মেয়েলি আড্ডার হালচাল – ১৮

বাণী বসু

পরিশেষ

শিল্পী আর মালবিকাদি চলে গেল সবচেয়ে আগে। তারপর কাজলকে নিতাইয়ের রিকশায় তুলে দিই। সুমিতা টয়লেটে গেছে। একটু পরে লিপস্টিক, ব্লাশার সব মুছে, মুখচোখ থেকে জল ঝরাতে ঝরাতে এল। ব্যাগ থেকে ভেসলিন বার করে ঠোঁটে লাগাল। বলল, ‘ওরা সব চলে গেছে? কাজলদিটা শিল্পীকেও খুব একহাত নিল, না?’

‘তুইও নিলি কম নয়, আমাদের সবাইকে।’

‘আমি আবার কী নিলাম?’

‘সত্যি কথা তো বলিসনি।’

বুঝতে পেরেছিলি? কী করে?’

‘বা রে আমার কল্পনার হলুদ শাড়ি, ফাইল, প্রজেক্ট, কোয়েশ্চনেয়ার সবই মিলে গেলেও বুঝব না? তা ছাড়া তুই তো আমায় সব বলবার জন্যেই সময় নিচ্ছিস।’

‘বলব আর কী! মুখটা আমার বীভৎস লাগছে না? ঠোঁটটা ঝুলে যায়নি?’

‘কোন বীভৎস? আগেকার মানে না এখনকার?’

‘আগেকার, আগেকার।’

‘মুখটা একটু ফোলা ফোলা লাগছে বটে, ঠোঁটটাও তাই, কী ব্যাপার?’

‘ব্যাপার আর কী? বিকাশকান্তি স্যান্যাল।’

‘সত্যি? সুমিতা!’

‘কালীপদর মা ছিল বলে কোনওমতে বেঁচেছি। চেম্বারে ঘটে। এক সপ্তাহেও দ্যাখ দাগগুলো যায়নি।’

‘বলিস কী? এ যে বীভৎস ডাইমেনশন? দাঁড়িয়ে আছিস কী করে?’

‘সাইকলজির লোক’ মনে রাখিস কিন্তু মুশকিল হল এ কথা কি মালবিকাদিকে বলা যায়?’

‘শুভমকেই বা কী বললি?’

‘সে তো একটা গাধা। পুরনো পেয়ারের কথা দিদিভাইটিকে বলতে পেরে তার এখন এমন কাথারসিস হয়ে গেছে যে সে আর কিছুই লক্ষ করছে না। সে ভেবেছে সে-ই এমনটা করেছে।’

হাসব না কাদব ভেবে পাই না। বলি—‘তা তুই জানতিস ওর ওই বাদল দিনের প্রথম কদম ফুলের কথা?’

‘জানব না? খ্যাপার মতো হয়ে গিয়েছিল তো! তাইতেই তো নিলয়দা আমায় বলল, ‘সুমিতা, তুমি তো সাইকলজির লোক, দেখো তো কিছু করতে পারো কি না? তোমাকে অনেকটা ওই মেয়েটির মতো দেখতে!’

‘তুই এত বড় রিস্‌ক নিলি?’

‘দ্যাখ রঞ্জুদি, আমি সাইকলজির ছাত্রী। মানুষের মন জানা আর তার ওপরে কন্ট্রোল এনে তাকে সারিয়ে তোলা এর চেয়ে বেশি ইনটারেস্ট আমার কিছুতেই নেই। বিকাশকান্তিরটাতে ভয় খেয়ে গেলাম। তবে সত্যি কথা বলতে কি মালবিকাদি যে আকর্ষণ-বিকর্ষণের তত্ত্ব বলে গেল, সেটা আমার একেবারেই মাথায় আসেনি ভাই।’

‘মালবিকাদির তা হলে গুরুমারা বিদ্যে বল।’

‘তাই তো দেখছি। খালি নিজের কেসে বেচারি সুবিধে করতে পারল না।’

‘চলি রে রঞ্জুদি’—চটিতে পা গলিয়ে সুমিতা ‘সাইকলজির লোক’ চলে গেল তখন আটটা বাজে বাজে।

ঘরটা ইতিমধ্যেই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে দিয়েছে শেফালি। এখন ঢুকলে আর মাছ-মাংস বিভিন্ন রকম পারফ্যুমের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে না। একতলার ঘর হলেও কর্নার প্লট বলে খুব হাওয়া আসছে জানলা দিয়ে। আর সেই সঙ্গে ঘরময় ছড়িয়ে যাচ্ছে যূথীর গন্ধ। কেয়ার বন্যতাও কি একটু মিশছে তাতে? মালবিকা সান্যালের মুখ উড়ছে যূথীর গন্ধে, কেয়ার সাদায় মুখের রেখাগুলো সাদা হয়ে যাচ্ছে।

দরজার বেলটা বাজল। শেফালিকে বললুম—‘দ্যাখ তো, বোধ হয় দাদা এল।’

‘দাদা তো কতক্ষণ আগেই এসে গেছে। তোমরা হাল্লা করছিলে বলে বুঝতে পারোনি। সে এখন চান-টান করে পাজামা পাঞ্জাবি পরে তোমার গোলাপ ফুলের সুবাস নিচ্ছে গো!’

‘আচ্ছা যা যা, এখন দেখ তো কে এলো।’

একটু পরে যিনি এসে দাঁড়ালেন তিনি অধ্যাপক গঙ্গাপ্রসাদ মিত্র। গেরুয়া পাঞ্জাবি, কাঁচি ধুতি, কাঁধে শান্তিনিকেতনি ঝোলা।

‘আপনি?’

‘কাজল, মানে কাজল এখনও…এখানে আছে…নিতে’

‘সে কী? কাজল এখনও পৌঁছয়নি? এই তো আধঘণ্টা আগে রিকশা করে চলে গেল।’

‘না…মানে আমি…কলেজস্ট্রিট…মীটিং…স্ট্রেইট…তাই…’

‘আপনি বসুন। চা খাবেন তো?’

‘হ্যাঁ …তা…না..যদি…’

গঙ্গাপ্রসাদ একটা সোফায় বসে মুখ নিচু করে অন্যমনস্কভাবে নিজের পাঞ্জাবির কোল দেখতে লাগলেন।

আমি শেফালিকে বললুম—তার দাদাকে ডেকে আনতে।

‘ইনি অধ্যাপক গঙ্গাপ্রসাদ মিত্র, কাজলের স্বামী’, আমি পরিচয় করিয়ে দিই, ‘আর ইনি আমার স্বামী নিরুপম…’

‘ও, আচ্ছা’ হাত তুলে নমস্কার করল নিরুপম। কাউন্সিলরের কাছে মানুষ নানা প্রয়োজনে আসে।

গঙ্গাপ্রসাদ ফিকে একটু হাসলেন। প্রতি-নমস্কার করলেন না। ভুলে গেছেন।

আমি দুজনকে বসিয়ে চা আনতে যাই। শেফালিগিন্নি বললেন ‘এই গরমে অসময়ে চা দেবে কেন বউদি, বরং তোমার সেই জিরের শরবত করে দাও।’

সেটাই তৈরি করছি, সারাদিনের আড্ডার ক্লান্তিতে হাত চলছে না, নিরুপম রান্নাঘরে এসে ঢুকল, বলল—‘উনি কোনও কথাই বলছেন না আমার সঙ্গে, বোধ হয় তোমায় কিছু বলতে চান।’ ‘তোমায়’ কথাটার ওপর অস্বাভাবিক জোর দিয়ে নিরুপম সিঁড়ি বেয়ে ওপরে চলে গেল। হাওয়াই চপ্পলের আওয়াজটা থ্যাপ্‌ থ্যাপ্‌ করে কানে বাজতে লাগল।

আমি শরবত নিয়ে বসার ঘরে ঢুকতেই গঙ্গাপ্রসাদ শশব্যস্তে উঠে দাঁড়ালেন। কাঁধের ঝোলা পড়ে গেল। চশমা খুলে এল, উনি চশমা পরে নিলেন, ঝোলা তুলে নিলেন।

এ কী? উনি কি আমার হাতের শরবতের গ্লাসটা দেখতে পাচ্ছেন না? অদ্ভুত তো! ঝোলা থেকে একটা বই বার করে শরবত-এর ওপর রাখছেন, চোখ কোথায় ওঁর?

‘“বাসমতীর উপাখ্যান”…জীবনানন্দ..মানুষ নয়…দেশ ভাগ…একটা জায়গা… সম্পাদনা দেবেশ রায়… প্রতিক্ষণ… পড়েননি… বার করেছে… পঞ্চম খণ্ড… অনেক পরে…’ কাঁপা কাঁপা ব্যারিটোনে থেমে থেমে এই কথাগুলো উনি বলে যেতে থাকলেন যেন ওঁর বক্তব্য কখনও শেষও হবে না, সংলগ্নও হবে না।

***

অধ্যায় ১৮ / ১৮

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন