ভগবানের সাথে কিছুক্ষণ – ৫

কৃষণ চন্দর

পাঁচ

রাতে খোলার ঝুপড়িতে চাটাই বিছিয়ে আমরা দু’জন পাশাপাশি শুয়েছিলাম। শোবার পূর্বক্ষণে আমরা আমাদের পুরনো বেশে ফিরে এলাম। মনেই হবে না যে, কিছুক্ষণ আগে আমরা দুটো নধরকান্তি বালকের বেশে ছিলাম। ভগবান দুটো হাতের অঞ্জলি রচনা করে তার উপর শুলো। আমি গায়ের পুরনো ছেঁড়া জামাটা খুলে দূরে ছুঁড়ে মারলাম। ভীষণ গুমট লাগছিল।

ভগবান বলল, ‘ভীষণ গরম তো। তোমাদের এসব ঝুপড়িতে ইলেক্ট্রিকের ব্যবস্থা নেই?’

আমি বানিয়ে বললাম, ‘ইলেকট্রিক ছিল বই কি। মাস তিনেক ভাড়া বাকী পড়েছিল, তাই লাইন কেটে দিল। তারপর থেকে অন্ধকারেই দিন কাটাচ্ছি।’

‘সত্যি, ফ্যান না হলে যা অসুবিধা। বড্ড গরম লাগছে আমার। স্বর্গে থাকতে থাকতে অভ্যেসটা একেবারে যা তা হয়ে গেছে। একটু অসুবিধা হলেই বিতিকিচ্ছা লাগে।’

‘যদি বলো একটা কথা জিজ্ঞেস করি ভগবান।’

‘বলো।’

‘স্বর্গ বলতে কোন কিছু আছে কি?’

‘আছে।’

‘নরক?’

‘নরকও আছে।’

‘পাপ?’

‘আছে।’

‘পূণ্য?’

‘তাও।’

‘পাপের জন্যে শাস্তি, পূণ্যের স্বর্গ?’

‘হাঁ।’

‘সত্যি, তুমি পাপীদের শাস্তি দাও?’

‘দেই বই কি।’

‘অথচ আমি বলি পাপীদের স্বর্গের প্রয়োজন সবচাইতে বেশী। পাপি -যাদের মন পাপাচারে অন্ধকার ছিল, যাদের হাত ছিল রক্তাক্ত, যাদের দৃষ্টিতে নিষ্ঠুরতা উপচে পড়তো, যারা প্রতি পদে পদে পৃথিবীতে বাধা প্রাপ্ত হতো। আমি বলি, স্বর্গের প্রয়োজনটা তাদেরই সবচাইতে বেশী। কেননা, যেখানে অন্ধকার সেখানেই না আলো পৌঁছে দেবার প্রয়োজন। পাপাচারে যাদের হাত রক্তাক্ত, শুধু মাত্র তাদের জন্যেই ক্ষমা থাকা উচিত। কিন্তু তা না করে এমন বিধান কেন রেখেছ? যারা ‘প্রথম থেকেই পূত-পবিত্র, যাদের প্রাণে পাপজনিত কোন অশান্তি ছিল না, তাদেরকেই বেছে বেছে শান্তির পারাবার স্বর্গে পাঠাচ্ছ। আর যারা সারা জীবন পাপাচারে বিদগ্ধ, পরকালে তাদেরকে পাঠাচ্ছ নরকে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, তুমি স্বর্গকে স্বর্গে পাঠাচ্ছ, আর নরককে নরকে পাঠাচ্ছ। আসলে এসব করার পেছনে তোমার উদ্দেশ্যটা কি শুনি?’

‘তা না করে আমি কি করব? আমার জায়গায় তুমি হলে কি করতে? তোমার কি ইচ্ছে?’

‘আমার মতে, তুমি কখনো কখনো পাপী লোকদেরকেও এক আধবার স্বর্গে জায়গা দিও। পক্ষান্তরে, ভাল লোকদেরকেও নরকের শাস্তি ভোগ করতে দিও। পেত্যেক লকেরই এটা জানা উচিত -সে কি হারিয়েছে। যে পাপে ক্ষমা নেই এবং যে পূণ্যে বেদনা নাই, তার মহাত্ম্য কোথায়?’

‘তার মানে তুমি বলতে চাচ্ছ, বিনা ক্লেশেই এসব কুঁড়েঘরে বিজলী বাতি আসুক! কিন্তু মিষ্টার, মানুষকে পরিশ্রম করতে হবে। নিজের বুদ্ধিবৃত্তি কাজে লাগাতে হবে। আমি তো তাদেরকে জন্ম দিয়েই ক্ষান্ত। ভালমন্দ সবকিছু তাদের প্রয়াসের উপর নির্ভরশীল। মানুষ চেষ্টা করেই তার ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারবে।’

‘ললাটের লিখন মানুষ চেষ্টাকরে কেমন করে খন্ডাবে?’

‘পারবে। পারবে বলেই তো এই গুরুদায়িত্ব মানুষকে দেয়া হয়েছে, দেবতাদেরকে দেয়া হয়নি।’

এরপর বেশ কিছুক্ষণ নীরবতা। চারিদিক নিথর। আমার চোখ ঘুমে ঢুল ঢুল। ভগবানের কতগুলো অস্ফুট-কথা আমার কানে ভেসে ভেসে আসছিল।

ভগবান বলছিল, ‘কিন্তু এই পাপ-পূণ্য, সাজা-পুরস্কার –এসবের উর্দ্ধে রয়েছে জন্ম এবং মৃত্যুর পরিক্রমা। জন্ম এবং মৃত্যু, কারো সাধ্য নেই একে নিয়ন্ত্রণ করে। ঠিক এই মুহুর্তে সৌরজগতে একটি তারকা উল্কা হয়ে ফেটে পড়ছে মর্তের মাটিতে। কি অভিনব তার নিমজ্জন। মৃত্যুর পূর্বক্ষণে সে হাসতো খেলতো। আশায় পরিপূর্ণ ছিল তার প্রতিটি মুহুর্ত। হাসি কান্না, দূঃখ বেদনা মিশ্রিত জীবনের এই কি পরিসমাপ্তি…….ঠিক একই সময়ে বিশ্বব্রহ্মান্ডের অপর প্রান্ত থেকে সম্পূর্ণ নতুন এক তারকা কি অপরাধ করেছিল যে, তাকে মৃত্যুবরণ করতে হলো এবং নবজাত তারকা এমন কি পূণ্য করছিল যে, এই মুক্ত আলো-বাতাস আর নীলাভ আকাশের উন্মুক্ত অঙ্গনে তার জন্ম হল? তাই আমাকে অযথা পাপ-পূণ্য স্বর্গ-নরক আলো-আঁধারকে একত্রিত করে একটি অস্তিত্বের ঘোষণা করেছি, সে হলো মানুষ। এখন আমি মানুষের পাপ-পুণ্যের আলাদা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে চাই না। ওসব তোমাদের মাথাব্যথা, তোমরা ওসব নিয়ে ভাবো।’

ভগবানের সে অস্ফুট আওয়াজ আমার কানে ভেসে আসছিল। ভেসে আসছিল দূর দূরান্তের পাহাড় পর্বত উপত্যকা থেকে। আমি আধো ঘুমে আধো জাগরণে ঝিমুচ্ছিলাম। হঠাৎই আমার মনে হলো কে যেন আমার পা চাপড়ে দিয়েছে। আমি ধরমড় করে উঠে বসলাম। ভগবান বলল, ‘হতভাগা, এত সকালেই ঘুম আসছে তোর? এখন তো সবে রাত শুরু হলো।’

আমি ভ্যাবাচেকা খেয়ে বললাম, ‘তুমিতো ভগবান, তোমার কি? ঘুম নিদ্রা বলে তো তোমার কিছুই নেই। কিন্তু আমি মানুষ বেচারীর তো ঘুম না গেলে চলবে না। সারা দিনের পরিশ্রান্ত, ক্লান্ত। আর শোনো, ওসব দুস্তি ইয়ার্কী আমার ধাতে সয় না। শোন, বঞ্চিত, হতভাগ্য এসব কথা শুনতে আমার খুব খারাপ লাগে। তোমার সাথে আমার দুস্তি খাটে? তুমি হলে গিয়ে ভগবান। তোমার সাথে আমার পাল্লা দেয়া চাট্টিখানি কথা নয়। অতএব, মাফ করো, আমাকে একটু ঘুমতে দাও এই মুহুর্তে।’

বলেই আমি পাশ ফিরে শু’লাম। ভগবান আবারও তেমনি অস্ফুট স্বরে বলতে লাগলো, ‘হায়, আমিই বা কি ধরনের জীবন গ্রহণ করলাম, একেবারে একা নিঃসঙ্গ। সবাই আমার পূজারী, আমার বন্ধু কেউ নয়। কারো পিঠ চাপাড়ে শালা হতভাগা বলে একটা কথা বলতে পারি না। সারা সৃষ্টি জগতে এমন একজনও নেই যে আমাকে বন্ধু ভেবে দুটো গালি দেবে। হায়, দুঃসহ নিঃসঙ্গতা……।’

জানি না এমন কতক্ষণ সে স্বগতোক্তি করেছিল আপন মনে। আমি তার এমন দুর্বোধ্য কথা-বার্তায় কান না দিয়ে বরং নাক ডেকে ঘুমাতে লাগলাম। আমার যখন ঘুম ভাঙ্গল, সকাল হয়ে গেছে। ঝুপড়ির বেড়ায় কঞ্চির ফাঁক দিয়ে লম্বমান একটা আলোকরশ্মি তীরের মতো এসে পড়েছে ছোট পরিসরে। আমি ধড়মড় করে উঠে বসলাম। চেয়ে দেখি, আমার পাশের চাটাইতে ভগবান নেই –একটা বছর আটেকের নাদুস নুদুস ছেলে অঘোরে ঘুমাচ্ছে। কত সুন্দর তার ত্বক, কত সুন্দর তার চোখের পালক, কত মসৃণ তার ললাট। শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে সাথে তার ছোট দেহটা মৃদু মৃদু দুলছিল।

এই ধরণীর শিশুদের দেখতে এসে ভগবানের পরদিনও কেটে গেল বোম্বেতে। আজ আমি মনোহর নামে একটা গুজরাটি ছেলের সাথে তার পরিচয় করিয়ে দিলাম। মনোহরের কাঠির মতো ছিল দেহখানি। কিন্তু কথায় ভীষণ তেজ ছিল। ক্ষুধার্ত চোখ দুটো তার সারাক্ষণ ধিকি ধিকি জ্বলছে। চোখে-মুখে সব সময় যেন একটা শিকারের অন্বেষা। দরজায় টোকা দিয়ে যখন সে আমাদের ঝুপড়ির ভেতরে ঢুকে পড়ল এবং চাটাইতে দুটি সমবয়েসী শিশুকে দেখতে পেল, অনেকটা হোঁচট খাবার মতো সে আমতা আমতা করে বলল, ‘এ ছেলে, তোমার শেঠ কোথায়? আমাকে ইঙ্গিত করে বলল। আমাকে সে মোটেই চিনতে পারল না। কেন না, আমিও শিশুর বেশ ধারণ করেছি।’

আমি বললাম, ‘শেঠ তো বাইরে।’

মনোহর আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তুমি শেঠের ছেলে মনে হচ্ছে?’

আমি মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানালাম। মনোহর এবার ভগবানের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘ও কে?’

‘ও একটি ছেলে, আমার সাথে আছে।’

মনোহর চুপসে গেল। কিছুক্ষণ আমার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল। তার পর বলল, ‘শোনো, শেঠকে বলো তার লটারীতে চৌকা এসেছে। টাকা ন’টা আমার কাছে, সন্ধ্যার দিকে এসে দিয়ে যাবো।’ বলেই আমার আপাদমস্তকটা একবার দেখে নিয়ে বলল, ‘ধরবে নাকি তুমিও? বড় মজার লটারী।’

‘হ্যাঁ।’ আমি সম্মতি দিলাম।

‘কিসে ধরবে?’

‘তিন থেকে পাঞ্জা।’

‘কতো ধরবে?’

‘দু’ আনার।’

বলতেই মনোহর একটা কাগজের টুকরা বের করে তাতে তা নোট করে নিল। আমি ভগবানের কাছ থেকে দু’আনা ধার নিয়ে তাকে দিলাম। মনোহর ভগবানের এদিকে একবার তাকাল। তারপর আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘এ ছাড়াও খেলবে নাকি?’

‘কিসের খেলা?’ ভগবান প্রশ্ন করল।

‘লটারী।’ মনোহর বলল।

‘সেটা আবার কি ধরনেরর খেলা?’

মনোহর তার দিকে তাচ্ছিল্য ভরে তাকাল। আমি তাকে বললাম, ‘ও কালই গ্রাম থেকে এসেছে কিনা।’

মনোহর ভগবানের কাছ ঘেঁষে বসে পড়ল। এবং তাকে বুঝাতে শুরু করল, ‘লটারীতে ছটা নম্বর হয়ে থাকে। ওপেন’টু ক্লোজ ধরা যায়। ওপেনও ধরা যায়। সন্ধ্যার দিকে যখন লটারী খোলা হবে তোমার নাম্বার যদি আসে, তাহলে তুমি টাকা প্রতি ন’টাকা পেয়ে যাবে।’

‘এক টাকার বদলে ন’টাকা?’ ভগবান বিস্মিয় প্রকাশ করে।

‘হ্যা।’

‘কিন্তু এক পাপের বদলে একই পাপ, এক পূণ্যের বদলে একই পূণ্য হয়ে থাকে, কিন্তু……’

‘এসব পাপ-পূণ্য কি বলছে ছেলেটি?’

মনোহর জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো। আমি চট করে বললাম, ‘গ্রাম থেকে এসেছে তো, এসব ওদিককার হিসেব।’

‘আচ্ছা বুঝেছি। তো যা বলছিলাম, একের বদলে পাবে নয়। আর যদি না পাও, তাহলে মাত্র এক টাকাই গচ্চা যাবে।’

‘বেশ তো মজার খেলা তাহলে এটা।’ বলেই ভগবান উৎফুল্ল হয়ে উঠল।

‘নাও, তাহলে এক্ষুণি আমি চার আনা ধরলাম।’

‘নাও, তাহলে তাড়াতাড়ি ধর। আমার আবার হাতে সময় কম।’

‘সময়ের কি কোন শেষ আছে?’ ভগবান বলল।

মনোহর বলল, ‘তোমার বন্ধুটি কিসব আজব ধরনের কথাবার্তা বলছে। সময়ের শেষ নেই মানে?’

‘তুমি কোন স্কুলে পড়?’

‘স্কুল? কিসের স্কুল? বি.এ. পাশ করে কত লোক ঘোড়ার ঘাস কাটে। কত লোক পোষ্টাফিসের বাইরে বসে মানুষের চিঠি লিখে রোজ দশ আনার বেশী কামাতে পারে না। অথচ আমি এই করে ভগবানের ইচ্ছায় দশ টাকা কামিয়ে থাকি। তাই পড়াশুনা করে কি হবে শুনি। যাক, লটারী খেলবে ত, ঝটপট কর, নয়তো আমি চললাম। আমার ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে।’

মনোহর চলে গেলে ভগবান বলল, ‘এই ছোকড়া লটারীর ধান্দা করছে। বার বছর বয়স হয়েছে, অথচ পড়াশুনার নামটি নেই। এসব লটারী তো আসলে জুয়া খেলা।’

‘বোম্বাই শহরের তিন-চতুর্থাংশ নাগরিক জুয়া খেলে থাকে। খেলায় জিতার আশা নিয়ে সকালকে সন্ধ্যা করে। শুধু আশার ছলনে ভুলি। তুমি কি এই আশার আনন্দটুকু তার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে চাও?’

‘কিন্তু ওতো এখনো ছোট মানুষ। ওর অনাগত জীবনের সকল আশা ভরসা এভাবে বিনষ্ট হবে কেন?’

‘বোম্বাইতে হাজার হাজার শিশু এ করেই দিনাতিপাত করছে। রাস্তাঘাট, ষ্টেশন, বাজার, অলি-গলি –সর্বত্রই এরা বিচরণ করছে। যেখানেই যাবে এদের দেখা পাবে।’

‘ওপেন টু ক্লোজ –মনোহর লটারীর ওপেন টু ক্লোজ অবধি ন’টাকা দিয়ে থাকে। কিন্তু তোমরা ওপেন টু ক্লোজ –মানে জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি কি নিয়ে থাক? মারামারি, কাটাকাটি, বেকারত্ব, দারিদ্র্য এবং হানাহানি নিয়েই তো তোমাদের জীবন।’

আমি একটু উত্তেজিত হয়ে বললাম, ‘বুঝেছি, তোমার মেজাজটা ঠিক নেই। চলো বেরিয়ে পড়ি।’

‘চলো।’ তারপর দিকচক্রবালের দিকে তাকিয়ে ভগবান বলল, ‘আমি আজ সন্ধ্যার দিকেই স্বর্গে চলে যাব ভাবছি।’

ছয়

মহম এলাকায় খৃষ্টান ছেলেপিলেদের জমজমাট মেলা বসেছিল। সেন্ট এন্ড রিজ চার্চের প্রশস্ত প্রাঙ্গণ লোকে লোকারণ্য। রং-বেরং ফুলের সাজ চারিদিকে। প্রাঙ্গণের এককোণে রয়েছে মাতা মেরীর আবক্ষ প্রস্তর মূর্তি। লোকেরা গড় হয়ে প্রণাম করছিলো একে একে। রং-বেরং-এর কাপড় পরিহিত ছেলে, বুড়ো এবং মহিলারা গির্জার ভেতরে যেয়ে মোম জ্বেলে আসছিল দলে দলে।

গির্জার কম্পাউন্ডের বাইরে ছেলে-বুড়ো সবাই চড়ক গাছে চড়ে আনন্দ উপভোগ করছিল। নানাবর্ণের যীশু খ্রীষ্টের ছবি বেচাকেনা চলছিলো। গিল্টি করা সোনার সুদৃশ্য পুতুল, আমেরিকানদের তৈরী পাতলুন এবং অন্যান্য পরিচ্ছদের নকশী বোতাম, চকলেট, মিষ্টি, লিপষ্টিক, কাগজের ফুল, রেশমী রুমাল ইত্যাদিও বিক্রি হচ্ছিল। মোটকথা চারিদিকে বেশ মনোমুগ্ধকর মেলা চলছিল। আনন্দ উচ্ছ্বাস আর হৈ-হুল্লোড়ে রীতিমত কানে তালা লাগার যোগাড়।

ভগবান একটা উল্লেখযোগ্য ব্যবধান রেখে এই মেলা অবলোকন করছিল। বহুক্ষণ ধরে এই রকমারী মেলা খুঁটে খুঁটে দেখছিল সে। সুন্দর সুন্দর ফুটফুটে শিশু, সুসজ্জিত পোশাক-আশাক আর মেলার রং-বেরং-এর আয়োজন দেখে ভগবানের মনটাও বেশ লাগছিল। বাহ্‌! কি সুন্দর শিশুরা আর ওদের মা-বাপ ভাই-বোনেরাও কত সুন্দর দেখতে। বেশ লাগছে। বিশ্বের সকল শিশুদেরই এমন হওয়া চাই। পুরো দুনিয়াটাই এই শিশুদের মতো হাস্যোজ্জল হবে। এইটেই আমি চাই।

আমার বড্ড ক্ষুধা পেয়েছিল। আমি গট গট করে চার প্লেট পানি পুরি গলধঃকরণ করলাম। এর আগে ক’টা চকলেটও খেয়েছি। দু’পকেটে প্রচুর মিষ্টি ভরে নিয়ে ভগবানের এসব দার্শনিক উক্তিগুলো হাসিমুখে শুনছিলাম। মাঝখানে আমি ফোড়ন কেটে বললাম, ‘এই জগতে জীবনের যে দর্শন তুমি পেশ করছ ছ’সাত বছরের শিশুদের থেকেই তুমি তা কেমন করে আশা করো? জানি না, তুমি কোন্‌ দুনিয়ার কথা বলছ?

ভগবান অশ্রু ছল ছল চোখে তার সামনের অগনিত শুচিশুভ্র শিশুদের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এমন শুচিশুভ্র সুন্দর আর সুসভ্য পরিবারের শিশুদের দেখার জন্যেই তো আমি স্বর্গ থেকে এসেছিলাম। এ রকম শিশুদেরকেই আমি দু’চোখ ভরে দেখবো, এই ছিল আমার কামনা।’

আমি বললাম, ‘তাহলে তোমার ইস্পিত শিশুদের পেয়ে গেছ। দু’চোখ ভরে দেখেও নিয়েছ তাদের। এবার স্বস্তির নিঃশ্বাস টেনে তুমি স্বর্গের দিকে রওনা দিতে পারো।’

‘তা পারি বৈকি।’

‘তা হ’লে চলো এবার আমরা ফিরে চলি। মনের ইচ্ছা পূরণ হয়ে গেছে। এবার স্বর্গে যেয়ে তুমি ইচ্ছা মতো একটা চমকপ্রদ রিপোর্ট পেশ করতে পারবে।’

‘তাতো বটে। আমি আশা করছি, আজ সন্ধ্যেতেই স্বর্গে রওনা হয়ে যাবো।’

সুশ্রী ও সুসজ্জিত শিশুদের উপর আর একবার নজর বুলিয়ে নিয়ে ভগবান বললো, ‘তা’হলে চলো, মহমের বাস ষ্ট্যান্ডে যেয়ে তোমাকে বাসে তুলে দেই। তোমার পাড়ি তো বেশ লম্বা।’

‘আচ্ছা চলো।’ বলেই আমরা দু’জন কম্পাউন্ডের বাইরে চলে এলাম।

বাইরে আসতেই সামনে পড়লো মোমবাতি বিক্রেতা একটা ছোট ছেলে। আমাদের দেখেই ছেলেটা পিছু নিল এবং বলতে লাগলো, ‘আমি এতিম ছেলে…নেহাত এতিম…তিন আনায় দু’টো মোমবাতি বিক্রি করি। দয়া করে দু’টো মোমবাতি নিয়ে যাও। ক্রাইষ্ট তোমাদের মঙ্গল করবে…মাত্র তিন আনা…মাদার ফাদার ডেড…দয়া করে নিয়ে যাও।’

ছেলেটি আমাদের পিছে পিছে অনেকদূর এলো। ভগবান তার কথা শুনে প্রথমটায় গলে গিয়েছিল। হাত বাড়িয়ে দু’টো মোমবাতি নিতেও যাচ্ছিল। কিন্তু আমি বাধা দেওয়াতে আর নিলো না। কিন্তু দূর থেকে তার শান্ত স্নিগ্ধ স্বর ভেসে আসছিল। আর আকুলি বিকুলি শুনে আমার মনটাও গলে গেল। আমি বললাম, ‘নিয়েই নাও দু’টো মোমবাতি। মাত্র তিন আনার ব্যাপার। সারাক্ষণ ঘ্যান ঘ্যান প্যান প্যান আর ভালো লাগে না।

ভগবান স্মিত হেসে আমার দিকে তাকালো।

পকেট থেকে তিন আনা বের করে ছেলেটিকে দিলো এবং দুটো মোম নিয়ে নিল।

ছেলেটি বলল, ‘ক্রাইষ্ট, সেভ ইওর সোল।’

ছেলেটি তিন আনার বদলে মোফতে দু’টো দোয়াও করল। – ‘গড ব্লেস ইউ।’

পুওর অরফান, মাদার ফাদার ডেড – তিন আনার দুটো দোয়া।

আমরা পায় পায় কিছুদূর এগিয়ে এলাম। চলতে চলতে আমি ভগবানকে বললাম, ‘ক্রাইষ্ট, সেভ ইওর সোল। তোমার কোন সোল আছে, কোন আত্মা?’

‘আমার আবার কিসের আত্মা? দুঃখ-সুখ বলতে যার কিছু নেই, তার আত্মা থাকবে কোত্থেকে? আত্মা তো আমি তাদের দিয়েছি যারা দুঃখ-সুখ, হাসি-আনন্দ বহন করে চলে।’

‘আচ্ছা ভগবান, স্বাদ, আয়ু এবং অনুভূতি – এগুলো আসলে কি?’

‘শুধু একটা খেয়াল, একটা অনুভূতি ছাড়া আর কিছু নয়।’

‘লোকেরা তা’হলে কি শুধু একটা খেয়ালের বশে মোমবাতি জ্বালিয়ে থাকে?’

মোমবাতি কেন, একটা খেয়ালের বশে সারা জীবনটাই তো সে প্রজ্জলিত করে রাখে।’

‘তা তুমিই ভালোজানো।’ আমি বললাম।

ভগবান বলল, ‘একটা খেয়াল ছাড়া আর কি? একটা খেয়াকের জন্যেই তো মানুষকে কাঠের সাথে বেঁধে আগুন দিয়ে পোড়ায়, গভীর কবর খনন করে দেহটাকে পুঁতে দেয়, রেশমী দড়ি লাগিয়ে প্রাণবায়ু নির্গত করে, ক্রুশ বিদ্ধ করে মারে। কিন্তু তারপরও তো খেয়ালের শেষ নেই।’

সাত

পায় পায় আমরা বান্দ্রার বাস ষ্ট্যান্ডে এসে দাঁড়ালাম। আমি আর কিছু ভাবতে পারছিলাম না। ভাবতে ভাবতে আমার মাথা ভোঁ ভোঁ করছিল। মনে হচ্ছিল আরো যদি ভাবতে যাই, পাছে দেহটা এখানে থেকে যাবে, আর আমি উড়ে যাবো নিসীম দিগন্তে। অতএব এসব রেখে বাসে উঠে বসাই শ্রেয় মনে করলাম আমরা দু’জনে। ডবল ডেকার বাস ছিল সেটা। আমরা সরাসরি দোতলায় যেয়ে বসলাম। উপরে বেশ বাতাস লাগছিল। উপর থেকে চারদিকের দৃশ্যও বেশ ছবির মতো মনে হচ্ছিল। আমরা দু’জন পাশাপাশি ঘে’সে বসলাম। আমাদের ডানদিকের সিটে একটি স্কুলগামী সুদর্শন এবং ভাল পোশাক-আশাক পরা ছেলে বসেছিল। কাঁধে ঝুলানো তার চামড়ার ব্যাগে এক গাদা বই রয়েছে। বাঁ হাতে একটা ছোট নোট বুক খাতা রয়েছে। বুক পকেটে একটা ফাউন্টেন পেন রয়েছে। ছেলেটির আপাদমস্তক ইউনিফরম ছিল সাদা ধবধবে। বড্ড ভালো লাগছিল ছেলেটিকে আমার। আমরা বারবার ছেলেটির দিকে সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিলাম, কিন্তু ছেলেটি আমাদের দিকে কোন ভ্রক্ষেপ করলো না।

ইতিমধ্যে টিকিটের তাড়া এলো। ভগবান টিকেট কেনার জন্যে পকেটে হাত দিল। কিন্তু পকেটে হাত দিয়ে ভাগবান একেবারে ‘থ’ বনে গেল। চোখ ছানাবড়া। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কি হয়েছে?’

জবাব দিল, ‘আমার পকেট সাফ।‘

‘কখন নিলো?’

‘তা কেমন করে বলব?’

মানিব্যাগের বদলে ভগবানের হাতে একটা সাদা মোমবাতি। মোমবাতি দেখিয়ে ভগবান বলল, ‘সেই চার্চের ছেলেটির কাছ থেকে মোমবাতি কেনার সময় পর্যন্ত ত আমার মানিব্যাগ ঠিকঠাক ছিল। তারপর আমরা বাস ষ্ট্যান্ডে এসে দাঁড়ালাম। বাস ষ্ট্যান্ড পর্যন্ত তো আমাদের সাথে তৃতীয় কোন ব্যক্তির যোগযোগ হয়নি। মনে হচ্ছে এই কেরামতি সেই গরীব ছেলেটির…যে নিজেকে পুওর অরফান বলে চেচাচ্ছিল…মাদার ফাদার ডেড…’ আমি জোরে জোরে হাসছিলাম।

‘অথচ অশ্রুসিক্ত সেই ছেলেটিকে কত নিষ্পাপ এবং ভালো মনে হচ্ছিল।‘

ভগবান চরম বিষ্ময় প্রকাশ করে আবার বলল, ‘হাঁ, চোখে জল ছিল আর হাতে ছিল কাঁচি।’

কন্ডাক্টর হাকল, ‘পয়সা বের করো।’

ভগবান মোমবাতিটা এগিয়ে দিয়ে বিনীতভাবে বলল, ‘এটা নিয়ে নাও। এটা জ্বালালে তোমার আত্মা শান্তি পাবে। গীর্জা থেকে এনেছি।’

কন্ডাক্টর বিরক্তি প্রকাশ করে বলল, ‘আত্মা শান্তি পাবে, কিন্তু চাকুরী তো চলে যাবে। জলদি জলদি পয়সা বের করো।’

‘আমার কাছে তো পয়সা নেই। দয়া করে এমনি দুটো টিকিট দাও। আমি তোমাকে দোয়া করব। গড ব্লেস ইউ।’ ভগবান বিনয় প্রকাশ করে আবার বলল।

কন্ডাক্টর বলল, ‘আবে ছোকড়া, আমার সাথে তামাসা হচ্ছে বুঝি? এক্ষুনি নিচে নামিয়ে পুলিশে দিয়ে দেব। পয়সা বের কর্‌। সাথে সাথে তুইওবার হ বাস থেকে।’ বলেই বাস কন্ডাক্টর এবার আমাকে ধরল।

আমি মুখ কাচুমাচু করে বললাম, ‘আমার পয়সাও ওর কাছে ছিল। পকেট মার হয়ে গেছে, আমি কি করব?’

বাস কন্ডাক্টর চরম বিরক্তি প্রকাশ করে ঘন্টা বাজাল। বাস আস্তে আস্তে থামতে লাগল। বাস থামতে দেখে পাশের সাদা ইউনিফরম পরা ছেলেতি মুচকি হেসে বলল, ‘তোমরা, দু’জন

কোথায় যাবে?’

আমি বললাম, বাইকাল্লা ষ্ট্রিট।’

ছেলেটি বলল, ‘আমিও ওখানেই নামবো। চলো আমি তোমাদের পয়সা দিয়ে দিচ্ছি। ওখানে নেমে তোমাদের বাসা থেকে আমার পয়সাটা দিয়ে দিও।’

ভগবান জবাবে একটা কিছু বলতে যাচ্ছিল। আমি তাকে চোখে টিপ দিয়ে নিরস্ত করলাম।

সেই ছেলেটি যখন টিকেটের পয়সা দিচ্ছিল এমন সময় বাস মহম ষ্ট্যান্ডে এসে থামলো।

একজন পুলিশ দোতলায় উঠে এসে চারদিকে সন্দেহজনক দৃশটি মেলে তাকাচ্ছিল।

ভগবান জিজ্ঞেস করল, ‘পুলিশ এভাবে কি দেখছে?’

ছেলেটি বলল, ‘এখানে এলেই মদের জন্যে তল্লাশী হয়। বোম্বেতে মদ নিষিদ্ধ করা হয়েছে কিনা।’

‘তুমি কি বোম্বেতে নতুন এসেছ?’ পুলিশতি ভগবানকে জিজ্ঞাসা করল।

‘হ্যাঁ।’ ভগবান জবাব দিল।

‘তুমি যেখান থেকে এসেছ, সেখানে মদের করবার কেমন চলে?’

ভগবান বলল, ‘বেশ চলে। সেখানে তো রীতিমতো মদের সরোবর রয়েছে।’

‘তাহলে তো তোমাদের তল্লাশী নিতে হয়।’

বলেই পুলিশ আমাদের দুজনের তল্লাশী নিয়ে নিলো। স্কুলের ছেলেটি আমাদের দু’জনের ভাবসাব দেখে মুখ টিপে হাসতে লাগল। পুলিশও ছেলেটির দিকে তাকিয়ে হাসল। এরপর পুলিশটি চলে গেল। বাসও ষ্ট্যান্ড ত্যাগ করে আস্তে আস্তে চলতে লাগলো।

ছেলেটি এবার উঠে এসে আমাদের সামনে বসল এবং ভগবানকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘তোমার পকেটে কত টাকা ছিল?’

‘হিসাব তো ছিল না, তবে যা ছিল, সবই গেছে।’

‘তবুও অনুমান করে বলো কত ছিল?’

‘তা আমি কেমন করে বলব? বোম্বেতে যা কিছু নিয়ে এসেছিলাম সবকিছু নিয়ে গেছে। একটা পাই পয়সাও আমার কাছে নেই।’

‘এখানে কোথায় থাকো?’

‘কোথাও থাকি না। এসেছিলাম এর কাছে। এর কাছেও কোন কাজ নেই।’ ভগবান আমাকে দেখিয়ে বলল।

ছেলেটি আমার দিকে তাকালো।

আমি তাকে বললাম, ‘মাষ্টার, আমরা তো রাস্তার ছেলেপিলে। কোন কাজ-কাম নেই। স্কুল-পাঠশালাতেও আমরা যাই না। এখন ধরে নিতে পারো, তোমার টিকেটের পয়সাটা মারা গেছে। বাইকাল্লাতে আমাদের কোন বাসা নেই। এখন সব জেনেশুনে পয়সাটি মাফ করে দিতে পারো, নয়তো পুলিশে দিয়ে দাও।’

ছেলেটি আমার কথা শুনে মিটি মিটি হাসতে লাগল। পকেট থেকে একটা সাদা রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছে নিলো ইতিমধ্যে। সম্ভবতঃ এ ধরনের কথাবার্তা সে জীবনে প্রথমবার শুনলো। কেননা, ছেলেটি সত্যিই উঁচু ধরনের কোন অভিজাত পরিবারের ছেলে। আমাদের দুরবস্থা দেখে নিজের পয়সা দিয়ে টিকেট কিনে দিয়েছিল। কিন্তু…

বাইকাল্লা ব্রিজের কাছে বাস থামতেই ছেলেটি নামতে উদ্যত হলো এবং বলল, ‘তোমরা যদি আমার পয়সাটা না দিতে পারো তাহলে আমার ব্যাগটা কিছুদূর বহন করে নিয়ে দিতে হবে।’

‘কদ্দূর?’

‘বাসা পর্যন্ত।’

আট

ভগবান চামড়ার ব্যাগটা বগলে নিয়ে ছেলেটিকে অনুসরণ করে চলতে লাগল। আমিও তাদের পেছনে চলতে লাগলাম। সামনে ট্রামের লাইন পেরিয়ে আমরা এক থমথমে গলিতে ঢুকে পড়লাম। তারপর অন্য আরেক গলিতে। তারপর অন্য আরেক গলিতে। তারপর তৃতীয় গলি অতিক্রম করে কতকগুলো কাঠের গুড়ির স্তুপের কাছে যেয়ে আমরা উপনীত হলাম। কাঠের স্তুপের উপর ময়লা টুপি, ময়লা গেঞ্জি এবং ময়লা লুঙ্গি পরিহিত একটি বখাটে ছেলে বসেছিল। বয়েস সতের আঠার বছরের কাছাকাছি হবে। তার মুখাবয়ব কালো এবং সবুজ মিশ্রিত রং-এর সমন্বিত একটা রূপ বলে মনে হলো। গায়ের রংটা শ্যমলা। চেহারা বদসুরত এবং মুখভর্তি কালো কালো দাগ। কালো লুঙ্গির ভেতরে হাত ঢুকিয়ে গা খুজলাতে খুজলাতে আমাদের সঙ্গের ছেলেটিকে জিজ্ঞাসা করল, এরা কারা?’

‘আমার বন্ধু।’

‘সতিকার বন্ধু, না বাটপার?’

‘নেহাত গরীব, কোন কাজটাজ নেই এদের হাতে।’

‘কি কাজ করবে?’ ময়লা কাপড় পরিহিত ছেলেটি আমাদের দিকে চোখ ঘুরিয়ে বলল।

‘কাজ পেলে তো করব।’ আমি বললাম।

জবাবে সে কিছু বলল না। চামড়ার ব্যাগওয়ালা ছেলেটিকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘এনেছ?’

‘হ্যাঁ।’

‘কৈ, বের করো।’

ছেলেটি তার চামড়ার ব্যাগ থেকে তিনটি বোতল বের করল। বলা বাহুল্য, বোতল তিনটি ছিল মদের। ছেলেটির ব্যাগে কোন বই ছিল না। স্কুলের ছেলের ছদ্মবেশে অবশেষে……

ভগবান বিস্ময়ে হাঁ করে তাকিয়ে রইলো। ভগবান বলল, ‘আমি তো মনে করেছিলাম, তুমি স্কুলের ছাত্র।’

‘হাকুকে এখনো চেননি তোমরা!’ বলেই সে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল।

আবার বলল, ‘আমি তো ভাই মদের স্কুলের ছাত্র। দশ বছর থেকে আমি এই পেশা করে আসছি। এখন তো স্কুল পাশ করে হুইস্কির কলেজে ঢুকেছি।’

হাকু এবার ময়লা কাপড় পরিহিত ছেলেটিকে জিজ্ঞাস করল, ‘তোর বাবা কোথায়?’

‘খেতে চলে গেছে। আমাকে বলে দিয়েছে, হাকু এলে পয়সা দিয়ে বোতলগুলো নিয়ে নিবি। আর শালা তুমি কি না এতো দেরী করে এলে!’

‘নাও, টাকা বের করো।‘ হাকু বলল।

‘এত তাড়াহুড়া কেন, এক পেগ আগে গলাতে ঢেলে নিই……’ বলেই ময়লা কাপড় পরিহিত ছেলেটি কাঠের গুড়ির পেছন দিক থেকে গোটা চারেক গ্লাস বের করে নিয়ে এলো।

ভগবান বলল, ‘তোমরা এত ছোট, অথচ মদপান করছ দিব্যি। এমনটি তো আর দেখিনি।’

হাকু খিল খিল করে হেসে উঠে বলল, ‘এতে এমন দোষ কি? মদের কারবারই যখন করছি, মদকে ভয় পেলে তো চলবে না। যব পেয়ার কিয়া তো ডরনা কিয়া? নাও, তোমরাও একটু টেস্‌ করে দেখো।’

বড় ছেলেটি চারটি গ্লাসেই মদ ঢেলে নিলো। মদ ঢেলে বোতলটির বাকী মদটুকুর সাথে পানি মিশিয়ে নিয়ে মুখ বন্ধ করে বলল, ‘এবারে আমার বাবা শালা একটুও টের পাবে না যে, মাঝখানে আমরা এই কারবারটা করেছি। নাও, নাও, তোমরা তাড়াতারি গ্লাস খালি করে দাও। বাবা এসে পড়ল বলে। বাবা যদি দেখেই ফেলে, তাহলে মারতে মারতে প্লাষ্টার করে ফেলবে।’

হাকু এবং সেই ছেলেটি গট গট করে পান করছিল। আমরা একটা মোক্ষম সুযোগ মনে করে এই ফাঁকে কেটে পড়লাম। আমাদের কেটে পড়তে দেখে ওরা হাঁ করে তাকিয়ে রইলো। ওরা আমাদের পিছু নিল না। কোনরকম বাঁধাও দিল না। ওরা আমাদেরকে আস্ত বোকা বলেই মনে করল।

বাইকাল্লা পুলের কাছে পৌঁছে আমরা পদব্রজে দাদর পুলের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলাম। আমি ভগবানকে বললাম, ‘এবার কোথায় যাবে?’

‘কেন, তোমার বাসায়।’

‘কিন্তু তোমার তো আজ ফিরে যাবার কথা ছিল।’

‘আপাততঃ স্থগিত রাখলাম।’

‘কেন, হাকুকে দেখে?’

ভগবান প্রতি উত্তরে কিছু বলল না। আমি চেয়ে দেখলাম, ভগবানের চোখ দুটো অশ্রুতে ভারাক্রান্ত হয়ে এসেছে।

আমি ভগবানকে বলতে চেয়েছিলাম, ভগবান তোমার মত ভাল মানুষটি আর হয় নয়া, তোমার মতো সংবেদনশীল, উদার এবং নিষ্পাপ মন আর দেখিনি। কিন্তু চোখের জলে যদি এই সমাজ বদলে যেতে পারতো তাহলে প্রতি ভোরে শিশিরের অশ্রু দুর্বা ঘাসে ঘুমিয়ে থাকতো না।

সে রাতে খোলার ঘরে বড্ড গরম এবং ক্ষুধা-তেষ্টায় আমি রীতিমত ঘেমে উঠেছিলাম।

আমি ক্রুদ্ধ হয়ে ভগবানকে বললাম, ‘তুমি কেন যে আমার কাছে এলে? এই শহরে শত শত লক্ষপতি ব্যবসায়ী, কোটিপতি ঠিকাদার এবং মিল মালিকরা রয়েছে। তারা তোমাকে পেলে আদর-যত্ন করে রাখতো। কোন কষ্ট হতো না তোমার সেখানে। কিন্তু তুমি জেনেশুনে আমার কাছে কেন কষ্ট করতে এলে?’

ভগবান বলল, ‘আমি ভগবান, যেখানে ইচ্ছা যেতে পারি। তোমার আস্পর্ধা তো কম নয়। তোমার তো শোকরিয়া আদায় করা দরকার যে, আমি অন্য কারো কাছে না যেয়ে তোমার ঝুপড়িতে এসেছি। অথচ তুমি উল্টা আমাকে শাসাচ্ছ।’

‘না শাসিয়ে কি করব? সেই সকাল থেকে উপোস করে আছি। খৃষ্টানদের গির্জাতে সেই যে একটু মিষ্টি খেয়েছি, তারপর থেকে এখন পর্যন্ত একটু চা পর্যন্ত পেটে পড়েনি। দিন ভর তোমার সাথে পই পই করে ঘুরলাম আর তুমি কিনা কোন পকেটমারের দ্বারা তোমার পকেটটা সাফ করিয়ে নিয়ে আমার উপর চড়াও হয়েছ।’

ভগবান বলল, ‘তোমার যে ক্ষুধা পেয়েছে সেটা আমি টের পেয়েছি।’

আমি রেগেমেগে বললাম, ‘আমি তো আর তোমার মতো ভগবান নই যে, আমার ক্ষুধা লাগবে না।’

ভগবান চুপসে গেলো।

আমি বললাম, ‘চুপ করে কেন রয়েছ? আমাদের জন্ম দিয়েছ, আমাদের বেঁচে থাকার উপকরণ কেন দাওনি। এই কি আমাদের কপালে ছিল, এই খোলার ঘরে জ্বলে-পুড়ে হা-পিত্যেশ করে মরব? যাও তোমার স্বর্গে তুমি চলে যাও। সেখানে গিয়ে অন্ততঃ আমাদের মত এই গরীবদের একটা মরার উপায় করো যেন।’

ভগবান বলল, ‘আমার তো এখনো যাবার সময় হয়নি। আমি যে উদ্দেশ্যে দুনিয়াতে এসেছি, সে উদ্দেশ্য এখনো আমার পুরো হয়নি।

‘তাতো বুঝলাম। এখন পয়সা নেই, তুমিতো জানো –সেই দুটো মোমবাতি ছাড়া আর কিছু নেই আমার কাছে। মোমবাতিতে তো আর পেট ভরবে না।

‘ভগবানজী, তুমিও তো আজেবাজে লোকের মত আজেবাজে বকছ।

‘তাহলে আমি কি করব?

‘কি করবে তা আমি জানি না। আমার সাংঘাতিক ক্ষুধা পেয়েছে। তুমি স্বর্গ থেকে পয়সা আনিয়ে নাও।’

‘স্বর্গ থেকে কেউ পয়সা পাঠাবে না।

‘কেন, কার হুকুমে তারা পাঠাবে না?

‘আমার হুকুমেই তারা পাঠাবে না, সকল আইন-কানুন আমি নিজেই তৈরী করেছি, এখন নিজেই আমি কেমন করে সেসব আইন-কানুন ভঙ্গ করব?

‘তুমি দেখছি আজব ধরনের জীব। সারা বোম্বাই শহরে তুমি একমাত্র আমাকেই দেখলে! বিরক্ত করবার আর মানুষ পেলে না, ফিল্মষ্টার ভাগ কাপুর রয়েছে ইঁদুর শাহ কলন্দরের মুরীদ। দিনে দু’বার মাজারে না গিয়ে সুটিং করতে যায় না। চার লাখ টাকা ব্লাকে নেয়। কট্রাক্টে থাকে মাত্র পঁচিশ হাজার। তার বাড়ির গেটের তোরণ ইয়া বড়। তুমি তার কাছেও তো যেতে পারতে।

‘একবার আমি তার হৃদয়ের ঘ্রাণ নিয়ে দেখেছি, তাতে কোন গন্ধ নেই।’

‘তাহলে হাপুরজী কাপুরজী দালানের সেই বাড়িতেও তো যেতে পারতে। আমি তাদের সবকিছু জানি। মিডল ইষ্ট থেকে ষাট টাকা দামে প্রতি তোলা সোনা স্মাগল করে কিনে এখানে এনে একশ পঁচিশ টাকায় বিক্রি করে দেয়। প্রতি বছর কোটি কোটি টাকার সোনা স্মাগল করে থাকে। সরকারের বড় বড় ঠিকাদারী কাজে দাও মারে। তবে খুবই দানশীল এবং পুণ্যবান ব্যক্তি। এ বছরেই সে দুটো মন্দির, দুটো মসজিদ এবং দুটো গুরুদ্বার নিজের পকেটের চাঁদা থেকে তৈরী করেছে। তুমি তার কাছে গেলেই ভালো করতে।

ভগবান বলল, ‘আমি লোকটির দুটো চোখ দেখেছি। তার চোখে কোন লজ্জা-শরম নেই।’

নয়

‘তুমি এখানে না এসে আমা পুচকারণীর মহলে গিয়েও উঠতে পারতে। বোম্বের সবচাইতে বড় কাহবাখানা। আমা পুচকারণী গোটা পঞ্চাশেক কাহবাখানার (কাফেখানা) মালিক। এসব কাহবাখানাগুলোতে একরাতে যে আমদানী হয়, চিচামল কারখানার দেড় হাজার মজদুরের ত্রিশ দিনের উপার্জনের চাইতে অনেক বেশী। পুচকারণী প্রতিদিন দু’বার করে পূজা করে এবং দু’ঘন্টা ধরে তোমার চরণে পড়ে থাকে।’

ভগবান বলল, ‘আমি তারও বুকে কান পেতে শুনেছি, তার বুকে কোন নিষ্পাপ শিশুর কলধবনি শুনতে পাইনি।’

‘তাহলে তুমি পীর কেরামত আলীর দরবারেও যেতে পারতে। বোম্বের সবচাইতে বড় আধ্যাত্মিক পীর সে। সব সময় মোরাকাবায় পড়ে থাকে।’

‘তাও জানি, কিন্তু খয়রাতি পয়সায় তার জীবন চলে।’

‘তাহলে রামু ধোপা?’

‘সে নিত্য তার বউকে মারপিট করে।’

তা না হলে আমাদের পাশের বাসার কেরানীর বাসা…….?’

‘আমি তার নাক পছন্দ করি না।’

ভগবানের কথা শুনে আমি না হেসে পারলাম না। ভগবানও হেসে উঠলো। কিছুক্ষণের মধ্যে আমার মনের পুঞ্জীভূত ক্রোধটা মাটি হয়ে গেল। আমি বললাম, ‘তুমি জাতে হলে ভগবান, তোমার আবার পছন্দ অপসন্দ’…

‘এরা তো আমারই তোইরী। আমার সৃষ্ট জীবের উপর আমিই বা হাসি কেমন করে?’ ভগবান মুচকি হেসে বলল।

আমি বললাম, ‘বেশতো কথা হলো, এখন এটাতো বোঝ, হাসাহাসি যতই করি না কেন, তাতে ক্ষুধার নিবৃত্তি হয় না, ক্ষুধা বরং বেড়ে যায়।’

‘মনে হচ্ছে, এবারে আমার ক্ষুধা পাচ্ছে।’

‘তোমার ক্ষুধা পাচ্ছে, তার মানে?’

‘সম্ভবতঃ পৃথিবীর নিয়মে আমি সংক্রমিত হয়ে পড়েছি।’

আমি একুট চিন্তা করে বললাম, ‘আমার এক বন্ধু আছে, নাম তার ঘিনু। আদিবাস ছিল আজমগড়ে। ধুতি পরে। লম্বা টিকি রাখে। দিনভর গোয়ালাগিরি করে, রাতের বেলা মদের ধান্ধা করে। তার কাছে গেলে খাবার তো পাবেই, তদুপরি দু’এক পেগও ……তবে মহম অবধি পায়ে হেঁটে যেতে হবে।’

‘চল, তাই চলো।’

‘কিন্তু সে যদি পীড়াপীড়ি করে, দু’এক পেগ নিতে হবে কিন্তু।’

‘তা নোব।’

‘যদি দুর্ভাগ্যক্রমে পুলিশ এসে পাকড়াও করে তাহলে তোমাকেই জেলে যেতে হবে।’

‘তা যাব। তাতে এমন দোষের কি?’

‘ভালভাবে ভেবে-চিন্তে দেখো। পরে আমাকে কিন্তু দোষারোপ করতে পারবে না। পরদিন যখন খবরের কাগজে বের হবে যে, ভগবান জেলে, তখন তোমার লজ্জায় মাথা কাটা যাবে না?’

‘লজ্জায় মাথা কাটা যাবার বাকী আছে কোথায়? বোম্বে শহরের এই যে শত শত মন্দিরের মাঝে আমার মূর্তিকে লোহার গরাদের মাঝে বন্দী করে রেখেছে, তাতে আমার লজ্জা হতে কি বাকী আছে?’

ভগবান অনেকটা আক্ষেপের সুরে বলল। আমি তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়ার জন্যে চপ্পল খুঁজতে লাগলাম।

মহমক্রেক। এখানে বছরে দু’ দু’বার ‘দি গ্রেট রয়াল সার্কাসের শামীয়ানা টানানো থাকে। শামীয়ানার কাছেই ঘিনুর ঝুপড়ি। প্রকৃত পক্ষে তার বাসাবাড়ি গোর গাঁয়ে। কিন্তু সেখানে থেক তো ধান্ধাবাজী করা যায় না। অতএব সে পুলিশের ক্যাম্পের কাছে এই ডেরা বানিয়ে নিয়েছে। পুলিশের কাছে থাকলে সাহসটা বাড়ে।

ঘিনুর সাথে আমার দেখা হয়নি বেশ অনেকদিন হয়ে গেছে। এজন্যে আমাকে দেখেই সে খুশীতে বাগ বাগ। ওর মধ্যে একটা গুণ ছিল, সে মুখ দেখে সহজেই মানুষের মন বুঝতে পারতো। পেটে দানা-পানি পড়েনি বুঝতে পেরে অন্য কথা রেখে প্রথমেই সে আমাদের দু’জনের সামনে দু’পেগ রেখে দিল। তারপর বলল, ‘ঝটপট আগে মুখে তুলে নাও। খুব ক্ষুধা পেয়েছে তোমাদের, বুঝতে পেরেছি। কিছুক্ষণ পর আরো খাবার আনিয়ে দেব। ভগবানের ইচ্ছায় আমার কারবার আজকাল ভালই চলছে। যেমন দুধ বিক্রি হচ্ছে, তেমনি তোমার এই পানি …’

ঘিনু এ কথা বলেই নিজেই টিকিটায় একটা গিরা দিয়ে গুছিয়ে নিল। তারপর ভগবানের একটা প্রতিকৃতির সামনে গড় হয়ে প্রণাম করল।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন