খুশবন্ত সিং
বিকেলের দিকে ইকবাল মোটা দড়ি দিয়ে বাঁধা চারপাই-এর ওপর নিজেকে এলিয়ে দিয়ে ঘুমাবার চেষ্টা করলেন। গতরাতে তিনি ট্রেনের একটি তৃতীয় শ্রেণীর কামরায় নিজের মোড়ানো বিছানার ওপর বসে কাটিয়েছেন। কামরাটি ছিল যাত্রীতে ভরা। যখনই তিনি একটু ঘুমাবার চেষ্টা করেছেন তখনই ট্রেনটা হঠাৎ ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে গেছে। কামরার দরজা জোর করে খুলে যাত্রীভরা কামরায় আরও যাত্রী উঠেছে সাথে রয়েছে পরিবারের অন্যান্য সদস্য আর বিছানাপত্র। অনেক মহিলা যাত্রীর কোলে শিশুরা ঘুমিয়েছিল। কিন্তু যাত্রীদের ওঠানামা, ঠেলাঠেলি ও চিৎকারে তাদের ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ায় তারা চিৎকার শুরু করে দেয়।
নিরুপায় মায়েরা সেই ভিড়ের মধ্যেই অবুঝ শিশুর মুখে স্তন দিলে তাদের কান্না থেমে যায়। কিন্তু স্টেশন ছাড়ার পর বহুক্ষণ ধরে সেই চিৎকারের রেশ থাকে। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে বার বার। কারণ পঞ্চাশ জন যাত্রীর এই কামরায় উঠেছিল প্রায় দু’ শ’ জন যাত্রী। কেউ বসে, কেউ দাঁড়িয়ে। সাথে তো বিছানাপত্র ছিলই। দরজার পাদানিতে দাঁড়িয়ে ছিল প্রায় ডজন দুই যাত্রী। হ্যান্ডেল ধরে তারা দাঁড়িয়ে ছিল। ছাদের ওপর ছিল বহু লোক। গরম ও বিকট গন্ধ ছিল অসহনীয়। ঝগড়া করার জন্য তাদের মেজাজ যেন তৈরিই ছিল। কয়েক মিনিট পর পরই যাত্রীদের মধ্যে কথা কাটাকাটি এবং উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়। কারণ অতি সামান্য। কেউ হয়ত অন্যের জায়গা সামান্য একটু দখল করে নিয়েছে অথবা টয়লেটে যাওয়ার সময় কারও পায়ে পাড়া লেগেছে। দু’জনের কথা কাটাকাটিতে অন্যেরা দুই পক্ষ নিয়ে যোগ দিয়েছে। আবার শেষে অনেকে বিরোধ মিটিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছে। সব মিলিয়ে একটা অসহনীয় পরিবেশ। এর মধ্যে ইকবাল স্বল্প আলোয় কিছু পড়ার চেষ্টা করছিলেন। বাল্বের চারপাশে পতঙ্গ উড়ছিল। তিনি একটা প্যারা পড়া শেষ না করতেই পাশ থেকে একজন বলে উঠলেন :
‘আপনি পড়ছেন?’
‘হ্যাঁ, আমি পড়ছি।’
‘আপনি কি পড়ছেন?’
‘একটা বই।’
এ উত্তরে তিনি সন্তুষ্ট হলেন না। ইকবালের হাত থেকে বইখানা নিয়ে তিনি বইয়ের পাতা উল্টে-পাল্টে দেখলেন।
‘ইংরেজী?’
‘হ্যাঁ, ইংরেজী।’
আপনি নিশ্চয়ই শিক্ষিত লোক।
ইকবাল এ কথার জবাব দিলেন না।
রইখানার হাত বদল হলো। কামরার অনেক যাত্রীই তা পরখ করে দেখলেন। তাদের ধারণা হলো, তিনি শিক্ষিত, ফলে অন্য শ্রেণীর লোক। তিনি বাবু শ্রেণীর লোক।
‘আপনার নাম কি?’
‘আমার নাম ইকবাল।’
‘স্রষ্টা আপনার ইকবাল (সুনাম) বৃদ্ধি করুক।’
লোকটা মুসলমান বলে সবাই ধরে নিল। ভাল হলেই ভাল। যাত্রীদের প্রায় সবাই ছিল মুসলমান। তারা যাচ্ছিল পাকিস্তানে।
‘আপনার বাড়ী কোথায় বাবু সাহেব?’
‘আমার পর্ণকুঠির ঝিলাম জেলায়।’ ইকবাল বললেন অতি সহজভাবে। তাঁর উত্তরে সবাই নিশ্চিত হলেন যে, লোকটি মুসলমান। কারণ ঝিলাম জেলা পাকিস্তানে।
ফলে অন্য যাত্রীরাও ইকবালকে নানা প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে তুলল। ইকবালকে তাদের বলতে হলো: সে কি করে, তাঁর আয়ের উৎস কি, সমাজে তাঁর মর্যাদা কতটুকু, কোথায় সে লেখাপড়া শিখেছে, সে বিয়ে করেনি কেন, এ যাবত সে কি কি রোগে আক্রান্ত হয়েছে। তারা তাদের পারিবারিক সমস্যা ও অসুখের কথা তুলে ইকবালের পরামর্শ চাইল। যৌন শক্তি হ্রাস পেলে ইংরেজ লোকেরা যা করে এমন কোন ওষুধ বা আয়ুর্বেদীয় ওষুধ ইকবাল কি জানে? ইত্যাকার প্রশ্নে জর্জরিত ইকবালকে পড়া বা ঘুমানোর চেষ্টা থেকে বিরত থাকতে হলো। সারা রাত এবং পরদিন সকাল পর্যন্ত তারা এ ধরনের আলোচনা চালিয়ে গেল। ইকবাল এই সফরকে দুঃসহ বলে বর্ণনা করতে পারতেন। কিন্তু তিনি জানেন ভারতে মানুষের সহ্যের সীমা কত বিস্তৃত। তাই তিনি সফরের বর্ণনা দেয়াকে অর্থহীন বলে মনে করলেন। মানো মাজরা স্টেশনে তিনি ট্রেন থেকে নেমে পরিতৃপ্তির নিঃশ্বাস ছাড়লেন। তিনি সেবন করলেন নির্মল বায়ু। অপেক্ষা করতে লাগলেন একটা দীর্ঘ নিদ্রার।
কিন্তু ঘুম ইকবালের চোখে এলো না। কামরায় বাতাস চলাচলের কোন ব্যবস্থা ছিল না। ছাতা-পড়া মাটির দুর্গন্ধ। কামরার এক কোণায় এক স্তূপ ময়লা পুরাতন কাপড়। হয়ত ধোয়ার জন্য রাখা আছে। তার চারপাশে মাছি ভন্ ভন্ করছে। ইকবাল তাঁর মুখের ওপর একটা রুমাল ছড়িয়ে দিলেন। তাঁর শ্বাস নিতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল। এমন পরিবেশেও তিনি নিদ্রায় ঢলে পড়লেন। কিন্তু মিত সিং-এর দার্শনিক কথায় তাঁর সে নিদ্রা ভেঙ্গে গেল।
‘নিজ গ্রামের লোকের বাড়িতে ডাকাতি করা আর মায়ের জিনিস চুরি করা একই ব্যাপার। ইকবাল সিংজি এটা হলো কলিযুগ, অন্ধকার যুগ। প্রতিবেশীর বাড়িতে ডাকাতি করার কথা আপনি কখনও শুনেছেন? এখন দুনিয়ায় নৈতিকতা বলতে আর কিছু নেই।’
ইকবাল তাঁর মুখ থেকে রুমালটা সরিয়ে নিলেন।
‘কি ঘটেছে?’
‘কি ঘটেছে?’ একই কথার পুনরাবৃত্তি করে মিত সিং বিস্ময়ের ভান করে বললেন, ‘কি হয়নি তাই বলুন! জুয়ার জন্য পুলিশ এসেছে। জুমা হলো দশ নম্বর বদমায়েশ। (পুলিশের খাতায় লিপিবদ্ধ অসৎ লোকদের তালিকার নম্বর মোতাবেক)। কিন্তু জুগ্গা পালিয়েছে, ফেরার। কিন্তু জুমার ঘরের আঙ্গিনায় লুঠ করা এক জোড়া চুড়ি পাওয়া গেছে। সুতরাং এ কাজ কে করেছে তা আমরা বুঝতে পেরেছি। এবারই প্রথম সে হত্যা করল না। হত্যার নেশা তার রক্তের সাথে মিশে আছে। তার পিতা ও পিতামহ ডাকাত ছিল এবং খুন করার জন্য তাদের ফাঁসি হয়। কিন্তু তারা নিজের গ্রামের কারও বাড়িতে কোনদিন ডাকাতি করেনি। সত্যি কথা বলতে কি, তারা বাড়িতে থাকলে মানো মাজরায় কোন ডাকাত আসতে সাহস করত না। জুগ্গাত সিং তার পরিবারকেই অসম্মান করল।’
ইকবাল উঠে বসে দু’হাত দিয়ে চোখ রগড়াতে লাগলেন। তাঁর ইউরোপীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে এমন অনেক কিছুই ধরা পড়ে যা তাঁর দেশীয় ভাইদের কাছে কিছুই নয়। তাদের নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি তাঁকে মাঝে মাঝে হতবাক করে দেয়। পাঞ্জাবীদের নীতিবোধ আরও বেশি বিভ্রান্তিকর। তাদের কাছে সত্য, সম্মান, অর্থনৈতিক সাধুতা—এসবই ভাল। কিন্তু এর মূল্য বন্ধুর কাছে বন্ধুর উপকারী এবং নিজ গ্রামবাসীর চেয়ে কম। বন্ধুর জন্য তুমি আদালতে মিথ্যা বলতে পার বা কাউকে ঠকাতে পার। এজন্য তোমাকে কেউ দোষ দেবে না। একইভাবে তুমি যদি পুলিশ বা ম্যাজিস্ট্রেটকে অগ্রাহ্য করতে পার, ধর্মকে অস্বীকার করতে পার, অথচ বন্ধুর প্রতি অবিচল থাক, তাহলে লোকে তোমাকে বীরের মর্যাদা দেবে। গ্রামীণ সমাজের চিত্র এটাই। এখানে গ্রামের সবাই সবার আত্মীয় কিনা এবং সবাই সবার প্রতি অনুগত কিনা সেটাই বিবেচ্য বিষয়। জুন্না হত্যা করেছে, এটা কিন্তু ধর্মগুরু মিত সিং-এর কাছে বড় কিছু নয়। তার কাছে বিবেচ্য বিষয় হলো, জুগ্গা নিজ গ্রামের এক লোকের রক্তে নিজের হাত রঞ্জিত করেছে। জুয়া যদি এমন অপরাধ পাশের গ্রামে করত তাহলে হয়ত মিত সিং তার পক্ষ সমর্থন করে এবং পবিত্র গ্রন্থের নামে শপথ করে বলতেন খুন হওয়ার সময় জুমা গুরুদুয়ারায় প্রার্থনারত ছিল! মিত সিং-এর মতো লোকের সাথে কথা বলতে ইকবালের ক্লান্তিবোধ হয়। তারা কিছু বুঝতে পারে না। ইকবাল শেষে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, তিনি ঐ ধরনের লোকের সমপর্যায়ের নন।
ইকবাল কোন আগ্রহ দেখাল না বলে মিত সিং হতাশ হলেন।
‘আপনি দুনিয়া দেখেছেন, অনেক বই পড়েছেন। কিন্তু শুনে রাখুন, সাপ তার খোলস ছাড়লেও বিষ ছাড়তে পারে না। একথা হাজার টাকার চেয়েও দামী।’
এই মূল্যবান কথারও গুণগান করল না ইকবাল। মিত সিং ব্যাখ্যা করে বললেন, ‘জুগ্গা কিছু দিন বেশ সৎভাবেই দিন কাটাচ্ছিল। সে জমি চাষ করত, গৃহপালিত পশু দেখাশোনা করত। গ্রাম থেকে বাইরে যেত না, সরদারের কাছে প্রতিদিন রিপোর্ট করত। কিন্তু কতদিন একটা সাপ না কামড়িয়ে থাকতে পারে? তার রক্তের সাথে পাপ মিশে আছে।’
‘কারও রক্তে যদি পুণ্য মিশে থাকে তাহলে তার চেয়ে বেশি কারও রক্তে পাপ মিশে থাকে না’, কিছুটা উত্তেজিত হয়েই বললেন ইকবাল। অনেক মতবাদের মধ্যে এটাও তাঁর একটা মত। কেউ কি কখনও জানার চেষ্টা করেছে মানুষ কেন চুরি, ডাকাতি, হত্যা করে? না। তারা তাদের জেলে ঢোকায় আর না হয় ফাঁসিতে ঝোলায়। এটা খুব সহজ কাজ। ফাঁসি কাষ্ঠ বা জেলের সেল যদি মানুষকে খুন বা চুরি থেকে বিরত রাখতে পারত তাহলে কোন খুন বা চুরি হত না। এটা হতে পারে না। এ প্রদেশে তারা প্রতিদিন একজন লোককে ফাঁসিতে ঝোলাচ্ছে। কিন্তু প্রতি চব্বিশ ঘণ্টায় দশ জন লোক খুন হচ্ছে। না, ভাইজি, কেউ পাপী হয়ে জন্মায় না। ক্ষুধা, চাহিদা ও অবিচার তাদেরকে পাপী করে তোলে।’
এমন নিরস বক্তব্য দেয়ায় ইকবাল নিজেকে অবিবেচক বলেই মনে করল। আলোচনার সময় এ ধরনের বক্তৃতা দেয়ার অভ্যাস তাঁর পরিত্যাগ করাই বাঞ্ছনীয়। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তিনি আগ্রহ প্রকাশ করলেন।
‘জুয়া যেহেতু সবার অতি পরিচিত, সেহেতু আমার মনে হয়, তারা সহজেই তাকে ধরতে পারবে।
‘জুগ্গা বেশি দূর যেতে পারবে না। এলাকার সবাই তাকে চেনে। সাধারণ লোকের চেয়ে সে বেশ লম্বা। ডেপুটি সাহেব সব থানায় নির্দেশ পাঠিয়েছেন জুগ্গার ওপর কড়া নজর রাখতে।’
‘ডেপুটি সাহেব কে?’ ইকবাল জিজ্ঞাসা করলেন।
‘আপনি ডেপুটি সাহেবকে চেনেন না?’ মিত সিং বিস্ময় প্রকাশ করলেন। ‘তাঁর নাম হুকুম চাঁদ। তিনি এখন আছেন পুলের উত্তর পাশে ডাকবাংলোয়। এখন হুকুম চাঁদই সত্যিকারের বীর। তিনি ছিলেন একজন কনস্টেবল। আর এখন তিনি কোথায়। তিনি সব সময় সাহেবদের খুশি রাখেন এবং তাঁরা তাঁকে একটার পর একটা পদোন্নতি দেন। শেষের জন তাঁকে ডেপুটি করে দেন। সত্যি ইকবাল সিংজি, হুকুম চাঁদ একজন বীর এবং তিনি চালাকও বটে। তিনি বন্ধুদের প্রতি সহানুভূতিশীল এবং তাদের সব কাজ তিনি করিয়ে দেন। তিনি তার বহু আত্মীয়- স্বজনকে ভাল চাকরি জুটিয়ে দিয়েছেন। তাঁর মতো লোক এক শ’ জনে একজন পাওয়া ভার।’
‘তিনি কি আপনার বন্ধু?’
‘বন্ধু? না, না।’ প্রতিবাদের সুরে বললেন মিত সিং। আমি এই গুরুদুয়ারার একজন সাধারণ ভাই। আর তিনি একজন সম্রাট। তিনি সরকার আর আমরা তাঁর প্রজা। তিনি মানো মাজরায় আসলে আপনি তাঁকে দেখতে পাবেন।
আলোচনায় কিছুটা বিরতি ঘটল। ইকবাল তাঁর স্যান্ডেলে পা ঢুকিয়ে দাঁড়ালেন। ‘আমার কিছুটা হাঁটা দরকার। কোন্ দিকে যাওয়া ঠিক বলে আপনি মনে করেন?’
‘আপনার যেদিকে ইচ্ছা সেদিকে যান। সব দিকই উন্মুক্ত। নদীর ধারে যান। দেখবেন ট্রেন আসছে আর যাচ্ছে। রেল রাস্তা পার হয়ে গেলে আপনি ডাকবাংলো দেখতে পাবেন। কিন্তু দেরি করবেন না। এখন সময় ভাল নয়। সন্ধ্যার আগে ঘরে ফেরাই ভাল। তাছাড়া আমি মসজিদের ইমাম বখশ ও সরদারকে বলেছি আপনার কথা। তারা আপনার সাথে দেখা করার জন্য আসতে পারে।’
‘না, আমার দেরি হবে না।’
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন