৫.০২ উদোর পিণ্ডি – শওকত থানবী

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ

ব্যক্তিগতভাবে আমি জীবন-সঙ্গিনীকে সফর-সঙ্গিনী করার ঘোরবিরোধী। সুতরাং গতকাল বউ-ছেলেমেয়ে পাঠিয়ে দিয়েছি আর আজকে আমি একলা যাচ্ছি।

অনেক ছেলেমেয়ের বাবা এবং অনেক বউয়ের স্বামীই হয়তো আমার এই অবস্থাকে আহাম্মকি মনে করবেন। কিন্তু আমার নিজের মত হচ্ছে, সফর করলে সফরই করব– suffer করতে রাজি নই। আর, ট্রেনের সফরে ছেলেমেয়ে সঙ্গে থাকলে তো কথাই নেই। আমি চাপব ট্রেনে আর তাঁরা চাপবেন আমার ঘাড়ে। কয়েকবারের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে জ্ঞান লাভ করেছি এবং চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, বউ-ছেলেমেয়ে নিয়ে সফর করব না কস্মিনকালেও।

এখন কেমন আরাম। একটা বার্থ রিজার্ভ করে নিয়ে একলা যাই, নিরাপদে ঘুমোই, জানালার ফাঁক দিয়ে মুখ বের করে দৃশ্য দেখি, মাটির পেয়ালায় একআনা দামের চা খাই এবং প্রয়োজনবোধে ট্রেনের শব্দের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ঠুমরি কিংবা দাদরা গাই কেউ কোনোরকমের আপত্তি তুলতে পারে না। গাড়ি থামলে প্ল্যাটফর্মে পায়চারি করি, চানাচুর-বাদামভাজা কিনে আস্তে আস্তে চিবোই, যতক্ষণ খুশি, ডাইনিং-কারে ঝিমোই এবং মেজাজ-মাফিক সহযাত্রী পেলে তাস পিটোই– কারও কিছুই বলার থাকে না। আর, সহযাত্রী মেজাজ-মাফিক না-ও যদি জোটে, সারারাত নাক ডেকে নিদ্রা দিই এবং সারাটা দিন ঘুম-ঘুম ভাব দেখিয়ে চোখ জুড়িয়ে আলতো হয়ে পড়ে থাকি– তাতেই-বা কার কী বলার থাকতে পারে!

অথচ, এমন না-হয়ে যদি বাচ্চাকাচ্চা আর তাদের জননী সঙ্গে থাকেন, তাহলে আর আমিত্ব পাইনে খুঁজে। তখন আমি হই একটা ভারবাহী পশু। আমার আমিত্ব, ব্যক্তিত্ব, আমার নিজস্ব বলতে কিছুই থাকে না অবশিষ্ট।

এইসব কারণে গতকাল বউ-ছেলেমেয়ে পাঠিয়ে দিয়েছি, আর আজকে আমি নিজে, একলা আমার নিজস্ব ব্যক্তিত্ব আর অবশিষ্ট নিয়ে রওনা হয়েছি।

স্টেশনে পৌঁছে রিজার্ভ করা বার্থের উপর বিছানা পাড়লাম। দীর্ঘ পথে সময় কাটানোর মতো করে পত্রিকা কিনলাম। এক সেট তাসও সঙ্গে নিলাম। গাড়ি ছাড়ার বিলম্বটুকু প্ল্যাটফর্মে পায়চারি করে কাটাব ভেবে সবেমাত্র একটা পা উঠিয়েছি, এমন সময় …

এমন সময় দেখলাম, আমাদের কুদ্দুস চাচা হাতে একটা ঘটি ঝুলিয়ে ভারি ব্যস্ত-সমস্ত হয়ে আমার দিকেই ছুটে আসছেন। একটা থামের আড়ালে লুকিয়ে পড়ব ভাবছি, কিন্তু তার আগেই তিনি ‘বাবা জীবন যে…’ বলে মূর্তিময় বিঘ্নস্বরূপ হয়ে সামনে এসে দাঁড়ালেন। নেহাত বাধ্য হয়ে, আদব-কায়দা বজায় রেখে একটা সালাম ঠুকতেই হল। উত্তরে তিনি হাঁপাতে হাঁপাতে কেটে কেটে বললেন, ‘কোথায় উঠেছ? এই সামনের কামরায়? আচ্ছা।

বললেন এবং সঙ্গে সঙ্গে যেদিক দিয়ে এসেছিলেন, সেই দিকে চলে গেলেন।

বুঝলাম, এখন তিনি লটবহর নিয়ে আসবেন এবং সারাটা পথ আমার ওপর ভর করে থাকবেন। তাঁর যত সব বেয়াড়া কথা শোনাবেন, রোগ-পীড়ার বৃত্তান্ত পাড়বেন এবং বিছানা পেড়ে নেবেন আমাকে দিয়ে। সারাটা পথ ঘুম ভাঙিয়ে জিগ্যেস করবেন, কোন স্টেশন ‘বাবা’ এটা। আমার এত সুন্দর করে সাজানো সমস্ত পরিকল্পনা ভেস্তে তো যাবেই, উপরন্তু সিগারেট খেতে হলেও ঢুকতে হবে পায়খানায়। সর্বোপরি, তিনি যা খাবেন, তার বিল পরিশোধ করার জন্যও আমাকেই অনুমতি চাইতে হবে ভদ্রতা করে এবং অনুমতি দিতে তিনি এতটুকু বিলম্ব করবেন না। এত সব করতে হবে। কেননা তিনি হলেন গিয়ে আমার পরলোকগত শ্রদ্ধেয় জনকের ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের মধ্যে অন্যতম। সুতরাং তিনিও আমার শ্রদ্ধাভাজন।

এইসব চিন্তা করে, নিতান্ত হতাশ হয়ে পড়ে ভাবলাম বিছানাপত্র গুটিয়ে নিয়ে এই সুযোগে পালিয়ে যাই, অন্য কামরার গিয়ে লুকিয়ে পড়ি। কিন্তু সময় আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করল। দেখা গেল, অল্পক্ষণের মধ্যেই সেই কামরায় হোল্ডল যাচ্ছে জানালা গলিয়ে, বাক্স-পেটরা ট্রাঙ্ক ঢোকানো হচ্ছে ধাক্কা মেরে মেরে, বিরাট বিরাট কয়েকটা ঝাঁপিও প্রবেশ করল সেগুলোকে অনুসরণ করে এবং সবশেষে এক-দুই-তিন করে কোত্থেকে কাচ্চাবাচ্চারা এসে নিমেষে আসন জুড়ে বসল। তারপর, এক মহিলা তাঁর শেষ সংস্করণটিকে কোলে নিয়ে কামরায় আবির্ভূত হলেন। অবশেষে কুদ্দুস চাচা এক হাতে টিফিন-কেরিয়ার আর এক হাতে ঘটিটা নিয়ে এসে বললেন, ‘বাবা জীবন, ইনি হলেন গিয়ে তোমার বহিন– শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছেন। এতক্ষণ তো আমি ভেবেই সারা হচ্ছিলাম। এতগুলো ছেলে-মেয়ে আর একলা মানুষ– মেয়ে আমার কেমন করে যাবে! তা বাবা ভালোই হল। তুমি তো আমাদের আপনার মানুষ।’

আমি প্রায় দিশেহারার মতোই বলে ফেললাম। ‘কিন্তু চাচাজান, এখানে তো খুব সম্ভব বার্থ একটাও খালি নেই।’

তিনি বেশ নিশ্চিন্ত মনে জবাব দিলেন, ‘সেসব তোমাকে ভাবতে হবে না, আমি খোঁজ-খবর নিয়েই এসেছি– উপরে একটা বার্থ খালি রয়েছে। তোমার বিছানাটা উপরে করে দাও, আর ও নিচেরটাতেই থাকবে। বড়টাকে তুমি উপরে নিয়ে শুয়ো, আর বাকিগুলোকে ও নিজের সঙ্গেই রাখবে। মাত্র বিশ-বাইশ ঘণ্টারই তো জার্নি, বাবা।’

আমি তবু প্রতিবাদ করব ভাবছিলাম এবং বলতে যাচ্ছিলাম, আমি তো হায়দ্রাবাদেই নামব– এমন সময় হুইসেল বাজল। আর, কুদ্দুস চাচা ‘খোদা হাফেজ’ বলে গাড়ি থেকে নামলেন। তারপর সম্পূর্ণ ট্রেনটা নড়ে উঠল, চলতে লাগল এবং কুদ্দুস চাচা ট্রেনের সঙ্গে সঙ্গে চলতে চলতে তাঁর শেষ বাণী বর্ষণ করতে লাগলেন, ‘বাবা জীবন, একটু লক্ষ রেখো, যেন বাচ্চারা মুখ বাড়িয়ে না থাকে জানালা দিয়ে। হামিদ মিয়া আসবেন লাহোর স্টেশনে ওদের নিতে।…’ এবং এমনি আর কত কী তিনি বলছিলেন আর ছুটছিলেন গাড়ির সঙ্গে সঙ্গে। শেষ অবধি একটা কুলির সঙ্গে ধাক্কা না লাগলে হয়তো লাহোর পর্যন্ত ছুটতেন এমনি করে।

তা যাই হোক, তখনো শুনছি, তিনি বলে যাচ্ছেন, ‘বাচ্চাদের জন্যে দুধের ব্যবস্থা কোরো জানালা বদ্ধ করে ঘুমিয়ো… জিনিসপত্র গুণে নামিও, ষোলটা আছে, টিকিট নিজের কাছে নিয়ে রেখে দাও, নইলে হারিয়ে ফেলবে… সামনের স্টেশনে কুঁজোতে পানি ভরে নিও– খেও– ঘুমিও– তালা– বিছানা… ‘ এবং তারপর তাঁর কথাগুলো ক্রমেই অস্পষ্ট থেকে অস্পষ্টতর হয়ে বাতাসের সঙ্গে মিশে গেল, আর শোনা গেল না।

অমনি আমার মনে হল, আমি মহা-বিপদে পড়ে গেছি এবং এ বিপদ থেকে উদ্ধারের উপায় হিসাবে চেন টানব কিনা, ভাবছি– এমন সময় একটি ছেলে আমার কোট টেনে টেনে বলতে লাগল, ‘সরো এখান থেকে, আমি এখানে দাঁড়িয়ে দেখব।’

ছেলেটির মা তখন তাকে এই বলে ভদ্রতা শেখাতে লাগলেন, ‘বেয়াদব ছেলে, মামা বলতে পারিসনে!’ তারপর, আমাকে সম্বোধন করলেন এই বলে, ‘ভাইজান, আপনি দরজাটা বন্ধ করে জানালার কাঁচটা নামিয়ে দিন, তাহলে ওরা বাইরে দেখতে পাবে।’

হুকুম তামিল করে, নিজের বিছানা গুটিয়ে উপরে তুললাম। তারপর, কোনোরকমে ঘুমিয়ে পড়তে পারলে বা ঘুমিয়ে পড়ার ভান করতে পারলে আপাতত অনেক ঝক্কি থেকে রেহাই পাব মনে করে একটা ঠ্যাং উপরে তুলেছি, এমন সময় ছেলেদের মা তাঁর নিজস্ব বাণীবর্ষণ শুরু করলেন। ঠ্যাংটা আবার যথাস্থানে ফিরিয়ে এনে তাঁর সেই বাণী শুনতে হল আমাকে, ‘ভাইজান, ছেলেটা তো এখনো ঘুমোল না, তা আপনিই আমাদের বিছানাটা একটু পেতে দিন না– বাক্সগুলো ওখান থেকে নামিয়ে রাখুন।– ঝাঁপিগুলোকে বেঞ্চের নিচে সরিয়ে দিন।– পোঁটলাটা আপনার বিছানার মাথার কাছে থাক—-এর মধ্যে ছেলেদের নতুন জুতো রয়েছে। আরে, আরে, ও-কী করছেন! টিফিন কেরিয়ারটা আমাকে দিন।– বাচ্চাটা কোলে ঘুমোচ্ছে, আমার হাত বন্ধ– আপনিই দয়া করে শব্ মিয়ার নাকটা একটু সাফ করে দিন না।… শ মিয়া, মামার কাছে নাক সাফ করিয়ে নাও!… ‘

নিজের ক্ষেত্রে হলে, আমার ছেলের নাক সাফ করতে যাওয়ার আগে তাকেই পকে সাফ করে দেওয়ার সম্ভাবনা ছিল; অথবা নিজের বউ যদি বলত এ কাজ করতে তাহলে তাকে তালাক দেওয়ার কথাও চিন্তা করতাম কিনা, বলা যায় না। অথচ, পরের ছেলের নাক সাফ করা নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বে তা-ও করতে হল, হ্যাঁ তা-ও করলাম।

যাক এখন একটু হাঁফ ছাড়ার সময় পাওয়া গেল। কিন্তু না, তা হবার নয়। আর এক ছেলে তার মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে বিবিন্ শুরু করল। মুখে কিছু বলে না, শুধু ভঙ্গিতে একটা বিশ্রী অভিব্যক্তি, আর কান্না-কান্না ভাব। মা কয়েকবার প্রশ্ন করলেন, ‘কী ব্যাপার, কী হয়েছে?’ কিন্তু কোনো জবাব না পেয়ে শেষে তার গালে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে বললেন, ‘কমবক্ত, কী হয়েছে, বলবি তবে তো’!

কিন্তু কিছুই বলল না সে। চড় খেয়ে কান্না জুড়ে দিল, ‘ভ্যাঁ-অ্যা-অ্যা…

সুতরাং, আমাকেই ভদ্রতা দেখিয়ে এ জটিল পরিস্থিতিতে হস্তক্ষেপ করতে হল। না কাঁদলেও যে ছেলের চোখে-মুখে কান্না কান্না ভাব সবসময় লেগে থাকে, কান্নারত সেই ছেলেকে আদর করলাম। তার মায়ের চাইতে বেশি শক্তি প্রয়োগ করে যে ছেলের গালে ঠাস-ঠাস করে অনবরত চড় মারার ইচ্ছা আমারও হচ্ছিল, সেই ছেলেকে উল্টোদিকের অন্য এক ভদ্রলোকের বার্থে নিয়ে গিয়ে সস্নেহে মাথায়-গালে হাত বুলিয়ে বললাম, ‘কী হয়েছে আব্বু, আমায় বল। ক্ষিদে পেয়েছে? পেটে ব্যথা উঠেছে? নানার কথা মনে পড়ছে? পানি খাবে?

খাওয়ার ব্যাপারে পানির চাইতে বড় কিছুর প্রস্তাব করতে সাহস হল না। কেননা, টফি-চকোলেট, আইক্রিম-লেমনেডের প্রস্তাব করলে তখন সে হাতি-ঘোড়াও খেতে চাইতে পারে– আশ্চর্য নয়।

কিন্তু সবকথার উত্তরেই মাথা নেড়ে যখন সে অসম্মতি জানাল এবং কান্নার ভাব আরো তীব্র হল, তখন বাধ্য হয়েই টফি-চকোলেটেরই প্রস্তাব পাড়তে হল আমাকে।

কিন্তু এবারও যখন সে তার নির্বোধ মাথাটাকে উত্তরে-দক্ষিণে ঘুরিয়ে অনিচ্ছা প্রকাশ করল, তখন তার মা পায়ের স্লিপার উঠিয়ে বললেন, ‘কী চাস, বলবি, না দেব বসিয়ে বল্।’ অপরিচিত ভদ্রলোক সভয়ে পাশ কাটালেন। কেননা, মেয়েদের লক্ষ্যভেদ যে কখনো অব্যর্থ হয় না, একথা হয়তো তাঁর জানা ছিল।

আমিও মধ্যে থেকে বাধা দিয়ে বললাম, ‘আপনি থামুন, আমিই ওর কাছ থেকে জেনে নিচ্ছি।’ তারপর, সেই গোঁয়ার অশ্ব-শাবকটিকে আবার জিগ্যেস করতে লাগলাম, ‘বিস্কুট খাবে? পয়সা নেবে? পেট চেপে ধরে কাঁদছ, পেটে নিশ্চয় ব্যথা হচ্ছে, তাই না? পেটে মালিশ করে দেব? ঘুমুবে? কোলে চাপবে? পেচ্ছাব করবে?’

শুকুর আল্লার কাছে। এই শেষ প্রশ্নটিতে উল্লুকটা মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। এবং তার মা-ও তাঁর এই গুণধর সন্তানটিকে একটা ধমক দিয়ে বললেন, ‘কমবক্ত, তা এতক্ষণ বলছিলিনে কেন?… ভাইজান, আপনি ওকে একটু বাথরুমে বসিয়ে দিয়ে আসুন।’

সুতরাং, তাই করতে হল। কিন্তু কয়েক সেকেন্ড পরেই সে আবার তার মায়ের সামনে এসে মূর্তিমান প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। বোঝা গেল, পায়জামার ফিতেতে গিঁট লেগে গেছে এবং ফাঁস খুলতে গিয়ে সেই-ই এই কাণ্ড ঘটিয়ে এখন আর খুলতে পারছে না। সুতরাং মহিলা নিজেই তাঁর সূক্ষ্ম নখর দিয়ে চেষ্টা চালালেন এবং না-পেরে শেষে দণ্ড প্রয়োগ করলেন। কিন্তু অনেক টানা-হেঁচড়ায় গিঁট এতই শক্ত হয়ে গেছে যে, খোলার কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। এহেন জটিল পরিস্থিতিতে কী করা উচিত, ভাবছি– এমন সময় ইডিয়টটা নিজেই সমস্যার সমাধান করে দিল। সম্পূর্ণ ব্যাপারটাতে যথেষ্ট সময় লেগে গেছে; সুতরাং দেখা গেল, গিঁট খোলার আপাতত আর প্রয়োজন নেই। অতি দ্রুত তার পায়জামাটা উপর থেকে নিচে পর্যন্ত ভিজতে আরম্ভ করল এবং সঙ্গে সঙ্গে আমাদেরও কর্তব্যকর্ম বেড়ে গেল। যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি জিনিসপত্র সরাতে লাগলাম। কেননা, যে হারে বন্যা নামতে শুরু করেছে, তাতে সবকিছু ভেসে যেতে পারে। মহিলাটির জিনিসপত্রও সরাচ্ছি– তাঁর নিজের এখন ফুরসত নেই। তিনি তখন তাঁর আদরের ছেলেটিকে এমনি ভাষায় সম্বোধন করছেন, ‘খোদার গজব নামুক তোর ওপর। এতে বড় উটটা কিনা কাপড়ের মধ্যেই মুতে ফেলল!’

এই মধুর সম্ভাষণ তখনো শেষ হয়নি, হঠাৎ দেখি, মাত্র এক হাত লম্বা তাঁর সর্বশেষ সংস্করণটিকেও একটা থাপ্‌পড় বসিয়ে দিয়ে ধড়মড় করে উঠে বসেছেন তিনি। ক্ষুদে উল্লুকটাও তার অগ্রজের ক্রিয়ার পুনরাবৃত্তি করেছে এবং তাতে মহিলার কাপড়-চোপড় ভিজে নাশ হয়েছে।

বাচ্চাটাকে শুইয়ে দিয়ে তার ল্যাঙট খুলতে লাগলেন মহিলা। একদিকে তার বাজখাঁই চিৎকারের বিরাম নেই, অন্যদিকে মায়ের গজর-গজরও চলছে। এমনি সময়ে ট্রেনটা এসে হায়দ্রাবাদ স্টেশনে ভিড়ল।

মহিলা চিৎকাররত বাচ্চাটাকে আমার কোলে চাপিয়ে দিয়ে বললেন, ‘ভাইজান, একে আপনি একটু প্ল্যাটফর্মে তাজা হাওয়া খাইয়ে নিয়ে আসুন তো, তাহলে থামবে। ততক্ষণে আমি এই ধাড়ি পাঁঠাটার পাজামা বদলে দিই, আর বিছানাটাও ঠিক করি।

এবার আপনারা একটু লক্ষ করুন আমার অবস্থা। আমি বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে প্ল্যাটফর্মে পায়চারি করছি আর তাজা হাওয়া খাওয়াচ্ছি। আমার মতো বদ-মেজাজি অপরিচিতজনকে পেয়ে তার কান্নার মাত্রা চতুর্গুণ হয়েছে, আর আমি তাকে থামাবার জন্য কীরকম সব অদ্ভুত অদ্ভুত কথা বলছি, ‘আরে-রে-রে-রে। ওহো-হো-হো-হো। না-না-না! সোনা আমার মানিক আমার, লক্ষ্মী ছেলে, কাঁদে না, চাঁদ মামা, চাঁদ মামা, টিপ দিয়ে যা। ধুত্তোর ছাই, দেব এক পটকানি! না-না-না। কাঁদে না, কাঁদতে নেই। সোনা-মানিক ছেলে। পাজি কোথাকার। হারামজাদার হাড্ডি। না নচ্ছার, এবারে থামবি, না দেব রেল-লাইনে ফেলে।’

বহুক্ষণ যাবৎ এতরকমভাবে আদর-সোহাগ করার পরও সে থামল না এবং গাড়ি হুইসেল দিয়ে দিল। তখন কামরায় ফিরে এসে, যার জিনিস তাঁকে ফেরত দিয়ে নিশ্চিন্ত হলাম এবং ক্ষুদে উল্লুকটা মায়ের বুকে মুখ গুঁজে চুপ করল।

গাড়ি চলতে আরম্ভ করেছে, হঠাৎ মহিলাটি সাপে কামড়ানো মানুষের মতো আঁতকে চিৎকার করে উঠলেন। ভাবলাম, কি-বা না জানি হল। কিন্তু না, তেমন কিছু নয়। বললেন যে, হায়দ্রাবাদ স্টেশনে দুধ নেওয়ার কথা ছিল, তা নেওয়া হয়নি। বাচ্চাটা তাহলে না-খেয়েই শুকিয়ে মরবে। এইটুকু কথাও মানুষের মনে থাকল না। এখন কী হবে। সর্বনাশ হয়ে গেল। ইত্যাদি।

অনেক কষ্টে ক্রোধ সংবরণ করতে হল এবং তিনি আর তাঁর পুরো ব্যাটেলিয়নের সেবা করতে গিয়েই যে দুধ নেওয়ার কথা মনে ছিল না, সে-প্রসঙ্গের উল্লেখ না-করে বলতে হল যে, দুধের ব্যবস্থা সামনের স্টেশনে চা-অলাদের কাছ থেকে হোক বা যেমন করেই হোক, করা হবে। তাঁর আদরের সন্তানকে দুধের অভাবে মরতে দেওয়া হবে না, তার আগে এ বান্দাই হারিকিরি করে মরবে। মাঝারি সাইজের ছেলেটা জানালায় ঠেস দিয়ে, গালে হাত রেখে ঝিমোচ্ছিল। বললাম, ‘ওকে একটু শুইয়ে দেন, নইলে মুখ ঠুকে পড়বে।’

বললেন, ‘ওকে বরং আপনার বিছানাতেই শুইয়ে দিন, ও আপনার সঙ্গেই থাকবে।’ বললাম, ‘জি, না, তার চাইতে আমার গোটা বিছানাই দিয়ে দিলাম। আপনার বড় দুটোকেই উপরে শুইয়ে দিন, আর আমি নিচে একটা কিছু পেতে এই দরজার কাছেই শুয়ে পড়ব।

উত্তরে তিনি ভারি খুশি-খুশি ভাব দেখিয়ে বললেন, ‘তা যাই হোক, ভালোই হল। ওদের উপরে শোয়াতে আমারও যেন মন কেমন সরছিল না। ওরা উপরে শুলে পড়ে যাওয়ার ভয় ছিল। এখন আপনি ওদের সবাইকে নিয়ে তাহলে নিচেই শোন।’

ইচ্ছে হল, দরজা খুলে চলন্ত গাড়ি থেকে একটা লাফ মেরে দিই। অবাঞ্ছিত মৃত্যু দিয়ে এই অবাঞ্ছিত জীবনের অবসান ঘটাই। কিন্তু আপনারাই আবার আত্মহত্যাকে কাপুরুষতা বলে অভিহিত করবেন। সুতরাং, সারারাত আমি ধাত্রী-সুলভ পরিচর্যায় রত থাকলাম। ছেলেদের খাওয়ালাম। ধোয়ালাম। মোছালাম, আদর করলাম। সুয়োরানি-দুয়োরানির কেচ্ছা শোনালাম। বেসুরো গলায় ঘুম-পাড়ানি গান গাইলাম সুর করে করে। আর, নিজে নিদ্রাহীন, তন্দ্রাহীন রাত্রি যাপন করলাম। তন্দ্রা মাঝে মাঝে যে না-এসেছে, এমন নয়; কিন্তু তখনই সে তন্দ্রা কেটে গেছে মহিলাটির এমনিধারা সব সম্বোধনে, ‘ছম্‌মু মিয়ার গায়ে র‍্যাপারটা একটু টেনে দিন।- কমু মিয়ার মাথাটা সরে গেছে– বালিশের উপর চাপিয়ে দিন… কুঁজো থেকে একটু পানি ঢেলে দিন তো… বাচ্চাটাকে একটু ধরুন দয়া করে, আমি বাথরুম থেকে আসছি।…

Suffer করা কপালে লেখা ছিল, তাই এই সফর। আল্লা-আল্লা করে দুই-ই শেষ হল। এবং লাহোর পৌঁছে প্রথম যে কাজ আমি করলাম, তা হল, নিজের এবং বউ-ছেলেমেয়ে, বাচ্চাকাচ্চা– একসঙ্গে সবার জন্য ফিরতি পথের সিট বুক করে রাখলাম। পিণ্ডি চাপানোই যদি উদ্দেশ্য হয়, তাহলে বুদোর পিণ্ডিই বুদোর ঘাড়ে চাপুক– উদোর পিণ্ডি কেন?

অনুবাদ : নেয়ামাল বাসির

সকল অধ্যায়

১. ১.১ কফন ॥ প্রেমচন্দ / ননীগোপাল শূর
২. ১.২ পৌষের রাত ॥ প্রেমচন্দ / ননীগোপাল শূর
৩. ১.৩ পেশোয়ার এক্সপ্রেস ॥ কৃষণ চন্দর / সৌরীন ভট্টাচার্য
৪. ১.৪ জামগাছ ॥ কৃষণ চন্দর / কমলেশ সেন
৫. ১.৫ তোমার দুঃখ আমাকে দাও ॥ রাজেন্দ্র সিংহ বেদী / ড. অরুণকুমার মুখোপাধ্যায়
৬. ১.৬ ঠাণ্ডা গোশত ॥ সাদত হাসান মান্টো / জাফর আলম
৭. ১.৭ আনন্দী ॥ গোলাম আব্বাস / আখতার-উন-নবী
৮. ১.৮ চড়ুইপাখি ॥ খাজা আহমদ আব্বাস / জাফর আলম
৯. ১.৯ পর্যটক ॥ কুররাতুল আইন হায়দার / মোস্তফা হারুণ
১০. ২.১ সদগতি ॥ প্রেমচন্দ / ননীগোপাল শূর
১১. ২.২ জঞ্জাল-বুড়ো ॥ কৃষণ চন্দর / ড. অরুণকুমার মুখোপাধ্যায়
১২. ২.৩ মিথুন ॥ রাজেন্দ্র সিংহ বেদী / ড. অরুণকুমার মুখোপাধ্যায়
১৩. ২.৪ দুই হাত ॥ ইসমত চুগতাই / ড. অরুণকুমার মুখোপাধ্যায়
১৪. ২.৫ খুলে দাও ॥ সাদত হাসান মান্টো
১৫. ২.৬ সর্দারজি ॥ খাজা আহমদ আব্বাস / এ বি এম কামাল উদ্দিন শামীম
১৬. ২.৭ প্রতিশোধ ॥ খাজা আহমদ আব্বাস
১৭. ২.৮ মা ॥ কুদরতুল্লাহ শাহাব / শহিদুল আলম
১৮. ৩. শ্ৰেষ্ঠ উর্দু গল্প – ৩য় খণ্ড
১৯. ৩.০১ গোঁফ – হামিদ কাশ্মিরি
২০. ৩.০২ মৌন – শফিকুর রহমান
২১. ৩.০৩ সাহেব গোলাম – রাজিয়া ফসিহ্ আহমদ
২২. ৩.০৪ পুতুল – মমতাজ মুফতি
২৩. ৩.০৫ সাইকেল – পিত্তরাম বোখারি
২৪. ৩.০৬ কপোতের প্রাণ – আলি আব্বাস হোসাইনি
২৫. ৩.০৭ মিস্ লোভিট – কৃষণ চন্দর
২৬. ৩.০৮ আপা – মমতাজ মুফতি
২৭. ৩.০৯ শেকড় – ইস্‌মত চুগ্‌তাই
২৮. ৩.১০ খানবাহাদুর – আয়াজ আস্‌মি
২৯. ৩.১১ অনুরোধ – আহমদ নদিম কাসমি
৩০. ৩.১২ কোল্ড ওয়েভ – খাজা আহমদ আব্বাস
৩১. ৩.১৩ মধুমতী – কৃষণ চন্দর
৩২. ৪.০১ ভাড়াটে বাড়ি – ফিকর তওনসভি
৩৩. ৪.০২ মেয়েলি হিসাব – হাজেরা মস্‌রূর
৩৪. ৪.০৩ কালো শালওয়ার – সাদত হাসান মান্টো
৩৫. ৪.০৪ আত্মীয় – গোলাম মোহাম্মদ
৩৬. ৪.০৫ জুয়াড়ি – গোলাম আব্বাস
৩৭. ৪.০৬ পথে যেতে যেতে – আনওয়ার
৩৮. ৪.০৭ আঘাত – হামিদ কাশ্মিরী
৩৯. ৪.০৮ রাজকুমার – কৃষণ চন্দর
৪০. ৪.০৯ একটি সত্যি গল্প – রিয়াজ রউফি
৪১. ৪.১০ ভৈরবী মন্দির লিমিটেড – কৃষণ চন্দর
৪২. ৪.১১ বাবা নূর – আহমদ নদিম কাস্‌মি
৪৩. ৪.১২ হাসিতে অশ্রু – হায়াতুল্লাহ আনসারি
৪৪. ৪.১৩ সন্ন্যাসী ও গণিকা – সোহেল আজিমাবাদী
৪৫. ৫.০১ ধান কাটার আগে – দেবেন্দ্র সত্যার্থী
৪৬. ৫.০২ উদোর পিণ্ডি – শওকত থানবী
৪৭. ৫.০৩ মুরগির চাষ – মুশতাক আহমদ ইউসুফি
৪৮. ৫.০৪ বোবা চোখ – মির্জা আদিব
৪৯. ৫.০৫ হলুদ পাহাড় – গোলামুস্ সাক্‌লাইন নাক্‌বি
৫০. ৫.০৬ নিখোঁজ – খোদেজা মস্‌তুর
৫১. ৫.০৭ সুলতান – আহমদ নদিম কাস্‌মি
৫২. ৫.০৮ দুশমন – আবুল ফজল সিদ্দিকি
৫৩. ৫.০৯ সেকালের মেয়ে – রাজিয়া সাজ্জাদ জহির
৫৪. ৫.১০ ওভারকোট – গোলাম আব্বাস
৫৫. ৫.১১ এক মগ চাল – খাজা আহমদ আব্বাস
৫৬. ৫.১২ বিভ্রান্ত-বৈভব – ইব্রাহিম জলিস
৫৭. ৫.১৩ পলাতকা – গোলাম আব্বাস

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন