মোল্লা নাসিরুদ্দিনের আরো গল্প (২)

সত্যজিৎ রায়

মোল্লা নাসিরুদ্দিনের আরো গল্প (২)

১.

রাজদরবারে নাসিরুদ্দিনের খুব খাতির।

একদিন খুব খিদের মুখে বেগুন ভাজা খেয়ে ভারী খুশি হয়ে রাজা নাসিরুদ্দিনকে বললেন, বেগুনের মতো এমন সুস্বাদু খাদ্য আর আছে কি?

বেগুনের জবাব নেই, বললে নাসিরুদ্দিন।

রাজা হুকুম দিলেন, এবার থেকে রোজ বেগুন খাব।

তারপর পাঁচদিন দুবেলা বেগুন খেয়ে ছদিনের দিন রাজা হঠাৎ বেঁকে বসলেন। খানসামাকে ডেকে বললেন, দূর করে দে আমার সামনে থেকে এই বেগুন ভাজা।

বেগুন অখাদ্য, সায় দিয়ে বললে নাসিরুদ্দিন।

রাজা একথা শুনে ভারী অবাক হয়ে বললেন, সে কী মোল্লাসাহেব, তুমি যে এই সেদিনই বললে বেগুনের জবাব নেই!

আমি তো আপনার মোসাহেব, জাঁহাপনা, বললে নাসিরুদ্দিন, বেগুনের তো নই।

.

২.

নাসিরুদ্দিন সরাইখানায় ঢুকে গম্ভীরভাবে মন্তব্য করলে, সুর্যের চেয়ে চাঁদের উপকারিতা অনেক বেশি।

কেন মোল্লাসাহেব? অবাক হয়ে প্রশ্ন করলে সবাই।

চাঁদ আলো দেয় রাত্তিরে, বললে নাসিরুদ্দিন, দিনে আলোর দরকারটা কী শুনি?

.

৩.

নাসিরুদ্দিন তার এক বন্ধুকে নিয়ে সরাইখানায় ঢুকেছে দুধ খাবে বলে। পয়সার অভাব, তাই এক গেলাস দুধ দুজন আধাআধি করে খাবে।

বন্ধু বললে, তুমি আগে খেয়ে নাও তোমার অর্ধেক। বাকিটা আমি পরে চিনি দিয়ে খাব।

চিনিটা আগেই দাও না ভাই, বললে নাসিরুদ্দিন, তা হলে দুজনেরই দুধ মিষ্টি হবে।

বন্ধু মাথা নাড়লে। আধ গেলাসের মতো চিনি আছে আমার সঙ্গে, আর নেই।

নাসিরুদ্দিন সরাইখানার মালিকের সঙ্গে দেখা করে খানিকটা নুন নিয়ে এল। ঠিক আছে, সে বললে বন্ধুকে, এই নুন ঢাললাম দুধে। আমি অর্ধেক নোনতা খাব, বাকি অর্ধেক মিষ্টি খেও তুমি।

.

৪.

মোল্লা এক ছোঁকরাকে মাটির কলসি দিয়ে পাঠালে কুয়ো থেকে জল তুলে আনতে। দেখিস, কলসিটা ভাঙিসনি যেন, বলে একটা থাপ্পড় মারলে ছোঁকরার গালে।

এক পথচারী ব্যাপারটা দেখে বললে, কলসি না ভাঙতেই চড়টা মারলেন কেন মোল্লাসাহেব?

তোমার যা বুদ্ধি,বললে নাসিরুদ্দিন, ভাঙার পরে চড় মারলে কি আর কলসি জোড়া লেগে যাবে?

.

৫.

নাসিরুদ্দিন একটা মনিহারী দোকানে গিয়ে জিজ্ঞেস করলে, এখানে পেরেক পাওয়া যায়?

আজ্ঞে হ্যাঁ, বললে দোকানদার।

আর চামড়া?

আজ্ঞে হ্যাঁ, যায়।

আর সুতো?

যায়, আজ্ঞে।

আর রঙ?

তাও যায়।

তা হলে তুমি বসে না থেকে একটা জুতো তৈরি করে ফেলো না বাপু!

.

৬.

নাসিরুদ্দিন এক পড়শির কাছে গিয়ে হাত পাতলে। এক গরিব তার দেনা শোধ করতে পারছে না। তার সাহায্যে যদি কিছু দেন।

পড়শির মনটা দরাজ, সে খুশি হয়ে তার হাতে কিছু টাকা দিয়ে বললে, আহা বেচারি! এই ঋণগ্রস্ত অভাগাটি কে, মোল্লাসাহেব?

আমি, বলে নাসিরুদ্দিন হাওয়া।

কিছুদিন পরে নাসিরুদ্দিন আবার সেই পড়শির কাছে এসে হাত পেতেছে। পড়শি একবার ঠকে সেয়ানা হয়ে গেছে। বললে, বুঝেছি। দেনাদারটি এবারও তুমিই তো?

আজ্ঞে না। বিশ্বাস করুন। এবার সত্যিই আমি না।

পড়শির আবার মন ভিজল। নাসিরুদ্দিনের হাতে টাকা দিয়ে বললে, এবার কার দুঃখ দূর করতে যাচ্ছ মোল্লাসাহেব?

আজ্ঞে, আমার।

কীরকম?

আজ্ঞে এই অধম এবার পাওনাদার।

.

৭.

সুসংবাদ দিলে বকশিশ পায় জেনে একজন লোক নাসিরুদ্দিনকে গিয়ে বললে, তোমার জন্য খুব ভাল খবর আছে, মোল্লাসাহেব।

কী খবর?

তোমার পাশের বাড়িতে পোলাও রান্না হচ্ছে।

তাতে আমার কী?

তোমাকে সে পোলাওয়ের ভাগ দেবে বলছে।

তাতে তোমার কী?

.

৮.

নাসিরুদ্দিন নদীর ধারে বসে আছে, এমন সময় দেখে নজন অন্ধ নদী পেরোবার তোড়জোড় করছে।

নাসিরুদ্দিন তাদের কাছে প্রস্তাব করলে যে, জনপিছু এক পয়সা করে নিয়ে সে নজনকে পর পর কাঁধে করে পার করে দেবে। অন্ধরা রাজি হয়ে গেল।

নাসিরুদ্দিন আটজনকে পার করে ননম্বরের বেলায় মাঝনদীতে হোঁচট খেতে পিঠের অন্ধ জলে। তলিয়ে গেল।

বাকি আটজন দেরি দেখে ওপার থেকে চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলে, কী হল মোল্লাসাহেব?

এক পয়সা বাঁচল তোমাদের, বললে নাসিরুদ্দিন।

.

৯.

নাসিরুদ্দিন আর তার গিন্নি একদিন বাড়ি ফিরে এসে দেখে চোর এসে বাড়ি তছনছ করে দিয়ে গেছে। গিন্নি তো রেগে আগুন। বললে, এ তোমার দোষ। সদর দরজায় তালা দাওনি, তাই এই দশা।

পড়শিরাও সেই একই সুর ধরলে। একজন বললে, জানলাগুলোও তো ভাল করে বন্ধ করোনি দেখছি।

আরেকজন বললে, চোর আসতে পারে সেটা আগেই বোঝা উচিত ছিল।

আরেকজন বললে, দরজার তালাগুলোও পরীক্ষা করে দেখা উচিত।

কী আপদ! বললে নাসিরুদ্দিন, তোমরা দেখছি শুধু আমার পিছনেই লাগতে শুরু করলে!

দোষ তো তোমারই মোল্লাসাহেব, পড়শিরা বললে।

বটে? বললে নাসিরুদ্দিন, আর চোরের বুঝি দোষ নেই?

.

১০.

নাসিরুদ্দিনের ভারী শখ একটা নতুন জোব্বা বানাবে, তাই পয়সা জমিয়ে দরজির দোকানে গেল ফরমাশ দিতে। দরজি মাপ নিয়ে বললে, আল্লা করেন তো এক সপ্তাহ পরে আপনি জোব্বা পেয়ে যাবেন।

নাসিরুদ্দিন এক সপ্তাহ কোনওরকমে ধৈর্য ধরে তারপর আবার গেল দরজির দোকানে।

একটু অসুবিধা ছিল মোল্লাসাহেব, বললে দরজি, আল্লা করেন তো কাল আপনি অবশ্যই জোব্বা পেয়ে যাবেন।

পরদিন গিয়েও হতাশ। মাফ করবেন মোল্লাসাহেব, বললে দরজি, আর একটি দিন আমাকে সময় দিন। আল্লা করেন তো কাল সকালে নিশ্চয় রেডি পাবেন আপনার জোব্বা।

নাসিরুদ্দিন এবার বললে, আল্লা না করে তুমি করলে জোব্বাটা কবে পাব সেটা জানতে পারি কি?

.

১১.

এক প্রবীণ দার্শনিক সরাইখানায় বসে বিলাপ করছেন, বিচিত্র জীব এই মানুষ। কোনও কিছুতেই তৃপ্তি নেই। শীতকালে বলে ঠাণ্ডায় মলাম, গ্রীষ্মে বলে গরমে প্রাণ আইঢাই।

সবাই তার কথায় সায় দিয়ে গম্ভীরভাবে মাথা নাড়ল।

বসন্তের বিরুদ্ধে যার নালিশ আছে সে হাত তোলো, বললে নাসিরুদ্দিন।

.

১২.

নাসিরুদ্দিনের গানবাজনা শেখার শখ হয়েছে। এক জবরদস্ত ওস্তাদের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলে, আপনি বাদ্যযন্ত্র শেখাতে কত নেন?

প্রথম মাসে তিন রৌপ্যমুদ্রা, তারপর থেকে প্রতি মাসে এক রৌপ্যমুদ্রা।

বেশ, তা হলে দ্বিতীয় মাস থেকেই শুরু করব আমি, বললে নাসিরুদ্দিন।

.

১৩.

এক চোর নাসিরুদ্দিনের বাড়িতে ঢুকে তার প্রায় সর্বস্ব চুরি করে রওনা দিল নিজের বাড়ির দিকে।

নাসিরুদ্দিন রাস্তা থেকে সব দেখে একটি কম্বল কাঁধে নিয়ে চোরের পিছু ধাওয়া করে তার বাড়িতে ঢুকে কম্বল গায়ে দিয়ে শুয়ে পড়ল মেঝেতে।

কে হে তুমি? চোর জিজ্ঞেস করলে, আমার বাড়িতে কেন?

আমার জিনিস যখন সবই এখানে, বললে নাসিরুদ্দিন, এখন থেকে এটাই আমার বাড়ি নয় কি?

.

১৪.

সরাইখানায় কজন সৈনিকের আগমন হয়েছে। তারা যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের বীরত্বের বড়াই করছে। একজন বললে, খোলা তলোয়ার হাতে এমন তেজের সঙ্গে ছুটলাম আমি দুশমনের দিকে যে-তারা একেবারে ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। আমায় রেখে কার সাধ্য!

সবাই একথা শুনে সমস্বরে বাহবা দিলে। নাসিরুদ্দিনও এককালে যুদ্ধ করেছে। সে বললে, তোমার কথা শুনে আমার নিজের একটা যুদ্ধের ঘটনা মনে পড়ছে। এক শত্রুর পা কেটে ফেলেছিলাম তলোয়ারের এক কোপে।

তাই শুনে এক প্রবীণ যোদ্ধা বললে, ওইখানেই তো ভুল। কাটা উচিত ছিল মুণ্ডুটা।

মুণ্ডুটা না থাকলে আর মুণ্ডু কাটব কোত্থেকে? বললে নাসিরুদ্দিন।

.

১৫.

এক পড়শি মোল্লাসাহেবের কাছে একগাছ দড়ি ধার চাইতে এসেছে।

পাবে না বলে নাসিরুদ্দিন।

কেন মোল্লাসাহেব?

দড়ি কাজে লাগছে।

ওটা তো মাটিতে পড়ে আছে আজ কদিন থেকে মোল্লাসাহেব।

ওটাই কাজ।

পড়শি তবু আশা ছাড়ে না। বললে, কদিন চলবে কাজ মোল্লাসাহেব?

যদ্দিন না ওটা ধার দেওয়া দরকার বলে মনে করি বললে নাসিরুদ্দিন।

.

১৬.

নাসিরুদ্দিন হামামে গেছে গোসল করতে। পরিচারক তার ছেঁড়া পোশাক দেখে আধখানা সাবান আর একটা ময়লা তোয়ালে ছুঁড়ে দিলে তার দিকে।

নাসিরুদ্দিন কিন্তু যাবার সময় তাকে ভালরকম বকশিশ দিয়ে গেল। পরিচারক ভাবলে, এ কেমন হল? খাতির না করেই যদি এত পাওয়া যায় তা হলে খাতির করলে না জানি কত মিলবে!

পরের সপ্তাহে নাসিরুদ্দিন আবার গেছে হামামে। এবার তাকে দেখেই পরিচারক একেবারে বাদশার হালে তার তোষামোদ করেছে। আচ্ছা রকম দলাই-মালাই করে, গায়ে আতর ছিটিয়ে দিয়ে, কাজের শেষে হাত পাততেই নাসিরুদ্দিন তাকে একটি তামার পয়সা দিয়ে বললে, গতবারের জন্য এই বকশিশ। এবারেরটা তো আগেই দেওয়া আছে।

.

১৭.

নাসিরুদ্দিন এক আমীরের বাড়ি গেছে দুর্ভিক্ষের চাঁদা তুলতে। দরোয়ানকে বললে, তোমার মনিবকে গিয়ে বলল মোল্লাসাহেব চাঁদা নিতে এসেছেন।

দরোয়ান ভিতরে গিয়ে মিনিটখানেক পরে ফিরে এসে বললে, আজ্ঞে, মনিব একটু বাইরে গেছেন।

তা হলে তোমায় একটা কথা বলে যাই,বললে নাসিরুদ্দিন, তোমার মনিব এলে তাঁকে বোলো যে, বেরোবার সময় তাঁর মুণ্ডুটা যেন জানলার ধারে রেখে না যান। কখন চোর আসে বলা কি যায়!

সন্দেশ, শারদীয়া ১৩৮৫

সকল অধ্যায়

১. পুরস্কার
২. বর্ণান্ধ
৩. বঙ্কুবাবুর বন্ধু
৪. টেরোড্যাকটিলের ডিম
৫. সেপ্টোপাসের খিদে
৬. অনাথবাবুর ভয়
৭. প্রোফেসর হিজিবিজবিজ
৮. ক্লাস ফ্রেণ্ড
৯. অতিথি
১০. রামধনের বাঁশি
১১. সুজন হরবোলা
১২. নিতাই ও মহাপুরুষ
১৩. মহারাজা তারিণীখুড়ো
১৪. হাউই (নাটক)
১৫. প্রতিকৃতি
১৬. তারিণীখুড়ো ও ঐন্দ্রজালিক
১৭. অনুকূল
১৮. কাগতাড়ুয়া
১৯. টেলিফোন
২০. রণ্টুর দাদু
২১. সহযাত্রী
২২. ব্লু-জন গহ্বরের বিভীষিকা
২৩. মোল্লা নাসিরুদ্দিনের গল্প
২৪. মোল্লা নাসিরুদ্দিনের আরো গল্প
২৫. মোল্লা নাসিরুদ্দিনের আরো গল্প (২)
২৬. আবার মোল্লা নাসিরুদ্দিন
২৭. আর এক দফা মোল্লা নাসিরুদ্দিন
২৮. ব্রেজিলের কালো বাঘ
২৯. মঙ্গলই স্বর্গ
৩০. ঈশ্বরের ন লক্ষ কোটি নাম
৩১. ইহুদির কবচ

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন