২২. দেশে দেশে মজুরির পার্থক্য

কার্ল মার্ক্স

দ্বাবিংশ অধ্যায় ॥ দেশে দেশে মজুরির পার্থক্য

সপ্তদশ অধ্যায়ে আমরা বহুবিধ সংযোজন নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম, এমন সব সংযোজন। নিয়ে যা শ্রমশক্তির আয়তনে পরিবর্তন ঘটাতে পারে; এই আয়তনকে আমরা বিবেচনা করেছিলাম, হয়, অনাপেক্ষিক ভাবে আর, নয়ত, আপেক্ষিক ভাবে অর্থাৎ উদ্বৃত্ত-মূল্যের সঙ্গে তুলনার মাধ্যমে; অথচ, অন্যদিকে, জীবনধারণের উপকরণসমূহের পরিমাণ, যার মধ্যে শ্রমের দাম রূপায়িত হয়, তা আবার এই দামের পরিবর্তন থেকে স্বতন্ত্রভাবে ও ভিন্নতরভাবে ওঠা-নামা করতে পারে।[১] যে কথা আগেই বলা হয়েছে, মজুরির মামুলি রূপটিতে শ্রমশক্তির মূল্যের, কিংবা, যথাক্রমে দামের, এই সরল রূপায়ণ এই সমস্ত নিয়মকে রূপান্তরিত করে মজুরির হ্রাস-বৃদ্ধির নিয়মাবলীতে। একটি মাত্র দেশের অভ্যন্তরে যা মজুরির এই হ্রাস-বৃদ্ধিতে আত্মপ্রকাশ করে পরিবর্তনশীল সংযোজনসমূহের একটি ক্রম হিসাবে, তা বিভিন্ন দেশে আত্মপ্রকাশ করতে পারে জাতীয় মজুরিতে সমকালীন পার্থক্য হিসাবে। বিভিন্ন দেশে মজুরির তুলনা করতে গিয়ে, আমাদের তাই অবশ্যই হিসাবে ধরতে হবে এমন সমস্ত উপাদানকে, যা শ্রম শক্তির মূল্যের পরিমানে পরিবর্তনগুলিকে নির্ধারণ করে। স্বাভাবিক ও ঐতিহাসিক ভাবে বিকশিত জীবনধারণের প্রাথমিক প্রয়োজনসমূহের দাম ও মাত্রা, শ্রমিকদের প্রশিক্ষিত করার খরচ, নারী ও শিশুদের শ্রমের দ্বারা সম্পাদিত ভূমিকা, শ্রমের উৎপাদনশীলতা, তার ব্যক্তিগত ও তীব্রতাগত মাত্রা। এমনকি, একান্ত ভাসা-ভাসা তুলনা করার জন্যও চাই বিভিন্ন দেশে একই রকমের বৃত্তির জন্য গড় দৈনিক মজুরিতে একটি অভিন্ন কর্ম-দিবসে পর্যবসিত করা। দৈনিক মজুরিতে একই শর্তাবলীতে পর্যবসিত করার পরে, সময়-ভিত্তিক মজুরিকে আবার রূপায়িত করতে সংখ্যা-ভিত্তিক মজুরিতে, কেননা একমাত্র সংখ্যা-ভিত্তিক মজুরিই শ্রমের উৎপাদনশীলতা ও তীব্রতা এই উভয়েরই একটা পরিমাপ হিসাবে কাজ করতে পারে।

প্রত্যেক দেশেই শ্রমের একটা নির্দিষ্ট গড় তীব্রতা আছে, যার নীচে কোন পণ্য উৎপাদনের জন্য প্রয়োজন হয় সামাজিকভাবে আবশ্যিক সময়ের চেয়ে বেশি সময়; সুতরাং তা স্বাভাবিক গুণমানের শ্রম হিসাবে পরিগণিত হয় না। কোন একটি দেশে জাতীয় গড়ের তুলনায় উচ্চতর মাত্রার তীব্রতাই কেবল মূল্যের পরিমাপকে কাজের সময়ের নিছক স্থিতিকাল দিয়ে প্রভাবিত করে। বিশ্বজনীন বাজারে, যার সংগঠনী অংশগুলি হচ্ছে বিভিন্ন স্বতন্ত্র দেশ, সেখানে এমন ঘটেনা। শ্রমের গড় তীব্রতা দেশে দেশে ভিন্ন ভিন্ন। এখানে তা বেশি, ওখানে কম। এই জাতীয় (দেশগত) গড়গুলি একটি মানদণ্ড ( স্কেল) রচনা করে, যার পরিমাপের এককই হল বিশ্বজনীন শ্রমের গড় একক। অতএব, কম তীব্র জাতীয় শ্রমের তুলনায় বেশি তীব্র জাতীয় শ্রম একই সময়ের মধ্যে বেশি মূল্য উৎপাদন করে, যা নিজেকে অভিব্যক্ত করে বেশি অর্থের আকারে।

কিন্তু মূল্যের নিয়মটি তার আন্তর্জাতিক প্রয়োগের ক্ষেত্রে এই ঘটনার দ্বারা আরো উপযোজিত হয় যে, বিশ্ববাজারে অধিকতর উৎপাদনশীল জাতীয় শ্রম পরিগণিত হয় অধিকতর তীব্র শ্রম হিসাবে, যে-পর্যন্ত না অধিকতর উৎপাদনশীল জাতিটি (দেশটি ) প্রতিযোগিতার চাপে তার পণ্যদ্রব্যাদি বিক্রয়-দাম তাদের মূল্যের স্তরে নামিয়ে আনতে বাধ্য হয়।

যে-অনুপাতে একটি দেশে ধনতান্ত্রিক উৎপাদন বিকশিত হয়, সেই অনুপাতে সেখানে শ্রমের জাতিগত তীব্রতা ও উৎপাদনশীলতা আন্তর্জাতিক স্তরের উপরে ওঠে।[২] সুতরাং বিভিন্ন দেশে একই কাজের সময়ের মধ্যে উৎপাদিত, একই ধরনের পণ্যের বিভিন্ন পরিমাণ হয় অসমান আন্তর্জাতিক মূল্যের অধিকারী, যা আবার অভিব্যক্তি পায় বিভিন্ন দামের মধ্যে অর্থাৎ টাকার অঙ্কে, যে-অঙ্ক আবার পরিবর্তিত হয় আন্তর্জাতিক মূল্য অনুযায়ী। সুতরাং যে জাতির মধ্যে ধনতান্ত্রিক উৎপাদন-পদ্ধতি কম বিকশিত, সেই তুলনায়, যে জাতির মধ্যে সেই পদ্ধতি বেশি বিকশিত, সেই জাতিতে অর্থের আপেক্ষিক মূল্য অল্পতর হবে। সুতরাং এ থেকে বেরিয়ে আসে যে, কম বিকশিত জাতিটির তুলনায় বেশি বিকশিত জাতিটির আর্থিক মজুরি অর্থাৎ অঙ্কে প্রকাশিত শ্রমশক্তির মূল্য বেশি হবে। অবশ্য, এতে প্রমাণিত হয় না যে আসল মজুরির ক্ষেত্রেও, অর্থাৎ শ্রমিকের প্রাপ্ত জীবনধারণের দ্রব্য সামগ্রী পরিমাণের ক্ষেত্রেও, তা হবে।

বিভিন্ন দেশে টাকার মূল্যের এই আপেক্ষিক পার্থক্য ছাড়াও, এটা প্রায়ই দেখা যাবে, কম বিকশিত দেশটির চেয়ে বেশি বিকশিত দেশটিতে দৈনিক বা সাপ্তাহিক ইত্যাদি মজুরি বেশি, অথচ শ্রমের আপেক্ষিক দাম অর্থাৎ উদ্বৃত্ত-মূল্য ও উৎপন্ন দ্রব্যের দাম উভয়ের তুলনায় শ্রমের দাম বেশি বিকশিত দেশটির চেয়ে কম বিকশিত দেশটিতে বেশি।[৩]

সুতোকাটা শিল্পে সমীক্ষা চালিয়ে ১৮৩৩ সালের কারখানা কমিশনের সদস্য জে ভব কাওয়েল এই সিদ্ধান্তে আসেন যে, “ইউরোপ-ভূখণ্ডের তুলনায় ইংল্যাণ্ডে মজুরি কার্যত ধনিকের ক্ষেত্রে কম, যদিও শ্রমিকের ক্ষেত্রে বেশি।” (উরে, পৃঃ ৩১৪)। ইংরেজ কারখানা-পরিদর্শক আলেক্সাণ্ডার রেডগ্রেভ তঁার ১৮৬৬, ৩১শে অক্টোবরের রিপোর্টে ইউরোপীয় ভুখণ্ডবিস্তৃত রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে তুলনামূলক পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে বলেন, অল্পতর মজুরি ও দীর্ঘতর কাজের সময় সত্ত্বেও, উৎপন্ন দ্রব্যের অনুপাতে ভূখণ্ডের শ্রম ইংল্যাণ্ডের শ্রমের তুলনায় মহার্ঘতর। ওভেনবুর্গের একটি তুলো কারখানায় একজন ইংরেজ ম্যানেজার ঘোষণা করেন যে, শনিবার সমেত সেখানে কাজের সময়ের দৈর্ঘ্য সকাল ৫টা ৩০ মিনিট থেকে রাত পর্যন্ত এবং সেখানকার শ্রমিকেরা ঐ সময়ে যখন তারা কাজ করে ইংরেজ তদারককারীদের অধীনে, তখন তারা ততটা জিনিসও উৎপাদন করে না, যতটা তারা করে ১০ ঘণ্টায়, কিন্তু জার্মান তদারককারীদের অধীনে, তারা উৎপাদন করে অনেক কম। ইংল্যাণ্ডের তুলনায় মজুরি অনেক কম; বহু ক্ষেত্রে শতকরা ৫০ ভাগেরও কম; কিন্তু মেশিনারির অনুপাতে শ্রমিক-সংখ্যা ঢের বেশি, কোন কোন বিভাগে ৫: ৩ অনুপাতে।মিঃ রেডগ্রেভ রুশ তুলো কারখানাগুলি সম্পর্কে অত্যন্ত পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্য উপস্থিত করেন। অতি সাম্প্রতিক কাল পর্যন্ত সেখানে কাজ করেছেন, এমন একজন ইংরেজ ম্যানেজারের কাছ থেকে তিনি ঐ তথ্যগুলি পেয়েছেন। যাবতীয় অখ্যাতিতে ফলবতী এই রুশ মৃত্তিকায় ইংরেজি কারখানার সেই প্রথম যুগের বিভীষিকাগুলি আজও পূর্ণমাত্রায় বিরাজ করছে। ম্যানেজাররা অবশ্যই ইংরেজ, কেননা ব্যবসার এই ব্যাপারে স্থানীয় রুশ ধনিক একে বারেই অপদার্থ। দিন-রাত জুড়ে মাত্রাহীন খাটুনি সত্ত্বেও, শ্রমিকের মজুরির লজ্জাজনক স্বল্পতা সত্ত্বেও, রুশ ম্যানুফ্যাকচার কেবল বিদেশী প্রতিযোগিতার উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করেই কোনক্রমে টিকে আছে। উপসংহারে, আমি ইউরোপের বিভিন্ন দেশে কারখানা-পিছু ও সুতো-কাটুনি-পিছু টাকুর গড় সংখ্যা-সংক্রান্ত মিঃ রেডগ্রেভের তুলনা মূলক সারণীটি এখানে তুলে দিচ্ছি। তিনি নিজেই মন্তব্য করেছেন যে, তিনি কয়েক বছর আগে এগুলি সংগ্রহ করেছেন এবং তখন থেকে আজ পর্যন্ত ইংল্যাণ্ডে কারখানা গুলির আয়তন এবং শ্রমিক-পিছু টাকুর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। অবশ্য, তিনি মনে করেন যে, ইউরোপীয় ভূখণ্ডের উল্লিখিত দেশগুলিতে মোটামুটি সমান অগ্রগতি ঘটেছে, সুতরাং যে-সংখ্যাতথ্য এখানে দেওয়া হয়েছে, তুলনা করার উদ্দেশ্যে এখনো তার মূল্য আছে।

কারখানা-পিছু টাকুর গড় সংখ্যা

 ইংল্যাণ্ড       কারখানা-পিছু টাকুর গড় সংখ্যা     ১২,৬০০
ফ্রান্স                   ,,                                ১৫০০
 প্রুশিয়া               ,,                                ১৫০০
 বেলজিয়াম           ,,                                 ৪০০০
স্যাক্সনি               ,,                                 ৪৫০০
অস্ট্রিয়া               ,,                                 ৭০০০
সুইজারল্যাণ্ড         ,,                                 ৮০০০

ব্যক্তি-পিছু টাকুর গড় সংখ্যা

ফ্রান্স    একজন ব্যক্তি-পিছু    ১৪ টাকু
রাশিয়া        ,,                 ২৮
প্রুশিয়া        ,,                  ৩৭
 ব্যাভেরিয়া    ,,                  ৪৬
অস্ট্রিয়া        ,,                  ৪৯
বেলজিয়াম    ,,                   ৫০
 স্যাক্সনি       ,,                   ৫০
 সুইজারল্যাণ্ড  ,,                  ৫৫
জার্মানির ক্ষুদ্রতর রাষ্ট্রসমূহ  ,,    ৫৫
গ্রেট ব্রিটেন     ,,                  ৭৪

মিঃ রেভগ্রেভ বলেন, “এই তুলনা গ্রেট ব্রিটেনের পক্ষে আরো কম অনুৰুল যেহেতু এক বিরাটসংখ্যক কারখানায় শক্তির সাহায্যে বয়নের কাজ সুতো তৈরির সঙ্গে একযোগে পরিচালিত হয় (অথচ উল্লিখিত সারণীতে বয়নকারীদের বাদ দেওয়া হয়নি, এবং বিদেশের কারখানাগুলি প্রধানতঃ সুতা তৈরির কারখানা; যদি কঠোরভাবে সমানে সমানে তুলনা করা যেত, আমি আমার জেলায় এমন অনেক তুলল-কারখানা দেখতে পারতাম, যেখানে ২,০০০ মাকুর কাজ দেখছে মাত্র একজন লোক (মাইণ্ডার) এবং তার সঙ্গে দুজন সহকারী, দৈনিক উৎপাদন করছে ২২০ পাউণ্ড সুতোযার দৈর্ঘ্য হবে ৪০০ মাইল” (কারখানা-পরিদর্শকের রিপোর্ট, ৩১শে অক্টোবর, ১৮৬৬ সাল, পৃ: ৩১-৩৭)।

এটা সুপরিজ্ঞাত যে, পূর্ব ইউরোপে এবং এশিয়ায়, ইংরেজ কোম্পানিগুলি রেলপথের নির্মাণকার্য শুরু করেছে এবং তা করতে গিয়ে, তদ্দেশীয় শ্রমিকদের পাশাপাশি কিছু সংখ্যক ইংরেজ শ্রমিকও নিযুক্ত করেছে। বাস্তব প্রয়োজনের চাপে তারা এইভাবে বাধ্য হয়েছে শ্রম-তীব্রতায় জাতিগত পার্থক্যকে হিসাবের মধ্যে ধরতে, অবশ্য তাতে তাদের কোনো ক্ষতি হয়নি। তাদের অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে যে, এমনকি যদি মজুরির উচ্চতা শ্রমের গড় তীব্রতার মোটামুটি অনুরূপ হয়, তাহলে আমরা শ্রমের আপেক্ষিক দাম সাধারণতঃ বিপরীত দিকে পরিবর্তিত হয়।

তাঁর প্রথম অর্থ নৈতিক লেখাগুলির একটিতে,“মজুরির হার প্রসঙ্গে প্রবন্ধে”[৪] এইচ ক্যারি প্রমাণ করতে চেষ্টা করেন যে, বিভিন্ন জাতির মজুরি জাতীয় কর্মদিবসের উৎপাদনশীলতার মাত্রার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ভাবে আনুপাতিক; এই আন্তর্জাতিক সম্পর্ক থেকে তিনি এই সিদ্ধান্ত টানেন যে, সর্বত্রই মজুরির হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে শ্রমের উৎপাদন শীলতার অনুপাতে। উদ্বৃত্ত-মূল্যের উৎপাদন সম্পর্কে আমাদের সমগ্র বিশ্লেষণটি প্রমাণ করে দেয় ক্যারির এই সিদ্ধান্তটি কত আজগুবি; তার অভ্যাসগত অবিবেচক ও ভাসাভাসা ভঙ্গিমায় এক গাদা পরিসংখ্যানের তালগোল পাকান পিণ্ড নিয়ে এদিক ওদিক কসরৎ না করে, তিনি নিজে যদি এমনকি তার প্রতিজ্ঞাগুলিও প্রমাণ করতে পারতেন! তার বক্তব্যের সবচেয়ে ভাল দিক এইটাই যে, তিনি বলেননি, তাঁর তত্ত্ব অনুসারে যা যা হওয়া উচিত, ঠিক তাই তাই হয়েছে। কেননা, রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ স্বাভাবিক অর্থনৈতিক সম্পর্কসমূহকে ভেস্তে দিয়েছে। অতএব, বিভিন্ন জাতীয় মজুরিগুলিকে গণ্য করতে হবে যেন তার প্রত্যেকটির যে-অংশ ট্যাক্সের আকারে রাষ্ট্রের হাতে যায়, তাই শ্রমিকের নিজের হাতে এসে গিয়েছে। মিঃ ক্যারির কি আরো বিবেচনা করে দেখা উচিত ছিল না যে ঐ “রাষ্ট্রীয় ব্যয়গুলি” ধনতান্ত্রিক বিকাশের স্বাভাবিক” ফল নয়? যে-ব্যক্তিটি সর্বপ্রথমে ঘোষণা করেছিলেন যে, ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের সম্পর্কসমূহ হল প্রকৃতি ও যুক্তির শাশ্বত নিয়ম,-যার অবাধ ও সুষম ক্রিয়াশীলতা ব্যাহত হয় কেবল রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের দ্বারা এবং যিনি পরে আবিষ্কার করেছিলেন যে বিশ্ববাজারের উপরে ইংল্যাণ্ডের শয়তানি প্রভাবই (যে-প্রভাব, মনে হয়, ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের প্রাকৃতিক নিয়মাবলী থেকে উদ্ভূত হয় না), রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপকে অর্থাৎ রাষ্ট্র কর্তৃক, ওরফে, সংরক্ষণতন্ত্র”-কর্তৃক, প্রকৃতি ও যুক্তির ঐ নিয়মাবলীর সংরক্ষণেকে অবশ্যম্ভাবী করে তুলেছিল, সেই ব্যক্তিটির পক্ষে এমন ধারা যুক্তি প্রদর্শন খুবই শোভন। তিনি আরো আবিষ্কার করেছিলেন যে, রিকার্ডো ও অন্যান্যদের যেসব উপপাদ্যে উপস্থিত সামাজিক বৈরিতা ও বিরোধগুলি সূত্রায়িত হয়েছে, সেই উপপাদ্যগুলিতে বাস্তব অর্থ নৈতিক গতিপ্রকৃতির তত্ত্বগত ফল নয়, বরং, বিপরীত, ইংল্যাণ্ডে ও অন্যত্র ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের বাস্তব সম্পর্কগুলিই রিকার্ডো ও অন্যান্যদের তসমূহের ফল। সর্বশেষে, তিনি আবিষ্কার করলেন যে, বাণিজ্যই শেষ পর্যন্ত ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের সহজাত সৌন্দর্য ও সুষমা সমূহের সংহার সাধন করে। আরো এক পা এগোলেই, সম্ভবত, তিনি আবিষ্কার করে ফেলবেন ধনতান্ত্রিক উৎপাদনে একটিই মাত্র খারাপ জিনিস আছে, সেটি হল মূলধন নিজেই। বিবেচনা-বৃত্তির এমন নিদারুণ অভাব এবং এমন মিথ্যা পাণ্ডিত্যের ভড়ং যার আছে, তিনিই হতে পারেন, তার সংরক্ষণবাদী বিধর্মিতা সত্ত্বেও, বাষ্টিয়াট এবং আজকের দিনের তাবৎ অবাধ বাণিজ্যকামী আশাবাদীদের গোপন উৎস।

————

১. এটা বলা ঠিক নয় যে (এখানে কেবল টাকার অঙ্কে প্রকাশিত মজুরির কথা বলা হয়েছে) মজুরি বৃদ্ধি পেয়েছে, কেননা তা অপেক্ষাকৃত সস্তা দামে অপেক্ষাকৃত বেশি জিনিস ক্রয় করতে পারছে। (ডেভিড বুকানন কৃত অ্যাডাম স্মিথের ওয়েলথ…’-এর সংস্করণে, প্রথম খণ্ড, পৃঃ ৪১৭, টীকা)।

২. আমরা অন্যত্র আলোচনা করব উৎপাদনক্ষমতা সম্পর্কে কোন্ কোন ঘটনা এই নিয়মটিকে আলাদা শিল্প-শাখার সঙ্গে উপযোজিত করতে পারে।

৩. অ্যাডাম স্মিথের বিরুদ্ধে তার তর্কযুদ্ধে জেমস এণ্ডার্সন মন্তব্য করেন। “অনুরূপ ভাবে এই প্রসঙ্গেও মন্তব্য হওয়া উচিত যে, যদিও শ্রমের দাম দরিদ্র দেশগুলিতে সচরাচর কম, যেখানে মাটির ফসল এবং সাধারণ ভাবে দানাশস্য সন্তা, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা বাস্তবিক পক্ষে অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশি। কারণ শ্রমিককে দিন-প্রতি যে মজুরি দেওয়া হয়, তা শ্রমের আসল দাম নয়, যদিও তা তার আপাত দাম। আসল দাম হল যা একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ শ্রম সম্পাদন করার জন্য নিয়োগকর্তাকে বস্তুতই ব্যয় করতে হয়। এবং এই আলোতে দেখলে, শ্রম প্রায় সর্ব ক্ষেত্রেই দরিদ্র দেশের তুলনায় ধনী দেশে সস্তা, যদিও দানাশস্য ও অন্যান্য খাদ্যসামগ্রীর দাম ধনী দেশের তুলনায় দরিদ্র দেশে ঢের কম। দিনের ভিত্তিতে হিসাব করা শ্রম ইংল্যাণ্ডের তুলনায় স্কটল্যাণ্ডে অনেক কম। সংখ্যার ( ‘পিস-এর ভিত্তিতে হিসাব করা শ্রম ইংল্যাণ্ডে সাধারণতঃ অপেক্ষাকৃত সস্তা।” (জেমস এণ্ডার্সন, অবজার্ভেশনস অন দি মিনস অব এক্সাইটিং এ স্পিরিট অব ন্যাশনাল ইণ্ডাষ্ট্রি’, ১৭৭৭, পৃ: ৩৫, ৩৫১)। বিপরীত দিকে, মজুরির নিম্নহার আবার তার বেলায় শ্রমের মহাতা ঘটায়। ইংল্যাণ্ডের তুলনায় আয়াল্যাণ্ডে শ্রম মহার্ঘতর কেননা মজুরি এত বেশি নিয়তর। (নং ২০৭৪, “রয়্যাল কমিশন অন রেলওয়েজ, মিনিটস’, ১৮৬৭)।

৪. ‘এসে অন দি রেট অব ওয়েজেস উইথ অ্যান এগজামিনেশন অব দি কজেস অব দি ডিফারেন্সস ইন দি কণ্ডিশন অব দি লেবারিং পপুলেশন থআউট দি ওয়ান্ড” ফিলাডেলফিয়া, ১৮৩৫। (মজুরির হার প্রসঙ্গে প্রবন্ধ : তৎসহ সমগ্র বিশ্বে শ্রম জীবী জনসংখ্যার অবস্থায় পার্থক্যের কারণ সম্পর্কে একটি সমীক্ষা)।

সকল অধ্যায়

১. ০১. পণ্য (১ম অধ্যায়)
২. ০২. বিনিময় (দ্বিতীয় অধ্যায়)
৩. ০৩. অর্থ, অথবা পণ্য-সঞ্চলন (তৃতীয় অধ্যায়)
৪. ০৪. মূলধনের জন্য সাধারণ সূত্র
৫. ০৫. মূলধনের সাধারণ সূত্রে স্ববিরোধসমূহ
৬. ০৬. শ্রমশক্তির ক্রয়-বিক্রয়
৭. ০৭. শ্ৰম-প্রক্রিয়া এবং উদ্বৃত্ত-মূল্যে উৎপাদনের প্রক্রিয়া
৮. ০৮. স্থির মূলধন এবং অস্থির মূলধন
৯. ০৯. উদ্বৃত্ত মূল্যের হার
১০. ১০. শ্রম-দিবস
১১. ১১. উদ্বৃত্ত মূল্যের হার ও মোট পরিমাণ
১২. ১২. আপেক্ষিক উদ্বৃত্তমূল্যের ধারণা
১৩. ১৩. সহযোগ (ত্রয়োদশ অধ্যায়)
১৪. ১৪. ম্যানুফ্যাকচারের দ্বিবিধ উৎপত্তি
১৫. ১৫. মেশিন ও আধুনিক শিল্প
১৬. ১৬. অনাপেক্ষিক ও আপেক্ষিক উদ্বৃত্ত-মূল্য
১৭. ১৭. শ্রমশক্তির দামে এবং উদ্বৃত্ত-মূল্যে আয়তনের পরিবর্তন
১৮. ১৮. উদ্বৃত্ত-মূল্যের হার প্রসঙ্গে বিবিধ সূত্র
১৯. ১৯. শ্রমশক্তির মূল্যের (এবং যথাক্রমে দামের) মজুরিতে রূপান্তর
২০. ২০. সময়-ভিত্তিক মজুরি
২১. ২১. সংখ্যা-ভিত্তিক মজুরি
২২. ২২. দেশে দেশে মজুরির পার্থক্য
২৩. ২৩. সরল পুনরুৎপাদন
২৪. ২৪. উদ্বৃত্ত মূল্যের মূলধনে রূপান্তরণ
২৫. ২৫. ধনতান্ত্রিক সঞ্চয়নের সাধারণ নিয়ম
২৬. ২৬. আদিম সঞ্চয়নের গুপ্তকথা
২৭. ২৭. জমি থেকে কৃষি-জনসংখ্যার উৎপাটন
২৮. ২৮. পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষ থেকে উৎখাতদের বিরুদ্ধে রক্তাক্ত আইন-প্রণয়ন
২৯. ২৯. ধনতান্ত্রিক কৃষি মালিকের উৎপত্তি
৩০. ৩০. শিল্পের উপরে কৃষি বিপ্লবের প্রতিক্রিয়া
৩১. ৩১. শিল্প-ধনিকের উৎপত্তি
৩২. ৩২. ধনতান্ত্রিক সঞ্চয়নের ঐতিহাসিক প্রবণতা
৩৩. ৩৩. উপনিবেশ-বিস্তারের নোতুন তত্ত্ব

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন