পুষ্কর

ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়

অনেকদিন আগেকার কথা। হাওড়া বাঁশতলা শ্মশানে রাতবিরেতে মড়া পোড়াতে যাওয়া একটা রীতিমতো ভয়ের ব্যাপার ছিল। চারদিকে ঘুটঘুট করত অন্ধকার বাঁশবন। আগাছার জঙ্গল। শুধু তাই নয়, নানারকম ভৌতিক ব্যাপারও ঘটত।

সেবার গ্রীষ্মের শুরুতেই হঠাৎ এই অঞ্চলে খুব মহামারি দেখা দেয়। তা এক সন্ধ্যায় মধ্য হাওড়ার রামকৃষ্ণপুরের এক ভদ্রলোক কলেরায় মারা যান। এই মড়া তো সারারাত ফেলে রাখা যায় না, তাই মৃতদেহ নিয়ে বাড়ির লোকেরা চলল শবদাহ করতে। চারজন কেঁধো আর দু’জন বাড়তি। মোট ছ’জন। সঙ্গে ভদ্রলোকের ভাইপোও ছিল। ভাইপোর নাম বিশু। সে ছিল খুব ডাকাবুকো।

গোছগাছ করে মড়া নিয়ে যেতে রাত হয়ে গেল অনেক। তা প্রায় দশটা। মড়া শ্মশানে নামিয়ে অন্যান্য কাজে মানে কাঠকুটো, নতুন কাপড়, মেটে কলসি ইত্যাদি জোগাড় করতে সবাই চলে গেল। মড়া আগলে বসে রইল বিশু।

সামনেই শ্মশানকালীর মন্দির। মন্দিরে একটি রেড়ির তেলের মাটির প্রদীপ জ্বলছে। দেবীমূর্তিকে দেখাচ্ছে অতি ভয়ঙ্করী। এ ছাড়া ঝোপঝাড় থেকে কীটপতঙ্গর ডাক, শ্মশানের নিমগাছ, বটগাছ থেকে প্যাঁচার ডাক ও শেয়াল-কুকুরের চেঁচানিতে এক ভয়াবহ পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে সেখানে। সে এমনই এক পরিবেশ যে, বিশুর মতো সাহসী যুবকেরও বুক কেঁপে উঠতে লাগল মাঝে মাঝে।

এরই মধ্যে একবার মড়িপোড়া বামুনটা এসে বলল, “এ কী! তুমি একা? আর কেউ নেই?”

বিশু বলল, “আর কারও থাকার দরকারও নেই। আমি একাই একশো।”

“এ জায়গা ভাল নয় বাবা। মাথার চুল পেকে গেছে আমার। তোমার চেয়ে অনেক আচ্ছা আচ্ছা সাহসী ছেলে আমি দেখেছি। একটু সাবধানে থেকো। মড়া ছেড়ে কোথাও যেয়ো না। কিছু দেখলে অযথা গোঁয়ার্তুমি কোরো না। আর ভয় পেলে আমাকে ডেকো। আমি ওদিকে থাকি।”

বিশু বলল, “আপনি যান তো মশাই, আমাকে একটু একা থাকতে দিন। আমার বহু দিনের সাধ ভূত দেখার। আজ যদি ভূত একটা দেখতে পাই তো সে সুযোগ ছাড়ি কেন? যতসব বুজরুকি।”

অগত্যা বামুন ঠাকুর চলে গেলেন।

বিশু মড়ার খাটিয়ার পাশে বসে কিছুক্ষণ পায়ের ওপর পা রেখে দোলাতে লাগল। তারপর মনের আনন্দে শিস দিল। হঠাৎ “ম্যাও।” একটা বেড়াল ডাকল যেন।

কোথায় বেড়ালটা?

আবার “ম্যাও।”

বিশুর হঠাৎ চোখ পড়ল চিমনির দিকে। চিমনির ভেতর থেকে একটা কালো বেড়াল বেরিয়ে এসে ওর দিকে তাকিয়ে আবার ডাকল, “ম্যাও।”

বিশু সেদিকে তাকাতেই হঠাৎ ওর শরীরে কেমন শিহরন খেলে গেল। এ কী হল! এমন তো হওয়ার কথা নয়! ওর মতো সাহসী ছেলের ভূতের বদলে শেষকালে একটা বেড়াল দেখে…? না না। মন থেকে এ দুর্বলতা ঝেড়ে ফেলতেই হবে।

বিশু আবার বেড়ালের দিকে তাকাল।

বেড়ালের চোখ দুটো যেন তীব্র আলোকরশ্মির মতো তাকানো যায় না। । সেই আলোর দিকে

বিশু মনের দুর্বলতা ত্যাগ করে তবুও একদৃষ্টে সেই বেড়ালের চোখের দিকে তাকিয়ে রইল।

বেড়ালটাও কিছুক্ষণ ওইভাবে থেকে এক-পা এক-পা করে এগিয়ে আসতে লাগল এবার।

কিন্তু এ কী! বেড়ালটা হঠাৎ অতবড় হয়ে উঠছে কেন?

বিশুর এবার সত্যি ভয় হল।

ও দেখল, বেড়ালটা যত এগোচ্ছে ততই বড় হচ্ছে। এও কি সম্ভব! পাশেই একটা চিতা খোঁচা অর্ধদগ্ধ বাঁশ পড়ে ছিল। ও সেটা কুড়িয়ে নিয়েই রুখে দাঁড়াল এবার। বলল, “আর এক পা এগোবি তো মেরে ফেলব।”

বেড়ালটা তখন আর বেড়াল নেই। তার তখন বাঘের মতো আকার।

চোখেমুখে আগুনের হলকা আর কুচকুচে কালো গায়ের রং।

হঠাৎ কে যেন বিশুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ওর হাত থেকে কেড়ে নিল বাঁশটা। তারপর সেটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে বলল, “এ কী করছ হে ছোকরা। আমি জানি এরকম অঘটন একটা কিছু ঘটবে। দু’হাত জোড় করে ক্ষমা চাও ওর কাছে। বলো অন্যায় হয়ে গেছে।” বলে বামুন নিজেই বলতে লাগল, “তুমি ওকে ক্ষমা করো বাবা। ও ছেলেমানুষ। ওর অপরাধ নিয়ো না। তুমি স্বস্থানে ফিরে যাও।”

বিশু নিজেও তখন ভয়ানক ঘাবড়ে গেছে। সেও একবার হাতজোড় করে বলল, “আমি তোমাকে অবিশ্বাস করেছিলাম, তাই কি তুমি এমন রূপে আমাকে দেখা দিলে? আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি। কথা দিচ্ছি, আর কখনও তোমার অস্তিত্বকে অস্বীকার করব না।”

অনেকক্ষণ ধরে ওদের কাতর অনুনয় বিনয়ের পর সেই বেড়ালটা যেমন এসেছিল তেমনই এক-পা এক-পা করে পিছু হটতে লাগল আর প্রতিটি পদক্ষেপে ছোট হতে হতে আবার সেই আগের চেহারায় পরিণত হল। তারপর চিমনিটার ভেতরে ঢুকে যেতেই মাথায় হাত দিয়ে ধপ করে মাটিতে বসে পড়ল বিশু। ওর গা দিয়ে তখন দরদর করে ঘাম ছুটছে।

বামুন বলল, “ওই বেড়ালটা বেড়াল নয় বাবা। কালো বেড়াল অপঘাতে মরলে অনেক সময় ওরা পুষ্করযোনি প্রাপ্ত হয়। ওটাও তাই। মাঝেমধ্যে তিথি নক্ষত্রের দোষ ঘটলে ওকে এখানে দেখা যায়। ও জেগে উঠলে কারও সাধ্যি নেই ওকে আটকায়। আমি আসতে আর একটু দেরি করলেই ও শেষ করে ফেলত তোমাকে।”

বিশু বলল, “আপনি না এলে আমি সত্যিই রক্ষা পেতাম না ঠাকুরমশাই। ভূত আমি বিশ্বাস করতাম না, কিন্তু এখন করছি। এরকম ভৌতিক ব্যাপার যে হতে পারে, তা আমার জানা ছিল না। পুষ্করভূত সত্যিই ভয়ঙ্কর।”

এর কিছুক্ষণ পরেই সবাই এসে পড়লে দলবদ্ধ হয়ে শবদাহ করল ওরা। গঙ্গায় স্নান করে শুদ্ধ হয়ে ভোরবেলা বাড়ি ফিরে গেল। তবে সেই থেকে বিশু আর কখনও মড়া পোড়াতে যায়নি।

সকল অধ্যায়

১. লক্ষ্মী আচার্যির গল্প
২. আজাহার মথুরার গল্প
৩. ময়রা সিংহের ভূতের গল্প
৪. বিজলের ডাঙা
৫. সতে মুচি
৬. লালুমিঞার মাঠ
৭. বালিডাঙার মাঠ
৮. ব্রহ্মডাঙার মাঠ
৯. দক্ষিণবাড়ির মাঠ
১০. স্বর্গারোহণ পালা
১১. কী ভয়ঙ্কর রাত
১২. আতঙ্কের রাত
১৩. পীরবাবার রাত
১৪. দুর্যোগের রাত
১৫. বোড়ালের সেই রাত
১৬. রাতের অতিথি
১৭. রাত্রির যাত্রী
১৮. রাতদুপুরে
১৯. রোমহর্ষক
২০. পৈশাচিক
২১. পুরনো বাড়ি
২২. প্রেতাত্মার ডাক
২৩. প্রেতিনী
২৪. প্রেত আতঙ্ক
২৫. পুষ্কর
২৬. শিমুলতলার মাধবী লজ
২৭. শিবাইচণ্ডীর বিষ্টু মশাল
২৮. শাঁখটিয়ার আতঙ্ক
২৯. সন্ধ্যানীড়
৩০. সন্ধ্যামালতী
৩১. সাত নম্বর ঘর
৩২. সৈকত সুন্দরী
৩৩. অশরীরী
৩৪. অবিশ্বাস্য
৩৫. অদৃশ্য হাত
৩৬. অদ্ভুতুড়ে
৩৭. অকল্পনীয়
৩৮. করিম ফকিরের বন
৩৯. কালো সেনের ক্ল্যারিওনেট
৪০. কাঞ্চনকন্যা
৪১. চাঁপাডাঙার বাঁধ
৪২. ছায়াশরীর
৪৩. জ্যোৎঘনশ্যামের বিপদ
৪৪. বছর কুড়ি আগে
৪৫. বাঁকিপুরের মস্তান
৪৬. বিদেহী
৪৭. গাড়লমুড়ির চর
৪৮. নিরাকারের কাহিনী
৪৯. ঘনাপুরার কুঠিবাড়ি
৫০. বেলগাছের মহাপ্রভু

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন