সৈকত মুখোপাধ্যায়
সত্যিই কোনো দরকার নেই। তবু শিল্পপতি শঙ্কর মণ্ডল প্রতিদিন রাত বারোটায় একবার তাঁর নতুন ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে ঘুরে যান।
আসলে এই কাজটা তার ভালো লাগে। সকাল আটটা থেকে রাত দশটা অবধি যে বিরাট দোকানটা শয়ে শয়ে নারীপুরুষের গলার আওয়াজে গমগম করে, এই মাঝরাতে সেই পুরো জায়গাটাই কীরকম অদ্ভুত শান্ত হয়ে যায়।
ঝকঝকে মার্বেলের মেঝে একটু আগেই শেষবারের মতন ধুয়ে মুছে দিয়ে চলে গেছে সুইপার ছেলেরা। সেই মেঝেতে ছায়া ফেলেছে অসংখ্য আলমারি, সেল্ফ আর কাউন্টার। তার মধ্যে কোনোটায় সার সার টিনে ভরা খাবার— কর্ন, মাশরুম, আচার, জ্যাম। কোথাও থরে থরে কোল্ড—ড্রিঙ্কসের বোতল। একদিকে একটা দেয়াল জুড়ে যদি শিশুদের বার্বি—ডল আর টেডি বেয়ার তো আরেকদিকে মহিলাদের অজস্র দামি দামি পোশাকের স্তূপ। জুতো থেকে টুপি, ন্যাপথালিন থেকে সেফটিপিন সমস্তই পাওয়া যায় শঙ্কর মণ্ডলের এই সাধের ডিপার্টমেন্টাল—স্টোরে, যার নাম তিনি নিজেই পছন্দ করে রেখেছেন— ‘সম্ভার’।
বহু টাকা খরচা করে, মাত্র চার মাস আগে এই ডিপার্টমেন্টাল—স্টোর—টা চালু করেছেন তিনি। বলতে নেই, মোহনপুরের মানুষজন যেন এমন একটা দোকানের জন্যেই এতদিন অপেক্ষা করে ছিল। তারা একেবারে পঙ্গপালের মতন ছুটে আসছে ‘সম্ভার’—এর সম্মোহনে। কাউন্টারের কর্মচারীরা দিনের শেষে টাকা গুনে শেষ করতে পারে না।
শঙ্কর মণ্ডল বুঝতে পারেন, তার রাইস মিল, তার অয়েল মিল, তার মোহনপুর বর্ধমান রুটে চলাচল করা চারটে বাস, বড় রাস্তার ওপরে দুটো দোকানঘরের ভাড়া, সব মিলিয়ে এতদিন যা উপার্জন করেছেন, তাকে একবছরের মধ্যে ছাপিয়ে যাবে এই ডিপার্টমেন্টাল—স্টোরের রোজগার।
সেইজন্যেই সম্ভারের ওপর তার এত মায়া। সেইজন্যেই প্রতিদিন মাঝরাতে তিনি নিয়ম করে চলে আসেন এখানে। পায়ে হেঁটেই আসেন। কারণ ‘সম্ভার’—এর পাশের দোতলা বাড়িটাই তার রেসিডেন্স।
তিনি আসেন। এসে দশহাজার স্কোয়ার ফিটের বিরাট ঘরটার চারিদিকে ঘুরে বেড়ান। দেখেন সমস্ত জিনিস আগামীকালের জন্যে যথাস্থানে গুছিয়ে রাখা আছে কি না। দেখেন ঘরের সাজসজ্জা কোথাও নষ্ট হয়েছে কি না, কোথাও সারাইয়ের দরকার আছে কি না। যদিও সব কিছু দেখার জন্যেই শঙ্কর মণ্ডলের মাইনে করা সুপারভাইজার রয়েছে, কিন্তু কে না জানে, মাইনে করা লোকের দেখা আর মালিকের নিজের দেখার মধ্যে অনেক তফাত থাকে।
আরও একটা কথা শঙ্কর মণ্ডল মনে মনে স্বীকার করেন, তা হল, কোনো প্রয়োজন না থাকলেও তিনি এখানে আসতেন। কারণ এই ‘সম্ভার’ তার একটা জয়ের চিহ্ন।
সেই জয়কে একা একা, তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করার জন্যেই তিনি এমন সময়ে আসেন, যখন সেখানে আর কেউ থাকে না।
.
এখন যেখানে ‘সম্ভার’, সেখানেই মাত্র একবছর আগে ছিল বোষ্টমবুড়ির বাগান আর কুঁড়েঘর।
বাগান না ঘোড়াড্ডিম। জঙ্গলে ভরা দু বিঘে জমি। আমড়া বাতাবিলেবু পেয়ারার মতন শস্তা আর বুনো গাছে ভর্তি। কুঁড়েঘরটার অবস্থাও দিন দিন শোচনীয় হয়ে পড়ছিল। ছাদের অনেক জায়গাতেই টালি ছিল না। বাগানের কুঁয়োতলায় ইটের ফাটলে ঝোপঝাড় আর পুরু শ্যাওলা। নিজের বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে সেই জংলাজমির দিকে তাকিয়ে শঙ্কর মণ্ডল ভাবতেন, কোনদিন বুড়িটা সাপের কামড়েই মরবে।
তাও বুড়ির এমন অদ্ভুত গোঁ ছিল— কিছুতেই সেই জমি শঙ্কর মণ্ডলের কাছে বেচবে না। বুড়ির ছেলে, সে ব্যাটাও সমান হাঘরে। দুর্গাপুর না কোথায় যেন থাকে। শঙ্কর মণ্ডল তাকেও হাত করেছিলেন, মা কে বুঝিয়ে—বাঝিয়ে রাজি করানোর জন্যে। টাকার লোভে ছেলেটা মাকে দারুণ চাপাচাপি করেছে। মারধর অবধি করেছিল বুড়িকে, তা শঙ্করের নিজের চোখে দেখা। কোনো ফল হয়নি। বুড়ি খালি বলত, ওর স্বামীর লাগানো সব গাছপালা, প্রাণ থাকতে নষ্ট হতে দেবে না।
তারপর গতবছর বুড়ি মরল।
অপঘাতেই মরল বুড়ি। সাপের কামড়ে নয়। কুয়োতলার শ্যাওলায় পা হড়কে পড়েছিল একেবারে খোলা কুয়োর মধ্যে।
অনেক দেরি করে হলেও বুড়ির সঙ্গে লড়াইয়ে শঙ্কর মণ্ডলেরই জয় হল। বুড়ির ছেলেকে ডেকে এনে, তার হাতে টাকাপয়সা দিয়ে জমিটা তিনি নিজের নামে লিখিয়ে নিলেন। তারপর সেই বাগান আর কুঁড়েঘরকে মাটিতে মিশিয়ে দিয়েই গড়ে তুললেন এই মোহনপুরের গর্ব, ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, ‘সম্ভার’।
মেন গেটটা সিকিউরিটের ছেলেরা রাত নটাতেই বন্ধ করে দেয়। পাশের একটা ছোট দরজা দিয়ে প্রতিদিনের মতন দোকানে ঢুকতে ঢুকতে শঙ্করের চোখে পড়ল ডিজিটাল ডিসপ্লে বোর্ডটা। সেখানে সময়ের সঙ্গে আজকের তারিখটাও আলোর অক্ষরে জ্বলজ্বল করছে। বারোই জানুয়ারি। ঠিক একবছর আগে এই দিনেই বুড়ি কুয়োয় পড়ে মরেছিল।
হ্যাঁ, গতবছর বারোই জানুয়ারি এইসময়েই পাড়ায় ছেলেরা বোষ্টমবুড়ির মৃতদেহ নিয়ে শ্মশানে রওনা হয়েছিল। খরচাপাতি প্রতিবেশী হিসেবে তিনিই সব দিয়েছিলেন। এমনকি পুলিশে বডি নিয়ে গিয়ে যাতে পোস্টমর্টেমের নামে অনর্থক কাটাছেঁড়া না করে সে ব্যবস্থাও পয়সা দিয়ে তিনিই করিয়েছিলেন। পাড়া পড়শিরা বলেছিল, শঙ্কর মণ্ডলের দিল আছে।
পুরনো কথা জোর করে মাথা থেকে সরিয়ে শঙ্কর মণ্ডল সম্ভারের ভেতরে পা দিলেন।
এ কী! এত জল এল কোথা থেকে! অবাক হয়ে পায়ের দিকে তাকালেন শঙ্কর মণ্ডল।
সাদা মার্বেল পাথরের মেঝের ওপরে আবছায়া অন্ধকারে চট করে জলের রেখাটা বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু শঙ্কর মণ্ডলের পায়ের চটিতে ছিটকে লেগেছে জল। কোনো ভুল নেই তাতে। শঙ্কর ঝুঁকে পড়ে ভালো করে দেখলেন মেঝেটা।
হ্যাঁ, বেশ মোটা একটা জলের ধারা ঠিক তার পায়ের কাছ থেকে শুরু হয়ে এগিয়ে গেছে সামনের দিকে।
মনে মনে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন শঙ্কর মণ্ডল। ওঃ! এই সুপারভাইজারগুলোকে নিয়ে আর পারা যায় না। নিশ্চয় কোথাও জলের পাইপে বেশ বড়সড় একটা ছ্যাঁদা হয়েছে। কিন্তু বাবুদের সেদিকে মন দেওয়ার সময় নেই। তিনি মোবাইলের স্ক্রিনের আলোটা সামনে ধরে মাথা নিচু করে জলের রেখাটাকে অনুসরণ করে চললেন। পাইপের ফাটলটা এক্ষুণি বার করতে না পারলে কাল সকালে দোকান খোলার আগে সারানো যাবে না।
পাইপের ফাটল খুঁজে পেলেন না শঙ্কর, তবে তার বদলে দেখতে পেলেন কর্মচারীদের অপদার্থতার আর এক চিহ্ন। যেদিকে পুরুষদের পোশাকের বিভাগ সেদিকেই এগিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। হঠাৎই তার চোখে পড়ল একটা ‘ম্যানিকুইন’— মানে ওই মানুষপ্রমাণ নকল পুতুল। দোকানের এক কোনায় দুমড়ে মুচড়ে পড়ে আছে। শুধু তাই নয়, সেটার গায়ে একটা কর্ডুরয়ের জ্যাকেট। অত দামি পোশাক ‘ম্যানিকুইনের’ গায়ে চাপিয়ে রাখার ব্যাপারে কড়া নিষেধ আছে তার। একশোজন খরিদ্দার একবার করেও ওই জ্যাকেটটায় হাত বোলালে ওর সমস্ত জেল্লা নষ্ট হয়ে যাবে। দেখাই যাচ্ছে, তার কর্মচারীদের মধ্যে কোনো একজন তার বারণ শুনবার প্রয়োজন বোধ করছে না। ঠিক আছে, কাল সকালে তার ব্যবস্থা হবে। আপাতত তিনি নিজেই জ্যাকেটটা খুলে তুলে রাখবেন। এই ভেবে আবছায়া কোণটার দিকে এগিয়ে গেলেন তিনি। হাত বাড়িয়ে ছুঁলেন জ্যাকেটটা। আর সঙ্গে সঙ্গেই কারেন্ট খাওয়ার ভঙ্গিতে হাতটা সরিয়ে নিলেন তিনি।
জ্যাকেটটা ভিজে থসথস করছে।
ওই জ্যাকেটটা থেকে জল ঝরে ঝরেই যে মেঝের ওপরে ছোট নদীটার জন্ম হয়েছে সেটা বুঝতেও কোনো অসুবিধে হচ্ছে না শঙ্কর মণ্ডলের।
কিন্তু তার থেকেও যেটা অবাক কাণ্ড, তা হল, দুমড়ে পড়ে থাকা ম্যানিকুইনটা আস্তে আস্তে উঠে বসছে। সে এবার ঘুরে তাকাল শঙ্করের দিকে।
না, ম্যানিকুইন না। বুড়ি। বোষ্টমবুড়ি।
‘বড় শীত করছিল বাবা। এই শীতের রাতে অতক্ষণ কুয়োর মধ্যে পড়ে থেকে হাড় অবধি কাঁপুনি ধরে গেছে। তাই এইটা গায়ে জড়িয়ে নিলুম।’
বোষ্টমবুড়ি একটা লোহার তাকের ওপর হাতের ভর রেখে উঠে দাঁড়াল। ছোট্টখাট্টো শালিখপাখির মতন শরীরে ঢোলা আলখাল্লার মতন জ্যাকেটটায় তাকে ঠিক একটা কাকতাড়ুয়ার মতন দেখতে লাগছিল। বুড়ি এবার শঙ্কর মণ্ডলের মুখের দিকে চেয়ে একটা নিশ্বাস ফেলল। শঙ্কর পরিষ্কার বুঝতে পারলেন, সে নিশ্বাস এই পৃথিবীর নয়। প্রবল ঠান্ডায় ঠকঠক করে কেঁপে উঠলেন তিনি। একই সঙ্গে সিকিউরিটিকে হাঁক পাড়তে গিয়ে বুঝতে পারলেন, তার গলা দিয়ে স্বর বেরোচ্ছে না।
‘তাছাড়া তুমি যে কুয়োয় ফেলার আগে আমার ঘাড়টা ভেঙে দিয়েছিলে, সেই থেকে ঘাড়টাও বেশিক্ষণ সোজা রাখতে পারি না।’
শঙ্কর মণ্ডল দেখলেন, সত্যিই বুড়ির ঘাড়টা মাঝেমাঝেই ন্যাকড়ার পুতুলের মতন বুকের ওপর লটকে পড়ছে।
‘কিন্তু আমার কুঁয়োতলায় এসব কি ছাইপাঁশ বানিয়ে তুলেছ বলো তো। উঠে এসে দেখছি আর কিছুই চিনতে পারছি না। আমর ঘরটা কোনখানে রইল একটু দেখিয়ে দেবে চলো দেখি।’ বুড়ি দু পা এগিয়ে এল শঙ্করের দিকে। শঙ্কর মণ্ডল দু পা পিছিয়ে গেলেন। তাঁর প্রবল ইচ্ছে হচ্ছিল, ঘুরে দৌড় মারেন। এক দৌড়ে বেরিয়ে যান এই দুঃস্বপ্নের জগৎ থেকে। কিন্তু একই সঙ্গে এও বুঝতে পারছিলেন যে, বোষ্টমবুড়ির ওই কালো আগুনের মতন চোখের মণি দুটোর থেকে চোখ সরানো তাঁর পক্ষে অসম্ভব।
‘ওইখানে আমার করমচা গাছের ঝোপটা ছিল, ওই যেখানে ঝকমকে ইস্টিলের ডেরামের মধ্যে চালডাল জড়ো করে রেখেছ। আর ওই পেলাস্টিকের বালতির পাহাড়টার নিচেই বোধহয় আমার সজনে ফুলের গাছ।’— বুড়ির গলাটা কেমন যেন করুণ শোনাল।
বুড়ির চলাফেরার সঙ্গে সঙ্গে চারিদিকে জল আর শৈত্য ছড়িয়ে পড়ছিল। পেছোতে গিয়ে শঙ্কর একবার সেই জল থইথই মেঝের ওপর দড়াম করে আছাড় খেলেন। তিনি পরিষ্কার নিজের কাঁধের হাড় ভেঙে যাওয়ার শব্দ পেলেন। ভয়ে আর যন্ত্রণায় ক্রমশ অসাড় হয়ে আসছিল তাঁর শরীর। কিন্তু কিছুতেই বোষ্টমবুড়ির প্রেতদৃষ্টির বাঁধন কেটে বেরোতে পারছিলেন না। গড়াতে গড়াতেই শঙ্কর মণ্ডল সরে গেলেন বুড়ির এগিয়ে আসার পথ থেকে। কিন্তু তাঁর চোখ তখনও অনুসরণ করে যাচ্ছিল বুড়ির কার্যকলাপ।
ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের কোনায় কোনায়, দেয়ালে দেয়ালে, মেঝেতে, ছাতে, সর্বত্র একটা বাদুড়ের ছায়ার মতন ঘুরে বেড়াচ্ছিল বোষ্টমবুড়ির প্রেত। সেই প্রেতের হাহাকারে মাঝেমাঝেই কেঁপে উঠছিল ‘সম্ভার’—এর অভিজাত অন্দরমহল। সেই প্রেত খুঁজে বেড়াচ্ছিল তার হারিয়ে যাওয়া বাগান আর ঘর, আর খুঁজে না পেয়ে নিজের অজান্তেই ডুকরে কেঁদে উঠছিল।
কতক্ষণ যে এইভাবে কেটে গেল, খেয়াল নেই শঙ্কর মণ্ডলের। একবার শুধু সে অবাক হয়ে ভেবেছিল সিকিউরিটির ছেলেটা তার দেরি দেখেও খোঁজ নিতে আসছে না কেন! তার পরেই তার কানে এসেছিল বাইরে থেকে প্রবল বৃষ্টি আর বজ্রপাতের আওয়াজ। অসময়ের বৃষ্টি আর জাঁকিয়ে নামা ঠান্ডায় পুরো মোহনপুর শহরটাই যেন একটা কম্বলের নিচে ঢুকে পড়েছে। নিশ্চয় ছেলেটা ভাবছে, বাবু বৃষ্টি না থামা অবধি ভেতরেই অপেক্ষা করবে। সেরকমটা ভাবাই তো স্বাভাবিক।
চারিদিকে নজর চালিয়ে সেই প্রেতছায়া আবার এসে দাঁড়াল শঙ্কর মণ্ডলের সামনে। বাইরে খুব জোরে একবার বিদ্যুৎ চমকালো। তার আলোয় শঙ্কর স্পষ্ট দেখল বুড়ির শরীর থেকে কখন যেন খসে পড়ে গেছে সেই ঢোলা জ্যাকেটটা। সত্যি বলতে কি মাংস চামড়া সবই যেন খসে পড়েছে তার গা থেকে। হাড়সার একখানা হাত বাড়িয়ে বুড়ি এক হ্যাঁচকা টানে মাটিতে পড়ে থাকা শঙ্কর মণ্ডলকে দু পায়ের ওপর দাঁড় করিয়ে দিল। ভাঙা হাতের প্রবল যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠলেন শঙ্কর।
‘চলো, খুঁজে দাও আমার ঘরখানা। কোথায় লুকিয়ে রেখেছ? ওই দিকেই তো ছিল। চলো চলো!’ বুড়ি হিড়হিড় করে শঙ্কর মণ্ডলকে ধরে টেনে নিয়ে চলল যেদিকে বাচ্চাদের খেলাধুলোর সরঞ্জাম আর তুলোর পুতুলের বিরাট সংগ্রহ দেওয়াল জুড়ে সাজিয়ে রাখা ছিল। বুড়ির গা থেকে জলের ধারা ঝরছে তো ঝরছেই। তার মধ্যে দিয়ে হ্যাঁচড়াতে হ্যাঁচড়াতে বোষ্টমবুড়ি শঙ্কর মণ্ডলকে টেনে নিয়ে গিয়ে ফেলল সেই ছাদ অবধি উঁচু করে সাজানো পুতুলের তাকের নিচে। এত কষ্টের মধ্যেও শঙ্করের মনে পড়ল, আজ যদি তিনি এই ডিপার্টমেন্টাল স্টোরটা বানিয়ে না তুলতেন, তাহলে ঠিক এইখানটাতেই থাকত বুড়ির ভাঙা টালি ছাওয়া ঘর। ঘরের জায়গাটা চিনে নিতে কোনো ভুল হয়নি একবছর বাদে ফিরে আসা ঘরের মালিকের।
‘খুঁজে দাও, খুঁজে দাও, খুঁজে দা আ আ আ ও! — তীব্র চিৎকারে কানে তালা লেগে গেল শঙ্করের। একটা পা দিয়ে তাকে মেঝেতে চেপে রেখে বুড়ি এবার হাত দিয়ে টেনে আছড়ে ফেলতে শুরু করেছে তাকের পুতুলগুলো। বিরাট বিরাট টেডি—বেয়ার, গালফোলা খরগোশ, ল্যাজতোলা কাঠবেড়ালি, জোকার আর বেবি পুতুল খসে পড়তে লাগল শঙ্করের মুখের ওপর।
নিচের তাকগুলো খালি করে বুড়ি এবার হাত বাড়িয়েছে ওপরের তাকে…আরও ওপরে…আরও ওপরে। ক্রমশই লম্বা হয়ে যাচ্ছে তার হাত, আর পুতুলের পর পুতুল ঝরে পড়ছে শঙ্করের মুখের ওপর। তিনি একবার শেষ চেষ্টা করলেন সেই তুলোর মতন নরম সব পুতুলের দমবন্ধ করা কবর থেকে নিজেকে মুক্ত করার। কিন্তু কোনো লাভ হল না। বুড়ির কঙ্কালসার পা তাঁকে পেরেকের মতন গেঁথে রেখে দিয়েছে তারই স্বপ্নের সম্ভারের মেঝেতে। আস্তে আস্তে শঙ্কর মণ্ডলের শরীরটা পাহাড়প্রমাণ পুতুলের স্তুপের নিচে হারিয়ে গেল।
পরদিন সকালে মোহনপুর থানার ও.সি. সব দেখে শুনে স্বীকার করলেন যে, এমন অদ্ভুত অ্যাকসিডেন্ট তিনি তাঁর চাকরি জীবনে কমই দেখেছেন। পুতুলের তাক ভেঙে পড়ে পুতুল চাপা পড়ে মৃত্যু… নাঃ, সত্যিই ভাবা যায় না।
শুধু একটা ব্যাপারই তিনি বুঝতে পারছিলেন না— সমস্ত জানলা দরজা বন্ধ থাকা সত্ত্বেও এত বৃষ্টির জল ঘরে ঢুকল কোথা দিয়ে।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন