তৃতীয় রিপু

দেবারতি মুখোপাধ্যায়

তৃতীয় রিপু

যে রোমহর্ষক হত্যাকাণ্ডের গল্প বলতে যাচ্ছি, তা ২০১১ সালে আলোড়ন ফেলেছিল গোটা দেশে। মানুষের মনে ভয়ের চেয়েও কৌতূহল জাঁকিয়ে বসেছিল। কারণ একই মামলায় তিনজনকে একসঙ্গে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার সাজা বিরল। আর সেই তিনজনের মধ্যে যদি একজন হয় সুন্দরী তরুণী, তবে তাকে দেখতে আদালতে যে ভিড় উপচে পড়বে, সেটাই তো স্বাভাবিক!

আর সেই সুন্দরী খুনিই পরে জাতীয় পুরস্কার পেলে?

অদ্ভুত এই ঘটনার পটভূমি মধ্যপ্রদেশের ইন্দোর শহর। শ্রীনগর এলাকা। এই অঞ্চলটি অত্যন্ত অভিজাত, মূলত উচ্চবিত্তরাই থাকেন।

২০১১ সালের ১৯ জুন শ্রীনগরেরই এক প্রাসাদোপম বাংলোয় হঠাৎ কলিং বেল বাজল।

টিং টং!

এই প্রচণ্ড গরমে দুপুরবেলা আবার কে এল? বাংলোর মালকিনের নাম মেঘা দেশপান্ডে। বয়স বিয়াল্লিশ, নিজের সত্তর বছরের বৃদ্ধা মা ও একুশ বছরের কলেজপড়ুয়া কন্যাকে নিয়ে তিনি একাই থাকেন। স্বামী নিরঞ্জন দেশপান্ডে শিল্পপতি, নিজের ব্যাবসার কাজে বছরের বেশির ভাগ সময়েই থাকেন বিদেশে।

প্রভূত সম্পত্তির মালিক মেঘা এই মধ্যচল্লিশেও অত্যন্ত সুন্দরী, এবং নিজের সৌন্দর্য সম্পর্কে সচেতন। ইন্দোর শহরের অনেক অভিজাত ক্লাবের তিনি সদস্যা, কিটি পার্টি থেকে সপ্তাহান্তের নৈশভোজ, মিসেস দেশপান্ডে ছাড়া আসর জমে না। তিনি ব্যক্তিত্বময়ী, মিতবাক ও প্রখর বুদ্ধিমতী।

মেঘা দেশপান্ডে সাজেনও খুব রুচিসম্মত। আগে নানারকম আধুনিক পোশাক পরলেও গত চার-পাঁচ বছর তিনি শুধুই শাড়ি পরেন। বহুমূল্য শাড়ির সঙ্গে মানানসই ব্লাউজ ও অলংকারে তিনি যখন সেজে বেরোন, তরুণী কন্যাও মায়ের কাছে ম্লান হয়ে যায়।

কলিং বেলটা যখন বাজল, তখন মেঘা আর তাঁর কন্যা অশ্লেষা টিভি দেখছিলেন। আজ অশ্লেষার কলেজ ছুটি, দুপুরবেলা ঠান্ডা ঘরে বসে মা-মেয়ে এই দিনগুলোয় সিনেমা দেখতে খুব ভালোবাসেন। বাড়িতে পরিচারিকার অভাব নেই, কিন্তু তারা সবাই আসে কাজ করে, আবার চলে যায়। চব্বিশ ঘণ্টার লোক বাড়িতে রাখা মিসেস দেশপান্ডে পছন্দ করেন না। প্রাইভেসি ক্ষুণ্ণ হয় তাতে।

মেঘা দেশপান্ডের বৃদ্ধা মা রোহিণী ফাড়কে বাইরের ঘরে পুজো করছিলেন। তিনি ধীরেসুস্থে উঠে দরজার সামনে গিয়ে আই-হোলে চোখ রাখলেন।

একটি অল্পবয়সি মেয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। করিডরের অল্প আলোয় রোহিণী ফাড়কে মেয়েটিকে চিনতে পারলেন না।

সামান্য ইতস্তত করে তিনি দরজাটা খুললেন।

মেয়েটি খুবই সুন্দরী। তার চেয়েও বেশি চটকদার তার পোশাক। প্রসাধনে ঢাকা মাথা থেকে পা। নিখুঁত বিন্যাসে রং-করা চুল সামনে ফেলে রাখা।

মেয়েটির কাজলে আঁকা চোখ দেখতে দেখতে রোহিণী ফাড়কে বললেন, ”কে তুমি?”

মেয়েটি মিষ্টি হাসল। সুরেলা স্বরে বলল, ”মেঘা ম্যাডাম আছেন? উনি আমাকে আসতে বলেছিলেন!”

”ওহ! ভেতরে এসো।” রোহিণী ফাড়কে দরজাটা খুলে গিয়ে পিছু ফিরলেন। মেঘা নিয়মিত নামীদামি বিউটি পার্লারে গেলেও অনেক সময় পার্লারের মেয়েরা বাড়িতে আসে। এও তেমনই কেউ হবে। মেয়েকে ঘরে ডাকতে যাওয়ার রোহিণী ফিরে তাকালেন। মেয়েটা সোফায় বসুক ততক্ষণ।

ও মা! মেয়েটা ঘরে ঢুকে তো এসেইছে, মেয়েটার পিছু পিছু ঢুকে পড়েছে দুটো লম্বা চওড়া যুবক।

”একী!’ রোহিণী ফাড়কে বিস্ফারিত চোখে বললেন, ”কে তোমরা?”

সামনের ছেলেটা পকেট থেকে পিস্তল বের করল। চাপাস্বরে বলল, ”চিৎকার করবেন না। চিৎকার করলে কিন্তু মাথা ফুটো করে দেব!”

রোহিণী ফাড়কে ভয়ে কাঁপতে লাগলেন। কিন্তু তিনি ওই অবস্থাতেও লক্ষ করলেন, ছেলেটিও কাঁপছে। বোঝাই যাচ্ছে, জীবনে কখনো সে আগ্নেয়াস্ত্র ধরেনি। রোহিণী আড়চোখে ওপাশের বন্ধ ঘরের দিকে তাকালেন। ভেতরে এসি চলছে। সঙ্গে জোর ভলিউমে টিভি।

চিৎকার করলে কি মেঘা শুনতে পাবে না? নিশ্চয়ই পাবে!

রোহিণী আর কিছু ভাবলেন না। যা থাকে কপালে, তিনি পরিত্রাহি চেঁচাতে লাগলেন, ”মেঘা! অশ্লেষা! জলদি আও!”

পিস্তল ধরে ছেলেটার নাম রাহুল, সে হতবুদ্ধি হয়ে সঙ্গী মেয়েটির দিকে তাকাল। মেয়েটা ভাবল এক মুহূর্ত, তারপর আদেশ করল, ”গুলি চালাও।”

চোরাবাজারে বিক্রি হওয়া সস্তা পিস্তল হলেও তাতে সাইলেন্সার লাগানো রয়েছে। রাহুলের অনভ্যস্ত হাত থেকে গুলি ছিটকে গিয়ে যখন রোহিণী ফাড়কের মাথা এ ফোঁড় ও ফোঁড় করে দিল, সামান্য পটকা ফাটার মতো আওয়াজ হল।

রোহিণী ফাড়কের চোখ দুটো বড়ো বড়ো হয়ে গেল, মাথার দু-পাশ থেকে ঘিলুর কিছুটা অংশ ছিটকে বেরোল বাইরে, তারপর তার ন্যুব্জ শরীরটা পড়ে গেল দামি কার্পেটের ওপর। নাক ও কান থেকে তাজা রক্ত বেরিয়ে এসে ভিজিয়ে দিতে লাগল পশম।

কিন্তু এরপরেও কেউ বেরিয়ে এল না। দ্বিতীয় যুবকের নাম মনোজ, সে ফিসফিস করে বলল, ”কেউ তো আসছেই না!”

দলের নেত্রী হাত তুলে তাকে থামাল। তারপর সন্তর্পণে এগোতে লাগল ভেতরের দিকে। প্রকাণ্ড ডাইনিং-ড্রয়িং পেরিয়ে একদিকে কিচেন, অন্যদিকে বেডরুম। আপাদমস্তক ইন্টেরিয়র ডিজাইন করা বাড়ির সর্বত্র বৈভবের ছাপ স্পষ্ট। মেয়েটা এদিক-ওদিক তাকাতে তাকাতে বেডরুমের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর বন্ধ দরজায় কান পাতল।

ভেতরে হাসির কোনো সিনেমা চলছে। কিছুক্ষণ করে সংলাপের পরই ঘরে বসে থাকা মানুষরা হেসে উঠছে। মেয়েটা তার দুই সহকারীকে ইশারা করল। তারপর দুম করে দরজাটা খুলে দিল।

ভেতরে বিছানায় বসে রয়েছেন মেঘা দেশপান্ডে ও তাঁর কন্যা অশ্লেষা। রাহুল সোজা এগিয়ে গিয়ে পিস্তল তাক করল, ”চুপচাপ যা আছে দিয়ে দাও, না হলে এখুনি গুলি করব।”

অশ্লেষার চোখ দুটো আতঙ্কে বড়ো বড়ো হয়ে গেলেও মেঘা স্থিতি হারালেন না। তিনি ঘরের মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে-থাকা মেয়েটিকে চিনতে পেরেছেন।

অস্ফুটে বললেন, ”নেহা! তুমি?”

দলের পান্ডা নেহার সুন্দর মুখে কোনো ভাবান্তর হল না। বলল, ”ওয়ার্ডরোবের চাবি দিন চুপচাপ।”

মেঘা দেশপান্ডে কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ হয়ে গেলেন। কঠিন পরিস্থিতিতে তিনি বোধবুদ্ধি হারান না। এই মুহূর্তে সবচেয়ে প্রয়োজন তাঁদের তিনজনের বাঁচা। তিনি তো আর জানেন না তাঁর মা ইতিমধ্যেই খুন হয়েছেন।

দ্রুত ঝুঁকে পড়ে খাটের লাগোয়া টিপয় টেবিলের ড্রয়ার থেকে চাবি বের করে দিলেন, ”এই নাও। তোমরা যা পারো, নিয়ে যাও। কিন্তু আমাদের কোনো ক্ষতি কোরো না!”

রাহুল আর মনোজ ক্ষিপ্রগতিতে ওয়ার্ডরোব খোলামাত্র তাদের সামনে কুবেরের ভাণ্ডার উন্মোচিত হয়ে পড়ল। আলমারির ভল্টে থরে থরে সাজানো রয়েছে টাকা আর গয়না।

নেহার মুখে হাজার ওয়াটের আলো জ্বলে উঠল। উফ! কী দারুণ একখানা দাঁও মারতে চলেছে সে। সেদিন শপিং মলে অত দামি গাড়ি থেকে মেঘা দেশপান্ডেকে নামতে দেখেই ও বুঝে ফেলেছিল, মহিলা কোটিপতি।

আর কিছুক্ষণের মধ্যে ও আর রাহুল এরকমই বড়োলোক হয়ে যাবে। স্বপ্নরাজ্যে বিচরণ করতে করতে নেহা দ্রুত বাস্তবে ফিরে এল। দেখল, রাহুল আর মনোজ একটা ব্যাগে টাকা, গয়নাগাটি সব পুরে ফেলেছে।

নেহা সামনে তাকাল। অল্পবয়সি মেয়েটা আতঙ্কে কাঁপছে। কিন্তু মেঘা দেশপান্ডে শান্ত চোখে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছেন।

নেহা ভেতরে ভেতরে সামান্য কুঁকড়ে গেল। ভদ্রমহিলার পেছনে গত কয়েকদিন ধরে ছিনেজোঁকের মতো পড়েছিল ও, ঠিকানা না পাওয়া অবধি হাল ছাড়েনি। কিন্তু উনি এভাবে কী দেখছেন?

মেঘা দেশপান্ডে আবারও স্থিরচোখে বললেন, ”সব নেওয়া হয়ে গেলে তোমরা চলে যাও, কেমন?”

আশ্চর্য! ভদ্রমহিলা এই অবস্থাতেও এত পরিশীলিত কীভাবে? ভাবতে ভাবতে নেহা জিজ্ঞেস করল, ”আ-আপনি পুলিশে খবর দেবেন না তো?”

মেঘা দু-দিকে ঘাড় নাড়লেন, ”না।”

”দিমাগ খারাপ হয়ে গেল নাকি তোমার?” হাতের কাজ চালাতে চালাতে রাহুল ধমকে উঠল নেহাকে, ”আমাদের দেখে ফেলেছে, এখন কেউ জিন্দা ফেলে রেখে যায়? বাইরের বুড়িটার মতো এদেরকেও খতম করে যেতে হবে।”

”কী? আমার মা… আমার মা…!” মেঘা দেশপান্ডের সমস্ত সংযমের বাঁধ ভেঙে গেল। তিনি উদ্ভ্রান্তভাবে বিছানা থেকে লাফিয়ে পড়ে বাইরের ডাইনিং-এর দিকে দৌড়ে বেরোতে লাগলেন।

”দাঁড়াও দাঁড়াও! এক্ষুনি না দাঁড়ালে গুলি করব!” রাহুল পিস্তল উঁচিয়ে মেঘা দেশপান্ডেকে থামাতে গেল, কিন্তু তার আগেই বন্দুকটা কেঁপে উঠল। চোরাবাজার থেকে কেনা সস্তার লোকাল মেড পিস্তল, ট্রিগার জোরে না টিপতেও দুম করে গুলি বেরিয়ে গেছে। আর রাহুলের হাত কাঁপাতে সেই গুলি এসে ঢুকেছে তার নিজেরই পায়ে।

”আ-আ-আহ!” বিকট শব্দ করে রাহুল মাটিতে বসে পড়ল। যন্ত্রণায় তার মুখ বেঁকে যাচ্ছে। অন্যকে গুলি করার সময় সেই যন্ত্রণাটা কেউ অনুভব করতে পারে না। নিজের সময়ে বোঝা যায়।

পরিস্থিতি হঠাৎ করে গোলমেলে হয়ে যেতে নেহা হতবুদ্ধি হয়ে গেল। তারপরেই সে নিজের পোশাকের নীচে লুকিয়ে রাখা চকচকে ছুরিটা বের করে ছুটে গেল।

ততক্ষণে মেঘা প্রচণ্ড জোরে চিৎকার করতে শুরু করেছেন। নেহা উল্কার গতিতে গিয়ে দেওয়ালে ঠেসে ধরল মেঘা দেশপান্ডেকে, নিজের শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে এলোপাথাড়ি ঘুসি লাথি চালাল, তারপর ছুরি দিয়ে সোজা গলার নলিটা ফাঁক করে দিল।

ওদিকে চোখের সামনে মায়ের এই অবস্থা দেখে অশ্লেষাও চিৎকার করছিল। কয়েক সেকেন্ড হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে-থাকা মনোজ ছুটে গেল তার দিকে, যথেচ্ছ ঘুসি লাথি মেরে তাকে অচৈতন্য করে দিল।

মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই মায়ের মতো অশ্লেষারও প্রাণবায়ু বেরিয়ে গেল। রাহুল যন্ত্রণায় কোঁকাচ্ছিল। গোটা শরীরে রক্ত মাখা অবস্থায় নেহা গিয়ে তার প্রেমিককে জড়িয়ে ধরল, ”কষ্ট হচ্ছে, সোনা?”

”হ্যাঁ! কিন্তু আর দেরি করা যাবে না, ডার্লিং! আমাদের এখুনি বেরিয়ে যেতে হবে!”

প্রায় পাঁচ-ছ-লক্ষ টাকার গয়না, দু-তিন লক্ষ নগদ টাকা একটা ব্যাগে পুরে নিয়ে তারা বাথরুমে স্নান করল।

শাওয়ারের নীচে শরীরে লেগে থাকা রক্ত ধুতে ধুতে আনন্দে নেহার চোখ বুজে এল। আর কিছুদিন মাত্র! তারপর নিজেদের বাড়িতেও ওরা এরকমই শাওয়ার লাগাবে।

বাথটাব? হ্যাঁ, সেটাও লাগাবে।

তিনজনে স্নান করে ধোপদুরস্ত হয়ে বেরিয়ে এল। আসার সময় কাপবোর্ডের ওপর রাখা দুটো এ. টি. এম. কার্ড দেখতে পেয়ে নেহা সেগুলোকেও হস্তগত করল। তারপর তিনজন ধীরেসুস্থে বেরিয়ে চলে গেল। কেউ তাদের দেখতে পেল না।

নেহা বার্মা। মাত্র তেইশ বছর বয়সের উঠতি মডেল। ইন্দোর আদালত মহিলা হিসেবে তাকেই প্রথম ফাঁসির সাজা শুনিয়েছিল।

কে এই নেহা? কেনই বা সে মডেলিং ছেড়ে এমন ভয়ংকর খুনে অংশ নিতে গেল? জানতে গেলে পিছিয়ে যেতে হবে আরও বছরখানেক আগে।

উচ্চাকাঙ্ক্ষা ভালো, স্বপ্ন দেখা ভালো, কিন্তু সেই উচ্চাকাঙ্ক্ষায় পরিমিতিবোধ না থাকলে তা সর্বনাশ ডেকে আনে। মফসসল থেকে শহরে আসা নেহারও তা-ই হয়েছিল। নজরকাড়া সুন্দরী হলেও সে ছিল নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়ে। কিছুটা অনীহায়, কিছুটা পারিবারিক পরিস্থিতির চাপে ক্লাস টেন অবধি পড়েই পড়াশুনোয় ইতি টানতে হয়েছে তাকে।

কিন্তু তাতে কী? তার অনেক গুণ। সেলাইয়ের হাত দারুণ, চমৎকার সাজাতেও পারে।

নেহা স্বপ্ন দেখে, সে একদিন বড়োলোক হবে। অনেক বড়োলোক! হবে না-ই বা কেন? তার মতো সুন্দরী কি এই মফসসলে মানায়?

বাড়ির সঙ্গে ঝগড়া করে সে একদিন ইন্দোরে পালিয়ে এল। শুরু হল তার নতুন জীবন। প্রথম কিছুদিন মডেলিং এজেন্সিগুলোয় দৌড়োদৌড়ি করল। পোর্টফোলিয়ো বানাতে হবে শুনে নিজের সঙ্গে আনা সব টাকাপয়সা দিয়ে দামি জামা, জুতো কিনে পোর্টফোলিয়ো বানাল। মনের মধ্যে উত্তেজনা টগবগ করে ফুটছে তার, আর কিছুদিন মাত্র! তারপরই সে র‌্যাম্পে হাঁটবে, এই শহর ঢেকে যাবে তার ছবিতে। এক ঘুপচি লেডিজ হস্টেলের অন্ধকার ঘরে শুয়ে আকাশ পাতাল ভাবে নেহা।

কিন্তু বাস্তব একেবারে অন্য। যে কটা এজেন্সিতে নেহা পোর্টফোলিয়ো জমা দিয়েছিল, ছ-সাত-মাসেও তারা কোনো সন্তোষজনক জবাব দিতে পারল না।

”এতদিন হয়ে গেল, আমি কোনো কল পাচ্ছি না কেন?”

”উই আর ট্রায়িং, ম্যাম!” এজেন্সির রিসেপশনিস্টের রুটিনমাফিক উত্তরে নেহা জ্বলতে জ্বলতে বেরিয়ে এল। এভাবে কী করে চালাবে সে? তাকে যে বড়োলোক হতে হবে। পয়সা কামাতে হবে। অনেক পয়সা!

অতঃপর এই ধরনের শিক্ষা ও রুচি না-থাকা আকাঙ্ক্ষাসর্বস্ব মেয়েদের যা হয়, নেহারও তা-ই হল। নিজের রূপের জালে একেকজন সুন্দর পুরুষকে আকৃষ্ট করে তার সঙ্গে কিছুদিন প্রেম, হোটেলে উদ্দাম যৌনতা চলতে লাগল। তাতে নেহার কোনো সমস্যা নেই। টাকা কামানোর জন্য সে যতদূর হয়, যাবে। তাতে তার কোনো ছুঁতমার্গ নেই।

কিন্তু সমস্যা অন্য জায়গায়। এত কিছু করেও নেহার মন ভরছিল না। এর-তার সঙ্গে প্রেম করে ভালো খাওয়াদাওয়া, জামাকাপড়, দু-দিন এদিক-সেদিক ঘোরা হয় ঠিকই, কিন্তু টাকা আয় হয় না খুব একটা।

হতাশ নেহা একটা বিউটি পার্লারে কাজ নিল। আর সেখানে কাজ করতে করতেই একদিন তার সঙ্গে একটা পার্কে আলাপ হল রাহুলের। রাহুল স্থানীয় এক কারখানায় ওয়েল্ডিং-এর কাজ করে। এক ঝকঝকে বিকেলে রাস্তার ধারে নেহাকে আইসক্রিম খেতে দেখে রাহুল চোখ ফেরাতে পারল না।

প্রথমে নেহা মনে মনে হেসেছিল। হাতি-ঘোড়াদের সঙ্গে প্রেম করে শেষে কি মশার সঙ্গে ও পিরিত করবে নাকি? এত নিচু রুচি নেহা বার্মার নয়।

কিন্তু প্রেমের তো কোনো ফর্মুলা হয় না। মাসখানেক ঘোরা-বেড়ানো, সস্তা হোটেলে রাত কাটানোর পর নেহাও রাহুলের প্রেমে পড়ে গেল।

”আমরা বিয়ে কবে করব, ডার্লিং?” একদিন হোটেলের বিছানায় শুয়ে নেহার চুলে হাত বোলাতে বোলাতে বলল রাহুল।

”এই অবস্থায় বিয়ে করব নাকি? এভাবে আমি সংসার করতে পারব না।” ফুঁসে উঠল নেহা, ”আমার টাকা চাই। অনেক টাকা!”

”কেন, আমার কারখানার মজুরি আর তোমার পার্লারের মাইনেতে তো ভালই চলে যাবে!”

”এই শোনো, তুমি কোনো ভিখিরিকে বিয়ে করছ না, নেহা বার্মাকে বিয়ে করছ, ঠিক আছে?” মুখঝামটা দিল নেহা, ”এরকম গরিব হয়ে আমি বাঁচতে পারব না। তা ছাড়া…!”

”তাছাড়া?”

ঠোঁট কামড়ে ধরল নেহা, ”আমার পার্লারের কাজটা চলে গেছে।”

”সেকী! কেন?” রাহুল ধড়মড় করে উঠে বসল।

”কয়েকটা জিনিস সরিয়েছিলাম, টের পেয়ে গেছে। পুলিশে ফোন করতে যাচ্ছিল, আমি হাতে-পায়ে ধরে…!” কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ঝাঁজিয়ে উঠল নেহা, ”আমার হেয়ার ড্রায়ার, হেয়ার স্ট্রেইটনার বাড়িতে দরকার হয়। আমি আনব না? শালি শয়তান কোথাকার!”

রাহুল চুপ করে থাকে। কী বলা উচিত সে মনস্থির করতে পারে না। দোলাচলে ভুগতে ভুগতে সুন্দরী প্রেমিকাকে সমর্থন করাটাই শেষে সে উচিত বিবেচনা করে।

”ঠিকই তো! বাদ দাও। তোমার কামধান্দার অভাব হবে না মেরি জান!”

নেহা বিরক্ত মুখে বলে, ”আরে এরকম কাম আমার আর ভালো লাগছে না। মোটা দাঁও মারতে হবে, বুঝলে?”

”কীভাবে?”

সেদিন হোটেলে বাকি রাতটা নেহা প্রেমিকের সঙ্গে পরিকল্পনা করে কাটায়। দরজায় দরজায় ঘুরে কসমেটিকস বিক্রির সেলস গার্লের কাজ এখন খুব পাওয়া যাচ্ছে। ও তাতেই ঢুকবে। জাল বিছোবে।

নিজের মুরগি খুঁজে পেতে নেহার খুব বেশি দিন দেরি হয় না। একদিন শপিং মলে দাঁড়িয়ে মহিলাদের প্রসাধনী দ্রব্যের ডেমো দেওয়ার সময় ওর চোখে পড়ে যান মেঘা দেশপান্ডে।

”বাপ রে! কী দামি গাড়ি!”

নেহা মিসেস দেশপান্ডের সামনে গিয়ে আলতো ঝুঁকে অভিবাদন জানায়, ”হ্যালো ম্যাডাম!”

”হ্যালো!” মেঘা দেশপান্ডে ব্যস্ত পায়ে স্টোরে ঢুকতে যাচ্ছিলেন, নেহা বলে, ”একটা খুব ভালো অ্যান্টি রিঙ্কল ক্রিম এনেছে আমাদের কোম্পানি। আপনার স্কিনে ভীষণ ভালো স্যুট করবে। একবার দেখবেন ম্যাম?”

”নো থ্যাঙ্ক ইউ!” মিসেস দেশপান্ডে এগিয়ে গেলেন। তিনি বিদেশি প্রসাধনী ছাড়া কিছু ব্যবহার করেন না।

কিন্তু নেহা হাল ছাড়ার পাত্রী নয়। ক্রমাগত মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে জপিয়ে ফেলল মেঘা দেশপান্ডেকে। তারপর বলল, ”আমাদের কোম্পানি থেকে আপনাদের মতো হাই ভ্যালু কাস্টমারদের জন্য বাড়ি গিয়ে ফ্রি ডেমো দিচ্ছে, ম্যাম। এই সুযোগ প্লিজ ছাড়বেন না। আপনার ঠিকানাটা দেবেন?”

”আমি—আমি তো বাড়িতে সেভাবে থাকি না। আমার মা আর মেয়ে থাকে!” দোনোমনা করে জবাব দেন মেঘা।

চকিতে বিদ্যুতের ঝিলিক খেলে যায় নেহার চোখে, ”কেন ম্যাম, আপনার হাজব্যান্ড?”

”উনি বিদেশে থাকেন!”

”কোনো ব্যাপার নয়, ম্যাম! আমরা ছুটির দিন যাব। কাইন্ডলি আপনার অ্যাড্রেসটা!”

নেহা ছুটতে ছুটতে বাড়িতে আসে। রাহুলের সঙ্গে গোটা পরিকল্পনা ছকে নেয়। কাজের সুবিধার জন্য রাহুল নিজের আরেক বন্ধু মনোজকে সঙ্গে নেয়। তারপর কী হয়, সেটা তো আগেই বলেছি।

পুরোপুরি অনভিজ্ঞ হয়ে তিন-তিনখানা খুন, অত বড়ো ডাকাতি করেও নেহা, রাহুল, মনোজ কোনো ভুল করেনি। শুধু গণ্ডগোল পাকায় রাহুলের পায়ের গুলিটা। রাত বাড়তে থাকে। রাহুলের মুখ যন্ত্রণায় বেঁকে যায়।

এত আনন্দের দিন, কিন্তু নেহার চোখ দিয়ে জল পড়ছে দরদর করে। রাহুলকে ও সত্যিই ভালোবাসে। টাকা-গয়নার ব্যাগ সরিয়ে রেখে ও ভাবতে থাকে, কী করা যায়।কোনো সরকারি হাসপাতাল বা ডাক্তারের কাছে যাওয়া যাবে না, তাহলেই ধরা পড়ে যাবে। তাহলে?

ভাবতে ভাবতে হঠাৎ নেহার মনে পড়ে যায় পাড়ার এক হাতুড়ে আয়ুর্বেদিক ডাক্তারের কথা। কেউ একজন অচেনা লোক রাতের অন্ধকারে গুলি ছুঁড়েছে এইসব স্তোকবাক্য দিয়ে সেই ডাক্তারকে ভোলায় নেহা।

কিন্তু সেই ডাক্তার ক্ষত দেখে চমকে ওঠে, ”এ আমি বের করতে পারব না। অনেক ডিপে ঢুকেছে গুলি। অপারেশন করে বের করতে হবে। না হলে সেপটিক হয়ে যাবে!”

অগত্যা কোনো উপায়ান্তর না দেখে নেহা রাহুলকে নিয়ে ছোটে এক বেসরকারি নার্সিং হোমে। সেখানে বের করা হয় গুলি।

ওদিকে মেঘা দেশপান্ডের এক প্রতিবেশী দরজার নীচ দিয়ে রক্ত বেরোতে দেখে খবর দেন পুলিশে। ইন্দোর পুলিশ এসে দরজা খুলে ভেতরে বীভৎস দৃশ্য দেখে চমকে ওঠে।

দিনেদুপুরে শ্রীনগর এলাকার মতো জায়গায় তিন-তিনজনকে বাড়িতে খুনের মতো ঘটনায় গোটা শহরে হইচই পড়ে যায়। সিকিউরিটি ক্যামেরা নেই, কোনো প্রত্যক্ষদর্শী নেই, রক্তের স্যাম্পল, ফিঙ্গারপ্রিন্ট—সব কালেক্ট করেও পুলিশ কোনো ক্লু পায় না।

ওদিকে বিধ্বস্ত নিরঞ্জন দেশপান্ডে দেশে ফিরে এসেছেন। তাঁর প্রভাব-প্রতিপত্তিতে টলে যাচ্ছে ইন্দোর রাজ্যের মন্ত্রীসভাও। রাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রবল চাপাচাপিতে পুলিশের বড়োকর্তা বিশেষ টিম গঠন করলেন। তাও কোনো কিনারা পাওয়া যাচ্ছে না। বন্দুক থেকে দুটো গুলি বেরিয়েছে, পাওয়া যাচ্ছে না দ্বিতীয় গুলিটাও।

হঠাৎ ইনভেস্টিগেশন অফিসারের মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে যায়। তিনি আদেশ দেন, ”শহরের সব ছোটো-বড়ো নার্সিং হোম ট্র্যাক করো। গত কয়েকদিনে কি কেউ গুলি বের করতে ভরতি হয়েছিল?”

অবশেষে খুনিরা ধরা পড়ে। রাহুলের নামে পুলিশের খাতায় আগেও ক্রাইম রেকর্ড ছিল, মিলে যায় ফিঙ্গারপ্রিন্ট থেকে রক্তের নমুনাও। নেহা, রাহুল আর মনোজ যত সতর্কতার সঙ্গেই কাজ সারুক, শেষরক্ষা হয় না। টাকাপয়সা, গয়না সব মেলে নেহার বাড়িতে।

সুন্দরী নেহা বার্মার মতো খুনির ধরা পড়ার সংবাদে গোটা শহরে আলোড়ন পড়ে যায়। পুলিশ ৫৮ পাতার চার্জশিটে আদালতকে জানায়, তিন প্রজন্মের তিন মহিলার সারল্যের সুযোগ নিয়ে বাড়ি ঢুকে ডাকাতি ও খুন করেছে ওই তিনজন।

সব খতিয়ে দেখে ২০১৩ সালের ১৩ ডিসেম্বর বিচারপতি ডি. এন. মিশ্র ‘‘rarest of the rare case’’ ঘোষণা করে তিনজনকেই ফাঁসির আদেশ দেন। পরে সেই সাজা বদলে যায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে।

আদালতে নেহা বার্মার ট্রায়াল চলার সময় ভিড় উপচে পড়ত। রাহুল বা মনোজের মতো ছেলেছোকরা ঠিক আছে, কিন্তু নেহার মতো একজন ধোপদুরস্ত সুন্দরী তেইশ বছরের যুবতি যে এভাবে তিনজনের প্রাণ নিতে পারে, তা যেন বিশ্বাস করতে পারছিল না কেউ!

চমকের আরও বাকি আছে। জেলে থাকার সময় নেহা বার্মা জারদৌসি শাড়ির কাজ শিখে আরও অনেক মহিলা বন্দিকে স্বনির্ভর করার জন্য বছর দুয়েক পর জাতীয় পুরষ্কার পায়। এছাড়া সে জেলে সবাইকে বিউটি টিপস দিত, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে শেখাত। সে হল দেশের আটজন মহিলা বন্দির মধ্যে একজন, যে জাতীয় স্তরে পুরস্কৃত হয়েছে।

তার সেই প্রেমিক রাহুল কোথায়? কে জানে!

প্রতিভা থাকলে সেটা ভালোদিকে লাগানোও বড়ো জরুরি হয়ে পড়ে! না হলেই সর্বনাশ! আকাঙ্ক্ষা হোক বা লোভ, কোনো কিছুই যে মাত্রাহীন হওয়া ভালো নয়, তা নেহার মতো মেয়েরা বারে বারে আমাদের বুঝিয়ে দিয়ে যায়।

***

অধ্যায় ৩ / ৩

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন