০৬. মিষ্টি গন্ধ পাচ্ছি

হুমায়ূন আহমেদ

মিষ্টি গন্ধ পাচ্ছি। গন্ধটা পরিচিত কোনো ফুলের না, আবার অপরিচিতও না। গন্ধের উৎস ধরার চেষ্টা করছি। ধরতে পারছি না।

গন্ধের উৎস ধরে ফেলা জটিল কোনো কাজ না। চোখ মেললেই বোঝা যাবে ব্যাপারটা কী। চোখ মেলতে ইচ্ছা করছে না। আধো-ঘুম আধোজাগরণ অবস্থার আলাদা মজা আছে। এ-অবস্থায় অনুমান-অনুমান খেলা খেলতে ভালো লাগে।

এখন বুঝতে পারছি। ফুলের গন্ধের উৎস আমার বিছানার পাশের চেয়ার। সেই চেয়ারে কেউ-একজন বসে আছে। হাতে ফুল নিয়ে এসেছে। প্রসেস অব এলিমিনেশন পদ্ধতিতে কি বের করা যায়, কে?

আমার কাছে ফুল নিয়ে আসার মানুষ একজনই—ব্রহ্মপা। রূপা অবশ্যই আসেনি। সে গভীর রাতে আমার মেসবাড়িতে উপস্থিত হবে না। রাত অনেক। আমি ঘুমুতে গেছি। এগারোটার দিকে। দু-তিন ঘণ্টা নিশ্চয়ই ঘুমিয়েছি। অবশ্যই রাত একটার বেশি। প্রসেস অব এলিমিনেশন পদ্ধতিতে রূপা বাতিল। শুধু রূপা না, পুরো মহিলাজাতিই বাতিল। কোনো মহিলাই রাত একটায় মেসে উপস্থিত হবে না।

বাকি থাকল পুরুষ। এমন কোনো পুরুষ এসেছে যে গায়ে আফটার শেভ লোশন দিয়েছে, কিংবা সেন্ট দিয়েছে। খালুসাহেব গায়ে সেন্ট দেন। বাদলের সমস্যা নিয়ে গভীর রাতে আমার কাছে তিনি উপস্থিত হতে পারেন। তবে তিনি চেয়ারে চুপচাপ বসে থাকার লোক না। তা ছাড়া ঘর অন্ধকার। তিনি ঘরে ঢুকেই বাতি জ্বালাবেন। প্রসেস অব এলিমেনশন পদ্ধতিতে তিনিও বাতিল।

এমন কেউ আমার বিছানার কাছে বসে আছে, যে বাতি জ্বালানোর ব্যাপারে আগ্রহী না। অর্থাৎ, সে নিজের পরিচয় গোপন রাখতে চাচ্ছে। এমন লোক কে হতে পারে? আঙুল-কাটা জগলু ভাই? উনি কি গায়ে সেন্ট দেন।

আমি চোখ না মেলেই বললাম, জগলু ভাই, কখন এসেছেন?

চেয়ারে বসে-থাকা মানুষটা জবাব দিল না। তবে সিগারেট ধরাল। তামাকের গন্ধ পেলাম।

তোমার ঘর সবসময় খোলা থাকে?

জি।

আমার জিনিস কোথায়?

আমি উঠে বসতে বসতে বললাম, সুটকেসের কথা বলছেন? চৌকির নিচে আছে। হাত বাড়িয়ে নিয়ে নিন।

পাঁচিশ লক্ষ টাকাভিরতি সুটকেস, তুমি চৌকির নিচে রেখে দিয়েছ। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ পর্যন্ত করনি। এটা আমাকে বিশ্বাস করতে বলছ?

হ্যাঁ, বলছি। যা চলে যাবার সেটা যাবেই। হাজার চেষ্টা করেও ধরে রাখা যাবে না। মনসুর সাহেব তার টাকা পয়সা ব্যাংকে রাখেন। তার পরও সেখান থেকে পঁচিশ লক্ষ টাকা বের হয়ে গেল না?

টাকা ঠিকঠাক আছে?

আছে বলেই তো মনে হয়। আমি গুনে দেখিনি। বাতি জ্বালাই, গুনে দেখুন।

বাতি জ্বালাতে হবে না।

আপনি মেসে ঢুকেছেন কীভাবে? কেউ কিছু জিজ্ঞেস করেনি?

দারোয়ান জিজ্ঞেস করেছিল কোথায় যাব।–তোমার কথা বলেছি, দরজা খুলে দিয়েছে।

আপনি কি একা এসেছেন?

একা আসি নাই। আমি একা ঘোরাফেরা করি না।

আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম, আমরা পৃথিবীতে আসি একা, পৃথিবী থেকে ফেরত যাই একা, কিন্তু পৃথিবীতে ঘোরাফিরা করি অনেককে নিয়ে।

এই ধরনের সস্তা ফিলসফি আমার সঙ্গে কপচাবে না। এইসব থার্ড রেট কথাবার্তা আমি জানি।

বাতিটা জ্বালাই, জাগলু ভাই। মুখ দেখতে পাচ্ছি না বলে কথা বলে আরাম পাচ্ছি না। তা ছাড়া সুটকেসের টাকাও আমাদের গোনা দরকার। পঞ্চাশটা পঞ্চাশ হাজার টাকার বান্ডিল থাকার কথা।

জগলু ভাই কিছু বললেন না। আমি বাতি জ্বালালাম। সুটকেস খুলে টাকার বান্ডিল গুনলাম। জগলু ভাই কোনো কথা বলছেন না। তিনি তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। টাকার পরিমাণ ঠিক আছে কি না, এই বিষয়ে তার কোনো আগ্রহ দেখা গেল না।

হিমু!

জি জাগলু ভাই?

তোমার সম্পর্কে আমি কিছু খোঁজখবর নিয়েছি। তোমাদের মেসের দারোয়ানকেও জিজ্ঞেস করলাম। বেশির ভাগ মানুষের ধারণা, তুমি সাধুসন্ন্যাসী টাইপ কেউ। তুমি নাকি ভবিষ্যৎ বলতে পার। আমার ভবিষ্যৎ কী বলো দেখি।

আমি কয়েক সেকেন্ড চোখ বন্ধ করে রাখলাম। তারপর চোখ খুলে বড় করে নিশ্বাস নিয়ে বললাম, আপনি পুলিশের হাতে ধরা পড়বেন। তারপর ফাঁসিতে ঝুলবেন।

জগলু ভাই বিরক্ত গলায় বললেন, আমি যে ফাঁসিতে ঝুলাব এটা বলার জন্য সাধু-সন্ন্যাসী, পীর-ফকির হওয়া লাগে না। যে-কেউ বুদ্ধিমান মানুষ বলতে পারবে যে, আমাকে ফাঁসিতে ঝুলতে হবে।

আমি বললাম, কবে ধরা পড়বেন সেটা কিন্তু যে-কোনো মানুষ বলতে পারবে না।

তুমি বলতে পারবে?

অবশ্যই।

কবে?

সেপ্টেম্বরের এগারো তারিখ।

জগলু ভাই হতভম্ব গলায় বললেন, সেপ্টেম্বরের এগারো তারিখ?

আমি বললাম, জি। আপনার ছেলের জন্মদিন।

ছেলের জন্মদিন করতে গিয়ে আমি পুলিশের হাতে ধরা খাব?

জি।

এত সহজ হিসাব?

জি, হিসাব সহজ।

জগলু ভাই হাতের সিগারেট ফেলে দিয়ে নতুন আরেকটি ধারালেন। চেয়ার টেনে আমার দিকে খানিকটা বুকে এলেন। গুছিয়ে কোনো কথা বলার প্রস্তুতি। বেশির ভাগ মানুষই গুছিয়ে কথা বলার সময় শ্রোতার দিকে খানিকটা এগিয়ে আসে।

হিমু, আমাকে তোমার কী মনে হয়? বোকা না বুদ্ধিমান?

বুদ্ধিমান।

কীরকম বুদ্ধিমান?

আপনার বুদ্ধি বেশ ভালো।

একজন বুদ্ধিমান মানুষ, যে জানে তার ছেলেকে সবসময় পুলিশ নজরে রাখছে, সে কি তার ছেলেকে দেখতে যাবে?

আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম, বড় বোকামিগুলি বুদ্ধিমান মানুষরাই করে।

জগলু ভাই সুটকেস-হাতে উঠে দাঁড়ালেন। আমি বালিশের নিচ থেকে মোবাইল সেট বের করে উনার দিকে এগিয়ে দিলাম। জগলু ভাই বললেন, এটা তুমি রেখে দাও। এটা তোমার গিফট।

আমি বললাম, গিফট আমি নেই না, জগলু ভাই। গিফট নেয়া আমার ওস্তাদের নিষেধ আছে।

কে তোমার ওস্তাদ?

আমার বাবা। তিনি বলে গিয়েছেন, হিমালয়, কাউকে কিছু দিবি না, কারো কাছ থেকে কিছু নিবিও না। নিজেকে সবরকম দেয়া-নেয়ার বাইরে রাখবি। উপহার দেয়া-নেয়া, প্ৰেম দেয়া-নেয়া কিংবা স্নেহ-মমতা দেয়ানেয়া কোনোকিছুর মধ্যেই থাকবি না।

জগলু ভাই মোবাইল টেলিফোন হাতে নিলেন। প্যান্টের পকেটে রাখলেন আর তখনই মোবাইল বেজে উঠল। আমি বললাম, জগলু ভাই, আপনার ছেলে টেলিফোন করেছে। সে প্রায়ই গভীর রাতে টেলিফোন করে। দেখি, শেষবারের মতো তার সঙ্গে কথা বলি।

জগলু ভাই বললেন, আমি যে এখানে আছি সেটা বলবে না। খবরদার!

হ্যালো, হিমু চাচু!

হ্যালো, বাবু।

কেমন আছ, হিমু চাচু?

ভালো আছি। তুমি কেমন আছ?

আমিও ভালো আছি। হিমু চাচু, তুমি কী করছ?

তোমার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলছি।

আমিও তোমার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলছি। হি হি হি।

জগলু ভাই আমার কানের কাছে তার মাথা নিয়ে এসেছেন। কী কথাবার্তা হয় শুনতে চাচ্ছেন। মোবাইল-নামক যন্ত্রের ভলুম বাড়ানোর ব্যবস্থা আছে। কাজটা কীভাবে করা হয় আমি জানি না। জানলে ভলু্যম বাড়িয়ে দিতাম, তাতে জগলু ভাইয়ের সুবিধা হতো। ছেলের প্রতিটি কথা পরিষ্কার শুনতে পেতেন।

হিমু চাচু!

বলো, শুনছি।

আমাকে তুমি যে ভূতের বাচ্চাটা দিয়েছ তার নাম হলো হং।

তুমি নাম দিয়েছ?

না। ও আমাকে বলেছে।

তোমার সঙ্গে কি ওর কথা হয়?

হয়। রোজ রাতে সে কথা বলে।

কী কথা বলে?

অনেক কথা বলে। বাবার কথা বলে।

বাবার কথা কী বলে?

বাবা কোথায় আছে, কী করছে—এইসব বলে।

ভূতের বাচ্চাটাকে জিজ্ঞেস করো তো এখন তোমার বাবা কোথায় আছে।

সেটা তো আগেই জিজ্ঞেস করেছি।

হং কী বলেছে?

বলেছে, বাবা তোমার সঙ্গে আছে।

কথা বলবে বাবার সঙ্গে?

না। আমি এখন ঘুমাব।

বাবার সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছ না কেন?

হং নিষেধ করেছে।

কেন নিষেধ করেছে?

হং বলেছে, আমি যদি অনেক দিন বাবার সঙ্গে কথা না বলি তা হলেই জন্মদিনে বাবা আমাকে দেখতে আসবে। কথা বললে আসবে না। আমি এখন আর তোমার সঙ্গে কথা বলব না। আমি ঘুমাব।

জগলু ভাই এখন বসে আছেন। মুখে জ্বলন্ত সিগারেট। আমি জগলু ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললাম, আর রাত করে লাভ কী? চলে যান।

জগলু ভাই বললেন, ভূতের বাচ্চার ব্যাপারটা কী?

আমি বললাম, কোনো ব্যাপারই না। একটা সবুজ বোতলে আমি কিছু সিগারেটের ধোয়া ভরে দিয়ে দিয়েছি।

ভূতের বাচ্চা কথা বলছে, এই রহস্যটা কী?

শিশুমনের কল্পনা। এর বেশি কিছু না।

আমি যে তোমার সঙ্গে আছি সেটা কীভাবে বলল?

কাকতালীয় ব্যাপার। লেগে গেছে। জগৎসংসারে কাকতালীয়া ব্যাপার ঘটে। ভালোমতো চিন্তা করে দেখুন, আপনার জীবনেও অনেকবার ঘটেছে।

জগলু ভাই উঠে দাঁড়ালেন। আমি বললাম, সুটকেস, ফেলে যাচ্ছেন।

জগলু ভাই বললেন, এত রাতে টাকা নিয়ে বের হব না। থাকুক তোমার কাছে। পরে একসময় এসে নিয়ে যাবে।

আমি বললাম, তা হলে একটা কাজ করি, সুটকেসটা নিরাপদে থাকে এমন একটা জায়গায় রেখে দেই। আবার মনসুর সাহেবের কাছে দিয়ে আসি?

জগলু ভাইয়ের ঠোঁটে এই প্রথম সামান্য হাসির আভাস দেখলাম। তিনি হ্যাঁ-না কিছুই বললেন না।

আমি বললাম, শুভ্ৰ কেমন আছে?

জগলু ভাই বললেন, শুভ্ৰ কেমন আছে আমাকে জিজ্ঞেস করছি কেন?

আপনাকে জিজ্ঞেস করছি। কারণ আমার ধারণা। আপনি তার খোঁজ খবর নেন।

শুভ্ৰ ভাল আছে।

আমি বললাম, জগলু ভাই আমার ধারণা আপনার সঙ্গে এই আমার শেষ দেখা। আপনি কি ঐ ধাঁধার উত্তরটা জানতে চান। ঐ যে কোন সে প্রাণী খাদ্য গ্ৰহণ করে না…।

উত্তর জানতে চাই না। উত্তর আমি নিজে নিজে বের করব।

সহজ লাইনে চিন্তা করবেন জগলু ভাই। সমস্যা যত জটিল তার সমাধান তত সহজ। অতি জটিল যে জীবন তার ব্যাখ্যা সেই কারণেই অতি সহজ।

ব্যাখ্যা কি?

আপনি এই ধাঁধাটার জবাবও নিজেই বের করুন। আপনি দীর্ঘ সময় জেগে থাকবেন ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করার সুযোগ পাবেন।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন