নাবিক দস্যু বনহুর

রোমেনা আফাজ

নাবিক দস্যু বনহুর

ভাগ্যিস বর্শাখানা বনহুরের দেহে বিদ্ধ হয়নি। সঙ্গে সঙ্গে জংলীরাণীর নিক্ষিপ্ত দ্বিতীয় বর্শাও তীরবেগে ছুটে এলো। মুহূর্ত বিলম্ব না করে বনহুর কাৎ হলো একপাশে।

বর্শাখানা এসে ঠিক বনহুরের সম্মুখে ভেলায় গেঁথে গেলো। সামান্যের জন্য তার দেহে বিদ্ধ হয়নি বা হলো না।

ভীত স্বরে কেশব বললো–সর্বনাশ! বাবু, জংলীরাণী অশ্ব নিয়ে ছুটে চলছে আমাদের ভেলার সঙ্গে।

বনহুর সোজা হয়ে বললো–অশ্বের গতির চেয়ে আমাদের ভেলার গতি আরও দ্রুত আছে।

বনহুরের কথা মিথ্যা নয়, তাদের ভেলা অত্যন্ত দ্রুত ভেসে চলেছে। কারণ জলপ্রপাতের গতি এখানে খুব বেশি।

ওদিকে পাড়ের উপর দিয়ে অশ্বপৃষ্ঠে এগুচ্ছে জংলীরাণী। হস্তে তার আর একখানা উদ্যত বর্শা। বনহুর তাকিয়ে দেখলো অশ্বপৃষ্ঠে আরও কতকগুলো বর্শা বাঁধা রয়েছে, জংলীরাণী তারই। একটি করে বর্শা খুলে নিয়ে নিক্ষেপ করছে তাদের লক্ষ্য করে।

ভেলাখানা অত্যন্ত বেগে স্রোতের টানে সম্মুখ দিকে ভেসে চলেছে। প্রশস্ত নদীবক্ষে কোনো বাধা পাচ্ছিলো না বা কোনো অসুবিধা হচ্ছিলো না ভেলাখানার।

বনহুর আর কেশব ভেলাখানা শক্ত করে ধরে বসে রইলো কিন্তু তাদের দৃষ্টি রয়েছে তীরস্থ অশ্বপৃষ্ঠে ছুটে চলা জংলীরাণীর দিকে। রুদ্রাণী মূর্তি নিয়ে এগিয়ে আসছে জংলীরাণী।

কেশবের মুখ ছাই-এর মত ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে।

বনহুরের মুখমন্ডলে একটা কঠিন ভাব ফুটে উঠেছে। জংলীরাণীকে কাবু করা তার পক্ষে অসম্ভব হবে না, কারণ জংলীরাণীর অসংখ্য জংলী অনুচরগণ এখন তার সঙ্গে নেই। কিন্তু যেভাবে। তাদের ভেলা চলেছে তাতে জংলীরাণীর কবলে ধরা পড়ার তেমন কোনো সম্ভাবনা নেই।

অল্পক্ষণের মধ্যেই ভেলা বহুদূরে চলে গেলো।

ওদিকে জংলীরাণী অশ্বপৃষ্ঠে তীরবেগে ছুটে আসছে।

পর্বতের পাদমূল বেয়ে জলপ্রপাতটি–কাজেই দু’ পাশের তট শুধু কঠিন পাথরে তৈরি এবং অত্যন্ত উঁচুনীচু। জংলীরাণী অশ্বপৃষ্ঠে ভেলাখানাকে অনুসরণ করলেও ঠিকমত এগুতে সক্ষম। হচ্ছিলো না। তবু ক্ষান্ত হবার কোনো লক্ষণ নেই জংলীরাণীর মধ্যে।

জমকালো বিরাটদেহী অশ্ব কতকটা বনহুরের তাজের মত দেখতে। এতো বিপদেও। জংলীরাণীর অশ্বটিকে লক্ষ্য করে বনহুরের মনে তার তাজের কথা স্মরণ হতে লাগলো। কতদিন। সে তাজকে দেখে না, তাজের পিঠে চাপেনি। না জানি আর সে কোনোদিন তাজের পিঠে চাপতে পারবে কিনা কে জানে।

বনহুর জংলীরাণীর অশ্বচালনা দেখে শুধু বিস্মিতই হলো না, মুগ্ধও হলো। বিনা লাগামে জংলীরাণী অশ্ব চালনা করছিলো। শুধুমাত্র লাগামের মত করে একখানা রশি ছিলো তার হাতের মুঠায়!

সূর্যের আলোকে জংলীরাণীর কণ্ঠের মূল্যবান হীরকখন্ডগুলো থেকে উজ্জ্বল দ্যুতি ঠিকরে বের হচ্ছিলো। বহুদূর হতে বনহুর আর কেশবের চোখ যেন ধাধিয়ে যাচ্ছিলো।

আকাশ সচ্ছ নীল।

সূর্য এখনও ঠিক মধ্য আকাশে উঠে আসেনি। পর্বতমালার সেই সুড়ঙ্গমুখ ছেড়ে এখন তাদের ভেলা বহুদূর চলে এসেছে। জংলীরাণী অশ্ব নিয়ে ছুটে আসছে, তীরস্থ পাথরখন্ডের উপর দিয়ে কৌশলে অশ্ব চালনা করছে সে।

হঠাৎ বনহুর লক্ষ্য করলো তাদের ভেলার গতি ক্রমেই হ্রাস হয়ে আসছে। বিপদ আসন্ন। উপলব্ধি করলো বনহুর এবং কেশব। কারণ জংলীরাণী ক্রোধান্ধ সিংহীর ন্যায় উন্মত্তভাবে ছুটে আসছে। কোনোক্রমে নাগালের মধ্যে পেলে মুহূর্ত বিলম্ব করবে না সে। সূতীক্ষ্ণ বর্শা প্রবেশ করিয়ে দেবে তাদের বক্ষমধ্যে।

ঐ দিন জংলীরাণী বনহুরের সৌন্দর্যে বিমুগ্ধ হয়েই তাকে হত্যা করেনি। তাকে সে সাথী করে নেবে ভেবেছিলো। তাই জংলীরাণী তার সমস্ত প্রেম-ভালোবাসা উজাড় করে দিয়েছিলো ওকে। কিন্তু তার প্রতিদানে জংলীরাণী ওর কাছে পেয়েছে নিদারুণ প্রতারণা। বনহুর হত্যা করেছে জংলীরাণীর কয়েকজন বিশ্বস্ত অনুচরকে এবং পালিয়ে গেছে গোপনে।

জংলীরাণী সভ্য সমাজের কোমলহৃদয় নারী না হলেও তার মধ্যেও আছে একটি নারী প্রাণ। যে প্রাণে আছে প্রেম-প্রীতি-ভালবাসা আর মাতৃত্বের সংযোজন।

প্রেমানুরাগীর নিকটে ব্যর্থতা লাভ করে তাই জংলীরাণী ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে। প্রতিহিংসার বহ্নিশিখা দাউদাউ করে জ্বলে উঠেছে তার মনের মধ্যে। প্রতিশোধ সে নেবেই ওকে হত্যা করে। হত্যাই উদ্দেশ্য নয় জংলীরাণীর, ওকে হত্যা করে রক্ত পান করবে সে, নিবৃত্ত করবে সে এর জ্বালাময়ী পিপাসা।

বিষম বিপদের সম্মুখীন হচ্ছে বনহুর আর কেশব। কারণ তাদের ভেলার গতি ক্রমান্বয়ে মন্থর হয়ে আসছে। কেশবের মুখমন্ডল বিবর্ণ পাংশু হয়ে উঠেছে। বনহুরের মনেও যে একটা বিভীষিকার ছায়াপাত হয়নি তা নয়।

বনহুর কেশবকে লক্ষ্য করে আরো বেশি উদ্বিগ্ন হলো, বললো বনহুর–কেশব, ভেলার গতি কমে আসছে।

হাঁ বাবু, আর বুঝি জীবন বাঁচাতে পারলাম না।

এতো সহজে হতাশ হচ্ছো কেন কেশব। যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ। কেশব, ভাল সাঁতার জানো?

বাবু, ঐ কাজ আমি জানি না।

সর্বনাশ করেছো তাহলে। আমি সেই ভরসাতেই আছি–এখন উপায়!

এমন সময় একটা শব্দ কানে আসে। পাশের তীর অভিমুখে তাকাতেই বনহুর দেখতে পায়…বিরাট একটা ফাটলের মধ্য হতে হু হু শব্দে জলস্রোত গড়িয়ে আসছে। দুই পাড় তার অত্যন্ত উঁচু।

মুহূর্তে বনহুর ফিরে তাকায় অদূরস্থ অশ্বপৃষ্ঠে জংলীরাণীর দিকে। তীরবেগে অশ্ব নিয়ে ছুটে আসছে সে, দক্ষিণ হস্তে তার সূতীক্ষ্ণ বর্শা।

বনহুর তাকালো তটস্থ সুউচ্চ ফাটলের দিকে। আর কয়েক রশি–তাহলেই জংলীরাণীর। অশ্বের পথ রোধ হয়ে যাবে। বনহুর বললো-কেশব আমাদের ভয় কেটে গেছে।

বাবু!

হ কেশব, ঐ দেখো সম্মুখে যে বিরাট ফাটল দেখছো, ঐ ফাটল পেরিয়ে কিছুতেই সে এ পাড়ে আসতে সক্ষম হবে না।

কেশবও তাকালো, সত্যিই ফাটলটা মস্তবড়–প্রায় বিশ গজের বেশিই হবে। নিচে কঠিন পাথর আর জলরাশি। জলরাশি কলকল করে ছুটে বেরিয়ে এসে মিশে যাচ্ছে নদীবক্ষে।

বনহুর আর কেশব ভেলার বুকে বসে দেখলো–জংলীরাণী অশ্ব নিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে। বিরাট ফাটলার ধারে। অশ্বটা সম্মুখস্থ পা দুটি উঁচু করে চিহি চিহি শব্দ করছে।

বনহুর আর কেশবকে নিয়ে ভেলাটা তখন মন্থর গতিতে এগুচ্ছে। স্তব্ধ নিশ্বাসে বনহুর তাকিয়ে আছে, এইবার জংলীরাণী কি করে দেখতে চায় সে।

হঠাৎ জংলীরাণী অশ্ব নিয়ে পিছু দিকে হটে যায়।

কেশব বলে উঠে–বাবু, বাবু, জংলীরাণী ফিরে যাচ্ছে…

কিন্তু কথা শেষ হয় না কেশবের, বনহুর আর কেশব বিস্ময়-ভরা নজরে দেখে–উল্কাবেগে জংলীরাণী অশ্ব চালিয়ে ফাটলটার দিকে ছুটে আসছে। জংলীরাণীর অশ্বখুরের প্রতিধ্বনি পাথরখন্ডে যেন আছাড় খেয়ে পড়ছে।

মাত্র কয়েক মিনিট জংলীরাণীর অশ্ব ফাটল পার হবার জন্য লম্ফ দিলো ভীষণ আকারে কিন্তু এপারে এসে পৌঁছতে পারলো না, আছাড় খেয়ে পড়লো গভীর খাদের মধ্যে।

বনহুর দক্ষিণ হস্তে নিজের চোখ দুটি ঢেকে ফেললো।

কেশব আনন্দে হাততালি দিয়ে বলে উঠলো–ঠিক হয়েছে। উপযুক্ত শিক্ষা পেয়েছে…

হঠাৎ বনহুরের মুখ নজর পড়তেই থ’ খেয়ে গেলো কেশব। একটা গভীর বেদনার ছাপ বনহুরের মুখমন্ডলে ঘনীভূত হয়ে ফুটে উঠেছে। ছলছল করছে তার দ্বীপ্ত উজ্জ্বল চোখ দুটি। একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে বললো বনহুর–জংলীরাণীর বাসনা বিদ্ধ হলো না।

বাবু, জংলীরাণী মারা পড়েছে?

হাঁ কেশব, জংলীরাণীর দেহ চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেছে। আর সে পৃথিবীর আলো দেখতে পাবে না, আর সে প্রতিশোধ নিতে পারবে না আমাদের উপর।

*

অবিরাম ক’দিন ধরে ভেলাখানা ভেসে চলেছে। এদিকে জল স্রোত অত্যন্ত বেশি নয়, তবে। একেবারে কমও নয়। ভেলার উপর বসে বসে অতীষ্ঠ হয়ে উঠেছে বনহুর আর কেশব। ক্ষুধা পিপাসায় অত্যন্ত কাতর হয়ে পড়েছে ওরা। বিশেষ করে কেশব ভেলায় শুয়ে পড়েছে, আর উঠবার শক্তিও নেই তার। বনহুরও অবশ্য অত্যন্ত কাতর হয়ে পড়েছে–শুধু ক্ষুধাই নয়, নূরীর জন্য তার মনে দুশ্চিন্তার ঝড় বইছে। কোথায় কোন দিকে নূরীকে নিয়ে গেছে তারা কে জানে। কেমন অবস্থায় আছে তাদের কাছে। কি আচরণ করছে তারা তার সঙ্গে তাই বা কে জানে!

বিশেষ করে কেশবের মুখের দিকে তাকিয়ে বনহুরের বড় মায়া হচ্ছিলো। বেচারী কেশবকে কি করে বাঁচাবে সেই চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়লো। এই নিঃসঙ্গ মুহূর্তে একমাত্র কেশবই যেন। তাহার সহায়-সম্পদ। ওকে হারালে বনহুর আরও মুষড়ে পড়বে, ভাল লাগবে না কিছু।

জলপ্রপাতের স্বচ্ছ জল পান করে আরও দুটোদিন কেটে গেলো। ভেলাখানা এবার আপন ইচ্ছায় ছুটতে শুরু করেছে, অত্যন্ত দ্রুত এগুচ্ছে ভেলাটা।

বনহুর ভাবলো, হয় এবার জীবন রক্ষা হবে নয় মৃত্যু হবে। সমস্ত দিন ভেলাখানা একভাবে চলার পর বিকেলের দিকে একটা শব্দ তার কানে আসতে লাগলো, ঠিক জলোচ্ছাসের শব্দ বলে মনে হলো বনহুরের।

অনুমান মিথ্যা নয় সন্ধ্যার পূর্বেই তাদের ভেলাখানা একটা বড় নদীতে এসে পড়লো। নদী হলেও অত্যন্ত খরস্রোতা এবং তরঙ্গায়িত প্রশস্ত নদী। এততক্ষণ বনহুর এই নদীর তীব্রগর্জন শুনতে পাচ্ছিলো। বনহুর চিন্তাগ্রস্ত হলো, বিশেষ করে কেশব অত্যন্ত দুর্বল, ক্ষীণ হয়ে পড়েছিলো। বড় নদীতে ভেলাখানা একখন্ড কাষ্ঠ টুকরার মত ঢেউয়ের বুকে দুলে দুলে এগুচ্ছিলো।

কেশব বললো একবার–আর যে পারছি নে বাবু?

বনহুর কেশবের বুকে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো–এখন আমাদের ভেলা বড় নদীতে এসে পড়েছে। আর কিছু সময় ধৈর্য ধরো কেশব, হয়তো কোনো ষ্টিমার বা জাহাজের নজরে পড়ে যেতে পারি।

কেশব শুকনো ঠোঁট দু’খানা জিভ দিয়ে চাটতে লাগলো। সূর্যের চাপ অত্যন্ত বেড়ে গেছে, কালো হয়ে উঠেছে কেশবের মুখ। বনহুরের সুন্দর মুখমন্ডল নিষ্প্রভ মলিন, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি চুলগুলো এলোমেলো। মর্মান্তিক অবস্থা বনহুর আর কেশবের।

বনহুর আর কেশব যখন মৃত্যুর জন্য তৈরি হয়ে নিচ্ছে, ঠিক সেই মুহূর্তে একটা ধুম্ররাশি নজরে পড়লো বনহুরের, দূরে অনেক দূর ক্ষীণ রেখার মত। কিছুক্ষণ পরেই কানে একটা শব্দ এলো, ঠিক জাহাজের ইঞ্জিনের শব্দ বলেই মনে হলো তার।

আশায়-আনন্দে বনহুরের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। কেশবকে ডেকে বললো বনহুর–ভাই কেশব, কোনো জাহাজ এদিকে আসছে বলে মনে হচ্ছে। হয়তো আমরা এবার বাঁচতে পারি।

বনহুরের কথা সত্য নয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে স্পষ্ট দেখতে পায় একটি জাহাজ দ্রুত এগিয়ে আসছে এই পথে।

মুহূর্ত বিলম্ব না করে বনহুর নিজের দেহ থেকে জামাটা খুলে নিয়ে নাড়তে লাগলো।

জাহাজখানার গতি ক্রমান্বয়ে মন্থর হয়ে আসছে বলে মনে হচ্ছে। তাহলে দেখতে পেয়েছে ওরা তাদের ভেলাখানাকে।

কিছু সময় জাহাজখানা তাদের ভেলার অতি নিকটে এসে পড়লো। বনহুর লক্ষ্য করলো, জাহাজ থেকে বোট নামানো হচ্ছে।

এবার বনহুর কেশবকে তুলে বসিয়ে দেবার চেষ্টা করে বললো–আমাদের উদ্ধারের জন্য বোট আসছে। কেশব, তুমি নিজকে একটু শক্ত করে নাও।

কেশব ধুকছিলো, অতিকষ্টে উঠে বসলো ভেলার বুকে। বনহুর ওকে ধরে রইলো মজবুত করে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই বোটখানা নিয়ে দুটি লোক এগিয়ে এলো বনহুর আর কেশবের ভেলার নিকটে।

বনহুর দেখলো এরা সম্পূর্ণ বাঙালি। ভেলার নিকটে পৌঁছে শুদ্ধ বাংলায় বললো–তোমরা কে? তোমাদের এমন অবস্থা কেন?

নিজের পরিচয় দেওয়া বনহুরের পক্ষে কোনোদিনই সম্ভব হয়না-বিশেষ করে কোনো কোনো ক্ষেত্রে। আজও বনহুর মিথ্যা বলতে বাধ্য হলো, বললো–জাহাজডুবি হয়ে আজ আমাদের এ অবস্থা।

লোক দুটির চোখেমুখে সহানুভূতির ছাপ ফুটে উঠলো, তুলে নিলো ওরা বনহুর আর কেশবকে তাদের বোটে।

জাহাজে পৌঁছে বনহুর বুঝতে পারলো, এরা বাংলাদেশের লোক। কথাবার্তায় আরও জানতে পারলো সে–এ জাহাজটির আরোহিগণ পর্যটক। দেশ হতে দেশান্তরে ঘুরে বেড়ানোই এদের কাজ। নতুন নতুন দেশ, নতুন নতুন জায়গা, এবং অদ্ভুত জিনিস আবিষ্কার করাই হলো এ জাহাজের সকলের উদ্দেশ্য।

জাহাজের ক্যাপ্টেন খাস বাঙালি, বয়স ষাটের অধিক হবে। সুদীর্ঘ বলিষ্ঠ চেহারা, চোখেমুখে আভিজাত্যের ছাপ সুস্পষ্ট। বড় অমায়িক ভদ্রলোক, নাম আর সাঈদ চৌধুরী। প্রচুর অর্থের মালিক। আবু সাঈদ, বিশেষ করে বাঙালিদের মধ্যে এতো-বড় ধনবান অর্থশালী বিত্তলোক কমই আছে। বয়স ষাট হলেও দেহ এবং মন সজীব এবং বলিষ্ঠ। আবু সাঈদের ছোটবেলা হতেই নেশা– বিশেষ বিশেষ জিনিস আবিষ্কার করা। নতুনত্বের নেশায় তিনি সর্বক্ষণ ব্যস্ত। সংসারে তার একমাত্র কন্যা নীহার ছাড়া আর তেমন কোনো আকর্ষণ নেই। প্রচুর কর্মচারী দ্বারা কোম্পানী পরিচালিত হয়ে থাকে, কাজেই কোম্পানী চালনার জন্য তাকে কোনোরকম চিন্তা করতে হয় না। তিনি বছরের প্রায় তিন ভাগ সময় নিজের জাহাজ ‘পর্যটন’ নিয়ে সাগরবক্ষে পাড়ি জমিয়ে থাকেন। তার জন্মস্থান বাংলাদেশের কোন এক অখ্যাত পল্লী, কিন্তু তাঁর সমস্ত কায়কারবার এবং কোম্পানী চিটাগাং শহরে অবস্থিত। এ শহরেই এখন তিনি বাস করেন, বিরাট বাড়ি-গাড়ি-ঐশ্বর্য–সব আছে।

অবশ্য জাহাজ ‘পর্যটনে তার সব কিছু–একটা গোটা সংসারের যাবতীয় আছে। পাশাপাশি দুটো ক্যাবিনে পিতা-পুত্রী থাকেন।

জাহাজটি অত্যন্ত বড় না হলেও খুব সুন্দর এবং আধুনিক ধরণের কয়েকটি ক্যাবিন বেড় রুম আকারে ব্যবহৃত হয়ে থাকে ডাইনিং কিচেন এবং বিভিন্ন প্রয়োজনীয় আরও ক্যাবিন আছে।

কুলী-মজুর ও খালাসীদের জন্য জাহাজের নিচের তলায় কয়েকটি ক্যাবিন–এ ক্যাবিনগুলোতে থাকে কর্মরত খালাসিগণ। নিচের তলাতেই একটি ক্যাবিনে আশ্রয় পেলো দস্যু বনহুর আর কেশব।

ক্যাপ্টেন আবু সাঈদের ক্যাবিনের পাশেই একটি বড় ক্যাবিন–সেই ক্যাবিনে থাকে আবু সাঈদের সঙ্গী-সাথী পর্যটক দল। দেশ হতে দেশান্তরে ঘুরে বেড়ানোই যাদের নেশা, সংসারের বন্ধন আবদ্ধ রাখতে পারে না তাদের কোনোদিনই। আবু সাঈদের বন্ধু-বান্ধবের দল ঠিক কতকটা তার মতই, তাই সখ করে অনেক সময় তারাও সঙ্গী হত মিঃ সাঈদের সঙ্গে।

এবার আবু সাঈদের সঙ্গে যারা এসেছেন সবাই প্রায় বয়স্ক ভদ্রলোক, কেবল নাসের ছিলো অল্পবয়সী যুবক। নাসের আবু সাঈদের বন্ধু হাশেম চৌধুরীর ছেলে। উচ্চশিক্ষিত আধুনিক মডার্ণ ছেলে। এ ছেলেটিকে আবু সাঈদ বড় পছন্দ করেন এবং ভবিষ্যতে কন্যা মিস নীহারকে সমর্পণ করবেন ওর হাতে–এই উদ্দেশ্যেই তিনি নাসেরকে পর্যটক হিসাবে সব সময় সঙ্গে রাখেন।

মিস নীহার কিন্তু নাসেরকে তেমন সমীহ করতো না, বা ভাল চোখে দেখতো না। কারণ নাসের ছিলো অত্যন্ত অসৎ চরিত্র যুবক। প্রায়ই সে নীহারকে তার প্রেমবাসনা জানাতো।

নীহার উপেক্ষা করতো তাকে, কিন্তু পিতার জন্যই কঠিন কিছু বলতে পারতো না।

নাসের শিক্ষিত ছেলে হলেও মন তার ছিলো কুৎসিত লালসাপূর্ণ এবং লোভী। তেমনি সুচতুর ছিলো সে। ভিতরের রূপটা তার কেউ সহজে ধরতে পারতো না, এমন কি জনাব আবু সাঈদ পর্যন্ত নয়। বিড়াল তপস্বীর মত নিজেকে সাধু সাজিয়ে কার্যসিদ্ধির উপায় খুঁজতো। আবু সাঈদ নাসেরের ভিতরের রূপ সম্বন্ধে না জানলেও নীহারের কাছে কিন্তু অজানা ছিলো না।

শুধু তাই নয়, নাসেরের মনে আরও একটা দূরভিসন্ধি লুকিয়ে ছিলো যা কেউ জানে না বা জানতে পারেনি। এমন কি, নাসেরের কয়েকজন দুষ্ট বন্ধুবর এই জাহাজে ছিলো–তারাও জানতো না তার মনের কথা।

বনহুর আর কেশবকে যখন জাহাজে উঠিয়ে আনা হলো তখন জাহাজের প্রায় সকলেই এসে ডেকের উপরে ভিড় জমিয়েছিলো। জনাব আবু সাঈদের সঙ্গে তার কন্যা নীহারও এসে দাঁড়ালো। তার চোখেও বিস্ময়, পিতার মতই জানার বাসনা–কে এরা? কি এদের পরিচয়? আর এসেছেই বা কোথা হতে?

আবু সাঈদ স্বয়ং জিজ্ঞাসা করলেন–কোথাকার লোক এরা জানতে পারি কি?

 যারা বনহুর আর কেশবকে বোটে তুলে নিয়ে এসেছিলো তাদের একজন জবাব দিলো, বললো–স্যার, জাহাজডুবি হয়ে এদের এ অবস্থা হয়েছে। কোথাকার লোক এখনও আমরা জানতে পারিনি।

বনহুর একবার ডেকের উপরে সকলের মুখে দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে তাকালো আবু সাঈদের মুখে, বললো–আমি নাবিক, জাহাজডুবি হয়ে আমার এ অবস্থা। আমার সঙ্গীও আমাদের জাহাজেরই একজন কর্মচারী।

সংক্ষেপে বনহুর নিজের বক্তব্য শেষ করে নিলো।

আবু সাঈদের চোখমুখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে, তাদের জাহাজে একজন ভাল নাবিকের নিতান্ত প্রয়োজন ছিলো। নিজেদের লোকজনদের বলে দিলেন তিনি এদের প্রতি ভাল ব্যবস্থা নিতে।

পিতার পাশে দাঁড়িয়ে নীহার এদের অবাক হয়ে দেখছিলো। করুণায় মন তার ভরে উঠেছিলো, জানি কত অসহায় এরা! আসলেই নীহার ছোটবেলা হতেই ছিলো অত্যন্ত মিষ্ট-স্বভাব মেয়ে, মায়া-মমতায় ভরা ছিলো ওর হৃদয়। ব্যথিতের ব্যথা তাকে চঞ্চল করে তুলতো।

আজ বনহুর আর কেশবের অবস্থা তার মনে আঘাত করলো। পিতা তার অনুচরদের আদেশ করে চলে গেলেও নীহার গেলো না, সে দাঁড়িয়ে রইলো তাদের পাশে।

অল্পক্ষণ পরেই একজন গরম দুধ নিয়ে এলো।

নীহার তার হাত থেকে দুধের গেলাস নিয়ে নিজেই এগিয়ে ধরলো বনহুরের মুখের কাছে।

বনহুর কৃতজ্ঞতাপূর্ণ দৃষ্টি নিয়ে তাকালো, একটু হাসবার চেষ্টা করে বললো–মেম সাহেব, আমার হাতে দিন। সত্যি আপনার কত দয়া!

বনহুরের গম্ভীর শান্ত মিষ্ট কণ্ঠস্বরে নীহার মুগ্ধ হলো। দুধের গেলাসটা বনহুরের হাতে দিয়ে, আর এক গেলাস দুধ নিয়ে কেশবের মুখে তুলে ধরলো।

কেশব অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়েছিলো, কাজেই নিজ হাতে খাবার মত সে সমর্থ ছিলো না। নীহারের হস্তে কেশব দুধ পান করতে লাগলো।

বনহুরের দুধ পান তখন হয়ে গিয়েছিলো, নিস্পলক নয়নে সে তাকিয়ে দেখছিলো নীহারের। অপূর্ব মমতায় ভরা মুখখানা। বনহুর এমন মেয়ে জীবনে কমই দেখেছে। বিশেষ করে ধনবান দুহিতাগণ এমন হয় না।

কেশবকে যখন নীহার নিজ হস্তে দুধ পান করিয়ে দিচ্ছিলো ঠিক তখন নাসের এসে দাঁড়ালো। সেখানে। ক্রুদ্ধ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাকালো সে একবার বনহুর আর কেশবের দিকে। তারপর ব্যঙ্গভরা কণ্ঠে বললো–নীহার, তোমার বিবেক বলে কিছু নেই দেখছি। কোথাকার কি ছোটলোক তাদের সেবায় এগিয়ে গেছো তুমি?

কেশবের দুধ পান হয়ে গিয়েছিলো, খালি গেলাস হাতে উঠে দাঁড়ালো নীহার, চোখে রাগত দৃষ্টি নিয়ে স্থির কণ্ঠে বললো সেনাসের সাহেব, আপনাকে আমার সম্বন্ধে এতো বেশি ভাবতে দেখে আমি দুঃখিত। আমার খুশিমত কাজ আমি করবো, এতে আপনি কোনো কথা বলতে আসবেন না।

নীহার, তোমার সম্বন্ধে আমি কেন এত বেশি ভাবি তা তুমি নিশ্চয়ই জানোনা, এখানে সেকথা বুঝিয়ে বলতে চাই না। কিন্তু এসব তোমার সাজে না মনে রেখো।

বনহুর মুহূর্তে বুঝে নিলো ব্যাপারখানা, নীরবে তাকিয়ে দেখে নিলো নাসের সাহেবকে একবার।

নীহার চলে গেলো।

অন্যান্য কর্মচারী বনহুর আর কেশবকে তাদের জন্য নির্ধারিত ক্যাবিনে নিয়ে বেডে শুইয়ে দিলো। জাহাজের ডাক্তার তাদের চিকিৎসায় নিয়োজিত হলেন।

*

কয়েক দিনেই কেশব আর বনহুর সুস্থ হয়ে উঠলো। তবু ডাক্তারের আদেশ অনুসারে আরও কয়েকদিন তাদের বিশ্রাম করতে হলো।

রোজই একবার করে বনহুর আর কেশবের ক্যাবিনে এসে খোঁজ নিতো নীহার। বনহুরের বেডের পাশে এসে দাঁড়াতো সে, জিজ্ঞাসা করতো তারা এখন কেমন আছে। ঠিকভাবে ঔষধ পথ্যাদি খাচ্ছে কিনা ওরা তাও জেনে নিতে ভুলতো না।

নীহার যখন উদ্বিগ্নভাবে তাদের ভালমন্দ নিয়ে প্রশ্নবাদ করতো, তখন বনহুর হেসে বলতো মেম সাহেব, আপনি বড় ভাল মেয়ে। আমরা গরিব বেচারী জেনেও আপনার দয়ার অন্ত নেই।

নীহার ওর কথা শুনে বলতো–আমার কাছে ছোট-বড় কোনো ভেদাভেদ নেই। মানুষ যে মানুষই এর চেয়ে বেশি আমি জানতে চাই না।

বনহুর স্তব্ধ হয়ে শোনে, নীহারের কথাগুলো তার অন্তর স্পর্শ করে। বলে বনহুর–মেম সাহেব, আপনি ধনবানের কন্যা হয়ে এমন, সত্যি এই দুনিয়ার সব মানুষের মন যদি আপনার মত হতো।

এমন সময় এসে দাঁড়ালো নাসের, গম্ভীর কণ্ঠে বললো–নীহার, এত বাড়াবাড়ি তোমার শোভা পায় না। সামান্য কুলি-মজুরদের ক্যাবিনে এসে একটা নিকৃষ্ট নাবিকের সঙ্গে তুমি এভাবে কথাবার্তা বলছো! তোমার আত্নসম্মান বোধ থাকা উচিৎ।

মুহূর্তে নীহারের মুখ কালো হয়ে উঠলো। অধর দংশন করে বললো–আমি প্রথম দিনই বলেছি, আমার সম্বন্ধে আপনি কোনোরকম উক্তি উচ্চারণ করবেন না!

নীহার, সব তোমার আব্বাকে জানিয়ে দেবো।

 তাতে আমার কোনো ক্ষতি হবে না। আব্বা জানেন, তার মেয়ে কোনোদিন অন্যায় কিছু করে না। আপনি যেতে পারেন নাসের সাহেব।

রাগত দৃষ্টি নিয়ে একবার বনহুর আর কেশবের দিকে তাকিয়ে বেরিয়ে যায় নাসের।

তীব্র চোখে তাকিয়ে থাকে নীহার নাসেরের চলে যাওয়া পথের দিকে।

 বনহুর বলে–মেম সাহেব, কেন আপনি এখানে আসেন? উনি এতে মোটেই খুশি নন।

নীহার এবার সোজা হয়ে দাঁড়ালো, তার চোখেমুখে এক কঠিন দীপ্তভাব ফুটে উঠেছে, বললো–উনার খুশিতে আমার কিছু যায়-আসেনা বুঝলে? আমি যখন ইচ্ছা আসবো তাতে তার কি? কথাটা বলে দ্রুত বেরিয়ে যায় নীহার।

বনহুর স্তব্ধ হয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকে, তারপর বলে–কেশব, আমি জানতাম বড়লোকদের হৃদয় বলে কিছু নেই…একটু থেমে বললো পুনরায়–দেখলাম আজ মানুষের এক নতুন রূপ।

কেশব এখন অনেকটা সুস্থ, বনহুরের কথাগুলো শুনে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো মুখের দিকে।

*

আবু সাঈদের পর্যটন জাহাজে নাবিক বেশে শুরু হলো বনহুরের কাজ।

ক্যাপ্টেন আবু সাঈদ বনহুরের কাজ দেখে মুগ্ধ হলেন। আরও মুগ্ধ হলেন তার আচরণে। এমন একজন সুদক্ষ নাবিককে তার জাহাজে পেয়ে অত্যন্ত খুশি হলেন তিনি।

অবশ্য বনহুরের নাবিকের কাজ পূর্ব হতেই জানা ছিলো। কারণ ইতিপূর্বে তাকে আরও অনেক জাহাজে থাকতে হয়েছে। তাছাড়া বনহুরের কান্দাই শহরে নিজস্ব একটি বড় এবং দুটি ছোট জাহাজ আছে। এসব জাহাজে সে অনেক সময় নিজে নাবিকের কাজ করেছে, কাজেই কোনো। অসুবিধা হলো না।

বনহুরের সহকারী হিসাবে কেশব আশ্রয় পেলো এই পর্যটনে।

বনহুরকে সর্বক্ষণ জাহাজে ইঞ্জিনের কাছে ব্যস্ত থাকতে হতো। তেল, কালি আর কয়লার ধুয়োতে তার নাবিক ড্রেস কালিময় হয়ে উঠতো, সুন্দর দেহের স্থানে স্থানেও লাগতো কালির প্রলেপ।

জাহাজের নাবিক ছিলো না তা নয় কিন্তু তবু বড় জাহাজ বেশি নাবিকের প্রয়োজন আবু সাঈদ তাই বনহুরকে তার জাহাজে বিনা দ্বিধায় নাবিক হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন।

বনহুর যখন ইঞ্জিনের কাজে ব্যস্ত থাকতো তখন আবু সাঈদ স্বয়ং এসে কাজ দেখতেন, তন্ময় হতেন বনহুরের অপূর্ব কর্মদক্ষতা দেখে!

এতো কাজ থাকতে নাবিকের কাজ বেছে নেওয়ার মধ্যে বনহুরের অভিসন্ধি যে ছিলো না, তা নয়। বনহুর আর কেশব তখন ভেলায় বসে জাহাজটিকে দেখেছিলো, কেশব লক্ষ্য না করলেও লক্ষ্য করেছিলো। বনহুর–জাহাজের গায়ে বড় বড় অক্ষরে লেখা পর্যটন শব্দটা। মুহূর্তে সে বুঝে নিয়েছিলো, এ জাহাজটি সাধারণ প্যাসেঞ্জার জাহাজ নয়। নিশ্চয়ই ভ্রমণকারী জাহাজ হবে। নূরীর-সন্ধান নিতে হলে এমনি একটি যানেরই প্রয়োজন। কাজেই আবু সাঈদ যখন তার সম্মুখে এসে দাঁড়িয়েছিলেন তখন প্রথম নজরেই বনহুর তার পরিচয় জানতে পেরেছিলো, বুঝতে পেরেছিলো এই ব্যক্তিই অধিনায়ক।

বনহুর নিজকে এ জাহাজে স্থায়ী করে নেওয়ার জন্যই নাবিক হিসাবে পরিচয় দিয়েছিলো এবং তার অভিসন্ধি সফলও হয়েছিলো। আবু সাঈদ তাকে তার জাহাজে নাবিক পদে নির্বাচিত করে নিয়েছিলেন।

বনহুর নাবিকের কাজে ব্যস্ত থাকলেও গোপনে জাহাজের সমস্ত কিছু খবরাখবর রাখতে লাগলো। সে সাবধানে সমস্ত জাহাজ অনুসন্ধান করে ফিরলো, কারণ সেদিন নুরী সেই পর্বতমালা থেকে অন্তর্ধান হয়েছিলো সেইদিন রাতে বৃক্ষশাখায় বসে সে শুনতে পেয়েছিলো জাহাজের। ইঞ্জিনের শব্দ। তাই এ জাহাজেও বনহুর নূরীকে খুঁজে ফিরেছিলো তন্ন তন্ন করে।

বনহুর আর কেশব এখন সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠলেও নীহার প্রতিদিন তাদের খোঁজখবর নিতো। কেমন আছে ওরা–একদিন না জানলে সে যেন মনে শান্তি পেতো না। ওদের ভালমন্দ দেখাশোনার দায়িত্ব যেন তার।

কোমল-প্রাণ নীহারের অন্তরের স্নিগ্ধ-সুন্দর অভিব্যক্তিকে উপেক্ষা করতে পারে না বনহুর। ওর সাক্ষাৎ কামনায় মন যেন উনুখ থাকতো বনহুরের।

বনহুর যখন ইঞ্জিনের কাজে লিপ্ত থাকতো, অদূরে এসে দাঁড়াতো নীহার, বনহুরের অজ্ঞাতে নিস্পলক নয়নে তাকিয়ে থাকতো ওর দিকে। নীহার নিজের অজান্তে কখন যে নাবিক বনহুরের সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিলো, সে বুঝতেই পারেনি।

আজ প্রায়-সপ্তাহের বেশি হয়ে এলো বনহুর আর কেশব এ জাহাজে আশ্রয় পেয়েছে। ইতিমধ্যে পর্যটন এখনও কোথাও নোঙ্গর করেনি। সাগরবক্ষে ধরে মেরুন্দা বন্দর অভিমুখে তাদের জাহাজ এখন চলেছে। আর দুদিন পর তাদের পর্যটন মেঘমুক্ত বন্দরে পৌঁছতে সক্ষম হবে।

মেঘমুক্ত সচ্ছ আকাশ।

আবহাওয়া সংবাদে জানানো হয়েছে–উপস্থিত প্রাকৃতিক কোনো গোলযোগের সম্ভাবনা নেই।

আবু সাঈদের মনে খুশির উৎস। প্রাকৃতিক কোনো দুর্যোগের লক্ষণ না থাকলে তার মন আনন্দে ভরপুর থাকতো। আবু সাঈদকে জীবনে বহুবার সামুদ্রিক ঝড়ের কবলে পড়তে হয়েছে। তাঁকে বহু কষ্ট স্বীকার করতে হয়েছে পর্যটক হিসাবে। প্রাকৃতিক আবহাওয়া লক্ষণ সন্তুষ্টজনক। থাকলে তার খুশির অন্ত থাকতো না।

 পর্যটন মেরুলা বন্দরে একদিন অপক্ষো করবে বলে ক্যাপ্টেন আবু সাঈদ জানিয়েছেন।

দীর্ঘ কয়েক সপ্তাহ পর্যটন’-এর আরোহিগণ জলপথে ভেসে চলেছে। মৃত্তিকার পরশ পাবার আশায় সবাই আনন্দে আপ্লুত হয়ে উঠেছে। আবু সাঈদ স্বয়ং বলেছেন, এই বন্দরে তারা সম্পূর্ণ একটি দিন অবস্থান করবেন।

*

বনহুর নানা কাজে ব্যস্ত থাকলেও সব সময় তার মনে নূরীর চিন্তা উদয় হচ্ছিলো। কিভাবে নূরীর সন্ধান সে পেতে পারে–কোথায় গেলে নূরীর দেখা পাবে কে জানে। ভাগ্যি এ জাহাজের সান্নিধ্যে আসতে পেরেছিলো, নাহলে তাদের জীবন রক্ষাই অসম্ভব হয়ে পড়তো। এখন জীবন। যখন রক্ষা পেয়েছে তখন যেমন করে হোক নূরীকে খুঁজে বের করবেই সে। কিন্তু কোন্ দিকে, কোন্ পথে–কোথায় গেছে নূরী…

বনহুরের চিন্তাজাল বাধা পড়ে, একটা শব্দে ফিরে তাকায় সে, অস্ফুট কণ্ঠে বলে–আপনি!

ইঞ্জিন-কক্ষে বনহুর মেশিনের কাজে ব্যস্ত ছিলো; দেখলো তার অদূরে দাঁড়িয়ে আছে নীহার। বনহুর ফিরে তাকাতেই নীহার বললো–সব সময় তুমি কাজ করো আলম?

বনহুর জাহাজে নিজের নাম আলম বলেছিলো। ইতিপূর্বে আরও কতবার সে এ নামেই নিজকে পরিচিত করেছিলো, এবারও সে আলম নামটাই বেছে নিয়েছিলো নিজের জন্য। নীহারের কথায় সোজা হয়ে দাঁড়ালো বনহুর, একটু হেসে বললো–মালিকের কাজে ফাঁকি দেওয়া আমার নীতি নয় মেম সাহেব।

না না, আমি তা বলছি না, বলছি তোমার কি বিশ্রাম নেই!

বিশ্রাম! গরিব বেচারীদের আবার বিশ্রাম। কাজ করা আমাদের অভ্যাস, কাজেই কোনো কষ্ট হয় না।

নীহার কোনো জবাব দেয় না, ধীর মন্থর গতিতে চলে যায় সেখান থেকে।

বনহুর আপন মনেই হাসে।

আর একদিন বনহুর ইঞ্জিনের কাজ শেষ করে ফিরে যাচ্ছিলো নিজের ক্যাবিনে সমস্ত দেহে তেলকালি মাখানো। একটু অন্যমনস্কভাবেই যাচ্ছিলো সে, হঠাৎ পাশে সন্ধ্যার ঝাপসা আলোতে দেখলো, কে যেন দাঁড়িয়ে আছে। বনহুর থমকে দাঁড়িয়ে ফিরে চাইতেই দুটি আখির সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় হলো তার। বনহুর বললো–মেম সাহেব আপনি!

দৃষ্টি নত করে নিয়ে বললো নীহার–এতোক্ষণে তোমার কাজ শেষ হলো বুঝি!

হাঁ মেম সাহেব।

এমন সময় নাসের এসে দাঁড়ালো সেখানে, চোখেমুখে তার কঠিন ভাব ফুটে উঠেছে। ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বললো নাসের নীহার, পুনরায় তুমি ঐ নিকৃষ্ট নাবিকের সঙ্গে কথা বলছো? এতোটুকু লজ্জা বোধ নেই তোমার?

নীহারও ফোঁস করে উঠলো, তীব্রকণ্ঠে বললো লজ্জা বোধ থাকলে আপনি আর আসতেন আমাকে সাবধান করে দিতে। কারণ আমি আপনাকে অনেক আগেই সাবধান করে দিয়েছি।

কথাটা বলে হন হন করে চলে গেলো নীহার সেখান থেকে।

বনহুরও চলে গেলো তার নিজ ক্যাবিনের দিকে।

মাঝপথে নাসের ক্রুদ্ধ পশুর ন্যায় দাঁড়িয়ে গর্জন করতে লাগলো। যত রাগ গিয়ে গড়লো বনহুরের উপর। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর অন্ধকারে এগিয়ে চললো।

বনহুর কিন্তু চলে গেলেও আসলে সে একটা থামের আড়ালে লুকিয়ে পড়েছিলো। নাসের। অন্ধকারে এগুতেই বনহুর তাকে গোপনে অনুসরণ করলো। আলগোছে সন্তর্পণে এগুতে লাগলো।

নাসের জাহাজের পিছন দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বনহুর বেশ দূরত্ব রেখে ক্যাবিনের আড়ালে আত্মগোপন করে তাকে অনুসরণ করেছে। নাসেরের চলার প্রতি এবং ভাবসাব লক্ষ্য করে বনহুরের মনে সন্দেহের দোলা জেগেছে। নিশ্চয়ই এ যুবক নীহার বা তার পিতার হিতাকাঙ্খী নয়।

কিছুদূর এগুতেই বনহুর দেখতে পেলো, ওদিকের একটা ক্যাবিনে প্রবেশ করলো নাসের। সঙ্গে সঙ্গে দরজা বন্ধ হয়ে গেলো ক্যাবিনার।

বনহুর এবার দ্রুতপদে ক্যাবিনের পিছনে যে শার্শী ছিলো তার পাশে এসে দাঁড়ালো। শুনতে পেলো নাসেরের গলার আওয়াজ, বলছে সে-শম্ভু, ঐ নাবিক বেটাকে প্রথমে সরাতে হবে।

একটা হেড়ে কর্কশ কণ্ঠস্বরে শোনা গেলো–কার কথা কইছেন স্যার? ঐ নতুন নাবিকটার কথা?

হা, শম্ভু ঐ বেটা জাহাজে আসার পর আমি লক্ষ্য করেছি নীহার যেন কেমন আনমনা হয়ে গেছে। বেটার সৌন্দর্য ওর হৃদয়ও জয় করে নিয়েছে মনে হচ্ছে।

ঠিক বলেছেন স্যার। ছোটলোক নাবিকের চেহারা এমন হয়–এর পূর্বে দেখিনি।

দেখোনি, কিন্তু জানো আমার সব অভিসন্ধি এবার ওর জন্য বিনষ্ট হবে? নীহারকে আমি চাই আর তার সঙ্গে চাই নীহারের পিতার বিপুল ঐশ্বর্য।

স্যার, আপনি কোনো চিন্তা করবেন না, আপনি যখন হুকুম করবেন তখনই আমি নীহারকে আপনার মুঠায় এনে দিতে পারি।

কিন্তু আমি জোর করে তার ভালবাসা আদায় করতে চাই না শম্ভু। কৌশলে তার ভালবাসা। আদায় করে তার সমস্ত সম্পত্তির ন্যায্য অধিকারী হতে চাই।

এবার শোনা যায় আর একটি কণ্ঠস্বর–স্যার, আপনার হুকুমের অপেক্ষায় আছি আমরা। আপনার সামান্য ইংগিতে সমস্ত জাহাজে আমরা আগুন ধরিয়ে দিতে পারি। বলুন ক্যাপ্টেনকে কিভাবে হত্যা করতে হবে?

থামো। এখনও সে সময় আসেনি। তার পূর্বে ঐ নাবিক বেটাকে সরাতে হবে…শম্ভু?

বলুন স্যার?

আমার কথা শুনেছো?

 হাঁ স্যার, সব শুনেছি।

বনহুর এবার দ্রুত সরে এলো ক্যাবিনের পিছন থেকে। এখন তার চোখের সম্মুখে সমস্ত কিছু পরিষ্কার হয়ে এলো, কি সাংঘাতিক শয়তান লোক নাসের বুঝতে পারলো সে।

ক্যাবিনে এসে বনহুর দেখলো কেশব তার বিলম্ব দেখে বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েছে। বনহুর ক্যাবিনে প্রবেশ করতেই বললো কেশব–বাবু, এতোক্ষণ কোথায় ছিলেন?

বিশেষ একটু কাজে আটকা পড়ে গিয়েছিলাম। কথাটা বলে তোয়ালে আর সাবান নিয়ে বাথরুমে প্রবেশ করে বনহুর। পাইপের ঠান্ডা পানিতে বেশ করে গোসল করতে লাগলো সে। যতক্ষণ দেহের তেল কালি সাবান লাগিয়ে পরিষ্কার করছিলো ততক্ষণ তার মস্তিস্কে একটা গভীর চিন্তার আলোড়ন সৃষ্টি করে চলেছিলো। নাসেরকে যতখানি শয়তান মনে করেছিলো, তার চেয়ে শত সহস্র গুণ বেশি শয়তান সে। এ জাহাজে ক্যাপ্টেন আবু সাঈদ মোটেই নিরাপদ নন, নিরাপদ নয় তাঁর কন্যা নীহার। এমন একটা দুষ্ট বিষ-কীটকে তারা তাদের জাহাজে সানন্দে গ্রহণ করেছে। যে কীট তাদের দংশন আশায় প্রহর গুণছে। বনহুর যতই ভাবছে ততই বেশি উত্তেজিত হয়ে উঠছে। নাসেরকে সে এর উপযুক্ত শাস্তি দেবে।

ফিরে আসে বনহুর বাথরুম থেকে।

এমন সময় তাদের খাবার টেবিলে ডাক পড়ে।

কেশব আর বনহুর বেরিয়ে যায়, নিচের একটা বড় ক্যাবিনে জাহাজের কুলি খালাসী আর। নাবিকদের খেতে দেওয়া হয়। টেবিলে এসে বসে বনহুর আর কেশব।

টেবিলে খাবার দেওয়ার পূর্বে হঠাৎ বনহুরের দৃষ্টি চলে যায় অদূরে ক্যাবিনের দরজায় কে একজন লোক বাবুর্চির কানে কিছু বলে দ্রুত সরে গেলো।

বাবুর্চি একটু পরে খাবার হস্তে ক্যাবিনে প্রবেশ করলো! বনহুর বাবুর্চির মুখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। কেমন যেন ভীত ভাব লক্ষ্য করলো সে তার মুখমন্ডলে। হাতের একখানা প্লেট নামিয়ে রাখলো বাবুর্চি বনহুরের সম্মুখে।

বনহুর প্লেটখানা নিজের দিকে টেনে নিতেই ভাত আর মাংসগুলো ক্যাবিনের মেঝে ঢেলে পড়ে গেলো।

বাধ্য হয়ে বাবুর্চি তাকে অন্য আর এক প্লেট খাবার দিলো। বনহুর তৃপ্তি সহকারে খেতে শুরু করলো। কিন্তু খেতে খেতে বনহুর লক্ষ্য করলো–বাবুর্চির মুখ বিবর্ণ ফ্যাকাশে হয়ে উঠেছে।

সেই রাতেই জাহাজ থেকে উধাও হলো বৃদ্ধ বাবুর্চি।

সমস্ত জাহাজের একটা আতঙ্ক সৃষ্টি হলো, কোথায় গেলো, কি হলো সে। বিশেষ করে আবু সাঈদ চিন্তিত হয়ে পড়লেন। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও আর বৃদ্ধ বাবুর্চিকে পাওয়া গেলো না।

*

পাহাড়িয়া ঝরণা এবং জলপ্রপাতের বিভিন্ন দৃশ্য গ্রহণের পর পরিচালক আসলাম আলী তাঁর ইউনিটসহ ফিরে চলেছেন বোম্বের দিকে। পথে আরও কতকগুলো বন-জঙ্গলের দৃশ্যও গ্রহণ করেছেন তাঁরা। ছবির আউট ডোের সুটিং প্রায় শেষ হয়ে গেছে। বাকি অংশের কাজ হবে ষ্টুডিও ফ্লোরে।

প্রত্যাবর্তন কালে পরিচালক আসলাম আলী কয়েকদিনের জন্য মেরুন্দা বন্দরে তাদের জাহাজ নোঙ্গর করার জন্য আদেশ দিয়েছিলেন। বেশ কিছুদিন হলো তারা বোম্বে ত্যাগ করে দূর-দূরান্তে পাড়ি জমিয়েছিলেন। ইউনিট অত্যন্ত পরিশ্রান্ত–কাজেই তাদের বিশ্রামের প্রয়োজন।

আসলাম আলীর যাত্রা এবার অত্যন্ত শুভ। পাহাড়িয়া ঝরণা এবং জলপ্রপাতের যে দৃশ্যগুলো তিনি এবার গ্রহণ করতে পেরেছেন তা অত্যন্ত সুন্দর ও অপূর্ব হয়েছে। শুধু দৃশ্য গ্রহণেই তিনি জয়ী হননি, লাভ করেছেন অপ্সরী সমতুল্যা বনকুমারীকে।

আসলাম আলীর হৃদয়ে অদ্ভুত বাসনা, কোনক্রমে ঐ বনকুমারীকে যদি বশে আনতে পারে তাহলে তাঁর ছবির জন্য আর নায়িকার অন্বেষণে হা হুতাশ করে মরতে হবে না। হাজারে এমনি একটি মেয়ে নজরে পড়ে কিনা সন্দেহ।

নূরীই হলো সেই বনকুমারী।

নূরীকে জাহাজে আনার পর থেকে চলেছে তাকে সাধ্য-সাধনা! কিসে সে খুশি হবে, কিসে তার মন সচ্ছ স্বাভাবিক হবে সব সময় সেই চেষ্টা চলেছে।

এ জাহাজে নূরীর সেবা-যত্নের ত্রুটি নেই। সুন্দর সুসজ্জিত একটি ক্যাবিনে নূরীকে রাখা হয়েছে। মূল্যবান পরিচ্ছদে তাকে সজ্জিত করা হয়েছে। নানাবিধ খাদ্যসম্ভারে তার সম্মুখস্থ টেবিল পরিপূর্ণ। ইউনিটের প্রতিটি লোক নূরীকে খুশি করার জন্য উন্মুখ রয়েছে। কিন্তু এতো করেও কেউ নূরীর মুখে হাসি ফোঁটাতে সক্ষম হয়নি।

স্বয়ং আসলাম আলী নিজেও নূরীর জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। সর্বক্ষণ নূরীর সুখ-সুবিধার জন্য ব্যাপৃত তিনি। নিজে এসে তাকে বলে বলে খাওয়ান সস্নেহ মিষ্ট কথায় সন্তুষ্ট করতে চেষ্টা করেন।

এতো করেও নূরীর চোখের অশ্রু শুষ্ক হয় না। এতো পেয়েও সে সন্তুষ্ট নয়। করুণ বিষ। মুখমন্ডল, ম্লান দুটি ডাগর আঁখি। স্তিমিত তার মুখের হাসি।

পরিচালক নূরীকে পেয়ে যেমন খুশি হয়েছেন, তেমনি হয়েছেন চিন্তিত। এতে করেও কিছুতেই নূরীকে বশে আনা সম্ভব হচ্ছে না তাদের।

অনেক সাধ্য-সাধনা করে যদিও নূরী সামান্য কিছু খাবার মুখে দিয়েছে কিন্তু আজও একটি কথাও সে বলেনি কারো সঙ্গে। এমনকি নিজের নামটাও ব্যক্ত করেনি সে।

এ জাহাজে নূরী যেন একটি আজব জীব।

নূরীকে জাহাজে নিয়ে আসার পর ইউনিটের সবাই তাকে বিস্ময়ভরা দৃষ্টি নিয়ে দেখেছিলো। নূরীর চেহারা স্বাভাবিক বাঙালি মেয়ের মত ছিলো না অদ্ভুত অপূর্ব চেহারা ছিলো তার। কতকটা ইরানী মেয়েদের মত দেখতে ছিলো সে। মাথার চুল ঘন লালচে এবং কোঁকড়ানো! তরবারীর মত বাঁকানো দুটি ভূযুগল। ডাগর ডাগর হরিণ চোখে মোহময় দৃষ্টি। ছিপছিপে লম্বা গড়ন, উন্নত নাসিকা, সরু ওষ্ঠদ্বয়।

নূরীকে দেখলে সহজে কেউ দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতে পারে না। ওকে যত দেখা যায়, ততই যেন আরও দেখতে ইচ্ছে করে। এহেন নূরী যে চিত্র পরিচালকদের নিকটে কত আখাঙ্ক্ষিত তা সহজেই অনুমেয়।

*

মেরুলা বন্দরে পরিচালক আসলাম আলীর জাহাজ ক’দিন হয় নোঙ্গর করে আছে। ছবির সমস্ত ইউনিট বন্দরে অবতরণ করে ঘুরে ফিরে দেখে নিচ্ছে বন্দরটাকে। কারণ এসব অঞ্চলে সচরাচর তারা আসে না এবং ভবিষ্যতে পুনরায় আসবে কিনা তারও ঠিক নেই।

মেরুলা বন্দর পাহাড়িয়া অঞ্চল।

উঁচুনীচু টিলার পাশ কেটে বয়ে চলেছে এই নদীটি। ঠিক সুন্দর একটা ছবির মত দেখতে মেরুন্দা। কালো কালো পাথুরিয়া টিলার উপরে সাদা ধরধবে ছোট ছোট বাংলো প্যাটার্ণের বাড়িগুলো দেখবার মত জিনিষ। কতকগুলো টিলার পাশ কেটে সচ্ছ ঝরণাধারা নেমে এসে মিশে গেছে সাগরবক্ষে।

সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত কালে এসব অঞ্চল অপূর্ব রূপ ধারণ করে। সচ্ছ জলরাশির বুকে ভোরের আলোকরশ্মি সৃষ্টি করে এক মহাসমারোহ। তেমনি বেলাশেষের সূর্যের আলো সোনালী বন্যায় ছেয়ে দেয় সব কিছু।

আসলাম আলীর ইউনিট মুগ্ধ হয়ে যায় এসব দেখে। সম্পূর্ণ তিন দিন তারা মেরুন্দা বন্দরে অপেক্ষা করার পর আজ তাদের শেষ দিন।

নূরী ক্যাবিনে বসে তাকিয়ে থাকে মেরুন্দা বন্দরের দিকে। অগণিত লোকজনের চলাফেরার মধ্যে তার দৃষ্টি খুঁজে ফেরে একজনকে–সে হল তার প্রিয়তম দস্যু বনহুর। নীরবে অশ্রু বিসর্জন করে নূরী।

আসলাম আলীর ছবির নায়িকা শ্যামারাণী মাঝে মাঝে নূরীর কাছে এসে বসতো। নূরীকে সে। ঈর্ষা না করে ভালোবাসতো, নূরীর নীরব অশ্রু তার মনে সৃষ্টি করতে একটা ভাবের উন্মেষ। ওর কাছে বসে পিঠে-মাথায় হাত বুলিয়ে সান্তনা দিতে চেষ্টা করতো সে। জানতে চাইতো ওর মনের কথা।

নূরী ওর সঙ্গে কোনো কথা না বললেও ওকে নূরীর ভাল লাগতো। মেরুন্দা আসার পর যখন শ্যামারাণী নূরীকে নিবিড়ভাবে কাছে টেনে নিয়ে বলেছিলো–বোন, আমি তোমাকে অনেক ভালবাসি। তোমার দুঃখ আমাকে বিচলিত করে, বলল তোমার কি দুঃখ?

এতোদিন নূরী ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতো শুধু শ্যামারাণীর দিকে, কোনো জবাব দিতো না তার প্রশ্নের। আজ নূরী চুপ থাকতে পারে না, ঠোঁট দুটি কেঁপে উঠে নূরীর।

ব্যাকুল কণ্ঠে বলে শ্যামারাণী-বলো? বলো তুমি কি বলতে চাও?

নূরীর গন্ড বেয়ে গড়িয়ে পড়ে অশ্রুধারা, বলে নুরী–কেন তোমরা আমাকে ধরে নিয়ে এলে? বাষ্পরুদ্ধ হয়ে আসে ওর গলা।

নূরীর কণ্ঠস্বরে মুগ্ধ বিস্মিত হয়ে শ্যামারাণী, আঁচলে ওর চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে সে– তোমাকে আমাদের পরিচালকের অনেক পছন্দ হয়েছে। তোমাকে তিনি ছবির নায়িকা করবেন।

অবাক হয়ে বলে নূরী–পরিচালক! কিসের ছবি?

ছায়াছবি–চলচ্চিত্র…

 মাথা নাড়ে নূরী, বলে–ওসব আমি বুঝি না।

সব বুঝতে পারবে। আমাদের স্টুডিওতে গেলে সব দেখতে পাবে।

না না, তোমরা আমাকে সেই বনে ফিরিয়ে দিয়ে এসো আমি তার কাছে যাবো–আমি তার কাছে যাবো।

কে সে? কার কথা বলছো?

আমার হুর। আমার হুরের কাছে।

হুর! সেকি?

নূরীর কথা বুঝতে পারে না শ্যামারাণী। তবু নূরী যে কথা বলেছে এই তার আনন্দ। ছুটে যায় শ্যামারাণী পরিচালক আসলাম আলীর কাছে।

শ্যামাকে আনন্দদীপ্ত দেখে আসলাম আলী জিজ্ঞাসা করলেন–কি ব্যাপার, বড় আনন্দমুখর দেখছি যে?

ব্যাপার অত্যন্ত শুভ। আপনার শিকার কথা বলেছে।

আসলাম আলী অবাক হয়ে বললেন–আমার শিকার!

 হাঁ, সেই বনকুমারী…

সত্যি বলছো শ্যামা?

মোটেই মিথ্যা নয়। বলুন কি পুরস্কার দেবেন আমাকে? কারণ আমিই তাকে প্রথম কথা বলতে বাধ্য করেছি।

যা চাও তাই পাবে শ্যামা, ওকে যদি তুমি আমার কাছে লাগিয়ে দিতে সহায়তা করো।

 সত্যি দেবেন?

সত্যি।

আমার হাত ধরে শপথ করুন। হাতখানা প্রশস্ত করে দেয় শ্যামা পরিচালকের সম্মুখে।

আসলাম আলী হাত রাখেন শ্যামার হাতের উপর–বলো কি চাও তুমি?

 শ্যামা ফিক করে হেসে বলে–বেশি কিছু নয়, আপনার স্নেহপ্রীতি আর আন্তরিকতা।

কথা দিলাম এসব থেকে কোনোদিন তুমি বঞ্চিত হবে না।

শ্যামারাণীর চোখ দুটি আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো, বললো–এর বেশি আমি কিছুই চাই না আলী সাহেব। আমি পতিতার মেয়ে জেনেও, আমাকে আপনি আপনার অন্তরে স্থান দিয়েছেন, শুধু তাই নয়, লোকসমাজের সম্মুখে তুলে ধরেছেন শ্রেষ্ঠ নায়িকা হিসাবে এর চেয়ে আর আমার কি লোভনীয় থাকতে পারে!

শ্যামারাণীর চোখ দুটো অশ্রু ছলছল হলো, কণ্ঠ কৃতজ্ঞতায় বাষ্পরুদ্ধ হয়ে এলো।

আসলাম আলী তাকে বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে আবেগভরা গম্ভীর শান্ত কণ্ঠে বললেন–আমার কাছে তুমি চিরদিন আদরিণীই থাকবে শ্যামা। তোমার শ্যামল রূপ যে আমাকে আত্নহারা করেছে। আমি তোমায় প্রাণের অপেক্ষা বেশি ভালবাসি।

আলী সাহেব! আলী সাহেব! আপনি কতবড়, কত মহান। শ্যামা আসলাম আলীর বুকে মাথা রাখে।

আসলাম আলী শ্যামাকে বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে প্রেমবাণী শোনালেও তার মনের গহনে বিরাজ করছে আর একটি মুখ। সে হলো গহন জঙ্গলে কুড়িয়ে পাওয়া সেই রত্ন, তার অন্তরের রাণী বনকুমারী।

আসলাম আলী সুচতুর বুদ্ধিমান পরিচালক–কেমন করে শিল্পী এবং কলা-কৌশলীদের খুশি রাখতে হয় জানেন। অভিজ্ঞ পরিচালক হিসাবে তার খ্যাতি কম নয়। তিনি খাঁটি বাঙালী এবং মুসলমান হয়েও নানাদেশীয় শিল্পীদের সমন্বয়ে চিত্র তৈরি করে থাকেন। শুধু বাংলা ছবিই নয়, উর্দু এবং পাঞ্জাবী ছবিও তৈরি করে চিত্রজগতে শীর্ষস্থান অধিকার করেছেন।

নূরীকে নিয়ে আসলাম আলীর মনে এক উদ্ভব হয়েছে, যা অনেক পরিচালকের পক্ষে সম্ভব। হয়নি আজও।

শ্যামার সঙ্গে আসলাম আলী চললেন নূরীর ক্যাবিনের দিকে। আজ নূরী কথা বলেছে–এ যেন তার চরম আনন্দের কথা। খুশিতে উজ্জল তার মুখমন্ডল, দীপ্ত কণ্ঠে বললেন–শ্যামা, ওকে। আমার সম্মুখে কথা বলাতে পারবে?

পারবো, চলুন। কিন্তু আপনি বাইরে অপেক্ষা করবেন, আমি ক্যাবিনে প্রবেশ করে তার সঙ্গে কথা বলবো।

বেশ তাই হবে।

পরিচালক আসলাম আলী ক্যাবিনের বাইরে দাঁড়িয়ে রইলেন। ক্যাবিনে প্রবেশ করলো শ্যামারাণী।

নূরী তখন ক্যাবিনের মুক্ত গবাক্ষে তাকিয়ে আছে মেরুলা বন্দরে থেমে থাকা অন্যান্য জাহাজের দিকে।

শ্যামা এসে নূরীর কাঁদে হাত রাখলো, বললো–কি দেখছো তুমি?

 ফিরে তাকায় নূরী, ম্লান হেসে বলে সে–দেখছি পৃথিবীর মানুষ কত নিষ্ঠুর!

নূরীর কণ্ঠস্বর এবং কথা বলার অপূর্ব ভঙ্গী পরিচালকের মনে আনন্দের উৎস বইয়ে দিলো, মৃদু হাসির আভাস ফুটে উঠলো তার মুখে! পরক্ষণেই ভেসে আসে শ্যামার কণ্ঠ–কি করে বুঝলে তুমি পৃথিবীর মানুষ বড় নিষ্ঠুর?

আমার নিজের জীবন দিয়ে। আচ্ছা বোন, তোমার জীবনের সব কথা বলবে আমাকে?

 বলবো, কিন্তু আজ নয়।

 কবে বলবে তুমি?

আর একদিন।

তোমার নামটা তো আজও বললে না বোন?

একটা দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করে বলে নূরী-আমার নাম বড় মন্দ আর অপেয়।

বলোই না কি নাম তোমার?

নূরী।

চমৎকার নাম…কথাটা বলে কক্ষে প্রবেশ করেন আসলাম আলী।

 নূরীর মুখ গম্ভীর হয়ে উঠে, মুখ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সে।

আসলাম আলী পাশে এসে দাঁড়ান! –স্নেহভরা কণ্ঠে বললেন–নূরী…কি সুন্দর, কি মিষ্টি নাম তোমার। আমি কিন্তু তোমাকে রত্না বলে ডাকবো।

শ্যামা হেসে বলে–বাঃ এ যে আরও মধুর, যেমন রূপ তেমনি নাম।

নূরী কোনো কথা বলে না, নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইলো যেমন ছিলো ঠিক তেমনি।

আসলাম আলী বললেন–রত্নার সমস্ত দেহ আমি রত্ন দিয়ে ভরে দেবো শ্যামা। আমার বাসনা। যদি সিদ্ধ হয়–যেমন তুমি আমার সমস্ত কামনা পূর্ণ করেছে।

শিউরে উঠে নূরী, ক্ষণিকের জন্য একবার চোখ তুলে আসলাম আলীকে দেখে নেয় সে।

আসলাম আলী তখনও বলে চলেছেন–বোম্বে ফিরে গিয়ে রত্নাকে তুমি তোমার মত করে তৈরি করে নিও।

হঠাৎ বলে উঠলো শ্যামা–মেরুন্দা ছেড়ে কবে আমরা বোম্বের দিকে রওয়ানা দেবো আলী সাহেব?

আজই আমরা মেরুন্দা বন্দর ত্যাগ করবো শ্যামা।

আজই!

হাঁ। তোমরা বিদায়ের জন্য তৈরি হয়ে নাও শ্যামা কোনো প্রয়োজনীয় দ্রবাদির অভাব মনে করলে মেরুন্দা হতে ক্রয় করে নিতে পারো।

পরিচালক আসলাম আলী নূরীর কক্ষ ত্যাগ করে বেরিয়ে গেলেন।

শ্যামা নূরীকে বললো–বোন, মেরুন্দার অপরূপ দৃশ্য সত্যি অপূর্ব! চলো যাই, ডেকে গিয়ে দাঁড়াই।

নূরী বিনা বাক্যে শ্যামাকে অনুসরণ করলো। আজ কতদিন সে বাইরের আলোয় গিয়ে দাঁড়ায়নি! প্রথম যেদিন তাকে জোরপূর্বক ধরে এনে ঐ যে ক্যাবিনে ভরেছে তারপর আর সে বাইরে আসেনি। পৃথিবীর আলো যেন তার চোখে অসহ্য লাগতো, ভালো লাগতো না কিছু। তাই নূরী কোনোদিন ক্যাবিনের বাইরে তাকিয়েও দেখেনি।

আজ শ্যামার সঙ্গে এসে ডেকের উপর দাঁড়ালো নূরী। মেরুদা বন্দর ত্যাগ করার ভো বেজে উঠেছে, একটু পরেই জাহাজ বন্দর ত্যাগ করবে।

করুণ অসহায় চোখে তাকিয়ে আছে নূরী মেরুন্দার শেষ প্রান্তে দূরে–অনেক দূরে ঘন জঙ্গলের শীর্ষভাগে। ভাবে সে, নিশ্চয়ই তার বনহুর ঐ পর্বতমালার উপরে জঙ্গলে এখনও বুঝি তার নাম ধরে ডেকে ফিরছে। হয়ত আবার সেই জংলীদের কবলে ধরা পড়ে গেছে। না হয় জংলীরাণী তাকে বন্দী করে হত্যা করে ফেলেছে। কি নৃশংস হত্যা…নূরী আর যেন ভাবতে পারে না, তার মাথাটা কেমন যেন ঘুরে উঠে। নূরীর চোখের সম্মুখে ভেসে উঠে রংলালের দলের ঝুলন্ত অবস্থায় মস্তকহীন মৃতদেহগুলো! ভেসে উঠে সাপুড়ে সর্দারের ভয়ঙ্কর মৃত্যুদৃশ্য।

নূরীর মাথার মধ্যে যখন জংলীদের পৈশাচিক হত্যাকান্ডের বীভৎস দৃশ্যগুলো প্রতিচ্ছবি। ঘুরপাক খাচ্ছিলো তখন তাদের জাহাজ মেরুন্দা বন্দর ত্যাগ করে ধীরে ধীরে সরে আসছিলো।

ঠিক সেই মুহূর্তে জাহাজ ‘পর্যটন এগিয়ে আসছে বন্দরের দিকে। পরিচালক আসলাম আলীর জাহাজের পাশ কেটে মন্থর গতিতে বন্দর অভিমুখে এগুচ্ছে জাহাজখানা।

নূরী বললো–আর আমি দাঁড়াতে পারছি না। চলো ক্যাবিনে যাই।

 শ্যামা ব্যস্তকণ্ঠে বললো–কি হয়েছে?

বড় অসুস্থ বোধ করছি।

শ্যামা নূরীকে নিয়ে ফিরে গেলো ক্যাবিনের মধ্যে।

 ‘পর্যটন’ তখন অতি নিকটে এসে পড়েছে। একেবারে আসলাম আলীর জাহাজের পাশে।

নাবিক বেশে বনহুর তখন ডেকের সম্মুখে দাঁড়িয়ে দূরবীক্ষণ যন্ত্রের দ্বারা মেরুন্দা বন্দর লক্ষ্য করছিলো! শুধু বন্দর লক্ষ্য করাই তার আসল উদ্দেশ্য নয়, উদ্দেশ্য ছিলো বন্দরে থেমে থাকা প্রত্যেকটা জাহাজ অনুসন্ধান করে দেখা। হঠাৎ যদি কোনো জাহাজে তার নূরী থাকে তাহলে নিশ্চয়ই তাকে দেখতে পাবে সে। চঞ্চলা নূরী কিছুতেই জাহাজের ক্যাবিনে চুপচাপ বসে থাকার মেয়ে নয়। কিন্তু বনহুরের আশা সফল হয় নারী ঠিক সেই মুহূর্তে জাহাজের কেবিনে চলে যায়!

বনহুর ব্যাকুল চোখে দেখেছিলো, অনুসন্ধান করে ফিরছিলো তার প্রিয়ার। নূরী তখন ক্যাবিনে গিয়ে শয্যায় দেহ এলিয়ে দিয়েছে।

নূরীকে শয্যায় শুইয়ে দিয়ে শ্যামা ফিরে আসে ডেকে একটু পূর্বে যেখানে নূরী আর সে দাঁড়িয়েছিলো। হঠাৎ শ্যামার নজর চলে যায় পাশের জাহাজের ডেকে বনহুরের উপর।

বনহুরও তাকিয়ে দেখছে শ্যামাকে।

একেবারে তখন জাহাজ দু’খানা পাশাপাশি ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়েছে।

নাবিকের ড্রেসে বনহুর-বড় সুন্দর দেখাচ্ছে ওকে!

শ্যামা নির্বাক দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকে নাবিকটির দিকে। এই মুহূর্তে যদি নূরী চলে না যেতো তাহলে নিশ্চয়ই বনহুরের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ? হয়ে যেতো তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু সবই ভাগ্য। যতটুকু যার অদৃষ্টে আছে তা থেকে কেউ কাউকে বাঁচাতে পারবে না। এই দন্ডে বনহুরের সঙ্গে সাক্ষাৎ তার ভাগ্যে নেই, কাজেই সে চলে গেলো ডেক ছেড়ে ভিতরে।

জাহাজখানা ক্রমান্বয়ে সরে যেতে থাকে দূরে সাগরবক্ষে আর পর্যটন এগিয়ে যায় মেরুন্দা বন্দরের অভিমুখে!

শ্যামার হঠাৎ কেমন যেন একটা মোচড় দিয়ে উঠে। বনহুরকে যতক্ষণ সে ডেকে দাঁড়িয়ে দেখতে পাচ্ছিলো ততক্ষণ তন্ময় হয়ে তাকিয়েছিলো শ্যামা ওর দিকে। কিন্তু যেইমাত্র আর নজরে পড়লো না তখন চলে এলো নূরীর ক্যাবিনে, কারণ এ ক্যাবিনের মুক্ত গবাক্ষে পিছন জাহাজের ডেক সম্পূর্ণ দেখা যাবে।

শ্যামা এসে দাঁড়ালো ক্যাবিনের পিছন জানালায়। সত্যি এখনও তাকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ঐ তো লোকটা দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে তাদের জাহাজখানার দিকে। তবে কি তাকেও ওর ভাল লেগেছিলো? না হলে অমন করে নির্বাক দৃষ্টি মেলে এখনও এ জাহাজখানার দিকে তাকিয়ে থাকবে। কেন! শ্যামার মনে একটা আনন্দের অনুভূতি সাড়া দিয়ে যায় সত্যি একটা স্মরণীয় পুরুষ মুখ আজ সে দেখতে পেয়েছে। যে মুখ তার জীবন পাতায় একটি স্বর্ণরেখোর মত উজ্জ্বল হয়ে থাকবে। ধীরে ধীরে জাহাজখানা সম্পূর্ণ দৃষ্টির অন্তরালে অন্তর্হিত হলো।

শ্যামার মুখ ম্লান হলো যেন সন্ধ্যার অন্ধকারের মত। মুক্ত জানালাপথ থেকে ফিরে এলো। নূরী তখন বালিশে মুখ গুঁজে নিশ্চুপ পড়েছিলো।

শ্যামা এসে বসলো নূরীর কাছে, পিঠে হাত রেখে ডাকলো রত্না!

নূরী মুখ তোলে, কিন্তু কোনো জবাব দেয় না।

বলে আবার শ্যামা-রত্না, জানো এততক্ষণ আমি তোমার ক্যাবিনের জানালায় দাঁড়িয়ে কি। দেখছিলাম?

কি দেখছিলে?

 দেখছিলাম এক সৌম্যসুন্দর দীপ্তকায় যুবককে। সত্যি অপূর্ব সে চেহারা…

নূরীর মনে হঠাৎ একটা প্রশ্ন জাগে, কে সে যুবক–তার বনহুর নয়তো? সোজা হয়ে বসে নূরী বলে–কেমন দেখলে তাকে? ছেঁড়া জামাকাপড় দেখলে? মাথার চুল বুঝি রুক্ষ? মুখে বুঝি। খোঁচা খোঁচা দাড়ি…

শ্যামা বলে উঠে–না না, ছেঁড়া জামা হবে কেন। রুক্ষ চুলই বা কেন হবে। আর মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়িই বা থাকবে কেন? সে যে জাহাজের নাবিক তার দেহে নাবিকের ড্রেস, মাথায় নাবিকের ক্যাপ। সৌম্যসুন্দর অপরূপ সে নাবিক!

নাবিক! হতাশায় নূরীর মন ভরে উঠে। কে কোন নাবিক-কি হবে তার সংবাদ জেনে!

শ্যামার চোখেমুখে তখনও লেগে রয়েছে ভাবের উন্মেষ। তার অন্তর জুড়ে নাবিকের প্রতিচ্ছবি ভাসছে। মাত্র ক্ষণিকের জন্য শ্যামা দেখেছে তাকে কিন্তু ওর যেন মন হচ্ছে কত দিনের চেনা ঐ মুখ।

জাহাজ তখন মেরুলা বন্দর ছেড়ে অনেক এগিয়ে এসেছে।

এদিকে পর্যটন এসে নোঙ্গর করলো মেরুন্দা বন্দরে। নীহারের আনন্দ আর ধরে না। আবু। সাঈদ স্বয়ং কন্যাসহ বন্দরে অবতরণ করবেন বলে প্রস্তুত হয়ে নিলেন।

জাহাজের প্রায় সকলেই বন্দরে অবতরণের জন্য উন্মুখ হয়ে উঠছে। নাসের এবং তার গোপন অনুচরগণ সেই ফাঁকে একটা কুমতলব এঁটে নিলো। জাহাজ আজ বেশ কিছুদিন অবিরত একটানা চলার পর মেরুন্দায় নোঙ্গর করেছে। ইঞ্জিনের মেশিনপত্র পরিস্কারের প্রয়োজন। হেড নাবিক। জানিয়েছে–সে কয়েকজন সহকারী নিয়ে ইঞ্জিন পরিষ্কার কাজে লিপ্ত হবে। কাজেই সবাই জাহাজ ত্যাগ করে বন্দরে অবতরণ করা চলবে না।

আবু সাঈদ বললেন–হ্যাঁ, সেই মতই কাজ করতে হবে। কারণ মেরুলা বন্দর ত্যাগ করার। পর নিকটবর্তী কোনো বন্দরের সম্ভাবনা নেই। সেজন্য জাহাজের নাবিকগণকে হেড নাবিককে সহায়তা করতে বললেন। পরে তারা একদিন মেরুলা বন্দরে অবতরণ করতে পারবে বলে জানালেন তিনি।

নাসেরের চোখেমুখে খুশির উৎস বয়ে গেলো। এই তো সুযোগ, নাবিক আলমকে কাবু করতে হবে এইবার।

আবু সাঈদ যখন দলবল নিয়ে বন্দরে অবতরণ করলেন তখন আলগোছে সরে রইলো নাসের আর তার কয়েকজন দুষ্ট অনুচর।

আবু সাইদ যখন তার পর্যটক বন্ধুদেরকে নিয়ে মেরুলা বন্দরে নেমে গেলেন, ঠিক তার পর মুহূর্তে নাসের আর তার দু’জন শয়তান অনুচরসহ হেড নাবিকের পাশে এসে দাঁড়ালো।

হেড নাবিক তখন একা চা পান করছিলো তার ক্যাবিনে বসে। নাসের এবং তার দু’জন। অনুচরকে দেখে উঠে দাঁড়ালো।

বললো নাসের–মকবুল, জানো কেন এসেছি?

না জনাব, আমি কেমন করে জানবো বলুন?

 তোমাকে এক কাজ করতে হবে মকবুল।

 বলুন স্যার? কি কাজ করতে হবে?

এ জাহাজে আমার এক দুশমন আছে, তাকে সরাতে হবে, পারবে সরাতে?

স্যার, আমি আপনার কথা ঠিক বুঝতে পারছি না?

নাসের সঙ্গীদ্বয়ের মুখে তাকিয়ে দেখে নিয়ে চাপা কণ্ঠে বললো–নাবিক আলম আছে না?

নতুন নাবিক আলমের কথা বলছেন স্যার?

 হাঁ, জানো এই অল্প কদিনে সে জাহাজের মালিকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে নিয়েছে।

ঠিক বলেছেন, ছেলেটা ভাল কাজ করে।

কিন্তু তোমার বদনাম হচ্ছে তা জানো? বদনাম।

 আমার বদনাম? কি বলছেন স্যার?

হাঁ সে এখন তোমার নাবিক নামে কলঙ্ক আঁকবে। ভাল কাজ দেখিয়ে তোমাকে সে নিচে নামিয়ে প্রমোশন নেবে সে। দুদিন পরে দেখবে আলম হেড নাবিক বনে বসে আছে।

নাসেরের কথা শুনে হেড নাবিক মকবুলের মনে একটা সন্দেহের দোলা জাগে তাই তো, আলমের কাজ দেখে প্রায়ই মালিক তার প্রশংসা করেন। হয়তো একদিন তার এই পঁচিশ বছরের অভিজ্ঞতা ব্যর্থ হয়ে যাবে ঐ ছোকরা নাবিকের কাছে। বললো মকবুল–বলুন স্যার, আমাকে কি করতে হবে?

অত্যন্ত সহজ কাজ এবং সেই কাজের উপর নির্ভর করছে তোমার নাবিক-জীবনের ভবিষ্যৎ?। তাছাড়াও আমি তোমাকে মোটা বখশীস দেবো। আর যদি কাজের আপত্তি করো বা কাউকে একথা বলে দাও তাহলে…একটা সূতীক্ষ্ণ ছোরা পকেট থেকে বের করে মেলে ধরে তার সম্মুখে–তাহলে এটা আমূলে বিদ্ধ হবে তোমার ঐ প্রশস্ত বুকে।

মকবুলের চোখে ভীতি এবং উকুণ্ঠা ভাব জেগে উঠে। বসে সে–যা বলবেন আমি তাই করতে রাজি আছি স্যার।

নাসের তার সঙ্গীদ্বয়কে ইঙ্গিত করলো কথাটা বলার জন্যে। লোক দুটো চারিদিকে তাকিয়ে দেখে নিলো। তারপর একজন বললো–মকবুল, আজ থেকে তোমাদের ইঞ্জিন পরিস্কার করবার জন্য নির্দেশ দেবে। যখন সে ইঞ্জিন পরিস্কারে নিয়োজিত হবে তখন হঠাৎ ভুল করে তুমি ইঞ্জিন চালু করে দেবে।

স্যার! ভয়ার্ত বিবর্ণ মকবুলের মুখমন্ডল।

কোনোরকম আপত্তি করলে তোমার মৃত্যু অনিবার্য। বললো নাসের। তখনও তার হাতে সূতীক্ষ ধার ছোরাখানা চক্ করছে। নাসের পুনরায় কথাটা মকবুলকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে সঙ্গীদেরকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো।

মকবুল পুনরায় বসে পড়লো তার পরিত্যক্ত আসনে। ঠান্ডা চায়ের কাপটার দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলো–এ কি করে সম্ভব হবে! একটা নিষ্পাপ সুন্দর জীবনকে সে কি করে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে ফেলবে। জানে মকবুল–আলমকে ইঞ্জিনের কাজে দিয়ে সে ইঞ্জিন চালু করে দিলে মাত্র এক সেকেন্ড–তাহলেই পিষে যাবে ওর দেহটা মেশিনের দাঁতের মধ্যে। কি ভয়ঙ্কর নৃশংস মৃত্যু…মকবুলের ললাটে বিন্দু বিন্দু ঘাম ফুটে উঠলো না না, সে পারবে না এ কাজ করতে। কিন্তু পরক্ষণেই নাসেরের কঠিন কণ্ঠস্বর তার কানের কাছে প্রতিধ্বনিত হলো কোনো রকম আপত্তি করলে মৃত্যু অনিবার্য। সূতীক্ষ্ণ ছোরাখানা ভেসে উঠলো চোখের সম্মুখে নাসেরের কথা অমান্য করলে তার মৃত্যু সুনিশ্চয়।

পায়চারী করতে লাগলো মকবুল, বয়স তার কম নয়। প্রায় পঞ্চাশের অধিক হবে। তিনভাগ জীবন গত হয়ে গেছে। আর একভাগ অবশিষ্ট রয়েছে। তার জন্য একটি পূর্ণ জীবন নষ্ট করবে? আলম সবেমাত্র যুবক–সুন্দর সুষ্ঠু একটি মানবদেহ। ওর মনে কত আশা আছে, বাসনা আছে– সম্মুখে পড়ে রয়েছে দীর্ঘচলার পথ। আর তার জীবন তো শেষ হয়ে গেছে, পথ চলা ক্ষান্ত হয়ে আসছে। ক্লান্ত পথিক সে, আর ক’দিন সে পৃথিবীর আলো-বাতাস উপভোগ করবে! তার জীবনের বিনিময়ে একটি জীবন যদি বাঁচে ক্ষতি কি। না না, সে পারবে না আলমকে ইঞ্জিনের যাতা মেশিনে নিষ্পেষিত করতে পারবে না সে এতোবড় নিষ্ঠুর অমানুষিক কাজ করতে।

মকবুল যখন দুর্ভাবনায়-দুশ্চিন্তায় উন্মত্ত প্রায় তখন আলমবেশী বনহুর এলো তার খোঁজে। মকবুলকে আলম চাচা বলে ডাকতো। কারণ বনহুর জানতো, মকবুলকে খুশি রাখতে পারলে তার মনোবাসনা পূর্ণ হবে। এ জাহাজে তার স্থান হবে ভালভাবে! কারণ মকবুল হেড নাবিক, তার উপর নির্ভর করে অন্যান্য নাবিকের ভাগ্য।

বনহুর মকবুলের ক্যাবিনে প্রবেশ করে হেসে বললো–চাচা চলো, কাজ শুরু করবে কখন?

মকবুল আলমকে দেখে যেন চমকে উঠলো, কেমন যেন ভয়বিহল ঘোলাটি দৃষ্টি নিয়ে তাকালো তার দিকে। কি যেন বলতে চায় কিন্তু পারছে না।

বনহুর আরও সরে এলো, বললো–চাচা, তোমার কি হয়েছে? তোমাকে যেন অত্যন্ত উত্তেজিত মনে হচ্ছে! ব্যাপার কি চাচা?

অধর দংশন করতে লাগলো মকবুল। বার বার তাকাচ্ছে সে আলমের মুখে। সমস্ত দেহ তার ঘেমে উঠেছে উত্তেজনায়।

বনহুর মকবুলের কাঁধে হাত রাখলো–তুমি কি অসুস্থ বোধ করছো চাচা।

অসুস্থ…না না, অসুস্থ আমি নই বাবা, অসুস্থ আমি হইনি। মকবুল ক্যাবিনের দরজার দিকে ভয়ার্ত দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে দেখে নেয়। তারপর বনহুরের কানের কাছে মুখ নিয়ে কিছু বলতে যায়।

কিন্তু মকবুল কিছু বলবার পূর্বেই সূতীক্ষ একখানা ছোরা এসে বিদ্ধ হয় তার পিঠে। সঙ্গে সঙ্গে আর্তনাদ করে পড়ে যায় মকবুল ক্যাবিনের মেঝেতে। রক্তে রাঙা হয়ে উঠে মেঝেটা।

বনহুর মকবুলের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে ছুটে যায়, বাইরে কিন্তু কাউকে দেখতে পায় না। ফিরে আসে বনহুর, দ্রুত হস্তে মকবুলের পিঠ থেকে ছোরাখানা তুলে নিয়ে ব্যাকুল কণ্ঠে বলে–চাচা, বলো কে তোমাকে হত্যা করতে চেয়েছিলো? যার নাম বলতে তুমি বিলম্ব করছিলে? বলো–বলল চাচা?

মকবুল অতিকষ্টে শুধু দুটি শব্দ উচ্চারণ করলো… আলম… আমাকে… নয়…তোমাকে…হত্যা ক-র-তে-কথা শেষ করতে পারে না সে, মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।

ঠিক সেই মুহূর্তে চোখ তুলে তাকায় বনহুর, দেখতে পায় নাসের ও আর ও দু’জন দাঁড়িয়ে দরজার উপরে!

নাসের সরে আসে; ক্রুদ্ধকণ্ঠে বলে–কেন তুমি ওকে হত্যা করলে আলম, বলো?

বনহুর মকবুলের মৃতদেহের পাশ থেকে উঠে দাঁড়ায়, সরে আসে নাসেরের সম্মুখে, গম্ভীর কণ্ঠে বলে সে–আমি ওকে হত্যা করিনি।

হাঃ হাঃ হাঃ এখনও তোমার হস্তে সূতীক্ষ ধার ছোরা বিরাজ করছে, আর তুমি বলছো ওকে হত্যা করোনি?

না।

কিন্তু কি প্রমাণ আছে যে তুমি ওকে হত্যা করোনি?

আমি নিজেই প্রমাণ। আমি নিজে জানি আমি হত্যা করিনি।

আমরা জানি, তুমিই মকবুলকে হত্যা করেছো, কারণ তুমি হেড নাবিক হতে চাও।

মিথ্যা কথা, আমি হেড নাবিক হতে চাই না। ছোরাখানা দূরে নিক্ষেপ করলো বনহুর।

নাসের তার সঙ্গীদ্বয়কে ইংগিত করলো।

সঙ্গে সঙ্গে শম্ভু আর জম্বু জাপটে ধরলো বনহুরকে। মনে করলো ওরা এই সময় জাহাজে মালিকের দল কেউ নেই, কাজেই আলমকেও হত্যা করে ফেলবে এবং মালিককে জানাবে– মকবুল আর আলম মারামারি করে নিহত হয়েছে।

শম্ভু আর জন্ধু নাবিক আলমকে জাপটে ধরতেই এক ঝটকায় সে ওদের দু’জনাকে মেঝেতে ফেলে দিলো।

বিস্ময়ে দু’চোখ গোলাকার হলো নাসেরের। সে জানে, শম্ভু আর জম্বুর মত বীর শক্তিশালী। লোক তাদের জাহাজে আর নেই। কিন্তু যে মুহূর্তে আলম ওদের দু’জনাকে এক সঙ্গে ভূতলশায়ী করলো তখন নাসের শুধু অবাক হলো না, মনে মনে ভীতও হলো।

ততক্ষণে শম্ভু আর জম্বু উঠে দাঁড়িয়ে গায়ের ধুলো ঝাড়া দিলো। নাসের উবু হয়ে যেমন। ছোরাখানা হাতে উঠিয়ে নিতে যাবে, অমনি বনহুর ওর হাতের উপর পা দিয়ে চেপে ধরলো– খবরদার!

নাসের ছোরা ত্যাগ করতেই বনহুর পা সরিয়ে নিলো।

আর এক মুহূর্ত ওরা দাঁড়ালো না, বেরিয়ে গেলো ক্যাবিন থেকে।

বনহুর মকবুলের মৃত্যুমলিন মুখখানার দিকে তাকিয়ে দেখলো–বুঝতে পারলো, এর হত্যার পিছনে রয়েছে গভীর এক রহস্য। সে আর বিলম্ব না করে নেমে গেলো মেরুদা বন্দরে। আবু। সাঈদ ও নীহার তখন ঘুরে ফিরে সব দেখছিলেন। হঠাৎ তারা আলমকে উত্তেজিত অবস্থায় দেখে বিস্মিত হলেন বললেন আবু সাঈদ–ব্যাপার কি আলম?

স্যার, আপনি জাহাজে আসুন, জরুরি প্রয়োজন আছে।

আবু সাঈদ, নীহার এবং অন্যান্য পর্যটক সবাই ব্যস্তভাবে জাহাজে ফিরে এলেন।

বনহুর হেড নাবিকের মৃত্যু সম্বন্ধে সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করে শোনালেন। শুধু নাসের ও তার অনুচরদ্বয়ের আক্রমণের কথা সম্পূর্ণ গোপন রেখে দিলো সে।

আবু সাঈদ প্রবীণ নাবিক মকবুলের নির্মম মৃত্যুতে অত্যন্ত বিচলিত হলেন। কে, কেন তাকে। হত্যা করলো–ভেবে অস্থির হলেন তিনি। হত্যাকারী যে তার জাহাজেই আছে তা সহজেই। বুঝতে পারলেন। কিন্তু আবু সাঈদ বেশি ঘাবড়ালেন না, কারণ মেরুন্দা বন্দরের পুলিশ মহল এ। সংবাদ অবগত হলে তাদের যাত্রায় ব্যাঘাত ঘটতে পারে। কাজেই ঘটনাটা চেপে যাওয়াই সমীচীন মনে করলেন।

তাদের জাহাজের নাবিক মকবুলের মৃত্যু স্বাভাবিক বলে তিনি ঘোষণা করলেন এবং তাকে। মেরুলায় কবরস্থ করবার জন্য আদেশ দিলেন।

যে অফুরন্ত আনন্দ নিয়ে পর্যটন মেরুন্দায় ভিড়েছিলো সে আনন্দ আর কারো মনে রইলো না। পর্যটনের যাত্রিগণের মনে একটা আতঙ্ক সৃষ্টি হলো। কে হত্যা করলো বৃদ্ধ নিরীহ নাবিক বেচারীকে?

বিশেষ করে নীহার আরও ভীত হয়ে পড়েলো। মকবুলের মৃত্যুদৃশ্য তাকে একেবারে ভয় বিহ্বল করে তুলেছে।

মেরুলায় কয়েকদিন থাকবেন মনে করেছিলেন আবু সাঈদ, কিন্তু তা আর হলো না–একদিন পরেই মেরুন্দা ত্যাগ করতে হলো তাকে। উদ্দেশ্য, এখন ফৌজিন্দিয়া দ্বীপের দিকে যাবেন, কিন্তু এতোবড় একটা রহস্যজনক হত্যাকান্ডের পর পর্যটক দলের মধ্যে বেশ কিছুটা চাঞ্চল্যতার ছাপ পরিস্ফুটিত হয়ে উঠলো। কিন্তু আবু সাঈদের মুখের উপর কেউ কোনো উক্তি উচ্চারণে সক্ষম হলো না। প্রবীণ পর্যটক আবু সাঈদ অবশ্য এ ব্যাপারে নিত্যন্ত মুষড়ে পড়লেও তার ইচ্ছা অটুট রাখবেন। আবু সাঈদ ছিলেন যেমন সরল-স্বাভাবিক তেমনি ছিলেন এক জেদী মানুষ। শত বাধা বিপত্তিতেও তিনি ঘাবড়াতেন না। তিনি যা মনে করতেন সে কাজ সমাধা না করে স্বস্তি ছিলো না তার।

আবু, সাঈদ জানতে পেরেছিলেন–ইরুইয়ার অদূরে একটি দ্বীপ আবিষ্কৃত হয়েছে–অদ্ভুত এক দ্বীপ। চারিধারে সাগর আর মাঝখানে কচ্ছপ পৃষ্ঠের ন্যায় একটি সুউচ্চ মৃত্তিকাস্তর। প্রায় পাঁচশত মাইলব্যাপী এই অদ্ভুত দ্বীপটি হঠাৎ একদিন সাগরবক্ষে মাথা উঁচু করে জেগে উঠেছে। একটি মালবাহী জাহাজই প্রথম আবিষ্কার করে এই দ্বীপটি। এখানে আরও বহু জাহাজ যাওয়া আসা করেছে কিন্তু কেউ কোনো দিন এখানে কোনো দ্বীপ দেখেনি। যে মালবাহী জাহাজ প্রথম এ দ্বীপ আবিষ্কার করেছে তার ক্যাপ্টেনের নাম হলো ‘ফৌজিন্দিয়ার’ তাই তার নাম অনুসারে এ দ্বীপের নামকরণ হয়েছে ফৌজিন্দিয়া দ্বীপ।

শুধু তাই নয়, এ দ্বীপ সম্বন্ধে আরও অদ্ভুত একটি উক্তি তিনি জানতে পেরেছেন, এ দ্বীপের নিকটবর্তী জলপথ দিয়ে কোনো জাহাজে চলাফেরা করতে গেলে তারা গভীর রাতে লক্ষ্য করেছে–দ্বীপের উপরে বেশ কিছুসংখ্যক আলোক প্রদীপ ক্ষিপ্রগতিতে ছুটোছুটি করে বেড়ায়। কিন্তু কোনো জন প্রাণী যদি সন্ধান নিতে ঐ দ্বীপে অবতরণ করে তাহলে কিছুই তারা দেখতে পায় না, এমনকি কোনোরকম আলোকরশ্মিও নজরে পড়ে না। আরও একটি বিস্ময়কর ঘটনা কর্ণগোচর হয়েছে আবু সাঈদের–সে হলো আশ্চর্য একটি শব্দ। দ্বীপ হতে মাঝে মাঝে একটা শব্দ শুনা যায়, যেন কোনো ইঞ্জিনের হুইসেলের তীব্র শব্দ। অনেক বৈজ্ঞানিক এবং আবিষ্কারক দল নানাভাবে সন্ধান নিয়ে দেখেছেন কিন্তু আজও কেউ এসব ব্যাপারে স্থির কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেনি।

আবু সাঈদের বন্ধুবর রব্বানী রিজভী নিজেও একজন অভিজ্ঞ প্রবীন বৈজ্ঞানিক। তিনিও এ দ্বীপ সম্বন্ধে অত্যন্ত কৌতূহলী হয়ে এ দ্বীপে গিয়েছিলেন, কিন্তু ব্যর্থ মনোরথ হয়ে ফিরে এসেছেন তিনি। গভীর রাতে আলোকরশ্মি এবং সেই বিস্ময়কর শব্দ সম্বন্ধে কোনোরকম রহস্য উদ্ঘাটনে সক্ষম হননি।

এই ফৌজিন্দিয়া দ্বীপ সম্বন্ধে নানাজন এখন নানারকম বাক্য উচ্চারণ করে চলেছে। নানা জনের নানা মতবাদ-স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত না হওয়া পর্যন্ত কারো স্বস্তি নেই। বিশেষ করে ভূতত্ত্ববিদ ও প্রত্নতত্ত্ববিদগণ ব্যতিব্যস্তভাবে সন্ধান চালিয়ে চলেছেন কিন্তু আজও কোনো কিছু আবিষ্কারে সক্ষম হননি।

রহস্যময় দ্বীপটি মানুষের মনে জাগিয়ে তুলেছে এক গভীর সমস্যাময় প্রশ্ন। এক উন্মত্ত বাসনা আকর্ষণ করে নিয়ে চলেছে প্রতিটি বিশেষজ্ঞ মহানকে।

আবু সাঈদ তাদেরই একজন।

মকবুল মিয়ার নির্মম মৃত্যু তাঁকে বিচলিত করলেও তিনি তাঁর সঙ্কল্পে অটল রইলেন। তিনি মকবুলের মৃত্যু সম্বন্ধে সকলকে শান্ত হবার জন্য অনুরোধ জানালেন।

*

জাহাজ চলেছে বটে কিন্তু হেড নাবিকের স্থানে এখনও কাউকে মঞ্জুর করা হয়নি। উপস্থিত হেড নাবিকের কাজ চালাচ্ছে নাবিক আলম–স্বয়ং দস্যু বনহুর।

বনহুর মকবুলের মৃত্যু স্বচক্ষে দেখেছে এবং তার মৃত্যু-যন্ত্রণা অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করেছে। মকবুলের মৃত্যুর কারণ যে কি, সঠিক না জানতে পারলেও তার মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে যে মুখোভাব এবং তার অস্থিরতা লক্ষ্য করেছে তা অত্যন্ত রহস্যময়। বনহুর কিছুটা যে একেবারে বুঝতে পারেনি তা নয়। মকবুলের মৃত্যুকালের শেষ উক্তিগুলোর প্রতিটা শব্দ তার মনে গাঁথা হয়ে আছে…আলম…আমাকে…নয় তোমাকে হত্যা করতে …কথা শেষ করতে পারেনি বেচারী। মকবুল তাকে কিছু বলতে যাচ্ছিলো, সেই কারণেই ওকে হত্যা করা হয়েছে এবং কে-বা কারা হত্যা করেছে তাও সে জানে, যদিও ছোরা নিক্ষেপকারী তার দৃষ্টির আড়ালে ছিলো।

বনহুর শুধু অসীম শক্তির অধিকারীই নয়, তার সূক্ষ্ণ বুদ্ধির কাছে অতি তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমানকেও হার মানতে হয়। বনহুর এতো জেনেও কেন নীরব রইলো? পারতো না কি সে সব কথা আবু সাঈদকে খুলে বলতে, কিন্তু বনহুর এ রহস্য উদঘাটন করতে ইচ্ছুক নয়। সে নিজ হস্তে প্রবীণ নাবিক মকবুলের হত্যাকারীকে সায়েস্তা করতে চায়। কাজেই বনহুর নীরব থেকে নিজ কাজ করে চললো

*

বনহুর যখন এতো জেনে এবং দেখেও নাসের সম্বন্ধে বাকহীন রইলো তখন শৃগালের মত সেজে নাসের আবার নতুন এক দূরভিসন্ধি নিয়ে মাথা ঘামাতে শুরু করলো।

নীহার এবং আবু সাঈদের মনে সন্দেহ জাগানোর জন্য একদিন নাসের তার এক অনুচরকে নিয়ে হাজির হলো ক্যাপ্টেনের ক্যাবিনে। ক্যাপ্টেন আবু সাঈদ এবং নীহার জাহাজের মধ্যে পাশা পাশি দুখানা সোফায় বসে চা পান করছিলেন। নাসের ক্যাবিনে প্রবেশ করতেই আবু সাঈদ তাকে আপ্যায়ন করালেন–এসো এসো, নাসের বসো!

নাসের আসন গ্রহণ করলো।

তার সঙ্গী লোকটিকে ক্যাবিনের বাইরে অপেক্ষা করতে বলে এসেছে সে, কাজেই লোকটি দাঁড়িয়ে রইলো দরজার ওদিকে।

আবু সঈদের মুখমন্ডল ভাবগম্ভীর থমথমে লাগছে।

নীহার ক্যাবিনের জানালা দিয়ে তাকালো বাইরে সীমাহীন আকাশের দিকে। নাসেরকে সে যেন দেখেও দেখলো না। সম্মুখস্থ টেবিল থেকে চানাচুর নিয়ে দু’একটা ফেলতে লাগলো। মুখগহ্বরে। চিবুতে লাগলো যেন অনিচ্ছাসত্ত্বে।

জাহাজের একটানা ঝকঝক শব্দের সঙ্গে জলতরঙ্গের কলকল খলখল শব্দ মিলে অদ্ভুত এক সুরের সৃষ্টি হচ্ছিলো। আবু সাঈদ সিগারেটটা পান করছিলেন; একরাশ ধুমকুন্ডলীর ভিতর দিয়ে তাকালেন তিনি নাসেরের মুখে নাসের, আমি বড় দুশ্চিন্তিত।

অনুগত ছাত্রের মত হাতের মধ্যে হাত কচলায় নাসের, কিছু বলতে চায় যেন, কিন্তু বলতে গলায় আটকে যাচ্ছে–অবশ্য এটা নাসেরের অহেতুক একটা অভিনয়ের ঢং মাত্র। ভূ জোড়া উঁচু করে এবার দেখে নিলো সে নীহারের মুখখানা, তারপর বললো–দুশ্চিন্তার কারণই বটে স্যার। সমস্ত জাহাজময় একটা আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে।

হাঁ, এই হত্যাকান্ড শুধু সমস্ত জাহাজেই আতঙ্ক সৃষ্টি করেনি নাসের, আমাকে কতখানি যে দমিয়ে দিয়েছে তা কি বলবো! আবু সাঈদের ললাটের রেখাগুলি যেন দড়ির মত শক্ত হয়ে উঠে। গভীর অশান্তির ছায়া প্রকাশ পায় তার চোখেমুখে।

নাসের মাথা নিচু করে, আবু সাঈদের অন্তরের বেদনার ছাপ যেন তার মনেও আঁচড় কেটেছে এমন একটা ভাব মুখে টেনে ঢোক গিলে বলে নাসের–স্যার, এতোবড় একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেলো যার জন্য আমাদের জাহাজের প্রতিটি যাত্রী ভীত আতঙ্কিত। অথচ সেই হত্যাকান্ডের। অধিনায়ক নিশ্চিন্ত মনে এ জাহাজেই বিচরণ করে ফিরছে।

একটা দীর্ঘশ্বাস গোপনে চেপে বললেন আবু সাঈদ–হাঁ, সে এ জাহাজেই আছে তাতে কোন সন্দেহ নেই।

স্যার, এতোবড় একটা নৃশংস হত্যা করেও সে আমাদের জাহাজে আশ্রয় নিয়ে তার মনস্কামনা পূর্ণ করে চলেছে, অথচ তাকে এভাবে প্রশ্রয় দেওয়া মোটেই উচিত হচ্ছে না।

নাসের কথাটা এমনভাবে শেষ করলো যেন সে হত্যাকারীর সঠিক সন্ধান জানে।

আবু সাঈদ তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তুলে ধরলেন নাসেরের দিকে। তারপর অর্ধদগ্ধ সিগারেটটা সম্মুখস্থ এ্যাসট্রেতে গুঁজে রেখে সোজা হয়ে বসে বললেন–মকবুলের হত্যাকারীর সঠিক সন্ধান এখনও উদঘাটন হয়নি, কাজেই আমি কি করতে পারি বলো?

নাসেরের মুখমন্ডলে একটা প্রতিহিংসার ছায়াপাত হলো, কঠিন হয়ে উঠলো তার মুখ, বললো সে–ঐ দুষ্ট হত্যাকারী যদিও সকলের দৃষ্টির অন্তরালে আত্নগোপন করতে সক্ষম হয়েছে কিন্তু আমার চোখে সে ধুলো দিতে পারেনি।

আচমকা বোমা বিস্ফোরণের শব্দে মানুষ যেমন চমকে উঠে তেমনি নাসেরের কথাটা তার গলা থেকে বের হবার সঙ্গে সঙ্গেই আবু সাইদ এবং নীহার চমকে ফিরে তাকালো।

বিস্মিত নীহারের সমস্ত দেহের রক্ত যেন থেমে গেছে শিরায় শিরায়।

আবু সাঈদ অস্কুট ধ্বনি করে উঠলেন–মকবুলের হত্যাকারী কে, তুমি তা জানো?

নাসেরের মুখে একটা বিকৃত হাসির ঢেউ খেলে গেলো বললো নাসের–স্যার, নিজের চোখে দেখা, কাজেই বলতে আমার কোনো অসুবিধা নেই।

স্তব্ধ নিশ্বাসে তাকিয়ে আছেন আবু সাঈদ আর নীহার ওর ভাবকঠিন মুখখানার প্রতি। এই মুহূর্তে জানতে পারবে তারা মকবুলের হত্যাকারীর নাম। কি ভয়ঙ্কর নরপিশাচ সে, যে ব্যক্তি বৃদ্ধ নাবিকের বুকে ছোরা বিদ্ধ করেছিলো।

বললো নাসের–যাকে আমরা সদ্য মৃত্যুর কবল থেকে উদ্ধার করে আমাদের জাহাজে আশ্রয় দিয়েছি…একটু থেমে বললো আবার সেই নরাধম অকৃতজ্ঞ আলম।

ক্যাবিনে বাজ পড়লেও এতোটা স্তম্ভিত হতেন না আবু সাঈদ ও নীহার। মুহূর্তে মুখ কালো হয়ে উঠলো আবু সাঈদের, বললেন–নাবিক আলম মকবুলের হত্যাকারী–বলো কি!

হাঁ। দৃঢ় কণ্ঠে বলতে চাইলো নাসের কিন্তু গলাটা কেমন ফ্যাসফ্যাসে শোনালো।

মিথ্যা কথা! চিৎকার করে বললো নীহার। তার সমস্ত মুখে ফুটে উঠেছে একটা অবিশ্বাসের ছাপ।

নাসেরের মিথ্যা বলা অভ্যাস–তবু সেদিনের আলমের যে দুর্দান্ত রূপ সে লক্ষ্য করছিলো, তার নামে এতোবড় একটা জলজ্যান্ত মিথ্যা বলতে একটু ভড়কে গেলো বইকি, তবু বললো– শুধু আমিই নই, শম্ভু নিজেও দেখেছে।

শম্ভু! আমাদের লাঠিয়াল সর্দার শম্ভু?

হা। জবাব দিলো নাসের।

আবু সাঈদ তার জাহাজে শুধু পর্যটকগণকেই সাদরে গ্রহণ করেননি, তাঁর জাহাজে সবরকম ব্যক্তিই তিনি গ্রহণ করেছেন। বাবুর্চি থেকে লাঠিয়াল, তীরন্দাজ, বন্দুকধারী, সবরকম লোক আছে। কারণ তাকে পর্যটক হিসেবে নানা দেশে নানা স্থানে অবতরণ করতে হয়। কখন কোন্ বিপদ আসে বোঝা মুস্কিল, এজন্যই তিনি সতর্কতার সঙ্গে সাবধানতা রক্ষা করে চলেন। শুধু শম্ভুই নয়, আরও বেশ কতকগুলো শক্তিশালী লোককে তিনি মোটা বেতন দিয়ে নিজেদের রক্ষাকারী হিসাবে জাহাজে রেখেছেন। এরা শুধু বসে বসে মনিবের খাদ্য গলধঃকরণ করবে আর মাস শেষে বেতনের টাকা পকেটস্থ করবে। কাজ বিপদ কালে, অন্যসময় নয়।

অবশ্য আবু সাঈদ পূর্বে এমন সাবধান ছিলেন না, তিনি বিনা অস্ত্রে ও দেশ পর্যটন করেছেন কতবার। কিন্তু একবার তিনি একটা অদ্ভুত দেশে গিয়ে হাজির হয়েছিলেন, যেখানে আবু সাঈদ পর্যটক হিসাবে সমাদর না পেয়ে পেয়েছিলেন নানারকম বাধা-বিপত্তি। এমনকি সে দেশের বাসিন্দাগণ ভীষণভাবে আক্রমণ করে আহত করেছিলেন তাঁকে এবং তার কতকগুলো সঙ্গী সাথীকে। দু’জন নিহতও হয়েছিলো সেবার। তাছাড়া আরও কতবার যে কত বিপদের সম্মুখীন হতে হয়েছে আবু সাঈদকে, তার ইয়ত্তা নেই। কাজেই আবু সাঈদ আত্নরক্ষার জন্য সবরকম জাহাজে অস্ত্রশস্ত্র এবং বেশ কিছুসংখ্যক বলিষ্ঠ লোক রাখতেন।

শম্ভু আবু সাঈদেরই লাঠিয়াল বিভাগের একজন সর্দার।

আবু সাঈদ বললেন–শম্ভুও দেখেছে?

 বাইরেই আছে সে, আমি ডাকছি। উচ্চকণ্ঠে ডাকলো নাসের–শম্বু!

 আজ্ঞে? জবাব এলো ক্যাবিনের দরজার ও পাশ থেকে।

এসো। বললো নাসের।

ভীমকায় লাঠিয়াল সর্দার শম্ভু প্রবেশ করলো নতমুখে ক্যাবিনের মধ্যে। লম্বা একটা ছালাম ঠুকে সোজা হয়ে দাঁড়ালো।

যেন সে আদালতের বিপক্ষপাতী সাক্ষী।

আবু সাঈদ পুনরায় আসন গ্রহণ করলেন। তিনি নাসেরের মুখে আলম হত্যাকারী কথাটা শুনে উঠে পড়েছিলেন আসন গ্রহণ করে বললেন–শম্ভু মকবুলের হত্যা সম্বন্ধে তুমি কিছু জানো?

অপরাধীর দৃষ্টি নিয়ে তাকায় শম্ভু আবু সাঈদের মুখে, তারপর দৃষ্টি নত করে নিয়ে বলে–হাঁ, আমি দেখছি হুজুর।

দেখেছো! আলম…নাবিক আলম মকবুলকে হত্যা করেছে, তুমি দেখেছো?

পিতার সঙ্গে সঙ্গে নীহারের দৃষ্টিও স্থির হয় শম্ভুর মুখের উপর। নীহারের নিশ্বাস দ্রুত বইছে। যা শুনছে সম্পূর্ণ যেন অস্বাভাবিক এবং মিথ্যা। নাবিক আলম কেন হত্যা করবে বৃদ্ধ নাবিক মকবুলকে ভেবে পায় না সে। বুকের মধ্যে একটা তীব্র আলোড়ন শুরু হয়েছে তার।

শম্ভু একবার নাসেরের মুখে তাকিয়ে দেখে নিলো, চোখ মিলালো দু’জনা, তারপর বললো সে হুজুর, আমি নিজের চোখে…

কঠিন কণ্ঠে গর্জে উঠলো নীহার–খবরদার, মিথ্যা কথা বলো না।

 মিথ্যা–না না, মিথ্যা বলব না মেমসাহেব। যা দেখেছি–যা দেখেছি–আমি ঠিক তাই বলবো।

কি দেখেছোবলো? বললেন আবু সাঈদ।

শম্ভু তার বক্তব্য পেশ করবার পূর্বে একবার ক্যাবিনের দরজার দিকে সতর্ক দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। যার সম্বন্ধে বলতে যাচ্ছে, সে যদি হঠাৎ এসে পড়ে তাহলে বিভ্রাট ঘটা অস্বাভাবিক নয়। সেদিন শম্ভু তার কিছুটা পরিচয় পেয়েছে। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে তার মুখের কাছে হাত নিয়ে একটু কেশে গলাটা পরিস্কার করে নিলো, তারপর বললো–আলম আর মকবুল মিয়ার মধ্যে কি যেমন কথা নিয়ে তর্ক হচ্ছিলো। হঠাৎ একটা গোঙ্গানির শব্দ শুনতে পেয়ে আমরা ছুটে যাই…আবার একবার নাসেরের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় হলো শম্ভুর কিন্তু কণ্ঠ বন্ধ হয় না, বলেই চলে সে–আমরা ছুটে গিয়ে দেখতে পাই–মকবুলের দেহটা মেঝেতে পড়ে রয়েছে, ওর বুক থেকে রক্ত ঝরছে– আলমের হাতে একখানা সূতীক্ষ্ণ ধার ছোরা…।

শম্ভু যখন কথাগুলো বলছিলো তখন কণ্ঠ যেন কেমন আটকে আসছিলো তার। মনে মনে। নাসের ওর কথায় রাগান্বিত হচ্ছিলো, শম্ভুর কথা শেষ না হতেই বললো নাসের–ওর পূর্বেই আমি ক্যাবিনে প্রবেশ করেছিলাম। স্যার, আমি নিজের চোখে দেখেছি, আলম মকবুলের বুক থেকে ছোরাখানা টেনে তুলে নিচ্ছে। নাবিক আলমই ওকে হত্যা করেছে স্যার।

নীহার তীব্র কণ্ঠে বলে উঠলো–আব্বা, নাসের সাহেব যা বলছেন–সম্পূর্ণ মিথ্যা। কারণ। মকবুলের বুকে ছোরার আঘাত ছিলো না, আঘাত ছিলো পিঠে অথচ উনি বলছেন মকবুলের বুক থেকে নাবিক আলমকে তিনি ছোরা তুলে নিতে দেখেছেন।

নীহারের কথায় একটু ভড়কে যায় নাসের, দ্রুত বলে উঠে–সরি, বলতে একটু ভুল হয়েছে, মানে আমি ঠিক লক্ষ্য করতে পারিনি, মকবুলের রক্তাক্ত দেহের দিকে তাকিয়ে আমি জ্ঞানশূন্যের মত দিশেহারা হয়ে পড়েছিলাম। নীহার পুনরায় বলে উঠলো–এমনও তো হতে পারে কেউ মকবুলকে ছোরাবিদ্ধ করেছিলো, আলম তাকে বাঁচানোর জন্য ছোরাখানা তার দেহ থেকে টেনে তুলে ফেলছে–সেই মুহূর্তে আপনারা সেখানে গিয়ে হাজির হয়েছেন।

নাসেরের সঙ্গে পুনরায় দৃষ্টি বিনিময় হলো শম্ভুর।

বললো নাসের–এ জাহাজে মকবুল মিয়ার সঙ্গে কারো কোনোরকম দুশমনি ছিলো না। সরল স্বাভাবিক নাবিক ছিলো সে। জাহাজের ছোট বড় সবাই তাকে ভালবাসতো। স্যার, আপনি বলুন, অন্য কেউ কেন তাকে হত্যা করবে?

বললেন আবু সাঈদ–আর নাবিক আলমই বা তাকে হত্যা করতে যাবে কেন? তার সঙ্গে কোনোরকম প্রতিহিংসা ছিলো বলে মনে হয় না আমার।

স্যার, আপনি একটু গভীরভাবে চিন্তা করলেই বুঝতে পারবেন ব্যাপারখানা।

তার মানে? বললেন আবু সাঈদ।

ব্যাপারখানা অত্যন্ত স্বাভাবিক স্যার, শুধু আমি আর শম্ভুই নয়, জাহাজের অনেকেই জানে– নাবিক আলম এ জাহাজে আশ্রয় পাবার পর থেকে তার মনোভাব, সে হেড নাবিকের পদে বহাল হয় এবং সেই কারণেই দিবারাত্র অবিশ্রান্ত খাটুনি করে সকলের মন জয় করে নেবার চেষ্টা করে– বিশেষ করে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করাই ছিলো তার মূল উদ্দেশ্য। কিন্তু সে শেষ অবধি বুঝতে পেরেছিলো, মকবুল মিয়া থাকা পর্যন্ত হেড নাবিক পদে বহাল হবার তার কোনো আশা নেই। কাজেই মকবুল মিয়াকে সরাতে না পারলে…

নাসের সাহেব, আপনি যা বলছেন সে ধরনের লোক নয় আলম। সে কখনো হেড নাবিক হবার জন্য লালায়িত ছিলো না। নীহার রুদ্ধ কণ্ঠে কথা কয়টা বললো।

নাসের নীহারের কথায় ভিতরে ভিতরে ভীষণ রাগান্বিত হলেও নিজেকে সংযত রেখে শান্ত কণ্ঠে বললো–তার যদি হেড নাবিক হবার সাধই না থাকতো সে নিজে যেচে মকবুলের কাজ করতে এগিয়ে যেতো না। এতেই বোঝা যায়, সে লালায়িত ছিলো কিনা।

আবু সাঈদ বললেন এবার–নাসের তুমি ভুল বলছো। কারণ আলমকে আমিই সেধে তবে হেড নাবিকের কাজ দিয়েছি, সে কখনো হেড নাবিক হতে চায়নি বা সে জন্য কোনো বেশি পারিশ্রমিক গ্রহণ করতেও রাজি নয়।

নাসের ব্যঙ্গপূর্ণ হাসি হাসলো, বললো আবার–বেশ, যা ভাল মনে করেন সেই ভালো। পুনরায় যেদিন আবার মহা অঘটন ঘটবে তখন দেখবেন আমার কথা মনে পড়বে।

আবু সাঈদ বললেন–তোমরা এতগুলো আমার হিতৈষী আপন জন থাকতে একা আলমের সাধ্য কি সে কোনো অঘটন ঘটায়। তোমরা এখন যেতে পারো নাসের। পর্যটন’ যতদিন না স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেছে ততদিন আমাকে ধৈর্য সহকারে অপেক্ষা করতেই হবে।

এরপর নাসের আর শম্ভু দাঁড়াতে পারে না, বেরিয়ে যায় ধূর্ত শিয়ালের মত লেজ গুটিয়ে।

নীহার ওদের চলে যাওয়ার পর পিতাকে লক্ষ্য করে বলে–আব্বা, ওদের কথা তুমি কখনো বিশ্বাস করো না। বেচারী আলম সত্য ও মহৎ ব্যক্তি।

হা মা, ওকে আমার ভাল লাগে, আহা বড় গরীর বেচারী! যেমন সরল তেমনি অমায়িক। গরিবের ঘরে জন্মালেও চেহারাটা যেমন সম্ভ্রান্ত ঘরের সন্তানের মত।

পিতার মুখে নাবিক আলমের প্রশংসা বাণী যেন নীহারের কানে মধুবর্ষণ করে। মাথা নিচু করে নিজের মনের দুর্বলতা গোপন করার চেষ্টা করে সে।

*

দীর্ঘ কয়েক ঘন্টা ইঞ্জিনে কাটানোর পর ছুটি পেয়ে বেরিয়ে এলো বনহুর। সমস্ত দেহ তেল কালি মাখা, হাতে একটি কালি মাখা রুমাল। ঘর্মাক্ত দেহটা জুড়িয়ে নেবার জন্য ডেকের রেলিং এর ধারে এসে দাঁড়ালো সে। রেলিং-এ ভর দিয়ে তাকিয়ে রইলো ফেনিল ঘোলাটে জলরাশির দিকে।

সাগরের মুক্ত বাতাসে অল্পক্ষণেই ক্লান্তি দূর হলো কিন্তু তখন বনহুরের মনের আকাশ একটা দুর্দমনীয় চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে এসেছে। নূরীর অন্তর্ধান নিয়ে গভীরভাবে ভেবে চলেছে সে। নূরীর আশা হয়তো এবার তাকে চিরদিনের মত ত্যাগ করতে হবে। আর কোনোদিন ওকে পাবে বলে মনে হয় না। সাগরের পানিতে যেন ওর করুণ মুখখানাই ভাসছে। কলকল ছলছল ধ্বনির মধ্যে সে যেন শুনতে পাচ্ছে নূরীর আকুল কণ্ঠের ক্রন্দনের শব্দ। বনহুরের চোখ দুটো অশ্রু ভারাক্রান্ত হয়ে উঠে।

আলম, তুমি কি ভাবছো?

একি, মেম সাহেব আপনি?

নীহার বনহুরের পাশে ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়ায়, বলে–হাঁ, কি ভাবছিলে আলম?

বনহুর হাতের পিঠে চোখ দুটো মুছে নিয়ে সোজা হয়ে বলে–গত জীবনের কথা স্মরণ। হচ্ছিলো তাই…

তাই খুব দুঃখ হচ্ছিলো মনে বুঝি?

 বনহুর নিশ্চুপ থাকে।

নীহার বলে আবার–সমস্ত দিন ইঞ্জিনের গনগনে বয়লারের পাশে কাটাও–খুব কষ্ট হয়, তাই না?

না মেম সাহেব।

আলম, তুমি না বললেও আমি বুঝি–সব বুঝি। আলম?

বলুন মেম সাহেব।

তুমি আর এতো কষ্ট করতে পারবে না। আব্বাকে বলে আমি তোমার জন্য কাজ জুটিয়ে দেবো। মাইনেও বাড়িয়ে দেবো, বুঝলে?

কিন্তু আমি তো নাবিকের কাজ ছাড়া অন্য কোনো কাজ জানি না। মেম সাহেব, আপনি আমার জন্য কিছু ভাববেন না। ইঞ্জিনের কাজে আমার কোনো কষ্ট হয় না।

কি যে বলো! এইতো গোটাদিন পর সবে ছুটি পেলে। চেয়ে দেখো দেখি কি অবস্থা হয়েছে তোমার দেহটার।

বনহুর নিজের দেহটার দিকে একবার তাকিয়ে দেখে নিয়ে হাসবার চেষ্টা করে বলে গরিবের আবার দেহ!

নীহার এতোবেশী সরে এসেছে যে, তার দেহের একটি মিষ্ট গন্ধ বনহুরের নাসিকায় প্রবেশ করছিলো। একটা উগ্র মিষ্ট গন্ধ, চুলগুলো বাতাসে উড়ছে ওর। আঁচলখানা বার বার সরে যাচ্ছিলো। বুকের উপর হতে। বনহুর বললো–চলুন মেম সাহেব, আপনাকে ক্যাবিনে পৌঁছে দিয়ে আসি।

একটু অপেক্ষা করো আলম, কথা আছে তোমার সঙ্গে।

 কথা! আমার সঙ্গে?

হাঁ। তোমার সঙ্গে। আলম, জানো এ জাহাজে তোমার কয়েকজন শত্রু আছে? তারা তোমাকে সর্বক্ষণ বিপদে ফেলার জন্য উনুখ।

আমি তো কোনো অপরাধ করিনি?

শয়তানদের কাছে কোনো অপরাধ করতে হয় না আলম, তারা পরের ভালো দেখতে পারে না। তোমার গুণটাই হলো ওদের ঈর্ষার কারণ। আব্বা তোমার কাজ অনেক পছন্দ করেন তাই…

হাসে বনহুর।

নীহার অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে তার মুখের দিকে। বনহুর ফিরে তাকায়, ওর সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় হতেই দৃষ্টি নত করে নেয় নীহার। বুদ্ধিদীপ্ত অন্তর্ভেদী যেন সে চোখ দুটি। নীহার কোনো কথা বলতে পারে না সহসা।

বনহুর নীহারের মনের দুর্বলতা উপলব্ধি করে, বুঝতে পারে–নীহার তার মনের আসনে প্রতিষ্ঠিত করে নিয়েছে তাকে–কিন্তু এ তার কত বড় ভুল জানে না! বনহুর নীহারের মুখে স্থির দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকে। দেখতে চায় সে, ওর মায়ামমতায় ভরা সুন্দর অন্তরটাকে। যে অন্তর ফুলের চেয়েও পবিত্র, জ্যোছনার আলোর চেয়েও স্নিগ্ধ, শিশিরের চেয়েও সচ্ছ।

বনহুর নিষ্পলক নয়নে তাকিয়ে আছে নীহারের সুন্দর মুখমন্ডলের দিকে।

নতমুখে দাঁড়িয়েছিলো নীহার; চোখ তুললো–পুনরায় বনহুরের সঙ্গে চোখাচুখি হলো। নীহারের মনের মধ্যে একটা আনন্দের অনুভূতি বিদ্যুতের মত খেলে গেলো। লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠলো ওর গন্ড দু’টি। আর দাঁড়াতে পারলো না সে বনহুরের সম্মুখে, একটু হেসে দ্রুত চলে গেলো সেখান থেকে।

বনহুর প্যান্টের পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ধরলো, ঠিক সেই সময় নাসেরের সঙ্গে শম্ভু, জম্বু আর জলিল এসে দাঁড়ালো। লাঠিয়ালদের আর একজন হলো জলিল।

সেদিন শম্ভু আর জম্বুর মুখে তাদের নাকানি চুবানির কথা শুনে জলিল পাহলওয়ান ক্ষেপে গেলো ভীষণভাবে। একটা সামান্য নাবিক বেটার কাছে তারা এতো বড় বড় শক্তিশালী জোয়ান লোক হয়ে হুমড়ি খেলো! ছিঃ ছিঃ কি লজ্জার কথা! জলিল স্বয়ং সুযোগ বুঝে তাদের সঙ্গে এসেছে, আজ সে একাই দেখে নেবে নাবিক আলমকে।

শম্ভু আর জম্বুর চেয়ে জলিলের দেহ আরও বলিষ্ঠ। দেহের বিশিষ্ট বিশিষ্ট অংশের মাংশপেশীগুলো যেন লৌহপিন্ডের মত শক্ত আর দলা হয়ে রয়েছে। খাড়াখাড়া এক জোড়া গোঁফ ক্ষুদে গোল গোল লাল চোখ! আকারে লম্বা নয়, বেটে গোছের চেহারা।

নাসের সম্মুখে আর ওরা তিনজন বনহুরের তিন পাশে দাঁড়ালো। এক একজনের চোখ দিয়ে যেন অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নির্গত হচ্ছে। হিংস্র জন্তু শিকারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বার পূর্বে যেমন ভীষণ আকার ধারণ করে তেমনি ভয়ঙ্কর রূপ নিয়ে শম্ভু, জম্বু আর জলিল এসে দাঁড়ালো।

বনহুর সিগারেটে সবেমাত্র অগ্নিসংযোগ করেছে, মুখের কাছ থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে একবার দৃষ্টি বুলিয়ে নিলো ওদের চারজনার মুখে, ঠেস দিয়ে দাঁড়ালো রেলিং এ। সিগারেট থেকে একমুখ ধুয়া টেনে নিয়ে সম্মুখে ছুঁড়ে দিলো নিশ্চিন্ত মনে। সিংহ যেমন ক্রুদ্ধ শিয়ালের দিকে অবহেলা করে তাকিয়ে দেখে তেমনি শান্ত ভাব নিয়ে তাকালো।

বনহুরের তাচ্ছিল্য ভাব দেখে নাসের এবং তার সঙ্গীদের দেহ জ্বালা করে উঠলো। ক্রমান্বয়ে ফুলে উঠতে লাগলো শম্ভু, জম্বু আর জলিলের মাংসপেশীগুলো।

জাহাজের এদিকটা সম্পূর্ণ নির্জন, আশেপাশে বা অনতিদূরে কেউ নেই। বনহুর কাজ শেষে প্রায়ই এই পাশে এসে দাঁড়াতে নিরালায় গভীরভাবে চিন্তা করার অবকাশ পেতো সে।

আজও তাই প্রতিদিনের মত কাজ শেষ করে এখানে এসে দাঁড়িয়েছে। ইঞ্জিন কামরায় এখন অন্যজনের ডিউটি আছে তাই সে কতকটা নিশ্চিন্ত। অবশ্য কয়েক ঘন্টা পর আবার তাকে যেতে হবে ইঞ্জিন কামরায়।

বনহুর ওদের দেখেও যেন দেখছে না, এমনি ভাব নিয়ে সিগারেট পান করছিলো।

জলিল হঠাৎ চেপে ধরলো বনহুরের গলার কাছের জামাটা। কর্কশ কণ্ঠে বললো–ঘুঘু দেখেছো ফাঁদ দেখোনি, বাছাধন!

বনহুর দক্ষিণ হস্তের সিগারেটটা নিক্ষেপ করলো, তারপর সঙ্গে সঙ্গে প্রচন্ড এক ঘুষি বসিয়ে দিলো জলিলের নাকে।

অমনি হুমড়ি খেয়ে পড়লো জলিল ডেকের মেঝেতে।

কালবিলম্ব না করে শম্ভু, জম্বু আর নাসের চেপে ধরলো বনহুরকে। জলিলও ততক্ষণে উঠে এসে ধরেছে, বনহুরের মুখমন্ডল লক্ষ্য করে ঘুষি মারলো জলিল। বনহুর দক্ষিণ হস্তে জলিলের মুষ্ঠিবন্ধ হাতখানা চেপে ধরলো এটে। বনহুর এবার এক ঝটকায় ওদের তিনজনার কবল থেকে নিজকে মুক্ত করে নিয়ে রুখে দাঁড়ালো। তারপর শুরু হলো ভীষণ লড়াই। এক এক ঘুষিতে এক একজনকে ভূতলশায়ী করতে লাগলো। প্রচন্ড এক লাথি দিয়ে কাবু করে ফেললে জলিলকে। বনহুরের বুটের লাথি যেয়ে লেগেছিলো ঠিক জলিলের তলপেটে।

পেট ধরে কুকড়ে বসে পড়লো জলিল, একটা গোঙানি বেরিয়ে এলো জলিলের মুখ দিয়ে।

শম্ভু আর জম্বু জলিলের অবস্থা দেখে একটু ভড়কে গেলেও বনহুরের উপর ঠিকভাবেই আক্রমণ চালিয়ে চললো। নাসের হাঁপিয়ে পড়েছে, বনহুরের এক ঘুষি লেগে দাঁত দিয়ে রক্ত ঝরছে। বুকেও লেগেছে একটা মুষ্ঠাঘাত। পাল্টা আক্রমণের সাহস হচ্ছে না তার! রুমালে দাঁতের রক্ত মুছছে বার বার।

বনহুর বজ্রমুষ্ঠিতে শম্ভু আর জম্বুকে নাজেহাল করে ফেললো, অল্পক্ষণেই লড়াই-এ সাঙ্গ দিয়ে। পালাচ্ছিলো ওরা। জলিল উঠে দাঁড়াতে পারছিলো না তলপেট চেপে ধরে বসেছিলো উবু হয়ে। নাসের তীব্র কটাক্ষে ক্রুদ্ধভাবে বনহুরের দিকে তাকিয়ে জলিলকে ধীরে ধীরে নিয়ে চললো।

বনহুর হেসে উঠলো হা হা করে, তারপর ফিরে গেলো নিজের কেবিনে!

*

নীহার আর আবু সাঈদ সম্মুখ ডেকে দাঁড়িয়ে প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করছিলো। একটু পূর্বে নীহার আলমের নিকট হতে চলে এসেছে। তখনও তার মনে আলমের সুন্দর হাসির প্রতিচ্ছবি মিশে যায়নি। ওর মিষ্টি গাম্ভীর্যপূর্ণ কণ্ঠের প্রতিধ্বনি তখনও ভাসছে তার কানে। সন্ধ্যাটা যেন। পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে নীহারের কাছে।

পিতা-পুত্রী মিলে নানারকম কথাবার্তা চলছিলো।

সন্ধ্যার অন্ধকার এখনও জমাট বেঁধে উঠেনি, ডেকের বিজলী বাতিগুলো জ্বলে উঠেছে বটে কিন্তু আলোর দ্যুতি এখনও আত্নপ্রকাশে সক্ষম হয়নি।

উন্মত্ত হাওয়া বইছে।

 নীহারের কাছে সব আজ স্বপ্নময় মনে হচ্ছে। উচ্ছল জলরাশির দিকে তাকিয়ে আছে সে।

আবু সাঈদ চুরুট পান করছিলেন, গায়ে তার একটা পশমী চাদর জড়ানো। গলায় মাফলার, হঠাৎ একটু ঠান্ডা লাগায় শরীরটা আজ ম্যাস ম্যাস করেছে বলেই নীহারের আব্দারে এসব পরিধান করেছেন তিনি। নইলে বড় একটা শরীরের যত্ন নেন না আবু সাঈদ। নীহারের কাছে এজন্য তাকে অনেক সময় অবাধ্য সন্তানের মত অনেক কথা শুনতে হয়। আজ তাই সাবধানে গলায় মাফলারটা বেঁধে শরীরে চাদর জড়িয়ে ডেকে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। অবশ্য নীহার পূর্বেই তাকে এ ব্যাপারে। সতর্ক করে দিয়েছিলো।

আবু সাঈদ খামখেয়ালী মানুষ হলেও কন্যা নীহারের কাছে খেয়ালী না হয়ে পারতেন না। মেয়ের কাছে তিনি হার মারতেন সব কাজে। এমনকি তার পর্যটক জীবনটাও নীহারের বাধ্যের মধ্যে এসে গিয়েছিলো অনেকখানি।

নীহার যদি বলতো–আব্বা, এবার তোমাকে দক্ষিণ দিকে যেতে হবে, তাই যেতে হতো। যদি বলতো পশ্চিমে–তাই স্বীকার করে নিতেন আবু সাঈদ। তবে নিজের বিবেচনা মত বিদেশ সফরে বের হতেন কিন্তু নীহারের মত না নিয়ে তিনি কোনোদিন পা বাড়াতেন না কোথাও। শুধু তাই নয় যে কোনো কাজে কন্যার পরামর্শ তিনি গ্রহণ করতেন।

আজ ডেকে দাঁড়িয়ে কোনো গুরুত্বপূর্ণ আলাপ-আলোচনা না চললেও পিতা-পুত্রীর মধ্যে মাঝে মাঝে সচ্ছ কথাবার্তা হচ্ছিলো।

এমন সময় কয়েকটি পদশব্দে ফিরে তাকায় পিতা-পুত্রী!

সন্ধ্যার অন্ধকার গাঢ় না হওয়ায় স্পষ্ট দেখতে পেলেন আবু সাঈদ এবং নীহার–কেমন যেন ছন্নছাড়ার মত এলোমেলো বেশে এগিয়ে আসছে কয়েকজন, সর্বাগ্রে নাসের, তার পেছনে শম্ভু ও জন্ধুর কাঁধে ভর দিয়ে এগুচ্ছে লাঠিয়াল সর্দার জলিল।

প্রথম নজরেই নীহারের মুখ কালো হয়ে উঠলো, ভূকুঁচকে তাকালো সে ওদের দিকে।

আবু সাঈদ বিস্ময়ভরা চোখে তাকিয়ে আছেন, চোখেমুখে ফুটে উঠেছে তার উদ্বিগ্নতার ছাপ। ক’দিন পূর্বে মকবুলের হত্যাকান্ডে তিনি ভীত না হলেও আতঙ্কিত হয়েছিলেন কিছুটা। আজকাল সামান্যেই তিনি চমকে উঠেন, একটুতেই বেশি ঘাবড়ে যান যেন।

নাসের এবং তার জাহাজের লাঠিয়ালদের আসতে দেখে কয়েক পা এগুলেন সম্মুখে, ব্যস্তকণ্ঠে বললেন–ব্যাপার কি নাসের?

নাসেরের মুখ শয়তানের মুখের মত কুৎসিত হয়ে উঠেছে যেন। নীহারের দিকে একবার তীব্র কটাক্ষে তাকিয়ে দৃষ্টি স্থির করলো আবু সাঈদের মুখে বললো–করুণা দিয়ে যার প্রাণরক্ষা করা হয়েছে সেই অকৃতজ্ঞ আলম কি করেছে দেখুন।

অবাক কণ্ঠে অস্কুট ধ্বনি করে উঠেন আবু সাঈদ আলম!

হাঁ, ছোটলোকদের বেশি লাই দিলে তারা এমনি হয়। তাছাড়া গরিব বেচারী মকবুলকে হত্যা করে আরও স্পর্ধা বেড়ে গেছে তার।

নীহার তীব্রকণ্ঠে বলে উঠে–ভূমিকা রেখে সোজা কথা বলুন? আলম কি করেছে?

হাঁ কি করেছে সে? বললেন আবু সাঈদ।

নাসের বিশাল বপু জলিলের কাঁধে হাত রেখে সহানুভূতির স্বরে বললো–স্যার, এতোবড় অমানুষিক ব্যবহার, সে জলিল ভাই এবং আমাদের উপর করেছে তা কি বলবো! জলিল ভাই এবং আমরা তিন জন–শম্ভু জন্ধু আর আমি ডেকে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম, সেই সময় নাবিক আলম এসে দাঁড়ালো আমাদের পাশে। একটা কথা নিয়ে সে আমাদের সঙ্গে তর্ক জুড়ে দিলো। কিন্তু তর্কে হেরে গিয়ে ক্ষেপে গেলো সে ভীষণভাবে। স্যার, বেচারী জলিল ভাই ও আমাদের সে নাজেহাল করে ছেড়েছে।

খিলখিল করে হেসে উঠে নীহার, তারপর হাসি থামিয়ে বলে–আলম আপনাদের চারজন বীর পুরুষকে নাজেহাল করে ছেড়েছে? সত্যি তাকে বাহবা দিতে হয়।

নীহারের কথায় লজ্জায়, ক্ষোভে কালো হয়ে উঠে নাসের এবং তার সঙ্গীদের মুখ।

আবু সাঈদ গম্ভীর কণ্ঠে বললেন–তোমরা চারজন অথচ সে একা তোমাদের কাবু করে। ফেললো–আশ্চর্য! তার মুখমন্ডল দীপ্ত হয়ে উঠলো। একটু থেমে বললেন আবু সাঈদ–অমন ব্যক্তিকে সমাদর করতে হয়। নাসের, আজ থেকে তোমরা আলমকে সমীহ করে চলবে, বুঝলে?

এরপর আর দাঁড়াতে পারলো না ওরা, মুখ চুন করে ফিরে চললো নিজেদের ক্যাবিনের দিকে।

নাসের শম্ভু, জম্বু আর জলিল চলে যেতেই বললেন আবু সাঈদ–সত্যি মা, আলম এ জাহাজে আসায় আমাদের বড় উপকার হয়েছে।

কিন্তু তোমার ঐ গুনধরের দল যে তাকে নানাভাবে অপদস্ত করতে চেষ্টা করছে!

অপদার্থ সব!

এতোদিনে বুঝতে পারলে আব্বা।

চলো মা, আলমকে ধন্যবাদ জানিয়ে আসি।

*

বনহুর সবেমাত্র হাত-মুখ পরিস্কার করে ক্যাবিনের খাটিয়ায় দেহটা এলিয়ে দিয়েছে। কেশব তার নিজের খাটিয়ায় বসে আরাম করছিলো–এমন সময় ক্যাবিনে প্রবেশ করেন আবু সাঈদ আর। নীহার।

বনহুর ক্যাপ্টেন আবু সাঈদ ও তার কন্যাকে দেখে শশব্যস্তে উঠে দাঁড়ালো।

কেশবও উঠে পড়লো বনহুরের সঙ্গে।

বনহুর বুঝতে পারলো, নাসের গিয়ে নালিশ জানিয়েছে। সেই কারণে স্বয়ং মালিক এসে। হাজির হয়েছেন কৈফিয়ৎ তলব করতে। বনহুর নতদৃষ্টি তুলে তাকালো মালিকের দিকে। নীহারের সঙ্গেও দৃষ্টি বিনিময় হলো একবার।

বনহুর একটা কঠিন বাক্যের জন্য প্রতীক্ষা করছিলো প্রস্তুতও ছিলো সে জবাব দেবার জন্য। কিন্তু আবু সাঈদ এবং তার কন্যার মুখোভাব লক্ষ্য করে বনহুর একটু আশ্চর্য হয়ে গেলো। পুনরায় চোখ দুটো তুলে ধরলো আবু সাঈদের মুখে।

বিস্ময়কর নিষ্পলক নয়নে তাকিয়ে আছেন আবু সাঈদ।

নীহারের চোখেও অদ্ভুত দৃষ্টি।

বলেন আবু সাঈদ–আলম, তোমাকে ধন্যবাদ জানাতে এলাম।

ধন্যবাদ! অস্ফুট কণ্ঠে বললো বনহুর।

হাঁ, তোমার মত একজনকে পেয়ে সত্যি আমি শুধু গর্বিত হইনি সার্থক হয়েছি।

মাথা চুলকায় বনহুর–স্যার আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।

আলম, নাসেরের মুখে শুনলাম তুমি একা নাকি আমার লাঠিয়ালদের তিনজন জোয়ানকে পরাস্ত করেছে। নাসেরকেও?

বনহুর বিব্রত বোধ করলো, বললো–স্যার, পরাস্ত ঠিক্ নয়। ওদের কবল থেকে আত্নরক্ষা করেছি।

আত্নরক্ষা! তার মানে? বললেন আবু সাঈদ।

ছুটির পর অত্যন্ত গরম বোধ করায় পিছন ডেকে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম, সেই সময় ওরা হঠাৎ আমাকে আক্রমণ করে, তাই আমি সামান্য দু’চারটে উত্তম-মধ্যম দিয়েছিলাম এই যা।

সাবাস আলম। আবু সাঈদ বনহুরের পিঠ চাপড়ে দেন।

নীহারের দিকে দৃষ্টি চলে যায় বনহুরের, অপলক নয়নে সে তাকিয়ে আছে তার দিকে। সে চাহনির মধ্যে ফুটে উঠেছে তার অন্তরের শুভেচ্ছার ছাপ। একটা মিষ্টিমধুর হাসির ক্ষীণ আভা। দেখতে পায় বনহুর নীহারের ঠোঁটের কোণে।

আবু সাঈদ এবার বিদায় হন।

চলে যাবার সময় পুনরায় ফিরে তাকায় নীহার বনহুরের দিকে। বনহুরের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় হয়।

বেরিয়ে যায় ওরা।

কেশব অবাক হয়ে বলে–বাবু, নাসের সাহেব আর লাঠিয়ালরা আপনাকে…

হাঁ, আমাকে ওরা আচমকা আক্রমণ করেছিলো।

আপনি এ কথা মালিককে না জানিয়ে চুপ করেছিলেন! বাবু, আপনারই গিয়ে আগে কথাটা জানানো উচিৎ ছিলো।

আমি জানতাম মালিককে তারাই গিয়ে জানাবে কাজেই আমি নিশ্চুপ ছিলাম।

বাবু, ওরা মিথ্যা সত্য বানিয়ে লাগাতে পারতো তো?

তা নিশ্চয়ই করেছে। কিন্তু সত্য কোনোদিন গোপন থাকে না কেশব! দেখলে তো তার জলজ্যান্ত প্রমাণ। ওরা গিয়ে নালিশ জানালো অথচ মালিক এসে ধন্যবাদ জানিয়ে গেলেন আমাকে।

কেশব এবার খুশীর হাসি হাসলো।

বনহুর ক্লান্ত দেহটা শয্যায় সম্পূর্ণ মেলে দিয়ে একটা সিগারেট ধরালো। গভীর চিন্তায় ডুবে গেলো–ধীরে ধীরে সব কথা বিস্মৃত হয়ে গেলো সে। নূরীর জন্য মনটা ডুকরে কেঁদে উঠলো, না জানি কোথায় সে বেঁচে আছে কি না–তাও সে জানে না।

নূরীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে যায় বনহুর।

 কেশব ঘুমিয়ে পড়ে নিজের বিছানায়।

শয্যা অসহনীয় হয়ে উঠে বনহুরের কাছে, যতই নূরীর কথা স্মরণ হয় ততই মনটা যন্ত্রণায় ছটফট করে উঠে। শয্যা ত্যাগ করে বেরিয়ে আসে ক্যাবিনের বাইরে। আধো অন্ধকারে চুপ করে দাঁড়ায়, স্থির দৃষ্টি ফেলে তাকিয়ে থাকে সাগরবক্ষে সীমাহীন জলরাশির দিকে।

কতক্ষণ কেটেছে কে জানে, হঠাৎ পিছনে একটা নিশ্বাসের শব্দ শুনতে পেয়ে ফিরে তাকায় বনহুর। ডেকের আধো অন্ধকারে স্পষ্ট দেখা না গেলেও বেশ বুঝতে পারলো, তার পিছনে অতি নিকটে দাঁড়িয়ে একটি নারীমূর্তি। বনহুর সোজা হয়ে দাঁড়ালো–মেম সাহেব আপনি!

আরও সরে এলো নীহার, ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়ালো বনহুরের পাশে। চাপা মিষ্টি কণ্ঠে বললো– আলম!

বলুন মেম সাহেব?

এতো রাতেও তুমি ঘুমাওনি কেন?

বনহুর একটা দীর্ঘনিশ্বাস গোপনে চেপে নেবার চেষ্টা করলো; কিন্তু পারলো না, বললো– গোটাদিন বয়লারের পাশে থাকতে হয়, শরীরটা বড় রুক্ষ হয়ে পড়েছে তাই ঘুম আসেনি মেম সাহেব!

আলম!

বলুন!

 তোমার জীবনের কাহিনী আমাকে শোনাবে?

একটা বেদনার হাসি হাসলো বনহুর–আমার জীবন-কাহিনী আপনি শুনতে চান মেম সাহেব?

হ।

কিন্তু সে অনেক দীর্ঘ কাহিনী, আপনার ধৈর্য থাকবে না।

কোথায় তোমার দেশ? কে তোমার পিতা-মাতা? কি করে এলে তুমি নদীবক্ষে? দেশে তোমার কে কে আছে?

আজ নয় মেম সাহেব, একদিন আপনার ক্যাবিনে বসে সব বলবো আপনাকে। চলুন আপনাকে ক্যাবিনে পৌঁছে দিয়ে আসি।

এরপর আর দাঁড়াতে পারে না নীহার, বলে চলো।

নীহার এগুলো।

 বনহুর তার পিছনে চলতে লাগলো।

হঠৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো নীহার, কিছুটা অগ্রসর হবার পর বললো সে–আলম, তোমাকে। দেখতে কিন্তু নাবিক বলে মনে হয় না। তুমি কি ভদ্রঘরের সন্তান?

কেন মেম সাহেব, নাবিক তারা কি মানুষ নয়?

 না, তা বলছি না বলছি তোমাকে নাবিকের কাজ মানায় না আলম! তুমি লেখাপড়া জানো না?

সামান্য কিছু জানি।

 কিন্তু তোমাকে দেখে অনেক বুদ্ধিমান, অনেক জ্ঞানী বলে মনে হয়।

বনহুর মৃদু হাসে।

 নীহার বলে আবার–আলম, তোমার বীরত্বে আমি মুগ্ধ হয়েছি!

 সেজন্য আমি কৃতজ্ঞ মেম সাহেব।

আলম!

আর এখানে বিলম্ব করা ঠিক নয় মেম সাহেব, চলুন।

 চলো।

ক্যাবিনের দরজা অবধি পৌঁছে দেয় বনহুর নীহারকে।

নীহার ক্যাবিনের মধ্যে প্রবেশ করে দরজা বন্ধ করতে গিয়ে স্থির নয়নে একবার বনহুরকে দেখে নেয়।

নীহার দরজা বন্ধ করে দেয়।

বনহুর ফিরে যায় নিজের ক্যাবিনে।

*

ওদিকে জলিলের ক্যাবিনে সমস্ত লাঠিয়াল মিলে গোপন পরামর্শ চলেছে। কেমন করে কাবু করবে নাবিক আলমকে। জীবনে তারা বহু দুষ্ট দুর্দান্ত লোকের সঙ্গে লড়াই করেছে; কিন্তু কারো। কাছে এমনভাবে হেরে যায়নি। আজ একটা সামান্য নাবিকের কাছে তারা যেভাবে নাকানি-চুবানি খেয়েছে, আর অপদস্ত হয়েছে এতে তাদের লাঠিয়াল জীবনে যে কলঙ্কের কালিমা পড়েছে, তা কোনোদিন মুছে যাবে না। বিশেষ করে জনাব আবু সাঈদ নাবিক আলমের পক্ষ হয়ে তাদের যা অপমান করেছেন, এর প্রায়শ্চিত্ত না করা পর্যন্ত তাদের স্বস্তি নেই।

এ দলে শুধু লাঠিয়ালগণই ছিলো না, ছিলো নাসের এবং তার কয়েকজন অনুগত বন্ধু স্থানীয়। জন।

নাসের একটা চেয়ারের হ্যান্ডেলে অর্ধ দন্ডায়মানভাবে ঠেশ দিয়ে বসে ছিলো। কেউ বা মেঝেতে বসে, কেউ বা দাঁড়িয়ে কেউ বা দড়ির খাটিয়ায় অর্ধশায়িত অবস্থায় শুয়ে আলাপ আলোচনা করছিলো।

ক্যাবিনের স্বল্প পাওয়ারের বাল্বের আলোতে এক-একজনের বন্য পশুর মতই লাগছিলো। চোখগুলো জুলছিলো ক্ষুধিত ব্যাঘের মত।

জলিল দড়ির খাটিয়ায় শায়িত। জাহাজের ডাক্তার বলেছে সম্পূর্ণ দুটো দিন শয্যায় শুয়ে থাকতে। এখনও তলপেটের ব্যথা সেরে যায়নি। জোরে কথা বলতেও কষ্ট হয় তার। কাজেই বাধ্য হয়ে শুয়ে আছে জলিল। তাই বলে মোটেই সে নীরব ছিলো না, মাঝে মাঝে দাতে দাঁত পিষে বলছিলো–যতক্ষণ ওকে শায়েস্তা করতে না পেরেছি ততক্ষণ আমি স্বস্তি পাবো না। শপথ। করছি, নাবিক আলমকে আমি সাগরের পানিতে ডুবিয়ে মারবো তবেই আমার নাম জলিল মিয়া। ৭০২ )

নাসের সম্মুখের টেবিলে মুষ্টিঘাত করলো–আমি ওকে নিঃশেষ না করে নিশ্চিন্ত হবো না। মালিকের ভালোবাসাই শুধু সে জয় করে নেয়নি; আমার ভাবী পত্নী নীহারের মনেও সে আসন। গেড়ে নিয়েছে।

শম্ভু বলে উঠলো–ঠিক বলেছেন ছোট স্যার, মেম সাহেব একেবারে ঐ নাবিক ছোকরার প্রেমে পড়ে গেছেন। দেখলেন না, কেমন ওর হয়ে কড়া কথা শোনালো?

হু কিন্তু জানেন, নাসের কড়া কথা হজম করবার লোক নয়। একদিনে আমি ঘুচিয়ে দেবো না। প্রেমের লীলা খেলা!

শম্ভু বললো–হুঁজুরের হুকুমে আমরা সব পারি। একদিন বেটা আমাদের কাবু করেছে কিন্তু অমন আরও কতদিন বাকী আছে। বেটাকে একেবারে পরপারে পাঠিয়ে তবে ছাড়বো।

আস্তে বলল, কেউ শুনে ফেলবে! বললো আর একজন।

নাসের বললো–শুনলো তো বয়েই গেলো। এবার বাড়াবাড়ি করলে শুধু আলম বেটাকেই নয়, স্যারকেও শায়েস্তা করে নেবো।

ক্যাবিনের মধ্যে যখন নানারকম আলাপ-আলোচনা চলছিলো, তখন ক্যাবিনের পিছনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একজন সব শুনছিলো। সে অন্য কেউ নয়–স্বয়ং দস্যু বনহুর। নীহারকে তার ক্যাবিনে পৌঁছে দিয়ে নিজ ক্যাবিনেই চলে গিয়েছিলো সে। হঠাৎ মনে পড়লো একবার জাহাজের পিছন দিকটা দেখে আসা ভালো। কারণ ঐ দিকেই জলিলের গোপন আড্ডা বসে। বিশেষ করে নিজের চেয়ে সে এখন বেশি চিন্তিত আবু সাঈদের জন্য। সন্ধ্যায় আবু সাঈদ ঠিক তার হয়ে ওদের হয়তো কোনো গালমন্দ করেছেন, কাজেই শয়তানের দল ক্ষেপে যেতে পারে। কোনো শলা-পরামর্শ যে চলেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বনহুর শয্যাগ্রহণ করতে গিয়ে করতে পারেনি, চলে এসেছে সে ডেকের শেষ অংশে, যেখানে রয়েছে লাঠিয়ালদের বিশ্রাম কামরা।

নাসেরের শেষ কথা শুনে বনহুরের হস্তদ্বয় মুষ্টিবদ্ধ হলো। যার জাহাজে বসে দিব্য ফুর্তি চালাচ্ছে, তাকে হত্যার পরামর্শ। কি ভয়ঙ্কর লোক এরা! বনহুর নিজের জন্য বিশেষ চিন্তিত নয়, কারণ তাকে কাবু করা নাসেরের দলের কাজ নয়। চিন্তিত হলো সে জাহাজের মালিক ক্যাপ্টেন আবু সাঈদের জন্য।

বনহুর যখন ভাবছে তখন পুনরায় শোনা গেলো জলিলের কণ্ঠ–ছোট স্যার, আমাকে সুস্থ হয়ে উঠতে দিন।

হাঁ, তোমার সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত আমরা অপেক্ষা করবো। দেখো জলিল, স্যার যা মাহিনা দেন তার ডবল দেবো আমি। এ জাহাজ আমার হবে, এ জাহাজের মাল-মসলা আমার হবে। নীহার হবে আমার–তখন তোমরা যা চাইবে তাই পাবে, বুঝলে?

ছোট স্যার, জানি বলেই তো আমরা আপনার কথামত এ জাহাজে এসেছি। আর আপনার কথাকে বিশ্বাস করেই আমরা ধৈর্য্য ধরে আছি।

জলিল আমাকে বিশ্বাস করো, আমি তোমাদের খুশি করতে কোনোরকম দ্বিধা করবো না। শুধু একটি বাধা ছিলো মালিককে সরানোর ব্যাপার, এখন তার চেয়ে আর একটা বড় মসিবৎ হলো ঐ ছোট লোক বেটা নাবিক আলম। এ জাহাজে ও আসার পর শুধু মালিক নয়, মালিকের মেয়েটাও ওকে ভালোবেসে ফেলেছে….

শুধু ভালোবাসা নয় ছোট স্যার, মেম সাহেব তার প্রেমে ডগমগ আর কি। নাসেরের কথার মাঝখানে বললো শম্ভু।

জন্ধু বললো–ছোকরার রূপটাই সব মাটি করে দিয়েছে ছোট স্যার। বেটা ছোটলোকের ছেলে কিন্তু দেখেছেন তার চেহারাটা?

ঐ তো হলো সব। না হলে নীহারের মত ধনবানের শিক্ষিতা কন্যা একটা ভিখারী নাবিককে দেখে মুগ্ধ হয় আর তার পিছু লাগে!

বনহুর আড়ালে দাঁড়িয়ে হাসে। দীপ্ত স্ফীত হয়ে উঠে তার সমস্ত মুখমন্ডল।

*

কয়েক ঘন্টা পর নাবিক আলমের ডিউটি রয়েছে ইঞ্জিনে। আলম এখন তার শয্যায় শুয়ে ঘুমাচ্ছে। যত চিন্তা আর অশান্তিই থাক নিদ্রাদেবীর কোমল স্পর্শে সব কিছু থেকে বিস্মৃতির পথে সরে এসেছে সে।

এখানে যখন নাবিক আলম মানে দস্যু বনহুর নিদ্রায় মগ্ন, ঠিক তখন জাহাজের মিস্ত্রী কানাই লালের শয্যার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো নাসের পিছনে তার জলিল, শম্ভু আর জম্বু জম্বু আর শম্বুর হস্তে ছোরা, নাসের আর জলিলের হাতে পিস্তল।

জলিল এখন সুস্থ হয়ে উঠেছে। তিন দিন তাকে শয্যায় শুয়ে থাকতে হয়েছিলো সেদিন নাবিক আলমের বুটের লাথি খেয়ে। প্রতিহিংসার বহ্নিজ্বালায় জলিলের হৃৎপিণ্ড জ্বালা করছে ভীষণভাবে। যেমন করে লোক ওকে নিঃশেষ না করা পর্যন্ত স্বস্তি নেই তার। শুধু জলিলের নয়, নাসের এবং জম্বুর রাগও অত্যন্ত তীব্র হয়ে উঠেছে। আলমকে হত্যার নেশায় উন্মত্ত হয়ে উঠেছে ওরা।

বনহুর যখন নিশ্চিন্ত মনে নিদ্রায় মগ্ন তখন তাকে নিয়ে নাসেরের দলের গভীর আলোচনার অন্ত নেই। ওর সঙ্গে সাক্ষাৎ লড়াই-এর সাহস কারো নেই, কিন্তু কৌশলে ওকে শায়েস্তা করতে হবে।

নাসের জাহাজের প্রধান মিস্ত্রী কানাই লালের কামরায় প্রবেশ করলো–সঙ্গে জলিল, শম্ভু আর জস্তু রয়েছে। জলিল এসে কানাই লালের মুখের চাদর সরিয়ে ফেললো।

সঙ্গে সঙ্গে নিদ্রা ছুটে গেলো কানাই লালের, দড়বড় উঠে বসে তাকালো, নিজের চোখকে। প্রথমে বিশ্বাস করতে পারলো না–নাসেরের হস্তে উদ্যত পিস্তলের উপর তার প্রথম নজর পড়লো।

ভয়বিহ্বল দৃষ্টি নিয়ে তাকালো কানাইলাল নাসেরের মুখে। তারপর দৃষ্টি তার চলে গেলো নাসেরের পিছনের শম্ভু এবং জম্বুর হস্তে সুতীক্ষ্ণ ছোরাগুলোর উপর। কানাই-এর মুখ হা হয়ে উঠে, ফ্যাল ফ্যাল চোখে তাকিয়ে বললো–ছোট স্যার!

হাঁ আমি। কানাইলাল, জরুরি একটা কাজে তোমার কাছে এলাম, যদি আমার কথায় রাজি না হও তাহলে মকবুলের মত তোমার অবস্থাও হবে।

কানাইলাল বেতসপত্রের মত থর থর করে কাঁপতে শুরু করেছে। তার অসহায় চোখ দুটো আর একবার ঘুরে এলো জলিল, শম্ভু আর জম্বুর হস্তস্থিত অস্ত্রগুলোর উপর দিয়ে। ঢোক গিয়ে বললো–কি কাজ আমাকে করতে হবে বলুন ছোট স্যার?

কানাইলাল উঠে দাঁড়ায় শয্যা ত্যাগ করে। হাতের মধ্যে হাত কচলায় সে। বলির পূর্বে মেষশাবকের যেমন অবস্থা হয় তেমনি হয় ওর অবস্থা।

নাসের কঠিন চাপাকণ্ঠে বলে উঠে–জাহাজ এখন চলছে, ইঞ্জিন ক্যাবিনে আছে ফারুক আলী। ওকে কিছুক্ষণের জন্য সরিয়ে নিচ্ছি, সেই মুহূর্তে ইঞ্জিনের মেইন মেশিন তোমাকে নষ্ট করে দিতে হবে।

জাহাজের মেইন মেশিন নষ্ট…

হাঁ, তোমাকে নষ্ট করে দিতে হবে।

কয়েক ঘন্টা পর ইঞ্জিনে আসবে আলম। মেইন মেশিন নষ্ট থাকলে সে নিশ্চয়ই ইঞ্জিনের ভিতরে প্রবেশ করে পরীক্ষা কাজ চালাবে। আলম নিজেও অনেক সময় ইঞ্জিনের মেশিন মেরামত করে থাকে। ঠিক সে সময় তোমাকে হেড মেশিন চালু করে দিতে হবে…।

ভয়বিহ্বল কণ্ঠে বলে উঠে কানাইলাল–আলম যে তাহলে পিষে থেতলে মারা পড়বে?

 কি বুঝলে তুমি তাহলে কানাইলাল?

ছোট স্যার, আমি এখনও ঠিক বুঝেতে পারছি না কিছু।

সোজা কথায় না বুঝলে মকবুলকে যেভাবে বুঝিয়ে দিয়েছি সেইভাবে দিতে হবে। নাসের হাতের রিভলভারের উদ্যত ডগাটা ঠেকালো কানাইলালের বুকে।

ফ্যাকাশে বিবর্ণ মুখে তাকালো কানাইলাল।

নাসের দাঁতে দাঁত কটমট করে রগড়ে নিলো, বললো তারপর–আলমকে পিষে পারতে হবে তোমার, বুঝলে?

হ্যাঁ বলেন কি ছোট স্যার? আলমকে পিষে মারতে হবে?

হাঁ, চলে এসো, আর বিলম্ব নয়।

ছোট স্যার আমি…মানে…আমি…

খবরদার, কথা বলবে না–কোনোরকম আপত্তি করলে শম্ভু জম্বু আর জলিল তোমাকে টুকরো টুকরো করে ফেলবে।

চলুন কি করতে হবে।

 নাসের ইঙ্গিৎ করলো জলিল, জম্বু আর শম্বুকে।

বেরিয়ে গেলো ওরা।

*

জাহাজের ইঞ্জিনরুমে তখন ফারুক আলীর ডিউটি ছিলো। জলিল, জম্বু আর শঙ্কু এসে দাঁড়ালো, চট করে মুখে কাপড় চাপা দিয়ে ওকে টেনে নিলো বয়লারের পেছনে।

ঐ মুহূর্তে নাসেরের সঙ্গে ইঞ্জিনরুমে প্রবেশ করলো মিস্ত্রী কানাইলাল, বাধ্য ছাত্রের মত তার পেছনে পেছনে এগিয়ে এলো।

নাসের ইঙ্গিৎ করলো কানাইলালকে।

কানাইলাল চারদিকে তাকিয়ে দেখে নিলো, তারপর মেইন মেশিনের পাশে এসে দাঁড়ালো। মাত্র কয়েক মিনিট–তারপর বেরিয়ে এলো সে। যেমনভাবে এসেছিলো তেমনি আলগোছে বেরিয়ে গেলো নাসের আর কানাইলাল।

বয়লারের পিছন থেকে ছেড়ে দেওয়া হলো ফারুক আলীকে। জানিয়ে দিলো জলিল, শম্ভু আর জন্ধু–আমাদের কথা যদি প্রকাশ পায় তাহলে নাবিক মকবুলের মত তারও অবস্থা হবে।

জলিল, শম্ভু আর জম্বুর চেহারা দেখেই পিলে চমকে গিয়েছিলো ফারুক আলীর। কোনোরকমে তাদের কাছে কান ধরে শপথ করে চলে এলো ইঞ্জিনকক্ষে।

কিন্তু ডিউটি তার শেষ হয়ে গিয়েছিলো, আলম আসতেই সে চলে গেলো।

বনহুর নিদ্রা জড়িত আঁখি দুটি রগড়ে হাই তুললো।

নাসের আর কানাইলাল ইঞ্জিনরুম থেকে বেরিয়ে গেলেও ওরা দু’জন লুকিয়েছিলো আড়ালে।

বনহুর মেশিনে হাত দিতেই অনুভব করলো কেমন একটা কড়কড় শব্দ হচ্ছে ইঞ্জিনের ভিতরে। অল্পক্ষণ পরই মেইন মেশিন অকেজো হয়ে পড়লো।

বনহুর চেষ্টা করলো নানাভাবে কিন্তু বাইরে থেকে কিছুই বুঝতে পারলো না। ইঞ্জিনের হেড সুইচ অফ করে দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলো সে, নেমে গেলো নিচে।

এই সুযোগের প্রতীক্ষায়ই ছিলো ওরা।

বনহুর ভিতরে প্রবেশ করে ইঞ্জিনের নিচে কল-কজা পরীক্ষা করলো, ঠিক সেই মুহূর্তে নাসের কানাইকে মেশিন চালু করে দেবার জন্য আদেশ করে।

কানাই-এর চোখ ছানাবড়া হয়ে উঠে, বুকের মধ্যে যেন হাতুড়ের ঘা পড়ছে। শুষ্ক কণ্ঠে বলে উঠে কানাইলাল–ছোট স্যার, আমাকে মাফ করবেন, আমি পারবো না মাফ করবেন…

সঙ্গে সঙ্গে একটা হীম-শীতল শক্ত অনুভূতি করলো কানাইলাল নিজের পিঠে। শিউরে উঠলো ওর সমস্ত শরীর, ঠান্ডা হয়ে গেলো বুক। একটা কথাও আর উচ্চারণ করতে পারলো না, যন্ত্রচালিতের মত এগিয়ে গেলো কানাইলাল ইঞ্জিন রুমের মধ্যে। হ্যান্ডেলে হাত রাখতেই থরথর করে কেঁপে উঠলো হাতখানা। ফিরে তাকালো সে, ওদিকে দেখলো নাসেরের হস্তে জমকালো পিস্তলের নলটা উঁচু হয়ে আছে ঠিক তার দেহ লক্ষ্য করে। কানাইলাল আর ভাবতে পারলো না, চাপ দিলো হ্যান্ডেলের চাকায়।

সঙ্গে সঙ্গে ইঞ্জিনের হেড মেশিন কর্কশ আওয়াজ করে চলতে শুরু করলো। নিস্তব্ধ মেশিন কক্ষ থেকে ভেসে এলো একটা তীব্র আর্তনাদ-উঃ-উঃ-আঃ-আঃ!

কানাইলাল আর নাসের ছুটে অদৃশ্য হয়ে গেলো।

ইঞ্জিনের বিকট শব্দে ফায়ারম্যানগণ এবং কয়েকজন খালাসী ছুটে এলো ইঞ্জিনকক্ষে। তারা বুঝতে পারলো, কোন দুর্ঘটনা ঘটেছে। একজন নাবিক হেড মেশিন বন্ধ করে দিলেন।

ততক্ষণে জাহাজের বিপদ সংকেত ঘন্টাধ্বনি শুরু হয়েছে।

কয়েক মিনিটের মধ্যে ইঞ্জিন কক্ষে এসে জমায়েত হলো সমস্ত জাহাজের লোক। যারা ঘুমাচ্ছিলো তারাও সবাই এসে ঘিরে দাঁড়ালো–কি হলো কি হলো সবার মনেই দারুণ উৎকণ্ঠা।

ক্যাপ্টেন আবু সাঈদ এবং নীহারও ছুটে এলেন।

ক্যাপ্টেনের চোখেমুখে দারুণ আতঙ্কের ছাপ–না জানি আজ আবার কি ঘটলো! তিনি সবার অগ্রে এসে দাঁড়ালেন, জিজ্ঞাসা করলেন–কি হয়েছে? ব্যাপার কি?

একজন নাবিক চঞ্চল কণ্ঠে বললো–স্যার, জাহাজের হেড ম্যাশিন নষ্ট হয়ে গেছে। এক্ষুণি জাহাজে আগুন ধরে যেতো। ইঞ্জিন কক্ষে কেউ ছিলো না, আমি এসে মেশিন বন্ধ করেছি।

কথাগুলো বলতে গিয়ে বড় হাঁপিয়ে পড়ছিলো নাবিক বেচারী। কারণ সে যদি ঐ মুহূর্তে দ্রুত ছুটে এসে হেড মেশিন বন্ধ করে না দিতো তাহলে ইঞ্জিনে আগুন লেগে যেতো তাতে কোনো ভুল নেই। ভাগ্যক্রমে সে ঠিক মুহূর্তে এসে পড়েছিলো তাই রক্ষা পেয়েছে জাহাজখানা–শুধু জাহাজখানাই নয়, জাহাজের যাত্রীগণ প্রাণ রক্ষা পেলো।

আবু সাঈদ উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বললেন–এখন ইঞ্জিনরুমে কার ডিউটি ছিলো?

ভীড় ঠেলে কেশব এসে দাঁড়িয়েছিলো সেখানে খালাসীর কাজ করে সে। মাঝে মাঝে ফায়ারম্যানের কাজও করতে হয় তাকে। কোনো কোনো সময় নাবিক আলমের সঙ্গে মেশিন পরিস্কার বা তাকে অন্যান্য কাজে সহায়তা করতে হয়। গোটাদিনের পরিশ্রমের পর সন্ধ্যায় ছুটি হয়। কেশব কোনোদিন হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করেনি, এখন তাকে যথেষ্ট খাটুনি করতে হচ্ছে, কাজেই ছুটি হলেই গিয়ে দড়ির খাটিয়ায় নাক ডাকিয়ে ঘুমাতে শুরু করে। কেশবের বুকের মধ্যে ধক করে উঠলো–এখন তো তার বাবুর ডিউটি ছিলো! একটু পূর্বেই তো সে তাকে জাগিয়ে ক্যাবিনের দরজা বন্ধ করতে বলে বেরিয়ে এসেছিলো। কেশব প্রতিদিনের মত ন্দ্রিা-অলস দেহটা কোনো রকমে উঠিয়ে ক্যাবিনের দরজাটা বন্ধ করে পুনরায় ধপাস করে শুয়ে পড়েছিলো, তারপর ভাল করে ঘুম না আসতেই জাহাজের বিপদ সংকেত ঘন্টাধ্বনি শুনতে পেয়েছিলো এবং সেই শব্দ শুনে ছুটে এসেছে সে বাবুর সন্ধানে। কেশব প্রায় কেঁদেই ফেললো–হুঁজুর, আলম সাহেব এখন ডিউটিতে ছিলেন।

আঁতকে উঠেন আবু সাঈদ–বলো কি–আলম ছিলো। কিন্তু সে কোথায়?

ঠিক তখন ভিড়ের অদুরে কয়েকজন দাঁড়িয়ে ফিস ফিস করে আলাপ হচ্ছিলো। তাদের কানেও এসে পৌঁছলো আবু সাঈদের গম্ভীর কণ্ঠস্বর। নাসের বললো–শয়তানটার খোঁজ হচ্ছে।

জম্বু বললো–আর পাবে কোথা, বেটার হাড়-মাংস পিষে দলা গয়ে গেছে।

শম্ভু বললো–শুধু দলা নয়, বেটার দেহটা এখন মেশিনে। চাকার দাঁতে দাঁতে লেপটে আছে মাত্র। আখ-মাড়াই কলের মত রক্তগুলো নিংড়ে পড়েছে মেঝেতে।

জলিল দাঁতে দাঁত পিষে বললো যেমন বাছাধন তেমনি তার সাজা হয়েছে। ছোট স্যার, এখন যান, মালিককে সন্তুষ্ট রাখতে চেষ্টা করুন। নইলে সব ফাঁস হয়ে যাবে।

তার মানে?

 মানে এখন ওখানে আপনাকে না দেখলে সন্দেহ জাগতে পারে।

ঠিক বলছো জলিল। নাসের কথাটা বলে এগিয়ে গেলো।

নাবিক আলমের সন্ধানে উপস্থিত সবাই তখন ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। সমস্ত জাহাজে লোক ছুটলো–কোথায় সে? চারদিক থেকে সবাই ফিরে এলো–নাবিক আলমকে পাওয়া যাচ্ছে না।

নাসের ধূর্ত শিয়ালের মত সুরসুর করে এসে দাঁড়ালো, যেন এইমাত্র শোরগোল শুনে জেগে উঠে এলো সে। চোখ রগড়ে নিদ্রাজড়িত কণ্ঠে বললো–স্যার কি হয়েছে?

আবু সাঈদ রাগত কণ্ঠে বললো–এতোক্ষণে বুঝি তোমার নিদ্রা ভঙ্গ হলো?

শয়তান নাসের আবু সাঈদের ক্রুদ্ধ কণ্ঠে রাগান্বিত না হয়ে বরং খুশি হলো, তার নিদ্রার ভান তাহলে তিনি ধরতে পারেননি। এবার যুৎসই কথা বলার জন্য নিজেকে তৈরি করে নিলো। আবু সাঈদের কথায় সে যেন বেশ আহাম্মক বনে গেছে, এমনি ভাব নিয়ে বললো–বড় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম স্যার।

নীহারের মাথার মধ্যে তখন আলমের অন্তর্ধান নিয়ে গভীর চিন্তার উদ্বেগ হচ্ছিলো। অজানিত একটা আতঙ্ক মোচড় দিচ্ছিলো তার মনে। নাসেরের ভন্ডামি ভরা নেকামি কথায় পা থেকে মাথা অবধি জ্বালা করে উঠে ওর। গম্ভীর গলায় বলে উঠে নীহার–এতো হৈচৈ-এর মধ্যেও যে ঘুমিয়ে থাকতে পারে তাকে ধন্যবাদ দিতে হয়। কারণ ঘুম তার সত্য নয়–মিথ্যা।

আবু সাঈদ তখন অত্যন্ত ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। আলম গেলো কোথায়? নীহারের কথা বা নাসেরের উক্তি তার মাথায় তখন প্রবেশ করছিলো না।

নাসের এই সুযোগে পুনরায় আর একবার নিজেকে সচ্ছ করে নেবার চেষ্টা করলো বললো– স্যার আপনি তাকে যতখানি ভাল মানুষ মনে করেছেন ঠিক ততখানি নয়। জাহাজখানা ধ্বংস করে ফেলার জন্য সে এইভাবে মেশিন চালু করে রেখে ভেগেছে।

ভেগেছে। একটু ধ্বনি করে উঠলেন আবু সাঈদ।

হ! আমার মনে হয় জাহাজ ত্যাগ করে সে পালিয়েছে।

 অসম্ভব। চলন্ত জাহাজ থেকে পালানো অসম্ভব। বললেন আবু সাঈদ। নাসের দাঁত বের করে একটু ব্যাঙ্গপূর্ণ হাসি হাসবার চেষ্টা করে বলে–স্যার, অসম্ভব তার কাছে কিছুই নয়।

এমন সময় একজন নাবিক ছুটে আসে–হুঁজুর ইঞ্জিনের নিচে মেশিন রুমে দেখুন। আমি একটা আর্তনাদ শুনতে পেয়েছিলাম।

নাবিকটার কথা শেষ হয় না, একসঙ্গে আবু সাঈদ এবং নীহার উচ্চারণ করে উঠেন–কি বললে?

হুজুর আমি একটা আর্তনাদ শুনতে পেয়েছিলাম কিন্তু শব্দটা কোথা থেকে এলো বুঝতে পারিনি কারণ তখন মেশিনে একটা ভয়ঙ্কর কড়কড় শব্দ হচ্ছিলো।

নীহার ব্যস্তকণ্ঠে বললো–আব্বা, আর এক মুহূর্ত বিলম্ব করা উচিৎ হবে না, শীগগির মেশিন কক্ষে খোঁজ নিন।

নীহারের কথায় মিটি মিটি হাসলো নাসের জানে সে এতোক্ষণে নাবিক আলমের হাড়গোড়ো সব চুর্ণ-বিচুর্ণ হয়ে ছিটকে পড়েছে মেশিনের দাঁতের চারপাশে। এবার সে প্রস্তুত হয়ে নিলো আলমের পরিণতি সচক্ষে দেখবে–দেখবে যে হস্তদ্বয় দ্বারা সে তাদের নাক, মুখ–দাঁতের রক্ত বের করে দিয়েছিলো সেই হস্তদ্বয়ের কি অবস্থা হয়েছে। যে পা দিয়ে জলিলের তলপেটে চরম আঘাত করেছিলো সেই পা দুটির কি অবস্থা হয়েছে।

আবু সাঈদ হুকুম দিলেন দু’জন নাবিককে ইঞ্জিনের নিচে মেশিন-রুমে প্রবেশ করতে।

সঙ্গে সঙ্গে আদেশ পালন করা হলো।

 দু’জন নাবিক প্রবেশ করলো নিচে।

কেশবও এই মুহূর্তে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইলো না সেও ওদের দু’জনার সঙ্গে নেমে পড়লো মেশিন-রুমে।

নাবিকদ্বয় ও কেশব মেশিন-রুমে নেমে যেতেই নীহার দু’হাতে মাথাটা টিপে ধরলো। সত্যই যদি নাবিক আলম মেশিনের চাকায় নিষ্পেষিত হয়ে থাকে– না না, এ দৃশ্য সে সহ্য করতে পারবে না।

ঠিক ঐ দন্ডেই মেশিন-রুমের ভিতর হতে একসঙ্গে নাবিক দু’টি এবং কেশব আর্ত চিৎকার করে উঠলো–কেশবের গলা স্পষ্ট শোনা গেলো–বাবু বাবু হায়–হায় হায়, একি হয়েছে–বাবু একি হয়েছে—

নীহারের বুকে তীরফলকের মত বিদ্ধ হলো শব্দগুলো, আর সে দাঁড়াতে পারলো না। একটা অব্যক্ত যন্ত্রণা তার মনে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো। ছুটে পালিয়ে গেলো নীহার নিজ কামরার দিকে। আলমের ঐ সুন্দর দেহটা নিষ্পেষিত অবস্থায় সে দেখতে পারবে না।

নাবিক দুটির গলাও শোনা গেলো–হুঁজুর, সর্বনাশ হয়ে গেছে। সর্বনাশ হয়ে গেছে–

আবু সাঈদের সংজ্ঞা আছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। তিনি যেন মাতালের মত টলছেন। তবু খেয়াল করে বললেন–আরো দু’জন মেশিনের ভিতরে যাও, দেখো আলমের কি অবস্থা হয়েছে।

আবু সাঈদ ক্ষিপ্তের মত ইঞ্জিন রুমের পাশে পায়চারী শুরু করলেন। হঠাৎ এমন একটা বিপদ ঘটবে বা ঘটতে পারে কল্পনাও করতে পারেনি তিনি।

অল্পক্ষণ পর চার-পাঁচজনে ধরে নাবিক আলম-বেশি বনহুরের ক্ষত-বিক্ষত দেহটা নিয়ে এলো বাইরে। রক্তে রাঙা হয়ে উঠেছে ওর নাবিক ড্রেস।

ডেকের উপরে শুইয়ে দেওয়া হলো বনহুরকে।

আবু সাঈদ বাহুর মধ্যে মুখ ঢেকে ফেললেন।

জাহাজের সবাই দারুণ অনুশোচনায় ভেঙে পড়লো। সবাই আঁতকে উঠলো এ দৃশ্য দেখে। কেউ চোখ ঢাকলো, কেউ বা কষ্টে তাকালো। কেউ কেউ দেখতে না পেরে সরে গেলো দূরে।

নাবিকগণ আলমকে শুইয়ে দিলে পরে আবু সাঈদের আদেশে জাহাজের ডাক্তার পরীক্ষা করলেন, বললেন তিনি স্যার বরাৎ বলতে হবে, নাবিক আলমের মৃত্যু ঘটেনি; সে এখনও জীবিত আছে।

আবু সাঈদ যেন দেহে প্রাণ ফিরে পেলেন, তিনি নিশ্বাস নিলেন নতুন করে। কেশবের অবস্থাও তাই–সে রোদন করছিলো।

ডাক্তারের প্রশ্নে জবাব দিলো নাবিকগণের মধ্যে হতে একজন, বললো–মেশিনের নিচে এক পাশে রক্তাক্ত দেহে পড়েছিলো আলম। ভাগ্যিস তার দেহটা দাঁতের ফাঁকে আটকা পড়ে যায়নি, তাহলে ছাতু হয়ে যেতো একেবারে।

ডাক্তার ভালভাবে পরীক্ষা করে আরও বললেন–হাত পা বা দেহের হাড়গোড় ভেঙে যায়নি। শুধু দেহের মাংসগুলো স্থানে স্থানে কেটে গেছে এবং আঘাত পেয়েছে অত্যন্ত।

কেশব আলমের বুকে এসে আছড়ে পড়লো কিন্তু তাকে সরিয়ে নেওয়া হলো সেখান থেকে।

ডাক্তার যখন আলম সম্বন্ধে জীবিত আছে বলে প্রমাণ দিলেন এবং জানালেন আঘাত ভয়ঙ্কর হলেও গুরুতর নয়–তখন নাসেরের মুখ অমাবস্যার অন্ধকারের মত কালো হলো। ধীরে ধীরে সকলের অজ্ঞাতে সরে পড়লো সেখান থেকে।

আবু সাঈদ কয়েকজন নাবিককে বললেন আলমকে তার ক্যাবিনের শয্যায় নিয়ে গিয়ে যত্ন সহকারে শুইয়ে দিতে। কারণ এক্ষুণি তার চিকিৎসা শুরু করতে হবে।

বনহুরকে অজ্ঞান অবস্থায় তার নিজস্ব ক্যাবিনে শুইয়ে দেওয়া হলো তার বিছানায়।

আবু সাঈদ স্বয়ং এলেন ডাক্তারের সঙ্গে, চোখেমুখে তার সেকি ব্যাকুলতা! যেমন করে হোক বাঁচাতে হবে ওকে। আলমের মত একজন ব্যক্তির নিতান্ত প্রয়োজন তাদের জাহাজে। সেদিন আলম একা তার জাহাজের লাঠিয়ালদের ক’জনাকে কাবু করে ফেলেছিলো, শুধু দৈহিক শক্তিশালীই সে নয়–তার কর্মনিষ্ঠা অত্যন্ত বিমুগ্ধ করেছিলো মালিককে। পর্যটক হিসাবে তাঁকে গোটা বছর ঘুরে ফিরতে হয় দেশ হতে দেশান্তরে। কখন কোন দেশে যান তার কোনো ঠিক নেই।

অজানা-অচেনা জায়গা আবিষ্কার করাই হলো তার কাজ। যেমন বিভিন্ন দেশ-বিদেশ ঘুরে ফিরতে হয়, তেমনি নানারকম বিপদ আপদেও পড়তে হয়। এবং সেই কারণেই জাহাজে তিনি বেশ কিছুসংখ্যক দেহরক্ষী রেখেছিলেন। আলমকেও আবু সাঈদ পছন্দ করেছিলেন একজন কৌশলী বুদ্ধিমান শক্তিশালী সঙ্গী হিসাবে। আজ সেই আলমের অবস্থা দেখে চোখ ফেটে পানি বেরিয়ে আসছিলো তার। অনেক কষ্টে সংযত করে রাখছিলেন তিনি নিজেকে।

ডাক্তার আলমের ক্ষতস্থানে ঔষধ লাগিয়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিলেন। ইনজেকশন করলেন কয়েকটা।

নাসেরের দল ছাড়া এ জাহাজে আলমকে ভালোবাসতো সবাই। ওর ব্যবহারে কেউ অসন্তুষ্ট। ছিলো না, বরং সবাই খুশি ছিলো। অবশ্য এর কারণ ছিলো–জাহাজের ছোট-বড় সকলকে সে সমান চোখে দেখতো। সুযোগ পেলেই তাদের সহায়তা করতে কাজে।

একদিন আলম পিছন ডেক অভিমুখে যাচ্ছিলো, তখন একজন খালাসী ভারী কোন একটা বস্তু উপরে উঠানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। তখন আশে পাশে কেউ ছিলো না তাকে সাহায্য করবার মত। অসহায় খালাসী ঘর্মাক্ত দেহ নিয়ে চেষ্টার পর চেষ্টা করে চলেছে।’

আলমের দৃষ্টি স্থির হলো খালাসীটার উপরে, এগিয়ে গেলো সে ওর পাশে নির্বিঘ্নে তাকে সাহায্য করলো। আর এক দিন একজন নাবিক তার ডিউটিকালে হঠাৎ পেটের ব্যথায় অস্থির হয়ে পড়লো। কিন্তু ডিউটি তাকে করতেই হবে। ঐ সময় আলম তার কাজ শেষ করে ফিরে যাচ্ছিলো, হঠাৎ নাবিকের মুখোভাব লক্ষ্য করে সে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলো কি হয়েছে তার। নাবিক তার অস্বস্তির কথা জানালো। আলম তাকে ঐ মুহূর্তে বিশ্রাম করতে বললো–সে তার ডিউটি সময়টা চালিয়ে নেবে বলে তাকে আশ্বাস দিলো।

নাবিক কৃতজ্ঞতায় নত হলো আলমের কাছে।

এমনি আরও কতজন আলমের এ করুণ অবস্থা দর্শনে চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লো।

ভীড় জমে গেলো আলমের ক্যাবিনে।

কিন্তু ডাক্তারের নির্দেশে সবাইকে ক্যাবিন ত্যাগ করতে হলো। চলে গেলেও তাদের অন্তর যেন পড়ে রইলো আলমের পাশে, ব্যথা বেদনা নিয়ে নিজ নিজ স্থানে গমন করলো ওরা।

নীহার তখন নিজের ক্যাবিনে বালিশে মুখ গুঁজে পড়ে আছে। আজ সে উপলব্ধি করছে– কখন সে নাবিক আলমকে এতখানি ভালবেসেছিলো, কখন তার মনের আসনে প্রতিষ্ঠা করেছিলো ওকে! আজ আলমের মৃত্যুর সংবাদ তাকে উন্মাদিনী করে ফেলেছে। মাথা ঠুকে কাঁদতে লাগলো নীহার। কেন তবে ও এসেছিলো তাদের জাহাজে। না এলে এমন তো হতো না। তার জীবন ছিলো স্বাভাবিক সচ্ছ। হাসি আর আনন্দই ছিলো পরম সম্পদ কিন্তু যেদিন থেকে ওকে সে দেখেছে কেন সে নিজেই জানে না হারিয়ে ফেলেছে নিজেকে। আগের নীহার পাল্টে গিয়েছিলো ক’দিনের ব্যবধানে। প্রকৃতির চলার গতির পথে ঋতু যেমন বয়ে আনে পরিবর্তন, ভাবগম্ভীর বসুন্ধরা বিভাসিত হয়ে উঠে যেমন বসন্তের আগমনে তেমনি নীহারের মধ্যে নাবিক আলম এনেছিলো এক ছন্দের শিহরণ। ধনবান দুহিতা বিদুষী সে; সামান্য একজন নাবিকের মধ্যে খুঁজে নেবে তার প্রিয়জনকে এ যে কল্পনাতীত!

প্রেম প্রীতি-ভালবাসা, স্নেহ-মায়া-মমতা কোনদিন জাতি বা স্থান-কুল বিচার করে না। নীহারও নিজের অজান্তে ওকে মনের গহনে আসন দিয়ে বসেছিলো। আজ সে উপলব্ধি করে। বিশেষ করে সবকিছু।

নীহার যখন অন্ধকার ক্যাবিনে কান্নায় ভেঙে পড়েছে তখন আস্তে করে ক্যাবিনে প্রবেশ করে। নাসের। দরজার পাশে দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করে ওকে। হাসে নাসের আপন মনেই কারণ সে জানে নীহারের কান্না কিসের জন্য।

সরে আসে একেবারে নীহারের শয্যার নিকটে পিঠে হাত রেখে ডাকে সে গলাটাকে কোমল করে নিয়ে নীহার!

চমকে মুখ তোলে নীহার। সোজা হয়ে বসে, দ্রুত হস্তে চোখের পানি মুছে ফেলে বলে– আপনি কেন এখানে?

নাসের কেঁচোর মত হাত দু’খানা কোটের পকেটে পুরে নিয়ে মুচকি হেসে বললো–চোখের পানি মুছে ফেললে কেন নীহার? কাঁদো আরও কাঁদো–বরফ যখন গলতে শুরু করেছে তখন আর থামবে না।

ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলে উঠে নীহার–বেরিয়ে যান।

যদি না যাই?

আব্বাকে ডাকবো।

আব্বা! আব্বা এখন তোমার সেই নাবিকটার মৃতদেহের সৎকাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।

নীহার নিজের মাথাটা চেপে ধরে দু’হাতে ভুলে যায় নাসের তার পরম শত্রু, বলে সে ব্যাকুল কণ্ঠে–নাসের সাহেব আলম মারা পড়েছে!

হাঁ, মেশিনের দাঁতের ফাঁকে পিষে গেছে তার হাড়গোড় মাংসের দলা বনে গেছে ওর দেহটা।

 উঃ! শেষ পর্যন্ত ওর এই অবস্থা? নীহার টলতে লাগলো মাতালের মত।

নাসের নীহারকে ধরে ফেললো টেনে নিলো নিবিড় করে বুকের মধ্যে। এই আশাতেই সে আজ এসেছে নীহারের ক্যাবিনে সকলের অনুপস্থিতিতে।

নীহারের অসংযত দেহ থেকে আঁচলখানা খসে পড়ে। যৌবনভরা অনিন্দ্য-স্লথ বক্ষে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে লোভাতুর নাসেরের চোখ দুটো শ্বাপদের মত জ্বলে উঠে জ্বলজ্বল করে। আরও ঘনিষ্ঠ করে টেনে নেয় ওকে বাহু দুটির মধ্যে।

কিন্তু নীহার জ্ঞান হারায়নি, একটু মাথাটা ঘুরে গিয়েছিলো নাসেরের কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে। অল্পক্ষণেই নীহার নিজেকে সামলে নিলো, নাসেরের আচরণে নাগকন্যার মত রুখে উঠলো। এক মোচড়ে নাসেরের বাহুবন্ধন থেকে নিজকে মুক্ত করে নিয়ে প্রচন্ড এক চড় বসিয়ে দিলো ওর গালে।

নাসের গালে হাতটা একবার বুলিয়ে নিলো আলগোছে। কিছু যেন হয়নি হাসলো সে নীহারের মুখের দিকে তাকিয়ে, নেশা চেপে গেছে ওর মাথায় নীহারের অপরূপ যৌবনসুধা পান করতেই হবে। খপ করে ধরে ফেললো নাসের পুনরায় ওকে। বলিষ্ঠ কঠিন হাতে ওকে চেপে ধরে মুখের কাছে মুখটা নিয়ে এলো।

নীহার নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার জন্য ধস্তাধস্তি করতে লাগলো, ভীষণভাবে কামড়ে দিলো নাসেরের হাতে।

নাসেরের মধ্যে তখন জেগে উঠেছে একটা পাপান্ধ পশুত্ব বোধ। নীহারের দাঁত হাতের পিঠে বসে গেলেও নাসের তাকে মুক্ত করে দিলো না।

নীহার প্রাণপণে নিজেকে বাঁচিয়ে নেবার জন্য সমস্ত শক্তি ব্যয় করে চলেছে।

আর নাসের ওকে পাওয়ার জন্য হিংস্র হয়ে উঠেছে ভয়ঙ্করভাবে। নীহারের মুখের কাছে ওর কঠিন লোভাতুর ওষ্ঠদ্বয় এগিয়ে আসছে চুম্বকের মত।

নীহার ঘেমে উঠেছে–যেন গোসল করেছে সে। হাঁপাচ্ছে রীতিমত। নাসেরও হাঁপাচ্ছে, যেন দুটি যুদ্ধরত ছায়ামূর্তি।

ক্যাবিনে স্বল্প আলো জ্বলছিলো।

ক্রমে নীহারের দেহ শিথিল হয়ে আসছে যেন। হাজার হলেও সে নারী, শক্তির দিক দিয়ে নাসেরের চেয়ে অনেক দুর্বল সে। কতক্ষণ পেরে উঠবে এভাবে লড়াই করে।

নীহার এবার প্রাণ দিয়ে স্মরণ করে খোদাকে, হে দয়াময়, তুমি আমাকে রক্ষা করো, রক্ষা। করো ইজ্জৎ বাঁচাও তুমি– নীহারের কণ্ঠ দিয়ে কথাগুলো একরকম জোরেই বেরিয়ে এলো। নিশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে।

নাসের তখন নেশাযুক্ত মত্তের মত হুশহারা। কোনো কথাই তার কানে পৌঁছাচ্ছে না। সে নীহারের দেহটাকে নিষ্পেষিত দলিত-মথিত-নিঃশেষিত করে ফেলতে চাইছে।

নীহারের বাধা দিবার ক্ষমতা ক্রমান্বয়ে হ্রাস হয়ে আসছে। অবশ হাত দুখানা ঝুলে পড়ে দু’পাশে। ঠিক ঐ মুহূর্তে ক্যাবিনের বাইরে শোনা যায় আবু সাঈদের কণ্ঠ–নীহার! নীহার–মা। মনি।

আবু সাঈদের গম্ভীর ব্যস্ত কণ্ঠস্বরে হুঁশ ফিরে আসে, নাসের তাড়াতাড়ি নীহারকে মুক্ত করে দিয়ে সরে দাঁড়ায়।

আবু সাঈদ ক্যাবিনে প্রবেশ করে বলেন-নীহার মা আলম মরেনি। আলম বেঁচে আছে, আলম বেঁচে আছে– হঠাৎ নীহারের উপর দৃষ্টি পড়তেই দেখলেন নীহার দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে টলছে। যেন, ব্যস্তভাবে বললেন–একি মা, কি হয়েছে তোমার?

ওদিক থেকে নাসের এগিয়ে আসে, দ্রুতহস্তে রুমাল দিয়ে নিজের কপালের বিন্দু বিন্দু। ঘামগুলো মুছে ফেলছে সে, হন্তদন্ত কণ্ঠে বলে,–হঠাৎ আলমের এ্যাকসিডেন্ট সংবাদে নীহার সংজ্ঞা হারার মত হয়ে পড়েছিলো, তাই আমি ওকে–

ও তাই বলো। বেশ করেছো নাসের আমি তো আলমকে নিয়ে এতোক্ষণ ব্যস্ত ছিলাম। কি যে দুর্ভাবনা হয়েছিলো আমার। যাক ডাক্তার বলেছেন আঘাত গুরুতর হলেও মৃত্যুর কোনো সম্ভাবনা নেই। নীহারের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম একেবারে।

আমি তাহলে আসি স্যার।

আচ্ছা এসো বাবা। ইস কি উপকারটাই না করেছো তুমি! তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।

আবু সাইদের ধন্যবাদ গ্রহণ করার মত স্থিরচিত্ত তখন ছিলো না নাসেরের। মুখের গ্রাস হারিয়ে হিংস্র জন্তু যেমন ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে ঠিক তেমনি অবস্থা নাসেরের। কিন্তু সরে না পড়ে কোনো উপায় নেই। তাই আর কোনো কথা না বাড়িয়ে প্রস্থান করলো সাধু ব্যক্তির মত মন্থর পদক্ষেপে।

শুধু শিকার হারিয়ে নয়–আলম জীবিত আছে; তার মৃত্যুর সম্ভাবনা আর নেই জেনে আরও ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলো। সমস্ত দেহে এবং মনে যেন আগুন জ্বলে উঠলো। হিংসার বহ্নিজ্বালা যাকে বলে।

আবু সাঈদ নীহারের কাঁধে হাত রাখলেন–নীহার! নীহার–নীহার ধপ করে বসে পড়লো শয্যার উপরে, গলা শুকিয়ে গেছে এতক্ষণ শয়তানটার ধস্তাধস্তি করতে গিয়ে। কিন্তু এত বিপদের মধ্যেও যখন নীহারের কানে ঐ একটিমাত্র শব্দ এসে পৌঁছলো–মা আলম বেঁচে আছে–সে। মরেনি-মৃত্যুর সম্ভাবনা আর নেই–অনবিল এক শান্তিতে নীহারের বুক থেকে একটা কঠিন চাপ যেন নেমে গেলো মুহূর্তে। কথা সে বলতে পারলো না সহজে কিন্তু সমস্ত ব্যথা ভুলে গেলো। বসে পড়লো শয্যায়, শুকনো জিভটা একবার ঠোঁটের উপর বুলিয়ে নিয়ে বললো–আব্বা একটু পানি দাও–

পানি! পানি খাবে মা? সবুর করো, ক্ষুণি আনছি। আবু সাইদ টেবিলে ঢাকা দেওয়া পানির গেলাসটা হাতে তুলে নিয়ে কন্যার দিকে এগিয়ে গেলেন–নাও।

নীহার পিতার হাত থেকে পানির গেলাসটা নিয়ে এক নিশ্বাসে ঢক ঢক করে পান করে ফেলে।

আবু সাঈদ দেহ থেকে স্লিপিং গাউনটা খুলে রাখতে রাখতে বললেন–কি বলবো মা, আলমের অবস্থা দেখে আমিই সংজ্ঞা হারাতে বসেছিলাম। ভেবেছিলাম, ছেলেটা মারা পড়েছে। ডাক্তার যখন বললেন ভয়ের সম্ভাবনা নেই তখন আমি আশ্বস্ত হয়েছি। উঃ বেচারী একটুর জন্য বেঁচে গেছে।

নীহার তখনও হাঁপাচ্ছিলো, পিতার কথাগুলো তার কানে প্রবেশ করেছিলো কিনা কে জানে। রাগে অধর দংশন করছিলো নাসেরের আচরণ সম্বন্ধে পিতাকে সব বলবে কিনা ভাবছে!

শয়তানটা তার আব্বাকে সুন্দর একটা সান্ত্বনা দিয়ে নিজেকে সচ্ছ করে নিয়ে বেরিয়ে গিলো।

আবু সাঈদ ভাবলেন সত্যিই নাসের তার কন্যাকে যত্ন সহকারে আগলে রেখেছিলো তাই ধন্যবাদ জানাতে তিনি ভুললেন না। নীহার বললো–আব্বা, নাসের সাহেবকে তুমি ধন্যবাদ জানালে কিন্তু জানো সে কত বড় অন্যায় করেছে?

সে কি মা? কি করেছে সে?

ওর মত শয়তান আমাদের জাহাজে দ্বিতীয় জন নেই। সুযোগ বুঝে সে আমাকে–মানে আমার উপর আক্রমণ চালিয়েছিলো–আমাকে–আমাকে–কণ্ঠ আটকে আসে, বলতে পারে না নীহার স্পষ্ট করে সব কথা।

আবু সাঈদ চমকে উঠেন, উদ্বিগ্নভাবে বললেন–কি হয়েছে মা বলো?

আজ নয় আব্ব। আজ কিছু বলতে চাই না কিন্তু জেনে রেখো নাসের সাহেব শুধু শয়তান নয়, সে একজন এক নম্বর লম্পট।

আবু সাঈদ গম্ভীর হয়ে পড়লেন চোখমুখ তার কালো হয়ে উঠলো। বুঝতে পারলেন নাসের তাহলে কোনো কুমতলব নিয়েই নীহারের পাশে এসেছিলো। রাগে ক্ষোভে পায়চারী শুরু করলেন তিনি। নাসেরকে আবু সাঈদ স্নেহের দৃষ্টি নিয়েই দেখতেন, বন্ধুপুত্র বলেই শুধু নয়–নাসের শিক্ষিত সুদর্শন এবং বুদ্ধিদীপ্ত ছেলে, নীহারের সঙ্গে সুন্দর মানানসই হবে। তাছাড়াও নাসেরকে তিনি পেয়েছিলেন সর্বসময় নিজের পাশে পাশে পর্যটক হিসাবে। নানা কারণে আবু সাঈদ নাসেরকে ভালবেসেছিলেন। কিন্তু তিনি বুঝতে পারেননি ঐ সর্বগুণ সম্পন্ন ছেলেটিই তার কতখানি অমঙ্গল কামনা করে।

*

বোম্বে স্টুডিও।

পরিচালক আসলাম আলীর ওপেল কার গাড়িখানা এসে থামলো তিন নাম্বার ফ্লোরের সামনে। গাড়ি থেকে নামলেন পরিচালক স্বয়ং এবং বশির আহাম্মদ। নায়িকা শ্যামা এবং আর একটি যুবতী সঙ্কোচিতভাবে নেমে দাঁড়ালো গাড়ি থেকে।

আসলাম আলী শ্যামা ও যুবতীটিকে লক্ষ্য করে বললেন –এসো তোমরা।

 পরিচালককে অনুসরণ করলো ওরা সবাই।

 সহকারী বশির আহম্মদও এগুলেন সবার পিছনে।

 শ্যামা যুবতীটির দক্ষিণ হাতখানা তুলে নিলো হাতে–কোনো ভয় নেই।

যুবতীর রক্তিম গন্ড আরও রক্তিম দেখাচ্ছে অসহায় করুণ চোখে একবার তাকালো শ্যামার দিকে।

ফ্লোরে প্রবেশ করেই বললেন আসলাম আলী–শ্যামা ওকে নিয়ে গ্রীণরুমে যাও। আমি সেট থেকে ফিরে আসছি। বশির তুমিও এসো।

শ্যামা মৃদু হেসে গ্রীবা বাঁকা করে বললো–চট করে আসবেন কিন্তু।

হাঁ, এক্ষুণি এসে যাচ্ছি শ্যামা তুমি ওকে ওর চরিত্রটা সুন্দর করে বুঝিয়ে দাও।

আসলাম আলী ও বশির আহম্মদ চলে গেলেন সেটের দিকে। শ্যামা যুবতীকে নিয়ে এগুলো।

গ্রীনরুমে প্রবেশ করে অবাক হলো যুবতী ফ্যাল ফ্যাল করে তাকাতে লাগলো চারিদিকে।

শ্যামা একটা চেয়ার দেখিয়ে বললো–বসো।

 যুবতী বসলো।

শ্যামা ড্রেসিং টেবিলের সম্মুখে দাঁড়িয়ে নিজের দেহটাকে একবার নিখুঁতভাবে দেখে নিলো। তারপর বললো–কি বলে ডাকবো তোমায় বলো? পরিচালক সাহেব যে নাম দিয়েছেন ঐ নামে ডাকতে মানা করেছে, কিন্তু কেন বলতো?

ও নাম আমার কাছে ভাল লাগেনা।

তবে কি বলে ডাকবো? বলো লজ্জা কি? আমিও তো তোমার মতই একজন। যুবতী চেয়ারের হাতলে বসলো শ্যামা। দক্ষিণ হস্তের আংগুলে ওর কপালে থেকে চুলগুলো সরিয়ে দিতে লাগলো। সস্নেহে। বললো আবার বলো কি বলে ডাকলে তুমি খুশি হবে?

আমার নাম ধরে ডেকো।

 উ হু, নূরী নামটা তোমাকে পাল্টাতে হবে।

 তাহলে যা খুশি তাই বলে ডেকো কিন্তু ঐ নামে নয়।

হেসে বললো শ্যামা–ঐ নাম মানে পরিচালক যে নাম দিয়েছেন?

হাঁ, ও নামে আমাকে ডেকো না।

 বেশ, তাহলে আমিই একটা নাম রাখবো তোমার।

নূরী মাথা নিচু করে কথা বলে না কিছু।

শ্যামা ঠোঁটের উপর আংগুল রেখে ভ্রু কুঁচকে চিন্তা করে।

নূরী তখন তলিয়ে যায় নিজের চিন্তায়।–আজ বেশ কয়েকদিন হলো সে এই নতুন দেশে এসে হাজির হয়েছে। তাকে জোরপূর্বক ধরে এনেছে এরা। তাকে কোনো কষ্ট না দিয়ে যত্নই করেছে বরাবর। জীবনে সে যে সব দেখেনি–তা দেখেছে। যা সে কোনোদিন খায়নি, তাই খাচ্ছে। যা সে জীবনে পরেনি তাই সে এখন পরছে। কিন্তু এতো আদর যত্নে থেকেও তার পাশে তাহলে সে এতোটুকু চিন্তিত বা দুঃখিত হতো না। কিন্তু কে জানে কোথায় সে। হয়তো এখনও সেই পর্বতমালার উপরে তার নাম ধরে ডেকে ফিরছে। খুঁজে ফিরছে বন হতে বনান্তরে। নূরীর গন্ড বেয়ে গড়িয়ে এলো দু’ফোঁটা অশ্রু।

শ্যামা হঠাৎ বলে উঠলো–পেয়েছি চমৎকার একটা নাম পেয়েছি তোমার জন্য। একি তুমি কাঁদছো?

নুরী হাতের পিঠে চোখের পানি মুছে ফেলে বলে-কই না তো।

হা তুমি কাঁদছিলে। কিন্তু কেঁদে শুধু কষ্টই পাবে; ব্যথা কমবে না আরও বেশি হবে।

বলো শ্যামা কি নাম তুমি আমার জন্য পছন্দ করলে?

শশী বলে ডাকবো তোমায়।

শশী!

হ, শশী মানে কি জানো?

 মাথা নাড়লো নূরী–না, জানি না।

শশী–চন্দ্রের এক নাম।

হাসলো নূরী।

এমন সময় আসলাম আলী এলেন, ব্যস্তসমস্তভাবে বললেন–শ্যামা মেক আপম্যান এলেই তোমরা তৈরি হয়ে নাও। আর শোনো।

শ্যামা বললো–তার আগে আমার একটা কথা শুনুন।

 বলো? আসলাম আলী সিগারেট ধরালেন।

শ্যামা বললো–ওর নাম আমি নতুন করে দিয়েছি।

কি নাম?

শশী।

শশী?

হুঁ।

কেন–আমার দেওয়া নামটা বুঝি—

পছন্দ হয়নি ওর।

বেশ তো! শশী–শশীকলার মতই আত্মবিকাশ করবে চিত্রজগতের আকাশে। হাসলেন আসলাম আলী। তারপর বললেন–শ্যামা, সেটে সব প্রস্তুত শুধু তোমরা হাজির হলেই হয়।

এমন সময় মেক আপ-ম্যান গ্রীনরুমে প্রবেশ করেন।

আসলাম আলী তার সঙ্গে নূরীর পরিচয় করিয়ে দিলেন।

নূরী মেক আপ-ম্যানের অর্থই বুঝে না, ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো।

আসলাম সাহেব মেক আপ ম্যানকে তার কাজ বুঝিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেলেন।

 শ্যামা নূরীকে বললো–এসো শশীরাণী।

 নূরী উঠে এলো।

বড় আয়নাটার সম্মুখে বসতে বললো শ্যামা নূরীকে।

নূরী আদেশ পালন করলো শ্যামার।

মেক আপ ম্যান এসে দাঁড়ালেন নূরীর অতি নিকটে রং এর তুলি হাতে তুলে নিয়ে বাম হাতখানা রাখলেন নূরীর মাথায়।

সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ালো নূরী বিদ্যুৎগতিতে।

শ্যামা হেসে উঠলো খিলখিল করে। তারপর বললো–উনি তোমায় সাজিয়ে দেবেন বুঝলে?

 নূরী তীক্ষ্ণকণ্ঠে বললো–আমি কারো হাতে সাজতে চাই না। নিজেই ঢের পারি।

অনেক বুঝিয়েও নূরীকে শ্যামা রাজি করাতে পারলো না।

খবর পেয়ে শশব্যস্তে ছুটে এলেন আসলাম আলী, শ্যামার মুখে সব শুনে অবাক হলেন। নানাভাবে বুঝিয়ে শেষ পর্যন্ত নূরীকে রাজি করিয়ে তবে ছাড়লেন।

পার্শ্ব-নায়িকার চরিত্রে রূপ দেবার জন্য নূরীকে একটি ভীলবালার বেশে সজ্জিত করা হলো। এ ড্রেসে ওকে মানালো অপরূপ। আসলাম আলী আনন্দে যেন ফেটে পড়লেন। এবার তার ছবি হিট না করে যাবে না। এখন অভিনয়ে সুনাম রাখলেই হয় মেয়েটা। আশায় বুক ভরে উঠলো তার ভরা নদীর মত।

*

স্টুডিও সেটেলাইট ক্যামেরা সাউন্ড সব প্রস্তুত। শ্যামার সঙ্গে নূরী এসে দাঁড়ালো সেটে। একি! চারিদিকে তাকিয়ে আড়ষ্ট হলো নূরী। কাঁপছে তার দেহটা বেতসপত্রের মত থরথর করে। বিস্ময়ে চোখ তার ছানাবড়া হয়ে উঠলো। শ্যামার আচল চেপে ধরলো ভয়কম্পিত হাতে।

প্রমাদ গুণলেন পরিচালক আসলাম আলী। এতে করে আজ কদিন থেকে অবিরত বুঝিয়েছেন তিনি মেয়েটাকে। তাছাড়াও শ্যামা তো সর্বক্ষণ ওর সঙ্গে রয়েছে ছায়ার মত! আজ নূরীর প্রথম শট, সামান্য কিছু এ্যাকশন আছে। কিন্তু একি বিভ্রাট। সেটে আসবার পূর্বেও কি কম বোঝাতে হয়েছে তাকে। তার আগে মেক আপ নিতে গেছে কয়েক ঘন্টা।

বোম্বে-স্টুডিও ফ্লোর। তারিখ পাওয়াই মুস্কিল। একটার পর একটা ছবি সুটিং চলেছে একটানাভাবে। কোনোরকমে তারিখ করে নিয়েছেন আসলাম আলী দু’টি দিনের জন্য। শুধু কি তারিখ ফেলা ভার? আজকাল ফ্লোর পেতে হলেও চাই টাকা। ঘন্টায় হাজার দিতে হয় স্টুডিও কোম্পানীকে।

নূরীর ব্যাপারে আজ ঘন্টার পর ঘন্টা কেটে যাচ্ছে অহেতুকভাবে। আবার শুরু হলো নূরীকে বোঝানোর পালা।

আসলাম আলী নিজে ম্যান্সক্রিপ্টা হাতে চরিত্রটা বুঝিয়ে দিতে লাগলেন।

 টেকিং শুরু হবে এবার।

ক্যামেরা রেডি করে নিয়ে দাঁড়িয়েছেন ক্যামেরাম্যান মধু বোস। ফ্লোরের বাইরে সাউন্ডভ্যানে ইঞ্জিনিয়ার সারথী বাবু প্রস্তুত হয়ে অপেক্ষা করছেন।

সেটে একটি কুটিরের দৃশ্য পড়েছে।

দাওয়ার খুটিতে ঠেশ দিয়ে বসে আছে শ্যামা নায়িকা রাজকুমারী জয়শ্রীদেবীর বেশে, এলায়িত রাশিকৃত চুল লুষ্ঠিত হচ্ছে ভূতলে। আঁচলখানা লুটায়িত দাওয়ার নিচে। গম্ভীর চিন্তায় আচ্ছন্ন। জয়শ্রী, গন্ড বেয়ে গড়িয়ে আসছে দু’ফোঁটা অশ্রু।

নূরী ভীলবালার বেশে দন্ডায়মান তার পাশে। খোঁপায় গলায় হাতে ফুলের মালা। খোঁপাটা বামে উঁচু করে বাঁধা ঠিক্ ভীল নারীদের মত। পায়ে মল।

ছবির নাম হলো “স্বয়ং বরা”

রাজকুমারী জয়শ্রী ভালবাসতো রাজকুমার বিশ্বজিৎকে। কিন্তু দুই রাজ্যের রাজার মধ্যে ছিলো বিরোধ। কাজেই দুই রাজ্যের রাজকুমারী আর রাজকুমারের মিলন কিছুতেই সম্ভব ছিলো না।

প্রেম অন্ধ।

জয়শ্রী বিশ্বজিৎকে না পেলে যেমন বাঁচবে না তেমনি রাজকুমার বিশ্বজিৎ জয়শ্রীকে না পেলে মৃত্যুবরণ করবে।

জয়শ্রীর বাবা রাজা মহন্ত সেন কন্যার জন্য স্বয়ংবরের ব্যবস্থা করলেন। বিভিন্ন দেশে নিমন্ত্রণ পাঠালেন রাজকুমারগণকে আহ্বান জানিয়ে। পাশের রাজ্যের রাজকুমার বাদ পড়লো এ আমন্ত্রণে।

রাজকুমার বাদ পড়লেও সে গোপনে এলো রাজসভায় এক সন্ন্যাসী যুবক বেশে।

কেউ তাকে না চিনলেও চিনতে পারলো জয়শ্রী দেবী।

সখীগণ পরিবেষ্টিত হয়ে মালাহস্তে জয়শ্রী যখন রাজসভায় অসংখ্য রাজকুমারের মধ্যে তার প্রিয়জনকে অন্বেষণ করে ফিরছিলো তখন প্রতিটি রাজকুমার আশায়-উদ্দীপনায় গলাটা উঁচু করে বাড়িয়ে ধরছিলো। কিন্তু জয়শ্রীর কোনদিকে ভূক্ষেপ নেই–সে সম্মুখে এগুচ্ছে।

সখীগণ পিছন থেকে পুষ্পবৃষ্টি করছিলো।

হঠাৎ জয়শ্রী দেখতে পায় তার সামনে ভূতলে বসে এক সন্ন্যাসী যুবক। জয়শ্রী চিনতে পারে তাকে হস্তস্থিত মালাটা পরিয়ে দেয় তার গলায়।

সঙ্গে সঙ্গে রাজসভার অন্যান্য রাজকুমার অমঙ্গলসূচক শব্দ করে দাঁড়িয়ে পড়ে।

কোষাবদ্ধ তরবারি উন্মোচন করে ক্ষিপ্তের মত উঠে দাঁড়ান রাজা মহন্ত সেন–কে ঐ সন্নাসী যুবক তাকে গ্রেফতার করো।

কিছু অদূরেই ছিলো রাজকুমার বিশ্বজিতের তেজবান অশ্ব, মুহূর্ত বিলম্ব না করে রাজকুমারী জয়শ্রী দেবীকে নিয়ে অশ্বপৃষ্ঠে চেপে বসে উধাও হয়ে যায় হাওয়ার বেগে।

বিশ্বজিতের বাবা জানতে পেরে ভয়ানক ক্রুদ্ধ হন, পুত্রকে তিনি রাজপ্রাসাদে স্থান দেন না। কারণ শত্ৰুকন্যাকে তিনি গ্রহণ করতে পারবেন না পুত্রবধু হিসাবে।

বিশ্বজিৎ এতে ভেঙে পড়লো না, সে রাজকুমারী জয়শ্রী দেবীকে পেয়ে আত্মহারা। গহন বনে পর্ণকুটির তৈরি করে সেখানে ঘর বাঁধলো ওরা দু জনে।

বিশ্বজিৎ সারাদিন বনে বনে কাঠ কাটে, সন্ধ্যায় হাটে বিক্রয় করে জয়শ্রীর জন্য নিয়ে আসে। আলতা আর সিঁদুর। নিয়ে আসে ফলমূল আর দুধ। হাসে, খেলে, গান গায়–রাজকুমার এতেই খুশি।

কিন্ত জয়শ্রী ব্যথা- বেদনায় মুষড়ে পড়ে, স্বামীর কষ্ট তাকে অত্যন্ত পীড়া দেয়। আজ তার জন্যই রাজকুমার হয়ে গহন বনে কুড়ে ঘরে বাস করছে। একমুঠি অন্নের সংস্থানে প্রখর রৌদ্রের মধ্যে কাষ্ঠ সংগ্রহ করে সে তারই জন্য।

জয়শ্রী এই জঙ্গলে সখী হিসাবে পেয়েছে ভীলবালা ফুল্লরাকে সে প্রায়ই আসে, ওর কাছে বসে কথা বলে, কখনও বা বন থেকে ফল এনে খেতে দেয়, কখনও বা ফুল দিয়ে মালা গেঁথে পরিয়ে দেয় জয়শ্রীর গলায়।

আজ জয়শ্রীর সঙ্গে ফুল্লরার একটি দৃশ্য গ্রহণ করা হবে।

পরিচালক শ্যামা এবং নূরীকে তাদের চরিত্র সম্বন্ধে বুঝিয়ে দিয়ে সরে দাঁড়ালেন, তারপর উচ্চকণ্ঠে বললেন–লাইট রেডি।

ক্যামেরা সাউন্ড….

ফ্লোরের বাইরে সাউন্ডভ্যান থেকে শোনা গেলো সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ারের গলা–ও,কে!

সাইলেন্স প্লিজ! অল লাইটস।

 নিস্তব্ধ চারিদিক।

প্রখর শক্তিশালী বৈদ্যুতিক আলোগুলো যেন আগুন ছড়াচ্ছে।

ক্লপষ্টিকে সিকোয়েন্স সিন নাম্বার টেক-নাম্বার এবং বই–এর নাম চক পেন্সিলে লিখে এ্যাসিসটেন্ট ক্যামেরার সামনে ধরলো।

পরিচালক বলে উঠলেন স্টার্ট ক্যামেরা।

এ্যাসিসটেন্ট বলে দ্রুত গলায় স্বয়ংবরা। নাম্বার নাইনটি নাইন। টেক থ্রী!

 ক্যামেরা চলতে শুরু করে।

কিন্ত ঐ মুহূর্তে নূরী শ্যামাকে জড়িয়ে ধরে বলে উঠে–না না আমি পারবো না, পারবো না এ সব! গলা থেকে ফুলের মালা ছিঁড়ে ফেলে। খোঁপা থেকে খুলে ফেলে ফুলের থোকা।

একি কান্ড, ইউনিট স্তব্ধ হয়ে যায়।

পরিচালক কাট’ বলবার আগেই ক্যামেরাম্যান ক্যামেরা বন্ধ করে ফেলেন।

 এবার পরিচালক চিৎকার করে উঠেন–লাইটস্ অফু, ফ্যান্স…

পট পট করে শক্তিশালী বৈদ্যুতিক আলোগুলো নিভে যায়।

 চার পাশে ফ্যানগুলো স্পীডে চলতে শুরু করে।

পরিচালক মাথায় হাত দিয়ে ধপ করে বসে পড়েন একটা চেয়ারে। সেটে সবাই স্তব্ধ-বিস্মিত হতবাক কারো মুখে কোনো কথা নেই। সহকারী দল এ-ওর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে।

শ্যামা তখন রাগতভাবে উঠে দাঁড়িয়েছে, ক্রুদ্ধকণ্ঠে বলে সে-শশী, এ তুমি কি করলে?

নূরী তখন তার সমস্ত মেকআপ নষ্ট করে ফেলেছে, বলে সে–চলো, তোমরা আমাকে শীগগির নিয়ে চলো বাসায় আর এক মুহূর্তও আমি এখানে থাকবো না।

শেষ পর্যন্ত নূরীর কথাই শুনতে বাধ্য হলেন পরিচালক।

*

ললাটে একটি কোমল হস্তের স্পর্শ অনুভব করে চোখ মেললো বনহুর–কেশব, এতো রাত–তুমি ঘুমাও নি?

কেশবের ডিউটি আছে, সে ইঞ্জিন-কক্ষে।

আপনি! আপনি এখানে মেম সাহেব?

কেমন আছো আলম এখন?

অনেক ভাল। কিন্তু আপনি এখানে…

 কেন, দোষ কি তাতে?

 মেম সাহেব, নিকৃষ্ট এক নাবিকের ক্যাবিনে আপনি সত্যি কল্পনাও করতে পারি না।

আলম, নাবিক বলে তুমি নিকৃষ্ট কে বলো? কেউ না জানুক আমি জানি, নাবিক হলেও তুমি অনেক মহৎ নীহারের হাতখানা তখনো বনহুরের ললাটে ধীরে ধীরে সঞ্চারিত হচ্ছিলো।

পূর্ণ দু’সপ্তাহ পর আরোগ্য লাভ করেছে বনহুর। এখনও সে সম্পূর্ণ সুস্থ নয়। দেহের কয়েকটা ক্ষতে তখনও ব্যান্ডেজ বাঁধা রয়েছে। ডাক্তার আপ্রাণ চেষ্টায় নাবিক আলমের চিকিৎসা করেছেন–আজও করছেন। শুধু আবু সাঈদের অনুরোধেই নয়, ডাক্তার আলমকে কখন ভালবেসে ফেলেছিলেন গভীরভাবে।

দিনরাত পরিশ্রম করেছেন ডাক্তার আলমের জন্য। নানা রকম ঔষধ-ইনজেকশন চালিয়েছে, পথ্যা-পথ্যের দিকে লক্ষ্য দিয়েছেন তিনি ভালভাবে।

নীহার নিজ হাতে আলমের সেবা করেছে, ঔষধ খাওয়ানো থেকে মাথা ধোয়ানোটা পর্যন্ত।

 আবু সাঈদ মানা করেননি বা বিরক্ত হননি কোনো সময়। বরং এতে তিনি খুশিই হয়েছেন। ধনবান ঐশ্বর্যশালী লোক হলেও তাঁর অন্তর ছিলো অত্যন্ত সচ্ছ, স্বাভাবিক। কোনো রকম অহঙ্কার বোধ ছিলো না তার মধ্যে! তাই নীহারের নিরহঙ্কার স্বভাবে তিনি আনন্দই পেতেন।

অনেক রাতেও পিতার সঙ্গে কতদিন খোঁজ নিতে আসতো নীহার। আজও এসেছে–কিন্তু আবু সাঈদ তখন নিদ্রামগ্ন ছিলেন।

বনহুর নীহারের মুখে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো, দেখলো ওর চোখ দুটো। কেমন মায়াময় ছলছল দুটি চোখ। শুভ্র ললাটে কয়েকগুচ্ছ কোকড়ানো কালো চুল। চিবুকের পাশে একটি তিল চিহ্ন। ক্যাবিনের স্বল্প আলোতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে নীহারের চিবুকে তিলটা। বড় সুন্দর লাগছে ওকে– বনহুর অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।

নীহার দৃষ্টি ফিরাতেই বনহুরের দৃষ্টির সঙ্গে চোখাচুখি হয়।

বনহুর বলে–মেম সাহেব এবার আপনি যান।

আমি তোমার পাশে থাকলে খারাপ লাগে বুঝি?

না। ভাল লাগে।

 তবে আমি এলেই তুমি কেমন যেন অস্বস্তি বোধ করো?

বনহুরের মুখে একটা ব্যথা করুণ হাসি ফুটে উঠে, বলে–আপনি কেমন করে জানলেন ঐ সময় আমি অস্বস্তি বোধ করি?

আমি এলেই তুমি আমাকে চলে যাবার জন্য বারবার ইংগিপূর্ণ কথা বলো।

মেম সাহেব!

না, আমাকে আর মেম সাহেব বলে ডাকবে না।

সে কি!

আমি জানি তুমি নাবিক নও।

চমকে উঠে বনহুর–আপনি কি বলছেন?

কেশবের মুখে শুনেছি, তুমি নাকি সাধারণ লোক নও!

বনহুর শয্যায় উঠে বসতে যায়। মুখখানা কেমন যেন বিবর্ণ হয়ে উঠে–ভাবে বনহুর, তবে কি কেশব সব কথা নীহারের কাছে বলে দিয়েছে…

নীহার শুইয়ে দেয় পুনরায় ওকে, বলে সে–আমি সব শুনেছি, কিন্তু কেন নিজকে গোপন করে নাবিক বেশে পরিচিত হয়েছো আলম?

মেম সাহেব, আমি অতি সাধারণ, তবে বড় খামখেয়ালী কিনা, তাই বুঝি কেশব আপনাকে যাতা বলেছে।

নিজকে লুকোতে চাইলেই লুকোনো যায় না আলম। তুমি ঘুমাও, আমি চললাম।

বনহুর কোনো জবাব দিলো না।

নীহার কম্বলখানা ভালভাবে বনহুরের দেহে টেনে দিয়ে বেরিয়ে গেলো।

বনহুর পাশ ফিরে শুলো।

কিন্তু গভীরভাবে চিন্তা করতে লাগলো, কেশব কি তাহলে ছেলেমানুষের মত সব কথা প্রকাশ করে দিয়েছে নীহারের কাছে।

সমস্ত রাত কেমন যেন ছটফট করে কাটাতে লাগলো বনহুর। কেবলি নীহারের শেষ কথাটা মনে আঁচড় কেটে চললো, নিজকে লুকোতে চাইলেই লুকোনো যায় না আলম।

তবে কি কেশব সব ব্যক্ত করে দিয়েছে? নিশ্চয়ই তাই হবে।

পরদিন কেশবকে ডেকে বললো বনহুর–কেশব শোনো।

 কেশব খুশি হয়ে এলো বনহুরের পাশে, শিয়রে বসলো–বাবু কিছু বলবেন?

হা।

বলুন বাবু?

কেশব, আমি তোমাদের বিশ্বাস করি, তোমাকে আমি নিজের ভাই-এর মত মনে করি। আর। তুমি আমার সম্বন্ধে সব কথা বলে দিয়েছো মালিকের কন্যা নীহারের কাছে?

অবাক হয়ে তাকালো কেশব, বললো–আপনি কি বলছেন বাবু? আমি আপনার কথা বুঝতে পারছি না।

কেশব, তুমি নীহারের কাছে আমার আসল পরিচয় ব্যক্ত করেছো?

না তো বাবু।

হাঁ, তুমি আমার পরিচয় দিয়েছো ওর কাছে? সব কিছু বলেছে?

মাফ করবেন বাবু, আমি নিজে কিছু বলিনি। মেম সাহেব একদিন আমাকে ডেকে বললেন, কেশব, তোমার বাবুকে দেখলে কিন্তু নাবিক বলে মনে হয় না।

তুমি কি বললে?

আমি বললাম–বাবু আসলেই নাবিক নন, তিনি মস্ত বড়লোকের ছেলে।

 হুঁ, শুধু তাই বলেছো?

 হাঁ বাবু, আমি শপথ করে বলছি শুধু তাই বলেছি।

 বনহুর নিশ্চিত হয়ে চোখ মুদলো, একটা চাপ যেন নেমে গেলো তার বুক থেকে।

*

বনহুর প্রায় সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠেছে।

কাজে যোগ দিতে চাইলেও আবু সাঈদ তাকে কাজ করতে দেননি, বলেছেন আর কয়েকদিন বিশ্রাম গ্রহণ করতে হবে। অগত্যা বনহুর শুয়ে-বসেই কাটাচ্ছে। ইতিমধ্যে তাদের জাহাজ দুটো বন্দর অতিক্রম করেছে। লাইলিয়াস বন্দর আর হিংলী বন্দর–এখানে দু’চারদিন নোঙ্গরও করেছে তাদের জাহাজ।

ক্যাপ্টেন জানিয়েছেন আর দু’দিন পর তাদের জাহাজ ইরুইয়ায় পৌঁছবে। ইরুইয়ায় একদিন অপেক্ষা করবার পর জাহাজ রওয়ানা দেবে ফৌজিন্দিয়া দ্বীপে।

ইরুইয়ায় প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ক্রয় করে নেবেন আবু সাঈদ–চাউল, ময়দা, মুরুগী, শুকনো দুধ আর ফলমূল। এসব ছাড়াও অনেক জিনিস ক্রয় করতে হবে।

আবু সাঈদ কন্যাসহ প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির একটি লিস্ট তৈরী করে ফেললেন। অন্য সময় হলে এক্ষণে নাসের থাকতো তাদের পাশে। পর পর কয়েকটা ঘটনার পর আবু সাঈদের মন যেন নাসেরের উপর বিরূপ হয়ে পড়েছিলো। কাজেই তিনি কতকটা ইচ্ছে করেই ওকে এড়িয়ে চলছেন আজকাল।

নীহার সেদিনের নাসেরের ঘটনাটা পিতার কাছে সচ্ছভাবে বলতে না পারলেও যতটুকু ব্যক্ত করেছিলো, তাতেই আবু সাঈদের কাছে নাসেরের আসল রূপ উদঘাটিত হয়ে পড়েছিলো। শুধু অমানুষই নয় সে, নষ্ট চরিত্রহীন এক কুৎসিত যুবক।

তার এতোদিনের ইচ্ছার পাদমূলে কুঠারাঘাত হয়েছিলো। দূষিত আবর্জনার মত মন থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়েছিলেন আবু সাঈদ নাসেরকে। স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেই ওকে পর্যটক দল থেকে বিতাড়িত করবেন–এ কথাও তিনি মনে মনে স্থির করে ফেলে ছিলেন। নীহারকেও তিনি বলে দিয়েছিলেন ওর সংস্পর্শে যেন আর না যায় সে।

শুধু আবু সাঈদই নন, নীহারও আজকাল নাসেরকে দেখে তুচ্ছ জ্ঞান করে পরিহার করে চলে।

আবু সাঈদের অবহেলার চেয়ে নীহারের অবজ্ঞাভরা ভাব দুষ্ট নাসেরকে আরও ক্ষিপ্ত করে তোলে। নানা ব্যাপারে বেশ কয়েকবার বিফল মনোরথ হয়ে খৰ্গহস্ত হয়ে উঠে সে। সদা-সর্বদা চলে গোপন পরামর্শ জলিল, শুম্ভ আর জন্ধুকে নিয়ে।

নাবিক ফারুক আলীকেও দলে টেনে নেয়; ওকে দিয়ে পুনরায় যদি কোনো পথ পরিস্কার করা। যায়!

আসলে ফারুক আলী মন্দ লোক নয়। সে জীবনের ভয়ে মুখ বুজে থাকে, এবং নাসেরের দলবলের সঙ্গে যোগ দিয়ে চলে। মকবুলের মৃত্যুরহস্য তার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে ঐদিন যেদিন নাসের বলেছিলো–আমার কথায় আপত্তি জানালে তোমাকেও মকবুলের মত পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হবে।

দেশে ফারুক আলীর বৌ ছেলেমেয়ে আছে, সংসার আছে। সবাই মুখ চেয়ে আছে ওর। ফারুক আলী অর্থ নিয়ে দেশে ফিরবে–কত আশা, বাসনা, আর কিনা সে মৃত্যুবরণ করবে! মরতে রাজি নয় সে, জীবনরক্ষার্থে তাকে দু’চারটা-কুকর্ম করতে হয় তাই করবে।

নাসের তার অনুচরদের নিয়ে সদা গোপন বৈঠক করলেও সহজে সে কিছু করে উঠতে পারছিলো না। বিশেষ করে জাহাজের সবাই সতর্ক হয়ে গিয়েছিলো, মকবুলের মৃত্যু, নাবিক আলমকে হত্যার ষড়যন্ত্র ভাবিয়ে তুলেছিলো প্রতিটি যাত্রীকে।

আবু সাঈদের সঙ্গী-সাথী পর্যটকগণও আতঙ্কিত হয়েছেন–আলমের মত একজন কর্মপরায়ণ উন্নতমনা নাবিককেও যখন প্রাণনাশ করার চেষ্টা হয়েছিলো, তখন বিশ্বাস কি।

নীহার নিজের চেয়ে বেশি আতঙ্কগ্রস্ত ছিলো নাবিক আলমের জন্য। পিতাকে বলে সে তার জন্য আরও কিছুদিন ছুটি মঞ্জুর করে নিয়েছিলো। উপস্থিত ওকে বিশ্রাম নিতে হবে।

হেড নাবিকের মৃত্যুর পর ঐ পদে ছিলো আলম।

আলম এক্সিডেন্ট হবার পর হেড নাবিকের কাজ করে চলেছে নাবিক ফারুক আলী। যে ফারুক আলীকে নাসের হাতের মুঠায় ভয়ে নিয়েছে।

নীহার পিতার অনুমতি নিয়ে আলমকে দেখাশোনার ভার নিয়েছিলো, কাজেই সে সময় অসময় সর্বক্ষণ যেতো নিচের ডেকে নাবিক আলমের ক্যাবিনে।

স্বল্প পাওয়ারের আলোতে ছোট বোয়াটে ক্যাবিনটার মধ্যে এসে দাঁড়াতে নীহার। তাকিয়ে দেখতে অসুস্থ আলমের ঘুমন্ত মুখ। করুণ ব্যথাভরা লাগতো ওকে। আহা বেচারী, কেউ নেই ওর। নীহারের গন্ড বেয়ে দু’ফোঁটা পানি ঝরে পড়তো।

নীহার আলগোছে কম্বলটা ঠিক করে দিতো আলমের দেহে।

কোনোদিন শিয়রে বসে কপালে হাত রাখতো।

ঔষধ খাওয়ানোর সময় হলে কতদিন খাইয়ে দিতো।

আলমের তখন হুশ ছিলো না, সে তখন ক্ষতের ব্যাথায় কাতর।

যখন তার হুশ হলো, তখন নীহারকে তার অপরিচ্ছন্ন ক্যাবিনে দেখে অবাক হলো–মেম সাহেব এসেছেন তার রোগশয্যার পাশে!

বনহুর একদিন বলেই ফেলেছিলো–মেম সাহেব, আপনি কষ্ট করছেন আমার জন্য!

হেসে বলেছিলো নীহার–আমার এ কষ্ট দিয়ে তোমার কষ্ট যদি লাঘব করতে পারতাম, তার চেয়ে আনন্দ বুঝি আমার আর কিছু ছিলো না।

বনহুর সেদিন এক অভূতপূর্ব খুশিতে অভিভূত হয়ে পড়েছিলো, বলেছিলো মেম সাহেব, আপনি আমাকে এতো আর বলতে পারেনি সে।

কেশব এসে পড়েছিলো কক্ষের মধ্যে।

বনহুর চোখ মুদে ছিলো তখন অনিচ্ছাসত্ত্বে নীহারের দিকে চাইতে পারেনি সে।

নীহার বনহুরকে ঔষধ খাইয়ে চলে গিয়েছিলো সেদিন, শোনা হয়নি তার–কি বলতে চেয়েছিলো আলম।

*

বনহুর ক্যাবিনের বিছানায় অর্ধশায়িত অবস্থায় শুয়ে তাকিয়েছিলো পাশের ছোট শার্সী দিয়ে কলকল ছলছল জলরাশির দিকে।

ক্যাবিনে বা আশেপাশে কেউ নেই। কেশব কাজে গেছে। বনহুরকে বড় একা লাগছে আজ। এখন তো সে অসুস্থ নয়। প্রায় সম্পূর্ণ সুস্থ বলা বলে।

কাঁধে এবং হাতে দু’এক জায়গায় ছোট্ট পট্টি রয়েছে এখনও। তবে ভয় নেই আর, বিপদ কেটে গেছে পূর্ণভাবে। বনহুর ভেবে চলেছে তার বিগত জীবনের কথা।

ঠিক সেই সময় লঘু পদশব্দ শুনতে পেলো বনহুর।

হালকা হিলের খুটখাট শব্দ।

আজ এ ক’দিনে এই শব্দটার সঙ্গে বেশ পরিচিত হয়ে গেছে সে। নীহারের জুতোর শব্দ বুঝতে পেরে বনহুর যেমন ছিলো তেমনি থাকে।

এ শব্দটা বড় ভাল লাগে দস্যু বনহুরের কাছে। মায়া-মমতা আর প্রীতির ছোঁয়া যেন লেগে আছে এ শব্দের সঙ্গে; স্নিগ্ধ হিমেল হাওয়ার মত মিষ্ট এ শব্দটা মনে হয় বনহুরের কাছে।

সুমিষ্ট কণ্ঠের প্রতিধ্বনি জাগে–ঔষধ খেয়েছো আলম?

 সোজা হয়ে বসে বনহুর–মেম সাহেব আপনি!

 আবার তুমি আমাকে মেম সাহেব বলছো? মেম সাহেব বললে আমি কিন্তু বড় রাগ করবো।

 আমি গরিব বেচারী কি বলে ডাকতে পারি বলুন?

 নাম ধরে ডেকো।

নাম! আপনার নাম ধরবো আমি?

দোষ কি আমার নাম ধরতে?

কি যে বলেন, আমরা চাকর-বাকর নাবিক মানুষ…

আবার নেকামি? আমি তো বলেছি তোমার সব খোঁজ জানি?

কেশব যা বলছে মোটেই সত্য নয়।

কেশব মিথ্যা বললেও আমার চোখ তো মিথ্যা নয়। আমার দৃষ্টি বলছে–তুমি সাধারণ মানুষ নও।

নীহার! হঠাৎ বনহুরের মুখ দিয়ে শব্দটা বেরিয়ে এলো।

বনহুরের মুখে নামটা শুনে নীহারের চোখ দুটো আনন্দে স্ফীত হয়ে উঠলো। বসে পড়লো সে বনহুরের বেডের পাশে।“হাঁ, তুমি আজ থেকে আমাকে নাম ধরে ডাকবে।

তা হয় না মেম সাহেব। আপনি মনিব-কন্যা আর আমি…

আলম!

বলুন?

তোমার যদি এতো অসুবিধা মনে হয় তবে সবার আড়ালে তুমি আমায় নাম ধরে ডাকবে? নীহার বনহুরের মুখের দিকে ব্যাকুল আঁখি মেলে তাকালো।

বনহুর শয্যায় দেহটা এলিয়ে দিলো, একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে বললো–যদি খুশি হন। আপনি তবে তাই ডাকবো।

কিন্তু আপনি নয় তুমি বলতে হবে।

আমাকে এতোটা প্রশ্রয় দেওয়া ঠিক হবে না মেম সাহেব।

 কেন?

সে জবাব আমি দিতে চাই না।

ঔষধ খেয়েছো?

 আর কত ঔষধ খাবো? এখন তো আমি সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভ করেছি।

শরীর তো মোটেই সারেনি। আরও এক সপ্তাহ তোমাকে বিশ্রাম নিতে হবে।

 আমি যে দম বন্ধ হয়ে মারা পড়বো মেম সাহেব?

বেশ, আমি তোমাকে মুক্ত হাওয়ায় নিয়ে যাবো। নাও, ঔষধটা খেয়ে নাও। শিশি থেকে ছোট্ট গেলাসটায় ঔষধ ঢেলে বনহুরের মুখের কাছে এগিয়ে ধরে।

বনহুর হাত বাড়ায়–দিন।

নীহারের হাত থেকে ঔষধের ছোট্ট গেলাসটা নিতে গিয়ে বনহুরের হাতখানা লাগে নীহারের হাতে। অভূতপূর্ব এক শিহরণ বয়ে যায় নীহারের সমস্ত দেহে, হাতখানা চট করে সরিয়ে নিতে পারে না ওর হাতের তলা থেকে।

বনহুর বলে–নীহার, সত্যি তোমার অন্তরের অনুভূতি বরফের চেয়েও ঠান্ডা। গভীর তোমার প্রতিবোধ। সামান্য নাবিক জেনেও তুমি আমাকে ঘৃণা করোনি কোনোদিন। তোমার সচ্ছ হৃদয়ের কাছে আমি কৃতজ্ঞ।

বনহুর নীহারের হাত থেকে ঔষধের ছোট্ট গেলাসটা নিয়ে ঔষধ পান করে।

নীহার তখন অপলক নয়নে তাকিয়ে আছে বনহুরের দিকে। একজন সাধারণ নাবিকের মুখে এ কথা তাকে যেন সম্বিৎ হারা করে ফেললো। বুঝতে পারলো, কেশবের কথা শুধু সত্যই নয়, একেবারে খাঁটি বিশ্বাসযোগ্য। বললো নীহার–আলম, তুমি নাবিক সেজে কেন নিজেকে এভাবে গোপন রেখেছো?

হাসলো বনহুর–কাজ তো কোনোদিন ছোট হয় না নীহার। যে কোন কাজের মাধ্যমেই মানুষ মহত্বের পরিচয় দিতে পারে।

আলম, তোমাকে যত দেখি তত আরও দেখতে ইচ্ছা করে। যত ভাবি তোমার কথা, ততই আরও ভাবতে চায় মন। তোমার সান্নিধ্য আমাকে আত্নবিস্মৃতির পথে টেনে নিয়ে যায়….

নীহার!

আলম, বলো তুমি কি চাও আমার কাছে?

বনহুর স্থির দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়েছিলো মুক্ত গবাক্ষে। সীমাহীন জলরাশির উচ্ছলতার দিকে তাকিয়ে শুনে যাচ্ছিলো। নীহারের আবেগভরা কথাগুলো। ফিরে তাকালো বনহুর এবার নীহারের শেষ কথাটা শুনে। দেখলো ওর চোখেমুখে এক অপূর্ব ভাবের উন্মেষ।

বনহুরের বুকের মধ্যে একটা আলোড়ন শুরু হলো। দেহের মাংস পেশীগুলো যেন সজাগ হয়ে। উঠলো ক্রমান্বয়ে। সোজা হয়ে বসলো বনহুর।

নীহার ঠিক তার অর্ধ হাত দূরে, তারই শয্যায় বসে রয়েছে। নীল মায়াভরা দুটি চোখে মোহময় চাহনি। গোলাপের পাপড়ির মত দুটি আঁখিপল্লব। ওষ্ঠদ্বয় অর্ধস্ফীত। কুঞ্চিত একরাশি চুল বিনী করে ঝুলানো রয়েছে পিঠে ঠিক একটি সাপের মত।

বনহুর নিশ্বাস নিলো। একটা সুগন্ধ প্রবেশ করলো তার নাসিকারন্ধ্রে। নীহারের দেহের মিষ্ট গন্ধ এটা জানে বনহুর। কারণ আরও অনেকদিন এ গন্ধ বনহুরের নাকে প্রবেশ করেছে তার অসুস্থকালে। অতি পরিচিত এ গন্ধ। নীহার শিয়রে এসে দাঁড়ালেই বনহুর টের পেতো নীহার এসেছে, কারণ নীহারের দেহের সুগন্ধ এটা।

অবশ্য নীহার ইচ্ছে করে সুগন্ধ ব্যবহার করে তবে এ ক্যাবিনে আসতো না। ধনবান দুহিতা মূল্যবান প্রসাধন ব্যবহার করতো–তাই এ গন্ধ। বনহুর তাই ঐ গন্ধের সঙ্গে বিশেষ করে পরিচিত হয়ে গিয়েছিলো।

আজ নীহারের দেহের মিষ্ট সুবাস বনহুরের আনমনা নাককে চঞ্চল করে তোলে। নীহারের হাতখানার উপর আস্তে তার হাতখানা রাখে।

নীহার শিউরে উঠলেও চমকায় না। বুকটা টিপ টিপ করতে থাকে। একটা অনুভূতি দোলা জাগায় সমস্ত দেহ আর মনে। মাথা নত করে নেয় নীহার। চোখ তুলে তাকাতে পারছে না যেন আর সে।

সেদিন নাসেরের ক্ষুধিত শার্দুলের মত ক্ষুব্ধ আক্রমণে নীহার ক্ষিপ্তের ন্যায় হয়ে উঠেছিলো। নিজকে বাঁচানোর জন্য সে চালিয়েছিলো ভীষণ সংগ্রাম। মৃত্যুকেও সে ঐ মুহূর্তে জয় করে নিতে। কি কঠিনভাবে যুদ্ধই না সে করেছিলো নাসেরের সঙ্গে নিজকে রক্ষা করার জন্য।

নীহার মরিয়া হয়ে উঠেছিলো নাসেরের কবল থেকে ইজ্জৎ বাঁচানোর জন্য। সেই মুহূর্তে সে ওকে হত্যা করতেও কুণ্ঠা বোধ করতো না। নাসেরের দেহের মাংস ছিঁড়ে ফেলেছিলো নীহার দাঁত দিয়ে সেদিন।

নীহার জানতো নাসের তাকে ভালবাসে, জানতো তার পিতা আবু সাঈদ ওর সঙ্গে বিয়েও দেবেন। নাসের অসুন্দর যুবক নয় বলিষ্ঠ সুশ্রী সুপুরষ। তবু নীহার ওকে ঘৃণা করতো, কারণ চরিত্রহীন কুৎসিতমনা পুরুষকে কোন সতচরিত্রা নারী প্রেমপ্রীতি আর ভালবাসা দিয়ে গ্রহণ করতে পারে না।

নীহার সম্ভ্রান্ত ঘরের শিক্ষিতা আদর্শবতী কন্যা। নাসের তাকে নানাভাবে প্রলুব্ধ করতে চেষ্টা করলেও সে কোনো সময় নাসেরের প্রতারণায় আত্নহুতি দিতো না। যতদূর সম্ভব নিজেকে কুচরিত্রের শ্যেন দৃষ্টি থেকে সরিয়ে রাখতো। নাসেরের সংস্পর্শকে সে ঘৃণা করতো চরম আকারে।

নাসের নীহারের কাছে ঘৃণিত ব্যক্তি হিসাবে প্রথম থেকেই অবহেলা পেয়ে এসেছে। যখন। আলম আসেনি এ জাহাজে, তখনও ওকে কোনো সময় প্রশ্রয় দেয়নি, বা প্রীতির চোখে দেখেনি। নাসেরের মত একজন সুদর্শন বলিষ্ঠ তেজোদ্দীপ্ত যুবক পাশে থাকা সত্ত্বেও নীহারের মনে ছিলো অতৃপ্ত বাসনা–যে আকাঙ্খা পূর্ণ করতে পারবে না নাসের।

নীহার যেমন ধীরস্থিরা মেয়ে, চরিত্র যেমন ফুলের মত সচ্ছ-সুন্দর, তেমনি একজনের সন্ধানে সে অহরহ প্রতীক্ষা করতো শান্ত মন নিয়ে খুজতো ফুলের সুবাস।

নাবিক আলমের আগমনে নীহার সন্ধান পেয়েছিলো তার কামনার মানুষটির। প্রথম নজরেই ওকে ভাল লেগেছিলো। সুন্দর চেহারা তখন ঢাকা খোঁচা খোঁচা দাড়ি-গোঁফের আড়ালে। কাজেই নাবিকের রূপলাবণ্য আকৃষ্ট করেনি তাকে। নীহার আকৃষ্ট হয়েছিলো আলমের পৌরুষোচিত কণ্ঠস্বরে, তার দীপ্ত উজ্জল চোখ দুটির চাহনি অভিভূত করেছিলো তাকে।

কিন্তু জানে না নীহার–যাকে খুঁজে পেয়েছে তাকে কোনদিন সে নিজের করে পাবে না। ধূমকেতুর মত এসেছে, আবার হারিয়ে যাবে তার জীবনপাতার অন্তরালে।

নীহার বনহুরের হাতের মধ্যে হাত রেখে নতমুখে বসে থাকে। সরিয়ে নিতে পারে না সে হাতখানা। বনহুর হাতখানা তুলে নেয় হাতের মুঠোয়। বাম হস্তের মধ্যে নীহারের হাতখানা নিয়ে দক্ষিণ হস্ত বুলোতে থাকে ওর হাতের উপর। এমনি একটি কোমল নরম হাত কদিন আগেও সে হাতের মুঠায় রেখেছিলো, কিন্তু কালচক্রে আজ সে হাত কোথায় ছিটকে পড়েছে কে জানে। হিংস্র জন্তুর গহ্বরে চলে গেছে, না কোনো জংলীদলের কবলে ধরা পড়েছে–কে বলবে তাকে তার সন্ধান বনহুরের গন্ড বেয়ে দু’ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে।

বনহুর বাষ্পরুদ্ধ গলায় বলে নীহার!

চোখ তুলে নীহার, আলমের চোখে পানি দেখে চমকে উঠে–আলম তুমি কাঁদছো?

একটা জমাট ব্যথা যেন বেরিয়ে আসে বনহুরের বুক চীরে। দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে বলে– নীহার, আমি বড় দুঃখী! বড় একা।

আলম, আমি তোমাকে বলছি, যা চাও আমি তোমায় তাই দেবো! আর আমি যদি থাকি। তোমার পাশে?

নীহার!

আলম, আমার অতৃপ্ত হৃদয় তোমায় খুঁজে পেয়েছে; আমি তোমায় কোথাও যেতে দেবো না আর।

একটা করুণ বিষণ্ণ হাসির স্মিত রেখা ফুটে উঠলো বনহুরের ঠোঁটে। নীহারের হাতখানা সেই মুহূর্তে খসে পড়লো বনহুরের হাতের মুঠা থেকে।

নীহার অবাক হয়ে তাকালো।

জীবনে সে বহু পুরুষ দেখেছে, যদিও সে কারো সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ায়নি। কিন্তু যতটুকু পরিচয় হয়েছে তার সঙ্গে সবাই তাকে কাছে পেলেই কিসের যেন একটা লোলুপ দৃষ্টি নিয়ে দেখেছে। সুযোগ পেলেই শুনিয়েছে প্রেমবাণী। আরও কাছে পাবার জন্য তারা যেন পশুর মত ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে।

নীহারের চোখেমুখে এক মধুময় দীপ্তভাব ফুটে উঠে। নিজের আঁচলে বনহুরের চোখের গড়িয়ে পড়া দু’ফোঁটা পানি মুছিয়ে দেয়।

বনহুর পুনরায় নীহারের হাতখানা মুঠায় চেপে ধরে বাষ্প ভরা গলায় বলে নীহার, চোখের অশ্রু যেমন করে মুছিয়ে দিলে, পারবে অমনি করে আমার মন থেকে সব ব্যথা-বেদনা মুছে ফেলতে?

পারবো। তোমার সব বেদনা আমি মুছে ফেলতে পারবো। কথাটা বলে নীহার হঠাৎ বনহুরের বুকে মাথা রাখে।

ঠিক সেই মুহূর্তে ক্যাবিনে প্রবেশ করে নাসের, দক্ষিণ হস্তে তার উদ্যত পিস্তল।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন