মহাশ্বেতা দেবী
বম্বের এক কম্পুটার কোম্পানির কলকাতা শাখার সর্বেসর্বা সুজয়কে গাঁথতে বস প্রচুর ছোটাছুটি করেন। সুজয় গোপার অতীত জানত কি না কে জানে। বালিগঞ্জ সার্কুলারে মরকত প্রাসাদে সাতদিন বিবাহোৎসব চলে। আশীর্বাদও উৎসব। গায়ে হলুদও উৎসব। বিয়ের পর পার্টির বন্যা।
অবশ্যই গোপাকে বাদ দিয়ে।
কনকাঞ্জলি ঢেলে দিয়ে মা বাপের অন্নঋণ চুকিয়ে শুকনো চোখে গটগটিয়ে সেই যে গোপা গাড়িতে ওঠে, তারপরই গোপা অনুপস্থিত।
”মেয়ে অসুস্থ…বিয়ের ধকল…” এসব বলে বস হাস্যাস্পদ হচ্ছিলেন। এবং অষ্টমঙ্গলার দিন সুজয় জানাল, যেহেতু গোপা আসবে না, সেহেতু ওর আসাও অপ্রাসঙ্গিক হবে। বস যেন মাপ করেন।
অপমানে জ্বলতে জ্বলতে বস দৌড়ে গিয়েছিলেন। সল্টলেকে সুজয়ের প্রকাণ্ড বাড়ি। একাধিক প্লট কোনো কৌশলে নিয়ে ভালো বাগান।
গোপা ভি. সি. আরে ছবি দেখছিল।
—তুমি কি ভেবেছ গোপা! আমাকে এ ভাবে বারবার অপদস্থ করছ কেন?
—বিরক্ত কোর না, ছবি দেখছি।
—কথা বলছ কার সঙ্গে?
—ওসব বলে লাভ নেই।
—তুমি যাবে না?
—না, কোনদিন না।
—বাড়ি ভর্তি নিমন্ত্রিত…
—ওটা তোমার প্রচারের জন্যে।
—তোমার মা…
—মা নয়, তুমি নয়…
—এত দেখে বিয়ে দিলাম…
—সব দেখেছিলে! সুজয় যে সাত বছর ধরে ওর বিধবা মাসতুতো বউদির সঙ্গে থাকে, তাও তো জানতে।
—ভেবেছিলাম কুৎসা!
—চমৎকার। এটা তো সুবিধার্থে বিবাহ। তুমি তোমার মেয়ের অতীত চেপে রেখে বিয়ে দিয়েছ। ও নিজের বর্তমান চেপে রেখে বিয়ে করেছে। এরপর সুজয়ের মুখ রাখবার জন্যে ভালো বউয়ের অভিনয় আমাকে করতে হবে না, করব না। তোমার মুখ রাখার জন্যে ভালো মেয়ের অভিনয়ও করব না।
—সম্পর্কই রাখবে না?
গোপা বসকে স্তম্ভিত করে টেবিলে পা তুলে দিয়ে সোফায় এলিয়ে পড়েছিল। হাতের হীরের আংটি ঘোরাতে ঘোরাতে বলেছিল, সম্পর্ক তো সবে শুরু। তোমাদের সম্পর্ক থাকবে।
—গোপা! তুমি এ কি বলছ?
—তোমরা টাটা বিড়লা নও। তাহলে বলা যেত হাউসে হাউসে বিয়ে হয়েছে। তবে তোমরা যেমন উচ্চাকাঙ্ক্ষী, অনেক দূর যাবে। বিয়েটা তো সে ভাবেই হল। সুজয়ের বাবা মাও পাটনা থেকে এসেছিলেন মাত্র।
—তুমি আমার বড় মেয়ে!
—কি আশ্চর্য! তোমার সম্পত্তি বলো। কিন্তু এখন সম্পত্তি তোমার নয়।
—সুজয় কি তোমায় ক্ষমা করবে?
—ওর সঙ্গে আমার চমৎকার বোঝাপড়া। আমার পক্ষে যদি ওর বর্তমানকে মেনে নিয়ে চলা সম্ভব হয়, ওকেও আমার অতীতকে মেনে নিতে হবে।
—তুমি…ওকে…সব বলেছ?
—নিশ্চয়। লুকোব কেন?
—ও মেনে নিয়েছে?
—নিশ্চয়। না মানলে আবার বেরিয়ে যেতাম, অবশ্য তোমাদের কাছে নয়!
—আমার বলার কিছু নেই।
—আহত পিতার ভূমিকাটা খুব মানাচ্ছে না তোমাকে। চার বছর ধরে আমাকে শুধু অবাঞ্ছিত বোঝা ভেবেছ। বিয়ে হয়ে গেল বলে হঠাৎ আমার দোষ কেটে গেল? আমি মুক্ত, না জামিন পেয়েছি, না প্যারোলে খালাস?
—ওই অরূপ!
—ওর নাম তুমি করবে না।
—বিশ্বাস করো, সুজয়ের বিষয়ে কানাঘুষো শুনেছিলাম মাত্র, সব জানতাম না।
—চাইলে জানতে পারতে। সবাই জানে, তুমি জান না কেন? ওদের সম্পর্ক তো বহুদিনের।
—তাকেই কেন বিয়ে করল না?
—বাঃ, বিধবাকে সুজয় বিয়ে করে? একে আত্মীয়, তাতে বিধবা। আবার যদি বিধবা হয়? এ সম্পর্ক নিয়ে অনেক কথা হচ্ছিল বলেই তো সমাজের কাছে মুখ রাখতে এ বিয়েটা করল সুজয়।
—একটা মেয়ের…
—একটা মেয়ে বলতে যদি আমি হই, তাহলে সিধা কথা, আমার কথা তুমিও ভাবোনি, সেও ভাবেনি। অনেক সময় কেটে গেছে, এখন হঠাৎ আমার বিষয়ে দুশ্চিন্তা না করলে খুশি হবো।
—সুজয়!
—কি?
—সে মহিলাকে টাকাপয়সা দিয়ে…
—আমার সঙ্গে সুন্দর সুখী পরিবার গড়বে?
হঠাৎ ফুঁসে উঠেছিল গোপা, সে মেয়েটার দোষ কোথায়? সাত বছরের সম্পর্ক। সুজয় ওর মেয়ের বাবা। সে তো চিরন্তন ভারতীয়া। সম্পর্কও কাটাবে না, বিয়েও করবে না। কাজকর্ম করার যোগ্যতাও নেই। পাপবোধও ওকে তাড়ায়। রাতদিন গুরুর নাম জপে। সুজয় গিয়ে হাজির হয়।
—ছি ছি!
—সবই তো ইনভেস্টমেন্ট। মহিলার স্বামীর টাকা দেখভাল করতে গিয়ে সুজয় এ বাড়িটা দখল করেছে। মহিলাকে ফ্ল্যাট কিনে দিয়েছে। মাসে মাসে খরচ দেয়। সুজয়ের দিক থেকে যথেষ্ট ইনভেস্টমেন্ট আছে। সময়, উদ্যম, টাকা খাটানোর পরিশ্রম। মহিলাকে টাকা তো দেয় এ বাড়ির ভাড়া বাবদ।
—আমি এত জানতাম না।
—এখন জানলে, এখন এসো। সুজয়ের সঙ্গে আমার কথা, দুজনে দুজনকে ঘাঁটাব না, এবং সুখী স্বামী—স্ত্রীর অভিনয় করে চলব। কে জানে কোনো অভিনয় শেখার স্কুল আছে কি না। যারা এ অভিনয়টা আমার মতো ধনী লোকদের বউদের শেখাতে পারে। ঋষিদাও জানবে না। ও তো অভিনয়টা বোঝে না।
পরাভূত, হতভম্ব বস বেরিয়ে এসেছিলেন।
বাড়িতে এসে বলেছিলেন, ওরা এ সব মানে না… আসতে চায় না…
রূপা বলেছিল, বাজে কথা। আমি জানতাম দিদি আসবে না। আসবেই বা কেন? এ বাড়ি থেকে বেরোতে চায় বলেই না বিয়ে করেছে।
—চুপ করো রূপা।
আত্মীয়স্বজনরা তো বসের এমন বোলবোলাও দেখে মনে মনে অনেকদিনই হিংসেয় পুড়ছেন।
এখন তাঁদের মুখ মুখর হল।
—মানা—না মানার কি আছে?
—নিয়ম মানতে হবে না?
—বিয়ে হল কেমন ঘরে তাই বা…
—আসলে গোপা সেবার যা যা করল…
—হ্যাঁ। এমন মেয়েকে যত দাপে রাখবে ততই ভালো।
সুপ্তি বসু অপ্রস্তুত, অপ্রস্তুত। রূপা ঋষিকে ডাকল।
—প্লেটে তুলে খেয়ে নিন তো, আমিও খাচ্ছি। শুনুন, আমি আর আপনি দিদির কাছে যাব। খান।
—খাব?
—কেন খাবেন না? দিদিকে তো আমার শ্রদ্ধা হচ্ছে। তবে ওকে তো এমন বিয়ে দেয়া হল…ঋষিদা! আপনার স্ত্রী কতদিন মারা গেছেন?
—কয়েক বছর হল!
রূপা মুরগির ঠ্যাং হাতে ধরে খুব সহজে বলেছিল, দিদির খুব সাদাসিধে মানুষপছন্দ। অরূপদার মতো। আপনি কিন্তু স্বচ্ছন্দে দিদিকে বিয়ে করতে পারতেন।
—যাঃ! তা কি হয়?
—কেন হয় না? রুদ্রর কথা বলছেন? দিদি ঠিক তাকে ভালোবাসত। এখনই বা কি…
—কি?
—তাও জানেন না? সুজয়দার তো কে একজন আছেন, তার মেয়েও আছে। দিদি বলেছে।
—তোমার বাবা জানতেন?
—তিনি জানেন।
—গোপা, গোপার কপালে শেষ অবধি…
অল্পবয়সে অত্যন্ত প্রখরবুদ্ধি থাকলে ছেলেমেয়েরা যথেষ্ট রায় দিতে পারে।
রূপা বলল, একবার ঘা খেয়েছে বলে দিদি যেন ভাগ্যবাদী হয়ে গেল। একটা বিয়ের কথা হল, চোখ বুজে বিয়ের পিঁড়িতে বসল। এখন যে কি করবে তা তো ওকেই ঠিক করতে হবে।
—মনটা খারাপ হয়ে গেল।
—আইসক্রিমটা খান।
—বাড়ি যাব, রূপা।
—আমি কবে যাব আপনার বাড়ি?
—যেদিন ইচ্ছে, সেদিনই।
—আসলে দিদিকে গেঁজিয়ে যেতে দেয়া হবে না। কোনো ট্রেনিং নিক, কাজ করুক…শেষ পর্যন্ত ওকে অবশ্য ডাইভোর্স করতেই হবে, তাই না?
—তোমার মত তাই?
অবাক হয়ে রূপা বলেছিল, নিশ্চয়। আমি কেরিয়ারটা করে নিই, তারপর দিদিকে মনের জোর জোগাব!
—রূপা। তুমি এসব কথা ভাবো?
—নিশ্চয়। আপনি কি ভাবেন আমি গোয়েন্দা গল্প পড়ি? মালা প্যাটেল আমাদের গ্রুপের কাছে গুরু। ও তো প্রতিবাদ গ্রুপ চালায়। অ্যাডভোকেট। আমার বন্ধুর দিদি। বাঙালী মেয়ে, স্বামী প্যাটেল।
রূপা আরেকটা আইসক্রিম নিয়েছিল।
—আত্মীয়স্বজনদের দেখুন। সবাই দিদির নামে ফিশফিশ করে একশো কথা বলছে। আমি কেটে পড়ি ঋষিদা। এখন আমারও ঝামেলা, না?
—কেন?
—গোপা ফশকে বেরিয়ে গেল তো রূপাকে ধর। অবশ্য সেদিকে খুব সুবিধে হবে না। সুন্দর টুন্দর নই, সেটা হেভি বাঁচোয়া। তাছাড়া আমি রূপা, গোপা নই।
মাধ্যমিকে বেজায় ভালো ফল।
উচ্চমাধ্যমিকে বিজ্ঞানে তৃতীয়।
তারপর ফিজিকস অনার্স।
তারপর?
সকলকে হতভম্ব করে ”সুন্দর সামাজিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশ” (মূল নাম ইংরিজিতে) সংগঠনে যোগদান।
রূপাকে দেখাই যায় না এখন। কখন ও এখানে, কখন ও গ্রামে গ্রামে, জেলা শহরে।
ইউনিট নিয়ে তথ্যচিত্র করছে।
চুল ছেঁটে ফেলেছে, (কে চুলের জন্যে সময় দেয়)। শাড়ি ত্যাগ করেছে। (জিনস ও পাঞ্জাবী অনেক প্র্যাকটিকাল আর ময়লা হলেও বোঝা যায় না)। পায়ে পথের ধারের দোকানে মুচির সযত্ন তৈরি কাবলে পরে (টেকসই জুতো)। ঝোলায় সর্বস্ব বয়ে বেড়ায়।
রূপা বাড়িতে আছে না নেই বোঝা যায় যখন ও কয়েকদিন বাদে বাদে ধপাধপ জামাকাপড় কাচে, মাথায় সাবান ঘষে (নির্মা সাবানই ভালো)!
এ নিয়ে বহু ঝড় বয়েছে বাড়িতে।
রূপার সাফ জবাব। অন্যত্র থাকব। আমার বন্ধুরা অনেকেই থাকে। যারা রোজগার করে।
এ সব কথা হয় মার সঙ্গে।
—এভাবে ঘুরলে বিয়ে হবে?
রূপা চার্মস ধরায়।
—”বিয়ে হবে” মানে? ও সব ভুলে যাও, ভুলে যাও মা। গোপা পাওনি যে বিয়ে ”হবে।”
—বিয়ে করবি?
—করলে করব, না করলে না করব।
—তোর বাবা…
—আমার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে তোমার, বা বাবার মাথা ঘামানোর কোনো দরকার নেই।
—কি এক দঙ্গল ছেলে মেয়ে নিয়ে ঘুরিস।
—চিয়াও মা।
—”বেসনে” (বিউটিফুল সোসাল অ্যানড ন্যাচারাল এনভায়রনমেন্টের সংক্ষেপিত নাম) রূপাকে খেল। কিন্তু সেখানে গোপা কি করে? ঋষি জানো?
—এখন করে না, করত।
—কি করত?
—অফিস সেক্রেটারি।
—সুজয় জানত?
—তা আমি জানি না।
বস জানলা দিয়ে বাইরে তাকান। বলেন, গোপা একমাস নিরুদ্দেশ। আজ ভোরে রূপার ট্রাঙ্ককল, গোপার মৃতদেহ ওটা। আমাকে যেতে বলছে।
—আপনি আমায় কি বলছেন?
—শোনো।
বসের কথা শুনতে শুনতে ঋষির মাথা যেন ক্রমেই ঘুরে যায়, ঘুরতে থাকে।
রূপা ট্রাঙ্ককল করেছে ঝাড়গ্রাম থেকে। সব শুদ্ধ বারো মিনিট কথা বলেছে।
রূপারা কাছাকাছি পিঠাডিহাতে শুটিং করতে গিয়েছিল। ওখানে অরবিন্দ সেন পঞ্চাশ একর জমিতে কাজু গাছ, চল্লিশ একর বিলে মাছচাষ, বিশ একর জমিতে পেঁপে ও পেয়ারার নার্সারি করেছেন। সবই সমবায় প্রথায় হচ্ছে এবং দুশো নরনারী কাজ করে খাচ্ছে। ওখানে বেসনে একটি বেবি ক্রেশ, মা ও শিশু কেন্দ্র, এবং ছোট স্বাস্থ্যকেন্দ্র খুলবে সরকারী সহযোগিতায়। অরবিন্দ সেনের বয়স হয়েছে। ওঁর ইচ্ছে ছিল বেসনেও চেয়েছিল, সমগ্র ব্যাপারটির একটি ডকুমেন্টারি তোলা হোক।
—রূপারা পনেরো দিন ওখানে ছিল।
—জানি।
—অবাধ্য, অসভ্য মেয়ে। বললাম ”নো” হচ্ছে, সেখানে ঢোকো। জবাব দিল ”নো”। আমার কাগজ মানেই নাকি সেটা আরেকরকম ধান্দাবাজি। আমি ধান্দাবাজ।
—খবর তো আজ বেরিয়েছে।
—ওরা দেখেছে কালকেই। রূপা কাল থেকে চেষ্টা করে আজ লাইন পেল।
—তারপর?
—রূপার কথামতো ও গোপা। গোপাকে খুন করে ফেলে দেয়া হয়েছে। ও সনাক্ত করে বসে আছে।
—তারপর?
—বলছি বডি এখানে আনো। এখানে আনলে সব তো আমার হাতে আসে, বুঝলে?
—ও কি বলছে?
—ওখানে যেতে হবে। আমাকে, সুজয়কেও। পুলিশ বলছে, সুজয় সনাক্ত করলে তবে কাটাছেঁড়ার পর বডি দেবে। এখন ব্যাপার হল…
বস অকারণেই গলা নামাল।
—সুজয় তো সবে কাল রাতে ফিরল ট্যুর থেকে। ওকে ফোন করতে কেমন লাগছে।
—কেন? গোপা ওর স্ত্রী।
—যে স্ত্রী একমাস নিরুদ্দেশ, এবং যে…বলতে বাধা নেই….”ডিভোর্সের চিঠি পাবে” লিখে রেখে চলে গেছে এবং যে যাবার সময় থেকে বেসনের উলটো দিকের ব্যাঙ্কের এক কর্মীও নিরুদ্দেশ, তাকে সনাক্ত করতে…মানে ও যদি গোপা হয়…অবশ্য হতে পারে না…সুজয়ের কতটা আগ্রহ থাকতে পারে তা তুমিই বলো।
—এ সব কথার জবাব, নিজের অভিজ্ঞতা থাকলে তবে বলা যায় হয়তো।
—তোমার সে অভিজ্ঞতা নেই। এই তো?
—হ্যাঁ। তবে একটা কথা নিশ্চয় বলা যায়, যে কারণেই হোক, গোপা যদি চলে গিয়ে থাকে, ডিভোর্স চেয়ে থাকে, তাহলেই তাকে একলা অপরাধী বলে ধরে নেব কেন?
—মেয়েছেলের বেলা সাত খুন মাপ?
—গোপা তো একটা খুনও করেনি। রূপা বলছে। আপনি যা বললেন, গোপাকেই খুন করা হয়েছে।
—তুমি বুঝতে পারছ না। বুঝতে পারছ না, ও যদি গোপা হয়, মৃত্যু যদি অস্বাভাবিক হয়, তাহলে এখনকার যা ব্যাপার, কাগজে কেচ্ছা বেরোবেই। গোপা কবে কি করেছিল…আমি… সুজয়…”নো” কাগজ বেরোবার মুখে…
—আপনি চান, ও গোপা হলেও ব্যাপারটা ”না” করতে হবে।
—যা বলেছ।
—আপনি গেলেই ভালো হত।
—না। রূপা সীন করবে।
—তবু চলুন।
—এখানে বডি নিয়ে এসো।
—আমি আনার কে?
—কি করতে বলো?
—সুজয়ের কাছে যান।
—তুমিও চলো।
—আপনারা দুজনেই যান।
—তুমিও চলো।
ঋষি কি করে বোঝাবে? ওর জীবন জেট সেট নয়। বস হয়তো একবিংশ শতাব্দীতে পৌঁছে গেছেন, ঋষি যায়নি। কলকাতায় প্রাতরাশ, দিল্লীতে লাঞ্চ, বম্বেতে ডিনার একই দিনে খাওয়া ওঁর কাছে কিছু নয়।
ঋষি তো উনি নয়। রুদ্র আছে, মা আছেন, বাড়ি আছে।
—যেতে হলেও আমাকে বাড়ি যেতে হবে। বাড়ির ব্যবস্থা করতে হবে। রুদ্র ছোট, মা অসুস্থ।
—তোমাকে বলাটাই অন্যায়, আমার স্বার্থপরতা। কিন্তু আমার পক্ষে একা একা…
—রূপা ওখানে কোথায় আছে?
—আর কোথায়। অরবিন্দ সেনের একটা বাড়ি আছে না? রূপারা তো সেখানেই ওঠে।
—যেতেই বলছেন?
—হ্যাঁ। বলছি।
উনি চেয়ে থাকেন।
ঋষির মনের মধ্যে রেলগাড়ি চলতে থাকে। ”নো” কাগজ বেরোচ্ছে, এটা ঘটনা। এক মাস থেকেই ঋষি মাইনে পাচ্ছে। ” তোমার ভারত” বিভাগের সম্পাদক ঋষি। ঋষি চক্রবর্তী নয়, সি, ঋষি, ভালো দেখাবে ছাপা হরফে। ঋষির মনেও তো লোভ আছে, নাম করবে। ”নো” কাগজ …বস… গোপার খবর জেনেও ওর মন উতলা।
ঋষি নিশ্বাস ফেলে।
হঠাৎ রূপার কথাও মনে হয়। রূপা নিশ্চয় যথেষ্ট অসহায়, যথেষ্ট একলা।
—ব্যাঙ্কের ছেলেটির কথা ভাবা হচ্ছে কেন?
—ভাবার কারণ আছে।
ব্যাঙ্কে ও কি করে?
—কি আবার, কেরানি। গোপার রুচি আর কত ভালো হবে?
ঋষি আরেকটি ধাক্কা খায়। রূপা বলেছিল, আপনি যদি দিদিকে বিয়ে করতেন।
গোপা কেন, কাউকে বিয়ে করার কথাই ভাবেনি ঋষি। ভাবার ফুরসতই পায় না। কাকে বিয়ে করবে, সে আর রুদ্র কি পরস্পরকে মেনে নেবে? প্রেমজার মা বলেছিলেন, আমার মেয়ে তো থাকল না। তুমি বিয়ে করো আবার।
ঋষির কথা নয়, গোপার কথা। অরূপ ছিল সাধারণ মাপের ভদ্র সভ্য সৎ ছেলে। ব্যাঙ্কের এ ছেলেটিও তাই হবে। কিন্তু তার সঙ্গে চলে গেল গোপা? এত সাহস হল?
—কি ভাবছ?
—আমি বাড়ি যাই। বাড়িতেই থাকব। আপনি সুজয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে আমাকে তুলে নেবেন। এখান থেকেই যেতে পারব না।
—বেশ।
ঋষি বেরিয়ে আসে। গোপা যে দেবদারু গাছটার কথা বলেছিল, সেটা অনেক বড়ো হয়েছে। হবারই কথা। একে কলকাতার মাটি বেশ সরস। তাতে প্রচুর আলগা মাটি, সার ঢালা হয়েছিল। নিয়মিত জলও পড়ে। দেবদারু, দেবদারু পার্ক থেকে পাতা ছিঁড়ে এনে ঋষিরা ক্লাবের অনুষ্ঠানে তোরণ সাজাত।
ভোঁদার বাবা ছিলেন এসব সাজসজ্জায় অত্যুৎসাহী। একবার সরস্বতী বসানো হয়েছিলো ওঁর হাতে তৈরী বাঁশের বাতার নৌকোর ফ্রেমে দেবদারু পাতার ঝালর লাগিয়ে সবুজ নৌকোতে। কাগজে সে ঠাকুরের ছবিও উঠেছিল!
ভদ্রলোক গানও বাঁধতেন। সরস্বতী পুজোয় ঋষিরা গাইত, বসন্ত—পঞ্চমী রজনী ভোরে।
গাহিয়া গাহিয়া ফিরি তোমার দ্বারে।
জাগো।
হবি তো হ, ভোঁদার কাকা বসন্তবাবু বিয়ে করে বউ আনলেন। বউয়ের নাম পঞ্চমী। ঋষিদের তখনও গান গাইবার উৎসাহ বেড়ে গিয়েছিল।
ঋষি বাড়ি পৌঁছে যায়।
নলিনী বলে, ভাল দিনে তাড়াতাড়ি এসেছ। আজ কমল কেমন তাজা ট্যাংরা এনেছে। মা বলল যেমন করে, তেমন করে ঝোল রাঁধছি।
—কমল কোথায়?
—মাকে কাগজ পড়ে শোনাচ্ছে।
ঋষি মার ঘরে ঢোকে।
মায়ের নাম কমলিনী, মায়ের বোনের নাম কুমুদিনী। ঋষির মাসি এই বাষট্টি বছরেও দিব্যি শক্ত আছেন। নারকেলডাঙ্গা থেকে বাস বদলে দিদিকে দেখতে আসেন ছোট একটি টিফিনক্যারিয়ার নিয়ে।
—থোড়ের ঘণ্ট তোর মা ভালবাসে, আর নতুন একটা রান্না শিখলাম, ঝিঙে নারকোলে, তোরাও খাস।
রুদ্র অমনি বলল, আমার মোয়া?
—তাও এনেছি দাদু। মোয়া, নারকোল তক্তি, তোমার জন্য আনব না?
মাসির পায়ে চাকা বাঁধা।
সরশুনা গিয়ে পিসতুত বোনের খবর আনেন। কল্যাণী যান কাকীমাকে দেখতে।
স—ব খবর দিদিকে শোনান।
নলিনী আর রানী ঘুরঘুর করে।
—নাও বাছা! তোমাদের দোক্তা ভাজা।
মাসি দেখ কেমন শক্ত আছেন। আর পঁয়ষট্টি না হতে ঋষির মা যেন অথর্ব হয়ে গেলেন। নিশ্বাস নেবার পরিশ্রমেই বুকের হাড় বেরিয়ে আসে। চোখে এ বয়সেই ছানি।
এই মা পাড়ার পুজোয় ভোগ রাঁধতেন। ঋষির পড়া ধরতেন। খটখট করে বাজারে চলে যেতেন। সবগুলো বাংলা কাগজ পড়তেন। পাড়ায় প্রতি বিয়েবাড়িতে আলপনা দিতেন। ঋষির বিয়ের সময়ে আলপনা দেননি। বিধবা হবার পর আর আলপনা দেন নি, তবু কত কাজ করতেন।
উল বুনছেন, সেলাই করছেন, ঋষির বিয়ের সময়ে সূচের কাজে কি সুন্দর বিছানা ঢাকনি বানালেন।
সধবা মার পছন্দ ছিল নীল রং।
বিধবা হয়ে পরতেন কালো পাড়ের কাপড়।
এখন থান সর্বস্ব ওই রোগা অসহায় মানুষটিকে দেখে ঋষির যে কি কষ্ট হয়।
—মা!
—কে, ঋষি এলি?
—হ্যাঁ মা! একটা কাজে হয়তো বস আমাকে ঝাড়গ্রাম নিয়ে যাবেন দিন দুই।
—কাল যাবি? ইস্পাতে? উনি থাকতে আমরা ইস্পাতেই তো যেতাম ঝাড়গ্রাম, ঘাটশিলা।
—না মা। উনি গাড়ি আনছেন।
—এখনি যাবি?
—এলেই যাব, তোমার কোনো কষ্ট হবে না। মাসিকে ফোন করতে পারি। কমল আছে। নিচে মাসিমারা আছেন। আমি চলে আসব।
—কুমুকে ফোন করিস না। ওর তো ঘরসংসার ফেলে আসা। কষ্ট হবে।
বউদি থাকতে মাসির আবার ঘরসংসারের দায়িত্ব কোথায়।
মাসি খুশিই হবে।
—হ্যাঁ … জবা বড় ভালো বউ। বউ তো আমারো ছিল। কে জানত…
প্রেমজার জন্যে মা এখনো দুঃখ পান। ভাবলে ঋষির অবাকই লাগে। ওর মনে তো আর দুঃখ নেই। তবু অবচেতনে প্রেমজা থাকে, প্রেমজা থাকে। নইলে ওর মৃত্যুর ব্যাপারটা কয়েকবার স্বপ্ন দেখল কেন ঋষি?
জাগরণে তো মনে পড়ে না। দশ বছর হতে চলল, রুদ্রর জন্ম থেকে সোজা হিসেব। তখন ঋষির বয়স ছিল ত্রিশ। ওরও চল্লিশ হতে চলল।
প্রেমজার চব্বিশও পূর্ণ হয়নি।
পনের বছর বাদে রুদ্র ওর মার চেয়ে বড় হয়ে যাবে।
ততদিনে হরতনীর সাজে নৃত্যভঙ্গিমায় প্রেমজার ছবিটাও আবছা হয়ে যাবে।
—কমল, একটু শোন।
কমল উঠে আসে। জবাকুসুম তেলের গন্ধ এবং কোনো সাবানের। কমল কেন মাথায় জবাকুসুম মাখে এবং গায়ে মাখে রেশনে পাওয়া সাবান, তা ঋষি জানে না। কমল যেমন বিকট সবুজ রঙের লুঙ্গি পরে তাও ঋষি কাউকে পরতে দেখেনি।
—কি, বলো।
ঋষি সাধ্যমতো সংক্ষেপে ব্যাপারটি বলে। অবশ্যই কমলকে বলে, কাউকে বলিস না।
—বুঝলাম। ফেঁসে যাবে।
—কিসে?
—এ সব ব্যাপারের গুরুত্ব নেই?
—আমি ফাঁসব কেন?
—ওদের বাড়ির ব্যাপারে তোমাকে টানছে কেন? তোমার বস তো নিজেই যথেষ্ট সক্ষম।
—ওদের সঙ্গে আমার বহুকালের আলাপ। তা ছাড়া রূপার কথা ভেবেও যেতে হচ্ছে।
—দেখ! এখানকার জন্যে ভেবো না। আমি দোকান করব, রুদ্র স্কুলে গেলে ওপরেই থাকব। মাসিকে ফোন করবে?
—মাসি থাকলে আরো নিশ্চিন্ত।
—ফোন করো তবে। ঝপ করে খেয়ে নাও। রুদ্রকে বলে যাবে তো। দেরি কোর না।
—মাসিকে তবে তুই ফোন করিস।
মাসির ফোন নেই। ওপরতলায় ফোন করলে ওরা ডাকে। প্রথমত ফোন পাওয়া। তারপর ডাকা দেরি হবে।
নলিনী আর রানীকেও বলতে হয়। কমলকে টাকা দিতে হয়। তারপর কোনোমতে একটু খেয়ে নেওয়া। না, মাছের ঝোলটা ভালই হয়েছে, কিন্তু এমন আগুন গরম যে স্বাদ পাওয়া গেল না।
ছেলের ছুটির দিনে ধীরে সুস্থে দুজনে খায়। কমলের খাওয়া, বসল, গবগবিয়ে খেয়ে উঠে গেল।
রুদ্র ভালবাসে ছোট ছোট মাছ, মুসুর ডাল, উচ্ছে ভাজা। ছোট ছেলে যে অমন তৃপ্তি করে ছোট মাছ খায়, তেতো খায়, তা ভাবাই যায় না।
কুমুদিনী বলেন, জামাইবাবু ঘুরে এসেছেন। তাঁর মতো খাওয়ার রুচি। তেমনি মাথা হেলিয়ে হাসি।
মা বলেন, ছোটবেলার ঋষি।
নলিনী বলে, ওর মায়ের মতো ধরনধারণ।
যার যেমন মনে হয়, তেমন বলে।
ঋষি বলে, এই কমল। আমার বিছানায় শুবি তো বালিশে কিছু পেতে নিবি। বালিশে তেলের গন্ধ অসহ্য। কেমন করে মাখিস?
কেশশ্রী হবো। চুলের বাড় দেখেছ?
নেমে যায় কমল।
কুশল আর রুদ্র অত্যন্ত মন দিয়ে ক্যারম খেলছে। রুদ্র চোখ কুঁচকে ভালোই খেলছে।
—রুদ্র।
—আঃ! দাঁড়াও।
এক মিনিট।
—কি হল?
—শোনো বাবা, আমি একটা কাজে দু’দিন বাইরে যাচ্ছি। তুমি কমল কাকুর কাছে থাকবে। ঠাম্মাকে দেখবে। নলিনী পিসিদের কথা শুনবে, ছোট ঠাম্মা আসতে পারেন।
এলে ওঁর কথা শুনবে।
—তুমি কবে আসবে?
—ধরো দু’দিন।
—আমার হোমটাস্ক?
মেসোমশাই বলেন, আমার কাছে বসে করবে। কুশল করে, তুমিও করবে, ভাবনা কি?
—একটু দেখবেন মেসোমশাই।
—নিশ্চয়।
—মাসিমাকে বলে যাই।
—আমি বলে দিব। নাতিদের জন্য পাকসাকে তিনি বড়ই ব্যস্ত। ইস। মোচাঘণ্ট তো উপরেও দিবে।
—আরেকদিন হবে।
আচ্ছা। এই মেট্রো রেলের ব্যাপার কি চলতেই থাকব? রাসবিহারীর পর। ঈশ। অগম্য।
—হয়ে যাবে।
—তবে উঠতে বেশ লাগে। আর ওই এসকালেটর। কুশল আর আমি তো…
মেসোমশাই বাচ্চাদের মতই হাসেন। ঋষি দেখেছে, বাড়িতে একটু ভালো রান্না হলে, লোডশেডিং কম হলে, কলের জল ঠিকমতো এলে। মেসোমশাই খুব অল্পেই খুশি। ঋষির এটা ভালো লাগে।
সামান্য সন্তুষ্টি তো দেখা যায় না এখন।
—বস, এখানেই বস।
—বসি।
এখানে বসাই ভালো। তাহলে গাড়ি এলেই উঠে যাওয়া যাবে।
—ট্রেন কখন?
—একজন গাড়ি করে নিয়ে যাচ্ছেন।
—কোন জায়গা?
—ঝাড়গ্রাম?
—ভাল। জল ভাল, হাওয়া ভাল। স্বাস্থ্যকর জায়গা। শান্তির জায়গা। বিবাদ ঝামেলা নাই।
ঋষি বলতে পারত। সে কথা সত্যি নয়। বলল না। ওর মায়ের দেখা ঝাড়গ্রাম ওরও শৈশবে দেখা। সে ঝাড়গ্রাম শুধুই সুখস্মৃতি। মেসোমশাই ঝাড়গ্রাম গেছেন কি না ও জানে না। গেলেও অনেক আগে গেছেন। এ বাড়িতে বসবাসের পনেরো বছর ওদের শুধু দক্ষিণেশ্বর যেতে দেখেছে ঋষি। সেও নাকি খুব শান্তির জায়গা।
জন বিস্ফোরণ, ব্যাপক মস্তানী, ড্রাগ, মেয়েছেলে নিয়ে নোংরামি। এসব কারণে দক্ষিণেশ্বর এখন আর খুব শান্তির জায়গা নয় নিশ্চয়।
সে কথা মেসোমশাইকে বোঝানো যাবে না।
আর ঝাড়গ্রাম।
মহকুমা টাউন। রাজনীতিক দলাদলি। একশে রকম সংগঠন। ব্যাপক বনউচ্ছেদ। আদিবাসীদের বঞ্চনা। আদিবাসীদের নিয়ে নানা রাজার টানাটানি। ওদের নামে বহুজনের বহুরকম কাজ। জন বিস্ফোরণ। জমির দাম বাড়ছে। শহর এলোমেলো ছড়াচ্ছে। ধনীরা ধপাধপ বাড়ি করছে, সিনেমা, মিটিং। হইহট্টগোল, সবরকমে ঝাড়গ্রাম সে ঝাড়গ্রাম নেই।
মেসোমশাইকে তা বলা যাবে না।
ওই ওঁর মতে শান্তির জায়গাটিতেই রূপা কোনো এক রমণীর মৃতদেহ নিয়ে বসে আছে।
কে কাকে বোঝায়।
বস দেরি করছেন।
সুজয় সম্ভবত দেরি করাচ্ছে।
সুজয় প্রবঞ্চিত ভগ্নহৃদয় স্বামীর মতোই কথাবার্তা বলল বসের সঙ্গে।
অবশ্য যথেষ্ট বাগড়া দিল।
প্রথমে বলল, ফোনে এসব কথা হতে পারে না। আপনি আসুন।
সল্টলেকে পৌঁছবার বর বসকে ও ঝাড়া পঁচিশ মিনিট বসিয়ে রাখল, তারপর এল।
—স্নান করছিলাম। বলুন।
স্নাত চেহারা নয়। বরঞ্চ যথেষ্ট বিধ্বস্ত এবং বিচলিত চোখমুখ। সিগারেট ধরাচ্ছে। দু’টান দিয়ে সেটা ফেলে দিচ্ছে, আবার ধরাচ্ছে।
সব শুনে গেল ও।
—আমি কেন যাব বলুন?
—তুমি যাবে না?
—এর পরেও যাব? দেখুন। এটা দেখুন। একটি খাতার পাতার অর্ধেকটা ছিঁড়ে ”ডিভোর্সের চিঠি পাবে” লেখা। গোপার লেখা, তবে নাম সই করে নি। বসের মনে খটকা লাগে।
—এই দেখুন।
এটা কি?
—রূপার অত ঘন ঘন আসা। গোপার বেসনেতে গিয়ে কাজ নেওয়া, আমার খুব পছন্দ হয়নি। তবে ও তো অ্যাবনর্মাল। সেটা আগে জানতাম না, জানার পর আর বাধা দিইনি। করুক, কাজ করুক…
—গোপা অ্যাবনর্মাল?
সুজয় ম্লান হেসে বলে। মা—বাবার সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চায় না, আমার সঙ্গেও …এগুলো কি নর্মাল?
ব্যাপারটি জটিল হতে থাকে। গোপার কথামতো ওর অতীতের সব কথাই ও সুজয়কে বলেছিল। গোপা বাপের বাড়ি যেত না। বাবা মাকে ও কেন সইতে পারত না, তা সুজয়ের বোঝা উচিত ছিল।
কিন্তু এখন তো তালে তাল দিতে হবে।
—হ্যাঁ। আমার ওপরেই…
—কিন্তু কেন? ও একজনের সঙ্গে পালাল। তারপর আত্মহত্যার চেষ্টা করল। আপনার মতো মানুষের মুখ পোড়াল বারবার। আপনি তো অত্যন্ত ক্ষমাশীল পিতা। তারপরেও ওকে সাধ্যমতো…
বসের চোখ ভিজে ওঠে। ”অত্যন্ত ক্ষমাশীল পিতা” শব্দগুলি ওঁর মন ভেজায়।
—তুমিও তো উদার স্বামী।
বস ভাবেন। এবার সুজয় কি বলবে?
সুজয় আবার মলিন হাসে।
—জানি না আমার এক বউদি, মানে মাসতুত বউদি, তাঁর দায়িত্ব আমারই ওপর। সে কথা ওকে বলি। ও যে সে কথার কি ব্যাখ্যা করে নিল তা ওই জানে। বিয়ের পর থেকে আমার সঙ্গে…
—আমি তো তোমার সঙ্গে কখনো…
—না। কখনো নয়।
কথার দাবাখেলা চলতে থাকে, চলতে থাকে। সুজয় এবং বস অবশ্যই ”নো” কাগজের ব্যাপারে, নতুন বিলডার্স ফার্মের ব্যাপারে, ব্যবসার অংশীদার।
তবুও এখন কথার দাবাখেলা।
গোপা বলেছিল, সুজয়ের ”বর্তমান” থাকতে পারে। অর্থাৎ ওই মাসতুত বউদি। তাহলে গোপার একটা দুঃখময় ”অতীত” কি দোষ করল?
সুজয় ব্যাপারটা ঘুরিয়ে দিচ্ছে।
—দেখুন, বিবাহিত জীবনের বঞ্চনা তো থাকলই। কিন্তু কথা ছিল দুজনে ব্যবহারিক জীবনে মানিয়ে চলব। ভি সি আর দেখ। বেড়াও। পার্টি দাও যথেষ্ট। যা চাও তাই করো শুধু আমার মুখ পুড়িও না।
—কথা হয়েছিল?
—নিশ্চয়।
—ও কি বলল?
—তখন মনে হল মেনে নিল। অবশ্য আমার ওই মাসতুত বউদির ব্যাপারে ও বলতই … কি করব। একজন অসহায়া বিধবাকে ভাসিয়ে দেব?
—তারপর?
—বেসনেতে যাবার পর ওর ধরণধারণ খুব পাল্টে যেতে থাকে। খুবই চোখে পড়ে। বেপট কিছু করলে আমার মুখ পুড়ত। অবশেষে পাঁচজনের কাছে শুনতে শুনতে আমি একটা প্রাইভেট সিক্রেট সার্ভিসকে লাগাই। ওদের রিপোর্ট পেয়ে আমি তাজ্জব।
—কোথায় সে রিপোর্ট?
—আছে, লকারে আছে।
—তাতে কি বলছে?
—চলে যাবার তিন মাস এগারো দিন আগে দেখা যাচ্ছে বেসনের উলটো দিকের এক ব্যাঙ্কের ছোকরার সঙ্গে গোপা ঘুরছে।
—ওঃ, গোপা! গোপা!
—ছবি দেখুন। দেখুন গোপা কি রকম হাসছে! এটা চিড়িয়াখানায় তোলা। কত চেষ্টা করেছি। আপনার মেয়েকে এমন করে হাসতে দেখিনি আমি।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন