সুখ অসুখ – ১

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

এক

ঝপ করে বেতের চেয়ারটার ওপর বসে পা দুটো সামনে ছড়িয়ে একটা বড় নিশ্বাস ফেললেন রজত। অনেকক্ষণ টানা গাড়ি চালিয়ে এসেছেন, সেই ক্লান্তি। গলার টাইয়ের ফাঁস আলাগা করতে করতে বললেন, জানো, আজ হঠাৎ অরুণের সঙ্গে দেখা হল।

পাশের ছোট্ট ঘরটার দরজার পাশে বসে মালতী লুচি ভাজছিল। স্টোভের হিস হিস শব্দ, সামান্য অন্ধকারে মালতীর মুখে লাল আভা। গাঢ় নীল রঙের শাড়ি পরেছে বলে সেই অন্ধকার, মালতীর ফরসা মুখ আর স্টোভের লালচে শিখা, সব মিলিয়ে খুব মানিয়েছে। মুখ না তুলেই মালতী বলল কে অরুণ? অরুণ দাশগুপ্ত? ছুটি শেষ হয়ে গেল এর মধ্যে?

সে নয়, তোমার বন্ধু অরুণ।

আমার আবার কে বন্ধু?

বিয়ের আগে তুমি যাকে চিনতে!

চাকি থেকে গোল লেচি তুলে আলুমিনিয়ামের কড়াইতে গরম ঘিয়ের মধ্যে ছাড়ার সময় ছ্যাঁক করে একটা শব্দ হল। সেই শব্দের সঙ্গে মিলিয়ে সামান্য হেসে মালতী বলল, বিয়ের আগে তো আমি তিনজন অরুণকে চিনতুম! এ কোন জন?

টাই খোলা হয়ে গেছে, রজত এখন জুতোর ফিতে খুলছেন, সেই অবস্থায় মুখ নিচু রেখেই বললেন, বাঃ, অরুণ চ্যাটার্জিকে তোমার মনে নেই?

মালতী বলল, তুমি আগে জলখাবার খাবে, না আগে স্নান সেরে নেবে?

আগেই খেয়ে নিই। বেশ খিদে পেয়েছে দেখছি, লুচির গন্ধটা নাকে আসার পর আরও খিদে বেড়ে গেল!

তা হলে মুখ-হাত ধুয়ে নাও অন্তত। যা ধুলো রাস্তায়।

জুতো খুলে ফেলে রজত একেবারে মালতীর কাছাকাছি এসে মাটিতে বসে পড়েছেন। দরজার এপারে। বললেন, আমি হাত দেব না, তুমি একটা লুচি আমার মুখে পুরে দাও তো!

না, হাতটা ধুয়েই এসো না, কী কুঁড়েমি!

ইচ্ছে করছে না। দাও না একটা খাইয়ে।

এমন ছেলেমানুষ! দাঁড়াও, এই কড়াইটা নামিয়ে নিই।

অরুণ চ্যাটার্জিকে তোমার মনে পড়ল না?

মাংসের কিমা দিয়ে আলুর তরকারি আগেই রান্না করা ছিল। খানিকটা তরকারি লুচির মধ্যে রেখে পাকিয়ে এগিয়ে এনে মালতী বলল, নাও হাত দিয়ে ধরতে পারবে না, আমি খাইয়ে দিচ্ছি।

বলাই বাহুল্য, রজত শুধু লুচিটাই মুখে পুরে ক্ষান্ত হলেন না, মালতীর দুটি আঙুলও আলতো করে কামড়ে ধরলেন। মালতী ‘উঃ’ বলে হাত ছাড়িয়ে নিতেই রজত দু-হাতে মালতীর দুই বাহু জড়িয়ে ধরে কাছে টেনে এনেছেন। মালতী ত্রাসের সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল, এই, কী হচ্ছে? আগুন লেগে যাবে, স্টোভ।….ছাড়ো, ছাড়ো, কড়াইতে গরম ঘি।

রজত তবু অবুঝের মতন মালতীর বুকের মধ্যে মুখ ডোবাতে চেয়ে ওকে আরও কাছে টেনে আনেন। মালতী তখন চেঁচিয়ে ওঠে, লক্ষ্মণ! লক্ষ্মণ!

একতলা থেকে চাকর সাড়া দিতেই রজত দ্রুত মালতীকে ছেড়ে দিয়ে দূরে সরে যান। চাকরের সামনে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব সম্মান হারাতে চান না। উঠে গিয়ে স্নানের তোয়ালেটা আলনা থেকে নিয়ে রজত কৃত্রিম রাগের সঙ্গে বললেন, এ তুমি এক অস্ত্র পেয়েছ। না?

মালতী আলতো ভাবে হাসছে, দরজার সামনে দাঁড়ানো চাকরকে বলল, নদীর ধারে গিয়ে দেখে এসেছিলি, আজ ইলিশ মাছ উঠেছে কি না?

লক্ষ্মণ জানায়, আজও ইলিশ মাছ ওঠেনি, কিছু বাটা মাছ উঠেছে।

মালতী তাকে বলে দিল, ঠাকুরকে বলগে যেন মাছে বেশি ঝাল না দেয়। কাল মাছে এমন ঝাল হয়েছিল, বাবু খেতেই পারেননি।

লক্ষ্মণ চলে যাবার পর মালতী রজতের দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বলল, তুমি সব সময় এমন ছেলেমানুষী কর কেন?

রজত ঘর-সংলগ্ন বাথরুমে ঢুকতে যাচ্ছিলেন, বললেন, কী করব, যে বয়সটায় সবাই ছেলেমানুষি করে, সেই বয়সটায় যে আমার কিছুই করা হয়নি! আমার ছেলেবেলায় যে একদম ছেলেমানুষি করার সুযোগ পাইনি। ঘাড় গুঁজে শুধু লেখাপড়াই করতে হয়েছে!

আহা, লেখাপড়া যেন আর কেউ করে না!

করে, কিন্তু আমার মতো দুর্ভাগ্য কারওর নয়।

কীসের দুর্ভাগ্য?

তুমি জানো না, কী কষ্টে যে আমার ছেলেবেলাটা কেটেছে!

মালতী এবার জোরে হেসে ওঠে। বলে, বুঝেছি, এই বলে এখন সহানুভূতি আদায় করার চেষ্টা! তাড়াতাড়ি স্নান করে নাও, সব ঠান্ডা হয়ে যাবে।

স্নান সেরে রজত বেরিয়ে এলেন খালি গায়ে। প্রায় চল্লিশের কাছাকাছি বয়স, কিন্তু এখনও যে-কোনও নবীন যুবকের ঈর্ষণীয় স্বাস্থ্য। চওড়া কাঁধ ও প্রশস্ত বুক, ফরসা রং, মাথার চুলগুলো এলোমেলো হয়ে এসে পড়েছে কপালে। মালতী ততক্ষণে দুটি প্লেটে খাবার সাজিয়ে বেতের চেয়ার দুটোর সামনে ছোট্ট টিপয়ে রেখেছে। এখন সে জানলার কাছে দাঁড়িয়ে। রজত কাছে এসে বললেন, এই, পিঠটা মুছে দাও তো! আমি পারছি না।

মালতী তোয়ালেটা নিয়ে পিঠটা মুছিয়ে দিতে দিতে বলল, একেবারে ছেলেমানুষ! স্নান করে নিজে নিজে গা মুছতে পারো না, লোকে কী বলবে?

রজত অবাক হবার ভান করে বলল, এখানে লোক আবার কোথায়? বলার মধ্যে এক তো তুমি। তুমি কি লোক নাকি?

আমি তবে কী?

তুমি আমার মালতীমালা, আমার সোনামণি।

এবার আর নিষ্কৃতি নেই, রজত দু’হাতে মালতীকে সম্পূর্ণ জড়িয়ে ধরেছেন। প্রথমে প্রগাঢ় চুম্বন করলেন, তারপর মালতীর বুকের মধ্যে মুখ ডুবিয়ে বড় বড় নিশ্বাস ফেলতে লাগলেন। এইটা ওঁর বিশেষ শখ, স্ত্রীর বুকের মধ্যে মুখটা চেপে অনেকক্ষণ নিশ্বাস ফেলা। যখন তখন এই ইচ্ছে জাগে।

মালতী বলল, এদিকে সব ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে কিন্তু!

রজত সেই রকমই মুখ ডুবিয়ে রেখে বললেন, না, কোনও দিন ঠান্ডা হবে না। সারাজীবন এই রকম তাপ থাকবে।

তারপর কী মনে পড়তেই, ধড়ফড় করে ছেড়ে দিয়ে মালতীর মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি ওষুধ খেয়েছ আজ?

ধরাপড়া মুখে লাজুক হেসে মালতী বলল, না, ভুলে গেছি।

রজতের মুখ একটু কঠিন হয়ে এল। বলল, কেন ভুলে গেছ? রোজ-রোজ এ অন্যায়।

খাচ্ছি, খাচ্ছি এখনই খাচ্ছি।

কিন্তু চারটের সময় খাবার কথা। এখন প্রায় ছ’টা।

আর পারি না! ভাল্লাগে না! ওষুধ খেতে খেতে মুখ পচে গেল।

লক্ষ্মীটি, আর বেশিদিন না, আর দু’সপ্তাহ—ডাক্তার সেন বললেন।

ডাক্তার সেনের সঙ্গে কোথায় দেখা হল?

তিন নম্বর ক্যানেলের পাশে একটা ইন্সপেকশনে গিয়েছিলাম। ভাবলুম ফেরার পথে একবার ডাক্তার সেনের চেম্বারটাও ঘুরে আসি। ওখানেই তো অরুণ চ্যাটার্জির সঙ্গে দেখা।

তুমি খেতে বসে যাও, আমি ততক্ষণে ওষুধটা খেয়ে নিচ্ছি।

ক্যাপসুলগুলো ফুরিয়ে গেছে, না আছে এখন?

আছে দুটো।

মালতী পাশের ঘরে এসে ড্রেসিং টেবিলের দেরাজ থেকে কালো শিশিটা বার করল। ক্যাপসুল দুটো হাতে ঢেলে, একটুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর কাচের জার থেকে এক গ্লাস জল গড়িয়ে নিয়ে জানলার কাছে এসে দাঁড়াল। বাইরে অন্ধকার, কিছুই দেখা যায় না। কিছুই দেখা যায় না যে অন্ধকারে, সে দিকেও তাকিয়ে থাকতে কখনও কখনও ভালো লাগে। মুখের কাছে গেলাসটা এনে শুধু এক চুমুক জল খেল। এর মধ্যেই জল বেশ ঠান্ডা হয়ে এসেছে, তার মানে শীত প্রায় এসে গেল। অন্ধকারের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মালতীর আর ইচ্ছে হয় না ওষুধ খেতে। ইচ্ছে হয় ক্যাপসুল দুটো জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিতে, রজত তো দেখতে পাবে না। কিন্তু রজত ওর মুখের দিকে তাকালেই বোধহয় বুঝে ফেলবে। রজত মুখের দিকে তাকিয়েই অনেক কিছু বুঝতে পারে।

নিজের খাবারের প্লেট হাতে নিয়ে মালতী এসে বসল রজতের পাশে। মাটিতে খবরের কাগজখানা বেছানো, রজত সেইদিকে এখন মনোযোগী। মালতী বলল, তোমাকে আর দু’খানা দেব?

কাগজ থেকে চোখ না তুলেই রজত বললেন, মেয়েরা বিষম নিষ্ঠুর!

মালতী হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করল, কী করে বুঝলে?

তাই তো দেখতে পাচ্ছি।

সে-রকম কোনও খবর বেরিয়েছে বুঝি?

না, তোমাকে দেখেই বুঝতে পারছি। অরুণ চ্যাটার্জির সঙ্গে দেখা হয়েছে বললুম, তোমার সে সম্পর্কে কোনও কৌতূহলই হল না? অথচ আগে—

আগে কী?

আগে তো তোমাদের খুবই বন্ধুত্ব ছিল।

তা ছিল। সে কত দিন আগের কথা!

খুব বেশিদিন নয়। অরুণ তো তোমায় নিয়ে দু-একটা কবিতা-টবিতাও লিখেছিল শুনেছিলাম। তোমায় ও খুব ভালোবাসত, না?

কাগজ থেকে রজত মুখ তুলে তাকিয়েছেন। ঝকঝকে হাসিতে তাঁর চোখ-মুখ উজ্জ্বল। মালতীও মুচকি হেসে বলল, কী জানি ও ভালোবাসত কিনা। আমি কিন্তু ওকে ভালোবাসার জন্য একসময় পাগল হয়ে উঠেছিলাম।

তাই নাকি? তোমাদের কী করে আলাপ হয়েছিল?

দাদার বন্ধু ছিল তো, আমাদের বাড়িতে আসত, খুব বড় বড় বক্তৃতা-টক্তৃতা দিত, তাই শুনে আমিও ভালোবেসে ফেললুম।

মালতীর কথার ভঙ্গিই এমন যে, দুজনকেই সমস্বরে হেসে উঠতে হয়। রজত একটু ঝুঁকে আলতো ভাবে মালতীর চুলে বিলি কাটতে লাগল। পট থেকে চা ঢালল মালতী, রজতের হাতে কাপ তুলে দিয়ে বলল, এখন ভাবলে সত্যিই হাসি পায়! চলো, বারান্দায় গিয়ে বসি।

রজত বলল, তুমি তা হলে গায়ে শালটা জড়িয়ে নাও। শীত নেই যদিও, কিন্তু এই সময়টাতেই ঠান্ডা লাগে। আমাকেও একটা পাঞ্জাবি এনে দাও।

গাড়িবারান্দা ধাঁচের ছোট ব্যালকনি, পাশাপাশি টবে রজনীগন্ধা আর গোলাপ ফুটে আছে। বেলফুলের গাছে এখনও কুঁড়ি আসেনি। নিচু টেবিল ঘিরে তিনটে বেতের চেয়ার। এখান থেকে গঙ্গা দেখতে পাওয়া যায় জ্যোৎস্না রাতে, কিন্তু আজ ঘন অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। তবে একটু চুপ করে কান পেতে থাকলে বোঝা যায়, কোথাও একটা প্রবল জলস্রোত বয়ে যাচ্ছে।

বসেই রজত বললেন, যাঃ, সিগারেট আনতে ভুলে গেলুম!

মালতী বলল, দাঁড়াও, এনে দিচ্ছি।

তোমাকে যেতে হবে না। লক্ষ্মণকে ডাকো না।

এইটুকুর জন্য আবার লক্ষ্মণকে ডাকা কেন? আমিই আনছি।

নিজে সিগারেট ধরিয়ে রজত বললেন, তুমি একটা খাবে নাকি?

মালতী ঘাড় নেড়ে উত্তর দিল, নাঃ, সিগারেট আমার বিচ্ছিরি লাগে।

বিচ্ছিরি লাগে মানে? কত যেন খেয়ে দেখেছ!

কলেজে পড়ার সময় সত্যিই খেয়েছি। আজকাল কলেজের অনেক মেয়েরাই লুকিয়ে সিগারেট খায়।

যাঃ!

তুমি মেয়েদের সম্বন্ধে কী জান? তবে, আমার সিগারেট কখনও ভালো লাগেনি। আমার ভালো লাগে চুরুটের গন্ধ। চুরুট থাকলে একটা খেতুম।

ওরে বাবা, চুরুট? আচ্ছা ঠিক আছে, কাল চুরুট কিনে আনব, দেখি কী রকম খেতে পার!

আমি যদি সত্যি খেতে শুরু করি, তুমি আপত্তি করবে না?

কেন আপত্তি করব? তোমার কোনও কিছুর ইচ্ছে হলে, আমি আপত্তি করব কেন?

কেউ যদি দেখে ফেলে? ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের বউ চুরুট খাচ্ছে—এই নিয়ে লোকে নিন্দে করলে, তোমার খারাপ লাগবে না?

রজত একটু ভেবে দেখলেন। মুখে একটা দ্বিধার ভাব দেখা গেল। ঠিক যেন মনস্থির করতে পারলেন না, তারপর বললেন, থাক তোমার যা শরীর, এ নিয়ে আর সিগারেট খেতে হবে না!

আবার শরীর? তুমিই না বললে, আমি ভালো হয়ে গেছি! খবরদার, আমার অসুখের কথা বলবে না।

সত্যিই ভালো হয়ে গেছ? আচ্ছা, আর অসুখের কথা বলব না। তারপর কী হল বলো?

কার পর কী হল?

সেই অরুণকে যখন তুমি ভালোবাসলে, তার পর?

আরে, তোমাকে যে দেখছি আজ অরুণের কথায় পেয়ে বসেছে! কোথাকার কে অরুণ তার ঠিক নেই। ওসব ছেলেবেলায় সবারই একটু আধটু হয়।

রজত হঠাৎ আহত সরল মুখ তুলে তাকালেন। দু’চোখ মালতীর চোখে সম্পূর্ণভাবে ফেলে বললেন, তুমি আমাকে অন্য রকম ভাবছ? আমার কিন্তু সেসব কিচ্ছু মনে হয়নি। হঠাৎ আজ অরুণ ছেলেটাকে দেখে আমার মায়া হল।

এখানে হঠাৎ কী করে দেখা হল?

ক্যানালের ওপাশটায় ইন্সপেকশান করার পর হাতে খানিকটা সময় ছিল। ভাবলুম, ডাক্তার সেনের সঙ্গে দেখা করে আসি। ডাক্তার সেনের ঘরে গিয়ে দেখি অরুণ চ্যাটার্জি বসে আছে। এখানে নতুন এসেছে বোধহয়।

ডাক্তার সেন আমার ওষুধ সম্বন্ধে কী বললেন?

উনি বললেন, এবারের ওষুধগুলো ফুরোলে, আর মাস দুয়েক তোমাকে কোনও ওষুধ খেতে হবে না। এখন তোমার রেস্ট। পর পর তিনটে টেস্টে কিচ্ছু পাওয়া যায়নি। তুমি একেবারে সেরেই গেছ। বড়জোর স্বাস্থ্য ইমপ্রুভ করার জন্য দু’একটা টনিক।

টনিক-ফনিক আর কিচ্ছু আমি খাব না। আমার স্বাস্থ্য আমার অসুখের আগে যা ছিল, তার চেয়েও ভালো হয়ে গেছে।

অসুখের আগে তুমি কেমন দেখতে ছিলে তা তো আমি দেখিনি।

এর চেয়েও অনেক খারাপ ছিলাম।

এখন বুঝি খারাপ? তা হলে, পৃথিবীতে রূপসি কে? এসো—

রজত দু’হাত বাড়িয়ে দিলেন। মালতী মৃদু হেসে বলল, না।

রজত বিন্দুমাত্র সময় না দিয়ে ঝপ করে উঠে এধারে এসে জড়িয়ে ধরলেন মালতীকে। মালতীর বুকে মুখ রেখে শিশুর মতো নিশ্বাস ফেলতে ফেলতে বললেন, আঃ, আঃ, তুমি সেরে উঠেছ, এখন তুমি সম্পূর্ণ প্রস্ফুটিত মালতী। তোমাকে আমি পেয়েছি—

মালতীর চোখ চলে গিয়েছিল অন্ধকার নদীর দিকে। অন্ধকারের দিকে তাকালে চোখ জ্বালা করে। চোখ ফিরিয়ে এনে রজতের মাথার ওপর একটা হাত রেখে খুব আস্তে আস্তে বলল, এ জীবন তো তোমারই। তুমিই তো আমার জীবন দিয়েছ।

না, আমি দিইনি! তুমি তোমার নিজের জীবনশক্তিতেই বেঁচে উঠেছ।

তুমি না এলে এতদিনে আমি মরে ভূত হয়ে যেতুম!

ওসব বাজে কথা বলতে হবে না। অন্য কথা বলো। আচ্ছা, তোমার অসুখের সময় অরুণ রোজ আসত না?

হ্যাঁ, আসতেন। রোজ নয়, মাঝে মাঝে। এসে নীচে বসে থাকতেন।

কেন, নীচে কেন? ওপরে আসত না?

না। দাদা তো তখন জেলে, শুধু আমার সঙ্গে দেখা করার জন্যই আসবেন কী করে? দু-একদিন এসেছিলেন তবু, কিন্তু মা খুব খিটখিট করতেন। রোজ রোজ আসবার মতন অনাত্মীয় পুরুষ বন্ধু মেয়েদের তো থাকতে নেই!

তবে আমি যেতুম কী করে?

তুমি এসেছিলে দরজা ভেঙে। তুমি জোর করে নিজের দাবি প্রতিষ্ঠা করেছিলে, তুমি এসেছিলে আমার নিয়তির মতন। যদি ভগবানে বিশ্বাস করতুম, তা হলে বলতুম, ভগবান তোমাকে পাঠিয়েছিলেন।

থাক, থাক। যে দু-এক দিন এসেছিল অরুণ, কী বলত?

তোমার এত কৌতূহল কেন? বিয়ের আগের সব কথা জানতে নেই।

আহা, বলো না! এসব ছেলেবয়সি প্রেমের কথা শুনতে আমার বেশ ভালো লাগে।

বিশেষ কিছুই বলতেন না। এমনিতেই লাজুক ছিলেন, তা ছাড়া মায়ের ওই রকম গম্ভীর মুখ দেখে উনি চুপ করে বসে থাকতেন, বেশি লোকজন এলে আস্তে আস্তে বেরিয়ে যেতেন। একদিন শুধু বলেছিলেন, আমার নাকি ঠিক মতন চিকিৎসা হচ্ছে না।

ঠিকই বলেছিল।

উনি বলেছিলেন, ওঁর হাতঘড়িটা বিক্রি করে একজন বড় ডাক্তার ডেকে আনবেন। শুনে আমার এমন হাসি পেয়েছিল, ওসব ছেলেমানুষি—

আমিও ওকে দেখেছি কয়েকদিন তোমাদের বাড়ির সামনে। তোমার যখন বেশি সিরিয়াস অবস্থা, তখন দেখেছি ওকে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে। তোমাদের তো পাগলের বাড়ি। কোনও খবর নেবার উপায় নেই, তাই বোধহয় আমার কাছেই জিজ্ঞেস করত। প্রথমে তোমার দাদার নাম করে জিজ্ঞেস করত, শশাঙ্ক জেল থেকে ছাড়া পেয়েছে কিনা! তারপরেই জিজ্ঞেস করত, মালতী কেমন আছে? একদিন আমি জোর করে ওকে আমার সঙ্গে ওপরে তোমার ঘরে নিয়ে গিয়েছিলাম। সেদিন তোমার হাই ফিভার, তুমি মানুষ চিনতে পারছিলে না।

মালতী রজতের আলিঙ্গন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে উঠে গেল ফুলের টবের দিকে। ফুল না ছিঁড়ে নিজের মুখ ফুলের কাছে ঝুঁকিয়ে এনে গন্ধ শোঁকার চেষ্টা করল। হালকা, মৃদু গন্ধ। বলল, আমার সে কথা মনে নেই।

আচ্ছা, অরুণ নিজেই তোমার চিকিৎসার ব্যবস্থা করেনি কেন?

বাঃ, উনি কেন আমার চিকিৎসা ব্যবস্থা করতে যাবেন? উনি তো বাইরের লোক, এমনি বন্ধু। আমাদের বাড়িতেই তো কত লোক।

তোমার বাড়ির লোকের কথা তো জানি—আর একটু হলে তোমাকে মেরেই ফেলছিল। সেক্ষেত্রে অরুণেরই উচিত ছিল ইনিসিয়েটিভ নেওয়া, ডাক্তার-টাক্তার ডাকা……

ওর সে সামর্থ্য ছিল না। ওই যে বললুম, হাতঘড়ি বিক্রির কথা!

মালতী ছোট্ট একটু হাসল কথার প্রসঙ্গে। অনেক সময় একটা কথা হচ্ছে, কিন্তু হঠাৎ অন্য কথা মনে পড়ে যে-রকম হাসি, এ হাসিটা সেই রকম। রজত ওর হাসি লক্ষ করেননি। আপন মনেই বললেন, আমার ওকে দেখে খুব মায়া হত। এক-একসময় সত্যি মনে হত, আমি বোধ হয় জোর করে ওর অধিকার কেড়ে নিচ্ছি। কিন্তু তারপরই ভাবতুম, ওর চেয়ে আমার ভালোবাসা অনেক বেশি। আমার ভালোবাসা দাবি জানাতে ভয় পায় না। ভালোবাসার জোরে আমি তোমাকে আর সকলের কাছ থেকে জয় করে নেব।

মালতী খুব থেমে থেমে গাঢ় স্বরে বলল, তুমি শুধু আমাকে জয় করেই নাওনি তুমি আমাকে নতুন জীবন দিয়েছ।

আজও অরুণকে দেখে বেশ মায়া হচ্ছিল। ওর মুখের মধ্যে কীরকম যেন একটা অসহায় অসহায় ভাব আছে। আমাকে বোধহয় প্রথমে চিনতে পারেনি। আমি কিন্তু ঠিক চিনতে পেরেছিলাম। কিংবা চিনতে পেরেও হয়তো না-চেনার ভান করছিল। প্রেমিকার স্বামীকে কে আবার পছন্দ করে বলো! সুতরাং আমিই ওর কাঁধে চাপড় মেরে বললুম, কী খবর? তবে ও যে খুবই অবাক হয়ে গিয়েছিল, তা ঠিক। আমরা যে এখানে আছি, তা ও একেবারেই জানত না। জানলে হয়তো এখানে আসতই না চাকরি নিয়ে।

এখানে উনি কি করছেন? তোমার আন্ডারেই চাকরি-টাকরি করছেন না তো!

রজত হা-হা করে উচ্চস্বরে হেসে উঠলেন। ওঁর দরাজ গলার হাসি বহুদূর উঠে যায়। হাসতে হাসতেই বললেন, তা হলে বুঝি সেটা তোমার পছন্দ হত না? তা ঠিক, প্রাক্তন প্রেমিক এসে স্বামীর অফিসে চাকরি করছে—এটাও ঠিক মানায় না! বরং স্বামীর তুলনায় তার বড় চাকরি করাই উচিত।

তুমি খুব জানো। গল্প-উপন্যাসও পড়ো না! ব্যর্থ প্রেমিকরা আবার চাকরি-টাকরিতে মন দিতে পারে নাকি! তা হলে তাদের ব্যর্থ প্রেমিক বলে চেনা যাবে কী করে? তারা দাড়ি রাখে, কিংবা বাউন্ডুলে হয়ে যায়, কিংবা মফঃস্বলে মাস্টারি করে!

আশ্চর্য, ঠিক ধরেছ তো! দাড়ি রাখেনি বটে, তবে অরুণ এখানকার কলেজে লেকচারারের চাকরি নিয়েই এসেছে। তা, কলেজের মাস্টারি চাকরি হিসেবে ছোট হতে পারে, কিন্তু ও তো আবার গল্পকবিতাও লেখে শুনেছি। তাতেই হয়তো ও অনেক বড় হয়ে উঠবে। আমায় কেউ চেনে না, কিন্তু ওকে সারা দেশের লোক চিনবে। আমার ছেলেমেয়ে, অন্তত নাতি-নাতনিরা হয়তো ইস্কুল-কলেজে অরুণের লেখাই মুখস্থ করবে! তখন কি তারা জানবে যে—

ইস, কী স্বপ্ন তোমার! এর মধ্যেই নাতি-নাতনি পর্যন্ত দেখতে পেয়ে গেলে? তোমার নাতনি বেণী দুলিয়ে ইস্কুলে যাচ্ছে, আর তুমি বারান্দায় বসে আলবোলায় তামাক টানছ? আর আমি পাকা চুল মাথায় ঠাকুর পুজো করছি? মাগো, ভাবলেই বিচ্ছিরি লাগে।

কেন, আমাদের বুঝি ছেলেমেয়ে হবে না একটাও? আর ছেলেমেয়ে হলেই নাতি-নাতনিও হতে বাধ্য! কী?

হবে না কেন? আমি মরে গেলেই তুমি আর একটা বিয়ে করবে। আর তখন প্রত্যেক বছর একটা করে ছেলে-মেয়ে—

আবার ওইসব কথা? তুমি একেবারে সেরে গেছ, তা বুঝি তোমার বিশ্বাস হয় না? প্লুরিসি আবার একটা অসুখ নাকি? কত লোকের হয়—

তা তো জানি। তবু কেন মরতে বসেছিলুম ওই সামান্য অসুখে?

এখন তুমি বেঁচে উঠেছ। আচ্ছা মিলু, তোমার বেশ অনেকদিন বেঁচে থাকতে ইচ্ছে হয় না?

কী জানি? বাঁচতে পারব কি না, তা তো এতদিন ঠিক ছিল না, তাই বাঁচতে চাই কি না ভেবে দেখতেও ভুলে গেছি।

তুমি আমার চেয়েও বেশিদিন বাঁচবে। তোমার সিঁথির সিঁদুর থাকবে চিরকাল।

না, না, যদি মরতেই হয়, দুজনে একসঙ্গে মরব।

সেই ভালো। আচ্ছা, তোমার একটা কথা জানতে কৌতূহল হচ্ছে না?

কী কথা?

সে-কথা জানার জন্যে তোমার মন হয়তো ছটফট করছে, সে-কথার উত্তরও আমি জানি, কিন্তু বলব না। পুরনো প্রেমিকের সঙ্গে অনেক দিন পর দেখা হলে একটা কথাই প্রথম জানতে ইচ্ছে করে; সেটা হচ্ছে, তারও বিয়ে হয়ে গেছে কি না। কী, ঠিক বলিনি?

বয়েই গেছে আমার জানতে।

রজত হাসতে হাসতে বললেন, তোমার চোখ দেখে কিন্তু মনে হচ্ছে কৌতূহলে একেবারে চকচক করছে। অরুণের বিয়ে হয়েছে কিনা, তার বউ সুন্দরী কিনা—

মালতী কৃত্রিম কোপে বলল, ইস, মোটেই না। অরুণদা’র মুখখানাই আমার ভালো করে মনে পড়ে না, তার সম্বন্ধে আমার এত কৌতূহল থাকবে কেন? বিয়ে তো হবেই, সবারই বিয়ে হয়—

মিলু, তুমি অরুণ সম্পর্কে বড্ড নিষ্ঠুরের মতন কথা বলছ। ওর জন্য তোমার এখন একটুও মন কেমন করে না? সত্যি বলো না, আমি কিছু মনে করব না। এ তো স্বাভাবিক! একজনকে ভালোবাসার পরও অন্য দু-একজনের জন্যে মনের মধ্যে একটু জায়গা রাখায় কোনও দোষ নেই। অত ভাব ছিল অরুণের সঙ্গে তোমার, সব ভুলে গেলে কী করে? তোমার যেদিন একশো পাঁচ ডিগ্রি জ্বর উঠেছিল, তুমি প্রলাপ বকছিলে, বার বার অরুণ, অরুণ বলে ডাকছিলে। আমি তোমার শিয়রের কাছে বসে কপালে ওডিকোলন লাগাচ্ছিলুম, তুমি একবার লাল চোখ মেলে বললে, রজত, তুমি অরুণদাকে ক্ষমা করবে তো? ও বড় অসহায়। তুমি আর একবার বলেছিলে, অরুণদা, তুমি চলে যাও! কেন বসে আছ?

মালতী আবার সেই কথা মনে পড়ার হাসি হাসল। এবার একটু জোরে। অন্যমনস্ক গলায় বলল, সত্যি, বলেছিলাম নাকি? কী ছেলেমানুষ ছিলাম তখন! কিছুটা উচ্ছ্বাস, কয়েকখানা চিঠিপত্র লেখা—এই এক ধরনের প্রেম, ছেলেবেলায় সবারই হয়। হয় না?

খুব বেশিদিন আগের কথা নয়। মাত্র চার বছর আগে—

এই চার বছরে আমার জীবন একেবারে বদলে গেছে। আগেকার কিছুই আর মনে নেই। সত্যি, আগেকার কিচ্ছুই আর স্পষ্ট মনে পড়ে না। মনে হয় গত জন্মের কথা।

ছেলেবেলার ওই প্রেম কিন্তু ভারী মধুর। কারও ভোলা উচিত নয়। আমি এমন যা-তা, আমার ছেলেবেলায় ওসব কিছুই হল না।

সত্যি, তোমার কিছু হয়নি? আগে কোনও মেয়ের সঙ্গেই তোমার কিছু হয়নি?

উঁহুঃ! আমি ছেলেবেলায় এমন গোবেচারা ছিলুম যে, ওসব কিছু করার সুযোগই পাইনি। খালি পরীক্ষার পড়া মুখস্থ করে সময় নষ্ট করেছি! তা ছাড়া, কাকার বাড়িতে মানুষ, কাকা খুব কড়া শাসনে রাখতেন।

বিয়ের আগে একটা মেয়ের সঙ্গেও তোমার ভাব হয়নি? কাউকে একবার চুমুও খাওনি?

সত্যি কথা বলব? রাগ করবে না? একবার একজনকে মাত্র খেয়েছিলুম। আমার এক বন্ধুর দিদিকে। কিন্তু তোমার কাছে এ-লজ্জার কথাও স্বীকার করছি, আসলে তিনিই আমাকে একদিন হঠাৎ জড়িয়ে ধরে জোর করে চুমু খেয়েছিলেন। আমার সাহস হয়নি, উলটে আমি ভয়ে মরছিলুম!

এবার স্পষ্টভাবে হাসতে হাসতে মালতী বলল, কাউকে প্রেমপত্রও লেখনি?

রজত তখন মুখ গম্ভীর করে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, তাও একজনকে লিখেছিলাম, তিনি অবশ্য উত্তর দেননি।

তোমার মতো পুরুষের কাছ থেকে চিঠি পেয়েও উত্তর দেয়নি, কে সেই মেয়ে? নাম জানতে পারি?

তুমি তাকে চেনো।

আমি চিনি? কে সে?

নাম বলব?

কী মুশকিল, তুমি কি ভাবছ আমি কিছু মনে করব? আমি এত ছেলেমানুষ নাকি? তোমার বলতে আপত্তি থাকলে অবশ্য বোলো না।

না আপত্তি কীসের! কানন দেবী! তখন অবশ্য ওর নাম ছিল কাননবালা। ‘মুক্তি’ বইটা তিনবার দেখার পর এত ভালো লেগেছিল—

রজতও মালতীর সঙ্গে গলা মিলিয়ে হেসে উঠলেন। হাসির দমকে মালতীর সারা শরীর দুলছে। বলল, যাঃ! খালি ঠাট্টা! ‘মুক্তি’ কি আজকের কথা নাকি? তখন তুমি কতটুকু ছিলে?

খুব ছোট নয়। ভুলে যাচ্ছ কেন, তোমার চেয়ে আমি অন্তত দশ-বারো বছরের বড়! সে কি আজকের কথা?

থাক, আর বুড়ো বুড়ো ভাব দেখাতে হবে না।

সত্যি মিলু, ছেলেবেলাটা আমার একেবারে বাজে নষ্ট হয়েছে। একটা মধুর স্মৃতি নেই। তাই তো ভালোবাসার জন্য এমন উন্মুখ হয়েছিলাম। চাকরি পাবার পর ঠিক করে রেখেছিলাম, যদি কোনওদিন কাউকে ভালোবাসতে না পারি, তবে বিয়েই করব না। ওসব বিজ্ঞাপন দিয়ে পাত্রী দেখে বিয়ে করা আমার দু’চোখের বিষ! তারপর একদিন তোমার সঙ্গে দেখা হল। আমার খুকুমণিকে আমি বুকে তুলে নিলাম।

মালতী বলল, চলো, হিম পড়ছে, এবার ঘরে যাই।

আর একটু বসি। এখানেই বেশি ভালো লাগছে। শোনো না—

শুনছি তো!

রজত মালতীর এ স্বভাব জানেন। ডাকলে কখনও কাছে আসবে না। ব্যাপারটা রজত গোপনে উপভোগই করেন। মালতীর শরীর নিয়ে আদর করতে গেলে একটা অর্জন করার সুখও পাওয়া যায়। রজত চেয়ার ছেড়ে উঠে পাঁচিলের কাছে চলে এলেন, আলতো ভারে দু’হাত রাখলেন মালতীর কাঁধে। কিন্তু হাত দুটো কাঁধেই স্থির থাকতে চায় না, শরীরের অন্য অঞ্চলেও ঘোরাঘুরি করতে চায়। এক হাতে মালতীর মুখটা নিজের ঠোঁটের দিকে ফেরাতেই মালতী বলল, দাঁড়াও, রান্নার কতদূর হল একটু দেখে আসি।

তোমাকে কিছু দেখতে হবে না। ঠাকুর যা-করছে করুক না!

একটু না দেখলে কী মাথামুন্ডু যে করে রাখবে, তার ঠিক আছে?

করুক। তোমাকে আগুনের আঁচের কাছে যেতে হবে না! তুমি যে বিকেলের জলখাবারটা নিজের হাতে বানাও, তাতেই আমার খুব ভালো লাগে। আর কোনও রান্না নিয়ে তোমার মাথা ঘামাবার দরকার নেই।

বাঃ, সারাদিন কিছু একটা করতে হবে তো! ঠাকুর রান্না করবে, চাকর ঘর গুছোবে, আর আমি কী করব?

তুমি শুয়ে শুয়ে বই পড়বে। আরও একডজন বই পাঠাতে লিখেছি কলকাতায়।

সারাদিন বুঝি বই পড়তে কারওর ভালো লাগে?

কলকাতা ছেড়ে থাকতে তোমার খারাপ লাগছে, না?

মোটেই না। কলকাতার চেয়ে এ-জায়গা অনেক ভালো। কিন্তু একটা কিছু কাজ তো করা উচিত। আচ্ছা, আমার তো একটা বি.এ. ডিগ্রি আছে, এখানকার মেয়ে ইস্কুলে মাস্টারি করলে কেমন হয়?

কেন, তোমার বুঝি টাকা রোজগার করার শখ হয়েছে?

যাঃ, তুমি বুঝতে পারলে না। টাকার জন্য নয়, যা-হোক একটা কিছু কাজ নিয়ে থাকা।

না, তা হয় না। ম্যাজিস্ট্রেটের স্ত্রীর পক্ষে মাস্টারনি হওয়া বোধহয় মানাবে না। তা ছাড়া শরীরের ওপর আবার ধকল—

মালতী একটু থতমত খেয়ে বলল, ও, আচ্ছা থাক। বলেই চুপ করে গেল।

রজত একটু চিন্তিতভাবে আবার বেতের চেয়ারে ফিরে এসে বসলেন। বললেন, তার চেয়ে বাড়িতে একটা ক্লাব-টাব করলে মন্দ হয় না। তোমার সময় কাটবে। তুমি যদি একটা নাচ-গানের ফাংসান অর্গানাইজ কর….তুমি তো কলেজে পড়ার সময় ওসব করতে।

হুঁ, তা হলে মন্দ হয় না।

অরুণ চ্যাটার্জিকে একদিন আমাদের বাড়িতে আসতে বলেছি।

মালতী একথা শুনে কিছুই বলল না। বেশ কিছু সময় চুপ করে থেকে আবার অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রইল। রজতও চুপ করে রইলেন। একটা সিগারেট ধরিয়ে অন্যমনস্কভাবে টানতে লাগলেন। মাঝে মাঝে শুধু বিরাট বিরাট ট্রাকের দ্রুত ছুটে যাবার শব্দ, এ ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই। বাতাসে একটা ভারী মোলায়েম স্বাদ! বছরের এই সময়টায় জীবনকে ভারী সুন্দর মনে হয়। দু’হাত ছড়িয়ে আলস্য ভেঙে রজতও ভাবলেন, জীবনটা সত্যিই সুন্দর। আবার ডাকলেন, মিলু, শোনো—

মালতী এবার দেয়ালের কাছ থেকে সরে এসে একেবারে রজতের কাছে চলে এল। একেবারে মাটিতে হাঁটু ভেঙে বসে রজতের কোলের মধ্যে মুখ ডুবিয়ে বলল, কী বলবে, বলো?

রজত আচ্ছন্ন গলায় জিজ্ঞেস করলেন, মিলু, তুমি সত্যি সুখী হয়েছ?

এর চেয়ে বেশি সুখ আর কোনও মেয়ে চাইতে পারে?

রজত কোমল ভাবে মালতীর মুখখানা দু’হাতে ধরে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন।

অধ্যায় ১ / ১১

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন