৩.৪ রাত্রে আহারের কি হবে

প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

রাত্রে আহারের কি হবে! এই দুর্যোগে ঘর থেকে বেরুনো অসম্ভব। সকালবেলা যা পেটে পড়েছিল গাঁজার ধোঁয়ায় কখন তা উবে গিয়েছে। ক্ষিধের চোটে পেট চোঁ-চোঁ করতে লাগল। রামসিং সেই-যে আমাদের সঙ্গে টেনে বিছানা নিয়েছিল, সে তখনও পড়ে আছে। সূরয তাদের সেই প্রদীপ জ্বালিয়ে তারই ক্ষীণ আলোয় এদিক-ওদিক কাজ করে বেড়াতে লাগল। সে ছাগলগুলোকে বাচ্চা ও ধাড়ী হিসাবে স্থানে স্থানে বেঁধে তাদের সামনে চাট্টি করে শুকনো ঘাস ছড়িয়ে দিলে। কুকুরগুলো ইতিমধ্যে কোথায় চরতে গিয়েছিল, তারা একটা একটা করে পরদা ঠেলে ঘরে এসে জমতে লাগল। আমরা সূরযকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলুম, তোমরা রাত্রে কি খাও?

সূরয বললে, রাত্রে খাবার আমাদের কিছুই ঠিক নেই, আজ আর কিছুই খাব না। নেহাত ক্ষিধে পেলে আটা মেখে গুড় দিয়ে খেয়ে নেব। আমার ঘরে আটা গুড় আছে, মেখে দেব, খাবে?

–না বাবা! কাঁচা আটা আমরা হজম করতে পারব না। কালই ওর নাম কি হয়ে যাবে! জিজ্ঞাসা করলুম, এ-বেলায় তো দুধ বিক্রি হয়নি, দুধ আছে না?

সূরয বললে, হাঁ হাঁ, দুধ আছে।

বললুম, আমাদের এক-একজনকে আধ সের করে গরম দুধ দিতে পারবে না?

সূরয খুশি হয়ে বললে, হাঁ হাঁ খুব পারব–কেন পারব না? আধ সেরের দাম চারপয়সা তিনজনের দেড় সের, তা হলে তিন আনা দাও।

আমরা তখুনি সূরযকে তিন আনা পয়সা দিলুম। সে আলাদা একটা ছোট মাটির কেঁড়ে-গোছের পাত্রে দেড় সের দুধ ঢেলে একটা আঙ্গেঠি জ্বেলে তার ওপরে কেঁড়েটি বসিয়ে দিলে।

দুধ জ্বাল হতে লাগল।

সেই ফাঁকে জনার্দন কাগজের মোড়কটা ট্যাক থেকে বের করে বললে, তা হলে আর এক ছিলিমের বন্দোবস্ত করা যাক।

সূরযকে ডেকে অনেকখানি গঞ্জিকা তার হাতে দিয়ে জনার্দন বললে, তৈরি কর। সূরয বললে, সবটা এখনই সেজে কি হবে? এত বড় রাত. এখনও সামনে পড়ে রয়েছে–আজ রাত্রে দেবতার কি মর্জি আছে কে জানে!

কেন বলো দিকিনি?

সূরয বললে, আজ রাতে খুব ঝড় হবে বলে মনে হচ্ছে। এরকম ঝড় আর একবার হয়েছিল, তাতেই তো পাশের ঘরখানা ও এই ঘরের ওই কোণের দিকটা পড়ে গেল। এবার ঘরখানা সবটা না পড়লেই বাঁচি।

বলো কি! তা হলে তো আর কিছু বাড়াবাড়ি হবার আগেই ইস্টিশানের দিকে পাড়ি জমাতে হয়।

সূরয অভয় দিয়ে বললে, কিছু করতে হবে না, দেবতা আছেন, সব ঠিক করে দেবেন।

তার পরে চারদিকে চেয়ে পরম ঔদাস্যভরে বললে, পড়েই যদি যায় এবার তবে ওই কোণটা পড়ে যাবে, তাতে আমাদের কিছু হবার ভয় নেই।

সত্যি কথা বলতে কি, সূরযের অভয়-বাণীতে ভরসা কিছু পেলুম না। ঘরের খানিকটা পড়ে যাবে, বাকি খানিকটায় আমরা থাকব, সেই ব্যাপারের পরেও আমাদের থাকা সম্বন্ধে একেবারে নিশ্চিন্ত হতে পারছিলুম না।

রামসিং তখনও মাথা-মুড়ি দিয়ে ঘুমুচ্ছিল। ইতিমধ্যে গাঁজা তৈরি করে সূরয তাকে ডেকে তুললে। তারপরে গোল হয়ে বসে আবার আমরা মেঘলোক সৃষ্টি করলুম। বেশ নেশা হল, আনন্দও কিছু কম হল না; কিন্তু ওই ঘর চাপা-পড়ার আশঙ্কায় থেকে থেকে মনটা বিগড়ে যেতে লাগল। দু-একবার রামসিংহকে এ-বিষয়ে জিজ্ঞাসা করায় সে বললে, হাঁ, দেওতার যা মর্জি আছে তাই হবে।

ছাত চাপা পড়বার আশঙ্কা নেই–এমন কথা রামসিং বললে না। কত বড় দার্শনিক হলে তবে আসন্ন বিপদে আত্মরক্ষার কোনো চেষ্টা না করে তাকে পরাশক্তির লীলা বলে গ্রহণ করা যায় তা বিপদের সম্মুখীন না হলে বোঝা যায় না।

রামসিং এবার আর না শুয়ে আমাদের সঙ্গে গল্প করতে লাগল। সূরযের মুখে ঘর-পড়ার কথা শুনে আমরা ভয় পেয়েছি বুঝতে পেরে দু-একটা অভয়বাক্যও শোনালে। ইতিমধ্যে সূরয একটা ছোট লোহার কড়াইতে করে তিনবারে আমাদের তিনজনকে দুধ খাইয়ে বাকি দুধটুকু তারা স্বামী-স্ত্রী খেয়ে ফেললে।

গাঁজার ওপরে গরম খাঁটি দুধ পড়ায় ঘর-চাপা পড়ার আশঙ্কা কিছু দূর হল বটে, কিন্তু ঝড় ক্রমেই যেন বাড়াবাড়ি করতে শুরু করে দিলে। ঝড়ের বাতাস কিরকম ঘুরপাক খেতে খেতে দেওয়ালের সেইসব বিরাট গর্ত দিয়ে ঢোকবার চেষ্টা করতে লাগল, আর সেইসঙ্গে কামান-গর্জনের মতন একটা নিরবচ্ছিন্ন আওয়াজ হতে লাগল–বুম্-বুম্-বুম্। পিছনের সেই জঙ্গল, যাকে কয়েক ঘণ্টা আগেও শান্ত শ্রীমণ্ডিত ঘুমন্ত রূপসির মতন মনে হচ্ছিল, ঝড়ের পরশ পেয়ে সে যেন সর্বনাশিনী মূর্তি ধরে জেগে উঠল। থেকে থেকে বিদ্যুতের চমকানিতে তার রূপ এক-একবার আমাদের চোখে প্রতিভাত হচ্ছিল–মনে হতে লাগল, গাছগুলো যেন অসংখ্য বাহু মেলে আকাশ স্পর্শ করতে উদ্যত হচ্ছে কিন্তু তখুনি আবার কে তাদের ঝুঁটি ধরে মাটির দিকে নামিয়ে দিচ্ছে। কখনও বা মনে হয়, সূরয-বর্ণিত সেই কালনাগিনীর দল শোঁ-শোঁ শব্দে আকাশে ছুটোছুটি করতে করতে সহস্র শাখায় তাদের অগ্নিজিহ্বা বিস্তার করছে আর সঙ্গে সঙ্গে আওয়াজ হচ্ছে-কড়কড়-কড়াৎ। সঙ্গে সঙ্গে সেই নিরবচ্ছিন্ন আওয়াজ চলছে–বুম্‌-বুম্-বুম্। আমি কলকাতাবাসী জীব, প্রকৃতির আত্মঘাতিনী সেই স্বৈরিণী মূর্তি দেখা তো দূরের কথা এক-শো মাইল বেগে বাতাস বইলে আমার জানলায় ফুর-ফুর করে দক্ষিণার আমেজ দেয়; কিন্তু জনার্দন ও সুকান্ত দুজনেই তারা পূর্ববঙ্গের ছেলে, ঝড়ের কোলেই তারা একরকম মানুষ হয়েছে–ব্যাপার দেখে তারাও বেশ ভড়কে গেল।

এদিকে আমাদের ঘরের প্রদীপটি একবার বাতাসের এক ঝটকায় নিবে গেল। ঘরের মধ্যে বাতাস এমন ছুটোছুটি করতে আরম্ভ করলে যে প্রদীপ জ্বালানো আর সম্ভব হল না। সেই অন্ধকারে বসে ঝড় সম্বন্ধে আরও কিছুক্ষণ আলোচনা করে রামসিং তো লম্বা হল। সূরয আমাদের আশ্বাস দিয়ে বললে, ‘কোনো ভয় নেই। ওপরে দেবতা রয়েছেন, তাঁকে স্মরণ করে শুয়ে পড়।

সূরয শোবার জোগাড় করতে লাগল। আমরা দেশলাই জ্বেলে জ্বেলে নিজেদের খাঁটিয়ার কাছে এসে গায়ের কাপড় আড়াল করে ধরে মোমবাতি জ্বালিয়ে নিয়ে বসলুম। আমাদের শোবার জায়গাটায় বাতাস তত জোর ছিল না, তবুও ক্ষীণ মোমবাতির পক্ষে বেশিক্ষণ তার বেগ সহ্য করা সম্ভব হল না। কি আর করি–নিরুপায় হয়ে সেই সন্ধ্যারাত্রেই শুয়ে পড়তে হল।

শুয়ে তো পড়লুম কিন্তু ঘুম কোথায়! সেই নিবিড় অন্ধকারের মধ্যে সহস্র নাগিনী ও সহস্র কামানের প্রতিযোগিতা চলেছে। এরই মধ্যে আবার নেশার ঘোরে কত রকমের চিন্তা মাথার মধ্যে জোট পাকাতে লাগল। মনে হতে লাগল, কবে অতীতের কোন্ এক বিস্মৃত দিনে রামসিংয়ের পূর্বপুরুষের কে এই প্রাসাদ প্রতিষ্ঠা করেছিল–আজকের এই দিন যে ভবিষ্যতের গর্ভে লুকিয়ে বসে ছিল, সে-কথা কি সে-ব্যক্তি ভাবতে পেরেছিল! কতরকম চিন্তা ভিড় করতে লাগল মগজে–কখনও বা নিজের মনেই হাসি, কখনও মনে হয় নেশাটা বড্ড চেপে ধরেছে। নিজের মনে ভাবতে ভাবতে বাইরের সেই প্রচণ্ড শব্দ ক্রমেই যেন ক্ষীণ হয়ে আসতে লাগল। ঝড়ের সেই ভীষণ শব্দগুলো যেন দূরে চলে যেতে লাগল–দূর–দূর–দূরতর, দূরতর, তারপর কখন করুণাময়ী নিদ্রা এসে সকল চিন্তা দূর করে দিলে।

কতক্ষণ ঘুমিয়েছিলুম জানি না, হঠাৎ বাহুতে একটা ধাক্কা পেয়ে ঘুমটা ভেঙে গেল। আমাদের খাট-তিনটে একেবারে গায়ে গায়েই পাতা ছিল। আমার পাশেই ছিল জনার্দনের খাট। তার ধাক্কা খেয়ে আমি ধড়মড় করে উঠে বসলুম। আমার সঙ্গে সঙ্গে সে-ও উঠে বসে আমাকে চেঁচিয়ে কি যেন বললে। কিন্তু তখন কার সাধ্য কিছু শুনতে পায়। বাইরে ক্রুদ্ধ প্রকৃতির হুঙ্কার চলেছে অবিচ্ছিন্ন ধারায়, তা ভেদ করে কোনো শব্দ কি আর কানে যায়! আমি চিৎকার করে জিজ্ঞাসা করতে লাগলুম, কি রে, কি বলছিস?

জনার্দনও চেঁচাতে লাগল।

মিনিটখানেক এইরকম চলবার পর জনার্দনের কণ্ঠস্বর কানে গেল। জনার্দন বললে, বাতিটা শিগির জ্বাল–আমায় বোধ হয় সাপে কামড়েছে।

কি সর্বনাশ!

জনার্দন চিৎকার করতে লাগল, ওরে বাবা রে! মরে গেলুম’ রে! বাবা গো, আর পারি না!

বাস্! বাইরে ঝড়ের সেই ভীষণ আওয়াজ আমার শ্রবণে ক্ষীণ হয়ে গেল। জনার্দনের আর্তনাদ সব শব্দ ছাপিয়ে উঠতে লাগল। তক্ষুনি সুকান্তকে ঠেলে তুলে বললুম, শিগগির ওঠ, জনার্দনকে সাপে কামড়েছে।

মোমবাতি জ্বালাবার চেষ্টা করতে লাগলুম, কিন্তু ঘরের মধ্যে তখন ঝড় চলছে, দেশলাই জ্বালাই আর নিবে যায়। শেষকালে একটা খাঁটিয়াকে পাশ ফিরিয়ে দাঁড় করিয়ে তার ওপর কাপড় দিয়ে একটা পর্দার মতন করে তার পাশে মোমবাতি জ্বালালুম।

জনার্দন বললে, ওঠবার জন্যে মাটিতে পা-রাখা-মাত্র কিসে কামড়ালে, নিশ্চয় সাপ–অসহ্য যন্ত্রণা রে বাবা, আর সহ্য করতে পারছি না!

জনার্দনের কথা শুনেই সুকান্ত তো ভেউ-ভেউ করে কেঁদে উঠল। কিন্তু এখন কাঁদলে চলবে না, একটা কিছু করা চাই। শুনেছিলুম যে, সাপে কামড়ালে দষ্ট স্থানের ওপরেই গোটাকয়েক বাঁধন দিতে হয়। কিন্তু দড়ি কোথায় পাই! ছুটে গিয়ে সূরযকে ধাক্কা দিয়ে তুললুম। সে হাঁউমাউ করে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে রামসিংও উঠে পড়ল। সব শুনে তারা ছুটে জনার্দনের কাছে এল। ডান পায়ের বুড়ো-আঙুলে কামড়েছে শুনেই রামসিং সেই আঙুলটা মুখে দিয়ে চুষতে আরম্ভ করে দিলে।

ওদিকে জনার্দন চিৎকার করতে লাগল, ও বাবা! আর যে পারি না! ও বড়দা ও মেজদা ও সোনাদা রাঙাদা, তোমরা কোথায় আছ, আমি যে মরি!

সূরযকে বললুম, পায়ে দড়ি বাঁধতে হবে, দড়ি দিতে পাব?

সে ছুটে গিয়ে ধাড়ি ছাগলগুলোর গলা থেকে সব দড়ি খুলে নিয়ে এল। আসবার সময় তাড়াতাড়িতে দু-চারটে কুকুরের পেটে পা দিতে তারা কেঁউ-কেঁউ করে চিৎকার শুরু করলে। ঘরের মধ্যে কুকুর ছাগল ও জনার্দন, আর বাইরে ঝড়ের আওয়াজ মিলে এক বীভৎস রসের সৃষ্টি হল।

আমি ও সূরয মিলে জনার্দনের পায়ের গাঁট থেকে আরম্ভ করে হাঁটু অবধি চার জায়গায় বাঁধলুম। ওদিকে রামসিং জনার্দনের পা চুষে চুষে বার-তিন-চার থুতু ফেলে বললে, সাপে কামড়ায়নি, মনে হচ্ছে বিচ্ছুতে কামড়েছে।

তারপরে সে আস্তে আস্তে বললে, সাপে কামড়ালেও মরে, বিচ্ছুতে কামড়ালেও মরে, তবে সাপে কামড়ালে এত যন্ত্রণা হয় না। এ বিচ্ছুতে কেটেছে বলেই মনে হচ্ছে।

রামসিংয়ের কথা শুনে জনার্দন আরও চেঁচাতে শুরু করে দিলে। সেইসঙ্গে তাল মিলিয়ে সুকান্তও শুরু করলে, ওরে বাবা! কি হবে রে!

ওদিকে জনার্দনের রজ্জুবদ্ধ পা-খানা দেখ দেখ করে ফুলে ঢোল হতে লাগল। সূরয তার পায়ের অবস্থা দেখে বললে, যখন বিচ্ছুতেই কেটেছে তখন বাঁধন দিয়ে ওর কষ্ট বাড়িয়ে লাভ কি, ওকে শান্তিতে মরতে দাও।

কিন্তু বাঁধন কাটি কি করে! দেখতে দেখতে জনার্দনের পা-খানা ফুলে এমন অবস্থা হল যে, বাঁধনের দুই পাশ ফুলে দড়িগুলো মাংস কেটে বসে যেতে লাগল। শেষকালে সূরয তার বিছানা তলা থেকে ইয়া-বড় চক্‌চকে এক খাঁড়ার মতন অস্ত্র টেনে বার করলে। সেই সাংঘাতিক জিনিস দিয়ে জনার্দন বেচারির পা-খানা ক্ষতবিক্ষত করে বাঁধন-চারটে কেটে ফেলা গেল।

বাঁধন খোলার পর বোধ হয় মৃত্যু অবধারিত বুঝতে পেরে জনার্দনের আক্ষেপ আরও বেড়ে গেল।

আমি ও সুকান্ত ঠিক করলুম, এইভাবে জনার্দনকে বিনা চিকিৎসায় মরতে দেওয়া হবে না। রামসিং ও সূরযকে বললুম, তোমরা দুজনে একে দেখ, আমরা শহর থেকে একজন ডাক্তার ডেকে নিয়ে আসি। এখানে সব থেকে বড় ডাক্তারের নাম কি, কোথায় থাকেন তিনি?

রামসিং হেসে বললে, ডাক্তার! সে যত বড় ডাক্তারই হোক-না কেন, কিছুই করতে পারবে না।

সূরয বললে, এই ঝড়-তুফানে বাইরে গেলে বাঁচবে! গাছ চাপা পড়ে পথে মরে থাকবে। যে মরছে তাকে মরতে দাও, দেওতার যা ইচ্ছে তাই হবে, তাই বলে তিনজনে মিলে মরবে কোন্ বুদ্ধিতে?

তবে! বন্ধু বিনা চিকিৎসায় মরে যাচ্ছে তাই-বা দাঁড়িয়ে দেখি কি করে?

আমরা বেরুতে যাচ্ছি, এমন সময় সূরয আমাদের একরকম বাধা দিয়ে বললে, দাঁড়াও। ডাক্তার কিছুই করতে পারবে না–

তারপরে সে তার পরনের কাপড়-চোপড়গুলো এঁটে পরতে-পরতে পাশের সেই বিরাট ভগ্নস্তূপের দিকে আঙুল দেখিয়ে বললে, ওই জঙ্গলের মধ্যে একরকম লতা জন্মায়, সেই লতা বেটে দষ্ট-স্থানে লাগাতে পারলে ও বেঁচে যেতে পারে, তা না হলে যেরকম লক্ষণ দেখছি তাতে মনে হচ্ছে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ওর মৃত্যু হবে–

এই অবধি বলে সে নিজেদের ঠেট-ভাষায় চিৎকার করে তার স্বামীকে কি বললে। সূরযের কথা শুনেই রামসিং বিনাবাক্যব্যয়ে উঠেই মাথার কাপড়খানা বেশ করে জড়িয়ে নিলে। তারপরে সেই অসভ্য নিরক্ষর জাঠ-দম্পতি-যারা ছাগলের দুধ বেচে জীবিকা অর্জন করে, দিনকয়েক আগেই যারা পরস্পরে খুনোখুনি করে মরছিল, ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে সেই প্রভঞ্জনের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল–যে সময়ে ক্ষুদ্রতম কীট-পতঙ্গও নিজের আশ্রয় ত্যাগ করে না, তারা গেল সেই অন্ধকারের মধ্যে, সেই উঁচু-নীচু ধ্বংসস্তূপে,–যেখানে বাঘ, সাপ, বিচ্ছু, শেয়াল–কি না আছে, চলে গেল এক অপরিচিতের প্রাণ বাঁচাবার জন্যে সেই ওষধির সন্ধানে।

এদিকে জনার্দনের চিৎকারের বিরাম নেই। সে তারস্বরে চেঁচিয়ে চলল। আমি কিসে যেন পড়েছিলুম যে, সর্পদষ্ট ব্যক্তির কিছুক্ষণ পরে গলায় স্বর ভেঙে যায়। অনবরত চিৎকার করেই হোক, অথবা অন্য যে কোনো কারণেই হোক–ক্রমেই যেন জনার্দনের কণ্ঠস্বর ভেঙে আসতে লাগল। সে চেঁচাতে লাগল, ওরা কি আমার বাড়িতে খবর দিতে গেল?

-–না, ওরা তোমার জন্যে ওষুধ আনতে গেল।

–আর ওষুধে কি হবে! আমি বেশ বুঝতে পারছি, আমার হাত-পা সব ঠান্ডা হয়ে আসছে। ও রাঙাদা–রাঙাদা গো–

বললুম, জনার্দন, চেঁচিয়ে নিজেকে কেন ক্লান্ত করছিস ভাই?

জনার্দন হাঁপাতে হাঁপাতে বললে, মরবার সময় ভাইকে ডাকছি, যদি শুনতে পায় —

–কোথায় বিক্রমপুরের কোন্ গাঁয়ে তোর বাড়ি, আর কোথায় এই ভরতপুর! এখান থেকে চিৎকার পাড়লে কি তারা শুনতে পায় কখনও?

–হ্যায় হায়! তবে মরবার সময় কারুকে দেখতে পেলুম না!

জনার্দন যত এই ধরনের কথা বলে, সুকান্তর কান্নার বেগ ততই বাড়তে থাকে। সুকান্ত ও জনার্দন একই দেশের ছেলে। সে কাঁদে আর বলে, ওর বাড়িতে মুখ দেখাব কি করে?

এদিকে জনার্দনের কণ্ঠস্বর ভেঙে গেলেও তার চিৎকারের বিরাম নেই। সে বলতে লাগল, যে-সাপটা তাকে কামড়েছে সেটাকে সে দেখেছে, একেবারে কালসাপ রে বাবা! ও বাবা, তুমি কোথায়? ব্রহ্মশাপ না হলে লোককে সাপে কামড়ায় না। হরিশচন্দ্রের ছেলে রোহিতাশ্বকে সাপে কামড়েছিল তাকে মাত্র একটা ব্রাহ্মণে শাপ দিয়েছিল, আর আমি দেশসুদ্ধ ব্রাহ্মণের দানের টাকা মেরে নিয়ে এসেছি, এতগুলো বামুনের অভিসম্পাত–ওরে, কি হবে রে!

এইরকম সব বকতে বকতে ক্রমে সে নির্জীব হয়ে পড়ল। আস্তে আস্তে তার কথা-বলাও শেষ হয়ে গেল।

সুকান্ত বললে, বাস্! দেখছ কি? শেষ হয়ে গেল।

সুকান্ত জনার্দনের মাথার কাছ থেকে উঠে নিজের খাটে গিয়ে বসল। আমিও সেখান থেকে উঠে মেঝেতে যেখানে মোমবাতিটা জ্বলছিল, সেখানে গিয়ে বসে পড়লুম।

বাইরে তুফান গর্জাতে লাগল।

সেই প্রকাণ্ড প্রায়ান্ধকার ঘরে আমরা দুজনে জেগে আর একজন নিদ্রিত কি মহানিদ্রাগত তা জানি না। কুকুর-ছাগলগুলোও ঘুমিয়ে পড়েছে। এতক্ষণ পরে সমস্ত ব্যাপারটা ভালো করে চিন্তা করবার অবসর পেলুম। বেশ বুঝতে পারলুম যে, জনার্দন যদি মরে গিয়ে থাকে তো কাল সকালেই পুলিসের লোক এসে তার মৃতদেহ আর আমাদের জীবন্ত দেহ নিয়ে একচোট টানা-পোড়েন করবে। পুলিসের কবল থেকে যদি ভালোয় ভালোয় মুক্তি পাই তো প্রথমে জনার্দনের দেহের সৎকার করতে হবে। তার পরে কি হবে?

ভাবতে লাগলুম, ব্রাহ্মণের অভিশাপে জনার্দন না-হয় মারা গেল। কিন্তু এ কার অভিশাপ আমার জীবনকে এমন পাকে-পাকে ধরেছে! যেখানে যাই, যে কাজেই অগ্রসর হই ঠিক সাফল্যের পূর্ব-মুহূর্তটিকে অতর্কিতে বাধা এসে সব পণ্ড করে দেয়। এই তো বরাবরই দেখে আসছি। কোথায় জমা হয়ে আছে, এই বাধা, কে প্রয়োগ করছে এই বাধা–আমার ইচ্ছাকে, আমার জীবনকে বিপর্যস্ত করবার এই চক্রান্ত প্রকৃতির মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে কেন? কি আমার অপরাধ?

কার প্রতি জানি না–ধীরে ধীরে একটা অভিমান আমার অন্তরে জমা হতে লাগল। এই দুর্জয় অভিমানে আত্মহত্যা করবার প্রবল ইচ্ছা আমার মনের মধ্যে লাফালাফি করতে শুরু করে দিলে। আমি ঠিক করলুম, জনার্দন যদি মরে যায় তো ওই টিনে যত অর্থ এখনও অবশিষ্ট আছে তা সুকান্তর হাতে দিয়ে তাকে বাড়ি পাঠিয়ে দেব। আমি কিন্তু আর ফিরব না; ফিরব না বটে, কিন্তু জীবনযুদ্ধ থেকে একেবারে সরে দাঁড়াব। কোনো চেষ্টা করব না জীবনে কোনো উন্নতি করবার। আমি খুঁজব তাঁকে, যিনি আমার ভাগ্যলিপি লিখেছেন। জিজ্ঞাসা করব তাঁকে, কেন তিনি দিলেন আমার মধ্যে এই আবেগ ও আকুলতা, অথচ সংসারের প্রতিটি জিনিসকে লেলিয়ে দিলেন আমার বিরুদ্ধে–যেন কোনো কাজেই আমি সাফল্যলাভ করতে না পারি! কেন! কেন! কি আমার অপরাধ?

আমার পাশের মোমবাতিটা ফুরিয়ে গিয়ে অনেকক্ষণ থেকে নোটিশ দিচ্ছিল–দাউদাউ করে কিছুক্ষণ জ্বলে সেটা নিবে গেল।.

অন্ধকারে বসে ভাবতে লাগলুম, আসুক ওই জঙ্গল ও ভগ্নস্তূপ থেকে বাঘ নেকড়ে–আসুক বিচ্ছুর দল–কামড়ে মেরে ফেলুক আমাকে–আমি নড়ব না।

একটু পরে সুকান্ত আর-একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে আমার পাশে রেখে উবু হয়ে বসল। দেখলুম তখনও তার চোখে জল রয়েছে। তাকে আমার সংকল্পের কথা বলায় সে ঘাড় নেড়ে বললে, আমিও তোমার সঙ্গে যাব, বাড়ি যাবার কথা আমায় বলো না। জনার্দন যদি মারা যায় তো কোন মুখ নিয়ে আমি বাড়ি যাব? তা ছাড়া বন্ধুকে এমনভাবে ফেলে সব টাকা নিয়ে মজা করে আমি বাড়ি যেতে চাই না। তুমিও যেখানে যাবে, আমিও সেখানে যাব।

সুকান্ত আমার আরও কাছে এসে তার একটা হাত দিয়ে আমার গলা জড়িয়ে ধরলে। সুদূর অতীতে দুর্দিনের সেই দারুণ রাতে সে আমায় কি কি বলেছিল তার খুঁটিনাটি কথা আজ আর ভালো করে মনে পড়ছে না কিন্তু সেই ঘটনাকে আশ্রয় করে তার সঙ্গে আবার যেন নতুন করে আমার বন্ধুত্ব হল। যদিও ভবিষ্যতে তার জীবনের কর্মক্ষেত্র ছিল আলাদা- সে থাকত এক জায়গায়, আমি থাকতুম আর-এক জায়গায়। তবুও যখনই দেখা হয়েছে আমরা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরেছি–অতীতের সেই ভয়ঙ্কর রাত্রে চোখের জলে আমাদের সে বন্ধুত্ব পাকা হয়েছিল হাসতে-হাসতে সে-কথা আলোচনা করেছি।

একবার অনেকদিন অসাক্ষাতের পর সকালবেলা প্রায় দশটার সময় এসে সুকান্ত জিজ্ঞাসা করলে, হ্যাঁ রে? ওই-যে অমুক কাগজে ‘মহাস্থবরি জাতক’ নামে একটা লেখা বেরুচ্ছে, সেটা নাকি তুই লিখছিস?

বললুম, হ্যাঁ।

সুকান্ত বললে, ও বাবা! তা হলে আমাদের সেইসব কথা ফাঁস করে দিবি নাকি?

জিজ্ঞাসা করলুম, কেন, তোর আপত্তি আছে?

সুকান্ত একটু ভেবে বললে, না, আপত্তি আর কি, তবে নামটা আর দিসনি। ছেলেপুলে বড় হয়েছে–নাতি-নাতনি আসছে, সে-সব কেলেঙ্কারি–

দুজনে একচোট খুব হাসা গেল।

বললুম, অনেকদিন পরে দেখা হল–দু-দিন থাক না আমার কাছে

সে বললে, না ভাই, এবার অমুক জায়গায় উঠেছি, সেখান থেকে হঠাৎ চলে এলে কি মনে করবে তারা? এর পরের বারে একেবারে তোর এখানে এসে উঠে ক’দিন থাকব।

ঘণ্টাখানেক হাসি-গল্প করে সুকান্ত চলে গেল। বোধ হয় দু-তিন দিন পরেই শুনলুম স্নানের ঘরে অস্বাভাবিক দেরি হচ্ছে দেখে তার আত্মীয়েরা দরজা ভেঙে দেখলে, তার প্রাণহীন দেহ বাথ-টবের পাশে পড়ে রয়েছে।

যাই হোক, আমরা তো জনার্দনকে নিয়ে সেইভাবে বসে রইলুম। প্রায় ঘণ্টাকয়েক পরে রামসিং ও সূরয ফিরে এল, তাদের মাথায় বড় বড় দুই লতার বোঝা। বোঝা নামিয়ে তখুনি ডাঁটা থেকে পড়পড় করে রাশীকৃত পাতা ছিঁড়ে নিয়ে সূরয বাটতে আরম্ভ করে দিলে।

রামসিং বললে, এ-লতার নাম বিশল্যকরণী, লক্ষ্মণজীর জন্যে মহাবীরজী এই লতা হিমালয় থেকে লঙ্কায় নিয়ে গিয়েছিল। তাঁদের সঙ্গে এ-ওষধি অযোধ্যায় যায়–তার পরে ভরতজী যখন এখানে রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন, তখন তাঁর হুকুমে এইখানে বিশল্যকরণী লাগানো হয়েছিল। এ-লতা জঙ্গলে জন্মায় বটে, কিন্তু যে-সে জঙ্গলে তা বলে হয় না।

ওদিকে সূরয তাল-তাল সেই পাতা বাটতে লাগল, আর রামসিং জনার্দনের পায়ের পাতা থেকে আরম্ভ করে প্রায় কুঁচকি অবধি থেবড়ে-থেবড়ে সেগুলো বসিয়ে দিতে লাগল। সব লাগানো হয়ে গেলে মেঝে পরিষ্কার করে সেখানে জনার্দনকে শোয়ানো হল। রামসিং ও সূরয দুজনেই বেশ করে তাকে পরীক্ষা করে বললে, এখনও প্রাণ আছে–বেঁচে যাবে বলে মনে হচ্ছে।

এইসব করতে করতে ফরসা হয়ে গেল। সকালের দিকে বৃষ্টি একেবারে থেমে গেল বটে কিন্তু তখনও হাওয়ার জোর ছিল, রোদ ওঠার সঙ্গে সঙ্গে হাওয়ার জোরও কমে গেল–প্রসন্ন সূর্যালোকে আবার পৃথিবী হাসতে লাগল।

এতক্ষণে জনার্দনকে ভালো করে দেখবার সুযোগ পেলুম। মনে হল, তার মুখখানা যেন কালো হয়ে গিয়েছে। খুব আস্তে আস্তে সে নিশ্বাস নিচ্ছিল–সূরয কয়েকবার নাকের কাছে হাত দিয়ে দেখে বললে, ও এখন বিষের ঘোরে ঘুমুচ্ছে, সেই বিকেল নাগাদ ঘুম ভাঙবে। পরমাত্মা ওকে বাঁচিয়ে দিলেন–

সকালবেলা দুধের খদ্দেররা এসে কেউ দুধ পেলে না। রাত্রে ধাড়িদের গলার দড়ি খুলে জনার্দনের পায়ে বাঁধা হয়েছিল, সেই তালে তারা বাচ্চাদের কাছে গিয়ে দুধ খাইয়ে দিয়েছে। খদ্দেররা দুধ পেল না বটে, কিন্তু মজা পেল। দুধ না পাওয়ার কারণটিকে তারা দেখে গেল। তারপর নিজ নিজ মহল্লায় গিয়ে বেশ ফলাও করে গল্প করার ফলে চারদিক থেকে দলে দলে লোক আসতে লাগল জনার্দনকে দেখতে। আমাদের উপকার করতে গিয়ে সেদিন তাদের সকাল-বেলার রোজগারটি নষ্ট হল। তারপরে সেই দড়িগুলো কেটে ফেলায় ভবিষ্যতের অবস্থাও খারাপ হল দেখে আমরা তাদের দড়ি কেনবার পয়সা তো দিলুমই, তা ছাড়া খোরাকিবাবদও কিছু দিলুম।

বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দর্শনার্থীর ভিড় কমে আসলে লাগল। সূরয বললেও, যাও তোমরা খেয়ে এস। রুগির অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, আর ভয় নেই। বিকেল নাগাদ ও ভালো হয়ে উঠবে। তখন একটু গরম দুধ খাইয়ে দেব–সব ঠিক হয়ে যাবে।

সেদিন বিকেল নাগাদ জনার্দন সত্যিই ভালো হয়ে উঠল। চলে ফিরে-বেড়াতে না পারলেও, সে উঠে বসে আমাদের সঙ্গে হেসে কথা বলতে লাগল। জনার্দনকে বললুম যে, সূরয ও রামসিং সেই দুর্যোগে প্রাণ তুচ্ছ করে বেরিয়ে গিয়ে লতা এনেছিল বলেই-সে বেঁচে গিয়েছে। নইলে–

জনার্দন যখন সূরযের হাত ধরে তাদের কাছে কৃতজ্ঞতা জানাতে লাগল, তখন তাদের স্বামী-স্ত্রী দুজনের চোখেই অশ্রু ফুটে বেরুল। বাইরের আবরণটা কঠিন হলেও বুঝলুম, তাদের ভেতরটা তখনও দরদে ভরা রয়েছে।

সূরয বললে, বৃষ্টি-বাদলের দিনে সব বিচ্ছু বেরোয়, তোমরা বিছানাপত্র ভালো করে ঝেড়ে নাও।

আমরা বিছানা খাট ভালো করে ঝেড়ে আছড়ে আবার বিছানা পাতলুম। জনার্দনের বিছানা ঝাড়তে গিয়ে প্রায় এক বিঘৎ লম্বা ও সেই অনুপাতে মোটা, গায়ে খাড়া-খাড়া রোঁয়াওয়ালা একটা বিচ্ছু বেরিয়ে পড়ল। তখুনি জুতো-পেটা করে তো সেটাকে মেরে ফেলা হল। ওরা বললে, একবার কামড়ালে সাত দিন আর ওদের বিষ থাকে না, কাজেই আজকে যদি ওটা কামড়াত তা হলে কিছুই হত না। সঙ্গে সঙ্গে এ-কথাও বললে যে, এই শ্রেণীর বিচ্ছুর বিষ প্রায়ই মারাত্মক হয়ে থাকে। এরা যদি সাপকে কামড়ায় তো সাপ মরে যায়।

বিকেলবেলা জনার্দনকে আধ-সের-টাক দুধ দেওয়া হল বটে, কিন্তু সে আরও কিছু খাবারের জন্যে এত গোলমাল আরম্ভ করলে যে তার জন্যে আবার স্টেশন থেকে রুটি মাছ কিনে আনতে হল।

সেদিন সন্ধ্যায় জনার্দনের ভালো হয়ে যাওয়া উপলক্ষে আগের অবশিষ্ট গাঁজাটুকু টেনে সবাই শুয়ে পড়া গেল, তারপরে এক ঘুমেই রাত কাবার।

দিন-তিনেকের মধ্যেই জনার্দন বেশ সেরে উঠে আগের মতন আমাদের সঙ্গে স্টেশনে যাতায়াত আরম্ভ করলে। স্টেশনের কাছের সেই বাড়ির মালিক তখনও ফেরেনি। স্টেশনের দোকানদারটি বললে, আর আট-দশ দিনের মধ্যেই সে নিশ্চয় ফিরে আসবে। কিন্তু এদিকে আমাদের জনার্দন মহা হাঙ্গামা জুড়ে দিলে। সে খালি বলতে লাগল, তার কিরকম মনে হচ্ছে–এখানে থাকলে সে মরে যাবে। সেদিন তো দক্ষিণ দরজা অবধি পৌঁছে গিয়েছিল–এবার চৌকাঠ পেরুতে হবে। জনার্দনকে বোঝাতে লাগলুম এরকম সস্তার জায়গা ছেড়ে অন্য কোথাও গেলে হয়তো মুশকিলেই পড়তে হবে। ওদিকে দুধের ব্যবসার জন্যে ভালো ভালো ছাগল ইত্যাদি দেখা হয়েছে এইসব ছেড়ে দিয়ে চলে যাওয়া অত্যন্ত অবিবেচকের কাজ হবে।

জনার্দন কিন্তু কোনো যুক্তিই মানে না। তার যুক্তি হচ্ছে যদি প্রাণেই না বাঁচি তো ব্যবসা দিয়ে কি করব!

এইরকম চলেছে। একদিন আমরা স্টেশন থেকে খেয়ে ডেরায় ফিরছি বেলা তখন প্রায় দেড়টা হবে, এমন সময় একটা লোক দৌড়তে দৌড়তে এসে আমাদের বললে, তোমাদের ওই চৌকিতে ডাকছে।

চৌকি কি রে বাবা! শেষকালে টের পাওয়া গেল যে পুলিসের লোক থানায় আমাদের ডাকছে। লোকটার সঙ্গে সঙ্গে গেলুম। কাছেই একটা বড় গাছের নীচে একটা খোলার ঘর। সেখানে টেবিল বেঞ্চি আছে। বেঞ্চিতে চার-পাঁচজন লোক বসে রয়েছে, আরও কয়েকজন দাঁড়িয়ে আছে।

আমরা সেখানে গিয়ে উপস্থিত হতেই থানাদার খুব খাতির করে বসতে বলে আমাদের জিজ্ঞাসা করলেন, কিছুদিন থেকে লক্ষ্য করছি, আপনারা এই পথে যাতায়াত করছেন, কে আপনারা?

এই অবধি বলেই আবার বললেন, আমার অপরাধ মার্জনা করবেন। জানেনই তো, এটা একটা রেয়াসৎ অর্থাৎ দেশীয় রাজ্য। এখানকার বাসিন্দা নহে, এমন লোক এখানে এলে তাদের খোঁজ রাখতে হয় আমাদের।

আগ্রায় সত্যদার কাছে আমরা রেয়াসতের অনেক খবরই পেতুম। বাঙালির ছেলে, বিশেষ কলকাতার লোক এই স্বদেশীর সময় সেখানে গেলে যে খুব খাতির পাবে না তাও আমাদের জানা ছিল। থানাদার কিছুক্ষণ ধরে আমাদের আপাদমস্তক দেখে বললেন, আপনাদের দেখে তো বাঙালি বলে মনে হচ্ছে। বাংলাদেশের কোথায় আপনাদের বাড়ি, কোন্ জেলা কোন্ পোস্ট-অফিস, কোন্ গ্রাম কোন্ থানা?

বললুম, বাংলাদেশ আমাদের পূর্বপুরুষের বাড়ি ছিল, কিন্তু কয়েক পুরুষ থেকেই আমাদের আগ্রাতে বাস।

প্রশ্ন হল–আপনাদের তিনজনেরই কি তাই?

–আজ্ঞে হ্যাঁ।

–বেশ আপনাদের নাম ধাম ঠিকানা?

থানাদারের সঙ্গে আমার কথাবার্তা হচ্ছিল। আমি তো যা-তা একটা নাম বলে দিলুম। ঠিকানাও একটা দিয়ে দিলুম। বললুম, আমরা সবাই একই মহল্লায় বাস করি।

আমার দেখাদেখি জনার্দন ও সুকান্তও নাম ভাঁড়ালে। কিন্তু এতেও তারা রেহাই দিলে না। থানাদার আবার প্রশ্ন করলেন, কতদিন এসেছেন এখানে?

–তা মাসখানেক হবে।

–কোথায় আছেন?

–ধর্মশালায়।

–কোন ধর্মশালায়?

–ওই-যে রামসিং বলে একটা লোকের ধর্মশালা আছে, সেখানে।

আমাদের কথা শুনে থানাদার ও উপস্থিত সকলে হো-হো করে হেসে উঠল। থানাদার বললেন, রামসিংয়ের ধর্মশালা! বলেন কি! রামসিং কি ধর্মশালা খুলেছে নাকি? উপস্থিত লোকদের মধ্যে একজন বললে রামসিং মধ্যে মধ্যে লোক রাখে বলে শুনেছি। থানাদার আমাদের জিজ্ঞাসা করলেন, আপনারা কি ওকে পয়সা দেন?

–হ্যাঁ দিই।

এবার থানাদার একটু গম্ভীর ভাব অবলম্বন করে বললেন, ওই রামসিং ও তার স্ত্রী কিরকম চরিত্রের লোক, তা কি আপনাদের জানা আছে?

বললুম, ওদের ভালো লোক বলেই তো মনে হয়। বেচারারা আজই গরিব হয়ে পড়েছে–শুনেছি, ওদের পূর্বপুরুষেরা রাজা ছিল। রাজত্ব চলে গেছে, কিন্তু ওদের ব্যবহারের মধ্যে আভিজাত্যের ইঙ্গিত পাওয়া যায়–

আমার বক্তৃতার তোড় থামিয়ে দিয়ে থানাদার বললেন, বাবুসাহেব, আপনার কথা মেনে নিচ্ছি–এ-কথা খুবই সত্যি যে, ওদের পূর্বপুরুষ রাজা ছিল। কিন্তু আমি এখনকার কথা বলছি। জানেন কি যে ওরা ডাকাত! ওই রামসিং ডাকাতি করে ধরা পড়ে পাঁচবছর জেল খেটেছে। আর ওর বউটা–সেটারও দু’বছর জেল হয়েছিল। রামসিং যে-দলের লোক সে-দলকে শুধু এখানকার নয়, এর চারপাশের তিন-চারটে রেয়াসতের লোক ভয় করে। ডাকাতি, নরহত্যা ও যে কত করেছে তার আর ঠিক-ঠিকানা নেই। আপনাদের কেন যে প্রাণে মারেনি, তা বুঝতে পারছি না। মেরে ওই জঙ্গলের মধ্যে ফেলে দিলে আর কারুর সাধ্যি নেই যে, ওদের ধরে। নিজের যদি মঙ্গল চান তো এখুনি ওখান থেকে সরে পড়ুন। এখানে ভালো ধর্মশালা আছে, সেখানে চলে যান–পয়সাকড়ি কিছুই লাগবে না।

সত্যিকথা বলতে কি, থানাদারের কথা শুনে আমরা দস্তুর-মতন ভড়কে গেলুম। সঙ্গে সঙ্গে সুকান্ত বললে, ক’দিন থেকে ওরা স্বামী-স্ত্রী দুজনে প্রায়ই বিস্কুটের বাক্সের দিকে টেরিয়ে টেরিয়ে দেখতে আরম্ভ করেছে। তার ওপর সেদিন রাত্রে সূরয তার বিছানার তলা থেকে যে-অস্ত্রটি বার করেছিল, তার দ্বারা আমাদের এক-একজনকে দুখানা করে ফেলতে বিশেষ কষ্ট করতে হবে না।

আমাদের নিজেদের মধ্যে এইসব কথাবার্তা চলেছে, এমন সময় জনার্দন থানাদারকে বললে, কিন্তু এখন চলে যেতে চাইলে ওরা যদি যেতে না দেয়?

থানাদার একটু ভেবে নিয়ে বললে, আচ্ছা আমি আপনাদের সঙ্গে লোক দিচ্ছি–জবরদস্ত লোক দিচ্ছি।

থানাদার তিনজন ষণ্ডা দেখে সিপাহী আমাদের সঙ্গে দিলে।

আমাদের কারুর মুখে আর কথা নেই। রামসিং ও সূরয যে সাধারণ মানুষের চাইতে অনেক উঁচুদরের লোক, সে-বিষয়ে আমাদের মনে কোন সন্দেহই ছিল না। সেই ঝড়ের রাতে তারা যে করে জনার্দনকে বাঁচিয়ে তুলেছিল, তার তুলনা কোথায় পাব? সেই রামসিং ও সূরয ডাকাত ও নরহত্যাকারী!

চলতে চলতে জনার্দন বলতে লাগল, ওরা আমার প্রাণ বাঁচিয়েছে বটে, কিন্তু সেইদিন থেকেই কে যেন দিনরাত আমার মনের মধ্যে খোঁচা দিয়ে এখান থেকে সরে পড়তে বলছে–এখানে আর কিছুদিন থাকলে নিশ্চয় ওরা আমাদের খুন করে ফেলবে।

ধীরে ধীরে রামসিংয়ের ডেরায় পৌঁছনো গেল। খাওয়াদাওয়া সেরে তখন তারা শোবার জোগাড় করছিল। আমাদের পেছনে তিনজন পুলিসের সিপাহী দেখে তারা দুজনেই অবাক হয়ে চেয়ে রইল। আমরাও তাদের সঙ্গে আর কোনো কথা না বলে তিনজনে তিনটে বোঁচকা বাঁধতে আরম্ভ করে দিলুম–তারা ঠিক সেইরকম দৃষ্টিতে হাঁ করে আমাদের কার্যকলাপ দেখতে লাগল।

আগে আগে প্রতিদিন সকালেই সূরয আমাদের কাছ থেকে সেদিনের খাট ও ঘরের ভাড়া চেয়ে নিত। ইদানীং একটু ঘনিষ্ঠতা হওয়ায় দু-তিন দিন বাদে চাইত। সে-সময় কয়েক দিনের ভাড়া বাকি ছিল। আমাদের পুঁটলি বাঁধা শেষ হলে আমি এগিয়ে ঘর ও আঙ্গেঠির জন্যে বাকি পাওনা সূরষের হাতে দিলুম। সে হাত পেতে পয়সা-ক’টা নিয়ে নিলে, কিন্তু একটা কথাও উচ্চারণ করলে না। একবার ভাবলুম, সূরযকে কিছু বলি–কিন্তু লজ্জায় তার মুখের দিকে চাইতেই পারলুম না। ফিরে এসে সিপাহীদের সঙ্গে তাদের ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লুম।

এই সূরয ও রামসিং আমার সারা জীবনের বিস্ময় হয়ে আছে। তারা ছিল রাজার ঘরের ছেলে-মেয়ে, অথচ সংসারে স্বজন বলতে তাদের কেউ ছিল না। বিরাট প্রাসাদের একখানা ভাঙা ঘর তখনও অবশিষ্ট ছিল–সেখানকার অবস্থাও তাদেরই মতন–তারই মধ্যে তারা বাস করত। তাদের দেখে মনে হত না যে, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বলে কোনো অনুভূতির বালাই তাদের আছে। তাদের জীবনের সঙ্গে সঙ্গে সেই ঘরখানার আয়ুও বোধ হয় এতদিনে শেষ হয়ে গিয়েছে। একবেলা কোনো রকমে খেয়ে বেঁচে থাকলেও সেই রুক্ষ কাঠখোট্টা চেহারার মধ্যে বাস করত দু’খানা অদ্ভুত প্রাণ। জনার্দনকে সাপে কামড়িয়েছে শুনে রামসিং যে করে পায়ের আঙুল ধরে চুষতে আরম্ভ করলে–তার পরে সে ও সূরয সেই ভীষণ ঝড়ের রাতে ভীষণতর সেই জঙ্গলে অন্ধকারে ওষুধ আনতে ছুটে বেরিয়ে গেল–মানুষের ইতিহাসে তার তুলনা কোথায়!

আবার যখন শুনলুম সেই রামসিং বহু ডাকাতি করেছে–ডাকাতি করতে গিয়ে ধরা পড়ে ‘জেল খেটেছে, ডাকাতকে আশ্রয় দেওয়ার অপরাধে সূরযকেও জেল খাটতে হয়েছে–এক বছর আগেও প্রতি রাত্রে তাদের স্বামী-স্ত্রীকে দু’বার করে থানায় হাজিরা দিতে হত–একাধিক নরহত্যা তারা করেছে, শুধু আইনের ফাঁকিতে বেঁচে গিয়েছে–তখন নিউটনের মতন আমার বলতে ইচ্ছা করে, দুর্ভেয় মানব-চরিত্রের সমুদ্রোপকূলে সারাজীবন ধরে কতকগুলি উপলখণ্ড, নয়–বালুকাকণা মাত্র আহরণ করেছি। সত্যিকথা বলতে কি আমাদের সঙ্গে তারা যে সদয় ব্যবহার করেছিল, তাতে তাদের কাছ থেকে অমনভাবে বিদায় নেওয়া কখনই উচিত হয়নি। কিন্তু আগেই বলেছি মানব-চরিত্র অতি জটিল ও বিচিত্র-আর আমরাও মানুষ মাত্র। অর্থলোভে হত্যা করতে অভ্যস্ত জেনে–হোক-না সে উপকারী–তার পাশে নিশ্চিন্ত হয়ে রাত্রে ঘুমোই কি করে? তখনও একটা টিনভরা সিকি দুয়ানি আমাদের কাছে রয়েছে–তাই একদিন যারা আমাদের প্রাণ রক্ষার জন্যে নিজেদের প্রাণকে তুচ্ছ করতে দ্বিধা করেনি, তাদের কাছ থেকেই আমরা প্রাণভয়ে পলায়ন করলুম।

তারপর একদিন বিনা মাসুলে তানসেনের’ দেশে এসে উপস্থিত হওয়া গেল। গোয়ালিয়র ভরতপুরের চেয়ে অনেক বড় শহর। অনেক লোকজন বাজার-হাট জমজম করছে সেখানে। এবারে দেখে-শুনে একটা ভালো ধর্মশালায় আশ্রয় নেওয়া গেল।

প্রথমে কয়েকদিন বিভিন্ন পল্লীতে ঘুরে ঘুরে শহরটাকে ভালো করে বোঝবার চেষ্টা করা গেল। কিন্তু শহর বোঝা, লোক বোঝা আমাদের কাছে সবই বৃথা। অতি ভালো শহরও আমাদের বরাতে খারাপ দাঁড়িয়ে যায়, অতি ভালো লোকও মন্দ লোকে পরিণত হয়। আমাদের অলক্ষ্যে বসে যিনি কলকাঠি নাড়াচাড়া করছেন, তাঁর সঙ্গে বোঝাপড়া করি কি করে! কি জিনিস ঘুষ দিলে যে তিনি তুষ্ট হয়ে আমাদের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করবেন তার হদিশ তো কিছুই পাইনি।

অনেক ভেবে-চিন্তে তিন মাথা এক হয়ে পরামর্শ করে ঠিক করা গেল, আপাতত ব্যবসা করার কল্পনা ত্যাগ করাই ভালো। প্রথমে চাকরির চেষ্টা করা যাক–তারপরে চাকরি করতে করতে একটা হদিশ লেগে যেতে পারে।

গোয়ালিয়র শহরে বিস্তর মহারাষ্ট্রীয়ের বাস। উকিল, ডাক্তার, ব্যবসাদার, সরকারি চাকুরে প্রভৃতি অনেক প্রতিষ্ঠাবান মহারাষ্ট্রীয় সে-সময় সেখানে বাস করতেন। মোট কথা, সেই রাজ্যটাই তো তাদের। এ ছাড়া মুসলমান ও অন্যান্য প্রদেশের হিন্দুদের সংখ্যাও কিছু কম ছিল না।

গোয়ালিয়র সঙ্গীতের রাজ্য। সেই তানসেন থেকে আরম্ভ করে গত শতাব্দীর হদ্দ হস্ খাঁ অবধি। গোয়ালিয়র শহরে বড় বড় গুণীর আবাসস্থল ছিল। আমরা যে-সময় সেখানে গিয়েছিলুম, সে-সময় জনসাধারণের মধ্যে গান-বাজনার খুবই চর্চা ছিল। তা ছাড়া ভারতবিখ্যাত কয়েকজন বড় গাইয়ে ও বাজিয়ে মহারাজার দরবারে বেতনভুক ছিলেন। এঁদের বড়, মেজো ও ছোট চেলায় শহর তখন ভর্তি ছিল। পুরুষ ছাড়া জনকয়েক নাম-করা গাইয়ে-বাইজীও সে-সময় থাকতেন সেখানে। দেখে-শুনে মনে হল, একটা করে চাকরি সেখানে জুটিয়ে নেওয়া খুব কঠিন হবে না।

আমরা যে-ধর্মশালায় উঠেছিলুম, সেখানকার রক্ষক বাঙালি দেখে আমাদের সঙ্গে সেধে আলাপচারী করত। সকাল-সন্ধ্যায় তার আড্ডায় অনেক মুরুব্বিগোছের লোক যাতায়াত করত। তারাও আমাদের আশ্বাস দিতে লাগল–তোমরা কাজের লোক, এখানে একটা কিছু লেগে যাবেই যাবে।

সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে আমরা তিনজনে মিলে বেরুতে লাগলুম চাকরির সন্ধানে। আমরা ঠিক করেছিলুম যে-কোনো কাজ–তা সে জুতো-সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ–যা জোটে তাই করব। একটা কিছু অবলম্বন পেলে তাই ধরেই ওঠা যাবে।

তিনজনে মিলে বাড়ি-বাড়ি ঘুরতে আরম্ভ করে দিলুম–হ্যাঁগা, লোক রাখবে?

সকলেই বলে, না।

সকাল-বিকেল ঘোরাই সার হতে লাগল। শেষকালে ধর্মশালারই একজন পরামর্শ দিলে–তিনজনকে একসঙ্গে দেখলে কেউ রাখতে চাইবে না–একজন একজন করে চেষ্টা কর।

কথাটা আমাদের মনে লাগল। পরের দিন থেকে আমরা আলাদা আলাদা এক-এক দিকে বেরিয়ে পড়তে লাগলুম। বেলা বারোটা অবধি পথে-পথে দুয়ারে দুয়ারে চাকরির চেষ্টায় ঘুরে ধর্মশালায় ফিরে এসে নিজের নিজের বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা বলাবলি করতুম। একদিন জনার্দন বললে, এক গৃহস্থ তাকে দেখে দয়াপরবশ হয়ে পেট ভরে খাইয়েছে।

একদিন এক বাড়িতে আমি কাজের চেষ্টায় গিয়েছি। একটি আধাবয়সি স্ত্রী-লোক বোধ হয় সেই বাড়ির গিন্নি হবে, আমায় জিজ্ঞাসা করলে, তোমার খাওয়া হয়েছে?

‘আমি ‘না’ বলায় সে খান-দুয়েক গরম রুটি ও তার ওপরে এক-ছিটে ঘন ডাল আমার হাতে আলগোছে ফেলে দিয়ে বললে, খাও।

ডালটুকু তখুনি চেটে মেরে দিয়ে রুটি-দু’খানা পকেটে পুরে ধর্মশালায় ফিরে এসে সকলে মিলে হাসাহাসি করতে করতে খাওয়া গেল।

এর কিছুকাল পরে অনেকদিন ধরে রুটি তরকারি পকেটে পুরতে হয়েছিল–সে-কথা যথাস্থানে বলব। সেদিন সেই ভিক্ষের রুটি খেতে খেতে সুকান্ত বললে, ওঃ, উন্নতি যা করা যাচ্ছে, জাতি-গুষ্টির কেউ টের পেলে হিংসেয় বুক ফেটে মরে যাবে।

একদিন এইরকম করে পথে-পথে দোরে-দোরে চাকরির চেষ্টায় ঘুরে বেড়াচ্ছি, এমন সময় একজনদের বৈঠকখানায় গানের আসর বসেছে দেখে সেখানে দাঁড়িয়ে গেলুম। একজন লোক প্রাণপণ শক্তিতে তুম্-তারা-নারা করে চেঁচাচ্ছে আর একজন তবলা চাঁটাচ্ছে–দু-চারজন লোকও তাদের ঘিরে বসে তারিফ করছে। আমি একটু একটু অগ্রসর হতে হতে বাড়ির মধ্যে বেশ খানিকটা ঢুকে গিয়েছি, এমন সময় দেখি, একটা বাচ্চা মেয়ে–বোধ হয় আট-দশ মাসের বেশি বয়স হবে না-বনবন করে হামাগুড়ি দিতে দিতে রাস্তার দিকে এগিয়ে চলেছে। তার কোমরে রুপোর পাটা, গলায় আমড়ার মতন রুপোর একটা বল ঝুলছে। মেয়েটা আমাকে ছাড়িয়ে দরজার কাছ অবধি এগিয়ে যাওয়ায় আমি ফিরে গিয়ে তাকে তুলে বাড়ির মধ্যে নিয়ে গেলুম। সেখানে কয়েকবার ‘মাইজী’ ‘মাইজী’ ‘মাতাজী’ বলে ডাক দিতেই একটি মহারাষ্ট্রীয় মহিলা বেরিয়ে এলেন। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, এ কি আপনাদের মেয়ে?

মহিলাটি এগিয়ে এসে টপ করে বাচ্চাটিকে আমার কোল থেকে নিয়ে নিলেন। আমি বললুম, মাইজী, বাচ্চা এখন হামা দিতে শিখেছে–ওকে এখন সাবধানে রাখতে হয়। দেখুন রাস্তায় বেরিয়ে গিয়েছিল। ভাগ্যে আমার চোখে পড়েছিল, নইলে নিঘাত আজ গাড়ি-চাপা পড়ত। কোনো চোর-ডাকাতের হাতে পড়লে ওকে গয়নার জন্যে মেরে পর্যন্ত ফেলতে পারে।

আমার কথা শুনে মেয়ের মা বাচ্চাটিকে কোলে চেপে ধরে কাঁদতে শুরু করে দিলে। আমি বললুম, কাঁদবেন না মা। মেয়ের তো কিছু হয়নি–ভবিষ্যতে ওকে সাবধানে রাখবেন।

–তুমি কে? তোমাকে তো কখনও দেখিনি!

–আমি বিদেশী, এখানে এসেছি চাকরির সন্ধানে। গান শুনে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলুম।

–তোমার মা-বাপ নেই? আত্মীয়-স্বজন কেউ নেই?

–না মা, দুনিয়ায় কেউ থাকলে কি আর দেশ ছেড়ে এত দূরে চাকরির জন্যে আসি! আমি আর আমার দুটি বন্ধু এসেছি এখানে পেটের দায়ে।

–তোমার দেশে দুর্ভিক্ষ হয়েছে বুঝি?

–ভয়ানক দুর্ভিক্ষ, মা, পয়সাওয়ালা লোক সব খেতে না পেয়ে মরে যাচ্ছে।

–তুমি কি জাত?

–আমরা বেনে। আপনাদের এখানে যেমন বৈশ্য আছে না?–সেই জাত।

–তোমার পৈতে আছে?

–আছে।

–তুমি আমাদের বাড়িতে কাজ করবে? কাজ খুব বেশি নয়, এই ঘর-গৃহস্থালির কাজ। ঝাড়ু দেওয়া, জিনিসপত্তর সাফ রাখা, বাড়ির কর্তার ফরমাশ খাটা আর মাঝে মাঝে এই বাচ্চাকে ধরা।

আমি জাহাজে কখনও কাজ করিনি। শুনেছি সমুদ্রের মাঝখানে দারুণ ঝড়ের মধ্যে সেই টলটলায়মান অর্ণবপোতের প্রধান মাস্তুলে চড়ে পাল-নামানো খুবই শক্ত কাজ। এ-সম্বন্ধে আমি কোনো সন্দেহ প্রকাশ করছি না, কিন্তু ছোট ছেলে রাখাও যে কতখানি শক্ত কাজ তা যে না-করেছে সে কিছুতেই বুঝতে পারবে না।

যা হোক সেদিন অপ্রত্যাশিতভাবে সেই গিন্নির মুখে কাজের কথা শুনে একেবারে আকাশের চাঁদ হাতে পেয়ে গেলুম। বললুম করব–কি মাইনে দেবেন?

গিন্নি বললেন, মাইনের কথা কর্তার সঙ্গে হবে। যা দস্তুর তাই পাবে।

কিছুক্ষণ কি ভেবে নিয়ে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি মাছ মাংস এসব খাও না তো?

এক হাত জিভ বের করে দুই হাত দুই কানে ঠেকিয়ে বললাম, রাম রাম, ওসব আমরা খাই না।

গিন্নি বললেন, কিছু মনে করো না–তোমাদের জাত ওইসব জিনিস খায় কিনা—

বললাম, যারা খায়, তারা খায়, আমরা ওসব জিনিস ছুঁই না।

–আমাদের বাড়িতে কাজ করতে হলে এইখানেই থাকতে হবে, রোজ স্নান করতে হবে। আমি সব-তাতেই হাঁ দিয়ে যাচ্ছি, এমন সময় বাড়ির কর্তা এসে হাজির হলেন। আমার সম্বন্ধে স্বামী-স্ত্রীতে কিছুক্ষণ কথাবার্তা হল। তারপরে কর্তা আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, কাজ করবে?

–করব হুজুর।

–কিন্তু মাইনের কথা এখন নয়। এক মাস কাজ করবার পর কিরকম কাজ কর তা দেখে মাইনে ঠিক হবে।

তখনকার মতন বিদায় নিয়ে চলে যাচ্ছিলুম, এমন সময়ে গিন্নিমা বললেন, কোথায় যাচ্ছ?

–যাচ্ছি আমার মিত্ররা যেখানে আছে সেখানে। তাদের বলতে হবে। আমার ধুতি ও একটা বালিশ আছে নিয়ে আসব। তা ছাড়া খেতে-টেতেও তো হবে।

গিন্নিমা বললেন, হ্যাঁ, জিনিসপত্র এনে এখানেই খেয়ো।

এদের কাছ থেকে তখনকার মতন ছুটি নিয়ে একরকম ছুটতে ছুটতে ধর্মশালায় এসে হাজির হলুম। চাকরি জুটেছে–দেবদুর্লভ চাকরি–কিন্তু এসে দেখি বন্ধুরা তখনও ফেরেনি। তখুনি ছুটলুম ইস্টিশানের দিকে। সেখানে একদিন এক ফেরিওয়ালাকে পৈতে বিক্রি করতে দেখেছিলুম। সেখান থেকে তিনটে ময়লা দেখে পৈতে কিনে ধর্মশালায় ফিরে এসে দেখি, সুকান্ত বসে রয়েছে–কিছুক্ষণের মধ্যে জনার্দনও ফিরে এল। আমার একটা কাজ জুটেছে শুনে বেচারারা একেবারে দমে গেল। নিজেদের সম্বন্ধে তারা অত্যন্ত হতাশা হয়ে পড়েছে দেখে আমি তাদের বোঝাবার চেষ্টা করলুম যে, একজনের কাজ হওয়া মানে আমাদের সকলেরই কাজ হওয়া। অন্য জায়গায় থাকলেও তাদের সঙ্গে প্রতিদিনই দেখা-সাক্ষাৎ হবে–দু’দিন পরে তাদেরও কাজ লেগে যাবে, ইত্যাদি।

যাই হোক, সেদিন স্নান করবার সময় ধর্মশালার কুয়োর ধারে আমাদের উপনয়ন হয়ে গেল। তিনজনে পৈতে গলায় দিয়ে সূর্যদেবকে প্রণাম করে জামা গায়ে চড়িয়ে ঘরে ফিরে এলুম। বন্ধুদের সঙ্গে কথা হল যে, প্রতিদিন দুপুরবেলা ঘণ্টাদুয়েক করে তাদের কাছে থাকতে হবে। এতে যদি মনিবরা আপত্তি করে তো চাকরি ছেড়ে দিতে হবে। সেদিন ধর্মশালাতেই তাদের সঙ্গে খেতে হল–আবার কবে একসঙ্গে বসে খাওয়া হবে তার ঠিক কি! খাওয়া-দাওয়ার পর চাকুরিস্থলের দিকে বা বাড়ানো গেল। জনার্দন ও সুকান্ত আমার সঙ্গে মনিবের বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে গেল। হঠাৎ আমাকে ছাড়তে হবে মনে করে বেচারিরা খুবই মুষড়ে পড়েছে দেখে আরও কিছুক্ষণ তাদের সঙ্গে রাস্তায় দাঁড়িয়ে বেশ করে বিড়ি টেনে মনিব-বাড়িতে ঢুকে পড়লুম।

প্রথম চাকরি-আমার জীবনের একটি প্রধান ঘটনা। আমি সারাজীবন ধরে দাসত্বই করে এসেছি। সঙ্গে সঙ্গে দাসত্বের সবরকম হীনতাই সহ্য করতে হয়েছে। দাসত্ব করতে করতে যখন তা অসহ্য হয়েছে তখন ছেড়ে দিয়ে ব্যবসা করেছি; কিন্তু দাসত্ব কিংবা ব্যবসা কিছুই আমার দ্বারা ভালো করে হয়ে ওঠেনি। সৃষ্টিকর্তা আমাকে কেন যে এখানে পাঠিয়েছিলেন, জীবনে আমার কি করা উচিত ছিল, আজও তা ঠিক করতে পারিনি। তবুও আমার জীবনের প্রথম মনিব-বাড়ির কথা এই জাতকে থাকা উচিত।

আমার প্রথম মনিব ছিলেন মহারাষ্ট্রীয় ব্রাহ্মণ। বোম্বাই, পুনা, নাসিক প্রভৃতি জায়গায় যে-সব আচারনিষ্ঠ ব্রাহ্মণ দেখতে পাওয়া যেত (এখন যায় কি না বলতে পারি না) ইনি ঠিক সেরকম ব্রাহ্মণ ছিলেন না। ওইসব জায়গাকার ব্রাহ্মণ বা ব্রাহ্মণেতর লোকদের সঙ্গে গোয়ালিয়র, ইন্দোর, কোল্হাপুর প্রভৃতি দেশীয় রাজ্যের লোকদের অনেক তফাৎ আছে আচারে ও বিচারে। বিশেষজ্ঞ মাত্রেরই জানা আছে রেয়াসতের অর্থাৎ দেশীয় রাজ্যসমূহের লোকেরা আচারে বিচারে, অশনে বসনে, বাক্যে ও ব্যবহারে বাইরের লোকদের চাইতে অনেক বেশি বিলাসী হয়ে থাকে। স্বাধীনতা পাবার পর সেখানকার কি অবস্থা হয়েছে তা ঠিক বলতে পারি না, তবে আমি যে-সময়ের কথা বলছি, অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে সেখানকার অবস্থা ওইরকমই ছিল। আমার মনিব রাজসরকারে কি-একটা চাকরি করতেন। কিন্তু চাকরি ছাড়াও তাঁর অর্থাগমের অন্য রাস্তাও ছিল–তবে সেটা কি তা আমার জানা নেই, জানবার চেষ্টাও কখনও করিনি।

মনিবের সংসার খুব বড় ছিল না। তাঁর দুটি বিবাহ এবং দুই স্ত্রী-ই তখনও বর্তমান ছিলেন কর্তাকে দেখলে মনে হত বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি হবে। কিন্তু বড় গিন্নিকে দেখলে মনে হত ষাট পেরিয়ে গিয়েছে। বড় গিন্নির মাথার মাঝখানটি ছিল একেবারে ফাঁকা। মাথার চারপাশে যে কয়েকগাছা চুল তখনও অবশিষ্ট ছিল, সেগুলি সর্বদা আঁচড়ানো ও খোঁপা-বাঁধা থাকত। রাত থাকতে উঠে তিনি পূজা-অর্চনা করতেন এবং রান্নার জন্যে ও সকলের পানীয় জল নিজ হাতে কুয়ো থেকে তুলতেন–সেই সকালেই স্নান সেরে জল-তোলা ইত্যাদি হত। রান্নাও স্বহস্তে করতেন, অবিশ্যি তাঁর সতীনও তাঁকে এ-কাজে সাহায্য করতেন। দুই সতীনে ঝগড়া বচসা হতে কখনও দেখিনি।

বড় গিন্নিকে অতিশয় দয়াশীলা বলে মনে হত। আমাকে তিনি অতি যত্নের সঙ্গে খেতে দিতেন। খাবার সময় অনেকদিন তাঁর ছেলেও আমার কাছে বসত, চাকর ও পুত্রের মধ্যে কোনো পক্ষপাতিত্ব করতে কখনও দেখিনি।

বাড়ির ছোট গিন্নি ছিলেন বয়সে তরুণী। তাঁকে ত্রিশ বছরের বেশি বলে মনে হত না। দেখতে-শুনতে মন্দ ছিলেন না। সকলের সঙ্গেই হেসে কথা বলতেন। এঁর এক মেয়ে–যাকে উপলক্ষ করে আমার এখানে চাকরি-আমি তাঁর মেয়ের বায়না সামলাতুম বলে আমার ওপরে তিনি ছিলেন ভারি সদয়। মোট কথা এক স্বামী ছাড়া তিনি বিশ্বসুদ্ধ লোককেই পছন্দ করতেন, কিন্তু স্বামীকে দেখলেই তাঁর মেজাজ যেত বিগড়ে।

মনিব অর্থাৎ বাড়ির কর্তার নাম ছিল সদাশিব। কিন্তু নাম সদাশিব হলে কি হবে, এমন তে-এঁটে লোক আমি জীবনে খুব কমই দেখেছি।

বেশ রাত থাকতে উঠে তিনি রোজ পায়খানায় যেতেন। পায়খানার কাছেই একটা বড় গামলা-গোছের পাত্র থাকত–প্রতিদিন রাতে ঘুমুতে যাবার আগে কুয়ো থেকে জল তুলে আমাকে সেই পাত্রটি ভরে রাখতে হত। কিন্তু এই বাসী জলে শৌচ-করা মনিব-মশায় মোটেই পছন্দ করতেন না। পায়খানায় যাবার আগে আমাকে ধাক্কা দিয়ে ঘুম থেকে তুলে –এত বেলা অবধি ঘুমুচ্ছি বলে তিরস্কার করতেন–বলা বাহুল্য, তখনও ঘোরতর অন্ধকার থাকত। আমি উঠে একটা ঘটির গলায় দড়ি লাগিয়ে কুয়ো থেকে জল তুলে তাঁর ঘটিতে ঢেলে দিতুম, তিনি সেই জল নিয়ে পায়খানায় ঢুকতেন। এতেও নিস্তার ছিল না, কারণ কখন তিনি শ্রীমন্দির থেকে নিষ্ক্রান্ত হবেন–সেই আশায় আমাকে বাইরে বসে থাকতে হত। প্রায় ঘণ্টাখানেক সেখানে কাটিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলে আবার জল তুলে দিতে হত ঘটির পর ঘটি। কারণ পায়খানা থেকে বেরিয়ে ভালো করে মুখবিবর পরিষ্কার না করে তিনি শুতে যেতে পারতেন না। এর পর মনিব-মশায় ফিরে যেতেন–যেদিন যেখানে শোবার পালা থাকত। সঙ্গে সঙ্গে আমাকেও সেখানে যেতে হত এবং শুয়ে পড়লে পদসেবা এবং সর্বাঙ্গ সংবাহন করতে হত প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে। ভোর হয়ে গেলে তিনি উঠে স্নানাদি করতেন এবং প্রায় দিনই তাঁকে স্নানের জল তুলে দিতে হত। স্নান সেরে কর্তা প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে পুজো-আহ্নিক করতেন। ইতিমধ্যে বৈঠকখানা বা অন্য শয়নমন্দির থেকে তাঁর বিছানাপত্র তুলে ঘর পরিষ্কার করতে হত। পুজো সেরে তিনি বৈঠকখানাঘরে ঢুকে দরজায় খিল লাগিয়ে তম্বুরার সঙ্গে গলা সাধতেন। প্রায় ঘণ্টা-দুয়েক ধরে পাড়ার লোককে ব্যতিব্যস্ত করে সামান্য কিছু জলযোগ সেরে রাজকার্যে বেরুতেন। বেলা প্রায় একটার সময় কার্য থেকে ফিরে এসে আহার করে লাগাতেন ঘুম একেবারে বেলা পাঁচটা অবধি। প্রায় প্রতি সন্ধ্যায় কখনও ছোট, কখনও বড় গান-বাজনার আসর বসততা। অনেক বড় বড় গুণী আসতেন গাইতে বাজাতে এবং তা শোনবার ও তারিফ করবার জন্যে অনেক ব্যক্তি নিমন্ত্রিত হতেন। কর্তাও ভালো গাইতেন ও কোনো কোনো দিন একা তিনিই আসর জমাতেন। বড় বৈঠকখানা-ঘরের পাশে একখানি অপেক্ষাকৃত ছোট ঘর ছিল। এই ঘরের দেওয়ালে গেলাপে মোড়া বিরাট সব তম্বুরা ঝুলত। তা ছাড়া বেঁটে লম্বা রোগা নানা আকারের খয়ের, রক্তচন্দন, গান্তেরী প্রভৃতি কাঠের তবলা আর মাটি ও তামার ওপরে রুপোলি গিলটি-করা ছোট-বড় ডুগিও সাজানো থাকত। এইসব যন্ত্র ও তা ছাড়া তবলা ঠোকবার হাতুড়ির পর্যন্ত তদ্বির আমাকে করতে হত। যেদিন বড় আসর বসততা এবং মাননীয় ব্যক্তির শুভাগমন হত, সেদিন মদ্যাদি এনে এই ছোট ঘরখানিতে জমা রাখা হত। রসিকেরা মধ্যে মধ্যে আসর থেকে উঠে এই ঘরে গিয়ে ঢুকু-ঢুকু চালাতেন। তা না হলে অধিকাংশ দিনই বড় বৈঠকখানাতে বসেই মদ্যাদি ও নানারকম ভাজাভুজি চলত। আমাদের কর্তা প্রায় প্রতিদিনই প্রচুর টেনে একেবারে ট্যা হয়ে পড়তেন। রাত্রির আসর ভাঙলে তা কোনোদিন দশটায় কোনোদিন বারোটায় কোনোদিন-বা দুটোয়–আসরের চাদর ইত্যাদি তুলে ঘর ঝাঁট দিতে হত। তারপর মনিব মহাপুরুষ আমার ওপর ভর দিয়ে ভেতর-বাড়ির দিকে অগ্রসর হতেন। দুটি উঠোন পার হয়ে সিঁড়ি ভেঙে ছাদ পেরিয়ে ছোট গিন্নির ঘর। ছোট গিন্নি তো দূরের কথা, সংসারের সব গিন্নি ই সেই রাত্রে ঘুমের কোলে আত্মসমর্পণ করেছেন। সেই রাতে দরজা ঠেঙিয়ে তাঁকে তোলা হত। সে-ভদ্রমহিলা জেগে উঠে বাতি জ্বালিয়ে দরজা খুলে আমার কণ্ঠলগ্ন মাতাল স্বামীকে দেখলেই উঠতেন জ্বলে। তার পরে শুরু হত দাম্পত্য কলহ–কবি দাম্পত্য কলহকে বহ্বারম্ভে লঘুক্রিয়া বলে উড়িয়ে দিয়েছেন, কিন্তু আমার বরাতে সবই উলটো! কারণ এক্ষেত্রে আরম্ভ হত অতি লঘুভাবে, কিন্তু বাড়তে বাড়তে শেষে ঠেঙাঠেঙি ব্যাপারে পরিণত হত। তাঁদের স্বামী-স্ত্রীতে ঝগড়া, তাতে আমার বলবার কিছু ছিল না; কিন্তু আমাকে ঠায় সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে হত, কারণ ঝগড়ার পরে কর্তামশায় শয়নমন্দিরে যদি ঢোকবার অনুমতি পেতেন তা সেইখানেই আমার দিনের কর্ম শেষ হত, নচেৎ আমায় দুর্ভোগ ভুগতে হত আরও।

ব্রাহ্মণ-সন্তানের মদ্যপানে ছিল দেবীর আপত্তি। অন্তত মত্ত অবস্থায় স্বামীকে শয়নমন্দিরে প্রবেশ করবার অধিকার তিনি দিতেন না। কিন্তু ‘দ্যাবা’র যুক্তি ছিল মাল না টেনে তরুণী ভার্যার কাছে যাওয়ার কোনো মানেই হয় না। দুজনের পক্ষেই যুক্তি ছিল, কিন্তু দ্যাবা প্রায় প্রতিদিনই তাড়িত হতেন এবং তার পরে তিনি এত ভগ্নোদ্যম ও হতাশ হয়ে পড়তেন যে, তাঁকে প্রায় কাঁধে করে নিয়ে এসে আবার বৈঠকখানায় শুইয়ে দিতে হত। এইজন্যেই ঝগড়ার যতক্ষণ একটা ফয়সালা না হয় ততক্ষণ কর্তা আমাকে ছাড়তে পারতেন না। কিন্তু বৈঠকখানায় শুইয়ে দিয়েই কি নিশ্চিন্ত হবার জোর ছিল! সেখানে তাঁর পা টিপতে ও কথার অর্থাৎ বকবকানির সায় দিতে হত। যেমন–

–এই বাঙালি! আরে এই বাঙালি!

– হুজুর!

–শালা, জবাব দিচ্ছিস নে কেন? তোকে আমি বলে রাখছি, কখনও বিয়ে করিস না। আমার দুর্দশা দেখছিস তো?

হয়তো বললুম, হুজুর, আপনি জোর করে ঢুকে পড়লেই তো পারেন।

–শালা তোর কিছু বুদ্ধি নেই। আমি জোর করে ঢুকে পড়লে বিবি বেরিয়ে পড়ে অন্য নিশি যাপন করবেন। আচ্ছা কাল যদি ঘরে ঢুকতে না দেয়, তবে পরশুই আমি আবার একটা বিয়ে করব।

এইরকম বকতে বকতে তিনি ঘুমিয়ে পড়লে তবে আমি শুতে যেতুম।

সদাশিবের আমার বয়সি এক ছেলে ছিল বড় গিন্নির দরুন, তার নাম ছিল বিনায়ক। সে ছিল বাড়ির দুলাল। দুই মা-ই তাকে খুব আদর দিতেন। বয়সের ধর্মে বিনায়কের সঙ্গে আমার বন্ধুত্বই দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। সে ইস্কুলে পড়ত এবং বিকেলবেলা বাড়িতে ফিরে জল-টল খেয়ে মাঠে খেলতে যেত। কিছুদিন বাদে সে আমাকেও খেলার মাঠে নিয়ে যেতে আরম্ভ করলে। সেখানে অনেক সমবয়সি ছেলে খেলা করত। দু-একদিন যাবার পর আমি সুকান্ত ও জনার্দনকে সেই খেলার দলে ভিড়িয়ে নিলুম। আমরা সকলেই তাদের চাইতে ভালো খেলতে পারতুম বলে সকলেরই প্রিয় হয়ে উঠতে লাগলুম। তখন ক্রিকেট শেষ হয়ে ফুটবলের মরসুম পড়ছে। সেই সময় কে ক্যাপ্টেন হবে কে সেক্রেটারি হবে–এই নিয়ে খেলার শেষে তাদের মধ্যে খুব আলোচনা হত, মধ্যে মধ্যে তারা আমাদেরও মতামত জানতে চাইত। শুধু তাই নয়, বিনায়ক ও তার বন্ধুরা তখন নতুন বিড়ি-সিগারেট টানতে শিখেছিল। তারা বাড়ি থেকে পয়সা নিয়ে আসত, আর তাই দিয়ে সিগারেট বিড়ি ভাজাভুজি খাওয়া চলত।

আমাদের এই খেলার মাঠে খুব উৎসাহী সভ্য ছিল তুক্কো। বিনায়কদের পাড়াতেই ছিল তুক্কোদের বাড়ি। সে-পাড়ার মধ্যে তুক্কোরা বেশ অবস্থাপন্ন পরিবার ছিল। তার বাবা ও ঠাকুরদা দুজনেই ছিলেন ওখানকার বড় উকিল।

খেলার মাঠে কাপ্তেনি করতে না পারলেও খেলার পরের আড্ডায় তুক্কোই ছিল কাপ্তেন। সে প্রায় রোজই বাপ-ঠাকুরদার পকেট মেরে দু’চার-আট আনা নিয়ে আসত আর তাই দিয়ে বিকেলে আমাদের মহা ভোজ হত।

তুর্কোদের সঙ্গে বিনায়কদের কি-একটা সম্বন্ধ থাকায় দুই বাড়ির মহিলারাই পরস্পরের বাড়ি যাতায়াত করতেন। একদিন তুক্কোর ঠাকুরমা আমাকে বললেন, আমার কোনো জানাশোনা লোক তাঁদের বাড়ির জন্যে দিতে পারি কি না। আমি জনার্দনের নাম করায় তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, সে কি আগে কোথাও কাজ-টাজ করেছে?

–হ্যাঁ ভরতপুরের মস্ত রইস রাজা রামসিংয়ের ওখানে কাজ করেছে।

বেশি কিছু বলতে হল না, তুক্কোদের বাড়িতে জনার্দনের কাজ হয়ে গেল, মাইনে হল তিন টাকা।

জনার্দনের কাজ হয়ে যাওয়ায় সুকান্তর হল মুশকিল। একলা সারাদিন ও সারারাত সে কাটাতে পারে না। শেষকালে রাত্রিবেলা তাকে আমাদের বাড়িতে শুতে বললুম। সে এসে শুতো বটে, কিন্তু শেষরাত্রে মনিব আমাকে ডাকতে আসার আগেই তাকে বের করে দিতে হত। কিন্তু বেশিদিন সেরকম করতেও সাহস হল না। পাছে কোনো অনর্থ ঘটে–এই ভয়ে একদিন ছোট গিন্নির কাছে সুকান্তর জন্যে আশ্রয় ভিক্ষা করা গেল। বললাম, সে রাত্রে শোবে, অন্য কোথাও চাকরি হলেই চলে যাবে। ছোট গিন্নি বড় গিন্নির সঙ্গে পরামর্শ করে সুকান্তকে সেখানে শোবার অনুমতি দিলেন।

একটু একটু করে সুকান্তকেও বাড়ির সকলে চিনে ফেললে। ক্রমে তার ওপরে একটু একটু করে ফাইফরমাশের ভারও পড়তে লাগল, অবশ্য বেশি ফাইফরমাশ করতেন মনিব-মশায়।

.

কিছুদিন এইরকম চলতে চলতে .একদিন বড় গিন্নি সুকান্তকে বললেন, তুমি কোথায় এখানে-সেখানে খেয়ে বেড়াও, আমাদের এখানেই খেলে পার। আমাদের বাড়িতে থেকে অন্য কোথাও খেলে আমাদের নিন্দা হবে যে!

এইরকম যখন চলেছে, তখন মাসকাবার হয়ে যাওয়ায় মনিবের কাছে মাইনে চাইলুম। মাইনের কথা শুনে তিনি একেবারে খাপ্পা হয়ে আমাকে প্রহার করতে উদ্যত হলেন। তারপর চোখ পাকিয়ে যা বললেন তার সোজা অর্থ হচ্ছে যে, দু-ব্যাটায় পড়ে এখানে বসে বসে দু-বেলা খ্যাট লাগাচ্ছ, আবার এর ওপরে মাইনে!! শালা বাঙালি তো ভারি নেমকহারামের জাত! ভালোভাবে এখানে খাও-দাও, থাক, মাইনের কথা তুলো না–তা হলে অন্যত্র পথ দেখ।

কিছুকাল আগে জনার্দনের যখন ও-বাড়িতে তিন টাকা মাইনে হয়েছিল, তখন ছোট গিন্নি একবার আমায় আভাস দিয়েছিলেন যে, আমিও মাসে তিন-টাকা করে পাব। কিন্তু মনিব-মহাশয়ের ওই মূর্তি দেখে বড়ই আশাহত হলুম।

রাত্রে অতি অল্প সময়ই আমি ঘুমুতে পেতুম। কারণ রাত্রি এগারো-বারোটা পর্যন্ত মনিবের ঘরে চলত হুল্লোড় গান ও আড্ডা। সেই ঘর পরিষ্কার করে মনিবকে বহন করে অন্তঃপুরে নিয়ে যাওয়া ও সেখান থেকে আবার নিয়ে আসা–এই করতেই রাত্রি প্রায় একটা বাজত। ওদিকে বেশ রাত থাকতেই উঠতে হত মনিবকে পায়খানার জল দেবার জন্যে। কয়েক ঘণ্টা সময়ের মধ্যে প্রথম আধঘণ্টা আমার কাটত ওই তিনটাকা মাইনের ধ্যানে। টাকাটা পেলে জমানো হবে কি খরচ করা হবে! ওই তিনটাকার মধ্যে কতখানি খরচ ও কতখানি জমানো সম্ভব হতে পারে তা নিয়ে নিজেদের মধ্যেও আলোচনা কিছু কম হত না। আমরা যে চিরদিন চাকরি করব না এটা একরকম ঠিকই ছিল। চাকরি-বাকরি করে কিছু জমিয়ে নিয়ে ব্যবসা করব বলেই যে-কোনো চাকরি নিতে দ্বিধা করিনি। কিন্তু তার ফল এই হল দেখে সত্যিই বড় দুঃখ বোধ হল।

এদের বাড়ি সেই শেষরাত্রি থেকে রাত্রি বারোটা-একটা অবধি চাকরি–তার ওপর খাওয়া ছিল অতি জঘন্য। জঘন্য এই জন্যে বলছি যে, সাধারণ গৃহস্থ মহারাষ্ট্রীয় ব্রাহ্মণের বাড়িতে এক-আধদিন শখ করে খাওয়া চলতে পারে–সে-খাওয়া বেশিদিন খেলে বাঙালির ছেলে বাঁচে না।

আমি সুকান্তর সঙ্গে পরামর্শ করে ঠিক করলুম, বিনা-মাইনের এই চাকরি আর করব না। কিন্তু কর্তা যতই নির্দয় হোন না কেন, দুই মা-ই ছিলেন দয়াবতী। আমরা চলে যাব শুনে তাঁরা আপত্তি করতে লাগলেন। ছোট মা বলতে লাগলেন, তোমার রূপ ধরে ভগবান আমার লক্ষ্মীকে প্রাণে বাঁচিয়েছেন। তুমি অসন্তুষ্ট হয়ে চলে গেলে আমাদের অকল্যাণ হবে। তুমি মাসে মাসে যাতে ঠিকমতো মাইনে পাও তার ব্যবস্থা আমি করে দিচ্ছি–শুধু তোমার নয়, কান্তও যাতে মাইনে পায় তারও বন্দোবস্ত আমি করছি।

সে-সময় গ্রহও বোধ হয় সুপ্রসন্ন ছিল, কারণ আমরা চলে যাব শুনে বিনায়ক এমন হাঙ্গামা লাগালে যে তার বাবা ‘বাপ বাপ’ বলে আমার তিন টাকা মাইনে তো চুকিয়ে দিলেই, সুকান্ত, যার মাস পুরতে তখনও দেরি তাকেও তিন টাকা দিয়ে দিলে।

একসঙ্গে ছ’টি টাকা তখনি আমাদের বিস্কুটের বাক্সে বন্দি হল।

আমরা বিকেলবেলায় খেলা সেরে কিছুক্ষণ বাজারে ঘুরে বাড়ি ফিরতুম। কারণ সেখানে পান সিগারেট ও নানারকম খাদ্যদ্রব্যাদি পাওয়া যেত। সিগারেট দ্রব্যটির প্রতি তখন সরকারের এত কড়া নজর পড়েনি। ব্যাটল এক্স, রেড ল্যাম্প, পেডরো, কলম্বিয়া প্রভৃতি চলনসই সিগারেটের দাম ছিল দু’পয়সা প্যাকেট আর রেলওয়ে, ট্যাবস প্রভৃতি ভালো সিগারেটের দাম ছিল চার-পাঁচ পয়সা প্যাকেট অর্থাৎ দশটা। মোট কথা চার আনা পয়সা জুটলে আমাদের আট দশজনের ভাজা-ভুজি ও তৎসহ পান-সিগারেট অবধি চলত।

আমাদের রাস্তাতেই একটা বড় হোটেল পড়ত। হোটেলটা ছিল মুসলমানদের এবং নানারকম মাংসের খাবার থালা করে বাইরে সাজানো থাকত। একটা থালায় বড় বড় ভাজা মাছের টুকরো থাকত। একজন লোক সামনে বসে মোগলাই পরোটা ভাজত। সে যে কতরকমের কায়দায় হাত ঘুরোতে থাকত তা আর কি বলব! লোকটা পরোটা ভাজছে কি মুগুর ভাঁজছে তা বোঝা মুশকিল হত। সেই মচমচে ভাজা টাটকা পরোটা তাওয়া থেকে নামিয়ে রাখতে-না-রাখতে বিক্রি হয়ে যেত। আমরা রোজই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এই পরোটা-ভাজার কায়দা দেখতুম।

একদিন সন্ধ্যাবেলা সেইরকম পরোটা-ভাজা দেখছি, এমন সময় বিনায়ক তুক্কোকে বললে, একদিন বেশ করে মাংস দিয়ে পরোটা খেতে হবে, তুক্কো।

দেখলুম, তুক্কোর তাতে কোনো আপত্তি নেই। জিজ্ঞাসা করে বুঝতে পারা গেল যে, খাবার ইচ্ছেটা ষোলো-আনা থাকলেও তারা মাছ মাংস কখনও খায়নি। তার প্রথম কারণ এই যে, বাড়িতে যদি কেউ ঘুণাক্ষরে জানতে পারে তা হলে জ্যান্তে ছাল ছাড়িয়ে নেবে। বিশেষ করে এখন তাদের পৈতে হয়ে গেছে। পৈতে হবার আগে মাছ-মাংস খাওয়ার প্রায়শ্চিত্ত আছে, কিন্তু পৈতে হবার পর সে-পাপের প্রায়শ্চিত্ত তুষানল। অথচ পৈতে হবার পর থেকেই ওই পাপের প্রতি আকর্ষণ তাদের হয়েছে প্রবল। দ্বিতীয় বাধা হচ্ছে, দোকানে গিয়ে মাছ কিংবা মাংস কেনবার মতন সাহস আজও তারা সঞ্চয় করে উঠতে পারেনি।

সেদিন আমাদের সঙ্গে গুটি-চারেক ছেলে ছিল। সুকান্ত বললে, যদি পয়সা থাকে তো আমাকে দাও, আমি কিনে আনছি।

আমাদের তুকাজী অর্থাৎ তুক্কো তখুনি পকেট থেকে একটা সিকি বের করে ফেললে। দোকানদার এতক্ষণ আমাদের বেশ করে লক্ষ করছিল। জনার্দন গিয়ে মাছ-ভাজা চাইতে সে একটা কাগজের ঠোঙায় বেশ করে মুড়ে-ঝুড়ে মাল দিলে। তারপরে সেই ভাজা-মাছ খাওয়া নিয়ে এক ব্যাপার! দুটি ছেলে তো মুখে দিয়েই ওয়াক ওয়াক করে বমি করে ফেলে দিলে। আমাদের বিনায়ক বেশ করে কাঁটা বেছে তিন-চারখানা ভাজা মেরে দিলে। গপ গপ করে খেতে গিয়ে তুক্কোর গলায় বিঁধল কাঁটা। শেষকালে সে যায় আর কি! আমি তার মুখের মধ্যে হাত পুরে দিয়ে গলা থেকে ইয়া বড় একটা কাঁটা বের করলুম। তার থুথুর সঙ্গে রক্ত বেরুতে লাগল। গলার যন্ত্রণা ও রক্ত দেখে সে তো ভড়কে গেল। তারপরে একজায়গা থেকে গরম চা খেয়ে তুক্কো একটু সুস্থ বোধ করায় সেদিন যে যার বাড়ি চলে গেল।

তুক্কোর গলার ব্যথা সারতে ক’দিন কেটে গেল। তারপর একদিন আমরা গরম টিকিয়া কাবার কিনে খেলুম। কাবাব সকলের মুখে অমৃতের মতো লাগল। এমনকি সেদিন মাছ খেয়ে যারা জলচরের শত নিন্দা করেছিল, কাবার খেয়ে তারা পন্টক-নন্দনের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠল।

দিনে দিনে এই সন্ধ্যাযাত্রায় আমাদের সহযাত্রীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে লাগল। শেষকালে আমরা অন্য রাস্তা দিয়ে ঘুরে ঘুরে বাড়ি ফিরতে লাগলুম–আমাদের সঙ্গে কিছুক্ষণ ঘুরে অন্যরা সবাই কেটে পড়লে তখন আবার বাজারে ফিরে গিয়ে কাবাব খাওয়া হতে লাগল।

একদিন তুক্কো বাড়ি থেকে গোটা-চারেক টাকা মেরে নিয়ে এল। আগেই বলেছি, তার বাবা ও ঠাকুরদা দুজনেই ওখানকার পসারওয়ালা উকিল ছিলেন। তাঁরা দুজনে আলাদা আলাদা জায়গায় টাকা রাখতেন আর তুক্কো দু-জায়গা থেকেই কিছু কিছু সরাত। এতদিন সে চার-আনা আট-আনা কখনও বা পুরো একটা টাকা মেরে আনত; কিন্তু কথায় বলে ‘ঘটি-চোর বাটি-চোর হতে-হতে সিঁদেল চোর’–সেদিন একেবারে চার-চারটে টাকা এনে সে বললে, আজ হোটেলে ঢুকে পরোটা ও মাংস খেতে হবে।

মাংসের গন্ধে গন্ধে আরও দুটি ছেলে জুটে গেল আমাদের সঙ্গে।

খেলা-টেলা ফেলে বেশ বেলাবেলিই আমরা হোটেলের সামনে এসে দাঁড়ালুম। কিন্তু হোটেলের মধ্যে ঢুকতে তাদের কারুর আর সাহস হয় না। আমরা তিনজন অর্থাৎ আমি জনার্দন ও সুকান্ত যতবার হোটেলের দরজার দিকে এগিয়ে যাই ওরা চারজন আমাদের পিছু পিছু খানিকটা এসে আবার ফিরে যায়। এমনি দু-চারবার করতেই হোটেলের একটি ছোকরা-মতন চাকর বেরিয়ে এসে আমাকে ডাকলে, বাবুসাব শুনিয়ে!

ছেলেটি হোটেলের পাশেই একটা গলি দেখিয়ে দিয়ে বললে, আপনারা ওই গলিতে ঢুকে খানিকটা এগিয়ে গেলেই একটা দরজা দেখতে পাবেন, সেইখান দিয়ে চলে আসুন,

ছেলেটির নির্দিষ্ট পথে আমরা সবাই টুপ টুপ করে গলিতে ঢুকে পড়লুম। তারপর একটু এগিয়ে গিয়ে একটা দরজা দিয়ে ঢুকেই দেখি, এক বিরাট ব্যাপার–সেটা হচ্ছে হোটেলের পেছনের একটা ঘর। ঘরখানা বেশ বড়। বড় রাস্তা থেকে হোটেলের যে-ঘরটা দেখতে পাওয়া যায় প্রায় তত বড়ই হবে। ঘরের মধ্যে লোকের অন্ত নেই–সকলেই হিন্দু তারা। যেসব মাংসলোলুপ হিন্দু সামনের দিক দিয়ে ঢুকতে ভয় পায় অথবা মুসলমানদের সঙ্গে একজায়গায় বসে খেতে যাদের আপত্তি আছে, তাদের জন্যে এই পেছনের দরজা খোলা হয়েছে। আমরা একটু কোণ-গোছের জায়গা দেখে বসতে-না-বসতে সেই ছেলেটি এসে জিজ্ঞাসা করলে, কি দেব তোমাদের?

–আপাতত পরোটা-মাংসই তো চলুক।

তক্ষুনি গরম খাবার এসে গেল। দু-একজন বাদে সকলকেই মাংস-খাওয়া শেখাতে হল। কেউ মাংসের টুকরো হাতে করে গায়ের ঝোলটুকু চুষেই ফেলে দিচ্ছিল, কেউ-বা চিবিয়ে ছিবড়ে ফেলে দিতে লাগল–চিবিয়ে গিলে ফেলতে বলায় কেউ কেউ বিষম বিপদে পড়ে গেল। যা হোক, একটু চেষ্টা করতেই তারা দিব্যি ওড়াতে আরম্ভ করে দিলে। তুক্কো উপরি-উপরি তিনপ্লেট কারি ও তিনটি পরোটা মেরে দিলে। আমাদের বিনায়ক দেখলুম এ-বিষয়ে খুবই ওস্তাদ–অথচ সেই মাছ খাওয়ার দিনের মতন সেদিনেও সে বললে, এর আগে মাংসের সঙ্গে এমন সাক্ষাৎ-পরিচয় তার হয়নি।

যাই হোক, সেখানে বসে ঘণ্টাখানেক ধরে দম ভোর-খাওয়া গেল। এরই মধ্যে আমাদের চেনা একজন মহা নিষ্ঠাবান সৎ-ব্রাহ্মণ হোটেলে ঢুকে খেয়ে বেরিয়ে গেল। আমরাও খাওয়া শেষ করে পয়সা চুকিয়ে দিয়ে আবার সেই রাস্তা দিয়ে বেরিয়ে এলুম।

সেদিন আবার কর্তার একটি বড় জলসা ছিল। আমরা বাড়ি ফিরে দেখি, তিনি নিজেই বৈঠকখানা ঝাড়ামোছা করছেন। আমাদের দেখেই তো মহা তম্বি লাগিয়ে দিলেন। এই নিয়ে বাপ-ব্যাটায় খুব খানিকটা খচাখচি হয়ে গেল। আমরা বেগতিক দেখে, কর্তা কিছু বলবার আগেই বৈঠকখানা পরিষ্কারের কাজে লেগে গেলুম। ও-কাজ আগে থেকেই আমাদের জানা ছিল। কোথায় কি পাততে হবে, তম্বুরা কোথায় থাকবে, তবলা হাতুড়ি কোথায় থাকবে–সব ঝেড়েঝুড়ে সাজাতে লেগে গেলুম। কর্তা ওদিকে মৌজের ব্যবস্থাপনায় মন দিলেন। এদিককার কাজ সারা হতেই আমাদের ছুটতে হল সোডা-লেমনেডের দোকানে। বোম্বাইয়ের কে একজন বড় গাইয়ে আসবেন বলে কর্তা একটু বিশেষ ব্যবস্থা করেছিলেন সেদিন। সন্ধ্যা হবার আগেই হোমরা চোমরা নিমন্ত্রিতবর্গ ইয়া-ইয়া পাগড়ি মাথায় বেঁধে জলসায় আসতে লাগলেন। অন্য জলসার দিন বিনায়ক প্রায়ই বাড়ির ভেতরে থাকত, কিন্তু সেদিনকার বিশেষ ব্যবস্থায় বিনায়কও আমাদের সঙ্গে আছে। আমরা কারুর পাগড়ি দেখে হাসছি কখনও বা বাইরে বেরিয়ে গিয়ে দু-টান সিগারেট ফুঁকছি, সময়টা বেশ আনন্দেই কাটছিল–এমন সময় তুক্কোর বাড়ি থেকে তারই সম্পর্কিত এক খুড়ো হন্তদন্ত হয়ে এসে বিনায়ককে ডেকে নিয়ে গেল। লোকটা বিনায়ককে তাদের ভাষায় ধমকের সুরে কি সব বলতে লাগল। দেখলুম, তার মুখখানা একেবারে শুকিয়ে গেল।

বিনায়ক চলে যাবার একটু পরেই আমন্ত্রিত সেই গাইয়ে সদলবলে এসে উপস্থিত হলেন। আদর আপ্যায়নের পর যন্ত্রাদি বেঁধে গান শুরু হল–সেই হেঁড়ে গলায় হ্যাঁ র‍্যা র‍্যা র‍্যা–ত্যা র‍্যা র‍্যা র‍্যা–গান। শ্রোতারা কেউ তারিফ করতে লাগল, কেউ-বা মন্ত্রমুগ্ধের মতন চুপ করে বসে রইল।

ইতিমধ্যে আমি ও সুকান্ত-জলসা ছেড়ে বিড়ি ফোকবার জন্যে রাস্তার দিকে যাচ্ছি এমন সময় একদল লোক, তার মধ্যে স্ত্রীলোকের সংখ্যাও নেহাত কম নয়–এসেই আমাদের দুজনেরই দুই বাহু জোর করে চেপে ধরে মহারাষ্ট্রীয় ভাষায় কি সব বলতে লাগল।

এই কয়েকদিন ওদের বাড়ি কাজ করে সে-ভাষায় যতখানি পাণ্ডিত্য লাভ করা গিয়েছিল তাতে বুঝতে পারলুম, লোকগুলো যা বলছে তা বিশেষ সুবিধার কথা নয়।

দেখলুম, দুজন লোক বিনায়ককেও সেইরকম ভাবে ধরেছে। লোকগুলো সেইরকম ভাবে ধরে টানতে টানতে আমাদের বৈঠকখানা ঘরের দরজা অবধি নিয়ে এল। কিন্তু সেখানে আসর তখন খুবই সরগরম, দরজার দিকে মনোযোগ দেবার মতন মেজাজ তাদের নেই। তার ওপর বড় জলসা হবে বলে, কর্তা আগে থাকতেই বড় বড় পাত্র মেরে, আসরের মধ্যিখানে চোখ বুজে বসে গান উপভোগ করছিলেন। সেখানে বিশেষ সুবিধা হবে না বুঝে তারা আমাদের টানতে টানতে বাড়ির ভেতরে নিয়ে চলল। সিঁড়ি দিয়ে ওঠবার সময় তারা কি-সব বলে চেঁচাতেই দুদিক থেকে দুই গিন্নি একরকম ছুটতে ছুটতে বেরিয়ে এলেন। এইখানে ব্যাপারটা যা শোনা গেল তা এই–আজ বিকেলে তুকাজী বাড়িতে ফিরে ভয়ানক পেট কামড়াচ্ছে বলে শুয়ে পড়েছিল। পেট-কামড়ানি অসহ্য হওয়ায় যোয়ানের আরক ইত্যাদি খাওয়ানো হয়, কিন্তু তাতেও যন্ত্রণার উপশম হচ্ছে না দেখে চাওন-সাহেবকে ডাকতে পাঠানো হয়। চাওন (চ্যবন ) বিলেত-ফেরত ডাক্তার, তুক্কোর ঠাকুরদাদার বিশেষ বন্ধু। কিন্তু চাওন-সাহেব এসে পৌঁছবার আগেই আমাদের অতি খলিফা তুকাজী হড় হড় করে তিন-প্লেট মাংস ও তিনটি পরোটা উদ্‌গার করে ফেলেন। ব্রাহ্মণের ছেলের পেট থেকে তিনটি সাপ ও একডজন ব্যাঙ বেরুলেও বাড়ির লোকেরা এতটা আশ্চর্য হতেন না। তাকে জেরা করায় সে আমাদের তিনজনের ও বিনায়কের নাম করে দিয়েছে।

বিনায়ক চেঁচাতে লাগল, তুক্কোর ওসব মিছে-কথা। আমরা তিনজন কিংবা সে ওসব দ্রব্য স্পর্শ পর্যন্ত করিনি।

তুক্কোর বাড়ির লোকদের মুখে ওই বিবরণ শুনতে-না-শুনতে দুই গিন্নি একেবারে একসঙ্গে আমাদের–দূর দূর-বেরো, বেরো–করতে আরম্ভ করে দিলে। বিনায়ক চেঁচিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলতে বলতে লাগল, সব মিছে-কথা–তুক্কোর সব মিছে-কথা–

বারান্দার এক কোণে একটা হাঁড়িতে বড় গিন্নির ‘রেডি-মেড’ গোবর-জল থাকত। এই চেঁচামেচি হাঙ্গামার মধ্যে তিনি চট করে সেই হাঁড়িটা তুলে নিয়ে এসে একেবারে বিনায়কের মাথায় ঢেলে দিলেন। ওদিকে তুক্কোর বাড়ির মেয়েরা আমাদের উদ্দেশে চেঁচাতে লাগল–ঝ্যাঁটা মেরে বিদেয় কর–দুধ-কলা দিয়ে এইসব সাপদের কখনও পুষতে আছে!

শেষকালে উপস্থিত স্ত্রী-পুরুষ সবাই মিলে আমাদের ‘দূর দূর’ করতে আরম্ভ করে দিলে। সদ্যক্রীত একখানা শতরঞ্চি বগলদাবা করে আমরা বাইরের দিকে পা বাড়াতেই বিনায়ক লাফিয়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদতে-কাঁদতে বলতে লাগল, যাস নে–ও বাঙালি, তুই যাস নে

তুক্কোর বাড়ির পুরুষেরা জোর করে তাকে ছাড়িয়ে নিতে লাগল। এর মধ্যে তার গর্ভধারিণী মাঝে মাঝে চড়-চাপড়ও দিতে লাগলেন।

বিনায়কের কান্না, দুই গিন্নির চিৎকার, তুক্কোর বাড়ির পুরুষ ও স্ত্রীলোকদের ভর্ৎসনা ও গঞ্জনা, তার ওপরে নীচের গায়কের বাট, তখন ও কর্তবে মিলে বাড়িটা একেবারে নরককুণ্ডে পরিণত হল। ব্যাপার দেখে সরে পড়াই আমরা সমীচীন বোধ করলুম।

বাইরে এসে দেখি, একটু দূরে অন্ধকারে-গা-ঢাকা দিয়ে জনার্দন দাঁড়িয়ে আছে। সে বললে, তুক্কো আমাদের নাম করতেই আমার খোঁজ পড়েছিল, কিন্তু আমি সরে পড়ায় আর খুঁজে পায়নি।

আর কালবিলম্ব না করে ছুটলুম সেই ধর্মশালার দিকে।

পঞ্চাশ বছর আগের জীবন-প্রভাতের সেই দুর্দিনের বন্ধুর মুখখানা জীবনের সায়াহ্নে আজ ভালো করে মনে পড়ছে না। চোখের দৃষ্টির মতন স্মৃতির পরকলাও আজ আবছায়ায় অস্পষ্ট হয়ে এসেছে। তবুও বিস্মৃতির কুহেলিকা ভেদ করে সেই রুদ্যমান বালকের মুখের একটা অস্পষ্ট ছবি মনের মধ্যে ভেসে উঠছে–আর ভাবছি, আজও কি সে বেঁচে আছে? যদি থাকে তো, এই মিলন, শোক, হাসি ও অশ্রুভরা পৃথিবী তার সঙ্গে কিরকম ব্যবহার করলে! জীবনে বহুবার মনে হয়েছে তার কথা, কতবার মনে করেছি, একবার তার খোঁজ করি; কিন্তু তা আর হয়ে ওঠেনি। আজ এই শেষবারের মতন তাকে আমার হৃদয়ের অভিনন্দন জানিয়ে গেলুম।

.

এমনি করে ঘুরে ঘুরে কখনও পথে, কখনও ঘাটে, কখনও দীনের কুটিরে, কভু-বা ধনীর অট্টালিকায়,–কখনও ট্রেনের কামরায় আমাদের দিনগুলি কাটতে লাগল। এমনই করে পাক খেতে খেতে একদিন সন্ধ্যার প্রাক্কালে আমরা জয়পুর রাজ্যের রাজধানীতে এসে উপস্থিত হলুম।

স্টেশনে থেকে বেরিয়ে একটু দূরেই একটা গতাঁর মতন ঘর একপয়সায় ভাড়া করা গেল। ঠিক করলুম, রাতটা সেখানে কোনো রকমে কাটিয়ে কাল শহরের ভেতরে ঢোকা যাবে।

তখন প্রকৃতির মধ্যে শীতান্তের সাড়া পড়ে গেছে। আকাশের রঙ আর পৃথিবীর ঢঙ একটু একটু করে বদলাতে আরম্ভ করেছে। যে-গাছ পাতা ঝরে ন্যাড়া হয়ে গিয়েছিল তার ডালে ডালে নতুন পাতা গজিয়ে উঠেছে, যে-গাছ শুকনো পাতা নিয়ে তখনও ঋতুরাজের অপেক্ষায় ছিল সেগুলো থেকে বাতাসের ঝোঁকে-ঝোঁকে ঝাঁকে-ঝাঁকে পাতা উড়তে আরম্ভ করেছে পাখির মতন।

শহরের মধ্যে ঢুকে তো একেবারে অবাক হয়ে গেলুম। এমন পরিষ্কার সোজা রাস্তা অন্য কোনো শহরে আর দেখিনি–সে যেন ছক কেটে তৈরি করা হয়েছে। রাস্তার দু’দিকে সব বাড়িগুলোরই একরকমের রঙ। বাড়িগুলো ঠিক যেন ছবি। রাস্তা চলতে চলতে মনে হয় যেন রঙ্গমঞ্চের দৃশ্যপটের সামনে চলাফেরা করছি।

রাস্তা দিয়ে দলে দলে মেয়ে চলেছে। কঠিন শীতের শেষে তারা পুরাতন মোটা বসন ছেড়ে নতুন কাপড় পরেছে। সে কি রঙের বাহার –শুভ্রবসনবিলাসী বাঙালির চোখ ঝলসে যায় তার বৈচিত্র্যে। ঝকঝকে নানাবর্ণের লহেঙ্গা অর্থাৎ ঘাগরা, উত্তরার্ধে রঙিন চোলি, তার ওপরে বিচিত্র রঙের ওড়না–কোনো কোনো ওড়ার জমিতে জরির ফুল, কোনোটায় বা জরির পাড়–সূর্যের আলোতে সেগুলো ঝকমক করছে। বড় বড় গেট পার হয়ে শহরে ঢুকতে হয়। একটা রাস্তায় দেখলুম, ফুটপাথের ওপর প্রায় আধমানুষ সমান উঁচু করে ছোলা, মটর, মুগ ও অন্যান্য শস্যের দোকান বসে গিয়েছে। রাজ্যের গোলা-পায়রা ও টিয়া-পাখি এসে সেইসব শস্য খাচ্ছে। দোকানদারের হাতে একটা হাতদেড়েক লম্বা লাঠি–তাই দিয়ে পায়রা ও অন্যান্য পাখি তাড়ানো হচ্ছে। পাছে তাদের অঙ্গে আঘাত লাগে সেইজন্যে লাঠির ডগায় আবার খানিকটা ন্যাকড়া বেঁধে নেওয়া হয়েছে।

সনাতন এক্কা-গাড়ি আছে বটে, কিন্তু তা ছাড়াও আর-একরকমের বলদে-টানা গাড়ি দেখলুম, যার নাম রথ। চমৎকার রঙিন-চাঁদোয়া-দেওয়া গাড়ি, তার মধ্যে একজন কি দুজন বসবার জায়গা আছে–বাকিটা সমস্তই অলঙ্কার অর্থাৎ বাহার কিংবা বাহুল্য। বলদের চেহারাই বা কি সুন্দর! যেমন বিরাট তাদের চেহারা, তেমনই হৃষ্টপুষ্ট চিকন তাদের দেহ–সর্বাঙ্গে লাল, নীল, বাসন্তী রঙের ছাপমারা, দুটি সুদৃশ্য তেল-মাখানো চকচকে বড় শিং, আবার শিংয়ের ডগায় পেতলের অলঙ্কার। তাদের চলবার ঢঙ-ই বা কি সুন্দর! যুগল বলীবর্দ যখন একতালে ঘাড় নেড়ে নেড়ে সর্বাঙ্গ দুলিয়ে রথ টেনে নিয়ে যায় তখন মনে হয়, নিজেদের রূপ ও পোশাক সম্বন্ধে তারা অত্যন্ত বেশিমাত্রায় সচেতন।

নব-বসন্তে নতুন দেশে সেই প্রাচুর্যের মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেললুম। বাড়ি থেকে বেরিয়ে অবধি এতদিন আপনাকে নিয়ে অত্যন্ত ব্যস্ত ও বিব্রত ছিলুম। অবিশ্যি প্রয়াগের গঙ্গা ও যমুনার সঙ্গম, আগ্রার তাজমহল ও অন্যান্য স্থাপত্যের নিদর্শন মনকে আকর্ষণ করেছিল বটে, কিন্তু তারা আমাকে আত্মসাৎ করতে পারেনি। তখনও ধরা পড়বার ভয় ছিল, কোনো কাজকর্ম যদি না জোটে ভবিষ্যতে কি করে চলবে! কোথায় ব্যবসা করব, কিসের ব্যবসা ফাঁদব, টাকা কোথায় পাব–সব কিছুর মধ্যেই নিরন্তর এই চিন্তা মনের মধ্যে গুনগুন করছিল। কিন্তু জয়পুরে এসে প্রকৃতির এই পরিবেশের মধ্যে পড়ে নিজেকে একেবারে ভুলে গিয়ে আমিও এরই একটা অঙ্গবিশেষে দাঁড়িয়ে গেলুম।

মনের এই অবস্থাটার সম্যক পরিচয় দিতে পারলুম কি না বলতে পারি না। সে একটা অবস্থা, যে-সময় মনটার কেবল গ্রহণ করবার ক্ষমতাই থেকে যায়, নিজে থেকে কিছু ভাববার ক্ষমতা একরকম লোপ পেয়ে যায়। আমার সঙ্গী যারা ছিল তাদের কথা কিছু বলতে পারি না। তারা কি ভাবছে কিংবা তাদের কি ইচ্ছে তা জানবারও কোনো রকম উৎসাহ নেই–কেবল নেহাত প্রয়োজনীয় আহার ও রাত্রের আশ্রয় ছাড়া আর কোনো ভাবনাই নেই। সমস্ত দিন শহরে ঘুরে বেড়াই, দাঁড়িয়ে কোনো জিনিস দেখছি তো দেখছিই–হয়তো অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছি, যা দেখছিলুম তা কখন চলে গেছে–শুধু দাঁড়িয়েই আছি, মনের মধ্যে থেকে কোনো চিন্তাই উঠছে না। চোখে জিনিস প্রতিফলিত হচ্ছে বটে, কিন্তু ভেতরে কিছু বহন করে নিয়ে যাচ্ছে না।

শহরের ঠিক বাইরেই রামনিবাসবাগ নামে চমৎকার বাগান। এই বাগানের মধ্যে পশুশালা ও সুদৃশ্য পাথরের অট্টালিকায় যাদুঘর। কলকাতার তুলনায় এই যাদুঘরে কিছুই নেই বললেই হয়। বাড়িখানার ছাতে উঠে আমরা ঘুরে বেড়াতুম। শুধু ছাত নয়, সেখানে যত উঁচু ও দুর্গম জায়গা আছে সেখানে উঠে দৃষ্টি প্রসারিত করে দিতুম দূর-দূরান্তরে। কখনও বা যাদুঘরের কোনো ছায়া-শীতল জায়গায় পড়ে লাগাতুম ঘুম একেবারে সন্ধ্যা অবধি। কখনও বা বাগানের চিড়িয়াখানায় পশু দেখে-দেখেই দিন কেটে যেত। সেদিন সে-চিড়িয়াখানা ছিল অত্যন্ত মামুলি–পরে অবশ্য তার অনেক উন্নতি হয়েছে। বাগানে ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে পড়লে কখনও গাছের তলায়, কখনও ঝোঁপের পাশে ছায়ায় পড়ে ঘুমিয়েছি।

এমনই করে স্রোতের মুখে কুটোর মতন উদ্দেশ্যহীন হয়ে যখন ভেসে চলেছি সেই সময়ে একদিন সকালে এক খাবারের দোকানে বসে খেতে খেতে দু-তিনজন লোকের মুখে শুনলুম যে, শহর থেকে কিছু দূরে এক ধনীর বাড়িতে একজন সন্ন্যাসী এসেছেন, তাঁর বয়স পাঁচ-শো বছর। একজন বললে যে, সে নিজে গিয়ে সন্ন্যাসীকে দেখে এসেছে।

জায়গাটা সেখান থেকে কত দূরে এবং কি করে সেখানে যেতে হয় জিজ্ঞাসা করায় সে বললে, উট কিংবা ঘোড়ার পিঠে চড়ে যেতে পার। তোমরা তিনজনে মিলে একটা উট ভাড়া করলে পাঁচ-ছ’টাকার বেশি নেবে না। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই মহারাজের চরণ দর্শন করে ফিরে আসতে পারবে।

সেখানে যাদের বাড়িতে সন্ন্যাসী আছেন তারা দেখতে দেবে কি না জিজ্ঞাসা করায় সে বললে, নিশ্চয় দেবে।

লোকটি আরও বললে যে, সন্ন্যাসীর নাম হচ্ছে সাধু-মহারাজ। তিনি সেখানকার সরকারের অর্থাৎ রাজার গুরু। তাঁকে যারা দেখতে যাবে তাদের থাকবার স্নান করবার ও খাবার ব্যবস্থা ওই রাজ-সরকার থেকেই হয়েছে। তোমরা দর্শন করতে গেলে রাজার হালে সেখানে থাকতে পাবে।

লোকটি সাধু-মহারাজ সম্বন্ধে অলৌকিক কাহিনি বলতে লাগল। সন্ন্যাসীর কথা শুনে তাঁকে দেখতে যাবার ইচ্ছা প্রবল হল বটে, কিন্তু পাঁচ-ছু’-টাকা ভাড়া লাগবে শুনে বাসনা আপনিই চুপসে গেল। কিন্তু লোকটা আবার বললে, আপনারা ইচ্ছা করলে হেঁটেও যেতে পারেন। অনেক ভক্ত পঞ্চাশ-ষাট মাইল পথ হেঁটে মহারাজকে দর্শন করতে যাচ্ছে–অনেক স্ত্রীলোক পর্যন্ত। ‘যাব কি যাব-না’ দোলায় মন যখন দুলছে তখন লোকটির সঙ্গী বললে, আপনারা বাংগাল-দেশের লোক তো? মহারাজের একজন বাংগালী চেলাও আছেন।

–কি বললে! বাঙালি চেলাও আছেন?

– হ্যাঁ।

–তিনি সেইখানেই আছেন?

–হ্যাঁ, তাঁকে নিজের চোখে দেখেছি। কথা বলেছি, বড় সাধুলোক তিনি।

আর বেশি বলতে হল না-এ পরেশদা না হয়ে যায় না। আমরা তাদের কাছে ভালো করে ঠিকানা জেনে সকালেই বেরিয়ে পড়বার ব্যবস্থা করলুম।

সকল অধ্যায়

১. ১.১ মহাস্থবির জাতক – প্ৰথম পৰ্ব
২. ১.২ মা বড় উদ্বিগ্ন
৩. ১.৩ এক সের মাছ উড়ে গেল
৪. ১.৪ স্তব্ধ বনস্থলীতে
৫. ২.১ মহাস্থবির জাতক – দ্বিতীয় পর্ব
৬. ২.২ ময়রার দোকানে
৭. ২.৩ দু-তিন ঘণ্টা ঘুমিয়েছিলুম
৮. ২.৪ গাড়ি চলেছে
৯. ২.৫ নতুন করে জীবনযাত্রা শুরু
১০. ৩.২ শহরের ঘিন্‌জি থেকে দূরে
১১. ৩.১ মহাস্থবির জাতক – তৃতীয় পৰ্ব
১২. ৩.৩ আগ্রায় রাত্রে শীত
১৩. ৩.৪ রাত্রে আহারের কি হবে
১৪. ৩.৫ ভারতবর্ষ স্বাধীন হবার আগে
১৫. ৩.৬ জয়পুর শহরে
১৬. ৩.৭ পাশাপাশি শুয়ে
১৭. ৩.৮ ভাগ্য-পরিবর্তনের কথা
১৮. ৪.১ মহাস্থবির জাতক – চতুর্থ পর্ব
১৯. ৪.২ সন্ন্যাসী চলে যাবার পরে
২০. ৪.৩ রাস্তাটাকে যতখানি সহজলভ্য
২১. ৪.৪ ঘণ্টাখানেক কাজ করবার পর
২২. ৪.৫ কালীর চেহারাটা সত্যিই খারাপ
২৩. ৪.৬ হরিদ্বার থেকে গুরুদেব আসছেন
২৪. ৪.৭ মীর-সাহেব এসে হাজির
২৫. ৪.৮ কোথা দিয়ে আগ্রা যেতে হবে
২৬. ৪.৯ জানলা-দরজা হাট করে খোলা
২৭. আমার জীবনে মহাস্থবির প্রেমাঙ্কুর – প্রভাতচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়
২৮. পরিমল গোস্বামীর তিনটি প্রবন্ধ
২৯. মরমী কথাশিল্পী – দিলীপকুমার মুখোপাধ্যায়
৩০. প্রেমাঙ্কুর আতর্থী – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
৩১. জন্ম জন্মান্তর – অভয়ঙ্কর
৩২. যাঁদের দেখছি – হেমেন্দ্রকুমার রায়
৩৩. পূর্বপত্র – সুধীরঞ্জন মুখোপাধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন