শৈলেন ঘোষ
তাহলে বরং আমার নিজের কথা দিয়েই গল্পটা শুরু করা যাক!
তোমার আবার কী কথা?
আছে, আছে। শুনলে হাঁ হয়ে যাবে! সে ভারি আজব কথা!
বলেই ফেলো তাহলে, শুনি!
কথাটা কী জানো, এই যে কোটি কোটি মানুষ পৃথিবীজুড়ে ঘুরছে-ফিরছে, হাসছে-কাঁদছে, নাচছে-গাইছে, মারছে-ধরছে, গড়ছে-ভাঙছে এদের সক্কলেরই একটা-না-একটা নাম আছে। আজব কথাটা হল, আমার কোনো নাম নেই!
শুনলে আরও তাজ্জব হয়ে যাবে, আমি বিলকুল ফক্কা!
সে আবার কী?
ফক্কা, ফক্কা! ফক্কা মানে জানো না? এ তো খুব সোজা! এই যেমন ধরো তোমার কথা। তোমার একটা মাথা আছে, মাথাভরতি একঝাঁক চুল আছে, একটা নাক আছে, কান আছে, চোখ আছে, হাত-পা, এমনকী বুকের ভেতর একটা ধুকধুকি সবসময় ধুকধুক করছে। আমার কিন্তু সেসব কিচ্ছু নেই। অথচ আমি কথা বলতে পারি, দেখতে পাই। আমি পৃথিবীর এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে নি:শব্দে ঘুরে বেড়াই হাওয়ায় ভেসে ভেসে। মজাটা কী, আমায় কেউ দেখতেও পায় না, আমার কথা জানতেও পারে না। আমি শূন্য, তাই আমি ফক্কা!
আরও মজার কথা কী জানো, এইভাবে সবার অজান্তে কত কী যে উদ্ভট কান্ড দেখতে পাই, বলে শেষ করা যায় না।
একবার হয়েছে কী, এলোমেলো উড়তে উড়তে ফস করে একটা ঘন জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে পড়ি। চারপাশটা তন্নতন্ন করে দেখেও মনে করতে পারলুম না এদিকে কোনোদিন এসেছি কি না। জঙ্গলটা ঘন বলে ঘন! তুমি মাথা খুঁড়ে মরে গেলেও একচিলতে আকাশও দেখতে পাবে না। দিনদুপুরেও যেন আঁধার। যেদিকেই চোখ ফেরাও, গা-ছমছম অন্ধকার। আমার অবশ্য গা-ছমছম করার কথা নয়, কেন-না, আমি তো ফক্কা! তবে, তুমি যদি এ জঙ্গলে দুম করে ঢুকে পড়ো, তোমার গায়ে কাঁটা দেবেই!
যাক, সে তো অন্যকথা। তুমি নিশ্চয়ই ভাবছ, এটা কে রে! আসল কথা না বলে ফালতু ধানাই-পানাই করছে! যেমন নামেও ফক্কা, তেমনই গল্পেও ফক্কা নাকি!
আরে বাবা না! গল্প বলতে গেলে কোথাকার গল্প সেটা তো আগেভাগে একটু বলে নিতে হয়। গল্প তো ওই চমকদার গগন জুড়েও আছে, আবার এই চটকদার ভুবন জুড়েও গল্পের ছড়াছড়ি। তাই তো এত ধানাই-পানাই!
এখন তোমার নিশ্চয়ই মনে হচ্ছে, আমি যে-জঙ্গলে আচমকা ঢুকে পড়েছি সে-জঙ্গলে বাঘ আছে, হয়তো ভালুক আছে, এমনকী সেই সাংঘাতিক ঝাঁক ঝাঁক খুনে বুনো-কুকুরও আছে। থাকতে পারে। জঙ্গলটা যখন গভীর, তখন বাঘ-ভালুক থাকবে না, এ তো ভাবা যায় না? তবে, সত্যি বলতে কী এখনও পর্যন্ত বাঘের গর্জনও শুনিনি, কুকুরের খ্যাঁকখ্যাঁকানিও কানে আসেনি। কিন্তু আবছা অন্ধকারে হঠাৎ যেটা দেখতে পেলুম, সেটা দেখেই পটকা ফটাস! দেখি কী, ঝোপের মধ্যে ইয়া পেল্লায় কটা মূর্তি খাড়া দাঁড়িয়ে আছে! অবশ্য, মূর্তিটা তো আমায় দেখতে পাচ্ছে না। কাজেই আমার ভয় পাওয়ারও কিছু নেই। আমি তো ফক্কা। তাই ভাবলুম, কাছে গিয়ে দেখি ইনি কে বটে!
ওমা! কাছে গিয়ে দেখি, ইনি জ্যান্ত নন, একটা পেল্লায় পাথরের মূর্তি। খোদাই করা। ও বাবা, পেল্লায় বলে পেল্লায়! তোমার মতো পাঁচ-ছ-জন, একজনের ঘাড়ে আর একজন পা রেখে পরপর সটান দাঁড়ালে যতটা পেল্লায় দেখতে হবে, তেমনই পেল্লায় মূর্তিটা। তেমনি ঢাপ্পুস মুখখানা। যেমন ভাঁটার মতো চোখ, কান দুটোও তেমন কলাগাছের পাতার মতো ঢাউস। ঠোঁট দুটোও দেখো। ছিরি নেই, ছাঁদ নেই, থ্যাবড়ানো! মূর্তির যখন সব আছে তখন হাত-পা থাকবে না, তা তো হয় না। মূর্তির দু-পাশে দুই লম্বা হাতও আছে, ঢ্যাঙা-ঢ্যাঙা দুটো পা-ও আছে। কী ভয়ংকর! যেন একটা দৈত্য দাঁড়িয়ে আছে জঙ্গলের ঝোপের আড়ালে!
তুমি শুনলে শিউরে উঠবে, ঠিক এই সময়ে ঘটল একটা আজব কান্ড। কী, না সেই মূর্তিটা আচমকা একেবারে আকাশ-কাঁপানো মেঘের মতো গর্জে উঠল। এই গর্জনের কাছে বাঘ-সিংহের গর্জন কোথায় লাগে! নস্যি! আমি যে আমি, যার নাম ফক্কা, সে পর্যন্ত শব্দের ধাক্কায় হাওয়ায় একটা গোঁত খেয়ে থমকে গেল? কী আশ্চর্য! যা কোনোদিন ভাবতেই পারিনি, আজ কিনা সেটাই ঘটে গেল! আমি গোঁত খেলুম!
ঠিক আছে। সে না-হয় হল। কিন্তু সে কি শুধুই গর্জে থেমে গেল?
না, আরও ভয়ংকর ব্যাপার। গলা ফাটিয়ে সেই পাথরের মূর্তি কথা কয়ে উঠল, ‘কীরে, কিছু খুঁজে পেলি?’
অন্ধকারে কোথায় ছিল কে জানে, দেখি কী, সেই বাজখাঁই গলা শুনে একটা লোক পাঁই পাঁই করে ছুট মারল! লোকটা যে সাংঘাতিক ভয় পেয়েছে, সে আর বলতে! মধ্যিখান থেকে হল কী, অন্ধকারে পড়িমড়ি ছুটতে গিয়ে তার পায়ে জড়িয়ে গেল ঝোপ-ঝাড়ের লতাপাতা। মারল এক ডিগবাজি। পড়ল মুখ থুবড়ে। গেল বোধহয়!
আরে না, না। সঙ্গে সঙ্গে ঘটে গেল সে আর এক আশ্চর্য ঘটনা। দেখি কী, হঠাৎ হেসে উঠল সেই মূর্তিটা! মূর্তির সে কী বিকট হাসি! জঙ্গল কাঁপিয়ে সেই হাসির শব্দ ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। তার ওপর আরও আশ্চর্য কী, হঠাৎ সেই মূর্তি গলাটা একটু মোলায়েম করে লোকটাকে বলল, ‘এই যা:! পড়ে গেলি তো! লেগেছে? দূর বোকা, জঙ্গলের অন্ধকারে ভয়ে অন্ধের মতো কেউ ছুটে পালায়! আয়, আমার কাছে আয়!’
চোখের পলকে লোকটা ঝেড়েঝুড়ে উঠে দাঁড়াল। ভয়ে মুখখানা চুপসে এইটুকু হয়ে গেছে। তারপর ফ্যালফ্যাল করে এদিক-ওদিক তাকিয়ে ঘুরপাক খেতে লাগল। কাউকে দেখতে পেল না।
তার ওই অবস্থা দেখে মূর্তি আবার বলে উঠল, ‘এই তো, আমি। এই তো তোর সামনেই দাঁড়িয়ে আছি। দেখতে পাচ্ছিস না, আমার এই পাথরের মূর্তিটা!’
বুঝতেই তো পারছ, তখন কী অবস্থা সেই লোকটার। ভয়ে চুপসানো মুখখানা শুকিয়ে একেবারে আমচুর হয়ে গেছে! হবেই তো! সে কেন, পৃথিবীর কোনো মানুষ কি কোনোদিন ভাবতে পারে, একটা পাথরের মূর্তি কথা কইছে! শুনলে, কে না বলবে, যত সব আজগুবি গল্প শোনাচ্ছে! ঠিক কথা!
তবে শোনো, আমি তো ফক্কা! আমি এখানে-ওখানে-সেখানে হঠাৎ-হঠাৎ এমন সব অদ্ভুত কান্ড দেখি, শুনলে কেউ আজগুবি বললেও আমি কিছুতেই মানব না। তবে শোনো, আমি একবার ঝড়ের তোড়ে ভাসতে ভাসতে হঠাৎ একটা ফর্সা মানুষের দেশে গিয়ে পড়ি। ঝড় মানে কী, সব যেন ভেঙে-ছড়িয়ে পৃথিবীটাকে শেষ করে ফেলবে! শুধু কি ঝড়, সঙ্গে আকাশ চমকায় মুহুর্মুহু বিদ্যুতের ঝলকে। মেঘেরও তেমনই গর্জন।
এমন সময় হঠাৎ হল কী, একবার এমন বিদ্যুৎ চমকাল যে, তার দাপটে আকাশ তো ঝলসালই, সঙ্গে ঘটল একটা চোখ-ধাঁধানো কান্ড! দেখলুম কী, বিদ্যুতের ঝলক থেকে ছিটকে বেরিয়ে এল একটা জ্বলন্ত আগুনের গোলা। সেটা দাউদাউ করে জ্বলছে, আর ঝড়ের ঘূর্ণিতে পাক খাচ্ছে। পাক খেতে খেতে সেই জ্বলন্ত গোলাটা শূন্য থেকে নীচে নেমেই, একটা দোতলা-বাড়ির চান-ঘরে ঢুকে পড়ল জানলা গলে। তখন চান-ঘরে ছিল একটি তরুণ ছেলে। সে তো ভয়ে-ময়ে দরজা খুলে গেল পালাতে! ওমা! সঙ্গে সঙ্গে সেই আগুনের গোলাটা কী করল, তার চারপাশে বাঁই-বাঁই করে ঘুরপাক খেতে লাগল! মজা কী, তার গায়ে একুটও ছেঁকা লাগল না। পাক খেল মাত্র কয়েক মুহূর্ত। তারপরে কোথাও কিছু নেই, হুস করে চান-ঘরের নর্দমার মধ্যে ঢুকে পড়ল। ঢুকে চোখের পলকে হারিয়ে গেল, আর দেখা গেল না। এ তো আর আজগুবি কথা নয়। আমারও দেখা আছে, বইয়েও লেখা আছে।
তা, সে যাই হোক, এবার আবার পাথরের মূর্তির কথা বলি। পাথরের মূর্তি সেই লোকটাকে ডেকে যেসব কথা বলল লোকটা সেইসব কথা শুনে হাঁ। মূর্তিটা বলল, ‘শোন, তোরা কী খুঁজছিস আমি জানি। হিরে-জহরত, মণি-মুক্তো এইসব তো? মনে হচ্ছে, তোরা বোধহয় শুনেছিস, এককালে এখানে এক রাজার রাজপ্রাসাদ ছিল। এক ভয়ংকর ভূমিকম্পে রাজার রাজত্বটা যেমন ধ্বংস হয়ে গেল, সঙ্গে রাজপ্রাসাদটাও। তোরা নিশ্চয়ই একথাও শুনেছিস, সেই রাজার ছিল অনেক ধনরত্ন। হ্যাঁ ঠিকই শুনেছিস। ছিল। তবে সে সবই রাজবাড়ির ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়ে আছে। তা, সে কি আজকের কথা! অনেকদিন হয়ে গেল। এখন তো দেখছিস চারদিকে ঘন জঙ্গল। এই জঙ্গল খুঁড়ে কি আর ধন-রত্ন পাওয়া যায়! তবে আশ্চর্য কথা কী জানিস, ভূমিকম্পের মারাত্মক ধাক্কায় সব কিছু গুঁড়িয়ে চুরমার হয়ে গেলেও কিন্তু আমার এই মূর্তিটা রক্ষা পেয়ে গেল। কোন জাদুবলে আমি জানি না। আরও জানি আমিই সেই রাজা।
আমি দেখতে পাচ্ছি, তোর মতো আরও অনেকেই খুঁজে বেড়াচ্ছে আমার ধনরত্ন। আমার মনে হয়, তুই তাদেরই সঙ্গী। কীরে, ঠিক বলিনি?’
লোকটা ভয়ে ভয়ে ঘাড় নাড়ল। যার মানে, হ্যাঁ।
মূর্তি তার ঘাড় নাড়া দেখে বলল, ‘তাহলে শোন, যেখানে-সেখানে এভাবে খোঁজাখুঁজি করে লাভ নেই। তোরা কিছুই পাবি না। আমার বিশ্বাস, তোরা ধনরত্ন পেতে পারিস আমার রাজপ্রাসাদের ধ্বংসস্তূপে। তা, সেই ধ্বংসস্তূপও তো আরও গভীর জঙ্গলে। সেখানে তোদের যেতে হবে। সেই ধ্বংসস্তূপ কি তোরা খুঁজে বার করতে পারবি?’
যে-লোকটা এতক্ষণ পাথরের মূর্তির মুখে কথা শুনে ভ্যাবাচাকা খেয়ে দাঁড়িয়েছিল, সেই লোকটাই হঠাৎ চিৎকার করে বলে উঠল, ‘হ্যাঁ পারব, নিশ্চয়ই পারব।’ বলে আবার ছুট দিল। ছুটল সঙ্গীদের কাছে।
এবার অবশ্য লতাপাতায় তার পা জড়িয়ে অঘটন কিছু ঘটল না। সে নির্বিঘ্নেই পৌঁছে গেল তার সঙ্গীদের কাছে। তা হবে, তার প্রায় আট-দশজন সঙ্গী জঙ্গলের সেই আবছায়ায় মাটি খুঁড়ে খুঁজছে রাজার ধন-রত্ন। স্পষ্ট দেখা না গেলেও বোঝা যায়, লোভে চকচক করছে তাদের চোখগুলো।
লোকটা ছুটতে ছুটতে পৌঁছে গেল তাদের কাছে। হাঁপাতে হাঁপাতে হুংকার দিয়ে উঠল ‘পেয়েছি! পেয়েছি!’
সঙ্গীরা তার হুংকার শুনে খোঁড়াখুঁড়ি ছেড়ে লাফিয়ে উঠেছে। লাফিয়ে তাকে ঘিরে ধরে জিজ্ঞেস করল, ‘কই? কই? কী পেয়েছিস?’
লোকটা উত্তর দিল, ‘ধনরত্ন এখানে পাওয়া যাবে না। কোথায় পাওয়া যাবে। তার হদিশ আমি পেয়েছি। জঙ্গলের গভীরে আছে রাজপ্রাসাদের ধ্বংসস্তূপ। ধনরত্ন পাওয়া যাবে সেই ধ্বংসস্তূপে। এক্ষুনি আমাদের জঙ্গলের আরও গভীরে যেতে হবে। খুঁজে বার করতে হবে সেই ধ্বংসস্তূপ। আর দেরি নয়, চলো এক্ষুনি চলো!’
কথা মুখ থেকে পড়তে যতক্ষণ। সঙ্গে সঙ্গে তার সঙ্গীরা টপকাতে শুরু করে দিল জঙ্গল। ঢুঁড়তে লাগল রাজবাড়ির ধ্বংসস্তূপ। তা, ঢুঁড়লে কী হবে, জঙ্গল তো আর একটুখানি নয়, যে ফুৎকারে ধ্বংসস্তূপ তোমার চোখে ভেসে উঠবে। ঢুঁড়তে ঢুঁড়তে একঘণ্টা, দু-ঘণ্টা, তিন-চার-পাঁচ ঘণ্টা পার হয়ে গেল! ঢুঁ-ঢুঁ! কোথায় কী! ধ্বংসস্তূপের ‘ধ’-ও নজরে পড়ল না। শেষপর্যন্ত মানুষগুলো নাকাল হয়ে, যে-যেখানে পারল চিৎপাত! আর পা চলে না। চিৎপাত হয়ে ভাবতে লাগল, এবার কী হবে!
সত্যিই তো এবার কী হবে?
এবার উঠতে হবে। তাদের সেই যে সঙ্গী জঙ্গলের গভীরে রাজবাড়ির ধ্বংসস্তূপ খুঁজে বার করতে বলেছিল, তাকে ধরতে হবে। কে তাকে বলেছিল, জঙ্গলের গভীরে রাজবাড়ির ধ্বংসস্তূপে ধন-রত্ন চাপা পড়ে আছে? সেটা জানতে হবে। সুতরাং, ধরো তাকে!
ব্যাস! এবার ফাঁপরে পড়ল সেই সঙ্গী। তাকে সবাই ছেঁকে ধরল তখন, যা সত্যি, সেই কথা সে খুলে বলল। বলল, সেই কথা-বলা পাথরের মূর্তির কথা।
শুনে, সবাই সমস্বরে চিৎকার করে উঠল, ‘তুই মিথ্যে বলছিস! কোনকালে কে শুনেছে পাথরের মূর্তি কথা বলে!’
সত্যিই তো, যে-কথা বিশ্বাস করার নয়, সে-কথা কেউ মানবে কেন!
তখন সঙ্গীটি বলল, ‘আমার কথা যখন বিশ্বাস করছ না, তখন আমার সঙ্গে চলো তোমরা সেই মূর্তির কাছে।’
যা কথা তা-ই কাজ। সবাই চলল পাথরের মূর্তির কাছে। হ্যাঁ, তারা মূর্তির সামনে এসে দাঁড়াল। মূর্তি কথা কয়ে উঠল, ‘কীরে, তোরা আমার সামনে এসে দাঁড়ালি কেন? ধ্বংসস্তূপ খুঁজে পেলি না?’ তার গলার স্বর তেমনই। আকাশ-কাঁপানো গর্জনের মতো।
মূর্তির মুখে ওই গর্জন ছড়ানো কথা শুনে, ভয়ে লোকগুলোর আত্মারাম খাঁচাছাড়ার গোত্তর! কীরে বাবা, তারা পালাবে, না মূর্তির পায়ে লুটিয়ে পড়বে!
না, তারা কিছুই করল না। উলটে মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে ঠকঠক করে কাঁপতে লাগল।
তা সামনে দাঁড়িয়ে লোকগুলোকে অমন ঠকঠক করে কাঁপতে দেখে মূর্তি হেসে ফেলল। হাসতে হাসতে বলল, ‘আমাকে দেখে ভয়ে কাঁপছিস কেন? দুর বোকা! আমাকে ভয় নেই তোদের। আমি তো পাথর। এখানে ঠায় দাঁড়িয়ে আছি। আমার কারও ক্ষতি করার কোনো ক্ষমতা নেই। দেখলুম, তোরা অন্ধকারে আমার হারিয়ে-যাওয়া ধন-রত্ন এখানে-ওখানে খুঁজছিস, তাই বললুম, এখানে সেই ধন-রত্ন পাবি না। আমার রাজপ্রাসাদের ধ্বংসস্তূপে পেতে পারিস। তা, তোদের দেখে মনে হচ্ছে, সেখানেও তোরা কিছু পেলি না?’
সঙ্গে সঙ্গে সেই একদঙ্গল লোকের মন থেকে ভয় যেন উবে গেল মুহূর্তে। তারা হতাশ স্বরে চেঁচাল, ‘না, আমরা রাজপ্রাসাদের ধ্বংসস্তূপ খুঁজে পেলুম না।’
মূর্তি বলল, ‘তা হলে আর কী হবে।’
তখন সেই প্রথম দেখা লোকটি হঠাৎ বলে উঠল, ‘তুমি আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চলো না রাজবাড়ির সেই ধ্বংসস্তূপে!’
লোকটার কথা শুনে পাথরের মূর্তি এবার বিকট শব্দ করে হেসে উঠল, হো-হো-হো। হাসতে হাসতে বললো ‘তুই একটা গন্ডমুখ্যু! আরে বাবা, আমি যাব কেমন করে? আমি কি তোদের মতো জীবন্ত মানুষ? আমি তো পাথর! আমাকে তোরা যদি তোদের মতো জীবন্ত করতে পারতিস, তাহলে আর কোনো কথাই ছিল না, আমি নিজেই তোদের আমার চেনা-পথে সোজা ধ্বংসস্তূপে নিয়ে যেতে পারতুম।’
মূর্তির কথা শুনে এবার সবাই হতাশায় দীর্ঘশ্বাস ফেলল। একজন তো হতাশ গলায় বলেই ফেলল, ‘সত্যি কথাই, পাথরকে তো আর জীবন্ত করা যায় না।’
তার কথা শুনে তখন মূর্তিও একটা উদ্ভট কথা বলল। বলল, ‘কে বলেছে পাথরকে জীবন্ত করা যায় না? যায় রে যায়। আমিও তোদের মতো হেঁটে-ছুটে বেড়াতে পারি, তোরা যদি কেউ আমার জন্যে জীবন দিতে পারিস।’
মূর্তির এক ভয়ংকর কথা! ওই দশটা মানুষের বুকের ধুকধুকি যেন একসঙ্গে থমকে ওঠে। তারপর ওই দশটা মানুষের বিশটা চোখ এ-ওর মুখের দিকে তাকায়। কে দেবে জীবন? কেউ একজন জীবন দিলে তার কী লাভ? তার জীবনটাই যাবে, সে তো ধন-রত্ন পাবে না। কাজেই সে ভাবে, আমি কিছুতেই জীবন দেব না, আমি ধন-রত্ন নেব! আর একজনও ভাবে একই কথা। আসলে দশজনই ভাবে জীবন দেব না, ধন-রত্ন নেব। তারপর শুরু হয়ে যায় নিজেদের মধ্যে খন্ডাখন্ডি। এ বলে তুই জীবন দে, আর একজন বলে তুই দে! তারপর এ-ওকে খামচে ধরে, আর একজন অন্যজনকে জাপটে ধরে। লেগে গেল নিজেদের মধ্যে ঝটাপটি। ঝটাপটি থেকে মারামারি। মারামারি থেকে রক্তারক্তি। দশজনের মধ্যে সে ধুন্ধুমার লড়াই। এ লড়াই যতক্ষণ চলল আমি ততক্ষণ দেখলুম। দশটা মানুষ যখন লড়াই করতে করতে বিধস্ত হয়ে এদিকে-ওদিকে ছিটকে পড়ল, তখন রাত কাবার হয়ে সকালের আলো ফুটব-ফুটব করছে।
হ্যাঁ, সত্যিই তা-ই। এইমাত্র সকালের প্রথম রোদের একটি রেখা, গাছপাতার ফাঁক দিয়ে, মূর্তির গায়ে এসে পড়ল। পাথরের মূর্তি এবারও হেসে উঠল সেই আগের মতো বিকট আওয়াজ করে। হাসতে হাসতে বলল, ‘ওরে দুরন্ত লোভ, তুই কবে মানুষের মন থেকে দূর হবি বলতো?’
ঠিক এই সময়ে হঠাৎ একটি রঙিন পাখি ডানা মেলে উড়ে এল। এসে, সেই পাথরের মূর্তির কাঁধে বসল। মূর্তির কানের কাছে মুখটা এনে যেন কিছু বলল। হয়তো বলল, ‘মানুষের লোভ সেদিনই দূর হবে, যেদিন পৃথিবী ধ্বংস হবে!’
তবে এই ফাঁকে একটা কথা বলে রাখি, আমি কিন্তু কোনোদিন ধ্বংস হব না। আমি যে ফক্কা!
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন