৩৪. একটি শোকাতুর মৌনতার মধ্যে

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়

একটি শোকাতুর মৌনতার মধ্যে আপন ঘরে গৌরীর আবাহন হইল। নিত্য ও রতন গৌরীকে দেখিয়া দিল, কিন্তু নীরবে কাঁদিল। পাছে গৌরী দুঃখ পায়, লজ্জা পায়, তাই তাহারা চোখের জল আসিতে আসিতে আঁচল দিয়া মুছিয়া ফেলিতে চাহিল। কেষ্ট সিং তাড়াতাড়ি খোকাকে বুকে তুলিয়া লইয়া চোখের জল ফেলিতে ফেলিতে বাহিরে চলিয়া গেল। রাখাল সিং গম্ভীরভাবে বলিলেন, এই দেখ নিত্য, আপনাকেও বলছি রতন-ঠাকরুন, ওসব চোখের জলটল ফেলো না বাপু। অকল্যেণ কোরো না কেউ। কালই বাবুকে নিয়ে আসছি ফিরিয়ে—বলিয়া ব্যস্তভাবে বাহিরে চলিয়া গেলেন। কমলেশের সহিত পরামর্শ করিয়া একটা উপায় স্থির করিতে হইবে। মরিবার মত অবসরও তাহার নাই।

নিত্য বলিল, বউদিদি, আপনি ওপরে গিয়ে বসুন। এখুনি পাড়ার যত মেয়েতে দল বেঁধে মজা দেখতে আসবে।

রতন বলিল, হ্যাঁ, সেই কথাই ভাল। কারও ঘরে কিছু একটা ভাল-মন্দ হলে হয়, সব আসবে, যেন ঠাকুর উঠেছে ঘরে। তুমি ওপরে যাও, আমরা বলব বরং, বউয়ের মাথা ধরেছে,

সে শুয়েছে।

গৌরী কথাটা মানিয়া লইল। উপরে গিয়াই সে বসিল। নিত্য বলিল, আপনার ঘরই খুলে দিই বউদিদি। ঝাড়া-মোছাই সব আছে, একবার বরং ঝাঁট দিয়ে দিই, বিছানাটার চাদরও পালটে দিই। শুতেও তো হবে আপনাকে!

এতক্ষণে গৌরী কথা বলিল। কহিল, না নিত্য, এই দরদালানেই বিছানা কর। তুমি, রতনঠাকুরঝি, আমি সব একসঙ্গেই শোব।

নিত্যর চোখে জল আসিল, তাড়াতাড়ি চোখ মুছিয়া বলিল, সেই আপনি যেদিন গেলেন বউদিদি, সেইদিন শুধু দাদাবাবু এ ঘরে শুয়েছিলেন, তারপর আজ এই আড়াই বছর তিন বছর এ ঘরে কেউ শোয় নাই। তার পরের দিনই তো দাদাবাবু চলে গেলেন বেলগাঁয়ে।

গৌরী এ কথার কোনো উত্তর দিল না, নীরবে সে খোলা জানালা দিয়া আকাশের দিকে চাহিয়া রহিল। এখানে যাত্ৰা করিবার অব্যবহিত পূর্বে আকস্মিক যে আলোক আসিয়া তাহার জীবনকে গ্লানিহীন শুভ্রতায় উজ্জ্বল করিয়া তুলিয়াছিল, তাহার উপর একখানি মেঘের বিষণ্ণ ছায়া যেন আসিয়া পড়িতেছে। শিবনাথের ওপর অভিমান তাহাকে বিচলিত করিয়া তুলিল। কিন্তু তবুও এ অভিমান পূর্বেকার অভিমান হইতে স্বতন্ত্র। ইহার মধ্যে ক্ৰোধ নাই, আক্রোশ নাই, বরং একটা আত্ম-অপরাধবোধ আছে। কিন্তু শত অপরাধ সে করিলেও যাইবার পূর্বে একবার দেখা করাও কি তাহার উচিত ছিল না, অন্তত একখানি পত্ৰ লিখিলেও কি ক্ষতি ছিল।

নিত্য গৌরীর মনের কথা অনুমান করিয়া অনুশোচনা না করিয়া পারিল না, কথাটা বলা তাহার উচিত হয় নাই। কথাটা চাপা দিবার জন্য সে অকস্মাৎ ব্যস্ত হইয়া বলিল, আ, আমার মনের মাথা খাই, আপনার জন্যে চা করে নিয়ে আসি। ভুলেই গিয়েছি সে কথা।

গৌরী বলিল, এ আড়াই বছরের মধ্যে তিনি কি একেবারেই আসেন নি নিত্য?

একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া নিত্য বলিল, এক দিনের জন্যে না বউদিদি। ঘর-সংসার, বিষয়-সম্পত্তি একদিন চেয়েও দেখেন নাই। যা করেছেন সিংমশায়। বলব কী বউদিদি, একটা পয়সাও নাকি তিনি এস্টেট থেকে নেন নাই।

সেখানে রান্নাবান্না কে করত?

এই একজন ঠাকুর ছিল,সেই বামুন, সেই চাকর, সেই সব। কাপড় কাচতেন নিজে, ঘর অ্যাঁট দিতেন নিজে, জুতো তো পরতেনই না, তা কালি বুরুশ। তার উপর। বলিতে বলিতে আবার তাহার মনে হইল, এ কী করিতেছে সে! নিজেকে গঞ্জনা দিয়াই সে নীরব হইল। তারপর আবার বলিল, সেসব রাত্রে শুয়ে শুয়ে বলব বউদিদি, এখন আপনার জন্যে চা আনি।

সমস্ত রাত্রিটাই প্রায় জাগিয়া কাটিয়া গেল। নিত্য ও রতন এই দীর্ঘ আড়াই বৎসরের কথা বলিয়া গেল, গৌরী শুনিল। নিত্য যে কথা বলিতে ভুলিল, সেটি রতন বলিয়া দিল; আবার রতন বলিতে যে কথা বিস্মৃত হইল, সে কথা স্মরণ করাইয়া দিল নিত্য। বলিতে বলিতে রতন। আপনাকে সংবরণ করিতে পারি না, আবেগভরে সে বলিয়া উঠিল, রাগ কোরো না ভাই বউ, তোমাতে আর মাসিমাতেই শিবনাথকে এত দুঃখ দিলে। তোমরা রাগ করে যদি দুজনে দুদিকে চলে না যেতে, তবে শিবু এমন হত না।

নিত্যও আর থাকিতে পারি না, সেও এবার বলিল, পিসিমা গিয়েছিলেন অনেকদিন, তুমি যদি থাকতে বউদিদি, তবে দাদাবাবুর সাধ্যি কী যে এমন সন্নেসী হয়ে বেড়ায়, যা খুশি তাই করে।

গৌরী রাগ করিল না, ক্ষুণ্ণ হইল না, ম্লান হাসি হাসিয়া বলিল, দোষ আমার স্বীকার করছি। রতন-ঠাকুরঝি। কিন্তু কই, বেশ ভেবে বল দেখি, আমি থাকলেই কি তোমাদের ভাই এসব করত না?

রতন কথাটা একেবারে অস্বীকার করিতে পারি না, কিন্তু তবু বলিল, করত, কিন্তু এতটা করতে পারত না।

গৌরী হাসিয়া বলিল, যারা করে ঠাকুরঝি, তারা মাপ করে বিচার করে না। কলকাতায় যদি দেখতে, তবে বুঝতে; অহরহ এই কাও চলছে। সি. আর. দাশ-চিত্তরঞ্জন দাশ, বছরে লক্ষ লক্ষ টাকা রোজগার করতেন, তিনি সব ছেড়েছুড়ে জেলে গেলেন। তার স্ত্রী বাসন্তী দেবী তিনিও গেলেন জেলে; তার ছেলে—তিনিও গেলেন জেলে। গান্ধী–তিনি জেলে গিয়েছেন। কিছুক্ষণ নীরবে থাকিয়া গৌরী আবার বলিল, জান ঠাকুরঝি, দেশে আবার এমন লোকও আছে, যারা এইসব লোকের নিন্দে করে। বলে, দেশের সর্বনাশ করছে। ভলেন্টিয়ারদের বলে, খেতে পায় না, তাই জেলে যাচ্ছে পেট ভরে খেতে। তোমার ভাই কি খাবারের অভাবে জেলে গেল ভাই?

রতন সবিস্ময়ে বলিল, তাই বলে লোকে?

নিত্য অহঙ্কার করিয়া বলিল, এখানে কিন্তু তা কেউ বলে না বউদিদি। দাদাবাবুর নাম আজ ঘরে ঘরে, লোকের মুখে মুখে।

অকস্মাৎ যেন নদীর বাঁধ ভাঙিয়া গেল, গৌরীর দুই চোখ বাহিয়া জল ঝরিতে আরম্ভ করিল, সে আর আপনাকে সংবরণ করিতে পারি না। খোকাকে কাছে টানিয়া লইয়া নীরবে সে কাঁদিতে লাগিল।

অন্ধকারের মধ্যে নিত্য ও রতন আপন মনেই বকিয়া চলিয়াছিল, এক সময় তাহাদের খেয়াল হইল গৌরীর সাড়াশব্দ আর পাওয়া যায় না। রতন মৃদুস্বরে ডাকিল, বউ!

কোনো উত্তর আসিল না।

নিত্য বলিল, ঘুম এসেছে, চুপ কর রতনদিদি।

তাহারাও পাশ ফিরিয়া শুইল।

ভোরের দিকে গৌরী ঘুমাইয়াছিল। সকাল হইয়া গেলেও সে ঘুম তাহার ভাঙে নাই। কলিকাতাতেও তাহার সকালে ওঠা অভ্যাস ছিল না, তাহার ওপর প্রায় সারারাত্রি জাগরণের পর ঘুম। নিত্য তাহাকে ডাকিয়া বলিল, আপনার দাদা ডাকছেন বউদিদি।

গৌরী নিচে আসিয়া দেখিল, একা কমলেশ নয়, কমলেশের সঙ্গে এ বাড়ির সকল হিতৈষী আপনার জনই আসিয়াছেন, রাখাল সিং কে সিং, এ বাড়ির ভাগিনেয়-গোষ্ঠীর কয়েকজন এমনকি রামরতনবাবু মাস্টারও আসিয়াছেন। গৌরী মাথায় ঘোমটা খানিকটা বাড়াইয়া দিয়া একপাশে দাঁড়াইল।

কমলেশ বলিল, দশটার সময় আমাদের বেরুতে হবে গৌরী, তাড়াতাড়ি স্নান করে খেয়ে নাও।

গৌরী ঘাড় নাড়িয়া সম্মতি জানাইল। কমলেশ বলিল, খালাস শিবনাথ এখুনি হয়ে যাবে। কিন্তু খালাস নেওয়াটা হল তার হাত। তোমাকে যেমন করে হোক সেইটি করতে হবে, তাকে রাজি করাতে হবে।

রামরতনবাবু বলিলেন, ইম্পসিল, শিবনাথ কান্ট ড়ু ইট, তার মন অন্য ধাতুতে গড়া।

রাখাল সিং অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হইয়া উঠিলেন, বলিলেন, দেখুন মাস্টারমশায়, আপনি হলেন এই সবের মূল। কিন্তু আর আপনি বাধা-বিঘ্ন দেবেন না বলছি, আপনার সঙ্গে আমার ভাল হবে না।

এ বাড়ির ভাগিনেয়-গোষ্ঠীর একজন, সম্পর্কে তিনি শিবনাথের দাদা, বলিলেন, না না, সে করতে গেলে চলবে কেন শিবনাথের? এ আপনি অন্যায় বলছেন মাস্টারমশায়। এই বালিকা বউ, শিশু ছেলে, বিষয় সম্পত্তি-এ ভাসিয়ে দিয়ে যাব বললেই যাওয়া হয়? আপনিও বরং যান, আপনার কথা যখন সে শোনে, আপনিও তাকে বুঝিয়ে বলুন।  মাস্টার দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করিয়া ঘাড় নাড়িয়া বলিলেন, সে আমি পারি না, পারব না। তাতে শিবনাথ খালাস পাবে বটে, কিন্তু সে কত ছোট হয়ে যাবে, জানেন?

কমলেশ এবার তিক্তস্বরে বলিল, বেশ মশায়, আপনাকে যেতেও হবে না, বলতেও হবে না। আপনি দয়া করে আর বাধা দেবেন না, পাক মারবেন না। হুঃ, জেল খাটলেই বড় হয়, আর না খাটলেই মানসম্মান ধুলোয় লুটোয়! অদ্ভুত যুক্তি! লুডিক্রাস! আপনি বাইরে যান দেখি।

গৌরীর মন—তাহার নূতন মন কমলেশের কথায় সায় দিল না। কিন্তু সে তাহার প্রতিবাদ করিতে পারিল না। এতগুলি লোকের সম্মুখে শিবনাথ-সম্পর্কিত কথায় অভিমত প্রকাশ করিতে বন্ধু-জীবনের লজ্জা তাহাকে আড়ষ্ট করিয়া দিল। কিন্তু তাহার মন বার বার বলিতেছিল, তাহাকে হেয় হইতে, ছোট হইতে বলিতে সে পারিবে না—পারিবে না। আর তাহাকে ছোট হইতে অনুরোধ করিতে গিয়া তাঁহার কাছে সে নিজেও হেয় হইতে পারিবে না।

রামরতনবাবু কমলেশের কথায় বলিলেন, অল রাইট, চললাম আমি!—বলিয়া বাড়ি হইতে বাহির হইবার জন্য অগ্রসর হইলেন। কিন্তু দরজার সম্মুখে গিয়াই থমকিয়া দাঁড়াইয়া বিস্ময়ে আনন্দে অভিভূতের মত উচ্ছ্বসিত স্বরে বলিয়া উঠিলেন, পিসিমা।

মুহূর্তে সমস্ত লোকগুলির দৃষ্টি দরজার দিকে নিবদ্ধ হইল, পরমুহূর্তেই বাড়িতে প্রবেশ করিলেন শৈলজা-ঠাকুরানী। কিন্তু কত পরিবর্তন হইয়াছে তাহার! তপস্বিনীর মতই শীর্ণ দেহ, তপস্যার দীপ্তির মতই তাহার দেহবর্ণ ঈষৎ উজ্জ্বল, মুখে তাহারই উপযুক্ত কঠোর দৃঢ়তা, মাথার চুলগুলি ছোট করিয়া ছাঁটা,তাহাকে দেখিয়া বিস্ময়ে সম্ভ্ৰমে সকলে যেন নির্বাক হইয়া গেল।

তিনিই প্রথম প্রশ্ন করিলেন, শিবুকে আমার ধরে নিয়ে গেছে?

এবার হাউমাউ করিয়া রাখাল সিং কাঁদিয়া উঠিলেন। কেষ্ট সিংও কাঁদিতে আরম্ভ করিল। মাস্টার আপন মনেই বলিলেন, ইডিয়টস।

শৈলজা দেবী বলিলেন, কেঁদো না বাবা রাখাল সিং, কাঁদছ কেন?

রাখাল সিং বলিলেন, আমাকে রেহাই দেন মা, এ ভার আমি বইতে পারছি না।

অদ্ভুত হাসি হাসিয়া শৈলজা দেবী বলিলেন, যে ভার যার বইবার, সে যে তাকেই বইতে হবে বাবা। রেহাই নোব বললেই কি মানুষ রেহাই পায়, না রেহাই দেবার মানুষই মালিক। নাও, তোমার চাবি নাও। রামজীদাদাকে দিয়েছিল শিবু, তিনি দিয়ে গেলেন আমাকে।

ভাগিনেয়-বাড়ির একজন বলিলেন, হ্যাঁ হ্যাঁ, তিনি যে আজ চার দিন হন। এখান থেকে চলে গেছেন। পুরোহিতকে সব বুঝিয়ে-সুঝিয়ে দিয়ে তীর্থে যাচ্ছি বলে গেছেন বটে।

নিত্য এবার আসন পাতিয়া দিয়া বলিল, বসুন পিসিমা।

বসিয়া পিসিমা বলিলেন, তিনিই আমাকে খবর দিয়ে বললেন, তুমি যাও ভাই দিদি, আমার কথা তো শিবু শুনলে না। শুনে আর থাকতে পারলাম না, ছুটে আসতে হল।

রামরতনবাবু বলিলেন, তারই সঙ্গে এলেন বুঝি?

না। তিনি আমায় চাবি দিয়ে কেদারমাঠে চলে গেলেন। বললেন, মৃগশিশু পালন করে মমতায় কেঁদে মরছি, চোখ যাবার আগে আমি গুরুর কাছে চললাম। আর আমার অদৃষ্ট দেখ বাবা, ভগবানের কাছে গিয়েও আমি থাকতে পারলাম না। শিবুকে দেখবার জন্যে বুক যেন তোলপাড় করে উঠল, আমি ছুটে চলে এলাম—একলাই এলাম। শিবুকে আমার কবে ধরে নিয়ে গেল।

রাখাল সিং বলিলেন, সোমবার সন্ধেবেলায়। কিন্তু কোনো ভাবনা নাই, চলুন, আজই যাব সদরে, খালাস করে নিয়ে আসব।

সবিস্ময়ে শৈলজা-ঠাকুরানী বলিলেন, খালাস!

হ্যাঁ। কমলেশবাবু ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবকে বলে রাজি করাবেন। আপনি চলুন, বউমা চলুন, আপনারা বাবুকে ধরে রাজি করান, একটা এগ্রিমেন্ট লিখে দিলেই খালাস হয়ে যাবে।

বউমা এসেছেন?

নিত্য বলিল, কাল এসেছেন। লোকজনের ভিড়ে তিনি যে আসতে পারছেন না।

শৈলজা দেবী নিত্যর কথার উত্তর না দিয়া রাখাল সিংকে বলিলেন, তোমরা বউমাকে নিয়ে যাও বাবা, এগ্রিমেন্ট লিখে দিয়ে আমি তাকে খালাস হতে বলতে পারব না।

রামরতনবাবু উচ্ছ্বসিত হইয়া বলিয়া উঠিলেন, দ্যাটস লাইক পিসিমা।

শৈলজা দেবী বলিয়াই গেলেন, আমার বাবা বলতেন, আমার দাদা বলতেন, না খাব উচ্ছিষ্ট ভাত, না দিব চরণে হাত। আমি তো ঘাট মানতে বলতে পারব না বাবা। যদি সে অন্যায় করত, কথা ছিল। কিন্তু এ তো অন্যায় নয়। আজ চার বছর কাশীতে থেকে আমি দেখলাম, কঁচা বয়েসের ছেলে—কচি কচি মুখ হাসিমুখে জেলে গেল, দ্বীপান্তরে গেল, ফাঁসি গেল। আর আজ ছ মাস ধরে দলে দলে ছেলে যুবা বুড়ো জেলে চলেছে দেশের জন্যে। আগে শিবু দেশ দেশ করত, বুঝতাম না; কিন্তু কাশীতে থেকে বুঝে এলাম, এ কত বড় মহৎ কাজ।

এর জন্যে ঘাট মানতে বলতে তো আমি পারব না বাবা।

গৌরী আর থাকিতে পারিল না, সে আসিয়া শৈলজা দেবীর পায়ে প্ৰণাম করিয়া উঠিয়া মৃদুস্বরে বলিল, আমিও পারব না পিসিমা, আপনি ওদের বারণ করুন।

নিত্য বলিল, আপনারা সব বাইরে যান কেনে গো! শাশুড়ি-বউকে একটু দুঃখের কথা কইতে অবসর দেবেন না আপনারা?

সর্বাগ্রে উঠিল কমলেশ, সে গম্ভীর মুখে বাড়ি হইতে বাহির হইয়া গেল।

 

বধূর দিকে চাহিয়া শৈলজা দেবী কঠিন স্বরেই বলিলেন, আসতে পারলে মা?

গৌরী চুপ করিয়া অপরাধিনীর মত দাঁড়াইয়া রহিল, চোখ তাহার জলে ভরিয়া উঠিয়াছে। রতন শঙ্কিত হইয়া উঠিল, নিত্য একরূপ ছুটিয়াই বাহির হইয়া গেল।

শৈলজা দেবী আবার বলিলেন, নাও, চাবিটা তুমিই নাও। রাখাল সিংকে দিতে ভুলে গেলাম, ভালই হয়েছে।

এবার গৌরীর চোখ হইতে টপটপ করিয়া জল মাটিতে ঝরিয়া পড়িল।

নিত্য খোকাকে কোলে করিয়া ছুটিয়া আসিয়া সম্মুখে দাঁড়াইয়া বলিল, কে বলুন দেখি পিসিমা?

শিশুর দিকে চাহিয়াই শৈলজা দেবী ঝরঝর করিয়া দিয়া ফেলিলেন, এ যে তাহার শিবু ছোট হইয়া ফিরিয়া আসিয়াছে। সেই শৈশবের শিবু, এতটুকু তফাত নাই। নিত্য তাহার কোলে খোকাকে ফেলিয়া দিয়া বলিল, নেন, কোলে নেন।

শৈলজা দেবী তাহাকে বুকে চাপিয়া ধরিলেন, তারপর আবার তাহাকে ভাল করিয়া দেখিয়া বলিলেন, ঠিক ছোটবেলার শিবু।

শিশুও অবাক হইয়া তাহাকে দেখিতেছিল, নিত্য তাহাকে বলিল, খোকন, তোমার দাদু। বল দাদু।

শৈলজা দেবী তাহাকে বুকে চাপিয়া ধরিয়া এবার বধূকে বলিলেন, কাঁদছ কেন বউমা? ছি, এতে কি কদে? বোসো, আমার কাছে বোসা। কাঁদছ কেন? শিবু তো আমার ছোট কাজ করে জেলে যায় নি। বরং ভগবানের কাছে তার মঙ্গল কামনা কর। দু বছর, দশ বছর এই জীবনেই যেন জয় নিয়ে সে ফিরে আসে।

খোকা তাঁহার হাতের কবচ রুদ্ৰাক্ষ লইয়া নাড়িতেছিল, তিনি হাসিয়া বলিলেন, কী দাদু, দাদুর ধন-সম্পত্তি নিয়ে টানাটানি করছ? দেখ বউমা, তোমার ছেলের কাণ্ড দেখ, ছেলে কেমন চালাক দেখ!

বধূ এবার হাসিল।

নিত্য বলিল, দাদাবাবুকে কিন্তু খালাস করে আনুন বাপু।

কঠোর চক্ষে চাহিয়া শৈলজা দেবী বলিলেন, না, তাতে আমার শিবুর মাথা হেঁট হবে। ও কথা কেউ বোলো না আমাকে।

রতন বলিল, তা না আন, তার সঙ্গে দেখা করে এস।

শৈলজা দেবীর কণ্ঠস্বর মুহূর্তে আর্দ্র হইয়া উঠিল, বলিলেন, যাব বৈকি মা, আজই যাব। নিত্য, তুই ডাক্ রাখাল সিংকে।

সকল অধ্যায়

১. ০১. বাংলা দেশের কৃষ্ণাভ কোমল উর্বর ভূমি
২. ০২. পরদিন বেলা আটটা
৩. ০৩. সন্ধ্যায় নিচের তলার
৪. ০৪. পরদিন প্রাতঃকালে
৫. ০৫. বাঁড়ুজ্জেরা ক্ষুদ্র জমিদার
৬. ০৬. বিবাহ নির্বিঘ্নে শেষ হইয়া গেল
৭. ০৭. খাজনা আদায়ের ব্যবস্থা
৮. ০৮. দিন-তিনেক পরের কথা
৯. ০৯. শিবুকে লইয়া পিসিমা বাড়িতে ফিরিলেন
১০. ১০. ঘটনাটা হয়ত সামান্য
১১. ১১. পিসিমার একাগ্র সতৃষ্ণ দৃষ্টি
১২. ১২. শিবুর মায়ের কথাই থাকিল
১৩. ১৩. শৈলজা-ঠাকুরানীই বিচার করিলেন
১৪. ১৪. ফ্যালা ডোম মারা গিয়াছে
১৫. ১৫. সুশীল মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র
১৬. ১৬. বিষয়-সম্পত্তির দিকে
১৭. ১৭. মাসখানেক পর
১৮. ১৮. শৈলজা-ঠাকুরানী
১৯. ১৯. শ্রাবণের শেষ
২০. ২০. রামকিঙ্করবাবু
২১. ২১. শিবনাথ বিস্ময় কাটাইয়া
২২. ২২. গন্তব্য স্থানে তাহারা গিয়া পৌঁছিল
২৩. ২৩. জ্যোতির্ময়ী যেন শিবনাথের প্রতীক্ষাতেই
২৪. ২৪. গৌরী প্রণাম করিতে উদ্যত হইতেই
২৫. ২৫. কয়দিন পর
২৬. ২৬. ফাল্গুনের প্রথম
২৭. ২৭. মাস চারেক পরের কথা
২৮. ২৮. রাখাল সিং
২৯. ২৯. গভীর রাত্রিতেও শিবনাথ বিনিদ্র
৩০. ৩০. পরদিন প্ৰভাতে
৩১. ৩১. আড়াই বৎসর পর
৩২. ৩২. গরুরগাড়িতে
৩৩. ৩৩. কলিকাতার অবস্থা
৩৪. ৩৪. একটি শোকাতুর মৌনতার মধ্যে
৩৫. ৩৫. লোহার দরজাটা

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন