদের অবস্থা দেখেছিল। একবার গাড়িটা দাঁড় করিয়ে জানলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে দুটো চিলড কোল্ড-ড্রিঙ্কসের ক্যান কিনে আমার আর দীপার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, ‘গলায় আস্তে করে বুলিয়ে যান। থামবেন না। কোল্ড-কম্প্রেস দিলে ব্যথাও কমবে আর কালশিটের দাগটাও ফুটে উঠবে না।’
ঠিক তখনই আমার মোবাইলে একটা কল এল। আননোন নাম্বার। কলটা রিসিভ করতেই ওদিক থেকে চেনা-গলার স্বর ভেসে এল, ‘স্যরি ভাই রুবিক। নাটা জাস্ট দু-চার মিনিটের জন্য তোমাদের ট্র্যাক হারিয়ে ফেলেছিল। তারমধ্যেই এত কিছু ঘটে গেল। আবার বলছি, স্যরি।’
আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘তুমি এতকিছু জানলে কেমন করে, দরিয়াদা? নাটাদা তো এরমধ্যে কাউকে ফোন করেনি।’
দরিয়াদা বলল, ‘পেছনে দেখো, আমারই আরেকটা গাড়ি তোমাদের ফলো করছে। আমি ভাগ্যের হাতে কিছুই ছাড়ছি না।’
বললাম, ‘আমাদের কখন থেকে শ্যাডো করছ?’
‘কাল রাতে যখন খিদিরপুর থেকে বেরোলে, তখন থেকে। এখনো বোধি স্যারকে আগলানোর জন্যে এশিয়াটিক সোসাইটির সেমিনার হলে বোধি স্যারের ঠিক পেছনে আমার দুজন লোক বসে আছে। বোধি স্যার অবশ্য সে-কথা জানেন না। তুমিও ওনাকে কিছু বোলো না, ওকে?’
‘ওকে।’
‘তোমার জিএফকেও এত কিছু বলতে যেও না। নাটা আগে ওকে বাগবাজারের বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে তারপর তোমাকে উত্তরপাড়ায় পৌঁছে দিয়ে আসবে, ঠিক আছে?’
আমি আড়চোখে একবার দীপার দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বললাম, ‘শি ইজ নট মাই জিএফ। উই আর জাস্ট কো-ওয়ার্কারস।’
দরিয়া হাসল। তারপর বলল, ‘আচ্ছা গুডনাইট।’
ও ফোনটা রেখে দিতে যাচ্ছিল। আমি তাড়াহুড়ো করে বললাম, ‘কিন্তু দরিয়াদা, এভাবে কতদিন সবাইকে বাঁচিয়ে রাখবে? ফাদার রেনল্ড, তোমার মা এঁরা সকলেই তো একলা থাকেন প্রায় সারাদিন।’
দরিয়াদা বলল, ‘আরে, ও নিয়ে ভেবো না। আমি ওদের সঙ্গে আজ রাতেই মিটমাট করে নিচ্ছি। ওদের বলে দিয়েছি, আজ রাত দুটোয় কন্টেনার-ইয়ার্ডে এসে দাঁড়াতে। বাবা মুম্বাই থেকে যা নিয়ে এসেছিলেন তার ফিফটি পারসেন্ট ওখানেই ওদের হাতে তুলে দেব।’
এত অবাক হলাম যে মুখ দিয়ে কিছুক্ষণ কথাই বেরোল না। তারপর বললাম, ‘তুমি জিনিসটা পেয়ে গেছ?’
‘পাগল নাকি? বলতে হয় বলে বললাম। যাই হোক, ওদিকটা আমার ওপরে ছেড়ে দাও। আর আরেকবার তোমাদের থ্যাঙ্কস জানাচ্ছি। আমার জন্যে তোমাদের সাফার করতে হল।’
হঠাৎই ফোনের মধ্যেই দরিয়াদার গলাটা বদলে গেল। একটা অদ্ভুত ঠান্ডা গলায় ও বলল, ‘এর দাম ওদের চোকাতে হবে, রুবিক। ওরা দরিয়ার আপনজনের গায়ে হাত দিয়েছে। এর দাম ওদের চোকাতে হবে।’
বলেই ফোনটা কেটে দিল।
ঠিক পাঁচমিনিট বাদে বুধোদার ফোন এল। বুধোদা বলল, ‘আমিও এখন বাড়ি ফিরছিরে। দরিয়া ফোন করেছিল। তোদের ঝামেলার কথা শুনলাম। শোন, এখন আর একদম কথা বলিস না। গলাটাকে রেস্ট দে। কাল সকালে তো তোর স্কুল। আমি সন্ধের দিকে যাব। আর সপ্তদ্বীপাকে বলিস আমি খুব শিগগিরই একদিন ওর বাড়ি গিয়ে ওকে দেখে আসব।’
এই বলে বুধোদা ফোন ছেড়ে দিল।
সারাদিনের অসহ্য টেনশন আর পরিশ্রমের ফলেই বোধহয় রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। তাই ঘুমটা ভেঙেও গেল বেশ সকালে। ব্যালকনিতে বেরিয়ে দেখলাম, খবরের কাগজটা পড়ে আছে। ওটা হাতে তুলে নিয়ে চোখ বোলাতে গিয়ে তৃতীয় পাতায় একটা খবরে চোখ আটকে গেল।
গতকাল রাত দুটো নাগাদ রিমাউন্ট-রোডে এক ভয়ঙ্কর পথ-দুর্ঘটনায় এক কন্টেনার-ট্রাকের সঙ্গে মুখোমুখি ধাক্কায় পিষে গিয়েছে একটি যাত্রীবাহী গাড়ি। গাড়িটিতে মোট তিনজন যাত্রী ছিলেন। ঘটনাস্থলেই তাদের মৃত্যু ঘটেছে। মৃতদেহগুলি তল্লাশি করে যে কাগজপত্র পাওয়া গেছে তার থেকে পুলিশের অনুমান, আরোহীরা মুম্বাইয়ের অন্ধকার জগতের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এই সন্দেহ আরও দৃঢ় হয়েছে, কারণ, গাড়িটির ভেতরে দুটি আগ্নেয়াস্ত্র এবং প্রচুর বুলেট পাওয়া গেছে। ঘাতক ট্রাকটির খোঁজ চলছে।
.
কথামতন সেদিন সন্ধেবেলায় বুধোদা এল আমার বাড়িতে। দেখেই বুঝলাম ক্যামাক স্ট্রিটে ওর মহারাজা কালেকশন্সের শো-রুম থেকে স্ট্রেট চলে এসেছে। সোফার ওপরে বাবু হয়ে গুছিয়ে বসে মাকে বলল, ‘কাকিমা! ছ’টা লুচি আর বেগুনভাজা হলেই চলবে। ছানার পোলাওটা অপশনাল। থাকলে দিও, না থাকলে দিও না।’
‘আছে।’ মা বলল। ‘তুই আসছিস শুনে সকালেই শীতলা মিষ্টান্ন ভান্ডার থেকে আনিয়ে রেখেছি। কিন্তু, হ্যাঁ রে, তোদের কাজগুলো দিন-কে-দিন এমন বিপজ্জনক হয়ে উঠছে কেন বল তো। ভাবিস আমি কিছুই খবর রাখি না?’
বুধোদা করুণ স্বরে বলল, ‘আমিও ঠিক সেই কথাই ভাবি কাকিমা। আমি তো ডিটেকটিভ নই। অ্যাডভেঞ্চারিস্টও নই। তবু চেনা রাস্তার বাইরে বেরিয়ে একটা অ্যান্টিক সংগ্রহ করতে গেলেই কিছু-না-কিছু বিপদে জড়িয়ে পড়ছি। তবে এবারের ব্যাপারটা আন্ডার কন্ট্রোল। এটা নিয়ে ভেব না।’
‘ভাবতে না হলেই ভালো’, বলে মা চলে গেল রান্নাঘরের দিকে আর বুধোদাও সঙ্গে সঙ্গে আমার দিকে ঝুঁকে পড়ে বলল, ‘তরুণবাবুর বাড়িতে কী দেখলি বল।’
বললাম, ‘তরুণ সরখেল তিন-বছর আগে মারা গেছেন। ওই বাড়ির উঠোনেই ওঁর একটা প্লাস্টিকের পুতুল বানানোর ছোট ওয়ার্কশপ ছিল। ওঁর স্ত্রী বললেন, আট বছর আগে কিছুদিন দীনেশবাবুর ওই বাড়িতে যাতায়াত ছিল। কিন্তু তিনি তরুণবাবুকে দিয়ে কিছু বানিয়েছিলেন কিনা বলতে পারলেন না। দীনেশবাবুর মারা যাওয়ার খবরও ওঁরা কেউই জানতেন না।’
বুধোদা বলল, ‘পুতুল বানাতেন বললি। কীরকম পুতুল?’
আমি ব্যাকপ্যাক থেকে সেই রং না করা প্লাস্টিকের পুতুলটা বার করে বুধোদার হাতে দিয়ে বললাম, ‘এইরকম সব পুতুল তৈরি হতো।’
বুধোদা পুতুলটা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখল। নাকের কাছে নিয়ে গিয়ে গন্ধও শুঁকল। তারপর একপাশে নামিয়ে রেখে বলল, ‘নাঃ। সাধারণ প্লাস্টিকের পুতুল। এর মধ্যে কোনো রহস্য নেই।’
অনেকক্ষণ থেকে বুধোদাকে একটা কথা বলবার জন্যে উসখুস করছিলাম। বলবার সুযোগ পাচ্ছিলাম না। এবার বুধোদা থামতেই সেন্টার-টেবল থেকে সেদিনের নিউজ পেপারটা এনে তৃতীয় পাতাটা বুধোদার সামনে খুলে ধরে বললাম, ‘এই খবরটা দেখেছ?’
বুধোদা একবার আড়চোখে রিমাউন্ট রোডে দুর্ঘটনার খবরটা দেখে নিয়ে বলল, ‘সকালেই দেখেছি। সত্যিকথা বলতে কী দেখেই মাথায় আগুন জ্বলে গিয়েছিল। ভেবেছিলাম দরিয়া যদি এত সহজে মানুষ খুন করতে পারে তাহলে ওর সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ রাখব না। মনটা এতটাই তেতো হয়ে ছিল যে, দুপুরের দিকে শোরুম থেকে একবার ওর বাড়িতে চলে গেলাম। এর আগে বাড়িটা বাইরে থেকে দেখেছিলাম, কিন্তু ভেতরে ঢুকিনি কখনও।
‘যাবার আগে ফোন করেছিলে ওকে?’
বুধোদা উত্তর দিল, ‘করেছিলাম। কিন্তু ধরেনি। উল্টে একটা মেসেজ করেছিল, ‘একটু ব্যস্ত আছি স্যার। আপনাকে পরে রিং ব্যাক করছি। কিন্তু ওই যে বললাম, আমার মাথায় তখন আগুন জ্বলছিল। ওসব পরে-টরে শোনার মতন ধৈর্য ছিল না।’
‘তারপর?’
‘খিদিরপুরের একটা সরু রাস্তায় ওর বাড়ি। জায়গাটাকে বস্তি বললেই ঠিক হয়। চারিদিকের অন্যান্য বাড়ির সঙ্গে দরিয়ার বাড়ির কোনো তফাত নেই। সেই টালির চাল, নোনাধরা এক ইটের গাঁথনির দেয়াল। সামনে একফালি রোয়াক, তার একটা দিক টিন দিয়ে ঘেরা। সেখানে বসে গ্যাসের উনুনে ভাত রান্না করছিলেন যিনি তিনিই নিশ্চয় দরিয়ার মা।
‘রোয়াকের গায়ে পাশাপাশি দুটো ঘর। পর্দা-টর্দার বালাই নেই বলে আমি বাইরে থেকেই ঘরের ভেতরের দৃশ্য দেখতে পাচ্ছিলাম। একটা ঘরের মেঝেয় বসে পনেরো-ষোলো বছরের একটা মেয়ে আরও খুদে কয়েকটা ছেলেমেয়েকে কিছু পড়াচ্ছিল। অন্য ঘরটার প্রায় পুরোটা জুড়েই একটা তক্তপোষ। তার ওপরে দরিয়া এবং আরও চার-পাঁচটি ছেলে বসে কিছু আলোচনা করছিল। একবার মুখ তুলে আমাকে দেখেই দরিয়া চাপা গলায় কিছু বলল। অন্য ছেলেগুলি তাড়াহুড়ো করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। বেরিয়ে যাওয়ার সময় স্বাভাবিক সৌজন্যে আমাকে কপালে হাত ঠেকিয়ে সালাম জানিয়ে গেল ওরা।
‘দরিয়া বিছানা ছেড়ে উঠে দরজার কাছে দাঁড়াল। বলল, আসুন স্যার। আমি নিজেই যেতাম আপনার কাছে। কিন্তু আপনি এসেছেন ভালোই হয়েছে। এতদিনে গরিবের কুঁড়েয় আপনার পা পড়ল। মা! মজুমদার সাব এসেছেন, একটু নাস্তা-চা দিও।
‘আমি কড়া গলায় বললাম, নাস্তা খেতে আসিনি দরিয়া। তোমার ঘরে পা দেওয়ার ইচ্ছেও আমার ছিল না।
‘ওভাবে বলা উচিত হয়নি। মুহূর্তের মধ্যে ওর মুখটা কালো হয়ে গেল। বলল, কেন স্যার? আমার অপরাধটা কী?
‘আমার রাগ তখনও কমেনি। প্রায় চেঁচিয়েই বললাম, সেটা আবার জিগ্যেস করছ? মাফিয়া হোক আর যাই হোক, মুম্বাইয়ের লোকগুলোকে এইভাবে খুন করার অধিকার তোমার আছে?
‘শান্ত হন স্যার। ভেতরে আসুন—দরিয়া আমার হাত ধরে ঘরের ভেতরে টেনে নিয়ে গিয়ে দরজাটা ভেতর থেকে ভেজিয়ে দিল। তারপর বলল, জানি না আপনি বিশ্বাস করবেন কিনা, কিন্তু ওই লোকগুলোকে আমি খুন করাইনি।
‘ন্যাকামি হচ্ছে? তুমি বলতে চাইছ ওটা সত্যিই অ্যাকসিডেন্ট?
‘না। তাও নয়। ওরা নিজেদের লোকের হাতেই মারা পড়েছে। আমার একটা সন্দেহ হচ্ছিল যে ওরা এবার এইভাবেই মরবে।
‘কেন? আমি সত্যিই অবাক হলাম দরিয়ার কথা শুনে।
‘দরিয়া বলল, প্রথম কারণ, ওরা গতকাল যাচ্ছেতাইভাবে ধেড়িয়েছে। নাটা ছিল একা, আর ওরা তিনজন। তবু নাটা ওদের মেরে পাট করে, রুবিক আর দীপাকে নিয়ে সেফলি বেরিয়ে গেছে। আর দ্বিতীয়ত, এটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ, ওদের নিশ্চয় বলা হয়েছিল আমরা জিনিসটা হাতে পেয়ে গেলে তারপর সেটা আমাদের কাছ থেকে ছিনতাই করতে। তার আগে অবধি আমাদের সন্দেহ জাগে এমন কিছু না করতে। অথচ ওরা বারবার সেই ভুলটাই করেছে। ওরা গির্জায় দাপিয়ে বেরিয়েছে। ওরা রুবিক আর দীপাকে খোলা রাস্তায় গলা টিপে ধরেছে। এর ফলে আমি সাবধান হয়ে গেছি। এমন গার্ড নিয়েছি যে ওরা আর আমাদের ধারে-কাছেও পৌঁছতে পারবে না।
‘শুনুন স্যার! এই যে লোকগুলো মরল না, এদের বলা হয় হেঞ্চম্যান—একদম নীচের লেভেলের খুনে। পুরো ব্যাপারটা দূরে বসে যে চালায় সে হচ্ছে কিংপিন। একটু এদিক-ওদিক হলে হেঞ্চম্যানদের সরিয়ে দেওয়াটা আন্ডারওয়ার্ল্ডে নতুন কিছু নয়। এখানেও সেটাই হয়েছে। তার ফলে একটা ব্যাপারে আমরা নিশ্চিন্ত হয়ে গেলাম, যতক্ষণ না বাবার ওই ট্রেজার খুঁজে পাচ্ছি, ততক্ষণ আর কেউ আমাদের জ্বালাবে না। বড়জোর দূর থেকে ফলো করে যাবে, এইটুকুই।
‘ঠিক এইসময়েই বাইরে থেকে দরজায় টোকা পড়ল। তারপর দরজা খুলে ঘরে ঢুকলেন দরিয়ার মা, মিনতি দেবী। হাতে চায়ের কাপ আর প্লেটে ওমলেট। সেগুলোকে একটা ছোট টেবিলের ওপরে নামিয়ে রেখে আমাকে হাতজোড় করে নমস্কার করলেন। আমিও ওঁকে দেখে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছিলাম। প্রতিনমস্কার করে বললাম, বসুন না কাকিমা।
‘উনি তক্তপোষের একদিকে বসলেন। বললেন, আপনার কথা…।
‘আমি ওঁকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, আপনি নয়, তুমি।
‘উনি হেসে ফেললেন। বললেন, বেশ। দরিয়ার মুখে তোমার কথা অনেক শুনেছি। ওর ভাগ্য ভালো যে, তোমার মতন শিক্ষিত ছেলে ওকে কাছে টেনে নিয়েছ। কিন্তু তোমাকে সত্যি কথাই বলি, আমার মায়ের মন সারাক্ষণ আতঙ্কে থাকে, কখন ছেলেটার বিপদ ঘটে যায়। দেখো না বাবা, ওকে যদি একটু সৎপথে নিয়ে আসতে পারো।
‘দরিয়া ইঙ্গিতে পাশের ঘরের দিকে দেখিয়ে ওর মাকে বলল, তাহলে ওদের কী হবে? ওদের মতন আরও একশোটা বাচ্চার কী হবে?
‘মা-ছেলের এই কথোপকথন শুনে ন্যাচরালি আমার চোখে প্রশ্ন ফুটে উঠেছিল। তাই দেখে মিনতি দেবীই বললেন, এই তল্লাটের সমস্ত বাচ্চার পড়াশোনার ভার ওর। সমস্ত অসুস্থ মানুষের চিকিৎসার দায়িত্বও ওর। সেসব ঠিকই আছে। ওগুলো করতে আমি বারণ করি না। কেনই-বা করব? মানুষের কাজই তো করছে। কিন্তু কাজ করতে গেলেও প্রাণটাকে তো বাঁচিয়ে রাখতে হবে বাবা।
‘দরিয়া ওর মাকে আলতো হাতে জড়িয়ে ধরে বলল, অত চিন্তা কোরো না মা। মজুমদারসাব বাবার ওই ট্রেজারটা খুঁজে দিলেই আমি বড়লোক হয়ে যাব আর বড়লোক হয়ে গেলেই এসব খারাপ কাজ ছেড়ে দেব।
‘মিনতিদেবী খুব করুণ চোখে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, পারবে বাবা? সত্যিই তুমি পারবে? পারলে তিনি স্বর্গ থেকে তোমাকে আশীর্বাদ করবেন।
‘বললাম, চেষ্টা তো করছি কাকিমা। তবে মাঝখানে অনেকগুলো বছর কেটে গেছে তো।
‘উনি আমার মাথায় একবার আলতো করে ডানহাতের পাতাটা রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। আমি আর দরিয়া দুজনেই কিছুক্ষণ মাথা নীচু করে বসে রইলাম। তারপর দরিয়াকে বললাম, গত কয়েকদিন ধরেই একটা কথা ভাবছি জানো, তোমার বাবা তো নিশ্চয় অনন্তকালের জন্য ওই ট্রেজার লুকিয়ে রাখার কথা ভাবেননি। মারা যাওয়ার আগে হাতে একটা বছর সময়ও পেয়েছিলেন। তারমধ্যে কি আর নিজের মতন করে ওগুলোকে বিক্রি করার চেষ্টা করেননি? যদি চেষ্টা করে থাকেন, তাহলে নিশ্চয় কোনো লোকের সঙ্গে কিংবা কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগও করেছিলেন। সেই যোগাযোগের চিহ্ন তো ওঁর ফোনে কিংবা ই-মেলে থেকে যাবে।
‘দরিয়া বলল, নেই স্যার। কথাটা আমারও মাথায় এসেছিল। কম্পিউটার বাবার ছিল না। বাবা মেল-টেল করতেও জানত না। তবে মোবাইল-ফোন একটা ছিল। এখানে আসার পর ফোনটা কিনেছিল। স্মার্ট ফোন নয়, অর্ডিনারি ফোন। তার কল লিস্ট, তার মেসেজ, কনট্যাক্টস সব আমি খুঁটিয়ে দেখেছি। কিছুই পাইনি।
‘চিঠি আসত না ওঁর কাছে? উনি চিঠি লিখতেন না?
‘দরিয়া বলল, এই কথাটাও মাকে জিগ্যেস করেছিলাম। আমি তো তখন ছোট। বাবা কী করছে না করছে অত খেয়াল করে দেখতাম না। মা কিন্তু একটা ইন্টারেস্টিং কথা বলল। বলল, বাবা নাকি এয়ারমেলে চিঠি লিখত, মানে বিদেশের কাউকে উদ্দেশ্য করে বাবা লিখত সেই চিঠি। আর বাবার নামে বিদেশ থেকে এক-দুটো চিঠি এসেও ছিল। কিন্তু বাবা মারা যাবার পরে মা আর সেইসব চিঠি খুঁজে পায়নি। হতে পারে বাবা ওগুলো পকেটে নিয়েই ঘুরত। খুন হওয়ার পরে মার্ডারাররা পকেট থেকে ওগুলো বার করে নিয়ে পালিয়েছিল।
‘কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললাম, সেই ব্যাগটা কি তোমাদের কাছে এখনো রয়েছে দরিয়া? কালো ব্যাগটা, যেটা উনি মুম্বাই থেকে নিয়ে এসেছিলেন। আমাকে সেটা একবার দেখাতে পারবে?
‘দরিয়া বলল, নিশ্চয় পারব স্যার। বাবার সামান্য যে-কটা স্মৃতিচিহ্ন আমাদের কাছে রয়েছে, তার মধ্যে ওই ব্যাগটাও তো একটা। একটু বসুন, আমি নিয়ে আসছি। এই বলে দরিয়া উঠে পাশের ঘরে গেল। বাচ্চাগুলোর ইতোমধ্যে পড়া হয়ে গিয়েছিল। ওরা বেরিয়ে গিয়েছিল। পাশের ঘর থেকে একটা স্টিল-আলমারি খোলার শব্দ পেলাম। একটু বাদে দরিয়া একটা কালো ব্যাগ হাতে নিয়ে ঢুকল।
‘আমি ব্যাগটা ওর হাত থেকে নিয়ে দেখলাম। একদম সস্তা রেক্সিনের একটা ব্যাগ। এরকম ব্যাগ ধর্মতলায় ফুটপাথে ডাঁই করে বিক্রি হয়। একটা বড় খাপ ছিল, আর তার গায়ে কাগজপত্র রাখবার মতন একটা ছোট খাপ। প্রথমে বড় খাপটা খুলে, ভেতরে হাত ঢুকিয়ে দেখলাম। কিছুই পেলাম না। তবে খুব হালকা একটা সুগন্ধ পাচ্ছিলাম। ব্যাগটাকে নাকের কাছে এনে জোরে শ্বাস নিলাম। কোনো ভুল নেই, অদ্ভুত একটা গন্ধ আসছে ভেতর থেকে। আমার চেনা কোনো গন্ধের সঙ্গে সেই গন্ধের মিল পেলাম না। ব্যাগটা দরিয়ার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললাম, শুঁকে দেখো।
‘ও-ও জোরে জোরে কয়েকবার শ্বাস টানল। তারপর বলল, অবাক ব্যাপার তো। বহুবছর বাদে এটা বার করলাম। এর আগে কিন্তু একটা আঁশটে গন্ধই পেয়েছিলাম আর সেটাই তো স্বাভাবিক। বাবার প্রফেসন কী ছিল সে তো আপনি জানেন। কিন্তু এখন তো সত্যিই একটা অন্যরকমের গন্ধ পাচ্ছি।
‘তারপর নিজে থেকেই বলল, ওই আলমারিতেই আমার শার্ট-ট্রাউজার এসবও থাকে। আর আমি তো নানা রকমের ডিও, কোলন, পারফিউম এসব ব্যবহার করি। হয়তো সেইসব গন্ধই মিলেমিশে এর মধ্যে ঢুকে গেছে।
‘অন্য কোনো ব্যাখ্যা না থাকায় দরিয়ার কথাটাই মেনে নিলাম। তবে এখনো তোকে বলছি রুবিক, ব্যাখ্যাটায় গলতি আছে। কারণ ব্যাগটার বাইরের গায়ে কোনো গন্ধ নেই। কিংবা থাকলেও রয়েছে সেই ফিশিং-ট্রলারের আঁশটে গন্ধ। দরিয়ার ডিও কিংবা পারফিউমের গন্ধ চেন-আঁটা ব্যাগের ভেতরে ঢুকল কেমন করে?
‘তোকে আমি দেখাব ব্যাগটা। দেখিস তো, তুই গন্ধটা চিনতে পারিস নাকি।’
‘কবে দেখাবে?’ আমি জিগ্যেস করলাম। ‘তুমি কি ওটা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছ?’
‘এনেছি তো। তুই তো অনেকটাই সেরে উঠেছিস দেখছি। কাল সকালে চলে আসিস না একবার আমার ঘরে। বুঝতেই পারছিস, এমনিতেই কাকিমা একটু ইয়ে…মানে উদ্বিগ্ন হয়ে রয়েছে। তার মধ্যে এইসব মৃত মানুষের জিনিস নিয়ে এলে…।’
ঠিক তখনই মা জলখাবারের থালা নিয়ে ঘরে ঢুকল। বুধোদাও লুচি, ছানার পোলাও ইত্যাদি খুব তৃপ্তি করে খেয়ে, যেন কিছুই হয়নি এইভাবে বাড়ি চলে গেল।
.
পরদিন গেলাম বুধোদার বাড়ি। সেই বহু পরিচিত দোতলার ঘর। আমাকে দেখে বুধোদা আলমারি থেকে দীনেশবাবুর ব্যাগটা বার করে আমার হাতে দিল। আমিও প্রথমেই চেনটা খুলে গন্ধ নিলাম। দেখলাম, বুধোদার কথা সত্যি। খুব হালকা একটা সুগন্ধ জড়িয়ে রয়েছে ভেতরে। কিন্তু বুধোদার অন্য কথাটাও সত্যি। আমাদের পরিচিত কোনো সুগন্ধের সঙ্গেই সেটা মিলছে না। গন্ধটার মধ্যে নিশ্চিতভাবেই কিছুটা সমুদ্রের নোনা হাওয়ার গন্ধ মিশেছিল। আর যেটা মিশেছিল, সেটাকে ইংরিজিতে বলে উডি-স্মেল—কাঁচা কাঠের চোকলায় যে-গন্ধটা পাওয়া যায় সেটা।
আমি ভুরু কুঁচকে কিছুক্ষণ ভাবলাম। তারপর একটা কথা মনে পড়ে যাওয়ায় হেসে উঠলাম।
বুধোদা অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘পেগলে গেলি নাকি? হাসছিস কেন?’ বললাম, ‘একটা কথা মনে পড়ে গেল। সেটাই হচ্ছে এই গন্ধ-রহস্যের সমাধান। কিন্তু দুঃখের বিষয়, তার সঙ্গে দীনেশবাবুর গুপ্তধনের কোনো সম্পর্ক নেই।’
‘তবু শুনি।’
বললাম, ‘তোমার মনে আছে, ফাদার রেনল্ড বলেছিলেন, যেদিন দীনেশবাবু গির্জা ছেড়ে চলে গেলেন সেদিন যিশু আর মেরিমাতার সামনে তিনি মোমবাতি জ্বালিয়ে প্রার্থনা জানিয়েছিলেন। শুধু মোমবাতিই কি কিনে এনেছিলেন? ধূপকাঠিও কি আর কেনেননি? এ হচ্ছে সেই ধূপকাঠির গন্ধ।’
বুধোদা নাক দিয়ে এমন একটা আওয়াজ ছাড়ল, বুঝলাম একেবারেই কনভিন্সড হয়নি। বলল, ‘এরকম ধূপকাঠির গন্ধ বাপের জন্মে শুঁকিনি। জুঁই নয়, চন্দন নয়, মগরা নয়, গোলাপ নয়। যাই হোক, আপাতত বিকল্প নেই বলে তোর থিয়োরিটাই মানছি। আটবছর আগের ধূপকাঠির গন্ধই কোনো অলৌকিক উপায়ে হয়তো রয়ে গেছে।’
বুধোদার কথা শুনতে-শুনতে আমি হাসছিলাম আর অন্যমনস্কভাবেই খালি ব্যাগটার ভেতরটা হাত দিয়ে ঘাঁটছিলাম। এইধরনের সস্তার ব্যাগের নীচের দিকে একটা চৌকোনা পিজবোর্ডের টুকরো আঠা দিয়ে সাঁটা থাকে। ওই শক্ত পিজবোর্ডটাই ব্যাগের নীচের ফ্রেম হিসেবে কাজ করে। ভেতরে হাত বোলাতে বোলাতে হঠাৎই আমার একটা আঙুল ওই পিজবোর্ডের টুকরোটার নীচে ঢুকে গেল। বুঝলাম, ওইখানটায় আঠার কামড় আলগা হয়ে গিয়ে টুকরোটা উঠে এসেছে।
আঙুলটা যখন টেনে বার করছি, তখন আঙুলের সঙ্গে বেরিয়ে এল একটা কাগজের কোনা। ওটাকে পুরোটা টেনে বার করে ফেললাম।
কাগজটা চার ভাঁজ করে ওই পিজবোর্ডের নীচে রাখা ছিল। ‘রাখা ছিল’ না বলে ‘লুকিয়ে রাখা ছিল’ বলাই ভালো। ভাঁজ খুলে যা দেখলাম তার থেকে মনে হল রুল টানা কাগজটাকে কোনো খাতা থেকে ছিঁড়ে নেওয়া হয়েছে। আর সেই কাগজের বুকে লেখা আছে কয়েকটা নাম আর ঠিকানা। সাধারণ নীল কালির ডটপেনে লেখা। গোটা গোটা ইংরিজি হরফগুলো দেখলে মনে হয় সম্ভবত দীনেশবাবুর নিজেরই হাতের লেখা।
এক দুই নম্বর দিয়ে মোট ছ’টা নাম আর ঠিকানা লেখা ছিল কাগজটায়। পুরো ঠিকানা না লিখে আমি শুধু দেশগুলোর নাম লিখছি।—
.
ফার্মেনিখ, সুইজারল্যান্ড।
সিমরিজ, জার্মানি।
কোয়েস্ট ইনটারন্যাশনাল, ইংল্যান্ড।
টাকাশাগো ইনটারন্যাশনাল, জাপান।
মায়েন, ফ্রান্স।
রবার্টেট, ফ্রান্স।
.
বুধোদাকে বললাম, ‘দেখো তো। কয়েকটা নাম লেখা আছে দেখছি। মনে হচ্ছে কয়েকটা কোম্পানির নাম। কিন্তু কীসের কোম্পানি বুঝতে পারছি না। একটাও চেনা নাম নয়। ঠিকানাগুলো বিদেশের।’
বুধোদা আমার হাত থেকে কাগজটা নিয়ে একপলক চোখ বুলিয়েই বলল, ‘আরে! এ তো দেখছি দুনিয়ার সবচেয়ে বড় ছ’টা ফ্র্যাগ্রান্স ম্যানুফ্যাকচারারের নাম আর ঠিকানা।’
‘ফ্র্যাগ্রান্স ম্যানুফ্যাকচারার মানে?’
‘ফ্র্যাগ্রান্স হচ্ছে যাবতীয় সুগন্ধীর কাঁচামাল। বাংলায় যাকে বলা হয় সুগন্ধসার। এই কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে সেই সুগন্ধসার কিনে, তাদের নানানভাবে মিলিয়ে মিশিয়ে তৈরি করা হয় বিভিন্ন পারফিউম। তারপর সেই পারফিউমগুলো সুন্দর শিশিতে প্যাকড হয়ে, নানান ব্র্যান্ডনেমে বাজারে আসে।
‘পারফিউমের নামগুলো সবাই একডাকে চেনে। যেমন শ্যানেল, তাবাক ব্লন্ড, শালিমার, ক্রিশ্চিয়ান ডিওর। কিন্তু পারফিউমগুলোর পেছনে যে ফ্র্যাগ্রান্স থাকে, তাদের নাম কেউই প্রায় জানে না। যে-কোম্পানিগুলো সেই ফ্র্যাগ্রান্স বানায়, তাদের নামও না। অথচ এদের প্রত্যেকের ব্যবসার পরিমাণ বিলিয়ন ডলারে মাপতে হয়।’
‘কীরকম কাঁচামাল?’, আমি জিগ্যেস করলাম।
বুধোদা বলল, ‘বিভিন্ন ফুল, ঘাস, পাতার নির্যাসই বেশি। যাদের বলা যায় উদ্ভিজ্জ সুগন্ধী। তাছাড়া সামান্য কিছু প্রাণীজ সুগন্ধী রয়েছে। যেমন কস্তুরী হরিণের নাভি থেকে পাওয়া যায় কস্তুরী বা মাস্ক। কানাডিয়ান বিভারের শরীরের গ্রন্থী থেকে পাওয়া যায় ক্যাস্টোরিয়াম। ইথিওপিয়ার এক নিশাচর ভাম জাতীয় প্রাণীর শরীরের গ্রন্থী থেকে সিভেট। আর স্পার্ম তিমির শরীর থেকে অ্যাম্বারগ্রিস…।’
বুধোদা দিব্যি বলে যাচ্ছিল, আমিও মন দিয়ে শুনছিলাম। কিন্তু হঠাৎ কী যে হল। বুধোদা অস্থিরভাবে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। বিরবিড় করে কবার নিজের মনেই বলল, ‘অ্যাম্বারগ্রিস…অ্যাম্বারগ্রিস।’
আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘কী হল বুধোদা?’
বুধোদা নিজের কপালে মুঠি পাকিয়ে দুটো ঘুষি মেরে বলল, ‘ওঃ! কী স্টুপিড, কী স্টুপিড আমি! সব মিলে যাচ্ছে তো রুবিক। অ্যাম্বারগ্রিসের কথা ভাবিনি কেন এতদিন! অ্যাম্বারগ্রিসকেই তো লোকে তার দামের জন্যে, তার দুর্লভতার জন্যে সমীহ করে সমুদ্রের সোনা বলে ডাকে। একবার ভাব তো, দীনেশবাবু এগজ্যাক্টলি কী বলেছিলেন। বলেছিলেন না, দরিয়ার সোনা যাতে দরিয়ার হাতেই পৌঁছয় তার ব্যবস্থা করে ফেললাম। মাঝের সময়টা ঈশ্বর সেই সোনার পাহারায় রইলেন।’
আমার তখনও বিমূঢ় অবস্থা। বললাম, ‘হ্যাঁ, বলেছিলেন তো। তাতে কী হল?’
বুধোদা বলল, ‘আরে হিন্দিতে দরিয়া মানেই তো সমুদ্র। দীনেশবাবুর ওই কথার মধ্যেও প্রথম দরিয়ার মানে হচ্ছে সমুদ্র, আর দ্বিতীয় দরিয়া ওঁর ছেলে। সমুদ্রের সোনা যাতে ওঁর ছেলের কাছে ফিরে যায় সেই ব্যবস্থা উনি করে ফেলেছিলেন।’
এইবার ব্যাপারটা আমার কাছেও ক্রমশ পরিষ্কার হচ্ছিল। বললাম, ‘ব্যাগের ভেতরের এই গন্ধটা কি তাহলে…?’
আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বুধোদা বলল, ‘আমি দুশোভাগ নিশ্চিত রুবিক, গন্ধটা অ্যাম্বারগ্রিসের।’
আমি বললাম, ‘কিন্তু ওঁর হাতে অ্যাম্বারগ্রিস এল কোথা থেকে? দীনেশবাবু তো সাধারণ ট্রলারে কাজ করতেন। মুম্বাইয়ের আশেপাশের সমুদ্রে তার ঘোরাঘুরি। সেখানে কি তিমি শিকার সম্ভব?’
বুধোদা কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে চেয়ে থেকে আবার নিজের চেয়ারে ফিরে এসে বসল। বলল, ‘তোকে তাহলে অ্যাম্বারগ্রিস জিনিসটা কী, সেটা একটু বলি। তাহলে তোর কাছে ব্যাপারটা ক্লিয়ার হবে।
‘অ্যাম্বারগ্রিস তৈরি হয় তিমি মাছের পেটে। সব তিমির নয়। শুধু স্পার্ম-হোয়েলের পেটে। আবার সব স্পার্ম-হোয়েলের পেটেই যে অ্যাম্বারগ্রিস থাকবে তা নয়। হয়তো একশোটার মধ্যে একটা স্পার্ম-হোয়েলের পেটে অ্যাম্বারগ্রিস তৈরি হয়।
‘কীভাবে হয়? কখন হয়? বৈজ্ঞানিকেরা মনে করেন, তিমিমাছ খাবারের সঙ্গে যে স্কুইডের কাঁটার মতন ধারালো জিনিসগুলো গিলে ফেলে সেগুলো তার অন্ত্রকে যাতে জখম না করতে পারে তার জন্যে একধরনের সিক্রিসন দিয়ে সেগুলোকে ঢেকে দেয়। তারপর ওরকম অনেকটা অপাচ্য জিনিস পেটের মধ্যে জমা হলে সেটাকে উগরে দেয় সমুদ্রের জলে।
‘জিনিসটা যেহেতু জলের চেয়ে হালকা, তাই ভাসতে থাকে। ভাসতে-ভাসতে বহুদূরে চলে যায় আর তার চেহারা আর চরিত্র বদলাতে থাকে। প্রথমে যেটার রং থাকে সাদা, সেটা আস্তে-আস্তে বাদামি হয়ে যায়। প্রথমে যাতে থাকে দুর্গন্ধ, সেটাই ক্রমশ পরিণত হয় এক আশ্চর্য্ সুগন্ধী পদার্থে।
‘কিন্তু এত বড় সমুদ্র। তার মধ্যে কোথায় একটা বাদামি ডেলা ভেসে চলেছে, সেটা মানুষের চোখে পড়ল কিনা, চোখে পড়লেও সে জিনিসটাকে চিনতে পারল কিনা, এতগুলো সম্ভাবনা পেরিয়ে তবে দশ, বিশ, পঞ্চাশ কেজি অ্যাম্বারগ্রিস মানুষের হাতে এসে পৌঁছয়। সেইজন্যেই তার দাম এই মুহূর্তে দু-কোটি টাকা প্রতি কিলোগ্রাম।
‘বুঝলি রুবিক, আমি নিশ্চিত, দীনেশবাবু ট্রলারের ডেকে দাঁড়িয়ে একদিন ওরকম একতাল অ্যাম্বারগ্রিস ভেসে যেতে দেখে চিনতে পেরেছিলেন এবং সেটাকে তুলে এনেছিলেন। মনে পড়ছে তো, দীনেশবাবুর মেন্টর ছিলেন এমন একজন যিনি নাকি দীর্ঘদিন জাপানে তিমি শিকারের জাহাজে কাজ করেছেন। তাঁর কাছ থেকেই নিশ্চয় দীনেশবাবু অ্যাম্বারগ্রিসের নাড়িনক্ষত্র চিনেছিলেন।
‘ফাদার রেনল্ড ব্যাগের ভেতরের জিনিসটার যেরকম সাইজ বলেছিলেন, তাতে তো মনে হচ্ছে দীনেশবাবু যে অ্যাম্বারগ্রিসের তালটা খুঁজে পেয়েছিলেন, সেটার ওজন ন-দশ কেজির কম হবে না।
‘এবার বুঝলি ব্যাগটায় আগে কেন সুগন্ধ ছিল না, আর এখন কেন হালকা সুগন্ধ পাওয়া যাচ্ছে? সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ওর ভেতরে যে সামান্য অ্যাম্বারগ্রিসের অণু রয়ে গেছে, সেগুলো সুগন্ধ ছড়াতে শুরু করেছে, তাই।
‘এবং এটাও নিশ্চয় বুঝতে পারছিস, কেন উনি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কয়েকজন ফ্র্যাগ্রান্স কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছিলেন? অ্যাম্বারগ্রিস জিনিসটাকে ওরাই পাগলের মতন খুঁজে বেড়ায় কিনা। দীনেশবাবুর দুর্ভাগ্য তার আগেই উনি মাফিয়াদের নজরে পড়ে গেলেন। খুনই হয়ে গেলেন শেষ অবধি।’
বললাম, ‘কিন্তু মুম্বাইয়ের মাফিয়ারা জিনিসটার কথা জানল কেমন করে বলো তো।’
বুধোদা বলল, ‘সবটাই আন্দাজে বলছি। দীনেশবাবু যখন জাল থেকে অ্যাম্বারগ্রিসের তালটা মাছধরা জাল থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছেন, তখন তো আর তিনি ওখানে একা ছিলেন না। অন্য শ্রমিকরাও নিশ্চয় ছিল। তাদের কাছ থেকেই নিশ্চয় কথাটা দ্রুত পৌঁছে যায় বন্দর মাফিয়াদের কানে।
‘তারপর আর কী? শুরু হল দীনেশবাবুর পালিয়ে বেড়ানো। সেই পর্বটা তো তুই জানিস। দীনেশবাবু ফাদার রেনল্ডের সঙ্গে সেন্ট মাইকেলস চার্চে এসে উঠলেন এবং ঠিক করলেন, এই চার্চেই তিনি লুকিয়ে রাখবেন সেই সাত রাজার ধন। সেই সমুদ্রের সোনা।’
বললাম, ‘কিন্তু সেই অ্যাম্বারগ্রিসের তাল কোথায় বুধোদা? আমরা তো তন্নতন্ন করে পুরো গির্জাটাই খুঁজে দেখলাম। পেলাম না তো কিছু।’
বুধোদা কেমন অদ্ভুতভাবে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আগেও বহুবার এরকম হয়েছে, রুবিক। তুই বুঝতে পারিসনি, তোরই কোনো একটা কথা থেকে আমি খুঁজে পেয়ে গেছি রহস্যের চাবিকাঠি। এবারেও ঠিক তাই হয়েছে। তুই নিজেই একটু আগে একটা কথায় বলে দিয়েছিস, কোথায় রয়েছে সেই অ্যাম্বারগ্রিস।
‘মজার কথা কী জানিস? সকলের চোখের সামনে থাকলেও কেউ সেটাকে অ্যাম্বারগ্রিস বলে চিনতে পারেনি। ফাদার রেনল্ড পারেননি, দশদিন আগে মুম্বাই থেকে যে-গুন্ডারা এসে চার্চে ভাংচুর চালিয়েছিল তারা পারেনি এবং গত পরশু তুই আর আমিও পারিনি।’
আমি চেঁচিয়ে উঠলাম, ‘যাঃ। হতেই পারে না। আমরা অ্যাম্বারগ্রিস দেখেছিলাম?’
বুধোদা বলল, ‘আলবাত দেখেছিলাম। আবার তোকে দেখিয়ে আনছি, চল। তুই বাড়ি থেকে ড্রেস চেঞ্জ করে আয়। আমি ততক্ষণে গাড়িটা বার করছি।’
ড্রেস চেঞ্জ করার পর লিফটে নয়, আমি সিঁড়ি বেয়ে দুড়দাড় করে নীচে নামলাম। এইরকম মুহূর্তগুলোর জন্যেই তো কতদিন ধরে অপেক্ষা করে থাকি।
.
বুধোদা এরপর যে-স্পিডে গাড়িটাকে চালাল, সেটাকে ইংরিজিতে বলে ‘ব্রেক-নেক স্পিড?’ ধাক্কা লেগে ঘাড় মটকানোর পক্ষে আইডিয়াল। এবং তারমধ্যেও পকেট থেকে ফোন করে দরিয়াকে একগাদা ইনস্ট্রাকশন দিল। তার ফলে যেটা হল, বস্তিটা পেরিয়েই দেখতে পেলাম দরিয়া এবং তার অনুচররা আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছে। ওরাই আমাদের ঘিরে ধরে নিয়ে গেল চার্চের দিকে।
বাকিরা দরিয়ার ইশারায় চার্চের বাইরেই রইল। ভেতরে ঢুকলাম শুধু আমি, বুধোদা, দরিয়া আর ফাদার রেনল্ড।
বুধোদা ভয়ঙ্কর আত্মবিশ্বাস নিয়ে পুলপিটের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর ছ’টা মোমদানের মধ্যে থেকে একটাকে দু-হাতে তুলে নিয়ে মেঝের ওপরে রাখল। দু-হাত লাগাতেই হতো। কারণ, এই মোমদান কিংবা মোমবাতি কোনোটাই ঘরোয়া জিনিস নয়। এগুলো টিপিকাল গির্জার মোমবাতি। একেকটা মোমবাতি একহাত লম্বা এবং সেইরকমই মোটা। উপরন্তু গায়ে পেঁচানো পেঁচানো ডিজাইন।
বুধোদা ফাদার রেনল্ডের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ফাদার, একটু চিন্তা করে বলুন তো, এই মোমবাতিগুলো কি আগে থেকেই এই চার্চে ছিল, না দীনেশবাবু চার্চ ছেড়ে যাবার দিনে নিয়ে এসেছিলেন?’
ফাদার রেনল্ড বললেন, ‘এটা আমার আগেই বলা উচিত ছিল। দীনেশই নিয়ে এসেছিল। ও বলেছিল, প্রভু যিশুকে আমার কৃতজ্ঞতা জানিয়ে গেলাম। এতদিন তিনি আমাকে তাঁর আশ্রয়ে থাকতে দিলেন, এই সামান্য ছ’টি মোমবাতি তাঁর আরতির জন্যে দিলাম।’
বুধোদা আমার দিকে তাকিয়ে চাপা গলায় বলল, ‘বলছিলাম না রুবিক, তুই-ই একটু আগে আমাকে মনে করিয়ে দিয়েছিলিস যে, দীনেশবাবু ব্যাগে করে সেদিন মোমবাতি নিয়ে এসেছিলেন। শুধু তুই যেটা ভাবতে পারিসনি, সেটা হল, মোমবাতিরও নিজস্ব সুগন্ধ থাকতে পারে। পারলে, তুই-ই অ্যাম্বারগ্রিস খুঁজে পেতিস।
তারপর বুধোদা আবার ফাদার রেনল্ডের দিকে ফিরে বলল, ‘সেবারে তো আপনি তাড়াহুড়ো করে মুম্বাইয়ের ট্রেন ধরতে ছুটেছিলেন। এবারে এখানে এসে এগুলো জ্বালিয়েছিলেন?’
‘না না?’ ফাদার নাক সিঁটকোলেন। ‘এগুলো যে বড্ড নোঙরা হয়ে গেছে। কিন্তু বোধিসত্ত্ব, তুমি হঠাৎ মোমবাতি নিয়ে এত ইন্টারেস্টেড হয়ে পড়লে কেন বলো তো?’
‘ইন্টারেস্টেড হলাম ফাদার, কারণ, এগুলো মোমবাতি নয়। অ্যাম্বারগ্রিসের ব্লক। একেকটার ওজন অন্তত দেড় কেজি। মানে মোট ন-কেজি, যার বাজার দর আঠারো-কোটি টাকার আশেপাশে একটা কিছু।’
বুধোদা বাতিটার গা থেকে কিছুটা মোমের মতন পদার্থ খুঁটে নিয়ে আমাদের তিনজনের মধ্যে ভাগ করে দিলেন। বললেন ‘শুঁকে দেখুন আপনারা। এই সৌভাগ্য পৃথিবীতে খুব কম মানুষের হয়।’
আমি নাকের কাছে হাতটা নিয়ে জোরে শ্বাস নিলাম এবং কী বলব, মনে হল, এক আশ্চর্য ম্যাজিকে আমি পৌঁছে গেলাম সমুদ্রের ধারে এক ফুলের বাগানে। ওই একরত্তি অ্যাম্বারগ্রিসের মধ্যে একইসঙ্গে মিশে ছিল সমুদ্রের গন্ধ, ফুলের গন্ধ এবং আরও অনেকগুলো অচেনা সুগন্ধ।
দরিয়া এতক্ষণ অবাক হয়ে বুধোদার কথা শুনছিল। এবার বলল, ‘স্যার, তার মানে বাবা তরুণকাকুকে বলেছিলেন, অ্যাম্বারগ্রিসের লাম্পগুলোকে ছাঁচে ফেলে গির্জার মোমবাতির মতন শেপ দিয়ে দিতে আর তরুণকাকু সেটাই করে দিয়েছিলেন?’
‘এগজ্যাক্টলি’, বলল বুধোদা। বলল, ‘কাজটা এমন কিছু কঠিনও নয়। কারণ সাধারণ মোম আর অ্যাম্বারগ্রিসের ভৌত ধর্ম প্রায় এক। অ্যাম্বারগ্রিসও মোমের মতোই অল্প আঁচে নরম হয়ে যায়। আবার তাপ সরিয়ে নিলে জমেও যায় চট করে। আমার মনে হয় তাঁর বন্ধু যে তাকে সাধারণ মোম দেননি সেটা তরুণবাবু বুঝতেই পারেননি, এক যদি না গন্ধ থেকে কিছু সন্দেহ করে থাকেন। তবে সেক্ষেত্রেও বোঝানো যেতেই পারে যে, মোমের সঙ্গে কৃত্রিম সুগন্ধী মেশানো হয়েছে।’
বুধোদা ঘড়ি দেখল। তারপর বলল, ‘চল রুবিক। এ যাত্রাতেও আমরা কোনো অ্যান্টিক পেলাম না। তবে আশ্চর্য এক অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হল। কী বলিস?’
দরিয়া হা হা করে উঠল। বলল, ‘তার মানে কী স্যার? আপনি আমার এত বড় একটা উপকার করলেন, তার চেয়েও বড় কথা, আমার দুঃখী বাবার শেষ ইচ্ছেটা পূরণ করলেন, দরিয়ার সোনা ঈশ্বরের হেপাজত থেকে ফিরিয়ে দিলেন আরেক দরিয়ার হাতে, আপনারা এভাবে চলে যাবেন তাই হয় নাকি? আপনি কী নেবেন বলুন। আপনার সম্মান দক্ষিণা?’
বুধোদা দরিয়ার কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘আমি তোমাকে আগেই বলেছিলাম দরিয়া, কোনো বেআইনি কারবারের মধ্যে আমি থাকব না। ভারতের মাটিতে অ্যাম্বারগ্রিস বেচা-কেনা এমনকী কাছে রাখাও বেআইনি। তবে দীনেশবাবু সেটা জানতেন না নিশ্চয়ই। আর তাঁর শেষ ইচ্ছেটাকে সম্মান দেওয়ার জন্যেই আমিও কাউকে এই কথা জানাচ্ছি না। এরপর তুমি এই সম্পদ নিয়ে কী করবে, সেটা তোমার বিবেচনা।’
তারপর আর একটাও কথা না বলে, একবারও পেছনদিকে না তাকিয়ে, বুধোদা নদীর তীর ধরে হেঁটে গিয়ে ওর গাড়ির ড্রাইভারের সিটে বসল। আমি পাশে বসা মাত্রই স্টার্ট দিল গাড়িতে।
.
এই ঘটনার ঠিক একবছর বাদে দরিয়াদা হঠাৎই আমাকে একদিন ফোন করল। আমি জানি, এর মধ্যে ওর সঙ্গে বুধোদার নিয়মিত যোগাযোগ হয়েছে, যেমন আগেও হতো। অ্যান্টিকের কেনা-বেচাও হয়েছে। জানতাম, ও এখনো মাকে নিয়ে খিদিরপুরের সেই পুরোনো বাড়িটাতেই আছে। জীবনযাত্রার কোনোই পরিবর্তন হয়নি।
তাহলে হঠাৎ আমাকে ফোন করছে কেন?
ফোনটা রিসিভ করলাম। দরিয়াদা বলল, ‘রুবিক! স্যারকে এসব বলতে ভয় লাগে। তোমাকেই বলছি। তুমি ওঁর মুড বুঝে একটু যদি এগুলো ওকে জানাও।’
আমি বললাম, ‘কী জানাব, দরিয়াদা?’
‘তোমাকে কিছু ফটো হোয়াটস অ্যাপ করছি। ডেসক্রিপসন সঙ্গেই থাকবে। সেই ফটোগুলো ওঁকে দেখিও।’
দরিয়াদা ফোন ছাড়ার পরে আমি ফোটোগুলো দেখলাম।
দেখলাম, পুরোনো সেন্ট মাইকেলস চার্চের জায়গায় মাথা তুলেছে খিদিরপুরের পথশিশুদের জন্যে একটা তিনতলা বিশাল বোর্ডিং স্কুল। সেন্ট মাইকেলস স্কুল। একটা ছবিতে স্কুলের প্রিন্সিপালের চেয়ারে ফাদার রেনল্ডকে বসে থাকতে দেখলাম।
পাশে নন্দীদের মাঠটা না থাকলে ছিমছাম দোতলা বাড়িটা যে কার বুঝতে পারতাম না। তবে এখানেও একটা ছবিতে দোতলার বারান্দায় হাসি-হাসি মুখে দাঁড়িয়েছিলেন আমাদের সেদিনের সেই দুঃখিনী মাসিমা। আর বাড়িটার দরজার ওপরে লেখা ছিল ‘তরুণ স্মৃতি।’
তৃতীয় ছবির গুচ্ছে দেখেছিলাম, ডায়মন্ড হারবারের ফিশিং হারবারের লাগোয়া একটা হাসপাতাল আর বৃদ্ধাবাস। ছবির ক্যাপশনে দরিয়াদা লিখেছিল, এটাও একটা ট্রাস্টের হাতে দেওয়া হয়েছে। শুধু বয়সের ভারে অকর্মণ্য হয়ে যাওয়া নিঃসঙ্গ ধীবররাই ওখানে থাকতে পায়।
শেষকালে দরিয়াদা লিখেছিল, ‘আরও কিছু টাকা এখনো অবশিষ্ট আছে। আরও কিছু কাজের কথাও মাথায় রয়েছে। সেগুলো সমাধা হয়ে গেলেই আমি কলকাতা ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যাব।
আমি মেসেজ করলাম, ‘কোথায় যেতে চাও? পাহাড়ে’
ও উত্তর দিল, ‘দরিয়া কি পাহাড়ে যায়? দরিয়া মানে সমুদ্র। আমি সমুদ্রে যাব, রুবিকবাবু! সমুদ্রের ধারে কোনো নির্জন জেলেদের গ্রামে একটা কুঁড়ে বানিয়ে মা-বেটায় থাকব, এই আমার স্বপ্ন।’
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন