পিয়া সরকার
ঘিলু যায় ভেস্তিয়ে বুদ্ধি গজায় না!
আজ সকালে থানায় পৌঁছাতেই বড় চমক অপেক্ষা করছিল। গতকাল রাতে বাঁকুড়ার জয়পুর রিজার্ভ ফরেস্টে মাওবাদীদের সঙ্গে গোলাগুলি বিনিময়ের পর মোতিরা পোয়ামের ডানহাত জগন্নাথ বাস্কে নিহত হয়েছে। উদ্ধার হয়েছে প্রচুর পরিমাণে অস্ত্র আর গোলাবারুদ।
বাঁকুড়ার এস.পি জানিয়েছেন, বিশ্বস্ত সূত্রে খবর পেয়ে, স্পেশাল অপারেশন গ্রুপ, ডিভিএফ জওয়ান ও রাজ্য পুলিশের একটা জয়েন্ট টিম জয়পুর ফরেস্টে এই অপারেশন চালায়। এই টিমের লিডে ছিলেন ডি.আই.জি অভিনন্দন রায়। মাওদলের কিছু সদস্য পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও, জগন্নাথ বাস্কের মৃত্যু বিরাট সাফল্য নিয়ে এসেছে বলে জানান এস.পি। ক্রমাগত শক্তিক্ষয়ের ফলে মাও নেতা মোতিরা পোয়ামের গ্রেফতারি অথবা আত্মসমর্পণ এখন সময়ের অপেক্ষা বলে জানান এস.পি
ডি.আই.জি কেন এতদিন ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিলেন তা বুঝতে পারলাম। থানায় একটা চাপা খুশি আর গর্বের আবহ ছিল। দূরাগত সাফল্য হলেও তার ছিটেফোঁটা এই রোজকারের উর্দিগুলোকে একটু অক্সিজেন জোগায় বৈকি। খবরের কাগজের পাতা উল্টিয়ে, টিভিচ্যানেলের বাইট শুনে মুখগুলো চকচক করছে দেখে খুব ভালো লাগল। অভিনন্দন রায়ের মুকুটে আরেকটা পালক জুড়ল। নিরঞ্জন সেন হয়ত এবার ইন্টারভিউটা সত্যি পেয়ে যাবেন।
আমি এইসব উচ্ছ্বাস থেকে একটু দূরে থানার কম্পাউন্ডে পায়চারি করছিলাম। বিভাস আমাকে ডাকতে এল। নৈহাটি পি.এস থেকে ফোন এসেছে। থানা ইনচার্জ জানালেন ওঁরা দিবাকর বিশ্বাসের বাড়িতে গিয়েছিলেন। অযোধ্যাতে যখন ঘটনাটা ঘটে, তখন সদ্য ছমাসের বিবাহিত জীবন দিবাকরের। ভদ্রলোক একমাত্র সন্তান। বাবা রিটায়ার্ড স্কুলমাস্টার, মা গৃহবধূ। দুজনেই মারা গেছেন ২০১২ থেকে ১৪ সালের মধ্যে। বাড়ি এখন লকড থাকে। পাড়া প্রতিবেশীরা জানিয়েছেন, দিবাকরের স্ত্রী নীলিমা বৈদ্যবাটিতে তাঁর বাপের বাড়ি থাকেন। মাঝেসাঝে এই বাড়িতে এসে তালা খুলে বাড়ি পরিষ্কার করিয়ে আবার ফিরে যান। প্রতিবেশীদের কাছ থেকেই নিলীমা বিশ্বাসের নাম্বার জোগাড় করে রেখেছিলেন এস.এইচ.ও। সেটি দিয়ে অল দ্য বেস্ট বলে ফোন ছাড়লেন ভদ্রলোক।
ওপারে মোবাইলটা অনেকক্ষণ রিং হয়ে বন্ধ হয়ে গেল। ব্যস্ত আছেন হয়ত ভেবে ফোনটা রাখতেই কল ব্যাক করলেন নিলীমা।
কল রেকর্ডার অন করে, কানে ফোন ঠেকিয়ে বললাম, “হ্যালো?”
ওপার থেকে একটা ক্লান্ত গলা বলল, “হ্যাঁ, বলুন। কে বলছেন?”
“আমি দর্শনা বোস। বাঘমুণ্ডি থানার এস.আই। আপনার স্বামী দিবাকর বিশ্বাসকে নিয়ে কিছু কথা ছিল।”
ফোনে পলকয়েক কোনো শব্দ এল না। তারপর নিলীমা শান্ত গলায় বললেন, “কিছু জানা গেছে কি? উনি আর বেঁচে নেই, তাই তো?”
আমি কথা হাতড়িয়ে বললাম, “না আসলে একটা সম্ভাবনা তৈরী হয়েছে ওঁকে পাওয়ার…”
নিলীমা আমাকে থামিয়ে বললেন, “জীবিত না মৃত?”
আমি দুসেকেন্ড দম নিয়ে বললাম, “মৃত।”
“ওহ!” হতাশার একটা ছোট্ট অভিব্যক্তি এল কণ্ঠস্বরে। যেন নিজে যে খবরের প্রত্যাশা করেছেন এতদিন, তাতে সরকারি শিলমোহর পড়েছে বলে হাল ছেড়ে দিলেন একেবারে।
“বলুন কী জানতে চান?” নিলীমা একটু পরে জিজ্ঞাসা করলেন।
“আপনি এখন কী করছেন? কোথায় আছেন?”
“কেন? সরকার থেকে কোনো মেডেল দেওয়া হবে বুঝি?” নিলীমার গলাটা ব্যঙ্গে বেঁকে গেল।
“ম্যাডাম, আপনার জন্য ডিপার্টমেন্টের তরফ থেকে আমি…”
“শুকনো সমবেদনা দেবেন না প্লিজ!” নীলিমা রুক্ষস্বরে বলে উঠলেন, “এত বছরেও ওঁকে কে মারল সেটা বার করতে পারেননি আপনারা। উল্টে যাদের বিরুদ্ধে খবর জোগাড় করতে নেমে প্রাণ খোওয়ালেন, তাদের মধ্যে অনেকেই আজ পুলিশ! কী আশ্চর্যের ব্যাপার না!”
“আপনি বরং একটু শান্ত হন। আমি পরে কথা বলব।” আমি কোনো কথা খুঁজে না পেয়ে ফোনটা রাখতে গেলাম।
“না! এই ব্যাপারে বারবার কথা বলার রুচি বা প্রবৃত্তি আমার নেই। আপনার যা জিজ্ঞাস্য এখনই বলুন।”
“দিবাকর বাবু নিখোঁজ হওয়ার আগে, আপনার সঙ্গে তাঁর শেষ দেখা কবে হয়?”
“ষোলোই অগাস্ট। স্বাধীনতা দিবসের দিন সেবার বাড়ি ছিলেন। পনের তারিখ রাতে ফোন এল, বলল যেতে হবে। ষোল সকালে বেরিয়ে গেলেন।”
“কোথায় যেতে হবে কিছু বলেছিলেন?”
“কখনই বলতেন না, কোথায় যাচ্ছেন। খুব জোরাজুরি করলেও নয়। বলতেন এসব পার্ট অ্যান্ড পার্সেল অফ আই.বি পোস্টিং।”
“কোন সব?”
“এই গোপনীয়তা…কাজের সম্পর্কে কোনো কিছু আলোচনা না করা। “ “কোনো বিষয়ে চিন্তিত থাকতে দেখেছিলেন? কাজের সাফল্য অসাফল্য নিয়ে কোনো আলোচনা?”
“বুঝতে পারিনি। খুবই কমসময়ই পেয়েছি ওঁকে,” নিলীমার গলাটা ধরে এল, “দু একদিনের জন্য বাড়ি আসতেন, কাজের কথা কিছু আলোচনা হত না। হইহই করে কাটিয়ে দিতেন।”
আমি সামান্য থেমে নিলীমাকে সময় দিলাম। তারপর বললাম, “তাও…
কখনও কোনোসময়… অন্যমনস্কভাবে…”
নীলিমা কিছুক্ষণ ভাবলেন, ইতস্তত করে বললেন, “একটা খুব ব্যক্তিগত মুহূর্ত মনে পড়ছে। যদিও জানি না, কোনো কাজের কিনা।”
“যদি অসুবিধা না থাকে বলুন না।”
“খুব ছন্দে কথা বলতে ভালোবাসতেন তো। সুকুমার রায় খুব প্রিয় ছিল। পনের তারিখ রাতে ওঁকে একান্তে জিজ্ঞাসা করলাম, উনি যেখানে কাজের প্রয়োজনে যান, সেখানে আমাকে নিয়ে যেতে পারেন না?”
“তাতে কী বললেন?”
“অন্যমনস্কভাবে একটা ছড়া শোনালেন।”
“মনে আছে আপনার?”
“শুধু যে মনে আছে তাই না…লেখা আছে আমার কাছে।”
“আপনি লিখে রাখতেন!” একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম।
নীলিমা সামান্য হাসলেন। যেন পুরোনো কথা মনে পড়ে গেল। বললেন, “আসলে প্রেমের কথাও ওভাবেই লিখে পাঠাতেন। মেসেজে। ছড়া করে, কাব্য করে। যাতে হারিয়ে না যায়, লিখে রাখতাম। এটাও লিখে রেখেছিলাম।”
“আপনার কাছে আছে লেখাটা?”
“একটু দাঁড়ান। নিয়ে আসছি।”
একটু পরে খসখস করে একটা শব্দ হল। মনে হয় ডায়েরির পাতা উল্টালেন। তারপর নীলিমার কণ্ঠস্বর ভেসে এল,
“জোছনা রাতে সবাই যেথায় আলতা মাখায় চোখে,
যেথায় পথে দমদমাদম পটল তোলে লোকে,
সেই দেশেরই প্যায়দা আমি, পল্টনেতে সেরা
অষ্টপ্রহর লেপমুড়ি দিই, নইলে যাব ধরা
রাতে নিজের ট্যাঁকঘড়িটি ডুবিয়ে রাখি ঘিয়ে,
সকাল বিকাল বিছনা পাতি শিরীষ কাগজ দিয়ে,
সেই দেশেতে রাত দুপুরে, নামতা শোনায় একশ উড়ে,
চাঁদনি রাতের গান কেড়ে নেয়, ছায়ার বাজি ছুঁড়ে
সেই দেশেতে বসন্তরাগ? ইমন, আভোগ কিংবা বেহাগ?
লক্ষ্মী মেয়ে রাগ করো না, গোলকধাঁধায় ডুব মেরো না
সুরের নেশায় চিত্ত অবাক, রঙিন আকাশ মাখবে সোহাগ
সেই ক্ষণেতে ফিরব আমি, বাড়িয়ে দিও হাত দুখানি…”
নিলীমার গলা আবার ধরে এল। ফোনটা করেছি বলে মনে একটা অস্বস্তি হল। কতবার কত মানুষের গোপন দুঃখ চাগিয়ে দিতে হবে, কে জানে!
নীলিমা একটু সামলাতে বললাম, “আপনি নিশীথ মাহাতো বলে কাউকে চেনেন?”
“নিশীথ মাহাতো! মানে যিনি রিসেন্টলি খুন হলেন?” নিলীমা অবাক হয়ে বললেন।
“হ্যাঁ।”
“আমি কীভাবে চিনব!”
“দিবাকরবাবুর কাছে আলাদা করে কারুর নাম শুনেছেন?”
“নাহ!”
“দেবাশিস মাহাতো? রাজা?”
“না। এরা কারা!”
আমি আর উত্তর দিলাম না। প্রয়োজনে আবার ফোন করব বলে রেখে দিলাম। আমার মাথায় দিবাকর বিশ্বাসের কবিতা ঘুরপাক খাচ্ছিল।
নিলীমা বিশ্বাস এখনও শোকগ্রস্তা। কিন্তু সেটাই সবথেকে বেশি অস্বস্তির কারণ। যদি উনি স্বাভাবিক জীবনছন্দে ফিরে যেতেন, তবে ওঁকে সন্দেহ তালিকার বাইরে রাখতাম। এই এতগুলো বছরে দিবাকর বিশ্বাস সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়ে উনি কি গোপন কিছু জানতে পেরেছিলেন? নিশীথ মাহাতোকে চেনেন না এটা কি আদৌ সত্যি বললেন? প্রতিশোধ নেওয়ার সবথেকে বড় মোটিভ তো তাঁরই। কিন্তু এই ধরণের খুনে যে বিরাট প্ল্যানিং লাগে সেটা করার জন্য লোকাল এরিয়া সম্পর্কে বেশ আঁটোসাঁটো জ্ঞান দরকার। তবে কি লোকাল কাউকে ব্যবহার করে…! বৈদ্যবাটি পি.এসে ফোন করে নীলিমা বিশ্বাসের ফোন কলের রেকর্ড আর গত তিন মাসের হোয়ারাবাউটের একটা ডিটেইলড রিপোর্ট চাইলাম। থানা ইনচার্জ কতটা সহযোগিতা করবেন বোঝা গেল না। সেরকম প্রয়োজনে বৈদ্যবাটি যেতে হবে।
থানায় একটা কুরিয়ার কোম্পানির লোক ঢুকল। সাদা মোটা একটা প্যাকেট, তাতে আমার নাম লেখা। পাঠিয়েছেন এসিপি পুরকায়স্থ। সই করে প্যাকেটটা খুলতেই একটা মোটসোটা ডকুমেন্টের তাড়া বেরোলো। খুলে দেখলাম সি.আই.ডি ইনভেস্টিগেশনের রিপোর্টের কপি। পি.পি স্যারকে একটা থ্যাঙ্কু বলে মেসেজ লিখলাম।
রিপোর্টটা দেড়শ পাতার। ইনভেস্টিগেটিং অফিসারদের নাম ঠিকানা, ফোন নম্বর, কেসের ডেসক্রিপশন, আগের ইনভেস্টিগেশনের ফাইন্ডিংস, দিবাকর বিশ্বাসের জব প্রোফাইলের সঠিক ডেসক্রিপশন, বেশ কিছু দীর্ঘ জেরার রিটেন কপি…খুঁটিয়ে পড়তে গেলে দুদিন লেগে যাবে। মতিদা পাশের টেবিলে বসে বিরক্ত হয়ে কাগজপত্র উল্টাচ্ছিলেন। সার্কল ইন্সপেক্টর হিসাবে ওঁর একাধিক কাজের দায়িত্ব। নিশীথ মাহাতো মার্ডার কেসে প্রথম চার-পাঁচদিন সেসব থেকে সাময়িক অব্যাহতি পেয়েছিলেন। কিন্তু আবার নানা কাজে তাঁর ডাক পড়ছে। ডিপার্টমেন্টে লোক শর্ট। আমি দিবাকর বিশ্বাসের ফাইলটা নিয়ে গিয়ে দাঁড়াতে আমার দিকে মুখ তুলে তাকালেন। চোখদুটো ক্লান্ত লাগছিল।
“কী হয়েছে মতিদা?”
ম্লান হেসে বললেন, “এস.পি অফিস থেকে দিবাকর বিশ্বাসের ফাইল নিয়ে নাড়াঘাঁটা খুব একটা ভালো চোখে দেখছে না। ভাবছে অসীমকে বাঁচানোর জন্য আমরা জবরদস্তি কেসদুটোকে লিঙ্ক করার চেষ্টা করছি।”
“আশ্চর্য!” আমি বলে উঠলাম, “একী ছেলের হাতের মোয়া নাকি, কড়াই থেকে নামিয়ে গড়ে দেব! একটা লোককে এমন নৃশংসভাবে খুন করা হল, তার বাড়ি থেকে একজন আই.বি অফিসারের কঙ্কাল পাওয়া গেল…”
“সেটা তো কনফার্মড নয়।” মতিদা মৃদু প্রতিবাদ করে উঠলেন।
“ডিজিটাল সুপারইমপোজিশনের রিপোর্টটা আসুক! এত তাড়া কিসের ডিপার্টমেন্টের?”
মতিদা হাসলেন। তারপর বললেন, “ফর্মালিটিগুলো বোঝ। প্রথম কথা দিবাকর বিশ্বাসের কেসটা কোল্ড কেস। এখন যা যা আমরা করেছি সবটাই ইনফর্মালি করা। নতুন করে তদন্ত শুরু করতে হলে সি.আই.ডিকে জানাতে হবে, এস.পিকে কনভিন্স করতে হবে। কোর্ট অর্ডার বার করতে হবে। তারপর বাকি প্রসেস।”
“দিবাকর বিশ্বাসের স্কেলিটনটা যে দিবাকরবাবুরই, সেটা প্রুভ হয়ে গেলে তো কেস রি-ওপেনের অ্যাপিল করতে পারি আমরা?”
“করতে পারি। কিন্তু অত সময় পাব কী!” মতিদা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “মজন্তালী সরকারের গল্প পড়িসনি? লোকজন আজকাল খাপেই থাকে। ঝাঁপে যায় না। অসীম নিজে সুড়সুড় করে গর্তে ঢুকেছে। নিজের ডিপার্টমেন্ট, তবুও অতিশয় লজ্জার সঙ্গে বলছি, এখন নিশীথ মাহাতো খুনে আসামীর একটা রেডিমেড মুখ দরকার ছিল। সেটা পেয়ে গেছে। এবার বেশি এদিক ওদিক ঘোরালে চাপ হবে।”
“আমাদের কি কেস থেকে সরিয়ে দিতে পারে নাকি?” আমি উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম।
মতিদা কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন, “দেখা যাক! আমি শেষ মুহূর্ত অবধি চেষ্টা চালিয়ে যাব। আপাতত দুদিন আসছি না। তুই একটু ম্যানেজ করে নিস।”
মতিদা বেরিয়ে যেতে, মনে মনে খিস্তি দিয়ে ডিপার্টমেন্টের গুষ্টি উদ্ধার করলাম। মতিদা যতই বলুন, দিবাকর বিশ্বাসের কেসে নিশীথ মাহাতোর হাত থাকা প্রমাণিত হয়ে যাওয়া যে বেশ বড়সড় একটা রাজনৈতিক সেট-ব্যাক, সেটা বোঝার মত বুদ্ধি আমার আছে। দিবাকর বিশ্বাসের ফাইলটা পড়তে শুরু করলাম। বাঘমুণ্ডিতে তাঁকে পাঠানোর উদ্দেশ্য কেস প্রিমাইসেসে লেখা। আই.ও রিপোর্ট দিয়েছেন যে ২০০৪ সালের অক্টোবর মাসে বাঘমুণ্ডি থানার বীরগ্রামে দুজন সিপিআইআর নেতাদের গুলি করে ওড়ায় আলট্রারা। পুলিশ খবর পেয়ে, স্পটে পৌঁছালে আলট্রাদের ফেলে যাওয়া মাইন ফেটে মারা যায় দুজন পুলিশকর্মী। এর ঠিক তিন সপ্তাহ পরে, পুলিশের কাছে আলট্রাদের একটা অস্ত্রের কনসাইনমেন্ট পৌঁছানোর খবর পৌঁছায়। ঝাড়খণ্ড বর্ডারে এই অস্ত্র কেনাবেচা আটকাতে ছজন পুলিশের একটা টিমকে পাঠানো হয়। হাইলি সিক্রেটিভ মিশন, কিন্তু আলট্রারা কীভাবে যেন খবর পেয়ে যায়। এবং বুবিট্র্যাপ ফেটে জিপ সমেত ছজন পুলিশকর্মী ছিন্নভিন্ন হয়ে যান।
চারপাতা জোড়া কেস প্রিমাইসেসে আই.ও বাঘমুণ্ডি, ঝালদা, বলরামপুর বেল্টে একাধিক কেসের রেফারেন্স দিয়ে বারবার ইনটেলিজেন্স ফেলিওর শব্দটা ব্যবহার করেছেন। দিবাকর বিশ্বাসকে আই.বি, ইনটেলিজেন্স ফেলিওরের কারণ অনুসন্ধান করতে পাঠায়। বিশ্বাস বাঘমুণ্ডিতে প্রথম আসেন ২০০৪ এর মে মাসে। কলকাতাস্থিত একটা এন.জি.ওর কর্মী রূপে। খুব সহজেই স্থানীয় আদিবাসীদের মধ্যে ইনফিলট্রেট করেন। তাঁর পাঠানো রিপোর্টের ভিত্তিতে দুবার বড়সড় দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পায় ডিপার্টমেন্ট। একবার স্বাস্থ্যকর্মীদের একটা অ্যাম্বুলেন্স কনভয় করে নিয়ে চলা একটা জিপ, দ্বিতীয়বার স্বয়ং তৎকালীন এস.পি। দুবারই তাঁর দেওয়া খবরের ভিত্তিতে আগেভাগেই রাস্তায় পোঁতা ল্যান্ডমাইনের খবর পেয়ে যায় পুলিশ। এবং যথাসময়ে সেগুলো নিস্ক্রিয় করা হয়।
সমস্যা শুরু হয় ২০০৫ এর গোড়ায়। দিবাকর বিশ্বাসের রিপোর্টগুলো ফেলিওর হতে শুরু করে। সঠিক সময়ে খবর না পৌঁছানো, বা ভুল খবর পৌঁছানো… আই.ও লিখেছেন এই নিয়ে দিবাকর বিশ্বাস একাধিকবার তাঁর ঘনিষ্ঠ অফিসারদের কাছে ক্ষেদ প্রকাশ করেছিলেন। একাধিক দুর্ঘটনা না আটকাতে পারায় নিজেকে দায়ী ভাবতে শুরু করেন। তাঁকে শেষ বার পাঠানো হয় ২০০৫ এর ষোলোই অগাস্ট। এর পর তিনি নিখোঁজ হয়ে যান। সি.আই.ডি রিপোর্টে ও দেবাশিস মাহাতোর কথা উল্লেখ করা আছে, বাইকে দিবাকর বিশ্বাসকে উঠিয়ে নিয়ে গেছেন। মিডিয়াম বিল্ট, ডার্ক কমপ্লেকশনড, এজ অ্যারাউন্ড ৩৫ টু ৩৮। আশ্চর্যের ব্যাপার, এখানেও দেবাশিস মাহাতোর কোনো ছবি নেই। লোকটার কোনো ছবি কি আদৌ পাওয়া যায়নি! ফেরার আসামীর ক্ষেত্রে ছবি না পাওয়া গেলেও পরিচিত লোকজনের বর্ণনা থেকে একটা আর্টিস্ট-স্কেচ তৈরি করার ব্যবস্থা করে ডিপার্টমেন্ট। এক্ষেত্রে সেটাও নেই!
বিভাস কম্পিউটারে কাজ করছিল। ওকে ডেকে বললাম, রঘুনাথপুর কলেজে দেবাশিস মাহাতোর কোনো এমপ্লয়মেন্ট রেকর্ড থাকলে সেটা খুঁজে বার করে আনতে। যদি সেখানে আরও কিছু ডিটেইল পাওয়া যায়।
রিপোর্টের পাতাগুলো আবার উল্টালাম। দেড়শ পাতার রিপোর্টে প্রায় ৭৫ পাতা জোড়া জেরার বিবরণ। উল্টেপাল্টে দেখে বোঝা যায়, ঝালদায় গেরিলা বেসে দিবাকর বিশ্বাসকে পাওয়া যেতে পারে এমন একটা সম্ভাবনার কথা জানতে পেরেছিল ইনভেস্টিগেটিং টিম। কিন্তু বিশেষ কোনো ইনভেস্টিগেশন হয়নি। সম্ভবত কেউই সেখানে পৌঁছাতে পারেনি। গেরিলা জোনের গ্রামগুলোয় টুকটাক জিজ্ঞাসাবাদ করে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। বাঘমুণ্ডি অঞ্চলে অবশ্য প্রচুর মানুষকে জেরা করা হয়েছে। দোকানদার, সরকারি কর্মচারি, কলেজ পড়ুয়া, স্কুল টিচার…কেউ বাদ নেই। প্রত্যেকেই কোনো না কোনোভাবে দিবাকর বিশ্বাসের সংস্পর্শে এসেছিলেন। শেষ পাতায় পৌঁছে একটা নাম দেখে চমকে উঠলাম। আই.ও ডক্টর উমানাথনকেও জেরা করেছেন! ডক্টর এন.উমানাথনের দু পাতার সংক্ষিপ্ত জেরা গ্রন্থিত রয়েছে ফাইলে।
যে সময় দিবাকর বিশ্বাস গ্রামে গ্রামে আদিবাসী শিশুদের পড়াতেন, সেসময় ডাক্তার উমানাথন একই অঞ্চলে মেডিকেল ক্যাম্প করতেন। জেরা পড়লে বোঝা যায় দেখা-সাক্ষাৎ, পরিচয় ছিল। কিন্তু উমানাথনও বাকিদের মতই দিবাকর বিশ্বাসের হোয়ারাবাউট সম্পর্কে কোনো তথ্য দিতে পারেননি।
ফাইলটা বন্ধ করে মাথার রগদুটো টিপে বসে থাকলাম। আমার টেবিলে একটা কাগজে নিলীমা বিশ্বাসের বলা কবিতাটা কোট করে রাখছিলাম। গিয়ে দাঁড়িয়ে কাগজটাকে ছুঁতেই, একটা গরম হাওয়ার হলকা এসে পাতাটাকে খসখস করে উড়িয়ে দিল।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন