আনিসুল হক
৬০
 আজাদের মায়ের মৃত্যুর পরে, মালিবাগের শ্বশুরবাড়িতে বসে কচির মনে পড়ে, ‘৭২ সালে মাঝে মধ্যে আম্মাকে সে গান গেয়ে শোনাত৷ এই সময় আম্মার প্রিয় গান ছিল, আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি…
 কচি গলা ছেড়ে গাইত৷ মা, ঘরে কুপি জ্বলছে, আলো নড়ছে, মায়ের মুখে আলো পড়ছে আর নড়ছে, চুপচাপ পাটিতে বসে গান শুনছেন :
 আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি
 তুমি এই অপরূপ রূপে বাহির হলে জননী!
 ওগো মা, তোমায় দেখে দেখে আঁখি না ফিরে!
 তোমার দুয়ার আজি খুলে গেছে সোনার মন্দিরে।।
 ডান হাতে তোর খড়্গ জ্বলে, বাঁ হাতে তোর শঙ্কাহরণ,
 দুই নয়নে স্নেহের হাসি, ললাটনেত্র আগুনবরন৷
 ওগো মা, তোমার কী মুরতি আজি দেখি রে!
 তোমার দুয়ার আজি খুলে গেছে সোনার মন্দিরে।।
 তোমার মুক্তকেশের পুঞ্জ মেঘে লুকায় অশনি,
 তোমার আঁচল ঝলে আকাশ তলে রৌদ্রবসনী!
 ওগো মা তোমায় দেখে দেখে আঁখি না ফিরে!
 তোমার দুয়ার আজি খুলে গেছে সোনার মন্দিরে।।
 যখন অনাদরে চাইনি মুখে ভেবেছিলাম দুঃখিনী মা
 আছে ভাঙা ঘরে একলা পড়ে দুঃখের বুঝি নাইকো সীমা৷
 কোথা সে তোর দরিদ্র বেশ, কোথা সে তোর মলিন হাসি-
 আকাশে আজ ছড়িয়ে গেল ওই চরণের দীপ্তিরাশি!
 ওগো মা, তোমার কী মুরতি আজি দেখি রে!
 তোমার দুয়ার আজি খুলে গেছে সোনার মন্দিরে।।
 আজি দুখের রাতে সুখের স্রোতে ভাসাও ধরণী-
 তোমার অভয় বাজে হৃদয়মাঝে হৃদয়হরণী!
 ওগো মা, তোমায় দেখে দেখে আঁখি না ফিরে!
 তোমার দুয়ার আজি খুলে গেছে সোনার মন্দিরে।।
কচি গান গায় আর তার ভারি কান্না পায়৷ গানের কথাগুলো কি রবীন্দ্রনাথ আম্মাকে নিয়েই লিখে রেখেছিলেন ? এই মা কি আম্মা, নাকি দেশ ? আমার সোনার বাংলা, যাকে আমরা খুব ভালোবাসি, যাকেও আমরা মা বলে ডাকি ? বলি, মা তোর বদনখানি মলিন হলে আমি নয়নজলে ভাসি… কী জানি, কচির ছোট মাথায় হিসাব মেলে না৷ কিন্তু দ্যাখো, রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, আজি দুখের রাতে সুখের স্রোতে ভাসাও তরণী, এ তো তাদের আম্মারই রূপ৷ কোথা সে তোর দরিদ্র বেশ, কোথা সে তোর মলিন হাসি, এও তো তাদের আম্মাকেই কেবল বলা যায়৷
 কুপির সলতে জ্বলে, কুপির শিখাটা এমন যে শিখার ছায়া পড়েছে মেঝেতে, আশ্চর্য না, আলোর নিজের ছায়া পড়ে! আর আম্মাকে দেখা যাচ্ছে কী! মনে হচ্ছে, পিতলের তৈরি এক মাতৃমূর্তি৷ সত্যি তিনি আজ দুখের রাতে সুখের স্রোতে ধরণী ভাসিয়ে দিচ্ছেন, আম্মা বলেন, ‘আজাদ বেঁচে আছে, দেখিস, ও আসবে, আর দ্যাখ, দেশটা তো স্বাধীন হয়েছে, জুলুম অত্যাচার তো বন্ধ হয়েছে, এখন তো আর সারাক্ষণ ভয়ে ভয়ে থাকতে হয় না, আজাদ যেদিন আসবে, কত খুশি হবে সে…’
 ১৯৮৫ সালে, স্বামিগৃহে বসে, স্মৃতিতাড়িত কচি তার নিজের ছোট ছোট মেয়েদের ডেকে বলে, ‘আম্মা আর আমি আর কী করতাম জানিস ?’
 তারা আধো আধো স্বরে বলে, ‘কী করতা ?’
 ‘আম্মা যখন আমার ওপরে রাগ করতেন, আমার সঙ্গে কথা বলতে চাইতেন না, আমি তার দরজায় দাঁড়িয়ে গান গাইতে আরম্ভ করে দিতাম :
 বড় আশা করে এসেছি গো, কাছে টেনে লও,
 ফিরায়ো না জননী
 দীনহীনে কেহ চাহে না, তুমি তারে রাখিবে জানি গো৷
 আর আমি যে কিছু চাহি নে, চরণতলে বসে থাকিব৷
 আর আমি যে কিছু চাহি নে, জননী বলে শুধু ডাকিব৷’
 কচি গুনগুন করে গান গেয়ে চলে, মাকে গান গাইতে দেখে তার দুই মেয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে, কচি বলে, ‘আম্মা চুপ করে এই গান শুনত, গান শেষ হলে দেখতাম তার রাগ আর নাই৷’
 কচির চোখ জলে টলমটল করে৷
 তার ছোট ছোট মেয়েরা অবাক হয়ে দেখে তাদের মা কাঁদছে৷
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন