রাজর্ষি – ৪৫ উপসংহার

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

এইখানে বলা আবশ্যক তিনটি বালক সুজার তিন ছদ্মবেশী কন্যা। সুজা মক্কা যাইবার উদ্দেশে চট্টগ্রাম বন্দরে গিয়াছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে গুরুতর বর্ষার প্রাদুর্ভাবে একখানিও জাহাজ পাইলেন না। অবশেষে হতাশ হইয়া ফিরিয়া আসিবার পথে, গোবিন্দমাণিক্যের সহিত দুর্গে দেখা হয়। কিছুদিন দুর্গে বাস করিয়া সুজা সংবাদ পাইলেন এখনো সম্রাট-সৈন্য তাঁহাকে সন্ধান করিতেছে। গোবিন্দমাণিক্য যানাদি ও বিস্তর অনুচর-সমেত তাঁহার বন্ধু আরাকান-পতির নিকটে তাঁহাকে প্রেরণ করেন। যাইবার সময় সুজা তাঁহাকে বহুমূল্য তরবারি উপহারস্বরূপ দান করেন।
ইতিমধ্যে রাজা রঘুপতি ও বিলবনে মিলিয়া সমস্ত গ্রামকে যেন সচেতন করিয়া তুলিলেন। রাজার দুর্গ সমস্ত গ্রামের প্রাণ হইয়া উঠিল।
এইরূপে ছয় বৎসর কাটিয়া গেলে ছত্রমাণিক্যের মৃত্যু হইল। গোবিন্দমাণিক্যকে সিংহাসনে ফিরাইয়া লইবার জন্য ত্রিপুরা হইতে দূত আসিল।
গোবিন্দমাণিক্য প্রথমে বলিলেন, “আমি রাজ্যে ফিরিব না।”
বিল্বন কহিলেন, “সে হইবে না মহারাজ। ধর্ম যখন স্বয়ং দ্বারে আসিয়া আহ্বান করিতেছেন তখন তাঁহাকে অবহেলা করিবেন না।”
রাজা তাঁহার ছাত্রদের দিকে চাহিয়া কহিলেন, “আমার এতদিনকার আশা অসমাপ্ত, এতদিনকার কার্য অসম্পূর্ণ রহিবে?”
বিল্বন কহিলেন, “এখানে তোমার কার্য আমি করিব।”
রাজা কহিলেন, “তুমি যদি এখানে থাক তাহা হইলে আমার সেখানকার কার্য অসম্পূর্ণ হইবে।”
বিল্বন কহিলেন, “না মহারাজ, এখন আমাকে আর তোমার আবশ্যক নাই। তুমি এখন আপনার প্রতি আপনি সম্পূর্ণ নির্ভর করিতে পার। আমি যদি সময় পাই তো মাঝে মাঝে তোমার সহিত সাক্ষাৎ করিতে যাইব।”
রাজা ধ্রুবকে সঙ্গে লইয়া রাজ্যে প্রবেশ করিলেন। ধ্রুব এখন আর নিতান্ত ক্ষুদ্র নহে। সে বিলবনের প্রসাদে সংস্কৃত ভাষা শিক্ষা করিয়া শাস্ত্র-অধ্যয়নে মন দিয়াছে। রঘুপতি পুনর্বার পৌরহিত্য গ্রহণ করিলেন। এবার মন্দিরে আসিয়া যেন মৃত জয়সিংহকে পুনর্বার জীবিতভাবে প্রাপ্ত হইলেন।
এ দিকে বিশ্বাসঘাতক আরাকান-পতি সুজাকে হত্যা করিয়া তাঁহার সর্বকনিষ্ঠ কন্যাকে বিবাহ করেন।-
“দুর্ভাগা সুজার প্রতি আরাকান-পতির নৃশংসতা সমরণ করিয়া গোবিন্দমাণিক্য দুঃখ করিতেন। সুজার নাম চিরসমরণীয় করিবার জন্য তিনি তরবারের বিনিময়ে বহুতর অর্থদ্বারা কুমিল্লা-নগরীতে একটি উৎকৃষ্ট মসজিদ প্রস্তুত করাইয়াছিলেন। তাহা অদ্যাপি সুজা-মসজিদ বলিয়া বর্তমান আছে।
“গোবিন্দমাণিক্যের যত্নে মেহেরকুল আবাদ হইয়াছিল। তিনি ব্রাহ্মণগণকে বিস্তর ভূমি তাম্রপত্রে সনন্দ লিখিয়া দান করেন। মহারাজ গোবিন্দমাণিক্য কুমিল্লার দক্ষিণে বাতিসা গ্রামে একটি দীর্ঘিকা খনন করাইয়াছিলেন। তিনি অনেক সৎকার্যের অনুষ্ঠান করিতেছিলেন, কিন্তু সম্পন্ন করিতে পারেন নাই। এইজন্য অনুতাপ করিয়া ১৬৬৯ খৃঃ অব্দে মানবলীলা সম্বরণ করেন।”

—————–
শেষ দুই প্যারাগ্রাফ শ্রীযুক্ত বাবু কৈলাস চন্দ্র সিংহ প্রণীত ত্রিপুরার ইতিহাস হইতে উদ্ধৃত

অধ্যায় ৪৫ / ৪৫

সকল অধ্যায়

১. রাজর্ষি – ০১ পরিচ্ছেদ
২. রাজর্ষি – ০২ পরিচ্ছেদ
৩. রাজর্ষি – ০৩ পরিচ্ছেদ
৪. রাজর্ষি – ০৪ পরিচ্ছেদ
৫. রাজর্ষি – ০৫ পরিচ্ছেদ
৬. রাজর্ষি – ০৬ পরিচ্ছেদ
৭. রাজর্ষি – ০৭ পরিচ্ছেদ
৮. রাজর্ষি – ০৮ পরিচ্ছেদ
৯. রাজর্ষি – ০৯ পরিচ্ছেদ
১০. রাজর্ষি – ১০ পরিচ্ছেদ
১১. রাজর্ষি – ১১ পরিচ্ছেদ
১২. রাজর্ষি – ১২ পরিচ্ছেদ
১৩. রাজর্ষি – ১৩ পরিচ্ছেদ
১৪. রাজর্ষি – ১৪ পরিচ্ছেদ
১৫. রাজর্ষি – ১৫ পরিচ্ছেদ
১৬. রাজর্ষি – ১৬ পরিচ্ছেদ
১৭. রাজর্ষি – ১৭ পরিচ্ছেদ
১৮. রাজর্ষি – ১৮ পরিচ্ছেদ
১৯. রাজর্ষি – ১৯ পরিচ্ছেদ
২০. রাজর্ষি – ২০ পরিচ্ছেদ
২১. রাজর্ষি – ২১ পরিচ্ছেদ
২২. রাজর্ষি – ২২ পরিচ্ছেদ
২৩. রাজর্ষি – ২৩ পরিচ্ছেদ
২৪. রাজর্ষি – ২৪ পরিচ্ছেদ
২৫. রাজর্ষি – ২৫ পরিচ্ছেদ
২৬. রাজর্ষি – ২৬ পরিচ্ছেদ
২৭. রাজর্ষি – ২৭ পরিচ্ছেদ
২৮. রাজর্ষি – ২৮ পরিচ্ছেদ
২৯. রাজর্ষি – ২৯ পরিচ্ছেদ
৩০. রাজর্ষি – ৩০ পরিচ্ছেদ
৩১. রাজর্ষি – ৩১ পরিচ্ছেদ
৩২. রাজর্ষি – ৩২ পরিচ্ছেদ
৩৩. রাজর্ষি – ৩৩ পরিচ্ছেদ
৩৪. রাজর্ষি – ৩৪ পরিচ্ছেদ
৩৫. রাজর্ষি – ৩৫ পরিচ্ছেদ
৩৬. রাজর্ষি – ৩৬ পরিচ্ছেদ
৩৭. রাজর্ষি – ৩৭ পরিচ্ছেদ
৩৮. রাজর্ষি – ৩৮ পরিচ্ছেদ
৩৯. রাজর্ষি – ৩৯ পরিচ্ছেদ
৪০. রাজর্ষি – ৪০ পরিচ্ছেদ
৪১. রাজর্ষি – ৪১ পরিচ্ছেদ
৪২. রাজর্ষি – ৪২ পরিচ্ছেদ
৪৩. রাজর্ষি – ৪৩ পরিচ্ছেদ
৪৪. রাজর্ষি – ৪৪ পরিচ্ছেদ
৪৫. রাজর্ষি – ৪৫ উপসংহার

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন