সবুজ আতঙ্ক • স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায়

অদ্রীশ বর্ধন

সবুজ আতঙ্ক – স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায়

বসবার ঘর থেকে কলিং বেলটা বেজে উঠলো। ওঃ! ছুটির দিনেও রেহাই নেই। অন্যদিন যে কর্মচারীটি রুগীদের বসবার ঘরে অভ্যর্থনা জানায় আজ তার ছুটি আর রামবিলাস গেছে বাইরে থেকে কিছু টুকিটাকি জিনিস কিনতে। ব্যাটা গায়ে গতরে হাতির মতো হলে কি হয়—বিশ্ব কুঁড়ে। কখন ফিরবে তার ঠিক কি! অর্থাৎ ডাক্তার মালহোত্রাকেই পাশের ঘরে যেতে হবে কে এসেছে। তার খোঁজ নিতে।

কিন্তু ডাক্তার মালহোত্রা এখন বোতলে ডিসটিলড্‌ ওয়াটার ভরছেন। যে কোন কাজ নিখুঁতভাবে শেষ না করে অন্য কাজে মন দেওয়া তাঁর স্বভাবের বাইরে। এর জন্যে রুগীকে যদি কয়েক মিনিট বেশী অপেক্ষা করতে হয়, উপায় কি।

ইজিচেয়ারে হাত পা ছড়িয়ে বসে রয়েছে এক আগন্তুক। ডাক্তার মালহোত্রা লোকটার মাথা থেকে পা পর্যন্ত চোখ বুলিয়ে নিলেন। কুৎসিত একটা মানুষ। মরা মাছের মতো চোখ, খসখসে শুকনো গায়ের চামড়া, হাতগুলো কেমন যেন বর্ণহীন ফোলাফোলা, আর লোকটার পরনে ওটা যেন পোশাক নয়, একটা বস্তা—পোশাকের মতো চাপানো রয়েছে।

নালী ঘায়ের রুগী নাকি, না ফালতু কোন বীমা কোম্পানীর দালাল? বীমার দালাল হলে অবশ্য লোকটাকে এক্ষুনি বিদেয় করতে ডাক্তারের কোন অসুবিধে হবে না। কিন্তু তার থেকেও বড় কথা—লোকটার মুখের ভাব মোটেই কোন জীবিত মানুষের মতো নয়। কেমন যেন গা ছমছম করা, ভুতুড়ে…!

—আপনি বোধহয় ডাক্তার মালহোত্রা?

লোকটায় কথায় ডাক্তারের চিন্তাসূত্র ছিন্ন হল। আচ্ছা, লোকটার গলার স্বর কেমন যেন অস্বাভাবিক ঘড়ঘড়ে না? যেন শুনতে শুনতে শিরদাঁড়ায় একরাশ ফুসকুড়ি ফুটে ওঠে।

ডাক্তার মালহোত্রার উত্তরের অপেক্ষা না করেই আগন্তুক এক নাগাড়ে বকে চলেছে। সেই সঙ্গে ভাবলেশহীন দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেছে ডাক্তারের দিকেই।

ডাক্তার শুনলেন আগন্তুক বলছে—আমরা হচ্ছি কুৎসিত একটা মানুষ। মরা মাছের মতো চোখ, খসখসে শুকনো গায়ের চামড়া, হাত-পাগুলো কেমন বর্ণহীন ফোলা ফোলা।

কী আশ্চর্য! ও তো ডাক্তারের মনের কথাগুলোই উগরে দিচ্ছে। এ কি ভেলকি নাকি! সামনের সোফাটাতেই ধপ করে বসে পড়লেন ডাক্তার মালহোত্রা।

আগন্তুক তখনও বলে চলেছে—আমাদের পরনে এটা যেন পোশাকই নয়, একটা বস্তা—পোশাকের মতো চাপানো রয়েছে। আমরা কোন নালী ঘায়ের রুগী অথবা ফালতু বীমা কোম্পানীর দালাল। সব থেকে বড়কথা আমাদের মুখের ভাবটা মোটেই কোন মানুষের মতো নয়—কেমন যেন গা ছমছম করা ভুতুড়ে…আর আমাদের গলার স্বরটা কেমন যেন অস্বাভাবিক ঘড়ঘড়ে, যেন শুনতে শুনতে শিরদাঁড়ায় ফুটে ওঠে একরাশ ফুসকুড়ি।

ডাক্তার মালহোত্রার মনে হল এবার তিনি সত্যি সত্যিই পড়ে যাবেন। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলাবার চেষ্টা করতে লাগলেন তিনি। ঠিক সেই মুহূর্তে আগন্তুকের কণ্ঠে নিজের চিন্তার ভাষা শুনতে পেলেন—কী সর্বনাশ। মানুষের মনের চিন্তা পড়ে ফেলতে পারে।

ডাক্তার মালহোত্রা লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। কিন্তু তার আগেই একটা হিম শীতল কণ্ঠ কথা বলে উঠেছে—বসুন আপনি।

ডাক্তার তবু দাঁড়িয়ে রইলেন। সারা শরীর তাঁর ঘামে ভিজে গেছে।

—বসুন। আগন্তুক তীব্র কণ্ঠে আদেশ করলো। সে শাসানি ডাক্তার মালহোত্রার শেষ শক্তিটুকুও যেন কেড়ে নিল। তিনি আবার ধপ করে বসে পড়লেন।

লোকটার মুখের রং-ও কেমন অদ্ভুত ফ্যাকাশে! ও কি মানুষ না শয়তান? ডাক্তার মালহোত্রা এ কথাটা মুখে না উচ্চারণ করলেও লোকটা নিশ্চয়ই জানতে পেরেছে। খবরের কাগজের একটা কাটিং বার করে সে এগিয়ে দিল ডাক্তারের কাছে।

দেখবেন না ভেবেও ডাক্তার মালহোত্রা কাগজের কাটিংটায় একবার চোখ না বুলিয়ে পারলেন না। কিন্তু এ দিয়ে কি করবেন তিনি? ও তো কোন এক লাশকাটা ঘর থেকে একটা মড়া চুরির ঘটনা।

—কিছু বুঝলেন? লোকটা তখনও এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে ডাক্তার মালহোত্রার দিকে।

—না। মাথা নাড়লেন ডাক্তার।

নিজের দিকে একটা ফ্যাকাশে আঙুল নির্দেশ করে আগন্তুক বললো—এই সেই লাশ।

শুনেই আবার লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালেন ডাক্তার মালহোত্রা। কাগজের টুকরোটা তাঁর অবশ আঙুলের ফাঁক গলে খসে পড়ে গেল কার্পেটের ওপর। চেয়ারে ও কে বসে আছে? ডাক্তার নিজের ছ’ফুট। লম্বা শরীরটা কোন রকমে দাঁড় করিয়ে রাখলেন। নাকের মধ্যে থেকে নিশ্বাস ছাড়লেন ইঞ্জিনের মতো—কিন্তু আর একটা শব্দও উচ্চারণ করতে পারলেন না তিনি।

—এটাই সেই চুরী করা দেহ। তেলের কড়ার তলা থেকে ওঠা বুদবুদের মতে ও বলতে লাগলো। কার্পেটে পড়ে থাকা কাগজের কাটিংটা দেখিয়ে আবার বললো—ওতে একটা ছবিও আছে, লক্ষ্য করলে দেখতে পেতেন সে ছবির সঙ্গে আমাদের এই মুখের সম্পূর্ণ মিল।

কিন্তু নিজের সম্পর্কে ও কেবলই বহুবচন ব্যবহার করছে কেন? ডাক্তার মালহোত্রা কোন রকমে জিজ্ঞেস করলেন—কিন্তু মুখ তো একটা!

—সে তো ঠিকই। মুখ একটা, দেহও একটাই। কিন্তু লাশ যারা দখল করেছে তারা সংখ্যায় অনেক। বসুন আপনি।

—কিন্তু…

—আগে বলুন, তারপর কথা। ঠাণ্ডা আড়ষ্ট একটা হাত নিজের পোশাকের ভেতর ঢুকিয়ে যে বস্তুটি বার করে আনলো, সেটি একটি মস্ত বড় পিস্তল। তারপর আনাড়ির মতো বাগিয়ে ধরলো ডাক্তার মালহোত্রার দিকে। ডাক্তার সতর্ক চোখে সেদিকে তাকিয়ে কাগজটা কুড়িয়ে নিয়ে ছবির দিকে চোখ রাখলেন।

ছবির ওপরে লেখা রয়েছে—মৃত অজিত নাইডু, মৃতদেহটি চুরী করা হয়েছে শহরের উপকণ্ঠে কাঁটাপুকুর মর্গ থেকে।

ডাক্তার মালহোত্রা বারবার ছবির সঙ্গে আগন্তুকের চেহারা, চোখ, মুখ খুঁটিয়ে দেখলেন। হুবহু এক! ডাক্তারের সারা শরীরের রক্তস্রোত যেন তীব্র গতিতে ছুটোছুটি শুরু করে দিয়েছে।

ভূতপূর্ব অজিত নাইডুর হাতের পিস্তলটা একবার নড়ে উঠলো, মুখ দিয়ে তার লালা ঝরছে।

সে বললো, আপনি যা ভাবছেন তা নয়। মৃগী রুগী অনেক সময় মড়ার মতো নিষ্প্রাণ হয়ে থেকে আবার বেঁচে ওঠে বটে, কিন্তু এক্ষেত্রে তা হয় নি। তবে স্বীকার করছি আপনি যথেষ্টই বুদ্ধিমান—

কিন্তু মৃগী রুগী কি অপরের চিন্তা পড়তে পারে?

—এ ব্যাপারটা তাহলে কি? অনেকটা বেপরোয়া দুঃসাহসেই ডাক্তার এবার তাঁর প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিলেন।

—ব্যাপার তো আগেই বলেছি। এই দেহটা আমরা দখল করেছি। অনেকটা আপনাদের ভূতের ভরের মতো। তবে ভূত আমরা নই—একেবারে নিখাদ বর্তমান।

কিন্তু হাসিটা ভূতের মতোই শোনা গেল তার। হাসতে হাসতে বললো—অজিত নাইডু লোকটা বেঁচে থাকতে নির্ঘাৎ রসিক ছিল। তার মস্তিষ্ক নিয়েই তো কথাবার্তা চালাচ্ছি আমরা।

ডাক্তার মালহোত্রা এতক্ষণে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। মৃত অজিত নাইডুর সঙ্গে চেহারার মিল থাকা একটা বদ্ধ পাগল এসে জুটেছে তাঁর চেম্বারে। অপরের চিন্তা পাঠের বিদ্যেটা যতই ওর জানা থাকুক—পাগল ছাড়া ওকে আর কি ভাবা যায়?

কিন্তু চাকরটা এখনও দেরী করছে কেন? রামবিলাস একবার এলে হয়।

ভূতপূর্ব অজিত নাইডু তখন বলছে—আপনার চাকরটাকেই আমাদের দরকার। আসলে প্রয়োজন একটা সুস্থ সমৰ্থ দেহ—তা সে চাকর কিংবা অন্য কেউ হলেও ক্ষতি নেই। আপনি ভাবছেন আমরা বদ্ধ উন্মাদ। ভুল করছেন। দুদিন আগে শহরের বাইরে একটা উল্কাপাত হয়েছিল, মনে আছে?

—কাগজে দেখেছিলাম। উল্কাটাকে খুঁজে পাওয়া যায় নি। ডাক্তার মালহোত্রা বললেন।

—আপনাকে মুখে কিছু বলে আর কষ্ট করতে হবে না। আপনি ভাবলেই আমরা জানতে পারছি। যাক্‌ যা বলছিলাম। উল্কা যে আপনারা খুঁজে পান নি তার কারণ সে আসলে উল্কাই ছিল না—সেটা একটা মহাকাশযান। অন্য গ্রহের একটা ছোট্ট বিমান। গ্ল্যান্টক গ্রহের নাম শুনেছেন? সেখান থেকেই আসছি আমরা। আপনাদের সব বিশাল বিশাল বিমানের তুলনায় আমাদের বিমানটি ছোটই বলতে হবে। আসলে আমরা নিজেরাও ছোট যে। খুবই ক্ষুদ্র। আপনাদের অণুবীক্ষণেও দেখা যায় না—এত পুঁচকে। তবে সংখ্যায় অগুন্তি, হিসেবে আনাই দুঃসাধ্য।

ডাক্তার মালহোত্রার মনে যে চিন্তাটা উদয় হতে যাচ্ছিল সেটা আগেই পড়ে ফেলে আগন্তুক বললে—আবার ভুল করছেন, আমরা কোন বুদ্ধিমান জীবাণু নই, তার চাইতেও ছোট। সংখ্যায় অগুন্তি একসাথে তরল পদার্থের মতো থাকা এক ধরনের ভাইরাস, কিংবা বলতে পারেন বুদ্ধিমান ‘বিযাণু’।

ঘর থেকে পালিয়ে যাবার চিন্তাও আর মাথায় আনতে সাহস পাচ্ছেন না ডাক্তার মালহোত্রা। উনি জানেন এ চিন্তা কার্যকর করার আগেই ধরা পড়ে যাবেন।

আগন্তুক বলছে—আমাদের গ্ল্যান্টক গ্রহবাসীদের সর্বদাই অন্য কোন বৃহৎ দেহধারী বুদ্ধিমান জীবের ওপর নির্ভর করতে হয়। এই যে এখানে এলাম তা আমাদের চেয়ে আকারে বহুগুণ এক গ্ল্যান্টিক স্তন্যপায়ীর দেহ আশ্রয় করে।

একটা ভিজে কাশি ঘড় ঘড় করে উঠলো ওর গলায়। তারপর বললো—আমাদের মহাকাশযানটা যখন নামলো, আমরা নামলাম ওই স্তন্যপায়ীটাকে আশ্রয় করে। কিন্তু আপনাদের দেশের একটা কুকুর ওই অচেনা জীবটাকে দেখে তাড়া করলো। আমরাও ফাঁক তালে ঢুকে পড়লাম তার দেহে। ব্যস, আমাদের গ্রহের জীব তখন একেবারে কাৎ!

কুকুরটা আমাদের সোজা এনে হাজির করলো শহরের ভেতরে একটা লাশকাটা ঘরে। সেখানেই মৃত অজিত নাইডুর দেহটা পেয়ে ঢুকে পড়লাম। কুকুরের সেখানেই পতন এবং মৃত্যু।

হঠাৎ সদর দরজায় একটা আওয়াজ। ডাক্তার মালহোত্রা কান পাতলেন। হালকা পায়ে কেউ দ্রুত ওপরে উঠে আসছে।

ভূতপূর্ব অজিত নাইডু তখন বলেই চলেছে—অজিত নাইডুর দেহটায় ঢুকে পড়েই আমরা কাজ শুরু করে দিলাম। ইতিমধ্যে জড় হয়ে যাওয়া ওর শরীরের পেশী আর অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলোকে সজীব সচল করে তুললাম। লোকটা বেঁচে থাকার সময় বেশ বুদ্ধিমান ছিল। মৃত অবস্থাতেও ওর মস্তিষ্ক বহন করছিল জীবিত কালের যাবতীয় স্মৃতি। এ সবই আমাদের কাজে লাগতে শুরু করলো। এই যে পিস্তলটা ধরে আছি—এ কি বস্তু, কিভাবে কাজে লাগে, সবই অজিত নাইডুর মস্তিষ্কের স্মৃতির মধ্যে থেকে পাওয়া।

ওদিকে হালকা পায়ের আওয়াজ ক্রমেই এগিয়ে আসছে।

—লাশ কাটা ঘরে অজিত নাইডুর দেহটা ছিল সম্পূর্ণ নগ্ন। এই পোশাক এবং এই পিস্তল সবই চুরী করতে হয়েছে দেহটাকে কাজে লাগিয়ে… সাবধান! দরকার হলে এই দেহের হাত পিস্তলও চালিয়ে দিতে পারে।

অতএব দরজার দিকে লাফ দিয়ে যাবার চিন্তাটা ছাড়তেই হল ডাক্তারকে। ওদিকে পদশব্দ চেম্বারের দরজার কাছে এসে পড়েছে।

—মৃতদেহ নিয়ে বেশীদিন কাজ চালান যায় না, তা তো বোঝেনই। বললো ভূতপূর্ব অজিত নাইডু। একটা সজীব দেহ চাই আমাদের। স্নায়বিক শক্তিসম্পন্ন সতেজ একটা শরীর। আপাততঃ একটা দেহ দখল করতে গেলে মুশকিল হল যে সে ধাক্কা আপনাদের শরীরে সামলাতে পারবে না, পাগল হয়ে যাবে। আর বিকল-মস্তিষ্ক পাগল নিয়ে কি লাভ হবে আমাদের? তা তো যে কোন বিকল যন্ত্রের মতোই অকেজো।

ওদিকে বাইরে পায়ের শব্দ থেমেছে। খুট করে একটা শব্দ। দরজা বন্ধ করে সে ভেতরে ঢুকে এদিকেই আসছে।

সে ততক্ষণে চরম-পত্র দাখিল করে দিয়েছে—আমরা আপনার কাছে একটা সাহায্যের আশায় এসেছি। একটা সুস্থ সবল মানুষ আপনাকে অজ্ঞান করে দিতে হবে—যাতে তার শরীরে ভর করার সময় তার ইচ্ছাশক্তি বাধা না দিতে পারে আমাদের। তারপর যখন তাকে আবার জাগিয়ে দেবেন আমাদের অধিকার তার দেহ মনের ওপর থাকবে পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত।

দরজা খুলে একটা মেয়ে এসে দাঁড়িয়েছে। সুন্দরী, কমনীয় কান্তি এক তরুণী। তার দিকে এক পলক তাকিয়েই আগন্তুক বললো—এই তো একটা ভালই দেহ এসে জুটেছে। এখন আপনার কাজ আমাদের সাহায্য করা।

এদিকে ঘরে ঢুকেই ওই মরা-মুখের বিভীষিকা দেখে তরুণীর চোখেও ফুটে উঠেছে ভয় আর বিস্ময়।

আগন্তুকের দেহটা হঠাৎ আড়মোড়া ভেঙ্গে উঠে দাঁড়াল চেয়ার থেকে। টলতে টলতে দু’পা এগিয়ে এল নবাগতার দিকে। মুখে তার একটা নোংরা হাসি। গ্ল্যান্টকী বিযাণু কি সৌন্দর্য দেখে চঞ্চল হয়েছে? নাকি ভূতপূর্ব অজিত নাইডু এখনও বেঁচে থাকার সংস্কার ভুলতে পারে নি?

ওকে এগিয়ে আসতে দেখে সেই সঙ্গে ওর মুখের ওই নোংরা হাসিটা আগন্তুক তরুণীকে ঘৃণায় আর আতঙ্কে নীল করে দিল। একটা আর্ত চিৎকার করে মেঝেতে জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়লো সে।

সে পড়ে যাওয়ায় সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তার মালহোত্রা ছুটে এসেছেন তার কাছে। তুলে নিয়ে শুইয়ে দিয়েছেন ঘরের কোণের লম্বা টেবিলটায়।

ভূতপূর্ব অজিত নাইডু-ও পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। বললো—অজ্ঞান হয়ে সুবিধেই হল। আমরা এক্ষুনি ঢুকে পড়তে পারি ওর দেহে।

কিন্তু গ্ল্যান্টক অধিবাসীর সে আশায় ছাই দিয়ে তরুণী চোখ মেলে তাকাল। তার দুচোখে এখনও ভয় আর বিতৃষ্ণা!

—নাঃ হল না! ডাক্তার, আপনাকে দেখছি একটু খাটতেই হচ্ছে। গ্ল্যান্টকী বললো—এক্ষুনি অজ্ঞান করে দিন ওকে। কি ভাবছেন, ঈথার দিলে অজ্ঞান হয় বুঝি? তবে তাই দিন, আর দেরী করবেন না।

সিঁড়িতে আবার পায়ের শব্দ। ডাক্তার মালহোত্রা কান পাতলেন। এবার যেন একটা প্রকাণ্ড গণ্ডার উঠে আসছে ভারী শরীর নিয়ে।

—ভাবছেন বুঝি আপনার চাকর রামবিলাস এল? তা ভালই হল। সংখ্যায় আমরা অগুন্তি। দুজনের শরীরে ভর করতে কোন অসুবিধে হবে না। আপনি বরং ঈথারটা দুজনের জন্যে একটু বেশী পরিমাণ বার করুন। দেরী করলে কিন্তু মারা পড়বেন বলে দিচ্ছি। আর মরেও রেহাই পাবেন না। আপনাকে গুলী করে আপনার দেহে প্রথমে আমরা ঢুকবো তারপর ঈথার প্রয়োগ করব ওই মেয়েটা আর চাকরটার ওপর। কেউই নিস্তার পাবে না। তার চেয়ে আমাদের হুকুম মতো কাজ ভাল নয় কি—মরেও যখন কারুর কোন উপকার করতে পারছেন…!

দরজা খুলে রামবিলাস সটান ঘরে ঢুকলে—হুজুর, রাস্তায় গাড়ির টায়ার ফেঁসে গেল, তাই…

রামবিলাসের দিকে পিস্তল উঁচিয়ে ঘুরে দাঁড়াল গ্ল্যান্টকী।

আর সঙ্গে সঙ্গে একটা ক্রুদ্ধ গণ্ডারের মতো ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো রামবিলাস। সেকেণ্ডের এক ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ—তার মধ্যেই গ্ল্যান্টকী ধরাশায়ী। হাত থেকে পিস্তলের গুলী ছিটকে গিয়ে বিঁধলো দেওয়ালের গায়ে। ঝর ঝর করে খানিকটা চুনবালি খসে পড়লো মেঝেতে।

ডাক্তার মালহোত্রা তখন চিৎকার করে চলেছেন—মেরে ফেল, একবারে শেষ করে দে।

রামবিলাসের বিশাল শরীরটা তখন গ্ল্যান্টকীর ঠিক পেটের ওপর ক্রমাগত লাফিয়ে চলেছে। একটু বাদেই বমি করলো গ্ল্যান্টকী। থক থকে কাদার মতো সবুজ বমি। গ্ল্যান্টক গ্রহের ভাইরাসের দল ভূতপূর্ব অজিত নাইডুর শরীর থেকে বেরিয়ে পড়েছে রামবিলাসের বজ্র পেষণে।

সঙ্গে সঙ্গে সারা ঘরটায় ঈথার ছড়িয়ে দিলেন ডাক্তার মালহোত্রা—নইলে সারা ঘরটা ভরে যাবে ওই সবুজ কাদায়।তারপর মেয়েটিকে তুলে নিয়ে লাফিয়ে ঘরের বাইরে আসতে আসতে হাঁক দিলে—রামবিলাস, এখনি বেরিয়ে পড় ঘর থেকে।

রামবিলাস ঘর থেকে বেরুবার সঙ্গে সঙ্গে পকেট থেকে জ্বলন্ত লাইটার বার করে ছুঁড়ে মারলেন ঈথার ভরা সেই ঘরে। সারা ঘরে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো আগুন। গ্ল্যান্টক গ্রহের মারাত্মক ভাইরাস থেকে পৃথিবীকে বাঁচাবার আর কোন উপায় ছিল না।

আগুন নিয়ে তখন চারদিক থেকে রীতিমত হৈ চৈ শুরু হয়ে গেছে। দমকল! পুলিশ!

নীচে রাস্তায় দাঁড়িয়ে এতক্ষণে মেয়েটি ডাক্তার মালহোত্রাকে দ্বিধাগ্রস্ত স্বরে বললো—আমি এসেছিলাম আপনাকে ডাকবার জন্যে। আমার ভাই এর হাম হয়েছে।

ডাক্তার মালহোত্রা হাসলেন। বললেন—বেশ চল যাওয়া যাক।

কিন্তু যাওয়ার আগে রামবিলাসকে একটা প্রশ্ন না করে পারলেন ডাক্তার—গ্লান্টকী তো মানুষের চিন্তা পড়ে ফেলতে পারতো। কিন্তু তুই যে ওকে আক্রমণ করতে যাচ্ছিস, সে চিন্তার খবর ও পেলো না কেন বলতে পারিস?

—চিন্তা! না হুজুর, কোন চিন্তাই আমি করি নি। ওর হাতে পিস্তল দেখেই ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। যে লোকটা পিস্তল উঁচিয়ে দাঁড়ায় তাকে আক্রমণ করবো

কিনা তাও আবার চিন্তা করতে হয় নাকি? রামবিলাসের সাফ জবাব!

.

প্রথম প্রকাশ: ফ্যানট্যাসটিক, সেপ্টেম্বর, ১৯৭৯

বিদেশী ছায়ায়

সকল অধ্যায়

১. জুলে ভার্ন • নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
২. বিদ্রূপ ব্ৰহ্মর ব্রহ্মাণ্ড • অদ্রীশ বর্ধন
৩. ইনফ্রা-রেডিওস্কোপ • অজিতকৃষ্ণ বসু
৪. প্রোফেসর শঙ্কু ও ভূত • সত্যজিৎ রায়
৫. শমনের রঙ শাদা • প্রেমেন্দ্র মিত্র
৬. মন্দাবতীর জঙ্গলে • ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য
৭. শিলাকান্থ • ডক্টর দিলীপ রায়চৌধুরী
৮. লোকান্তরের হাতছানি • নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়
৯. জয়পুরের সেই অদ্ভুত ট্যুরিস্ট • দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়
১০. প্রথম ম্যমী • মাণিক্য বন্দ্যোপাধ্যায়
১১. পিপে • রণেন ঘোষ
১২. মহাপ্রলয়ের মুহূর্তে • হরিহর প্রসাদ সাহু
১৩. আকাশ-ঘাঁটি • লীলা মজুমদার
১৪. মাইক্রোমেগসের পৃথিবী যাত্রা • শান্তি ঠাকুর
১৫. ঈশ্বরের ছেলেখেলা • অনীশ দেব
১৬. বাতিক • অমিত চক্রবর্তী
১৭. গিরগিটির রহস্য • তারাপদ রায়
১৮. জীবন বনাম মৃত্যু • বরেন গঙ্গোপাধ্যায়
১৯. নাগ-নিকেতন • গৌরীশংকর দে
২০. খাচ্ছিলো তাঁতী তাঁত বুনে • গুরনেক সিং
২১. সময়ের মোচড় • তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়
২২. সবুজ আতঙ্ক • স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায়
২৩. কায়াহীনের কাহিনী • সৌরেশ দে
২৪. হিপেসকাস—সে এক জন্তু • সমরজিৎ কর
২৫. প্রফেসর ত্রিশঙ্কু • শিশির কুমার মজুমদার
২৬. হরিহরণ এফেক্ট • সুমিত কুমার বর্ধন
২৭. ঘাড় বেঁকা পরেশ • মনোজ বসু
২৮. পৃথিবীর শেষদিন • প্রবোধবন্ধু অধিকারী
২৯. যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে • বিশু দাস
৩০. পি-আর রোবট • নিরঞ্জন সিংহ
৩১. এস্‌ এফ • সত্যজিৎ রায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন