বিমল কর
০৪.
কিকিরাদের দীপনারায়ণের কাছে পৌঁছে দিয়ে শশধর চলে গেল।
রাজবাড়ির নিচের তলায় একসারি ঘরের মধ্যে তারাপদরা যে-ঘরটায় এসে বসল সেটা ঠিক বসার ঘর নয়, বসা এবং অফিস করা–দুই যেন চলতে পারে। বেশ বড় মাপের ঘর, মস্ত মস্ত দরজা জানলা মেঝেতে কার্পেট পাতা, আসবাবপত্র সাবেকি এবং ভারী ধরনের। রাজবাড়িতে ইলেকট্রিক নেই, ডিজ ল্যাম্প, পেট্রমাক্স, হ্যাঁজাক-এইসব জ্বলে।
দীপনারায়ণ বসতে বললেন কিকিরাদের।
কিকিরা ঘরের চারদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন, তারপর বসলেন। তারাপদ বোকার মতন দাঁড়িয়েছিল, কিকিরাকে বসতে দেখে বসে পড়ল।
দীপনারায়ণ বললেন, “গাড়িতে আপনাদের কোনো কষ্ট হয়নি তো?”
মাথা নাড়লেন কিকিরা। “না, আরামেই এসেছি। জিপ গাড়িতে খানিকটা সময় লাগল।”
“অনেকটা দূর। জঙ্গলের রাস্তা।”
তারাপদ নজর করে দীপনারায়ণকে দেখছিল। কলকাতায় সেদিন কয়েক মুহূর্তের জন্যে যাকে দেখেছিল–সেই মানুষই সামনে বসে আছেন–তবু আজ অন্যরকম লাগছে। দীপনারায়ণ সুপুরুষ, গায়ের রঙ উজ্জ্বল, চোখমুখ পরিষ্কার, সুশ্রী, মাথার চুল পাতলা, শরীর স্বাস্থ্য দেখলে মনে হয় চল্লিশের বেশি বয়েস। অথচ কিকিরা বলেছেন, দীপনারায়ণের বয়েস পঞ্চাশ। দেখতে ভাল লাগে মানুষটিকে। ভদ্র, নিরহঙ্কার ব্যবহার।
দীপনারায়ণ কিকিরার সঙ্গে আরও দু-একটা কী যেন সাধারণ কথা বললেন, তারাপদ খেয়াল করে শুনল না।
কলকাতায় ঠাকুর বিসর্জন কিংবা মারোয়াড়ি বিয়ে-টিয়েতে তাসা পার্টি সঙ্গে যেমন গ্যাস বাতি নিয়ে আলোর মিছিলদাররা চলে তাদের হাতে থাকে বাহারি বাতি–সেই রকম একটা বাতি ঘরের একপাশে জ্বলছিল। আজকাল এরকম বাতি কলকাতাতেও কম দেখা যায়, আগে যেত। কার্বাইডের আলো, কিন্তু অন্য ধাঁচের; চারদিক থেকে চারটে সরু সরু নল বেরিয়ে চারদিক ঘিরে রেখেছে, মুখ খোলা কাচের শেড, আলোর শিখা যেন কাচে না লাগে। মাত্র দুটি নলের মুখে শিখা জ্বলছিল, অন্য দুটো নেবানো। শিখাও কমানো রয়েছে। ঘরে কার্বাইডের সামান্য গন্ধ।
দীপনারায়ণ বললেন, “এবার কাজের কথা হোক, কিংকরবাবু?”
“বলুন।”
“আমি আপনাদের কথা বলে রেখেছি। তিনজনের কথাই। দুজনে এসেছেন।”
“আর একজন পরশু নাগাদ আসবে।”
“আমারও তাই বলা আছে।…আমি বলেছি, আপনারা এই রাজবাড়ির লাইব্রেরির ছবি আর বইয়ের ভ্যালুয়েশান করতে আসছেন। যদি দর-দস্তুরে পোষায় আপনারা কিছু কিনতে পারেন। নয়ত কলকাতায় ফিরে গিয়ে আপনারা পার্টি জোগাড় করবেন, বিক্রি বাটা হয়ে গেলে কমিশন পাবেন। ভ্যালুয়েশান করার জন্যে ভ্যালুয়ার হিসেবে আপনারা রাজবাড়িতে অতিথি হিসেবে থাকবেন, আর কাজ শেষ হয়ে গেলে দু হাজার টাকা পারিশ্রমিক পাবেন।…বোধ হয় ঠিক বলেছি, কী বলেন?”
কিকিরা বললেন, “ঠিকই বলেছেন।”
তারাপদ হঠাৎ বলল, “শশধরবাবু আমায় কতগুলো কথা জিজ্ঞেস করছিলেন।”
দীপনারায়ণ তারাপদর দিকে তাকালেন, কিকিরাও।
একটু আগে যে-সব কথা হয়েছে শশধরের সঙ্গে, তারাপদ তা বলল।
কিকিরা বললেন, “যা বলেছ ঠিকই বলেছ। আবার কিছু জিজ্ঞেস করলে বলো, হিসেব তৈরি করা চিঠি লেখা এইসব কাজগুলো তুমিই করো, আমি ও-সব করতে পারি না।”
ঘাড় নাড়ল তারাপদ।
কিকিরা দীপনারায়ণকে বললেন, “আমায় ক’টা কথা বলতে হবে দীপনারায়ণবাবু।”
“বলুন।”
“তার আগে আরও একটা কথা আছে। কেউ যদি আপনাকে জিজ্ঞেস করে রাজবাড়ির ছবি বই–এ-সব কেন আপনি বেচে দিতে চাইছেন তার জবাব কী হবে?”
দীপনারায়ণ তাঁর সিগারেটের কেস থেকে একটা সিগারেট তুলে নিয়ে কেসটা কিকিরার দিকে বাড়িয়ে দিলেন।
কিকিরা সিগারেট নিলেন না।
দীপনারায়ণ সিগারেট ধরিয়ে নিয়ে বললেন, “কেউ জিজ্ঞেস করবে না। বিক্রি করার অধিকার আমার আছে। তবু যদি জিজ্ঞেস করে, তার জবাব আমার তৈরি আছে।”
“সেটা জানতে পারি?”
“পারেন। পুরনো ছবি কিংবা বই আমি বুঝি না। আমার কোনো ইন্টারেস্ট নেই। জয়নারায়ণ কিছু কিছু বুঝত। তার ভালও লাগত। জয়নারায়ণ ছাড়া লাইব্রেরি ঘরে এবাড়ির কেউ পা দিত না। সে যখন নেই, লাইব্রেরি সাজিয়ে রাখা অকারণ।” দীপনারায়ণ একটু থেমে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন–দরজার দিকে পরদা নড়ে উঠল। তিনি চুপ করে গেলেন।
মাঝবয়সী একটা লোক এসে কফি দিয়ে গেল।
লোকটা চলে যেতে দীপনারায়ণ বললেন, “জয় নেই এটা একটা কারণ। আর অন্য কারণ হল, আমাদের অবস্থা। আপনাকে আমি আগেই কলকাতায় বলেছি–আমাদের অবস্থা পড়ে গেছে, জমি-জায়গা হাতছাড়া হয়েছে আগেই, জঙ্গল-টঙ্গল এখন সরকারি সম্পত্তি, আমাদের একটা ক্লে মাইন ছিল–সেটা নানা ঝামেলায় বেচে দিতে হয়েছে লাখ পাঁচেক টাকা ধার। মামলা মোকদ্দমায় বছরে হাজার দশ পনেরো টাকা খরচ হয়ে যাচ্ছে এখনো।“
তারাপদ বেশ অবাক হচ্ছিল। রাজরজাড়া মানুষ–তারও টাকা-টাকা চিন্তা। তা হলে আর তারাপদ কোন দোষ করল। দীপনারায়ণ মানুষটিকে ভালই লাগছিল তারাপদর, কেমন খোলামেলাভাবে সব কথা বলে যাচ্ছেন।
কফি নিতে বললেন দীপনারায়ণ।
কিকিরা কাপে চিনি মেটাতে মেশাতে বললেন, “এবার আমায় অন্য কয়েকটা কথা বলুন।”
দীপনারায়ণ জবাব দেবার জন্যে তাকিয়ে থাকলেন।
“রাজবাড়িতে কে কে থাকেন? মানে আপনাদের পরিবারের?”
“আমাদের এই বাড়ির তিনটে মহল। কাকার, আমার আর জয়নারায়ণের।”
“মহলগুলো কেমন একটু বলবেন?”
“কাকা থাকেন পুবের মহলে, জয় থাকত মাঝ-মহলে, আর আমি পশ্চিম মহলে…।”
“নিচের মহলে কারা থাকে?”
দীপনারায়ণ কালো কফিতে চিনি মিশিয়ে কাপটা তুলে দিলেন।”নিচের মহলের এই সামনের দিকটা আমাদের অফিস কাছারি, বাইরের লোকজন এলে বসাটসা, লাইব্রেরির জন্যে রাখা আছে। বাবার আমল থেকেই। ভেতর দিকে আমরা সকলেই ওপর আর নিচের মহল যে যার অংশ মতন ব্যবহার করি। শুধু নিচের একটা দিক রাজবাড়িতে যারা কাজ করে তাদের থাকার জন্যে।”
কফি খেতে খেতে কিকিরা বললেন, “আপনার কাকা কি একা থাকেন?”
“না। কাকিমা জীবিত রয়েছেন। কাকার প্রথমা স্ত্রীর ছেলে আমার খুড়তুতো ভাই এখানে থাকে না। সে আসামে থাকে। ডাক্তার। দ্বিতীয় স্ত্রীর একটি মেয়ে। সে বোবাহাবা। সে এখানেই থাকে। তার বিয়ে হয়নি। কাকিমার এক ছোট ভাই, সেও থাকে কাকার কাছে।”
“ছোট ভাইয়ের নাম?”
“ইন্দর।”
“কী করে?”
“কিছু করে না। ভাল শিকারি। খায় দায় ঘুমোয় আর কুকুর পোষে।”
“কুকুর পোষে?”
“কুকুরের শখ ওর। পাঁচ-সাতটা কুকুর এনে রেখেছে। একেবারে জংলি। চেহারা দেখলে ভয় করে। বুনো কুকুর, অ্যালসেশিয়ান কিংবা টেরিয়ারের চেয়ে কম নয়।”
তারাপদ ভয়ে ভয়ে বলল, “খানিকটা আগে আমরা কুকুরের ডাক শুনেছি।”
“ইন্দরের একটা কুকুর-ঘর আছে। কুকুরদের মাঝে মাঝে হান্টার কষায়। বলে ট্রেনিং দিচ্ছে।”
কিকিরা কুকুরের কথা কানেই তুললেন না যেন, বললেন, “আপনার পরিবারের কে কে আছেন দীপনারায়ণবাবু?”
দীপনারায়ণ সামান্য চুপ করে থেকে বললেন, “আমার মা শয্যাশায়ী, পঙ্গু। স্ত্রী মারা গেছেন। বড় ছেলে দেরাদুন মিলিটারি কলেজে। ছোট ছেলে সিবাস্টিন কলেজে পড়ে, মাদ্রাজের কাছে। এখন সে ছুটিতে। এখানেই রয়েছে।”
“জয়নারায়ণবাবুর কে কে আছেন?” কিকিরা জিজ্ঞেস করল।
“জয়ের স্ত্রী রয়েছেন। একটি ছোট মেয়ে, বছর চার বয়েস। এখন এঁরা নেই, ভুবনেশ্বর গিয়েছেন।”
কফির পেয়ালা নামিয়ে রেখে কিকিরা যেন কিছুক্ষণ কিছু ভাবলেন। তারপর বললেন, “শশধর কি আপনাদের দূর সম্পর্কের কোন আত্মীয়?”
“না”, মাথা নাড়লেন দীপনারায়ণ, “এ বাড়িতে পঁচিশ ত্রিশ বছর রয়েছে। বাবার আমলের কর্মচারী। অনুগত।”
“এই লোকটাকে আপনার সন্দেহ হয় না?”
দীপনারায়ণ তাকালেন কিকিরার দিকে। সামান্য পরে বললেন, “এত দুঃসাহস ওর হবে? শুনেছি, বাবা ওকে প্রাণে বাঁচিয়েছিলেন।”
“কেন?”
“আমি জানি না।”
“ইন্দর লোকটাকে আপনি সন্দেহ করেন?”
“করি। ও একটা জন্তু। অথচ জয় ওকে পছন্দ করত। বন্ধুই ছিল জয়ের।”
কিকিরা আবার চুপ করে থাকলেন কিছুক্ষণ। তারপর বললেন, “দীপনারায়ণবাবু, আপনি কি সত্যি-সত্যিই বিশ্বাস করেন, আপনাদের রাজবাড়িতে যে ছোরাটা ছিল তার কোনো জাদু আছে?”
দীপনারায়ণ বললেন, “করি। হয়ত এটা আমাদের সংস্কার। বিশ্বাস। কোনো প্রমাণ তো দেখাতে পারব না কিংকরবাবু!”
কিকিরা আর কিছু বললেন না।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন