মুহম্মদ জাফর ইকবাল
জেনারেল জিনজি তার টেবিলের উপর পা দুটি তুলে দিয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে ডাকল, “কিটি।”
কিটি সাথে সাথে উত্তর দেয়, “বলো।”
“তুমি একটা জিনিস জানো?”
“সম্ভবত জানি। বললে বুঝতে পারব।”
“আমার কোনো বন্ধু নেই।”
কিটি বলল, “হ্যাঁ জানি। বন্ধুত্ব হয় সমানে সমানে। এই দেশে তোমার সমান সমান কেউ নেই। যারা তোমার কাছাকাছি তাদেরকেও তুমি মেরে ফেলেছো।”
“এ ছাড়া উপায় কী বলো। বেঁচে থাকতে হলে মাঝে মাঝে এগুলো করতে হয়। এখন আমার কোনো বন্ধু নেই। এখন সবাই আমার অনুগত। হয় স্তাবক না-হয় কর্মচারী।”
“জানি।”
জেনারেল জিনজি তার চোখ দুটো একটু খুলে বলল, “এখন আমার বন্ধু শুধু তুমি।”
কিটি হাসির মতো শব্দ করল। বলল, “আমি একটা পরিব্যাপ্ত সিস্টেম, আমার কোনো অবয়ব নেই। আমার মানুষের বন্ধু হওয়ার যোগ্যতা নেই। বড়জোর তোমার কাজকর্মে একটু সাহায্য করতে পারি।”
“কিন্তু তুমি আমার বন্ধুর মতন। আমি তোমাকে আমার সব মনের কথা বলতে পারি, আমি জানি তুমি কখনো সেই কথা কাউকে বলে দেবে না।”
“সেটি সত্যি। আমি কখনো তোমার কোনো কথা কাউকে বলব না। বলার ক্ষমতা নেই।”
“তুমি বুদ্ধিমান।”
“এটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা।”
“কৃত্রিম হোক আর খাঁটি হোক, কিছু আসে-যায় না। তোমার বুদ্ধিমত্তা আছে সেটা হচ্ছে বড়ো কথা।”
“আমার বুদ্ধিমত্তা মানুষের সাথে মিলিয়ে তৈরি করা হয়েছে।”
জেনারেল জিনজি তার চোখ পুরোপুরি খুলে বলল, “তোমাকে আমার সবচেয়ে বেশি পছন্দ কী কারণে জানো?”
“অনুমান করতে পারি।”
“সবচেয়ে বেশি পছন্দ কারণ তুমি কখনো আমাকে ভালো-খারাপ হিসেবে বিচার করার চেষ্টা করো না।”
কিটি বলল, “আমি একটা পরিব্যাপ্ত সিস্টেম। আমার ভালো-মন্দ বিচার করার ক্ষমতা নেই।”
“আমি যখন দুই-চারজন মানুষকে গুম করে দিয়ে না-হয় খুন করে ফেলে তোমার কাছে আসি, তুমি একবারও বলো না কাজটা ঠিক হয় নাই।”
“আমি তোমাকে বলেছি ভালো-মন্দ বিচার করার ক্ষমতা আমার নেই।”
“অসাধারণ! দেশের সব মানুষ তোমার মতো হলে কী চমৎকার হতো।”
“সাধারণ মানুষ কখনো আমার মতো হবে না। মানুষ সবসময় ভালো- মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, সত্য-মিথ্যা নিয়ে মাথা ঘামায়।”
জেনারেল জিনজি সোজা হয়ে উঠে বসে বলল, “আচ্ছা কিটি, তুমি একটা কথা বলো দেখি—আমি ক্ষমতা নেয়ার পর দেশের অবস্থা ভালো হয়েছে না খারাপ হয়েছে?”
“অবশ্যই খারাপ হয়েছে, অনেক খারাপ হয়েছে।”
জেনারেল জিনজি কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, তারপর বলল, “তুমি যদি মানুষ হতে তাহলে এই কথা বলার জন্য ফায়ারিং স্কোয়াডে গুলি করে মারা হতো।”
“জানি। কিন্তু কথাটা তো সত্যি। তুমি যখন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট আর মন্ত্রীদের গুলি করে মেরে ক্ষমতা নিয়েছো তখন তুমি বলেছিলে তারা দেশ চালাতে পারছে না। দেশে অভাব, অনটন, বিশৃঙ্খলা। দুর্নীতি, চুরি, ডাকাতি। তুমি সবকিছু ঠিক করে দেবে। এখন বিশৃঙ্খলা কমেছে—তোমার ভয়ে কেউ কথা বলে না, কিন্তু আর সবকিছু খারাপ হয়েছে। অভাব-অনটন বেড়েছে, দুর্নীতি, চুরি, ডাকাতি বেড়েছে। মানুষ না খেয়ে আছে।”
“আমার কী দোষ বলো। আমি তো সবকিছু ঠিক করতেই চেয়েছিলাম। কিন্তু কেমন করে বুঝব পৃথিবীর অবস্থা এত খারাপ হয়ে যাবে?”
“সেটা সত্যি। পৃথিবীর অবস্থা অনেক খারাপ। পৃথিবীর তাপমাত্রা অনেক বেড়ে গেছে। আরো বাড়বে।”
জেনারেল জিনজি ভুরু কুঁচকে বলল, “তুমি নিশ্চিত আরো বাড়বে?”
“অবশ্যই। তোমরা ঘরবাড়ি ঠান্ডা রাখার জন্য যা কিছু করছো তাতে বাইরের তাপমাত্রা আরো বেড়ে যাচ্ছে। সেটাকে ঠান্ডা করতে তাপমাত্রা আরো বাড়ছে, সেটাকে ঠান্ডা করতে আরো—”
জেনারেল জিনজি গলা উঁচু করে বলল, “বুঝেছি, বুঝেছি। আর বলতে হবে না।”
কিটি তবুও বলল, “তুমি দেশের মানুষদের দুই ভাগ করে ফেলেছো। গরিব আর ধনী। ধনীদের খুশি রাখার চেষ্টা করেছো—খুব লাভ হয় নাই, মাঝখানে তাদের লোভ বেড়েছে। গরিবদের কোনো সুযোগ নাই, নাগরিকত্ব কার্ড পর্যন্ত নাই।”
জেনারেল জিনজি একটু বিরক্ত হয়ে বলল, “অনেক হয়েছে, এখন চুপ করো।”
“তুমি বলেছো আমি তোমার বন্ধু। আমি বন্ধুর মতো একটু কথা বলতে চাইছিলাম।”
“আর বলতে হবে না। এখন একটু কাজ করো।”
“কী কাজ?”
“যত ডেটা আছে সেগুলো গুছিয়ে রাখো। আগামী দশ বছরে দেশের অবস্থা কী হতে পারে তার একটা সঠিক ভবিষ্যদ্বাণী তৈরি করে দাও।”
“সঠিক?”
“হ্যাঁ সঠিক।”
“এর আগে তুমি সবসময়েই বলেছো ভুয়া তথ্য দিতে। সেই জন্য জানতে চাচ্ছিলাম।”
“না। এবারে আমি সঠিক তথ্য চাই। আমি বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করতে চাই।”
“তুমি কার সাথে আলোচনা করবে?”
“বিজ্ঞানীদের সাথে। আমি দেশের সব বড়ো বড়ো বিজ্ঞানীদের সাথে কথা বলব।”
“কেন? এত রকম মানুষ থাকতে বিজ্ঞানীদের সাথে কেন কথা বলতে চাইছো?”
“আমার একটা পরিকল্পনা আছে।”
“কীসের পরিকল্পনা?”
“দেশটা ঠিক করার পরিকল্পনা।”
কিটি একটু হাসির মতো শব্দ করল। জেনারেল জিনজি মুখ শক্ত করে বলল, “তুমি হাসছো কেন?”
“আমি আসলে হাসতে পারি না। শুধু হাসির মতো শব্দ করতে পারি।”
“তুমি হাসির মতো শব্দ করেছো কেন?”
“তোমার কথা শুনে। তুমি বলেছো দেশটাকে ঠিক করে দেবে। দেশটাকে ঠিক করা সম্ভব না। এই দেশের সব মানুষের জন্য খাবার পর্যন্ত নেই। পৃথিবীতে ফসলের উৎপাদন কমে গেছে। খাবার আনতেও পারবে না। সবচেয়ে বড়ো কথা, তোমার কোনো টাকা নেই। দেশের মানুষ খেতে না পেরে একদিন তোমার এই প্রাসাদ আক্রমণ করবে। তোমাকে মনে হয় পিটিয়ে মারবে।”
জেনারেল জিনজির মুখে হাসি ফুটে উঠল, বলল, “আমাকে নিয়ে তোমার কোনো চিন্তা করতে হবে না। যখন দেখবে আমি দেশটাকে ঠিক করে ফেলেছি তখন তুমি বুঝবে। এখন শুধু আমাকে বলো, দেশের সব সম্পদ ব্যবহার করে দেশটাকে যদি খুব ভালোভাবে চালাতে চাই তাহলে দেশটা কয় বছর চালাতে পারব?”
“ভবিষ্যতের কথা চিন্তা না করে?”
“হ্যাঁ। ভবিষ্যতের কথা চিন্তা না করে।”
“দুই বছর। দুই বছর পর তোমার দেশ পুরোপুরি দেউলিয়া হয়ে যাবে। দেউলিয়া থেকেও খারাপ কিছু যদি থাকে, তাহলে সেটা হবে। তোমাকে অবশ্য এর পরে কী হবে সেটা দেখতে হবে না।”
“কেন? দেখতে হবে না কেন?”
এর আগেই দেশের মানুষ তোমাকে পিটিয়ে মেরে ফেলবে।”
জেনারেল জিনজি শব্দ করে হাসল। বলল, “তুমি আমাকে এখনো চিনতে পারোনি কিটি!”
“আমি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে চালিত একটা পরিব্যাপ্ত সিস্টেম। মানুষকে চেনার ক্ষমতা আমার নেই। কখনো ছিল না।”
* * * *
হৃদের তীরে একটি লোহার বেঞ্চে চব্বিশ বছরের সুদর্শন যুবক রিমান বসে আছে। সে কেন্দ্রীয় বিজ্ঞান কাউন্সিলের একজন তরুণ বিজ্ঞানী। রিমানের পাশে বসে আছে তার অনেক দিনের বান্ধবী তিনা। তিনা রিমানের সমবয়সি, একটি বিজ্ঞাপন এজেন্সিতে কাজ করে। তিনা হৃদের পানিতে হুটোপুটি করে খেলতে থাকা কিছু হতদরিদ্র শিশুদের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বলল, “আমার ওই শিশুদের দেখে হিংসা হচ্ছে।”
রিমান বলল, “হওয়ারই কথা। হৃদের তীরে বিশাল সাইনবোর্ডে লেখা যে হৃদের পানি বিষাক্ত, এখানে নামা নিষিদ্ধ। শিশুগুলো সেই সতর্কবাণীকে কোনো গুরুত্ব না দিয়ে পানিতে খেলছে। তাদের আনন্দ দেখে আমারও হিংসা হচ্ছে। শেষবার কখন কিছু নিয়ে আমার এ রকম আনন্দ হয়েছে আমি মনে করতে পারি না।”
“কী অসহ্য গরম। মনে হচ্ছে আমিও পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ি!”
রিমান হাসার চেষ্টা করে বলল, “তুমি যদি গরম সহ্য করতে না পারো তাহলে তোমার ঘর থেকে বের হওয়ার কথা না। ঘরের ভেতর আরামদায়ক শীতল বলে বাইরে এত গরম।”
“জানি। কিন্তু ঘরের ভেতর যতই আরামদায়ক শীতল হোক না কেন, সেখানে কেন জানি নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়। মুখ ফুটে কথা বলতেও ভয় হয়। সবসময় মনে হয় কিছু একটা বলে ফেলব, সেটা রিপোর্ট হয়ে যাবে আর আমি গুম হয়ে যাব। বাইরে এসে তোমার সাথে মাঝে মাঝে মন খুলে কথা বলি। তা না হলে মন খুলে কথা বলতে কেমন লাগে মনে হয় সেটাও ভুলে যেতাম।”
রিমান ঘুরে তিনার দিকে তাকাল। কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল। তারপর একটা নিশ্বাস ফেলে হৃদের পানিতে হুটোপুটি খেতে থাকা শিশুদের দিকে তাকিয়ে রইল।
তিনা বলল, “কী হলো? তুমি আজকে এত চুপচাপ কেন? কিছু কী হয়েছে?”
রিমান বলল, “বুঝতে পারছি না তোমাকে বলা ঠিক হবে কি না।”
“আমাকে নিয়েও তোমার ভয়?”
রিমান মাথা নেড়ে বলল, “না তিনা, তোমাকে নিয়ে ভয় নয়। যে বিষয়টা তোমার না জানলেও চলে সেটা যদি তুমি জেনে যাও তাহলে তোমার বিপদটা একটু বেড়ে যায়। আমরা সবাই এ দেশে বিপদের মাঝে আছি। তোমাকে নূতন করে আরো বড়ো বিপদে ফেলতে চাই না।”
“এখন তুমি আমার কৌতূহল বাড়িয়ে দিয়েছো। তোমাকে এখন বলতেই হবে কী নিয়ে তোমার দুর্ভাবনা।”
রিমান বলল, “আগামীকাল আমাকে একটা মিটিংয়ে যেতে হবে, যেখানে জেনারেল জিনজি থাকবে।”
তিনা চমকে উঠল, বলল, “কী বললে? জেনারেল জিনজি?”
“হ্যাঁ। জেনারেল জিনজি।”
“নিজে? নাকি হলোগ্রাফি ইমেজ?”
“নিজে। রক্ত-মাংসের জেনারেল জিনজি!”
তিনা আতঙ্কিত মুখে জিগ্যেস করল, “কিন্তু তুমি কেন? তুমি একজন খুবই কমবয়সি বিজ্ঞানী। তোমাদের কেন্দ্রে এত বড়ো বড়ো অভিজ্ঞ বিজ্ঞানী আছে, তারা থাকতে তুমি কেন?”
“আমাদের মহাপরিচালকও যাবে। তাকে মূল বক্তব্য দিতে হবে। মহাপরিচালকের সেই বক্তব্যটি আমাকে তৈরি করে দিতে হবে। সেই জন্য মহাপরিচালক আমাকে তার সাথে থাকতে বলেছে।”
“তোমার মহাপরিচালকের বক্তব্যটি তৈরি করে দিতে হয়েছে? যে বক্তব্যটি জেনারেল জিনজি নিজের কানে শুনবে?”
রিমান একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “আসলে ব্যাপারটি এত সহজ নয়, ব্যাপারটি আরো অনেক জটিল। তুমি যদি শোনো তাহলে তোমার মন খারাপ হয়ে যাবে। কে জানে তুমি হয়তো আমাকে ঘৃণা করতে শুরু করবে।”
তিনা রিমানের হাত স্পর্শ করে বলল, “না রিমান। তোমার ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমি তোমাকে ঘৃণা করব না। তুমি নির্ভয়ে আমাকে বলো।”
রিমান তিনার চোখের দিকে তাকাল, বলল, “তুমি তো খুব ভালো করে জানো যে দেশের অবস্থা খুব খারাপ। আমি যেহেতু মূল তথ্য কেন্দ্রে কাজ করি, তাই আমার কাছে সব সত্যিকারের তথ্য আছে। ভয়ংকর ভয়ংকর তথ্য। কিন্তু জেনারেল জিনজিকে সেইসব তথ্য দেয়া যাবে না। তাকে সব রকম মিথ্যা তথ্য দিতে হবে—বোঝাতে হবে দেশটি খুব ভালো আছে। ছোটোখাটো যেসব সমস্যা আছে সেগুলো সব সাময়িক। এইসব সমস্যা কীভাবে মেটাতে হবে তার সব রকম কাল্পনিক সমাধান দিতে হবে।”
তিনা বিচিত্র দৃষ্টিতে রিমানের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “তুমি সেই মিথ্যা প্রতিবেদন তৈরি করেছো?”
“না, আমি নিজে সেটা তৈরি করিনি। আমি আমাদের মহাপরিচালককে সব তথ্য দিয়েছি, যেন সে সত্যের যত কাছাকাছি সম্ভব মিথ্যা তথ্য তৈরি করত পারে।”
“সেই মিথ্যা তথ্য প্রতিবেদন তুমি দেখেছো?”
“হ্যাঁ। আমি দেখেছি।” রিমান মাথা নিচু করে বলল, “সেটি দেখলে মরে যেতে ইচ্ছা করে। দেশটি সর্বনাশের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে কিন্তু আমাদের বলতে হবে দেশটি উন্নতির একেবারে চরম উচ্চতায় পৌঁছে যাচ্ছে।”
তিনা কিছুক্ষণ ম্লান মুখে বসে রইল, তারপর জিগ্যেস করল, “তুমি তো সেই বক্তব্য দিচ্ছ না। তাহলে তোমার মতো এত কমবয়সি একজনকে কেন সেখানে থাকতে হবে?”
“আমাদের মহাপরিচালক আমাকে তার পাশে বসিয়ে রাখতে চায়। তার যদি কোনো প্রশ্ন থাকে সে যেন আমাকে জিগ্যেস করতে পারে।”
তিনা না-সূচকভাবে মাথা নাড়ল, তারপর বলল, “আমি ব্যাপারটা একেবারেই পছন্দ করলাম না। জেনারেল জিনজিকে সামনাসামনি দেখা একটা অবিশ্বাস্য অভিজ্ঞতা হতে পারে কিন্তু সেই অভিজ্ঞতা একটি চরম অশুভ অভিজ্ঞতা।”
রিমান মাথা নাড়ল, বলল, “আমি সেটা জানি তিনা। আমি মোটেও এই অভিজ্ঞতাটুকুর জন্য অপেক্ষা করছি না। কখন সেটি শেষ হবে তার জন্য অপেক্ষা করছি।”
তিনা হঠাৎ মুখ তুলে বলল, “কিন্তু আমরা কখন এই ভয়ংকর বিপদ থেকে মুক্তি পাব? দেশের সব মানুষকে নিয়ে পুরো দেশটি একটা ভয়ংকর বিপদের দিকে ছুটে যাচ্ছে কিন্তু সেখান থেকে মুক্তি পাবার কোনো পথ নেই?”
রিমান বলল, “পথ মাত্র একটি তিনা।
“সেটি কী?”
“জেনারেল জিনজিকে শেষ করে দেওয়া! সে যতদিন বেঁচে থাকবে এই দেশের ততদিন মুক্তি নেই।”
সন্ধে নেমে আসছে। বিষাক্ত হৃদের পানিতে হুটোপুটি খাওয়া হাড়- জিরজিরে শিশুগুলো উঠে নিজেদের ভেতর কথা বলতে বলতে হেঁটে যাচ্ছে। তিনা আর রিমান অন্যমনস্কভাবে ওদের দিকে তাকিয়ে রইল।
* * * *
কেন্দ্রীয় বিজ্ঞান কাউন্সিলের মহাপরিচালক এইমাত্র তার বক্তব্য শেষ করেছে। মহাপরিচালক তার ভিডি ফোন টেবিলে রেখে খুব ভয়ে ভয়ে জেনারেল জিনজির দিকে তাকাল। খুব যত্ন করে এই বক্তব্যটি তৈরি করা হয়েছে, দেশ সম্পর্কে একটি নেতিবাচক বক্তব্য নেই, অনেক রকম আশাবাদী কথা আছে।
জেনারেল জিনজি সোজা হয়ে বসে মহাপরিচালকের দিকে তাকাল, বলল, “তোমার বক্তব্য শেষ?”
“জি, মহামান্য জেনারেল।”
“আর কিছু বলার আছে?”
“না মহামান্য জেনারেল।”
“তুমি আমাকে এই বানোয়াট বক্তব্য বিশ্বাস করতে বলো?”
মনে হলো ঘরের ভেতর একটি বজ্রপাত ঘটে গেল। সবাই আতঙ্কে শিউরে উঠে নিশ্বাস বন্ধ করে ফেলে, কেউ জেনারেল জিনজির দিকে তাকাতে সাহস পায় না।
জেনারেল জিনজি হুংকার দিয়ে বলল, “অপদার্থ বুড়ো ভাম কোথাকার! তুমি কেন্দ্রীয় বিজ্ঞান কাউন্সিলের মহাপরিচালক আর তুমি দেশের আসল অবস্থা জানো না? আমাকে খুশি করার জন্য তুমি একগাদা মিথ্যা তথ্য হাজির করেছো? তোমার এত বড়ো সাহস, তুমি আমার সাথে মিথ্যা কথা বলো?”
রিমান মহাপরিচালকের পাশে বসে ছিল। সে দেখল মহাপরিচালকের হাত থরথর করে কাঁপছে, কোনোভাবে কাঁপুনি থামাতে পারছে না। মহাপরিচালক নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারে না যে জেনারেল জিনজি দেশের সত্যি অবস্থা জানতে চাইছে। বিজ্ঞান কাউন্সিলের সবাই জানে সত্যি তথ্য জানানোর চেষ্টা করার জন্য গত বছর একজনকে ফায়ারিং স্কোয়াডে গুলি করে মারা হয়েছে।
জেনারেল জিনজি তার হাত দিয়ে টেবিলে থাবা দিয়ে চিৎকার করে বলল, “নর্মদার কীট কোথাকার! এই দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ যে খাবারের অভাবে না খেয়ে আছে তুমি জানো? পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে যে পুরো গ্রহটি বাসের অযোগ্য হয়ে যাচ্ছে তুমি জানো? স্বার্থপর আবর্জনার ডিপো, তুমি নিজে শীতল আরাম ঘরে থাকবে আর দেশের গরিব মানুষকে গরমে সিদ্ধ হয়ে না খেয়ে রোগেশোকে পুড়ে মরতে দেবে? আমি যদি এই তথ্যগুলো না জানি তাহলে কীভাবে দেশের মানুষকে রক্ষা করব? কীভাবে? জবাব দাও।”
কেন্দ্রীয় বিজ্ঞান কাউন্সিলের মহাপরিচালক তার মাথা নিচু করতে থাকে, হলঘরের আরামদায়ক শীতল পরিবেশেও তার কপাল থেকে টপটপ করে ঘাম ঝরে পড়তে থাকে। হলঘরের বড়ো কালো গ্রানাইটের টেবিল ঘিরে বসে থাকা প্রায় তিরিশজন মধ্যবয়স্ক এবং বয়স্ক বিজ্ঞানীরা হতবুদ্ধি হয়ে জেনারেল জিনজির দিকে আড়চোখে তাকিয়ে থাকে। এখনো তারা নিজেদের কানকে বিশ্বাস করতে পারে না যে জেনারেল জিনজি দেশের প্রকৃত অবস্থা জানতে চাইছে। তারা আতঙ্কিত-ফ্যাকাসে মুখে বসে থাকে, তাদেরকে যে এ রকম অবিশ্বাস্য একটা অবস্থায় পড়তে হবে, সেটা স্বপ্নেও কল্পনা করেনি।
জেনারেল জিনজি প্রচণ্ড ক্রোধে ফুঁসে উঠে চিৎকার করে বলল, “তোমরা কেন এতদিন দেশের আসল অবস্থা আমাকে জানতে দাওনি? জবাব দাও।”
কেউ কোনো কথা বলল না।
জেনারেল জিনজি আবার টেবিলে থাবা দিয়ে বলল, “বলো আমাকে। বলো দেশের আসল অবস্থা কী। কতজন না খেয়ে আছে? কতজন রোগেশোকে ভুগছে? কতজনের নাগরিকত্ব কার্ড পর্যন্ত নেই—নিজের দেশে নামহীন-পরিচয়হীন হয়ে বেঁচে আছে? কতজন শিশু শিক্ষার আলো দেখেনি? বলো।”
কেউ কথা বলল না।
জেনারেল জিনজি অপ্রকৃতস্থের মতো চিৎকার করে বলল, “এই হলঘরে দেশের সবচেয়ে জ্ঞানী-গুণী মানুষেরা আছে, দেশের সবচেয়ে বড়ো বিজ্ঞানীরা আছে অথচ একজন মানুষ এই দেশের প্রকৃত অবস্থাটা আমাকে বলতে পারবে না? একজনও না? তাহলে আমি কি তোমাদের ফায়ারিং স্কোয়াডে পাঠাব? দেশের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার জন্য প্রকাশ্যে ফাঁসিতে ঝোলাব?”
এবারেও কেউ কোনো কথা বলল না!
জেনারেল জিনজি রক্তচক্ষুতে সবার দিকে তাকাল। হঠাৎ করে গলার স্বর শীতল করে হিসহিস করে হিংস্র গলায় বলল, “কেউ আমাকে দেশের প্রকৃত তথ্য দিতে পারবে না?”
রিমান তখন তার হাত তুলে বলল, “মহামান্য জিনজি, আমি আপনাকে দেশের প্রকৃত তথ্য দিতে পারব।”
ঘরের প্রতিটি মানুষের মনে হলো ইলেকট্রিক শক খেয়ে কেঁপে উঠল। সবাই বিস্ফারিত চোখে রিমানের দিকে তাকিয়ে থাকে।
জেনারেল জিনজি খুব ধীরে ধীরে মাথা ঘুরিয়ে রিমানের দিকে তাকাল। তারপর বরফের মতো শীতল গলাই বলল, “তুমি আমাকে দেশের প্রকৃত অবস্থার কথা বলতে পারবে?”
“জি মহামান্য জেনারেল।”
“বলো।”
রিমান জিভ দিয়ে তার শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে এই প্রথম জেনারেল জিনজির দিকে তাকাল। এটি আসলে মানুষ নয়। এটি একটি দানব। দেশের মানুষের জন্য তার বিন্দুমাত্র মমতা নেই। দেশের প্রকৃত অবস্থা এই মানুষটি খুব ভালো করে জানে, কিন্তু এখানে প্রকাশ্যে দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের নিয়ে সে একটি ভয়ংকর খেলায় নেমেছে। ইচ্ছায় হোক অনিচ্ছায় হোক রিমান এই ভয়ংকর খেলায় নেমে গেছে। এখন তাকে এই খেলাটি খেলে যেতে হবে। খেলা শেষে সে বেঁচে থাকবে কি না জানে না কিন্তু খেলতে নেমে সে আর পিছিয়ে যেতে পারবে না।
রিমান বুক ভরে একটা নিশ্বাস নিল, তারপর শান্ত গলায় বলল, “দেশের অবস্থা ভালো নেই মহামান্য জেনারেল। সত্যি কথা বলতে কী দেশের অবস্থা খারাপ। খুবই খারাপ। দেশে বহুদিন থেকে একটি নীরব দুর্ভিক্ষ চলছে। আগামী তিন থেকে চার বছরে সেটা আরো অনেক স্পষ্ট হবে, তখন দেশের অর্ধেক মানুষ না খেয়ে মারা যাবে। দেশের মানুষকে স্পষ্ট দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। ধনী এবং দরিদ্র। ধনীদের সব সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার পরও তাদের ভেতর অসন্তুষ্টি। তার কারণ হচ্ছে লোভ। দরিদ্র গোষ্ঠীর ভিতরে গভীর বেদনা এবং ক্ষোভ। যেকোনো মুহূর্তে তাদের ক্ষোভ বিস্ফোরণে রূপ নেবে তখন তাদের কোনোভাবে দমিয়ে রাখা যাবে না—”
রিমান কথা বলতে থাকে। জেনারেল জিনজি একধরনের বিস্ময় নিয়ে এই যুবকটির দিকে তাকিয়ে থাকে।
* * * *
পরদিন তিনা যখন রিমানের খোঁজ পাওয়ার জন্য পাগলের মতো ছোটাছুটি করছে, কোনোভাবেই সে কোথায় আছে, কেমন আছে বের করতে পারছে না, ঠিক তখন জেনারেল জিনজি কিটির সাথে হালকা আলাপ করে তার স্নায়ুকে শীতল করতে চেষ্টা করছে। বারান্দায় সোফায় হেলান দিয়ে কফিতে চুমুক দিতে দিতে জেনারেল জিনজি বলল, “কিটি, আমার কাজকর্ম তোমার কেমন লাগছে?”
কিটি বলল, “আমার যদি ভয়ের অনুভূতি থাকত তাহলে বলতাম ভয় লাগছে।”
জেনারেল জিনজি শব্দ করে হাসল, বলল, “কেন? তোমার ভয় কেন লাগবে?”
“কারণ দেশের সাধারণ মানুষের জন্য তোমার এতটুকু মায়া নেই কিন্তু এখন সারা দেশের সামনে বলছো তাদের জীবন তুমি পাল্টে দেবে। সাধারণ মানুষদের তুমি রক্ষা করবে।”
“কিটি, তুমি খুব ভালো করে জানো আমি মানুষের সামনে প্রকাশ্যে যে কথা দিই সবসময় সেই কথা রাখি। তুমি সত্যি সত্যি দেখবে আমি এই দেশের প্রত্যেকটা মানুষকে নাগরিকত্ব কার্ড দেবো, তারা সেই কার্ড ব্যবহার করে কাজ করতে পারবে, চিকিৎসা নিতে পারবে, বাসায় থাকতে পারবে, খাবার রেশন পাবে, তাদের বাচ্চারা স্কুলে যেতে পারবে, এমনকি বিনোদন পর্যন্ত করতে পারবে।”
“তোমার কথা যদি সত্যি হয় তাহলে সেটি সাধারণ মানুষের জন্য খুব ভয়ের কথা।”
জেনারেল জিনজি হাসি হাসি মুখে বলল, “তুমি কেন এই কথা বলছো?”
“কারণ তুমি খুব ভালো করে জানো এই দেশের প্রত্যেকটা মানুষকে সেবা দেওয়ার মতো সম্পদ তোমার দেশে নেই। খুব বেশি হলে অর্ধেক মানুষকে সেবা দিতে পারবে। প্রত্যেকটা মানুষকে সেবা দিতে চাইলে আগে অর্ধেক মানুষকে শেষ করে দিতে হবে। শুধু তাহলেই বাকি যে অর্ধেক মানুষ বেঁচে থাকবে তাদের প্রত্যেককে সেবা দিতে পারবে।”
জেনারেল জিনজি আঙুল দিয়ে টেবিলে ঠোকা দিতে দিতে বলল, “তোমার যথেষ্ট বুদ্ধি কিটি! আমি তোমাকে যতই দেখি ততই অবাক হয়ে যাই।”
“আমার বুদ্ধিমত্তা কৃত্রিম, আমি তোমাকে আগেও বলেছি।”
“আমি জানি।”
“সে জন্য মানুষ যেভাবে চিন্তা করতে পারে আমি তার বাইরেও চিন্তা করতে পারি। একজন মানুষ কখনো কল্পনা করতে পারবে না যে তুমি দেশের অর্ধেক মানুষকে শেষ করে দেওয়ার কথা চিন্তা করছো।”
জেনারেল জিনজি তার কফিতে চুমুক দিয়ে বলল, “তুমি যদি মানুষ হতে শুধু এই কথাটা বলার জন্য তোমাকে ফায়ারিং স্কোয়াডে গুলি করে মেরে ফেলতাম।”
কিটি হাসির মতো শব্দ করল, বলল, “আমি তোমার একমাত্র বন্ধু। বন্ধুকে ফায়ারিং স্কোয়াডে মেরে ফেললে তোমার কথা বলার আর কেউ থাকবে না।”
“সেটা সত্যি।”
“কিন্তু রিমান নামের ছেলেটাকে তো সত্যি সত্যি ফায়ারিং স্কোয়াডে পাঠাচ্ছ?”
“তাই ঠিক করেছি।”
“তুমি দেশের সত্যি তথ্য জানার জন্য চিৎকার করেছিলে, সে তোমার কথা বিশ্বাস করে তোমাকে সত্যি তথ্য দিয়েছে। তাকে দোষ দেয়া যায় না।”
“বোকামি অনেক বড়ো দোষ। আমি জানতে চাইলেও আমাকে বলতে হবে কে বলেছে?”
“তুমি বলেছিলে তা না হলে তুমি সবাইকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেবে। রিমান সবাইকে বাঁচাতে চেয়েছে। তুমি যেহেতু দানবের মতো তাই মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তিগুলি জানো না।”
“তুমি জানো?”
“না। আমিও জানি না।”
জেনারেল জিনজি কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে বলল, “আমি কি ঠিক করেছি জানো?”
“অনুমান করতে পারি।”
“করো দেখি অনুমান।”
“তুমি রিমান ছেলেটিকে ছেড়ে দিবে।”
“কেন ছেড়ে দিবো বলতে পারবে?”
“পারব। কারণ তুমি নিজের সম্পর্কে দেশের মানুষকে যে ধারণা দিতে চাইছো সেটা প্রমাণ করার একটা সুযোগ তৈরি হয়েছে। শুধু যে রিমানকে ছেড়ে দিবে তা নয়, তাকে কোনোভাবে পুরস্কৃত করবে।”
জেনারেল জিনজি কফি মগে চুমুক দিতে গিয়ে থেমে গেল। কফিটা একটু ঠান্ডা হয়ে গেছে—মগটাকে ঠেলে সামনে সরিয়ে রেখে বলল, “তুমি ঠিকই অনুমান করেছো! দেশের সব মানুষকে নাগরিকত্ব কার্ড দেওয়ার যে বিশাল প্রজেক্ট হাতে নিয়েছি, এই ছেলেটাকে তার দায়িত্ব দিয়ে দিবো। কেমন হবে ব্যপারটা কিটি?”
“ভালো হবে না।”
“কেন? ভালো হবে না কেন?”
“ছেলেটার বয়স কম। অভিজ্ঞতাও কম। সে বড়ো প্রজেক্ট হাতে নেওয়ার উপযুক্ত হয়নি।”
“সেটি নিয়ে পরে চিন্তা করা যাবে। তার সাথে কাজ করার অনেক মানুষ থাকবে। তাকে দায়িত্ব দেওয়াটা হবে চমক। শুধু চমক।”
কিটি বলল, “আমি জানি তুমি চমক পছন্দ করো। আমি ব্যাপারটি ঠিক বুঝতে পারি না। আমি পরিব্যাপ্ত সিস্টেম। চমক বলে কোনো ব্যাপার আমার হিসেবের মাঝে নেই।”
জেনারেল জিনজি অন্যমনস্কভাবে মাথা নাড়ল। মাথা নেড়ে বাইরে অন্ধকারে তাকিয়ে রইল। সে অন্ধকার খুব ভালোবাসে। সব রকম অন্ধকার।
* * * *
হৃদের তীরে লোহার বেঞ্চটাতে রিমান আর তিনা বসে আছে। তিনা রিমানের হাত ধরে কাঁপা গলায় বলল, “আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না যে তুমি আমার সামনে বসে আছো। জেনারেল জিনজি যখন কাউকে নিজের কাছে ডেকে নেয় সে কখনো ফিরে আসে না।”
রিমান মাথা নাড়ল, “আমিও ফিরে আসিনি তিনা। এই যে আমি তোমার সামনে বসে আছি, এটি কিন্তু কোনো জীবন্ত মানুষ নয়। এটি একজন মৃত মানুষ। জেনারেল জিনজি কিছু একটা খেলছে। আর আমাকে তার খেলার ঘুঁটি হিসেবে বেছে নিয়েছে। খেলা শেষে জেনারেল জিনজি তার ঘুঁটিগুলো ছুড়ে ফেলে দেবে।”
তিনা মাথা নাড়ল, বলল, “কিন্তু এই মুহূর্তে তোমাকে যে দায়িত্ব দিয়েছে সেটি তো চমৎকার একটা দায়িত্ব। এই দেশের হতদরিদ্র মানুষের নাগরিকত্ব কার্ড ছিল না, তাদের জন্য কোনো সুযোগ-সুবিধা ছিল না, কত কষ্ট করে বেঁচে থাকতে হতো। এখন তাদের নাগরিত্ব কার্ড হবে, এখন তারা মানুষের সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকবে। তাদের দুঃখ-কষ্ট থাকবে না।”
রিমান একটা বিচিত্র দৃষ্টিতে তিনার দিকে তাকাল। অনেকটা হতাশার ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল, তারপর বলল, “তুমি সত্যি বিশ্বাস করো এটি শুধুই একটা ভালো উদ্যোগ?”
তিনা ইতস্তত করে বলল, “আমি তো এই মুহূর্তে এর মাঝে ভালো ছাড়া খারাপ কিছু দেখছি না। হতদরিদ্র মানুষদের নাগরিকত্ব দেওয়ার মাঝে খারাপ কী হতে পারে?”
“আমি জানি না তিনা। সে জন্য আমার ভিতরে এত অশান্তি। এই মানুষটির নিশ্চয়ই একটা ভয়ংকর পরিকল্পনা আছে, সেই পরিকল্পনাটি আমি বুঝতে পারছি না।” রিমান হতাশভাবে তার মাথা নেড়ে বলল, আমার ভিতরে অশান্তি বেশি কেন জানো?”
“কেন?”
“তার কারণ এই মানুষটি আমাকে ব্যবহার করছে! আমি তার হাতের একটা ঘুঁটি!”
তিনা কীভাবে রিমানকে সান্ত্বনা কিংবা সাহস দেবে বুঝতে পারল না। তাই সে তার হাত ধরে বসে রইল। সামনে হৃদের পানিতে হতদরিদ্র কয়েকটি শিশু ঝাঁপাঝাঁপি করছে। শিশুগুলোর মাঝে কোনো দুর্ভাবনা নেই, কোনো দুশ্চিন্তা নেই। তাদের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে রিমান একধরনের হিংসা অনুভব করে। কেন সে এ রকম হতদরিদ্র একটি পরিবারের হতদরিদ্র একটি শিশু হয়ে জন্ম নিল না?
* * * *
দেখতে দেখতে এক বৎসর কেটে গেছে।
অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি এই এক বৎসরে দেশের প্রতিটি মানুষের নাগরিকত্ব কার্ড দেওয়া হয়েছে। রিমান কখনো বিশ্বাস করেনি সব মানুষ এই কার্ড ব্যবহার করে সমান সুযোগ পাবে কিন্তু সত্যি সত্যি সব মানুষ সমান সুযোগ পাচ্ছে। যারা একসময় হতদরিদ্র মানুষ ছিল তারা নিজেদের দক্ষতার উপযোগী কাজ খুঁজে পেতে শুরু করেছে। তাদের ছেলেমেয়েরা স্কুলে লেখাপড়া করতে পারছে। মানুষগুলো রোগেশোকে চিকিৎসা পাচ্ছে। শহরতলিতে সুন্দর ফ্ল্যাটে থাকার জায়গা পাচ্ছে। ঝলমলে শপিং মলে উৎসবের দিনে পরিবারের জন্য উপহার কিনতে পারছে। রেস্টুরেন্টে গিয়ে ভালো-মন্দ খেতে পারছে। বাইরে থেকে দেখতে অনেকটা ইউটোপিয়ান সমাজের মতো কিন্তু রিমান জানে আর দুই বছরের ভেতর সবকিছু তাসের ঘরের মতো ধসে পড়বে।
রিমান গত এক বছর অমানুষের মতো কাজ করেছে। মাত্র কয়েক সপ্তাহ হয়েছে শেষ পর্যন্ত তার কাজের চাপ একটু কমেছে। আজকাল মাঝে মাঝে তিনার সাথে সে একটু সময় কাটাতে পারে। এ রকম একটি সন্ধেবেলা রিমান তিনাকে নিয়ে বের হয়েছে। শহরের রাস্তার পাশে ছোটো ছোটো খাবারের দোকান। একসময় যারা হতদরিদ্র মানুষ ছিল তারা নিজেদের মতো করে বেঁচে থাকার জন্য এ রকম অনেক পথ খুঁজে বের করেছে।
রিমান আর তিনা এ রকম ছোটো একটা খাবার দোকানের বাইরে বসেছে। কমবয়সি একটা মেয়ে এসে তারা কী খাবে জেনে গেছে। রিমান আর তিনা দেখল তাদের সামনেই খাবার রান্না করা হচ্ছে। যে মানুষটি রান্না করছে সে রান্না করতে করতে উচ্চৈঃস্বরে পাশের দোকানের একজনের সাথে কথা বলছে, রিমান হঠাৎ আগ্রহ নিয়ে তার কথা শুনতে চেষ্টা করে। শুনল মানুষটি বলছে, “আমি গত পরশু কী বিপদে পড়েছিলাম জানো?”
পাশের দোকানের মানুষটি জিগ্যেস করল, “কী বিপদ?”
“হঠাৎ করে আমার নাগরিকত্ব কার্ড কাজ করা বন্ধ করে দিলো!”
“তাই নাকি?”
“হ্যাঁ।”
“তারপর?”
“তারপর মহা বিপদ। আমাকে কেউ চিনে না। বাজার করতে পারি না, বাসে উঠতে পারি না, বউয়ের সাথে যে যোগাযোগ করব সেটারও উপায় নেই!”
পাশের দোকানের মানুষটা শব্দ করে হাসল, “নাগরিকত্ব কার্ড অচল হয়ে গেলে বউও অচল হয়ে যায়! কী আশ্চর্য।”
“অনেকটা সে রকম অবস্থা। নাগরিকত্ব কার্ড অচল হওয়ার অর্থ আমি বুঝলাম।”
“কি বুঝেছো?”
“আমার এই রক্ত-মাংসের শরীরটা থেকে বেশি গুরুত্ব এই কার্ডের। কার্ড নাই তো আমিও নাই!”
“ভাগ্যিস আমরা কার্ডটি পেয়েছি—তাই জীবনটা এখন মোটামুটি কেটে যাচ্ছে!”
“হ্যাঁ। ঠিকই বলেছো।”
“কিন্তু তোমার কার্ড অচল হয়েছিল কেন?”
“জানি না। শেষ পর্যন্ত যখন হেঁটে হেঁটে কার্ড ইস্যু করার অফিসে গেছি তারা কার্ডটা ঠিক করে দিয়েছে। বলেছে সূর্য থেকে কী জানি একধরনের কণার ঝড় হয় তখন পৃথিবীর সিস্টেমে মাঝে মাঝে সমস্যা হয়।”
পাশের দোকানের মানুষটা আবার শব্দ করে হাসল, বলল, “কী মজা! সরাসরি সূর্যকে দায়ী করে দিলো—এখন সূর্যকে ধরতে যাবে কে? সূর্যকে ধরে তো আর জেল দেওয়া যাবে না!”
রান্না করতে থাকা মানুষটা জ্বলন্ত আগুনে মাংস সেঁকতে সেঁকতে বলল, “আমি কী ঠিক করেছি জানো?”
“কী?”
“নাগরিকত্ব কার্ডটাকে যেন সৌরঝড় কিংবা চাঁদের ঝড় কোনো ঝড়ই অচল করে দিতে না পারে সে জন্য এটাকে এখন থেকে সিসার তৈরি প্যাকেটে রাখব।”
পাশের দোকানের মানুষটার কাছেও এই আইডিয়াটা অসাধারণ মনে হলো, সে মাথা নেড়ে বলল, “ভালো বলেছো। আইডিয়াটা খারাপ না। খুবই ভালো আইডিয়া।”
রিমান একধরনের কৌতুক অনুভব করল। এই মানুষগুলো প্রথমবার নাগরিকত্ব কার্ডের সুযোগ-সুবিধা উপভোগ করতে গিয়ে এটাকে বাড়াবাড়ি গুরুত্ব দিয়ে ফেলেছে! রিমান ভাবল একবার তাদের ডেকে বলে কার্ডগুলোকে সিসার প্যাকেটে রাখার কোনো প্রয়োজন নেই, এর মাঝে গুরুত্বপূর্ণ কিছু নেই! কার্ডগুলো নষ্ট হলে কিংবা হারিয়ে গেলে কিছু আসে-যায় না। একজন মানুষের আঙুলের ছাপ, রেটিনার ছাপ, ডি.এন.এ. কোডিং, এমনকি মুখের ছবি দিয়েই তাদের পরিচয় বের করে নূতন নাগরিকত্ব কার্ড দিয়ে দেওয়া যাবে। এখানে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে তথ্য কেন্দ্রে রাখা এই মানুষগুলোর তথ্য! সেগুলো রক্ষা করার জন্য দেশের ছয় জায়গায় বিভিন্ন মাত্রার নিরাপত্তা দিয়ে রাখা আছে! সেগুলো নষ্ট হবার বা হারিয়ে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। কেউ চাইলেও সেই তথ্যগুলো নষ্ট করতে পারবে না। এই তথ্য নষ্ট করতে হলে কিংবা পরিবর্তন করতে হলে চারজন ভিন্ন ভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মানুষের গোপন পাসওয়ার্ড জানতে হবে। সারা দেশে শুধু একজন মানুষ আছে যে ইচ্ছা করলে এই তথ্য নষ্ট করতে পারবে কিংবা পরিবর্তন করতে পারবে। সেই মানুষটি হচ্ছে দেশের রাষ্ট্রপ্রধান জেনারেল জিনজি।
জেনারেল জিনজি? হঠাৎ করে নিজের অজান্তেই রিমানের ভুরু কুঁচকে গেল। আগে কখনোই সে ব্যাপারটা চিন্তা করেনি। গত এক বছর ধীরে ধীরে নাগরিকত্ব কার্ডটি একজন মানুষের জীবনে এতই প্রয়োজনীয় করে তোলা হয়েছে যে, হঠাৎ করে কোনো মানুষের তথ্য যদি তথ্য কেন্দ্ৰ থেকে সরিয়ে ফেলা হয় মুহূর্তের মাঝে সেই মানুষটি আক্ষরিক অর্থে অদৃশ্য হয়ে যাবে। রক্ত-মাংসের মানুষ হিসেবে তার দেহটি থাকবে কিন্তু কেউ তাকে খুঁজে পাবে না। সে নামহীন-পরিচয়হীন-অস্তিত্বহীন জঞ্জালে পরিণত হবে। তাকে রক্ষা করার কোনো উপায় থাকবে না।
রিমান হঠাৎ করে শুনল তিনা বলছে, “কী হলো রিমান? তুমি হঠাৎ করে এমন কী চিন্তায় ডুবে গেলে?”
রিমান থতমত খেয়ে বলল, “না, না তিনা। হঠাৎ করে একটা জিনিস মনে হলো—”
“কী জিনিস?”
“না না—তোমাকে বলার মতো কিছু না।”
রিমান কথাটা ঘুরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করল কিন্তু মাথা থেকে চিন্তাটা সরাতে পারল না। জেনারেল জিনজি এতদিন তার গোপন বাহিনী ব্যবহার করে মানুষ গুম করেছে, খুন করেছে। এখন তাকে কিছুই করতে হবে না। তাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে চাইলে তথ্যকেন্দ্রে তার নামটি বের করে সেটি মুছে দিতে হবে।
মুহূর্তে মানুষটি বেঁচে থেকেও একজন মৃতমানুষ হয়ে যাবে। তাকে রক্ষা করতে পারে শুধু একজন। সেটি হচ্ছে রিমান। রিমানকে নাগরিকত্ব কার্ড প্রজেক্টের দায়িত্ব দিয়ে নিজের অজান্তেই তাকে একটি বিশাল ক্ষমতা দিয়ে রাখা হয়েছে।
এত বড়ো ক্ষমতা দিয়ে সে কী করবে?
তিনা কিছু একটা বলছে, রিমান তার দিকে তাকাল, অপরাধীর মতো জিগ্যেস করল, “কী বলছো তিনা?”
“তোমার কী হয়েছে? আমার কথা পর্যন্ত শুনছো না!”
“আসলে—আসলে—হঠাৎ একটা জিনিস টের পেয়েছি, সেটা নিয়ে খুব অস্থির লাগছে।”
তিনা শান্ত মুখে বলল, “অস্থির হওয়ার অনেক সময় পাবে। এখন দুজন খেতে এসেছি, খাবার ঠান্ডা হওয়ার আগে খেতে শুরু করি।”
রিমান বলল, “চমৎকার আইডিয়া।” রিমান প্লেটে খাবার তুলে নিতে নিতে বাইরে তাকাল। হাসি-খুশি মানুষজন হাঁটছে, কথা বলছে। তার মাঝে কিছু কালো পোশাক পরে থাকা মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। এরা কখন এসেছে? কেন এসেছে?
কেউ বলে দেয়নি কিন্তু রিমান বুঝতে পারল মানুষগুলো তাকে ধরে নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে।
* * * *
জেনারেল জিনজি দেওয়ালের বড়ো মনিটরের দিকে তাকিয়ে আছে। সেখানে ডজন খানেক মানুষের হলোগ্রাফিক ত্রিমাত্রিক ছবি। নানা বয়সি মানুষ, কিছু পুরুষ, কিছু মহিলা। ভিন্ন ভিন্ন মানুষ কিন্তু তাদের চেহারায় কোথাও যেন একধরনের মিল রয়েছে। জেনারেল জিনজি মানুষগুলোর ত্রিমাত্রিক ছবিগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে তারপর সেগুলো নিয়ে একধরনের অর্থহীন খেলা শুরু করে দেয়। কৃত্রিমভাবে মানুষগুলোর চেহারা পাল্টে দিতে থাকে। কখনো চেহারার মাঝে আতঙ্ক ফুটিয়ে তুলে, কখনো যন্ত্রণা, কখনো হতাশা কিংবা দুঃখ। একটি একটি করে প্রত্যেকটি মানুষের চেহারায় একধরনের ভয়াবহ অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলে সে কিটিকে ডাকল। কিটি সাথে সাথে সাড়া দিয়ে বলল, “বলো জেনারেল জিনজি।”
“কেমন দেখছো আমার শিল্পকর্ম?”
“আগের থেকে অনেক ভালো। আগে সত্যিকার মানুষকে তুমি এ রকম ভয়াবহ যন্ত্রণার অভিব্যক্তি দেওয়াতে। এখন শুধু তাদের হলোগ্রাফিক ছবিতে।”
“কিছুক্ষণের মাঝেই সত্যিকার মানুষগুলোর মুখে এ রকম যন্ত্রণার ছবি ফুটে উঠবে। তখন তাদের দেখতে কেমন লাগে সেটা দেখার চেষ্টা করছি।”
“তুমি হলোগ্রাফিক ছবিতে এবারে শারীরিক যন্ত্রণার অভিব্যক্তি আনার চেষ্টা করছো, কিন্তু বাস্তবে তাদের তো শারীরিক যন্ত্রণা দেওয়া হবে না। নাগরিকত্ব কার্ড অচল করে দিলে তাদের চেহারায় বড়জোর হতাশা, ক্রোধ কিংবা দুশ্চিন্তার অভিব্যক্তি আসবে।”
“এগুলো দিয়ে হয়তো শুরু হবে কিন্তু দেখতে দেখতে সেগুলো একেবারে শারীরিক যন্ত্রণায় রূপ নেবে।”
জেনারেল জিনজি দৃশ্যটা কল্পনা করে কেমন জানি দুলে দুলে হাসতে শুরু করল।
কিটি বলল, “বুঝতে পারছি। তুমি সে জন্য গত রাতে সেই বিশেষ প্রজ্ঞাপনটি জারি করেছো।”
“হ্যাঁ। প্রজ্ঞাপনে স্পষ্ট করে বলে দেওয়া হয়েছে। নাগরিকত্ব কার্ড না থাকা দেশের আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। তারা নিশ্চিতভাবে ঘাগু ক্রিমিনাল। তারা রাষ্ট্রের কোনো ধরনের সমবেদনা বা সহায়তা পাবে না।”
“তুমি নাগরিকত্ব কার্ড বাতিল করার জন্য যাদের বেছে নিয়েছো তারা নিশ্চিতভাবেই এই দেশের সবচেয়ে দুর্ভাগ্যবান মানুষ।”
জেনারল জিনজি মাথা নাড়ল, “না না কিটি। তারা দুর্ভাগা মানুষ না। যদি কোনো মানুষের নিজের কোনোরকম গাফিলতি ছাড়া তার জীবনে দুর্ভোগ নেমে আসে তাহলে সে হচ্ছে দুর্ভাগা। কিন্তু যখন একজন মানুষের নিজের কাজকর্মের জন্য তার জীবনে দুর্ভোগ নেমে আসে, সেটা মোটেও দুর্ভাগ্য নয়। সেটা কর্মফল।”
“তোমার যুক্তিতে কোনো ভুল নেই জেনারেল জিনজি। তোমার দৃষ্টিতে অবশ্যই এই মানুষগুলো অপরাধী। তারা দেশের মানুষকে সংগঠিত করার চেষ্টা করেছে। বৈষম্য আর বিভাজনের কথা বলেছে। এ রকম মানুষ বেশি থাকলে তোমার নৃশংস শাসন চালিয়ে যাওয়া কঠিন।”
“তুমি মানুষ হলে এই কথার জন্য নিশ্চিতভাবেই তোমার নাগরিকত্ব কার্ড বাতিল করে দিতাম।”
কিটি হাসির মতো শব্দ করল, বলল, “কিন্তু আমি তোমার একমাত্র বন্ধু। আমাকে অচল করে দিলে তুমি পুরোপুরি নিঃসঙ্গ হয়ে যাবে।”
“ সেটি সত্যি।”
“তুমি কখন এই এক ডজন মানুষের নাগরিকত্ব কার্ড বাতিল করবে? বিষয়টি দেখার জন্য আমি এখন একধরনের আগ্রহ বোধ করছি।”
জেনারেল জিনজি ঘরের দেওয়ালের বড়ো ঘড়িটির দিকে তাকাল, তারপর বলল, “প্রথমবার বিষয়টি আমি আনুষ্ঠানিকভাবে করতে চাইছি। বিষয়টি সবচেয়ে নিখুঁতভাবে কী করে করতে হয় সেটা জানার জন্য আমি নাগরিকত্ব কার্ড প্রজেক্টের দায়িত্ব দেওয়া তরুণ বিজ্ঞানীকে ডেকেছি।”
কিটি বলল, “গতবার যখন তুমি তাকে ফায়ারিং স্কোয়াড থেকে মুক্তি দিয়ে এই প্রজেক্টের দায়িত্ব দিয়ে পুরস্কৃত করেছিলে তখন তাকে আমি একজন সৌভাগ্যবান মানুষ ভেবেছিলাম। এখন দেখতে পাচ্ছি তার সৌভাগ্যটুকু ফুরিয়ে গেছে।”
“তুমি কেমন করে বুঝতে পারলে?”
“অনুমান করছি তুমি নিজ হাতে নাগরিকত্ব বাতিল করার এই প্রক্রিয়াটির কোনো সাক্ষী রাখতে চাইবে না।”
জেনারেল জিনজি হাসির মতো শব্দ করল। বলল, “তুমি যেকোনো হিসেবে যথেষ্ট বুদ্ধিমান। সে জন্য তোমার সাথে কথা বলা আমি খুব উপভোগ করি।”
“শুনে খুশি হলাম।”
ঠিক তখন ঘরের এক পাশে একটি বড়ো দরজা নিঃশব্দে খুলে যায়। দেখা গেল দরজার বাইরে রিমান দাঁড়িয়ে আছে। তার চেহারায় একধরনের আতঙ্ক।
জেনারেল জিনজি গলায় সহৃদয় একটি ভাব ফুটিয়ে বলল, “এসো। তুমি ভিতরে এসো।”
রিমান ধীরে ধীরে ভিতরে ঢুকল। জেনারেল জিনজি থেকে মোটামুটি একটা নিরাপদ দূরত্বে এসে সে থেমে গেল। ঘরের চারপাশে যন্ত্রণাক্লিষ্ট এক ডজন মানুষের হলোগ্রাফিক মূর্তিগুলো কেমন জানি বীভৎস মনে হয়। সে সেদিকে তাকাতে সাহস পায় না।
জেনারেল জিনজি রিমানের দিকে তাকিয়ে হাসি হাসি মুখে বলল, “তোমাকে যে দায়িত্ব দিয়েছিলাম সেটি ভালোভাবে শেষ করার জন্য অভিনন্দন।”
রিমানের বুক কেঁপে ওঠে। এই ভয়ংকর মানুষটির মুখে অভিনন্দন শব্দটি কেমন যেন হিংস্র গর্জনের মতো শুনায়। রিমান জিভ দিয়ে তার শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে কাঁপা গলায় বলল, “ধন্যবাদ। অসংখ্য ধন্যবাদ।”
“নাগরিকত্ব কার্ডের প্রথম পর্ব শেষ হয়েছে।” জেনারেল জিনজি হাসি হাসি মুখে বলল, “আজ থেকে দ্বিতীয় পর্ব শুরু হবে। দ্বিতীয় পর্ব শুরু করার সম্মানটুকু আমি তোমাকে দিতে চাই। তুমি সামনের টেবিলে বসো। টেবিলে যোগাযোগ মডিউল তোমার জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। তুমি নাগরিকত্ব তথ্য ভান্ডার উন্মুক্ত করো।”
রিমান টেবিলের সামনে রাখা চেয়ারটিতে বসে টেবিলের পৃষ্ঠে হাত রেখে যোগাযোগ মডিউল স্পর্শ করে। সাথে সাথে সিস্টেমটি উন্মুক্ত হয়ে যায়। সে তার আঙুলের ছাপ, চোখের রেটিনার ছবি এবং ত্বকের মৃতকোষের ডিএনএ কোডিং দিয়ে নিজের পরিচয় নির্দিষ্ট করতেই তথ্য ভান্ডার উন্মুক্ত হয়ে যায়। দেশের অসংখ্য মানুষের ছবি এবং পরিচয় তার সামনে দ্রুত পাল্টে যেতে থাকে। রিমান জেনারেল জিনজির দিকে তাকিয়ে বলল, “তথ্য ভান্ডার উন্মুক্ত হয়েছে মহামান্য জেনারেল।”
জেনারেল জিনজি ঘরের বিভিন্ন কোনায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর হলোগ্রাফিক মূর্তিগুলো দেখিয়ে বলল, “এই মানুষগুলোর নাগরিকত্ব কার্ড বাতিল করতে শুরু করো।”
রিমান চমকে উঠল। শুকনো গলায় বলল, “নাগরিকত্ব কার্ড বাতিল করব?”
“হ্যাঁ।”
“মহামান্য জেনারেল, তাহলে কিন্তু এই মানুষগুলো পুরোপুরি অস্তিত্বহীন হয়ে যাবে।”
জেনারেল জিনজি বিরক্ত হয়ে বলল, “সেটি তোমার আমাকে শেখাতে হবে না। যা বলছি সেটি করো।”
রিমান শুকনো গলায় বলল, “ঠিক আছে মহামান্য জেনারেল। আমি নাগরিকত্ব কার্ড বাতিল করছি।”
জেনারেল জিনজি হাত দিয়ে একটি প্রতিমূর্তি দেখিয়ে বলল, “বাম পাশের লাল চুলের এই মহিলাটি দিয়ে শুরু করো। এই মহিলা মনে হয় পালের গোদা।”
রিমান তার সামনের স্ক্রিনে ঝুঁকে পড়ে। একজন মানুষের নাগরিকত্ব কার্ড বাতিল করে দেওয়া আর মানুষটিকে হত্যা করার মাঝে কোনো পার্থক্য নেই। সে এই প্রথম কাউকে হত্যা করতে যাচ্ছে। রিমানের নিজেকে একজন জল্লাদ বলে মনে হয়। রিমান কাঁপা হাতে স্ক্রিনটি স্পর্শ করে।
জেনারেল জিনজি জিগ্যেস করল, “নাগরিকত্ব কার্ড বাতিল করতে কতক্ষণ সময় নেবে?”
“বেশি সময় নেওয়ার কথা নয়। কয়েক সেকেন্ড।”
কয়েক সেকেন্ড পার হয়ে গেল। জেনারেল জিনজি একধরনের কৌতূহল নিয়ে হলোগ্রাফিক প্রতিমূর্তিটির দিকে তাকিয়ে ছিল। নাগরিকত্ব কার্ড বাতিল করার সাথে সাথে হঠাৎ করে সেটি ম্যাজিকের মতো অদৃশ্য হয়ে যাবে।
কিন্তু সেটি অদৃশ্য হলো না। জেনারেল জিনজির ভুরু কুঞ্চিত হয়ে উঠল, ক্ষিপ্ত স্বরে বলল, “কয়েক সেকেন্ড থেকে অনেক বেশি সময় পার হয়ে গেছে। আশা করি তোমার ভালো একটি ব্যাখ্যা আছে যুবক।”
রিমান ধীরে ধীরে তার চেয়ারে হেলান দিয়ে বসল, তারপর টেবিলের উপর থেকে হাত দুটি সরিয়ে নিয়ে নিজের বুকের ওপর ভাঁজ করে রাখল, তারপর বলল, “হ্যাঁ জেনারল জিনজি। আমার খুব ভালো ব্যাখ্যা আছে।”
জেনারেল জিনজি গর্জন করে ওঠে, “কী ব্যখ্যা?”
“নাগরিকত্ব কার্ডটি বাতিল হতে আসলেই মাত্র কয়েক সেকেন্ড সময় লেগেছে। জেনারেল জিনজি, আমি তোমার নাগরিকত্ব কার্ডটি বাতিল করে দিয়েছি।”
জেনারেল জিনজির কয়েক মুহূর্ত সময় লাগে কথাটি বুঝতে। যখন বুঝতে পারল প্রচণ্ড আক্রোশে তর মুখ বিকৃত হয়ে যায়। সে চিৎকার করে বলল, “কিটি, তুমি এই মুহূর্তে প্রেসিডেন্সিয়াল গার্ডদের ডাকো—”
কিটি শান্ত গলায় বলল, “প্রেসিডেন্সিয়াল গার্ড? কিন্তু তার আগে বলো তুমি কে?”
জেনারেল জিনজি হিংস্র গলায় কিছু একটা বলতে গিয়ে হঠাৎ থেমে গেল, তার মুখে হঠাৎ করে একটা আতঙ্কের ছাপ পড়ল। সে উঠে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে বলল, “কিটি, তুমি কী বলছো এসব?”
“আমি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় পরিচালিত একটি পরিব্যাপ্ত সিস্টেম। আমি শুধু প্রকৃত তথ্যধারী মানুষের জন্য কাজ করতে সক্ষম। তুমি তথ্যবিহীন একটি অস্তিত্ব। তোমার এখানে থাকার কথা না। তোমাকে ধরে নেওয়ার জন্য কিছু যান্ত্রিক মানব আসছে। তুমি বিন্দুমাত্র নিয়ম ভঙ্গ করলে তাদের হাতে তোমার প্রাণহানি ঘটবে।”
জেনারেল জিনজি চিৎকার করে বলল, “কী বলছো তুমি এসব? কী বলছো?”
তার কথা শেষ হওয়ার আগেই ঘরটির চার কোনার চারটি দরজা খুলে যায়। ভয়ংকর দর্শন কয়টি রোবট ভিতরে ঢুকে জেনারেল জিনজিকে ঘিরে ফেলে। একটি রোবট তার কলার ধরে তাকে টেনেহিঁচড়ে নিতে থাকে। জেনারেল জিনজি চিৎকার করে বলে, “ছেড়ে দাও আমাকে—আমি জেনারেল জিনজি— জেনারেল জিনজি।”
জেনারেল জিনজিকে টেনে ঘর থেকে বের করে নিয়ে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে। ঘরটি খালি হয়ে যাবার পর রিমান আবার টেবিলের উপর ঝুঁকে পড়ল। দেশটি এখন কে চালাবে সে জানে না। নাগরিকত্ব কার্ড বাতিল করার জন্য জেনারেল জিনজি যে এক ডজন মানুষকে বেছে রেখেছিল তাদেরকে দিয়ে নিশ্চয়ই শুরু করা যাবে। জেনারেল জিনজি যাদেরকে মেরে ফেলতে চায় তারা নিশ্চয়ই ভালো মানুষ, কাজের মানুষ।
রিমান তাদের সাথে যোগাযোগ করতে শুরু করে দেয়।
* * * *
জেনারেল জিনজি লোকালয় থেকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল। অভুক্ত অবস্থায় একটা গ্রাম থেকে খাবার চুরি করে ধরা পড়ার পর গ্রামবাসী তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছিল।
নাগরিকত্ব কার্ডবিহীন একজন মানুষকে পিটিয়ে মেরে ফেললেও সেটি নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন