৪৩. পৃথু কোথায়, নিজে সে জানে না

বুদ্ধদেব গুহ

পৃথু কোথায়? নিজে সে জানে না।

জীবন ও মৃত্যুর মধ্যে কোনও এক ফালি জমিতে সে থিতু হয়ে বসেছে। এই ফালিটুকু নো-ম্যানস ল্যান্ডেরই মতো। জীবন অথবা মৃত্যুর কারওই অধিকার বর্তায় না এতে। এ শুধু মৃত্যুপথযাত্রীর বিশ্রামেরই জায়গা।

মৃত্যু এসে কালো দস্তানা পরে তার কালো চাবি দিয়ে বন্ধ না করে দিলে মস্তিষ্কর ঘড়ি বোধহয় চলতেই থাকে। কত গান, কত ছবি, কত সমুদ্রের কুয়াশা সবুজ ফ্রেম, পাহাড়ের উপরের সূর্যাস্ত এখন ছুঁয়ে যাচ্ছে তাকে। দেখেও যেন দেখতে পাচ্ছে না, ছোঁওয়ার ক্ষমতা বা অধিকার আর নেই, ভোগের বাসনা নেই, প্রেমের তীব্রতা নেই, বিরহের যাতনা নেই। একেই বোধহয় বলে আনন্দময় আবেশ।

আনন্দম! আনন্দম! আনন্দম।

চার/চার/চার/চার পাঞ্জাবী তালে তিলোক কামোদে ঠুংরী গাইছে যেন কে, “পিয়া পরদেশ মোরা মনহ/রহে কৌন মোতন কে দ্বার/ না মোরি নৈয়া না রে খাবৈয়া/ কৌন বিঠো উতরোবো পার/ পিয়া পরদেশ মোরা মনহ…

কুর্চি কে?

কোথায় হারিয়ে গেলে তুমি?

কেনই বা কাছে এলে আবার দূরে গেলেই বা কেন? দূরই ভাল। দূরই ভাল ছিল। দূরেই থাকবে তুমি? কূর্চি?

রুষা? তুমি খুশি তো! আমি চলে যাচ্ছি।

কোথায়?

তা তো আমি নিজেই জানি না। আর ফিরব না গো আমার সুন্দরী বউ। আর জ্বালাব না তোমাকে। অনেকই কষ্ট দিয়েছি। ক্ষমা করে দিও। নিঃশর্ত ক্ষমা। চাইছি, সকলের কাছেই।

জীবন মানে তো জীবিত থাকার চেষ্টা? তাইই কি? টেড হিউজ-এর কবিতা ছিল না একটা? টেড হিউজেরই তো!

মাথার মধ্যে বৈশাখের ভোরের মহুয়া আর করৌঞ্জের গন্ধ মাখা মন্থর হাওয়ার মতো, বসন্তবনের মন্থর মৌমাছির মতো, শ্রাবণের রাতের একটানা ঝরঝরানি ব্যস্ততাহীন এক-পর্দায়-বাঁধা বৃষ্টির শব্দের মতো কবিতার কলিগুলি মস্তিষ্কর কোষে কোষে। প্রথম গ্রীষ্মের উদ্বেল বনের কাঁচপোকার মতো তিরতির করে এখন ডানা নাড়ছে।

একটাই তো জীবন, সবাই বলে। কত কী করার ছিল, সবই বাকি রয়ে গেল যে। কবি হওয়া হল না। গান গাওয়া হল না। ছবি আঁকা হল না। ভালবাসা হল না। কতজনকে, নিংড়ে দেওয়া হল না নিজেকে, পাওয়া হল না কতজনকে নিঃশেষে; এরই মধ্যে চলে যেতে হবে?

ফেরা কি হবে না আর? হাঁটা হবে না ভোরের জঙ্গলে? বন-বাংলোর চওড়া বারান্দার আরাম কেদারায় বসে চাঁদের বনে একলা চেয়ে রাত-পাখিদের ডাক আর যাবে না শোনা?

“ডেথ ওলসো ইজ ট্রাইং টু বী লাইফ,

ডেথ ইজ ইন দ্যা স্পার্ম লাইক দ্যা অ্যানসিয়েন্ট ম্যারিনার

উইথ হিজ হরিবল টেল,

ডেথ মিউজ ইন দ্যা ব্ল্যাঙ্কেটস—ইজ ইট আ কিটেন?

টেড হিউজ। হ্যাঁ টেড হিউজই তো! “মুরটাউন!”

বাঃ! বাঃ! টুসু! কেমন আছিস বাবা? ভাল আছিস তো?

মিলি? পড়াশুনা নিয়ে খুবই ব্যস্ত? তোদের আমি খুব ভালবাসতাম রে! শুধু দেখাতে পারিনি। আমার মতো অনেকেই হয়তো আছে যারা দেখাতে পারে না নিজেদের। যাদের মন যা বলতে চায়, মুখ ঠিক তার উল্টোটা বলে। এই অভিশাপ থেকে তোরা মুক্তি পাস যেন। এইই প্রার্থনা! বাবা খারাপ বলেই তোরা খারাপ হোস না। সমাজের, এই সভ্য পৃথিবীর; এই নব্য বিজ্ঞানের আশীর্বাদধন্য জীবনের সমস্ত যোগ্যতার প্রার্থনা তোদের জন্য করে যাচ্ছি। যে যেমনভাবে চাস, তোদের মা যেমন তার মতো চেয়েছিল; তেমন করেই সুখী হোস তোরা। যার যার জীবন তার তার। তোদের অপদার্থ, অজীব বাবার পরিচয় যদি তোরা অস্বীকার করে ভারমুক্ত হতে চাস, তবে তাইই হোস। আমি কিছুমাত্র মনে করব না রে। বাবা, মা, বংশ পরিচয় এসব কিছুই নয়। প্রত্যেক মানুষকে, মানুষ হয়ে উঠতে হলে, তার পরিচয় তৈরি করে নিতে হয়। তার জন্য দাম যা লাগে লাগুক, বিনামূল্যে এ জীবনে কি আর মেলে বল? দাম দিতে ভয় পাস না। নিজের নিজের বিশ্বাসের পাশে পিস্তল হাতে করে দাঁড়াতেও ভয় পাস না। কোনও মানুষকেই নষ্ট করে দিতে পারে না অন্য কেউই, যদি সে নিজে না নষ্ট হয়।

আমি যেমন। তোর মা বলতেন, আমার মধ্যে খারাপ হয়ে যাবার প্রবণতা ছিল।

আর্নেস্ট হেমিংওয়ের জীবনী পড়েছিস মিলি? না পড়লে, পড়িস। “আ ম্যান ক্যান বী ডেস্ট্রয়েড, বাট ক্যানট বী ডিফীটেড।”

হারবি না কখনও। হেরে যাওয়া মানুষ, মানুষই নয়।

কে? কে আবার কথা কয় মাথার ভিতরে? পৃথু ঘোষ? তুমি থামো। তোমার কথা ঢের শুনেছি। থামো তুমি।

কত কীইই তো ভেবেছিলাম।

এটা করব, সেটা করব, বাড়ি করব পাহাড় চুড়োয় স্বপ্ন এবং সুখের কুটো দিয়ে। পায়ের কাছে বইবে নদী, নারীর মতো, সাধের নারী, বাধ্যতা আর নাব্যতাতে নীল। ভেবেছিলাম, লিখব আমি গানের মতো, গান গাইব যেমন করে লিখি। আঁকব ছবি খুন করে রঙ, রঙের রক্ত ছেনে। মধ্যবুকের সব ব্যথাকে আনব টেনে টেনে।

কিছুই তো হল না সেই সব/সেই সব, সেই অশ্রু সেই হাহাকার রব…

“সন্ধে হলে জোনাক জ্বলে বাঁশ পাহাড়ে। হুক্কা-হুয়ায় শেয়াল দোলে নকশী-কাঁথার মাঠ পেরিয়ে, নগ্ন-নিজন নীল-কুয়াশার উথালচুলের উড়াল-গন্ধ রাতে। আগল-খোলা বোকা-পাগল কাঁপা-গলায় গান গেয়ে যায় স্বপ্নমালা হাতে।”

মা। মাগো! কত্বদিন তোমার হাতের খিচুড়ি খাইনি। কড়াইশুঁটির চপ। দেখা হবে কি তোমার সঙ্গে? তুমি কোথায়? শেষ পুজোতে আমার দেওয়া সেই মুগা-পাড়ের টাঙ্গাইল শাড়িটা পরে আসবে তো?

কত্বদিন দেখিনি তোমাকে?

সকল অধ্যায়

১. ১. বানজার নদী
২. ২. অ্যালসেশিয়ান কুকুর
৩. ৩. হাটচান্দ্রার সীমানা
৪. ৪. রাত কত ঠিক বোঝা যাচ্ছে না
৫. ৫. পৃথুর ঘুম ভেঙে গেল
৬. ৬. পুবে সবে আলো ফুটেছে
৭. ৭. ঠুঠা বাইগা আর দেবী সিং
৮. ৮. যাবে বলে ঠিক করে
৯. ৯. পৃথুর জীবনে কুর্চিই একমাত্র আনন্দ
১০. ১০. সন্ধের আগে আগেই
১১. ১১. পৃথুর গভীর মগ্নতা ছিঁড়ে
১২. ১২. গিরিশদার বাড়ি ঢুকতেই
১৩. ১৩. ভুচুরা ক্রীশ্চান
১৪. ১৪. পারিহার সাহেব সুফকরের বাংলো
১৫. ১৫. বিকেল বিকেলই গিয়ে পৌঁছল পৃথু
১৬. ১৬. আজকের পৃথু অন্য পৃথু
১৭. ১৭. শামীম আর ভুচুকে বলতেই হয়েছিল
১৮. ১৮. কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল ওদিকে
১৯. ১৯. শুধু দুঃখই পেতে এসেছিল
২০. ২০. সকাল সাড়ে সাতটা এখন
২১. ২১. মিস্টার দিগা পাঁড়ে
২২. ২২. মেয়ে তো আর কম দেখলাম না
২৩. ২৩. শীতটা এবার বেশ জাঁকিয়ে পড়বে
২৪. ২৪. পড়ন্ত বেলার ঝাঁটি জঙ্গলে
২৫. ২৫. কদম গাছের নীচে
২৬. ২৬. ভিনোদের বাড়ি নিমন্ত্রণ ছিল
২৭. ২৭. ছুটি ফুরিয়ে গেল
২৮. ২৮. একা ঘরে পৃথু বসেছিল
২৯. ২৯. শরীর ভাল না থাকায়
৩০. ৩০. গিরিশদার বাড়ি অনেকদিনই যায় না পৃথু
৩১. ৩১. নুরজাহানকে যেদিন উদ্ধার করা হল
৩২. ৩২. কুর্চির বাড়ি গিয়ে হাজির
৩৩. ৩৩. বিজলীর কাছে যাওয়া হয়নি
৩৪. ৩৪. চিঠিটা পড়া শেষ করে
৩৫. ৩৫. ড্রাইভার শ্রীকৃষ্ণ
৩৬. ৩৬. তান্ত্রিকের জন্যেই দিনটা খারাপ
৩৭. ৩৭. রাতে খেতে বলব ভাবছি
৩৮. ৩৮. চিঠিটি হাতে পেয়ে
৩৯. ৩৯. পৃথু ও রুষা বসবার ঘরে বসে ছিল
৪০. ৪০. ভিনোদের বাংলো থেকে বেরিয়ে
৪১. ৪১. ভুচুর গারাজে বসেছিল পৃথু
৪২. ৪২. তিন চার মিনিট ওখানে শুয়ে
৪৩. ৪৩. পৃথু কোথায়, নিজে সে জানে না
৪৪. ৪৪. ক্রীসমাস ঈভ-এর পার্টি
৪৫. ৪৫. জবলপুরের মিলিটারী হাসপাতালের বারান্দা
৪৬. ৪৬. কোথায় যেন ভোর হচ্ছে
৪৭. ৪৭. ঠুঠা বাইগা বানজার নদীর পাশে বসে ছিল
৪৮. ৪৮. এখন দুপুরবেলা
৪৯. ৪৯. পাতলা করে মাছের ঝোল আর ভাত
৫০. ৫০. বিজলীর পিঠের উপর দুটি হাত রাখল পৃথু
৫১. ৫১. কুড়ি দিন হল একটানা জঙ্গলে
৫২. ৫২. রুষা বসবার ঘরে বসে ছিল
৫৩. ৫৩. আস্তে আস্তে ভিড় কমে আসছে হাসপাতালে
৫৪. ৫৪. আজ ছুটি হবে পৃথুর
৫৫. ৫৫. ঘুম নেই
৫৬. ৫৬. উধম সিং সাহেব বললেন
৫৭. ৫৭. সন্ধে লাগার আগেই
৫৮. ৫৮. বাসটা ছেড়ে দিয়েছে অনেকক্ষণ
৫৯. ৫৯. সীওনীতে বেশ থিতু হয়েই বসেছে পৃথু
৬০. ৬০. সীওনীতে এসে অবধি স্কুলটাই দেখা হয়নি
৬১. ৬১. নতুন কাজে কিন্তু বেশ মন লেগে গেছে
৬২. ৬২. পাহাড়ী নদীর রেখা ধরে
৬৩. ৬৩. ভুচুর চিঠি এল আজ বিকেলে
৬৪. ৬৪. এ রবিবার সকাল থেকেই
৬৫. ৬৫. বেশ গরম পড়ে গেছে
৬৬. ৬৬. দিসাওয়াল সাহেবের বিড়িপাতার কাজ
৬৭. ৬৭. চিঠিটা খামে ভরে ভুচুর কাছে ফিরে এল পৃথু
৬৮. ৬৮. ইদুরকার ড্রেসিং টেবলের সামনে বসে
৬৯. ৬৯. ভুচু একটা অ্যাম্বাসাডর গাড়ির নীচে
৭০. ৭০. যেদিন রুষারা ফিরে এল
৭১. ৭১. আজ ভোরের বাসে হাটচান্দ্রা যাবে
৭২. ৭২. ভুচু চান-টান করে অপেক্ষা করছিল
৭৩. ৭৩. পূবের আকাশ সবে লাল হচ্ছে

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন