নীললোহিতের চোখের সামনে – সংযোজন ক

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

বিয়েবাড়িতে দেখা ছবির সঙ্গে। বেশি সাজগোজ করেনি, তার শাড়ি-গয়না চোখ ধাঁধায়না, তবে খোঁপাটি খুব সুন্দর ক’রে বেঁধেছে, সেই সঙ্গে একটা মানানসই টিপ। হাল্কা ছিপছিপে শরীরটা নিয়ে বারবার সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করছে। আমার দিকে একবার চোখাচোখি হতেই ভুরু তুলে জিজ্ঞেস করল, কখন এলেন।

আর বেশি কথা বলার সময় নেই। কনে রয়েছে তিনতলায়, একতলায় বরযাত্রীরা হাসিঠাট্টা করছে, উঠোনে সাজানো হচ্ছে ছাঁদনাতলা। দোতলায় ব’সে আছে অন্য মেয়েরা—সব জায়গাতেই তাকে একবার ক’রে যেতে হবে তো! বরের নাম অনিন্দ্য, সে আবার আগে থেকেই ছবির চেনা—সুতরাং তার সঙ্গেও মাঝে—মাঝে এসে রসিকতা ক’রে যেতে হয়।

আমি প্রথম ব্যাচেই খেয়ে নিয়ে পালাবার মতলবে ছিলাম, ধরা প’ড়ে গেলাম ছবির হাতে। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গিয়ে তার মুখোমুখি। চোখ পাকিয়ে বলল, এই তো আপনি এক্ষুনি খেতে যাচ্ছেন কি? লজ্জা করেনা? যান নিচে গিয়ে বসুন! আমতা-আমতা ক’রে কিছু বলতে গেলাম, শুনলনা। আমাকে আবার ফিরে আসতে হ’ল।

অনিন্দ্য আমাকে ইসারায় ডেকে পাশে বসালো। আজকের আসরে বরই সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি—সবাই তাকে একবার ক’রে দেখে যাচ্ছে—আমি তার পাশে বসার জন্য আমার ওপরেও পড়ছে তাদের চোখ। এত চোখের দৃষ্টি একসঙ্গে আমার ওপর পড়লে আমার খুব অস্বস্তি হয়। সবাই হয়ত ভাবছে, এ আবার কে? অন্যদের দিকে পিছন ফিরে আমি অনিন্দ্যকে জিজ্ঞেস করলাম, কি নার্ভাস লাগছে একটু-একটু?

অনিন্দ্য বলশ, বুকে হাত দিয়ে দেখুন। বুকটা টিপ-টিপ করছে?

অনিন্দ্যর সঙ্গে মমতার বহু দিনের চেনা-পরিচয়। মমতা আমার পিসতুতো বোন। দু-পক্ষের বাড়ি থেকেই বিয়ের ব্যাপারে ঘোর আপত্তি—কারণ জাতের অমিল। এদিকে ওরা বিয়ে করবেই। প্রায় চার-পাঁচ বছর টালবাহানা করার পর শেষ পর্যন্ত দুটি পরিবারই মত দিয়েছে। আসলে কিন্তু এই আজকের বিয়ের ব্যাপারটা নিছক লোক-দেখানো—অনিন্দ্য আর মমতার গোপনে রেজিস্ট্রি বিয়ে হয়ে গেছে ছ-মাস আগেই। সেই বিয়েতে আমি সাক্ষী ছিলাম—আর সাক্ষী ছিল অনিন্দ্যর বন্ধু সুকোমল এবং ছবি। এরকম দুটো গোপন বিয়েতে তিন মাসের মধ্যে দুবার আমাকে সাক্ষী দিতে হয়েছে।

অনিন্দ্যর অন্যান্য বন্ধুদের আমি চিনিনা—আজ যারা বরযাত্রী এসেছে। এইসব দিনে সবারই একটু হাস্য-পরিহাসের দিকে মন যায়, মাঝে-মাঝে মুখ-আগা কথাও বেরিয়ে আসে। আমি আর অনিন্দ্য অন্য কথা বলছিলাম।

এইসময় ফটোগ্রাফার এল অনিন্দ্যর ছবি তুলতে—সেই সঙ্গে কৌতূহলী মেয়ের দঙ্গল। তাদের মধ্যে ছবিও আছে। ছবি আমাকে দেখে বলল, এই আপনি ওখানে ব’সে আছেন কেন? আপনারও বুঝি ছবি তোলার শখ?

আমি উঠে এসে ছবিকে বললাম, বাঃ, খেতে যাবনা, বরের পাশেও বসবনা —তাহ’লে আমি যাব কোথায়?

—কিছু কাজ করতে পারছেননা?

আমি হাসলাম। এটা যদিও আমার পিসিমার বাড়ি—কিন্তু সবাই জানে আমি একটা অপদার্থ। সারা বাড়ি ছুটোছুটি কিংবা কোমরে তোয়ালে জড়িয়ে পরিবেশন করা আমার দ্বারা সম্ভব নয়। বিয়েবাড়িতে এসে শুধু খাওয়া ছাড়া আমার আর—কোন যোগ্যতা নেই।

জিজ্ঞেস করলাম, ছবি তুমি এখন কী করছ?

ছবি বললো, আপনাকে যে একদিন বললাম, মনে নেই? আমি একটা স্কুলে পড়াচ্ছি। মিশনরি স্কুল।

–তাহ’লে তো মাইনে ভালোই পাচ্ছ। একদিন খাওয়াবেনা?

—যে কোনদিন।

–তোমার একটা খাওয়া তো ফস্কে গেছে।

ছবি এবার আমার দিকে গাঢ় চোখে তাকাল। তৎক্ষণাৎ আমি বুঝতে পারলুম, ও-কথাটা আমার বলা উচিত হয়নি। সবসময় আমার কাণ্ডজ্ঞান থাকেনা। আবার হাওয়া হাল্কা করার জন্য বললাম, তোমাকে আজ দারুণ দেখাচ্ছে। কত ছেলে যে আজ তোমার প্রেমে প’ড়ে যাচ্ছে।

ছবি এ-কথাতেও খুশি হ’লনা। তীক্ষ্ণচোখে চেয়ে রইল আমার দিকে। তখন ওর পিঠে হাত রেখে বললাম, যাও মমতা বোধহয় তোমাকে এতক্ষণ না-দেখে ছটফট করছে।

ছবি চ’লে যাবার পর আমার আর কিছুই করার নেই দেখে আমিও চুপি—চুপি ছাদে চ’লে গেলাম খাওয়াটা সেরে নেবার জন্য। বিয়েবাড়িতে আজ এত আনন্দ, এত সাজপোশাক, সানাইয়ের বাজনা ও ফুলের গন্ধ—কিন্তু আমি আজ এসবের মধ্যে যোগ দিতে পারছিনা। আমার একা থাকতে ইচ্ছে করছে।

খেয়েদেয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামবার সময় কনের ঘরে একবার উঁকি মারলাম। ছবি সেখানে নেই। এক গুচ্ছ মেয়ে ঘিরে আছে মমতাকে। আমার সঙ্গে একবার চোখাচোখি হ’ল–মমতার চোখে একটা ম্লান ছায়া। আমি জানি ওর মানে।

নিচে বরের আসর অনেকটা ফাঁকা। অনেকেই খেতে গেছে। অনিন্দ্য তার এক বন্ধুর সঙ্গে কী নিয়ে যেন রাগারাগি করছে। বিয়ের দিন বরের রাগারাগি করা বড়োই বেমানান। আমি কাছে গিয়ে বললাম, অনিন্দ্য এক্ষুনি তোমাকে ডাকতে আসবে। একটা সিগারেট খেয়ে নেবে নাকি। এরপর কিন্তু অনেকক্ষণ আর সিগারেট টানার সময় পাবেনা।

অনিন্দ্য উঠে এল। জিজ্ঞেস করলাম, ওরকম রাগারাগি করছ কেন? আজ হাসিখুশি থাকার দিন।

ঘটনাটা এই। ইতিমধ্যে ছবি আর-একবার এসেছিল। তখন বরযাত্রীদের মধ্যে অনিন্দ্যর এক বন্ধু নিচু গলায় ছবির রূপ-যৌবন সম্পর্কে একটা মুখ-আল্‌ল্গা মন্তব্য করেছে। আমি অনিন্দ্যকে বললাম, ওতে কিছু যায় আসেনা। ছবি তো শুনতে পায়নি।

অনিন্দ্য বলল ছবি যে আজ এসেছে, এতে আমি এত খুশি হয়েছি!

আমি বললাম, খুব খাটাখাটনি করছে ছবি। বেশ আনন্দেই তো আছে।

—আপনি ভালো ক’রেই জানেন, আমার মন আজ একটুও ভালো নেই। আমার কান্না পাচ্ছে বারবার।

—ছিঃ এখন ও-কথা বলতে নেই।

অনিন্দ্যর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল সুকোমল। রেজিস্ট্রি বিয়ের দিন সে সাক্ষী ছিল সে আজ বেঁচে নেই। উগ্রপন্থী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হয়ে সে হঠাৎ মারা গেল। সেইসঙ্গে সে ছবিকেও নিঃস্ব ক’রে গেছে। ছবির সঙ্গে সুকোমলের গোপনে বিয়ে হয়ে গিয়েছিল-সে-বিয়েতেও আমরা উপস্থিত ছিলাম। আজ বারবার মনে পড়বেই সুকোমলের কথা। ছবির সেই কথা আর কেউ জানেনা। ছবির বাবা-মা উঠে প’ড়ে লেগেছেন ওর বিয়ের জন্য।

অনিন্দ্যর ডাক এসে গেল। আমি চুপি-চুপি পালিয়ে আসছিলাম-হঠাৎ দরজার পাশ থেকে ছবি আমার হাত ধ’রে বলল, দাঁড়ান, আমিও আপনার সঙ্গে যাব।

—সে কি, তুমি এখন যাবে কি? খাবেনা?

—দই মিষ্টি খেয়ে নিয়েছি। আমার শরীর ভালো নেই।

—বিয়ে দেখবেনা? এক্ষুণি আরম্ভ হচ্ছে।

—না।

—কেন? মেয়েরা কখন বিয়ে না-দেখে বাড়ি যায়?

ছবি আমার চোখ থেকে চোখ নামিয়ে নিল। তারপর খুব আস্তে-আস্তে বলল, বিয়ের সময় বিধবাদের উপস্থিত থাকতে নেই।

আমি বললাম, কী বলছ আজেবাজে কথা। ও তো আর কেউ জানেনা।

ছবি বলল, আমি তো জানি! চলুন।

অনেকের ধারণা, আমিই নেহাৎ-ই একটা বেচারা টাইপের, হাতে হ্যারিকেন মার্কা ছেলে। আমার যে জীবনে কোনই উন্নতি হ’ল না, তা-ই নয়, কেউ কোনদিন আমাকে পাত্তা দেয়না, আর মেয়েরা তো আমাকে গ্রাহ্যই করেনা! আর সবারই প্রেমিকা-ট্রেমিকা আছে, শুধু আমারই কেউ নেই। খুব ভুল ধারণা। এমনকি আমারও বেশ কয়েকজন প্রেমিকা আছে, এবার তাদেরই একজনের কথা বলছি।

আজকাল অনেক ছেলেই সকালবেলা বাজার থেকে মাছ-তরকারি কেনার ব্যাপারটাকে নিতান্ত হেয় জ্ঞান করে। বাজারের থলে হাতে নিয়ে যাচ্ছে বা ফিরছে, এটা দেখে ফেললেই প্রেস্টিজ পাংকচার।

আমাকে অবশ্য ছেলেবেলা থেকেই বাজারে যেতে হয়। বাজার করার ব্যাপারে আমি রীতিমত ট্রেনিংপ্রাপ্ত পাশ-করা বাজার-সরকার বলা যায়। বেশ কিছুদিন আমি এই ব্যাপারে অ্যাপ্রেন্টিস ছিলাম পর্যন্ত।

আমার বাবা খুব ব্যস্ত মানুষ ছিলেন! সকালবেলা বাজার করার পুরো ফুরসৎ পেতেননা। ছেলেবেলায় আমার নির্দিষ্ট ডিউটি ছিলো রোজ সকালে একটা নির্দিষ্ট সময়ে বাজারের একটা নির্দিষ্ট পানের দোকানের কাছে বাজারের থলি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা। বাবা দুটো টিউশনির ফাঁকে এসে আমার কাছ থেকে থলিদুটো নিয়ে ঝাঁ ক’রে বাজার ক’রে এনে আবার আমার হাতে সেগুলো দিয়ে চ’লে যেতেন। আমি সেগুলো বাড়িতে নিয়ে আসতাম। অর্থাৎ, প্রথম পর্বে আমার ছিল দাঁড়িয়ে থাকার ধৈর্যপরীক্ষা ও ভরতি বাজারের থলি বয়ে আনার ট্রেনিং।

এতে পাশ করবার পর, বাবা বাজার করার সময়টুকুতেও আমাকে সঙ্গে—সঙ্গে নিয়ে ঘুরতেন। তখন আমার কাজ ছিল দরাদরির ব্যাপারে কোনরকম মন্তব্য না-ক’রে শুধু আলু-পটল ইত্যাদি ওজন করার পর থলিতে ঢালার সময় দু-একটা প’ড়ে যাচ্ছে কিনা সেদিকে লক্ষ রাখা। এ-পরীক্ষাতেও আমি পাশ ক’রে গেলুম। তারপর, একটু বড়ো হবার পর, বাবা আমার ওপর পুরোপুরি বাজার করার ভার ছেড়ে দিলেন।

তখন থেকেই আমি ঠিক সাবালক হলুম বলা যায়। বাজারের পয়সা থেকে বেশ কিছু ইনকাম করা যায়, তাই দিয়ে সিগারেট ফোঁকা কিংবা বন্ধুবান্ধবদের চা খাওয়ানো চলে। আর এসব না-হ’লে আর সাবালক হওয়ার মানে কি? কে বলে বেকারদের স্বাধীন ব্যবসায়ের সুযোগ নেই? যেসব বেকারদের বাড়িতে এখনও বাজার হয়, তারা অনায়াসেই বাজার করার ভার নিয়ে টু-পাইস ম্যানেজ করতে পারে। সেদিন আমার এক বেকার বন্ধু খানিকটা লজ্জার সঙ্গে বলছিল, জানিস আজ বাজারে গিয়েছিলুম। উঃ কী ভিড়, লোকে পা মাড়িয়ে দেয়—কী ক’রে যে লোকে রোজ সকালবেলা…ইত্যাদি। আমি তো শুনে অবাক! শুধু কষ্টটাই দেখল, পয়সা উপায় করার সম্ভাবনাটা ওর চোখে পড়লনা? বিনা পরিশ্রমে কে কবে টাকা উপার্জন করতে পেরেছে? একমাত্র শুনেছি সরকারি চাকরিতেই কোন খাটুনি নেই—কিন্তু সে তো সহজে পাওয়া যায়না! ভবিষ্যতে আর কেউ পাবে কিনা তা-ও সন্দেহ?

যাই হোক, এবার আমার প্রেমিকার কথা বলি। বাজার করতে গিয়েই আমি আমার এই প্রেমিকার দেখা পেয়েছিলাম। না, যা ভাবছেন তা নয়। কোন মেছুনির প্রেমে পড়ার সৌভাগ্য আমার এ-পর্যন্ত হয়নি। আমি যে-বাজারে যাই, সে-বাজারে মেছুনি কয়েকটি আছে বটে, কিন্তু তারা কেউই মৎস্যগন্ধা সত্যবতী-তুল্যা নয়, তাছাড়া আমি একপো আধসেরের বেশি মাছ কোনদিন কিনতে পারিনি ব’লে মেছুনীরা কোনদিন আমাকে ভালো ক’রে গ্রাহ্যই করেনি।

আমার এই প্রেমিকার নাম আমি জানিনা। ঝিঙেদি বা পটলরানী বললে কেমন হয়? কিন্তু এগুলো শুনতে খারাপ, তারচেয়ে সীমকুমারী বললে বরং মানায়। মেয়েটি সীম, পটল, ঝিঙে এইসব বিক্রি করত। চাষীর ঘরের মেয়ে, নিজের ক্ষেতের শব্জী-তরকারি এনে বিক্রি করে, সেটা তরকারিগুলোর টাটকা সতেজ রং দেখলেই বোঝা যায়। মেয়েটিরং রং মাজা-মাজা, বেশ লম্বা, খুব মুখরাধরনের, সহজে কেউ তাকে ঠকাতে পারেনা।

আমার সঙ্গে তার প্রথম পরিচয় এইভাবে। দু-তিনজন লোক তার তরকারির ঝুড়ির সামনে হাত দিয়ে এটা-সেটা ঘাঁটাঘাঁটি করছে। আমি জিজ্ঞেস করলুম, কি গো সীম কত ক’রে?

—এক টাকা।

—দাও, হাফ কিলো।

মেয়েটি একটা ছোট্ট চুবড়ি আমার দিকে বাড়িয়ে বলল, বেছে নাও। আমি বললাম, না আমি বাছবনা! তুমি নিজের হাতে বেছে-বেছে বেশ পচা-পচা আর পোকায়-ধরা সীমগুলো আমায় দাও তো। ঐগুলোই আমি ভালোবাসি।

মেয়েটি চোখ তুলে আমার দিকে তাকিয়ে ফিক ক’রে হেসে ফেলল। সেই হ’ল প্রথম চার চোখের দর্শন।

পাঠক হয়ত ভাবছেন, আমি প্রথম প্রেমেই এমন গদগদ হয়ে গেছি যে, মেয়েটিকে দেখেই দরদাম করার কথা ভুলে গেছি আর নিজের হাতে বেছে নেবার বাসনাও পরিত্যাগ করেছি। এখানে তাহ’লে প্রেমের বদলে বাজার করা বিষয়ে দু-একটা কথা আগে বলা যাক্।

সব জিনিস টিপে-টুপে বাছাই ক’রে কেনাই ভালো বাজার করার লক্ষণ নয়। দোকানে গিয়ে অত্যধিক দরদাম করলেই সুবিধে হয়না। ঐসব ওপরচালাক লোক বেশি ঠকে, সারা বাজারটা ঘুরে জিনিসপত্রের প্রকৃত দর জেনে নিলে আর দরাদরি করতে হয়না। যে বেশি দর চায়, তার কাছ থেকে না-কেনাই ভালো। আর যে লোক বেশি বাছাবাছি করে, দোকানদারও তাকে বেশি ঠকাবার চেষ্টা করে। এটা একধরনের খেলা। ক্রেতা ভাবছে পচা-টচা বাদ দিয়ে শুধু ভালোগুলো সে নেবে—আর দোকানদারও তাকে কিছু খারাপ জিনিস গছাবার চেষ্টা করবেই। দোকানদারকেই নিজের হাতে বাছাই করার ভার দিলে, সে খারাপ জিনিস দিতে পারেনা। (দু-একটা অতি-পাজী ছাড়া।) মানুষকে অবিশ্বাস করলে যত ঠকতে হয়, বিশ্বাস করলে ঠকতে হয় তার চেয়ে অনেক কম।

সেদিন তো চ’লে গেলুম। পরদিন আমি আবার বাজারে এসেছি, মেয়েটির কথা আমার মনে নেই, হঠাৎ শুনতে পেলাম, ও বাবু, সীম লেবেনি?

তাকিয়ে দেখলাম সেই মেয়েটি। সে আমাকে মনে রেখেছে। জিজ্ঞেস করল, কি, কালকের সীম ভালো ছিল? আমার নিজের গাছের সীম।

যেরকমভাবে মেয়েদের রূপের প্রশংসা করতে হয়, সেই গলায় আমি বললাম, খুব ভালো। কত নরম আর কত কচি। চমৎকার স্বাদ। কিন্তু আজ তো আর নেবনা! কালকেরটা এখনও ফুরয়নি। তুমি বরং আজ আমাকে এক কিলো বেগুন দাও।

মেয়েটি বলল, না, বেগুন নিওনা।

-কেন? বেগুন নেবনা কেন?

–না, ও-বেগুন ভালো নয়।

–তোমার ওগুলো কি আগেই বিক্রী হয়ে গেছে নাকি?

মেয়েটি ঝংকার দিয়ে বলল, তুমি কিরকম ভালোমানুষের ছেলে গো? দেখছনি, বেগুনগুলোতে পোকা লেগেছে?

আজ আমি হাসলাম। বললাম, আজ তোমার ভালো কী আছে?

—আর কিছু নেই! ঐ-সীমই আছে।

—দাও, তাই-ই দাও আধ কিলো—

আমার তখন সদ্য গোঁফ উঠেছে, ফুল প্যান্ট পরি। বাজারে যাবার ব্যাপারে আমার একটা অতিরিক্ত আগ্রহ জ’ন্মে গেলো। সেই মেয়েটির সঙ্গে দেখা হবে, দুটো কথা ও একটু হাসি। সেই বয়সের প্রেমে এর চেয়ে আর বেশি কি চাই? মেয়েটি আমার জন্য ভালো-ভালো তরিতরকারি বেছে রাখে, কোনদিন আমি দেরি ক’রে গেলে মৃদু বকুনি দেয়। আমার দরকার নেই—এমন তরকারিও সে জোর ক’রে গছিয়ে দেয় আমাকে। যেমন এই নারকোলটা তোমার জন্যে আলাদা ক’রে রেখে দিয়েছি—কত খদ্দের এসে ফিরে গেছে, দিইনি!

কোথাও কেউ আমার জন্য প্রতীক্ষা ক’রে আছে, এই ব্যাপারটাই মনে শিহরণ আনে। প্রেমের মূল লক্ষণও তো এটাই, না? সে তার সাধ্যমতন আমাকে দিলে, তার বাগানের সেরা ফসল, আমি বিনা দ্বিধায় নিয়ে নিচ্ছি, কেউ কোনদিন ঠকিনি।

আমি দু-একদিন বাজারে না-গেলে (বিশেষ ক’রে মাসের শেষ দিকে)—সে আমাকে জিজ্ঞেস করত। তারপর আমিই আর তাকে পরপর বেশ কয়েকদিন দেখতে পেলামনা। রীতিমতন চিন্তিত হয়ে উঠলাম। বাজার করতে আর ভালো লাগেনা।

আট-দশ দিন বাদে মেয়েটিকে আবার দেখলাম। সেই পুরোনো জায়গাতেই ব’সে আছে, পাশে একটি তেরো-চোদ্দ বছরের ছেলে। জিজ্ঞেস করলাম, এই ক’দিন আসনি কেন?

সে এক গাল হেসে বলল, তার স্বামীর অসুখ হয়েছিল। স্বামীর অসুখটা মোটেই হাসির ব্যাপার নয়, বোধহয় স্বামী আবার সেরে উঠেছে ব’লেই ঐ হাসি। তারপর হানলো আমার বুকে শক্তিশেল।

মেয়েটি বলল, সে আর এখন থেকে রোজ আসতে পারবেনা। তার বড়ো ছেলে আসবে, আমি যেন অবশ্য অবশ্য তার ছেলের কাছ থেকে কিনি। বাজারের সেরা জিনিস এখানে পাওয়া যাবে, ইত্যাদি। মেয়েটি বিবাহিতা, এটা খুব অপ্রত্যাশিত নয়। আমার ধারণা ছিল, ওর বয়েস কুড়ি-বাইশ তার থেকে কিছু বেশি হ’লেও সহ্য করা যায়। কিন্তু অত বড়ো ছেলে এবং ‘বড়ো ছেলে’—অর্থাৎ আরও ছেলেমেয়ে আছে। এটা টু মাচ! তারপর থেকে আমি ঐ-বাজারের বদলে অন্য বাজারে যাই।

তবুও এটাকে প্রেমের কাহিনীই বলব। প্রথম প্রেমে এরকম মোহভঙ্গ অনেকেরই হয়।

অনেকদিন বাদে অনিমেষের সঙ্গে দেখা। জিজ্ঞেস করলাম, কি রে কেমন আছিস? অনিমেষ চোখ-মুখ উদ্ভাসিত ক’রে হাসল। রীতিমতন উল্লাসের সঙ্গে বলল, বেশ ভালো আছি ভাই! দারুণ আছি!

একটু চমকে যেতে হয়। এই ডামাডোলের বাজারে কেউ খুব ভালো আছে, এটা বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়না। তাছাড়া কেউ একটু ভালো থাকলেও মুখে সে—কথা বলবে কেন?

আমাকে আর কিছু বলতে না-দিয়েই অনিমেষ আমার কাঁধে চাপড় মেরে বলল, বহুদিন পর দেখা হ’ল তুই কেমন আছিস বল?

আমি ওর মতন উল্লাস দেখাতে পারলুমনা! ঠোট ফাঁক ক’রে একটু হাসির অভিনয় করলুম।

অনিমেষ বিদ্রূপ ক’রে বললো কি রে, তুই এরকম মুখ-আমসি ক’রে রয়েছিস কেন? চল, চা-ফা খাওয়া যাক!

একটা বেশ বড়ো দোকানে ঢুকে অনিমেষ বলল, কী খাবি বল?

—শুধু চা!

—লিভারের বারোটা বাজাতে চাস? শুধু চা খেয়ে-খেয়েই তো জাতটা গেল। মাংস খাবি, বুঝেছিস, মাংস!

আমার কোন আপত্তি শুনলনা অনিমেষ, একগাদা খাবারের অর্ডার দিল। বিরিয়ানি, ফাউলকারি, শাম্মি কাবাব—

কলেজে পড়ার সময় অনিমেষ রীতিমত কৃপণই ছিল। বন্ধুবান্ধবদের পয়সায় চা খেতে ছিল ওস্তাদ। সিগারেট তো কক্ষনো কিনতনা, চিরকাল পরস্মৈপদী। একসময় আমি আর অনিমেষ এক পাড়ায় থাকতাম, কলেজ থেকে ফেরার পথে একসঙ্গে বাসে উঠলে অনিমেষ কিছুতেই ভাড়া দিতনা, পকেটে হাত ঢুকিয়ে খুচরো পয়সা নিয়ে রুনুঝুনু শব্দ করত, বার করতনা। আর সেই অনিমেষের এ—ধরনের পরিবর্তনে খুশি হবারই কথা।

ফাউল কারি চাখতে চাখতে হঠাৎ সন্দেহ হ’ল, ছেলেটা ব্ল্যাক মার্কেট—ফার্কেট করছেনা তো? দিন-দিন সবার অবস্থা খারাপ হচ্ছে, ওর এ-ধরনের উন্নতি হয় কি ক’রে? একটু ঈর্ষাও বোধ হ’ল, সেই সঙ্গে ফাউল কারিও জিভে তেতো মনে হ’ল। মুর্গীর ঠ্যাংটা নামিয়ে রেখে জিজ্ঞেস করলাম, খুব বড়োলোক হয়েছিস মনে হচ্ছে? কী চাকরি করছিস এখন?

—আপাতত কিছু চাকরি করছিনা।

—তাহ’লে ব্যবসা করছিস? আজকাল তো ব্যবসাতেও তেমন লাভ হয়না শুনি?

অনিমেষ একগাল হেসে বলল হ্যাঁ, ব্যবসা-ট্যাবসা করলে মন্দ হয়না। আমার গত মাসে চাকরি গেছে—ভাবছি এবার কী করা যায়!

—চাকরি গেছে? কেন?

–আমার কোন দোষে না ভাই। কোম্পানি উঠে গেল!

চাকরি যাওয়াটা কি একটা হাসির খবর? অনিমেষ এরকম উপভোগ ক’রে খাচ্ছেই বা কী করে, হাসিই-বা আসে কোথা থেকে?

অনিমেষ আরাম ক’রে মুর্গীর মাংস গলাধঃকরণ করতে-করতে জিজ্ঞেস করল, বিয়ে-থা করেছিস? না কি সেইরকম পাগলই রয়ে গেলি?

—তুই বিয়ে করেছিস নাকি?

—অনেকদিন, ছ-সাত বছর! তোকে নেমন্তন্ন করতে পারিনি। ধ’রে নে, আজ সেই নেমন্তন্ন খাওয়াচ্ছি।

—ছেলেমেয়ে হয়েছে?

–হয়নি মানে! তিন-তিনটে, দুটো মেয়ে একটা ছেলে—

—কী নাম রাখলি ছেলেমেয়ের?

—ছেলে তার নাম রাখার সুযোগই দেয়নি! মুখে-ভাতের আগেই মারা গেছে মেয়ে দুটোর নাম আন্না আর চান্না—তার মধ্যে চান্না বড্ড অসুখে ভোগে—বেশিদিন বাঁচবেনা বোধহয়, ঢেঁশে যাবে!

এবার অনিমেষের দিকে সরু চোখে তাকাতে হ’ল। ছেলেটার মাথা টাথা খারাপ হয়নি তো! নিজের সন্তান বিষয়ে কেউ এরকম নিষ্ঠুরের মতন কথা বলতে পারে! এখনও দিব্যি খেয়ে যাচ্ছে—সেটা পর্যন্ত থামায়নি।

—অনিমেষ, কী ব্যাপার বল তো? ছেলেমেয়ে সম্পর্কে তোর একটুও মায়া নেই?

–কে বললে মায়া নেই! ছেলেটা যখন মরল, কেঁদে ভাসিয়েছিলাম। চান্না ম’রে গেলেও কাঁদব, নিশ্চয়ই কাঁদব। কিন্তু ব্রাদার শুধু দয়া-মায়া দিয়ে তো আর বাঁচানো যায়না! যখন বেবি ফুডের খুব অভাব ছিল, নিজে লাইনে দাঁড়িয়ে কিনেছি, ব্ল্যাক মার্কেট থেকে বেশি দাম দিয়ে কিনেছি। সাধ্যমতন ডাক্তারও ডেকেছি। ডাক্তার ডাকলেই বা কী হবে। ডাক্তাররা যেসব ওষুধ লিখে দেয় প্রায় দোকানেই সেগুলো পাওয়া যায়না।— ঘুরে-ঘুরে সেগুলোও যোগাড় করি—এর পরেও যদি না-বাঁচে, কাণ্ট হেল্প!

-কোথায় থাকিস এখন?

—আজ পর্যন্ত তো ভবানীপুরে আছি। কাল কোথায় থাকব, তা জানিনা।

—তার মানে?

—বাড়িওয়ালা যদি তাড়িয়ে দেয়, তার দোষ দেওয়া যাবেনা। ভাড়া দিইনা। আমি মামলা-ফামলা করবনা, যেদিন গলাধাক্কা দেবে, বেরিয়ে যাব। আর কী খাবি বল! পুডিং?

—আর কিছু খাবনা! শোন অনিমেষ—

—তুই কী একঘেয়ে বাড়ি-ফাড়ির কথা জিজ্ঞেস করতে আরম্ভ করলি! কদ্দিন বাদে তোর সঙ্গে দেখা হ’ল, কোথায় দুটো রসের গল্প করব। হ্যাঁ রে, আমাদের সঙ্গে যে সুরূপা ব’লে মেয়েটা পড়ত তাঁর সঙ্গে তোর আর দেখা-টেখা হয়? কোথায় আছে, জানিস?

—কী জানি, খবর রাখিনা!

-বাজে কথা ছাড়! তোর বেশ উইকনেস ছিল ওর সম্পর্কে। আমারও ছিল, তবে তোর সঙ্গে কমপিটিশন হবে ব’লে—

-এসব বাজে কথা ছাড়! তোর কী হয়েছে, সত্যি ক’রে বল তো অনিমেষ?

—কী আবার হবে? কিচ্ছুনা! তুই আমার দিকে ওরকমভাবে তাকাচ্ছিস কেন?

–না, তুই আমাকে সব খুলে বল—

অনিমেষ হো-হো ক’রে হেসে উঠল। হাসির দমকে সারা শরীর কেঁপে উঠল ওর। তারপর বলল, তুই কি ভাবছিস, আমি পাগল-টাগল হয়ে গেছি! কি রে! কী করেছি আমি?

–না, মানে যা শুনেছি, তাতে তোর অবস্থা বিশেষ ভালো ব’লে মনে হচ্ছেনা! তুই হঠাৎ এরকম টাকা খরচ করছিস—

—তুই খুব লাকি। আজ বাইচান্স তোর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল! আজ আমার পুরোনো অফিস থেকে প্রভিডেন্ট ফাণ্ডের টাকাগুলো পেয়ে গেলাম। করকরে সাতশো টাকা—

কথাটা শুনে আমি বেশ দ’মে গেলাম। যার চাকরি গেছে, তার শেষ সম্বল এই সাতশো টাকা থেকে একটি পয়সাও বাজে খরচ করা উচিত নয়। আমি বললাম, অনিমেষ, আমার বিশেষ অনুরোধ, আজকের বিলটা আমরা ভাগাভাগি ক’রে দেব। আমার কাছে বিশেষ কিছু নেই, যা আছে—

অনিমেষ হাত নেড়ে আমার কথাটা উড়িয়ে দিয়ে বলল, ওসব ছাড়! আজ আমার আছে, আমি খরচ করব। তুই কি ভাবছিস, আমি বাড়ির লোককে ফাঁকি দিয়ে একা-একা খাচ্ছি! পাগল আজ বাড়ি ফেরার সময় জোড়া মুর্গী নিয়ে যাব!

-তারপর টাকা ফুরিয়ে গেলে?

—তখন দেখা যাবে! তুই ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবিস এখনও? তুই দেখছি আচ্ছা গাধা!

–এই অবস্থায় তুই হাসছিস কী ক’রে?

হাসবনা? মরার সময় তো হাসতে পারবনা, তাই যেটুকু সময় বেঁচে আছি, নষ্ট করা কেন? ফুর্তি ক’রে নেওয়া যাক্। হেসে নাও, দুদিন বৈ তো নয়।

আমি কোন কথা বললুমনা। চুপ ক’রে ব’সে রইলুম।

আমি ছেলেটিকে বললুম যাও, যাও, কিছু হবে না। ছেলেটি তবু দাঁড়িয়ে রইল। আমি ফের ধমকে উঠলুম, বলছি তো কিছু হবেনা। কেন বিরক্ত করছ? অন্য জায়গায় যাও।

ছেলেটি বকুনি খেয়েও নড়েনা, ধ্যাতা বেড়ালের মতন দাঁড়িয়ে থাকে। আমি খুবই বিরক্ত হয়ে তাকে আরও প্রচণ্ড ধমক লাগাতে যাচ্ছিলুম, সে তখন আদুরে—আদুরে গলায় বলল, আমাকে দিদিমণি দেবেন, দিদিমণি আমাকে রোজ দ্যান।

সুপর্ণা যে তখন ব্যাগ খুলে খুচরো পয়সা খুঁজছে, লক্ষ করিনি। আমাকে চুপ ক’রে যেতে হ’ল। সুপর্ণার হ্যাণ্ডব্যাগের ভেতর থেকে বেরুল আর-একটা ছোঁটো ব্যাগ, তার এক খোপ থেকে একটা পাঁচ পয়সা দুই লীলায়িত আঙুলে তুলে ভিখারী ছেলেটিকে দিয়ে মিষ্টি হেসে বলল, এবার যাও!

আমি বক্র হেসে ছেলেটিকে বললাম, যাও, এবার আর-একজনকে পাঠিয়ে দাও।

সুপর্ণা বলল, আর কেউ এলে দেবনা। এই ছেলেটা রোজ আমার কাছ থেকে পাঁচ পয়সা নেবেই, কিছুতেই ছাড়বেনা।

আমি বললাম, তুমি শুধু ওকেই ভিক্ষে দাও, আর কারুকে দাওনা। তোমার এই পক্ষপাতিত্ব কেন?

— যখন বেশি খুচরো থাকে তখন অন্যদেরও দিই। দেওয়াই তো উচিত সবার। সবসময় অবশ্য পারা যায়না।

বহুক্ষণ সুপর্ণার সঙ্গে বাস স্টপে দাঁড়িয়ে আছি। রাস্তা ফাঁকা। মনে হচ্ছে যেন ট্রাম-বাসেরা এ-রাস্তার কথা ভুলেই গেছে। কিংবা হঠাৎ বাস-ট্রাম ধর্মঘট শুরু হয়ে গেছে কিনা কে জানে!

সুপর্ণা জিজ্ঞেস করল, আপনি ও-ছেলেটাকে ওরকম ধমকালেন কেন? ও তো কোন দোষ করেনি, শুধু ভিক্ষে চাইছিল।

—আমি কমপিটিশন সহ্য করতে পারিনা।

—কি? তার মানে?

—কিছুনা। এ-কথা এখন থাক্।

বাসের জন্য অপেক্ষা করতে-করতে অধৈর্য হয়ে পড়েছি। মেজাজ ঠিক থাকছেনা। ভিখারি বালক নিয়ে আলোচনা করার উৎসাহ নেই। সুপর্ণা কিন্তু মুখে বেশ মিষ্টি হাসিটা ফুটিয়ে রেখেছে। পড়ন্ত বিকেলের আলোয় ওকে ওর নিজের চেহারার চেয়েও বেশি সুন্দর দেখাচ্ছে এখন।

সুপর্ণা বলল, গরীব দুঃখীদের সঙ্গে যদি কেউ নিষ্ঠুর ব্যবহার করে তাহ’লে আমার খুব খারাপ লাগে। এমনিতেই তো সবসময় নিজেকে স্বার্থপর মনে হয়। আমি খেতে পাচ্ছি, থাকার জায়গা পেয়েছি, ইচ্ছেমতন শাড়ি-টাড়ি কিনতে পারি —আর কত হাজার-হাজার মানুষ এখনও দুবেলা খেতে পায়না—

আমি মুগ্ধভাবে তাকিয়ে বললুম এইজন্যই তো তোমাকে আমার এত বেশি ভালো লাগে। তোমার মনটা একেবারে হীরের টুকরো—

—যাঃ। এ তো খুব সাধারণ কথা। কিন্তু আপনি যে আজ ছেলেটার সঙ্গে ওরকম ব্যবহার করলেন, তাতে আমি অবাক হয়ে গেছি।

–কেন?

—নিষ্ঠুরতা আপনাকে মানায়না।

—আমাকে কোন্ ভূমিকায় মানায়?

—আপনিই একদিন অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসের সামনে একটা বুড়ো ভিখারিকে এক সঙ্গে অনেকগুলো খুচরো পয়সা দিয়ে দিয়েছিলেন।

আমি অবাক হয়ে বললাম, যাঃ। কবে? মোটেইনা।

—হ্যাঁ, দিয়েছিলেন।

—হতেই পারেনা।

আমার ঠিক মনে আছে। মাস দেড়েক আগে। সেদিনও আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম।

একটু-একটু যেন মনে পড়ল। বললাম, তা হতেও পারে। বুড়োটা গাছতলায় দাঁড়িয়েছিল হাত পেতে। কারুর কাছ থেকে কিছু চায়নি। শুধু হাতখানা বাড়ানো ছিল—তার মুখখানা আঁকিবুকিতে ভরা-পুরনো দলিলের মতন হয়েছিল, একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম।

–সেদিন মায়া হয়েছিল, আর আজ…

—সুপর্ণা, আমাকে কি প্রত্যেকদিন এক ভূমিকায় মানায়? আমি তো সাধারণ মানুষ। মহৎ মানুষেরাই অনবরত দয়ালু হয়। আমি তো নই, আমার শরীরে খানিকটা দয়ামায়া আছে বটে, আবার রাগ ঈর্ষা, বিরক্তি—এসবও আছে। আমি কখন সামান্য দুঃখে অভিভূত হয়ে পড়ি, কখন কঠোর নির্মম হতেই আমার ভালো লাগে। একই মানুষ বিভিন্ন পটভূমিকায় বিভিন্নরকম।

—আপনি বড্ড বড়ো-বড়ো কথা বলছেন। আমি যা বললুম, তার সঙ্গে এর সম্পর্ক কী? দীন দুঃখীদের সাধ্যমতন দু-চারটে পয়সা দিতে সবারই ভালো লাগে—

—চলো বাস এসে গেছে।

এ-বাসে বড্ড ভিড়। এটাতে উঠবনা।

–তাহ’লে হেঁটেই যাওয়া যাক। কিংবা ট্যাক্সিতে উঠবে?

—ট্যাক্সি? একটু আগে আপনি একটা ভিখিরিকে দুটো পয়সা দেননি—এখন ট্যাক্সিতে যেতে চাইছেন!

—আরেঃ যাঃ। তুমি খালি ঐ ভিখিরি ছেলেটার কথা তুলছ কেন?

-ভিখিরিদের কেউ মুখঝামটা দিলে আমার বড্ড কষ্ট হয়। ঐ-ছেলেটিকে দেখে আপনার মায়া হ’লনা?

-না?

না! কিরকম করুণ আর মিষ্টি মুখটা—ওকে দেখে আপনার মায়া হ’লোনা? না। কারণ পাশাপাশি দুজন ভিখিরি থাকলে একজন আর-একজনকে সহ্য করতে পারেনা। ওর সঙ্গে আমার বিরাট প্রতিযোগিতা—আমি তো চেষ্টা করবই ওকে হটিয়ে দিতে।

-এ আবার কী কথা?

—ও চাইছিল দু-চারটে পয়সা, আর আমি তোমার করুণার ভিখারি। তোমার একটু কৃপা পাবার জন্য—আমি কতক্ষণ ধ’রে ঠায় দাঁড়িয়ে আছি। তুমি আমার দিকে চেয়ে যদি একটু হেসে—

সুপর্ণা কুলকুল ক’রে হাসল। তবে এ-হাসি অন্যরকম। আমি ঠিক এর কথা বলিনি, এর মধ্যে খানিকটা ঠাট্টা মিশে আছে। বলল, যাঃ, আপনি যে কী পাগলের মতো উল্টোপাল্টা বলেন?

আমি বললাম, আজ ঐ ভিখির ছেলেটাই জিতে গেছে। ও শুধু তোমার কাছ থেকে পয়সাই পায়নি—ও তোমার মনোযোগও পেয়েছে। তুমি সর্বক্ষণ ওর কথাই বলছ।

—আপনার জন্যই তো। আপনি যদি ওকে দু-চারটে পয়সা দিয়ে বিদায় করতেন, ও আর দাঁড়াতনা। এ নিয়ে কোন কথাই বলতনা।

আমি বললাম, আমার কী রকম লজ্জা করে।

-লজ্জা করে মানে?

—লজ্জা করে তো কী করব? অধিকাংশ লোকই ভিখিরিকে ভিক্ষে দেয় —তার প্রতি মায়াবশত নয়। তাকে বিদায় করবার জন্য। ভিখিরিরা পাশে দাঁড়িয়ে ঘ্যান-ঘ্যান করে—তাদের তাড়াতাড়ি বিদায় করার জন্য দু-চারটে পয়সা দিতে হয়। সেরকম দিতে আমার লজ্জা করে। একটা মানুষের আত্মাকে অবহেলা করতে কিংবা অপমান করতে আমার লজ্জা হয়। কিংবা ধরো, কখন কোন ভিখিরিকে দেখে মনটা উদার হয়ে গেল, পকেট থেকে খুচরো পয়সা তুলে তাকে দিয়ে দিলাম—সে আমাকে আশীর্বাদ করল। সেই আশীর্বাদটা পেয়ে আমার লজ্জা হয়। মনে হয়, ওটা আমার প্রাপ্য নয়। আমি তো সত্যিই দাতা নই!

—বাবারে বাবা! ভিখিরিকে দুটো পয়সা দেবেন, তার জন্য আবার এত কথা! এর জন্য এত ভাবতে হবে কেন?

–সেই তো, তার থেকে না-দিলেই চুকে যায়।

—আসলে আপনি কিপ্টে, সেই কথা বলুন!

-কে বলেছে কিপ্টে! চলো, তুমি কোন্ রেস্টুরেন্টে খাবে—তোমাকে সেখানে ট্যাক্সিতে—

দর্পিত ভ্রূভঙ্গি ক’রে সুপর্ণা বলল, মোটেই আমি যাবনা কোথাও! শুধু-শুধু ঐভাবে পয়সা নষ্ট করা—আর কত মানুষ খেতে পাচ্ছেনা, কত মানুষ ফুটপাথে…

সুপর্ণা যে পার্ক স্ট্রিটের রেস্তরাঁয় খেতে ভালবাসেনা, তা নয়। ট্যাক্সি চড়তেও পছন্দ করে। অন্য মেয়েদের মতোই। কিন্তু আজ কথা প্রসঙ্গে সে মানুষের দুঃখ—দুর্দশায় বড়ো কাতর হয়ে পড়েছে, এত কাতরতার ছায়ায় তার মুখখানি উদ্ভাসিত। এখন তার সৌন্দর্য অন্যরকম। এটা দেখার জন্যই আমি ওকে খোঁচাচ্ছিলুম। মানুষের দুঃখ-দুর্দশা দূর করার জন্য কেউই সঠিক পথে ভাবছেননা মনে হয় -প্রায় সকলেই শৌখিন মনে হয়। তবু, কখন-কখন মুখে এই কাতরতার ছায়া দেখাতে ভালো লাগে।

আমি বললুম এসো, তাহ’লে আজ সন্ধেটা অন্যভাবে কাটানো যাক। আমার কাছে টাকা দশেক আছে আর তোমার কাছে যা আছে, সব মিলিয়ে খুচরো ক’রে রাস্তার সব ভিখিরিদের বেলানো যাক।

সুপর্ণার মুখে তখনও হাসি ফিরে আসেনি। সন্দেহের সঙ্গে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি বুঝি এটাকে এখনও ঠাট্টা মনে করছেন?

আমি বললুম, না, ঠাট্টা নয়। আমি জানি এতে একজনেরও খিদে মেটানো যাবেনা। কিন্তু এক সন্ধের জন্য আমরাও ভিখিরি হয়ে যাই। আমি তো জন্মভিখারি, আমার কাছে এর নতুনত্ব খুব নেই, কিন্তু তোমাকে ভিখারিনী হিসেবে কেমন মানায়—সেটা দেখতে ইচ্ছে করছে।

চায়ের দোকানে তুমুল আড্ডা চালাচ্ছিলুম, হঠাৎ লক্ষ করলুম, দোকানের একটি · বেয়ারা অনেকক্ষণ ধ’রে আমাদের টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। শঙ্কিত হয়ে উঠলুম, মনে-মনে। নিশ্চয়ই আমাদের উঠে যাবার নোটিশ দিতে এসেছে।

আমরা ছজনে মিলে চার কাপ চা অর্ডার দিই, দুটো ফল্স কাপ চেয়ে নিই! তাতেই ঘণ্টা-দেড়েক চালাবার পর দোকানের মালিক তাড়া দিলে, আবার অর্ডার · দিই দু-কাপ চা। আবার ঘণ্টাখানেক। আড্ডার সময় যে কী ক’রে ডানা মেলে উড়ে যায়, কে জানে।

আমরা বসি দোকানের একেবারে শেষের দিকের কোণের টেবিলে। মালিকের চোখ থেকে যত দূরে সম্ভব। মালিক অবশ্য অমায়িক, আমাদের মুখে কিছু বলেনা, বরং চোখাচোখি হলেই একপ্রকার দেখন-হাসি ছুঁড়ে দেয়, তবে, বেয়ারার হাত দিয়ে পাঠিয়ে দেয় বিল।

আমাদের গণ্ডারের চামড়া। বেয়ারা পাশে এসে দাঁড়ালেও আমরা না-দেখার ভান করি, এমনকি চক্ষুলজ্জার মাথা খেয়ে ব’লে ফেলি, দেখি ভাই, এক গেলাস জল! আড্ডা মাঝপথে ভেঙে উঠে যাওয়া, আর খাবার টেবিল থেকে আধপেটা খেয়ে চ’লে যাওয়া একই কথা।

তবে, আমাদের আজকালকার আড্ডায় দু-একটি মেয়ে এসে যোগ দিয়েছে, তাদের মান-সম্মানবোধ বড্ড আবার প্রবল। মেয়েরা ঠিক এখনও আড্ডার মর্ম বুঝলনা। কিংবা সেরকম আড্ডাবাজ মেয়েকে আমরা এখনও দেখিনি!

বেয়ারাটি অনেকক্ষণ ধ’রে দাঁড়িয়ে আছে, আমরা না-দেখার ভান করছি, নন্দিতা বলল, এই, তোমরা চা খাবে তো আবার বলো! শুধু-শুধু কতক্ষণ আর-!

আজ আট কাপ চা নিয়েছি, তার ওপর আবার বাবুয়ানি ক’রে সিঙ্গাড়া খাওয়া হয়েছে, যার এক-একটার দাম কুড়ি পয়সা! পয়সা কোথায় আর, পকেট ঢন্‌ঢন্—! নন্দিতাকে বললাম, আরও চা খাব, তুই পয়সা দিবি?

নন্দিতা বলল, বারে, আমার যা ছিল সবই তো দিয়ে দিলাম।

অভিজিৎ রঙ্গ ক’রে বলল, তোর যা ছিল, তা কি এত সহজেই ফুরিয়ে যায়? ব্যাগটা বার কর, আরও কিছু ছাড়!

নন্দিতার কাছে সত্যিই আর পয়সা নেই। বাধ্য হয়েই আমি বিরস মুখে বেয়ারাটিকে বললুম, আর কিছু খাবনা, বিল নিয়ে এসো। চোখ রেখেছিলুম কুমকুমের দিকে। কুমকুমের সঙ্গে নতুন আলাপ, ওর কাছে মুখ ফুটে চাইতে পারিনা। তবে, কুমকুমের কাছে পয়সা আছে নিশ্চয়ই যতদূর জানি, কুমকুমের সহজে ফুরোয়না!

কুমকুম স্মিত হেসে বলল, আরও চা খাবে তো ব’লে দাওনা। আমার কাছে পয়সা আছে কিছু।

এবার আমি নবাবী স্টাইলে ঢালাও অর্ডার দিতে যাচ্ছিলুম, কিন্তু আমাকে অবাক ক’রে বিনীতভাবে বেয়ারাটি বলল, আমি স্যার, আপনাদের তাড়া দিতে আসিনি। আমি আপনাদের কথা শুনছিলুম!

আমরা সবাই হাঁ ক’রে তাকালুম বেয়ারাটির দিকে। আমাদেরই বয়েসী একটি ছোকরা, একে আগে বিশেষ দেখিনি, বোধহয় নতুন এসেছে। কিন্তু কাস্টমারদের কথা তো কোন বেয়ারার পক্ষে শোনা উচিত নয়, শুনলেও সেটা মুখে প্রকাশ করবে কেন?

ছেলেটি আবার নম্রভাবে বলল, আপনারা সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করছিলেন তো, আমার শুনতে খুব ভালো লাগছিল। আমিও একজন লেখক, আমার বই আছে। কারুর সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলতে পারিনা—!

আমরা টেবিলের সবাই পরস্পর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলুম। এ-যে রূপকথার মতন। কিংবা বিলেত-টিলেত। কোন বিখ্যাত লেখক, কিংবা এখন উদীয়মান; পরে বিখ্যাত হবে এমন লেখক চায়ের দোকানের বেয়ারার ছদ্মবেশে আছে। জীবন থেকে অভিজ্ঞতা সংগ্রহ করছে। চমৎকৃত হবার মতনই ব্যাপার।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, তোমার নাম কি ভাই?

—সাধনকুমার দাস।

অভিজিৎ আমাকে বলল, এই নীলে, স’রে বোস্ ওকে বসতে দে। তুমি ব’সো ভাই আমাদের সঙ্গে। তোমার সঙ্গে গল্প করি। আমাদের মধ্যে লেখক কেউ নেই, আমরা শুধু আলোচনাই করি—এক ঐ নীলেটা মাঝে-মাঝে দু-একটা রাবিশ লেখে, সম্পাদকদের তেল দিয়ে কাগজে ছাপায়—তোমার মতন একজন সত্যিকারের লেখককে যখন পাওয়া গেছে—

বিলেতে-টিলেতে এই অবস্থায় বেয়ারার ছদ্মবেশী লেখক নিশ্চয়ই আমাদের মতন লোকের সঙ্গে এক টেবিলে আড্ডায় ব’সে পড়ত—কিন্তু এখানে অন্য ব্যাপার। দোকানের মালিক যদিও এখন কাউন্টারে নেই, বোধহয় বাইরে গেছে, দোকানেও আর খদ্দের বিশেষ নেই—তবু আমাদের সঙ্গে বসার প্রস্তাবে ছেলেটি কুঁকড়ে উঠল একেবারে! সারা শরীর মুচড়িয়ে বিগলিত লাজুক হাস্যে বলতে লাগল, না না, বসব কি আপনাদের সঙ্গে। কী যে বলেন, আমি কি তার যোগ্য হেঁ-হেঁ—

ছেলেটি দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়েই কথা বলতে লাগল আমাদের সঙ্গে।

নন্দিতা আর কুমকুম বিস্ময়ের সঙ্গে দেখছে ছেলেটিকে। এতক্ষণ ওরা চুটিয়ে আমার লেখার নিন্দে করছিল। আমার লেখার নিন্দে ক’রে ওরা অনবদ্য আনন্দ পায়, আমিও পাই। এখন ওরা দেখছে একজন সত্যিকারের লেখককে।

গায়ের রং মাজা-মাজা, দোহারা চেহারা, মাথর চুল কোঁকড়া, তবে সব মিলিয়ে তাকে রেস্টুরেন্টের বেয়ারা হিসেবে বেমানান দেখায়না, ছদ্মবেশ ধরলেও ঠিক তা বোঝা যাচ্ছেনা।

শরৎ জিজ্ঞেস করল, তুমি বই লিখেছ বললে, কী নাম তোমার বইয়ের? আছে এখানে?

কাল আসবেন আপনারা? কাল দেখাব। আমার বইয়ের নাম, ‘নদীর মায়া’। আমরা ভেবেছিলাম, পনেরো-কুড়ি পাতার লিফলেট জাতীয় কোন বই হবে। কিন্তু ছেলেটি বলল, তার বইখানি রীতিমতন একটি উপন্যাস, একশো পনেরো পৃষ্ঠা, শক্ত মলাটে বাঁধানো, দাম তিন টাকা

যদিও সাধনকুমার দাস রচিত ‘নদীর মায়া’ নামের কোন উপন্যাসের নাম `আমরা কখন শুনিনি, কিন্তু তাতে কিছু যায় আসেনা! কে না জানে, বাংলাদেশের সম্পাদক-প্রকাশক মহলে রীতিমতন একটা র‍্যাকেট আছে, কিছুতেই তারা নতুন লেখকদের কোন সুযোগ দেয়না—আমি নিজেই তো একজন ভুক্তভোগী! আজকাল যেমন নতুন চাকরিতে ঢুকতে হ’লেও পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা চাই, তেমনি লেখক হতে হ’লেও আগে বিখ্যাত হতে হবে, তারপর লেখা ছাপানো। তাই আমাদের সবসময়ই মনে হয়, কোন বিরাট সম্ভাবনাময় প্রতিভাবান লেখক অবজ্ঞাত হয়ে চাপা প’ড়ে আছে।

অভিজিৎ জিজ্ঞেশ করল, তোমাকে তো ভাই আগে এখানে দেখিনি মনে হচ্ছে। আগে কোথায় ছিলে?

সাধনকুমার জানাল যে, সে আগেও দু-তিনটে দোকানে এই কাজ করেছে! চার বছর ধ’রে এই কাজে আছে, তবে আশা আছে, একদিন সে ঐ-কাজ ছেড়ে দিতে পারবে।

—এখনও লেখো তুমি?

—হ্যাঁ, যখনই সময় পাই একটু-একটু লিখি।

–তোমার বাড়ি কোথায়?

সাধন জানাল যে তার বাড়ি হুগলী জেলার একটি গ্রামে। ওঁর বাবা সেই গ্রামেই একজন পিওন। ওরা অনেকগুলি ভাইবোন, একবোন বিধবা। সাধন গ্রামের স্কুলে ক্লাস নাইন পর্যন্ত পড়েছে, তারপর আর পড়ার খরচ চালাতে পারেনি। খুব ইচ্ছে ছিল লেখাপড়া শেখার, তবে এখনও কোনও বই পেলেই পড়ে।

আমাদের আড্ডার মহিলা সদস্যাদ্বয়ের চোখ প্রায় সজল হয়ে এসেছে ওর দুঃখের কথা শুনে। আমাদের মনে হ’ল, এই দুঃখের অভিজ্ঞতা ওর লেখকজীবনকে সমৃদ্ধ করবে। পরের দিন ওর বইখানা দেখবার জন্য উন্মুখ হয়ে রইলাম। যে—আছে মাটির কাছাকাছি, সেইরকম একজন লোককে আমরা আবিষ্কার করতে চলেছি। লজ্জায় সেদিন আমরা বিল মেটাবার পর সাধনকে টিপ্স দিতে পারলামনা।

পরদিন আমরা এসে বসার পরই সাধন এসে তার বইখানা দেখাল। সত্যিই শক্ত মলাটে বাঁধানো একখানা বটতলায় ছাপা উপন্যাস। প্রকাশক সাধন নিজেই। মলাটে কাঠের ব্লকে এক নদীর তীরে হৃষ্টপুষ্ট চেহারার, মালকোচা মেরে ধুতি পরা যুবক ও এক কলসী কাঁখে যুবতীর ছবি।

সাধনের অন্য কোন উদ্দেশ্য নেই অবশ্য। কেননা, ওর ঐ-বইখানার জন্য আমরা দাম দিতে চাইলাম, ও কিছুতেই নিলনা। অত্যন্ত বিনীতভাবে বলল, অনেক কষ্ট ক’রে টাকা জমিয়ে বইটা ছাপিয়েছি, আপনারা যদি প’ড়ে এতটু মতাতমত জানান, তাহ’লেই আমি কৃতার্থ হব। সাধন বেশ শুদ্ধ ভাষায় কথা বলে!

বইখানা খানিকটা উল্টেপাল্টে আমরা সবাই একটা জরুরী কাজ আছে ব’লে সেদিনকার মতন উঠে পড়লাম। বাইরে বেরিয়ে আমরা ঠিক সমস্বরে হেসে উঠিনি, বরং দুঃখিতই বোধ করেছি।

ঐ চায়ের দোকানে আড্ডাটা আমাদের ছাড়তে হবে। সাধনকুমারের মুখোমুখি আর হওয়া আমাদের পক্ষে অসম্ভব। বইখানা অতিশয়ই খারাপ। একে তো অসংখ্য বানান ভুলে অতি নিকৃষ্ট ছাপা, তার ওপর ভাষার মা-বাপ নেই। ভাষার ওপর কোন দখলই নেই সাধনের। তাছাড়াও, গল্পটাই-বা কি! সে বাংলাদেশের গ্রামের ছেলে হয়েও যে-গ্রামের কথা লিখেছে, সেরকম কোন গ্রাম কোথাও নেই। এরকম নদীও কোথাও নেই যার দু-পাড়ে সোনা রঙের বালি ছড়ানো। কৃত্রিম অকিঞ্চিৎকর কাহিনী। তার হীরো এম. এ. তে ‘ফার্স্ট ডিভিশনে’ পাশ-করা এক অসমসাহসী যুবক, যে মানুষের বিপদ দেখলেই ঝাঁপিয়ে পড়ে, দীন দুঃখীদের বড়োলোক ক’রে দেয়—নদীতে নৌকোয় ক’রে ডাকতরা এক সুন্দরী যুবতীকে ধ’রে নিয়ে যাচ্ছিল, হীরো সাঁতরে গিয়ে একাই পনেরোজন ডাকাতকে কুপোকাৎ ক’রে দিল!

এর চেয়ে, সাধন আমাদের কাছে ওর নিজের জীবনের কথা যেরকমভাবে বলেছিল, তা লিখলেও যথেষ্ট পাঠ্য হ’ত। কিন্তু সবচেয়ে শক্ত বোধহয় নিজের জীবনের কথা লেখা।

ওরকম বই বটতলায় রাশি-রাশি বেরোয়। কিন্তু সাধনকে দেখার পর, একটা প্রশ্ন মনের মধ্যে অনবরত ঘোরে। গ্রাম্য পিওনের ছেলে সে, দুঃখের সংসার, নিজেও বেয়ারার চাকরি করছে—এরই মধ্যেই এত কষ্ট করে পাঁচ-ছশো টাকা জমিয়ে বই ছাপাতে গেল কেন? লেখক হবার জন্য কে তাকে মাথার দিব্যি দিয়েছিল?

একটাই শুধু উত্তর আছে, এতে সে আনন্দ পায়। আর বাংলাদেশের জল হাওয়াই বোধহয় শুধু এই আনন্দের খোঁজ দেয়। নইলে, এ-দেশে এত লেখক কেন?

ট্রেম ছেড়েছে সাড়ে-আটটায়, নটা বাজতে-না-বাজতেই ওঁরা দুজন পাজামা প’রে বাঙ্কে উঠে পড়লেন। ‘শীতটা বেশ জমিয়ে পড়েছে’—বললেন একজন। শীত আমার একদম সহ্য হয়না, তবে শীতকালে ফুলকপি বেশ পেট ভ’রে খাওয়া যায়—ওটা আমার খুব ফেভারিট, বললেন আরেকজন। দুজনেই কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে সিগারেট ধরালেন, ছাই ঝরে পড়তে লাগল আমার সামনে।

আমি নীচের বাঙ্ক পেয়েছি, আর-একটি তলার বাঙ্কে এক ভদ্রমহিলা! যেতে হবে কানপুর পর্যন্ত সহযাত্রীদের প্রতি খরচোখে চেয়ে তাদের রীতি-প্রকৃতি সম্পর্কে একটা ধারণা ক’রে নিতেই হয়। সুতরাং মুখের সামনে বই রেখে আসনে—আড়চোখে দেখছি বাকি তিনজনকে। ভদ্রমহিলার ব’সে থাকার ভঙ্গি খানিকটা যেন আড়ষ্ট। একটু আড়ষ্ট হওয়া অস্বাভাবিক নয়, কামরায় আর তিনজন অপরিচিত পুরুষ। কিন্তু একা ট্রেনে এতখানি পথ ভ্রমণ করার সাহস থাকলেও ভঙ্গিটাকে সহজ করতে পারেননি। এখনও বিছানা পাতেননি, একটা ছোট বাক্স ও টিফিন কেরিয়ার পায়ের কাছে—ওগুলো গুছিয়ে রাখা দরকার। হাতের পাশে একটা সিনেমা ম্যাগাজিন, সেটাও খোলেননি এখনও—এমনি তাকিয়ে আছেন জানলার দিকে। মহিলার বয়েস দেখে মনে হয় সাতাশ, প্রসাধনে যদি খুব বেশি বয়েস লুকিয়ে থাকেন, তাহ’লেও বত্রিশের বেশি না। ভদ্রমহিলাকে মাঝারিধরনের সুন্দরী বলা যায়—অর্থাৎ মেট্রো-লাইট হাউসের সন্ধের শো ভাঙার পর যে-ভিড়—তার মাঝখানে এই মহিলাকে তেমন রূপসী বলা যাবেনা, কিন্তু কোন বাড়িতে কারুকে ডাকতে গেলে এইরকম একজন নারী যদি দরজা খুলে দেয়—তখন বেশ লাগবে, ট্রেনের কামরার কক্ষে তো যথেষ্ট সুন্দরীই বলতে হবে।

ওপর থেকে সিগারেটের ছাইয়ের সঙ্গে সংলাপ ভেসে এল, ‘ফুলকপি বেশি খেলে আপনার অম্বল হয়না?

—হ্যাঁ, হয় একটু-একটু, ওষুধও খাই। কিন্তু ব্যাসন দিয়ে ফুলকপি গরম-গরম ভাজা—বুঝলেননা, একেবারে অমৃত।

—আমার তো শীতকাল এলেই অম্বলে এত জ্বালায়— তরিতরকারি শাকসব্জী কিছু খেতে পারিনা।

—অম্বলের একটা খুব ভালো ওষুধ আমাকে দত্তচৌধুরী বাৎলে দিয়েছিলেন। —কোন্ দত্তচৌধুরী?

—পে অ্যাণ্ড অ্যাকাউন্টসের ডেপুটি সেক্রেটারি। চেনেননা?

—হ্যাঁ চিনি। টপাটপ দুটো প্রমোশন পেয়ে গেল।

—ইউ নো ভেরি ওয়েল, প্রমোশন পাবার জন্য কীরকম—

গোড়া থেকেই লোকদুটির ওপর আমি বিলক্ষণ চ’টে আছি। চ’টে যাবার বিশেষ কোন যুক্তি নেই, কিন্তু অনেকগুলো কারণ মিলিয়ে। প্রথমত, ওদের কথাবার্তা শুনে বুঝেছি, ওঁরা দুজনই সরকারি অফিসার—সুতরাং ফার্স্ট ক্লাসে যাওয়ার জন্য নিজের টাকায় টিকিট কাটতে হয়নি—সেইজন্যই একটা হেলাফেলা ভাব। আমিও অবশ্য নিজের টাকায় টিকিট কাটিনি—মাসীমাকে আনতে যাচ্ছি কানপুর থেকে, মেশোমশাই জোর ক’রে গছিয়েছেন ফার্স্ট ক্লাসের ভাড়া। মনের মধ্যে অবশ্য খচখচ করছিল, থার্ড ক্লাসেই গিয়ে বাকি টাকাটা ম্যানেজ করব কিনা —শেষ পর্যন্ত মেশোমশাইয়ের সম্মানের কথা ভেবে পারিনি। কতসব ঠুনকো সম্মানবোধ যে থাকে মানুষের! যাই হোক, ফার্স্ট ক্লাসেই যখন যাচ্ছি, তখন তার আরামের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করতে চাই। সঙ্গী হিসেবে, ঐ দুজন লোককে ভালোলাগার কথা নয়।

দ্বিতীয়ত, আমি ভাবছিলাম, ঐ লোকদুটি যদি না-থাকত—তাহ’লে এই মহিলার সঙ্গে আমি বেশ ভাব জমিয়ে ফেলতে পারতাম। অবশ্য, ওঁরা না-থাকলেই যে বাঙ্কদুটি খালি থাকত—তার কোন মানে নেই। কিন্তু সেখানে কোন সদ্যবিবাহিত দম্পতি এলে—তারা নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত থাকত—আর আমি সেই সুযোগে—।

তৃতীয় কারণটিই হয়ত আসল। ওঁরা দুজনেই বাঙালি, এবং সরকারি অফিসার যখন—তখন মোটামুটি শিক্ষিত হওয়া উচিত, কিন্তু অনবরত কী বিরক্তিকর ও অর্থহীন কথা ব’লে যেতে লাগলেন। দুজন প্রায় প্রৌঢ় সুস্থ মানুষ— আগাগোড়া শুধু অম্বলের অসুখ আর চাকরির উন্নতি—বিভিন্ন অফিসারদের চরিত্র, পে কমিশন আর আর্ন লীভ—কাজুয়েল লীভ ব্যবহারের কায়দা—এই আলোচনায় ম’জে রইলেন। আশা করিনি, ওঁরা শিল্প-সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করবেন, কিন্তু ট্রেনে যাওয়ার সময় অন্য ভ্রমণের গল্পও মনে এলনা, জানালার বাইরে হিম আকাশের নীচে পৃথিবীর অজস্র টুকরো—সেদিকে স্তব্ধ হয়ে এক পলক তাকাতে ইচ্ছে হ’লনা! এমনকি নারী সম্পর্কেও কোন-কোন কৌতূহল নেই, তাঁদের সমগ্র আলোচনা মহিলা-বর্জিত তো বটেই এই কামরায় উপস্থিত মহিলা সম্পর্কেও ভ্রূক্ষেপ করলেননা, দুজনের কেউই একবার চেয়েও দেখেননি, বরং পাজামার দড়িতে গিট বাঁধলেন ভদ্রমহিলার সামনেই। এধরনের মানুষ আমার সহ্য হয়না।

ওপর থেকে সংলাপ ভেসে এল, হু-হু ক’রে ঠাণ্ডা হাওয়া আসছে কোথা থেকে?

নীচের জানলা বোধহয় খোলা আছে।

জানলাটা বন্ধ করলে হয়না?

জানলা বন্ধ ক’রে আলো নিভিয়ে দিলেই তো হয়।

কথাগুলো আমার উদ্দেশ্যেই বলা। কেননা, মহিলার দিকের জানলায় কাচ ফেলা। আমার হাওয়া খেতে বেশ ভালো লাগছে, একটু শীত করলেও; কলকাতার বাইরে এলেই হাওয়ায় একটা পরিচ্ছন্নতার গন্ধ পাওয়া যায়। আমি ওপরের দুজনের কথায় ভ্রূক্ষেপ করলামনা। কিন্তু এই সুযোগে, আমি মহিলার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, জানলা বন্ধ ক’রে দেব? আপনার কি অসুবিধে হচ্ছে?

মহিলা একটু সচকিত হয়ে উঠলেন। আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আমাকে বলছেন?

–হ্যাঁ, মানে জানলাটা।

— আপনার যা সুবিধে।

–না, যদি আপনার অসুবিধে হয়।

–না, না, আমার কোন অসুবিধে হচ্ছেনা।

এর ফলে আমি ঠিক বুঝতে পারলুমনা, জানলাটা খোলা রাখা কিংবা বন্ধ করা কোটা ঠিক কাজ হবে। এরপর আর কী প্রশ্ন জিজ্ঞেস করা যায়, আমার মাথায় এলনা। আর-কিছু জিজ্ঞেস করলেই যদি গায়ে-পড়া মনে করেন? এরপরই কি দুম ক’রে জিজ্ঞেস করা যায়, আপনার নাম কি! কিংবা, আপনি কোথায় যাচ্ছেন? মহিলা কিন্তু উত্তর দেবার সময় মুখখানা খুব গম্ভীর করেননি, একটু হেসেছিলেন—তার মানে আমাকে হয়ত একেবারে অপছন্দ করেননি! ওপরের দুজন একটু নিচু গলায় নিজেদের মধ্যে কী যেন বললেন।

ভদ্রমহিলা বিবাহিতা কিনা বোঝা গেলনা। অনেক মেয়েরই সিঁথির সিঁদুর এমন লুকিয়ে থাকে যে চোখেই পড়েনা সাধারণত। যাই হোক, আমি আমার সুবিধে মতন কল্পনা ক’রে নিলুম যে ওঁর বিয়ে হয়নি। কানপুরে যাচ্ছেন কেন? একা—একা মেয়েরা চট ক’রে অতদূর বেড়াতে যায়না। তা ছাড়া, আর কী কাজ থাকতে পারে? এমন হতে পারে, এই মহিলার দিদি কিংবা মাসী পিসী কেউ থাকেন—সেখানে যাচ্ছেন। কিন্তু এটা কোন ছুটির সময় নয়। কিংবা কানপুরেরই মেয়ে, কলকাতায় এসেছিলেন কোন কাজে? কি কাজ? এখন, কলকাতার মেয়ে আর কানপুরের মেয়ের চেহারার মধ্যে আলাদা কোন বৈশিষ্ট্য আছে কিনা, আমি জানিনা — পোশাকের সূক্ষ্ম পার্থক্য থাকলেও থাকতে পারে—সেটা মেয়েদের চোখে পড়ার কথা। তা ছাড়া, ভদ্রমহিলা সত্যিই যে কানপুরে যাচ্ছেন, তাই-বা আমি জানলুম কী ক’রে? আমি কানপুরে যাচ্ছি ব’লে উনিও সেখানে যাবেন, তার কি মানে আছে? এই ট্রেনে উনি তো দিল্লি, আগ্রা, এলাহাবাদ যে-কোন জায়গায় যেতে পারেন, কিংবা আবার ট্রেন পাল্টে অন্য কোথাও। কিন্তু আমার বদ্ধমূল ধারণা হ’ল মেয়েটি কানপুরেই যাচ্ছে—এবং ট্রেনে আমি যদি ওর সঙ্গে আলাপ জমাতে পারি তাহ’লে কানপুরেও দেখা হবে, এবং তারপর আস্তে-আস্তে একটা ইয়ে মানে…

আমি মেয়েটাকে আবার জিজ্ঞেস করলাম, আলো নিবিয়ে দেব?

মেয়েটি পূর্ববৎ স্মিতমুখে বলল, আমার কোন অসুবিধে হচ্ছেনা, আপনি যদি চান—

মুশকিল হচ্ছে এই, আমি একদম গল্প বানাতে পারিনা। ট্রেনের কামরায় একটি সুন্দরী নারীর সঙ্গে পরিচয়, রাত জেগে পাশাপাশি ব’সে গল্প করা—তারপর আপনি থেকে তুমি, আঙুলে আঙুলে খেলা, কানপুর স্টেশনে নেমে দেখা গেল— মেয়েটিকে কেউ স্টেশনে নিতে আসেনি, সুতরাং তাকে পৌঁছে দেওয়া ও বাড়ি চ’লে আসা, আবার পরদিন দেখা, তারপর…। পাকা গল্প লেখকেরা এই পরিবেশটিকে কাজে লাগিয়ে নিশ্চয়ই একটা সুন্দর রোমান্টিক গল্প ফাঁদতে পারতেন। কিন্তু আমি যে শুধু গল্প বানাতে পারিনা তাই নয়, এইরকম একটা পরিবেশকে কাজেও লাগাতে পারিনা।

আসল ঘটনা হ’ল এই, আমি সর্বক্ষণ মেয়েটিকে কী বলা উচিত আর কী বলা উচিত নয়, এই ভেবে-ভেবেই সময় কাটিয়ে দিলুম। সারা রাত ভালো ক’রে ঘুম হ’লনা, সর্বক্ষণই মনে হচ্ছিল, মেয়েটি বোধহয় আমাকে ডাকবে কিংবা কিছু বলবে, মেয়েটি ঘুমের ঘোরে একবার পাশ ফিরলেও আমি উৎকর্ণ হয়ে উঠছিলুম —কিন্তু কিছুই ঘটলনা। জীবনে সত্যি-সত্যি গল্পের মতন ঘটনা বেশি ঘটেনা। রাত জেগে আমি শুধু ওপরের দুটি কুম্ভকর্ণের নাক-ডাকা শুনতে লাগলুম।

সকাল হতে সেই দুজন নেমে এলেন নীচে। চা খাওয়ার আগেই শুরু হয়ে গেল আবার অফিসের গল্প পে কমিশন আর অম্বলের ওষুধের কথা। অন্য বিষয়ের মধ্যে একবার শুধু তাঁরা বললেন, ‘এদিকে কলা বেশ সস্তা’ এবং ইউ. পি. সাইডে বেশ ভালো চাল পাওয়া যায়—কিন্তু এর থেকেই প্রসঙ্গ চ’লে এল কলকাতার রেশনের চালে কীরকম কাঁকর, তারপর দর এবং আবার মাইনে, ছুটি এবং অফিস। কানপুর পর্যন্ত তাই কামরায় আমার কিংবা একজন মহিলার উপস্থিতি সম্পর্কে ওঁরা সম্পূর্ণ উদাসীন। জন্তু-জানোয়ার হ’লেও এতক্ষণ ভাব হয়ে যেত, কিন্তু চারজন সভ্য মানুষ, তাই কোন কথা হয়না। এদের সামনে আমি আলাদাভাবে মেয়েটির সঙ্গে ভাব জমাবার চেষ্টা করতে লজ্জা পেলাম, ভেতরে-ভেতরে ছটফট করতে লাগলাম শুধু! বই মুখে ক’রে ব’সে রইলাম, সে-বইয়ের একটি অক্ষরও মাথায় ঢুকলনা অবশ্য। মেয়েটি তাকিয়ে রইল জানলার বাইরে। কানপুর এসে গেল, একটা কথাও বলা হ’লনা।

এরপর যদি আমি বলি, পরদিন মেয়েটির সঙ্গে আমার কানপুরে দেখা হয়েছে, তাহ’লে কি সেটা অতিনাটকীয় শোনাবে? কিন্তু সত্যি-সত্যি দেখা হ’লে আমি কী করব। মেয়েটির নাম সুদীপ্তা এবং মেসোমশাইয়ের বিশেষ বন্ধুর মেয়ে। মাসীমাকে নিয়ে কলকাতায় রওনা হব, তার ঠিক আধ ঘণ্টা আগে মেয়েটি মাসীমার সঙ্গে দেখা করতে এল। পরিচয় করিয়ে দেবার পর আমার দিকে তাকিয়ে স্মিতভাবে হাসল শুধু, আমিও হাসলাম। তারপর চ’লে গেলাম বেডিং বাঁধতে।

ট্রেনে ওঠার পর মাসীমা বললেন, তোর সঙ্গে আসবার সময় সুদীপ্তা এক কামরায় এসেছে?

আমি বললাম, কী জানি মনে পড়ছেনা তো। একটি মেয়ে ছিল বটে, অনেকটা ঐরকমই দেখতে—

মাসীমা হাসতে-হাসতে বললেন, সুদীপ্তা কী বললে জানিস? তুই ছিলি ব’লে ও বেশ নিশ্চিন্তে আসতে পেরেছে—আর দুটো ধুমসো মতন লোক নাকি বারবার ওর দিকে বিশ্রীভাবে তাকাচ্ছিল আর আজেবাজে বকবক করছিল। তুই ব’সেছিলি বই নিয়ে। সুদীপ্তা বলল, তোর এত বই পড়ার নেশা, তুই একবার তাকিয়েও দেখিসনি ওর দিকে—ও ভেবেছিল যদি আলাপ-পরিচয় হয়—নইলে অতক্ষণের রাস্তা কথা না-ব’লে মুখ বুজে থাকা! তোর আবার পড়াশুনায় এত মনোযোগ হ’ল কবে থেকে?

সকল অধ্যায়

১. নীললোহিতের চোখের সামনে – ১
২. নীললোহিতের চোখের সামনে – ২
৩. নীললোহিতের চোখের সামনে – ৩
৪. নীললোহিতের চোখের সামনে – ৪
৫. নীললোহিতের চোখের সামনে – ৫
৬. নীললোহিতের চোখের সামনে – ৬
৭. নীললোহিতের চোখের সামনে – ৭
৮. নীললোহিতের চোখের সামনে – ৮
৯. নীললোহিতের চোখের সামনে – ৯
১০. নীললোহিতের চোখের সামনে – ১০
১১. নীললোহিতের চোখের সামনে – ১১
১২. নীললোহিতের চোখের সামনে – ১২
১৩. নীললোহিতের চোখের সামনে – ১৩
১৪. নীললোহিতের চোখের সামনে – ১৪
১৫. নীললোহিতের চোখের সামনে – ১৫
১৬. নীললোহিতের চোখের সামনে – ১৬
১৭. নীললোহিতের চোখের সামনে – ১৭
১৮. নীললোহিতের চোখের সামনে – ১৮
১৯. নীললোহিতের চোখের সামনে – ১৯
২০. নীললোহিতের চোখের সামনে – ২০
২১. নীললোহিতের চোখের সামনে – ২১
২২. নীললোহিতের চোখের সামনে – ২২
২৩. নীললোহিতের চোখের সামনে – ২৩
২৪. নীললোহিতের চোখের সামনে – ২৪
২৫. নীললোহিতের চোখের সামনে – ২৫
২৬. নীললোহিতের চোখের সামনে – ২৬
২৭. নীললোহিতের চোখের সামনে – সংযোজন ক
২৮. নীললোহিতের চোখের সামনে – সংযোজন খ

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন