১৪. মির্জাসাব, আরে ও মির্জাসাব

রবিশংকর বল

নগ্মহ্ হৈ, মহ্ব্‌-এ সাজ রহ; নশহ হৈ, বেনিয়াজ রহ্
রিন্দ-এ তমা-এ নাজ রহ; খল-কো পার্সা সমঝ।।
(সুর আছে, ভেসে যাও সুরের স্রোতে; সুধা আছে, ভুলে যাও সব কিছু।
রূপসীর প্রেমে পাগল হয়ে যাও, সাধুতা থাকে অন্যদের জন্য।)

মির্জাসাব, আরে ও মির্জাসাব, এই দ্যাখো, বুড়ো আবার ঘুমিয়া কাদা। এত বছর কবরে শুয়ে থেকেও ঘুমের কমতি নেই। নাকি মাঝে মাঝে ঘাপটি মেরে পড়ে থাকেন? এ-বুড়োকে চেনা দায়, ভাইজানেরা। ওঁর গজলের মতোই বাইরের রূপে ভুললে ভেতরে কী মাল আছে বুঝতে পারবেন না। মোমিন, জওকরা যখন চাদ-ফুল-পাখি-নারী নিয়ে একই কথা লিখে যাচ্ছেন, নয়তো বাদশাহের প্রশস্তিগাথা লিখেছেন, তখন মির্জাসাব এসে গজলের মরাস্রোতে ঢেউ। খেলালেন। কীভাবে একজন শিল্পী এত বড় কাজ করতে পারে? যখন নিজের জীবনকে পুড়িয়ে পুড়িয়েই কেউ শিল্পের অগ্নিশিখা জ্বালিয়ে রাখে, তখনই এইরকম হতে পারে। এইসব মানুষ খুব আনপ্রেডিক্টেবল, জানেন তো, মানে ধরাছোঁয়ার বাইরে; আমাদের প্রত্যেকটা দিনের যে রুটিন, সেই গজ ফিতে দিয়ে মির্জাসাবের মতো মানুষকে মাপতে যাওয়া ভুল। এক এক সময় মনে হবে, লোকটা একটা শয়তান ছাড়া আর কিছু নয়, হয়তো তা-ই, শয়তানই, এমন এক শয়তান যে তার নিজের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে পারে। মির্জাসাবের একটা মজার গল্প মনে পড়ল। রঙ্গরসিকতায় তো ওঁর জুড়ি কেউ ছিল না সে সময়ে, কিন্তু ব্যাঙ্গের চাবুকটা বেশীরভাগ সময় নিজের পিঠেই মারতেন। না, না, ভাইজানেরা, বিরক্ত হবেন না, গল্পটা বলছি। ভাববেন না যে আমি মির্জাসাবের হয়ে সাফাই গাইছি। আমি কে যে তার হয়ে সাফাই গাইব? আর মির্জাসাবের জীবনও তো এখন আর কিস্সা ছাড়া আর কিছুই না। শুধু বেঁচে আছে। তার গজল; আমরা ভুল করি ভাইজানেরা, জীবনে একজন শিল্পীকে হারিয়ে দেওয়া খুব সহজ, কিন্তু শিল্পীর সত্যিকারের জীবন শুরু হয় তো তার মৃত্যুর পরে, তখন ইব্রাহিম জওকের মতো মানুষ শত চেষ্টা করেও সেই জীবনকে মলিন করে দিতে পারে না।

এবার কিস্পটা শুনুন। মির্জাসাব যে -কামরায় সারাদিন থাকতেন, সেটা ছিল বাড়ির দরজার ছাদের ওপর। তার একদিকে ছোট একটা অন্ধকার কুঠুরি। দরজাটা ছিল খুবই ছোট, একেবারে কুঁজো হয়ে ঢুকতে হত। সেই ঘরে সতরঞ্চির ওপর মির্জাসাব গরমের সময় বেলা দশটা থেকে তিনটে-চারটে পর্যন্ত বসে থাকতেন। কোনওদিন একা, কোনওদিন সঙ্গী পেলে চৌসর খেলে দুপুরটা কাটিয়ে দিতেন। তখন রমজান মাস চলছিল। একদিন মৌলানা আজুদা এসে হাজির দুপুরে। মির্জাসাবের খুবই পেয়ারের মানুষ ছিলেন তিনি। তো সেদিন মির্জাসাব এক বন্ধুর সঙ্গে বসে চৌসর খেলছিলেন। রমজান মাসে চৌসর খেলা? মৌলানার চোখে এ তো গুনাহ্। তিনি বললেন হাদিসে পড়েছিলাম, রমজান মাসে শয়তান বন্দি থাকে। এরপর আর। হাদিসের কথা মানা যাবে না।

-কেন?

-আপনি চৌসর খেলছেন, তা হলে আর হাদিসের কথা মানি কী করে বলুন?

-হাদিসে কত বড় সত্য লেখা আছে, আপনি দেখতে পাচ্ছেন না? মির্জাসাব মিটিমিটি হাসেন।

-মানে?

-হাদিসের কথাই তো ঠিক। এই যে কুঠুরিটা, এখানেই তো শয়তান বন্দি হয়ে আছে, আপনি দেখতে পাচ্ছেন না? কী, মিঞা কী বলেন? খেলার সঙ্গীকে শেষ একটা প্রশ্নটা করে হা হা করে হেসে উঠলেন মির্জাসাব।

-আপনি নিজেকে শয়তান বলছেন?

-তা ছাড়া কী? আমার মতো একটা শয়তান না থাকলে আপনি মুফতি হতেন কী করে?

-মানে?

-সহজ কথাটা বোঝেন না? শয়তান আছে বলেই না শরিয়াতের এত নিয়মকানুনের দরকার হয়ে। আজুদাসাব আমি তো কতবার বলেছি, আমি অর্ধেক মুসলমান। মদ খাই, কিন্তু শুয়োর খাই না।

মির্জাসাব যেমন বলেছেন, আমিও কতকটা সেইরকম বলতে পারেন। আমি কতখানি মুসলমান, তা নিয়ে এক বন্ধু একবার প্রশ্ন করেছিল। আমি বলেছিলাম, ইসলামিয়া কলেজ আর ডিএভি কলেজের মধ্যে ম্যাচে ইসলামিয়া গোল দিলে আমি লাফিয়ে উঠব। আমি এতদূর পর্যন্ত মুসলমান। তার বেশী নয়।

আর একটা কিস্স বলি, শুনুন ভাইজানেরা। এ তাঁর বুড়ো বয়েসের কথা। তখন দিল্লিতে মহামারী লেগেছে, মানে কলেরা আর কী। মীর মেহদি হুসেন মজরুহ একদিন চিঠি লিখলেন, হজরত, শহর থেকে মহামারী পালিয়েছে নাকি এখনও মজুদ?? মির্জাসাব উত্তরে লিখেছিলেন, এ কেমন মহামারী, আমি তো বুঝতে পারি না। যে মহামারী দুটো সত্তর বছরের বুড়ো-বুড়িকে মারতে পারে না, তার আসার কী দরকার ছিল বলুন তো?

এই মির্জাসাবকে বোঝা আমার আপনার কম্মো নয়। কিন্তু একটা মানুষ আর একটা মানুষকে পুরোপুরি বুঝতে চায়। গলদটা সেখানেই। যেখানে একজন মানুষ নিজেকেই নিজে চিনে উঠতে পারে না-হিমশৈলের চূড়াটুকুই সে মাত্র দেখতে পায়-সেখানে অন্য মানুষের তাঁকে পুরোপুরি বুঝতে চাওয়াটা হাস্যকর নয়, বলুন? আমাদের কথা বাদ দিন, ফরিদউদ্দিন আতরের মতো সুফি সাধকও বুঝতে পারেননি ওমর খৈয়ামকে। কেন জানেন? খৈয়ামসাব বিশ্বাস করতেন, মৃত্যুর পরে আর পুনরুত্থান নেই। দার্শনিক ইবন সিনার মতো খৈয়ামসাবের মনে হয়েছিল, আল্লা হয়তো সুরভিকে বুঝতে পারেন, কিন্তু প্রতিটি ফুলের আলাদা আলাদা সৌরভ তাঁর কাছে পৌঁছায় না। ইবন সিনা বলতেন, এই মহাবিশ্বের স্রষ্টা কেউ নেই, আল্লার মতোই অনাদি অনন্তকাল ধরে সে আছে। আর খৈয়ামসাব একটা রুবাইতে লিখেছিলেন, এই বিশ্বে যখন আমার থাকার মতো জায়গা নেই, তখন মদ আর আশিককে ছেড়ে থাকা ভুল; এ-পৃথিবী তৈরী হয়েছে, না অনন্তকাল ধরে আছে, এই ভাবনা আর কতদিন? আমার চলে যাওয়ার পর তো এ সব প্রশ্নেরই কোনও মানে নেই। আতরসাব তাই কেয়ামতের দিনে খৈয়ামসাবকে যেভাবে কল্পনা করেছেন, সেখানে আল্লার দরবারে তার মতো শয়তানের কোনও জায়গা নেই। কেন নেই? খৈয়ামসাবের এক রেন্ডি একজন শেখকে প্রশ্ন করেছিল। কী সাহস ভাবুন। শেখ ওই রেন্ডিকে বলেছিল, তুমি মাতাল, সব সময় ছলাকলায় মেতে আছো। সেই রেন্ডি উত্তরে বলেছিল, আপনি যা বললেন, আমি তা-ই, কিন্তু আপনি নিজেকে যা মনে করেন, আপনি কী তাই?

তাঁর মৃত্যুর পরের কথা খৈয়ামসাবই বলে গিয়েছিলেন। নিজামিসাব শিষ্য হয়েছিলেন খৈয়ামসাবের। খৈয়ামসাবকে শেষ তিনি দেখেন বলখের ক্রীতদাস বাজারের রাস্তায় এক দোস্তের বাড়িতে। অনেকে সেখানে হাজির ছিল খৈয়ামসাবের কথা শোনার জন্য। খৈয়ামসাব নাকি বলেছিলেন, আমার কবর এমন জায়গায় হবে, যেখানে বছরে দুবার গাছ থেকে ফুল ঝরবে। নিজামিসাব কথাটা বিশ্বাস করতে পারেন নি। খৈয়ামসাবের মৃত্যুর চার বছর পর নিশাপুরে গিয়ে নিজামিসাব তাঁর গুরুর কবর দেখতে গেলেন। ফুলে-ফুলে ঢাকা সেই কবর দেখে কেঁদে ফেলেছিলেন নিজামিসাব।

মাফ করবেন ভাইজানরা, কথায়-কথায় অনেক দূর চলে এসেছি। আসলে কী জানেন, মির্জাসাবের যে কিস্সাটা আপনাদের বলছি, তা তো শুধুই ওনার কিস্সা নয়। খোদা তো ধুলো থেকেই আমাদের তৈরি করছেন। তাহলে ভাবুন, কত পুরনো, কত দূর দেশের ধুলো আর তাদের স্মৃতি রয়ে গেছে আমাদের ভেতরে। ভাবলে খুব মজা লাগে আমার, অনন্তকাল ধরে আমরা কোথাও না কোথাও আছি, ধুলোর ভেতরে লুকিয়ে।

[অনুবাদকের কথাঃ এখানে এসে মান্টোসাব হঠাৎই থেমে গেছেন। কিস্সা আবার শুরু হবার আগে মান্টোসাব একটা পৃষ্ঠায় যা লিখেছেন, তা তুলে ধরছি। এই অংশটা বাদ দিলেও অসুবিধা ছিল না। তবে আমরা যত দূর সম্ভব মূলানুগ থাকতে চাই। ফলে মান্টোসাবের এই বয়ানকেও উপন্যাসের অংশ মনে না করার কোন কারণ দেখছি না। এই কিস্সার বাইরে ভেতরে মান্টোসাব যেটুকু লিখেছেন, তা হুবহু লিখছি:]

মাঝে মাঝে প্রশ্ন জাগছে, লেখাটা কি সত্যিই গালিবের জীবন নিয়ে উপন্যাস হচ্ছে? আগে আমার এত ধন্দ ছিল না। কিন্তু লাহোরে আসার পর থেকে মদ খাওয়ার মাত্রা এত বেড়ে গেছে-সংসার চালানোর জন্যও এত ইতরামি করতে হচ্ছে-সংসারের দিকে কতটুকুই বা নজর আমার নিজেকে টিকিয়ে রাখার জন্যই ইতরামি বলা যায়-আমি অনেকদিন হল খেই হারিয়ে ফেলেছি। মির্জা গালিবকে নিয়ে সিনেমার জন্য যে গল্পটা লিখেছিলাম, ওটা একটা ফ্রড, গোটা সিনেমার জগত্তাই ফ্রড, ওরা চেয়েছিল মির্জার অবৈধ সম্পর্ক নিয়ে একটা গল্প। লিখে দিয়েছিলাম। সিনেমার গল্প, স্ক্রিপ্ট তো আমি লিখতাম শুধু টাকার জন্য। কিন্তু আমার উপন্যাসের গালিব তো গোগোলের ওভারকোট গল্পের সেই লোকটার মতো, আমি যেন তাঁকে ধরতে পারছি না। তাই বেগমকে ডেকে এ-পর্যন্ত শোনালাম। লাহোরে আসার পর থেকে আমারা লেখা শোনানোর লোক নেই। শাফিয়া বেগমকেই শাস্তিটুকু পেতে হল।

-কী মনে হয় তোমার শাফিয়া? আমি জিজ্ঞেস করলাম।

-আমি লেখার কী বুঝি বলুন? শাফিয়া হাসে, ইসমত থাকলে বুঝতে পারত।

-ইসমত তো নেই। তুমিই বল।

-গুনাহ মাফ করবেন মান্টোসাব।

-বলো।

-মির্জাসাবের ওপর আপনি নিজেকে চাপিয়ে দিচ্ছেন।

-তাই মনে হয় তোমার?

-জি।

বেগমকে আমি আরও কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম। সে শুধু বারবার বলেছে, আমি লেখার কী বুঝি বলুন? ইসমত থাকলে-। ইসমত, ইসমত,ইসমত। বারবার একই নাম। আমার সবচেয়ে বড় বন্ধু, সবচেয়ে বড় শত্রু। আমি মরতে বসেছি জানে তবু চিঠি লিখলেও উত্তর দেয় না। পাকিস্থানে আসার জন্য ও আমাকে ঘেন্না করতে শুরু করেছিল, আমি বুঝি। কিন্তু ইসমত তো ইসমতই।লিহাফ -এর মতো গল্প আর কে লিখতে পারবে? আকেবারে হইহই পড়ে গেছিল। মোল্লা থেকে শুরু করে প্রগতিশীল সবাই ইসমতের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। সমকাম নিয়ে গল্প? তাও আবার মেয়েদের মধ্যে। ইসমত সত্যিই একটা কাণ্ড করেছিল।

শেষ পর্যন্ত আমি মির্জাসাবকে ডেকে এনে সামনে বসালাম।

-কেয়া মিঞা? আপ কেয়া মাঙতে হ্যায়? মির্জাসাব হাসতে শুরু করলেন।

 -আপনাকে নিয়ে একটা উপন্যাস লিখছি। একটু শুনবেন? যদি বলেন, কিছু হচ্ছে না, আমি সালাম জানিয়ে সরে যাব।

-পড়ো শুনি। নিজের কিস্সা কে আর না শুনতে চায়?

পড়া শেষ হবার পর মির্জাসাব ঘরের ভেতর পায়চারি করতে লাগলেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কী মনে হল আপনার?

মির্জাসাব পায়চারি করতে করতেই একটা শের বলতে লাগলেন,

গরদিশ-এ সাগব্‌-এ জল্বহ্-এ রঙ্গীন তুঝ সে।
আইনহদরী-এ এক দীদহ -এ হৈরাঁ মুঝ সে।।
(সুরাপাত্রের গায়ে নানা বর্ণের চিত্র ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাও তুমি;
বিস্ময়ে উদ্ৰান্ত চোখের আয়নায় আমি তা ধরে রাখি।)

তারপর বললেন, লেখো, মান্টোভাই। জীবনে কেউ কাউকে ছুঁতে পারে না, লেখায় তুমি আমাকে ছোঁবে সে আশা বৃথা। তবু লেখো। লেখাই তো দীন্‌-এর পথ।

আমার জন্যও তবে দীনের পথ আছে? এত পাপের পরেও?

মান্টোসাবের লেখা এই অংশটা পড়ে আমার বেশ মজাই লাগে। তবসুমকে জানাই, মির্জা গালিবকে নিয়ে উপন্যাস লেখা হল না আমার, তবে মান্টোসাবকে নিয়ে একটা উপন্যাস লেখার ইচ্ছে হচ্ছে। -কেন জনাব? তবসুম হেসে জিজ্ঞেস করে।

-এত বড় শয়তান আমি দেখিনি। শয়তানকে এক্সপ্লোর করার আনন্দই আলাদা।

-আপনি নিজেকে কী ভাবেন?

-কী?

-বলুন না।

-জানলে কোনও সমস্যা ছিল না। মান্টোসাব যেমন কথায় কথায় বলতেন, ফ্রড, ফ্রড, আমিও একটা ফ্রড। লেখা আমার ফ্রড-এর বিজনেস বলতে পারেন।]

মির্জাসাবের কথাতেই ফিরে আসা যাক। শ্বশুর মারুফসাবের বাড়িতে বেশীদিন থাকলেন না মির্জাসাব। একে তো শ্বশুরকে সহ্য করতে পারতেন না, তার ওপর দিল্লিতে এসে নিজেকে কেউকেটা ভাবতে শুরু করেছেন। হ্যাঁ, এই স্বভাবটা ওনার পুরো মাত্রায় ছিল, ওই যে বলেছি, কখনও ভুলতে পারতেন না, তিনি তুর্কি সৈনিকদের বংশধর। আমিরি মেজাজ দেখানোটা ওনার রক্তের মধ্যেই ছিল। তাই শ্বশুরবাড়িতে থাকা সহ্য হল না। চাঁদনি চকের কাছে হাবাশ খান কা ফটক। তার পাসে সব্বান খানের হাভেলি ভাড়া নিলেন। এবার নিজের মর্জিমতো স্বাধীন জীবনযাপন। উমরাও বেগম পড়ে রইলেন জেনানামহলে, তাঁর কোরান-হাদিস-তসবি নিয়ে।

একটা কথা বলতেই হবে ভাইজানেরা, বেগমের দিকে কোনওদিন ফিরে তাকাননি মির্জাসাব। গজল-সুরা-মুশায়েরা-তবায়েফ-রঙ্গরসিকতা নিয়েই সবসময় মশগুল থাকতেন। এমনকী হয়নি যে উমরাও বেগম শৌহরের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছেন, তাঁর কাছাকাছি আসতে চেয়েছেন? নিশ্চয়ই চেয়েছিলেন। কিন্তু মির্জাসাবের অবহেলা, নিষ্ঠুরতার সীমা-পরিসীমা ছিল না। বেগমের সঙ্গে তিনি শুয়েছেন, সাত-সাতটা সন্তানের জন্ম দিয়েছেন, যারা কেউ এক-দেড় বছরের বেশী বাঁচেনি, কিন্তু নিজের রইসি জীবনে তিনি পুঁদ হয়ে থেকেছেন। আমি বুঝতে পারি, উমরাও বেগম কেন দিনে দিনে কোরানের ভেতরেই নিজের জীবনকে আটকে ফেলেছিলেন। কেন শেষ পর্যন্ত নিজের খাওয়ার বর্তন পর্যন্ত আলাদা করে নিয়েছিলেন। এক একটা সন্তানের জন্ম ও মৃত্যু তাঁকে ঠেলে দিচ্ছিল নিজের ভেতরের অন্ধকার থেকে আরও গভীর অন্ধকারে। মির্জাসাব বেগমের দিকে তাকাতে চাননি। বরং বেগমকে নিয়ে মজা করেছেন। কেমন জানেন? একবার বাড়ি বদল করার জন্য মির্জাসাব উঠে পড়ে লাগলেন, নিজে নতুন বাড়ি দেখেও এলেন। উমরাও বেগম জিজ্ঞেস করলেন, হাভেলি কেমন লাগল মির্জাসাব?

-দিবানখানা তো বেশ ভালোই। জেনানামহল আমি দেখিনি।

-কেন?

-আমি দেখে কী করব? সে তো তোমার মসজিদ, তুমিই একবার দেখে এসো।

মির্জাসাব হাসতে হাসতে বললেন।

-মসজিদ?

-তা ছাড়া কী? জেনানামহলকে তো তুমি মসজিদ বানিয়েই ছেড়েছ। যাও, আর কথা বাড়িও না, একবার দেখে এসো।

স্বামীর কথা মেনে নিয়ে উমরাও বেগম বাড়ি দেখে এলেন। মির্জাসাব জিজ্ঞেস করলেন, কেমন দেখলে? পছন্দ হয়েছে তোমার?

-জি। ফির-

-ফির কেয়া?

-সবাই বলে, ওই হাভেলিতে জিন আছে।

-জিন? কারা বলে?

-হাভেলির আশেপাশে যারা থাকে।

-তাঁরা তো তোমাকে দেখেছেন?

-জি।

মির্জাসাব হা-হা হাসিতে ফেটে পড়লেন।-আরে বেগম, দুনিয়াতে তোমার চেয়ে জবরদস্ত জিন আছে নাকি?

এ-কথা নিজের স্বামীর মুখে শোনার পর কোনও মেয়ের আর কিছু বলার থাকে? উমরাও বেগম কান্না চাপতে চাপতে জেনানামহলে ফিরে গেলেন। ভাইজানরা, এই মির্জাসাবকে আমি ক্ষমা করতে পারি না। শাফিয়া বেগমকে আমি স্বামী হিসাবে যা-যা দেবার দিতে পারিনি, নিজের খেয়াল খুশি মত চলেছি, কিন্তু ওভাবে কখনও তাকে অপমান করিনি। মির্জাসাব খুব সহজে যে কাউকে অপমান করতে পারতেন, অন্তত তাঁর যৌবনের দিনগুলোতে। অপমান করলে। তোমাকেও তো অপমান পেতে হবে। কিন্তু অপমান তিনি হজম করতে পারতেন না। আমি। এত সব কথা বলছি বলে মির্জাসাবকে আপনারা কিচরে নামিয়ে আনবেন না। সাদা-কালো ছবি হয়, জীবনটা তো সেরকম নয়, সেখানে নানারকম ছায়া থাকে। আর মির্জাসাবের জীবন ছিল। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের চেয়ে অনেক বড়, ইংরেজিতে বলে না, লার্জার দ্যান লাইফ? আপনার তাঁর জীবন নিয়ে সমালোচনা করতে পারেন, প্রশ্ন তুলতে পারেন, কিন্তু হাঙরের ঢেউয়ে লুটোপুটি খাওয়া অস্তিত্বটাকে অস্বীকার করতে পারেন না।

দিল্লিতে শায়র হিসাবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার জন্য কম অপমান তো মির্জাসাবকেও হজম করতে হয়নি। একের পর এক মুশায়েরায় তাঁর গজলকে, তাঁকে অপমান করা হয়েছে। কেন? তাঁর লেখার সমদ্দার তখনও জন্মায়নি; বেঁটেখাটো কবিরা তখন কী করে? প্রতিভার গায়ে কাদা ছিটোয়, ঠাট্টা-মশকরা করে, তাঁর কবিতার গায়ে দুর্বোধ্যতার লেবেল সেঁটে দেয়। একটা। মুশায়েরার কিস্যা বলি আপনাদের। দিল্লির বিখ্যাত কবিরা, রইস আদমিরা এসেছেন। একের পর এক কবিরা তাঁদের গজল পড়ছেন।কেয়া বাত, কেয়া বাত আওয়াজ উঠছে, হাততালি পড়ছে, মির্জাসাব বুঝতে পারছেন, সব লেখা অন্তঃসারহীন, শুধু অলঙ্কারে ঠাসা, অনেক গয়না-পরা মেয়ের সৌন্দর্য যেমন হারিয়ে যায়। মির্জাসাবের যখন গজল পড়ার পালা এল, হাকিম আগা জান আইশ উঠে দাঁড়ালেন, বললেন, এত বড় শায়ের গজল পড়ার আগে আমি কিছু বলতে চাই। আমাকে আপনার অনুমতি দিন। মুশায়েরায় হুল্লোড় উঠল, ববালিয়ে জি, বোলিয়ে জি

-আপ লোগ আরজ কিয়া হ্যায়?

-এরশাদ, এরশাদ।

হাকিম আগা জান পড়তে শুরু করলেন,

সে কাব্য অর্থহীন, যা বোঝেন শুধু কবি
আনন্দ তো হবেই যদি অন্যে পায় সে ছবি। মী

রকে বুঝি, মির্জাকেও, কিন্তু গালিব যা লেখেন

ঈশ্বর তাঁকে রক্ষা করুন, তিনিই জানেন কে বোঝেন!

হাসির হুল্লোড় উঠল মুশায়েরায়। এরপরে একজন কবি কি তাঁর কবিতা পড়তে পারেন, ভাইজানেরা?

আর একবার কী হয়েছিল, বলি। রামপুরের মৌলবি আব্দুল কাদির এসে বললেন। মির্জাসাব, আপনার একটা উর্দু শের কিছুতেই বুঝতে পারছি না। যদি বুঝিয়ে বলেন।

-কোন শেরটা জানাব?

-ওই যে আপনি লিখেছেন:

 গোলাপের গন্ধ তুমি
নিয়ে নাও মহিষের ডিম থেকে
আরও কিছু খুশবু আছে তাতে,
নিয়ে নাও মহিষের ডিম থেকে।

-কাদিরসাব এ তো আমার লেখা শের নয়।

-কিন্তু আপনার দিবান-এই তো পড়ছি। আপনি একবার খুলে দেখবেন নাকি?

মির্জাসাব বুঝতে পারলেন, এ আসলে তার লেখা নিয়ে হাসিঠাট্টা করার নখরা। কিন্তু বন্ধু ফজল-ই-হকের সমালোচনা তো তিনি মেনে নিয়েছিলেন। একজন শিল্পীকে আক্রমণ করে তো আমরা তাঁকে বদলাতে পারি না। বন্ধুর মতো পাশে এসে যদি বলি, বিষয়টা নিয়ে কথা বলার ক্ষমতা যদি আপনার থাকে, তবে শিল্পী তা মেনে নেন। ফজল-ই-হকের সমালোচনা থেকে। নিজের কাব্যভাষাকে বদলে নিচ্ছিলেন মির্জাসাব। কেননা বন্ধুর সমালোচনা তো মশকরা নয়, তা আসলে পিঠে হাত রাখা। আর ফজল-ই-হকও বুঝতেন কাব্যভাষার অন্ধিসন্ধির কথা। কিন্তু এমন কেউ, যে তা বোঝে না, তার কি মির্জাসাবের লেখার সমালোচনা করার অধিকার আছে? পদার্থবিদ্যা-রসায়নবিদ্যা নিয়ে কথা বলার জন্য তো আপনাকে জ্ঞান অর্জন করতে হবে। কবিতার বেলায় আপনি যা খুশি বলে পার পেয়ে যাবেন, তা তো হতে পারে না। কাব্যভাষা কীভাবে জন্মায়, তার ইতিহাস তার বিবর্তন না জেনেই কথা বলার অধিকার জন্মায় আপনার? যেহেতু কবিরা হাতে শুধু একটা কলম থাকে, আর বৈজ্ঞানিককে ঘিরে আছে যন্ত্রের পর যন্ত্র, সেজন্য কি কবির সম্বন্ধে এত সহজে কথা বলা যায়? এত অপমান সহ্য করার পর মির্জাসাব তাই একটা শের -এ লিখেছিলেন :

থী খবর গর্ম কে গালিব মে উড়েঙ্গে মুর্জে
দেখনে হম্ ভি গয়ে পেহ্ তামাশা না হুয়া।
(ছিল জোর খবর যে গালিবকে ছিন্নভিন্ন করা হবে
দেখতে আমিও গিয়েছিলাম কিন্তু তামাশাই হল না।)

অনেক আশা নিয়ে দিল্লিতে এসেছিলেন মির্জাসাব। কিছুদিন পরেই বুঝতে পেরেছিলেন, আশা করে কোনও ফল ফলবে না। দিল্লি দরবারেও তাঁর জায়গা হয়নি। দিবানখানায় বসে তিনি একা নেশাগ্রস্থ, কাঁদতে কাঁদতে বিড়বিড় করেন,

নহীঁ গর সর ও ব-এ অদ্ৰাক-এ মানে,
তমাশা-এ নৈরঈ-এ সুরৎ সলামাৎ।।
(অর্থ বুঝবার যোগ্যতা যদি নাও হয় কোনদিন
তবু রুপের বর্ণবৈচিত্র দেখার শক্তিটুকু বেঁচে থাক।)

সকল অধ্যায়

১. ০১. আমার জীবনে এমন সব ঘটনা
২. ০২. ভূমিকা – এই দস্তান কে লিখছে
৩. ০৩. এত দূর থেকে কি আমার কথা
৪. ০৪. মির্জাসাবকে একটু ঘুমোতে দেওয়া দরকার
৫. ০৫. অরূপের সমুদ্রে আমার তরী ভাসাল
৬. ০৬. কিস্সাটা একটু ঘুড়িয়ে দেওয়া যাক
৭. ০৭. কালে মহলের জীবন
৮. ০৮. দুসপ্তাহ তবসুমের বাড়ি যাওয়া হয়নি
৯. ০৯. শাহজাহানাবাদে আমি ঢুকেছিলুম
১০. ১০. গোস্তাকি মাফ করবেন
১১. ১১. আকাশ চক্রাকারে ঘুরছে
১২. ১২. একেবারে নরক গুলজার করে দিলেন
১৩. ১৩. আমার মতই এই শহরটা
১৪. ১৪. মির্জাসাব, আরে ও মির্জাসাব
১৫. ১৫. চোখ বুজে শুয়েছিলুম
১৬. ১৬. চলে যাচ্ছে বসন্তের দিন
১৭. ১৭. পয়গম্বর, হৃদয়, পথ হৃদয়, খুদাও হৃদয়
১৮. ১৮. রিজবানের বাগিচা
১৯. ১৯. এক ভোরবেলায় স্বপ্ন দেখে
২০. ২০. রূপমতীদের কিস্সা
২১. ২১. যুবক রোহিত কে দেবরাজ ইন্দ্র
২২. ২২. আপনি চললেন কলকাতা
২৩. ২৩. মণীকর্ণিকার ঘাটে
২৪. ২৪. আপনার উসখুস করছেন
২৫. ২৫. মুর্শিদাবাদ পেরিয়ে কলকাতায়
২৬. ২৬. মান্টোর উপন্যাস অনুবাদের কাজ
২৭. ২৭. নসিবের কী লিখন দেখুন
২৮. ২৮. বম্বে শহরটা আমার সঙ্গে কথা বলত
২৯. ২৯. কলকাতা থেকে ফেরার পর
৩০. ৩০. রোজগার কম ছিল
৩১. ৩১. শয়তানের কামরায় জুয়ার আসর
৩২. ৩২. মির্জাসাব, এই দোজখে
৩৩. ৩৩. একটা সুফি কিস্সা মনে পড়ল
৩৪. ৩৪. কবরে আজ আমাদের খুশির দিন
৩৫. ৩৫. জীবনটাকে একেবারে শূণ্য করে
৩৬. ৩৬. আমি তো একজন গল্পলেখক
৩৭. ৩৭. রঙ্গমঞ্চে প্রবেশ
৩৮. ৩৮. আমি যে অশ্লীল লেখক
৩৯. ৩৯. অবধ অধিকার করে ব্রিটিশ
৪০. ৪০. একটা কিস্সা শুনুন ভাইজানেরা
৪১. ৪১. বিস্মৃতির কুয়াশার ভিতরে
৪২. ৪২. আমি তো ঐতিহাসিক নই
৪৩. ৪৩. মৃতের শহর দিল্লি
৪৪. ৪৪. লাহোরে পৌঁছনোর পর
৪৫. ৪৫. হে আমার দোসর পাঠক

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন