শিক্ষাক্ষেত্রে আমরা প্রায় নৈরাজ্যের সম্মুখীন

আবুল ফজল

এক

কেন? এমন অবস্থা হওয়ার তো কোনো কারণ ছিল না। আমরা নিজেরাই এ অবস্থার জন্য পরিপূর্ণ দায়ী। আমরা মানে আমাদের সরকার, নেতা-উপনেতা, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, ছাত্র, অভিভাবক সবাই। সবাই মিলে আমরা সমগ্র শিক্ষা ব্যবস্থায় একটা নৈরাজ্য ডেকে এনেছি আজ। এ অবস্থার শুরু অনেক আগে থেকেই, এ সংকট চরম অবস্থায় পৌঁছেছিল ১৯৬৮-৬৯ এ। সে সময় শিক্ষা সম্বন্ধে আমি কয়েকটি প্রবন্ধ লিখেছিলাম। সেগুলির নাম যথাক্রমে; 

(১) ধর্মভিত্তিক বনাম ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা প্রসঙ্গে;

(২) শিক্ষা সম্বন্ধে কয়েকটি মোটা কথা;

(৩) সাম্প্রতিক ঘটনার আলোকে শিক্ষা সম্পর্কে দুটি কথা;

(৪) রাষ্ট্র : সমাজ আর ছাত্র;

(৫) শিক্ষকদের প্রতি ভাষণ; ও

(৬) ছাত্র-রাজনীতির ভয়াবহ পরিণতি। 

এ সব কটি লেখা তখনকার পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে এবং পরে আমার ‘সমকালীন চিন্তা’ নামক বইতেও পেয়েছে স্থান। সেদিন শিক্ষা বিষয়টি আমাকে কতখানি ভাবিয়ে তুলেছিল এসব লেখায় তার নিঃসন্দিগ্ধ প্রকাশ হয়েছে। আজ দেশ পরিপূর্ণভাবে স্বাধীন। অবসান হয়েছে পাকিস্তান যুগের। তবু শিক্ষা সম্বন্ধে সেদিন যেসব কথা আমি বলেছিলাম তা আজো আমার কাছে সত্য হয়ে আছে। তাই এখনকার নৈরাজ্য সম্বন্ধে কিছু বলার। আগে আমার ঐসব মন্তব্য থেকে কিছুটা দীর্ঘ পুনরাবৃত্তি করছি, তাহলে শিক্ষা সম্বন্ধে আমার দৃষ্টিভঙ্গির একটা মোটামুটি পরিচয় পাঠকেরা জানতে পারবেন। 

ইংরেজ আমলে যে শিক্ষাপদ্ধতি চালু ছিল তা শুধু বহু যোগ্য মানুষ সৃষ্টি করেছে তা নয়, অসংখ্য খাঁটি মুসলমান সৃষ্টিতেও তা কিছুমাত্র বাধা হয় নি। সে মুসলমানরা যে এখানকার শিক্ষিত মুসলমানদের চেয়ে গড়পড়তা অনেক যোগ্য ও ভালো মুসলমান ছিল, সে সম্বন্ধে দ্বিমতের অবসর আছে বলে মনে হয় না। সে শিক্ষাব্যবস্থা ছিল অনেকখানি স্বচ্ছ, সুষ্ঠু, সরল আর সাধারণের বোধগম্য। গত দুই দশকে সে স্পষ্ট আর অর্থপূর্ণ ব্যবস্থাকে নানা কমিশনের নানা উদ্ভট আর অবাস্তব সুপারিশের মারপ্যাঁচে ফেলে এখন স্রেফ ঘোলাটে, দুর্বোধ্য আর ছাত্রদের জন্য এক দুর্বহ বোঝা করে তোলা হয়েছে। ইতিপূর্বে শিক্ষা নিয়ে এমন ‘তোগলকি কাণ্ড’ আর কখনো ঘটে নি। পাকিস্তান পূর্ববর্তী শিক্ষিত মুসলমানের সঙ্গে পাকিস্তান পরবর্তী শিক্ষিত মুসলমানের তুলনা করলে সার্বিক যোগ্যতা আর আচার-আচরণে যে পার্থক্য দেখা যায় তা মনে হয় এ ‘ভোগলকি’ নীতিরই পরিণতি। ‘ফলেন পরিচিয়তে’–সব নীতি আর পদ্ধতি বিচারের এ তো একমাত্র মাপকাঠি। 

শিক্ষা দীর্ঘমেয়াদি ব্যাপার–-শিক্ষা দান আর শিক্ষা গ্রহণ দুই-ই। এর পেছনে দীর্ঘ প্রস্তুতি চাই, বিশেষ করে মানবিক প্রস্তুতি। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা আর অভ্যাসের ফলে শিক্ষকরা নিজেদের কর্তব্য আর দায়িত্ব সম্বন্ধে একটা ধারণা লাভ করেন, ছাত্ররাও নিজেদের কর্তব্য সম্বন্ধে একটি স্পষ্ট পূর্বধারণা নিয়ে শিক্ষার অঙ্গনে পারে প্রবেশ করতে। আর সবচেয়ে বড় কথা, এ রকম অবস্থায় অভিভাবকদেরও জানা থাকে, তাদের ছেলে মেয়েরা কী কী বিষয়ে পড়ছে, জীবনে তা কতখানি কাজে আসবে, ভবিষ্যতে জীবিকার কথা তাদের সামনে খুলে যাওয়ার সম্ভাবনা এতে কতটুকু ইত্যাদি। এসবের প্রধান শর্ত শিক্ষাসূচি আর শিক্ষা পদ্ধতিতে স্থিতিশীলতা। স্থিতিশীলতা মানে জড়তা নয়, কালের বা সমাজের প্রয়োজন আর চাহিদাকে অস্বীকার করে স্থাণু হয়ে বসে থাকা নয়। তবে রদবদল আর বিবর্তনের গতি ধীরে ধীরে আর ধাপে ধাপে হওয়া চাই। এক একটা ধাপ জাতির বা সমাজের ব্যবহারিক আর মানসিক অভিজ্ঞতার অঙ্গ হয়ে ওঠার পর, তবেই পরবর্তী ধাপের জন্য যথোপযুক্ত প্রস্তুতি নেওয়া বাঞ্ছনীয়। অভিজ্ঞতা আর অভ্যাসকে আমল না দিয়ে আমাদের শিক্ষা পদ্ধতিতে এখন যে ওলটপালট ঘটানো হয়েছে ও হচ্ছে, তার পরিণাম ভেবে শিক্ষাবিদ মাত্রই চিন্তিত না হয়ে পারে না। 

শিক্ষার ক্ষেত্রে এখন যে দ্রুত আর সার্বিক অবক্ষয় ঘটে চলেছে, তা কারো চোখ এড়াবার কথা নয়। শিক্ষা জিনিসটা এক সার্বিক ব্যাপার। জীবনের সর্বস্তর জুড়ে তার প্রভাব। এখন লেখাপড়ার মান যেমন অধঃপতনের দিকে দ্রুত নেমে যাচ্ছে, তেমনি নৈতিক চেতনাও আজ অবনতির চরম পর্যায়ে এসে ঠেকেছে। সমাজ থেকে বটেই, শিক্ষাজীবন থেকেও নৈতিকতাবোধ আজ সম্পূর্ণ অন্তর্হিত। এর সঙ্গে শিক্ষানীতি আর পদ্ধতির কিছুমাত্র যোগাযোগ নেই, তা বলা যায় না। রাজনীতি বা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা এক জিনিস, শিক্ষা-সংস্কৃতি সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাপার। স্বভাব আর চরিত্রে দুই-ই বিপরীত। তাই সব উন্নত দেশে শিক্ষাকে রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়। কথায় কথায় তারা। শিক্ষা-সংস্কারে হাত দেয় না। ইংল্যান্ডের মতো বুনিয়াদি গণতন্ত্রের দেশেও সরকারের পতন আর রদবদল ঘটে। তাই বলে শিক্ষা পদ্ধতিতেও সঙ্গে সঙ্গে রদবদল ঘটাতে তারা উঠে পড়ে লাগে না। শিক্ষা থেকে জাতীয় জীবনে সুফল পেতে হলে একটা ধারাবাহিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা প্রয়োজন–ঐ সত্যটুকু সে দেশের রাজনৈতিক দল আর নেতাদের শুধু যে জানা তা নয়, তারা সেটা মেনেও চলে। যে শিক্ষা পদ্ধতির উত্তরাধিকার আমরা পেয়েছিলাম তা মোটেও মন্দ ছিল না। তা থেকে যথেষ্ট সুফল আমরা পেয়েছি। সে পদ্ধতি থেকে যোগ্যতম মানুষের আবির্ভাব যে আমাদের সমাজেও ঘটেছে তা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই এ সম্পর্কে ইতোপূর্বে আমি আমার ‘শিক্ষা সম্পর্কে কয়েকটি মোটাকথা’ প্রবন্ধে বিস্তৃত আলোচনা করেছি, সে প্রবন্ধ থেকে প্রাথমিক কয়েকটি কথা নিম্নে উদ্ধৃত হলো : 

‘মোটকথা শিক্ষা থেকে সুফল পেতে হলে তাতে ঘন ঘন হস্তক্ষেপ করা অবাঞ্ছনীয়। যতদিন হস্তক্ষেপ ঘটে নি, ততদিন প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা থেকে আমাদের দেশ আর সমাজ উপকৃত হয়েছে। আমাদের উপযুক্ততা অনুসারে রাজনৈতিক ও সামাজিক চাহিদা যে ঐ শিক্ষা থেকে মোটামুটি ঘটেছে, তাতেও সন্দেহ নেই। ঘটে নি বলা স্রেফ সত্যের অপলাপ করা। প্রমাণ, রাজনৈতিক উত্থান-পতন সত্ত্বেও আমাদের প্রশাসন ব্যবস্থা কখনো অচল হয়ে থাকে নি। ক্ষমতালোভীদের হস্তক্ষেপের ফলে যদি কখনো অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়ে থাকে, সে অন্য কথা তার জন্য শিক্ষাব্যবস্থা দায়ী নয়। গত চব্বিশ বছরে কত সরকারই এলো কত সরকারই গেলো, দেখে অবাক হতে হয়, যে সরকারই আসে সে সরকারই অমনি তড়িঘড়ি একটি শিক্ষা কমিশন বসান, শিক্ষা সংস্কারের নামে রাতারাতি শিক্ষার ক্ষেত্রে একটা ওলটপালট তথা রীতিমতো একটা অরাজকতা ডেকে না এনে তারা যেন কিছুতেই স্বস্তি পান না। দেশের সামনে আজ সহস্র সমস্যা আশু সমাধানের প্রতীক্ষায়। এসবে হাত না দিয়ে তারা কেন যে অকারণে শিক্ষা নিয়ে মাথা ঘামাতে শুরু করেন, তা আমার মতো লোকের বুদ্ধির অগম্য। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যাঁরা বসেন, তাঁদের অনেকে যথারীতি শিক্ষিত নন, তবুও শিক্ষা নিয়ে অনধিকারচর্চা তাঁদের চাই-ই। আয়ুব আমল থেকেই এ অবস্থার সূচনা।’ 

শিক্ষার ক্ষেত্রে আমরা যে এখন এক ভয়াবহ রকম নৈরাজ্যের সম্মুখীন এ সম্বন্ধে বোধ করি সন্দেহের অবকাশ নেই। তবে জিজ্ঞাস্য এ অবস্থার জন্য দায়ী কে? নেহাত অনিচ্ছায় আর অত্যন্ত বেদনার সাথে যদি বলি–সরকার, তাহলে আমি জানি অনেকে অসন্তুষ্ট হবেন, আবার কেউ কেউ বিরক্ত হবেন, আবার কেউ কেউ লেখককে সরকারবিরোধী বলেও হয়তো অভিযুক্ত করবেন। তাতে আমার বিন্দুমাত্র দুঃখ নেই, আর আমি সর্বান্তঃকরণে বিশ্বাস করি, গণতন্ত্রে সরকারবিরোধী হওয়া কিছুমাত্র লজ্জার বিষয় নয়। বরং যেখানে। দেশের বৃহত্তম স্বার্থ জড়িত সেখানে চুপ করে থাকা, সত্য না বলা শুধু যে লজ্জার বিষয় বা কর্তব্যে অবহেলা তা নয় বরং একরকম দেশদ্রোহিতাও। বেদনার সাথে বলছি এ কারণে যে এ সরকারকে আমরাই ত চেয়েছিলাম। ভোটও দিয়েছি আমরা, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এ সরকারকে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে চায় নি বলেই ত ইয়াহিয়া খা আর তাঁর সরকারের সঙ্গে সারা সুবে বাংলার বিরোধ, যার পরিণাম রক্তাক্ত সগ্রাম আর স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। কাজেই এ সরকারকে হেয় করা কি দুর্বল করা আমাদের উদ্দেশ্য হতে পারে না। কারণ, তাতে ক্ষতি ছাড়া কোন লাভ নেই। দেশের যে সমস্ত রাজনৈতিক দল স্বাভাবিক অবস্থায় সরকারবিরোধী ভূমিকা পালনের কথা, তারাও আজ সরকারকে সার্বিক সমর্থন জুগিয়ে যাচ্ছে। কেন? তার একমাত্র কারণ বর্তমানে বিকল্প কোনো সরকার গঠনের ক্ষমতা অন্য কোনো দলের নেই। অথচ দেশের শাসন-কাঠামোকে ধরে রাখা আর চালু রাখার জন্য যে কোনো রকমের একটা সরকার অপরিহার্য। এ অপরিহার্যতার সুযোগ নিয়ে বর্তমান সরকার যদি বেপরোয়া হয়ে ওঠে এবং শিক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও যা-তা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে দেশের শিক্ষাজীবনের একটা মারাত্মক রকমের বিপর্যয় ডেকে আনে তা হলে তা কি অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হবে না? দেশ আর দেশের শিক্ষা-সংস্কৃতিকে যারা ভালোবাসে। তেমন বিবেকী লোকদের পক্ষে তখন কি চুপ করে থাকা সম্ভব, না উচিত? 

শিক্ষার ক্ষেত্রে কী করে অত্যন্ত অকারণে এ বিপর্যয় ও অচলাবস্থা ডেকে আনা হয়েছে তার একটা দৃষ্টান্ত এখানে উল্লেখ করছি। পাঠ্যবই নিয়ে যে কেলেঙ্কারির সৃষ্টি হয়েছে আজ তা স্রেফ কেলেঙ্কারি হলে হয়তো সহ্য করা যেতো কিন্তু এর ফলে শিক্ষাজীবনে এমন একটা বিপর্যয় আর শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে যে, তা কিছুতেই ক্ষমা করা যায় না, যায় না বরদাস্ত করা। অগ্র-পশ্চাৎ না ভেবে সস্তা জনপ্রিয়তা সন্ধান করতে গিয়েই শিক্ষা দফতর দেশকে এ দারুণ বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছে। একটা রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের ভেতর দিয়ে দেশ স্বাধীন হয়েছে। দেশের অর্থনীতি, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান, যোগাযোগ ব্যবস্থা ইত্যাদি সব কিছুই আজ বিধ্বস্ত। এ অবস্থা দেশের মানুষের সবারই জানা। তাই নবপ্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রের কাছে তেমন বড় কিছু মানুষ চায় না, কারণ তেমন অসম্ভব দাবি, কোন মহল থেকেও তেমন কোন দাবি-দাওয়া আজো উত্থাপিত হয় নি। তবু সরকার গায়ে পড়ে বছরের শুরুতেই ঘোষণা করে বসলো তারা সারা প্রদেশের তাবত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের বিনামূল্যে বই দেবে। শিক্ষাবিভাগের পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, প্রদেশে মোটামুটি ষাট লক্ষ ছাত্রছাত্রী রয়েছে প্রাথমিক স্কুলগুলোতে। ষাট লক্ষ বাদ দিয়ে যদি ত্রিশ লক্ষও ধরা হয়, আর যদি ধরা হয় গড়ে চার কি পাঁচটি করে বিষয় তাদের পড়ানো হয়, তাহলে প্রায় দেড় কোটি বইয়ের প্রয়োজন। বিনামূল্যে বই বিতরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় এ কথাটা মাথায় ঢোকে নি যে, এ স্বল্প সময়ের মধ্যে এত বই ছাপার উপযোগী কাগজ আর মুদ্রাযন্ত্র আমাদের আছে কি না? সবচেয়ে বড় কথা, প্রাথমিক স্কুলগুলো তো স্রেফ শহরে নগরে কেন্দ্রীভূত নয়–তা প্রদেশের দূর দূরান্তে ছড়িয়ে রয়েছে। শহর থেকে কোনো কোনো স্কুলের দূরত্ব ষাট-সত্তর মাইলেরও বেশি–পথ দুৰ্গম, যাতায়াত ব্যবস্থা অত্যন্ত দুরূহ। এসব স্কুলে বই পৌঁছাবার কী ব্যবস্থা? কোথায় সে সংস্থা, সে যন্ত্র, সে মেশিনারি? ব্যাংক? ব্যাংকের বাপের সাধ্যও নেই গ্রাম-গ্রামান্তরে ত্রিশ লক্ষ ছাত্রছাত্রীর নাগালের মধ্যে বই পৌঁছে দেয়া। সরকারের এ অদূরদর্শী সিদ্ধান্তের ফলে আজ বছরের সাত মাস গত হতে চলল তবু কোনো স্কুলের কোন ছাত্রই পুরো সেট বই পায় নি। এমন দাবি শহর কি মফস্বলে কোনো স্কুলই করতে পারবে না যে, তাদের ছাত্র-ছাত্রীরা সবাই পুরো বই পেয়েছে বা স্বাভাবিকভাবে তারা পড়াশুনা চালিয়ে যেতে পারছে। আজ শিক্ষাক্ষেত্রে এই যে অত্যন্ত দুঃখজনক এক অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে–আমার বিশ্বাস, তার জন্য সরকারই একমাত্র দায়ী। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর ছেলেমেয়েরা বছরে দু-তিনটা করে বই ছেড়ে, বই হারিয়ে ফেলে–এসব আমাদের অনেকেরই অভিজ্ঞতা। অভিভাবকরা তাদের কিনে দেন। এখন কী হবে? সরকার একটার বেশি দুটো বই কখনো খয়রাতি হিসাবে দেবে না, ঐদিকে দোকানেও পাওয়া যাবে না কিনতে। হ্যাঁ, বেশি দাম দিয়ে ব্ল্যাকে হয়তো পাওয়া যেতেও পারে। ইতিমধ্যে ঐ মর্মের খবর কাগজে প্রকাশিতও হয়েছে। মনোপলি যেখানে ব্ল্যাকও সেখানে–এ প্রায় অবধারিত সত্য। বোর্ড বা ব্যাংকের কর্মচারীরা সবাই সাধু নন। 

দেশ আর দেশের মানুষ সরকারের কাছে বিনামূল্যে বই চায় নি, সরকার গায়ে পড়ে এ বদান্যতা না দেখালেও পারতো। বদান্যতা দেখানোর আরো হাজারো উপায় রয়েছে। বহুনিন্দিত পূর্বতন সরকার প্রাথমিক শিক্ষা অবৈতনিক করেছে। বর্তমান সরকার ম্যাট্রিক পর্যন্ত অবৈতনিক কিংবা অর্ধ অবৈতনিক করলেই জনগণের প্রভূত উপকার সাধন করা হতো। অথবা বছরে এক একটা করে বার মাসই অবৈতনিক করা শুরু করলেই পারতো। এ ধরনের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের পথে কিছু মাত্র অসুবিধাও ছিল না–প্রশাসনিক একটি মাত্র আদেশই যথেষ্ট। কোনো রকম যন্ত্র কি মেশিনারির প্রয়োজন হতো না এতে। এ ধরনের সহজ ও অনায়াসসাধ্য পথে না গিয়ে কেন যে এক দুরূহ, যা সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নের কিছুমাত্র ক্ষমতা বা প্রশাসনিক ব্যবস্থা সরকারের নেই, তা নিতে গেলো তা একমাত্র সরকারই জানে। সরকারের এ ব্যবস্থা শুধু যে এবারই ব্যর্থ হয়েছে তা নয়, আগামী বছর এ ব্যর্থতা আরো ভয়ঙ্কর রূপ নিয়ে দেখা দেবে বলেই আমার বিশ্বাস। সরকারের জানা উচিত, জনগণের উপকার করতে চাইলেই উপকার করা যায় না। কিছুটা বুদ্ধি ও দূরদর্শিতার প্রয়োজন এবং প্রয়োজন হয় নিজেদের সাধ্য আর ক্ষমতা সম্বন্ধে সচেতনতার। সে সঙ্গে কিছুটা কল্পনাশক্তিরও। তা না হলে হিতে বিপরীত ফল না হয়ে যায় না। পাঠ্য বইয়ের ব্যাপারে অবিকল তাই হয়েছে। 

ব্যক্তিগত নির্বুদ্ধিতার পরিণাম ব্যক্তিগতের মধ্যেই সীমিত থাকে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় নির্বুদ্ধিতার পরিণাম সর্বব্যাপক। তাই প্রতিবাদ না করে উপায় নেই। পাঠ্য বইয়ের দ্রুত অবনতি কারো নজর এড়াবার কথা নয়। মনোপলি যে শুধু ব্ল্যাকের সৃষ্টি করে তা নয়, মানেরও অবনতি ঘটায়। বইয়ের ক্ষেত্রে সরকারি মনোপলির যন্ত্র হচ্ছে স্কুল পাঠ্য বই সংস্থা তথা স্কুল টেক্সট বুক বোর্ড। এ বোর্ড প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে পাঠ্য বইয়ের মান দ্রুত নেমে যাচ্ছে নিচের দিকে। এ বিষয়ে শিক্ষক আর শিক্ষাবিদমাত্র বোধ করি একমত। কোনো রকম প্রতিযোগিতা নেই বলে বইয়ের মান কমেছে এবং এ কারণে সময়ে বইও পাওয়া যায় না। এবং সে সঙ্গে বুক ট্রেড বা বইয়ের ব্যবসাটাকেও দেওয়া হয়েছে একদম নষ্ট করে। বইয়ের ব্যবসার সঙ্গে সাহিত্যের সম্প্রসারণ অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। বই-ব্যবসার সম্প্রসারণের সুযোগ নষ্ট হয়ে যাওয়ার ফলে সাহিত্য সম্প্রসারণের সুযোগও সংকুচিত হয়ে পড়েছে আমাদের দেশে। সাহিত্য গ্রন্থ প্রকাশনায় খতিয়ান নিলেই তা উপলব্ধি করা যাবে। 

মনোপলির আর একটি ক্রটি তাতে তদবির চলে, তার সুযোগ দরাজ। ফলে অযোগ্য লোকও পেয়ে যায় সুযোগ। এ সুযোগের ফলে পাঠ্য বই সংস্থার বই লেখার জন্য এমন সব লোক নির্বাচিত হয় যারা আদৌ লেখক নয়, যাদের লেখাপড়া শুধু যে নিম্নমানের তা নয়, সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান থেকেও যেন তারা বঞ্চিত। দুটো মাত্র সাম্প্রতিক দৃষ্টান্ত উল্লেখ করছি। কাণ্ডজ্ঞানহীনতার দৌড় যে কতখানি তা পাঠক সহজেই বুঝতে পারবেন (অবশ্য দৃষ্টান্ত দুটোই আমার শোনা, চাক্ষুষ দেখা নয়; তবে যারা বলেছেন, তাঁরা বিশ্বস্ত)। 

বাংলাদেশ হওয়ার পর স্বভাবতই কোনো কোনো পাঠ্য বই সংশোধন করতে হচ্ছে। না করে উপায় নেই। বোর্ড বা বোর্ডের নিযুক্ত সংশোধক একটা বইয়ের একটা লেখা সংশোধন করছেন এভাবে : বইটিতে কায়েদে আযম সম্বন্ধে একটি প্রবন্ধ ছিল। বোর্ড তাতে স্লিপ লাগিয়ে ছাত্রদের নির্দেশ দিয়েছে–যেখানে যেখানে কায়েদে আজম লেখা আছে সেখানে সেখানে শেখ মুজিবর রহমান পড়তে হবে। বাদবাকি যা ছিল সবই ঠিক রয়েছে। শেখ মুজিবরের মা-বাপের নাম আর কায়েদে আজমের মা-বাপের নাম এক নয়, জন্মস্থানও আলাদা। একজন জন্মেছে পাকিস্তানের করাচিতে, অন্যজন বাংলাদেশের ফরিদপুরের গোপালগঞ্জে। লেখা-পড়া, কর্মজীবন, বিয়ে-শাদি সবই আলাদা। এবার থেকে বোর্ডের কল্যাণে ছাত্রছাত্রীদের শেখ মুজিবরের বেনামিতে পড়তে হবে কিনা মোহাম্মদ আলী জিন্নার জীবনকথা! এরই নাম উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে। আর এভাবেই আমাদের ছাত্র-ছাত্রীরা পরিচিত হবে জাতির স্রষ্টার জীবনের সঙ্গে! কোনো পুস্তক ব্যবসায়ী প্রকাশক কি এমন কাণ্ড করার সাহস পেতো? যেহেতু বোর্ড সরকারি প্রতিষ্ঠান অতএব বেপরোয়া হতে তার বাধা নেই। আর একটা বই সংশোধন করা হয়েছে নাকি এভাবে। বইতে লেখা ছিল : ‘তিনি প্রত্যহ সকালে উঠিয়া কোরান পাঠ করেন। বোর্ডের সুযোগ্য সংশোধক কথাটাকে সংশোধন করেছেন এভাবে : ‘তিনি প্রত্যহ সকালে উঠিয়া পূর্বদেশ পাঠ করেন।’ কোথায় কোরান শরিফ আর কোথায় ‘পূর্বদেশ’ পত্রিকা! কোরান পাঠ করেন কথাটি থাকলে কি দোষ হতো? ধর্মনিরপেক্ষতার কি এ অর্থ? শিক্ষা দফতর কি বলেন? কাণ্ডজ্ঞানহীন হীনম্মন্যতারও একটা সীমা থাকা উচিত। কোন হিন্দু যদি গীতা, কোন বৌদ্ধ যদি ত্রিপিটক আর কোন খ্রিস্টান যদি বাইবেল পাঠ করে আর তা যদি পাঠ্য বইতে উল্লিখিত হয় তাহলে কি ধর্মনিরপেক্ষতা ক্ষুণ্ণ হয়? মাত্র কয়েকদিন আগে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী চট্টগ্রাম এসেছিলেন। তাঁর সংবর্ধনা সভার শুরুতে কোরান, গীতা, ত্রিপিটক ও বাইবেল পাঠ করা হয়েছিল। যদিও ব্যক্তিগতভাবে আমি জনসভায় ধর্মগ্রন্থ পাঠের বিরোধী তবুও এতে কোনো আপত্তির কারণ দেখি নি, অন্য কেউ এতে আপত্তি তুলেছেন বলেও শুনি নি। অথচ এ গণসংবর্ধনার প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন স্থানীয় প্রশাসন ও সরকারি দল।

‘পাঠ্য বই সংস্থা’ প্রতিষ্ঠান প্রথম দিন থেকেই চরম অযোগ্যতার পরিচয় দিয়ে আসছে। এ সংস্থাকে ঢেলে নতুন করে সাজানো উচিত। আমার মতে একটা ক্ষুদ্র সংস্থাই যথেষ্ট, এ সংস্থার কাজ হচ্ছে সিলেবাস বা পাঠ্যসূচি রচনা করা। সে পাঠ্যসূচি অনুসারে লিখিত বই আহ্বান করে মান ও মেধা পরীক্ষা করে তার অনুমোদন দান করা। যেমন আগে করা হতো। তাহলে প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে বই লেখা আর প্রকাশিত হবে। তখন স্বভাবতই বইয়ের মান না বেড়ে পারে না। পাঠ্য বই প্রকাশ করে প্রকাশনা। প্রতিষ্ঠানগুলি যদি সম্প্রসারণের সুযোগ পায় তাহলে তখন কিছুটা পুঁজি অ-পাঠ্য সাহিত্য গ্রন্থ প্রকাশনায়ও তারা বিনিয়োগ করবে। যেমন আগে করা হতো। দেশের পুস্তক ব্যবসাকে নষ্ট করে দেওয়ার আমি সম্পূর্ণ বিরোধী। এতে যে শুধু সাহিত্যের সম্প্রসারণ বিঘ্নিত হবে তা নয়, সার প্রদেশে কয়েক হাজার লোককেও বেকার করে দেওয়া হয়, বাস্তবে হয়েছেও। কোন গণতান্ত্রিক সরকারের এ কিছুতেই নীতি হতে পারে না। 

এ প্রসঙ্গে শিক্ষা কমিশনের কথাও স্মরণ করা যেতে পারে। এ কমিশন নিয়ে সরকার কেন যে এ টালবাহানা শুরু করেছেন তা সাধারণ বুদ্ধির অগম্য। জানুয়ারি কিংবা ফেব্রুয়ারি মাসে এ কমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। তারপর দীর্ঘকাল ঘুমিয়েছিলেন সংশ্লিষ্ট সরকারি দফতর। মাস দেড় কি দুই আগে হঠাৎ একদিন কাগজে উক্ত কমিশনের তিনজন পদকর্তার নাম প্রকাশিত হতে দেখা যায়। সকলে আশা করেছিল সঙ্গে সঙ্গে পুরো কমিশনের নাম প্রকাশিত হবে। এ উপলক্ষে কোনো কোনো কাগজে ফলাও করে সম্পাদকীয়ও লেখা হয়েছিল সরকারকে অভিনন্দিত করে। কিন্তু সরকার আবারও চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে থাকলেন। দীর্ঘকাল পর হঠাৎ জেগে উঠে সরকার আর একজন সদস্যের নাম ঘোষণা করে দেশবাসীকে জানিয়ে দিলেন যে, না, সরকার শিক্ষা কমিশনের কথা ভুলে যান নি। তাঁরা তাঁদের দায়িত্ব সম্বন্ধে পুরোপুরি সজাগ আছেন। তবে দুঃখের বিষয়, আজো পুরো কমিশনের সদস্যদের নাম-ধাম, কী নির্দেশ তাদের প্রতি, কখন তাঁরা রিপোর্ট দেবেন, কখন তা সরকার বাস্তবায়িত করবেন ইত্যাদি প্রয়োজনীয় তথ্য জানা যায় নি। এমন অভূতপূর্ব সংখ্যাগরিষ্ঠ ও গণসমর্থিত সরকারের এ গড়িমসির কারণ কী? সরকারের কোনো বাধা যদি থাকে সরকার তা কি দেশের মানুষকে জানাতে পারেন না? হ্যাঁ, বাধা কিছু আছে বই কি! ছাত্র, সরকারি স্কুল ও বেসরকারি স্কুলের শিক্ষক, সরকারি ও বেসরকারি কলেজের অধ্যাপক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দ সবাই কমিশনে স্থান পেতে চান। ছাত্র প্রতিষ্ঠান তো একটি নয়, তার উপর মাদ্রাসা শিক্ষা, চিকিৎসা, প্রকৌশল, কৃষি ইত্যাদি বহুতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই তো রয়েছে দেশে। সবারই দাবি, তাদেরও প্রতিনিধি শিক্ষা কমিশনে নিতে হবে। শিক্ষা কমিশনে স্থান পাওয়া যেন এক বিরাট কিছু, খুব একটা যেন লাভের বস্তু। শিক্ষা সম্বন্ধে মতামত দেওয়ার যোগ্যতা যেন সবারই আয়ত্ত। এ যদি করা হয়, শিক্ষা কমিশন হবে একটা পিণ্ডোরার বাক্স। মাঝখানে একবার শোনা গিয়েছিল, শিক্ষা কমিশন বাইশজন সদস্য নিয়ে গঠিত হবে। এও এক অশ্রুতপূর্ব ব্যাপার। ইতিপূর্বে বাইশজন সদস্য নিয়ে শিক্ষা কমিশন গঠনের কথা কোনো দেশেই বোধকরি শোনা যায় নি। এ করা হলে এটাও হবে আমাদের আর এক বিশ্ব রেকর্ড। ব্রিটিশ আমলে সারা ভারতের জন্য যে শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়েছিল, যাকে চেয়ারম্যানের নামানুসারে স্যাডলার বা ব্যাপক অর্থে ‘কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন’ বলা হতো, তাতে স্মরণ হয়, পাঁচ কি ছজন মাত্র সদস্য ছিল। কমিশন যত বড়ো হবে, বলাবাহুল্য, কাজও তত কম হবে। 

এই যে দেশব্যাপী নকল করে পাস করার এক মহামারী শুরু হয়েছে তার জন্যও কি সরকার দায়ী নয়? এ ব্যাপারে সরকার কি কিছু মাত্র কঠোরতার পরিচয় দিয়েছেন? নকল ধৰুতে গিয়ে কত শিক্ষক নাজেহাল হয়েছেন, হয়েছেন অপমানিত ও পর্যদস্ত, এমন কি মার পর্যন্ত খেয়েছেন; সরকার কি কখনো এ সব শিক্ষকের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন, এঁদের নিরাপত্তার কোন ব্যবস্থা কী করেছেন? বরং ছাত্ররা যখন যা আবদার করেছে সরকার তাই তো মেনে নিয়েছেন বার বার। স্বাধীনতাযুদ্ধের আগে তিন বছর ধরে যে সব ছাত্র নকল করেছে, নকল ধরা পড়ে যথারীতি দণ্ডিত হয়েছে, একদল ছাত্রের আবদারে বা হুমকিতে সরকার কি তাদের সকলের দণ্ড মওকুফ করে দেন নি? সরকারের জানা উচিত, খাঁটি মুক্তিযোদ্ধা আর আদর্শবাদী সংগ্রামী ছাত্ররা কখনো নকল করে পাস করতে চায় না। ঐ চোরা পথে পাস করতে চায় ভুয়া ছাত্র আর ভুয়া মুক্তিযোদ্ধারাই। অধিকন্তু কোন মুক্তিযোদ্ধা কিংবা দেশ-কর্মীই ছাত্রদের নকল করে পাস করার অধিকার দেয় না। শিক্ষার ক্ষেত্রে অন্তত কোন সরকারেরই শিক্ষা সম্পর্কীয় বিধি বিধান আর নীতি-ধর্মকে বিসর্জন দেওয়া উচিত নয়। এ সবকে বিসর্জন দিয়ে নকলবাজ ছাত্রদের প্রাপ্ত দণ্ড পাইকারিভাবে মওকুফ করে দেওয়ার সাক্ষাৎ পরিণতিই তো আজ আমরা সারা দেশে দেখতে পাচ্ছি। কোনো কোনো কলেজে নকলের অধিকার দাবি করে পোস্টার দেওয়া হয়েছে। দেওয়া হয়েছে শ্লোগান, বের করা হয়েছে মিছিল, ফোঁটানো হয়েছে গ্রেনেড। পরীক্ষা তদারকি শিক্ষক-অধ্যাপকরা ভয়ে থরহরি কম্পমান। দেখেশুনেও সরকার এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয়। তদারকি শিক্ষক-অধ্যাপকদের সাহায্যে সরকার ও সরকারি প্রশাসন এতটুকু এগিয়ে আসে নি। এবারকার বিভিন্ন বোর্ডের পরীক্ষার ফলাফল কি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে না নকলের প্রতাপ আর দিগন্ত কতখানি প্রসারিত? এ সম্বন্ধে সরকার একদম খামোস, এ বিষয়ে তাদের যেন করণীয় কিছুই নেই! এ অবস্থা চলতে থাকলে দেশ পাস করা লোকে ভরে যাবে সত্য। ঘরে ঘরে ম্যাট্রিক পাস, আই.এ., বি.এ., এম.এ. পাসও যে দেখা যাবে তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু সত্যিকার শিক্ষিত লোক তখন হয়তো একটিও খুঁজে পাওয়া যাবে না সারা দেশে। দেশকে এ অবস্থায় ঠেলে দেওয়ার জন্য কাকেও যদি দায়ী করতে হয়, আমরা সরকারকেই তো। দায়ী করবো। শিক্ষাক্ষেত্রে ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যে সাধারণ আইন আর শৃঙ্খলা রক্ষা অপরিহার্য তা রক্ষা আর প্রয়োগের জন্য সরকার এ যাবৎ কোথাও কোন ব্যবস্থা নিয়েছে বলে শোনা যায় নি। এর নাম দেশ-শাসন নয়। দেশ-শাসনের জন্য প্রয়োজন শাসকের কিছুটা মেরুদণ্ড ও দূরদর্শিতা, কল্পনাশক্তি, দেশের কল্যাণ সম্বন্ধে সুস্পষ্ট ধারণা আর তাকে বাস্তবায়নের চারিত্রিক দৃঢ়তা। এ সব গুণ দেখতে পাচ্ছি না বলেই আমাদের দুঃখের পেয়ালা আজ ভরে উঠেছে। দেশ আর দেশের ভবিষ্যৎ নাগরিকদের সত্যিকার স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে জনপ্রিয়তা সন্ধান তেমন কিছুমাত্র গৌরবের কথা নয়। শাসনযন্ত্র আজ দুর্বল, ছাত্র-শ্রমিকদের ভয়ে কম্পমান, দেশ তেমন নকল জনপ্রিয় সরকার চায় না, চায় দক্ষ সরকার যার ইংরেজি এফিসিয়েন্ট গভর্নমেন্ট। আমাদের বর্তমান সরকার দক্ষ তথা এফিসিয়েন্ট হোক এ আমাদের আন্তরিক কামনা। তা হওয়ার সব রকম সুযোগ-সুবিধা রয়েছে এ সরকারের–এমন জনপ্রিয় নেতা, এমন সংহত দল, এমন সংখ্যাগরিষ্ঠতা ইতিপূর্বে কোন সরকারেরই ছিল না। তবুও কেন এ নৈরাজ্য, বিশেষ করে শিক্ষার ক্ষেত্রে? 

[‘শিক্ষাক্ষেত্রে আমরা প্রায় নৈরাজ্যের সম্মুখীন’ প্রবন্ধটি প্রথম গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ১৯৭২ সালে শুভবুদ্ধি গ্রন্থে।]

অধ্যায় ৩০ / ৩০

সকল অধ্যায়

১. সাহিত্য ও শিল্পের উপেক্ষিত উপকরণ 
২. সাহিত্যের সঙ্কট 
৩. সাহিত্যের ঐতিহ্য
৪. সমাজ ও সাহিত্যিক 
৫. সাহিত্যে আধুনিকতা
৬. সাহিত্যের একটি সমস্যা 
৭. আধুনিক মন : আধুনিক সাহিত্য 
৮. সাহিত্যের ভূমিকা
৯. সাহিত্য ও সাহিত্যিক 
১০. সাহিত্যে বিদ্রোহ 
১১. সাহিত্য ও সাহিত্য-পুরস্কার 
১২. সাহিত্যের উপকরণ
১৩. সমালোচনা 
১৪. সাহিত্য ও সংস্কৃতি 
১৫. সংস্কৃতি 
১৬. সংস্কৃতি ও মুক্তচিন্তা 
১৭. সংস্কৃতি প্রসঙ্গে 
১৮. বুদ্ধির মুক্তি 
১৯. শিল্পীর স্বাধীনতা 
২০. বনের বাঘ বনাম মনের বাঘ
২১. লেখকের স্বাধীনতা 
২২. মানবতন্ত্র 
২৩. মানব-কল্যাণ 
২৪. ধর্ম ও রাষ্ট্র 
২৫. সভ্যতার সংকট 
২৬. ধর্মভিত্তিক বনাম ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা প্রসঙ্গে 
২৭. ছাত্র রাজনীতির ভয়াবহ পরিণতি 
২৮. রাষ্ট্র : সমাজ আর ছাত্র
২৯. ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বিপদ 
৩০. শিক্ষাক্ষেত্রে আমরা প্রায় নৈরাজ্যের সম্মুখীন

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন