৫. রাবারের জুতো

পাওলো কোয়েলহো

বরফের কারণে আমার রাবারের জুতো ভিজে যাচ্ছিল। পাদ্রী খোলামেলা একটা জুতো আর উলের মোজা পরেছিল। আমরা দুজনেই পাহাড়ের উপর উঠছিলাম।

 কতক্ষণ লাগবে উপরে উঠতে?’ আমি বললাম।

 ‘খুব বেশি হলে আধঘন্টা।

‘আমরা কোথায় যাচ্ছি?

 ‘তার সাথে এবং অন্যদের সাথে সাক্ষাৎ করতে যাচ্ছি।’

আমি দেখলাম পাদ্রী এর চেয়ে বেশি কিছু বলতে চাচ্ছে না। হতে পারে সে পাহাড়ের ওঠার জন্য তার সমস্ত শক্তিকে জমা রাখতে চাচ্ছে। আমরা নিরবে হাঁটছিলাম। কুয়শা এখন পুরোপুরি কেটে গেছে। হলুদ রঙের থালার মতো সূর্যটাকে দেখা যাচ্ছে।

 এই প্রথমবারের মতো পুরো উপত্যকাটা আমি পরিষ্কার দেখতে পেলাম। একটা নদী বয়ে যাচ্ছে, ছড়ানো ছিটানো গ্রাম, সেইন্ট সেভিন শহর। আমি গির্জার উঁচু একটা মিনার দেখতে পেলাম যেটা আমি আগে দেখতে পাই নি। নদীর পাশে প্রাচীন ঘরগুলো দাঁড়িয়ে আছে।

একটু নিচে যেখানটা আমরা কিছু আগে পার হয়ে এসেছি সেখানে একজন রাখাল তার ভেড়ার পাল চড়াচ্ছে।

‘আমি ক্লান্ত। একটু দাঁড়াও এখানে। পাদ্রী বলল।

আমরা পাথরের উপর থেকে বরফ সরিয়ে সেখানে বসে বিশ্রাম নিলাম।

পাদ্রী দ্রুত শ্বাস নিচ্ছিলেন। তার পা হয়ত জমে গেছে।

‘আশা করি সান্তিয়াগো আমার সক্ষমতাকে আবার ফিরিয়ে দিক। আমি তার পথে আরো একবার হেঁটে যেতে চাই। আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে পাদ্রী বলল।

পাদ্রীর কথা আমি বুঝতে না পেরে কথার বিষয় পাল্টানোর সিদ্ধান্ত নিলাম।

বরফের উপর অনেকগুলো পায়ের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। আমি বললাম।

 ‘কতগুলো শিকারিদের পায়ের চিহ্ন, কতগুলো পুরুষ আর নারীদের যারা একধরনের ঐতিহ্যে আবারো বাস করতে চায়।

‘কী ধরনের ঐতিহ্য?

‘সেইন্ট সেভিনের মতো। জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এই পাহাড়ে চলে আসে তারপর ঈশ্বরের ধ্যান করে।

‘পাদ্রী আমি আরো বেশি কিছু বুঝতে চাই। গতকাল পর্যন্ত আমি এমন একজন মানুষের সাথে ছিলাম যে ধর্মীয় জীবন আর বিবাহিত জীবনের মধ্যে কোনো একটা পছন্দ করতে পারছিল না। আজকে আমি জানলাম যে সেই একই মানুষ অলৌকিক অনেক কিছু করতে পারে।

 ‘আমরা সকলেই অলৌকিক অনেক কিছু করতে পারি। পাদ্রী বলল। মহান যীশু বলেছেন আমাদের যদি একটা মুশর দানার মতোও বিশ্বাস থাকে তাহলে আমরা পাহাড়কে নড়তে বললে সে নড়বে।’

‘পাদ্রী আমি ধর্মীয় কোনো পাঠ শিখতে চাই না। আমি একজন মানুষকে ভালোবাসি। আমি এখন তার বিষয়ে আরো জানতে চাই। তাকে সাহায্য করতে চাই। অন্যেরা কী করতে পারে না করতে পারে তাতে আমার কিছুই যায় আসে না।

পাদ্রী লম্বা করে একটা শ্বাস নিল।

কয়েকমুহূর্ত পাদ্রী ইতস্তত করে বলল, একবার একজন বিজ্ঞানী ইন্দোনেশিয়ার একটা দ্বীপে বানরদেরকে নিয়ে গবেষণা করছিলেন। তখন তিনি সেই দ্বীপের একটা বানরকে কলা খাওয়ার আগে সেটাকে পানিতে ধুয়ে খাওয়া শিখিয়েছিলেন। কারণ এতে করে কলার উপর নদীর তীরের যে বালি থাকে সেটা ধুয়ে যায়। বিজ্ঞানী এই কাজটা করেছিলেন কারণ তিনি বোঝার চেষ্টা করেছিলেন যে বানরের শেখার ক্ষমতা কতটুকু। কিন্তু এর পরে কী ঘটবে সেটা তিনি কল্পনাও করতে পারেন নি। তাকে অবাক করে দিয়ে দ্বীপের অন্যান্য বানরেরা প্রথম বানরের অনুকরণ করা শুরু করল। তারাও কলা খাওয়ার আগে পানিতে ধুয়ে নিতে শুরু করল। পরবর্তীতে সেই দ্বীপের সব বানর কলা খাওয়ার আগে ধুয়ে নেওয়া শুরু করল। তারপর একদিন অন্যান্য দ্বীপের বানরেরাও একইভাবে কলা ধুয়ে খাওয়া শুরু করল।

সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো পরবর্তীতে বিজ্ঞানী যে দ্বীপে গবেষণা করছিলেন সেই দ্বীপে এবং এর আশপাশের বানরেরা কোনো রকম যোগাযোগ ছাড়াই একই কাজ করা শুরু করল।

এতটুকু বলে পাদ্রী থামল।

“তুমি কি বুঝতে পারলে?”

 না। আমি উত্তর দিলাম।

এরকম আরো অনেক বৈজ্ঞানিক গবেষণা আছে। সবচেয়ে সহজ আর স্বাভাবিক ব্যাখ্যা হলো যখন একটা নির্দিষ্ট কাজে নির্দিষ্ট সংখ্যক লোক জড়িত হয়ে পড়ে তখন সারা পৃথিবীর সমস্ত মানুষ সে কাজে জড়িয়ে পড়ে। আমরা জানি না কতগুলো মানুষের দরকার পড়বে কিন্তু আমরা জানি কীভাবে এটা কাজ করবে। পথিবীর নিজস্ব একটা আতা আছে। নির্দিষ্ট একটা সময়ে সেটা সবার উপর কাজ করে।

 ‘সেটা একটা মেয়েলি আত্মা।’ আমি বললাম।

পাদ্রী হাসতে থাকল।

‘চলো আমরা এগুতে থাকি। এখানে দাঁড়িয়ে থাকা যাবে না। খুব ঠাণ্ডা। একটু আগে তুমি আমার পায়ের জুতো দেখছিলে। পাদ্রী বলল।

 ‘আপনি কি আমার অন্তর পড়ছেন পাদ্রী?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।

 ‘আমাদের ধর্মীয় বিষয়ের ধারণার জন্য আমি তোমাকে একটা গল্প বলছি। আমরা সবাই নগ্ন পায়ের সাধক।

এই জুতোটা আমার গল্পেরই অংশ। কেউ যদি তার শরীরকে শাসন করতে পারে তাহলে সে তার ক্ষমতাকেও শাসন করতে পারবে। পাদ্রী বলল।

 ‘টেরেসা খুব সুন্দরী ছিল। তার বাবা তাকে সুশিক্ষার জন্য একটা আশ্রমে দিয়েছিল। একদিন যখন সে আশ্রমের বারান্দা দিয়ে হাঁটছিল তখন সে যীশুর সাথে কথা বলা শুরু করল। তার পুরো জীবনটাই তখন পাল্টে গেল। তার কাছে মনে হলো কামেলীয় আশ্রমটা বিয়ের জন্য দালালির কেন্দ্র থেকে খুব বেশি কিছু না। তখন সে নতুন একটা নির্দেশনা চালু করল। তারপর থেকে কামেলীয় খ্রিষ্টানদের জন্য সেই নির্দেশটা মূল শিক্ষা হয়ে গেল।

 সেন্ট তেরেসা নিজেকে জয় করতে পেরেছিলেন।

একদিন যখন টেরেসা অনুভব করছিলেন যে তার আত্মাটা দুর্বল হয়ে আসছে তখন তিনি যেখানে থাকতেন সেখানে এক মহিলা নানা রকম চিত্র আঁকা একটা পোশাক পরে তার কাছে আসল। সেই মহিলা যেভাবেই হোক টেরেসার সাথে কথা বলবে। কিছুতেই সেখান থেকে যাবে না। ঘরের মালিক তাকে অনেক কিছু বোঝাল। কিন্তু সে কারো কথা শুনতে চায় না। সে টেরেসার সাথে কথা বলবেই।

তিন দিন ধরে সেই মহিলা কোনো কিছু না খেয়ে কিছু পান না করে বাড়ির বাইরে অপেক্ষা করতে থাকল। অবশেষে সমব্যাথি হয়ে টেরেসা বের হয়ে আসলেন। তিনি মহিলাকে ভেতরে আসতে বললেন।

কিন্তু ঘরের মালিক বলল, না তাকে ভেতরে ঢুকতে দেওয়া ঠিক হবে না। কারণ এই মহিলা পাগল। উত্তরে টেরেসা বলল মহিলার হয়ত আমার মতই কোনো ধরনের পাগলামি আছে কিংবা ক্রুশ বিদ্ধ যিশুর মত।

 ‘আপনি বলতে চাইছেন সেইন্ট টেরেসা যীশু খ্রিষ্টের সাথে কথা বলেছিল। আমি বললাম।

 ‘হা। তিনি উত্তর দিলেন। চলো আমরা গল্পে ফিরে যাই। সেই মহিলাকে টেরেসার কাছে আনা হলো। মহিলা বলল যে তার নাম হলো মারিয়া দি যীশুশ। সে গ্রানাডা থেকে এসেছে। সে একজন কামেলীয় অনুসারি ছিল। কিন্তু মেরিমাতা তার কাছে উপস্থিত হয়ে তাকে নির্দেশ দিয়েছিল একটা আশ্রম তৈরি করতে যেখানে প্রাচীন সকল নিয়ম অনুসরণ করা হবে। মারিয়া দা যীশুশ আশ্রম থেকে বের হয়ে নিজের লক্ষ্যে সারা নোম খালি পায়ে হাঁটতে লাগল। তার এই তীর্থযাত্রা দুই বছর ছিল। এ সময়ের মধ্যে সে শীত গ্রীষ্ম সব সময় বাইরেই ঘুমাতো। মারিয়া দা যীশুশ, টেরেসাসহ আরো অনেকেই একই বিষয় চিন্তা করেছিল। পাদ্রী তার গল্প বলা শেষ করল।

 পাদ্রীর গল্প শুনে আমার মধ্যে বিচিত্র একটা অনুভূতি হচ্ছিল।

আমরা এখন একটা জঙ্গলের ভেতর দিয়ে হেঁটে চলছি। কুয়াশা একদমই নেই। কিন্তু সবচেয়ে উঁচু গাছের শাখাগুলো বরফে ছেয়ে আছে। সেখানে সূর্যের আলো লুটোপুটি খাচ্ছে।

 ‘পাদ্রী আমি জানি আপনি কোথায় যাচ্ছেন।

 ‘হ্যাঁ। সব মানুষেরা যদি একই নির্দেশ মান্য করে তাহলে পৃথিবী এক বিন্দুতেই থাকবে। নিজের স্বপ্নকে অনুসরণ করো, জীবনকে পাল্টে দাও, ঈশ্বর যে পথে আছে সে পথে চলতে থাকো। তোমার নিজের অলৌকিক ক্ষমতাকে কাজে লাগাও। ঝুঁকি নাও।’

চারপাশে সূর্যের আলো ঝকমক করছিল। মনে হচ্ছিল একই সাথে এই সব কিছু পাদ্রীকে সমর্থন দিচ্ছে।

 ‘এ সব কিছুর তার সাথে কী কাজ?

‘আমি তোমাকে এই গল্পের বীরত্বের অংশটুকু বলেছিলাম। কিন্তু তুমি এই বীরদের বিষয়ে কিছুই জানো না।

পাদ্রী একটু থামলেন।

 ‘দুঃখ কষ্ট। পাদ্রী আবার শুরু করলেন। যখন পরিবর্তনের সময় হয় তখন বীর শহিদেরা জন্ম নেয়। একজন মানুষ তার স্বপ্নকে অনুসরণ করার আগেই বাকিদেরকে তাদের জীবন উৎসর্গ করতে হয়। কথা শেষ করে পাদ্রী একটু থামলেন।

আমার দিকে ঘুরে আমার কাঁধে হাত রাখলেন।

 দয়া করে তাকে এই কষ্ট থেকে বাঁচাও।’ পাদ্রী বললেন। সে এই সব কষ্ট আর বেদনা সহ্য করতে পারবে না।

 ‘তার প্রতি আপনার ভালোবাসাটুকু আমি বুঝতে পারছি পাদ্রী।

পাদ্রী তার মাথাটা নারল।

 “না না, না তুমি কিছুই বুঝতে পারে নি। এই পৃথিবীর মন্দ আর দুষ্টগুলোকে বোঝার জন্য তুমি এখনো অনেক ছোট। তোমার বয়স কম। এই মুহূর্তে তুমি নিজেকে একজন বিপ্লবী হিসেবে দেখছ। তুমি এই পৃথিবীটাকে তোমার বন্ধুকে সাথে নিয়ে পাল্টে দিতে চাইছ। নতুন নতুন সব পথ আবিষ্কার করতে চাইছ, নিজেদের ভালোবাসা দিয়ে সারা পৃথিবীতে এক কিংবদন্তি হতে চাইছ, যেন প্রজন্মের পর প্রজন্ম তোমাদের সেই কাহিনি ছড়িয়ে পড়ে। তুমি এখনো মনে করো ভালোবাসা সব কিছুকে জয় করতে পারবে।

‘কেন ভালোবাসা কি জয় করতে পারে না?

হ্যাঁ এটা পারে। তবে স্বর্গীয় যুদ্ধ যখন শেষ হবে তখন।

কিন্তু আমি তাকে ভালোবাসি। স্বর্গীয় যুদ্ধ শেষ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত আমি অপেক্ষা করতে পারব না।’

 পাদ্রী অনেক দূরে তাকিয়ে থাকলেন।

‘ব্যাবিলন নদীর তীরে আমরা বসেছিলাম আর কেঁদেছিলাম। পাদ্রী যেন নিজের সাথেই কথা বলছিলেন।

 ‘এটা খুব দুঃখজনক। আমি উত্তরে বললাম।

 ‘এইটা হলো বাইবেলের স্তুতিগানের প্রথম অংশ। এটা বর্ণনা করছে। নির্বাসনে থাকা সেই সমস্ত লোকদের কথা যারা নির্বাসনের পর তাদের প্রতিশ্রুত জায়গায় ফিরে আসতে চাইছে কিন্তু পারছে না। নির্বাসন তখনো আরো দীর্ঘ সময়ের জন্য চলছে। আমি তার জন্য কিইবা করতে পারি যে কিনা সময় হওয়ার আগেই স্বর্গে ফিরে যেতে চাইছে।

 ‘কিছুই করার নেই পাদ্রী, কিছুই করার নেই। আমি বললাম।

*

‘ঐতো ওখানে সে। পাদ্রী বলল।

আমি তাকে দেখলাম। আমার থেকে দুইশ গজ দূরে বরফের উপর হাঁটুগেড়ে বসে আছে। তার শরীরে কোন জামা নেই। আমি এতটুকু দূর থেকেও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম। আমি দেখতে পেলাম শীতে তার শরীরের চামড়া একদম লাল হয়ে গেছে।

তার মাথা নিচু করা। হাত দুটো জড়ো করে সে প্রার্থনায়রত।

হতে পারে আমি গতকাল রাতের অনুষ্ঠান দিয়ে প্রভাবিত হয়েছি অথবা আজকে সকালে যে মহিলাটা খড় কুড়াচ্ছিল তার কথা দিয়ে প্রভাবিত হয়েছি, আমার কাছে সত্যিই মনে হচ্ছিল আমার সামনে এমন একজনকে আমি দেখতে পাচ্ছি যে অতীন্দ্রিয় অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারি। সে এমন একজন যে এই পৃথিবীর কেউ না। সে ঈশ্বরের সাথে বসবাস করছে এবং স্বর্গের অলৌকিক ক্ষমতায় উদ্ভাসিত।

‘এই মুহূর্তে তার মত আরো অনেকেই আছে। পাদ্রী বলল। ধারাবাহিক ধ্যান, ঈশ্বরের সাথে সম্পর্ক তৈরি, ফেরেস্তাদের ঐশীবাণী শোনা আর বিজ্ঞতায় পূর্ণ কথাবার্তাগুলোকে একটা বিশ্বাসে পরিণত করা। এভাবে তারা যতক্ষণ এই কাজগুলো করে যাবে তাদের কোনো সমস্যা হবে না। কিন্তু তার এখানে বেশিক্ষণ থাকা ঠিক হবে না। তাকে সারা পৃথিবী ঘুড়ে বেড়াতে হবে। মহান মাতার বাণী প্রচার করতে হবে। এই কাজ করতে গিয়ে তাকে অনেক পাথরের আঘাত সহ্য করতে হবে। কারণ যারাই প্রথম এই কাজ করেছে তাদেরকেই পাথরের আঘাতের মুখোমুখি হতে হয়েছে।

তবে যারা প্রথম সাড়িতে থাকে তাদের দিকে ফুলও ছুঁড়ে মারা হয়। আমি বললাম।

‘এটা তার ক্ষেত্রে ঘটবে না।’

পাদ্রী তার দিকে এগুতে থাকল।

‘আপনি কোথায় যাচ্ছেন?

‘তাকে এই গভীর ধ্যান থেকে আমি জাগাতে চাচ্ছি। তাকে বলতে চাই আমি তোমাকে অনেক পছন্দ করি। তাকে আরো বলতে চাই যে তার প্রতি আমার আশীর্বাদ রইল। আমি এটা এখানেই করতে চাই যেটা তার জন্য অলঙ্ঘীনয়।

 আমার আবারো অস্বস্থি লাগতে শুরু করল। কেমন অপ্রত্যাশিত একটা ভয় আমাকে পেয়ে বসেছে।

‘পাদ্রী আমাকে ভাবতে হবে। আমি জানি না এটা ঠিক হচ্ছে কি না।

‘এটা মোটেও ঠিক না। পাদ্রী উত্তরে বললেন। অনেক বাবা মাই তাদের সন্তানদের সাথে ভুল করে থাকেন এটা ভেবে যে তারাই তাদের জন্য সেরাটা জানেন। আমি তার বাবা নই। আমি জানি আমি ভুল করতে যাচ্ছি। কিন্তু আমার অদৃষ্ট আমাকে পূর্ণ করতেই হবে।

 পাদ্রীর কথা শুনে আমি আরো আতংকিত হয়ে পড়লাম।

‘পাদ্রী আপনি তাকে বাধা দিয়েন না। তাকে বিরক্ত করবেন না। তার প্রার্থনা শেষ করতে দিন। আমি বললাম।

‘তার এখানে থাকা উচিত না। তার উচিত তোমার সাথে থাকা। পাদ্রী বলল।

 হতে পারে সে কুমারী মাতার সাথে যোগাযোগ শুরু করেছে।

‘হতে পারে। কিন্তু একই আমাদেরকে তার কাছে যেতে হবে। আমার পক্ষ থেকে যদি আমি তোমাকে সাথে নিয়ে তার কাছে যাই তাহলে সে জানবে আমি তোমাকে সব কিছু বলে দিয়েছি। সে জানে আমি কি চিন্তা করি।

 আজকের দিনটা হলো নিষ্কলঙ্ক বিশ্বাসের। আমি জোর দিয়ে বললাম।

‘বিশেষ একটা দিন তার জন্য। গত রাতে সেই গুহায় আমি তার চোখে সুখ আর আনন্দের ছবি দেখেছিলাম।

‘নিষ্কলঙ্ক বিশ্বাসের ধারণাটা আমাদের সকলের জন্যই বিশেষ কিছু। পাদ্রী উত্তরে বললেন। কিন্তু আমি এখন এমন একজনের সাথে আছি যে কিনা ধর্ম নিয়ে আলোচনা করতে চায় না। চলো আমরা তার কাছে চাই।

 ‘এখন এই মুহূর্তে কেন পাদ্রী?

‘কারণ আমি জানি সে তার ভবিষ্যৎকে নির্ধারণ করছে এখন। সম্ভবত সে ভুল একটা জিনিস পছন্দ করতে যাচ্ছে।

 আমি ঘুড়ে দাঁড়িয়ে যে পথ দিয়ে উপরে উঠে এসেছিলাম সেই পথের দিকে পা বাড়ালাম।

পাদ্রী আমার পিছু নিলেন।

 “কি করছ তুমি? তুমি কি জানো না যে একমাত্র তুমিই তাকে রক্ষা করতে পারবে। তুমি কি দেখছ না যে সে তোমাকে ভালোবাসে এবং তোমার জন্য সে সব কিছু ছেড়ে দিতে পারবে?

আমি আরো দ্রুত হাঁটতে লাগলাম। পাদ্রীর জন্য আমার সাথে সাথে দ্রুত হাটা কষ্টকর ছিল। তবুও সে আমার পাশে পাশে হাঁটার চেষ্টা করছে।

 ‘এই মুহূর্তে সে তার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। সে হয়ত সিদ্ধান্ত নিচ্ছে যে তোমাকে ত্যাগ করবে। তুমি যাকে ভালোবাস তার জন্য সংগ্রাম করো।

 কিন্তু আমি থামলাম না। যতদ্রুত সম্ভব আমি ছুটতে চেষ্টা করলাম। এই পাহাড়, পাদ্রী, আমার সামনে পছন্দ করার চূড়ান্ত সুযোগ সব কিছু পেছনে ফেলে আমি পালাতে চাইছিলাম। সব কিছু ছেড়ে আমি ছুটছিলাম।

 আমি জানতাম যে লোকটা আমার পিছু পিছু ছুটছে সে আমার অন্তরকে পড়তে পারছে।

আমি কি ভাবছি সে জানে ফলে সে জানে যে আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসার চেষ্টাটা বৃথা।

যদিও সে শেষ পর্যন্ত চূড়ান্ত চেষ্টা করেছে, যুক্তি তর্ক দিয়ে আমাকে বোঝাতে চেয়েছে।

অবশেষে আমরা বড় পাথরটার কাছে চলে আসলাম যেখানে আধঘণ্টা আগে বিশ্রাম নিয়েছিলাম।

আমি হাপাচ্ছিলাম। পাথরের উপর বসে পড়লাম।

আমি ধাতস্ত হওয়ার চেষ্টা করছিলাম। সেখান থেকে দৌড়ে কোথাও একা বসতে চাচ্ছিলাম যাতে করে আমি একা একা সব কিছু ভালোভাবে চিন্তা করতে পারি।

কয়েক মুহূর্ত পর আমার মতই ক্লান্ত হয়ে হাপাতে হাপাতে পাদ্রী হাজির হলো।

‘আমাদের চারপাশের এ পাহাড়গুলোকে দেখেছ? তিনি শুরু করলেন। তারা কোন প্রার্থনা করে না। তারা ইতোমধ্যেই ঈশ্বরের প্রার্থনাকারীদের অংশ হয়ে পড়েছে। তারা নিজেদের জায়গা এই পৃথিবীর মাঝে খুঁজে পেয়েছে। এখানেই তারা অবস্থান করবে। মানুষেরা স্বর্গের দিকে মনোযোগ দেওয়ার আগেই, বজ্রের শব্দ শোনার আগে এবং এসব কিছু দেখে অবাক হওয়ার অনেক আগে থেকেই তারা এখানে আছে।

‘পাদ্রী আপনি কি সত্যিই এটা মনে করেন?

পাদ্রী কয়েক মুহূর্ত নিরব থাকলেন।

‘আপনি কি এখন আমার মন পড়ছেন?

না। কিন্তু তুমি যদি এইভাবেই অনুভব করে থাকো তাহলে তোমার ধর্মীয় জীবন পছন্দ করা ঠিক হবে না। অসংখ্যবার আমি আমার ভাগ্যকে বোঝার চেষ্টা করেছিলাম। পাদ্রী বলল। কিন্তু আমি সেটা পারি নি। আমি মেনে নিয়েছি যে আমি ঈশ্বরের সৈন্যবাহিনীর একটা অংশ, আর যা কিছু আমি করছি তার সবকিছুই লোকদের একটা ব্যাখ্যা দেওয়ার প্রচেষ্টা যে কেন দুঃখ, কষ্ট বেদনা আর অন্যায় রয়েছে এই পৃথিবীতে।

আমি এমন কিছুরও ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছি যেগুলোর আসলে কোন ব্যাখ্যা নেই। আমি মানুষদেরকে বলতে চেষ্টা করি যে এখানে একটা বিশাল পরিকল্পনা রয়েছে, সংঘাত রয়েছে ফেরেস্তাদের মধ্যে, ফলে আমরা সবাই এই যুদ্ধের অংশ।

আমি তাদেরকে বলতে চেষ্টা করি যে যদি একটা নির্দিষ্ট সংখ্যক লোকের এই দৃশ্যপট পরিবর্তনের যথেষ্ট বিশ্বাস থাকে তাহলে পৃথিবীর অবশিষ্ট লোকেরা উপকৃত হবে। কিন্তু তারা কিছুতেই আমার কথা বিশ্বাস করে না। তারা কিছুই করে না।

 ‘তারা এই পাহাড়গুলোর মতো। আমি বললাম। পাহাড়গুলো অনেক সুন্দর। যে কেউ এই পাহাড়গুলোর পাশে থাকবে তাকেই সৃষ্টির মাহাত্ম নিয়ে চিন্তা করতে হবে। এই পাহাড়গুলো ভালোবাসার জীবন্ত প্রমাণ যে ঈশ্বর আমাদেরকে অনুভব করে। পাহাড়গুলো নদীর মতো নয় যে নদী সব সময় পাল্টে যায় আর তার দুই পাশের দৃশ্যও পাল্টাতে থাকে।

‘হ্যাঁ ঠিক আছে। তাহলে কেন তারা পাহাড় হচ্ছে না?

‘হতে পারে পাহাড়দের অদৃষ্ট অত্যন্ত ভয়ংকর। তাদের ভাগ্যেই আছে যে তারা সারা জীবন একই জায়গায় দাঁড়িয়ে একই দৃশ্য দেখতে থাকবে।

পাদ্রী কিছু বলল না।

‘আমি পাহাড় হওয়ার জন্য গবেষণা করেছিলাম। আমার কথা আমি চালিয়ে যেতে থাকলাম পাদ্রীর সাথে। আমি সব কিছুই তার নির্ধারিত জায়গায় রেখেছিলাম। আমার শহরে চাকরি নেওয়ার জন্য আমি গিয়েছিলাম, সেখানে বিয়ে করব তারপর আমার সন্তানদেরকে আমার পিতা মাতার ধর্ম শেখাব। কিন্তু তারপরেও আমি এসব গ্রহণ করিনি। তবে এখন আমার চারপাশের সব কিছু ছেড়ে যাকে আমি ভালোবাসি তাকে গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। পাহাড় হবার কথা চিন্তা না করে আমি যে সিদ্ধান্তটা নিয়েছি সেটা খুব ভালো সিদ্ধান্ত। আমি পাহাড়ের মতো দীর্ঘদিন থাকতে চাই না।’

“তুমি খুব প্রজ্ঞাপূর্ণ কিছু কথা বলেছ।

আমি উঠে পড়লাম। পায়ের চিহ্ন লক্ষ্য করে পিছু হাঁটা দিলাম।

পাদ্রীও আমার সাথে হাঁটা শুরু করল। রাস্তায় পৌঁছার পূর্ব পর্যন্ত পাদ্রী আমার সাথে কোন কথা বলল না।

আমি পাদ্রীর হাত দুটো ধরে চুমু খেলাম।

 ‘আমি বিদায় জানাতে যাচ্ছি। আমি চাই আপনি জানেন যে আমি আপনাকে বুঝতে পেরেছি এবং আমার বন্ধুর প্রতি আপনার ভালোবাসাটাকেও আমি বুঝতে পেরেছি। আমি বললাম।

 পাদ্রী হেসে আশীর্বাদ করলেন।

‘আমিও তোমার বন্ধুর প্রতি তোমার ভালোবাসাটাকে বুঝতে পেরেছি। তিনি বললেন।

.

বাকি দিনটুকু আমি সেই উপত্যকায় হেঁটে হেঁটেই পার করে দিলাম।

বরফ নিয়ে খেলোম, সেইন্টসেভিনের পাশে গ্রামগুলো ঘুড়ে দেখলাম, সেন্ডউইচ খেলাম, কয়েকজন বাচ্চাকে দেখলাম ফুটবল খেলছে। গ্রামের গির্জায় আমি মোমবাতি জ্বালালাম।

আমি চোখ বন্ধ করে গত রাতে যে প্রার্থনাগুলো শিখেছিলাম সেগুলো পুনরাবৃত্তি করতে থাকলাম।

হতে পারে নিছক এই কথাগুলো আমাদের কোন উপকারেই আসে না। এর কোন অর্থ নেই। কিন্তু যখনই আমরা এমনটা করি তখনই পবিত্র শক্তি আমাদের আত্মার সাথে কথা বলে। সেই কথাগুলোই বলে যে কথাগুলো আমাদের আত্মার শোনা খুব দরকার।

আমি যখন বুঝতে পারলাম আমার হৃদয় যথেষ্ট পরিশুদ্ধ হয়েছে তখন আমি চোখ বন্ধ করে প্রার্থনা করা শুরু করলাম।

.

মহান মাতা আমার বিশ্বাসকে আপনি ফিরিয়ে দেন।

আপনার কাজের একটা জরুরি উপাদান হয়ে আমি কাজ করতে চাই।

আমার ভালোবাসার ভেতর দিয়ে শেখার সুযোগ আমাকে দিন। কারণ ভালোবাসা কাউকেই তাদের স্বপ্ন থেকে দূরে রাখে না।

আমি যে লোকটাকে ভালোবাসি সব সময় তার সাথেই থাকতে চাই।

যাতে যে কাজটা আমাদের একত্রে করা দরকার সেই কাজটা আমরা এক সাথেই করতে পারি।

.

আমি যখন সেইন্ট সেভিনে ফিরে আসলাম তখন এর মধ্যেই রাত হয়ে গেছে।

আমরা যে বাড়িতে উঠেছিলাম সে বাড়ির সামনেই গাড়িটা পার্ক করা ছিল।

 ‘তুমি কোথায় গিয়েছিলে? সে আমাকে জিজ্ঞেস করল।

‘হাঁটছিলাম আর প্রার্থনা করছিলাম। আমি উত্তরে বললাম।

আমার বন্ধু জড়িয়ে ধরল আমাকে।

 ‘প্রথমে আমি ভেবেছিলাম তুমি চলে গেছ। এই পৃথিবীতে তুমি আমার কাছে সবচেয়ে দামী উপহার।

 ‘আমার জন্য হলে তুমি। আমি বললাম।

*

সেইন্ট মারটিন ডি উনেক্স এর কাছে যখন ছোট্ট একটা গ্রামে আমরা থামলাম তখন বেশ রাত হয়ে গেছে।

অতি বৃষ্টি আর আগের দিনের বরফের কারণে আমরা থামার সিদ্ধান্ত নিলাম।

 ‘আমাদের খোলা কোনো বাড়ি দেখতে হবে। আমি খুব ক্ষুধার্ত। সে গাড়ি থেকে বের হয়ে বলল।

আমি গাড়িতেই বসে থাকলাম। নড়লাম না।

বাইরে আস। সে গাড়ির দরজা খুলে বলল।

‘আমি তোমাকে এখন একটা প্রশ্ন করব যে প্রশ্নটা আমরা এক সাথে দেখা হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত আমি করি নি।

আমার বন্ধু হতচকিত হয়ে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভাব নিয়ে নিল।

তার এই উদ্বেগের ভাব দেখে আমি হেসে ফেললাম।

 ‘এটা কি সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন?

‘খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমি তখনো ভাব নিয়ে বললাম। প্রশ্নটা হলো আমরা

এখন কোথায় যাচ্ছি?

আমরা দুজনেই হেসে উঠলাম।

 ‘জারাগোজা যাচ্ছি। সে একটু আস্বস্ত হয়ে বলল।

আমি লাফিয়ে গাড়ি থেকে বের হয়ে আসলাম। তারপর একটা ভোলা রেস্টুরেন্টের দিকে হাটা দিলাম। রাতের এই সময় রেস্টুরেন্ট খোলা থাকাটা অবিশ্বাস্য ব্যাপার।

তবে এটা অসম্ভব ছিল না। কারণ সেই অন্যজন এখন আমার সাথে নেই। অলৌকিকতা সব কিছুকেই সম্ভব করে দিতে পারে। আমি নিজেকে বললাম।

 ‘তুমি বার্সেলোনা কখন থাকবে? আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম। কারণ সে আমাকে বলেছিল বার্সোলোনাতে তার একটা কনফারেন্স আছে।

আমার বন্ধু কোনো উত্তর দিল না। তার চোখ মুখ আবারো রাশভারি হয়ে উঠল।

আমি ভাবলাম এই ধরনের প্রশ্ন করাটা হয়ত ঠিক হয় নি।

কারণ সে ভাববে আমি তার জীবনটাকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছি। বেশ কিছু রাস্তা আমরা কোন কথা না বলেই হেঁটে গেলাম।

গ্রামের সেই চত্বর বাড়িতে কিছু একটা চিহ্ন দিয়ে লেখা ছিল।

 ‘এটা খোলা আছে। চলো কিছু খেয়ে নিই।’ সে বলল।

টেবিলে বেশ দারুন কিছু খাবার উপস্থাপন করা হলো। সাথে অর্ধেক বোতল রিওজা ওয়াইন।

‘এই দোকানটা মধ্যদেশীয় মদ বিক্রি করে। আমাদেরকে হোটেলের পরিচারক বলল।

রাতের সেই সময়টাতে সেখানে আর কেউ ছিল না। সে একটা টেলিফোন করার জন্য উঠে গেল। ফিরে আসার পর আমি তাকে জিজ্ঞেস করতে চাইলাম যে সে কাকে ফোন করতে গিয়েছিল। কিন্তু এই সময় আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করলাম।

 ‘আমরা মধ্য রাত আড়াইটা পর্যন্ত রেস্তোরাঁ খোলা রাখি। আপনার যদি চান তাহলে আমি আরো কিছু খাবার আর মদ নিয়ে আসি। আপনার যখন বাইরে যাবেন তখন এই মদটুকু আপনাদেরকে উষ্ণ রাখবে।’ পরিচারক বলল।

‘আমরা ততক্ষণ থাকব না। আমার বন্ধু উত্তরে বলল।

 ‘সকাল হওয়ার আগেই আমাদেরকে জারাগোজায় ফিরে যেতে হবে।

লোকটা তার জায়গায় চলে গেল। আমরা আবারো গ্লাসটা পূর্ণ করলাম। বিলাবোতে যে ধরনের একটা আলোর ঝলক আমি মনের মধ্যে পেয়েছিলাম যে ঝলকানি আমাদেরকে সব ধরনের জটিল আর কঠিন কিছু শুনতে সহায়তা করে এখানেও তেমন একটা অভিজ্ঞতা হলো।

‘গাড়ি চালিয়ে তুমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছ। আমরা মদ খাচ্ছি। রাতটা এখানে থেকে গেলে ভালো হতো। আমরা যখন আসছিলাম তখন আমি হোটেল দেখেছিলাম। আমি বললাম।

আমার বন্ধু টেবিলের উপর কিছু একটার দিকে ইংগিত করে আমাকে স্বাভাবিক বিষয়ে স্বতন্ত্রতা ও সংসার অভিজ্ঞতার কথা বলল।

 ‘একজন সেমিনারিয়ানের মুখে সংসার অভিজ্ঞতার কথা কেমন যেন শোনায় খুব অদ্ভুত। আমি বললাম। চেষ্টা করলাম আলোচনার মোরটা অন্য কোনো দিকে ঘোরানো যায় কিনা।

 ‘আমি সেমিনারিয়ানদের কাছেই এটা শিখেছি। আমাদের বিশ্বাস দিয়ে আমরা যতই ঈশ্বরের কাছাকাছি হবো ততই তিনি স্বাভাবিক হয়ে উঠবেন। আর তিনি যত স্বাভাবিক হবেন তত তার মাহাত্ম প্রকাশ পাবে। কিন্তু আমি তোমার সাথে সেই বিষয়ে কথা বলতে চাই না। আমি এক অন্য রকমের ভালোবাসার কথা বলতে চাই।

সে আমার মুখটা উঁচু করে ধরল। মদ খাওয়ার কারণে সব কিছু আমাদের কাছে স্বাভাবিক লাগছিল।

 ‘তুমি কেন কথার মাঝে হঠাৎ করে থেমে গেল। কেন তুমি ঈশ্বর আর মা মরিয়মের বিষয়ে আমাকে কিছু বলতে চাও না? আমি জিজ্ঞেস করলাম।

 ‘আমি তোমাকে অন্যরকম এক ভালোবাসার কথা বলতে চাই। সে আবারো বলল। সেই ভালোবাসার কথা যা একজন পুরুষ আর একজন নারী ভাগাভাগি করে নেয়। আর সেখানেই থাকে অনেক অলৌকিকতা।

আমি তার হাতটা আমার হাতে নিলাম।

আমার বন্ধু হয়ত দেবীদের রহস্যময়তার বিষয়ে অনেক কিছুই জানে কিন্তু। সে ভালোবাসার বিষয়ে আমার থেকে বেশি কিছু জানে না। সে যত দেশ ভ্রমণ করুক না কেন তাতে কিছুই যায় আসে না।

আমরা দীর্ঘ সময় হাত ধরাধরি করে বসে থাকলাম। আমি তার চোখের দিকে তাকিয়ে ভালোবাসার ভয় দেখতে পেলাম। আমি দেখতে পেলাম তার চোখে ভালোবাসার প্রত্যাখ্যানের ভয়, যে দীর্ঘ সময় আমরা পৃথক ছিলাম আর সে ঈশ্বরের সন্ধানে কত জায়গায় ঘুড়ে বেড়ালো। আমি দেখতে পেলাম এই রকম একটা মুহূর্তের জন্য তার প্রতিক্ষার প্রহরগুলো কীভাবে তার চোখে ভেসে উঠছে।

আমি তাকে বলতে চাইলাম যে হ্যাঁ তাকে আমার কাছে স্বাগতম।

আমি তাকে বলতে চাইলাম যে আমিও তাকে কত ভালোবাসি। এই মুহূর্তের মতো তাকে কাছে পেতে আমিও কত প্রতীক্ষা করেছি।

 কিন্তু আমি কিছুই বললাম না। শুধু চুপ করে থাকলাম।

মনে হচ্ছিল আমি যেন স্বপ্নে দেখছি যে তার ভেতরের সংঘর্ষ। আমাকে হারানোর ভয় আমি তার ভেতরে দেখতে পেলাম, আমি যদি তাকে আবারো ফিরিয়ে দেই সেই আতংকে কীভাবে সে ঘুড়ে বেড়াচ্ছে।

তার হাত থেকে আমার একটা হাত ছারিয়ে আমি মদের গ্লাসটা টেবিলে কোনায় ছুঁড়ে মারলাম।

 ‘গ্লাসটা পড়ে যাবে। সে বলল।

“ঠিক তাই। আমি চাই তুমি ঠোক্কর দিয়ে সেটাকে ধরো।

এই গ্লাসটা ভেঙে?

হ্যাঁ গ্লাসটা ভেঙে। একটা মূল্যহীন গ্লাস ভাঙলে কি হয় যখন আমাদের জীবনে প্রতিনিয়তই কেউ না কেউ কিছু না করেই অনেক কিছু ভেঙে ফেলছি।

‘এই গ্লাসটা ভেঙে? কেন? সে আবারো বলল।

 ‘আমি তোমাকে অনেক কারণই বলতে পারতাম। কিন্তু আমি শুধু বলছি এটাকে ভাঙো।

শুধু তোমার জন্য?

“অবশ্যই না।’

আমার বন্ধু চোখের কিনারা দিয়ে টেবিলটা দেখল গ্লাসটা পড়ে যাচ্ছে কিনা।

আমি টেবিলটাকে নারা দিলাম।

 সাবধান!

 ‘গ্লাসটা ভাঙো। আমি আবারো জোর দিলাম।

 আমি মূলত একটা পরীক্ষা করতে চেয়েছিলাম। জীবনটা কি এইভাবেই একটা টেবিলের কিনারে দাঁড়িয়ে আছে?

 ‘গ্লাসটা ভাঙো। আমি আবারো বললাম।

বন্ধু আমার দিকে এক চোখে তাকিয়ে থাকল। তার পর সে আস্তে আস্তে টেবিলের কাপড়টা টান দিল।

গ্লাসটা মাটিতে পড়ে ভেঙে গেল।

 গ্লাস ভাঙার শব্দে পরিচারক সর্তক হয়ে আমাদের দিকে তাকাল।

 ‘কোন সমস্যা নেই। পরিচারক বলল।

 কিন্তু আমার বন্ধু মনে হলো কিছু শুনতে পায় নি।

সে দাঁড়িয়ে পড়ল। আমার মাথার চুলগুলো তার হাত দিয়ে টেনে ধরে কাছে টেনে নিয়ে আমাকে চুমু খেতে শুরু করল।

আমিও শক্ত করে পাগলের মতো তার মাথার চুলগুলো ধরে সমস্ত শক্তি দিয়ে ওর ঠোঁট কামড়ে ধরলাম। বুঝতে পারলাম ওর ঠোঁট আর জিহ্বা আমার মুখের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে।

এই রকম একটা দীর্ঘ চুমুর জন্য আমি কতকাল ধরে অপেক্ষা করছি তখন থেকে যখন আমরা ছেলেবেলায় নদীর পাশে বসে থাকতাম একসাথে আর আমরা তখন জানতামও না ভালোবাসা কাকে বলে।

 এই দীর্ঘ চুমুটা আমাদের জন্য এতকাল বাতাসে ঝুলে ছিল, আমরা বড় হয়েছি, সে সারা পৃথিবী ঘুড়ে বেড়িয়েছে নানা অভিজ্ঞতার জন্য আর চুমুটা বাতাসে মিশে ছিল।

এই চুমুটা কতবার আমাদের কাছ থেকে হারিয়ে গেল, অবশেষে সেটাকে আমরা খুঁজে পেলাম।

কত অসম্ভব সব স্বপ্নে ভেতর দিয়ে সন্ধান করে আমরা চুমুটাকে খুঁজে পেলাম।

আমি তাকে খুব শক্ত করে চুমু দিলাম।

অল্প যে কয়জন লোক পানশালায় ছিল তারা হয়ত ভাবছিল এটা নিছক একটা চুমু ছাড়া আর কিছু না।

 তারা বুঝতেও পারছিল না এই চুমুটা আমাদের জীবন-মরণের সীমান্তে দাঁড়িয়ে আছে।

চুমুর সেই মুহূর্তটা হলো আমার জীবনের সেরা সুখের মুহূর্ত।

*

সে আমার সব কাপড় খুলে আমার ভেতরে সমস্ত শক্তি, ভয়, স্বপ্ন আর দৃঢ় সংকল্প নিয়ে ঢুকে পড়ল।

আমি তার মুখের উপর হাত বুলিয়ে দিলাম, তার গোঙানি শুনলাম, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিলাম যে আমার বন্ধুকে খুঁজে পেয়েছি, সে আমার ভেতরেই আছে। সেই প্রথমবারের মতই তাকে আমি অনুভব করছি।

আমরা সারা রাত ভালোবাসলাম, ঘুমালাম স্বপ্ন দেখলাম।

 আমার ভেতরে তাকে অনুভব করলাম, শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম নিশ্চিত হওয়ার জন্য যে এটা সত্যিই ঘটছে, নিশ্চিত হতে চাইছিলাম এই দৃশ্য কিছুতেই চলে যাবে না।

আমি প্রতিজ্ঞা করলাম কখনোই আমি তাকে হারাব না। কোথাও চলে যেতে দিব না। সে সারা জীবন আমার সাথেই থাকবে। কারণ আমি পবিত্র আত্মার কথা শুনতে পেয়েছি, তারা আমাকে বলেছে আমি কোন পাপ করি নি।

.

আমি তার সাথী হয়ে নতুন একটা পৃথিবী তৈরি করতে পারব। আমরা এক সাথে কাজ করব, নতুন সব অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যাব, এক সাথে যুদ্ধ করব। সেই আত্মাদের স্বর আমাকে তাই বলেছে। কারণ আমি আমার বিশ্বাস ফিরে পেয়েছি।

আমি জানি তারা সত্যি কথাই বলেছে।

*

বৃহস্পতিবার, ডিসেম্বর ৯, ১৯৯৩

আমি জেগে উঠলাম, আমার বুকের উপর তার হাত।

এর মধ্যেই বেশ সকাল হয়ে গেছে। কাছেই একটা গির্জায় ঘণ্টার ধ্বনি শোনা যাচ্ছে।

সে আমাকে চুমু খেল। আমার শরীরটা তার হাত দিয়ে বুলিয়ে দিল।

‘আমাদেরকে যেতে হবে। সে বলল। ছুটির দিন আজকে শেষ হয়ে যাবে, ফলে রাস্তায় প্রচুর ভিড়।

 ‘আমি জারাগোজায় ফিরে যেতে চাই না। আমি বললাম। আমি সোজা তুমি যেখাবে যাবে সেখানে যাব। খুব শিগগির ব্যাংক খুলবে। আমার কার্ড ব্যবহার করে কিছু টাকা উঠিয়ে আমি কাপড় কিনব।’

‘তুমি আমাকে বলেছিলে তোমার কাছে তেমন টাকা নেই।’

‘অনেক কিছুই আছে আমার করার। আমি যদি এখন জারাগোজায় ফিরে যাই তাহলে আমি হয়ত ভাবতে থাকব যে আমি ভুল করছি, কারণ পরীক্ষার সময় একদম ঘনিয়ে, আমার পরীক্ষা শেষ হওয়ার জন্য আমরা আবার দু মাস পৃথক থাকব। আর আমি যদি পরীক্ষায় পাস করি তাহলে আর জারাগোজা ছাড়তে আমার ইচ্ছে করবে না। না, না আমি কিছুতেই ফিরে যেতে পারব না। আমি আগের যেই নারীটা ছিলাম সেটাকে পুড়িয়ে ফেলতে চাই।

‘বার্সেলোনা। সে নিজের মনেই বলল।

কী?

‘কিছু না। চলো রওনা দেই।

‘কিন্তু তোমাকেতো একটু প্রস্তুতি নিতে হবে।’

‘আরো দুদিন বাকি আছে সেই অনুষ্ঠানের। সে বলল। তার গলার স্বরটা একটু অন্যরকম মনে হলো। চলো আমরা অন্য কোথাও যাব। আমি সরাসরি বার্সোলোনাতে যেতে চাই না।

আমি বিছানা থেকে উঠলাম।

 জানালার কাছে গিয়ে সেটার কপাট খুললাম, নিচের সরু পথটা দেখলাম।

বাড়ির বারান্দাগুলোতে শুকনো কাপড় ঝুলানো। গির্জা থেকে ঘণ্টার ধ্বনি শোনা যাচ্ছে।

“আমি একটা আইডিয়া পেয়েছি। আমি বললাম। চলো আমরা ছেলেবেলায় যে জায়গাটাতে এক সাথে বসতাম সেখানে যাই। তারপর আমি আর কখনোই সেখানে যাই নি।

 ‘কোথায় সেটা?

 ‘পিদরা নদীর পাশে সেই আশ্রম।

.

আমরা যখন হোটেল থেকে বের হয়ে আসছিলাম তখনো গির্জার ঘণ্টা ধ্বনি বেজে চলছিল।

সে আমাকে কাছেই কোনো গির্জার ভেতর ঢোকার পরামর্শ দিল।

 ‘আমরা এই সব করেছি। গির্জা, অনুষ্ঠান, প্রার্থনা। আমি বললাম।

‘আমি ভালোবাসা বাসি করেছি। সে বলল। তিন তিনবার আমরা মদ খেয়েছি, পাহাড়ের ভেতর দিয়ে হেঁটেছি। আমরা ভালোবাসা আর ক্রোধের ভেতর দিয়েও গিয়েছি।

আমি হয়ত কিছু চিন্তা করেই বলে ফেলেছিলাম। নতুন এই জীবনের সাথে আমাকে অভ্যস্ত হতে হবে।

‘আমি দুঃখিত। আমি বললাম।

 ‘চলো মাত্র কয়েক মিনিটের জন্য আমরা এর ভেতরে ঢুকি। ঘণ্টাগুলো একটা চিহ্ন।

আমার বন্ধুই আসলে সত্য ছিল। পরবর্তী দিন পর্যন্ত আমি সেটা বুঝতেই পারি নি।

আসলকথা হলো গির্জার ভেতরের সেই ঘন্টার ধ্বনি যেটা আসলে একটা ইশারা ছিল আমরা সেটা না বুঝেই চাৰ্চটা ঘুড়ে দেখলাম, গাড়িতে উঠে চার ঘণ্টা ড্রাইভ করে পিদরা নদীর তিরের আশ্রমে আসলাম।

*

মঠটার ছাদ ভেঙে গেছে, সামনে দিয়ে অনেক কিছু ঝড়ে পড়েছে, এখন যে চিত্রটা দাঁড়িয়েছিল সেটা আসলে আগের চিত্র না। আমি চারপাশটায় তাকালাম।

অতীতে এই জায়গাটা অনেক শক্তিশালী মানুষের আশ্রয়স্থল ছিল। এর চারপাশে তাকালেই দেখা যেত দেয়ালের পাথরগুলো ঝকঝক করছে। আশ্রমের প্রতিটি আসন ছিল সময়ের স্বাক্ষী।

 কিন্তু আমি এখন যা দেখছি তার সব কিছুই ধ্বংস হয়ে গেছে।

 বাল্যকালে আমরা যখন শিশুদের মতো খেলা ধুলা করতাম তখন এর ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রতিটি অংশকে একটা করে দুর্গ মনে করতাম। এই দুর্গের ভেতর আমার কাংখিত রাজকুমারটিকে খুঁজে বেড়াতাম।

 শত শত বছর ধরে পিদরা নদীর তীরে এই স্বর্গীয় জায়গাটুকু একইভাবে আছে।

প্রতিবেশি গ্রামবাসীদের জন্য এই নদী আশীর্বাদ হয়ে তাদের পানির চাহিদা মেটাচ্ছে। পিদরা নদী থেকে কয়েক ডজন ঝর্ণা, খাল, পুকুর চারপাশে ছড়িয়ে আছে।

 এই নদীটাও এক সময় শুকিয়ে যাচ্ছিল, পানির প্রবাহ কমে গিয়েছিল। তখন মঠের সন্ন্যাসীরা গ্রামের লোকজনের ওপর পানির জন্য কর আরোপ করেছিল। এই নিয়ে ইতিহাসে মঠ সন্ন্যাসী আর গ্রামবাসীদের মধ্যে যুদ্ধের ঘটনাও উল্লেখ আছে।

এক সময় এই আশ্রম স্পেনের সৈন্যদের ব্যারাকে পরিণত হয়েছিল। কেন্দ্রীয় গির্জার পাশ দিয়ে ঘোড়ার খুরের আওয়াজ পাওয়া যেত, মঠে সৈন্যরা বিশ্রাম নিয়ে ঘুমাতো, তারা গ্রামের মেয়েদের সাথে প্রেম করত।

প্রতিশোধ দেরিতে হলেও নেওয়া হলো। আশ্রমটা ধ্বংস করে দেওয়া হলো। আশ্রমের সন্ন্যাসীরা পুনরায় স্বর্গের এই অংশটাকে তৈরি করতে পারল না। বেশ কিছু যুদ্ধের পর একটা কাহিনি শোনা যায় যে কাছের গ্রামের এক লোক ঈশ্বরের বাণী নিয়ে এসেছিল। সে বলল যীশু বলেছে যারা পিপাসিত তাদেরকে পানি খাওয়াও, কিন্তু মঠের সন্ন্যাসীরা সেটা না করায় ঈশ্বর তাদেরকে ধ্বংস করে দিয়েছেন যারা নিজেদেরকে প্রকৃতির প্রভু বলে মনে করে।

 হয়ত এই কারণেই অধিকাংশ আশ্রমগুলো আবার তৈরি করে সেগুলো হোটেল বানিয়ে ফেলা হয়েছে। শুধু মূল আশ্রমটা এখনো ধ্বংসাবস্থায় আছে।

 গ্রামের উত্তরসুরি লোকেরা তাদের পূর্বপুরুষেরা প্রকৃতির স্বাভাবিক দান নদীর পানির জন্য যে উচ্চ মূল্য দিয়েছিল সেটা ভোলেনি।

 ‘মাথাওয়ালা ঐ মূর্তিটা কিসের?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।

 ‘ওটা সেইন্ট তেরেসার মূর্তি। সে খুবই শক্তিশালী। আমার বন্ধু বলল।

সে আমার হাতটা ধরল। আমরা আশ্রম থেকে বের হয়ে আসলাম। একটা লম্বা বারান্দা দিয়ে হাঁটতে লাগলাম।

আমি যখন ছোট্ট মেয়েটি ছিলাম আর এখানে এসেছিলাম সেই সময়ের প্রতিটি স্মৃতি আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। আমি এখন যা দেখছি তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ আর প্রাণবন্ত হয়ে উঠছে পুরাতন স্মৃতিগুলো।

.

এই যে সময়ের পরিবর্তনের মাধ্যমে আজকে আমি পাল্টে যাচ্ছি সে জন্য আমাকে কম কষ্ট করতে হয় নি। আমাকে জীবনে এমন অনেক বিষয়ের জন্য যুদ্ধ করতে হয়েছিল যে বিষয়গুলো আমি কখনোই পেতে চায় নি।

হয়ত এটা এই জন্য হয়ে ছিল যে আমি খুব অলস ছিলাম। কোনো কিছু পরিবর্তনের পক্ষে আমি ছিলাম না। কিন্তু অবশেষে সব কিছু পাল্টে গেল। ভাগ্য আমার কাছে আমার পছন্দ নিয়েই ফিরে আসল। এখন আমার নিজেকে আর আমার পৃথিবীকে পাল্টে দেওয়ার সুযোগ দিচ্ছে।

আমরা যখন ভ্রমণ করছিলাম তখন সেই পর্বতারোহীর কথা আবরো মনে পড়ছে।

তারা খুবই তরুণ ছিল। ঝলমলে পোশাক পরা, বরফের মধ্যে যদি তারা হারিয়ে যায় তাহলে যেন তাদেরকে খুব দ্রুত আর সহজেই চিহ্নিত করা যায়।

পাহাড়ের চূড়ায় যাওয়ার সঠিক রাস্তাটা তাদের জানা ছিল। পাহাড়ের শীর্ষ পর্যন্ত দরি আর হুক টানানো। যাতে করে তারা নিরাপদে চূড়ায় উঠতে পারে। সেখানে তারা ছিল ছুটিকালীন অভিযান উপভোগ করতে। সোমবার আবার তারা যার যার কাজে চলে যাবে। কাজে ফেরার আগে তারা প্রকৃতিকে চ্যালেঞ্জ করে এই জয়টুকু আর্জন করে তার স্মৃতি নিয়ে ফিরতে চায়।

কিন্তু ঘটনা আসলে সেরকম হয় না। এটা আসলে এরকম ছিল না।

 তাদের কেউ কেউ প্রথমে যারা ছিল হয়ত রাস্তা খুঁজে পেয়েছিল, কেউ কেউ অনেক উপরে উঠে গিয়েছে, আবার অনেকে নিচে পাথরের উপর পড়ে থেতলে গিয়েছে। কেউ কেউ অর্ধেক পথও পারি দিতে পারে নি। কেউ কেউ হয়ত তাদের হাত, পা ও আঙুল হারিয়েছে। কাউকে আর কখনোই সেখানে খুঁজে পাওয়া যায় নি।

কিন্তু একদিন তাদের কেউ কেউ শীর্ষ চূড়ায় উঠেছে।

সেখানেই নিচে কিছু লোক ছিল যারা ভাবছিল, ‘উপরেতো দেখার মতো কিছুই নেই। এটা করলে কি এমন রাষ্ট্র জয় করা হয়?

 কিন্তু প্রথম যে ব্যক্তিটি চূড়ায় উঠেছিল সেই জানে এতে কি বিশাল কিছু আছে। সে জানে চ্যালেঞ্জকে জয় করে কীভাবে সামনে এগুতে হয়।

সে জানত এক একটা দিন অন্যগুলোর মতো নয়, প্রতিটি দিনই আলাদা। প্রতিটি সকাল তার নিজস্ব নতুন নতুন অলৌকিকতা আর যাদু নিয়ে উপস্থিত হয়। যেই যাদুকরি মুহূর্তগুলোতে প্রাচীন কালে কত বিশ্ব ধ্বংস হয়েছে আর কত কত নতুন নক্ষত্র তৈরি হয়েছিল।

যে লোকটা পাহাড়ের চূড়ায় উঠেছিল সে নিশ্চয় নিচের দিকে তাকিয়ে ছোট ছোট ঘর বাড়িগুলো দেখে বলেছিল, নিচে যারা আছে তাদের প্রতিটি দিনই এক রকম। সেখানে কি এমন আছে?

এখন সমস্ত পাহাড় জয় করা হয়েছে। বিজ্ঞানীরা শূন্যে যাচ্ছেন। স্পেসে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।

কিন্তু তার চেয়েও অনেক আশ্চর্য ভ্রমণ অভিযান আছে আধ্যাত্মিক ভ্রমণে যার একটার প্রস্তাব আমাকে দেওয়া হয়েছিল।

এটা একটা আশীর্বাদ আমার জন্য। পাদ্রী সেটা বুঝতে পারে নি।

 যে লোকটা প্রথম পা দিয়েছিল পাহাড়ের চূড়ায় সেই সৌভাগ্যবান।

 একদিন সকলেই উপলব্ধি করতে পারবে যে পুরুষ আর নারীরা ফেরেস্তাদের কথা রপ্ত করতে পেরেছে, আর এ সব কিছুই হলো পবিত্র ক্ষমতার উপহার যার মাধ্যমে আমরা অলৌকিকতা ঘটাতে পারি, সুস্থ করতে পারি মানুষকে, ভবিষ্যত্বাণী দিতে পারি আর বুঝতে পারি সকলকে।

*

সমস্ত দুপুর আমরা বাল্যকালের স্মৃতি ভাবতে ভাবতে গভীর খাদের পাশ দিয়ে হেঁটে বেড়ালাম। এই রকমটা সে প্রথম করছিল। কারণ এভাবে সে আগে কখনো আসেনি।

 বিলাবোতে ভ্রমণের সময় সোরিয়ার বিষয়ে আমার বন্ধুর তেমন আগ্রহ ছিল না।

কিন্তু এখন সে সোরিয়ার প্রতিটি বিষয়ে জানতে আগ্রহি। সে আমাকে আমাদের পুরাতন বন্ধুদের কথা জিজ্ঞেস করছিল। তারা কেমন আছে, সুখী কিনা, কি করছে তারা, কীভাবে জীবনযাপন করছে এই সব।

অবশেষে আমরা পিদরা নদীর সবচেয়ে বড় ঝর্ণাটার কাছে চলে আসলাম। যেখানে ছোট-বড় বিচ্ছিন্ন অনেকগুলো ঝর্ণা এসে মিলিত হয়ে প্রায় একশ ফুট উপর থেকে পাথরের উপর আছরে পড়ছে।

আমরা ঝর্ণার একদম পাদদেশে দাঁড়িয়ে এর হুংকার ধ্বনি শুনলাম। আর ঝর্ণার পানির কুয়াশা থেকে যে রঙধনু তৈরি হচ্ছিল সেটা দেখলাম।

 ‘ঐ দেখো ঘোড়ার লেজ। আমি অবাক হয়ে নামটা মনে রাখলাম। কারণ অনেক কাল আগে এই নামটা আমার স্মৃতিতে ছিল।

‘আমার মনে আছে,..’। সে বলল।

‘হ্যা! আমি জানি এখন তুমি কি বলতে যাচ্ছ।’

অবশ্যই আমি জানি। ঝর্ণার আড়ালে বিশাল একটা গুহা লুকিয়ে আছে। আমরা দুইজন যখন ছোট ছিলাম তখন আশ্রম থেকে ঘুরে এসে এই জায়গাটার বিষয়ে কথা বলতাম।’

‘গভীর গুহা। সে বলল। চলো আমরা সেখানে যাই।

পানির স্রোত পেরিয়ে সেখানে যাওয়াটা ছিল অসম্ভব। কিন্তু আশ্রমের প্রাচীন সদস্যরা একটা সরু পথ তৈরি করেছিল যেটা ঝর্ণার উপর থেকে শুরু হয়ে মাটির ভেতর দিয়ে ঐ গুহাটার কাছে গিয়ে পৌঁছেছে।

ফলে প্রবেশপথটা খুঁজে বেড় করা তেমন কঠিন কিছু না। গ্রীষ্মকালে টানেলে কিছু আলো থাকে কিন্তু এখন একদম অন্ধকার।

 ‘এটাই কি সঠিক পথ? আমি জিজ্ঞেস করলাম।

 ‘হ্যাঁ। বিশ্বাস করো আমাকে।

.

আমরা ঝর্ণার পাশ দিয়ে নিচে নামতে থাকলাম।

আমরা যখন পরিপূর্ণ অন্ধকারের ভেতর তখনো আমরা জানতাম কোথায় যাচ্ছি আমরা। আমার বন্ধু বারবার আমাকে বলছিল যেন তাকে বিশ্বাস করি।

 আমরা সরু পথ দিয়ে মাটির গভীরে যাচ্ছি আর খোদাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। কারণ আমি ছিলাম পথহারা এক মেষ, আর তুমি আমাকে পথ দেখিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছ।

কারণ আমার জীবনটা মৃত ছিল আর তুমি সেটাকে বাঁচিয়ে দিয়েছ।

কারণ ভালোবাসাটা আমার অন্তরে মৃত ছিল আর প্রভু তুমিই সেটাকে জীবিত করে উপহার হিসেবে আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছ।

আমি তার কাঁধে মাথা রেখে হাঁটছিলাম। আমার প্রিয়তম অন্ধকারের মধ্যে আমাকে পথ দেখিয়ে চলছে, সে জানে যে আমরা আবারো পথের আলো খুঁজে পাব। এই আলো আমাদেরকে শুধুই আনন্দ দিবে।

খুব আস্তে আস্তে আমরা হাঁটছিলাম। মনে হচ্ছিল আমাদের এই নিচে নামা কখনোই থামবে না।

 টানেল দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমার মনে পড়ছিল কতবার আমি মাটি খুড়ে। সেখানে শেকড় পুঁতে কিছু জন্মাবার চেষ্টা করে সময় নষ্ট করেছিলাম। কারণ। সেই মাটি থেকে কোন কিছুই উৎপন্ন হওয়ার সম্ভাবনা ছিল না।

কিন্তু ঈশ্বর অনেক মহান, তিনি আমার হারিয়ে যাওয়া উদ্যম ফিরিয়ে দিয়েছেন, আমি যে অভিযানের স্বপ্ন এতকাল দেখেছি তিনি আমাকে তার পথ দেখিয়ে দিয়েছেন।

ঈশ্বর আপনাকে ধন্যবাদ। আমাকে আপনি সাহায্য করেছেন। আপনি আমাকে শক্তি দেন যাতে করে আমি তার লক্ষ্যে পৌঁছার যাত্রায় অংশ নিতে পারি। তার সাথে যেন এই পৃথিবীতে হাঁটতে পারি, আর আমার আধ্যাত্মিক অলৌকিক জীবনটাকে আরো নতুন আর শক্তিশালী করতে পারি। আমাদের সমস্ত দিনগুলো সে এক জায়গা থেকে যেভাবে অন্য জায়গায় ঘুরে বেড়াচ্ছে, মানুষকে সুস্থ করে তুলছে, যারা দুঃখে আছে তাদেরকে প্রশান্তি দিচ্ছে, শান্তির বাণী ছড়াচ্ছে ঈশ্বর যেন এই সময়গুলো এভাবেই কাটিয়ে দেওয়ার সুযোগ দেয়।

*

হঠাৎ করেই আমরা আবারো পানি প্রবাহের শব্দ শুনতে পেলাম।

আলোর বন্যা আমাদের রাস্তাকে ভাসিয়ে দিল। অন্ধকার গুহাটা যেন পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্যে পাল্টে গেল। আমরা এখন বিশাল এক গুহার ভেতর। গুহার তিনদিক পাথরের দেয়াল। আর সমুখটা ঘোড়ার লেজের মতো। সেখান থেকে পানির ধারা নিচে পড়ছে।

অস্ত যাওয়া সূর্যের আলো ঝর্ণার পানি ভেদ করে গুহার ভেতরের শেওলা পরা পাথুরে দেয়ালে ঝিকমিক করে উঠছিল।

আমরা পাথুরে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়ালাম। কিছুই বললাম না।

আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন এই গুহাটা ছিল একটা ডাকাত, আমাদের কল্পনার সমস্ত সম্পদ এখানে জমা করা থাকত। এখন এটা মা মরিয়মের অলৌকিকতা। আমি জানতাম তিনি এখানেই আছেন। আমি যেন তার উষ্ণ গর্ভে শুয়ে আছি।

এই পাথুরে দেয়াল দিয়ে তিনি আমাদেরকে রক্ষা করছেন। তার পবিত্র পানি দিয়ে আমাদের পাপগুলো ধুয়ে দিচ্ছেন।

অনেক ধন্যবাদ তোমাকে। আমি চিৎকার করে বললাম।

 ‘তুমি কাকে ধন্যবাদ দিচ্ছ। সে জিজ্ঞেস করল।

 ‘তাকে। তোমাকেও, কারণ আমার বিশ্বাস ফিরিয়ে দেওয়ার উসিলা হলে তুমি।

সে হেঁটে হেঁটে পানির কিনারে চলে গেল।

 হাসতে হাসতে বলল, এখানে আসো।

আমি তার কাছে গেলাম।

‘আমি তোমাকে এখন এমন একটা বিষয় বলব যেটা তুমি আগে কখনো শোনো নি। সে বলল।

 তার কথা শুনে আমি একটু চিন্তিত হয়ে পড়লাম। তবে তার সুখি আর শান্ত চেহারাটা দেখে আমি আস্বস্ত হলাম।

 ‘এই পৃথিবীতে সব লোকের জন্যই একটি করে উপহার আছে। কিছু উপহার নিজেই নিজেকে প্রকাশ করে, বাকিদেরকে সেটা আবিষ্কার করতে হয়। আমি যখন সেমিনারিতে ছিলাম তখন থেকে চারবছর ধরে আমার উপহারটা নিয়ে আমি কাজ করছি। সেটাকে আবিষ্কার করার চেষ্টা করছি।’

.

তার কথা আমি শুনছিলাম আর ভাবছিলাম আমাকে এখন একটা ভূমিকা পালন করতে হবে। গির্জার সেই বুড়ো পাদ্রী আমাকে যা শিখিয়েছিল সেটা অনুসরণ করে। আমি যেন কিছুই জানি না সেরকম ভান করলাম। এটা করলে তেমন কোন অন্যায় হবে না। আমি নিজের মনেই বললাম।

 ‘তুমি সেমিনারিতে কী করতে?’ আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম। আমার অভিনয়টাকে আরো ভালো করার জন্য আমি এমনটা করলাম।

 তাতে কিছুই যায় আসে না। সে বলল। আসল কথা হলো আমার উপহারটাকে আমি যত্ন করেছিলাম। আমি রোগমুক্তি করতে পারতাম যেভাবে ঈশ্বর চাইতেন।

 ‘তাহলে সেটাতো দারুণ একটা ব্যাপার। আমি অবাক হওয়ার ভান করে আবারো বললাম। আমাদেরকে আর টাকা খরচ করে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে না।’

 সে হাসল না। আমার নিজেকে তখন বোকা মনে হলো।

 ‘আমার উপহারটাকে অলৌকিক ক্ষমতা দিয়ে আমি আরো উন্নত করলাম। প্রথম প্রথম আমি খুবই অবাক হতাম। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতাম যেন পবিত্র ক্ষমতা উপস্থিত হয়, তারপর আমার হাতটা ছড়িয়ে দিতাম অসুস্থদের উপর, আমি অনেক অসুস্থ লোককে সুস্থ করেছি, তাদেরকে সুস্বাস্থ ফিরিয়ে দিয়েছি। আমার সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়লে অসংখ্য লোক এসে সেমিনারিতে ভীড় করা শুরু করল। তাদেরকে সুস্থ করার জন্য আবেদন করত।

 ‘তোমার জন্য আমার খুব অহংকার। আমি বললাম।

‘আশ্রমের অনেকেই আমার বিরোধিতা করেছিল, কিন্তু আশ্রমপ্রধান আমাকে পুরো সমর্থন দিয়েছিলেন।

 ‘এই কাজটা আমরা চালিয়ে যাব। দুজনে একসাথেই আমরা পৃথিবীর পথে বের হয়ে যাব, আহত ব্যক্তিদের ক্ষত পরিষ্কার করব, তুমি তাদেরকে আশীর্বাদ করবে, ঈশ্বর তার অলৌকিকতা ছড়িয়ে দিবেন।

আমার থেকে মুখ ঘুড়িয়ে অনেক দূরে হ্রদের ওপারে সে তাকাল।

আমরা সেইন্ট সেভিনে কুয়োর পাশে বসে মদ খাওয়ার সময় যেরকম একটা দৃশ্যের তৈরি হয়েছিল এখানেও সেরকম হলো।

 ‘আমি এর মধ্যেই তোমাকে সেটা বলেছি। আবারো বলব। একরাতে আমি ঘুম থেকে জেগে উঠলাম, আমার ঘর পূর্ণ আলোকিত ছিল, আমি মহান মা মরিয়মের চেহারা আমার ঘরে দেখতে পেলাম তিনি আমার দিকে কোমল ভালোবাসার চোখে চেয়ে আছেন। এর পর থেকে প্রায় সময়ই তিনি আমার ঘরে উপস্থিত হতেন। আমি এটা ঘটাতে পারতাম না। এমনিতেই ঘটত। তিনি মাঝে মাঝে হাজির হতেন। প্রথম দেখাতেই আমার কাজের বিষয়ে আমি সচেতন ছিলাম। আমি জানতাম এই পৃথিবীতে আমার একটাই লক্ষ্য মানুষকে শুশ্রষা করে যাওয়া।

আমি এক দৃষ্টিতে আমার বন্ধুর কথা শুনছিলাম। তার চোখমুখ হঠাৎ করে যেমন খুব চিন্তাগ্রস্থ আর ভারি হয়ে উঠেছিল একই ভাবে সেটা আবার শান্ত হয়ে উঠল।

 ‘আমি যেটা করতে চাচ্ছিলাম সেটার জন্য অনেক মূল্য দিতে হবে, আমি জানতাম।

আমার বন্ধু থামল। কীভাবে আরো সামনে তার কথাকে চালিয়ে নেওয়া যায় এটা হয়ত সে ভাবছিল।

‘তুমি যখন বলছিলে যে তোমার ইচ্ছে, সেটা বলে তুমি আসলে কি বোঝাতে চেয়েছিলে?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।

‘ঈশ্বর দেবতাদের পথ যেটা কেবল মন্ত্র আর অলৌকিকতা দিয়েই খোলা সম্ভব। কিন্তু এই পৃথিবীতে আর এভাবে কাজ করে না। এটা করা খুব কঠিন। চোখের অনেক পানি ঝরাতে হয় এই জন্য।

 ‘পথটা আসলে কষ্টের না, পথটা হলো মহান সেবার। আমি উত্তরে বললাম।

‘অধিকাংশ মানুষই ভালোবাসায় বিশ্বাস করতে পারে না।

আমি বুঝতে পারছিলাম সে আমাকে কিছু বলতে চায় কিন্তু বলতে পারছে না। আমি তাকে সাহায্য করতে চাইলাম যাতে করে সে কথাগুলো গুছিয়ে বলতে পারে।

 ‘আমিও এই নিয়ে দীর্ঘদিন চিন্তা করেছি। যে লোকটা প্রথমে পাহাড়ের চূড়ায় উঠেছিল সে নিশ্চয় ভেবেছিল এই রকমের অভিযানের অভিজ্ঞতা ছাড়া জীবনটা হলো আশীর্বাদ শূন্য।

তুমি আশীর্বাদ শূন্য বলতে কি বোঝাতে চাচ্ছ? সে আমাকে জিজ্ঞেস করল।

 আমি লক্ষ্য করলাম, তার চোখ মুখ আবারো শক্ত হয়ে যাচ্ছে।

 ‘মহান মা মরিয়মের অনেকগুলো নামের একটি নাম হলো আশীর্বাদ। তাঁর আশীর্বাদ সব সময় সেই লোকদের উপর যারা সেটাকে গ্রহণ করতে পারে। আমরা কিছুতেই আরেকজনের জীবন দিয়ে বিচার করতে পারব না। কারণ প্রতিটি লোকেরই তাদের নিজস্ব স্বতন্ত্র দুঃখ কষ্ট রয়েছে তারা সেগুলো নিজেদের মতো করে নিরাময় করে। আশীর্বাদ কিংবা উপহার হলো এক ধরনের অনুগ্রহ করা। এটা এমন এক ধরনের অনুগ্রহ যার মাধ্যমে কীভাবে সতোর আর সাধু জীবন যাপন করা যায় সেটা শেখা যায়।

আমি কিছুই বললাম না।

 সে আমার হাতটা ধরে বলল, আমার অসহিষ্ণুতার জন্য ক্ষমা করো আমাকে।

 আমি তার হাতে চুমু খেয়ে আমার গালে স্পর্শ করলাম।

 ‘আমি আসলে এটাই তোমাকে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছিলাম। সে আবারো হেসে বলল। যখন আমি তোমাকে আবার খুঁজে পেলাম তখন থেকে উপলব্ধি করতে পারছিলাম যে আমার লক্ষ্যে পৌঁছাতে আমি কিছুতেই তোমাকে কষ্ট দিতে পারব না।

.

আবারো আমি চিন্তিত হয়ে পড়লাম।

 ‘গতকাল আমি তোমাকে মিথ্যে বলেছিলাম। এটাই আমার প্রথম ও শেষ মিথ্যে কথা যা আমি তোমাকে বলেছি।’ সে বলতে থাকল। সত্য কথা হলো আশ্রমে যাওয়ার পরিবর্তে আমি সেই পাহাড়ে গিয়েছিলাম, সেখানে মেরি মাতার সাথে কথা বলেছিলাম। আমি তাকে বলেছিলাম তিনি যদি চান তাহলে আমি তোমাকে ত্যাগ করে আবার আমার পথে নেমে যাব। আশ্রমের সেই জায়গায় চলে যাব যেখানে অসুস্থ লোকেরা সুস্থ হওয়ার জন্য ভিড় করত, তাদের কাছে চলে যাব যারা বুঝতে পারে না বলে বিশ্বাসের ধারণাটাকে অস্বীকার করে। তিনি যদি চাইতেন তাহলে আমার পৃথিবীর সবচেয়ে দামী জিনিসটাকে আমি ত্যাগ করতাম; সেটা হলে তুমি।

.

আমি আবারো সেই পাদ্রীর কথাগুলো চিন্তা করতে থাকলাম। সে ঠিক আছে। সেই সকালেই একটা পছন্দ নির্বাচিত করা হয়েছিল।

 ‘কিন্তু। সে আবারো বলতে শুরু করল। আমার জীবনের এই কঠিন অবস্থাটা যদি আমি পাল্টে দিতে পারতাম তাহলে তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা দিয়েই সারা পৃথিবীকে সেবা করার প্রতিজ্ঞা করতাম।

 ‘তুমি এই সব কি বলছ?’ আমি উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।

মনে হলো সে আমার কথা শুনতে পাচ্ছে না।

কারো বিশ্বাসকে প্রমাণিত করার জন্য পাহাড়ে চরে বেড়ানোর কোন প্রয়োজন নেই। সে বলল। আমি একাই প্রস্তুত সব ধরনের বিপদ আর কষ্টের মুখোমুখি হওয়ার। এটা কারো সাথে ভাগাভাগি করতে চাই না। আমি যেই পথে আছি সেই পথই যদি ধারাবাহিকভাবে চালিয়ে যাই তাহলে আমাদের স্বাভাবিক সংসার আর হবে না। আমাদের ঘরের জানালায় সাদা পর্দা ঝুলবে, সেখান দিয়ে দূরের পাহাড় দেখা যাবে। এমনটা হবে না।’

তার কথা শুনে আমার ভয় ধরে গেল। আমি চিৎকার না করে বলার চেষ্টা করলাম যে,ঐ ধরনের ঘরের আমার কোন দরকার নেই। আমি সেখানে যেতেও চাই না। আমি শুধু তোমার সাথে যেতে চাই। তোমার সংগ্রামের আমিও অংশিদারী হতে চাই। আমি তাদের একজন হতে চাই যারা এই পৃথিবীতে এমন কিছু করেছে যেটা প্রথম। তুমি কি বুঝতে পারলে? তুমি আমার বিশ্বাস ফিরিয়ে দিয়েছ।

অস্ত যাওয়ার সূর্যের শেষ রশ্মিটুকু পাহাড়ের গুহাকে চিত্রিত করে তুলল। কিন্তু আমি এখন সেখানে কোন সৌন্দর্য খুঁজে পেলাম না।

ঈশ্বর নরকের আগুনকে স্বর্গের পাশেই লুকিয়ে রেখেছেন।

‘তুমি হলে তাদের একজন যারা কখনোই বুঝতে পারে না। সে বলল।

 ‘তুমি ঝুঁকিটাকে কিছুতেই দেখতে পাচ্ছ না।’

 ‘আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’

তার কথায় আমি বাধা দিতে চাইলাম। সে আমার কথায় কান দিল না।

 ‘তাই গতকাল আমি কুমারী মাতার কাছে প্রার্থনা করলাম তিনি যেন আমাকে দেয়া উপহারটা ফিরিয়ে নেন। সে বলল।

আমি এই সব কি শুনছি। কিছুতেই আমি নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলাম না।

 ‘আমার কিছু টাকা আছে। আর আছে সারা পৃথিবী ঘুড়ে বেড়ানোর অভিজ্ঞতা। আমরা একটা বাড়ি কিনব, একটা চাকুরি নিব, তারপর সেইন্ট যোসেফ যেভাবে ঈশ্বরের সেবা করেছিলেন আমিও সেভাবে তার সেবা করব। বিশ্বাসকে ধরে রাখার জন্য আমার অলৌকিকতার আর প্রয়োজন নেই। আমার দরকার তুমি।

তার কথা শুনে আমার পা কাঁপছিল। মনে হলো আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলব।

‘আমি যখনই কুমারী মাতার কাছে আমার উপহার ফিরিয়ে নেয়ার প্রার্থনা করলাম তখনই আমি শুনতে পেলাম একটা গলার স্বর আমাকে বলছে তোমার হাত মাটির উপরে রাখ। তোমার উপহার তোমার কাছ থেকে কুমারী মাতা মরিয়মের বুকে ফিরে যাবে।

‘তুমি নিশ্চই সেটা করো নি? আমি জিজ্ঞেস করলাম।

 ‘হ্যাঁ আমি সেটাই করেছি। আমাকে আধ্যাত্মিক স্বর যা বলল আমি তাই করলাম। তখন কুয়াশা কেটে গেল, পাহাড়ের উপর সূর্যের আলো ঝকমকিয়ে উঠল। আমি অনুভব করলাম মহান কুমারী মাতা আমাকে বুঝতে পেরেছেন। পিলার আমার উপহার এখন চলে গেছে অন্য কারো কাছে যার কাছে উপহারটা কখনোই নষ্ট হবে না। গতকাল আমি মদের দোকান থেকে বার্সেলোনায় ফোন করে আমার বক্তৃতার অনুষ্ঠান বাতিল করেছিলাম। চলো আমরা জারাগোজায় ফিরে যাই। তুমি সেখানকার লোকদেরকে ভালো করে চেনোনা। নতুন করে শুরু করার জন্য এটাই ভালো জায়গা। আমি খুব সহজেই একটা কাজ পেয়ে যাব।

আমি বেশিক্ষণ কিছুই ভাবতে পারছিলাম না।

পিলার!’ সে বলল।

তাহলে কি আমি সেই লোকটিকে ছাড়াই পাহাড়ে চরা শেষ করে এই অন্ধকার গুহাটা পার হয়ে আসলাম যে লোকটার স্পর্শে মৃতপথ যাত্রী সুস্থ হয়ে উঠত, তার সেই অলৌকিকতা কি আর দেখা যাবে না, সেই হাসি কি পৃথিবীকে আর খুশি করবে না। আর পাহাড় সেটা যেখানে আছে সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে?

.

আমার চারপাশে অন্ধকার ছাড়া আমি আর কিছুই দেখতে পেলাম না।

*

শুক্রবার, ডিসেম্বর ১০, ১৯৯৩

পিদরা নদীর তীরে বসে আমি কাঁদতে থাকলাম। সেই রাতের স্মৃতি আমাকে সংশয়ের মধ্যে ফেলে দিল।

আমি জানি আমি এর মধ্যেই মারা গেছি। আমি কিছুতেই তার চেহারা মনে করতে পারলাম না।

আমি সব কিছুই মনে করতে পারছিলাম কিন্তু সেগুলো মন থেকে কিছুতেই বের করে দিতে পারছিলাম না। আমি যেই মুহূর্তে পাহাড়ি সেই গুহার অন্ধকার থেকে বের হয় বাইরের জগতের অন্ধকারে চলে আসলাম তখন থেকে মনে হচ্ছিল আমি স্বপ্ন দেখছি।

আকাশে একটা নক্ষত্রও ছিল না। আমার মনে পরে দুলে দুলে আমি গাড়ির কাছে গিয়ে আমার ব্যাগটা তুলে নিলাম, তারপর আবারো দিকবিদিক হারিয়ে হাঁটতে থাকলাম। আমি সম্ভবত রাস্তার দিকেই হেঁটেছিলাম।

 জারাগোজায় যাওয়ার কোনো গাড়ি খুঁজেছিলাম। কিন্তু সফল হলাম না। আমি আবারো আশ্রমের বাগানের কাছে ফিরে এলাম।

 চারপাশেই ঝর্ণা থেকে পানি ঝরার শব্দ। আমার মনে হচ্ছিল আমি যেখানেই হেঁটে যাচ্ছি মহান মা মরিয়ম আমার উপর নজর রাখছেন। আমি জানি তিনি পৃথিবীকে ভালোবাসেন। যেভাবে ঈশ্বর ভালোবাসেন এই পৃথিবীকে।

কিন্তু তিনি কি একজন পুরুষের প্রতি একজন মেয়ে মানুষের ভালোবাসাকে বুঝতে পারেন?

তিনিও ভালোবাসার জন্য অনেক কষ্ট স্বীকার করেছেন, তবে সেটা ছিল অন্যরকম এক ভালোবাসা।

তার সন্তান তাকে ছেড়ে গেছে। সন্তানেরা সব সময় বাবা মাকে ছেড়ে চলে যায়। আপনি যদি কোনো ব্যক্তিকে, কিংবা পৃথিবীকে অথবা আপনার সন্ত নিকে ভালোবাসেন তাহলে খুব সহজেই কষ্ট পাবেন। এই ধরনের কষ্ট পাওয়া হলো জীবনেরই একটা অংশ। কিংবা কোনো লক্ষ্য অর্জনের জন্য ব্যার্থ হয়ে তার জন্য কষ্ট পাওয়াটাও স্বাভাবিক।

 কিন্তু একজন পুরুষ মানুষের জন্য দুঃখ পাওয়ার বিষয়টাকে কীভাবে ব্যাখ্যা

করা যায়? এটাতো ব্যাখ্যা করার মত কোন বিষয় না।

এ ধরনের দুঃখের ভেতর দিয়ে যে কেউ উপলব্ধি করবে যে সে নরকে আছে। কারণ সেখানে কোন আরাম নেই, কোন ভাল কিছু নেই, কেবলই দুঃখ।

.

সেই রাতে আমি বরফ ঠাণ্ডা মেঝেতে ঘুমালাম। ঠাণ্ডায় আমার সব কিছু জমে বরফ হয়ে গিয়েছিল। আমার মনে হচ্ছিল যদি আমি একটা গরম চাদর না পাই তাহলে মরেই যাব। কিন্তু আমি কোথায় সেটা পাই?

আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো গত এক সপ্তাহে দেওয়া হয়েছিল আর সেটা এক মিনিটেই আমাকে কোনো কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই কেড়ে নেওয়া হলো।

শীতে আমার শরীর বার বার কেঁপে উঠছিল। মাঝে মাঝে সেই কাঁপুনিটা থেমে যাচ্ছিল। শরীর উষ্ণ রাখতে গিয়ে আমার সমস্ত শক্তি নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছে মৃত্যুর বাহুতে আমি এলিয়ে পড়ছি।

আরো একটা ঘণ্টা আমি শীতে কাঁপলাম। তারপর শান্তি নেমে আসল।

আমার চোখ বন্ধ করার আগেই শুনতে পেলাম মায়ের কণ্ঠস্বর।

 আমাকে একটা গল্প বলছেন। যে গল্পটা আমি যখন ছোট ছিলাম মা প্রায়ই আমাকে বলত।

গল্পটা যে আমারই সেটা আমি তখনো বুঝতে পারি নি।

মা বলছেন, ‘একটা ছেলে আর একটা মেয়ে একে অপরকে ভালোবাসত। তারা বিয়ের সিদ্ধান্ত নিল। ছেলেটা এতই গরিব ছিল যে তার কাছে মূল্যবান কিছুই ছিল না। কেবলমাত্র একটা দামি ঘড়ি যেটা সে তার দাদার কাছ থেকে উত্তরাধিকারি সূত্রে পেয়েছিল। সে তার প্রেমিকার চুলের কথা চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিল ঘড়িটা বিক্রি করে তার প্রেমিকার জন্য একটা সুন্দর সিলভারের চিরুনি কিনে আনবে।

মেয়েটারও তেমন টাকা পয়সা ছিল না যে সে তার ছেলে বন্ধুটিকে ভালো কিছু উপহার কিনে দিবে। মেয়েটা তখন সবচেয়ে সমৃদ্ধ ব্যবসায়ির দোকানে গিয়ে তার লম্বা সুন্দর চুলগুলো বিক্রি করে সেই টাকা দিয়ে তার ছেলে বন্ধুর জন্য একটা সোনার ঘড়ির চেইন কিনে আনল। যাতে করে তার বন্ধুটি ঘড়িটা ভালোভাবে হাতে পরতে পারে।

যখন তারা বিয়ের অনুষ্ঠানে একে অপরে মিলিত হলো মেয়েটা তার চুল বিক্রি করা টাকা দিয়ে ছেলেটাকে ঘড়ির চেইন উপহার দিল যেই ঘড়িটা এর মধ্যেই বিক্রি হয়ে গেছে আর ছেলেটা তার ঘড়ি বিক্রি করে মেয়েটাকে চুল আচরানোর জন্য সুন্দর একটা চিরুনি উপহার দিল। মেয়েটার চুলগুলোও এর মধ্যে কেটে ফেলে বিক্রি করা হয়েছে।

*

কারো কারো ধাক্কাধাক্কিতে আমি জেগে উঠলাম।

 ‘এটা পান করো।’ সে বলল। এটা দ্রুত পান করো।’

আমি কি করব কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। সেই লোকটা জোর করে আমার মুখটা খুলে গরম পানীয়টুকু আমার মুখে ঢেলে দিল। আমি লক্ষ্য করলাম সে তার জামা দিয়ে আমাকে ঢেকে দিচ্ছে।

 ‘আরো পান করো। সে জোর করতে থাকল।

আমি কিছু না বুঝেই যা বলছে তা করতে থাকলাম। তারপর আবারো চোখ বন্ধ করে ফেললাম।

.

আমি আশ্রমে জেগে উঠলাম। দেখলাম একজন মহিলা আমার সেবা শুশ্রূষা করছেন।

তুমিতো প্রায় মরেই গিয়েছিলে। মহিলা বলল। পাহাড়াদার যদি তোমাকে না দেখত তাহলে তোমাকে আর খুঁজে পাওয়া যেত না। তুমি এখানে আসতে না।

টালমাটাল হয়ে আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম। পেছনের দিনের কথা আমার মনে পড়তে থাকল।

কিন্তু এখনতো আমার মরার সময় না। আমাকে বেঁচে থাকতে হবে।

মহিলাটা আমাকে রান্না ঘরে নিয়ে কফি, বিস্কিটা আর রুটি তৈরি করে দিলেন। তিনি আমাকে কিছুই জিজ্ঞেস করলেন না। আমিও কিছু বললাম না।

আমার খাবার শেষ হলে তিনি আমার ব্যাগটা বুঝিয়ে দিলেন।

সব কিছু ঠিক আছে কিনা দেখে নাও।’ তিনি বললেন।

‘আমি নিশ্চিত ঠিক আছে। আমার হারানোর মতো কিছু নেই।’

 “মা তোমার অনেক লম্বা একটা জীবন আছে। সেটার যত্ন নাও।

 ‘এখানেই কাছের একটা শহরের গির্জা আছে। আমি কান্না আটকানোর চেষ্টা করে বললাম।

 ‘গতকাল এখানে আসার আগে আমার বন্ধুকে নিয়ে সেই গির্জায় গিয়েছিলাম।’

আমি পরিষ্কারভাবে বলতে পারছিলাম না।

..আমার বাল্যকালের বন্ধুকে নিয়ে আমি এখানের প্রায় সবগুলো গির্জায় ঘুরে বেড়িয়েছি। কিন্তু তখন গির্জার ঘণ্টা বাজছিল আর আমার বন্ধু বলল যে এটা হলো চলে যাওয়ার সময়। আমাদের চলে যাওয়া উচিত।

মহিলাটা আমার কফির কাপটা আবারো ভরে দিল। গল্প শোনার জন্য আমার পাশে বসল।

 ‘আমরা গির্জার ভেতর ঢুকলাম। সেখানে কেউ ছিল না। খুব অন্ধকার ছিল। আমি একটা কিছু নিদর্শন খুঁজছিলাম, কিন্তু সেখানে সেই পুরাতন বেদি, মূর্তি, আর পুরাতন সন্ন্যাসীদের ছাড়া কিছুই দেখতে পেলাম না।

 হঠাৎ করেই আমরা উপরে কিছু একটার শব্দ শুনতে পেলাম যেখানে বাদ্যযন্ত্রটা রাখা আছে সেখানে। দেখলাম একদল ছেলে তাদের গিটারের সুর ঠিক করছে। আমাদের যাত্রা শুরু করার আগে সিদ্ধান্ত নিলাম ছেলেগুলোর মিউজিক আমরা শুনব। এর মধ্যেই একজন লোক আসল। লোকটাকে খুব হাস্যজ্জোল আর সুখী সুখী দেখাচ্ছিল। সে বসেই বাচ্চাদেরকে একটা কড়া মিউজিক শোনানোর জন্য উৎসাহ দিল।

‘বুলফাইট মিউজিক? মহিলাটা বলল। আমি আশা করি তারা এটা বাজায়নি?

‘না ছেলেরা এটা বাজায়নি। ছেলেগুলো হেসে উঠে খুব সুন্দর শান্ত একটা সুর বাজালো। আমার বন্ধু আর আমি ভাবছিলাম হয়ত স্বর্গীয় আবাস আমাদের চারপাশে ঘিরে আছে। গির্জা,

গির্জার ভেতরের আবছায়া অন্ধকার, গিটারের সুর, একজন হাস্যজ্জোল মানুষ এই সব কিছুই যেন ছিল একটা যাদু।

আস্তে আস্তে গির্জাটা লোকে ভরে গেল। ছেলেরা তখনো সেই সুর বাজিয়ে চলছে। যারা আসছে তারা সবাই গিটারের সুরে প্রভাবিত হচ্ছিল।

আমার বন্ধু জিজ্ঞেস করল, এই ভীড়ে কি আমি আরো কিছুক্ষণ থাকতে চাই কিনা।

আমি বললাম না। কারণ আমাদেরকে অনেক দূরের পথ পাড়ি দিতে হবে। ফলে আমরা গির্জা থেকে বের হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। তবে গির্জা ত্যাগ করার আগে আমরা খোদাকে এত সুন্দর একটা মুহূর্ত দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ জানালাম।

আমরা যখন গাড়িতে উঠলাম তখন দেখলাম একটা শবযাত্রার দল এগিয়ে যাচ্ছে। কেউ একজন মারা গেছে। এই জন্যই জনতার এত ভীড় সেখানে। শবযাত্রার দলাটি গির্জার দরজায় যাওয়ার সাথে সাথে ছেলেরা তাদের গিটারের সুর বন্ধ করে অন্য একটি সুর বাজানো শুরু করল।

 গির্জায় আমাদের ডোকাটা ছিল সত্যিকার অর্থেই কোনো কিছুর নিদর্শন। সেই ইশারাটা হলো প্রতিটি গল্পেরই একটি বেদনাত্মক সমাপনী থাকে।

গল্পের এতটুকু আসার পর মহিলাটা আমাকে বলল, চলো বাইরে যাই।

 আমরা এক সাথে বাইরে গেলাম। সূর্য তখন উদিত হচ্ছিল।

 ‘লম্বা করে একটা শ্বাস নাও। মহিলাটা বলল। চলো আজকের এই সুন্দর সকালটাকে আমরা ফুসফুস দিয়ে ভেতরে নিয়ে আমাদের সমস্ত শরীরে শিরায় উপশিরায় চালিয়ে দেই। আমার কাছে মনে হচ্ছে তোমার হারিয়ে যাওয়া গতকালটা নিছক একটা দুর্ঘটনা ছিল না।

আমি কোন উত্তর দিলাম না।

‘তুমি আমাকে যে গল্পটা বলেছিলে সেই গল্পটাও তুমি বুঝতে পারে নি। তুমি কেবল শবযাত্রার দুঃখের অংশটুকুই লক্ষ্য করলে কিন্তু এর আড়ালে যে আনন্দময় মুহূর্তটা তুমি চার্চে কাটিয়েছ সেটার কথা ভুলে গেলে। যেই স্বর্গীয় মুহূর্ত আর দৃশ্যটুকু তোমার চারপাশকে ঘিরে রেখেছিল কিছু কাল আগে তুমি তার কথা ভুলে গেলে।

 মহিলা একটু থেমে মৃদু হাসি দিল।

‘শিশুকালের বন্ধু। কথাটা বলে মহিলাটা তার চোখ দুটোকে একটু পিটপিট করল। যীশু বলেছেন মৃতকে দ্রুত দাফন করো, কারণ সে জানে মৃত ছাড়া এখন আর তেমন কিছুই নেই। আমরা জন্ম নেওয়ার আগেই জীবন ছিল, আর আমরা এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার পর সেই জীবন আবারো চলতে থাকবে।

কান্নায় আমার চোখ ভেসে গেল।

 ‘ভালোবাসার সাথে এমনটাই হয়। মহিলা বলে যেতে থাকল। এরকমটা আগেও ছিল আর ভবিষ্যতেও চলতে থাকবে।’

 ‘আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে আপনি আমার জীবনের সব কিছুই জানেন। আমি বললাম।

সব ভালোবাসার গল্প একই রকম।

মহিলাটা আমাকে একটা কলম আর কাগজ এগিয়ে দিল।

‘তোমার সমস্ত অনুভূতি এখানে লিখ। তোমার আত্মার ভেতর থেকে এটা বের করে এনে কাগজে লিখ তারপর সেটাকে ছুঁড়ে ফেলে দাও। কিংবদন্তি আছে যে পিদরা নদীর পানি এত ঠাণ্ডা যে এখানে, গাছের পাতা, পাখির পালক, পোকা মাকর যাই পড়ে সব কিছুই পাথর হয়ে যায়। তোমার কষ্টগুলো পানিতে ছুঁড়ে মারার জন্য এটা খুব ভালো একটা আইডিয়া।

আমি পৃষ্ঠাটা নিলাম। মহিলা আমাকে চুমু খেল। আমি বললাম দুপুরের খাবারের সময় আমি ফিরে আসছি।

 ‘ভুলে যেও না।’ মহিলা যাওয়ার সময় চিৎকার করে বলল।

আমি মৃদু হাসলাম।

মহিলাটা হাত নেড়ে বিদায় জানালো।

.

আমি নদীর দিকে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম। কাঁদতে কাঁদতে আমার চোখের পানি শুকিয়ে গেল।

তারপর আমি লেখা শুরু করলাম।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন