০৩. মামার মাইক্রোবাসে উঠছি

মুহম্মদ জাফর ইকবাল

০৩.

ভোর বেলা যখন রওনা দেওয়ার জন্য আমি আমার ব্যাগ নিয়ে মামার মাইক্রোবাসে উঠছি তখন সবাই আমাকে বিদায় দেওয়ার জন্য নিচে নেমে এলো। মিঠুন তার অভ্যাসমতো কয়েকবার নাকী গলায় বলল, “আঁমিও যাব। ভাইয়ার সাথে আমিও যাব। আঁ অ্যাঁ।” কেউ তার কথাকে কোনো গুরুত্ব দিল না, তখন সে চুপ করে গেল। আপু কোনো কথা না বলে মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে রইল। আমি যখন ঠিক মাইক্রোবাসে উঠব তখন আপু জিজ্ঞেস করল, “টোপন, বাথরুম করেছিস?”

আমি গম্ভীর মুখে বললাম, “করেছি।”

“ছোটটা না বড়টা?”

আমি না শোনার ভান করে মাইক্রোবাসে উঠে গেলাম। আম্মু এসে গাড়ির জানালা দিয়ে হাত ঢুকিয়ে আমার মাথায় শরীরে হাত বুলিয়ে প্রায় কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, “বাবা সাবধানে থাকিস। সহি সালামতে ফিরে আসিস।” তারপর হাত ধরে বললেন, “ফী আমানিল্লাহ। ফী আমানিল্লাহ।” সব শেষে আরো কিছু দোয়া দরুদ পড়ে আমাকে ফুঁ দিলেন।

আম্মুর কথা এবং ভাবভঙ্গী দেখে মনে হতে থাকে আমি বুঝি পাকিস্তানিদের সাথে যুদ্ধ করার জন্য মুক্তিযুদ্ধে যাচ্ছি। আব্বু আম্মুর মতো এতো কিছু করলেন না। শুধু গম্ভীর মুখে বললেন, “টোপন। তোর মামাকে বেশি জ্বালাবি না।”

আমি মাথা নাড়লাম, মামা ড্রাইভারের সিটে বসল তারপর হাত নেড়ে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মাইক্রোবাসটা স্টার্ট করে দিল। আমরা দেখতে দেখতে বাসার সামনের গলিটা পার হয়ে বড় রাস্তায় উঠে গেলাম। এখনো অনেক ভোর তাই রাস্তার দুই পাশের দোকানপাট বেশিরভাগ বন্ধ, রাস্তাও মোটামুটি ফাঁকা। বড় রাস্তা ধরে কিছুদূর এগিয়ে যখন হাইওয়েতে ওঠার জন্য রওনা দিয়েছি তখন আমি তলপেটে চাপ অনুভব করলাম, বুঝতে পারলাম আমার বাথরুম পেয়েছে। মাত্র বাথরুম করে আমি মাইক্রোবাসে উঠেছি কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি আবার বাথরুম পেয়ে গেল? কী আশ্চর্য! আমি জোর করে বাথরুম চেপে বসে রইলাম।

মামা যখন মাইক্রোবাসটা চালিয়ে হাইওয়েতে উঠেছে তখন আমি আবিষ্কার করলাম, শুধু যে বাথরুম পেয়েছে তা নয়। আমার খিদেও পেয়েছে। অথচ গাড়িতে ওঠার আগে আমি রীতিমতো জোর করে জেলি আর মাখন দিয়ে দুই টুকরা রুটি, একটা কলা, একটা ডিম পোচ আর আধ গ্লাস দুধ খেয়েছি। এতো কিছু খাওয়ার পর একজন মানুষের এতো তাড়াতাড়ি খিদে পায় কেমন করে? কী আশ্চর্য!

মামা গুন গুন করে গান গাইতে গাইতে গাড়ি চালাচ্ছে। মামার গলায় কোনো সুর নাই গানের কথাগুলিও জানে না তাই তার গানের কোনো আগা মাথা নাই কিন্তু সেই জন্য মামার কোনো সমস্যা হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না, মামা বেশ মন দিয়েই গান গেয়ে যাচ্ছে। এক সময় গান থামিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল “কী খবর টোপন? এতো চুপচাপ কেন?”

আমি তো আর বলতে পারি না, বাথরুম পেয়েছে এবং খিদে লেগেছে তাই একটু অস্পষ্ট শব্দ করে নড়েচড়ে বসলাম। মামা জিজ্ঞেস করল “বাসার জন্য মন খারাপ লাগছে? এখনো সময় আছে বল, গাড়ি ঘুরিয়ে নামিয়ে দিয়ে আসি।”

আমি জোরে জোরে মাথা নেড়ে বললাম, “না, না, মন খারাপ লাগছে না।”

“তাহলে প্যাঁচার মতো মুখ বন্ধ করে বসে আছিস কেন?”

প্যাঁচা আসলেই মুখ বন্ধ করে থাকে কী না সেটা নিয়ে কথা বলা যায় কিন্তু আমি লজ্জার মাথা খেয়ে শেষ পর্যন্ত বলেই ফেললাম, “আসলে একটু বাথরুম পেয়েছে তো”

“বাথরুম পেয়েছে?” মামা যথেষ্ট অবাক হলো কিন্তু সেটা প্রকাশ করল না। জিজ্ঞেস করল, “ছোটটা না বড়টা?”

“এখন ছোটটা হলেই হবে।”

“ইমার্জেন্সি? গাড়ি থামাব? ঐ গাছের পিছনে করে আসবি?”

আমার যে অবস্থা যে গাছের পিছনে নয় সামনেই করে ফেলতে পারি কিন্তু মামা তখন নিজেই বলল “দাঁড়া, সামনে একটা পেট্রল পাম্প দেখা যাচ্ছে। আমার তেলও নিতে হবে। এক ঢিলে দুই পাখি।”

আমি চিঁ চিঁ করে বললাম, “তিন পাখিও হতে পারে।”

মামা অবাক হয়ে বলল, “তিন পাখি?”

 “হ্যাঁ। কেন জানি খুব খিদে পেয়ে গেছে।

 মামা চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকায়, কিছু বলল না।

মামা পেট্রল পাম্পে তার মাইক্রোবাস থামাল এবং তারপর যথেষ্ট হই চই করে তিনটা পাখি মারা হলো। মামা পেট্রোল নিল, আমি হিস্যু করলাম। তারপর আমি পেট্রোল পাম্পের পাশে ছোট রেস্টুরেন্ট থেকে ডিম পরটা খেলাম। আমার পেটের মাঝে কোথায় এতো জায়গা ছিল কে জানত?

এইবারে যখন আবার রওনা দিয়েছি তখন আমি যথেষ্ট চাঙ্গা। পেট ভরা এবং তলপেট খালি, কাজেই মন মেজাজ ভালো হতেই পারে। আমি রাস্তার দুই পাশের দৃশ্য দেখতে দেখতে মামার সাথে গল্প করতে থাকি।

মামা তার বেসুরো গান গাইতে গাইতে হঠাৎ থেমে গিয়ে বলল, “তোকে একটা জিনিস সাবধান করে দিই।”

“কী জিনিস মামা?”

“এই দেশের মানুষের কৌতূহল খুব বেশি। দেখবি সবাই একশ রকম জিনিস জিজ্ঞেস করবে। বাড়ি কই, কী করি, কতো টাকা কামাই করি, বিয়ে করেছি কি না- এরকম হ্যাঁনো ত্যানো হাবি জাবি একশ জিনিস। উত্তর দিতে কোনো সমস্যা নাই– শুধু একটা জিনিস বলা যাবে না।”

‘কী বলা যাবে না?”

“আমি আসলে কী করছি। ইউরেনিয়াম খুঁজছি এটা বলা যাবে না।”

“কেন মামা?”

“কারণ এটা সিক্রেট। ইউরেনিয়াম অসম্ভব স্ট্র্যাটেজিক এলিমেন্ট। সারা পৃথিবীর নজর ইউরেনিয়ামের জন্য। আসলেই যদি পেয়ে যাই আর জানাজানি হয়ে যায় সর্বনাশ হয়ে যাবে!”

এরকম একটা ভয়ংকর প্রজেক্টের আমি অংশ হয়ে গেছি চিন্তা করেই আমি উত্তেজিত হয়ে উঠি। নিজেকে হলিউডের সিনেমার নায়ক নায়ক মনে হতে থাকে। আমি গম্ভীর হয়ে বললাম, “তুমি কোনো চিন্তা করো না মামা, আমি মরে গেলেও কাউকে কিছু বলব না।”

“তাহলে কী বলবি সেটা ঠিক করে রাখ।”

“কিছুই বলব না। চুপ করে থাকব। বলব সিক্রেট প্রজেক্ট।”

মামা মাথা নাড়লেন, বলল, “উঁহু। কিছু একটা বলতে হবে।”

আমি মাথা চুলকে বললাম, “বলব, গুপ্তধন খুঁজছি। একজন জলদস্যু মাটির নিচে সোনাদানা পুতে রেখেছিল সেটা খুঁজছি।”

মামা হাসল, বলল, “ইন্টারেস্টিং! কিন্তু তখন আরো একশ প্রশ্ন করবে। জলদস্যু পানিতে না রেখে শুকনার মাঝে কেন সোনাদানা পুতে রেখেছে? জলদস্যুর নাম কী? বাড়ি কোথায়? বউ কয়টা? ছেলেপিলে আছে? এই দেশের মানুষের কৌতূহলের কোনো মা বাপ নাই।”

আমি আবার মাথা চুলকালাম, তারপর বললাম, “তাহলে বলতে পারি ডাইনোসরের হাড্ডি গুড্ডি খুঁজছি।”

“হাড্ডি গুড্ডি? মানে ফসিল?”

আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, “হ্যাঁ ফসিল। বলব ডাইনোসরের ফসিল খুঁজছি।”

মামা মুখ সূচালো করে কিছু একটা চিন্তা করল, তারপর বলল, “উঁহু। এটা পলি মাটির দেশ, ডাইনোসরের ফসিল পাওয়ার কথা না। জানাজানি হলে পত্রিকায় আর্টিকেল উঠে যাবে। লিখবে, বিজ্ঞানের নামে অর্থের অপচয়। দুর্নীতিবাজ বিজ্ঞানীর প্রতারণা। বেইজ্জতি ব্যাপার হবে।”

আমি আবার মাথা চুলকালাম। কোনো একটা কিছু চিন্তা করতে কেন মাথা চুলকায় কে জানে। এটা নিয়েও নিশ্চয়ই গবেষণা হয়েছে। মাথা চুলকাতে চুলকাতে শেষ পর্যন্ত একটা আইডিয়া বের হলো। বললাম, “বলতে পারি যে পরিবেশ দূষণ নিয়ে গবেষণা হচ্ছে। মাটি তুলে তুলে পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে এর ভিতরে আলতু ফালতু কেমিক্যাল আছে না নাই।”

মামা মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ। এইটা বলা যায়। আজকাল পরিবেশ দূষণ খুব হট যাচ্ছে। গুড আইডিয়া।”

আমি একটা গুড আইডিয়া দিতে পেরেছি সেইজন্য আমার রীতিমতো অহংকার হতে লাগল। অহংকারের জন্যই কি না কে জানে, নাকি চিন্তা করার জন্য আমার একটু পরে আবার খিদে পেয়ে গেল। মামার নিজেরও একটু চা খাওয়ার ইচ্ছা করতে লাগল। তাই আমরা আবার থামলাম। মামা চা খেলো আর আমি আস্ত একটা হ্যামবার্গার খেয়ে ফেললাম।

আমরা এইভাবে যেতে থাকি। প্রতি দুই ঘণ্টা পর পর মামা তার মাইক্রোবাস থামিয়ে হাত পা নাড়িয়ে শরীরের আড়মোড়া ভাঙ্গে, তারপর কড়া লিকারের চা খায়। আমি অবশ্যি চা কফি খাই না সত্যিকারের খাবার খাই। একবার একটা ক্রিমরোল খেলাম, আরেকবার দই মিষ্টি আরেকবার গরম জিলাপি, আরেকবার চিকেন প্যাটিস মামা পর্যন্ত আমার খাওয়া দেখে অবাক হয়ে গেল। আমার মনে হতে লাগল বিজ্ঞানের গবেষণায় যখন এতো আনন্দ আমি বড় হয়ে বিজ্ঞানী হয়ে যাই না কেন?

.

মামা কোথায় যাবে আগে থেকে ঠিক করে রেখেছে। হাওড়ের একপাশে নদী, অন্য পাশে একটা টিলা, মোটামুটি নির্জন জায়গা তাই দিনের আলো থাকতে থাকতে মামা পৌঁছে যেতে চাইছে। মামা ঘড়ি দেখল, তার জিপিএস দেখল তারপর সময় বাঁচানোর জন্য মাইক্রোবাসের স্পিড বাড়িয়ে দিল। একটা ছোট শহর পার হয়ে আমরা পনেরো কুঁড়ি মিনিট গিয়েছি তখন হঠাৎ করে রাস্তার পাশে ছোট একটা ভীড় দেখতে পেলাম। জায়গাটা পার হওয়ার সময় দেখলাম রাস্তার পাশে একটা গাড়ি কাত হয়ে আছে। গাড়ির সামনের অংশটা দুমড়ে মুচড়ে গেছে। মনে হলো কয়েকজন রাস্তার পাশে মাটিতে শুয়ে বসে আছে। গাড়ি একসিডেন্ট।

মামা হঠাৎ করে তার মাইক্রোবাসে ব্রেক করল তারপর গাড়ি পিছিয়ে আনতে লাগল। যেখানে গাড়িটা কাত হয়ে পড়ে আছে সেখানে মাইক্রোবাসটা থামালো। মামা তার স্টার্ট বন্ধ করে নেমে আসে, আমিও মামার পিছু পিছু নেমে এলাম। মামা ভীড় ঠেলে ভিতরে ঢুকে গেল, আমিও ঢুকে গেলাম। একজন মানুষ গাছে হেলান দিয়ে বসে আছে, তার মাথার কোথায় জানি কেটে গেছে, হাত দিয়ে সেখানে ধরে রক্ত থামানোর চেষ্টা করছে। মানুষটার পাশে একজন মহিলা, মহিলার চোখে মুখে আতংক, রক্ত বন্ধ করার জন্য কিছু একটা করার চেষ্টা করছে। মিঠুনের বয়সী একটা বাচ্চা তার মাকে ধরে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে। মাঝবয়সী একজন মানুষ মনে হয় গাড়ির ড্রাইভার, ছোটাছুটি করছে, কী করবে বুঝতে পারছে না। তাদের সামনে বেশ কিছু মানুষ, কয়েকজন ছোট বাচ্চাও আছে। সবাই মিলে পুরো দৃশ্যটা দেখছে কিন্তু কেউ কাছে যাচ্ছে না।

মামা কাউকে কিছু জিজ্ঞেস না করে গাছে হেলান দেওয়া মানুষটা এবং তার পাশের মহিলার কাছে এগিয়ে গেল, হাটু গেড়ে বসে জিজ্ঞেস করল, “কী অবস্থা?” কতক্ষণ আগে হয়েছে?”

মানুষটা কোনো কথা বলল না, কেমন যেন শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। মহিলাটা হাহাকারের মতো শব্দ করে বলল, “পাঁচ দশ মিনিট হয়েছে, ট্রাকটা থামে নাই, পালিয়ে গেছে।”

আমরা বুঝতে পারলাম একটা ট্রাক ধাক্কা মেয়ে পালিয়ে গেছে। পত্রিকায় এরকম ভয়ংকর খবর পড়ি, আজকে নিজের চোখে দেখছি।

মহিলাটা থর থর করে কাঁপতে কাঁপতে বলল, “হাসপাতালে নিতে হবে। হাসপাতালে

“মামা বলল, জ্বি, বুঝতে পারছি। নার্ভাস হবেন না। আমি ব্যবস্থা করছি।”

এতক্ষণ সবাই দাঁড়িয়ে মজা দেখছিল, কেউ কিছু করছিল না। মামা প্রথম তাদের সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছে। মহিলাটা এতোক্ষণ কাঁদেনি এবারে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। মাকে কাঁদতে দেখে বাচ্চাটা আরো জোরে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। ব্যথায় না ভয়ে বুঝতে পারলাম না।

মামা বলল, “নার্ভাস হবেন না ম্যাডাম। সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। আপনার কী অবস্থা? হাঁটতে পারবেন?”

মহিলা কান্না থামানোর চেষ্টা করে বলল, “পারব। তারপর উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে পড়ে যাচ্ছিল আমি দৌড়ে ধরে ফেললাম। মহিলা আমাকে ধরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতে থাকে, আমি টের পেলাম মহিলার হাতে চটচটে রক্ত, আমার কাপড়ে লেগে যাচ্ছে। লাগুক।

মামা পকেট থেকে চাবিটা বের করে আমার হাতে দিয়ে বলল, “টোপন। মাইক্রোবাসটার পিছনটা খুলে মেঝেতে তোর বিছানাটা বিছিয়ে ফেল। কুইক।”

আমি বললাম, “ঠিক আছে।”

মামা মহিলাকে ধরলেন, আমি চাবিটা নিয়ে মাইক্রোবাসের দিকে ছুটে গেলাম। আমার পিছু পিছু বেশ কিছু মানুষ মজা দেখার জন্য ছুটে এলো। মাইক্রোবাসের দরজা খুলতেই ভেতরে বিচিত্র সব যন্ত্রপাতি দেখে সবাই বিস্ময়ের শব্দ করে। তারা আরো কাছে গিয়ে দেখতে চায়, যাদের উৎসাহ বেশি তারা হাত ঢুকিয়ে ছুঁয়ে দেখতে চেষ্টা করল।

আমি হুংকার দিয়ে শক্ত গলায় বললাম, “খবরদার। কেউ ভিতরে হাত দিবে না। খবরদার।”

আমার হুংকারে কাজ হলো। সবাই দুই পা সরে গেল। আমি আমার বিছানা খুলে মাইক্রোবাসের নিচে বিছিয়ে দিলাম। মাথার কাছে বালিশ রেখে চাদর দিয়ে ঢেকে আমি অপেক্ষা করতে থাকি।

একটু পরে দেখতে পেলাম মামা আর ড্রাইভার মিলে আহত মানুষটাকে ধরে ধরে নিয়ে আসছে। মাইক্রোবাসের ভিতরে তাকে শুইয়ে দিয়ে মামা আমাকে বলল, “টোপন। তুই এখানে থাক।”

একজন আহত মানুষ, মাথা থেকে দরদর করে রক্ত পড়ছে। তার সাথে থাকতে আমার ভয় করছিল কিন্তু সেটা তো আর বলতে পারি না তাই মাথা নেড়ে বললাম, “ঠিক আছে মামা।”

মহিলা নিজেই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলে এসেছে, মামা তাকে বলল, “আপনি আপনার ছেলেকে নিয়ে সামনে বসেন।”

“আর জাহিদ? জাহিদ?” বুঝতে পারলাম আহত মানুষটার নাম জাহিদ।

“টোপন দেখবে। টোপন অনেক রেসপন্সিবল। চিন্তা করবেন না।”

মামা আমাকে ‘রেসপন্সিবল’ বলছে কাজেই আমাকে এখন দায়িত্ব নিতেই হবে। আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, “আপনি চিন্তা করবেন না, আমি দেখে রাখব।”

মহিলা কাঁপা গলায় বলল, “অনেক ব্লিডিং হচ্ছে।”

“এক্ষুণি হাসপাতালে নিব। আমি একটা হাসপাতাল দেখে এসেছি। বেশ বড় মনে হলো। তবু একবার জিজ্ঞেস করে নিব। আপনি ওঠেন।”

ভদ্রমহিলা ছেলেকে নিয়ে সামনের সিটে বসলেন। বাচ্চাটা এখন কান্না বন্ধ করেছে। মাঝে মাঝে একটু পরে পরে শুধু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে উঠছে। মামা দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোকে জিজ্ঞেস করল, “এখানে কাছাকাছি হাসপাতাল কোথায়?”

কোন হাসপাতাল কাছে, কোনটা দূরে, কোনটা ভালো কোনটা খারাপ কোথায় টাকা বেশি লাগে কোথায় কম লাগে সেটা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়ে গেল। তখন একজন মাতবর টাইপের মানুষ মামাকে বলল, “আপনি কাজটা ঠিক করলেন না।”

মামা অবাক হয়ে বলল, “কোন কাজটা ঠিক করলাম না?”

“এই যে এসকিডেন্টের রোগী টানাটানি করতেছেন।” মানুষটা এক্সিডেন্ট বলতে পারে না, বলেছে এসকিডেন্ট!

“কী হয় এসকিডেন্টের রোগী টানাটানি করলে?” মামাও এক্সিডেন্ট না বলে বলছে এসকিডেন্ট, মাতবর অবশ্য এই ঠাট্টাটা বুঝতে পারল না।

“পুলিশের ঝামেলায় পড়বেন। পুলিশ আপনারে নিয়া টানাটানি করবে। আপনার জান শ্যাষ হইয়া যাইব।”

“তাই নাকি?”

মাতবর টাইপের মানুষটা বলল, “আর রোগী যদি মরে তাইলে আপনি মার্ডার কেইসের আসামী। হয় ফাঁসি নাহলে চৌদ্দ বছর জেল।”

মামা মাথা নাড়ল, বলল, “দোয়া করি আপনি একদিন একসিডেন্টে রাস্তার সাইডে হাত পা ভেঙে পড়ে থাকেন। মাথা ফেটে একটু ঘিলু বের হয়ে থাকে। তখন একজন যখন আপনারে হাসপাতালে নিতে আসবে তখন যেন অন্য মানুষেরা আপনারে হাসপাতালে নিতে না দেয়। আপনি রাস্তার সাইডে যেন পড়ে থাকেন। কেউ যেন আপনাকে সাহায্য করতে না আসে।”

মাতবর টাইপের মানুষটা কেমন যেন ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। বলল, “এইটা আপনি কী বলেন?”

“সত্যি কথা বলি।”

মামা আর কোনো কথা না বলে ড্রাইভিং সিটে বসে মাইক্রোবাসটা ঘুরিয়ে উল্টো দিকে যেতে শুরু করল।

আমি হাঁটু গেড়ে বসে থাকি। মানুষটার মাথার রক্ত বন্ধ হচ্ছে না। হাতের ফাঁক দিয়ে রক্ত গড়িয়ে গড়িয়ে বের হচ্ছে। আমি আমার ব্যাকপেক থেকে আমার একটা টিশার্ট বের করে সেটা দিয়ে মানুষটার মাথায় চেপে ধরলাম। মানুষটা আমার দিকে তাকিয়ে দুর্বলভাবে হাসার চেষ্টা করল, তারপর শোনা যায় না এরকম গলায় বলল, “থ্যাংক ইউ।”

আমিও একটু হাসার চেষ্টা করলাম, বললাম, “আপনি চিন্তা করবেন না। মামা আপনাকে এক্ষুণি হাসপাতালে নিয়ে যাবে।”

মানুষটা বলল, “আমি আর চিন্তা করছি না। মানুষের যেরকম বিপদ আসে সেরকম বিপদের সময় সাহায্যও আসে। তোমরা যেরকম এসেছ।”

এরকম একটা জ্ঞানের কথা শোনার পর ঠিক কী বলতে হবে বুঝতে পারলাম না। তাই মুখটা একটু হাসি হাসি করে রাখার চেষ্টা করে বসে রইলাম।

কিছুক্ষণের মাঝেই আমরা হাসপাতালে পৌঁছে গেলাম। মামা দরজা খুলে নেমে প্রায় দৌড়ে হাসপাতালের ভিতরে ঢুকে গেল। কয়েক মিনিট পরে কয়েকজন মানুষ একটা ট্রলি ঠেলতে ঠেলতে চলে এলো, সাথে একটা হুইল চেয়ার মাইক্রোবাসের দরজা খুলে আহত মানুষটাকে ধরাধরি করে ট্রলিতে শোয়ানো হলো। মহিলা হুইল চেয়ারে বসলেন, বাচ্চাটা তার কোলে বসে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বসে রইল। এতোক্ষণ চুপচাপ ছিল এখন আবার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করেছে।

একজন আমাকে জিজ্ঞেস করল, “তুমি যাবা না?”

 আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, “আমার কিছু হয় নাই।”

 “তোমার কাপড়ে এত রক্ত?”

 “আমার রক্ত না।”

আরেকজন জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছিল?”

“আমি জানি না। এরা রাস্তার পাশে পড়েছিল আমরা তুলে হাসপাতালে এনেছি।”

মানুষটা শুনে মাথা বাঁকা করে মুখটাতে কেমন একটা ভঙ্গী করল। সেই ভঙ্গী থেকে কাজটা ভালো হয়েছে না খারাপ হয়েছে বুঝতে পারলাম না।

কিছুক্ষণ পর মামা ছোট বাচ্চাটার হাত ধরে বের হয়ে এলো। আমার কাছে এসে বাচ্চাটাকে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “টোপন তুই লিটনকে দেখে রাখ কিছুক্ষণ। আমি ইমার্জেন্সিতে আছি।”

“কী অবস্থা মামা?”

“ভালো। মনে হচ্ছে সিরিয়াস কিছু না। এক্সরে করছে।”

“ঠিক আছে।”

মামা পকেট থেকে কিছু টাকা বের করে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “নে, তোরা কিছু খেয়ে নে।”

আমি বললাম, “আমার কাছে টাকা আছে।”

“থাকুক। রাখ তোর কাছে।”

আমি টাকাগুলো নিয়ে পকেটে রাখলাম। মামা যেভাবে এসেছিল আবার সেভাবে হাসপাতালের ভিতর ঢুকে গেল।

আমি এবারে ছেলেটার দিকে তাকালাম, একটু আগে যেরকম ভয় পেয়েছিল এখন তার আর সেরকম লাগছে না। একটু সামলে নিয়েছে। ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করলাম, “তোমার নাম লিটন?”

ছেলেটা মাথা নাড়ল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি কী অনেক ভয় পেয়েছিলে?”

ছেলেটা আবার মাথা নাড়ল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “ব্যথা পেয়েছিলে?”

ছেলেটা মাথা নাড়ল। তারপর হঠাৎ মাথা তুলে জিজ্ঞেস করল, “আমার আব্বু কী এখন মরে যাবে?”

আমি চোখ কপালে তুলে বললাম, “না, মোটেও না।”

 “তাহলে আম্মু?”

“না, তোমার আম্মুর তো কিছুই হয়নি। কেন শুধু শুধু মরে যাবে?”

ছেলেটা গম্ভীর মুখে বলল, “মানুষ যখন মরে যায় তখন তাকে হাসপাতালে নেয়। আমার নানুকে নিয়েছিল। আমি জানি।”

আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, “না। মানুষের যখন অসুখ হয় নাহলে একসিডেন্ট হয় তখন তাকে হাসপাতালে নেয়। আমার যখন ডেঙ্গু হয়েছিল তখন আমাকে হাসপাতালে নিয়েছিল। আমি কী মরে গেছি? আমি মরি নাই। বিশ্বাস না হলে আমাকে ছুঁয়ে দেখ।”

লিটনের কী মনে হলো কে জানে। সে সত্যি আমাকে ছুঁয়ে দেখল। তারপর মাথা নাড়ল। আমি বললাম, “তোমার খিদে পেয়েছে? কী খাবে বল।”

“আমি কিছু খাব না।”

 “কিন্তু আমি তো খাব। তুমিও খাবে আমার সাথে।”

 “তুমি কী খাবে?”

“দেখি কী পাওয়া যায়। আস আমার সাথে।”

আমি লিটনের হাত ধরে নিয়ে গেলাম, একটা দোকান থেকে একটা বিস্কুটের প্যাকেট, দুইটা চিপসের প্যাকেট আর দুইটা কোল্ড ড্রিংকের বোতল কিনে আমরা আবার হাসপাতালের সামনে ফিরে এলাম। তারপর হাসপাতালের বারান্দায় বসে খেতে লাগলাম।

খেতে খেতে লিটন হঠাৎ করে বলল, “ভুম করে শব্দ হয়েছিল।”

 “কখন ভুম করে শব্দ হয়েছিল?”

 “যখন একসিডেন্ট হয়েছিল।”

 “তখন তুমি কী করেছিলে?”

 “আমি ভেবেছি আমরা সবাই মরে গেছি।”

 “মরে গেছ?”

 “হ্যাঁ। সবাই মরে গেছি।”

 “তারপর?”

“তারপর ভেবেছি শুধু আব্বু আর আম্মু মরে গেছে।”

“আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, “আসলে কেউ মরে নাই।”

লিটন কিছু বলল না। চুক চুক করে কোল্ড ড্রিংক খেতে থাকল। একটু পর জিজ্ঞেস করল, “এখন আব্বু আর আম্মুকে কী করবে?”

“মাথায়, পায়ে মনে হয় ব্যান্ডেজ করে দেবে?”

“কিন্তু তোমার মামা যে বলেছে এক্সরে করবে?”

“এক্সরে তো ছবি তোলা। শরীরের ভিতরের ছবি তোলা। এক্সরে করে দেখবে শরীরের ভেতরে কিছু হয়েছে কী না।”

লিটন বলল, “ও।” আবার কিছুক্ষণ চুক চুক করে কোল্ড ড্রিংস খেয়ে জিজ্ঞেস করল, “তোমার মামা কি ডাক্তার?”

“না। আমার মামা হচ্ছে ডক্টর।”

“ডক্টর?”

 “হ্যাঁ।”

 “ডাক্তার আর ডক্টরে পার্থক্য কী?”

 “ডাক্তার হচ্ছে যে চিকিৎসা করে। আর ডক্টর হচ্ছে যে সায়েন্টিস্ট।”

 “সায়েন্টিস্ট? ডক্টর মানে সায়েন্টিস্ট?”

আমি ঠিক করে জানি না শুধু সায়েন্টিস্ট হলেই ডক্টর হয় না কি অন্যরাও ডক্টর হতে পারে কি না। তাই আলোচনা ঘোরানোর চেষ্টা করলাম। বললাম, “আমার মামা সায়েন্টিস্ট।”

“সত্যিকারের সায়েন্টিস্ট?”

 “হ্যাঁ সত্যিকারের সায়েন্টিস্ট।”

“সত্যিকারের সায়েন্টিস্টরা কী করে?”

“যন্ত্রপাতি দিয়ে কাজ করে।”

“তোমার মামার অনেক যন্ত্রপাতি আছে?”

 “হ্যাঁ। দেখতে চাও?”

লিটন ভুরু কুচকে তাকাল। বলল, “হ্যাঁ দেখতে চাই।”

আমি তখন মাইক্রোবাসের পিছনের দরজাটা খুলে লিটনকে মামার যন্ত্রপাতি দেখালাম। সে দেখে একেবারে হা হয়ে গেল। একটু পর জিজ্ঞেস করল, “তোমার মামা এই সব যন্ত্রপাতি দিয়ে কাজ করে?”

“হ্যাঁ।”

 “তুমি এই যন্ত্রগুলো চিনো?”

আমি কিছুই চিনি না, কিন্তু সেটা বলি কেমন করে? কয়েকদিন পর তো চিনেই যাব তাই না হয় একটু আগেই বলে ফেলি! বললাম, “যা, চিনি।”

লিটন বিস্ফোরিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর আঙুল দিয়ে একটা যন্ত্রকে দেখিয়ে বলল, “এইটা কী যন্ত্র?”

আমার কোনো ধারণা নেই কিন্তু মুখ গম্ভীর কার বললাম, “এইটা হচ্ছে গামা রে স্পেকট্রোস্কোপি।”

আরেকটা যন্ত্র দেখিয়ে বলল, “ঐটা কী যন্ত্র?”

“ঐটা হচ্ছে বিংগুটি বাঙ্গাট্রনিক।” বানিয়ে একটা শব্দ বললাম।

 আরেকটা যন্ত্র দেখিয়ে বলল, “ঐটা কী?”

বানিয়ে বললাম, “পিন্টাসি মিন্টুস।” আমার জ্ঞানের বহর দেখে লিটন মুগ্ধ হয়ে গেল।

আরেকটা যন্ত্র দেখিয়ে বলল, “ঐটা কী?”

 “ঐটা ক্রিটারিটন।”

“তুমিও ঐ যন্ত্র দিয়ে কাজ করো?”

 “এখনও পুরোপুরি শুরু করিনি। একটু একটু করি।”

“তার মানে তুমি সায়েন্টিস্ট?”

 “এখনও হই নাই, আস্তে আস্তে হয়ে যাব।”

লিটন কিছুক্ষণ চুপ করে রইল তারপর বলল, “আমি কী বড় হলে সায়েন্টিস্ট হতে পারব?”

“পারবে না কেন? চাইলেই পারবে।”

“আগে ভেবেছিলাম আমি বড় হয়ে পাইলট হব। এখন মনে হচ্ছে সায়েন্টিস্ট হয়ে যাই।”

আমি গম্ভীর মুখে বললাম, “ভেরি গুড।”

তারপর দুইজন আবার হাসপাতালের বারান্দায় বসে চিপস আর কোল্ড ড্রিংকস খেতে লাগলাম।

ঘণ্টা খানেক পরে মামা বের হয়ে এসে আমাদের ভিতরে নিয়ে গেল। তিন তলায় উঠে একটা ঘরে গিয়ে দেখি পাশাপাশি দুইটা বিছানায় লিটনের আব্রু আর আম্মু শুয়ে আছে। লিটনের আব্বুর চোখ বন্ধ এবং মাথায় ব্যান্ডেজ। লিটনের আম্মু বিছানায় পা তুলে বসে আছেন তার পায়ে প্লাস্টার। লিটন তার আম্মুর কাছে ছুটে গিয়ে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, “আম্মু, আব্বু কী মরে গেছে?”

আম্মু আঁতকে উঠে বলেন, “কী বলে ছেলে? মারা যাবে কেন? তোর আব্বুকে ঘুমের ওষুধ দিয়েছে, তাই ঘুমিয়ে আছে।”

লিটন বলল, “ও।”

আম্মু তার ছেলেকে জড়িয়ে ধরে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনাকে যে কী বলে ধন্যবাদ দেব বুঝতে পারছি না। একসিডেন্টের পর এতো ভয় পেয়েছি এতো ফ্রাস্ট্রেটেড লাগছিল তখন যেন আপনি এসেছেন একেবারে আশীর্বাদের মতো।”

লিটন আমাকে দেখিয়ে বলল, “আর টোপন ভাইয়াও এসেছে আম্মু।”

“হ্যাঁ, হ্যাঁ, আর আপনার ভাগনে, এইটুকুন ছেলে কিন্তু কতত রেসপন্সিবল। থ্যাংক ইউ সো মাচ।”

মামা বললেন, “আপনার ভাইয়ের সাথে কথা হয়েছে। উনি চলে আসছেন কয়েক ঘণ্টার মাঝে।”

“হ্যাঁ। আমিও কথা বলেছি। সে দল বল নিয়ে আসছে।”

“তাহলে আমাদের বিদায় দেন, আমরা যাই।”

“অবশ্যই, অবশ্যই। সাবধানে যাবেন। আর প্লিজ যোগাযোগ রাখবেন।”

আমি আর মামা বিদায় নিয়ে বের হয়ে এলাম। মামা মাইক্রোবাসে উঠে একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “বুঝলি টোপন, তুই একটা প্ল্যান করবি আর কোনো নোটিশ ছাড়া সবকিছু ওলট পালট হয়ে যায়।”

“তোমার কোনো ঝামেলা হবে না তো?”

“ঝামেলা হলেই আবার কী, না হলেই কী!”

 “এখন আমরা কী করব মামা?”

দেখি আশেপাশে থাকার মতো কোনো হোটেল পাওয়া যায় কিনা, যদি পাওয়া যায় তাহলে একটা রাত হোটেলে থেকে যাব। ভালো করে গোসল করে খেয়ে একটা ঘুম দেওয়া যায় কিনা দেখি।”

আমি হাতে কিল দিয়ে বললাম, “গুড আইডিয়া।”

.

রাত্রে একটা হোটেলে মামা আমাদের রক্তমাখা জামা কাপড় বিছানার চাদর ভালো করে ধুয়ে ঘরের ভিতর ফ্যানের নিচে টানিয়ে দিল। আমরা দুইজনই গরম পানিতে রগড়ে রগড়ে গোসল করলাম। তারপর নিচের রেস্টুরেন্টে খেতে গেলাম। মামা ভাত, সবজি, চিকেন ঝাল ফ্রাই, বেগুন ভর্তা আর ডাল অর্ডার দিল। খাওয়ার পর দই মিষ্টি আর কড়া লিকারের দুধ চা। এর থেকে ভালো খাবার আর কী হতে পারে?

আমরা যখন খাবারের জন্য অপেক্ষা করছি তখন আমি মামাকে জিজ্ঞেস করলাম, “মামা, মনে আছে একসিডেন্টের পর যখন সবাইকে হাসপাতালে নিচ্ছিলাম তখন যে একজন মানুষ তোমাকে বলছিল”

মামা কথার মাঝখানে আমাকে থামাল, “ঐ ছাগলটা? যে বলছিল পুলিশ আমাদের ধরবে”

“হ্যাঁ। হ্যাঁ। ঐ মানুষটা কী সত্যি সত্যি বলছিল?”

মামা হা হা করে জোরে জোরে হাসল, বলল, “হতে পারে সত্যি বলেছিল, কেন? তোর ভয় লাগছে?”

“না না ভয় লাগবে কেন?”

“তোর ভয়ের কিছু নাই, আমরা যাকে হাসপাতালে নিয়ে গেছি সে পুলিশের একজন এস পি! এখন গিয়ে দেখ, হাসপাতালে পুলিশ গিজ গিজ করছে।”

মামা পকেট থেকে একটা কার্ড বের করে আমার হাতে দিল, বলল, “এই যে আমাকে তার কার্ড দিয়েছে। তোর কাছে রাখ, হারিয়ে ফেলিস না। ফোন করে খোঁজ নিতে হবে।”

আমি কার্ডটা হাতে নিলাম, মামা আসলেই দরকারি কাজে আমাকে ব্যবহার করতে শুরু করেছে। কার্ডটা আমার ডাইরিতে লাগিয়ে রাখতে হবে। আমার একটা ডাইরি আছে, সব সময় ভাবি প্রত্যেক রাতে ডাইরিতে সারাদিন কী হয়েছে সেটা লিখে রাখব। লেখা হয় না। আজ রাতে অবশ্যই সবকিছু লিখতে হবে, বাড়িয়ে চাড়িয়েই লিখব! অনেক কিছু লেখার আছে।

আমার ডাইরি পড়লে যে কেউ ভয় পেয়ে যাবে, কিন্তু কেউ পড়ার সাহস পাবে না। কারণ ডাইরির প্রথম পৃষ্ঠায় বড় বড় করে লেখা আছে :

“নিম্ন স্বাক্ষরকারীর অনুমতি ছাড়া এই ডাইরি পড়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। যদি কেউ পড়িবার চেষ্টা করে তাহলে তাহার উপর অভিশাপ বর্ষিত হইবে। সেই অভিশাপ অত্যন্ত জ্বালাময়ী এবং তাহার কারণে যে পড়িবে তাহার হাত পা ভাঙ্গিয়া লুলা হইয়া যাইবে এবং শরীরের মাংস পচিয়া পচিয়া খসিয়া পড়িবে এবং পোকা কৃমি কিলবিল কিলবিল করিয়ে এবং চিরদিনের জন্য নরকবাসী হইবে।”

আমি অনেক চেষ্টা করে এটাকে সাধু ভাষায় লিখেছি, সাধু ভাষায় লিখলে পুরো জিনিসটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন