গ্রুপ থিয়েটারে সমস্যা

অভীক চট্টোপাধ্যায়

গ্রুপ থিয়েটারে সমস্যা

বর্তমানে একটা ব্যাপারে কোনও দ্বিধা নেই, সেটা হল, যে যার নিজের মতো কাজ করে চলেছে। গ্রুপ থিয়েটার ক্রমাগতই তার দর্শকসংখ্যা হারাচ্ছে। এখন বলা চলে, গ্রুপ থিয়েটারগুলো একটা সীমাবদ্ধ দর্শক শ্রেণির মধ্যেই আটকে পড়েছে। এঁরা থিয়েটার করে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কক্ষে। দর্শকের প্রচুর আরাম হয় এখানে। মনটা কতখানি ভরে, সেটা বলা মুশকিল। মনটা না ভরলেও এখানকার দর্শকরা কোনও চেঁচামেচি করে না। এঁদের বলা যেতে পারে ভদ্র দর্শক। এঁরা খারাপ লাগলেও চেঁচায় না— আবার ভালো লাগলেও উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে না। আমার মতে এই শ্রেণির দর্শক কোনও থিয়েটারকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে না। থিয়েটারের মূল উদ্দেশ্য যদি হয় দর্শকসংখ্যা বৃদ্ধি করা, তাহলে এখানে সেটা সম্ভব নয়। এইখানে রঙের অভাব। নানা রকমের রং না থাকলে দর্শকের প্রচুর সমাগম অসম্ভব। আর যদি প্রচুর দর্শক সমাগম না হলেও চলে তাহলে কোনও সমস্যা নেই। এটা আমার অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। সেই সময় কম দর্শক দেখলে হতাশ হয়ে পড়তাম। আবার বেশি দর্শক হলে যে প্রচুর আনন্দ হত, সেটা অস্বীকার করতে পারব না। থিয়েটার নিয়ে যত কথাই বলা হোক, দর্শকই যে আসল— এটা কেউ অস্বীকার করতে পারেন না। ‘to-day’s afternoon audience’—এটাই সবচেয়ে বড়ো কথা। এখন সরকার গ্রুপ থিয়েটার সম্পর্কে অনেক এগিয়ে এসেছেন। অনেক আর্থিক সাহায্যও করেছেন। কিন্তু দর্শকের সেই সমাগম দেখা যাচ্ছে না। এটা কিন্তু একটা সমস্যা। অনেক ছেলের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি। বেশির ভাগই হতাশায় ভুগছে। কিছু আছেন, যাঁরা অবশ্য এখনও একটা বিশ্বাস নিয়ে বেঁচে আছেন। আমার মনে হয় দাক্ষিণ্য সবচেয়ে দরকার দর্শকের। প্রথমাবস্থায় একটু-আধটু সরকার বা অন্য কিছুর সাহায্য নেওয়ায় দোষ নেই। কিন্তু সর্বসময় সরকারের আনুকূল্যে থিয়েটারকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব নয়।

এবার পেশাদারি মঞ্চ। এখানে অনেক ত্রুটি আছে। কিন্তু একটা ব্যাপারে এরা খুব পরিষ্কার। এদের মূল উদ্দেশ্য রোজগার (পয়সা) এবং প্রচুর রোজগার। কখনও কখনও নিম্নশ্রেণির মাধ্যমেও রোজগার হয়ে থাকে এখানে। অবশ্য বর্তমান পেশাদারি মঞ্চে সেরূপ নিম্নমানের ব্যাপার-স্যাপারগুলো এখন নেই বললেই চলে। কিন্তু দর্শককে জানতে হবে এমন অঙ্ক এখানে না জানলে টিকে থাকাই দায় হবে। এখানে মঞ্চ থেকে জ্ঞান বিতরণ করতে গেলেই বিপদ।

এখানে সর্বশ্রেণির লোক আসে। ভদ্রও আসে, অভদ্রও আসে। ভালো লাগলে উচ্ছ্বসিতভাবে প্রশংসা করে, খারাপ লাগলে চেঁচিয়ে ওঠে। এখানে সমস্যাটা মোর চ্যালেঞ্জিং। পেশাদারি মঞ্চ কখনওই সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকবে না। তার একমাত্র লক্ষ্য দর্শক। দুটো জগতেই আমি যাতায়াত করেছি— গ্রুপ থিয়েটার এবং পেশাদারি মঞ্চ। আমার কাছে কোনও জায়গাটাই খারাপ লাগেনি। একজন সাংবাদিক আমায় একবার খুব বোকার মতো একটা প্রশ্ন করেছিল। সেটা হল, আমি কেন ব্যাবসায়িক থিয়েটারে কাজ করি? আমি তার জবাবে বলেছিলাম, ‘আপনি কি অব্যাবসায়িক কোনও কাগজে চাকরি করেন?’ ব্যাবসা তো বটেই। সেটা জেনেও এই প্রশ্ন যাঁরা করেন, তাঁরাই অব্যাবসায়িক থিয়েটারগুলোর বেশি পৃষ্ঠপোষক। কিন্তু সত্য ঘটনা হল, এই ধরনের অসাধু লোকদের পৃষ্ঠপোষকতায় কোনও জিনিস বেশি দিন চলতে পারে না। আপনার দর্শককে আপনি চিনুন। সেটা কম হোক আর বেশিই হোক। থিয়েটার হচ্ছে দর্শকদের জন্য। দর্শকদের অবজ্ঞা করে থিয়েটার চালানো সম্ভব নয়। থিয়েটার হচ্ছে মনোরঞ্জনের জায়গা। মনোরঞ্জনের সঙ্গে যদি দু’-চারটে জ্ঞানের কথা বলতে পারেন, ক্ষতি নেই। কিন্তু শুধুমাত্র জ্ঞানের কথা উচ্চারণ করলে বিপদ হবেই। ‘আমি কিছু বুঝি না?’ এটা দর্শকের একটা প্রধান কমপ্লেক্স।

সমস্যার সমাধান নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু এখানে একটা সম্পূর্ণ সমাধানের রাস্তা এখনও তৈরি হয়নি। একদিন নিশ্চয়ই হবে। ও দেশে হয়ে গেছে।

‘কায়ানট’ নাট্যগোষ্ঠীর সৌজন্যে প্রাপ্ত রচনাটি প্রদ্যোতকুমার ভদ্র ও রানা দাস সম্পাদিত ‘রবি ঘোষ স্মারক সংকলন’

 (রবি ঘোষ স্মৃতি সংসদ; ৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৮) গ্রন্থে পুনর্মুদ্রিত

সকল অধ্যায়

১. ফিরে দেখা
২. প্রসঙ্গ : সাইকোলজিক্যাল প্লে
৩. গ্রুপ থিয়েটারে সমস্যা
৪. পেশাদারি মঞ্চ ও আমি
৫. নাটক থেকে ফিল্মে
৬. কমেডি বা হাস্যরস
৭. বাংলা ছবিতে হাসি
৮. ‘হীরক রাজার দেশে’র একটি স্মরণীয় আউটডোর
৯. যাত্রা
১০. চ্যাপলিন
১১. পরিচালক সত্যজিৎ রায়
১২. মানিকদার সমতুল্য অভিনেতা ভারতবর্ষে নেই
১৩. ফেলুদাদা ও লালমোহনবাবু
১৪. রঙ্গমঞ্চ ও কমলদা
১৫. রমাকুমত্তউ
১৬. আমার চোখে সৌমিত্র
১৭. মজার জগতে থাকতেন তিনি
১৮. ভক্তপ্রসাদ মঞ্চে এলেই হাততালি
১৯. অনবদ্য অনুপ
২০. সংগীত যাঁর কাছে পরম আনন্দের
২১. ষাটে শক্তি শক্তিমান
২২. প্রসাদদার উল্টোরথ
২৩. আপসহীন সংগ্রামী
২৪. অপরাজিত ‘মানিকদা’
২৫. রবি ঘোষ একটা সময়ের নাম – শর্মিলা ঠাকুর
২৬. রবি ঘোষ—জীবনপঞ্জি
২৭. রবি ঘোষ—কর্মপঞ্জি

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন