জোচ্চোর – ৩

আশাপূর্ণা দেবী

আমি কিন্তু খুব অবাক হয়ে যাচ্ছি নেবুমাসি। রাত্রে খাটে পা ঝুলিয়ে বসে সুদত্তা বলল।

না, আর মাসিমা নয় যথাযথ নিয়মে দিদিমাও নয়, সেই নেবুমাসিতেই এসে পৌঁছে গেল এই ঘণ্টা কয়েকের মধ্যে। হয়তো সেটাই আশ্চর্যের কারণ।

এই পুরনো বাড়ির ঘরে ঘরেই কালো কালো পালিশ উঠে যাওয়া বড়ো বড়ো জোড়া খাট পাতা, তবে নেবুমাসির ঘরে স্বতন্ত্র ব্যবস্থা। একখানা সোরু চৌকিতে নেবুমাসির স্বল্প উপকরণ যুক্ত বিশুদ্ধ শয্যা।

সেই ঘরেরই ফাঁকা দেওয়ালের ধারে অন্য কোনো ঘর থেকে একটা সোরু খাট আনিয়ে পাতা হয়েছে, এবং ফর্সা চাদর বালিশ সম্বলিত বিছানা পাতা হয়েছে।

ঘরে ঢুকে চারিদিকে তাকিয়ে দেখল সুদত্তা—শূন্য শূন্য ঘরগুলোর দেয়ালেও বড়ো বড়ো এক একখানা আর্শি বসানো আছে, এ ঘরে তার কিছুই না। এ ঘরের আসবাবের মধ্যে একটা মাত্র আলনা, তাতে নেবুমাসির দু—একটা থান ও ধুতি ও সেমিজ লম্বমান।

নেবুমাসি বলেছিলেন, পাশেই আয়না—টেবিলওয়ালা সাজানো ঘর রয়েছে ভাই, কিন্তু এই বুড়ো বুড়ো জানলা দরজাওলা বৃহৎ পুরনো ঘরে একা তোর ভালো লাগবে না, ভয় লাগবে। তাই এই বুড়ির ঘরেই স্থাপনা করলাম তোকে।

তারপর দুষ্টু হাসি হেসে বলেছিলেন, তোরা যে আমার আশায় ছাই দিলি। নাতবৌ এলো বলে আহ্লাদে ভাসছি, তা নয় এখনো হবু। এখনকার যে সব কায়দা হয়েচে নেকাপড়া না শেষ করে বে করব না। ইদিকে নেকাপড়ারও শেষ হবার নাম নেই। মেয়ে পুরুষ সবাই বিদ্যের জাহাজ হবে এই পণ! তা যাক, এই বুড়ি বেঁচে থাকতে থাকতে শুভ কাজটা সেরে ফেলে একবার আসিস ভাই। সাধ মিটিয়ে—চুপ করে গেলেন।

সুদত্তা এই নিশ্চিত বিশ্বাসের দিকে তাকিয়ে বলতে পারেনি, তুমি যত সিওর নেবুমাসি আমরা নিজেরা এখনো ততো নই। এখনো আমরা নিজেদের মন বুঝতে পারছি না।

সুদত্তা তাই ও পথ এড়িয়ে গিয়ে বলেছিল, বেঁচে থাকতে থাকতে মানে? একশো বচ্ছরের আগে আপনাকে পৃথিবী থেকে নড়তে দিচ্ছে কে?

নেবুমাসি হাসলেন, তা অসম্ভবও নয়। বাল্যবিধবার পরমায়ু পাথর দিয়ে বাঁধানো থাকে টসকাতে জানে না। নইলে দ্যাক এই আশী বচর বয়সেও তোদের মতন যুবিদের থেকে তিন গুণো খাচ্ছি, তিন টপকায় সিঁড়ি ভাঙছি। তবে মরতেও তো পারি।

ঘর বিছানা দেখিয়ে দেবার সময় এ সব আলোচনা। এখন শুতে এসে সুদত্তা খাটে পা ঝুলিয়ে বসে বলল, আমার কিন্তু খুব অবাক লাগছে নেবুমাসি।

নেবুমাসি বললেন, কেন বল তো?

ভাবছি আপনারা তো পুরনো কালের লোক, পুরনো সংস্কার, এ ভাবে একটা ছেলে আর একটা মেয়েকে একসঙ্গে ঘুরতে দেখে রাগ করলেন না, বিরক্ত হলেন না, নিন্দে করলেন না বরং এত ভালোবাসছেন—

নেবুমাসি হেসে উঠে বললেন, যে কালে যে ধর্ম, আমরা পুরনোরা রাগ করলে আর নিন্দে করতে বসলেই কি কাল তার স্বধর্ম হারাবে? আমাদের আমলে সাহেব মেমরা কোটশিপ করত, এ আমলে তোরা করচিস। জিনিসটা আমাদের অজানা নাকি?

আমরা কিন্তু মোটেই এটা ভাবিনি নেবুমাসি। একসঙ্গে পড়ি, বেড়াই—টেড়াই এই পর্যন্ত।

নেবুমাসি ঈষৎ গভীর গলায় বলেন, ও কথা বলিসনে ভাই, ছেলেটার মুখ চোখ দেখতে পাসনে? তোর পানে তাকালেই বিভোর—

সর্বনাশ! নেবুমাসি এই সব দেখছেন আপনি? ধ্যেৎ! কক্ষনো না।

দেখব বলে কি আর দেখচি রে বাপু। চোকে পড়ে গেলে করব কি? যাকগে। একটা কতা ভাবছি সারাদিন—

কি ভাবচেন? কাল সকাল থেকে রাত অবদি কি কি খাওয়াবেন আপনার আদরের অতিথিদের?

নেবুমাসি হেসে ফেলে বললেন, তাও ভাবছি, তবে আরো একটা কতা ভাবছি, থাক কাল বলব।

প্রবালের আশ্রয় জুটেছিল সরোজমোহনের ঘরে। অনেক রাত পর্যন্ত তার উচ্চ হাসি আর উচ্চরবের সাড়া পাওয়া যাচ্ছিল, সুদত্তা ভাবছিল এই ভেঙে পড়া প্রাসাদের মধ্যে এই জীর্ণ বিবর্ণ সব আসবাব পত্রের আবেষ্টনে, দিনরাত্রির খাজনা জুগিয়ে চলা ছাড়া আর তো কোনো কাজ নেই বুড়ো ভদ্রলোকের—তবু এত প্রাণশক্তি আসে কোথা থেকে?

মহিলাটির কথা তবু আলাদা। তিনি তাঁর পিতৃকুলের কুলমর্যাদা, বংশমর্যাদা, আচার—আচরণ সবকিছুর দায়িত্ব বহন করে চলে আসছেন, তার মধ্যে কর্তৃত্ব গৌরব রয়েছে। রয়েছে সংসার করার সুখও।

হলেও সে সংসারের সদস্য সুখী, সুখীর মা, চিরকালের প্রজা ঘর, বিনা ভাড়ায় বাসিন্দা রিকশাওলা নন্দ, আর পুরনো সরকার মণি পালের নাতি বাচ্চু। সংসারের ঠাট তো আছে। বাড়িটাই সংসার।

তবে প্রকাণ্ড এক প্রশ্নচিহ্নের মতো বিরাজ করছেন ওই বৃদ্ধ।

অনেক রাত্রে শুনতে পেল সুদত্তা, নেবুমাসি গলা তুলে কাকে যেন বলছেন, আজ রাতে কী আর ঘুমুতে—টুমুতে হবে না? বলি ঘুমের কমতিতে ছেলেটার শরীর বিগড়ালে?

কত রাত এখন? প্রবাল এখনো জেগে ছিল?

হঠাৎ খুব একটা ব্যাকুল আবেগ অনুভব করল সুদত্তা। ইচ্ছে করলেই সুদত্তা স্বর্গলোকের একখানি টিকিট কিনে ফেলতে পারে।

ঘুম ভাঙল সুদত্তার রিকশাওলা নন্দর ডাক—হাঁকে।

দাদাবাবু গাঁ দেখতে বেরোবেন নাকি? গাড়ি মজুত আচে।

নেবুমাসি কখন উঠে গেছেন কে জানে। দেখল ওঁর বিছানাটি পরিপাটি করে ঝাড়া ঠিক করা। আস্তে বেরিয়ে এসে ভিতর দালানের জানালার ধারে দাঁড়াল সুদত্তা। দেখতে পেল উঠোনের ওপারে বারান্দায় প্রবালও সদ্য নিদ্রোত্থিত ভাবে দাঁড়িয়ে।

অপূর্ব একটা আনন্দরসে ভরে উঠল মন। নিজেকে হঠাৎ নববিবাহিতা বধূর মতোই মনে হল সুদত্তার। প্রবালের মুখে চোখেও বুঝি সেই একই অভিব্যক্তি। ইশারায় বলল, যাচ্ছি ওদিকে।

আর এই সময় নেবুমাসির চড়া গলার প্রশ্ন শোনা গেল—এই অতি সকালে গাঁ দেকাতে নিয়ে যেতে এসেছিস মুকপোড়া? একটু বোধ—গ্যান নেই? বলি বিচানা থেকে তুলে নিয়ে যাবি নাকি? অ্যা!…কাগে এখনো বাসা ছাড়েনি। এখনো এসেচ গাড়ি নিয়ে!

নন্দ সতেজে বলল, আমার কি দোষ? দাদু কাল বলে থুয়েছে ভোরে আসবি নন্দ। বেলা করে বেরোলে ফিরতে রোদ চড়া হয়ে যাবে।

অ তাই বল। আমিও তাই ভাবচি, নন্দ এমন সাতসকালে কাঁথা মাদুর ছেড়ে এয়েচে! যা, এখন যা, এক ঘণ্টা বাদ আসবি।

খোয়া খাপরা রাস্তা দিয়ে রিকশা চলার শব্দ শোনা গেল। এবং নন্দ বিদায় পর্ব সমাধা হতে না হতেই সরোজমোহনের বিরক্ত গলা শোনা গেল, দেওয়া হল তো বিদেয় করে? নাও দেখ এখন কোন বেলায় আসে। ওদের এক ঘণ্টা মানেই তিন ঘণ্টা।

সুদত্তা আর প্রবাল দুজনে দু’দিক থেকে ঝুঁকে একই দৃশ্য দেখতে পায়।

লাল টুকটুকে সিমেন্টের দাওয়া বোধ হয় সদ্য ধোওয়া হয়েছে, ঈষৎ দূরত্ব রেখে মুখোমুখি দুখানি আসন পেতে চা খেতে বসেছেন। সদ্যস্নাতা নেবুমাসির পরণে কেটে থান, গায়ে একটা মটকা চাদর।

নেবুমাসির সামনে একটি উঁচু পাথরের গেলাসে চা। ঢ্যাঙার সামনে অবশ্য কাঁচের গ্লাস। চায়ের আসল সরঞ্জাম নামেনি। তার মানে এটি ওদের বলতে গেলে বেড—টী।

আচ্ছা, মুখের ভাবে তো পরিতৃপ্তির কোনো অভাব নেই। তবে গলার স্বর এই সক্কালবেলাতেই এমন কড়া কেন? নেবুমাসিরই অধিক।

তবে আর কি, হাত মুখ ধোবে না, চা জল খাবার খাবে না, বিচানা থেকে উঠেই গাঁ দেখতে বেরোবে। কী একেবারে তাজমহল দেকবার দেশ!

তাহলে আর ঘটা করে দেখতে যাওয়াই বা কেন? সরোজমোহন প্রায় খিঁচিয়ে ওঠেন, ফেরার সময় রোদ চড়বে সেটাই বলা হয়েছে। গোঁসাইবাগানে যাবে, সিদ্ধেশ্বরীর মন্দিরে যাবে—

যাবে তাতে আর কী? তোর সব তাতেই উটোন সমুদ্দুর ঢ্যাঙা। আমি এই নিত্য দিন সিদ্ধেশ্বরীর মন্দিরে যাই, তোর বচরে এ্যাকদিন হয়ে ওঠে না। রিশকোয় যাবে আসবে—বলি ওটা হচ্চে যে?… গেলাশটা পাত। বাটিতে চা আচে আরো।

বাঁ হাতের কাছে একটা ঢাকা দেওয়া বাটিতে বোধ হয় বাড়তি চা মজুৎ। ঢ্যাঙা সেইদিকে দৃষ্টিপাত করে বলেন, ওই তো ওইটুকু, থাক ও থেকে আর তোর দাতব্য করতে হবে না, নিজের গলায় ঢাল।

রাগ বাড়াসনে ঢ্যাঙা। কেন? সবটুকু আমার গলায় ঢালতে হবে কেন? মরুভূমি হয়ে আচে বলেচি?

তবে দে বাবা দে! গেলাসটা পাতলেন সরোজমোহন।

নেবুমাসি আঁচলের কোণ দিয়ে বাঁ হাতে বাটিটা ধরে দুটো গেলাশেই একটু একটু ঢেলে নিলেন।

সরোজমোহন একটু কোমল হাসি হেসে বললেন, এই সকালের চাটুকুই চা! এ চায়ের সঙ্গে সুখীর মা’র হাতের চা। হুঁঃ!

চা সাঙ্গ করেই উঠে গলা তুললেন সরোজমোহন, ওহে প্রবালবাবু, উঠেছেন নাকি?

উঠে পড়ে নেবুমাসিও গলা তুললেন, হল ডাক—হাঁক শুরু? কাল তো মাজ রাত্তির অবদি বকবক করে ছেলেটাকে ঘুমুতে দাওনি—

তবে ঘুমোক। যা বরং নাতির গায়ে আঁচল চাপা দিয়ে বসগে যা। এই মেয়েছেলেগুলোই হচ্ছে দেশের সর্বনাশের মূল। মায়ায় মরে গিয়ে বেটাছেলেদের আর বেটাছেলে হতে দেয় না।

নেবুমাসির হি হি হাসি ধ্বনিত হলয়, ওঃ, কী আমার পণ্ডিতমশাই বুদ্দি চূড়োমণি এলেন গো! তো বলি, তোর জন্যে তো জম্মোজীবনে কেউ মায়ায় মরেনি ঢ্যাঙা, তুই কেন ইয়া বীরপুরুষ হয়ে যুদ্দে গেলি না। ঘরকুনো কুড়ের সর্দার।…নে, ওষুদটুকু খেয়ে নিয়ে যা ইচ্ছে করগে যা।

রোজ রোজ কিসের ওষুধ? খাব না, যাঃ।

মদু দিয়ে মেড়ে ফেলেচি ঢ্যাঙা, আজ খেয়ে নে। কাল থেকে খাসনে।

এ কথা তো রোজ বলিস।

কি করব? হাঁপানির টান উটলে আমারই তো দুদ্দশা! এই ব্যাধিটি যদি না থাকত, নেবু এই দৌলতপুরের মাটি আঁকড়ে পড়ে থাকত? চাটি—বাটি উঠিয়ে কাশীবাস করতাম গিয়ে।

সরোজমোহনের বিদ্রূপের গলা আকাশে ওঠে, থাম নেবু, আর বাকতাল্লা মারিস না। তুই নইলে আর কাশীবাসী হবে কে? বলে একটা তেল মাখার বাটি হারালে বাড়ি মাথায় করিস, এই বৃহৎ পুরী দু’বেলা ঝাড়ু না পড়লে রাজ্য রসাতলে যায় তোর, আবার বৈরিগী বুলি!…আমার ব্যাধি আমার আছে, তোর কি?

তা তো নিশ্চয়। নেবুমাসি গম্ভীরভাবে বলেন, কতাতেই আছে মামার শালা পিসের ভাই তার সঙ্গে সম্বন্ধ নাই। তা এ তো আবার পিসের ভাইপো। ওদের ছোটো কাল থেকে দেখচি বলেই এ্যাকটা বিবেক—বোদ।

ওরে বাপ! শুধু বৈরাগ্য নয়, আবার বিবেক। যাত্রা পালা একেবারে। আর এক গেলাশ চা গলায় ঢাল নেবু। নইলে মাথা পরিষ্কার হবে না। বলে হা হা করে হেসে ওঠেন সরোজমোহন।

গোঁসাইবাগানের পথে যেতে যেতে নন্দ বলে, আজন্মো এক ঠাঁই রইল তবু দুটো মনিষ্যি যেন সাপে নেউলে। দেখতেচেন দাদাবাবু?

দেখতেচি।

ব্রেদ্ধ হয়েচে, এখনো সেই ছোটোকালের ঝুটোপুটি ঝগড়ার অব্যেস গেল না। আমরা দেখি আর হাসি। অথচ এমনিতে দুটো মানুষই খুব ভালো। বাচ্চু বলে দুজনারই বোধ হয় কোঁদল লগ্নে জম্মো!

হাত চালাও নন্দদা। মানে পা চালাও। প্রবাল বলল, আগে যখন বাড়িতে আরো লোকজন ছিল। তখন এমন ছিল না বাবা। কে কোথায় থাকত। এখন ফাঁকা বাড়িতে চেঁচামেচির খুব সুবিধে হয়েছে।

সুদত্তা অদ্ভুত হেসে বলল, চেঁচামেচির সুবিধে নয়, চেঁচামেচিটাই সুবিধে।

তা চেঁচামেচিও থাকল, হাসি গল্পও থাকল পুরো দমে। খাওয়া দাওয়ারও মহোৎসব চলল। যাওয়ার আগের দুপুরে নেবুমাসি সেই কাল বলব বলে তুলে রাখা কথাটি ব্যক্ত করেন।

কবে আছেন কবে নেই তিনি বলা তো যায় না। তাই প্রবালের ভাবী বৌয়ের আশীর্বাদ পর্বটা সেরে রাখবেন তিনি। অতএব—

হ্যাঁ সেই অতএবটাই আসল। শরদিন্দুনিভাননীর বাবার দেওয়ালে পোঁতা চোরাসিন্ধুক থেকে তাঁর গহনার বাক্সটি বার করে দিতে হবে।

আমার সেই গিণির মালাটা আমি মনে মনে পলার বো’র জন্যে তুলে রেকেচি। নেবুমাসী বললেন।

গিণির মালা, প্রবাল লাফিয়ে ওঠে। ক্ষেপেছ না পাগল হয়ে গেছ? নাকি আমাকে পুলিশের হাতে তুলে দিতে চাইছ নেবুমাসি? আজকালকার দিনে গিণির মালা! ঢ্যাঙা দাদু, তুমি আমায় এ বিপদ থেকে উদ্ধার করো।

নেবুমাসি সতেজে বলেন, আমার জিনিস, আমি যদি স্বেচ্ছায় কাউকে উপকার দিই, তাতে থানা পুলিশের কথা আসে কেন রে?

কেউ বিশ্বাস করবে না নেবুমাসি! গিণির মালা! এক একখানা গিণির এখন কত দাম জানো?

জানিনে। জানতে চাইওনে। আমি তো কিনতে যাচ্চিনে। বাবা দিয়েছিল, ও তো আমার স্ত্রীধন। যাকে ইচ্ছে দেব। দিইনি কী? কতজনাকে কত দিয়েচি আগে আগে। গহনা তো কম ছিল না। বুঝলি খুকু, ওজন করে দু’সের সোনা দিয়েছিল বাবা—

দু’সের! সুদত্তা হেসে উঠে বলল, সোনার সের!

তোদের একালে ভাতের চাল ভরি দরে বিকোয় আমাদের সেকালে অবস্তাপন্নের ঘরে সোনার হিসেব ওই রকমেই হতো বাছা। মাতা থেকে পা অবদি সোনায় মোড়া বৌ গিয়ে দুধে আলতার পাতরে গিয়ে দাঁড়াল। … আর তো যাইনি, সকল সোনা বাবার ওই চোরা সিন্দুকের মধ্যে। তো একে একে বিলিয়েচি অনেক। যতজনের বে হয়েচে, একেকখানা করে গহনা দিয়েচি। চর বাজুবন্দ, চিক সিঁতিপার্টি, সীতাহার, পুষ্পহার, গোট, বিছে, অনন্ত, তাগা, ইয়া মকরমুকো বালা, ফাঁস হার রতনচুর—

নেবুমাসি! প্রবাল বলে ওঠে, এই সব তুমি দাতব্য করেছ? শুনে আমার মাথা ঘুরছে। দিলে কোন প্রাণে?

হেসে ওঠেন নেবুমাসি, কি ছেলেবয়েসের বুদ্ধি। বিধবা মানুষ গহনা নিয়ে কী করব? তা যাক, একনো যা আচে অনেক। পালিশপাতের চুড়ি, বারোমেসে গোখরিচুড়ি, মানতাশা, ও গিণির মালাটা—তো বাক্সটা তুই আমায় বের করে দে দিকিনি ঢ্যাঙা।

ঢ্যাঙা অম্লান মুখে বলেন, কত কাল থেকে বলছি না, চাবিটা হারিয়ে গেছে। লোকজন ডেকে চাবি বানাও।

নেবুমাসি ক্রুদ্ধ গলায় বললেন, শুনছিস পলা বেআক্কেলের কতা! লোকজন ডেকে আমি চোরাসিন্দুক দেকাই। পর দিন বাড়িতে ডাকাত পড়বে না?

ঢ্যাঙা অবিচল, তবে আমি নাচার!

নাচার বললেই নাচার? আমি বড় মুক করে বললাম গিণির মালা দিয়ে আশীর্বাদ করব পলার হবু বৌকে—

তুমি দিলেই কি আমি নিতাম নেবুমাসি? প্রবাল বলে।

নিতিস না?

পাগল তো নই! তাছাড়া তুমি তো স্বপ্নে বাগান বানাচ্ছ। তোমার ওই খুকু আমার বৌ হতে রাজী হবে কিনা সে—গ্যারান্টি আছে?

বটে? নেই গ্যারান্টি? ডাকত দেকি তাকে—খুকু!

থাক থাক—ঢ্যাঙা বলে ওঠেন, জিনিসটা যখন দিতেই পারছ না—

দিতেই পাচ্ছি না? সাফ জবাব? তুই বুড়ো ধাড়ি ছেলে, সিন্দুকের চাবিটা হারিয়ে বসে আচিস। তা, একটু হায়া লজ্জা নেই? চাবি না থাকে পলাতে তোতে চাড় দিয়ে খোল।

প্রবাল আর সরোজমোহনের চোখে চোখে একটা ইশারা খেলে যায়। এবং প্রবাল প্রবল স্বরে বলে, চাড় দিয়ে? সেকালের বিলিতি কোম্পানির দেয়ালে গাঁথা আয়রণ সেফ চাড় দিয়ে খুলবে তুমি নেবুমাসি? বরং তোমার বাবার এই বাড়িখানা চাড় দিয়ে খুলতে পারতে পারো—ওটিকে পারবে না।

তবে কি তোরা বলতে চাস, আমার সেই গহনার কাঁড়ি, সেই গিণির মালা দেয়ালের মধ্যে গুমখুন হয়ে মরে পচবে? ও সব শুনতে চাই না ঢ্যাঙা, গিণির মালা আমার চাই—ই চাই।

চাই বললেই চাই? আজ দশ বছর ধরে তো সেই চাবি খুঁজছি রে বাপু। না পেলে?

পাশের ঘরে সুদত্তা। শুনতে পেয়েছে সবই।

স্তব্ধ হয়ে বসে ভাবে, তাকে কেন্দ্র করে এ কী ভয়ানক একটা কলঙ্কিত ইতিহাসের পৃষ্ঠা খুলে পড়ল? সুদত্তা কি ছুটে গিয়ে বলবে, আমি এক্ষুনি চলে যাব। ফুল ভেবে যা ধরতে যাচ্ছিলাম, সেটা এমন ভয়ঙ্কর একটা সাপ?

ওই বৃদ্ধ ভদ্রলোক! কিন্তু তাই কি সম্ভব? এত বড় ভয়ানক অপরাধ করে এমন নিশ্চিন্ত ভাবে বসে থাকতে পারে কেউ?

চাবি তুই হারালি কেন?

ইচ্ছে করে কেউ হারায়? তুই আমায় দিতেই বা গিয়েছিলি কেন? নিজে রাখলেই পারতিস।

আমি ও সব কলকব্জা জানি? ইংরিজি ইংরিজি অক্ষর সব ঘোরাতে হয়, কতা তৈরি করতে হয়, সে কি আমার কম্মো?

তবে যেমন কম্ম তেমনি ফল ভোগ কর। বাপ ভাইকেই লোকে বিশ্বাস করে চাবি দেয় না, আর আমি একটা পরস্য পর, আমার হাতে চাবি দিতে এলি। বেশ হয়েছে, ঠিক হয়েছে। এখন কী করবি কর। পুলিশ ডেকে হাতকড়া দিতে ইচ্ছে হয়েছে!

বলেছি আমি সে—কতা?

পাকে প্রকারে বলছিস। চাবি হারিয়ে গেচে। গিণির মালা পাওয়া যাবে না, ব্যস—বলে সরোজমোহন নামের ব্যক্তিটি ঘর থেকে বেরিয়ে যান।

নেবুমাসি চেঁচাতে থাকেন, এত অহঙ্কার ভালো নয় ঢ্যাঙা। আমায় মনিষ্যি বলেই মনে করচিস না। লম্বা লম্বা পা ফেলে চলে গেলি—

প্রবাল এ ঘরে এসে বলে, সত্যি কথাটা বলে ফেলুন না দাদু! দারুণ চটেছেন নেবুমাসি।

সরোজমোহন একটু রহস্যের হাসি হেসে বলেন, সত্যি কথাটা শুনলে আরও চটবে রে পলা। যখন শুনবে ওর জন্যেই আমার এই অকম্মো তখন—

কিন্তু আপনার এই ডিসিশান নেওয়াটা কিন্তু সত্যিই অদ্ভুত ঢ্যাঙা দাদু।

সরোজমোহন গম্ভীর ভাবে সিগারেটে টান দিতে দিতে বলেন, উপায় কী বল? রাজকন্যের যে অনুষ্ঠানের ত্রুটি হবার জো নেই। বাড়ি ভেঙে ওয়ার হচ্ছে, তবু ঠাট—বাটটি বজায় থাকা চাই। দোল—দুর্গোৎসব চাই, গোটা চারেক দাসদাসী চাই—এখনো লোকলৌকিকতার বাহারটি সমান রাখা চাই। পাড়ায় কারো বাড়িতে ভাত পৈতে বিয়ে হোক না, এ বাড়ি থেকে সেরা মাল যাবে। আকাশ থেকে পড়বে টাকা? কিন্তু এতদিন বেচারা জানতেন তার বাক্সভর্তি গহনা আছে, হঠাৎ যদি টের পান সব হাওয়া, হার্টফেল করে বসবেন না? সেই ভয়েই তো চাবিটাকে হারাতে হয়েছে রে ভাই।

কিন্তু ভয়টার কি সত্যিই কোন মূল্য ছিল? না অমূলক?

নইলে এরা যখন চলে আসছে, তখন কি না বলে ওঠেন নেবুমাসি, থাক হয়েছে। আর চাবি খোঁজা চাবি খোঁজা চাবি খোঁজা খেলা খেলতে হবে না ঢ্যাঙা। এরা এগোচ্চে, বেরিয়ে আয় ঘর থেকে। চাবি বেরোলেই কি আর আমার সেই গিণির মালা বেরোবে? ও নির্ঘাৎ তুই তলে তলে বেচে খেয়েচিস! নচেৎ দশ বচর ধরে নাকি লোকে চাবি খুঁজে মরে পায় না। ….. সন্দ আমার হয়েচে কবে থেকেই, লপচপানি চলচে কোথা থেকে? নেবু যখন গা হুকুম করচে তামিল হচ্চে। নেবুর বাপের জমিদারী তো ওদিকে ঢুঁ ঢুঁ হয়ে এয়েচে।….. অমনি হচ্চে? কত ধানে কত চাল বোজে না নেবু? কিন্তু তোর দুঃসাহসকে বলিহারী দিই ঢ্যাঙা। এ বার্তা পাঁচ কান হলে লোকে তোকে কি বলবে ভেবে দেকেচিস?

ঢ্যাঙা বিশ্ব নস্যাতের ভঙ্গীতে বলেন, দেখব না আবার কেন? তুই যা বলছিস, তাই বলবে। বলবে চোর।

কি? কি বললি? আমি তোকে চোর বলেচি?

চোর না হয় জোচ্চোর বলেছিস।

নেবুমাসি চড়া গলায় বলেন, তা বলবই তো, জোচ্চোরকে জোচ্চোর বলব না তো কি মহাপুরুষ বলব? বল তো পলা—বল তো বাছা খুকু?

সুদত্তা প্রণাম করছিল। প্রণাম করে উঠে দাঁড়িয়ে একটু হেসে বলে, হ্যাঁ, এ বিষয়ে আমি আপনার সঙ্গে একমত নেবুমাসি!

রিকশায় চলতে চলতে প্রবাল বলল, আসার সময় ওই কথাটা বলা তোমার ঠিক হয়নি সুদত্তা। শুনতে খারাপ লাগল।

কোন কথাটা? সুদত্তা সচকিত হয়।

ওই নেবুমাসির সঙ্গে একমত হওয়া।

সুদত্তা হেসে উঠে বলে, সত্যি কথাগুলোই সব সময় শুনতে খারাপ লাগে প্রবাল। চিরদিনই তো লোকটা জোচ্চুরী করে এসেছে। নিজের সঙ্গে, ভালোবাসার লোকের সঙ্গে।

অধ্যায় ৩ / ৩

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন