টিকটিকি

মুহম্মদ জাফর ইকবাল

ছুটির দিনে সবাই একসাথে নাশতা করে, ঠিক করে বললে বলতে হয় বড়রা ডাইনিং টেবিলে বসে নাশতা করার চেষ্টা করে, বাচ্চারা তাদের চারপাশে মেঝেতে দাপাদাপি করে। আজকেও একই ঘটনা ঘটছে, তখন বড় চাচা গলা উঁচু করে বললেন, “শারমিন দেশে আসছে!” 

বড়রা কেউ আনন্দের কেউ বিস্ময়ের শব্দ করল, ছোটরা কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করল। তাদের কেউ কেউ শারমিন খালার নাম শুনেছে, যারা একটু বেশি ছোট তারা নামটাও শুনেনি। শারমিন হচ্ছে দাদির (কিংবা নানির) ভাগ্নী, অনেক দিন থেকে দেশের বাইরে। 

দাদি জিজ্ঞেস করলেন, “কবে আসছে?” 

বড় চাচা বললেন, “সামনের সপ্তাহে।”

“কয়দিন থাকবে?”

“সেইটা কিছু বলে নাই।”

“উঠবে কোথায়?” 

“সেইটাও কিছু বলে নাই।”

ছোটাচ্চু বলল, “কোথায় আবার উঠবে? এইখানে উঠবে।” 

কিছু না বুঝেই বাচ্চারা বলল, “হ্যাঁ, হ্যাঁ এইখানে উঠবে।” 

শাহানা বলল, “শারমিন খালার একটা ছেলে আছে না টুনির বয়সি?” 

দাদি বললেন, “হ্যাঁ আছে।” 

ছোটাচ্চু বললেন, “ছোট থাকতে খুব দুষ্টু ছিল, এখন কেমন হয়েছে কে জানে।” 

শান্ত আনন্দে দাঁত বের করে হেসে বলল, “এখন নিশ্চয়ই আরও দুষ্টু হয়েছে।” 

দাদি হাত দিয়ে পুরো ব্যাপারটা উড়িয়ে দিয়ে বললেন, “ ছোট বাচ্চারা তো একটু দুষ্টু হতেই পারে। এই বাসায় বাচ্চাদের দেখিস না!” 

মেজো চাচি মাথা চুলকে বলল, “তবে দুষ্টুমির লাইনে এই বাচ্চার সুনাম একটু বেশি! তার উপর বিদেশি ট্রেনিং—” 

দাদি হাসলেন, বললেন, “এই লাইনে বিদেশি ট্রেনিং খারাপ না। আমরা দেশি দুষ্টু সহ্য করতে পারলে বিদেশি দুষ্টুও পারব।” দাদি বড় চাচার দিকে তাকিয়ে বললেন, “তুই খোঁজ নে দেখি কোথায় উঠবে শারমিনকে বল যেন এইখানে ওঠে।” 

বড় চাচা টেলিফোনটা বের করে বললেন, “এখনই ফোন করে দেখি। আমেরিকাতে এখনও বেশি রাত হয় নাই।” 

বড় চাচা ফোন করলেন এবং বাচ্চারা কাছাকাছি এসে তাকে ঘিরে দাঁড়াল। কয়েকবার রিং হওয়ার পর শারমিন খালার গলার আওয়াজ শোনা গেল, “হ্যালো, ভাইজান—” 

বড় চাচা বললেন, “কী খবর শারমিন। এখানে আমি একা না সবাই আছে।” 

বাচ্চারা চিৎকার করে সায় দিল, “সবাই! সবাই!” 

শারমিন খালা বললেন, “সবাই ভালো আছে ভাইজান?” 

বড় চাচা কিছু বলার আগেই বাচ্চারা চিৎকার করল, “ভালো ভালো।” 

দাদি বাচ্চাদের একটা ধমক দিলেন, “তোরা চুপ করবি?” 

বড় চাচা ফোনটা দাদির (কিংবা নানি) দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, “শারমিন, নাও মায়ের সাথে কথা বল—” 

ফোন হাতে নিয়ে দাদি বললেন, “শারমিন তুমি নাকি দেশে আসছ?” 

“জি খালা, সামনের সপ্তাহে—” 

“তুমি উঠবে কোথায়? আমার বাসায় উঠবে না?” 

“খালা, আমি দেশে আসব আর আপনার বাসায় উঠব না এটা তো আমি কখনো চিন্তা করি নাই। কিন্তু খালা এবার অন্য ব্যাপার—” 

“অন্য কী ব্যাপার?” 

“আমার ছেলেটাকে নিয়ে সমস্যা।” 

“কী সমস্যা?” 

সেটা বলে বোঝানো যাবে না। সে হচ্ছে শুধু দুষ্টু না—মহাদুষ্টু, তার যন্ত্রণায় জীবন অতিষ্ঠ। শুধু আমি না—পরিচিত যারা আছে, বন্ধুবান্ধব যারা আছে—এমনকি তার স্কুল পর্যন্ত অতিষ্ঠ। প্রত্যেক সপ্তাহে একবার করে আমার স্কুলে হাজিরা দিতে হয়। তাকে নিয়ে আমি কোনো বাসায় উঠতে সাহস পাই না। পুরো বাসা জ্বালিয়ে দেবে—” 

দাদি আনন্দে হি হি করে হাসলেন, বললেন, “শারমিন, তুমি সেই দিনের মেয়ে আমাকে তুমি দুষ্টু ছেলের কথা শিখাবে? তুমি ভেবেছ আমার বাসায় দুষ্টু ছেলেপিলে নাই? তুমি ভেবেছ আমার দুষ্টু ছেলেমেয়ে দেখে অভ্যাস নাই?” 

শারমিন খালা টেলিফোনের অন্য মাথা থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, বললেন, “খালা আপনি বুঝতে পারছেন না—এইমাত্র সেইদিন স্কুল থেকে আমাকে খবর পাঠিয়েছে। স্কুলের প্রিন্সিপাল দুইদিন পরপর আমার কাছে নালিশ পাঠায় দেখে প্রিন্সিপালের উপর আমার ছেলের খুব রাগ—তাই ঠিক করছে তাকে একটা শিক্ষা দেবে। তারপর কী করেছে জানেন?” 

দাদি নড়েচড়ে বসলেন, মুখে কৌতূহল এবং আগ্রহ ফুটে উঠল উৎসাহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কী করেছে?” 

শারমিন খালা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “থাক টেলিফোনে আর না বললাম। দেখা হলে সামনাসামনি বলব। এরকম কেস তো আর একটা না, শত শত! সেইদিন আটতলা একটা শপিং মলকে ধসিয়ে দিয়েছে—কী কেলেঙ্কারি!” 

বাচ্চারাও এবারে উৎসাহ নিয়ে এগিয়ে এল, “জিজ্ঞেস করল, কী করেছে?” 

শারমিন খালা আবার দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, বললেন, “থাক। দেখা হলে বলব। সবচেয়ে আজব কাজটা করেছে কার সাথে জানেন খালা?” 

“কার সাথে?” 

“আমার সাথে। সকালে ড্রয়ার খুলতেই দেখি—”

“কী দেখ?” 

শারমিন খালা বলল, “থাক। এটাও দেখা হলে বলব। যখন জিজ্ঞেস করেছি কেন এটা করেছ? সে বলে এটা নাকি জন্মদিনের গিফট। এটা যদি জন্মদিনের গিফট হয়, তাহলে যেগুলো গিফট না সেগুলোর কথা চিন্তা করেন!” 

দাদি বললেন, “শারমিন, তুমি তো আমার ভিতরে আরও আগ্রহ তৈরি করে দিলে। তুমি অবশ্যই তোমার ছেলেকে নিয়ে আমার বাসায় উঠবে—আমি তাকে দেখতে চাই!” 

বাচ্চারা চিৎকার করে উঠল, “অবশ্যই! অবশ্যই! অবশ্যই দেখতে চাই।” 

শারমিন খালা ইতস্তত করে বললেন, “আমি ভাবছিলাম ছেলেটাকে নিজের দেশ দেখাব। সুন্দরবন, কক্সবাজার, কুয়াকাটা, চা বাগান, হাওড়, রাঙামাটি, বান্দরবান, লালনের আখড়া, কান্তজীর মন্দির, পাহাড়পুর, ময়নামতি সব জায়গায় নিয়ে যাব, তাই কোথাও বেশিদিন থাকা হবে না। ঢাকা এসে একটা হোটেলে উঠব—” 

দাদি ধমক দিলেন, “হোটেলে থেকে কেউ নিজের দেশে থাকতে পারে? তুমি কী বলছ এসব? অবশ্যই তুমি তোমার দুষ্টু ছেলেকে নিয়ে আমার বাসায় উঠবে। এখানে সে যত খুশি দুষ্টুমি করতে পারবে—” 

বাচ্চারা হাত তুলে আনন্দে চিৎকার করে বলল, “ইয়েস! ইয়েস!” 

.

কাজেই পরের সপ্তাহে শারমিন খালা তার বিখ্যাত দুষ্টু ছেলে নিয়ে বাসায় হাজির হলেন। বাচ্চারা আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে। শারমিন খালার নাম শুনে মনে হচ্ছিল সে বুঝি হবে মোটাসোটা নাদুসনুদুস, কিন্তু দেখা গেল শারমিন খালা পাতলা ছিপছিপে—কম বয়সি মেয়ের মত। তার ছেলেটাকে দেখে মোটেও দুষ্টু ছেলে মনে হয় না। এক মাথা কালো চুল, বড় বড় চোখ। তবে একটু ভালো করে লক্ষ করলে বোঝা যায়—কারণ জ্বলজ্বলে চোখগুলো ক্রমাগত নড়ছে এবং মাঝে মাঝে ঝিলিক মারছে। মুনিয়া এগিয়ে গিয়ে তার হাতটা বাড়িয়ে ইংরেজিতে বলল, “হ্যালো। মাই নেম ইজ মুনিয়া, হোয়াট ইজ ইউর নেম?” 

ছেলেটা উত্তর না দিয়ে মুনিয়ার হাতের দিকে তাকিয়ে রইল। মুনিয়া তখন বলল, “মানে, আমি জিজ্ঞেস করছি তোমার নাম কী?” 

ছেলেটা এইবার সাবধানে মুনিয়ার হাতটা ধরে একটা একটা আঙুল পরীক্ষা করে হাতটা ছেড়ে দিয়ে পরিষ্কার বাংলায় বলল, “আমার অনেকগুলো নাম আছে। তুমি কোনটা শুনতে চাও?” 

পরিষ্কার বাংলা বললেও উচ্চারণ একটুখানি অন্যরকম। ‘র’ বলার সময় মাঝে মাঝে ‘ড়’ বলে। ‘ত’ বলার সময় কখনো কখনো ‘ট’ বলে ফেলে। 

মুনিয়া অবাক হয়ে বলল, “অনেকগুলো নাম? অনেকগুলো কেন?” 

“আমার বন্ধুড়া আমাকে ডাকে বাড়ি। আমার চামচাড়া ডাকে বস। যাড়া ভয় পায় তাড়া ডাকে লিডার। আম্মু ডাকে পাজির পা ঝাড়া। আব্বুর মন ভালো ঠাকলে ডাকে টেড়ড়, রেগে থাকলে ডাকে মনস্টার।” 

মুনিয়া হা করে তাকিয়ে রইল। টুনি বলল, “আমরা তোমাকে কী ডাকব?” 

“বস না হলে লিডার ডাকতে পাড়।” 

“উহুঁ। তোমার নাম কী সেটা বল। স্কুলের খাতায় যেটা লেখা আছে।” 

“সেটা কেউ উচ্চাড়ণ কড়টে পারে না।” 

“আমরা পারব।” 

মনে হল খুব অনিচ্ছার সাথে বলল, “ধ্রুব। আমার নাম ধ্রুব।“

মুনিয়া জিজ্ঞেস করে, “আমেরিকায় এটাকে কী উচ্চারণ করে?”

“ডি-রুবো।” 

মুনিয়া হি হি করে হাসল, বলল, “আমিও তোমাকে ডি-রুবো ডাকব। ডি-রুবো ভাইয়া।” 

“তোমার যেটা ইচ্ছা।” 

টুনি বলল, “যারা আমেরিকা থেকে আসে, তারা বাংলা বলতে পারে না। তুমি অনেক ভালো বাংলা বল, শুধু উচ্চারণটা একটু অন্যরকম।” 

ধ্রুব কিংবা ডি-রুবো একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “আমি বাসায় ইংড়েজিতে কথা বললে আম্মু আড় আব্বু দুইজনেই ভান কড়ে টাড়া কথা শুনে নাই।”

শান্ত এতক্ষণ মনোযোগ দিয়ে ধ্রুবর কথা শুনছিল। এবারে বলল, “তোমার আম্মু বলেছেন, তুমি নাকি অনেক দুষ্টু।” 

৪৪ ওগো টুনটুনি কীগো ছোটাচ্চু 

“মোটেও না।” ধ্রুব জোরে জোরে মাথা নাড়ল, বলল, “আমি মোটেও দুষ্টুমি কড়ি না। মাঝে মাঝে শুধু—” ধ্রুব কথা শেষ না করে থেমে গেল। 

“মাঝে মাঝে শুধু কী?” 

“যাড়া আমার সাথে অন্যায় কড়ে তাদেড়কে একটু শিক্ষা দেই।”

“তুমি নাকি তোমাদের প্রিন্সিপালকে কী একটা করেছিলে—” 

ধ্রুবর মুখে একটা আনন্দের হাসি ফুটে উঠল। বলল, “অনেক কিছু কড়েছি। প্রিন্সিপাল আমাকে দুই চোখে দেখতে পারে না। আমিও তাকে দুই চোখে ডেখটে পাড়ি না।” 

“মুনিয়া জিজ্ঞেস করল, কেন তাকে দেখতে পার না?” 

“দুই দিন পড়পড় হয় আম্মু না হয় আব্বুর কাছে নালিশ পাঠায়।” শান্ত গম্ভীর মুখে বলল, “খুবই অন্যায়।” 

মুনিয়া জিজ্ঞেস করল, “তুমি কীভাবে শিক্ষা দিয়েছিলে ডি-রুবো ভাইয়া?” 

ধ্রুব বলল, “আমাদের স্কুলটা নিউইয়র্ক শহড়েড় ঠিক মাঝখানে। সেখানে গাড়ি পার্কিংয়ের খুব সমস্যা। কোথাও কোনো পার্কিং নাই। আমাদের স্কুলের মাত্র কয়েকজনের গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গা আছে। সেই জায়গায় একেবারে নাম লেখা আছে কে কোনখানে পার্কিং কড়বে। সেইখানে প্রিন্সিপাল, ভাইস প্রিন্সিপাল, রেক্টর, সিকিউরিটি এইরকম ছয়জনের জায়গা। একদিন রাত্রে এসে আমরা কয়েকজন সেই ছয়টা পার্কিংয়ের দাগগুলি মুছে নতুন কড়ে দাগ দিয়ে পাঁচটা পার্কিং কড়ে দিলাম। পাঁচজনের নাম লেখা—প্রিন্সিপালের নাম নাই!” বিষয়টা কল্পনা করে ধ্রুব আনন্দে হা হা করে হাসল। 

শান্ত জিজ্ঞেস করল, “তারপর কী হয়েছে?” 

ধ্রুব বলল, “যা হবাড় তাই হয়েছে! সকালে প্রিন্সিপাল এসে দেখে টাড় পার্কিংয়ের জায়গা নাই—অন্য পাঁচজন পুড়ো জায়গা দখল কড়ে গাড়ি পার্ক কড়ে রেখেছে—প্রিন্সিপাল রেগেমেগে ফায়ার!” ধ্রুব আবার শব্দ করে হাসল! 

“তোমাদের ধরতে পারে নাই?”

“বুঝে গেছে আমাদের কাজ! কিন্তু কোনো প্রমাণ নাই। প্রিন্সিপালকে কেউ দেখতে পাড়ে না, তাই সবাই মনে মনে খুশি!” 

টুম্পা জিজ্ঞেস করল, “আর আটতলা শপিংমলে কী করেছিলে?” 

ধ্রুব সেটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু ঠিক তখন ঝুমু খালা এসে সবাইকে ডাইনিং রুমে ডেকে নিয়ে গেল। সবাইকে বিকেলের নাশতা দিয়েছে। 

নাশতার টেবিলে সবাই আছে, শারমিন খালা দাদির কাছ থেকে রাজ্যের খবর নিচ্ছেন। বাচ্চারা টেবিলের উপর রাখা খাবারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। ধ্রুব সাবধানে একটা দুইটা খাবার মুখে দিচ্ছে এরকম সময়ে ঝুমু খালা দাঁড়িয়ে গেল, ধ্রুবের দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি নিশ্চিন্তে খাও! আমি নাশতা পানি বানানোর সময় কুনো দুষ্টামি করি না!” 

ধ্রুব কোনো কথা না বলে সন্দেহের চোখে ঝুমু খালার দিকে তাকাল। ঝুমু খালা বলল, “পুরা এক সপ্তাহ খালি তোমার দুষ্টামির গল্প শুনছি! তুমি কী দুষ্টামি কর বল আমাদের। আমরা শুনি।” 

ধ্রুব মাথা নেড়ে বলল, “আমি কোনো দুষ্টুমি কড়ি না।” 

শারমিন খালা হুংকার দিয়ে বললেন, “কী বললি? তুই দুষ্টুমি করিস না? আমার জন্মদিনে কী করেছিলি? ঐটা দুষ্টুমি ছিল না?” 

ধ্রুব মাথা নেড়ে বলল, “আমি এত কষ্ট কড়ে তোমাকে জন্মদিনে একটা গিফট দিলাম আড় তুমি বল দুষ্টুমি—”

শারমিন খালা আরো রেগে গেলেন, “গিফট? ঐটা গিফট?” 

দাদি বললেন, “শুনি, গিফটটা কী ছিল!” 

শারমিন খালা বললেন, “ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে অফিস যাব। আমার ড্রয়ারটা খুলেছি—খুলে দেখি সেইখানে থইথই পানি! শুধু পানি না, সেই পানির মাঝে কয়টা গোল্ড ফিশ আর কচ্ছপের বাচ্চা ঘুরে বেড়াচ্ছে!” 

সবাই কমবেশি চিৎকার করে উঠল, “পানি? ড্রয়ারের মাঝে পানি? গোল্ড ফিশ? কচ্ছপের বাচ্চা?” 

ধ্রুব বলল, “আমি আম্মুর কিছু বুঝি না! এত সুন্ডড় গিফট দেখে খুশি হবে তা না, এমন চিৎকার দিল—” 

শারমিন খালা রেগে উঠলেন, “খুশি হব? খুশি? কেউ তার কাপড়ের ড্রয়ার খুলে সেখানে যদি দেখে পানি থইথই করছে, তার মাঝে মাছ আর কচ্ছপ ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাহলে খুশি হয় কেমন করে?” 

দাদি বললেন, “কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না ড্রয়ারে কেউ পানি রাখে কেমন করে?” 

“আপনার নাতিকে জিজ্ঞেস করেন—”

সবাই ধ্রুবের দিকে তাকাল। ধ্রুব মুখ শক্ত করল, “কেন? ড্রয়ারে পানি রাখা এমন কী কঠিন ব্যাপাড়। কিছু কাপড় সড়িয়ে জায়গা কড়ে নিয়ে সেখানে একটা প্লাস্টিকের শীট রেখে টাড় ভিতরে পানি ঢালতে হয়—খুবই সোজা!” 

সবাই ধ্রুবের দিকে তাকিয়ে রইল, ধ্রুব বলল, “আমি চাইছিলাম পুড়ো ঘরে কড়টে যেন আম্মু বিছানা থেকে নামটেই হাঁটু পানি পায়। এট বড় প্লাস্টিক পাওয়া গেল না—” 

ঝুমু খালা মুগ্ধ দৃষ্টিতে ধ্রুবের দিকে তাকিয়ে রইল, মাথা নেড়ে বলল, “তুমি অনেক কামেল মানুষ কুনো সন্দেহ নাই। এখন কি আমাগো বাসায় কোনো খেলা দেখাবে?” 

ধ্রুব কিছু বলার আগেই বাচ্চারা চিৎকার করে বলল, “দেখাবে দেখাবে দেখাবে—একশ বার দেখাবে—” 

শারমিন খালা চোখ পাকিয়ে ধ্রুবের দিকে তাকিয়ে বললেন, “খবরদার! এই বাসায় যদি তুই কোনো দুষ্টুমি করিস আমি তোকে খুন করে ফেলব!” 

দাদি বললেন, “আহা! কেন বাচ্চাটাকে ভয়ভীতি দেখাচ্ছিস, এতদিন পর দেশে এসেছে, বাচ্চাটাকে স্বাধীনভাবে থাকতে দে।” 

শারমিন খালা বললেন, “খালা আপনি এইসব বলবেন না—এই ছেলেকে দুষ্টুমিতে উৎসাহ দিবেন না—সর্বনাশ করে ফেলবে।” 

“ড্রয়ারের পানিতে কোনো সমস্যা হয়েছিল?” 

“হয় নাই আবার! যখন পানি সরিয়ে খালি করতে গেছি ড্রয়ারের কাপড় ভিজে শেষ—”

ধ্রুব মুখ শক্ত করে বলল, “তুমি পানি সরাটে গেলে কেন? ড্রয়ারে গোল্ড ফিশ ঠাকলে কী হয়?” 

বাচ্চারা ধ্রুবের সাথে একমত হল, তারাও বলল, ড্রয়ারে এক দুইটা গোল্ড ফিশ, এক দুইটা কচ্ছপ থাকা এমন কিছু অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। 

শারমিন খালা হতাশভাবে মাথা নেড়ে বললেন, “পরশু এই বাঁদরটাকে নিয়ে কক্সবাজার যাব। তখন একটু স্বস্তি পাব যে, এখানে কিছু করতে পারবে না।”

দাদি হাসলেন, বললেন, “শুধু শুধু এত চিন্তা করো না শারমিন। মাত্র কয়দিনের জন্য দেশে এসেছে, বাচ্চাটাকে স্বাধীনভাবে থাকতে দাও।”

ঠিক তখন শান্ত মেঘ স্বরে বলল, “দাদি!” 

দাদি (কিংবা নানি) বললেন, “কী হয়েছে?”

“আমার একটা কথা বলার আছে।” 

শান্তর গলার স্বর এতই থমথমে এবং চেহারা এত ভাবগম্ভীর যে, সবাই তার দিকে ঘুরে তকাল। শান্ত সেই অবস্থায় মুখ শক্ত করে বলল, “তুমি ধ্রুবকে দুষ্টুমি করার স্বাধীনতা দিয়েছ। অথচ আমাদের কাউকে তুমি কোনোদিন এই স্বাধীনতা দাও নাই। শুধু আমেরিকা থেকে এসেছে বলে তুমি ধ্রুবকে সুযোগ দিচ্ছ আর আমি এই দেশের সন্তান বলে কখনো আমাকে সুযোগ দেও নাই—এটা আমার দেশের অবমাননা।” 

সবাই মুখ টিপে হাসল এবং দাদি চোখ কপালে তুলে বললেন, “দেশের অবমাননা?” 

শান্ত মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ, রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল।” 

“একেবারে রাষ্ট্রদ্রোহিতা?” 

ছোটাচ্চু হাসি গোপন করে বলল, “মা জিজ্ঞেস করো তো রাষ্ট্রদ্রোহিতার বানান জানে কি না!” 

শান্ত না শোনার ভান করে বলল, “দাদি, তোমার কাছে আমরা ন্যায়বিচার চাই।” 

টুম্পা বলল, “শান্ত ভাইয়া, বল, ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করি।” 

শান্ত বলল, “ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করি।” 

দাদি বললেন, “ন্যায়বিচার করতে হলে আমার কী করতে হবে?”

“আমাদেরকেও দুষ্টুমি করার স্বাধীনতা দিতে হবে।” 

শারমিন খালা আতঙ্কের একটা শব্দ করে বললেন, “সর্বনাশ!” 

টুনি বলল, “দাদি, আমার মনে হয় শান্ত ভাইয়া ঠিকই বলেছে। শান্ত ভাইয়া অনেক রকম দুষ্টুমি করেছে কিন্তু কোনোদিন স্বাধীনভাবে করতে পারে নাই! একদিনের জন্য দুইজনকেই সুযোগ দাও!” 

বাচ্চারা বলল, “দাও! দাও!” 

শারমিন খালা কপালে থাবা দিয়ে বললেন, “হায়! হায়! কী সর্বনাশা কথা।” 

ছোটাচ্চু বলল, “অনেক রকম স্বাধীনতার কথা শুনেছি কিন্তু দুষ্টামি করার স্বাধীনতার কথা জন্মেও শুনি নাই!”

দাদি কিছুক্ষণ চিন্তা করলেন, তারপর বললেন, “আমি রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলায় পড়তে চাই না। ঠিক আছে এখন থেকে চব্বিশ ঘণ্টার জন্য দুইজনকে সুযোগ দেওয়া হল।” 

শান্ত বলল, “যা খুশি তাই করতে পারব?” 

অন্য কেউ কিছু বলার আগেই শারমিন খালা বললেন, “না-না-না যা খুশি তাই করার অনুমতি দিবেন না, সর্বনাশ হয়ে যাবে।” 

ধ্রুব বলল, “কোয়ালিটি দুষ্টুমি কড়টে একটু সময় লাগে, একটু ফান্ডও লাগে!” 

শারমিন খালা চিৎকার করে বললেন, “এখন ফান্ড দিতে হবে? তারপর বলবি স্পন্সর জোগাড় করে দিতে হবে, মিডিয়া কভারেজ লাগবে, সাংবাদিক সম্মেলন করতে হবে?” 

টুনি বলল, “দাদি ব্যাপারটা খারাপ হবে না—একটা আন্তর্জাতিক কম্পিটিশনের মত!” 

টুম্পা বলল, “আন্তর্জাতিক দুষ্টুমি অলিম্পিয়াড!” 

মুনিয়া জিজ্ঞেস করল, “তাহলে পুরস্কার কী দেওয়া হবে?” 

দাদি বললেন, “দেখ বাড়াবাড়ি করিস না, তাহলে সবকিছু বন্ধ করে দিব! দেখিস কারো যেন কোনো ক্ষতি না হয়। যা করতে চাস সব এই ঘরের মধ্যে। এর বাইরে কিছু করতে পারবি না।” 

ছোটাচ্চু বলল, “মা, তুমি আমার কাছে ছেড়ে দাও, আমি একটা নীতিমালা করে দিই।”

বাচ্চারা আনন্দে চিৎকার করল, “নীতিমালা! নীতিমালা!” 

“ঠিক আছে, তাহলে কালকে এই সময় এই জায়গায় আন্তর্জাতিক দুষ্টুমি প্রতিযোগিতা!” 

পরের দিন ভোরবেলা ডাইনিং টেবিলে বসে আন্তর্জাতিক দুষ্টুমি প্রতিযোগিতাটি সবার আগে টের পেলেন বড় চাচা। ভোরে ডাইনিং টেবিলে বসে বড় চাচা সবসময় চা খেতে খেতে খবরের কাগজ পড়েন। আজকে খবরের কাগজ পড়ার সময় পুরোপুরি বিভ্রান্ত হয়ে গেলেন, পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠা একরকম, পিছনের পৃষ্ঠা অন্যরকম। বড় চাচার অনেকক্ষণ লাগল বুঝতে যে, কেউ খুব যত্ন করে পত্রিকাটির প্রথম পৃষ্ঠার পিছনে পুরানো পৃষ্ঠা আঠা দিয়ে লাগিয়ে একটা কিম্ভূতকিমাকার পত্রিকা তৈরি করে রেখেছে। এর মাঝেই যেটুকু খবর পড়া যায় পড়ার চেষ্টা করতে করতে চায়ের কাপে চুমুক দিতে গিয়ে মুখ বিকৃত করলেন—গরম পানিতে নিজ হাতে টি ব্যাগ ডুবিয়েছেন কিন্তু চা লবণাক্ত। শুধু লবণাক্ত না, ভয়াবহ লবণাক্ত। বড় চাচার রাগার ক্ষমতা নাই, নেহায়েত ভালোমানুষ, তারপরও দুর্বলভাবে রাগার চেষ্টা করলেন। 

ঝুমু খালাকে দ্বিতীয় কাপ চা বানিয়ে দিতে বললেন। ঝুমু খালা বাচ্চাদের উদ্দেশে একটা হুংকার দিয়ে দ্বিতীয় কাপ চা তৈরি করে আনল, এবার চা আগুনের মত ঝাল। তৃতীয় কাপ রীতিমত টক। ঝুমু খালা চতুর্থ কাপ চা তৈরি করতে গিয়ে থেমে গেল, বলল, “বড় ভাইজান এইটাতে কেরোসিনের গন্ধ!” 

সকাল বেলা চা না খাওয়া পর্যন্ত বড় চাচার দিন শুরু হয় না—কাজেই আজকে বড় চাচার দিন শুরু হতে পারল না। বড় চাচা মনমরা হয়ে বসে তার বিদ্যুটে পত্রিকা নাড়াচাড়া করতে লাগলেন। 

আস্তে আস্তে অন্যরা আসতে লাগল। চায়ের বর্ণনা শুনে কেউ আর চা খাওয়ার সাহস পেল না। খুবই নিরাপদ হিসেবে ছোটাচ্চু একটা কলা হাতে নিয়ে সেটা ছিলতে শুরু করা মাত্রই ভেতরের কলাটুকু ছোট ছোট টুকরা হিসেবে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। ছোটাচ্চু হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল, একটা আস্ত কলার অক্ষত ছিলকের ভেতরে কলাটির কীভাবে ছোট ছোট টুকরা করা যায় বুঝতে পারল না। 

ছোটাচ্চু শুকনো গলায় দাদিকে বলল, “মা দেখেছ?” 

“কী হয়েছে?” 

“কলার ছিলকে না সরিয়ে ভেতরের কলাটি টুকরা টুকরা করে ফেলেছে!” 

“কী আশ্চর্য!” 

ঝুমু খালা কোমরে হাত দিয়ে বলল, “কী আচানক!” 

অন্যরাও তখন কলাগুলো হাতে নিয়ে পরীক্ষা করে তারপর ছিলকেটা খুলতেই ভেতরের ছোট ছোট কলার টুকরা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। 

এরকম সময়ে বাসার বাচ্চারা আস্তে আস্তে আসতে শুরু করেছে। তাদের মুখ দেখেই বোঝা যায় সবাই আন্তর্জাতিক দুষ্টুমি প্রতিযোগিতা উপভোগ করতে এসেছে। 

শারমিন খালাও এসেছেন, ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “দুষ্টুমির কী অবস্থা?” 

ছোটাচ্চু বলল, “অবস্থা এখনও নিয়ন্ত্রণের মাঝে আছে। বাড়াবাড়ি কিছু হয় নাই।” 

শারমিন খালা বললেন, “তার মানে আসল ঘটনা এখনো ঘটেনি।”

“আসল ঘটনা কী?” 

“কেমন করে বলি—কিছু একটা অঘটন নিশ্চয়ই ঘটাবে!” 

ঝুমু খালা বুকে থাবা দিয়ে বলল, “ভয় পাই না অঘটনরে! দেখি কী করে!” 

বাচ্চারা মুখে খুবই নিরীহ একটা হাসি ফুটিয়ে বসে রইল। 

ঝুমু খালা বলল, “আমি রুটি টোস্ট আর ডিম মামলেট নিয়ে আসি?” 

দাদি বললেন, “আন।” 

ঝুমু খালা রান্নাঘরে গেল এবং দুই মিনিট পরে রান্নাঘর থেকে আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল! সবাই দুদ্দাড় করে রান্নাঘরে ছুটে গেল, ঝুমু খালা বড় বড় চোখে একটা বাটির দিকে তাকিয়ে আছেন, পাশে ভাঙা ডিমের খোসা। 

ছোটাচ্চু জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে?” 

“রক্ত।” 

“কোথায় রক্ত?” 

“ডিমের ভেতরে।” 

সবাই দেখল সত্যি সত্যি বাটিতে টকটকে লাল রক্ত। 

বড় চাচা বললেন, “ডিমের ভিতর রক্ত কীভাবে আসবে?” 

দাদি বললেন, “বাচ্চাদের দুষ্টামি মনে হয়।” 

ঝুমু খালা কাঁপা গলায় বলল, “দুষ্টামি করে আস্ত ডিমের ভিতর রক্ত ঢুকাবে কেমন করে?” 

দাদি বললেন, “এদের অসাধ্য কিছু নাই।” 

ছোটাচ্চু বলল, “আরেকটা ডিম ভাঙো দেখি।” 

ঝুমু খালা সরে গেল, বলল, “আমার রক্ত ভয় করে। ছোডু ভাইজান আপনি ভাঙেন।” 

ছোটাচ্চু আরেকটা ডিম হাতে নিল, উল্টেপাল্টে পরীক্ষা করল, তারপর টোকা দিয়ে ভাঙল, এর ভেতর থেকেও টকটকে লাল রক্ত গলগল করে বের হয়ে এলো। 

ঝুমু খালা একটা আর্তচিৎকার করে আরও পিছিয়ে যায় এবং তখন পিছন দিকে বাচ্চাদের হাসির শব্দ শোনা যায়। 

দাদি বললেন, “বলেছি না এটা বাচ্চাদের কাজ—তাই এরা হাসছে।” 

ঝুমু খালা চোখ পাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তোমরা করেছ?” 

সবাই হি হি করে হাসতে হাসতে মাথা নাড়তে থাকে। 

ছোটাচ্চু একটা একটা করে সবগুলো ডিম ভাঙল। প্রত্যেকটার ভেতরে টকটকে লাল রক্ত—এতক্ষণে সবাই বুঝে গেছে যে এগুলো আসলে রক্ত নয়, লাল রং। 

ছোটাচ্চু শেষ ডিমটা না ভেঙে হাতে নিয়ে ডাইনিং টেবিলে এসে সেটাকে গভীর মনোযোগ দিয়ে পরীক্ষা করতে থাকে। সন্দেহজনক কিছু না পেয়ে বাচ্চাদের জিজ্ঞেস করল, “তোরা বলবি, কেমন করে এটা করেছিস?” 

টুম্পা বলল, “তুমি ডিটেকটিভ তুমি বল।” 

ছোটাচ্চু মাথা চুলকালো, বলল, “বুঝতে পারছি না।” 

শান্ত গম্ভীর হয়ে বলল, “বলা যাবে না ছোটাচ্চু। এটা হচ্ছে ট্রেড সিক্রেট!” 

মুনিয়া বলল, “আমি জানি। সিরিঞ্জ দিয়ে কুসুম বের করে রং ঢুকিয়ে দিয়েছে।” 

শান্ত মুনিয়ার মাথায় চাটি দিয়ে বলল, “পাজি মেয়ে বলে দিলি কেন?” 

ছোটাচ্চু বলল, “কিন্তু বোঝা যাচ্ছে না। কোনো ফুটো নেই।”

“পরে একটু মোম দিয়ে সিরিঞ্জের ফুটোটা বন্ধ করা হয়েছে। নিখুঁত কাজ ছোটাচ্চু।” 

দাদি বললেন, “তোদের দুষ্টুমি প্রতিযোগিতা শেষ হয়েছে?” 

বাচ্চারা কেউ কোনো কথা না বলে মিটিমিটি হাসতে লাগল। শারমিন খালা ভয় পাওয়া গলায় বললেন, “তার মানে এখনও কিছু একটা বাকি আছে।” 

সবাই মাথা ঘুরিয়ে প্রথমে শান্ত, তারপর ধ্রুবের দিকে তাকাল। ধ্রুব একদৃষ্টে উপরে সিলিং ফ্যানটির দিকে তাকিয়ে আছে। একটু শীত পড়ে গেছে বলে ফ্যানটা বন্ধ। শারমিন খালা ভয়ে ভয়ে ধ্রুবকে জিজ্ঞেস করলেন, “কী দেখিস?” 

“ফ্যান। আমি আগে কখনে ফ্যান দেখি নাই।” 

ঝুমু খালা অবাক হয়ে বলল, “তোমাগো বাসায় ফ্যান নাই?”

“নাহ!” একটু পর জিজ্ঞেস করল, “ফ্যান চালালে বাতাস কি নিচের দিকে আসে নাকি উপর দিকে যায়?” 

ঝুমু খালা হেসে বলল, “এইটা আবার কীরকম কথা? বাতাস উপর দিকে যাবে কেমনে?” 

ধ্রুব বলল, “আমাকে একটু চালিয়ে দেখাবে?” 

“হ্যাঁ। এই দেখ।” বলে ঝুমু খালা গিয়ে ফ্যান চালাল। 

.

তখন যা একটা কাণ্ড ঘটল সেটা বলে বোঝানো সম্ভব নয়। ফ্যানের পাখার উপর প্রচুর পরিমাণ ময়দা রাখা ছিল। ফ্যানের পাখা ঘোরার সাথে সাথে সেটি উড়ে যেতে শুরু করে—স্বাভাবিক নিয়মে সেটা উপর থেকে নিচে সবার মাথার উপর পড়ার কথা। কিন্তু সেটি না ঘটে আরও ভয়ংকর ব্যাপার ঘটতে থাকল—ময়দা উপরে উড়ে পাক খেতে খেতে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে—যারা নিচে ছিল তার চিৎকার করতে থাকে, হুটোপুটি করতে থাকে, নিজেকে আড়াল করতে থাকে এবং ছোটাছুটি করতে থাকে—আতঙ্কে দিগ্‌ বিদিক জ্ঞান হারিয়ে ধাক্কাধাক্কি করতে থাকে। ময়দায় পুরো ঘর ঢেকে যায়–নিঃশ্বাস নাকের ভেতর ঢুকে যায়—সবাই খকখক করে কাশতে থাকে—শরীরে ময়দা পড়ে একেকজনকে সাদা ভূতের মত দেখাতে থাকে। 

ছোটাচ্চু দৌড়ে গিয়ে ফ্যান বন্ধ করতে গেল কিন্তু ততক্ষণে যা হবার হয়ে গেছে। পুরো ডাইনিং রুমে একটা তুলকালাম কাণ্ড ঘটে গেছে! আতঙ্কের পর্যায়টা কেটে যাবার পর দেখা গেল বড়রা ঠিক যতখানি বিপর্যস্ত হয়েছে, ছোটদের ভিতর ঠিক ততখানি আনন্দ। তারা গলা ফাটিয়ে হাসতে হাসতে মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। 

সবচেয়ে আগে শারমিন খালা নিজেকে সামলে নিলেন, তারপর চিৎকার করে বললেন, “কোথায় গেলি পাজির পা ঝাড়া ধ্রুব, আজকে তোকে যদি আমি খুন করে না ফেলি।” 

যে কারণেই হোক, শারমিন খালার উপর ময়দার আক্রমণটা হয়েছে সবচেয়ে বেশি—তাকে এত অদ্ভুত দেখাচ্ছে যে, এরকম অবস্থায় তার রাগটাকেও কেউ সিরিয়াসলী নিতে পারল না। সবাই হি হি করে হাসতেই লাগল। 

শারমিন খালার পর দাদি নিজেকে সামলে নিলেন। শরীর থেকে ময়দা ঝাড়তে ঝাড়তে বললেন, “যাক, যেটা করার হয়ে গেছে। আরও বাকি আছে, নাকি এইটাই শেষ?” 

শান্ত বলল, “আজকের মত এইটাই শেষ!”

ছোটাচ্চু হুংকার দিয়ে বলল, “আজকের মত না—জন্মের মত এইটাই শেষ।” 

বড় চাচা ভদ্র মানুষ, রাগতে পারেন না, নাকের ভেতর থেকে ময়দা বের করতে করতে বললেন, “মনে হয় একটু মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে।” 

ঝুমু খালা তখনও ফ্যানের দিকে তাকিয়ে আছে, ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল, “কিন্তু আমি বুঝতে পারলাম না এত ময়দা রাখল কেমন করে আর ফ্যানের বাতাস নিচে না এসে উপরে গেল কেমন করে?” 

টুনি বলল, “ভালো করে দেখ ঝুমু খালা। শান্ত ভাইয়া আর ধ্রুব ভাইয়া মিলে ফ্যানের ব্লেডগুলো খুলে উল্টোদিকে লাগিয়েছে। আর এইজন্য এত ময়দা রাখতে পেরেছে।” 

ঝুমু খালা আরো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। জিজ্ঞেস করল, “এখন ফ্যান উল্টা ঘুরে?” 

“না উল্টা ঘুরে না, সোজাই ঘুরে কিন্তু ফ্যানের ব্লেডগুলো এমন করে বাঁকিয়েছে যেন বাতাস নিচের দিকে না এসে উপর দিকে যায়।” 

“কখন করেছে? কীভাবে করেছে?” 

কাল সারা রাত ঘুমায় নাই, দুইজনে মিলে এইগুলো করেছে। 

ঝুমু খালা হতাশভাবে মাথা নাড়ল, বলল, “তার মানে গরমের সময় বাতাস নিচের দিকে আসবে না? উপর দিকে যাবে?” 

টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “মিস্ত্রি ডেকে ঠিক না করলে বাতাস এখন থেকে উপর দিকে যাবে!” 

শারমিন খালা কাঁদো কাঁদো গলায় দাদিকে বললেন, “খালা আমি খুবই সরি ধ্রুব পাজিটা এরকম সর্বনাশ করেছে। এইজন্য আমি এই শয়তানটাকে নিয়ে আসতে চাচ্ছিলাম না।”

টুনি বলল, “শারমিন খালা, ধ্রুব ভাইয়া একা করে নাই, সাথে শান্ত ভাইয়াও ছিল।” 

“যাই হোক, আসল শয়তান হচ্ছে ধ্রুব।” 

শান্ত নিচু গলায় বলল, “না খালা, এইটা আমাদের যৌথ প্রডাকশন। আমরা চিন্তা করে দেখলাম প্রতিযোগিতা থেকে ভালো হচ্ছে সহযোগিতা—পৃথিবীতে বড় কাজ করতে হলে সহযোগিতা করতে হয়। যেমন ধর—” 

ছোটাচ্চু হুংকার দিল, “চুপ কর শান্ত। তোর বক্তৃতা থামা—বড় বড় কথা বলতে হবে না।” 

শারমিন খালা শরীর থেকে ময়দা ঝাড়তে ঝাড়তে দাদিকে (কিংবা নানিকে) বললেন, “খালা, আমি তোমার ঘর পরিষ্কার করে দেব। ঝুমু, আমাকে একটা ঝাড়ু এনে দাও প্লিজ।” 

টুনি বলল, “তোমার ঘর পরিষ্কার করতে হবে না। আমরা সবাই মিলে ঘর পরিষ্কার করে ফেলব।” 

ছোটাচ্চু বলল, “তোরা না হয় ঘর পরিষ্কার করে দিবি। আর আমাদের শরীর পরিষ্কার করে দেবে কে? আমাদের একেকজনের কী অবস্থা হয়েছে দেখেছিস?” 

শান্ত বলল, “তোমাদের শরীর পরিষ্কার করার ব্যবস্থা করে রেখেছি ছোটাচ্চু। তোমরা সবাই ছাদে চল। লাইন ধরে দাঁড়াবে, আমরা হোজ দিয়ে তোমাদের ধুয়ে পরিষ্কার করে দেব।” 

ছোটাচ্চু আবার হুংকার দিল, “ফাজলামি করবি না, খুন করে ফেলব।” 

শারমিন খালা এর মাঝে সত্যি সত্যি টেবিল থেকে ময়দা ঝেড়ে পরিষ্কার করতে শুরু করেছেন। তখন ঝুমু খালা তাকে সরিয়ে বলল, “আপনি সরেন। আমি দুই মিনিটে পরিষ্কার করে ফেলব। এই বাচ্চাদের কাম কাজে আমার অভ্যাস আছে।” তারপর উপরের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি খালি এই আজব ফ্যানটা আরেকবার দেখতে চাই। যদি আটা ময়দা থাকে নিচে ফেলে দিতে হবে।” 

সবাই উপর দিকে তাকাল। একটা অতি নিরীহ টিকটিকি নিচের উত্তেজনার খবর জানে না, সেটি গুটি গুটি পায়ে ফ্যানটার দিকে এগিয়ে আসছে। সেটাকে দেখে ধ্রুব হঠাৎ আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল, “এটা কী?” 

কয়েকজন ধ্রুবের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কোনটা?” 

ধ্রুব হাত দিয়ে দেখায়, “ঐ যে ঐ যে—” 

মুনিয়া একগাল হেসে বলল, “ঐটা টিকটিকি! তুমি কখনো টিকটিকি দেখ নাই?” 

ধ্রুব ফ্যাকাশে হয়ে যায়। বলে, “ঘরের ভেটড়ে টি-টি-টিকটিকি?” 

ঝুমু খালা তখন ফ্যানটা চালু করল, ফ্যানের পাখা জোর করে বাঁকানো হয়েছে, লাগানো হয়েছে উল্টোভাবে। সেটা বিচিত্র শব্দ করে কাঁপতে কাঁপতে ঘুরতে থাকে, একটা বাতাসের ঝাপটা নিচের দিকে না এসে উপর দিকে গিয়ে বেচারা টিকটিকিকে উড়িয়ে নেয়, সেটি ছিটকে নিচে এসে পড়ে। 

ধ্রুবের অবস্থা হল দেখার মত, সে আতঙ্কে চিৎকার করে ছুটে যেতে গিয়ে আছাড় খেয়ে পড়ল এবং টিকটিকিটা ঠিক তার গলার মাঝে পড়ে প্রাণ বাঁচানোর জন্যে শার্টের গলা দিয়ে তার পেটের দিকে ছুটে গেল। 

ধ্রুব চিৎকার করে দাপাদাপি করে তার শার্টটা টেনে খুলে ফেলার চেষ্টা করে—সব বোতাম ছিঁড়ে তার শার্ট খুলতে খুলতে ভীত আতঙ্কিত টিকটিকি তার পেটের উপর থেকে বগলের দিকে ছুটে যায়—ধ্রুব সেটাকে সরানোর চেষ্টা করে, ঝাপটাঝাপটি এবং খাবলাখাবলিতে টিকটিকির লেজটা খসে পড়ল, লেজবিহীন টিকটিকি তার লেজের মায়া ত্যাগ করে প্রাণ নিয়ে পালাল এবং লেজটা ধ্রুবের পেটের উপর তিড়িং তিড়িং করে নাচতে লাগল। সেটার দিকে তাকিয়ে ধ্রুব গগনবিদারী চিৎকার দিতে থাকে। 

মুনিয়া গিয়ে লেজটা ধরে সরিয়ে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “ও মা! তুমি টিকটিকিকে ভয় পাও?” 

কোনো কথা না বলে ধ্রুব হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। 

.

শারমিন খালা ধ্রুবকে নিয়ে ছয় সপ্তাহ দেশের আনাচেকানাচে ঘুরে বেড়িয়েছেন। পুরো সময়টিতে ধ্রুব বিন্দুমাত্র দুষ্টুমি করার চেষ্টা করেনি একটা টিকটিকি যে ধ্রুবের মাঝে এত বড় পরিবর্তন আনতে পারে, সেটা শারমিন খালা স্বপ্নেও চিন্তা করেন নাই! 

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন