২.০৮ মহাশ্বেতা কহিলেন

বানভট্ট

মহাশ্বেতা কহিলেন, মহাভাগ! অপ্সরাদিগের এক কুল অমৃত হইতে সমুদ্ভূত হয় আপনাকে কহিয়াছি। সেই কুলে মদিরা নামে এক কন্যা জন্মে। গন্ধর্ব্বের অধিপতি চিত্ররথ তাঁহার পাণিগ্রহণ করেন এবং তাঁহার গুণে বশীভূত হইয়া ছত্র চামর প্রভৃতি প্রদান পূর্ব্বক তাঁহাকে মহিষী করেন। কালক্রমে মহিষী গর্ভবতী হইয়া যথাকালে এক কন্যা প্রসব করেন। কন্যার নাম কাদম্বরী। কাদম্বরী নির্ম্মলা শশিকলার ন্যায় ক্রমে ক্রমে বৃদ্ধি প্রাপ্ত হইয়া এরূপ রূপবতী ও গুণবতী হইলেন যে, সকলেই তাঁহাকে দেখিলে আনন্দিত হইত ও অত্যন্ত ভাল বাসিত। শৈশবাবধি একত্র শয়ন, একত্র অশন, একত্র অবস্থান প্রযুক্ত আমি কাদম্বরীর প্রণয়পাত্র ও স্নেহপাত্র হইলাম। সর্ব্বদা একত্র ক্রীড়া কৌতুক করিতাম, এক শিক্ষকের নিকট নৃত্য, গীত, বাদ্য, বিদ্যা শিখিতাম, এক শরীরের মত দুই জনে একত্র থাকিতাম। ক্রমে এরূপ অকৃত্রিম সৌহার্দ্দ জন্মিল যে, আমি তাঁহাকে সহোদরার ন্যায় জ্ঞান করিতাম; তিনিও আমাকে আপন হৃদয়ের ন্যায় ভাবিতেন। এক্ষণে আমার এই দুরবস্থা শুনিয়া প্রতিজ্ঞা করিলেন, যাবৎ মহাশ্বেতা এই অবস্থায় থাকিবেন তাবৎ আমি বিবাহ করিব না। যদি পিতা মাতা অথবা বন্ধুবর্গ বলপূর্ব্বক আমার বিবাহ দেন তাহা হইলে অনশনে, হুতাশনে অথবা উদ্বন্ধনে প্রাণ ত্যাগ করিব। গন্ধর্ব্বরাজ চিত্ররথ ও মহাদেবী মদিরা পরম্পরায় কন্যার এই প্রতিজ্ঞা শুনিয়া অতিশয় দুঃখিত হইয়াছেন। কিন্তু এক অপত্য, অত্যন্ত ভাল বাসেন, সুতরাং তাঁহার প্রতিজ্ঞার বিরুদ্ধে কোন কথা উত্থাপন করিতে পারেন নাই। যুক্তি করিয়া অদ্য প্রভাতে ক্ষীরোদনামা এক কঞ্চুকীকে আমার নিকট পাঠাইয়াছিলেন। তাহার দ্বারা আমাকে বলিয়া পাঠান, “বৎসে মহাশ্বেতে! তোমা ব্যতিরেকে কেহ কাদম্বরীকে সান্ত্বনা করিতে সমর্থ নয়। সে এইরূপ প্রতিজ্ঞা করিয়াছে; এক্ষণে যাহা কর্ত্তব্য হয় কর।” আমি গুরুজনের গৌরবে ও মিত্রতার অনুরোধে ক্ষীরোদের সহিত তরলিকাকে কাদম্বরীর নিকট পাঠাইয়াছি। বলিয়া দিয়াছি, সখি! একেই আমি মরিয়া আছি, আবার কেন যন্ত্রণা বাড়াও? তোমার প্রতিজ্ঞা শুনিয়া অত্যন্ত দুঃখিত হইলাম। আমার জীবিত থাকা যদি অভিপ্রেত হয়, তাহা হইলে, গুরুজনের অনুরোধ কদাচ উল্লঙ্ঘন করিও না। তরলিকাও তথায় গেল; আপনিও এখানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন।

মহাশ্বেতা এইরূপ পরিচয় দিতেছেন এমন সময়ে নিশানাথ গগনমণ্ডলে উদিত হইলেন। তারাগণ হীরকের ন্যায় উজ্জ্বল কিরণ বিস্তার করিল। বোধ হইল যেন, যামিনী গগনের অন্ধকার নিবারণের নিমিত্ত শত শত প্রদীপ প্রজ্বলিত করিলেন। মহাশ্বেতা শীতল শিলাতলে পল্লবের শয্যা পাতিয়া নিদ্রা গেলেন। চন্দ্রাপীড় মহাশ্বেতাকে নিদ্রিতা দেখিয়া আপনিও শয়ন করিলেন। এবং বৈশম্পায়ন কত চিন্তা করিতেছেন, পত্রলেখা কত ভাবিতেছে, অন্যান্য সমভিব্যাহারী লোক আমার অনাগমনে কত উদ্বিগ্ন হইয়াছে; এইরূপ চিন্তা করিতে করিতে নিদ্রাগত হইলেন।

প্রভাত হইলে মহাশ্বেতা গাত্রোত্থান পূর্ব্বক সন্ধ্যোপাসনাদি সমুদায় প্রাতঃকৃত্য সমাপন করিয়া জপ করিতে আরম্ভ করিলেন। চন্দ্রাপীড়ও প্রাভাতিক বিধি যথাবিধি সম্পাদন করিতেছেন এমন সময়ে পীনবাহু, বিশালবক্ষঃস্থল, করে তরবারিধারী, বলবান্, ষোড়শবর্ষবয়স্ক, কেয়ূরকনামা এক গন্ধর্ব্বদারকের সহিত তরলিকা তথায় উপস্থিত হইল। অপরিচিত চন্দ্রাপীড়ের অলৌকিক সৌন্দর্য্য দর্শনে বিস্মিত হইয়া, ইনি কে? কোথা হইতে আসিলেন? এইরূপ চিন্তা করিতে করিতে মহাশ্বেতার নিকটে গিয়া বসিল। কেয়ূরকও এক শিলাতলে উপবিষ্ট হইল। জপ সমাপ্ত হইলে মহাশ্বেতা তরলিকাকে জিজ্ঞাসিলেন, তরলিকে! প্রিয়সখী কাদম্বরীর কুশল? আমি যাহা বলিয়া দিয়াছিলাম তাহাতে ত সম্মত হইয়াছেন? কেমন, তাঁহার অভিপ্রায় কি বুঝিলে? তরলিকা কহিল, ভর্ত্তৃদারিকে! হাঁ কাদম্বরী কুশলে আছেন, আপনার উপদেশবাক্য শুনিয়া রোদন করিতে করিতে কত কথা কহিলেন। এই কেয়ূরকের মুখে সমুদায় শ্রবণ করুন।

কেয়ূরক বদ্ধাঞ্জলি হইয়া নিবেদন করিল, কাদম্বরী প্রণয় প্রদর্শন পূর্ব্বক সাদর সম্ভাষণে আপনাকে কহিলেন, “প্রিয়সখি! যাহা তরলিকার মুখে বলিয়া পাঠাইয়াছ উহা কি গুরুজনের অনুরোধক্রমে, অথবা আমার চিত্ত পরীক্ষার নিমিত্ত, কি অদ্যাপি গৃহে আছি বলিয়া তিরস্কার করিয়াছ? যদি মনের সহিত উহা বলিয়া থাক, তোমার অন্তঃকরণে কোন অভিসন্ধি আছে, সন্দেহ নাই। এই অধীনকে একবারে পরিত্যাগ করিবে ইহা এত দিন স্বপ্নেও জানি নাই। আমার হৃদয় তোমার প্রতি যেরূপ অনুরক্ত তাহা জানিয়াও এইরূপ নিষ্ঠুর বাক্য বলিতে তোমার কিছুমাত্র লজ্জা হইল না? আমি জানিতাম তুমি স্বভাবতঃ মধুরভাষিণী ও প্রিয়বাদিনী। এক্ষণে এরূপ পরুষ ও অপ্রিয় কথা কহিতে কোথায় শিখিলে? আপাততঃ মধুররূপে প্রতীয়মান, কিন্তু অবসানবিরস কর্ম্মে কোন্ ব্যক্তির সহসা প্রবৃত্তি জন্মে? আমি ত প্রিয়সখীর দুঃখে নিতান্ত দুঃখিনী হইয়াছি। এ সময়ে কি রূপে অকিঞ্চিৎকর বিবাহের আড়ম্বর করিয়া আমোদ প্রমোদ করিব? এ সময় আমোদের সময় নয় বলিয়াই সেইরূপ প্রতিজ্ঞা করিয়াছি। প্রিয়সখীর দুঃখে দুঃখিত অন্তঃকরণে সুখের আশা কি? সম্ভোগেরই বা স্পৃহা কি? মানুষের ত কথাই নাই, পশুপক্ষীরাও সহচরের দুঃখে দুঃখ প্রকাশ করিয়া থাকে। দিনকরের অস্তগমনে নলিনী মুকুলিত হইলে তৎসহবাসিনী চক্রবাকীও প্রিয়সমাগম পরিত্যাগ পূর্ব্বক সারা রাত্রি চীৎকার করিয়া দুঃখ প্রকাশ করে। যাহার প্রিয়সখী বনবাসিনী হইয়া দিনযামিনী সাতিশয় ক্লেশে কাল যাপন করিতেছে, সে, সুখের অভিলাষিণী হইলে লোকে কি বলিবে? আমি তোমার নিমিত্ত গুরুবচন অতিক্রম, লজ্জা ভয় পরিত্যাগ ও কুলকন্যাবিরুদ্ধ সাহস অবলম্বন পূর্ব্বক, দুস্তর প্রতিজ্ঞা অবলম্বন করিয়াছি; এক্ষণে যাহাতে প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ না হয় ও লোকের নিকট লজ্জা না পাই, এরূপ করিও।” এই বলিয়া কেয়ূরক ক্ষান্ত হইল।

কেয়ূরকের কথা শুনিয়া মহাশ্বেতা মনে মনে ক্ষণকাল অনুধ্যান করিয়া কহিলেন, কেয়ূরক! তুমি বিদায় হও, আমি স্বয়ং কাদম্বরীর নিকট যাইতেছি। কেয়ূরক প্রস্থান করিলে চন্দ্রাপীড়কে কহিলেন, রাজকুমার! হেমকূট অতি রমণীয় স্থান, চিত্ররথের রাজধানী অতি আশ্চর্য্য, কাদম্বরী অতি মহানুভবা। যদি দেখিতে কৌতুক হয় ও আর কোন কার্য্য না থাকে, আমার সঙ্গে চলুন। অদ্য তথায় বিশ্রাম করিয়া কল্য প্রত্যাগমন করিবেন। আপনার সহিত সাক্ষাৎ হইয়া অবধি আমার দুঃখভারাক্রান্ত হৃদয় অনেক সুস্থ হইয়াছে। আপনার নিকট স্ববৃত্তান্ত বর্ণন করিয়া আমার শোকের অনেক হ্রাস হইয়াছে। আপনি অকারণমিত্র। আপনার সঙ্গ পরিত্যাগ করিতে ইচ্ছা হয় না। সাধুসমাগমে অতি দুঃখিত চিত্তও আহ্লাদিত হয়, এ কথা মিথ্যা নহে। আপনার গুণে ও সৌজন্যে অতিশয় বশীভূত হইয়াছি, যতক্ষণ দেখিতে পাই তাহাই ভাল। চন্দ্রাপীড় কহিলেন, ভগবতি! দর্শন অবধি আপনাকে শরীর প্রাণ সমর্পণ করিয়াছি। এক্ষণে যে দিকে লইয়া যাইবেন, সেই দিকে যাইব ও যাহা আদেশ করিবেন তাহাতেই সম্মত আছি। অনন্তর মহাশ্বেতা সমভিব্যাহারে গন্ধর্ব্বনগরে চলিলেন।

নগরে উত্তীর্ণ হইয়া রাজভবন অতিক্রম করিয়া ক্রমে কাদম্বরীর ভবনের দ্বারদেশে উপস্থিত হইলেন। প্রতিহারীরা পথ দেখাইয়া অগ্রে অগ্রে চলিল। রাজকুমার অসংখ্য সুন্দরী-কুমারী-পরিবেষ্টিত অন্তঃপুরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করিলেন। কুমারীগণের শরীরপ্রভায় অন্তঃপুর সর্ব্বদা চিত্রিতময় বোধ হয়। তাহারাও বিনা অলঙ্কারেও সর্ব্বদা অলঙ্কৃত। তাহাদিগের আকর্ণবিশ্রান্ত লোচনই কর্ণোৎপল, হসিতচ্ছবিই অঙ্গরাগ, নিশ্বাসই সুগন্ধি বিলেপন, অধরদ্যুতিই কুঙ্কুমলেপন, ভুজলতাই চম্পকমালা, করতলই লীলাকমল এবং অঙ্গুলিরাগই অলক্তকরস। রাজকুমার কুমারীগণের মনোহর শরীরকান্তি দেখিয়া বিস্ময়াপন্ন হইলেন। তাহাদিগের তানলয়বিশুদ্ধ বেণুবীণাঝঙ্কারমিলিত মধুর সঙ্গীত শ্রবণে তাঁহার অন্তঃকরণ আনন্দে পুলকিত হইল। ক্রমে কাদম্বরীর বাসগৃহের নিকটবর্ত্তী হইলেন। গৃহের অভ্যন্তরে প্রবেশিয়া দেখিলেন, কন্যাজনেরা নানা বাদ্যযন্ত্র লইয়া চতুর্দ্দিকে বেষ্টন করিয়া বসিয়াছে; মধ্যে সুচারু পর্য্যঙ্কে কাদম্বরী শয়ন করিয়া নিকটবর্ত্তী কেয়ূরককে মহাশ্বেতার বৃত্তান্ত ও মহাশ্বেতার আশ্রমে সমাগত অপরিচিত পুরুষের নাম, বয়স, বংশ ও তথায় আগমনহেতু সমুদায় জিজ্ঞাসা করিতেছেন। চামরধারিণীরা অনবরত চামর বীজন করিতেছে।

শশিকলাদর্শনে জলনিধির জল যেরূপ উল্লাসিত হয়, কাদম্বরীদর্শনে চন্দ্রাপীড়ের হৃদয় সেইরূপ উল্লাসিত হইল। মনে মনে চিন্তা করিতে লাগিলেন, আহা! আজি কি রমণীয় রত্ন দেখিলাম! এরূপ সুন্দরী কুমারী ত কখন নেত্রপথের অতিথি হয় নাই! আজি নয়নযুগল সফল ও চিত্ত চরিতার্থ হইল। জন্মান্তরে এই লোচনযুগল কত ধর্ম্ম ও পুণ্য কর্ম্ম করিয়াছিল, সেই ফলে কাদম্বরীর মনোহর মুখারবিন্দ দেখিতে পাইল। বিধাতা আমার সকল ইন্দ্রিয় লোচনময় করেন নাই কেন? তাহা হইলে, সকল ইন্দ্রিয় দ্বারা এক বার অবলোকন করিয়া আশা পূর্ণ করিতাম। কি আশ্চর্য্য! যত বার দেখি তত আরও দেখিতে ইচ্ছা হয়। বিধাতা এরূপ রূপাতিশয় নির্ম্মাণের পরমাণু কোথায় পাইলেন। বোধ হয়, যে সকল পরমাণু দ্বারা ইহার রূপ লাবণ্য সৃষ্টি করিয়াছেন তাহারই অবশিষ্ট অংশ দ্বারা কমল, কুমুদ, কুবলয় প্রভৃতি কোমল বস্তুর সৃষ্টি করিয়া থাকিবেন। ক্রমে গন্ধর্ব্বকুমারীর ও রাজকুমারের চারি চক্ষু একত্র হইল। কাদম্বরী রাজকুমারকে দেখিয়া মনে মনে কহিলেন, কেয়ূরক যে অপরিচিত যুবা পুরুষের কথা কহিতেছিল, বোধ হয়, ইনিই সেই ব্যক্তি। আহা! এরূপ সুন্দর ত কখন দেখি নাই। গন্ধর্ব্বনগরেও এরূপ রূপাতিশয় দেখিতে পাওয়া যায় না। এইরূপে উভয়ের সৌন্দর্য্যে উভয়ের মন আকৃষ্ট হইল। কাদম্বরী নিমেষশূন্য লোচনে চন্দ্রাপীড়ের রূপ লাবণ্য বারংবার অবলোকন করিতে লাগিলেন; কিন্তু পরিতৃপ্ত হইলেন না। যতবার দেখেন মনে নব নব প্রীতি জন্মে।

বহু কালের পর প্রিয়সখী মহাশ্বেতাকে সমাগত দেখিয়া কাদম্বরী আনন্দসাগরে মগ্ন হইলেন ও সহসা গাত্রোত্থান করিয়া সস্নেহে গাঢ় আলিঙ্গন করিলেন। মহাশ্বেতাও প্রত্যালিঙ্গন করিয়া কহিলেন, সখি! ইনি ভারতবর্ষের অধিপতি মহারাজ তারাপীড়ের পুত্র, নাম চন্দ্রাপীড়। দিগ্বিজয়বেশে আমাদের দেশে উপস্থিত হইয়াছেন। দর্শনমাত্র আমার নয়ন ও মন হরণ করিয়াছেন; কিন্তু কি রূপে হরণ করিয়াছেন তাহা বুঝিতে পারি নাই। প্রজাপতির কি চমৎকার নির্ম্মাণকৌশল! এক স্থানে সমুদায় সৌন্দর্য্যের সুন্দররূপ সমাবেশ করিয়াছেন। ইনি বাস করেন বলিয়া মর্ত্ত্যলোক এক্ষণে সুরলোক হইতেও গৌরবান্বিত হইয়াছে। তুমি কখন সকল বিদ্যার ও সমুদয় গুণের এক স্থানে সমাগম দেখ নাই, এই নিমিত্ত অনুরোধবাক্যে বশীভূত করিয়া ইঁহাকে এখানে আনিয়াছি। তোমার কথাও ইঁহার সাক্ষাতে বিশেষ করিয়া বলিয়াছি। তুমি অদৃষ্টপূর্ব্ব এই লজ্জা পরিত্যাগ করিয়া, অপরিচিত এই অবিশ্বাস দূর করিয়া, অজ্ঞাতকুলশীল এই শঙ্কা পরিহার করিয়া, অসঙ্কুচিত ও নিঃশঙ্ক চিত্তে সুহৃদের ন্যায় ইঁহার সহিত বিস্রম্ভ আলাপ কর। এই বলিয়া মহাশ্বেতা চন্দ্রাপীড়ের পরিচয় দিয়া দিলেন। মহাশ্বেতা ও কাদম্বরী এক পর্য্যঙ্কে উপবেশন করিলেন। রাজকুমার অন্য এক সিংহাসনে বসিলেন। কাদম্বরীর সঙ্কেত মাত্র বেণুরব, বীণাশব্দ ও সঙ্গীত নিবৃত্ত হইল। মহাশ্বেতা স্নেহসংবলিত মধুর বচনে কাদম্বরীর অনাময় জিজ্ঞাসা করিলেন। কাদম্বরী বলিলেন, সকল কুশল।

মনোভাবের কি অনির্ব্বচনীয় প্রভাব! প্রণয়পরাঙ্মুখ ব্যক্তির অন্তঃকরণও উহার প্রভাবের অধীন হইল। কাদম্বরীর নিরুৎসুক চিত্তেও অনুরাগ অজ্ঞাতসারে প্রবেশিল। তিনি মহাশ্বেতার সহিত কথা কহেন ও ছলক্রমে এক এক বার চন্দ্রাপীড়ের প্রতি কটাক্ষপাত করেন। মহাশ্বেতা উভয়ের ভাব ভঙ্গি দ্বারা উভয়ের মনোগত ভাব অনায়াসে বুঝিতে পারিলেন। কাদম্বরী তাম্বূল দিতে উদ্যত হইলে কহিলেন, সখি! চন্দ্রাপীড় আগন্তুক, আগন্তুকের সম্মান করা অগ্রে কর্ত্তব্য; চন্দ্রাপীড়ের হস্তে অগ্রে তাম্বূল প্রদান করিয়া অতিথিসৎকার কর, পরে আমরা ভক্ষণ করিব। কাদম্বরী ঈষৎ হাস্য করিয়া মুখ ফিরাইয়া আস্তে আস্তে কহিলেন, প্রিয়সখি! অপরিচিত ব্যক্তির নিকট প্রগল্‌ভতা প্রকাশ করিতে আমার সাহস হয় না। লজ্জা যেন আমার হস্ত ধরিয়া তাম্বূল দিতে বারণ করিতেছে; অতএব আমার হইয়া তুমি রাজকুমারের করে তাম্বূল প্রদান কর। মহাশ্বেতা পরিহাস পূর্ব্বক কহিলেন, আমি তোমার প্রতিনিধি হইতে পারিব না। আপনার কর্ত্তব্য কর্ম্ম আপনিই সম্পাদন কর। বারংবার অনুরোধ করাতে কাদম্বরী অগত্যা কি করেন, লজ্জায় মুকুলিতাক্ষী হইয়া তাম্বূল দিবার নিমিত্ত কর প্রসারণ করিলেন। চন্দ্রাপীড়ও হস্ত বাড়াইয়া তাম্বূল ধরিলেন।

এই অবসরে একটী শারিকা আসিয়া ক্রোধভরে কহিল, ভর্ত্তৃদারিকে! এই দুর্বিনীত বিহগাধমকে কেন নিবারণ করিতেছ না? যদি এ আমার গাত্র স্পর্শ করে, শপথ করিয়া বলিতেছি এ প্রাণ রাখিব না। কাদম্বরী শারিকার প্রণয়কোপের কথা শুনিয়া হাসিতে লাগিলেন। মহাশ্বেতা কিছু বুঝিতে না পারিয়া শারিকা কি বলিতেছে এই কথা মদলেখাকে জিজ্ঞাসিলেন। মদলেখা হাসিয়া বলিল, কাদম্বরী পরিহাস নামক শুকের সহিত কালিন্দীনাম্নী এই শারিকার বিবাহ দিয়াছেন। অদ্য প্রভাতে তমালিকার প্রতি পরিহাসকে পরিহাস করিতে দেখিয়া শারিকা ঈর্ষান্বিত হইয়া আর উহার সহিত কথা কহে না, উহাকে দেখিতে পারে না এবং স্পর্শও করে না। আমরা সান্ত্বনাবাক্যে অনেক বুঝাইয়াছি, কিছুতেই ক্ষান্ত হয় না। চন্দ্রাপীড় হাসিয়া কহিলেন, হাঁ আমিও শুনিয়াছি পরিহাস তমালিকার প্রতি অত্যন্ত অনুরক্ত। ইহা জানিয়া শুনিয়া শারিকাকে সেই বিহগাধমের হস্তে সমর্পণ করা অতি অন্যায় কর্ম্ম হইয়াছে। যাহা হউক, অন্ততঃ সেই দুর্বিনীত দাসীকে এক্ষণে এই দুষ্কর্ম্ম হইতে নিবৃত্ত করা উচিত।

এইরূপ নানা হাস্য পরিহাস হইতেছে এমন সময়ে কঞ্চুকী আসিয়া বলিল, মহাশ্বেতে! গন্ধর্ব্বরাজ চিত্ররথ ও মহিষী মদিরা আপনাকে আহ্বান করিতেছেন। মহাশ্বেতা তথায় যাইবার সময় কাদম্বরীকে জিজ্ঞাসিলেন, সখি! চন্দ্রাপীড় এক্ষণে কোথায় থাকিবেন? কাদম্বরী কহিলেন, প্রিয়সখি! কি জন্য তুমি এরূপ জিজ্ঞাসা করিতেছ? দর্শন অবধি আমি চন্দ্রাপীড়কে মন, প্রাণ, গৃহ, পরিজন সমুদায় সমর্পণ করিয়াছি। ইনি সমুদায় বস্তুর অধিকারী হইয়াছেন। যেখানে রুচি হয় থাকুন! তোমার প্রাসাদের সমীপবর্ত্তী ঐ প্রমোদবনে ক্রীড়াপর্ব্বতের প্রস্থদেশস্থ মণিমন্দিরে গিয়া চন্দ্রাপীড় অবস্থিতি করুন, এই কথা বলিয়া মহাশ্বেতা চলিয়া গেলেন। বিনোদের নিমিত্ত কতিপয় বীণাবাদিকা গায়িকা সমভিব্যাহারে দিয়া কাদম্বরী চন্দ্রাপীড়কে তথায় যাইতে কহিলেন। কেয়ূরক পথ দেখাইয়া অগ্রে অগ্রে চলিল। তাঁহার গমনের পর কাদম্বরী শয্যায় নিপতিত হইয়া জাগ্রদবস্থায় স্বপ্ন দেখিলেন, যেন লজ্জা আসিয়া কহিল, চপলে! তুমি কি কুকর্ম্ম করিয়াছ? আজি তোমার এরূপ চিত্তবিকার কেন হইল? কুলকুমারীদিগের এরূপ হওয়া কোন ক্রমেই উচিত নয়। লজ্জা কর্ত্তৃক তিরস্কৃত হইয়া মনে মনে কহিলেন, আমি মোহান্ধ হইয়া কি চপলতা প্রকাশ করিয়াছি! এক জন উদাসীন অপরিচিত ব্যক্তির সমক্ষে নিঃশঙ্ক চিত্তে কতভাব প্রকাশ করিলাম। তাঁহার চিত্তবৃত্তি, অভিপ্রায়, স্বভাব কিছুই পরীক্ষা করিলাম না, তিনি কিরূপ লোক কিছু জানিলাম না। অথচ তাঁহার হস্তে মন, প্রাণ, সমুদায় সমর্পণ করিলাম। লোকে এই ব্যাপার শুনিলে আমাকে কি বলিবে? আমি সখীদিগের সমক্ষে প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলাম যাবৎ মহাশ্বেতা বৈধব্যদশায় ক্লেশভোগ করিবেন, তত দিন সাংসারিক সুখে বা অলীক আমোদে অনুরক্ত হইব না; আমার সেই প্রতিজ্ঞা আজি কোথায় রহিল। সকলেই আমাকে উপহাস করিবে, সন্দেহ নাই। পিতা এই ব্যাপার শুনিয়া কি মনে করিবেন? মাতা কি ভাবিবেন? প্রিয়সখী মহাশ্বেতার নিকট কি বলিয়া মুখ দেখাইব? যাহা হউক আমার অত্যন্ত লঘুহৃদয়তা ও চপলতা প্রকাশ হইয়াছে। বুঝি আমার চপলতা প্রকাশ করাইবার নিমিত্তই প্রজাপতি ও রতিপতি মন্ত্রণাপূর্ব্বক এই উদাসীন পুরুষকে এখানে পাঠাইয়া থাকিবেন। অন্তঃকরণে একবার অনুরাগ সঞ্চার হইলে তাহা ক্ষালিত করা দুঃসাধ্য। কাদম্বরী এইরূপ ভাবিতেছিলেন এমন সময়ে প্রণয় যেন সহসা তথায় আসিয়া কহিল, কাদম্বরী! কি ভাবিতেছ? তোমার অলীক অনুরাগে ও কপট মিত্রতায় বিরক্ত হইয়া চন্দ্রাপীড় এখান হইতে প্রস্থান করিতে উদ্যত হইয়াছেন। গন্ধর্ব্বকুমারী তখন আর স্থির হইয়া থাকিতে পারিলেন না। অমনি শয্যা হইতে ত্বরায় উঠিয়া গবাক্ষদ্বার উদ্ঘাটন পূর্ব্বক এক দৃষ্টে ক্রীড়াপর্ব্বতের দিকে চাহিয়া রহিলেন।

সকল অধ্যায়

১. ১. উপক্রমণিকা – কাদম্বরী
২. ২.০১ কথারম্ভ – অবন্তি দেশে উজ্জয়িনী নামে নগরী
৩. ২.০২ কুমারের ক্রীড়ায় কালক্ষেপ
৪. ২.০৩ রাজা চন্দ্রাপীড়কে যৌবরাজ্যে অভিষেক
৫. ২.০৪ যুবরাজ দিগ্বিজয়ের নিমিত্ত যাত্রা করিলেন
৬. ২.০৫ দেবলোকে অপ্সরাগণ বাস করে
৭. ২.০৬ দিবাবসানে দিবাকরের বিরহে
৮. ২.০৭ চন্দ্রোদয় হইল
৯. ২.০৮ মহাশ্বেতা কহিলেন
১০. ২.০৯ চন্দ্রাপীড় মণিমন্দিরে প্রবেশিয়া
১১. ২.১০ চন্দ্রাপীড় স্কন্ধাবারে প্রবেশিয়া
১২. ২.১১ চন্দ্রাপীড় স্বভাবতঃ ধীরপ্রকৃতি
১৩. ২.১২ আপনি বৈশম্পায়নকে স্কন্ধাবার লইয়া
১৪. ২.১৩ চন্দ্রাপীড় নয়ননিমীলন পূর্ব্বক
১৫. ৩.১ উপসংহার : কথায় কথায় নিশাবসান
১৬. ৩.২ উপসংহার : লক্ষ্মীর বাক্য শুনিবামাত্র

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন