অলৌকিক

মনোজ সেন

অলৌকিক

অতনু গাঙ্গুলীর বিপদ

অতনু গাঙ্গুলীর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় হয় যাদবপুরে, আমার মেজকাকার বাড়িতে। মেজকা রিটায়ার করে ফরিদাবাদের ফ্যাক্টরি-কোয়ার্টার্স ছেড়ে এসে ওখানে বাড়ি করেছিলেন। আমি একদিন কলেজ সেরে ওঁর বাড়িতে গেছি, দেখি মেজকাকি শোবার ঘরে খাটের ওপর বসে তার এক বান্ধবীর সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছে। বান্ধবীটি মেজকাকির সমবয়সিই হবেন, ভীষণ ফর্সা, গোলগাল চেহারা, মাথার চুল সবই প্রায় সাদা, পরনে লালপাড় সাদা শাড়ি আর লালরঙের ব্লাউজ। গল্প চলেছে আর সেইসঙ্গে মেজকাকি অনবরত পান সেজে যাচ্ছে আর তার বান্ধবী খচখচ করে জাঁতি দিয়ে প্রবল বেগে সুপুরি কেটে যাচ্ছেন। আমি ঘরে ঢুকে ওই দৃশ্য দেখে বেরিয়ে এলুম। মেজকা পেছনের বাগানে মালিকে একটার পর একটা ভুলভাল ইন্সট্রাকশন দিচ্ছিলেন। আমি তাঁর কাছে চলে গেলুম।

একটু বাদেই দেখি মেজকাকি বাগানে আসছে, সঙ্গে একটা ছোকরা সাহেব। সে ছ-ফুটের ওপর লম্বা, বিশাল স্বাস্থ্যবান শরীর, চোখ দুটো নীল তবে মাথার চুল কালো। মহাবিপদ। আমি আবার সাহেব-সুবো দেখলে বেজায় ভয় পাই। একে তো ইংরিজি বলতে হয়, তার ওপরে ওরা যে কী বলে সেটা ভালো ধরতেই পারি না। তার ওপর দেখি মেজকাকি ওই সাহেবটাকে নিয়ে আমার দিকেই আসছে।

মেজকাকি বলল— শোন ভেনো, এই হল অতনু। ও এসেছে ওর মাকে নিয়ে যেতে। তা নিয়ে যাব বললেই তো আর হয় না। ছত্রিশ নম্বরের মহাদেববাবুর বাজার করতে গিয়ে মেছুনিদের সঙ্গে হাতাহাতির গল্পটা সবে জমে উঠেছে, বুঝলি? তার ওপরে এখনও আমার পঞ্চাশটা পান সাজা বাকি। এ সময় তো আর ওর মাকে যেতে দেওয়া যেতে পারে না— না কী বলিস?

তারপর অতনু নামক সাহেবটির দিকে ফিরে বলল— এ হল ভেনো, মানে ভানু। আমার ভাসুরপো। একেবারে তোর সমবয়সি। যোগেশচন্দ্র কলেজে পড়ে, তোরই মতো পলিটিকাল সায়েন্স। তোরা একটু গল্প কর। আমি আর আধঘণ্টার মধ্যেই তোর মাকে ছেড়ে দেব।

অতনু সহাস্যে পরিষ্কার বাংলায় বলল— ঠিক আছে, মাসিমা। আপনার কোনো চিন্তা নেই। তবে মহাদেবমেসোর ব্যাপারটা চুকে গেলেই কিন্তু মাকে ছেড়ে দেবেন। যা পান সেজেছেন! তাতে গোটা দশেক কম পড়লে কিছু অসুবিধে হবে না। বাকিটা না হয় আমি কাল এসে সেজে দিয়ে যাব।

.

সেই হল আমার অতনুর সঙ্গে পরিচয়ের সূত্রপাত। প্রথমে আপনি দিয়ে শুরু, এখন তুই। অতনুর বাবা গৌরাঙ্গ গাঙ্গুলী মেজকার প্রতিবেশী। নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ পরিবারের মানুষ, ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ পোস্ট গ্রাজুয়েট পড়বার জন্য আমেরিকায় গিয়েছিলেন। সেখানে অতনুর মাকে বিয়ে করেন। ভদ্রমহিলা জার্মান-আমেরিকান, নাম উরসুলা। বিয়ের আগে কেমন ছিলেন, জানি না। এখন তো একেবারে বাঙালি হয়ে গেছেন। পুজো-আচ্চা করেন, রবীন্দ্রসংগীতের ভক্ত আর পটলের দোলমা যা রাঁধেন তা একেবারে অসাধারণ।

অতনুও কিছু কম যায় না। তার পৈতে তো আছেই, বাড়ির পুজোর অনুষ্ঠানগুলোর অনেকগুলো সে নিজেই করে। অনেক পুজোর মন্ত্র তার কণ্ঠস্থ। আর কখন কী করতে হবে, না করতে হবে, সে সম্পর্কেও তার জ্ঞান কিছু কম নয়। সে ইংরিজি বলে আমেরিকান অ্যাকসেন্টে অথচ তার সংস্কৃত উচ্চারণে কোনো ত্রুটি নেই। তার চেহারায়, চালচলনে বা স্বভাবে এই বৈপরীত্যের জন্য তাকে অনেক সময় অনেক অদ্ভুত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়েছে। সে সব অভিজ্ঞতার একটা এখানে বলছি।

সেবার কলেজের বন্ধুদের সঙ্গে সরস্বতী পুজোর ছুটিতে অতনু গিয়েছিল মেমারির কাছে কাঁঠালপুকুর বলে একটা গ্রামে। কাঁঠালপুকুর একটা বেশ বর্ধিষ্ণু জায়গা, অনেকগুলো পাকা বাড়ি, পরিষ্কার রাস্তা, খোলামেলা গ্রাম। একপাশে একটা ছোটো নদী আছে, তার নাম সঙ্কটা। খুব যে চওড়া তা নয়, তবে টলটলে জল, বেশ স্রোতও আছে। এই সঙ্কটার ধারে গ্রামের জমিদার চাটুজ্জেদের বসতবাড়ি। এই বাড়ির ছেলে শ্রীমন্ত অতনুর সঙ্গে এক ক্লাসে পড়ে। সে-ই নিমন্ত্রণ করেছিল তার কয়েক জন বন্ধুকে তাদের বাড়ির পুজো দেখবার জন্য।

চাটুজ্জে বাড়ি যে খুব একটা বিশাল ইমারত তা নয়, তবে বেশ বড়োই বলা চলে। একতলা-দোতলা মিলিয়ে কুড়ি-বাইশটা ঘর, মাঝখানে ঠাকুরদালান, তার একপাশে অতিথিশালা। সামনে-পেছনে বাগান, গোশালা, গ্যারেজ, রান্নাঘর ইত্যাদি। পাঁচিল ঘেরা জমিটা বিঘে তিনেক তো হবেই। জমিদারি চলে যাবার পরেও চাটুজ্জেদের যে অর্থাভাবে পড়তে হয়নি, সেটা বেশ বোঝা যায়।

পুজোর আগের দিন বিকেল বেলা অতনুরা যখন ওখানে পৌঁছল, তখন বাড়িতে অনেক লোক। বাচ্চাকাচ্চাদের হুল্লোড়, মেয়েদের উচ্চকিত হাসি, বড়োদের ব্যস্তসমস্ত গতিবিধি বাড়িটাকে সরগরম করে রেখেছে।

ঠাকুরদালানের পুজোমণ্ডপের একপাশে একটা প্রকাণ্ড ইজিচেয়ারে আধশোয়া অবস্থায় শ্রীমন্তের ঠাকুরদাদা শ্রীশচন্দ্র পুজোর কাজকর্ম দেখাশোনা করছিলেন। তিনি নাতির বন্ধুদের সাদরে অভ্যর্থনা করলেন বটে কিন্তু অতনুকে দেখে তাঁর ভুরু দুটো একটু কোঁচকাল। সবার সঙ্গে অতনু যখন তাঁকে প্রণাম করতে গেল, উনি তাড়াতাড়ি কোঁচা দিয়ে পা দুটো ঢেকে দিলেন। তাঁর একমুখ পাকাদাড়ি অস্বস্তিটা গোপন করতে পারল না।

শ্রীশচন্দ্র নাতিকে বললেন— তোমার বন্ধুদের মালপত্র এখানেই রাখতে বলো। কানাই আর শিবু ওগুলো যার যার ঘরে পৌঁছে দেবে। এখন তুমি বন্ধুদের গ্রামটা একটু ঘুরে দেখিয়ে দাও। ছ-টার সময় আসবে। তখন চা দেওয়া হবে।

সেইরকমই করা হল। শ্রীমন্ত বন্ধুদের নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে কিছুটা পথ যেতে-না-যেতেই একটি লোক ছুটতে ছুটতে এসে শ্রীমন্তকে বলল— তোমাকে বড়োকর্তা ডাকতেছেন গো। তাড়াতাড়ি এসো। তোমার বন্ধুরা এখানেই একটু থাক। বড়োকর্তা বললেন, সময় বেশি লাগবে না।

শ্রীমন্ত চলে গেল। অতনু বন্ধুদের বলল— বড়োকর্তা ভেবেছেন, আমি খ্রিস্টান সাহেব। খুব সম্ভব আমাকে পুজোবাড়িতে ঢুকতে দেবেন না। আমাকে এখানে আনবার জন্য শ্রীমন্ত বকুনি খাবে।

শ্রীমন্ত যখন ফিরে এল, দেখা গেল যে অতনুর অনুমানই ঠিক। ম্লান হেসে শ্রীমন্ত বলল— ঠাকুরদাদার সঙ্গে একচোট ঝগড়া করে এলুম। একটা ম্লেচ্ছ সাহেবকে আনার জন্য বকতে গিয়েছিলেন আমাকে। আমি বললুম, ম্লেচ্ছ হবে কেন? অতনু গাঙ্গুলী ব্রাহ্মণসন্তান।

ঠাকুরদাদা বললেন— আমাদের দেশের লোকের কখনো নীল চোখ হয়?

আমি বললুম— হবে না কেন? কেলেকিষ্টি রামচন্দ্রেরই তো নীল চোখ ছিল। সেটাই তো একটা মিসিং নীলপদ্মের জায়গায় দিতে গিয়েছিলেন। আর এ তো ভীষণ ফর্সা। আমার কথায় ঠাকুরদাদা খুব যে একটা আশ্বস্ত হয়েছেন, তা মনে হল না। আসলে অতনুর দুরন্ত সাহেব সাহেব ফিচারগুলো মেনে নিতে পারছেন না। যাহোক, শেষপর্যন্ত বলেছেন যে তোর জন্যে অতিথিশালায় একটা ঘর ঠিক করতে। সেটা সিঙ্গল সিটেড ঘর। তোরা বাকি সকলে অন্য ঘরে থাকবি। সবাই তোকে ওয়াচ করবে, তারপরে ঠিক করা হবে যে তোকে পুজোমণ্ডপে ঢুকতে দেওয়া হবে কী হবে না।

অতনু সন্দিগ্ধ হয়ে বলল— সবাই ওয়াচ করবে মানে? কে সবাই?

শ্রীমন্ত কথাটা যেন এড়িয়ে গেল। বলল— সবাই মানে আমাদের সবাই। ভয় নেই, তোর কোনো অসুবিধে হবে না। বলে অন্য কথা পেড়ে বন্ধুদের গ্রাম দেখাতে শুরু করল।

অতনুর ঘরটা অতিথিশালার একধারে। যেকোনো হস্টেলের সিঙ্গল সিটেড ঘরের থেকে সামান্য ছোটোই হবে। বড়োজোর দশ ফুট বাই পাঁচ ফুট। ঘরের দু-পাশে দুটো জানলা, শীতের জন্য তাদের ঘড়খড়ি পাল্লাগুলো বন্ধ রয়েছে। ঘরের ভেতরে একটা সিঙ্গল তক্তপোশ আর একটা আলনা। তক্তপোশের একপাশে ওর ব্যাগটা রাখা ছিল।

সারা বিকেল মাঠে-ঘাটে ঘুরে, সন্ধে বেলা অতিথিশালার পাশের মাঠে ব্যাডমিন্টন খেলে আর রাত্রে গুরুভোজনের পর অতনু খুবই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। শ্রীমন্ত যখন ওকে ওর ঘরে নিয়ে এল, তখন শোবার জন্য ওর সমস্ত শরীর উদগ্রীব হয়ে ছিল।

ঘরে ঢুকতে গিয়ে একটা ধাক্কা খেল অতনু। সমস্ত ঘরটা অসম্ভব গুমোট, নিঃশ্বাস নিতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল। অথচ, শ্রীমন্তকে বেশ স্বাভাবিক বলেই মনে হল। এটা অবশ্য অসম্ভব ব্যাপার কিছু নয়। ছোট্ট ঘর, সব দরজা-জানলা বন্ধ, তার ভেতরটা গুমোট হতেই পারে। অতনু তাড়াতাড়ি একটা জানলা খুলে দিল। দেখা গেল বাইরে একটা অদ্ভুত কুয়াশা। মনে হচ্ছিল সেটা যেন নড়ছে, চড়ছে, ঘোঁট পাকাচ্ছে। আকাশে চতুর্থীর নখের মতো সরু একফালি চাঁদটাকে প্রায় দেখাই যাচ্ছে না। অতনু ভাবল কুয়াশাটা ঘরের ভেতরে চলে আসবে। তা কিন্তু এল না। জানলার বাইরেই একটা অস্বচ্ছ পর্দার মতো দুলতে লাগল।

শ্রীমন্ত বলল— জানলাটা খুলে রাখবি? ঠান্ডা লেগে যেতে পারে কিন্তু।

অতনু বলল— সন্ধ্যা করে নিই। তারপরে বন্ধ করব। বলে ব্যাগ থেকে একটা ধুতি বের করল।

তুই এখন সন্ধ্যা করবি? রাত হয়ে গেছে, শুয়ে পড়। জানিস না বিদেশে নিয়মো নাস্তি?

—তা হয় না। আজ পর্যন্ত কখনো সন্ধ্যা বাদ যায়নি। রাত হয়েছে তো কী? সন্ধে বেলা করতে না পারলে দশবার গায়ত্রী মন্ত্র জপ করে নিলেই হল। আমেরিকায় যখন যাই তখনও বাদ দিই না। বলে খোলা জানলাটার দিকে চোখ পড়তেই অতনু দেখল কুয়াশার ভেতরে নড়াচড়ার গতিটা যেন বেড়ে গেছে।

সন্ধ্যা করার পর প্রাণায়াম করে আচমন করার সঙ্গেসঙ্গে ঘরের গুমোটটা যেন অনেকটাই কেটে গেল। ঠান্ডাটাও একটু বাড়ল। তখন, জানলাটা বন্ধ করে দেওয়াই স্থির করল অতনু।

.

পরদিন সকালে অতনু যখন বন্ধুদের সঙ্গে পুজোমণ্ডপে গেল, তাকে কেউ বাধা দিল না। তবে প্রণাম করার সময় যেন অভ্যাসবশতই কোঁচা দিয়ে পা ঢেকে রাখলেন শ্রীশচন্দ্র। ঠিকই বলেছে শ্রীমন্ত। অতনুর প্রবল সাহেব সাহেব আকৃতিটাকে উনি কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না।

ওরা যখন মণ্ডপে ঢোকে তখন তার এককোণে একটা উত্তেজিত আলোচনা চলছিল। দেখা গেল উত্তেজনাটা ক্রমশ বাড়ছে। একটু বাদে শ্রীমন্ত দৌড়ে এসে অতনুকে বলল— একবার আমার সঙ্গে আয় তো।

বলে ওকে টানতে টানতে শ্রীশচন্দ্রের কাছে নিয়ে গেল।

.

শ্রীশচন্দ্র দারুভূত জগন্নাথের মতো ইজিচেয়ারের ওপর স্থির হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর চোখ দুটো রক্তবর্ণ, মুখ আষাঢ়ের মেঘের মতো থমথম করছে। দেখে মনে হচ্ছিল উনি এক্ষুণি একটা বোমার মতো ফেটে পড়বেন।

শ্রীমন্ত বলল— ঠাকুরদা, আমাদের আজকের বিপদ থেকে যদি কেউ উদ্ধার করতে পারে তো সে এই অতনু।

শ্রীশচন্দ্র রক্তচক্ষু করে নাতির দিকে তাকালেন। কিছু বলতে যাচ্ছিলেন কিন্তু তার আগে তাঁর পাশে দাঁড়ানো একজন মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক বললেন— তুমি একথা বলছ কেন? এই ছেলেটি পুজো করতে পারবে?

শ্রীমন্ত বলল— নিশ্চয়ই পারবে মেজকাকা। ও বড়ো বড়ো পুজো করে, শ্রাদ্ধ-ট্রাদ্ধ করে, আর সরস্বতী পুজো করতে পারবে না? কি রে অতনু, পারবি না?

অতনু ঘাড় নেড়ে বলল— পারব।

শ্রীমন্তর মেজকাকা বললেন— মন্ত্রের বই লাগবে?

—লাগবে না। আমার সরস্বতী পুজোর সব মন্ত্রই মুখস্থ আছে।

হঠাৎ শ্রীশচন্দ্রের মুখের কঠিন রেখাগুলো একটু কোমল হয়ে এল। দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন— ‘দ্যাখো অতনু, আমি মহাবিপদে পড়েছি। আমার সম্মান ধুলোয় মিশে যেতে বসেছে। আমাদের পুরোহিত কাঁঠালপুকুর হাই স্কুলের হেডপণ্ডিত দীননাথ ভটচায্যি। তিনি আজ সকাল থেকে ভয়ানক অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তাঁর অনুপস্থিতিতে আমাদের বাড়ির কাজকর্ম দেখাশুনো করে তাঁর ছেলে বিশ্বনাথ। সে আবার আজ সকালের ট্রেনে কলকাতায় চলে গেছে ডাক্তারবদ্যির সন্ধানে। এঁরা ছাড়া আর একজন পুরোহিত আছেন, কিন্তু ফন্টে হারামজাদা তাঁকে আসতে দেবে না। ও জানে, এইবার পুজো না-হলে আমার নাকটা মাটিতে ঘষে দেওয়া যাবে।

অতনু শ্রীমন্তকে জিজ্ঞেস করল— ফন্টে কে?

শ্রীমন্ত ফিসফিস করে বলল— ঠাকুরদার খুড়তুতো ভাইয়ের ছেলে। শরিক-শত্রুপক্ষ!

শ্রীশচন্দ্র এদিকে বলে চলেছেন— দ্যাখো যদি তুমি উদ্ধার করতে পারো। আমাদের এখানে আর যে সব পুরোহিত আছে তারা একবর্ণ সংস্কৃত জানে না, ঠংঠং করে ঘণ্টা বাজিয়ে, একগাদা বিড়বিড় করে অংবংচং বকে, তুমি নাও মা ফুলের ভার, আমাকে দাও মা বিদ্যের ভার বলে পুজো শেষ করে। আমি তাদের এ বাড়ির ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে দিতে পারি না। হয়তো তুমি পারবে। শুনলুম, তোমার সন্ধ্যাবন্দনার মন্ত্রোচ্চারণ অত্যন্ত সুন্দর। দ্যাখো, চেষ্টা করে।

অতনু আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করল— আমার মন্ত্রের প্রশংসা করলে কে আপনার কাছে?

শ্রীশচন্দ্র এ প্রশ্নের জবাব দিলেন না। শ্রীমন্তকে বললেন— মন্টু, একে সরকারমশাইয়ের কাছে নিয়ে যাও। ওকে জোড়ের ধুতি-চাদর দিতে বলো।

অতনু বিনীতভাবে বলল— সেইসঙ্গে একজোড়া খড়ম।

লম্বা চওড়া অতনু যখন গরদের ধুতি-চাদর পরে খড়ম খট খটিয়ে পুজোমণ্ডপে এসে ঢুকল, হঠাৎ যেন মন্ত্রবলে উপস্থিত সকলের কলরব বন্ধ হয়ে গেল। সবাই হাঁ করে তার দিকে তাকিয়ে রইল। আর সে যখন ভরাট উদাত্ত গলায় মন্ত্রোচ্চারণ শুরু করল, তখন ঠাকুরদালানের ছাদে পায়রাদের ডানার ঝটপট শব্দ ছাড়া আর টুঁ শব্দটি নেই। শ্রীশচন্দ্র পর্যন্ত তাঁর ইজিচেয়ারে সোজা হয়ে বসলেন। বেলা যত বাড়তে লাগল, ভিড়ও তত বাড়তে লাগল। জানা গেল, শরিকদের পুজোমণ্ডপ নাকি ফাঁকা হয়ে গেছে। সবাই চলে এসেছে এ তরফে, তার ফলে ও তরফ রেগে আগুন হয়ে আছে। অঞ্জলি দেবার সময় তো রীতিমতো হুড়োহুড়ি পড়ে গেল।

সব যখন শেষ হল, বন্ধুরা অতনুকে প্রায় কাঁধে তুলে অতিথিশালায় নিয়ে গেল। শ্রীশচন্দ্র পর্যন্ত এই ছেলেমানুষি দেখে বিরক্ত তো হলেনই না, বরং একটা প্রশ্রয়ের হাসি হাসতে লাগলেন। তার আগে অবশ্য তিনি সবাইকে রাত্রে খাওয়ার নিমন্ত্রণ করে বসে আছেন।

সন্ধের মুখে একটা বাচ্চা ছেলে এসে অতনুর হাতে একটা চিঠি দিল। চিঠিটা শ্রীমন্তের লেখা। সেটা এইরকম—

অতনু, পালা! আমাদের ওঁনারা তোকে বেজায় পছন্দ করে ফেলেছেন। বাবা বললেন, আমার সেজজ্যাঠামশায়ের ছোটো মেয়ের সঙ্গে তোর বিয়ের ব্যবস্থা হচ্ছে। তার দশ বছর বয়েস, কলকাতার গোখেল স্কুলে পড়ে। সেজজ্যাঠামশাই বা জ্যেঠিমার এ ব্যাপারে করণীয় কিছুই নেই কারণ ওঁদের আদেশ অমান্য করার ক্ষমতা কারুর নেই। তোর মতামতেরও কোনো প্রয়োজন নেই। ওঁদের জীবদ্দশায় ভালো ছেলে ধরে নিয়ে এসে এ বাড়ির মেয়েদের সঙ্গে ঘাড়ে ধরে বিয়ে দেবার অনেক ঘটনাই ঘটেছে। এ ব্যাপারে ওঁরা এক্সপার্ট। থানাপুলিশ করে কোনো লাভ হবে না কারণ এ তল্লাটে আইন, কানুন, পুলিশ, মিলিটারি সব-ই শ্রীশচন্দ্র চাটুজ্জে। আর তিনি ওঁদের আদেশ অমান্য করবেন না— শত হলেও ওঁরা তাঁর পূর্বপুরুষ।

অতএব এই মুহূর্তে বেরিয়ে পড়। তোর ব্যাগটা এখানেই থাক, শুধু কিছু টাকা সঙ্গে নিবি। জমিদারি যাবার আগে যাদের আমরা পাইক বলতুম তাদের এখন দরওয়ান বলি। তারা লাঠি-সড়কি নিয়ে রেডি হচ্ছে। তোর ঘর ঘিরে ফেলবার আগেই বেরিয়ে পড়। এক্ষুনি। তোর ব্যাগ আমি পরে পৌঁছে দিয়ে আসব।

তুই যেন সাঁঝের ঝোঁকে বেড়াচ্ছিস এইরকম ভাব করে এদিক-ওদিক ঘুরবি। সঙ্কটার উলটোদিকে পূর্বদিকে দেউড়ির দিকটা ফাঁকা। ওদিকে বাগান। ওখানে একটু ঘুরে সুযোগ বুঝে দেউড়ি পেরিয়ে রাস্তা পার হয়ে উলটোদিকের আমবাগানের মধ্যে যদি ঢুকে পড়তে পারিস তাহলে দরওয়ানেরা তোর পেছনে যাবে না, কারণ ওই বাগানটা ফন্টে-কাকার। দাঁড়াবি না কিন্তু। নাক বরাবর দৌড়বি। তাহলে স্টেশনে পৌঁছে যাবি। এখন পর পর কয়েকটা ট্রেন আছে। সামনে যেটা পাবি সেটাতেই উঠে পড়াবি। টিকিট-ফিকিটের কথা পরে ভাবিস। বড়োরাস্তা ঘুরে আমাদের লোকেদের স্টেশনে যেতে যে সময় লাগবে তার আগেই তোকে কেটে পড়তে হবে।

চিঠি পড়ে তো অতনুর মাথার চুল খাড়া! তার বন্ধুদেরও তথৈবচ। সবাই তৎক্ষণাৎ বেরিয়ে পড়ল। যেন কিছুই হয়নি, এরকম একটা ভাব করে বেড়াতে বেড়াতে ওরা পুবদিকের বাগানে চলে গেল। সত্যিই ওদিকে লোকজন কম। কয়েকটা চাদর মুড়ি দেওয়া রোগাপটকা মালি ঘোরাঘুরি করছিল। সবাই মাথা নেড়ে নেড়ে সপ্রশংস দৃষ্টিতে ফুলগাছগুলো দেখতে লাগল। অতনু ইচ্ছে করে দেউড়ির দিকে পেছন ফিরে রইল। যাতে কেউ সন্দেহ না-করে।

পবিত্র ফিসফিস করে বলল— দেউড়িতে মাত্র একটা হোঁৎকামতো গুঁপো দরওয়ান আছে। তুই যখন পালাবি, ওকে আমরা সামলাব।

অজয় বলল— ওই গাছটার নীচে দ্যাখ, কী রকম অদ্ভুত একটা ধোঁয়ার পিণ্ড জমাট বেঁধে রয়েছে। শীতকালে বাতাস ভারী হয়ে যায় বলে এরকম হয়, কিন্তু ওই ধোঁয়াটা যেন কেমন। দেখলে ভয় করে।

অতনুর বুকটা ধড়াস করে উঠল। আড়চোখে তাকিয়ে দেখল একটু দূরে একটা তেঁতুলগাছের নীচে মাটি থেকে ইঞ্চি ছয়েক ওপরে ভাসমান গত রাত্রের দেখা নিরলম্ব কুয়াশাটা। কালকের মতোই সেটা নড়ছে-চড়ছে, ঘোঁট পাকাচ্ছে। কখনো সরু হয়ে লম্বা হয়ে যাচ্ছে আবার কখনো মোটা হয়ে বেঁটে হয়ে যাচ্ছে।

ব্যাপার দেখে অতনু আর দাঁড়াল না। ‘আমি যাচ্ছি, তোরা এ দিকটা সামলা’ বলে হঠাৎ ফুলের বেড-টেড মাড়িয়ে, একগাদা ফ্লক্স আর প্যানসি চেপ্টে দিয়ে, গোটা চারেক গাঁদা গাছ ভেঙে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড় লাগাল দেউড়ির দিকে। দরওয়ানটা একটা টুলে বসে গোঁফে তা দিচ্ছিল। সে ব্যাপারটা বুঝে খচমচ করে উঠে দাঁড়াতে-না-দাঁড়াতে অতনু সাঁ করে তার সামনে দিয়ে ছুটে দেউড়ি পার হয়ে, রাস্তা পেরিয়ে আমবাগানের মধ্যে ঢুকে পড়ল। দরওয়ানটা ‘পালাল! পালাল!’ বলে ষাঁড়ের মতো চ্যাঁচাতে লাগল ঠিকই কিন্তু সত্যিই আমবাগানের ভেতরে ঢুকল না। রাস্তার ওপরে লাফাতে লাগল।

বেশ কিছুটা দৌড়ে একটু দম নেবার জন্য দাঁড়াল অতনু। দম নেবে কী? পেছন ফিরে যে দৃশ্য দেখল তাতে তো ওর একেবারে আক্কেল গুড়ুম!

সন্ধ্যার ম্লান আলোয় অতনু দেখল সাদাটে কুয়াশাটা বাতাসে ভেসে ভেসে একটা হিংস্র ক্ষুধার্ত হাঙরের মতো তার দিকে তেড়ে আসছে। তার এপাশ-ওপাশ থেকে মাঝে মাঝে যেন অতনুর গলা টিপে ধরার জন্য সরু লিকলিকে কতগুলো শুঁড়ের মতো প্রত্যঙ্গ বেরুচ্ছে আবার ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে। এমনকী সেই কুয়াশার ভেতর থেকে বহুদূর থেকে ভেসে আসা একটা ক্ষীণ কিন্তু ক্রুদ্ধ কোলাহলও যেন শোনা যাচ্ছে।

আর এক মুহূর্তও দাঁড়াল না অতনু। বিরাট একটা লাফ মেরে ‘গেছি রে!’ বলে একটা আর্তনাদ করে আবার প্রচণ্ড জোরে ছুট লাগল। তখন যদি স্টপওয়াচ নিয়ে ওর স্পিড মাপা যেত, তা বোধ হয় দেখা যেত যে অনেক অলিম্পিক রেকর্ড-ই ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে।

স্টেশনটা খুব দূরে নয়। অতনু যখন পৌঁছল তখন একটা ট্রেন সদ্য রওনা হয়েছে। ও লাফ দিয়ে একটা কম্পার্টমেন্টে উঠে পড়ে হাঁপাতে হাঁপাতে একটা নস্যিরঙের র্যাপার মুড়ি দেওয়া লোকের পাশে বসে পড়ল। জানলা দিয়ে দেখল প্ল্যাটফর্মের ধারে একটা গাছের নীচে কুয়াশাটা জমাট বেঁধে যেন নিষ্ফল রাগে ফুঁসছে।

নস্যিরঙের র্যাপার বলল— আর কেয়া দেখতা হায় সাহেব? এখানকার আদমি-লোগকো পলিউশনকে নিয়ে কোনো চিন্তাই নেহি হায়। কাঁচা কয়লা দেকে উনুন জ্বালায়গা আর ঐসা মাফিক ধোঁওয়ায় সকলের স্বাস্থ্যকা বারোটা বাজায়গা। দেখিয়ে না, উনুনওয়ালা কতক্ষণ চলা গিয়া তার ঠিক নেহি হায় অথচ ওই ধোঁয়াটা ওইখানমে এখনও ঘোঁট পাকাতা হায়।

গল্প শেষ করে অতনু বলল— জানিস ভেনো, শ্রীমন্তকে অনেক চাপাচাপি করলুম ওই কুয়াশার মতো জিনিসটা কী বা কেমন করে ওর সেই ‘ওঁদের’ সঙ্গে ওর ঠাকুরদার যোগাযোগ হয় সে কথা বলবার জন্য। কিছুতেই বলল না। আমি ওসব জানি না বলে এড়িয়ে গেল।

 ভয়

প্রায় পঁচিশ বছর বাদে দেশে ফিরেছেন অমরেন্দ্রনারায়ণ রায়চৌধুরি। পনেরো বছর বয়সে বিদেশে গিয়েছিলেন, সেখানেই লেখাপড়া করেছেন, ডাক্তারি পাশ করেছেন, তারপর স্থায়ীভাবে ওখানেই থেকে গিয়েছেন। তাঁর স্ত্রী মীনাক্ষীও ডাক্তার। দু-জনেই লন্ডন শহরের একই হাসপাতালে চাকরি করেন। কাজেই দেশে ফেরার কোনো প্রয়োজন বা তাগিদ তাঁরা কোনোদিনই অনুভব করেননি। এ ছাড়াও তাঁদের দেশে ফেরার ব্যাপারে কোনো উৎসাহ না থাকার অন্য কারণও ছিল।

গোলমাল বাঁধাল ছেলেমেয়েরা। তেরো বছরের ইন্দ্রনারায়ণ আর এগারো বছরের এষা তাদের দেশ দেখবার জন্য এমন ঝুলোঝুলি শুরু করে দিল যে শেষপর্যন্ত অমরেন্দ্র রাজি না হয়ে পারেননি। এরকম হওয়ারই কথা; কারণ ইন্দ্র আর এষাকে ছোটোবেলা থেকেই বাংলা বলতে, বাংলা বই পড়তে আর বাংলা গান শুনতে তাদের বাবা-মা-ই উৎসাহ দিয়ে এসেছেন। সেজন্যে তাদের ভেতরে নিজেদের দেশ সম্পর্কে একটা অদম্য কৌতূহল গড়ে ওঠাই স্বাভাবিক।

কলকাতায় একটা পাঁচতারা হোটেলে উঠেছিলেন রায়চৌধুরিরা। পঁচিশ বছর বাদে কলকাতার চেহারা দেখে বেশ খুশি হলেন অমরেন্দ্র। কিন্তু তাঁর ছেলেমেয়ে সন্তুষ্ট হল না। তারা, তাদের দেশ, হাওড়া জেলার মানিকপুর গ্রামে যেতে চায়। তাদের অনেক বোঝাবার চেষ্টা করলেন অমরেন্দ্র। বললেন, এই মানিকপুর একটি নিতান্তই অজ পাড়াগাঁ, এখানে সুইচ টিপলে আলো জ্বলে না, কল খুললে জল পড়ে না, চারদিকে ঝোপঝাড়, সাপখোপ, পোকামাকড়, সন্ধে হলে শেয়াল ডাকে। ওখানে গেলে কলকাতার সুন্দর স্মৃতিটা একেবারে নষ্ট হয়ে যাবে। তার চেয়ে দার্জিলিং যাওয়া অনেক ভালো। সকাল বেলা কাঞ্চনজঙ্ঘার দৃশ্য একটা অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা।

অমরেন্দ্রর এতসব যুক্তি তাঁর ছেলেমেয়ের কাছে ধোপে টিঁকল না। ওদের বাবা যেখানে তাঁর ছেলেবেলা কাটিয়েছেন, সে জায়গাটা না-দেখে তারা কোথাও যাবে না। অনেক তর্কাতর্কির পর স্থির হল যে ভোর বেলা একটা গাড়িভাড়া করে মানিকপুর যাওয়া হবে, সঙ্গে থাকবে প্যাক করা দুপুরের খাওয়া আর বিকেলের আগেই ওখান থেকে রওনা দিয়ে সন্ধে নাগাদ ফিরে আসা হবে।

সেইরকমই করা হল, গাড়ির ব্যবস্থা করে দিল হোটেলের কর্ত,পক্ষ। বিদ্যাসাগর সেতু আর কোনা এক্সপ্রেসওয়ে দেখে তো অমরেন্দ্র একেবারে চমৎকৃত। ড্রাইভার মহেন্দ্রকে বললেন— এই জায়গাটা যে এতদূর পালটে যাবে ভাবতেই পারিনি। আপনাকে রাস্তা চিনিয়ে নিয়ে যেতে পারব কি না বুঝতে পারছি না।

মহেন্দ্র বললেন— মানিকপুর যাবেন তো? কোনো চিন্তা করবেন না, আমি ঠিক নিয়ে যাব। মানিকপুরের পাশেই এই রাস্তার ওপরে বিরাট হাউসিং কমপ্লেক্স তৈরি হচ্ছে। আমি ওখানে বেশ কয়েক বার গেস্টদের নিয়ে গেছি। মানিকপুরের আশেপাশে সব-কটা রেস্টুরেন্ট আর পানের দোকানের মালিক আমার চেনা।

.

মানিকপুরে পৌঁছে অমরেন্দ্র একেবারে হতবাক। চারদিকে তাকান আর গলার মধ্যে নানারকম শব্দ করেন। শেষপর্যন্ত একটা বড়ো কাপড়ের দোকানের সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে ড্রাইভারকে বললেন— জেনে আসুন তো শ্রীবীরেন্দ্রনাথ রায়চৌধুরির বাড়িটা কোনদিকে। আমি তো কিছুই চিনতে পারছি না।

মহেন্দ্র ভেতরে গেলেন। ইন্দ্র জিজ্ঞাসা করল— বীরেন্দ্রনাথ রায়চৌধুরি তো তোমার কাকা, তোমার বাবার ছোটোভাই, তাই না? এখনও বেঁচে আছেন? কত বয়েস?

—বোধ হয় বেঁচে আছেন। মারা গেলে খবর পেতুম। ওঁর বয়েস এখন হবে সত্তরের কাছাকাছি।

বলতে-বলতেই দোকানের ভেতর থেকে মহেন্দ্র আর তার সঙ্গে তিন-চারজন ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন। তাঁরা দোকানের খরিদ্দার না কর্মচারী বোঝা গেল না। তাঁদের একজন এগিয়ে এসে অমরেন্দ্রকে জিজ্ঞাসা করলেন— আপনি রায়চৌধুরি বাড়িতে যেতে চান? জমি কিনবেন না কি?

অমরেন্দ্র সাবধানে বললেন— ঠিক তা নয়। অন্য একটা কাজ ছিল।

—আমার এসব প্রশ্নে কিছু মনে করবেন না। শুনলুম আপনি বিদেশ থেকে এসেছেন, তাই বলছিলুম যে, যে কাজই থাক, সতর্ক থাকবেন। বীরেন চৌধুরি লোকটা ভালো নয়, অত্যন্ত ধূর্ত আর প্রচণ্ড কিপটে। ওঁর দাদা আর ছোটোবোন অকালে মারা যান। সে ব্যাপারেও লোকে নানাকথা বলে। তখন উনি এখানকার জমিদার হন। সে সময় তো হাতে মাথা কাটতেন। পরে, প্রোমোটারদের খাসজমি বেচে লক্ষ লক্ষ টাকা করেছেন অথচ সৎকাজে একপয়সা ও উবুড়-হস্ত করতে নারাজ। বিয়েথা করেননি, এত টাকা যে কী করবেন তা ভগবানই জানেন। ওদিকে, সাদাসিধে সরল লোককে বিপদে ফেলে নাকাল করতে সিদ্ধহস্ত। এখানকার লোকেরা ওঁর নাম মুখে আনে না। আনলে না কি হাঁড়ি ফেটে যায়। সেকথা থাক, রায়চৌধুরি বাড়ি যাওয়ার পথ এঁকে বলে দিয়েছি। চিনতে অসুবিধে হবে না।

এষা হিহি করে হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করল— হাঁড়ি ফেটে যায় মানে কী বাবা?

চিন্তিত গম্ভীর মুখে অমরেন্দ্র বললেন— ও কিছু নয়, পরে বলব।

.

কিছুটা এগিয়ে পাকা রাস্তা ছেড়ে গাড়ি যখন কাঁচা রাস্তা ধরল, তখন গ্রামের দৃশ্য দেখা যেতে লাগল। টালির চালের ঘর, চাষের খেত ইত্যাদি দেখে ইন্দ্র আর এষা মহাখুশি। বলল— এই তো তোমার গ্রাম, তাই না বাবা?

অমরেন্দ্র সংক্ষেপে হ্যাঁ বলে চুপ করে গেলেন, তাঁর মুখ চিন্তিত আর গম্ভীর হয়ে রইল। তাঁর আনন্দ আর উৎসাহে কেমন যেন ভাঁটা পড়েছে বলে মনে হল।

রায়চৌধুরি বাড়ি গ্রামের এক প্রান্তে। প্রায় দশফুট উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা বিঘে-তিনেক জমির ওপরে দোতলা লম্বাটে প্রকাণ্ড ইমারত। সামনে টানা থামওয়ালা বারান্দা, মাঝখানে পেছনদিকে যাওয়ার জন্য খিলেন করা চওড়া প্যাসেজ। কিন্তু সমস্ত বাড়িটার এখন বড়োই দৈন্যদশা। অনেক জায়গায় প্লাস্টার খসে গেছে, মোটা থামগুলো জড়িয়ে উঠেছে বুনোলতা, জানলা দরজায় রং হয়নি যে কতকাল তা বোধ হয় কেউ জানে না। একজন ক্লান্ত বিষণ্ণ বৃদ্ধের মতো বাড়িটা যেন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ধুঁকছে। সে বাড়িতে যে কেউ বাস করে তা প্রথম দর্শনে মনে হয় না।

মীনাক্ষী বললেন— তুমি ঠিক জানো যে তোমার কাকা এইখানে থাকেন? আমার তো মনে হচ্ছে যে উনি হয়তো অন্য কোথাও বাড়ি করে উঠে গেছেন।

অমরেন্দ্র বললেন— তাই হবে হয়তো। তাহলে তো ভালোই হয়।

দেউড়ি দিয়ে ঢুকে গাড়ি দাঁড়াল একখণ্ড পোড়ো জমির ওপরে। সে জায়গাটা বোধ হয় একসময়ে লন ছিল, এখন আগাছায় ভরতি। এমন নিস্তেজ আর নিষ্প্রাণ জায়গায় এসেও ইন্দ্র আর এষার আনন্দের কোনো অভাব ঘটল না। হইহই করতে করতে গাড়ি থেকে নেমে দু-জনে প্রথমে বাড়ির সামনে একপাক ঘুরে এল, তারপর দৌড়ে প্যাসেজের ভেতরে চলে গেল। পেছন থেকে মীনাক্ষী ডেকে বললেন— সাবধানে যাবি। সাপখোপ থাকতে পারে।

ইন্দ্র আর এষা কোনো জবাব দিল না বটে কিন্তু প্রায় সঙ্গেসঙ্গেই বেরিয়ে এল। সমস্বরে বলল— এখানে লোক থাকে, বাবা।

অমরেন্দ্র জিজ্ঞাসা করলেন— কী করে বুঝলি?

—ওপাশে জামাকাপড় শুকোচ্ছে দেখলুম।

—তাহলে চল, দেখে আসি।

প্যাসেজের অন্যপাশে বাঁধানো উঠোন। শুকনো ডালপালা, ভাঙা ইটের স্তূপ আর আর্বজনায় ভরতি। দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে অমরেন্দ্র বললেন— ছেলেবেলায় এখানে পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে ফুটবল খেলতুম, ভাবাই যায় না।

—কে, কে ওখানে? বলতে বলতে একতলার একটা ঘরের ভেতর থেকে একজন গামছা কাঁধে আধময়লা ধুতিপরা প্রৌঢ় লোক বেরিয়ে এল, তার পেছনে একজন পক্ককেশ বিধবা বৃদ্ধা। প্রৌঢ় লোকটি জিজ্ঞাসা করল— কে আপনারা, কী চাই?

উত্তর দেওয়ার দরকার হল না। তার আগেই বৃদ্ধা বললেন— আরে অমর না? বড়োবাবুর ছেলে না তুমি?

অমরেন্দ্র মাথা নেড়ে বললেন— হ্যাঁ, তুমি তো মিনতি পিসি, তাই না? আর, তুমি তো জগাদাদা।

—হ্যাঁরে ছেলে, ঠিক চিনেছিস! তা, হাঁকডাক করিসনি কেন? কত বছর বাদে এলি, আর চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছিস? সঙ্গে কারা? তোর বউ আর বাচ্চারা? আয় বাবা, ভেতরে আয়। বৈঠকখানায় বস। বড্ডো ধুলো আমি পরিষ্কার করে দিচ্ছি। তুই হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন, জগু? যা, ওপরে গিয়ে ছোটোবাবুকে খবর দে।

প্রকাণ্ড বৈঠকখানা ঘর। সেখানে থাকবার মধ্যে আছে একটা ধূলিধূসরিত বিশাল সোফাসেট আর দেওয়ালে অনেকগুলো অয়েলপেন্টিং। আসবাবপত্র বলতে আর কিছুই নেই। মিনতিপিসি একটা সোফার ধুলো ঝেড়ে সেটা বসবার উপযুক্ত করে দিলেন। ইন্দ্র আর এষা দু-তিন মিনিট ঘরের ভেতরে ঘুরে দৌড়ে বাইরে চলে গেল।

মিনতিপিসি বললেন— তোরা বস, আমি তোদের জন্য চা করে আনি। বলেই পুরোনো দিনের স্মৃতিচারণ শুরু করে দিলেন। সে আর থামেই না।

প্রায় আধঘণ্টা পরে বারান্দায় চটির শব্দ পেয়ে বাক্যস্রোত বন্ধ করে মিনতিপিসি তাড়াতাড়ি চা করতে বেরিয়ে গেলেন। তখন ঘরে ঢুকলেন শ্রীবীরেন্দ্রনাথ রায়চৌধুরি। ছ-ফুট লম্বা শক্তসমর্থ শরীর। মাথার চুল, ভুরু আর ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি সব-ই সাদা। পরনে সাদা পাঞ্জাবি আর পাজামা। দেখলে ভক্তি হয় না, ভয় করে।

প্রণাম আর কুশল প্রশ্ন শেষ হলে বীরেন্দ্রনাথ জিজ্ঞাসা করলেন— তুমি এখানে এসেছ কেন? কোনো বিশেষ কারণ আছে কী? আমি তো জানতাম তুমি আর কোনোদিন এদিকে আসবে না।

অমরেন্দ্র বললেন— নিজের দেশে বা নিজের বাড়িতে আসতে গেলে কোনো বিশেষ কারণের দরকার হয় কি, কাকা? তবু কারণ একটা আছে। আমি এসেছি আমার ছেলেমেয়েদের তাদের পূর্বপুরুষদের বাসস্থান দেখাতে। এখানে এসে অবশ্য মনে হচ্ছে যে ওদের না আনলেই বোধ হয় ভালো হত। আমি এতদিন ধরে ওদের এই বাড়ির যে উজ্জ্বল রূপের কথা বলে এসেছি, তার তো কণামাত্রও আজ আর অবশিষ্ট নেই। ভয় হচ্ছে যে ওরা না আমাকে মিথ্যেবাদী ভাবে।

—সেরকম ভাবার তো কারণ দেখি না। যা দিনকাল পড়েছে তাতে তোমার ওই উজ্জ্বল রূপ আর অবশিষ্ট থাকা সম্ভব নয়। তুমি তো জানো না, জমিদারি চলে যাওয়ার পর আজ আমাদের কী দুরবস্থা। কোনোরকমে ডালভাত খেয়ে দিন কাটাচ্ছি। দেখছ না, এই ঘরে যত ফার্নিচার ছিল, সব-ই প্রায় বিক্রি করে দিতে হয়েছে? টাকাপয়সার যা অভাব তা বলে বোঝাতে পারব না। নেহাত পূর্বপুরুষের ভিটে, তাই বাড়িটা বিক্রি করতে পারিনি। তবে, হয়তো তারও আর বেশি দেরি নেই।

অমরেন্দ্র কথাটা খুব একটা বিশ্বাস করলেন বলে মনে হল না। বললেন— লোকে তো বলে আপনার নাকি অনেক টাকা।

ভয়ানক রেগে গেলেন বীরেন্দ্রনাথ, তবে নিজেকে চট করে সামলে নিলেন। বিস্ফারিত চোখে যথাসাধ্য শান্ত গলায় বললেন— লোকে কী বলে না-বলে, তাই দিয়ে কাকার কথার সত্যাসত্য বিচার করতে যেও না, অমর।

আরও কিছু হয়তো বলতেন, কিন্তু তার আগেই ইন্দ্র আর এষা লাফাতে লাফাতে ঘরে ঢুকল। এষা তড়বড় করে বলে গেল— জানো বাবা, ওই উঠোনটার একপাশে একটা দরজা আছে। সেখান দিয়ে পেছনের একটা জঙ্গলে যাওয়া যায়। ওখানে একজন সাধুবাবা আছেন। একটা গাছের নীচে একটা খুব সুন্দর প্ল্যাটফর্মের ওপরে লালরঙের কাপড় পরে বসেছিলেন। মুখে লম্বা দাড়ি কিন্তু খুব ভালো লোক। আমাদের জিগ্যেস করছিলেন যে আমরা কারা, কোথা থেকে এসেছি, এইসব।

মীনাক্ষী কথাটা শুনে চিন্তিত হয়ে পড়লেন। বললেন— তোমাদের না বলেছি যে অপরিচিত কোনো লোকের সঙ্গে কখনো কথা বলবে না বা তার কাছে যাবে না?

ইন্দ্র বলল— না মা, সাধুবাবা খুব ভালো মানুষ।

এতক্ষণ বীরেন্দ্রনাথ তীব্রদৃষ্টিতে ইন্দ্র আর এষার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। থেমে থেমে বললেন— এরা তোমাদের ছেলেমেয়ে? বেশ, বেশ। তা তুমি ঠিকই বলেছ, বউমা। এইসব সাধুবাবা-টাবার কাছেপিঠে না যাওয়াই উচিত। এই অঞ্চলে মাঝে-মাঝেই ছেলেধরার উৎপাত হয়। সবাইকে তাই সাবধানে থাকতে হয়।

বলতে বলতে তাঁর মুখে একটা অদ্ভুত চাপাহাসি দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেল। একটু চুপ করে থেকে বললেন— তা, তোমরা এখানে কতদিন থাকবে?

অমরেন্দ্র বললেন— আমরা আজ বিকেলেই চলে যাব।

—তা বেশ। এখন দেখি, তোমাদের দুপুরের খাওয়ার কোনো বন্দোবস্ত করতে পারি কিনা। না-হলে, এখানে কাঠেপিঠে খাওয়ার অবশ্য কোনো অভাব নেই।

—তার দরকার নেই, কাকা। আমাদের সঙ্গে প্যাকেট করা খাবার আছে।

—বেশ, বেশ। সব ব্যবস্থা করেই এসেছ দেখছি। তুমি আর বউমা তাহলে এখন বিশ্রাম করো। আমি বরং তোমার ছেলেমেয়েকে বাড়িটা ঘুরে দেখাই, কি বলো? ওদেরই তো সব।

বলামাত্র ইন্দ্র আর এষা মহাখুশি হয়ে সমস্বরে বলল— হ্যাঁ, হ্যাঁ, সেই ভালো।

বীরেন্দ্রনাথ গলায় যথাসাধ্য মধু ঢেলে ওদের বললেন— আমি তোমাদের ছোটো ঠাকুরদাদা। এখন প্রথমে তোমাদের আমাদের বাড়িটা দেখাব আর তারপরে তোমাদের খাওয়ার পর জমিটমিগুলো দেখাব, কি বলো?

দু-জনে তৎক্ষণাৎ রাজি হয়ে গেল।

মীনাক্ষী বললেন— সাড়ে বারোটা থেকে একটার মধ্যে গাড়ির কাছে চলে আসবে কিন্তু। আর কোনোরকম দুষ্টুমি করবে না, কেমন?

বীরেন্দ্রনাথ বরাভয়ের ভঙ্গিতে হাত তুলে বললেন— চিন্তা করো না বউমা, আমি ঠিক পৌঁছে দেব। আর, বাচ্চারা দুষ্টুমি করবে না, তা কখনো হয়?

বলে ছোটো ঠাকুরদাদা তাঁর নাতি-নাতনিকে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। অমরেন্দ্র কিন্তু কিছুটা সন্ত্রস্ত দৃষ্টিতে তাঁর গমনপথের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

মীনাক্ষী বললেন— তোমাকে এত চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন? কী ভাবছ?

অমরেন্দ্র বললেন— ভাবছি, মানুষের মধ্যে এতটা পরিবর্তন কী সম্ভব? বীরেন্দ্রনাথের ভেতরে স্নেহের সঞ্চার যে দেখিলেও না-হয় প্রত্যয়। কবে দেখব, গোরিলা গান গাইছে আর নেকড়েবাঘ গলায় কণ্ঠি ঝুলিয়ে হরিনাম করছে।

মীনাক্ষী বললেন— চমৎকার! কাকা-ভাইপোতে এমন ভাব তো বিশ্বসংসারে দেখা যায় না। পারোও তোমরা!

অমরেন্দ্র গম্ভীর হয়ে চুপ করে রইলেন। কোনো কথা বললেন না।

.

দেড়টা নাগাদ গরদের ধুতি আর উত্তরীয় পরা বীরেন্দ্রনাথকে হন্তদন্ত হয়ে বাড়ির মাঝখানের প্যাসেজটা দিয়ে বাইরে আসতে দেখা গেল, পেছনে জগা। মীনাক্ষী, মোবাইল ফোন হাতে, অমরেন্দ্র একটা লোহার রড হাতে, মহেন্দ্র অত্যন্ত উদবিগ্নমুখে গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে কী যেন পরামর্শ করছিলেন। বীরেন্দ্রনাথ উত্তেজিতভাবে বললেন— তোমার ছেলেমেয়েরা কি এখানে এসেছে?

রাগত কঠিন মুখে অমরেন্দ্র বললেন— ওরা আপনার কাছে ছিল।

—ছিল তো। আমি একটু পুজোয় বসেছিলুম, তখন ওরা জগুর সঙ্গে লুকোচুরি খেলছিল। খেলতে খেলতে কোথায় যে গেল। কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না। জগু আর আমি তন্নতন্ন করে খুঁজেছি। ভীষণ ভয় করছে। ছেলেধরা তুলে নিয়ে গেল না তো?

—ছেলেধরার ব্যবস্থা পরে হবে। আগে বলুন তো কাকা, এই ভরদুপুরে আপনি কী পুজো করছিলেন?

—সে তুমি বুঝবে না। আমি রোজ এই পুজো করে থাকি। আমার গুরুর আদেশ।

—আপনার গুরুটি তো তান্ত্রিক, তাই না, কাকা? তাকে তো এখন আমার বাবার শোওয়ার ঘরে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তার ব্যবস্থাও হবে। আর তোমাকেও বলি জগাদা, এই জঘন্য ব্যাপারে জড়িয়ে পড়ে ভালো কাজ করোনি। আমার বাবা আর পিসি যখন মারা যান, তখনও তুমি চুপ করে ছিলে, আজও চুপ করে আছ। তোমার কপালে অশেষ দুঃখ রয়েছে।

তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন বীরেন্দ্রনাথ। চিৎকার করে বললেন— তুমি শালিনতার মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছ, অমর। তোমার ছেলেমেয়েকে পাওয়া যাচ্ছে না বলে তুমি আমার সাধনাকে জঘন্য ব্যাপার বলতে সাহস পাও কী করে? তা-ও আমারই সামনে দাঁড়িয়ে।

—আপনার সামনে দাঁড়িয়ে আমি আরও অনেক কথাই বলব, কাকা। যথাসময়ে। আগে তো আমার ছেলেমেয়ে দুটোকে নিয়ে আসি। তারাও বলবে। পুলিশ আসতে আর বেশি দেরি নেই। সবকথা আপনার আর তাদের সামনেই হবে। আমি লালবাজারে ফোন করে দিয়েছি। তারা লোকাল থানায় খবর নিয়ে দিয়েছে।

বীরেন্দ্রনাথ পূর্ববৎ চিৎকার করে বললেন— তুমি আমাকে পুলিশের ভয় দেখাচ্ছ? ক্ষমতা থাকে তো যাও, নিয়ে এসো তোমার ছেলেমেয়েদের। দেখি তারা কী বলে? তারা কোথায় আছে তা কি তোমার জানা আছে?

—আছে। আমাদের গুমঘরে আপনি তাদের আটকে রেখেছেন যাতে তারা আস্তে-আস্তে কষ্ট পেয়ে মারা যায় আর যখ হয়ে যে কুবেরের ঐশ্বর্য আপনি ওই ঘরে জমিয়ে তুলেছেন সেটা অনন্তকাল ধরে পাহারা দিতে পারে। মোহর দেখাবার অছিলায় আপনি তাদের ওখানে নিয়ে গিয়েছেন কিন্তু আপনার সেই উদ্দেশ্য সফল হতে পারল না, কাকা। আপনার এই কদর্য নিষ্ঠুর কুসংস্কার কি জঘন্য ব্যাপার নয়?

মীনাক্ষি বললেন— আপনি শালিনতার কথা বলছিলেন না? এই আপনার শালিনতা?

চুপসে যাওয়া বেলুনের মতো মিইয়ে গেলেন বীরেন্দ্রনাথ। মিনমিন করে বললেন— আমাদের গুমঘর কোথায়, তোমরা জানো? সেটা তো আমি ছাড়া আর কেউ জানে না বলে জানতুম। সেই ঘর তো আজ বহুবছর তালাবন্ধ হয়ে পড়ে রয়েছে। তার চাবি তো কবেই হারিয়ে গিয়েছে।

অমরেন্দ্র বললেন— তার চাবি আপাতত আছে আপনার শোওয়ার ঘরে ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারের ভেতরে।

মহেন্দ্র বললেন— ভালোয় ভালোয় চাবি যদি না দেন, তাহলে এই লোহার রড দিয়ে তালা ভেঙে দেব। কোনো অসুবিধে হবে না।

স্তম্ভিত বীরেন্দ্রনাথ বললেন— তোমাদের এসব খবর দিলে কে? নিশ্চয়ই জগু হারামজাদা।

—না, আমি দিয়েছি। বলতে বলতে মাঝারি গড়নের, ধুতি আর ফতুয়া পরা, মুখে লম্বা কাঁচা-পাকা দাড়ি, একটি লোক বারান্দার একটি থামের পেছন থেকে বেরিয়ে এল।

বীরেন্দ্রনাথ বললেন— কে তুই? এসব খবর তুই জানলি কী করে?

লোকটি বলল— আমাকে চিনতে পারলেন না, ছোটোবাবু? আমি গোষ্ঠ, বড়োবাবুর খাস বেয়ারা।

বীরেন্দ্রনাথ মুখ বেঁকিয়ে বললেন— গোষ্ঠ? ফাজলামো হচ্ছে? এ গোষ্ঠ নয়, হতে পারে না। কারণ, গোষ্ঠ বেঁচে নেই। সে বহুকাল আগে খুন হয়েছিল। দাদা মারা যাওয়ার প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই। টাকাপয়সা চুরি করেছিল আর সেই সূত্রে ওর দলের লোকজনের সঙ্গে বিবাদে ওকে খুন হতে হয়েছিল।

শুনে সবাই স্তম্ভিত, বাক্যহারা। মহেন্দ্র সামলে নিয়ে বলল— লোকটা চোখের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে, আর আপনি বলছেন যে সে খুন হয়েছে! এ কি তবে ভূত? যত সব বাজে কথা। আমি ভূতে বিশ্বাস করি না।

বীরেন্দ্রনাথ বললেন— আমি তা বলছি না। আসলে, এ একটা বাজে লোক। তুমি এর একটা কথাও বিশ্বাস কোরো না, অমর। আমার কোনো শত্রু একে এখানে পাঠিয়েছে।

গোষ্ট সহাস্যে বলল— আমি বাজে লোক কি না জানি না। তবে, এটা জানি যে রানিমা যখন অমরদাদাকে নিয়ে বাপের বাড়ি গিয়েছিলেন, তখন জমিদারির লোভে আপনি আপনার দাদা আর ছোটোবোনকে বিষ খাইয়ে মেরেছিলেন। ওরা ফিরে এলে সুযোগ বুঝে ওদেরও মারতেন। আমি ব্যাপারটা জানতে পেরে সেই রাতেই খবরটা অমরদাদার বড়োমামাকে দিয়ে আসি। তিনি তখন কিছু করতে পারেননি; তবে আর ওদের এখানে আসতে দেননি। আপনি ঘটনাটা টের পেয়ে আমাকেও খুন করেন। তার ওপর, আজ আপনি দুটো নিরাপরাধ শিশুকে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছেন। তাদের হাহাকার আর কান্না আপনি শুনতে পাচ্ছেন, ছোটোবাবু? আমি পাচ্ছি। এতবড়ো অন্যায়, এতবড়ো পাপ আর সহ্য করা যায় না। এতদিন যে সুযোগের অপেক্ষায় ছিলুম, আজ অমরদাদার চলে আসায় তা এসেছে। এবার আপনার সব খেলা শেষ, ছোটোবাবু।

বলতে-বলতেই পুলিশের গাড়ি বাড়ির ভেতরে এসে দাঁড়াল। বীরেন্দ্রনাথ ঘাড় ঘুরিয়ে সেদিকে দেখলেন, তার পরেই অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন।

.

বিকেলের পড়ন্ত আলোয় মহেন্দ্রর গাড়ি কলকাতার দিকে ছুটে যাচ্ছিল। পেছনের সিটে ইন্দ্র আর এষা অকাতরে ঘুমোচ্ছিল আর সামনের সিটে অমরেন্দ্র আর মীনাক্ষি চিন্তিত-বিষণ্ণ মুখে বসেছিলেন। মীনাক্ষি বললেন— লোকে কেন যে ভূতে ভয় পায়, জানি না। আজ দেখলুম, মানুষ অনেক বেশি ভয়ংকর।

 বন্ধু

ইন্দ্রনাথ রায় আর বিষ্ণুপদ ভট্টাচার্য বহুদিনের বন্ধু। দু-জনে একসঙ্গে গিরিডি শিলটন মাইকা কোম্পানিতে ঢুকেছিলেন আজ থেকে প্রায় ছত্রিশ বছর আগে। তারপর অনেক উত্থান-পতনের পর একইসঙ্গে অবসর নিয়েছেন দু-বছর আগে। অভিন্নহৃদয় বন্ধু হলে কী হবে, দু-জনের মধ্যে তফাত ছিল অনেক। ইন্দ্রনাথ ছিলেন লম্বাচওড়া, ফর্সা আর প্রচণ্ড ফূর্তিবাজ। হাসতে শুরু করলে থামতে পারতেন না। আর বিষ্ণুপদ ছিলেন ছোটোখাটো মানুষ। শ্যামবর্ণ, গম্ভীর আর কিছুটা অন্তর্মুখী। দু-জনের বন্ধুত্বটা যে কী করে টিকে ছিল সেটা অনেকেই ভেবে পেত না। আর শুধু কী বন্ধুত্ব? দু-জনের মধ্যে আত্মীয়তাও গড়ে উঠেছিল। ইন্দ্রনাথের বড়ো ছেলে প্রদীপ্তর সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল বিষ্ণুপদর একমাত্র মেয়ে কল্যাণীর। কৈশোরে মাতৃহারা কল্যাণীকে নিজের মেয়ের মতো করে কাছে টেনে নিয়েছিলেন ইন্দ্রনাথের স্ত্রী সুতপা।

অবসর নিয়ে বিষ্ণুপদ বাড়ি করেছিলেন গিরিডি শহর থেকে অনেকটা দূরে। সে জায়গাটা বেশ নির্জন। বাড়িঘর বেশি নেই, জঙ্গলও কাছে। একা থাকতেন আর একটি স্থানীয় সাইকেল রিকশাওয়ালা তাঁকে দেখাশুনো করত। ছেলেটির নাম মদন। সে ভোর বেলা এসে বাড়ির কাজকর্ম করে রান্না করে দশটা নাগাদ চলে যেত। মাঝে মাঝে রাত্রি বেলা বাড়ি ফেরার পথে খবর নিয়ে যেত আর বিষ্ণুপদ-র শহরে বা স্টেশনে যাবার দরকার হলে তার সাইকেলরিকশায় তাঁকে নিয়ে যেত।

ইন্দ্রনাথও বাড়ি করেছিলেন গিরিডিতে; তবে সে একেবারে শহরের মধ্যিখানে। তাঁর বন্ধুর মতো নির্জনে বসে বই পড়া তাঁর ধাতে সইত না। আর তাঁর তিন ছেলে আজ ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় চাকরি নিয়ে চলে গেছে, তিনি স্ত্রীকে নিয়ে প্রায় সারা বছর ধরে তাদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়াতেন মহানন্দে। যতদিন গিরিডিতে থাকতেন, ততদিন অবশ্য রোজ বিকেলে বিষ্ণুপদর বাড়িতে যেতেন।

সেদিন মাঘী পূর্ণিমা। বিষ্ণুপদ অত্যন্ত উদবিগ্ন হয়ে বারান্দায় বসেছিলেন। রাত অনেক হয়েছে কিন্তু শুতে যেতে পারছেন না। তখন লোডশেডিং চলেছে। বিষ্ণুপদ মনে মনে প্রার্থনা করছিলেন, আকাশে যেন মেঘ না-আসে আর উজ্জ্বল চাঁদের আলোটা যেন ঢাকা পড়ে না-যায়। তা যদি যায় তাহলে নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে সবকিছু ঢাকা পড়ে যাবে। সেক্ষেত্রে, পঞ্চাননের সাইকেল চালিয়ে তাঁর বাড়িতে আসা যে শুধু কঠিন হবে তা-ই নয় বিপজ্জনকও হবে। এ অঞ্চলে সম্প্রতি চুরি-ডাকাতি খুব বেড়ে গেছে। পঞ্চাননকে যদি কেউ রাস্তায় ধরে, তাহলে তার কাছে টাকা পয়সা হয়তো পাবে না কিন্তু তাকে মারধর করে তার সাইকেলটা কেড়ে নেবে।

পঞ্চানন ইন্দ্রনাথের কাজের লোক। অনেক দিন ধরে রয়েছে ও বাড়িতে। আজ সকালে কল্যাণীর সন্তান হবার কথা। সেই খবরটা তাকে টেলিফোন করে কলকাতা থেকে জানাবেন ইন্দ্রনাথ আর সে এসে বিষ্ণুপদকে খবর দেবে, এরকমই কথা ছিল। দুপুর নাগাদ উদবেগ চেপে রাখতে না-পেরে বিষ্ণুপদ মদনের রিকশা নিয়ে শহরে গিয়েছিলেন। গিয়ে দেখেন, ইন্দ্রনাথের টেলিফোন কাজ করছে না। পঞ্চানন তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিল যে বাবু, ইন্দ্রনাথ যে ভাবেই হোক, ঠিক খবর দেবেন আর যত রাতই হোক, সেই খবর সে তাঁকে পৌঁছে দেবেই।

রাত যখন এগারোটা বাজল বিষ্ণুপদ শুয়ে পড়াই স্থির করলেন। পঞ্চানন এত রাতে কী আর আসবে? খবরাখবর সব কাল সকালেই পাওয়া যাবে। হ্যারিকেন লন্ঠনের আলোটা কমিয়ে দিয়ে সবে লেপের ভেতরে ঢুকেছেন বিষ্ণুপদ, হঠাৎ বাইরে একটা হুংকার শুনে তাড়াতাড়ি উঠে বসলেন। হ্যারিকেনের আলোটা উসকে দিয়ে একটা শাল জড়িয়ে দরজা খুলে বারান্দায় বেরিয়ে এলেন। দেখেন গ্রিলের একপাশে ধূসর রঙের একটা কম্বল মুড়ি দেওয়া মংকি ক্যাপ পরা একটা লম্বাচওড়া লোক একটা লম্বা লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছে। চাঁদের আলোয় দেখা গেল আগন্তুকটির হাতে সাদা উলের আস্তানা।

বিষ্ণুপদ হিন্দিতে প্রশ্ন করলেন— কৌন?

আগন্তুক আবার হুংকার দিয়ে উঠল— কী হয়েছে তোর? চশমা ছাড়া বই পড়তে পারিস না জানতুম। লোকজন চিনতেও অসুবিধে হচ্ছে না কি আজকাল?

বিষ্ণুপদ বললেন— ও তুই? এত রাতে? কী খবর? কখন এলি কলকাতা থেকে? বলতে বলতে গ্রিলের দরজার তলাটা খুলে দিলেন।

ইন্দ্রনাথ বারান্দায় উঠে লাঠিটা দেওয়ালের গায়ে ঠেকিয়ে রেখে বললেন— এসেছি আজ রাত্রের গাড়িতে। খবর অত্যন্ত ভালো। আজ ভোর চারটে চব্বিশ মিনিটে তুই দাদু হয়েছিস। সাত পাউন্ডের ছেলে। মা আর ছেলে দু-জনেই ভালো আছে।

বিষ্ণুপদ আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলেন। তাঁর দু-চোখ জলে ভরে এল। কম্পিত কণ্ঠে বললেন— এত ভালো খবর জীবনে কখনো পাব ভাবিনি। এসব তোর জন্যে। মানসী যে দায়িত্ব আমার হাতে দিয়ে গিয়েছিল, তুই আমার পাশে না থাকলে সে দায়িত্ব আজকের এই সার্থকতায় কোনোদিন পৌঁছতে পারত না।

ইন্দ্রনাথ বললেন— আমি আবার কী করলুম? যা করবার তো তুই-ই করেছিস। আমরা ছিলুম শুধু তোর পাশে। জ্ঞান ফিরে চেয়ে প্রথম কথা কী বলেছে কল্যাণী, জানিস? বলেছে, বাবা খবর পেয়েছে?

বিষ্ণুপদ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে নিজেকে সামলালেন। তারপর বললেন— আয় ভেতরে আয়।

ইন্দ্রনাথ মাথা নেড়ে বললেন— না, ভেতরে যাব না। এখন ঝামেলা করিসনি তো! ট্রেন থেকে নেমে সোজা তোর এখান আসছি। এবার বাড়ি যাওয়া দরকার। কিছু কাজ আছে।

—তুই এলি কেন? একটা টেলিফোন করে পঞ্চাননকে খবর দিতে পারলি না?

ইন্দ্রনাথ সহাস্যে বললেন— এলুম তোর এই আনন্দটা স্বচক্ষে দেখব বলে। এমন একটা খবর কি টেলিফোনে দেওয়া যায়। তা ছাড়া, দেবই বা কী করে? তোর তো ফোন নেই, তাই তুই জানিস না। গত তিনদিন যাবৎ গিরিডির সমস্ত ফোন খারাপ। সবচেয়ে বড়ো কথা আমার মা-টা আশা করে আছে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তোকে খবরটা দিতে হবে। তার কথা না-ভেবে কী করি বল?

—স্টেশন থেকে এ পর্যন্ত এলি কী করে? সাইকেল রিকশা এল?

—তা কখনো আসে? জয়সোয়াল মার্কেট পর্যন্ত রিকশা পেলুম। সেখানে রামেশ্বর চৌকিদারের কাছ থেকে লাঠিটা ধার করে হাঁটতে হাঁটতে চলে এলুম। বেশি সময় লাগেনি, মিনিট পনেরো।

—চমৎকার! এখন তো জয়সোয়াল মার্কেটেও রিকশা পাবিনে। আজ থেকে যা না এখানে, কাল সকালে যাস।

—অসম্ভব! অনেকগুলো কাজ আছে, বললুম না? কাল ভোর বেলাতেই বেরিয়ে পড়তে হবে। এখন চল, তোর মদনকে ঘুম থেকে ওঠাই। আপত্তি করবে না আশা করি।

—না তা করবে না।

দরজায় তালা দিয়ে বিষ্ণুপদ যখন ইন্দ্রনাথের সঙ্গে পিচের রাস্তায় উঠে এলেন, সারা পৃথিবী তখন জ্যোৎস্নায় যেন ভেসে যাচ্ছে। চারিদিক নিস্তব্ধ। যতদূর দৃষ্টি যায় রাস্তা জনপ্রাণীহীন। যেদিকে জয়সোয়াল মার্কেটের মোড়, তার উলটোদিকে মদনের ঘর। মিনিট পাঁচেকের হাঁটাপথ। দুই বন্ধু গল্প করতে করতে সেই দিকে রওনা হলেন। রাস্তার একপাশে ছোটো ছোটো একতলা বাড়ি অথবা কুঁড়েঘর। সেগুলো সব কটা অন্ধকার। কারুর মধ্যেই কোনো জনমানব আছে বলে মনে হয় না। অন্যপাশে ঝোপঝাড় তারপর কিছুটা ফাঁকা মাঠ, মাঠের শেষে জঙ্গল।

লাঠিটা কাঁধে নিয়ে বীরদর্পে হাঁটতে হাঁটতে ইন্দ্রনাথ বললেন— বুঝলি বিষ্টু এইরকম একটা লাঠি হাতে থাকলে আমি দুনিয়ায় কাউকে ভয় পাইনে। বলে লাঠির নানারকম গুণগান শুরু করে দিলেন।

এটা বেশিক্ষণ চলল না। হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেলেন ইন্দ্রনাথ। গলা নামিয়ে বললেন— কেউ আমাদের ফলো করছে। তিনজন লোক। আমাদের পেছনে ফুট দশেক দূরে ঝোপের আড়ালে।

বিষ্ণুপদ ইন্দ্রনাথের মতো গলা নামিয়ে বললেন— বলিস কী? তুই কী করে বুঝলি?

—আমি ঠিকই বুঝেছি। আয় তো, একটু মজা করি লোকগুলোর সঙ্গে। বলে ইন্দ্রনাথ বিষ্ণুপদর হাত ধরে টেনে একটা মস্ত গাছের আড়ালে চলে গেলেন।

বিষ্ণুপদ হাঁসফাঁস করে বললেন— মজা করবি কী-রে? লোকগুলো যদি ডাকাত হয়?

—ডাকাতই তো। দ্যাখ না কী করি!

গাছের তলাটা অন্ধকার। বাইরের চাঁদের আলোয় ইন্দ্রনাথকে সিলুয়েটে দেখতে পাচ্ছিলেন বিষ্ণুপদ। ইন্দ্রনাথ একহাত থেকে দস্তানা খুলে ফেললেন। গায়ে জড়ানো কম্বলের তলায় একটা কাঁধঝোলা ছিল; তার ভেতর থেকে একটা সাদা চাদর বের করলেন। তারপর কী যে করলেন, হঠাৎ বিষ্ণুপদ দেখলেন একটা সরু হাড় জিরজিরে সাদা হাত গাছের ছায়ার ভেতর থেকে বেরিয়ে লম্বা হয়ে ছুটে চলে গেল কিছুদূরে একটা ঝোপের দিকে।

সেইসঙ্গে ইন্দ্রনাথের গলা থেকে বেরিয়ে এল একটা রক্ত জল-করা ভয়াবহ চিৎকার। মনে হল যেন একশোটা কাঁসর ঘণ্টা একসঙ্গে বেজে উঠল। যদিও সেই শব্দটা হাসিই বলা যেতে পারে, কিন্তু বিষ্ণুপদর হৃৎপিণ্ডটা চমকে ওঠে গলার কাছে এসে ধড়ফড় করতে লাগল।

ঘটনার ফলটা হল অদ্ভুত। তিনটে কালো কম্বল-মুড়ি দেওয়া লোক ঝোপটার পেছন থেকে লাফ দিয়ে উঠল। তাদের একজনের হাতে দিশি গাদা বন্দুক অন্য দু-জনের হাতে চকচকে তলোয়ার। সে সব অস্ত্র ফেলে ভয়ংকর আতঙ্কে তারা ‘বাপ-রে, মা-রে’ করে চিৎকার করতে করতে ঊর্ধ্বশ্বাসে জঙ্গলের দিকে ছুট লাগাল।

ইন্দ্রনাথ লাঠিটা টেনে এনে তার ওপরে মোড়ান চাদরটা খুলে নিয়ে কাঁধঝোলায় রাখলেন আর দস্তানাটা খুলে হাতে পরে নিলেন। তারপর স্বভাবসিদ্ধ মোটা গলায় হাসতে শুরু করলেন। সে হাসি আর থামতেই চায় না। দম নেওয়ার ফাঁকে হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন— দেখলি, কেমন ভয় দেখালুম ব্যাটাদের। আর জীবনে এদিক মাড়াবে না, ডাকাতি করবার জন্য।

বিষ্ণুপদ ততক্ষণে একটু সামলেছেন। বললেন— তোর ছেলেমানুষি আর গেল না। ডাকাতের সঙ্গে এরকম ফাজলামো কেউ করে? যদি ভয় না পেত?

—পাবে না মানে? এরা হল গেঁয়ো ডাকাত, এদের যে কতরকম কুসংস্কার তার ইয়ত্তা নেই। আর সেইসব কুসংস্কারের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী যে ভূতের ভয়। যদি শহুরে ডাকাত হয় তো একটা কথা ছিল। তারা লেখাপড়া জানে, ভূত বলে যে কিছু নেই বা থাকতে পারে না, সেটা তারা জানলেও জানতে পারে। কিন্তু এরা? যত সব গোমুখ্যু লোক, এদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ভূতের ভয়। বলে আবার হা-হা করে হাসতে শুরু করলেন ইন্দ্রনাথ।

বিষ্ণুপদ-র মোটেই হাসি পাচ্ছিল না। তিনি একটু গম্ভীর হয়েই গাছের তলা থেকে বেরিয়ে রাস্তায় উঠে এলেন। বললেন— ঢের হয়েছে। এবার চল, মদনকে ঘুম থেকে ওঠাই।

ইন্দ্রনাথ বললেন— তার আর দরকার হবে না। তোর বাঁ-দিকে তাকিয়ে দেখ। একটা জিপ আসছে না? ওটা তোকেই নিতে আসছে।

সত্যিই একটা গাড়ির দুটো অত্যুজ্জ্বল হেডলাইটের আলো দেখতে পেলেন বিষ্ণুপদ। বললেন— একটা গাড়ি আসছে ঠিকই। এত রাতে আমাকে নিতে আসছে কেন?

—অত জানি না। তবে মার্কেট পুলিশ স্টেনের সাব-ইন্সপেক্টর রণধীর সিনহা আসছে বলে মনে হচ্ছে।

রণধীর বিষ্ণুপদর চেনা লোক, বিএ পরীক্ষার আগে তাঁর কাছে ইংরেজি পড়তে আসত। একটু আশ্চর্য হয়ে বিষ্ণুপদ স্বগতোক্তি করলেন— রণবীর আসছে? কী হল আবার?

দেখতে দেখতে গাড়িটা কাছে চলে এল। সেটা পুলিশের জিপই বটে। ভেতর থেকে রণধীর বেরিয়ে এলেন। বললেন— একী স্যার! এত রাতে আপনি এখানে! খবরটা কী পেয়েছেন?

—খবর? কী খবর বলো তো?

রণধীর মাথা নীচু করে বললেন— আপনাকে একবার আমার সঙ্গে যেতে হবে স্যার। আপনার বন্ধু মি. ইন্দ্রনাথ রায় আজ রাত্রের ট্রেনে এখানে এসেছিলেন। স্টেশন থেকে একটা সাইকেল রিকশা নিয়ে বোধ হয় আপনার কাছেই আসছিলেন। জয়সোয়াল মার্কেটের কাছে একটা ছুটন্ত মালবোঝাই ট্রাক প্রথমে রামেশ্বর গোয়ালাকে চাপা দেয় তারপর ওঁর সাইকেল রিকশায় ধাক্কা মারে। দু-জনেই অন দি স্পট মারা যান। ওঁর বাড়িতে আমরা গিয়েছিলুম। দেখলুম আত্মীয়স্বজন কেউ নেই। তাই, আপনার কাছে এসেছি।

বিষ্ণুপদ-র সমস্ত শরীর থরথর করে কেঁপে উঠল। কোনোরকমে বললেন— ইন্দ্র? বলে পেছনের গাছটার দিকে তাকালেন। চাঁদের আলোয় দেখলেন একটা নিশাচর পাখি প্রকাণ্ড ডানা মেলে ‘হা-হা’ করে ডাকতে ডাকতে ওঁর মাথার ওপর দিয়ে উড়ে চলে গেল।

 নন্দিনীর সেপাইশাস্ত্রী

নন্দিনী আর তার মা শিউলি হুগলি জেলার দোমালা গ্রামে থাকে। ওদের একতলা বাড়িটা খুব পুরোনো কিন্তু পাকাবাড়ি। বাড়িটা বানিয়েছিলেন নন্দিনীর ঠাকুরদাদার বাবা। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ঠিকেদারি করে অনেক টাকা করেছিলেন তিনি। সেই টাকাতেই প্রায় দশকাঠা জমির ওপরে এই বাড়িটা তৈরি হয়েছিল। বাড়িটার সামনে বাগান আর কিছু ফাঁকা জমি, পেছনে গোয়ালঘর, কুয়োতলা, চানের ঘর ইত্যাদি।

দোমালা গ্রামে নন্দিনীদের বাড়িটার একটু বদনাম আছে। অনেকে অনেক কথা বলে। কিন্তু নন্দিনীরা মোটামুটি নিশ্চিন্তে আর নির্ভয়েই ওখানে থাকে। প্রতিবেশীরা কেউ কিছু বলতে এলে শিউলি বলেন— এখানে তেমন কেউ থাকলে তো তাঁরা নন্দিনীর পূর্বপুরুষ। তাঁরা আমাদের খামোখা ভয় দেখাতে বা কোনোরকম ক্ষতি করতে যাবেন কেন? ওঁদের সঙ্গে তো আমাদের কোনো শত্রুতা নেই; বরং সম্পর্কটা স্নেহের।

নন্দিনীর বাবা পঞ্চানন কলকাতার কাছে একটা কারখানায় কাজ করেন আর প্রত্যেক শনিবার তাঁর গ্রামের বাড়িতে আসেন। যখনই আসেন, মেয়ের জন্যে কিছু না কিছু নিয়ে আসেন আর এসেই মেয়েকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। কখনো যান নদীর ধারে, কখনো বা সাইকেল করে দিয়াড়া স্টেশনে। সারাদিন দু-জনের কথা আর ফুরোয় না। সোমবার খুব ভোরে পঞ্চানন ফার্স্ট ট্রেন ধরে তাঁর কাজের জায়গায় ফিরে যান। নন্দিনী তখন ঘুমিয়ে থাকে।

নন্দিনীর বয়েস ন-বছর, কিন্তু তাকে নিতান্ত শিশু ভাবলে ভুল করা হবে। যখন তার বাবা থাকেন না, তখন তাকে সংসারের কত কাজ যে করতে হয়, তার কোনো সীমা নেই। তারমধ্যে আবার স্কুলের পড়া আর একটুখানি পুতুলখেলা তো আছেই। ওদের রান্নাঘরের একপাশে তার খেলাঘর। সেখানেই তার পুতুলের সংসার।

সেবছর পুজোর সময়, পঞ্চানন মেয়ের জন্যে এনেছিলেন দশটা কৃষ্ণনগরের মাটির সেপাই। তাদের প্রত্যেকের মুখে প্রকাণ্ড গোঁফ, মাথায় উঁচু টুপি আর পরনে ঝকমকে লাল-সবুজ উর্দি। তাদের কারোর হাতে তরোয়াল, কারোর সঙ্গিন লাগান বন্দুক আবার কারোর হাতে বর্শা। বাক্স থেকে বের করা মাত্র তারা নন্দিনীর সবচেয়ে প্রিয় পুতুল হয়ে পড়ল। এখন তারা তাকের ওপরে সাজানো আছে। সে ছাড়া আর কারোর তাদের ধরবার অধিকার নেই। এমনকী নন্দিনীর বেস্টফ্রেন্ড দীপালিরও নয়। ওর ধবধবে সাদা বেড়াল ‘বড়োসাহেব’ আড়চোখে পুতুলগুলো দেখে কিন্তু তাদের কখনো বিরক্ত করে না। এমনকী নন্দিনী যখন ওদের নিয়ে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলে, বড়োসাহেব তখন চৌকাঠের বাইরে বিমর্ষভাবে চুপ করে বসে থাকে।

তবে হ্যাঁ, রাত একটু বাড়লেই নন্দিনী কিন্তু আর তার মায়ের কাছ থেকে সরতে চায় না। শিউলি মাঝেমাঝে বললেন— বড্ড ভীতু তো তুই! বাইরে অন্ধকার হলেই আমার গা ঘেঁষে থাকিস। কীসের ভয় তোর? ভূতের? পাড়ার লোকের এসব বাজে কথায় কান দিবি না তো।

নন্দিনী বলে— ভয় আবার কী? সারাদিন তো তোমার কাছে বসাই হয় না। কত কাজ করতে হয় না আমাকে? এই রাত্রি বেলায় তো তোমার কাছে আসতে পারি।

শিউলি মেয়ের কথা শুনে হাসেন কিন্তু তার সবটা বিশ্বাস করেন বলে মনে হয় না। তিনি বোধ হয় বুঝতে পারেন যে নন্দিনী তাকে কিছু গোপন করে যাচ্ছে।

তাঁর ধারণাটা সত্যি। নন্দিনী তাঁকে যে কথাটা বলে না তা হল সে বেশ কয়েক বার চাঁদনি রাতে বারান্দায় আরামকেদারার ওপর ধুতি আর ফতুয়া পরা একজন বুড়োমানুষকে চুপ করে বাইরে জ্যোৎস্নার দিকে তাকিয়ে বসে থাকতে দেখেছে। এই কথাটা সে কাউকে বলেনি, এমনকী দীপালিকেও নয়।

আরও একটা ঘটনা তার কাছে অদ্ভুত লেগেছে। সন্ধে হলেই বড়োসাহেব কিছুতেই বারান্দায় যাবে না। একদিন বিকেল থেকে নন্দিনী বড়োসাহেবকে কোলে নিয়ে বারান্দায় বসে ছিল। যেই সূর্য ডুবে গেল, অমনি বড়োসাহেব হাঁচোড়পাঁচোড় করে ওর কোল থেকে নেমে দৌড়ে ঘরের ভেতরে চলে গেল।

নন্দিনী মনে মনে ভাবে, ভূত যদি থাকে তো থাক না। সে তো তাদের কোনো ক্ষতি করছে না। আর কেনই বা করবে? তাকে তো আর কেউ বিরক্ত করতে যাচ্ছে না। এই জন্যেই সে একটা ইচ্ছেকে চেপে রেখে দিয়েছে। ইচ্ছেটা হল, ওই ফতুয়া পরা বুড়োমানুষটির সঙ্গে গিয়ে আলাপ করবার। কিন্তু, ওর ভয় হয় তাতে যদি উনি বিরক্ত হন। তখন যে কী হবে তা তো বলা যায় না। তার চেয়ে এই ভালো, যে যার আপন মনে থাকো।

বোধ হয়, এই জন্যেই ওর বাবা বাড়িতে এলে দিনের বেলা যদিও বা আরামকেদারায় বসেন, সন্ধের পর কক্ষনো বসেন না। জিজ্ঞাসা করলে বলেন— আমার তো সর্দির ধাত। বাইরে বসলে যদি ঠান্ডা লেগে যায়, তাই বসি না।

.

সেবছর মাঘ মাসে খুব ঠান্ডা পড়েছিল। রাত্রে একটা কম্বলে কুলোচ্ছিল না, দুটোর দরকার পড়ছিল। সবাই শীতে জবুথুবু হয়ে পড়ছিল। দিনের বেলা রোদ ওঠে দেরিতে আর বিকেল হতে না-হতেই তার আর পাত্তা পাওয়া যায় না। সবাই তখন বাড়িতে ঢুকে দরজা জানলা বন্ধ করে বসে থাকে। এমনকী দোমালা পূর্বাচল ক্লাবে দু-চারজন মাংকি ক্যাপের ওপরে কম্ফর্টার জড়ানো আগাপাস্তলা কম্বল মুড়ি দেওয়া বুড়ো দাবাড়ু ছাড়া আর কারোর দেখা পাওয়া যায় না।

একমাত্র শিউলির কোনো হেলদোল নেই। একটা আলোয়ান গায়ে দিয়ে খালি পায়ে সংসারের যাবতীয় কাজ অবলীলাক্রমে করে যাচ্ছেন।

নন্দিনী তার বাবাকে বলল— দেখেছ বাবা, আমারা দুটো করে গরম জামা পরে তার ওপরে কম্বল মুড়ি দিয়ে বসে আছি। আর মা কেবল একটা গরম চাদর দিয়ে সব কাজ করে যাচ্ছে।

পঞ্চানন মেয়ের কানে কানে বললেন— হবে না কেন? তোর মা যে পাগল। পাগলের শীত লাগে না, জানিস না?

শুনে নন্দিনী হি হি করে হাসতে লাগল। শিউলি গোয়ালঘর থেকে মুখ বের করে বললেন— এ্যাই নন্দু, কী বলল রে তোর বাবা?

নন্দিনী বলল— কিছু না, মা। বাবা বলল যে তুমি যে আজকে আলু-ফুলকপির তরকারিটা করেছিলে, সেটা খুব ভালো হয়েছিল।

.

কিছুদিন বাদে সরস্বতী পুজো। সেদিনটা বুধবার। তার পরের শনিবার পূর্বাচল ক্লাবের উদ্যোগে কলকাতা থেকে এক বিখ্যাত যাত্রাপার্টি দোমালায় এসে উপস্থিত হল। এদিকে গ্রামে একেবারে হুলুস্থুল পড়ে গেছে। সরস্বতী পুজোর দু-সপ্তাহ আগে থেকে ক্লাবের উদ্যোক্তারা রিকশাভ্যানে চড়ে মাইক বাজিয়ে সবাইকে জানিয়ে দিয়েছেন যে এই ‘বিজন বনের অচিন পাখি’ যাত্রায় নায়ক-নায়িকা দু-জনেই বাংলার সিনেমা জগতের বিখ্যাত তারকা। নাচে আছেন মুম্বাইয়ের তারকা মিস জুলি। এঁদের অভিনয় দেখবার এমন সুযোগ যেন না-হারান। শিব মন্দিরের পাশের মাঠে প্রকাণ্ড প্যান্ডেল বাঁধা হয়েছে। গ্রামসুদ্ধ ছেলেমেয়ে সারাদিন সেখানেই পড়ে রয়েছে।

যাত্রার দিন বিকেল বেলা পাড়ার কয়েক জন মহিলা এসে পঞ্চাননকে বললেন যে রুনু মাসিমার শরীর খারাপ হয়েছে তাই তাঁদের একটা টিকিট বেশি হচ্ছে, শিউলি যদি সেই টিকিটে তাঁদের সঙ্গে যান তাহলে খুব ভালো হয়। ভোর না-হতেই সবাই ফিরে আসবেন।

পঞ্চানন তৎক্ষণাৎ রাজি হলেন কিন্তু শিউলি বেঁকে বসলেন। অনেক অনুনয় বিনয়ের পর রাজি হলেন বটে তবে যাবার আগে নন্দিনী আর পঞ্চাননকে একগুচ্ছ উপদেশ দিতে দিতে গেলেন।

পঞ্চানন বার বার বলতে লাগলেন— কোনো ভয় নেই তোমার। কোনো চিন্তা কোরো না। আমরা সব ঠিক ম্যানেজ করে নেব।

.

বাগানের গেট খোলার ঘড়ঘড় শব্দে নন্দিনীর ঘুম ভেঙে গেল। মা এসেছে ভেবে বিছানা ছেড়ে উঠে জানলা ফাঁক করে বাইরে তাকিয়েই চট করে জানলাটা বন্ধ করে দিল। দৌড়ে গিয়ে বাবাকে ঠেলতে ঠেলতে বলল— বাবা, বাবা, কতগুলো মোটকামতন লোক হাতে কী সব নিয়ে আমাদের বাড়িতে ঢুকছে। ওরা ডাকাত নয় তো, বাবা?

পঞ্চানন ঘুম জড়িত গলায় বললেন— ডাকাতই তো। তুই শুয়ে পড়। ও নিয়ে ভাবিস না।

—আমি ডাকাত দেখব, বাবা।

পঞ্চানন হাই তুলে আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে বললেন— ডাকাত দেখবি? ঠিক আছে, চল। আমিও দেখি।

বলে মেয়েকে নিয়ে পঞ্চানন আবার জানলার কাছে গিয়ে সেটা অল্প একটু ফাঁক করে বাইরে তাকালেন। দেখা গেল, পাঁচটি মুস্কো লোক হাতে তরোয়াল আর দেশি পিস্তল নিয়ে বাগানে ঢুকছে। একজন ফিস ফিস করে বলল— সাবধান, বাড়িতে লোক আছে। গলার আওয়াজ পেয়েছি।

নন্দিনী বলল— এবার ওরা কী করবে, বাবা?

পঞ্চানন আবার হাই তুলে বললেন— দ্যাখ-না কী করে!

লোকগুলো তখন গুঁড়িমেরে সাবধানে বাড়ির দিকে এগোচ্ছিল। হঠাৎ, মনে হল যেন ছাদের ওপর থেকে একটা ঘন কুয়াশার স্তূপ পাক খেতে খেতে বাগানের ওপরে নেমে এল আর লোকগুলো তার ভেতরে ঢাকা পড়ে গেল।

নন্দিনী বলল— ওই যাঃ, সবাই চাপা পড়ে গেল যে, বাবা। কিচ্ছু যে দেখতে পাচ্ছি না।

পঞ্চানন বললেন— তবে আর কী? চল শুয়ে পড়ি। ঠান্ডা লাগছে।

—আর একটু দেখি, বাবা?

পঞ্চানন একটা মোড়া টেনে এনে মেয়েকে কোলে নিয়ে বসে বললেন— ঠিক আছে। তাহলে আমিও দেখি।

দেখবার আর কী আছে? জানলার বাইরে তখন একটা ম্যাড়মেড়ে সাদা কুয়াশার স্তূপ। তার ভেতরে বাইরে কিছুই দেখা যাচ্ছে না।

হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই, সেই স্তূপের ভেতরে ধুম-ধাম, ধপাস-ধপাস করে শব্দ হতে আরম্ভ করল। আর, প্রায় তার সঙ্গে-সঙ্গেই নানারকম গলায় চ্যাঁচামেচি শুরু হল, এ্যাই, কে আমাকে মারলি রে? উফ, আমাকে মারছিস কেন? এটা তো আমি রে। কে আমাকে খোঁচা মারছিস? লাগছে যে! ভ্যাঁ ভ্যাঁ, বাবারে, মেরে ফেললে রে। ওফ, এত জোরে মারলি কেন? আবার মারলি? গেলুম রে, মলুম রে!

নন্দিনী বলল— কে কাকে মারছে, বাবা?

পঞ্চানন বললেন— আমি কী করে জানব? দেখতে পাচ্ছি নাকি কিচ্ছু? বোধ হয় নিজেরাই মারামারি করছে।

শব্দ আর চ্যাঁচামেচি যেমন হঠাৎ শুরু হয়েছিল, তেমনি হঠাৎই বন্ধ হয়ে গেল।

নন্দিনী জিজ্ঞাসা করল— কী হল, বাবা? সব চুপ হয়ে গেল কেন?

পঞ্চানন বললেন— কী জানি, সবাই চলে টলে গেল, মনে হচ্ছে। চ, আমরাও শুয়ে পড়ি।

নন্দিনী আরও কিছুক্ষণ কুয়াশার ভেতরে কিছু দেখা যায় কি না সেই আশায় বসে রইল। তারপর হাল ছেড়ে দিয়ে বিষণ্ণমুখে বাবার পাশে কম্বলের তলায় গিয়ে ঢুকল।

.

সদর দরজায় প্রবল ধাক্কা দেবার শব্দে নন্দিনী আর তার বাবার ঘুম ভাঙল। পঞ্চানন লাফ দিয়ে খাট থেকে নেমে দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দেখলেন বাইরে শিউলি দাঁড়িয়ে রয়েছেন। তাঁর চোখে-মুখে আতঙ্ক।

পঞ্চানন বললেন— কী ব্যাপার? দরজা ভেঙে ফেলবে নাকি?

শিউলি কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন— কী ব্যাপার, মানে? তুমি কিছু জানো না? বারান্দায় বেরিয়ে এসো, তাহলেই জানতে পারবে।

মেয়ের হাত ধরে পঞ্চানন বারান্দায় এলেন। তখন সবে পুব আকাশে আলোর ছোঁয়া লেগেছে, একটা দুটো পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। শীতের সকালের সেই আবছা আলোয় দেখা গেল বাগানের নীচু পাঁচিলের ওপাশে যাত্রা থেকে ফেরা দর্শকদের ভিড়, তাদের সংখ্যা ক্রমশ বেড়েই যাচ্ছে, কিন্তু কারোর মুখে কোনো কথা নেই। সবাই স্তম্ভিত বিস্ফারিত চোখে বাগানের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। সেখানে ঘাসের ওপরে পাঁচজন লোক চিতপাত হয়ে পড়ে আছে। কেউ তাদের এমন মার মেরেছে যে তাদের আর ওঠবার বা নড়াচড়া করবার ক্ষমতা নেই। তাদের আশেপাশে ছড়িয়ে রয়েছে নানারকম অস্ত্রশস্ত্র।

একটু বাদেই থানার দারোগাবাবু সদলবলে এসে উপস্থিত হলেন। লোকগুলোর দিকে তাকিয়েই চমকে উঠে বললেন— একী, এরা তো দেখছি ডেঞ্জারাস ন্যাড়া ঘেন্টুর দল। কী সর্বনাশ, এরা এখানে কোত্থেকে এল? আর এদের এমন দশাই বা করলে কে?

নন্দিনী বলল— আমি জানি। ওরা আমাদের বাড়িতে এসেছিল ডাকাতি করতে। তারপরে নিজেদের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি করে এই অবস্থা হয়েছে। ভীষণ কুয়াশা ছিল তো, তাই কেউ দেখতে পায়নি।

দারোগাবাবু কথাটা বিশ্বাস করলেন বলে মনে হল না। একটা ধরাশায়ী ন্যাড়ামাথা লোকের মুখের ওপরে ঝুঁকে পড়ে বললেন— এ্যাই ঘেন্টু, তোদের এই দশা কে করল রে?

ঘেন্টু কাতরাতে কাতরাতে বলল— সেপাই, সেপাই।

দারোগাবাবু সোজা হয়ে উঠে বললেন— এই রে, মার খেয়ে লোকটার মাথা একেবারে খারাপ হয়ে গেছে, দেখছি। কাল তো থানার সব কটা সেপাই যাত্রা দেখতে গিয়েছিল। তাদের দায় পড়েছে এই ঠান্ডায় মাঝরাত্তিরে ডাকাত দলের সঙ্গে মারামারি করবার। সে যাহোক, ওরে রামবিলাস, সব কটাকে জিপে তোল দেখি। আগে তো হেলথ সেন্টারে নিয়ে যাই। তারপরে লকআপে ঢোকাব।

.

নন্দিনীর কাছে সবকথা শুনে শিউলি পঞ্চাননকে আড়ালে ডেকে বললেন— ওরা যে আসবে, সেটা তুমি জানতে, তাই না? কী করে জানলে? ঠাকুরদাদা বলেছেন, না?

পঞ্চানন চোখ পিটপিট করে বললেন— সে তো বলাই বাহুল্য। আর এইবার বুঝতে পারছি, ঠাকুরদাদা কেন আমাকে দশটা সেপাইপুতুল কিনে আনতে বলেছিলেন।

 হাসির উপহার

ওষুধের স্যাম্পেলের ব্যাগটা টেবিলের ওপর নামিয়ে রেখে শ্যামল বলল— তুমি অকারণে ভয় পাচ্ছিলে, প্রতিমা। দ্যাখো তো, রুমা কী আনন্দেই না রয়েছে। সন্ধে হয়ে গেল, এখনও কেমন খেলে যাচ্ছে, বাড়ি আসার নাম নেই। অথচ তুমি ভেবেছিলে এরকম একটা নির্জন ফাঁকা জায়গায় ও হাঁপিয়ে উঠবে। শুনতে পাচ্ছ ওর হাসির শব্দ? আসতে চাইছিলে না। না-এলে এমন মুক্ত প্রকৃতির মধ্যে মেয়েটা এরকম খেলবার সুযোগই হয়তো কোনোদিন পেত না।

প্রতিমা কিন্তু গম্ভীর হয়ে রইল। কোনো কথা না-বলে চায়ের কাপটা এগিয়ে দিল। চা খেতে খেতে শ্যামল প্রশ্ন করল— কী হল তোমার? এমন ব্যাজার হয়ে আছো কেন? মনে হচ্ছে যেন তুমি নিজেই হাঁপিয়ে উঠেছ। আর তো মোটে তিনটে দিন। এর মধ্যে আমি এই অঞ্চলের সব কটা ডাক্তার আর হাসপাতাল ঘুরে নেব। মাঝে একদিন যাব উশ্রী ফলস দেখতে। সেখানে পিকনিক করব। ব্যস, তারপর কলকাতা।

প্রতিমা বলল— আমি হাঁপিয়ে উঠিনি। আমার কেমন যেন ভয় করছে।

—ভয় করছে? সে কী, কেন? এই গণেশমুণ্ডায় না-আছে কোনো বাঘ-ভালুক, না-আছে চোর-ডাকাত। তোমার কীসের ভয়?

—আচ্ছা, শহরের ভেতরে স্টেশনের কাছে কোনো বাড়ি পেলে না?

মাথা নেড়ে শ্যামল বলল— নাঃ, পেলুম না। ওই প্রাণজীবন লজে হয়তো ঘর পাওয়া যেত। আমি একা এলে হয়তো ওখানেই থাকতুম। কিন্তু তোমাদের নিয়ে তো ওই নোংরা জায়গায় থাকতে পারি না। এই বাড়িটা কেমন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, চারদিক ফাঁকা। অথচ শহর তো বেশি দূরে নয়। আমি তো ভেবেছিলুম এখানে থাকতেই তোমাদের বেশি ভালো লাগবে।

—ভালো হয়তো লাগত, কিন্তু…

—কিন্তু কী? কীসের ভয় পাচ্ছ বলো তো? একা থাকতে?

—ভয় আমাকে নিয়ে পাচ্ছি না, পাচ্ছি রুমাকে নিয়ে।

—রুমাকে নিয়ে ভয়? কেন, কী করেছে সে?

—তুমি তো দেখো না। আমি সারাদিন ওকে খেলতে দেখি। সবসময় আমার মনে হয় যেন ওর সঙ্গে আর একজন কেউ আছে। ও তার সঙ্গে কথা বলে, হাসিঠাট্টা করে। এমনকী ঝগড়াঝাঁটি পর্যন্ত করে। অথচ কাউকে দেখতে পাই না। জিগ্যেস করলে বলে, ওর একজন বন্ধু আছে। সে নাকি খুব সুন্দর দেখতে। তার খুব লম্বা চুল আর সুন্দর সুন্দর জামা পরে। আমি জানি ও খুব কল্পনাপ্রবণ। বাগবাজারেও ও যখন একা-একা খেলে, একটা পুতুল বা নিদেনপক্ষে একটা পাউডারের কৌটোর সঙ্গেও অনর্গল কথা বলে যায়, যেন সেটা একটা জ্যান্ত মানুষ। সে জন্য প্রথম প্রথম আমি ভয় পাইনি। কিন্তু, লক্ষ করছি,এখানকার ব্যাপারটা সেরকম নয়।

—কীরকম ব্যাপার?

—কীরকম জানো? হালে দেখছি, ওর কাল্পনিক বন্ধুর কাছে শুনে এসে ও যেসব কথা বলছে, সেসব কথা ওর জানার কথা নয়। পরশুদিন তোমার ফিরতে দেরি হচ্ছিল বলে চিন্তা করছিলুম। রুমা এসে আমাকে বলল, চিন্তা কোরো না, বাবার সাইকেলরিকশার চাকা পাংচার হয়ে গেছে, তাই ফিরতে দেরি হচ্ছে। কথাটা নাকি ওকে ওর বন্ধু বলেছে এবং কথাটা দেখলুম সত্যি। আর আজ সকালে হঠাৎ দৌড়ে এসে বলল, চৌবাচ্চার জলে একটা বিছে পড়েছে, সাবধানে গায়ে জল ঢেলো। এও দেখলুম সত্যি এবং এটাও ওকে বলেছে ওর এই বন্ধু।

প্রতিমার কথা শুনে একটু চিন্তিত হয়ে পড়ল শ্যামল। বলল— একটি পাঁচ বছরের কল্পনাপ্রবণ আর সংবেদনশীল বাচ্চার পক্ষে এই ধরনের কথা বলা বোধ হয় খুব একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। টেলিপ্যাথি জানো? এটা বোধ হয় সেই ব্যাপার। যারা খুব সেনসিটিভ, তাদের মধ্যে এই ক্ষমতাটা থাকে। স্বাভাবিকভাবেই থাকে। আমাদের দেশে মুনিঋষিদের আছে। তাঁদের বলে ভবিষ্যৎদ্রষ্টা। বিদেশে তো এ নিয়ে রীতিমতো গবেষণা চলেছে।

প্রতিমা বলল— টেলিপ্যাথি হলে তো ভালোই। তবে কলকাতায় তো ওর এই ক্ষমতা কখনো দেখিনি। এখানে এসে সেটা চাগিয়ে উঠল কেন, কে জানে। আমার ভালো লাগছে না। টেলিপ্যাথিই হোক আর যে প্যাথিই হোক, এতে কোনো বিপদ-আপদ না হলেই হল। চল, আমরা কালই কলকাতায় ফিরে যাই।

মাথা নেড়ে শ্যামল বলল— তুমি মিথ্যে ভয় পাচ্ছ। দেখি আজ আমি ওর সঙ্গে কথা বলে সমস্যাটা বোঝবার চেষ্টা করি।

যাওয়ার সময় কথাটা পাড়ল শ্যামল। রুমাকে জিগ্যেস করল— তোমার কেমন লাগছে এখানে?

মাথা নেড়ে রুমা বলল— খুব ভালো বাবা।

—বন্ধু হয়েছে?

—হ্যাঁ। আমি রোজ তার সঙ্গে খেলি।

—কী নাম তোমার বন্ধুর?

রুমা একগাল হেসে বলল— ওর নাম হাসি। ও না সবসময় হাসে। রাগ করলেও হাসে। খেলতে খেলতে মাঝে মাঝে চিটিং করে আমাকে খেপায়।

—কোথায় থাকে তোমার বন্ধু?

—তা তো জানি না। এখানেই কোথাও হবে। আমি যখনই খেলতে যাই, দেখি ও দাঁড়িয়ে আছে।

—ও যে তোমার সঙ্গে সারাদিন খেলে বেড়ায় তাতে ওর বাবা-মা রাগ করেন না?

—নাঃ। ওর বাবা-মা এখানে তো নেই। হাসি বলছিল, ওর বাবা-মা ওকে এখানে রেখে কলকাতায় চলে গেছে। ওর কী একটা অসুখ করেছিল। তারপরে ওর বাবা-মা ওকে রেখে চলে গেল।

—তুমি ওকে বাড়িতে ডেকে আনো না কেন? আমরা তো ওর সঙ্গে গল্প করতে পারি।

—তা হবে না। হাসি বলেছে, তোমরা ওকে দেখতে পাবে না।

কম্পিতকণ্ঠে শ্যামল বলল, কেন? আমরা দেখতে পাব না কেন?

—হাসি বলেছে, আমি তো ওর বন্ধু, তাই শুধু আমি ওকে দেখতে পাব। তোমরা পাবেই না। বলে রুমা হাসতে লাগল। তারপর হঠাৎ হাসি থামিয়ে বলল— জানো তো বাবা, হাসি না আমাকে একটা প্রেজেন্ট দেবে বলেছে। খুব সুন্দর প্রেজেন্ট। আর, খুব দামি।

—তাই নাকি? কী প্রেজেন্ট দেবে?

—তা জানি না। তবে খুব সুন্দর বলেছে। বলেছে, মাটির নীচে আছে। ওর মা যাওয়ার আগে রেখে গেছিল। মাটি কেটে বের করে আনতে হবে। আমরা যেদিন যাব, তার আগের দিন ও দেখিয়ে দেবে কোথায় মাটি কাটতে হবে।

.

রুমা ঘুমিয়ে পড়ার পর শ্যামল আর প্রতিমা বসবার ঘরে এসে বসল। প্রতিমা উদবিগ্ন গলায় জিগ্যেস করল— কিছু বুঝলে?

শ্যামল গম্ভীর মুখে, চিন্তিতভাবে বলল— আমি তোমার সঙ্গে একমত যে, ব্যাপারটা ঠিক সুবিধের নয়। এই ঘটনাটা বোধ হয় টেলিপ্যাথির পর্যায়ে পড়ে না। এখানে কিছু একটা আছে, বুদ্ধিতে যার ব্যাখ্যা চলে না। তবে, ভরসার কথা এই যে, যা কিছুই থাক, সেটা অনিষ্টকর নয়। যদি তা হত তা হলে তোমাকে স্নানের আগে সাবধান করে দিত না।

—তা হোক, তবু আর থেকে কাজ নেই। চলো, আমরা কালই সকালের গাড়িতে কলকাতায় ফিরে যাই।

শ্যামল মাথা নাড়ল। বলল— না কাল নয়। পরশুই চলে যাব। কাল একটা কাজ করতে হবে।

—আবার কীসের কাজ? থাক-না এখন! পরে একবার এসো না-হয়। দু-দিন দেরি হলে তোমার ওষুধ কোম্পানি উঠে যাবে না।

—আমি অফিসের কাজের কথা বলছি না। বলে শ্যামল কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপরে বলল— আমি ভাবছি প্রেজেন্টটা কী হতে পারে।

প্রতিমা যেন স্বগতোক্তি করছে এইভাবে বলল— আমিও ঠিক সেই কথা ভাবছিলুম। বলেছে, খুব সুন্দর আর খুব দামি। কী জানি কী জিনিস। নাঃ, এসবে লোভ করতে নেই। চলো, কালই চলে যাই।

শ্যামল একথার কোনো জবাব দিল না। বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল— যখ কাকে বলে জানো?

প্রতিমা কম্পিতকণ্ঠে বলল— জানি। মাটির তলায় মণিমুক্তো পুঁতে তার সঙ্গে একটা বাচ্চাকেও চাপা দিয়ে দিত আগেকার দিনে। সেই বাচ্চাটা নাকি যখ হয়ে সেই গুপ্তধন সামলাত। যে এই গুপ্তধনের দিকে হাত বাড়াত, সেই যখ তার ঘাড় মটকাত। ওরে বাবা! তুমি আর এসব কথা ভেব না তো। চলো, আমরা কালই চলে যাই।

শ্যামল হাত নেড়ে বলল— ধ্যাত্তেরি। তখন থেকে শুধু কাল চলে যাই, কাল চলে যাই করছে। সব ব্যাপারে অত ভয় পেলে চলে? আর ঘাড় মটকানোর তো কোনো প্রশ্নই ওঠে না। আমরা তো আর চুরি করছি না। ওই হাসি না কে, সে তো নিজের থেকে দেবে বলেছে। প্রেজেন্ট! প্রেজেন্ট দিয়ে কেউ ঘাড় মটকায়?

—হ্যাঁ, তাও তো বটে। আচ্ছা, প্রেজেন্টটা কী হতে পারে গো? আমার তো মনে হয় জড়োয়ার হার হবে। লাখখানেক টাকা দাম তো নিশ্চয়ই হবে। হবে না? আমি কিন্তু হারটা বেচে দেব। ওসব যখের ধন-টন বাড়িতে রেখে কাজ নেই বাবা!

—একটা হার হতে পারে, একাধিকও হতে পারে। আগে বের তো করি। এখন আমাদের কী করণীয় সেটা তোমাকে বলছি, শোনো, তুমি রুমাকে বলে দাও যে, পরশু সকালে আমরা কলকাতায় ফিরে যাচ্ছি। দুখিয়া বলে যে কাজের লোকটি আছে, তার পাওনাগণ্ডা মিটিয়ে দিয়ে আজ দুপুরের মধ্যে বিদেয় করে দাও। রুমাকে বলো যে প্রেজেন্টটা কোথায় আছে সেটা আজ বিকেলের মধ্যে জেনে নিতে। আমরা সন্ধে বেলা মাটি কাটা শুরু করব।

—তুমি নিজে মাটি কাটবে? পারবে? কোদাল চালানো বড়ো সহজ ব্যাপার নয়।

—জানি সহজ ব্যাপার নয়। কিন্তু পারতেই হবে। এসব ব্যাপারে অন্য কারুর সাহায্য নেবার কোনো প্রশ্নই ওঠে না।

—তা বটে। আচ্ছা, সন্ধে বেলা মাটি না-কেটে দুপুরে কাটলে হয় না? সন্ধে বেলা যদি সাপখোপ বেরোয়?

—দূর! এই শীতকালে সাপ কোত্থেকে বেরুবে? বিছে-টিছে বেরোতে পারে। তবে, আমি জুতো-মোজা আর ফুলপ্যান্ট পরে মাটি কাটব। তা হলে আর কোনো ভয় থাকবে না। তুমি শুধু নজর রাখবে, কেউ যেন এসে না পড়ে। ওই প্রান্তিক বাড়িটার প্রফেসর নন্দদুলাল ঘোষ আর সন্ধ্যার কুলায় বাড়িটার যদুনাথ মিত্তিরকেই আমার ভয়।

—যা বলেছ। দুই বুড়োর কাজকর্ম কিছু নেই। দিনরাত সামনের রাস্তা দিয়ে হাঁটছে আর মাঝে মাঝে গলা বাড়িয়ে, বউমা, ভালো আছ তো? বলে হাঁক দিয়ে যাচ্ছে।

—ওরা যদি আসে, কিছুতেই গেটের ভেতরে ঢুকতে দেবে না। আমার কথা জিগ্যেস করলে বলবে যে, আমার স্বামীকে বাগানে পেয়েছে, তাই মাটি কোপাচ্ছে। আর অন্য কথা বলে আটকে রাখবে।

—তা না-হয় রাখব। কিন্তু রুমা কী করবে? সন্ধে বেলা তো আর তাকে ঘুম পাড়াতে পারব না।

—ঘুম পাড়াতে যাবে কেন? রুমা তো আমার সঙ্গেই থাকবে। ভালো করে গরম জামাকাপড় আর জুতো-মোজা পরিয়ে দিও। ও-ই তো আমাদের গ্যারান্টি যে, আমরা ওর জন্যেই গুপ্তধন খুঁজছি। আমরা যে কোনো উটকো লোক নই, ওর উপস্থিতি তো সেটাই প্রমাণ করবে।

—আমার কেমন ভয় করছে। রুমার কোনো বিপদ-আপদ হবে না তো?

—না, না, কী বিপদ হবে? আমি তো সঙ্গে আছি। তা ছাড়া, এসব ব্যাপারে একটু ঝুঁকি তো নিতেই হয়। ভাগ্য তো আর এমনি-এমনি খোলে না। কিছু ভয় নেই তোমার।

.

সারারাত ঘুমোল না দু-জনে। পরদিন সকাল হতে না-হতেই ব্রেকফাস্টের জন্য তাড়া লাগাল শ্যামল। বলল— তাড়াতাড়ি করো। আমাকে যে বেরুতে হবে।

প্রতিমা বলল— এত সকালে বেরুবে? ডাক্তারবাবুদের তো ঘুমই ভাঙবে না এখন।

—দুত্তোর ডাক্তার! ডাক্তার-ফাক্তার নয়, আমি যাব মাটি কাটার যন্ত্রপাতি কিনতে।

.

চট দিয়ে মোড়া যন্ত্রপাতি নিয়ে শ্যামল সাইকেলরিকশা চড়ে ফিরল দশটা নাগাদ। ফিরেই গেটে একটা মস্ত তালা লাগাল। তারপর চলল উদগ্রীব প্রতীক্ষা। বিকেল বেলা রুমার কাছে খবর পেল যে, বাড়ির পিছনে একটা বটগাছের নীচে হাসির উপহার লুকোনো আছে।

সূর্যাস্তের একটু আগে, শ্যামল সপরিবারে বটগাছটার নীচে গিয়ে দাঁড়াল। উত্তেজনায় কম্পিত হাতে শাবল বাগিয়ে ধরে রুমাকে প্রশ্ন করল— কোথায় খুঁড়তে শুরু করি বল তো?

—বলছি বাবা। বলে রুমা একদৌড়ে বাড়ির সামনের দিকে চলে গেল। একটু বাদে ফিরে এসে একটা ঢিবির ওপর বসে একটা আঙুল তুলে বলল— ওইখানে বাবা। ওই জায়গাটায় খোঁড়ো। তা হলেই পাবো।

শ্যামল একটা লম্বা নিঃশ্বাস টেনে শাবল দিয়ে মাটি খুঁড়তে শুরু করল।

সূর্যাস্তের শেষ আলোটুকু ম্লান হতে হতে অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়ার একটু আগে ফুট দেড়েক গর্তের তলায় একটা শক্ত বিন্দুতে শাবলটা ঠেকল। আবছা আলোয় মনে হল সেটা একটা কাঠের বাক্স, লম্বা-চওড়ায় একটা জুতোর বাক্সের সমান হবে।

ঢিবির ওপর থেকে রুমা চেঁচিয়ে উঠল— ওই বাক্সটা বাবা! ওটা বের করো।

শ্যামল ধমকে উঠল, চুপ কর। চেঁচাসনি। বলে শাবলটা ফেলে দিয়ে পাগলের মতো কোদাল দিয়ে মাটি সরাতে লাগল। একটু বাদে গর্তের ভেতরে হাত ঢুকিয়ে একটা কাঠের বাক্স উঠিয়ে নিয়ে এল। তারপর কোনোদিকে না তাকিয়ে বাক্সটা বগলদাবা করে হনহন করে হাঁটা লাগাল বাড়ির দিকে। তার পিছনে পিছনে দৌড়ল প্রতিমা।

রুমা ঢিবির ওপর থেকে লাফিয়ে নেমে বাবা-মার পিছনে পিছনে দৌড়তে দৌড়তে বলতে লাগল— ও বাবা! ওটা কিন্তু আমার, ওমা, তুমি নেবে না কিন্তু! ওমা! ওটা কিন্তু আমার।

শ্যামল পিছন ফিরে রক্তচক্ষু করে চেঁচিয়ে উঠল— চোপ! তোকে না চেঁচাতে বারণ করলুম। একটি শব্দ করবি না। চ্যাঁচালে ভীষণ মার খাবি।

রুমা তার বাবার এই রুদ্রমূর্তি দেখে স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর নিঃশব্দে কাঁদতে কাঁদতে ফিরে গিয়ে ঢিবিটার ওপর বসে পড়ল।

রান্নাঘরে গিয়ে একটা কাটারি বের করে চাড় দিয়ে বাক্সটা খুলে ফেলল শ্যামল। ভেতর থেকে বেরুল একটা বিবর্ণ খবরের কাগজের মোড়ক আর তার ভেতরে একটা অপূর্ব সুন্দর বিলিতি পুতুল। তার চুলগুলো সোনালি, নীল চোখ, টুকটুকে লাল ঠোঁট, গোলাপি গালে টোল পড়া আর মুখটি হাসি-হাসি।

বিতৃষ্ণ দৃষ্টিতে পুতুলটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ হেসে উঠল শ্যামল। বলল— কী আশ্চর্য! আমার খেয়ালই ছিল না যে হাসি একটা বাচ্চা মেয়ে। আমারই ভুল… হি হি হি… আমারই ভুল। কতদিন এখানে সে একা রয়েছে, কে জানে। তার নতুন বন্ধুকে সে এর চেয়ে দামি উপহার আর কী-ই বা দিতে পারে? এটা নিশ্চয়ই তার সবচেয়ে প্রিয় পুতুল ছিল। ডাকো প্রতিমা, তোমার মেয়েকে ডাকো। তাকে প্রেজেন্টটা দেবে না?

কোথায় মেয়ে? সারা বাড়িতে কোথাও রুমাকে পাওয়া গেল না। পাগলের মতো দু-জনে ছুটে বাগানে বেরিয়ে এল। তারার আলোয় দেখা গেল একটা ঢিবির ওপরে পাথরের মূর্তির মতো বসে রয়েছে ছোটো মানুষটি। দু-হাঁটুর মধ্যে মুখ গুঁজে কান্না চাপার প্রবল চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

শ্যামল দৌড়ে এসে মেয়ের পাশে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। বলল— এ কী রুমা এখানে বসে রয়েছ কেন? তোমার প্রেজেন্টটা বের করেছি। নেবে না সেটা? ভীষণ সুন্দর প্রেজেন্ট।

প্রবলবেগে মাথা নেড়ে রুমা বলল— না, নেব না। আমার চাই না প্রেজেন্ট।

—কেন? নেবে না কেন? আমি যে এত কষ্ট করে তোমার জন্যে মাটি খুঁড়ে বের করলুম।

—না, আমার চাই না। তুমি আমাকে বকেছ কেন? কী করেছি আমি?

শ্যামল দু-হাতে মেয়েকে কোলে তুলে উঠে দাঁড়াল। বলল— তুই কিচ্ছু করিসনি রে, মা! আর বিশ্বাস কর, আমিও তোকে বকিনি।

—হাঁ, বকেছ! বলেছ, মারবে আমাকে।

—সে কথা আমি বলিনি রে। আমার বুকের ভেতরে কতকগুলো ভূতপ্রেত দত্যিদানব ঢুকে পড়েছিল। ওসব কথা তারা বলেছে, বিশ্বাস কর।

কথাটা রুমা খুব যে বিশ্বাস করল তা মনে হল না, কিন্তু তার কান্নার বেগটা কমে এল। বলল— কী করে ঢুকল ওগুলো?

শ্যামল বাড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে বলল— আমার নাক-চোখ-মুখ দিয়ে।

—সেগুলো এখনও আছে?

—নাঃ! একেবারে ঘাড় ধরে তাড়িয়ে দিয়েছি। তবে অনেকগুলো ঢুকেছিল তো। দু-একটা হয়তো এদিক-ওদিক লুকিয়ে রয়েছে। তবে, সেগুলোকে ঠিক শায়েস্তা করব, দেখে নিস।

চোখের জল মুছে হেসে উঠল রুমা। নিশ্চিত নির্ভরতায় দু-হাতে বাবার গলা জড়িয়ে ধরে বলল— তাহলে আর আমাকে বকবে না তো, বাবা?

এবার শ্যামলের চোখে জল আসার পালা। বলল— কখনো না। কোনোদিনও না। তারপর প্রতিমাকে বলল— চট করে তৈরি হয়ে নাও। রাত কিছুই হয়নি। চলো মি. মিত্র আর প্রফেসর ঘোষের সঙ্গে দেখা করে আসি। কাল চলে যাচ্ছি তো।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন