৩.১ প্যারিসের রাস্তায়

ভিক্টর হুগো

তৃতীয় খণ্ড প্রথম পরিচ্ছেদ

প্যারিসের রাস্তায় একটা দুষ্টু ছেলেকে প্রায়ই ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। সব সময়ই তাকে প্রাণচঞ্চল দেখায়। তার মধ্যে আছে জ্বলন্ত চুল্লির উত্তাপ আর নতুন প্রভাতের আলোর উজ্জ্বলতা।

ছোট্ট এক সুখী মানুষ। রোজ তার খাওয়া হয় না। কিন্তু রোজ সন্ধ্যায় সে খেলতে যায়। তার গায়ে জামা নেই, পায়ে জুতো নেই, মাথার উপর ছাদ বা কোনও আচ্ছাদন। নেই। মাছির মতো সে যেন শুধু উড়ে বেড়ায়। তার বয়স হবে সাত থেকে তেরো’র মধ্যে। সব সময় দল বেঁধে থাকার চেষ্টা করে, পথে পথে ঘুরে বেড়ায়, ফাঁকা জায়গায় শোয়, তার বাবার একজোড়া পুরনো পায়জামা পরে। সেই ঢিলে পায়জামাটা তার গোড়ালি পর্যন্ত নেমে আসে। তার মাথার টুপিটাও অন্য একটা বুড়ো লোকের কাছ থেকে পাওয়া এবং সেটা কানের উপর ঝুলে পড়ে। সে প্রায়ই খুব হইচই করে বেড়ায়, চারদিকে চোখ চেয়ে তাকায়, সব জায়গায় যায়, প্রচুর সময় নষ্ট করে বাজে কাজে, কাফেগুলোর আনাচ-কানাচে ঘুরঘুর করে, শহরের প্রতিটি চোরকে চেনে এবং বাজে মেয়েদের সঙ্গে কথা বলে, নোংরা গান গায়। তবু তার মনের ভেতরে খারাপ কিছু নেই। তার অন্তরের মধ্যে আছে এক সরল নির্দোষিতার মুক্তো। মুক্তো কখনও জলে-কাদায় গলে যায় না। মানুষ যতদিন শিশু থাকে, ঈশ্বর তাকে নির্দোষ নিষ্পাপ রাখেন।

প্যারিস শহরটাকে যদি কেউ জিজ্ঞাসা করে, কে এই খুদে মানুষটা, কে এই বখাটে ছেলেটা? তা হলে শহরটা উত্তর দেবে, ও হচ্ছে আমার ছেলে।

.

২.

এই দুষ্টু বখাটে ছেলেটা হল এক দানবীর গর্ভে জাত এক ক্ষুদ্রকায় বামন।

ছেলেটার কপালে মাঝে মাঝে এক-আধটা জামা জোটে। কিন্তু সে জামার মোট সংখ্যা একটাই। কখনও বা সে হয়তো একজোড়া বুট জুতো পেয়ে যায়, কিন্তু সে জুতোর তলায় চামড়া থাকে না। তার হয়তো একটা বাসা আছে। সে বাড়ির দিকে তেমন মন নেই তার। সে বাড়ির দরজার উপর তার মা তার পথপানে চেয়ে বসে থাকে। বলেই সে মাঝে মাঝে বাড়ি যায়। কিন্তু পথটাই সে বেশি পছন্দ করে, কারণ সেখানেই সে বেশি স্বাধীনতা পায়। তার কতকগুলি নিজস্ব খেলাধুলা আছে। বুর্জোয়াদের ঘৃণাই তার একমাত্র শত্রু। তার কতকগুলি নিজস্ব কাজ আছে। সে পরের জন্য গাড়ি ভাড়া করে দেয়। সে বৃষ্টিতে কাদার মধ্য দিয়ে হেঁটে যায়। জনসাধারণের সুবিধার জন্য সে সরকার ঘোষিত আইন-কানুনগুলো ঘোষণা করে। ফুটপাথের উপর গজিয়ে ওঠা আগাছাগুলো তুলে ফেলে পথ পরিষ্কার করে। বিভিন্ন জায়গায় পড়ে থাকা লোহার টুকরোগুলো কুড়িয়ে এনে বিক্রি করে যে পয়সা পায় সেটাই তার একমাত্র আয়।

প্যারিসের বিভিন্ন জায়গায় পোকামাকড় ধরে সে আমোদ পায়। আরশোলা, বিছে, ব্যাঙ, প্রভৃতি কত সব পোকামাকড়। এক একসময় হঠাৎ তামাশা করে মানুষকে তাক লাগিয়ে দেবার অদ্ভুত একটা ক্ষমতা ছিল ছেলেটার। হঠাৎ হাসি-পরিহাসের তুফান তুলে চমকে দিত সে আশপাশের দোকানদারদের। এদিক দিয়ে তালিবাদের মতোই তার প্রতিভা ছিল।

রাস্তা দিয়ে যখন কোনও শবযাত্রা যেত তখন সেই দুষ্টু ছেলেটা অমনি শববাহকদের লক্ষ করে বলে উঠত, কী হে, ডাক্তার, সমাধি ভূমিতে কখনও কি কাজ করবে?

এমন সময় রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা চশমাপরা কোনও ভদ্রলোক হয়তো সেই দুষ্টু ছেলেটার দিকে ঘুরে প্রচণ্ড রাগের সঙ্গে বলে ওঠে, পাজি বদমাশ কোথাকার! তুই আমার স্ত্রীকে চিমটি কেটেছিস।

আমি মঁসিয়ে! দেখুন, এই তো আমি রয়েছি।

.

৩.

যেদিন কিছু পয়সা পায় ছেলেটা সেদিন সন্ধ্যায় সে থিয়েটার দেখতে যায় এবং থিয়েটারের হলের মাঝে পা দিয়েই সে যেন অন্য মানুষ হয়ে যায়। শুককীটের কাছে যেমন প্রজাপতি তেমনি তার কাছ থিয়েটার। থিয়েটার হলটা যেন আমোদ-প্রমোদে ভর্তি একটা জাহাজ। সে সেখানে গেলেই আনন্দের জোয়ার এসে যায় তার জীবনে। আনন্দের। আবেগে সে বারবার হাততালি দেয়, যেন কোনও পাখি ডানা ঝাঁপটাচ্ছে। থিয়েটার তার কাছে স্বর্গ হয়ে ওঠে।

শিল্প-সাহিত্যের প্রতি তার যে কোনও আগ্রহ থাকে না, তা নয়। কিন্তু চিরায়ত শিল্প-সাহিত্যের দিকে তার কোনও ঝোঁক থাকে না। তার কোনও উন্নত রুচিবোধ থাকে না। উদারহণস্বরূপ বলা যেতে পারে ম্যাদময়জেল মাবস্ নামে কোনও অভিনেত্রীর নাম করলে সে তাকে ম্যাদময়সেল হিউশ বলে ডাকে।

কখনও আনন্দে ফেটে পড়ে সে, কখনও উচ্ছ্বাসে চিৎকার করে, হৈ-হুল্লোড় করে হাততালি দেয়, ঝগড়া করে, সবজান্তা হয়ে ওঠে, ছেলের পোশাক পরে এক খুদে দার্শনিক হয়ে ওঠে। একই সঙ্গে সে হয়ে ওঠে এক স্পার্টান আর পকেটমার। জ্ঞানে পাগল, গানে গল্পে আনন্দে উচ্ছল হয়ে সে কাদা মেখে অলিম্পাসে ঘুরে বেড়ায় যেন।

প্যারিসের রাস্তার যত সব বখাটে ছেলেরা সবাই যেন ছোটখাটো এক একটা রাবায়েত। তারা অল্পতেই বিস্মিত হয়, কিন্তু সে বিস্ময় রেখাপাত করে না তাদের মনে। তারা কুসংস্কারকে ঘৃণা করে, যে কোনও আতিশয্য বা অতিশয়োক্তিতে তাদের কোনও উৎসাহ নেই, কোনও অতিপ্রাকৃত বা রহস্যময় কোনও বস্তু বা ঘটনাতে তাদের বিশ্বাস নেই। মহাকাব্যসুলভ কোনও ভাবসমুন্নতিকে তারা উপহাস করে উড়িয়ে দেয়। কাব্য বা মহাকাব্য যে একেবারে মানে না তা নয়। কিন্তু কাব্যের রস সম্বন্ধে তাদের বোধ থাকলেও তাদের অসম্মানজনক উক্তির দ্বারা যে কোনও কাব্যরসকে বিকৃত করে দেয় তারা। কোনও দৈত্যদানবের অভিনয় দেখে তারা মন্তব্য করে, সার্কাসের একটা ভড়।

.

৪.

প্যারিস শহরে একই সঙ্গে কোনও পথচারী ভদ্রলোক আর রাস্তার বখাটে ছেলে দেখা যায় না। একই সঙ্গে সম্ভ্রমশীল ভদ্রতা আর নগ্ন বিশৃঙ্খলা কোনও শহরে দেখা যায় না। পাশাপাশি। ভদ্র পথচারী যেমন রাজতন্ত্রের ধারক ও বাহক, তেমনি ভবঘুরে বখাটে ছেলেগুলো অরাজকতার প্রতীক।

প্যারিস শহরের এইসব রাস্তার ছেলেরা রাজপথের আনাচ-কানাচে আর অলিগলিতে জন্মায় আর বেড়ে ওঠে। সমাজজীবনের যত সব কঠোর বাস্তবতা আর দুঃখকষ্টের মধ্যে তারা মানুষ হয়। তাকে দেখে মনে হয় সে কিছু জানে না বা বোঝে না। কিন্তু আসলে তা নয়। সে যেমন হাসতে পারে তেমনি আবার আরও অনেক কিছু করতে পারে। যারা অন্যায়, অবিচার, স্বৈরাচার প্রভৃতির প্রতীক তাদের বোঝা উচিত ওই সব ছেলেরা বেড়ে উঠছে, তারা এই সবকিছু দেখছে।

সমাজের যে কদর্য মাটি থেকে এইসব পথসন্তানের জন্ম সেই মাটি থেকেই আদিমতম মানবসন্তান আদমেরও জন্ম। নির্মম নিয়তি তাদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলে। তারা ক্ষুদ্রকায় আর নিরহঙ্কার, অমার্জিত, অসভ্য; কিন্তু পরিণত বয়সে কী হবে আর দেশের ভাগ্যবিধাতাদের সৃষ্টি করে, সেই আত্মা তাদের জীবনটাকে কিভাবে গড়বে? কুমোরের চাকার মতো সৃষ্টির সেই নিষ্ঠুর চাকাটা কোন পথে ঘোরাবে?

.

৫.

রাস্তার ওই সব বখাটে বেয়ো বাউণ্ডুলে ছেলেরা জনবহুল শহরের পথঘাট যেমন ভালোবাসে তেমনি ভালোবাসে নির্জনতা। তারা একাধারে ফামকাসের মতো নগরপ্রেমিক, আবার ক্লাকাসের মতো পল্লিপ্রেমিক।

প্যারিস শহরের প্রান্তে মফস্বল অঞ্চলে কেউ যদি দার্শনিকের মতো ঘুরে বেড়ায় তা হলে একই সঙ্গে গ্রাম আর নগরের শোভা দেখে বিমোহিত হয়ে যাবে সে। এই মফস্বল অঞ্চল আপাত দৃষ্টিতে দেখতে কুৎসিত হলেও তার একটা নিজস্ব শোভা আছে। সেখানে দেখা যাবে লম্বা লম্বা গাছগুলোর জায়গায় কিভাবে সেখানে গড়ে উঠেছে বড় বড় বাড়ি। পথের দু ধারে সবুজ ঘাসের উপর নির্মিত হয়েছে শানবাঁধানো ফুটপাত, চষা জমিগুলোর উপর গড়ে উঠেছে কত সব বড় বড় রাজপথ আর দোকানঘর। এইসব দেখে শুনে চিন্তাশীল মানুষরা বিশেষ আগ্রহের সঙ্গে ভাবতে থাকে অনেক কিছু। গ্রাম্য প্রকৃতির এই রূপান্তর দেখে তারা বিষণ্ণ না হয়ে পারে না।

এই কাহিনীর লেখকও একদিন এইসব অঞ্চলে অনেক ঘুরে বেড়িয়েছেন।

আমাদের মতো যারা প্যারিস শহরের উপকণ্ঠে মফস্বল অঞ্চলের অপেক্ষাকৃত নির্জন পরিবেশে ঘুরে বেড়িয়েছে, তারা নিশ্চয় কোনও পরিত্যক্ত জনহীন জায়গায় ছেঁড়া ময়লা পোশাকপরা নোংরা একদল ছেলেকে জটলা পাকিয়ে থাকতে দেখেছে। তারা হল যত সব গরিব ঘরের পালিয়ে আসা ছেলে। যেসব নোংরা জায়গায় কেউ থাকে না সেইসব জায়গাই তাদের বাসস্থান। তারা চিরদিনের ভবঘুরে। তারা কোনও বিধিনিষেধের ধার ধারে না কখনও, মুখে তাদের যত সব নোংরা গান লেগেই আছে। তারা কোনওদিন স্নান করে না, নোংরা গা-হাত পরিষ্কার করে না। শুধু ঝোপে-ঝাড়ে বনফুল তুলে বেড়ায়। এখানে-সেখানে মার্বেলের গুলি খেলে। একটা পয়সা নিয়ে কাড়াকাড়ি করে, ঝগড়া করে। তারা সমাজের অবজ্ঞাত অবহেলিত, তবু তারা সুখী। প্যারিস শহরের উপান্তবাসী এইসব গরিব হতভাগ্য ছেলেদের দেখার সঙ্গে সঙ্গে একই সঙ্গে মন আনন্দে উফুল্ল হয় এবং দুঃখে হৃদয় বিদীর্ণ হয়।

মাঝে মাঝে ওই সব ছেলেদের দলের মধ্যে দু চারটে মেয়েকেও দেখা যায়। এইসব মেয়েরা হয়তো ওই সব ছেলেদেরই বোন। ওই সব মেয়েদের মধ্যে দু একটা বেশ বড় মেয়েও আছে। তাদের চেহারাগুলো রোগা, রোদেপোড়া তামাটে রঙ, মাথায় ঘাস বা লতাপাতার টুপি, খালি পা। প্রায়ই দেখা যায় তারা ঘাসে ঢাকা বনপথে দাঁড়িয়ে চেরিফল খাচ্ছে। সন্ধের সময় তাদের হাসির শব্দ শোনা যায়। দুপুরের রোদে বা রাত্রির অন্ধকারে যখনি তারা কোনও পথিকের চোখে পড়ে তখনি তাদের কথা না ভেবে পারে না সে। পথিক। সে পথিকের মনে অনেকদিন বেঁচে থাকে তারা।

ওই সব ছেলেমেয়েদের কাছে প্যারিস শহরই হল সারা জগতের কেন্দ্রস্থল। এই শহরের চারপাশই হল সে জগতের পরিধি। মাছ যেমন জল ছেড়ে কোথাও যায় না। তেমনি তারা এই প্যারিস শহর ছেড়ে কোথাও যায় না। তাদের মতে এই শহরের সীমানার বাইরে আর কোনও জগতের অস্তিত্ব নেই।

.

৬.

এই কাহিনী যখন লেখা হয় তখন প্যারিসে ভবঘুরে ছেলেদের সংখ্যা অনেক বেশি ছিল। তখন প্রতিবছর ২৬০ জন করে নিরাশ্রয় ছেলেকে ধরা হত। যে সব নতুন বাড়ি নির্মাণ হত সেইসব জায়গায় অথবা কোনও পুলের তলায় তারা থাকত। যে কোনও অপরাধ ও কুকর্ম এদের থেকেই শুরু হয়।

তবু অন্যান্য শহরের বখাটে ছেলেদের থেকে প্যারিসের গৃহহারা বখাটে ছেলেদের একটা পার্থক্য ছিল। তারা অপরাধ এবং কুকর্ম করে বেড়ালেও তাদের মধ্যে একটা প্রচ্ছন্ন নীতিবোধ ছিল। তারা ছেঁড়া ময়লা পোশাক পরে থাকলেও তাদের মধ্যে একটা আশ্চর্য সততা ছিল। যে কোনও জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবে তারা অংশগ্রহণ করত। সমুদ্রের জলে যেমন লবণ গলে থাকে তেমনি প্যারিসের দুর্নীতিমূলক বিষাক্ত আবহাওয়ার ভেতরেও একটা বিকৃত নীতিবোধ মিশে থাকত সব সময়।

তথাপি এই ধরনের কোনও বখাটে ছেলেকে পথে দেখলেই তাদের মধ্যে একটা ভগ্ন দুঃখী পরিবারের কথা মনে পড়ে যায়। আমাদের যে সভ্যতা আজও পরিণতি লাভ করতে পারেনি, সে সভ্যতায় এই ধরনের ছিন্নভিন্ন পরিবারের ঘটনা এমন কিছু আশ্চর্য নয় যে সব পরিবার থেকে তাদের ছেলেরা ছিটকে বেরিয়ে এসে পথে আশ্রয় নেয়। এক জটিল দুর্ভাগ্য তাদের যেন প্যারিসের পথের উপর আছাড় মেরে ফেলে দেয়। রাজতন্ত্রের যুগে এইসব পরিত্যক্ত ছেলেদের সহজভাবে এক স্বাভাবিক ঘটনা বলে মেনে নেওয়া হত। মিশর থেকে আসা ভবঘুরেদের নিয়ে অনেকে বই লিখত। তাদের লেখাপড়া শেখার কোনও ব্যবস্থা ছিল না। সবাই বলত অল্প লেখাপড়া শেখার থেকে না শেখা ভালো।

ফ্রান্সের রাজা চতুর্দশ লুই-এর আমলে এইসব ভবঘুরে ছেলেদের নৌকোর দাঁড় টানার জন্য দরকার হত। অনুকূল বাতাসের ওপর নির্ভরশীল জাহাজগুলো যখন সমুদ্রের উপর নোঙর করে থাকত তখন সেইসব জাহাজে যাওয়া-আসা করার জন্য দাঁড়-টানা কতকগুলি নৌকোকে উপকূলের সঙ্গে জাহাজগুলোর যোগাযোগ রক্ষা করে চলতে হত। রাস্তায় পনেরো বছরের ঊর্ধ্বে কোনও ভবঘুরে ছেলে দেখলেই তাকে নৌকার দাঁড় টানার জন্য নিয়ে যাওয়া। হত। জেলখানার কয়েদিদেরও অনেক সময় এ কাজে নিযুক্ত করা হত। নাবিক দাস।

কিন্তু রাজা পঞ্চদশ লুই-এর আমলে পুলিশ এইসব ছেলেদের পথে দেখলেই ধরে নিয়ে যেত। তার কারণ জানা যায়নি। তবে অনেক পরিবারের পিতামাতারা এ বিষয়ে আইন প্রণয়নের জন্য চাপ দিত। কোনও ছেলের বাড়ি থেকে পালিয়ে এসে পথে আশ্রয় নেওয়া নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়।

.

৭.

প্যারিসের ভবঘুরে ছেলেদের দলে সবাই যোগদান করতে পারে না। তাদের আবার শ্রেণিবিভাগ আছে। ফরাসি ভাষায় তাদের গামি বলত।

এই ভবঘুরে ছেলেদের মধ্যে কয়েকজন আবার এক একটা কাজের জন্য তাদের দলের ছেলেদের শ্রদ্ধা পায়। একবার একটা ভবঘুরে ছেলে নোতার দ্যাম গির্জার উপর একজনকে পড়ে যেতে দেখে। তাদের মধ্যে আবার একজন বীর একটা সেবা প্রতিষ্ঠানের পেছনের দিকে কতকগুলি পাথরের প্রতিমূর্তি থেকে অনেকটা সিসে নিয়ে যায় চুরি করে। আর একজন একবার একটা ঘোড়ার গাড়িকে উল্টে যেতে দেখে। আর একজন একসময় এক সৈনিককে একটা লোকের চোখে ঘুষি মারতে দেখে। যে গির্জার। উপর থেকে একটা লোককে পড়তে দেখে সে নিজের মনে বলতে থাকে, আমার কী দুর্ভাগ্য যে আমি পাঁচতলা থেকে একটা লোককে পড়তে দেখি।

কারও স্ত্রী যদি অসুখে মৃতপ্রায় হয়ে ওঠে তা হলে গায়ের চাষিরা তাকে বলত, অসুখ হয়েছে তো ডাক্তার ডাকার দরকার কী মঁসিয়ে? গরিবরা নিজেদের অসুখে নিজেরাই ডাক্তার। একদিন এক ভবঘুরে ছেলে একটা ফাঁসির আসামিকে বধ্যভূমিতে যাবার পথে একজন যাজকের সঙ্গে কথা বলতে দেখে যাজকের উদ্দেশে মন্তব্য করেছিল, নোংরা লোকটা যেন এক বিমানচালকের সঙ্গে কথা বলছে।

এইসব ছেলেরা গিলোটিন দেখেও নানারকম অপ্রিয় মন্তব্য করে থাকে। শুধু পথে পথে বেড়ায় না, কখনও তারা কোনও পাঁচিলে বা বাড়ির ছাদে ওঠে পাইপ বেয়ে। কখনও গাছে চড়ে। গাছ এবং চিমনির মাথাগুলো তাদের কাছে জাহাজের নাবিকদের কাছে যেমন মাস্তুল। কখনও কখনও আবার বধ্যভূমিতে গিয়ে ফাঁসির কাঠ ধরে ঝোলে।

এক একসময় তাদের কলাকৌশল দেখে তাদের প্রশংসা না করে পারা যায় না। একবার জুভা নামে একজন দণ্ডিত আসামিকে সাহসের সঙ্গে গিলোটিনে ফাঁসি বরণ করতে দেখে একটা ভবঘুরে ছেলে বলে, ওকে দেখে হিংসা হচ্ছে। কারণ গিলোটিনে যারা ফাঁসি যায় তাদের কথা সবাই মনে রাখে যুগ যুগ ধরে।

তাদের মধ্যে কেউ কোনও দুর্ঘটনায় পড়লে অন্য সবাই শ্রদ্ধার চোখে দেখে তাকে। তারা বলে, ওর এমন কেটে গেছে যে হাড় পর্যন্ত বেরিয়ে গেছে। যে যত আহত হয় সে তত বেশি শ্রদ্ধা পায়। কারও স্বাস্থ্য বলিষ্ঠ হলে সে ঘুষি পাকিয়ে বড়াই। করে বলে, আমি খুব শক্তিমান। তাদের মধ্যে কেউ যদি নেটা হয় অর্থাৎ বাঁ হাতে সব কাজ করে অথবা কেউ যদি টেরা হয় তা হলেও সে বেশি শ্রদ্ধা পায় আর পাঁচজনের কাছ থেকে। সবাই তাকে ঈর্ষা করে।

.

.

গ্রীষ্মকালে তারা ব্যাঙের মতো হয়ে যায়। সন্ধ্যার অন্ধকার ঘন হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তারা কয়লাবোঝাই জাহাজ অথবা ধোবানীদের নৌকো থেকে সেন নদীর জলে ঝাঁপ দেয়। এমনি করে নির্লজ্জভাবে তারা তাদের শালীনতাবোধ বিসর্জন দিয়ে পুলিশ আইন ভঙ্গ করে। কিন্তু পুলিশ তাদের ধরে না। অনেক সময় তাদের এই কাজের ফলে এক নাটকীয় দৃশ্যের অবতারণা হয় রাজপথে। অনেকে তাদের তাড়া করে।

কখনও কখনও দেখা যায় কোনও কোনও ভবঘুরে ছেলে লিখতে-পড়তে পারে। কেউ কেউ আবার ছবি আঁকতে পারে। একজন অন্যজনকে শেখায়। ১৮১৫ সাল থেকে ১৮৩০ সালের মধ্যে ভবঘুরে ছেলেরা তুর্কিদের ডাক নকল করে এবং ১৮৪৫ সালের মধ্যে তারা ছবি আঁকতে শেখে।

কোনও এক গ্রীষ্মের সন্ধ্যায় রাজা লুই ফিলিপ যখন পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরছিলেন তখন তিনি পথের ধারে দেখেন একটি বেঁটে-খাটো ভবঘুরে ছেলে একটা স্তম্ভের উপর এক সামন্তের মূর্তি আঁকছিল। রাজা লুই ফিলিপ তাঁর পিতার মতোই অমায়িক এবং মধুর স্বভাবের ছিলেন। তিনি ছেলেটাকে তুলে ধরে ছবিটাকে শেষ করার সুযোগ করে দেন। তার পর আঁকার কাজ হয়ে গেলে তাকে একটা মুদ্রা পুরস্কারস্বরূপ দান করেন।

ভবঘুরে ছেলেরা যে কোনও বিশৃঙ্খলা আর গোলমাল ভালোবাসে। যাজকদের তারা ঘৃণা করে। একবার ৬৯ নম্বর একটা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে একটা ভবঘুরে ছেলে বিদ্রুপাত্মক অঙ্গভঙ্গি করে। যখন তাকে বলা হয় এ কাজ কেন সে করল তখন সে উত্তর। করেছিল ওখানে ছোট গির্জার এক যাজক থাকে। কিন্তু ভলতেয়ারের মতো ভবঘুরে ছেলেদের ধর্মে বিশ্বাস না থাকলেও তাদের কাউকে যদি কয়ের বয়’ বা প্রার্থনার স্তোত্ৰগানের কাজ দেওয়া হত তা হলে সে কাজ সে সুষ্ঠুভাবে করত। ভবঘুরে ছেলেদের জীবনে দুটো উচ্চাভিলাষ কখনও পূরণ হয় না। তাদের একটা উচ্চাভিলাষ হল সরকারের পতন ঘটানো আর একটা উচ্চাভিলাষ হল তাদের ছেঁড়া পায়জামায় তালি লাগানো।

প্রতিটি ভবঘুরে ছেলেই প্যারিসের সব পুলিশকে চেনে। তাদের সবার নামও জানে। পুলিশদের জীবনের সব কথা তারা জানে। তাদের স্মৃতিগুলোকে ভবঘুরে ছেলেরা গেঁথে রাখে মনের মধ্যে। কোনও পুলিশ সম্বন্ধে কোনও ভবঘুরে ছেলেকে যদি কোনও কিছু জিজ্ঞাসা করা হয় তা হলে সে অকুণ্ঠভাবে বলবে, ওই পুলিশটা হল একটা ভণ্ড, প্রতারক,… ওই পুলিশটা হল একটা নোংরা শুয়োর… ওই পুলিশটাকে দেখলে হাসি পায়।

.

৯.

সার্কাসের ক্লাউন ভাড় পোকেলিনের মধ্যে ভবঘুরে ছেলেদের একটা ভাব দেখা যায়। পোকোলিনের জন্ম হয় লে হ্যাঁনেতে। বোমারসাই-এর মধ্যেও এই ভাব দেখা যায়।

ভবঘুরেরা সাধারণত আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন, পরিহাসরসিক এবং দুর্বিনীত। তাদের দাঁতগুলো খারাপ, কারণ তারা কম খায়। তাদের চোখগুলো সুন্দর, কারণ তাদের বুদ্ধি তীক্ষ্ণ। জেহোভা যদি একবার হাতছানি দিয়ে ডাকে তা হলে তারা স্বর্গের সিঁড়ি বেয়ে উঠে যাবে। তারা হাত-পা দিয়ে লড়াই করে। তারা যে কোনও দিকে যে কোনও কর্মক্ষেত্রে উন্নতি করতে পারে। তারা কখনও রাস্তার ধারে খালে খেলা করে, আবার কখনও বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। তাদের ঔদ্ধত্য বা বিদ্রোহী ভাব বন্দুকের গুলির ভয় করে না। তারা খেলা করতে করতেই বীর হয়ে উঠতে পারে। খেলার ছলেই বীরত্ব দেখায়। থিবস্-এর ছেলেদের মতো সিংহের লেজ ধরে টানাটানি করে। জয়ঢাকের বাজনা শুনেই ‘আহা বলে চিৎকার করতে থাকে। মুহূর্ত মধ্যে তারা সাধারণ ছেলে থেকে দৈত্য-দানবে পরিণত হয়।

এককথায় তারা অসুখী বলেই আমোদ-প্রমোদের দিকে বেশি নজর দেয়।

.

১০.

প্যারিসের বর্তমান ভবঘুরে ছেলেরা রোমের অধীনস্থ গ্রিক ছেলেদের মতো। তাদের ললাটে আছে প্রাচীন জগতের ছাপ। তারা একদিকে জাতীয় আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক, আবার একদিকে এক দুরারোগ্য ব্যাধি, যে ব্যাধি অবশ্যই সারিয়ে তুলঁতে হবে। কিন্তু কেমন করে? আলোর দ্বারা। যে আলো সমগ্রতা দান করে, যে আলো মনের অন্ধকার দূর করে, মনকে আলোকিত করে।

সমস্ত ফলপ্রসূ সামাজিক প্রবৃত্তিগুলো জ্ঞান, সাহিত্য, শিক্ষা প্রভৃতি থেকে জন্মলাভ করে। শিক্ষা আর প্রকৃত জ্ঞানের আলোই পূর্ণতা দান করে। আজ হোক কাল হোক, ব্যাপক লোকশিক্ষাই পূর্ণ সত্য প্রতিষ্ঠা করবে সারা দেশে। আজ যারা দেশের শাসনকর্তা তাদের ঠিক করতে হবে, প্যারিসের ছেলেরা সত্যিকারের মানুষ হয়ে উঠবে, না পথে পথে ঘুরে বেড়াবে। আজকের এই ভবঘুরে ছেলেরাই প্যারিসের ভবিষ্যৎ, আর প্যারিস হচ্ছে সারা দুনিয়ার ভবিষ্যৎ।

প্যারিস হচ্ছে মানবজাতির মাথার ছাদ। এই বিশাল জনবহুল শহর একাধারে প্রাচীন এবং বর্তমান জীবনযাত্রার জীবন্ত এবং শ্রেষ্ঠ প্রতীক। প্যারিসকে দেখা মানেই ইতিহাসের গতিপ্রকৃতিকে প্রত্যক্ষ করা। জগতে কী এমন আছে যা প্যারিসে নেই? তার মধ্যে আছে ভবিষ্যদ্বক্তা এবং রাজার সৃষ্টিকর্তা, রাজনীতিবিদ আর জাদুকর। রোম একদিন একজন অভিজাত ও সম্ভ্রান্ত বারবণিতাকে সিংহাসনে বসিয়েছিল আর প্যারিসে তেমনি একদিন একজন সাধারণ নিম্নমানের মেয়েকে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করেছিল। ফ্রান্সের রাজা পঞ্চদশ লুই যদি ক্লডিয়াসের সমকক্ষ হন তা হলে মাদাম দু ব্যারি অবশ্যই মেসালিনার থেকে ভালো ছিলেন। যদিও পুটার্ক বলতেন অত্যাচারীরা বেশিদিন বাঁচে না তথাপি সুন্না আর ডোমিসিয়ানের অধীনে রোমকে অত্যাচার ভোগ করতে হয়। কিন্তু রোমের মানুষ নরকের লেথি নদীর মতো টাইবার নদীতে স্নান করেই সব অত্যাচারের কথা ভুলে যেত। কিন্তু প্যারিসের লোকরা বিদ্রোহ করতে জানে।

জগতের কোথাও ভালো-মন্দ এমন কোনও দিক নেই যা প্যারিসে নেই। এখানকার হোটেলে-রেস্তোরাঁয় যেমন প্রতীক্ষমানা বারবণিতা পাওয়া যায় তেমনি এই প্যারিসেরই কোনও হোটেলে একদিন ডেভিড দ্য অ্যাঙ্গার্স, বলজাক আর শার্লকের মতো প্রতিষ্ঠাবান ব্যক্তিরা একসঙ্গে বসে থাকতেন। জ্ঞান-বিজ্ঞানের জগতে তার প্রাধান্য সর্বাধিক। ওর প্রতিভা বিকশিত হয়ে ওঠে তার ছত্রচ্ছায়ায়। এ শহরের একদিকে যেমন অ্যাডনিস তার দ্বাদশ চক্রবিশিষ্ট বজ্রবিদ্যুতের রথে চড়ে চলে যায়, তেমনি তার অন্য দিক দিয়ে সাইলেনাস গাধার পিঠে চেপে চলে যায়।

প্যারিসই হল সারা জগতের এক ক্ষুদ্র প্রতিরূপ। জগতের দেখার মতো যত সব সভ্যতা ও বর্বরতা আছে সেইসব সভ্যতা বর্বরতার দ্বৈত উপাদানে গড়া যেন এই প্যারিস। তাই তার গিলোটিন না থাকাটাই অস্বাভাবিক হত তার পক্ষে। এথেন্স, রোম, সাইবারিস, জেরুজালেম, পন্তিন প্রভৃতি সব নগরী প্যারিসের মধ্যেই আছে। প্লেস দ্য গ্রিভে যদি মাঝে মাঝে দু’একটা ফাঁসি না হত তা হলে অবিমিশ্র অবাধ একটানা আনন্দ-উৎসব ভালো লাগবে কেন? সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে আবার আইন ভালো কাজই করেছে।

.

১১.

প্যারিসে কোনও কিছুরই সীমা-পরিসীমা বলে কিছু নেই। যে পরিমাণ প্রভুত্ব সে করে এসেছে দীর্ঘকাল ধরে সে পরিমাণ প্রভুত্ব আর কোনও শহর করতে পারেনি কোনও দিন। আবার এখানকার লোকেরা বিজিতদের বিদ্রূপ করার ব্যাপারেও সিদ্ধহস্ত। আলেকজান্ডার একদিন এথেন্সের অধিবাসীদের বলেছিলেন, আমি শুধু তোমাদের সন্তুষ্ট করতে চাই। প্যারিস শুধু আইন প্রণয়ন করে না; সে নিত্য নতুন অনেক ফ্যাশানও সৃষ্টি করে। আবার শুধু ফ্যাশান নয়, অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনারও জন্ম দেয় সে। প্যারিস যখন নির্বোধ হয়ে থাকে তখন সারা জগৎ নির্বোধ থাকে তার সঙ্গে। আবার প্যারিস যখন নিজের ভুল বুঝতে পারে এবং স্বীকার করে, ‘আমি কত বোকা!’ তখন সারা জগতের চোখ খুলে যায়। তখন সারা জগতের পানে তাকিয়ে হাসতে থাকে প্যারিস। কী আশ্চর্য এই শহর! তার আনন্দোচ্ছলতা বিদ্যুতের চমক; তার চঞ্চলতায় রাজার রাজদণ্ড কেপে ওঠে। তার মুখে মেঘ নেমে এলে ঝড়ের সৃষ্টি হয়। আগ্নেয়গিরির অগ্নদগারের মতো তার অট্টহাসিতে সমস্ত জগৎ কাঁপতে কাঁপতে ফেটে পড়ে। তার বিস্ফোরণ, বিক্ষোভ, তার সংকট, শিল্প সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠ কীর্তিসমূহ, তার কাব্য-মহাকাব্য সারা জগতে ছড়িয়ে পড়ে। সেই সঙ্গে তার অশালীনতা ও অধর্মাচরণের কথাও সারা জগৎ জানতে পারে। সব দিক দিয়ে সে সত্যিই অপূর্ব। তার ১৪ জুলাই-এর বিক্ষুব্ধ কর্মাকর্ম সারা জগৎকে মুক্ত করে। ৪ আগস্ট এই শহরে যা ঘটে তাতে হাজার বছরের সামন্তবাদ মাত্র তিন ঘণ্টায় বিলুপ্ত হয়ে যায়। তার যুক্তিবাদ দিয়ে বৈশ্বিক ইচ্ছার হাতকে শক্ত করে। সে নিজেকে এক মহৎ ভাবাদর্শে সমুন্নত করে সেই আদর্শের আলো দিয়ে ওয়াশিংটন, কোশিউষ্ণু, বলিভার, বায়রন আর গ্যারিবল্ডির আত্মাকে আলোকিত করে। পৃথিবীর যেখানেই নতুন যুগের প্রভাত হয়েছে, সেখানেই তার আত্মিক উপস্থিতির প্রভাব প্রত্যক্ষ করা গেছে। যেমন ১৭৭৯ সালে বোল্টনে, ১৮৪৮ সালে পেস্থে, ১৮৬১ সালে পালার্মোতে। আমেরিকায় ব্রিটিশবিরোধী উচ্ছেদবাদীদের কানে কানে স্বাধীনতার মন্ত্র প্যারিসই উচ্চারণ করে। জলের ধারে গাছের ছায়াবনে সমবেত আনকোনার দেশপ্রেমিক বিপ্লবীদের সে-ই প্রেরণা দান করে। প্যারিস থেকে যে স্বাধীনতার হাওয়া বয় সেই হাওয়াতেই মিসসালোদিতে বায়রনের মৃত্যু ঘটায়। প্যারিসই ছিল সেই ভিত্তিভূমি যার উপর মিরাববা দাঁড়িয়েছিলেন, আবার প্যারিসই ছিল সেই গহ্বর যার করাল গ্রাসে রোবোস্পিয়ার পড়ে যান। তার বই, নাটক, এবং রঙ্গমঞ্চ, তার বিজ্ঞান, কলাবিদ্যা, দর্শন সমগ্র মানবজাতির কর্ম ও চিন্তার মূলমন্ত্র হয়ে ওঠে–পাস্কেল, রেনার, কর্নেল, দেকার্তে, রুশো, ভলতেয়ার, মলিয়ের সকল যুগের মনীষী হিসেবে স্বীকৃত হন। তার ভাষা বিশ্বমানবের ভাষা হয়ে ওঠে, যে ভাষা বিশ্বের সকল জাতির মানুষের মনে স্বাধীনতা এবং প্রগতির ভাবধারা জাগায়। ১৭৮৯ সালের পর থেকে সকল দেশের বীরপুরুষেরা প্যারিসের কবি এবং চিন্তাশীলদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হন। এত কিছু সত্ত্বেও প্যারিসের পথে পথে ভবঘুরে ছেলেরা খেলা করে বেড়ায়। যে প্যারিসের বিরাট প্রতিভা জগৎকে পথ দেখায় সেই প্যারিসেরই ভবঘুরে ছেলেরা পোড়া কয়লা দিয়ে থিসিয়াসের মন্দিরের দেয়ালে নানারকম মূর্তি এঁকে চলে।

এই হল প্যারিস শহর। তার চিমনির ধোয়া জগতের চিন্তা জোগায়। কিছু কাঠ, কাদা মাটি আর পাথর দিয়ে গড়া সামান্য একটা শহর হলেও তার একটা নৈতিক সত্তা আছে। প্যারিস মহান থেকে মহত্ত্বর; বিরাট সমৃদ্ধির অন্ত নেই তার। কিন্তু কেন? কারণ সে সবকিছুতে সাহস করে এগিয়ে যায়।

সাহসই হচ্ছে যে কোনও অগ্রগতির মূল ও ফলশ্রুতি। যে কোনও বড় রকমের জয়ই হল সাহসের অল্পবিস্তর পুরস্কার। ফরাসি বিপ্লবের সংগঠনের জন্য মন্টেন্ধুর ভবিষ্যদ্বাণীই যথেষ্ট ছিল না। দিদেরোর প্রচারের জন্য ফরাসি বিপ্লব ঘটেনি, বোমারসাই ঘোষণা করেছিলেন বলেও তা ঘটেনি, কন্দরসেতের পরিকল্পনার জন্যও তা ঘটেনি, আরুয়েৎ পথ পরিষ্কার করেছিলেন এবং রুশো তার স্বপ্ন দেখেছিলেন বলেও তা ঘটেনি এই ফরাসি বিপ্লব ঘটানোর জন্য দাঁতনের দরকার ছিল।

মানবজাতিকে যদি এগিয়ে যেতে হয় তা হলে তার সামনে সাহসিকতার গৌরবোজ্জ্বল দৃষ্টান্ত থাকা দরকার। সাহসিকতার কাজই ইতিহাসের পাতাকে উজ্জ্বল করে তোলে, মানুষের আত্মাকে আলোকিত করে। যে কোনও সূর্যোদয় বা নতুন যুগের সূচনার পেছনেই আছে সাহসিকতা। যে কোনও কাজে সাহসের সঙ্গে এগিয়ে যাওয়া, প্রতিকূল শক্তিকে অমান্য করা, অধ্যবসায়সহকারে কাজ করা, নিজের প্রতি বিশ্বস্ত থাকা, ভাগ্যের সঙ্গে সংগ্রাম করা, যে কোনও বিপর্যয়ে নির্ভীক থাকা, যে কোনও অন্যায় ও অত্যাচারী শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো, আদর্শে অবিচল থাকা–এইসব দৃষ্টান্ত এবং প্রেরণার অগ্নিস্ফুলিঙ্গই মানুষকে মহৎ কাজে অনুপ্রাণিত করে তোলে।

প্রমিথিয়াসের মশাল এবং কাম্বোনের কর্কশ কণ্ঠ থেকে একই বিদ্যুৎ নির্গত হয়।

.

১২.

প্যারিসের জনগণ সম্বন্ধে কোনও কথা বলতে গেলে বলতে হয় সেখানকার পূর্ণবয়স্ক যে কোনও ব্যক্তি আসলে যেন এক একটা ভবঘুরে ছেলে। সেখানকার ভবঘুরে ছেলেদের কথা বলা মানে শহরের কথা বলা। এই কারণেই আমরা একটা চড়ুইপাখির ছদ্মবেশে একটা ঈগলকে চিহ্নিত করেছি।

প্যারিসের আসল অধিবাসীদের পাওয়া যাবে রাজপথের পেছন দিকে সেইসব গলির অন্ধকারে যেখানে মানুষ কাজ করে আর নীরবে দুঃখভোগ করে। কাজ আর কষ্টভোগই হল মানুষের জীবনের দুটো দিক। সামান্য সাধারণ মানুষের উইঢিবির মধ্যেই থাকে কত অদ্ভুত মানুষ। সিসারো এইসব মানুষদের বলতেন জনতা। বার্ক বলতেন, জনতা, গণশক্তি, জনসাধারণ… কথা সহজেই বলা যায়। কথায় কী যায়-আসে? যদি এই জনগণ খালি পায়ে হাঁটে বা তারা পড়তে শিখতে না পারে তা হলে তাতে কীই-বা যায়-আসে? তা হলে কি সেই অজুহাতে তাদের ত্যাগ করবে এবং তাদের দুর্দশাকে কি অভিশাপ বলবে? কিন্তু আলো কি কোনওদিন জনগণের মধ্যে প্রবেশ করতে পারে না? আলো আরও আলো… এবং কে জানে সেই আলোর প্রভাবেই একদিন অস্বচ্ছ বস্তু স্বচ্ছ হয়ে উঠবে। যে কোনও বিপ্লব কি জনগণের রূপান্তর নয়? দার্শনিকরা যদি জনগণকে ঠিকমতো শিক্ষাদান করেন, যদি তারা মার্শাই গাইতে গাইতে জনগণের সঙ্গে মিশে গিয়ে সূর্যোদয়ের দিকে এগিয়ে যান, তাদের মধ্যে প্রভূত উদ্যম আর উদ্দীপনার ধারাকে উদ্গত করাতে পারেন তা হলে এই জনগণই একদিন এক মহতী শক্তিতে পরিণত হয়ে উঠবে। তাদের নবজাগ্রত নীতিবোধ এবং গুণানুশীলনের জ্বলন্ত চুল্লি থেকে বেরিয়ে আসবে এক উজ্জ্বল অগ্নিশিখা। তা হলে তখন এই জনগণের অনাবৃত হাত-পা, ছেঁড়া ময়লা পোশাক, অজ্ঞতা, দারিদ্র এবং তাদের জীবনের অন্ধকার দিকগুলোকে আদর্শ পূরণের কাজে লাগানো যাবে সফলভাবে। জনগণের অন্তরের দিকে তাকালেই এই সত্য বোঝা যাবে। যে বালুকারাশির উপর দিয়ে আমরা হেঁটে যাই সেই বালুকারাশি চুল্লির মধ্যে ফেলে তাকে গলিয়ে স্বচ্ছ কাঁচে পরিণত করা যেতে পারে, যে কাঁচের স্বচ্ছতার সহায়তায় গ্যালিলিও, নিউটন একদিন দূর আকাশে তাকিয়ে নক্ষত্রমণ্ডলকে নিরীক্ষণ করতেন।

.

১৩.

দ্বিতীয় খণ্ডে আমরা যে কাহিনী বর্ণনা করেছি সে কাহিনী ঘটার সাত-আট বছর পর ভুলভার্দ দ্য তেম্পল ও শ্যাতো দ্য ইয়তে এগারো-বারো বছরের এক ভবঘুরে ছেলেকে ঘঘারাফেরা করতে দেখা যায়। এই ধরনের ভবঘুরে ছেলের কথা আমরা এর আগেই বলেছি। তফাৎ শুধু এই যে, হাসির আলোয় মুখখানা তার উজ্জ্বল হয়ে থাকলেও অন্তরটা ছিল তার শূন্যতা আর অন্ধকারে ভরা। এই ছেলেটা যে পায়জামা পরত সেটা তার বাবার কাছে থেকে পায়নি সে, আবার মেয়েদের মতো যে ব্লাউজটা সে পরত সে ব্লাউজটাও তার মায়ের নয়। এইসব পোশাক লোকে তাকে দান করেছে। তবু তার বাবা-মা দু জনই আছে। কিন্তু তার বাবা তাকে কখনও ভাবতে শেখায়নি এবং তার মা তাকে কখনও ভালোবাসেনি! এইসব ছেলেদের সকরুণ অবস্থা দেখলে সত্যিই মায়া লাগে, কারণ তাদের বাবা-মা থাকলেও তারা অনাথ শিশুর মতোই অসহায়। বাড়ি থেকে পথেই সে বেশি সুখে থাকে। পথের পাথর তাদের মা’র অন্তরের থেকে বেশি কঠিন নয়।

যে ছেলেটার কথা আমরা বলছি সে ছেলেটার বয়স কম, তার মুখখানা স্নান, সদাসতর্ক, নতুন, আবার একই সঙ্গে প্রাণচঞ্চল ও অবসাদগ্রস্ত। সে যেখানে-সেখানে ছুটে বেড়ায়, খেলা করে, পথের ধারের খালে সে দাপাদাপি করে। কেউ তাকে ভবঘুরে ছেলে বললে সে হেসে ওঠে। তার কোনও চালচুলো বা নির্দিষ্ট বাসস্থান নেই। তবু সে সুখী, কারণ সে স্বাধীন। বালক যখন পূর্ণবয়স্ক মানুষে পরিণত হয় তখন তারা সমাজব্যবস্থার চক্রের সঙ্গে বিঘূর্ণিত হতে থাকে, সমাজের প্রয়োজনের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে হয় তাকে। কিন্তু যতদিন তারা ছোট থাকে, তারা সব দিক দিয়ে অব্যাহতি পায়।

বাবা-মা’র দ্বারা অবহেলিত ও পরিত্যক্তপ্রায় হলেও মাসের মধ্যে দু তিনবার ছেলেটা আপন মনে বলে ওঠে, আমি মাকে দেখতে যাব।’ এই বলে ছেলেটি বুলভার্দ অঞ্চল ছেড়ে পোর্তে সেন্ট মার্তিন পার হয়ে নদীর বাঁধের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। তার পর নদী পার হয়ে শ্রমিকবস্তির পাশ দিয়ে সালপেত্রিয়ের দিকে এগিয়ে যায়। কিন্তু কোথায়? আর কোথাও নয়, ৫০-৫২ নম্বর সেই গর্বোর সেই ব্যারাক বাড়িটায় যায়। সেই সময় বাড়িটাতে কয়েকটা ঘর খালি ছিল এবং তার উপর বাড়ি ভাড়া দেওয়া হবে এই মর্মে একটি নোটিশ লাগানো ছিল। বাড়িটাতে তখন এমন কতকগুলি পরিবার বাস করত যারা পরস্পরকে চিনত না।

ভলজাঁ যখন সেই বাড়িতে ছিল তখন প্রধান ভাড়াটে’ নামে অভিহিত যে একটা বুড়ি বাড়িটা দেখাশোনা করত সে মারা যায়। তার জায়গায় যে বুড়িটা তার কাজ করতে থাকে সে-ও ছিল ঠিক আগেকার বুড়িটার মতো। নতুন যে বুড়িটা আসে তার নাম ছিল মাদাম বুর্গন, তার জীবনে উল্লেখযোগ্য কিছুই ছিল না।

গর্বের বাড়িটাতে তখন যে সব ভাড়াটে ছিল তাদের মধ্যে সবচেয়ে দৈন্যদশায় থাকত একটি পরিবার। সে পরিবারের ছিল চারটি প্রাণী–বাবা, মা, আর দুটি মেয়ে। মেয়ে দুটিই বড় ছিল। কিন্তু একটি মাত্র ছোট ঘরে একসঙ্গে থাকত তারা।

একমাত্র দুর্দশা ছাড়া ওই পরিবারের উল্লেখযোগ্য আর কিছুই ছিল না। এই পরিবারের কর্তা যখন এ বাড়িতে আসে তখন সে বলে তার নাম জনদ্ৰেত্তে। এই পরিবারেরই হল সেই নগ্নপদ ভবঘুরে ছেলেটা। সে যেন সেখানে গিয়েছিল শুধু দারিদ্র্য আর দুরবস্থার দ্বারা সম্ভাষিত হবার জন্য। প্রায়ান্ধকার হিমশীতল ঘরখানার মতোই তার বাবা-মা’র মুখগুলো ছিল ম্লান আর হিমশীতল। সে মুখে কোনও হাসি ছিল না।

ছেলেটা বাড়িতে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে তার বাবা-মা তাকে জিজ্ঞাসা করে, কোথা থেকে এলি?

ছেলেটা উত্তর করে, পথ থেকে। আবার ছেলেটা যখন বাড়ি থেকে রওনা হয় তখন আবার প্রশ্ন করে, কোথায় যাবি?’ ছেলেটা তখন উত্তর করে, ‘পথেই ফিরে যাচ্ছি। সব শেষে তার মা বলে, কেন এসেছিলি?’

এ কথার উত্তর দেয়নি ছেলেটা। এই ধরনের স্নেহহীন, মমতাহীন পরিবেশের মধ্যে বেড়ে ওঠে ছেলেটা। কিন্তু তার প্রতি তার বাবা-মা’র এই ঔদাসীন্য এবং নির্মমতা তাকে নতুন করে বিচলিত করতে পারেনি কিছুমাত্র। সে কারও ওপর কোনও দোষারোপ করত না

এর জন্য। সন্তানের প্রতি পিতামাতার কী রকম ব্যবহার করা উচিত সে সম্বন্ধে তার কোনও ধারণাই ছিল না।

বুলভার্দ অঞ্চলে ছেলেটাকে গ্রাম্ৰোশে বলে ডাকত।

তবে ছেলেটার মা তার মেয়েদের ভালোবাসত। তার বাবা জনত্রেত্তে যে ঘরটাতে থাকত তার পাশের ঘরেই একটা কপর্দকহীন গরিব যুবক থাকত। তার নাম ছিল মঁসিয়ে মেরিয়াস।

এখন এই মঁসিয়ে মেরিয়াস সম্বন্ধে কিছু বলতে হবে।

সকল অধ্যায়

১. ১.১ বিশপ পদ লাভ
২. ১.২ দিগনে শহরের পথে
৩. ১.৩ অষ্টাদশ লুই-এর রাজত্বকাল
৪. ১.৪ প্যারিসের অনতিদূরে
৫. ১.৫ মঁতফারমেলের হোটেলে
৬. ১.৬ কারখানার হাসপাতালে
৭. ১.৭ মন্ত্রিউল-সুর মের শহরে
৮. ১.৮ ভোরের আলো
৯. ২.১ ১৮৬১ সালের মে মাসে
১০. ২.২ জাঁ ভলজাঁ আবার ধরা পড়ে
১১. ২.৩ মঁতফারমেল শহরটা
১২. ২.৪ আজ হতে চল্লিশ বছর আগে
১৩. ২.৫ এরপর যেসব ঘটনা সংযোজিত হবে
১৪. ২.৬ আজ হতে অর্ধ শতাব্দী আগে
১৫. ২.৭ পেতিত পিকপাসের কনভেন্টে
১৬. ৩.১ প্যারিসের রাস্তায়
১৭. ৩.২ এমন কিছু অধিবাসী আছে
১৮. ৩.৩ কয়েকজন বিশিষ্ট লোকের বাড়িতে
১৯. ৩.৫ দিন চালানো খুবই কঠিন হয়ে উঠল
২০. ৩.৬ এক সুদর্শন যুবক
২১. ৩.৭ নিচের তলায় স্তর
২২. ৩.৮ গ্রীষ্ম ও শরৎ কেটে গিয়ে বসন্ত এল
২৩. ৪.০১ জুলাই বিপ্লবের পর
২৪. ৪.০২ গর্বোর বাড়ি থেকে
২৫. ৪.০৩ গত শতাব্দীর মধ্যভাগে
২৬. ৪.০৪ ধীরে ধীরে বিষাদের ছায়া
২৭. ৪.০৫ মনের যে বেদনাটা তীব্র ছিল
২৮. ৪.০৬ হোটেলটার অবস্থা খারাপের দিকে
২৯. ৪.০৭ কসেত্তেদের বাসার ঠিকানা
৩০. ৪.০৮ দাদুর সঙ্গে দেখা
৩১. ৪.০৯ বিপ্লবের মধ্যে কী আছে
৩২. ৪.১০ সেনাবাহিনী আর বিপ্লবী জনতার লড়াই
৩৩. ৪.১১ ব্যারিকেডের কথা
৩৪. ৪.১২ সব দুঃখের অবসান
৩৫. ৪.১৩ সেন্ট মেরি গির্জার ঘড়ি
৩৬. ৪.১৪ অন্তরে যে দারুণ বিপ্লব চলছিল
৩৭. ৫.১ প্যারিসে বিপ্লব ও পথযুদ্ধ
৩৮. ৫.২ ময়লাবাহী নালার জাল বিস্তার
৩৯. ৫.৩ প্রথম মাথা নিচু করে
৪০. ৫.৪ রাস্তা মেরামতকারী বুলাত্রিউলের কথা
৪১. ৫.৫ মেরিয়াস আর কসেত্তে’র বিবাহ উৎসব
৪২. ৫.৬ বিয়ের পরদিন সকালে
৪৩. ৫.৭ পরদিন সন্ধে হতেই
৪৪. ৫.৮ সুখী হওয়াটা এক ভয়ঙ্কর ব্যাপার

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন