তপন বাগচী
ষোড়শ অধ্যায়
মহারাজ ঈশানচন্দ্র মাণিক্যের মৃত্যুর ৪ দিবস অন্তে (৪ আগষ্ট ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দ) ত্রিপুরার জজ, মাজেস্ট্রেট প্রভৃতি সাহেবগণ নিকট একখণ্ড রোবকারী উপস্থিত হইল। সেখানা এইরূপ :-
শ্রীগুরু আজ্ঞা শ্ৰীশ্ৰী সহী
“রোবকারী কাছারি এলাকে রাজগী পর্বত ত্রিপুরা, হুজুর শ্রীশ্রীযুক্ত মহারাজা ঈশানচন্দ্র মাণিক্য বাহাদুর। ইতি সন ১২৭২ ত্রিপুরা, তারিখ ১৬ই শ্রাবণ।
এপক্ষ বাতব্যাধি পীড়াতে শারীরিক কাতর হওয়া প্রযুক্ত, রাজত্ব ও জমিদারি শাসন বিষয়ী কার্য্য সুচারুমতে নির্বাহ হইতেছে না এবং যে প্রকার ব্যামোহ ইচ্ছাধীন কোন সময়ে প্রাণ বিয়োগ হয় তাহারও নিশ্চয় নাই এমতেই এপক্ষের খান্দানের চিররীতিমতে ঐ কাৰ্য্য নির্বাহ তদর্থক যুবরাজ ও বড়ঠাকুর ও কর্তা নিযুক্ত করা প্রয়োজন, সেমতে হুকুম হইল যে— (১৭৭)
যুবরাজী পদে এপক্ষের ভ্রাতা শ্রীল শ্রীমান বীরচন্দ্র ঠাকুর ও বড়ঠাকুরী পদে প্রথম পুত্র শ্রীলশ্রীমান ব্রজেন্দ্রচন্দ্র ঠাকুর ও কর্ত্তা পদে দ্বিতীয় পুত্র শ্রীলশ্রীমান নবদ্বীপচন্দ্ৰ ঠাকুরকে নিযুক্ত করা যায় ও এ বিষয়ের এত্তেলা স্বরূপ এই রোবকারীর এক এক কিত্তা নকল জেলা চট্টগ্রাম ও জেলা ঢাকা প্রদেশের শ্রীলশ্রীযুক্ত দায়ের সায়ের কমিসনর সাহেব বাহাদুরান ও জেলা ত্রিপুরা ও জেলা শ্রীহট্টের শ্রীলশ্রীযুক্ত জজ সাহেব ও শ্রীযুক্ত কালেক্টর সাহেব ও শ্রীযুক্ত মাজেস্ট্রেট সাহেব বাহাদুরান হুজুরে প্রেরণ হয় ইতি।”
মং শ্রীবিশ্বনাথ গুপ্ত
শ্ৰীশ্ৰীসহী!
মোকাবেলা
শ্রীগুরুদাস বর্দ্ধন।
পেস্কার।
মোহরের।
বীরচন্দ্র ও তৎপক্ষীর ব্যক্তিগণ প্রচার করিলেন যে, “মহারাজ ঈশানচন্দ্র মাণিক্য তাঁহার মৃত্যুর পূর্ব দিবস এই সকল নিয়োগ করিয়াছেন।” কিন্তু জনসাধারণ বলিতে লাগিল “মহারাজের মৃত্যুর পর গুরু বিপিনবিহারী, ঠাকুর ব্রজমোহন, গোলকচন্দ্ৰ সিংহ ও গুরুদাস বর্দ্ধন প্রভৃতি প্রধান কর্ম্মচারীগণ পরামর্শ করিয়া বীরচন্দ্র ঠাকুরের যোগে এই রোবকারী সৃষ্টি করিয়াছেন। মৃত মহারাজের পুত্রগণ নাবালক, এই সূত্র অবলম্বন করিয়া গবর্ণমেন্ট ত্রিপুরা রাজ্য ও জমিদারি খাস মেনেজমেন্ট নিতে পারেন; কিম্বা (১৭৮) দুর্দান্ত কুমার নীলকৃষ্ণ আগরতলায় উপস্থিত হইয়া মৃত মহারাজের স্ত্রী, পুত্র প্রধান কর্ম্মচারিগণের প্রতি অত্যাচার করিয়া রাজ্যাধিকার করিতে পারেন, দ্বিবিধ আশঙ্কাই এই রোবকারী সৃষ্টির মূলীভূত কারণ।”
চক্রধবজ ও নীলকৃষ্ণ “এই রোবকারী অসত্য” এইরূপ প্রকাশ করিয়া ব্রিটিস গবর্ণমেন্ট সমীপে ত্রিপুরারাজ্যের দাবিদার বলিয়া উপস্থিত হইলেন। ত্রিপুরার মাজেষ্ট্রেট, চট্টগ্রামের কমিসনর নিকট রিপোর্ট করিলেন। কমিসনর সাহেব বেঙ্গল গবর্ণমেন্টকে জানাইলেন যে, “ত্রিপুরাপতি ঈশানচন্দ্র মাণিক্যের মৃত্যু হইয়াছে, ত্রিপুরারাজ্যের অনেকগুলি দাবিদার উপস্থিত; তন্মধ্যে বীরচন্দ্র রাজা এবং ঈশানচন্দ্র মাণিক্যের নাবালক পুত্রদ্বয় (ব্রজেন্দ্র ও নবদ্বীপচন্দ্র) যুবরাজ ও বড়ঠাকুর স্বরূপ এক্ষণ দখলকার আছেন। অতএব আমার বিবেচনায় গবর্ণমেন্ট একজনকে দখলকার রাজা স্বীকার করিয়া অন্যান্য দাবিদারগণকে দেওয়ানী আদালতে যাইয়া জমিদারিতে স্বত্ব সাব্যস্থ করিবার জন্য উপদেশ করিলেই চলিতে পারে।”[১]
কমিসনর সাহেবের রিপোর্টের প্রত্যুত্তরে বাঙ্গালার তদানীন্তন লেপ্টেনেন্ট গবর্ণর “বীরচন্দ্র ঠাকুরকে ত্রিপুরার (১৭৯) ডিফেক্টো” রাজা বলিয়া স্বীকার করিয়া অন্যান্য দাবিদারকে উচিত পন্থা অবলম্বনার্থে উপদেশ প্রদান করেন।
অল্পকাল মধ্যেই বীরচন্দ্রের বিরুদ্ধে চক্রধবজ ও নীলকৃষ্ণ জমিদারির দাবিতে দেওয়ানী আদালতে দুইটী মোকদ্দমা উপস্থিত করেন। চক্রধবজ ও নীলকৃষ্ণ বলিলেন, মহারাজ ঈশানচন্দ্র মাণিক্য যুবরাজ প্রভৃতি নিয়োগ না করিয়া পরলোক গমন করিয়াছেন। বিবাদী বীরচন্দ্র, গুরু বিপিনবিহারী ও অন্যান্য রাজকর্মচারীর সহিত চক্রান্ত করিয়া যুবরাজাদি নিযুক্ত হওয়া মিথ্যা প্রচার পূর্বক এই সম্পত্তি অন্যায়রূপে দখল করিয়াছেন। মৃত মহারাজার জীবিত ভ্রাতৃগণ মধ্যে তাহারা জ্যেষ্ঠ, সুতরাং তাহারাই রাজত্ব ও জমিদরির সত্বাধিকারী বটেন।
নীলকৃষ্ণ অতিরিক্ত এই বলিলেন যে, মহারাজ কৃষ্ণকিশোর মাণিক্যের বিবাহিতা পত্নী (ঈশ্বরী) গণের গর্ভজাত সন্তান মধ্যে তিনিই জ্যেষ্ঠ সুতরাং তিনিই রাজ্য ও জমিদারির অধিকারী। চক্রধবজ বিবাহিতা পত্নীর গর্ভজাত নহেন।
উভয় মোকদ্দমায় মহারাজ বীরচন্দ্র বর্ণনাদ্বারা উত্তর প্রদান করিলেন যে, তিনি ঈশানচন্দ্র দ্বারা যুবরাজি পদে নিযুক্ত হইয়াছেন। সুতরাং তিনিই রাজ্য ও জমিদারির অধিকারী। যুবরাজ প্রভৃতির অভাবে মৃত রাজার নিকট (১৮০) সম্পর্কিত ব্যক্তিই তাঁহার ত্যজ্য সম্পত্তির অধিকারী হইয়া থাকেন, বাদিগণ তদ্রূপ ব্যক্তি নহেন।
মৃত মহারাজার জীবিত ভ্রাতৃগণ মধ্যে প্রকৃতপক্ষে চক্রধবজই বয়োজ্যেষ্ঠ ছিলেন। নীলকৃষ্ণ তাঁহাকে মহারাজ কৃষ্ণকিশোর মাণিক্যের অবৈধ পুত্র নির্ণয় করিবার জন্য যত্নবান হইলেন। কারণ তাহা না হইলৈ তিনি জ্যেষ্ঠপুত্র হইতে পারেন না, স্বার্থান্ধ নীলকৃষ্ণের এবংবিধ কার্য্য দ্বারা ত্রিপুর রাজবংশের লুক্কায়িত কুৎসা প্রচারের সূত্রপাত হইল। রাজবংশধরগণ যে কার্য্যে লজ্জা বোধ করেন নাই, আমরা তাহাতে লজ্জা বোধ করিতেছি। আমরা তৎসম্বন্ধে কোন কথা উল্লেখ করিব না।
আবুল ফাজেল যাঁহাদিগকে “নারায়ণ” বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন, তাঁহাদের বংশধর ও অন্যান্য উপাধি প্রাপ্ত ব্যক্তিগণ অধুনা ঠাকুর লোক বলিয়া আখ্যাত হইয়া থাকেন। ব্রিটিসাধিকারের পূর্বে ইহারা বিশেষ পরাক্রমশালী ছিলেন। কিন্তু অধুনা ইহারা মহারাজের অনুগ্রহ প্রদত্ত বৃত্তি প্রাপ্ত হইয়া কথঞ্চিৎ জীবিকা নির্বাহ করিয়া থাকেন। গুরু যৎকালে মহারাজ ঈশানচন্দ্রের ঋণ পরিশোধণ কৃতসঙ্কল্প হইয়াছিলেন, তৎকালে তিনি এই সকল ঠাকুর লোকের বৃত্তি (১৮১) হ্রাস ও অধিকাংশ ভূসম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করিয়াছিলেন। এজন্য তাঁহারা গুরুর প্রতি খড়গহস্ত ছিলেন। কিন্তু ঈশানচন্দ্রের জীবিতকালে তাঁহারা গুরুর কিছুমাত্র অনিষ্ট কল্পনা করিতে পারেন নাই। যখন উল্লিখিত মোকদ্দমায় “ঠাকুরলোক” দিগের নাম সাক্ষীর ইসিমনবিসী ভুক্ত হইল, তখন তাঁহারা সুন্দর সুযোগ প্রাপ্ত হইয়া বীরচন্দ্রকে বলিলেন, “মহারাজ! হয় আমাদিগকে বিদায় দিন, নচেৎ গুরুকে অবসর করুন; আমরা তাঁহার অত্যাচার আর সহ্য করিতে পারি না।” তৎকালে মহারাজ বীরচন্দ্র এবপ্রকার অবস্থায় পতিত ছিলেন যে, তিনি কোন রূপেই “ঠাকুরলোক” দিগকে অসন্তুষ্ট করিতে পারেন না। বিশেষত গুরুকে রাজ্য হইতে তাড়িত করিলে, তিনি চক্রধবজ ও নীলকৃষ্ণের সহিত মিলিত হইয়া তাঁহার ভীষণ শত্রু হইয়া দাঁড়াইতে পারেন। সুতরাং ঘটনা চক্রের আবর্তনে বাধ্য হইয়া মহারাজ বীরচন্দ্র ১২৭৩ ত্রিপুরাব্দের জ্যৈষ্ঠ মাসের আরম্ভে গুরুকে অবরুদ্ধ করিলেন[২] এবং (১৮২) “ঠাকুরলোক” দিগের সম্মতিক্রমে রাজ্য ও জমিদারির শাসনভার ব্রজমোহন ঠাকুরের হস্তে সমর্পণ করিলেন।
এই সময় ত্রিপুরা পর্বত মধ্যে জমাতিয়া বিদ্রোহ উপস্থিত হয়। পার্বত্য ত্রিপুরা জাতির একটি পরাক্রমশালী সম্প্রদায় প্রাচীনকালে দলবদ্ধ থাকিয়া ত্রিপুরেশ্বরের সৈনিক কার্য্য নির্বাহ করিত, এইজন্য ইহারা জমাতিয়া আখ্যা প্রাপ্ত হইয়াছিল। অধুনা সেই পরাক্রমশালী জমাতিয়াগণ কৃষিকার্য্য দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করিতেছে। ওয়াখিরায় হাজারি নামক জনৈক কর্মচারীর অত্যাচারে জমাতিয়া বিদ্ৰোহ উপস্থিত হয়। জমাতিয়া দিগকে দমন করিবার জন্য মহারাজ প্রথমত যে সকল সৈন্য প্রেরণ করেন, তাহারা কিছুই করিতে পারে নাই। অবশেষে কুকি সৈন্য দ্বারা তাহাদিগকে নির্যাতন করা হইয়াছিল। কুকিগণ আপনাদের বিজয় চিহ্ন স্বরূপ নিহত জমাতিয়াদিগের মুণ্ড লইয়া রাজধানীতে উপস্থিত হইল। সেই সকল মুণ্ড ভীতি প্রদর্শক বিজয়ী কেতন স্বরূপ সুদীর্ঘ বংশোপরি বিলম্বিত হইয়াছিল।[৩] (১৮৩)
মহারাজ ঈশানচন্দ্রের জ্যেষ্ঠপুত্র কুমার ব্রজেন্দ্রচন্দ্র এই সময় মানবলীলা সংবরণ করেন।
ব্রজমোহন ঠাকুর গুরুর অবরোধ হইতে সমস্ত শাসন ভার প্রাপ্ত হইলেন বটে, কিন্তু প্রধান ঠাকুরগণ তৎকালে “রণ মুখো সিপাহির” ন্যায় নিতান্ত স্বেচ্ছাচারী হইয়াছিলেন। তাঁহাদিগদ্বারা স্বীয় অনুকূলে নীলকৃষ্ণ ও চক্রধবজের মোকদ্দমার সাক্ষী দেওয়াইবার জন্য মহারাজ বীরচন্দ্র বাহাদুর সেই সময় কুর্মনীতি অবলম্বন করিয়াছিলেন।[৪] তাঁহাদের এবপ্রকার ব্যবহার অবগত হইয়া ত্রিপুরার তদানীন্তন মাজেস্ট্রেট মেঙ্গল সাহেব জ্বলন্ত ভাষায় স্বীয় রিপোর্টে কমিসনর সাহেবকে তাহা জানাইয়াছিলেন। এই রিপোর্টে তিনি গুরুর শাসন প্রণালীর প্রশংসা করিয়া লিখিয়াছেন যে, তৎকালে গুরু জন্য কেহই মস্তক উত্থোলন করিতে পারিতেন না, কিন্তু এক্ষণ ঠাকুরগণ নিতান্ত স্বেচ্ছাচারী হইয়া উঠিয়াছেন। রাজা তাঁহাদের ভয়ে হস্তপদে সঙ্কুচিত করিয়া বসিয়া আছেন।[৫] (১৮৪)
তিন পক্ষেই বাচনিক প্রমাণ উপস্থিত হইল। রাজা পরিবারস্থ কয়েকটি মহিলা এবং অল্প কয়েকজন ঠাকুরলোক বাদিগণের উক্তি সমর্থন করিয়া সাক্ষ্য প্রদান করিলেন। অধিকাংশ ঠাকুর লোক ও রাজ কর্মচারী[৬] সেই রোবকারি খানাকে সত্য বলিয়া বীরচন্দ্রের অনুকূলে সাক্ষ্য প্রদান করিলেন এই সময় আদালতে একটি আশ্চর্য্য ঘটনায় সংঘটন হইল। মৃত মহারাজ ঈশানচন্দ্র মাণিক্য বাহাদুরের বিধবা পত্নীগণের পক্ষে বীরচন্দ্রের মঙ্গলার্থে তাঁহার উক্তি সমর্থন করিয়া এক দরখাস্ত উপস্থিত করা হইল।
স্থানীয় বিচারপতি, জেলা ত্রিপুরার প্রধান সদর আমিন বাবু বন্দ্যোপাধ্যায় ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দের ১১ জুন বীরচন্দ্রের যুবরাজী মিথ্যা সাব্যস্ত করিলেন এবং সর্ব জ্যেষ্ঠ চক্রধবজকে কৃষ্ণকিশোর মাণিক্যের অবৈধপুত্র অবধারণ করিয়া নীলকৃষ্ণের অনুকূলে মোকদ্দমা নিস্পত্তি করিলেন। অপরিণামদর্শী নীলকৃষ্ণের আর সহ্য হইল না। তিনি সেই ডিক্রীর বলে অগৌণে ডিক্রীজারি ক্রমে চাকলে রোশনাবাদ ২০ দিবসের জন্য অধিকার করিয়াছিলেন।
বীরচন্দ্র হাইকোর্টে আপীল করিলেন। সেখানেও, মহারাজ ঈশানচন্দ্রের পত্নীগণের পক্ষে বীরচন্দ্র অনুকূলে (১৮৫) আপত্তি উপস্থিত হইল। হাইকোর্ট রাণীগণের দরখাস্তের প্রতি প্রধান সদর আমিনের অবজ্ঞা দর্শনে তাঁহার কার্য্যের প্রতি বিশেষ সন্দিহান হইলেন এবং ইহাতেই নীলকৃষ্ণের অনিষ্টের সূত্রপাত হইল। ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দের ২৬ সেপ্টেম্বর চিপ জষ্টিস নরমেন ও জষ্টিস কেম্প, ঈশানচন্দ্রের অপ্রাপ্ত বয়স্ক পুত্র গণের অনুপস্থিতে হিন্দুশাস্ত্র অনুসারে নীলকৃষ্ণ অপেক্ষা বীরচন্দ্র ঈশানচন্দ্রের নিকটবর্ত্তী উত্তরাধিকারী অবধারণ এবং বীরচন্দ্র ঈশানচন্দ্রের দ্বারা যুবরাজের পদে নিযুক্ত হওয়া সম্ভবপর বিবেচনা করিয়া ঈশানচন্দ্রের নাবালক পুত্রগণের অভিভাবিকা রাণীগণ, বীরচন্দ্র যুবরাজের পদে নিযুক্ত হওয়া সম্বন্ধে কোন আপত্তি করিতেছেন না, এমতাবস্থায় এসম্বন্ধে অন্য তদন্ত নিস্প্রয়োজন; প্রধানত এই হেতুবাদে বীরচন্দ্রের আপিল ডিক্রী ও নীলকৃষ্ণের মোকদ্দমা ডিসমিস করিলেন।
হতভাগ্য চক্রধবজও হাইকোর্টে আপিল করিয়াছিলেন। হাইকোর্ট ও তাঁহাকে মহারাজ কৃষ্ণকিশোরের অবৈধ পুত্র নির্ণয় করিলেন।
গুরুর অবরোধের পর হইতে ব্রজমোহন ঠাকুর ত্রিপুরারশাসন ভার প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। কিন্তু হাইকোর্ট কর্তৃক উক্ত মোকদ্দমা নিস্পত্তি না হওয়া পৰ্য্যন্ত তিনি অকুল সাগরে হাবু ডুবু খাইতেছিলেন। এক্ষণ তিনি গুরুর পদচিহ্ন অনুসরণ করিয়া অভিজ্ঞ কর্ণধারের ন্যায় ত্রিপুরার কর্ণধারণ (১৮৬) পূর্বক দৃঢ়তার সহিত স্বীয় কাৰ্য সম্পাদন করিতে লাগিলেন। তিনি ঠাকুরলোকদিগকে কৌশলে হস্তগত করিয়া বিশেষ দক্ষতার সহিত প্রায় সাড়ে পাঁচ বৎসর রাজ্য শাসন করিয়া ছিলেন। প্রাচীন প্রণালী অনুসারে রাজা ও প্রজার মঙ্গল সাধন করত রাজ্যের উন্নতি বিধান জন্য তিনি প্রাণপণ যত্ন ও পরিশ্রম করিতে ত্রুটী করেন নাই। তাঁহার শাসনে মোকদ্দমা সমূহের ব্যয় নির্বাহ হইয়া ও রাজকোষে অর্থ সঞ্চিত হইয়াছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে তাঁহা দ্বারাও সামরিক বিভাগের সম্পূর্ণ উন্নতি সাধিত হয় নাই।
নীলকৃষ্ণ হাইকোর্টের নিস্পত্তির অসম্মতিতে প্রিবি কৌন্সেলে আপীল করিলেন। প্রিবি কৌন্সেলে নীলকৃষ্ণ, ঈশানচন্দ্রের জীবিত পুত্রগণকে অবৈধ প্রকাশ করত কেবল ভ্রাতৃদ্বয়ের মধ্যে উত্তরাধিকারিত্বের তর্ক মীমাংসার বিশেষরূপে চেষ্টা করিয়াছিলেন।
১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দের ১৫ মার্চ প্রিবি কৌন্সেল নীলকৃষ্ণের আপিল অগ্রাহ্য করেন। তদনন্তর বীরচন্দ্র সিংহাসন আরোহণ করিবার জন্য গবর্ণমেন্টের অনুমতি প্রার্থনা করেন। এবার তাঁহার প্রার্থনা গবর্ণমেন্ট মঞ্জুর করিলেন। গবর্ণমেন্টের অনুমত্যানুসারে চট্টগ্রামের তদানীন্তন কমিসনর লর্ড এইচ, ইউলিক, ব্রাউন সাহেব রাজধানীতে উপস্থিত হইয়া খেলাত ও সনন্দ প্রদান পূর্বক তাঁহাকে ত্রিপুর সিংহাসনে স্থাপন (১৮৭) করিলেন। রাজ্যাধিকার কালে মহারাজ বীরচন্দ্র মাণিক্য বাহাদুর গবর্ণমেন্টকে ১২৫টি স্বর্ণ মুদ্রা নজর প্রদান করিয়াছিলেন। ১২৭৯ ত্রিপুরার ২৭ ফাল্গুন (১৮৭০ খ্রিঃ ৯ মার্চ) বীরচন্দ্রের অভিষেক ক্রিয়া সম্পাদিত হয়।
মহারাজ বীরচন্দ্র রাজপদ প্রাপ্ত হইয়াও দীর্ঘকাল নীরদমালায় সমাচ্ছন্ন দিবাকরের ন্যায় ক্ষীণভাবে কাল যাপন করিতেছিলেন। শ্রীশ্রীমতি মহারাণী ভিক্টোরিয়ার প্রিবি কৌন্সেলের বিচারে তাঁহার স্বত্ব নির্ণীত হওয়ার পর, ব্রিটিস গবর্ণমেন্ট কর্তৃক তিনি পার্বত্য ত্রিপুরার “ডিজুর” রাজা স্বীকৃত হওয়ার পর মহারাজ বীরচন্দ্র মাণিক্য বাহাদুর মেঘমুক্ত ভাস্করের ন্যায় প্রকাশিত হইলেন। বিষ্ণুশর্মার পূর্বোদ্ধৃত শ্লোকের শেষার্দ্ধ ফলবতী হইতে চলিল। মহারাজ বীরচন্দ্র শত্রুর পরিবর্তে মিত্র নিপাত করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। এই সকল বিবরণ ক্রমে যথা স্থানে বর্ণিত হইবে।
১৮৭০ খ্রিস্টাব্দের ৩০ মার্চ ইণ্ডিয়া গবর্ণমেন্ট ভারতীয় সামন্ত নরপতিদিগের সম্বন্ধে “নজরানা রিজলিউসন” নামক যে বিজ্ঞাপনী প্রচার করেন তাহাতে লিখিত আছে যে, পার্বত্য ত্রিপুরা, স্বাধীন রাজ্য নহে; অথচ ত্রিপুরাপতির সহিত গবর্ণমেন্টের কোনরূপ সন্ধি বন্ধন নাই। ত্রিপুরেশ্বরের গবর্ণমেন্টকে কোনরূপ কর প্রদান করেন না, কেবল রাজ্যাভিষেক কালে গবর্ণমেন্টকে “নজর” প্রদান করিয় থাকেন। (১৮৮) এই সকল হেতুবাদে গবর্ণমেন্ট অবধারণ করেন যে, ত্রিপুর নরপতিগণের মৃত্যুর পর, পুত্র সিংহাসনে আরোহণ করিলে, ত্রিপুরা রাজ্যের এক বৎসরের উৎপন্নের অর্দ্ধাংশের ও পুত্র ব্যতীত অন্য ব্যক্তি উত্তরাধিকারী হইলে রাজ্যের এক বৎসরের সমস্ত রাজস্ব “নজর” প্রদান করিতে হইবে।” দীর্ঘ কাল অন্তে ব্রিটিস গবর্ণমেন্ট সূচিকার রন্ধ্রে কুঠার প্রবিষ্ঠ করাইলেন। মহারাজ কৃষ্ণকিশোর মাণিক্য বাহাদুর গবর্ণমেন্ট হইতে প্রাপ্ত খেলাতের মূল্যের প্রায় ত্রিংশাংশ এবং মহারাজ ঈশানচন্দ্র খেলাতের তুল্য মূল্য এবং মহারাজ বীরচন্দ্রের তদপেক্ষা কিঞ্চিদধিক “নজর” প্রদান করিয়াছিলেন। কিন্তু মহারাজ বীরচন্দ্রের উত্তর পুরুষগণকে লক্ষ লক্ষ টাকা “নজর” প্রদান করিতে হইবে।
১৮৬১ খ্রিস্টাব্দের ১২ নবেম্বর চট্টগ্রামের কমিসনর ত্রিপুরেশ্বরকে জানাইয়াছিলেন যে “স্বাধীন ত্রিপুরা রাজ্যের প্রতি গবর্ণমেন্ট হস্তক্ষেপ করিবেন না।” ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দে মার্চ মাসে ফরেণ সেক্রেটারি এচিসন সাহেব ভারতীয় নরপতিবর্গের সনন্দাদি সংগ্ৰহ করিয়া যে গ্রন্থ প্রণয়ন করিয়াছেন, তাহাতে তিনি লিখিয়াছিলেন যে, “স্বাধীন ত্রিপুরা ব্রিটিস গবর্ণমেন্ট কিম্বা তাঁহার পূর্বাধিকারিগণের অনুগ্রহ প্রদত্ত রাজ্য নহে।” ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দের ১৫ মার্চ শ্রীশ্রীমতি মহারাণী ভারতেশ্বরীর প্রিবি কৌন্সেলের বিচারপতি লিখিলেন (১৮৯) যে, ত্রিপুরার রাজা যদিও (চাকলে রোশনাবাদের) জমিদারীর জন্য ব্রিটিস ইণ্ডিয়ার আইন ও বিচার আদালতের অধীন বটেন, কিন্তু প্রকৃত পক্ষে তিনি ত্রিপুরা পর্বত নামক একটি বৃহৎ রাজ্যের স্বাধীন নরপতি বটেন। কিন্তু ইহার ১ বৎসর ১৫ দিবস অন্তে মহারাজ বীরচন্দ্রের অভিষেকের এক বিংশতি দিবসান্তে গবর্ণমেন্ট ঘোষণা করিলেন যে, “পার্বত্য ত্রিপুরা স্বাধীন রাজ্যনহে”। সুতরাং তাহার অধিপতিগণকে পূর্বোল্লিখিত মত “নজরানা” প্রদান করিতে হইবে। মহারাজ বীরচন্দ্র তৎকালে ঈশানচন্দ্রের একমাত্র অপ্রাপ্ত বয়স্ক পুত্রের সর্বনাশ সাধনানুষ্ঠানে ও গীত বাদ্যাদির আমোদে মত্ত ছিলেন। সুতরাং উপযুক্তরূপে স্বীয় স্বত্যাধিকার গবর্ণমেন্টকে দেখাইলেন না।
মহারাজ ঈশানচন্দ্রের যে কয়েকটী কর্ম্মচারী মাহারাজ বীরচন্দ্রকে সিংহাসনে স্থাপন করিবার জন্য সবিশেষ চেষ্টা ও যত্ন করিয়াছিলেন, তম্মধ্যে গুরু বিপিনবিহারী কিরূপে অবরুদ্ধ হন তাহা পূর্বেই উল্লেখ করা হইয়াছে। মহারাজ বীরচন্দ্রের অভিষেকের কিঞ্চিদূন ৪ বৎসর পূর্বে ১২৭৬ ত্রিপুরাব্দের জ্যৈষ্ঠ (১৯০) মাসে গুরু অবরুদ্ধারবস্তায় প্রাণ ত্যাগ করিলেন। ইহার প্রায় এক মাস অন্তে গোলোকচন্দ্ৰ সিংহ মানে মানে ইহলোক পরিত্যাগ করেন।
মহারাজ বীরচন্দ্র ফাল্গুনের ২৭ তারিখে সিংহাসন আরোহণ করেন, চৈত্র মাস আমোদ প্রমোদে অতিবাহিত হয়। বৈশাখ মাসে সচিবকুলতিলক ব্রজমোহন ঠাকুর সাহেব পদচ্যুত ও অবরুদ্ধ হন। দেওয়ান গুরুদাস পদচ্যুত ও রাজ্য হইতে তাড়িত হইলেন। বিশ্বনাথ অবস্থা দর্শনে রাজধানী পরিত্যাগ করিলেন।
ত্রিপুরাবাসী সর্বসাধারণের এরূপ বিশ্বাস ছিল, যে দিন, বীরচন্দ্র সিংহাসন আরোহণ করেন সেই দিবস মহারাজ ঈশানচন্দ্রের একমাত্র পুত্র নবদ্বীপচন্দ্র যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত হইলেন।
মহারাজ ঈশানচন্দ্রের মহিষী ও প্রধান কর্মচারিগণ মহারাজ ঈশানচন্দ্রের উপকারার্থ যে সমস্ত কার্য্য করিয়াছিলেন, তাহাতে তাঁহাদের প্রধান লক্ষ্য এই ছিল যে, ঈশানচন্দ্রের পুত্র বীরচন্দ্রের পর ত্রিপুর সিংহাসনের অধিকারী হইবেন কিন্তু মহারাজ বীরচন্দ্র তাঁহাদের আশা ষোল কলায় পূর্ণ করিতে কৃত সংঙ্কল্প হইলেন। যে দিন মহারাজ বীরচন্দ্র দ্বারা ঈশানচন্দ্রের একমাত্র পুত্র নবদ্বীপচন্দ্র একটি গৃহ মধ্যে (১৯১) অনাহারে অবরুদ্ধ থাকিয়া শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করিয়াছিলেন। তদনন্তর প্রায় এক বৎসর তিন মাস নবদ্বীপচন্দ্র, মহারাজ বীরচন্দ্র দ্বারা রাজভবনে অবরুদ্ধ ছিলেন। এই কাল মধ্যে মহারাজ বীরচন্দ্র ক্রমে নবদ্বীপচন্দ্রের বন্দুক, তরবারী প্রভৃতি অস্ত্র শস্ত্র অপহরণ করেন। নবদ্বীপচন্দ্রকে তাঁহার পিতা ঈশানচন্দ্র “নবদ্বীপচন্দ্র নগর” নামক একটি জায়গীর প্রদান করিয়াছিলেন, মহারাজ বীরচন্দ্র তাহাও বাজেয়াপ্ত করিলেন। মহারাজ বীরচন্দ্র বলেন, “নবদ্বীপচন্দ্রকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করিবার জন্য নবদ্বীপের বিমাতা মহারাণী রাজলক্ষ্মী ও মহারাণী চন্দ্রেশ্বরী তাঁহাকে বড়ই পীড়াপীড়ি করিয়াছিলেন।” বোধ হয় সেই অপরাধেই অল্পকাল মধ্যে মহারাজ বীরচন্দ্র, মহারাণী চন্দ্রেশ্বরীর “খেয়াইস নামক তালুক বাজেয়াপ্ত করিয়া প্রত্যুপকারের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত প্রদর্শন করিয়াছিলেন। এইরূপে মহারাজ বীরচন্দ্র স্বীয় দুর্দান্তশত্রু ঈশানচন্দ্রের পুত্র, পত্নী ও ভৃত্যগণকে নিৰ্য্যাতন করিয়া ১২৮০ ত্রিপুরাব্দের ১৬ই ভাদ্র তাঁহার জ্যেষ্ঠ পুত্র কুমার রাধাকিশোরকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করিলেন। নবদ্বীপচন্দ্রের সহায় বলিয়া, কয়েক জন ঠাকুরলোককেও নিয্যাতন করিয়াছিলেন।
ঠাকুর ব্রজমোহনকেও পদচ্যুত করিয়া মহারাজ বীরচন্দ্র স্বয়ং রাজ্য ও জমিদারের শাসন ভার গ্রহন করিলেন বলিয়া ঘোষণা পত্রে লিখিত হইয়াছিল; কিন্তু ঈশানচন্দ্রের সময়ের (১৯২) কর্মচারিগণের পরিবর্তে শাসন কাৰ্য্য নির্বাহ জন্য আগরতলায় একজন সাহেব ও দুইজন বাঙ্গালি নিযুক্ত হইলেন। সাহেব একজন ইংরেজ, তাঁহার নাম ডবলিউ, এফ, কেম্ববল, তিনি ইতিপূর্বে বারং বার চাকলে রোশনাবাদের মেনেজারের কার্য্য নির্বাহ করিয়াছিলেন। কেম্পবল সাহেব নিরীহ ভাল মানুষ ছিলেন। রামমাণিক্য বর্মণ দেওয়ান হইলেন। তাঁহার পরিচয় পূর্বেও কিঞ্চিৎ দেওয়া হইয়াছে। রাম মাণিক্য নিতান্ত কুটীল নীতিপরায়ণ ছিলেন, তাঁহাকে ক্ষুদ্র চাণক্য বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। পেস্কার হইলেন, মহারাজের বিশেষ প্রিয়পাত্র কাশীচন্দ্র দাস। তাঁহার চরিত্র সম্বন্ধে কোন কথা বর্ণনা করিতে আমরা ইচ্ছে করি না। চাকলে রোশনাবাদের দেওয়ান হইলেন, কুমিল্লা জজ আদালতের উকীল, –কণিকশিষ্য মুন্সি ঈশানচন্দ্র গুপ্ত। নবদ্বীপচন্দ্রকে যুবরাজী না দিয়া সিংহাসন হইতে দূরে নিক্ষেপ করিলে, তিনি আদালতের আশ্রয় গ্রহণ করিয়া কিছুই করিতে পারিবেন না বলিয়া মহারাজ বীরচন্দ্রকে পরামর্শ প্রদান করেন। মহারাজ সেই পরামর্শের পুরস্কার স্বরূপ তাঁহাকে রোশনাবাদের দেওয়ানী পদ প্রদান করেন। এই সকল কর্মচারিগণের শাসনে ত্রিপুরার অধঃপাতের সূত্রপাত হইল।
কয়েক মাস অবরুদ্ধাবস্থায় থাকিয়া ব্রজমোহন ঠাকুর (১৯৩) সাহেব কাল কবলিত হইলেন। প্রায় এক বৎসর তিন মাস কাল নানা প্রকার যন্ত্রণা ও কষ্ট ভোগ করিয়া কুমার নবদ্বীপচন্দ্র ১২৮১ ত্রিপুরাব্দের আষাঢ় মাসের প্রথম ভাগে স্বীয় মাতাকে লইয়া দীন হীনের বেশে কুমিল্লায় উপস্থিত হইলেন।
মহারাজ বীরচন্দ্র যৎকালে নবদ্বীপের সর্বনাশ সাধন মানসে তাঁহার অমাত্যবর্গকে লইয়া নানা প্রকার মন্ত্রনা করিতেছিলেন; বেলবেডিয়ার রাজ প্রাসাদে বসিয়া বাঙ্গালার লেপ্টেন্যান্ট গবর্ণর তৎকালে পার্বত্য ত্রিপুরায় জনৈক পলিটিকেল এজেন্ট নিযুক্তের প্রস্তাব, কার্য্যে পরিণত করিবার জন্য যত্নবান হইয়াছিলেন। ত্রিপুরা রাজ্যের আভ্যন্তরিক অবস্থা বিশেষ রূপে অবগত হওয়ার জন্য যে কেবল ত্রিপুরার পলিটিকেল এজেন্ট নিযুক্তের প্রয়োজন হইয়াছিল এমত নহে, ত্রিপুরা রাজ্যের পূর্বদিকস্থ “লুসাই” নামক কুকিজাতির অত্যাচার নিবারণ ও তাহাদিগকে দমন করিবার জন্য গবর্ণমেন্ট যে কয়েকটি সুন্দর উপায় অবলম্বন করিয়াছিলেন, ত্রিপুরায় পলিটিকেল এজেন্টের নিযুক্তি তাহার অন্যতম।৮ যদিচ এই কার্য্যে মহারাজ সম্পূর্ণ প্রীতিলাভ করেন নাই, কিন্তু (১৯৪) ইতিহাস লেখক হইা মুক্ত কন্ঠে স্বীকার করেন যে, পার্বত্য ত্রিপুরায় পলিটিকেল এজেন্ট নিযুক্ত করিয়া, গবর্ণমেন্ট প্রজা সাধারণের মহোপকার সাধন করিয়াছিলেন। ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে ইন্ডিয়া গবর্ণমেন্ট পার্বত্য ত্রিপুরায় পলিটিকেল এজেন্ট নিযুক্তির প্রস্তাব মঞ্জুর করেন। ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দের ৩রা জুলাই লেপ্টেনান্ট গবর্ণর কর্তৃক এ, ডবলিউ বি, পাওয়ার সাহবে প্রথম পলিটিকেল এজেন্ট নিযুক্ত হন। নবদ্বীপচন্দ্র কুমিল্লায় উপস্থিত হইবার অল্প কয়েকদিন পরেই পাওয়ার সাহেব তথায় উপস্থিত হইলেন।
এই সময় দেওয়ান ঈশানচন্দ্র গুপ্ত কর্তৃক দেওয়ানী ও ফৌজদারী বিষয়ক সংক্ষিপ্ত নিয়মাবলী (আইন) প্রণীত হন। ইহার পূর্বে ত্রিপুরা রাজ্যের লিখিত আইন ছিল না।
নবদ্বীপচন্দ্র কুমিল্লায় উপস্থিত হইয়া মহারাজ বীরচন্দ্রের বিরুদ্ধে চাকলে রোশন- াবাদের দাবিতে দেওয়ানী আদালতে নালিস করিবার জন্য উদ্যোগী হইলেন। সুতরাং তৎকালে মহারাজ বীরচন্দ্রকে পুনর্বার ঠাকুর লোকদিগকে হস্তগত করিবার প্রয়োজন হইল। পক্ষান্তরে দেওয়ান রামমাণিক্য ও পেস্কার কাশীচন্দ্রের মধ্যে স্বার্থ সাধন লইয়া বিষম কলহ উপস্থিত হইল। মহারাজ বীরচন্দ্রের অভিষেকের পর ঠাকুরগণকে নিৰ্য্যাতন জন্য কাশীচন্দ্র অগ্রণী হইয়াছিলেন। এক্ষণ রামমাণিক্য সেই ঠাকুরলোকদিগের সহিত মিলিত হইয়া কাশী (১৯৫) চন্দ্ৰকে নিৰ্য্যাতন করিবার জন্য বিশেষ সুযোগ প্রাপ্ত হইলেন। কাশীচন্দ্র যারপরনাই লাঞ্ছিত ও অপমানিত হইলেন; কিন্তু মহারাজ বীরচন্দ্রের বিশেষ প্রিয়পাত্র বলিয়া পদচ্যুত হইলেন না। ১৮৮১ ত্রিপুরাব্দের শীত ঋতুতে পুনর্বার ঠাকুর লোকেরা প্রকাশ্য ভাবে ভাগাভাগিতে রাজ্যের কর্তৃত্ব গ্রহণ করিলেন। নাজির দীনবন্ধু মন্ত্রী হইলেন, গৌরচন্দ্র ঠাকুর আপীল আদালতের বিচার ও বন্দোবস্ত কার্য্যের ভারপ্রাপ্ত হইলেন। পার্বতীচরণ ঠাকুর মাজেস্ট্রেট ও তোষাখানার অধ্যক্ষ হইলেন। কিন্তু পাহাড় আদালতের অর্থাৎ পার্বতীয় প্রজাগণের বিচার কার্য্য ঠাকুর পার্বতীচরণ ও সুবা জগমোহন নির্বাহ করিতেন। আনন্দকিশোর ঠাকুর দেওয়ানী আদালতের প্রথম বিচারক ও রাজকীয় ধনাগারের অধ্যক্ষ হইলেন। দেওয়ান রামমাণিক্য ও পেস্কার কাশীচন্দ্র মন্ত্রীর অধীনে রহিলেন। কেম্পবল কালে রোশনাবাদের মেনেজার হইয়া কুমিল্লায় গমন করিলেন।
প্রধান ঠাকুরগণকে নামত কয়েকটি কার্য্যে নিযুক্ত করা হইল বটে, কিন্তু সমস্ত কার্য্যের মূল সূত্র মহারাজের হস্তেই রহিল। অথচ কার্য্যের প্রতি মহারাজের উপযুক্ত দৃষ্টি রহিল না। তৎকালে সঙ্গীত, চিত্র ও অন্যান্য বিলাসিতায় মহারাজ সম্পূর্ণ নিমগ্ন রহিলেন। ভারতীয় সঙ্গীত শাস্ত্রবিদ প্রধান প্রধান ব্যক্তিগণ প্রায় সকলেই সেই সময় ক্রমে ক্রমে আগরতলায় (১৯৬) উপস্থিত হইয়াছিলেন।[৯] অযোধ্যার অধিপতি ওয়াজিদ আলীর অধঃপতনের পর এইরূপ সঙ্গীত সমিতি ভারতের অন্য কোন স্থানে সংঘটিত হইয়াছে বলিয়া আমরা জ্ঞাত নহি।
চিত্র বিদ্যায় সুপণ্ডিত কয়েকজন ইংরেজ ও বাঙ্গালি অধিক বেতনে নিযুক্ত হইলেন। এই সকল ও অন্যান্য বিলাসিতার কার্য্যে রাশি রাশি অর্থ ব্যয় হইতে লাগিল।
মহারাজা বীরচন্দ্র যৎকালে নানাপ্রকার বিলাসিতার নিমগ্ন ছিলেন। বীন, রবাব, সারদ, পাখোয়াজ প্রভৃতি যন্ত্র নিনাদে ও গায়কগণের রাগ রাগিণীর আলাপে যৎকালে তাঁহার বিলাসভবন প্রমোদিত হইতেছিল, ব্রিটিস গবর্ণমেন্ট (১৯৭) সেই সময় বাঙ্গালার পূর্ব সীমান্তে চিরশান্তি স্থাপন জন্য ত্রিপুরা রাজ্যের পূর্বপ্রান্তে সমরানল প্রজ্জ্বলিত করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন। আমরা সেই বিবরণ সংক্ষেপে যথাস্থানে বর্ণনা করিব। ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে ডিসেম্বর মাসে কাছাড় ও পার্বত্য চট্টগ্রাম হইতে কুকিদিগকে নির্যাতন করিবার জন্য দুইটি বৃহৎ সেনাদল প্রেরিত হইয়াছিল। এই সময় ত্রিপুরা রাজ্যের পূর্ব সীমা নির্ণয় করিবার জন্য গবর্ণমেন্ট বিশেষ যত্নবান হইয়াছিরেন। গবর্ণমেন্টের এই সদভিপ্রায় যে পূর্বপ্রান্তে চিরশান্তি স্থাপন জন্য বিশেষ প্রয়োজনীয়, তাহা ইতিহাস লেখক অবশ্যই স্বীকার করিবেন। যখনই কুকিদিগের দ্বারা কোনরূপ অত্যাচার সংঘটিত হইয়াছে তখনই ত্রিপুরেশ্বরগণ “ইহারা আমার প্রজা নহে।” কিম্বা “আমার শত্রু (উদাহরণ স্বরূপ যথা শম্ভুচন্দ্র, কৃষ্ণচন্দ্র, মধুচরণ, নীলকৃষ্ণ প্রভৃতি) কুকিদিগের সহিত ষড়যন্ত্র করিয়া আমাকে বিপদাপন্ন করিবার জন্য এই কাণ্ড করিয়াছেন। এবপ্রকার অমূলক কিম্বা আংশিক সমূলক উত্তর প্রদান করিয়াছেন। অথচ ত্রিপুরা রাজ্যের উত্তর পূর্ব সীমারেখা প্রদর্শন করিবার সময় উপস্থিত হইলে বিশেষ আগ্রহের সহিত টেপাই নালার প্রতি অঙ্গুলি নির্দ্দেশ করিয়া থাকেন।[১০] (১৯৮) ১৮০৫ খ্রিস্টাব্দে কাপ্তান পেম্বারটন টেপাই নালাকে ত্রিপুরা, মণিপুর এবং কাছাড়ের ত্রিসীমা বর্ণনা করিয়াছেন। প্রকৃতপক্ষে প্রাচীনকালে ত্রিপুরা রাজ্য সীমা তদপেক্ষা দূরবর্তী স্থান পর্যন্ত প্রসারিত ছিল। আমরা তাহার বিশেষ প্রমাণ প্রদর্শন করিতে পারি; কিন্তু যেদিন হইতে কল্যাণ মাণিক্যের বংশধরগণ কাণ্ডজ্ঞান হীন হইয়া আত্মকলহে রত হইয়াছেন, যে দিন হইতে মনোহারিণী “লাইছাবি” গণ[১১] ত্রিপুর রাজ অন্তঃপুরে প্রবেশ করিয়াছে, সেইদিন হইতেই তাঁহাদের বলবীর্য্য অসিত পক্ষীয় ইন্দুর ন্যায় ক্রমে ক্রমে ক্ষীণ হইতেছে। দুর্বল ও বিলাসী নরপতির রাজ্যসীমা জগতে চিরকালই সঙ্কুচিত হইয়া আসিতেছে। মহারাজ ঈশানচন্দ্র মাণিক্যের মৃত্যুর অল্পকাল পূর্বেও এচিসন সাহেবের “সনন্দ সংগ্রহ” গ্রন্থের সহিত বাঙ্গালা ও ব্রহ্মার যে মানচিত্র[১২] প্রকাশিত হইয়াছিল, সেই মানচিত্রে “স্বাধীন ত্রিপুরা” রাজ্যের আয়তন যেরূপ প্রদর্শিত হইয়াছে, (১৯৯) অধুনা তাহার প্রায় অর্দ্ধাংশ ক্ষয়প্রাপ্ত হইয়াছে। ত্রিপুরা রাজ্যের পূর্বপ্রান্ত ও লুসাই প্রদেশ পরিমাপ করিয়া সীমারেখা নির্ণয় জন্য পলিটিকেল এজেন্ট পাওয়ার সাহেব অসাধারণ যত্ন ও পরিশ্রম স্বীকার করিয়াছিলেন এবং তাহার রিপোর্ট অনুসারে হিচক ও জাম্পুই পর্বত শ্রেণীর মধ্যবর্ত্তী লঙ্গাই নদী ত্রিপুরা রাজ্যের পূর্বসীমা নির্ণীত হইয়াছে। ফলত ত্রিপুরাপতিকে সীমান্ত রক্ষায় অক্ষম জানিয়াই[১৩] ত্রিপুরা রাজ্যের পূর্ব সীমারেখা সঙ্কুচিত করিয়া, গবর্ণমেন্ট বাঙ্গালা দেশের পূর্বপ্রান্ত বাসী মানববৃন্দের মহোপকার সাধন করিয়াছেন। কারণ যদি দুৰ্দ্দান্ত লুসাইদিগের বসতিস্থান ত্রিপুর রাজ্যসীমার অন্তর্গত হইত, তাহা হইলে মহারাজ কখনই তাহাদিগকে সুশাসনে রাখিতে পারিতেন না। সুতরাং সেই দুর্দান্ত কুকিগণ তাহাদের চির অভ্যস্ত নরহত্যা, গৃহদাহ, লুটপাট প্রভৃতি কাৰ্য্য অবাধে নির্বাহ করিত। মহারাজ বীরচন্দ্র দৃঢ়রূপে রাজ সিংহাসনে আরোহণ করিয়া স্বীয় পত্নী, পুত্র, শ্যালক প্রভৃতি প্রিয়দর্শন আত্মীয়বর্গকে সামান্য জমায় যে (২০০) সমস্ত তালুক ক্রমে ক্রমে প্রদান করিয়াছেন, তাহাতে ত্রিপুরা রাজ্যের রাজস্ব[১৪] প্রায় তৃতীয়াংশ খববীকৃত হইয়াছে। দুৰ্দ্দান্ত কুকিদিগকে সর্বদা শাসনে রাখিবার জন্য যেরূপ সৈন্যের প্রয়োজন ছিল তাহার জন্য মহারাজা বাহাদুরকে অন্তত বার্ষিক সেই পরিমাণ অর্থব্যয় করিতে হইত, মহারাজ তাহা করিবেন দূরে থাকুক, যে সামান্য কয়েকটি গারদ তিনি সীমান্ত প্রদেশে রক্ষা করিবার জন্য গবর্ণমেন্টের নিকটে প্রতিশ্রুত হইয়াছেন, সর্বদা তাহাও উপযুক্তরূপে রক্ষা করিতেছেন না। মহারাজ আগরতলায় বসিয়া আমোদ প্রমোদে রাশি রাশি অর্থব্যয় করিতেছেন আর তাঁহার সীমান্ত রক্ষক সৈন্যগণ সময় সময় বেতনাভাবে প্রাচীন আর্য্য ঋষিদিগের ন্যায় নিবিড় অরণ্যে বসিয়া ফল মূল ভক্ষণে জীবন যাপন করিতেছে।[১৫]
পলিটিকেল এজেন্ট আগরতলায় উপনীত হইবার অল্পকাল পরে তাঁহার উপদেশ অনুসারে বিচারাদালত গঠিত হইয়াছিল। তাহা পূর্বে উল্লেখ করা হইয়াছে। প্রাচীন (২০১) কাল হইতে দেওয়ানী ও ফৌজদারী সংক্রান্ত বিচারের চূড়ান্ত নিষ্পত্তি মহারাজ স্বয়ং করিতেন। ১২৮২ ত্রিপুরার আষাঢ় মাস হইতে ঐ সকল মোকদ্দমার বিচার জন্য মহারাজ “খাসআপীল আদালত” নামে একটি বিচারালয় সংস্থাপন করেন। এই বিচারাদালত কোন কোন অংশে প্রিভি কৌন্সেলের অনুকরণে গঠিত হইয়াছে। মঞ্জুরী দানের ক্ষমতা স্বহস্তে রাখিয়া মহারাজ বীরচন্দ্র মাণিক্য, ছত্রমাণিক্যের বংশধর রাজা মুকুন্দরাম রায় ও (দ্বিতীয়) ব্রজমোহন ঠাকুরকে খাস আপীল আদালতের বিচারকের পদে নিযুক্ত করিলেন।
রাজধানীতে বসিয়া কয়েকজন রাজকর্মচারী সমগ্র ত্রিপুরা রাজ্য শাসন করিতে পারেন নাই। প্রাচীনকালে জনৈক রাজকর্মচারী কিছুকালের জন্য কৈলাসহরে বাস করিয়া, সময় সময় উত্তর ভাগের কার্য্যকলাপ নির্বাহ করিতেন। এক্ষণ কৈলাসহর উপরিভাগ সৃষ্টি করিয়া মহারাজ বাবু দুর্গাপ্রসাদ গুপ্তকে তাহার সুপারিটেন্ডের পদে নিযুক্ত করিলেন। আইন বহির্ভূত প্রদেশের ডিপুটি কমিশনারগণ যে সকল ক্ষমতা পরিচালন করিয়া থাকেন, দুর্গপ্রসাদবাবু সেই সকল ক্ষমতা প্রাপ্ত হইলেন। অল্পকাল মধ্যেই দুর্গাপ্রসাদ বাবু সুশাসন দ্বারা কৈলাসহর বিভাগের উন্নতি সাধন করিয়া, তথায় স্মরণীয় হইয়া রহিয়াছেন।(২০২)
এই সময় আগরতলায় নানা প্রকার বিশৃঙ্খলা উপস্থিত হইল। ঋণ বৃদ্ধি হইতে চলিল। ভাগাভাগীতে ঠাকুর লোকদিগকে রাজকার্য্যে নিযুক্ত করিয়া, মহারাজ স্ব স্ব প্রধান কতকগুলি নায়ক সৃষ্টি করিয়াছিলেন। গায়ক, বাদক ও রাজদরবারের অন্য চাটুকারবর্গও মহারাজের অতিরিক্ত অনুগ্রহ লাভ করিয়া, রাজকার্য্যে হস্তক্ষেপ করিতে লাগিলেন। এইরূপে বহুনায়ক ও বিলাসিতার ব্যয়ই বিশৃঙ্খলা ও ঋণ বৃদ্ধির মূল কারণ। এই বিশৃঙ্খলা দূর করিবার জন্য একটি ভাল লোক নিযুক্ত করিবার কারণ পলিটিকেল এজেন্ট মহারাজকে অনুরোধ করেন। চাকলার মেনেজার কেম্পবল সাহেব কুমিল্লার সাব রেজেষ্টার বাবু নীলমণি দাসকে সেই কার্য্যের সম্পুর্ণ উপযুক্ত বলিয়া, মহারাজ সমীপে প্রকাশ করিলেন। মহারাজ গবর্ণমেন্ট সমীপে বাবু নীলমণি দাসের সার্বিস পরিবর্তনের প্রার্থনা করেন। তদুনুসারে গবর্ণমেন্টের ১৮৭৩ খৃঃ অঃ ২৭ আগষ্টের অনুমতি দ্বারা ১২৮৩ ত্রিপুরাব্দের ভাদ্র মাসে নীলমণি দাস সর্বপ্রকার ক্ষমতা যুক্ত দেওয়ানী পদ প্রাপ্ত হইলেন।
নীলমণি দেওয়ানী পদে নিযুক্ত হইলে মন্ত্রীর প্রয়োজন রহিল না। সুতরাং অনুপযুক্ত মন্ত্রী দীনবন্ধু সদর মেজেস্ট্রেটের পদে অবনতি প্রাপ্ত হইলেন। নীলমণি দাস কার্যভার গ্রহণ করিয়া, ব্রিটিস অনুকরণে আবকারী (মাদক দ্রব্য (৩০৩) সংক্রান্ত) বিভাগ ও ষ্টাম্প সৃষ্টি, দলীল রেজেষ্টারির নিয়ম প্রবর্তিত করেন। তিনি দেওয়ানী ও ফৌজদারি সংক্রান্ত আইন সংশোধন এবং উন্নত করিবার অভিপ্রায়ে “উদয়পুর” বিভাগ সৃষ্টি করিয়া, বাবু উদয়চন্দ্র সেনকে তাহার শাসন কার্য্যে নিযুক্ত করেন। কিন্তু উদয়পুর বর্ষাকলে নিতান্ত অস্বাস্থ্যকর হইয়া উঠে। এজন্য সোনামুড়া নামক স্থানে সদর ষ্টেসন স্থাপন করা হইল। ১২৮৪ ত্রিপুরাব্দের বর্ষাকালে মহারাজ বীরচন্দ্র ঢাকায় যাইয়া, গবর্ণর জেনেরল লর্ড নর্থব্রুকের সহিত সাক্ষাৎ করেন। ইহার পূর্বে অন্য কোন নরপতি রাজ প্রতিনিধির সহিত সাক্ষাৎ করেন নাই। দর্শন কালে যদিচ গবর্ণর জেনেরল বাহাদুর মহারাজের প্রতি বিশেষ সম্মান প্রদর্শন করিয়াছিলেন; কিন্তু প্রতিদর্শন না করায়, জনসাধারণ ক্ষুব্ধ হইয়াছিলেন। বাবু নীলমণি দাস সর্বপ্রকার বিশৃঙ্খলা দূর করিয়া, আয়বৃদ্ধি ও ঋণ পরিশোধের পন্থা পরিষ্কার করিয়াছিলেন। এমন সময় কুমার নবদ্বীপচন্দ্র চাকলে রোশনাবাদের দাবিতে মহারাজ বীরচন্দ্র মাণিক্যের নামে ত্রিপুরার দেওয়ানী আদালতে এক মোকদ্দমা উপস্থিত করিলেন। (১৮৭৪ খ্রিঃ অঃ ৩৫ নং মোকদ্দমা) সুতরাং তৎপ্রতি বিশেষ মনোযোগী হইলেন।
কুমার নবদ্বীপচন্দ্র স্বীয় আবেদন পত্রে বলিলেন যে, (২০৪) তাঁহার পিতা মহারাজ ঈশানচন্দ্র, বীরচন্দ্রকে যুবরাজী পদে নিযুক্ত না করিয়া পরলোক গমন করিয়াছেন, সুতরাং শাস্ত্র মতে তিনিই স্বর্গীয় মহারাজ এবং কুমার ব্রজেন্দ্র চন্দ্রের একমাত্র ত্যজ্য সম্পত্তির অধিকারী।
মহারাজ বীরচন্দ্র এক সুদীর্ঘ বর্ণনা দাখিল করিয়া অনেক প্রকার আপত্তি উত্থাপন করিলেন। বাহুল্য বিবেচনায় আমরা সেই সমস্ত পরিত্যাগ করিলাম। তাঁহার তিনটী আপত্তিই উল্লেখযোগ্য যথা-১/ একপ্রকার মোকদ্দমার বিচার করিবার অধিকার ব্রিটিশ আদালতের নাই। ২- বাদী দাসীর গর্ভজাত সন্তান।১৬ সুতরাং হিন্দু শাস্ত্রানুসারে তিনি ঈশানচন্দ্রের ত্যজ্য সম্পত্তির অধিকারী হইতে পারেন না। ৩/ মহারাজ ঈশানচন্দ্ৰ, বীরচন্দ্রকে যুবরাজী পদে নিযুক্ত করিয়া গিয়াছেন, সুতরাং রাজবংশের চিরপ্রচলিত প্রথামত যুবরাজই রাজ্যাধিকারী বটেন। (২০৫)
নবদ্বীপচন্দ্রের অনুকূল ১৪টী সাক্ষী মাত্র উপস্থিত হইল। তন্মধ্যে মহারাজ ঈশানচন্দ্রের অন্তিমকালের চিকিৎসক দুইজন, এবং ঈশানচন্দ্র ও বীরচন্দ্রের “সভাপণ্ডিত” ত্রিপুরা— জেলার সর্বপ্রধান স্মার্ত্ত, পণ্ডিত রামদুলাল বিদ্যাভূষণের জবানবন্দি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। ইহারা উভয় পক্ষের মানিত এবং সাক্ষ্য দেওয়ার পূর্ব মুহূর্ত পর্য্যন্ত মহারাজ বীরচন্দ্রের বেতনভোগী ছিলেন। তাঁহারা সরলভাবে আদালতে প্রকাশ করিলেন যে, মহারাজ ঈশানচন্দ্র বীরচন্দ্রকে যৌবরাজ্যে নিযুক্ত করেন নাই। মহারাজ বীরচন্দ্রের অনুকূলে প্রায় ত্রিশজন সাক্ষী উপস্থিত হইয়াছিল। ইঁহাদের মধ্যে প্রধান ঠাকুরগণ পূর্বে নীলকৃষ্ণের ও চক্রধবজের মোকদ্দমায় বীরচন্দ্রের অনুকূলে সাক্ষ্য প্রদান করিয়াছিলেন। তাঁহারা দলে দলে উপস্থিত হইয়া বলিলেন, “যে নবদ্বীপের মাতা দাসী ছিলেন এবং ঈশানচন্দ্র, বীরচন্দ্রকে যুবরাজী পদে নিযুক্ত করিয়া গিয়াছেন।”১৭ (২০৬) ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দের ২৭ ফেব্রুয়ারি ত্রিপুরার জজ ফাউল সাহেব এই মোকদ্দমা নিষ্পত্তি করেন। ফাউল সাহেবের দ্বারা এইরূপ অবধারিত হয় যে, এই মোকদ্দমার বিচার করিবার অধিকার ব্রিটিস আদালতের আছে। নবদ্বীপচন্দ্র মহারাজ ঈশানচন্দ্র মাণিক্যের বিবাহিত পত্নীর গর্ভজাত পুত্র এবং শাস্ত্রানুসারে তিনি তাঁহার পিতার ত্যজ্য সম্পত্তির অধিকারী; কিন্তু বীরচন্দ্র মহারাজ ঈশানচন্দ্র দ্বারা যুবরাজী পদে নিযুক্ত হইয়াছেন; সুতরাং কুলাচারানুসারে তিনিই রাজ্যাধিকারী বটেন।
তদনন্তর হাইকোর্টে উক্ত মোকদ্দমার আপীল হইল। হাইকোর্টের জজগণ ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দের ১৪ আগষ্ট তারিখের নিম্ন আদালতের নিষ্পত্তি স্থির রাখিলেন। দেওয়ান নীলমণি দাস হাইকোর্টের হুকুম শ্রবণ করিয়া হর্ষচিত্তে কলিকাতা হইতে আগরতলায় উপনীত হইলেন।(২০৭)
১২৮৬ ত্রিপুরাব্দের কার্ত্তিক মাসে ব্রিটিস দণ্ডবিধির অনুকরণে দেওয়ান নীলমণি জনৈক নরহন্তাকে ফাঁসী দ্বারা প্রাণদণ্ড করেন। ইহার পূর্বে ফাঁসী দ্বারা ত্রিপুরা রাজ্যে কাহারও প্রাণদণ্ড হয় নাই।
এই সময় নীলমণি বাবুর যত্নে ত্রিপুরা রাজ্যে উকিলদিগের পরীক্ষার প্রথা প্রবর্ত্তিত হয়।[১৮]
বাবু নীলমণি দাস কর্মঠ এবং কার্যোৎসাহী ছিলেন। তিনি বিশেষ প্রতিভাশালী ছিলেন না, এজন্য অধীনস্থ সুচতুর ও বুদ্ধিমান সুপারেন্টেডেন্ট (অধুনা দেওয়ান) বাবু রাজমোহন মিত্র এবং অন্য একজন কর্মচারী হইতে গোপনে পরামর্শ গ্রহণ করিতেন।
১২৮৬ ত্রিপুরাব্দের শীত ঋতুতে বাবু নীলমণি দাস চাকলে রোশনাবাদের দক্ষিণ বিভাগ পরিদর্শন জন্য গমন করেন। এই সুযোগে তাঁহার শত্রু দীনবন্ধু তাঁহার বিরুদ্ধে এক দল গঠন করেন। ইহাদের পরামর্শে মহারাজ বীরচন্দ্র ত্রিপুরা রাজ্যের একজন প্রকৃত মঙ্গলাকাঙ্খী দেওয়ান (নীলমণি দাস) কে অবমানিত, লাঞ্ছিত ও ক্ষতিগ্রস্ত করিয়া রাজ্য হইতে বহিস্কৃত করিলেন। সরলচিত্ত নীলমণি এই অবমাননা সহ্য করিতে পারিলেন না, তাঁহার হৃদয় ভাঙ্গিয়া গেল। অল্পকাল মধ্যে তিনি কালগ্রাসে পতিত হইলেন। (২০৮)
.
টীকা
১. Commissiner’s letter to the Secretary to the Government of Bengtal. No. 359 B, Dated 7th Augut 1862.
২. গুরুকে কারাগার হইতে মুক্ত করিবার জন্য তাহার শিষ্য পূর্ণানন্দ সিংহ ঐ অব্দের ২১ আষাঢ় ও গুরুর ভ্রাতা নবকৃষ্ণগোস্বামী ৯ ভাদ্র জেলা ত্রিপুরার কর্তৃপক্ষগণের নিকটে দুইখণ্ড দরখাস্ত করিয়াছিলেন। পূর্ণানন্দের দরখাস্তে জয়েন্ট ম্যাজেস্ট্রেট সিলেট ১৮৬৩ খ্রিঃ ৬ই জুলাই ও নবকৃষ্ণের দরখাস্তে মেজেস্ট্রেট আর, এস, মেঙ্গল সাহেব ঐ অব্দের ২৪ আগষ্ট যে হুকুম দেন, তাহাতে বিপীন বিহারী ব্রিটিস প্রজা নহেন বলিয়া তাহাকে মুক্ত করিতে তাহারা অসম্মত এরূপ প্রকাশ করিয়াছিলেন।
৩. এই বীভৎস ঘটনা সম্বন্ধে ত্রিপুরায় তদানীন্তন ম্যাজেস্ট্রেট মেঙ্গল সাহেব স্বীয় রিপোর্টে লিখিয়াছেন।
The heads of this (Jamatyas) were cut off and are now hanging up in terrorem of Agurtollah.
৪. কৌৰ্ম্মং সঙ্কোচমস্থায় প্রহারমপিমর্যয়েৎ।
প্রাপ্তকালন্ত নীতিজ্ঞ উত্তিষ্ঠেৎ ক্রুরসর্পবৎ।
হিতোপদেশ, বিগ্রহ, ৫১ শ্লোক।
৫. The Raja is utterly helpless to control his immediate dependants or defend himself in the event of a Combined revolt.
৬. মহারাজ বীরচন্দ্রের নিজের তিনটি ভৃত্য ও মহারাজ ঈশানচন্দ্রের কর্মচারী উল্লেখে আদালতে সাক্ষ্য দিয়াছিলেন।
৭. ঈশানচন্দ্র মাণিক্যের মৃত্যুর অল্পকাল পরেই “ষ্ট্রগনমোটকেল” সারভে দ্বারা গবর্ণমেন্ট ত্রিপুরা রাজ্য জরিপ আরম্ভ করেন। উক্ত জরিপী কার্য শেষ হওয়ার পর সম্ভবত ১৮৬৫ কিম্বা ৬৬ খ্রিস্টাব্দ হইতে গবর্ণমেন্ট “স্বাধীন ত্রিপুরা” শব্দ কর্ত্তন করত “পবর্বত ত্রিপুরা” লিখিতে আরম্ভ করেন।
৮. Lord Mayo also advocated placing a Political Agent in Hill Tipperah.
Machenize’s North-East Frontier of Bengal Page 303.
৯. সুরবীন বাদক … নিশার হুসন।
রবাব, বীন ইত্যাদি বাদক … কাশেমআলি খাঁ
এছরাজ বাদক … হাইদর খাঁ।
সেতার বাদক … নবীনচাঁদ গোস্বামী।
বেহালা বাদক … হরিদাস।
কেশবচন্দ্র মিত্র।
পাখোয়াজ বাদক … পঞ্চানন মিত্র,
রামকুমার বসাক।
সারদ বাদক ***
গায়ক ভোলানাথ চক্রবর্ত্তী, যদুনাথ ভট্ট এবং আরও কতকগুলি গায়ক ও বাদক মিলিত হইয়াছিলেন;
তাঁহাদের নাম আমরা বিস্মৃত হইয়াছি।
১০. So. The Raja of Tipperah indeed claims supremacy over all the villages west of Tipai, but practrically his authority was never acknowledge east of the Chatterchoora Range.
Letter from J. W. Edgar Esq. Civil officer with Cachar Column of the Lushai expeditionary force. To the Commissioner of Dacca Division, dated 3rd April 1872.
১১. লাইছবি- মনিপুরী অবিবাহিত যুবতী।
১২ . Map of the acquisitions of British Territory in Bengal and the Burmese Provinces. 1862.
১৩. The Lieutenant Governor agrees with all the officers whose opin – ions he had, that we cannot expect the Raja of Tipperah to organise an efficient frontier defence.
Mackenzie’s North-East Frontier of Bengal Page 482 .
১৪. Land Revenue.
১৫. In most cases the Political Agent found the sepoy’s Pay in arrears and no ammunition provided for their muskets.
Mackenzie’s North-East Frontier of Bengal. PP. 320-321.
১৬. এবার মহারাজ বীরচন্দ্র, নীলকৃষ্ণের প্রদর্শিত কুপথ অবলম্বন করিলেন। তাহার পাল্টা স্বরূপ কুমার নবদ্বীপচন্দ্র প্রমাণ উপস্থিত করিলেন যে, “মহারাজ বীরচন্দ্রের মাতা দাসী স্বরূপ রাজান্তঃপুরে প্রবেশ করিয়াছিলেন। একটি সন্তান হওয়ার পর তাঁহার বিবাহ হইয়াছিল।” চক্রধবজের মোকদ্দমায় হাইকোর্টের মান্যবর জজগণ সিদ্ধান্ত করিয়াছেন যে রাজা ইচ্ছা করিলে সন্তানের জন্মের পর তাহাকে বিধিসিদ্ধ করিতে পারেন। W. R. vol. I. P. 194 এই সম্বন্ধে লেখকদের মত অন্যরূপ যথাস্থানে প্রদর্শিত হইবে।
১৭. দুর্গামণি যুবরাজের মোকদ্দমায় অধিকাংশ ঠাকুর লোক তাহার অনুকূলে সাক্ষ্য দিয়াছিলেন। এজন্য সাময়িক নরপতি মহারাজ রামগঙ্গা তাহাদিগকে সপরিবারে শৃঙ্খলাবদ্ধ করিয়াছিলেন। (Mackenzie’s N. E. Forntier of Bengal P 274) দুই বৎসর অন্তে দুর্গামনি রাজদণ্ড ধারণ করত তাহাদের শৃঙ্খল ছেদন করিয়াছিলেন। সুতরাং আমাদের বিশ্বাস কোন ঠাকুর সামরিক নরপতির বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে পারেন না। স্বাধীন ত্রিপুরার আদালত সমুহে যখন রাজসরকারের বিরুদ্ধে কোন মোকদ্দমা উপস্থিত হয়, তখন বিচারক ঠাকুরগণের বিবেকশক্তি কোন কোন সময়ে কুর্ম্মের হস্তপদের ন্যায় সংকুচিত হইয়া থাকে। (Bengal Administration Report, 1888-89) সামান্য কোন বিষয় সম্পত্তির জন্য বিরোধ উপস্থিত হইলে যখন ঠাকুরগণ এরূপ দুর্দশায় পতিত হইয়া থাকেন, সেস্থলে সিংহাসন লইয়া বিরোধ উপস্থিত হইলে যে, তাঁহারা কি করিবেন, তাহা সহজেই বুঝা যাইতে পারে।
১৮. ১২৮৬ ত্রিপুরাব্দের ২৭ আষাঢ়ের রোবকারী।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন