১.৫.১০ ফিরোজ শাহ তুঘলক (শাসনকাল : ১৩৫১ সাল থেকে ১৩৮৮ সাল)

অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়

ফিরোজ শাহ তুঘলক (শাসনকাল : ১৩৫১ সাল থেকে ১৩৮৮ সাল)

মোহম্মদের বিন তুঘলকের দুঃসম্পর্কের আত্মীয় মাত্র এক মাসের শাসক মোহম্মদ ইবন তুঘলককে হত্যা করে ফিরোজ শাহ তুঘলক ক্ষমতা দখল করে নেন। যদিও এই সুলতান ‘দয়ালু’ বলে খ্যাত ছিলেন, কিন্তু বিধর্মী হত্যায় তাঁর হাত-পা কাঁপত না। তাঁকে দয়ালু বলার কারণ তিনিই প্রথম বহিরাগত মুসলমানদের বিরোধিতা সত্ত্বেও ধর্মান্তরিত ভারতীয় মুসলমানদের সেনাবাহিনীতে নিযুক্ত করেছিলেন। সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলকের পূর্ববর্তী সুলতানরা হিন্দু ব্রাহ্মণদের জিজিয়া কর অব্যাহতি দিয়েছিলেন। কিন্তু ধর্মান্তরে অতি উৎসাহী ফিরোজ শাহ মনে করলেন যে এটা ছিল ধর্মীয় ভুল এবং ব্রাহ্মণরাই ছিল পৌত্তলিকতা চর্চার চাবিকাঠি। তিনি একান্তভাবে মূর্তিপুজো দমন করতেন। বহু হিন্দু মন্দির ধ্বংস করেছিলেন অবলীলায়। তিনি তাঁর রাজ্যে মূর্তিপুজো করছে কি না, মন্দির নির্মাণ করছে কি না কেউ, সেই সব খবর রাখতেন। এই খোঁজ নেওয়ার কাজ করার জন্য গুপ্তচরও নিয়োগ করেছিলেন। ফিরোজ শাহ তাঁর স্মৃতিনামা ‘ফতোয়া-ই-ফিরোজ’ গ্রন্থে এসব বিবরণ লিখে রেখেছেন। তিনি হিন্দু মন্দির ধ্বংস এবং যাজকদের হত্যার অনেক ঘটনা লিখে রেখেছেন। লিখেছেন– হিন্দুরা এখন নগরীতে প্রতিমা মন্দির করেছে, যা নবির আইনবিরোধী।… এরূপ মন্দিরগুলি সহ্য করা যাবে না। স্বর্গীয় নির্দেশে আমি এসব ভবন ধ্বংস এবং ওসব অবিশ্বাসী আনুগত্যহীন নেতাদের হত্যা করেছি, যাঁরা অন্যদেরকে বিভ্রান্তির দিকে প্ররোচিত করে এবং নিম্নস্তরের মানুষদের আমি কষাঘাত করি, যতক্ষণ পর্যন্ত এ অপকর্ম সম্পূর্ণ বিলুপ্ত না হয়। সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলকের সুলতালানাতে বিধর্মী কাফেরদের ধর্মগ্রন্থ, মূর্তি, পুজোর সব সামগ্রী বিনষ্ট করা হয়। নিষিদ্ধ করা হয় নতুন মন্দির নির্মাণ এবং সমবেত ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান। ফিরোজ শাহ তুঘলক অভিজাত ও উলেমাদের নির্বাচিত ছিলেন। আমির ও মালিকরাই ফিরোজকে সিংহাসনে বসতে অনুরোধ করেন। উলেমাগোষ্ঠীর সাহায্য নিয়ে সিংহাসন করার ফলে আলাউদ্দিন ও মোহম্মদ বিন তুঘলকের রাজতান্ত্রিক চিন্তাধারা ধ্বংস হয়। ফিরোজ উলেমাদের সাহায্যে সিংহাসন লাভ করায় এবং তাঁদের পরামর্শমতো রাজ্য শাসন করায় আলাউদ্দিন ও মোহম্মদ বিন তুঘলকের ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শ বিনষ্ট হয়। তিনি নিরপেক্ষ ও ন্যায্যভাবে সব সম্প্রদায়ের প্রতি যথাযথ সম্মান দেখাতে পারেননি। তাই বলে ফিরোজ ধর্মোন্মাদ বা গোঁড়া শাসক বলা যায় না। আসলে রাজকার্যে উলেমাদের হস্তক্ষেপের কারণেই ফিরোজের শাসন ধর্মাশ্রিত বা Theocratic হয়ে পড়েন। তুঘলক মোহম্মদ বিন তুঘলকের মতো ফিরোজ শাহর ধর্মনিরপেক্ষ যুক্তিবাদী দৃষ্টি ছিল না। ফিরোজ তাঁর শাসনব্যবস্থায় শরিয়তি নীতি প্রয়োগ করেন। এর ফলে তাঁর পক্ষে অ-মুসলিম ও অ-সুন্নি মুসলমানদের প্রতি সমদর্শী নীতি অনুসরণ করা সম্ভব হয়নি। ফুতুহা-ই ফিরোজশাহী গ্রন্থে তিনি ধর্মীয় গোঁড়ার জন্য বেশ কিছু হিন্দু মন্দির ধ্বংস করেন বলে লিখেছেন। হিন্দু ছাড়াও অন্য সম্প্রদায়ের মুসলিমদের উপরও তিনি বৈষম্যমূলক নীতি আরোপ করেন। শিয়া, ইসমাইলি সম্প্রদায়ের মুসলিমরাও তাঁর আদেশে নির্যাতিত হন এবং তাঁদের ধর্মগ্রন্থ পুড়িয়ে ফেলা হয়। ফিরোজের এই ধর্মনীতির ফল ভালো হয়নি। তাঁর এই নীতির ফলে রাজ্য শাসনের ব্যাপারে উলেমারা হস্তক্ষেপ করার সুযোগ পায়। তাতে নিরপেক্ষতা নষ্ট হয় এবং হিন্দুরা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। তবে ফিরোজ শাহ নিষ্ঠুর ও উগ্র স্বভাবের মানুষ ছিলেন না। মুসলমানদের প্রতি তাঁর দরদ আন্তরিক হলেও অ-মুসলমানদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করতেন। গোলাম আহমেদ মোর্তাজা তাঁর ইতিহাসের ইতিহাস’ গ্রন্থে ফিরোজ শাহের শাসন প্রসঙ্গে বলেছেন– “ফিরোজ শাহ তুঘলক সাধারণ ইতিহাসে মহামান্য ঐতিহাসিকদের বিষাক্ত কলমের খোঁচা থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারেনি। জিজিয়া কর আদায়ের জন্য তাঁর উপর বিদ্বেষমনা ও ধর্মান্ধতার দোষ আরোপ করা হয়। কিন্তু আগেই জিজিয়া কর প্রসঙ্গে আলোচনায় বলা হয়েছে, জিজিয়া কোনো অত্যাচারী বা সাম্প্রদায়িক কর নয়। মাথা গুনতি যে-কোনো অমুসলমানের কাছে থেকেই জিজিয়া কর নেওয়া হত না। তাই জিজিয়া করের দোহাই দিয়ে সচ্চরিত্রের ফিরোজ শাহের মাথায় অপরাধের বোঝা চাপানোর পশ্চাতে কোন্ মনোভাবের পরিচয় লুকিয়ে রয়েছে…।” ফিরোজ শাহ তুঘলকের দিল্লির সুলতানি শাসন ব্যর্থ হয়। তবে ফিরোজ শাহ তুঘলকের মৃত্যুর দশ বছরের মধ্যে তুঘলক সাম্রাজ্যের পতন হয়।

বস্তুত দিল্লিতে একের পর এক সুলতানদের পতনের ফলে কেন্দ্রীয় শাসন ক্ষমতায় দুর্বলতা প্রকাশিত হয়ে পড়ে। সেই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে ভারতের বিভিন্ন অংশে কতকগুলি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র তৈরি হতে থাকল। এক ভারতীয় উপমহাদেশে মধ্যে আরও অসংখ্য ভারত। সেটা শুরু হল ১২০১ সালে। বঙ্গদেশেই সর্বপ্রথম স্বাধীনতা ঘোষিত হল।

একে একে তুঘলক, খিলজি, সুলতানাত শাসকদের নিয়ে আলোচনা করা গেল। এবার দেখব মোগল শাসকদের, যাঁরা ‘সম্রাট’ বলে পরিচিত ছিল। যদিও বাবরই মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রথম মোগল সম্রাট, কিন্তু আমি আলোচনা শুরু করতে চাই তৈমুর লঙ ও চেঙ্গিস খাঁকে দিয়েই। বাবর ছিলেন মধ্য এশিয়ার তুর্কো-মঙ্গোল বংশোদ্ভূত শাসক। বাবার দিক থেকে তিনি তৈমুর লঙ ও মায়ের দিক থেকে চেঙ্গিস খানের বংশধর ছিলেন। সেই হিসাবে মোগল সম্রাটরা ছিলেন মধ্য এশিয়ার তুর্কো-মঙ্গোল বংশোদ্ভূত। তাই তৈমুর লঙ ও চেঙ্গিস খাঁকে বাদ মোঘল সম্রাটদের আলোচনায় ঢুকতে চাই না। কারণ মোঙ্গল থেকেই মোগল বা মোঘল বা মুঘল শব্দটি উদ্ভূত।

সকল অধ্যায়

১. ১.১ ইসলাম এবং মুসলিম : গোড়ার কথা
২. ১.২ এক হাতে তলোয়ার, অন্য হাতে কোরান
৩. ১.৩ প্রাচীন ভারতের রাষ্ট্রভাবনা এবং ভৌগোলিক সীমানা
৪. ১.৪ মধ্যযুগ : ভারতে মুসলিম আগমন
৫. ১.৫.০১ শাসক রূপে মুসলিমদের ভারতে প্রবেশ : মোহম্মদ বিন কাসিম
৬. ১.৫.০২ সুলতান মামুদ (শাসনকাল : ৯৯৭ সাল থেকে ১০৩০ সাল)
৭. ১.৫.০৩ বখতিয়ার খলজি (শাসনকাল ১২০১ থেকে ১২০৬ সাল)
৮. ১.৫.০৪ মোহম্মদ ঘুরি (শাসনকাল : ১১৭৩ সাল থেকে ১২০২ সাল)
৯. ১.৫.০৫ কুতুবউদ্দিন আইবক (শাসনকাল : ১২০৬ সাল থেকে ১২১০ সাল)
১০. ১.৫.০৬ ইলতুৎমিস (শাসনকাল : ১২১১ সাল থেকে ১২৩৬ সাল)
১১. ১.৫.০৭ গিয়াসুদ্দিন বলবন (শাসনকাল : ১২৬৬ সাল থেকে ১২৮৭ সাল)
১২. ১.৫.০৮ আলাউদ্দিন খিলজি (শাসনকাল : ১২৯৬ সাল থেকে ১৩১৬ সাল)
১৩. ১.৫.০৯ মোহম্মদ বিন তুঘলক (শাসনকাল : ১৩২৫ সাল থেকে ১৩৫১ সাল)
১৪. ১.৫.১০ ফিরোজ শাহ তুঘলক (শাসনকাল : ১৩৫১ সাল থেকে ১৩৮৮ সাল)
১৫. ১.৫.১১ চেঙ্গিস খান (শাসনকাল : ১২০৬ সাল থেকে ১২২৭ সাল)
১৬. ১.৫.১২ তৈমুরলঙ (শাসনকাল : ১৩৭০ সাল থেকে ১৪০৫ সাল)
১৭. ১.৫.১৩ বাবর (শাসনকাল : ১৪৯৪ সাল থেকে ১৫৩০ সাল)
১৮. ১.৫.১৪ হুমায়ুন (শাসনকাল : ১৫৩০ সাল থেকে ১৫৫৬ সাল)
১৯. ১.৫.১৫ শের শাহ সুরি (শাসনকাল : ১৪৮৬ সাল থেকে ১৫৪৫ সাল)
২০. ১.৫.১৬ আকবর (শাসনকাল : ১৫৫৬ সাল থেকে ১৬০৬ সাল)
২১. ১.৫.১৭ জাহাঙ্গির (শাসনকাল : ১৬০৫ সাল থেকে ১৬২৭ সাল)
২২. ১.৫.১৮ শাহজাহান (শাসনকাল : ১৬২৮ সাল থেকে ১৬৫৮ সাল)
২৩. ১.৫.১৯ আওরঙ্গজেব (শাসনকাল : ১৬৫৮ সাল থেকে ১৭০৭ সাল)
২৪. ১.৫.২০ দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ জাফর (শাসনকাল : ২৮ সেপ্টেম্বর ১৮৩৭– ১৪ সেপ্টেম্বর ১৮৫৭)
২৫. ২.০ জবাবদিহি (দ্বিতীয় খণ্ড)
২৬. ২.১.১ মধ্যযুগ : ভারতে মুসলিম শাসন : সিরাজ-উদ্-দৌল্লা (শাসনকাল : ১৭৫৬ সাল থেকে ১৭৫৭ সাল)
২৭. ২.১.২ রাজা গণেশ (শাসনকাল : ১৪১৪ সাল থেকে ১৪১৫ সাল)
২৮. ২.১.৩ আলাউদ্দিন হোসেন শাহ (শাসনকাল : ১৪৯৩ সাল থেকে ১৫১৯ সাল)
২৯. ২.১.৪ টিপু সুলতান (শাসনকাল : ১৭৮২ সাল থেকে ১৭৯৯ সাল)
৩০. ২.২ প্রাচীন যুগ থেকে মধ্যযুগ : বিশ্বজুড়েই যুদ্ধাভিযান এবং রক্তধারা
৩১. ২.৩ ব্রিটিশরাজ : বণিকের মানদণ্ড দেখা দিল রাজদণ্ড রূপে
৩২. ২.৪ ভারতে ব্রিটিশ শাসন : হিন্দু ও মুসলিম
৩৩. ২.৫ খণ্ডিত ভারত : হিন্দু, মুসলিম, ব্রিটিশ ও কংগ্রেস
৩৪. ২.৬ মুসলিম : যত দোষ নন্দ ঘোষ
৩৫. ২.৭ বিশ্ব তথা ভারতে মুসলিমদের অবদান
৩৬. ২.৮ শেষ পাতে শেষ পাতা

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন