১৩. রাত দুটোর সময়

জীবনানন্দ দাশ

রাত দুটোর সময় খুবই কাছাকাছি কোন্ একটা বাড়ির ভেতর বড় কান্নাকাটি পড়ে গেল; মাল্যবানের ঘুম গেল ভেঙে। তাড়াতাড়ি বিছানার থেকে উঠে কম্বল গায়ে দিয়ে সে দরজা খুলে রাস্তায় নামল। তাকিয়ে দেখল ধীরেনবাবুদের সদর দরজার কাছে ভিড় জমে গেছে। ঢুকে দেখল, একটি মেয়েমানুষের শব নিচে নামানো হয়েছে—মেয়েটির বয়েস পঁচিশ-ছাব্বিশ হবে হয়তো, এমন সুন্দর শান্ত নিরিবিলি মুখ-কপাল চুল সিন্দুরে মাখা-মাখা—দেখে তার প্রাণের ভেতর কেমন যেন করতে লাগল! অন্ধকার শীতের ভেতরে সে চুপে-চুপে নিজের ঘরে ফিরে এল আবার; খানিকটা সময় অবসন্ন হয়ে নিজের বিছানার ওপর বসে রইল;—তারপর আস্তে আস্তে সিঁড়ি ভাঙতে-ভাঙতে ওপরে গিয়ে দাঁড়াল।

মাল্যবান দেখল, উৎপলা আর মন বিছানায় উঠে বসে আছে। একটা চেয়ারে। বসে মাল্যবান বললে, আমিও ভেবেছিলাম, তোমাদের ঘুম ভেঙে যাবে

কারা কাঁদছে?

ঐ ধীরেনবাবুদের বাড়ি—

কী হল?

সত্যেনের স্ত্রী মারা গেছে।

আহা, সেই রমা!

হ্যাঁ।

কীসে মরল?

জানি না তো।

বাঃ, আমরা জানতে পারলাম না।

হঠাৎ হয়তো মারা গেছে—কোনো রোগ হয়েছে বলে শুনিনি তো।

হার্ট-ফেল করল। কিন্তু ওর স্বামী তো পুরুষমানুষ যাকে বলে। গলায় গামছা দিয়ে মেয়েমানুষকে ও-রকম জামাই টেনে আনতে দেখিনি তো কোথাও—অনেক জামাইষষ্ঠী তো দেখলুম–উৎপলা বললে।

এবারকার জামাইষষ্ঠী হয়ে গেছে, মা? কী মাসে জামাইষষ্ঠী হয়, মা?

মনুকে কনুই দিয়ে ঠেলে ফেলে উৎপলা বললে, সুখের পায়রার ঘাড়ে সোহাগের পায়রা করে রেখেছিল তো বৌকে। মেয়েটা এ-রকম ভিরমি খেল কেন গা।

কীসে কী হয়েছে, কে জানে। চানের সময় সমস্ত মুখে সাবান মাখতে-মাখতে যেন সংক্ষেপে কথা সারে, তেম্নি ভাবে বললে মাল্যবান।

আহা, দুটো কচিকাচা মেয়েও তো রয়েছে, ওদের কী হবে। সকলে মিলে দেখবে। অমন বাবা আছে। ঠাকুমা, পিসিমারা রয়েছে। যেন চোখে সাবান না যায় সেদিকে দৃষ্টি রেখে কটাকট-কটাকট কথা বলছে মাল্যবান—চানের সময় যেন মনে হচ্ছিল।

তা পাড়াপড়শী মরেছে, যেতে নেই?

আমি গিয়েছিলাম।

গেলে তো চোরের মতো, চলে এলে আবার?

তোমাদের একা ফেলে এ-রকম অবস্থায় বেশিক্ষণ তো সেখানে থাকা যায় না!

আহা-হা, শিমূলের তুলো উড়তে উড়তে মাদারকাটার গিয়ে ঠেকেছি আমরা। ধনেশপাখি এসে ঠোঁট নেড়ে খসিয়ে দেবেন— উৎপলা এক গা জ্বালাতন ঝেড়ে দাঁতে দাঁত ঘষে বললে।

আহা-হা!—আহা-হা! বলতে লাগল উৎপলা।

বিছানার থেকে নেমে আলনার থেকে একটা বোসা পেড়ে গায়ে বেশ আঁটসাটো জড়িয়ে নিয়ে উৎপলা বললে, আয় তো, মনু, কোটটা গায়ে দিয়ে।

মনুকে নিয়ে ধীরেনবাবুর বাড়ির দিকে রওনা দিল সে।

লৌকিকতা রক্ষা করছে, ভালোই; ভাবছিল মাল্যবান; কিন্তু মনুকে সঙ্গে নিচ্ছে? কেন? সামাজিকতা রক্ষার জন্যই শুধু যাচ্ছে না উৎপলা—যাচ্ছে দশ-পাঁচ রকম দেখবে বলে; হৃদয় আধার উৎপলার, বাইরের পৃথিবীটাও খুব সক্রিয় (আজ দুপুর-রাতেও), কয়েক ঘন্টার খোরাক জুটল উৎপলার। মাল্যবান অন্ধকারের ভেতর একটা বিড়ি জ্বালাল। কিন্তু তৎক্ষণাৎ সেটা ফেলে দিয়ে নিচে নেমে সদর দরজায় তালা মেরে ধীরেনবাবুদের বাড়িতে যাবার মাঝরাস্তায় উৎপলাকে পেয়ে বললে, এই নাও চাবি।

চাবি আমি কী করব?

নাও। আমি শ্মশানে যাচ্ছি।

উৎপলা ঠোঁট বসিয়ে বললে, পাড়ায় আর বামুন নেই, কাশীঠাকুর চিঁড়ে খাবে–

নাও, চাবিটা নাও, ধরো-মাল্যবান চাবিটা গছিয়ে দিয়ে বললে।

শ্মশানে যাবে মশানে যাবে, সেই একদিন যাবে, যাবে তো। নাও, পথ ছাড়ো—পথ ছাড়ো দিকিন, চৌখুপ্পী কম্বল জড়িয়ে রমাদের বাসায় ব্ল-অলা রাঘব বোয়ালের মতো হোঁৎ করে উজিয়ে উঠবার কোনো দরকার নেই তোমার

কতা শোনোকতা। মনটা একটু রঙে চড়ে ছিল বলে মাল্যবান থ-কে ত বানিয়ে দিয়ে বললে, রাঘববোয়াল আবার রঁ-অলা হয় না-কি। কতা শোনো! কতা! হি-হি করে কাঁপতে-কাপতে এগিয়ে গেল সে যেন বীরজননীর ছেলে-দেশের শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে যাচ্ছে; এ না হলে উৎপলাকে চমৎকৃত করে দেওয়া যাবে

কেমন যেন একটা প্রবল ছেলেমানুষি বীরপুরুষি ঝাপটা পেয়ে বসল তাকে; চমৎকৃত করে দেবার কী দরকার, ভাবতে গেল না সে; তার চেয়ে শীতরাতে নিচের ঘরের বিছানা-কম্বল যে সত্যিই ঢের পরিচ্ছন্ন সত্য শান্ত-মূল্য, মীমাংসার পৃথিবীতে সেটা ভুলে গেল।

সকল অধ্যায়

১. ০১. সারাদিন মাল্যবানের মনেও ছিল না
২. ০২. ওপরের ঘরটায় পলা আর মনু শোয়
৩. ০৩. দোতলার ঘরটার লাগাও বাথরুম ছিল
৪. ০৪. মাইনে তো আড়াই শো টাকা হল
৫. ০৫. মেজদারা তো থাকবেন অনেক দিন
৬. ০৬. পাথুরেঘাটার বাড়িটা
৭. ০৭. পরদিন সিনেমায়
৮. ০৮. বড় বৌঠানের সংবাদ
৯. ০৯. সেলাইয়ের কল
১০. ১০. পাশের বাড়ির ছোট্ট মেয়েটি
১১. ১১. স্ত্রী সন্তানের পাট চুকিয়ে দিয়ে
১২. ১২. কিছুই ভালো লাগছিল না
১৩. ১৩. রাত দুটোর সময়
১৪. ১৪. মড়া পুড়িয়ে বেলা দুটোর সময়ে
১৫. ১৫. মৃত্যু ও দাহের স্বপ্ন
১৬. ১৬. চা-জলখাবার খেয়ে
১৭. ১৭. প্রাণধারণের ব্যাপারে খারিজ
১৮. ১৮. ব্যবস্থা আবার আগের মতন
১৯. ১৯. মেজদার পরিবার এল
২০. ২০. সরস্বতী পূজোর দিন
২১. ২১. মেসের বিছানায় শুয়ে
২২. ২২. অফিস থেকে ফিরে উৎপলার কাছে
২৩. ২৩. মাল্যবান গোলদীঘিতে গেল
২৪. ২৪. মাল্যবানকে মেসে থাকতেই হল
২৫. ২৫. শীতের রাত

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন