১০. মারনেপতহর শিলালিপি

খন্দকার মাশহুদ-উল-হাছান

মারনেপতাহর শিলালিপি

মারনেপতাহর এই শিলালিপিটি আবিষ্কারের সাথে সাথেই সর্বত্র সাড়া পড়ে যায়। এই শিলালিপিটি মারনেপোহর রাজত্বের পঞ্চমবর্ষে উকীর্ণ হয়েছিল। উল্লেখ্য যে, উল্কীর্ণ এই শিলালিপির বক্তব্য তুলে ধরে অনেক সমালোচক উপরে বর্ণিত ‘দুই ফেরাউনের থিওরি’র বিরোধিতা করেন।

তাঁরা আরো বলেন, ইহুদীদের মিসরত্যাগের সাথে সাথেই যে মারনেপোহর রাজত্বের অবসান ঘটেছিল, তা নয়।

এই শিলালিপিটি সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, এটি সাংকেতিক চিত্রাক্ষরে লিপিবদ্ধ একমাত্র দলিল যেখানে ‘ইসরাইল’ শব্দটি বিদ্যমান। তাছাড়া, এই শব্দটির পর জাতিবাচক এমন শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে, যা থেকে নিঃসন্দেহে বলা চলে যে, ইসরাইল’ বলতে একটি দল বা সম্প্রদায়কেই বোঝানো হয়েছে। আগেই বলা হয়েছে, মারনেপোহর রাজত্বের পঞ্চমবর্ষে এই শিলালিপিটি উত্তীর্ণ হয়েছিল। এটি আবিষ্কৃত হয় থেবস মন্দিরে–এটি হচ্ছে ফেরাউনদের শেষকৃত্যের স্থান। মারনেপতাহ্ কিভাবে পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলোর উপর একের পর এক বিজয় অর্জন করেছেন, এই শিলালিপিতে তার উল্লেখ রয়েছে। বিশেষত, শিলালিপির শেষদিকে উৎকীর্ণ এক বিজয় বিবরণীতে বলা হয়েছে : “ইসরাইলকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করা হয়েছে, তাদের জড়গোষ্ঠী পর্যন্ত নির্মূল …।” এই বক্তব্য তুলে ধরা সমালোচকেরা বলছেন, এখানে যেহেতু ইসরাইল শব্দটি রয়েছে, সেহেতু ধরে নেয়া যায় যে, মারনেপতার রাজত্বের পাঁচ বছর পূর্তির আগেই ইহুদীরা কেনানে বসতি স্থাপন করেছিল। এরদ্বারা নাকি এটাও বোঝা যায় যে, ইহুদীদের মিসর ত্যাগের ঘটনা ঘটে গিয়েছিল এর আগেই।

কিন্তু সমালোচকবর্গের এই যুক্তি ধোঁপে টেকে না। কেননা, তাদের আপত্তিটা গড়েই উঠেছে কল্পিত একটা ধারণাকে কেন্দ্র করে। আর সেই ধারণাটা হল, কোনো ইহুদী কেনানে বসবাস করত না, তাদের বসবাস ছিল শুধু মিসরেই। ফাদার ডি ভক্সকে আমরা জানি, ফেরাউন হিসেবে দ্বিতীয় রামেসিস এর সমর্থক। তিনি (তাঁর ‘দি এনসিয়েন্ট হিস্ট্রি অব ইসরাইল পুস্তকে) বলছেন, “দক্ষিণ দিকে কাঁদেশ এলাকায় ইসরাইলীদের বসতিস্থাপনের যে কথাটা বলা হচ্ছে তা অস্পষ্ট। সময়টা ইহুদীদের মিসরত্যাগের আগেই হবে।” এরদ্বারা তিনি সেই সম্ভাবনার কথাই স্বীকার করেছেন যে, হযরত মুসা এবং তাঁর অনুসারীরা মিসরত্যাগের আগেও ইহুদীদের কোনো কোনো দল মিসর ত্যাগ করে যেতে পারে। ‘আপিরু’ বা ‘হাবিরু’ যাদের কখনো কখনো হিব্রু বা ইসরাইলী বলে ধরা হয়ে থাকে তারা দ্বিতীয় রামেসিসের আমলের আগে এবং ইহুদীদের মিসরত্যাগের বহুপূর্ব থেকেই সিরিয়া-ফিলিস্তিন এলাকায় বসবাস করছিল। আমাদের নিকট এমন দলিল রয়েছে যাতে প্রমাণ হয়, জবরদস্তি মূলকভাবে মিসরে শ্রমিকের কাজ করার জন্য মিসররাজ দ্বিতীয় আমেনোফিস ৩৬০০ জন যুদ্ধবন্দীকে মিসরে ধরে এনেছিলেন। বাদবাকি ইহুদীরা প্রথম সেথোসের আমলেও কেনানে ছিল এবং সেখানে তারা বেশিন এলাকায় গোলযোগ সৃষ্টি করেছিল। পি. মতেঁ তার ‘ইজিপ্ট অ্যান্ড দি বাইবেল’ গ্রন্থে সেকথাই স্মরণ করিয়ে দেন। সুতরাং, সত্য হিসেবে এটাই ধরে নিতে হয় যে, মারনেপতাহহ্ তার রাজ্যের সীমান্তস্থিত এই বিদ্রোহী-ইহুদীদের কঠোরভাবে দমন করেছিলেন। কিন্তু ওদিকে মিসরের অভ্যন্তরে যেসব ইহুদী ছিল, তারা পরে হযরত মুসার নেতৃত্বে মিসরত্যাগের জন্য জোরদার আন্দোলন শুরু করে দেয়। সুতরাং, মারনেপতাহহর রাজত্বের পঞ্চমবর্ষে উত্তীর্ণ এই শিলালিপিটি দুই ফেরাউন অথবা ‘মারনেপতাহ’র শেষ ফেরাউন হওয়ার তত্ত্ব নস্যাৎ করে দিতে পারে না।

তাছাড়া, শিলালিপিতে শুধু ‘ইসরাইল’ শব্দটার অস্তিত্ব হযরত মুসা ও তাঁর লোকজনের কোনে বসতিস্থাপনের দলিল হতে পারে না। ইহুদী জাতির ইতিহাস এ কথাই বলে। শিলালিপিতে উত্তীর্ণ ‘ইসরাইল’ শব্দটার উপর এমন শব্দ রয়েছে যার দ্বারা নিঃসন্দেহে ‘জনগণ’ বোঝায়। দেশ”-সূচক কোনো শব্দ সেখানে ব্যবহৃত হয়নি। শিলালিপিতে ব্যবহৃত অন্যান্য নামবাচক বিশেষ্যের ক্ষেত্রেও এটি লক্ষণীয়। এটি হল জেরুজালেম বাইবেল শিক্ষায়তনের অধ্যাপক ফাদার ডি কুরিয়ারের অভিমত, এটি প্রকাশ পেয়েছে তাঁর রচিত বাইবেলের যাত্রাপুস্তকের ভাষ্যে (প্যারিস, ১৯৬৮, পৃষ্ঠা ১২)। ‘ইসরাইল’ শব্দটির মূল এরূপঃ

বাইবেলের আদিপুস্তক অনুসারে ‘ইসরাইল’ হল হযরত ইয়াকুবের দ্বিতীয় নাম। হযরত ইয়াকুব হযরত ইসহাকের পুত্র এবং হযরত ইবরাহীমের পৌত্র। ইকুনেমিক্যাল ট্রান্সলেশন অব দি বাইবেল–এন্ড টেস্টামেন্ট’-এর (১৯৭৫) সুবিজ্ঞ লেখকবৃন্দ মনে করেন, ইসরাইল শব্দের অর্থ সম্ভবত “আল্লাহ নিজ শক্তির প্রকাশ ঘটিয়েছেন।” যদিও এটি একজন লোকের নাম, তথাপি একজন বিশিষ্ট পূর্ব-পুরুষের স্মরণে তার বংশের লোকদের অথবা তার সম্প্রদায়কে এ নামে অভিহিত করা বা তাদের এ নামে বিশেষিত হওয়াটা মোটেও বিচিত্র নয়। কোরআনে ইসরাইলীদের প্রায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বনী ইসরাইল বা ইসরাইলের বংশধর বলা হয়েছে।

সুতরাং, ‘ইসরাইল’ নামটি হযরত মুসার বহু আগে, আরো সঠিকভাবে বলতে গেলে, কয়েক শতবছর আগে থেকেই প্রচলিত ছিল। সে কারণে ফেরাউন মারনেপতাহহর শিলালিপিতে এই নাম থাকাটা আশ্চর্যের কিছু নয়। তাছাড়া, ঐ শিলালিপিতে এই নাম থাকায় এটাও বোঝায় না যে, ইহুদীদের মিসরত্যাগের ঘটনাটা ঘটেছিল মারপেতাহর রাজত্বের পঞ্চমবর্ষের আগেই।

শিলালিপির ওই শব্দটা বড়জোর এমন এক জনগোষ্ঠীকে বোঝাতে পারে–যারা ‘ইসরাইল’ নামে পরিচিত ছিল। তদুপরি মারনেপতাহহর শিলালিপির ওই নামের দ্বারা রাজনৈতিকভাবে সুসংগঠিত ওই নামের কোনো জনপদ বোঝানোও সম্ভব নয় …। ওই শব্দের দ্বারা এমন একটি জনগোষ্ঠীকেই বরং বোঝানো হয়ে থাকবে, যারা রাজনৈতিকভাবে ছিল অসংগঠিত।…

সকল অধ্যায়

১. ০১. ভূমিকা নয়, সূচনা
২. ০২. মধ্যযুগীয় কাব্য-কাহিনী বনাম সুসমাচার কাহিনী
৩. ০৩. যীশুকে গ্রেফতারের বিস্তারিত বিবরণ
৪. ০৪. ভূমিকার বদলে
৫. ০৫. তুলনামূলক আলোচনা : কোরআন ও বাইবেল
৬. ০৬. ইহুদীদের মিসরত্যাগ
৭. ০৭. ধর্মগ্রন্থের বর্ণনা : আধুনিক তথ্যজ্ঞান
৮. ০৮. ফেরাউনদের ইতিহাসের নিরিখ
৯. ০৯. দ্বিতীয় রামেসিস ও মারনেপতাহহ
১০. ১০. মারনেপতহর শিলালিপি
১১. ১১. ফেরাউনের মৃত্যু : ধৰ্মীয়-গ্রন্থের আলোকে
১২. ১২. ফেরাউন মারনেপতাহর মমি
১৩. ১৩. কোরআন, হাদীস ও আধুনিক বিজ্ঞান
১৪. ১৪. সাধারণ আলোচনা ও বাইবেল পুরাতন নিয়ম
১৫. ১৫. বাইবেলের আদি উৎস প্রসঙ্গে
১৬. ১৬. পুরাতন নিয়মের পুস্তকাবলী
১৭. ১৭. তওরাত-এর পঞ্চপুস্তক
১৮. ১৮. বিভিন্ন নবীর কিতাবসমূহ
১৯. ১৯. গীত-সংহিতা ও হিতোপদেশ পুস্তক
২০. ২০. বৈজ্ঞানিক বিচারের ফলাফল
২১. ২১. বাইবেলের দ্বিতীয় বর্ণনা
২২. ২২. বৈজ্ঞানিক আলোচনায় মানব-সৃষ্টি : ডারউইনের বিবর্তনবাদ
২৩. ২৩. সৃষ্টিতত্ত্ব : আদিপুস্তক
২৪. ২৪. এককালের একমাত্র ঐতিহাসিক স্বীকৃত দলিল
২৫. ২৫. কোরআনের আলোকে : মানব-সৃষ্টি
২৬. ২৬. কোরআন ও বিজ্ঞান
২৭. ২৭. সৃষ্টিতত্ত্ব ও কোরআন
২৮. ২৮. মানব-সৃষ্টিতত্ত্ব প্রসঙ্গ
২৯. ২৯. ধর্মীয় ও জাগতিক তাৎপর্যবহ কোরআন
৩০. ৩০. কোরআনের আলোকে জীবনের সূচনা
৩১. ৩১. কোরআনে বর্ণিত মানব-সৃষ্টির বর্ণনা
৩২. ৩২. কোরআনের মতে মানুষ, মৃত্তিকা ও পানি
৩৩. ৩৩. মানুষের দৈহিক পরিগঠন
৩৪. ৩৪. সাংগঠনিক পরিকল্পনা
৩৫. ৩৫. ক্রমবিকাশের ধারা : জিন-এর ভূমিকা
৩৬. ৩৬. প্রসঙ্গ কোরআন-এ প্রজনন : প্রজন্ম : রূপান্তর
৩৭. ৩৭. বিজ্ঞানের আলোকে : মানব-প্রজনন
৩৮. ৩৮. প্রসঙ্গ : সংমিশ্রিত বীর্য
৩৯. ৩৯. ডিম্বাণুর রোপণ প্রক্রিয়া
৪০. ৪০. মানুষের পরিবর্তন : বিবর্তন ও রূপান্তর
৪১. ৪১. ধর্ম ও বিজ্ঞান : উপসংহার

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন