দীনেশচন্দ্র সেন
নীলা
“এহি ত আঘ্রাণ মাসরে হারে নতুনেরি বাও[১]।
নিত্যি নতুন খাওরে[২] নীল্যা আজ অতিথ বুঝাও॥”
“বুঝাব বুঝাব অতিথ পেরথম যৌবন[৩]।
পাত্তরে[৪] বাঁধিয়া হিয়া রাখপ চিত্ত ভারাম[৫] দিয়া॥”
এহি ত পূষ[৬] মাসরে এ পূষ হিমালা[৭]।
দিনে দিনে নারীর যৈবন গুঞ্জরে ভ্রমরা[৮]॥
“হাল বাও হালুয়া বাইরে বেড়ে চারি আইল।
বিটা[৯] যার ভাজন[১০] হায়রে তার বাপে না খায় গাইল॥”
“এহি ত মাঘ মাসরে জোড়ে তিন মাস।
হাসি মুখে কহ কথা যাই হাপনার[১১] দ্যাশ॥”
“তুমি ত সাধুর কুমার হারে আমি রাজার ঝি।
আমার কি শকতি আছে বিদায় দিতে পারি॥”
“এহি ত ফাল্গুন মাসে মৈষীর শিঙা নড়ে[১২]।
তুমিত যুবতী নারী প্রাণে কত ধরে॥”
“জাল বাও জালুয়া ভাইরে ছাইরে তোল পানি।
শিষ্য যার ভাজন হয়রে গুরুর বাখানি[১৩]॥
এহি চত্তির[১৪] মাসরে ম্যাঘের আন্ধারী।
আজকের নিশীথে নীলে তোমার যৈবন যাবে চুরি॥”
“আজকের নিশীথেরে সাধু আমার যৈবন যাবে চুরি।
সিথ্যানে বসায়ে রাখপ আমার এ পাইক প্রহরী॥
বাসরে জ্বালায়্যা দিব আমি দশ কোঠার বাতী[১৫]।
দালানে বাঁধিয়া রাখপ গজমোতী হাতী[১৬]॥
হেলিয়া কঙ্কণ মাঞ্জা ন্যাতেতে জড়িয়া[১৭]।
য়্যাও রিশী[১৮] পোহাবরে সাধু খাড়া হাতে লয়্যা॥
আজকে নিশীথেরে যদি চুরার[১৯] নাগাল পাই।
খড়্গেতে কাটিয়া তারে চণ্ডীতি পাঠাই[২০]॥”
“থাপড়ে নিবাবরে নীল্যা তোমার দশ কোঠার বাতী।
দালানে পাছড়ায়ে মারব তোমার গজমোতী হাতী॥
দাওয়ায়্যা[২১] দিব নীল্যা তোমার এ পাইক প্রহরী॥
হেলিয়া কঙ্কণ মাঞ্জা নারে সয় তোমার টান।
যেমন লঙ্কা ধাওয়ায়্যা আসে বীর হনুমান॥
তার[২২] দিব তরু[২৩] দিবরে পায়েতে পাশলী।
গলেতে তুলিয়া দিব নীল্যা সুবর্ণ হাসলী॥
কাণে দিব কর্ণফুল হারে নাকে সোণার বেশর।
(ওরে) আরও কর্ম্ম কুইচ্যারে দিব যেমন ভ্রমরা পাগল॥”
“পাক দিয়া ফেলবরে সাধু তোমার অষ্ট অলঙ্কার।
তোমার মার নাম হৈল দোচারিণী যেমন বাপ তোমার গোয়ার॥”
“য়্যাও মাস গ্যালরে নীলা হারে সামনে বৈশাখ মাস।
তোমার যৌবন বাসরে নীল্যা না পুরিল আশ॥”
“এহি ত বৈশাখ হারে মাসে কিষাণ বাছে হুড়া।
(ওরে) বাহনে বাওয়া দিচ্ছে এ জালি কুমুড়া[২৪]॥”
“জালি কুমড়া খাইতেরে সাধু মনে করছাও আশ।
(যদি) জালি কুমড়া খাওরে সাধু তোমার মুখে ভাঙব বাশ॥”
“এহি ত জ্যৈষ্ঠ মাসে হারে গিরিষ্যির বাও।
ওরে দক্ষিণ দুয়ার দ্বারে তুমি আওল্যাইও কৈল ক্যাশ॥
এক শান্তি আমার মায়ে আরেক শান্তি আমি।
(ওরে) আরেক শান্তি কওনা যেমন আমার ছোট ভগ্নী॥”
“এহি ত আষাঢ় মাসরে নীল্যা গাঙে নতুন পানি।
(ওরে) তোমার পতি মরছেরে নীল্যা তাওত আমি জানি॥”
“যদি আমার পতি মরতরে সাধু শব্দ যাইত দূর[২৫]।
দিনে দিনে মৈল্যান হৈত আমার শিন্তার[২৬] সিন্দূর॥”
“এহি ত শ্রাবণ মাসরে নীল্যা খ্যাতে পাকা ধান।
বেজোড়া কোঁড়ার ডাকে তোমার উড়িবে পরাণ॥”
“ডাক ডাকুক ডুম্বারে ডাকুক পাঁজর করলাম শ্যাল।
বেজোড়া[২৭] কোড়ার ডাকে আমি ছাড়ব রাজার দ্যাশ।
(ওরে) তেওনা হব সাধুরে আমি হারে তোমার পরতাশ॥”
“এহি ত ভাদ্দর মাসে গাছে পাকা তাল।
জল খাইতে দিবরে ঝারি নীল্যা ভাত খাইতে থাল।”
“কেউ খাইল খের্ত্তরে অন্ন হারে কলা আর কোদলী।
দিনে দিনে পুষ্কুরে জোগায় যেমন বাড়ীর ম্যাইল্যানী[২৮]॥”
“এহি ত আশ্বিন মাসে হারে এ দুর্গা ভবানী।
আতপ চাউল আর কাঁচারে দুগ্ধ যেমন ব্রাহ্মণের ভোজনী।”
“য়্যাও মাস গ্যালরে নীল্যা হারে সামনে কার্ত্তিক মাস।
(ওরে) হাস্যমুখে কহরে কথা আমি যাই হাপনার দ্যাশ॥”
“কোন সহরে বাড়ী তোমাররে সাধু কোন সহরে ঘর।
ওরে কি নাম তোমার মাতাপিতা কি নামউী[২৯] তোমার।”
“বাড়ী আমার মরিচপুরে বাপ গদাধর।
মায়ের নামটি কওলারে সতী যেমন মোর নামটি সুন্দর॥”
“থাক থাক ওরে সাধু তোমরা নৌকাতে বসিয়া।
মাতাপিতার আগেরে আমি একবার জাইন্যা আসি গিয়া॥”
“ওগো মাতা ওগো পিতা তোমরা কি কর বসিয়া।
শিশুকালে দিছাও বিয়া জামাই চেন গিয়া॥”
“বার বচ্ছরের নীলা তেরো নারো পুরে।
যৌবনের ভারে নীলা আজ জামাই বলে কারে॥”
মাথে লৈয়া খৈল খরাসী হাতে তৈলের বাটী।
হেলিতে দুলিতে চল্লেন জামাই চিনিতি॥
“কোন সহরে বাড়ী তোমাররে সাধু কোন সহরে ঘর।
কি নাম তোমার মাতাপিতার হারে কি নামডী তোমার॥”
“বাড়ী আমার মরিচপুরে বাপ গদাধর।
মায়ের নামডী কওলারে সতী যেমন মোর নামডী সুন্দর॥”
“চিনিলাম চিনিলামরে সাধু তুমি নীলারই সোয়ামী।
নীলারে বামে রাইখ্যা ডাইনে বইস্য তুমি॥”
“যাওরে যাওরে ভাট বেরাম্মণ যাওরে মেলা দিয়া।
আজ ইস্তীক্ রৈল নীল্যা আমার খোপ কবুরে হয়্যা[৩০]॥”
বারো মাসে তেরো পদরে লওরে গুণিয়া।
য়্যাও গান বান্ধিয়া গাইছে জয়ধর বানিয়া॥
জয়ধর বানিয়া নারে দশরথের বাপ।
যেবা গায় যেবা শুনে খণ্ডে তার পাপ॥
.
টীকা
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন