একুশে পা – ৬

বাণী বসু

‘এখন সব প্রতিষ্ঠানই রাজনৈতিক সংগঠন’… ‘ধর্ম কি একটা চাই-ই?’

ঠিক দু’দিনের আড়াআড়ি এস. এফ. আই এবং ছাত্র পরিষদ রাজেশ্বরীকে কলেজের ছাত্র-ইউনিয়নের নিবার্চনে তাদের সেকশনের প্রতিনিধি হয়ে দাঁড়াতে বলল। দু’দলকেই না করে দিল সে। কিন্তু ব্যাপারটা তাকে খুব অবাক করল। দু’দল দু’রকম পোস্টার সাঁটছে। মুখোমুখি হলেই দাঁতে-নখে। রাজেশ্বরী কাদের সমর্থন করে, আদৌ এ সব ব্যাপারে কোনও আগ্রহ আছে কি না, কোন কথাই কেউ জানতে চাইল না, জানবার চেষ্টাও করল না। এসে স্রেফ বলে দিল তুমি আমাদের হয়ে দাঁড়াও! তার মনে হল উজ্জয়িনীর সঙ্গে আলোচনা করবে এটা নিয়ে। এমনিতে উজ্জয়িনীকে সে খুব একটা পছন্দ করে না। উজ্জয়িনী ধনীর দুলালী। যথেচ্ছ আশকারা পেয়ে বড় হয়েছে এবং হচ্ছে। অহংকারী, খামখেয়ালী। বন্ধুদের ওপর ছড়ি ঘোরাবার অভ্যেস আছে। রাজেশ্বরী এগুলো ভালো করেই লক্ষ করেছে। ওর সঙ্গে একত্রে হায়ার সেকেন্ডারি পড়েছে সে। উজ্জয়িনী ছিল তাদের হাউজ-লিডার। অনেক কাজই অণুকা বা মিঠুকে দিয়ে করাত তখন। অণুকে তো ক্রীতদাসীর মতো ব্যবহার করত—‘এই অণু আমার ব্যাগটা ধর তো, কাঁধে ব্যথা করছে,’ কিংবা ‘অণু কাল আমি স্কুলে আসব না, তুইও আসবি না খবর্দার,’ কলেজে ঢোকবার পর রাজেশ্বরী লক্ষ করেছে অণু পাস ক্লাসের সব নোটস রাখে উজ্জয়িনীর জন্যে। খুব ভাগ্য সে দু’জনের আলাদা-আলাদা বিষয়ে অনার্স। না হলে অণুকে উজ্জয়িনীর সব লাইব্রেরি-ওয়ার্ক করে দিতে হত। স্কুল-জীবনে যে মিঠুকে দিয়ে কত চার্ট করিয়েছে। কত প্রাচীর-পত্রিকা লিখিয়েছে তার ঠিক নেই। পরীক্ষা, অসুখ কিছুই মানবে না। অণুকাকেও সে এই একই কারণে পছন্দ করে না, অমন ক্রীতদাস মনোবৃত্তি হবেই বা কেন। তার সন্দেহ অণু একেবারেই মধ্যবিত্ত বলে এইরকম একটা হীনম্মন্যতা তার মধ্যে আছে। টাকার পরিমাপ, তা-ও আবার বাবা-মার টাকার পরিমাপে মানুষের মনুষ্যত্বের গুণমান বিচার হবে? ব্যাপারটা রাজেশ্বরীর খুব অশ্লীল লাগে। মিঠুর ধরনটা একটু অন্যরকম। সে উজ্জয়িনীকে সত্যি-সত্যি ভালোবাসে। মিঠুর বাড়ি খুব প্রগতিশীল। কিন্তু মিঠু মেয়েটা খুব নরম প্রকৃতির। মিঠুর প্রগতিশীল দিকটা সে পছন্দ করে, অত্যধিক নরম দিকটা ততটা নয়। সে জন্যেই উজ্জয়িনীকে এই আলোচনার জন্যে বাছল সে। হাজার হলেও অতদিন ক্লাস-ক্যাপটেন হাউস-লিডার হবার অভিজ্ঞতারও একটা দাম আছে তো! উজ্জয়িনীর বাঁ পাশে নিজের ব্যাগটা রাখল সে। বেঞ্চের ওপর মাথা নামিয়ে ফিসফিস করে কথাগুলো তাকে বলল রাজেশ্বরী। গোপনতা রক্ষা করতে বলল। দ্বিগুণ বিস্মিত হয়ে উজ্জয়িনী বলল, ‘তোকেও বলেছে এস. এফ? আমাকেও তো ভীষণ প্রেশার দিচ্ছে?’ রেগেমেগে ক্লাসে বসেই দু’জনে ঠিক করল ইউনিয়ন রুমে যাবে, এর ফয়সালা হওয়া দরকার।

তিনটের আগে ইউনিয়ন রুমে যাবার সুযোগ পেল না ওরা। উজ্জয়িনীর ক্লাস শেষ হয়ে গেছে। সে রাজেশ্বরীর জন্যে বসে আছে। মিঠু অণু দু’জনকেই সে কাটিয়ে দিয়েছে আজকে। ব্যাপারটার গোপনতা এখনও রক্ষা করছে ওরা। রাজেশ্বরী ক্লাস করে ছুটতে ছুটতে এলো।

ইউনিয়ন রুমে বেশ কয়েকজন ছেলে বসে বসে ফাইল গুছোচ্ছিল। ওরা গিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘সুকান্তদা নেই?’

‘বসো, এসে যাবে।’ কিছুক্ষণ বসে থাকবার পর একজন বলল ‘সুকান্তকে খুঁজছ কেন?’

‘দরকার আছে।’

‘আমি তোমাদের সুকান্তদার আগে পর পর তিন বছর জি. এস. ছিলুম। আমাকে বলা যায় না? আচ্ছা, তোমাদের মধ্যে কে যেন ফার্স্ট ইয়ার ‘এ’ থেকে দাঁড়াচ্ছ না?’ রাজেশ্বরী আর উজ্জয়িনী মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল। উজ্জয়িনী যুদ্ধং দেহি গলায় বলল, ‘সেটাই জানতে চাইছি। কে? কাকে আপনারা দাঁড়াতে বলছেন? নিজেরাই বোধ হয় মনস্থির করতে পারেননি এখনও, না? আমাকেও বলছেন, ওকেও বলছেন!’

এই সময়ে সুকান্তদা এসে গেল। রাজেশ্বরীকে দেখে বলল, ‘কী? মত বদলেছ, ভেরি গুড।’

তখন পূর্ববর্তী জি এস বলল, ‘উঁহু, এদের তোর নামে গুরুতর অভিযোগ আছে। তুই নাকি একই সময়ে দু’জনের কাছেই প্রোপোজাল রেখেছিস?’

‘তো কী হয়েছে? বিয়ের প্রোপোজাল তো আর নয়!’ সুকান্ত হাসতে হাসতে বলল, ‘আরে ভাই এসো, চা খাও। তোমরা দু’জনে খুব বন্ধু না? হবেই। দু’জনেই বর্ন-লিডার। কে দাঁড়াবে। তোমরা নিজেরাই ঠিক করো না!’

‘কেন? আর কাউকে বলেননি?’ রাজেশ্বরীর গলায় উষ্মা। ‘আমি তো না-ই বলে দিয়েছি।’

‘না না। তোমরাই ক্লাসে সবচেয়ে পপুলার। ইনফ্লুয়েনশ্যাল। ব্যক্তিত্ব আছে। কাজও করতে পারবে। কে রাজি হবে তা তো জানি না, তাই দু’জনের কাছেই…অন্যায় হয়েছে তাতে? মাফ চাইছি।’ সুকান্তদা হাত জোড় করল।

উজ্জয়িনী এক ঝটকায় উঠে দাঁড়াল, ‘আমি দাঁড়াচ্ছি না। আমাকে বাদ দিতে পারেন।’

রাজেশ্বরী বলল, ‘আমিও ইনটারেস্টেড নই।’

‘দয়া করো ভাই, দয়া করো’ সুকান্ত করুণ গলা করে বলল, ‘এক্কেবারে ডুবে যাব। রাজি হয়ে যাও রাজেশ্বরী। তোমাকে কিছু করতে হবে না, আমরাই সব করব।’

এমনভাবে প্রথমে তিন চারজন, পরে পাঁচ ছ’জন রাজেশ্বরীকে ঘিরে দাঁড়াল যে রাজেশ্বরী চট করে উজ্জয়িনীর মতো বেরিয়ে যেতে পারল না। তারপর সবাই মিলে চলল অনুনয়-বিনয়, ‘ভেবে দেখো, দায়িত্ব নেবার ক্ষমতা সবার থাকে না, যাদের থাকে তারাও যদি এভাবে মুখ ফিরিয়ে নেয়! তোমাদের ক্লাসে আমরা একটা মোটামুটি সার্ভে করেছি, বেশির ভাগই তোমাকেই প্রতিনিধি হিসেবে চায়।’

‘আপনাদের রাজনৈতিক মতাদর্শে আমি বিশ্বাস করি কি না-করি সেটাও তো আপনারা জানেন না। জানেন?’

‘আরে তোমাকে দেখলেই বোঝা যায় তুমি প্রগতিশীল, এর চেয়ে বেশি আমাদের জানবার দরকার করে না। একটা তো বছর…থাকলই বা অনার্স…এমন কিছু সময় তোমার থেকে আমরা দাবি করব না।’

শেষপর্যন্ত গলদ্‌ঘর্ম হয়ে যখন সে বেরোতে পারল তখন সুকান্তরা তার মত আদায় করে নিয়েছে।

কিন্তু কিছুদিন পর যখন ভোটের মনোনয়নপত্র দাখিল করা হয়ে গেল, এবং ক্লাসে রাজেশ্বরী আচার্যর নামে পোস্টার পড়তে লাগল, একদিন সবিস্ময়ে সবাই দেখল ছাত্র পরিষদের প্রার্থী হিসেবে তার পাশেই উজ্জয়িনী মিত্রর নাম পড়েছে।

মিঠু বলল, ‘আমরা কেউ জানতাম না বিশ্বাস কর। উজ্জয়িনীকে বলব উইথড্র করে নিতে। আমাদের কাউকেই ঘুণাক্ষরেও বলেনি। কোনও মানে হয়? তা ছাড়া দেখ, কালেজ ইউনিয়নে ভোট হবে তার আবার এস. এফ. আই, সি, পি. কি রে? যাচ্ছেতাই ব্যাপার সব!’

গৌতম কাছেই ছিল, বলল, ‘এ মেয়েটা কী রে! এস. এফ. আই. আর আর সি. পি. দুটো রাজনৈতিক দলের ছাত্রশাখা। দুটো দলই সব কলেজগুলোকে কব্জা করতে চাইছে। ভোটের বয়স আঠারো হওয়ায় গুরুত্বও ভীষণ বেড়ে গেছে ছাত্রদের রাজনৈতিক দিক থেকে। এটা বুঝতে অসুবিধে কোথায়?’

মিঠু বলল, ‘তোদের মগজ ওইভাবেই ধোলাই হয়েছে তাই বুঝতে পারিস না।’

‘ছাত্ৰশাখা তো কী! কলেজটা কি রাজনৈতিক সংগঠন? কলেজের গেটের বাইরে যা করবার করুক। ইচ্ছে হলে বাইরে থেকেও গাইড করতে পারে, কিন্তু ভেতরে এভাবে সর্দারি করাটা, খোলাখুলি রাজনৈতিক দলের নামে নির্বাচন হওয়াটা ভালগার। ভালো করে বুঝে দেখ।’

গৌতম বলল, ‘এভাবে কেউ এখন ভাবে না মিঠু। এখন সব প্রতিষ্ঠানই রাজনৈতিক সংগঠন। সারা দেশে কোনও মানুষই শুধু নিজের ব্যক্তি-পরিচয়ে চলাফেরা করছে না। কোনও না কোনও পার্টির কালারে তার পরিচয়। কে কংগ্রেস, তার মধ্যে আবার ভজকট, কে জনতা, কে বি. জে. পি, কে লেফট, কে রাইট।’

‘তাহলে বল আমরা ক্রমশ অরওয়েলের “নাইনটিন এইট্টি ফোর”-এর দিকে চলেছি। যদিও সারা পৃথিবীতে পার্টি ডিকটেটরশিপ অচল হয়ে যাচ্ছে ক্রমে ক্রমে। গর্বাচেভ হ্যাজ আশার্ড ইন আ নিউ এরা। পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো এক এক করে শেকল খুলে ফেলছে। আমরাই কী তবে খালি একটা পুরনো টেক্সট বই, পুরনো মডেল আঁকড়ে থাকব?’

‘উত্তরে গৌতম বলল, ‘কোথাও পার্টি ডিকটেটরশিপ অচল হয়ে যাচ্ছে না কমরেড। কোনও না কোনও ফর্মে, মানুষ ঠিকই গোষ্ঠীভুক্ত, দলভুক্ত হয়ে যাচ্ছে। এতদিন তার পেছনে একটা যাই হোক আদর্শবাদ ছিল, এখন প্রত্যেক দল, প্রত্যেক গোষ্ঠী খোলাখুলি নিজের নিজের কায়েমী স্বার্থ রক্ষার তাগিদে কাজ করবে। আমাদের মতো ইল্‌লিটারেট থার্ড ওয়ার্ল্ড কানট্রিতে ডেমোক্র্যাসি চলে? চলে না।’

মিঠু আর গৌতমের প্রচণ্ড তর্কবিতর্ক লেগে গেল। গৌতম যত বেশি কাগজ পড়ে, রাজনৈতিক খবরাখবর রাখে, মিঠু ততটা রাখে না। ওদিকে মিঠু আবার কিছুটা তত্ত্ব এবং সাহিত্য পড়েছে গৌতমের ততটা পড়া নেই। মিঠু বলে পার্টি-ইজম বাদ দিয়ে কি ডেমোক্র্যাসি হয় না? মানব সেবা বাদী বিশ্বসংঘের কথাও বলে সে। গৌতম বলে ওসব স্বপ্নের প্রাসাদ। রিয়্যালিটি হল, হয় মাল্টিপার্টি ডেমোক্র্যাসি, নয়তো পার্টি ডিকটেটরশিপ। গৌতমের গলা খুব চড়েছিল, মিঠুর অত গলার জোর নেই, তার প্রায় নাকের জলে, চোখের জলে অবস্থা। ইমন কোথায় ছিল, দুজনের মাঝখানে এসে দাঁড়াল।

‘মিঠু, আজ আমার হোস্টেলে যাবে বলেছিল না?’

গৌতম বলল, ‘তাই যা বাবা, তাই যা। ওফ্ এমনি এঁড়ে তক্ক করতে পারে না এই মেয়েগুলো, জানবে না শুনবে না, কেঁদে জিতবে।’

মিঠু বলল, ‘ভালো হবে না গৌতম, কথায় কথায় মেয়ে-মেয়ে করে খোঁচা দিবি না। ভবিষ্যতের পৃথিবীতে মেয়েরাই নেতা হবে তা জানিস? বেশি কথা কী, ক্লাস-রিপ্রেজেনটেটিভ দাঁড় করানোর জন্যে পর্যন্ত তো ওই মেয়েদের কাছেই ছুটেছিস তোরা… তার বেলা?’

‘সেটা তো স্রেফ স্ট্র্যাটেজি… তোরা মেজরিটি তাই। যেমন বড়বাজারে মাড়োয়ারি দাঁড় করানো হয়, রাজাবাজারে মুসলমান… তেমনি।’ এই সময়ে অনু চুপিচুপি গৌতমকে কী একটা ইশারা করল, কিছু বললও।

গৌতম বলল, ‘তো কী! আমি তো খারাপ কিছু বলি নি! এই মিঠু, রাজাবাজারে… মুসলমান বলে আমি তোকে কিছু আঘাত দিয়েছি? আমি অবশ্য জানতুম না তুই… কিন্তু না-ই বা জানলুম… কী এসে যায় এখনকার দিনে আর এইসব ধর্মে-টর্মে!’

মিঠু ভীষণ রেগে গিয়েছিল। তার মুখে কথা জোগাচ্ছিল না। ইমন তাকে জোর করে টেনে বার করে নিয়ে এলো। বাইরে এসে মিঠু সত্যি-সত্যি কেঁদে ফেলল। ইমন বলল, ‘চলো চলো অনেক ডিবেট হয়েছে, এবার মুখটা ধুয়ে নেবে চলো। তাহলেই রাগও ধুয়ে যাবে।’

বেলা শেষ হয়ে এসেছে। উজ্জয়িনীকে কোত্থাও দেখতে পেল না মিঠু। বলল, ‘ইমন, আজ তোর হোস্টেলে গেলে বড্ড দেরি হয়ে যাবে যে! বরং তুই আমাদের বাড়ি চ। মা বাবাকে কত বলেছি তোর কথা, খুব খুশি হবে সবাই।’

ইমন বলল, ‘হোস্টেলে তো এরকম নিয়ম নেই।’

‘চল না। মেট্রনকে বলি গিয়ে। যদি পার্মিশন দেন!’

ইমনের ভীষণ লোভ হচ্ছে। কতদিন যেন সে পারিবারিক স্নেহ আদর পায়নি। উপবাসী সে। এই অদ্ভুত গোলমেলে শহরটার মধ্যে এখন তার অনেক পরিচিতি। কিন্তু সবই খেলার সূত্রে। কলেজেও যারা যেচে এসে আলাপ করে ওই জন্যেই করে। ইমন জানে চ্যাম্পিয়নশিপ তাকে একটা গ্ল্যামার দিয়েছে, সে সেটা উপভোগ করে। নিজের এই প্রতিমা সে ভাঙতে চায় না। কিন্তু প্রতিমার আড়ালে সে বন্ধু খোঁজে। সত্যিকারের বন্ধু। মিঠু কি বন্ধু হবে?

এত কৃত্রিম এই শহরের মেয়েরা! এত কাঁচা বে-আব্রু এই শহরের ছেলেরা! কার সঙ্গে মিশবে সে! এরা মিশ্র ভাষায় কথা বলে। আগে ছিল ইংরিজিয়ানা। এখন আচার-আচরণে হিন্দিয়ানা ঢুকেছে খুব। নাকে-নাকে নাকছাবি। হাতে হাতে মেহেদির কারুকার্য, পায়ে পায়েল। সব মিলিয়ে কেমন যেন! সে সহজ হতে পারে না। কাউকে সেটা বুঝতেও দেয় না। এমন নয় যে সে হিন্দিভাষীদের অপছন্দ করে। কিন্তু বাঙালি মেয়ে যখন হিন্দিভাষীদের অনুকরণ করে তার মনে হয় এরা ঠিক করছে না। সে দূরে দূরে থাকে। দূরত্ব রেখে চলাটা তার খ্যাতির সঙ্গে মানিয়ে যায়। কিন্তু সে যে তার অনাথা মাকে ছেড়ে, পিতৃহীন ছোট ভাইটিকে ছেড়ে ভাগ্যান্বেষণে এসেছে! তার বুকের মধ্যে অনেকগুলো খালি জায়গা খাঁ খাঁ করে। মিঠু কি তার একটাও ভরতে পারবে? মিঠুদের বাড়ি… সে কী রকম? —চক্ষু ছানাবড়া হয়ে যাবার মতো নাকি? মিঠুর মা কি খুব আধুনিকা? লিপস্টিক মাখা, চুল-ছাঁটা মা? মিঠুর বাবা? অ্যাসোসিয়েশনের ওইসব ভদ্রলোকদের মতো? যাঁদের বাবার বয়সী হওয়া সত্ত্বেও দাদাই বলতে হয়; বাবার মতো কিছুতেই নন যাঁরা।

মিঠু বলল, ‘কী ভাবছিস এত!’

ইমন হাসল। সে যে ভাবছিল তা অস্বীকার করল না। আবার সরাসরি স্বীকারও করল না।

পেভমেন্টের ওপর দিয়ে হোস্টেলে যাবার পথটা এই পড়ন্ত বেলায় কী সুন্দর, শান্ত, বড্ড যেন মন-কেমন-করা। এই পথটাই যেন এঁকে বেঁকে চলে গেছে সারা জীবন বেয়ে। এটাই পৌঁছেছে তাদের বাড়ি। এটাই চলে গেছে সেই অদূর অতীতের দিনগুলোতে যখন বাবাতে ইমনেতে দালানের মাঝখানে নারকোল দড়ি টাঙিয়ে পিংপং খেলা জমে উঠত। মা গেলাস ভর্তি চা নিয়ে এসে দাঁড়াত আঁচলে জড়িয়ে, ভাই বল ধরবার জন্য হাত বাড়াত। সাড়ে তিনজন মানুষ বসে হুশহাশ শব্দ করতে করতে গরম খিচুড়ি খাওয়া হত শীতের দুপুরে।

হোস্টেলের গেট দিয়ে ঢুকতে ঢুকতে মিঠু বলল, ‘তুই কি করে একা একা থাকিস রে ইমন! ভয় করে না?’

‘ভয়?’ ইমন হাসল। মনে মনে বলল—ভয় করলে তার চলবে না। আরও অনেক অনুভূতির মতো ভয়টাও তার পক্ষে বিলাসিতা। ‘আমার ঘরে তো আরও একজন থাকে, অজন্তা।’ সে মিঠুকে আশ্বস্ত করতে চাইল।

‘ওরে বাবা, মা বাবাকে, বিশেষ করে মাকে ছেড়ে থাকবার কথা তো আমি ভাবতেই পারি না।’

‘যাকে থাকতেই হয়, তাকে থাকতে হয়’, উদাস গলায় বলল ইমন। চট করে ওর মুখের দিকে তাকাল মিঠু। নাঃ, ইমনের মুখে এখনও শান্ত সুদূর হাসি। ইমন কি আর আমাদের মতো’? ও অন্য ধাতু দিয়ে গড়া। কত সাহসী, আত্মবিশ্বাসী। সেন্টিমেন্টাল নয় একদম। ইমন কাঁদে না, মন খারাপ করে না। একমনে নিজের কাজ করে যায়। ওর সংকল্পের জোরই আলাদা। কী স্মার্ট ইমন, কোনও পরিস্থিতিতেই বোকা বনবার নয়। উজ্জয়িনী অত ব্রাইট, রাজেশ্বরীর অত ব্যক্তিত্ব, কিন্তু ওদের চেয়েও স্মার্ট ইমন। কত ভাগ্য যে ইমনের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছে। কে জানে ইমন শেষ পর্যন্ত বন্ধু থাকবে কি না!

হালকা হলুদ বর্ডার দেওয়া সবুজাভ বাড়িটা। দুয়ারের কাছাকাছি পেভমেন্টের ওপর একটা কাঠবাদামের গাছ। বারান্দায় একজন মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন। মিঠু ওপর দিকে মুখ তুলে হাসল। একটু পরেই দরজা খুলে গেল। ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে পাথরের ফলকে পড়ল ইমন—‘সাদেক চৌধুরী, অনুরাধা চৌধুরী’। সিঁড়ি দিয়ে সোজা ওপরে উঠে গোল দালান। পেছন দিকে জাফরি কাটা। মিঠুর মা দাঁড়িয়ে আছেন। হালকা হলুদ রঙের শাড়িতে কালো বুটি, কালো পাড়। মাথার চুলে একটা আলগা খোঁপা বাঁধা। দু চার গাছা সাদা চুল। চোখে চশমা। ‘ইমন, না’?

‘হ্যাঁ মা, নিয়ে এলাম। ভালো করিনি?’

‘বেশ করেছিস। দেখেছ ইমন তোমার কথা শুনে শুনে তুমি কি রকম আমাদের মুখস্থ হয়ে গেছে?’

ইমন নিচু হয়ে হঠাৎ প্রণাম করল। মিঠুর মা অবাক হয়ে বললেন ‘ওমা, তুমি প্রণাম করতে জানো? আমার ছেলেমেয়ে তো কক্ষনো আমাকে প্রণাম করে না।’

মিঠু বলল, ‘আহা, জন্মদিনে করি না?’

ইমন হাসল। মিঠুর মা মুগ্ধ হয়ে তার দিকে চেয়ে বললেন, ‘এসো, ঘরে এসো।’

মিঠু বলল, ‘মা, আজ কিন্তু ইমন আমাদের বাড়ি থাকবে।’

‘নিশ্চয়ই, এখন এত সন্ধেয় আবার সেই নর্থে ফিরতে পারে না কী? হোস্টেলে বলে এসেছ তো?’

মিঠু বলল, ‘ইমনের যা প্রেসটিজ! একবার বলতেই মেট্রন হ্যাঁ করে দিলেন। সুপারকেও উনিই বলে দেবেন। মা, আজকে কিন্তু ইমনকে বিরিয়ানি খাওয়াতে হবে!’

‘দেখি পারি কি না!’ মিঠুর মা হাসিমুখে বললেন, ‘এখন তো তোরা হাত মুখ ধো!’ ইমন যত বলে আমি এইভাবেই থাকব। মিঠু ততই জোর করে।

‘না তোকে আমার জিনিস পরতে হবে। চান করে আবার কেউ ছাড়া জামা কাপড় পরতে পারে না কি? ঘেন্না করবে না? এত যদি সঙ্কোচ করিস তবে আর বন্ধু কী?’ অগত্যা ভালো করে চান করে, ইমন মিঠুর ফুলছাপ লম্বা স্কার্ট আর লাল টপ পরে বাইরে আসে, আর মিঠু তাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে থাকে। ‘ইস্‌স্ ইমন। আমার ড্রেস তোকে কি সুন্দর ফিট করেছে। ফ্রি সাইজ হলে কী হয়, সবাইকে কিন্তু ফিট করে না। কী সুন্দর মেয়ে মেয়ে দেখাচ্ছে তোকে! বাচ্চা মেয়ের মতো!’

হাতে কফির মগ নিয়ে বারান্দার জাফরিতে পা রেখে মিঠু বলল, ‘দেখ ইমন, উজ্জয়িনীকে আমাদের বলতে হবে নাম উইথড্র করে নিতে। আমরা সবাই এক স্কুলে পড়েছি। একজন তো হারবেই। কী বাজে হবে বল তো সেটা! তা ছাড়া আমরা! আমাদের তো দুজনেই বন্ধু। আমরা কাকে দেব? তুই কিছু বলছিস না যে?’

ইমন মন দিয়ে রাস্তা দেখছে। সে বলল, ‘আমি এ সব ঠিক বুঝি না মিঠু। তবে মনে হয় যে কোনও প্রতিযোগিতাই খেলার মেজাজে নেওয়া উচিত।’

‘তুই বুঝছিস না এটা ঠিক খেলার মতো নয়। আমরা একজনকে আমাদের প্রতিনিধি বলে বেছে নেব। দুজনেই আমাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। দুজনেরই যথেষ্ট যোগ্যতা আছে। উজ্জয়িনী বরাবর আমাদের হাউজ-ক্যাপটেন ছিল স্কুলে। আর রাজেশ্বরী ভীষণ ভালো ডিবেট করতে পারে, বক্তৃতা করতে পারে, মেয়েও খুব ভালো। অনেস্ট। জাস্ট। আমাদের ডিলেমাটা বুঝতে পারছিস না?’

‘আমি তো তোমাদের স্কুলের নই! যে বেশি যোগ্য তারই নির্বাচিত হওয়া উচিত। তবে তোমার কথা শুনে বুঝতে পারছি এর মধ্যে একটা বন্ধুত্বের সঙ্কটের ব্যাপার আছে।’

‘সবচেয়ে ভালো কী হত জানিস তো! যদি দুজনে উইথড্র করে নিত নাম আর সবাই মিলে তোকে পাঠাত।’

‘না না, আমার অনেক কাজ মিঠু। এই কথাটা কারুর মাথায় ঢুকিও না প্লিজ।’

‘জানি। সেইজন্যেই বলছি না। কিন্তু এ সঙ্কট থেকে কী করে উদ্ধার পাই বল তো?’

‘সব সঙ্কট থেকে উদ্ধার পাওয়া বোধ হয় যায় না মিঠু। ছোট ছোট সঙ্কটগুলো দেখতে হয় নিস্পৃহভাবে। প্রার্থনা করা যাক বড় বড় সঙ্কটগুলো থেকে যেন আমরা উদ্ধার পাই।’

মিঠু অবাক হয়ে বলল, ‘তুই এসবই ভাবিস, না রে? তুই আসলে জীবনটাকে অন্যভাবে দেখিস। আমাদের সঙ্গে তোর দেখাটা মেলে না।’

ইমন বলতে গেল, ‘জীবন যে এক এক পাত্রে একেক রকম মিঠু।’ কিন্তু বলল না। নিজেকে শেষ মূহুর্তে সামলে নিল। সে তার ব্যক্তিগত ব্যাপারগুলো খুব সাবধানে আড়াল করে রাখে। নইলে তার পরিবারের কথা এসে পড়বে। তার দৃষ্টিতে তার মা বাবা ভাই যা, অন্যের দৃষ্টিতে তো তা নয়!

কিন্তু মিঠু একটু পরে বলল, ‘ভাবিসনি আমার কোনও সঙ্কট নেই। জানিস তো আমার বাবা মুসলিম, মা হিন্দু। আমি কী রে? আমার ধর্ম কী? পরীক্ষা-টরীক্ষার ফর্মে লিখতে হয়—ইসলাম। কেননা বাবার পরিচয়েই ছেলেমেয়েদের পরিচয় হবার প্রথা। কিন্তু আমার বাবা কোনও ধর্ম মানে না। একদম শতকরা একশ ভাগ সেকুলার। আর আমার মা সব ধর্ম মানে। আমি মাঝে মাঝে ভাবি এই যে অযোধ্যা নিয়ে এত কাণ্ড হচ্ছে, যদি হিন্দু-মুসলমানে দাঙ্গা বাধে তো কে আমাকে মারবে? আমি কার শত্রু!’

ইমন বলল, ‘কেউ তোমাকে মারবে না মিঠু।’

‘কিন্তু আমি কোথায় বিলঙ করি আমায় তো জানতে হবে! বাবা-মার রেজিস্ট্রি ম্যারেজ। মা ধর্ম পাল্টায়নি। আমার বড় দাদা মারা যাবার পর মা ভীষণ ভিতু হয়ে গেছে। এমন কি কালীমন্দিরে মানত করে। জন্মদিনে আমাদের মাথায় পুজোর ফুল ঠেকায়। আমি বাবাকে বলি—বাবা তুমি কী ঠেকাবে ঠেকাও। বাবা বলে “আমার কিচ্ছু নেই। খালি কোনক্রমে আমার আমিত্বটুকু এখনও বজায় আছে।” এইসব আমার সঙ্কট ইমন। এই সঙ্কটে আমায় পড়তে হত না, যদি ফর্মে রিলিজন ব্যাপারটা না থাকত। মুসলিম মেয়েদের ডিভোর্সের আইন চালু হল না বলে বাবা রাত্রে খেল না। সকালে উঠে আমার মাথায় হাত রেখে বলল—ভাগ্যিস আমার মেয়েটা মুসলিম নয়, আমি তখন পুঁচকে, বললাম—তাহলে আমি কি? হিন্দু? তাতেও বাবা বলল—ভাগ্যিস আমার মেয়েটা হিন্দু নয়! আচ্ছা তুই-ই বল, ‘বাবা না হয় একটা নতুন ধরনের হেঁয়ালি উদ্ভাবন করে মজা পেল। হয়ত বাবা অনেক কিছু পেছনে ফেলে এসেছে। কিন্তু আমার পক্ষেও এ হেঁয়ালি হজম করা সম্ভব? আমি কী? আমি কী?’

ইমন মন দিয়ে শুনছিল, বলল, ‘তোমাকে কিছু হতেই হবে, তার কী মানে আছে? ধর্ম একটা চাই-ই?

‘বাঃ, সবার আছে, আমার না থাকলে, আমার কেমন খালি খালি লাগবে না?’

ইমন হেসে ফেলল। বলল, ‘এক হিসেবে তুমি কিন্তু খুব ভাগ্যবান মিঠু। তোমার কোনও সংস্কার নেই, অন্তত থাকার কথা নয়।’

মিঠু বলল, ‘সত্যিই নেই। কিন্তু খুব সংকটের সময় আমাকেও তো কারো কাছে প্রার্থনা জানাতে হয়! ইমন আমি মনে মনে গড বলি, গডের কাছে যা বলবার বলি। তাহলে দেখ একটা না একটা খুঁটি তো আমার ধরতেই হল! জানিস, আইরিশ কবি ইয়েটস ধর্মের অভাব পূর্ণ করতে চেয়েছিলেন দেশের উপকথা পুরাণ দিয়ে, শেষ পর্যন্ত অকাল্টিজম-এ চলে গেলেন।’

‘তুমি দূর্গা পুজো, সরস্বতী পুজো এসব সময়ে কী করো?’

‘নতুন জামা-কাপড় পরে ঠাকুর দেখতে যাই। আমার বাবা তো মূর্তি গড়েন। অর্ডার পান প্রত্যেকবার নিউ ইয়র্ক থেকে।’

‘ঈদের সময়ে?’

‘ঈদের সময়েও নতুন জামাকাপড় পেতাম। কিন্তু কেউ তো বাড়িতে রোজাও করে না। ঈদের চাঁদ দেখার জন্যে ব্যস্তও হয় না। অঞ্জলি দেওয়া, নামাজ করা কিচ্ছু নেই। নতুন জামাকাপড় পরে একটা মজা হত। এখন আর হয় না। আমার বাবার বন্ধুরা কেউ ঈদ মুবারক বললে আমার ভালো লাগে। আমিও বলি ঈদ মুবারক।

‘মাসী কী করেন?’

‘মা-ও প্রকাশ্যে কিচ্ছু করে না। পুজো-টুজো, অঞ্জলি দেওয়া, উপোস, বার-ব্রত।’

ইমন বলল, ‘এসব আজকাল কেউই করে না মিঠু, উচ্চশিক্ষিত মানুষদের মধ্যে এসব উঠে গেছে।’ মনে-মনে সে বলল, ‘আমার মা অবশ্য করে, আমি বারণ করি শোনে না।’

মিঠু বলল, ‘কিন্তু মা ওই সব মানত-টানত করে, পুজো পাঠায়। কেমন একটা জগা-খিচুড়ি।’

ওদের দুই বন্ধুকে আগে খেতে ডাকলেন মিঠুর মা। আজকে ইমনের সম্মানে তিনি চমৎকার একটা বিদেশি ডিনার সেট বার করেছেন। বললেন, ‘বিরিয়ানির সময় করতে পারিনি। চটজলদি একটা পোলাও করেছি মিঠু। সামান্য একটু মাংসের কুচি আছে, মাছও দিয়েছি। দ্যাখ ইমনের ভালো লাগে কি না।’ তিনি পাশে দাঁড়িয়ে ইমনকে চাটনি, রায়তা, মাংস, মাছ, ভাজা তুলে তুলে দিতে লাগলেন।

অতি সুন্দর সুগন্ধ পোলাও ইমন মুখের মধ্যে খুব সাবধানে রাখল, মনে মনে বলল, ‘বাবুয়া খা, বাবুয়া দিদি দিচ্ছে খা।’ মাছের চপ ভেঙে মুখে দিতে দিতে মাকে স্মরণ করল যেমন লোকে ঠাকুরকে স্মরণ করে ‘খাও মা খাও, আমার মুখ, আমার জিভ, আমার দাঁত দিয়ে খাও মা, যত দিন না নিজের হাতে দিতে পারছি।’

যখন সে কোথাও খেলতে গিয়ে খায়, এত খিদে থাকে, এত অপরিচিত মানুষ থাকে চারদিকে, আর আবহাওয়াটাও এমন পেশাদারি থাকে যে এসব কথা তার মনে আসে না। কিন্তু এখন সুন্দর আলোর নিচে, চমৎকার টেবিল-ঢাকার ওপর, ফুলকাটা কাচের বাসনে ঘরোয়া পরিবেশে সুখাদ্য খাবার সময়ে বাবুয়া আর মার কথা মনে করে হঠাৎ তার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে।

‘ইমন, ভাল হয়েছে রান্না?’ কাঁধের ওপর আলতো হাত রেখে জিজ্ঞেস করলেন অনুরাধা। ইমন বলল, ‘খুব ভালো।’ সে একটুও মাথা নাড়ল না। যেটুকু বাষ্প আছে চোখে, আগে শুকিয়ে যাক।

ওদের খাওয়া প্রায় শেষ হয়ে এসেছে এমন সময়ে মিঠুর বাবা আর দাদা এসে বসলেন ইমনের অনুমতি নিয়ে। ইমন চোখ তুলে তাকিয়ে দেখল নীল ট্রাউজার্স আর কোরা রঙের বুশ শার্ট পরা বেশ হৃষ্টপুষ্ট একজন ভদ্রলোক। মুখ পরিষ্কার কামানো। চুল প্রায় অর্ধেক সাদা। ভারি স্নেহভরা দু চোখে চেয়ে বললেন, ‘এই ইমন! এ কি এত রোগা কেন তুমি ইমন। খাও, খুব ভালো করে খাও। আজকাল মেয়েরা বড্ড ফিগার-কনশাস হয়ে যাচ্ছে। মিঠুটা তো আলু, ভাত এসব খেতেই চায় না। তবে মিষ্টি আর আইসক্রিমে পুষিয়ে নেয়, তাই না রে মিঠু?’

মিঠুর দাদাকে ঠিক মিঠুর মতো দেখতে, সে বলল, ‘না বাবা, মোটা হলে ও খেলবে কী করে? এখন খেলা প্রচণ্ড ফাস্ট। বিদ্যুতের মতো ঘোরাফেরা করতে হয়। ইমন তুমি আমার বাবার মতে মোটেই চলো না।’

মাসি বললেন, ‘আচ্ছা, এখন তো ওকে খেতে দাও তোমরা। এই সময়ে আবার খাওয়ার তত্ত্ব আরম্ভ করলে।’

ইমন হাসি-হাসি চোখে একবার মেসোমশাই আর একবার দাদার দিকে তাকাতে থাকল, হঠাৎ যেন একটা বহু পরিচিত গন্ধ তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলছে। একটা চেনা প্রিয় গন্ধ। সেটা তার পাশে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা মিঠুর মায়ের শরীর থেকে আসছে। না উল্টো-দিকে-বসা সাদেক চৌধুরীর দিক থেকে বইছে সে ভালো বুঝতে পারল না। কিছুক্ষণ পর যখন মিঠু ঘরে গিয়ে নীল ডায়মন্ড চালিয়ে দিল, আর রেমব্রান্টের ছবির অ্যালবাম দেখতে দিল তাকে, তখন কানে সুর চোখে ছবি নিয়ে মনে মনে সে বলতে লাগল বাবা! বাবা!

কত ভাগ্য মিঠুর বাবা রয়েছেন। কিছু নয় শুধু থাকাটা জরুরি। মিঠু জানে বাবাদের চারপাশ থেকে একটা আভা বেরোয়। সেই আভা ছেলেমেয়েদের ছেয়ে থাকে। সে হঠাৎ বলল, ‘মিঠু, আমাদের ওদিকটায় অনেক মুসলিম আছেন। আমার বন্ধুদের মধ্যে অনেকেই মুসলিম। কিন্তু মেসোমশাইয়ের মতো এরকম পুরোপুরি ধর্মের ঊর্ধ্বে আমি কাউকে দেখিনি। এটা লাক। খুবই গুড লাক তোমার।’

মিঠু নরম গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘আমার মা-বাবাকে তোর খুব ভালো লেগেছে, না?’

ইমন বলল, ‘হ্যাঁ, দাদাকেও।’

‘বারে, আর আমাকে?’ মিঠু আবদেরে ভঙ্গিতে ইমনের গলা জড়িয়ে ধরল। এরকম করে তার গলা জড়ায় একমাত্র বাবুয়া, তার ভাই।

ইমন হেসে বলল, ‘তুমি? বাঃ তুমি তো আগে!’

মিঠুর পাশে শুয়ে শুয়ে তার ঘুম এলো চমৎকার। যদিও একদম আলাদা জায়গা, আলাদা পরিবেশ। মিঠু সকাল বেলায় উঠে দেখল ইমন পাশে নেই, দালানে বসে সে জুতোর ফিতে বাঁধছে। খুব ভোর, বাইরে অল্প কুয়াশা জড়িয়ে রয়েছে শহরের বাড়িঘর গাছপালার গায়ে। মা এক গ্লাস গরম দুধ এনে রাখল।

মিঠুর শীত করছে, সে বেড-কভারটাই গায়ে জড়িয়ে ঘুম চোখে উঠে এসেছে, সে ঘুমে ধরা-ধরা গলায় বলল, ‘এ কী রে?’

‘এবার যাই। একটু ছুটতে হবে।’

সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বেল্টটা ঠিকঠাক করে নিল ইমন। মুখে মায়াময় হাসি লেগে আছে।

‘আবার আসবে ইমন। নিজের বাড়ি মনে করে আসবে, হ্যাঁ?’ মৃদুস্বরে বললেন অনুরাধা।

‘ইস ইমন তুই কী পাজি! এক্ষুনি চুপিচুপি পালিয়ে যাচ্ছিলি!’

‘পালাচ্ছি না। হোস্টেলে ঠিক সময়ে ফিরছি শুধু। আবার আসব।’

ইমন মিছে কথা বলে না। ইমন আশ্বাসের হাসি হাসছে। একটা জার্কিন গায়ে চড়িয়ে ইমন বেরিয়ে যাচ্ছে।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন