সন্মাত্রানন্দ
লবণাম্বু
‘আজকের দিনে হলে ওদের মধ্যে বোঝাপড়া এত সহজে, এত সরাসরি সম্ভবই হত না।’ মনে হল, কোথা থেকে যেন কেউ বলে উঠল কথাগুলো। প্রথমে ঠাহর করতে পারলাম না, কে বলছে। কিন্তু সেই কণ্ঠস্বরের আঘাতে আঠেরোশো বছর আগের দৃশ্যপট, ঘটনাক্রম, চরিত্রসমূহ—সমস্তই এক লহমায় চুরমার হয়ে গেল। ক্রমে ক্রমে নয়, হঠাৎই। যেন গভীরতর এক স্বপ্ন থেকে সহসা জেগে উঠলাম আরেক উপরিতলের স্বপ্নের মধ্যে। দেখলাম, বাসবান্নার সেই ঘর, দেওয়ালঘেঁষা সারি সারি বুককেস, আধমানুষ সমান উঁচু ময়ূরমুখী পিতলের পিলসুজের উপর প্রদীপের তন্দ্রাচ্ছন্ন শিখা, সবজেটে টেবিলল্যাম্প, কর্পূর আর রজনীগন্ধার বিমিশ্র গন্ধ। আর্মচেয়ারে বসে বাসবান্না গল্প বলছেন আর উলটোদিকের পুরোনো জীর্ণ সোফায় বসে আমি আর কাঁকন গল্প শুনছি।
বাসবান্নাকে দেখেও মনে হল, যেন গল্প-বলার ঘোর থেকে তিনিও সদ্য জেগে উঠেছেন। যেন তিনিও ঠিক ঠাহর করে উঠতে পারছেন না প্রথমে, কে কথাটা বলল । তারপর অর্ধনিমীলিত চোখে কাঁকনের দিকে চেয়ে বললেন, ‘কিছু কি বললে ?’
কাঁকন ঘাড় নেড়ে বলে উঠল, ‘হ্যাঁ। বলছিলাম, এটা যদি এখনকার দিনে ঘটত, তাহলে কোভালন আর কন্নকীর বোঝাপড়া এত সহজে বা এত সরাসরি হতে পারত কি?
বাসবান্না হেসে জিজ্ঞেস করলেন কাঁকনকে, ‘তোমার কী মনে হয়?’
‘আমার মনে হয়, এত সরাসরি বোঝাপড়া হয় না আজকাল । আজকের দিন হলে কোভালনের এক্সট্রা-ম্যারিটাল অ্যাফেয়ার চলছে জেনেও কন্নকী ওই কথাগুলো কোভালনের কাছে কখনোই জানতে চাইত না যে, মাধবীর কাছে কোভালন কেন গিয়েছে, কী অভাব ছিল কন্নকীর মধ্যে, কী পায়নি কোভালন কন্নকীর কাছ থেকে—আজকের দিন হলে এই সব প্রশ্নগুলোই করত না কন্নকী।’
বাসবান্না খুব আগ্রহ নিয়ে কাঁকনকে প্রশ্ন করলেন, ‘কিন্তু কেন এই সহজ বোঝাপড়া এখন প্রায়শই অবলুপ্ত হয়ে আসছে, বলো তো? এই বোঝাপড়ারই তো খুব দরকার আজকের দিনে। তাহলে হচ্ছে না কেন এই বোঝাপড়া এখন?’
কাঁকন বলল, ‘তার কারণ, এখনকার মানুষের ইগো সাংঘাতিক। নিজের যে কোনো অসম্পূর্ণতা আছে, একথা মানতেই চায় না কেউ আজকাল। যদি বা কেউ মনে মনে ভাবেও নিজের সীমাবদ্ধতার কথা, তবু অন্যের কাছ থেকে সে-ব্যাপারে কিছু জানতে চাওয়া বা অন্যের দ্বারা ভেরিফায়েড হওয়া—নৈব নৈব চ। তাতে আজকের মানুষের ইগোতে আঘাত লাগে। কেউই খাটো হতে চায় না অন্যের কাছে। সেযুগের কন্নকী-কোভালনের মধ্যে বন্ধুত্বের ভাব অনেক গভীর ছিল বলেই ওরা খোলাখুলি এসব নিয়ে আলোচনা করতে পেরেছে। এ ওর মনকে বুঝতে চেয়েছে। দুদিক থেকেই সেই বন্ধুত্বের ভাবটা ছিল। আর এখন হলে দুজনেই দম ধরে বসে থাকত। হয়তো কিছুদিন পরে ডিভোর্স চাইত!’
বাসবান্নার কালো মোটা ফ্রেমের চশমার আড়ালে বড়ো বড়ো চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠল। মৃদু হাসি মুখে নিয়ে তিনি কাঁকনের দিকে তাকিয়ে আছেন। বোঝা যাচ্ছে, কন্যাসমা মেয়েটির বাস্তববুদ্ধিতে বেশ মুগ্ধ হয়েছেন বাসুদা ।
আমি বললাম, ‘অথবা অন্য কিছুও হতে পারত, কাঁকন, আজকের দিন হলে। এখনকার দিন হলে কন্নকী হয়তো নিজের মতো করেই জীবনটা কাটাত, কোভালনের সমস্ত ব্যাপার আনুপূর্বিক জেনেও। পাত্তাই দিত না সে এসব কিছুকে। নিজের সুখ, নিজের আনন্দ নিয়েই থাকত। কোনোদিন ও নিয়ে আলোচনাই করতে যেত না কন্নকী কোভালনের সঙ্গে। আজকের দিন হলে কন্নকী নিজেও হয়তো অন্য কারও সঙ্গে কোনো অ্যাফেয়ার-এ জড়াত। এবং আমি মনে করি, বেশ করত।’
‘বেশ করত?’বাসুদা তীক্ষ্ণভাবে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন।
‘হ্যাঁ, বাসুদা। আমি মনে করি, তাতে কিছু ভুল হত না কন্নকীর পক্ষে। হ্যাঁ, আমি এটাই মনে করি । কোভালনের যদি স্বাধীনতা থাকে মাধবীর সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার, তাহলে সেই একই স্বাধীনতা কন্নকীর কেন থাকবে না, বলুন? সেও ইচ্ছে করলে অন্য কাউকে ভালোবাসতে পারে।’
‘এটা স্বাধীনতা, না স্বেচ্ছাচারিতা ?’ বাসুদা আবার প্রশ্ন করলেন।
‘কোভালনের ক্ষেত্রে এক্সট্রা-ম্যারিটাল অ্যাফেয়ার যদি স্বাধীনতা হয়, তাহলে কন্নকীর জন্যেও সেটা স্বাধীনতাই। আর কন্নকী এক্সট্রা-ম্যারিটাল অ্যাফেয়ারে জড়িয়ে পড়লে, তাকে যদি আপনি স্বেচ্ছাচারিতা বলেন, তাহলে কোভালনের ক্ষেত্রেও সেটাকে স্বেচ্ছাচারিতাই বলুন।’
‘অর্থাৎ স্বেচ্ছাচারিতার উত্তরে স্বেচ্ছাচারিতাকে তুমি সমর্থন করছ?’
‘হ্যাঁ, করছি। কে বলে দেবে, কোনটা স্বাধীনতা আর কোনটা স্বেচ্ছাচার? এ যে যার নিজেকে ঠিক করতে হবে।’
‘তাহলে সমাজ? সমাজের কী হবে? এরকম স্বেচ্ছাচারী মানুষে ভরে গেলে সমাজ তো ভেঙে পড়বে।’
‘সমাজ একটা ভণ্ড প্রতিষ্ঠান, বাসুদা। এমনিতেই সমাজ প্রতিদিন ভেঙে পড়ছে। আর আমরা সবাই সেই ভঙ্গুর ভণ্ড সমাজের মধ্যেই বাস করছি। এই ভণ্ড ব্যবস্থার মধ্যে বেঁচে থাকতে হলে, এই হিপোক্রিট সিস্টেমের মধ্যে নিজের সুকুমার বৃত্তিগুলোকে খানিকটা অন্তত বাঁচিয়ে রাখতে হলেও, এর সঙ্গে চাতুর্য করেই চলতে হয়। চাতুর্য ছাড়া এখানে এক মুহূর্তও নিঃশ্বাস নিলে সমাজ তৎক্ষণাৎ আপনার পায়ে বেড়ি পরিয়ে এই হিপোক্রিট সিস্টেমের আগাপাস্তালা গোলাম করে ছাড়বে।’
বাসবান্না নিজের মনে অনেকক্ষণ ধরে চিন্তা করতে লাগলেন। তারপর বললেন, ‘তোমার কথা বাস্তবসম্মত হলেও আমি এটাকেই চরম সমাধান বলে ভাবতে পারছি না, স্বয়ম, সরি! তুমি হয়তো অনেক ঘা খেয়ে এসব বলছ। কিন্তু চরম নিষ্পত্তি—এ হতে পারে না। যাই হোক, এ নিয়ে তর্ক এখন মুলতুবি থাক। তবে এখানে আরও একটা ব্যাপার মনে রাখা দরকার কিন্তু।
কাঁকন বলল, ‘কী ব্যাপার?’
বাসবান্না বললেন, “কন্নকীর মতো মেয়ে কোনো যুগেই কি সংখ্যায় খুব বেশি ছিল? চরিত্র-বৈশিষ্ট্যের দিক দিয়ে কন্নকী কি অসাধারণ নয়?”
কাঁকন উত্তর দিল, “তা তো ঠিক। কন্নকী খুবই অন্য ধরনের মেয়ে। তার মতন সহজ, তেজস্বিনী, স্পষ্টভাষিণী অথচ সংবেদনশীলা নারী সব যুগের পক্ষেই ব্যতিক্রমী; একথা ঠিক।’
বাসবান্না মিটিমিটি হেসে কাঁকনের দিকে তাকিয়ে অতঃপর বললেন, ‘তাহলে ব্যতিক্রমী কন্নকীর পক্ষে এসব প্রশ্ন তোলা যতটা সম্ভব ছিল, অন্য কোনো সাধারণ মেয়েদের পক্ষে, এমনকি সেযুগেও, তা বেশ সহজ ছিল না। তাই না? তাই তো দাঁড়াচ্ছে?’
কাঁকন ভুরু কুঁচকে ভাবতে ভাবতে বলল, ‘হ্যাঁ, তাই-ই দাঁড়াচ্ছে বটে!
কাঁকন বুঝতে পারছে না, বাসবান্না তাকে ধীরে ধীরে কোন বাঘের গুহায় টেনে নিয়ে যাচ্ছেন!
বাসবান্না এবার সোজা হয়ে বসে বেশ দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন, ‘তাহলে তোমরা যে এতক্ষণ বলছিলে, সেযুগে মানুষ অনেক সরাসরি পরস্পরের মধ্যে বোঝাপড়া করতে পারত আর এখন এযুগে মানুষের ইগো এত বেশি যে, পরস্পর কোনো সহজ আলোচনাতে যেতেই পারে না–তোমাদের ওই থিয়োরিটা তাহলে তো আর দাঁড়াচ্ছে না, কী বলো ? কন্নকী ব্যতিক্রমী সারল্যের অধিকারিণী ছিল বলেই মন খুলে সে কোভালনের সঙ্গে এসব নিয়ে কথা বলতে পেরেছিল। কিন্তু সেটা তো সাধারণ নিয়ম নয়; সেটা ব্যতিক্রম। সাধারণ নিয়মের কথা যদি বলতে হয়, তাহলে এই বলব যে, মানুষের মনের আড়াল চিরকালই ছিল, সব যুগেই ছিল। অন্যের কাছে নিজের মনোবেদনা খুলে বলার সামর্থ্য সাধারণ স্বভাবের মানুষের কোনোকালেই খুব বেশি ছিল না। সেযুগেও নয়, এযুগেও নয় ।’
আমি বললাম, ‘তাহলে কি বলতে চাইছেন, সময়ের সাথে সাথে সমাজ পালটায়নি? মানুষের চরিত্র বদলায়নি?”
বাসুদা বললেন, “তা কেন বলব? সমাজ পালটেছে বই-কী! উপর-উপর অনেক কিছুই পালটেছে। কিন্তু মানুষের মনের গভীর অংশটা – সেটা খুব পালটেছে কি? সেই এক ক্ষুধা, এক কামনা-বাসনা, এক কপটতা, এক স্বেচ্ছাচার, একই প্রেম-অপ্রেম… কিছুটা পালটালেও সে অনেকটা ইধার কা মাল উধার, আউর উধার কা মাল ইধার-টাইপের পরিবর্তন। আমার তো তাই-ই মনে হয়।’
কাঁকনের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, সে বেশ চিন্তামগ্ন মুখে হাতের নেলপলিশ খুঁটছে। মুখে বেশ একটা অস্বস্তির ভাব। আমি মনে মনে হাসলাম। সাধের থিয়োরি ভন্ডুল হয়ে গেলে অল্পবয়েসি ছেলেমেয়েরা মনে মনে দুঃখ পায়৷
কিন্তু কাঁকনের বয়েসি ছেলেমেয়েদের মেঘলা মুখ আমি সইতে পারি না। আলোচনাটাকে অন্য খাতে বইয়ে দিলে যদি এখন কাঁকনের মন ভালো হয়—সেই কথা ভেবে আমি তাড়াতাড়ি অন্য একটা প্রসঙ্গ টেনে আনলাম। বললাম, ‘বাসুদা! কোভালনের মানসিক জটিলতাটাও—ওর কমপ্লেক্সটাও আমার কিন্তু বেশ ইন্ট্রিগিং লাগছে!’
কাজ হল। নেলপলিশের দিক থেকে নজর ঘুরিয়ে বেশ আগ্রহভরা চোখ তুলে কাঁকন আমাদের দিকে তাকাল। বাসুদা বললেন, ‘হ্যাঁ, কোভালনের কমপ্লেক্সটা চিত্তহারী তো বটেই, ভাই! আসলে কোভালনের মানসিক সমস্যাটা প্রায়শই কল্পনাপ্রবণ মানুষদের ক্ষেত্রে দেখা যায়। এরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই লেখক, কবি, শিল্পী হয়ে থাকে। এরা কেমন মানুষ, জানো? কোথাও যাবার আগে এরা মনে মনে সেই জায়গাটার একটা কল্পনা করে নেয়। কারও সঙ্গে দেখা করতে হলে, সাক্ষাতের আগেই এরা সেই ব্যক্তিকে মনে মনে কল্পনা করে নেয় । ‘
কাঁকন অবাক হয়ে বলে উঠল, “আরে, এমন তো আমারও হয়। আমি অবশ্য শিল্পী নই ।
বাসবান্না সস্নেহে কাঁকনের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘হয়তো তুমি শিল্পী হবে ভবিষ্যতে। কবি হবে। তোমার সামনে তো এখনও দীর্ঘ জীবন পড়ে আছে। সেকথা থাক। যা বলছিলাম, এই কল্পনাপ্রবণ মানুষগুলোর কথা। যেকোনো বাস্তব অভিজ্ঞতার সম্ভাবনা দেখা দিলেই আগে থেকেই এরা সেটা কেমন হবে, তা মনে মনে কল্পনা করে বসে। আমি
বললাম, ‘ফ্যান্টাসি?’
‘হ্যাঁ, ওইরকমই। এদের মন ভীষণ ফ্যান্টাসি-প্রবণ। ধরো, এই ধরনের একটা কল্পনাপ্রবণ ছেলে একটা মেয়েকে সবে দেখেছে এবং আকর্ষণ অনুভব করেছে। মানে, পূর্বরাগ চলছে। ব্যস! ভালো করে দেখাসাক্ষাৎ হওয়ার আগেই সে মনে মনে মেয়েটির ছবি আঁকতে শুরু করল। শুধু তাই নয়, ওই কল্পিত ধারণাটাকে সে ষোলো আনা সত্যি বলে মনে করতে থাকল। কল্পনার ওই ছবিটার জন্য সে তখন জান দিয়ে দিতে পারে। এদের ক্ষেত্রে প্রেমটা কেমন হয় জানো? অনেকটা তোমাদের কবি যেমন লিখেছেন, ওইরকম—’ এই অবধি বলেই বাসবান্না তাঁর ভাঙা গলায় গান ধরলেন। বাসবান্নার গলার যা অবস্থা, যেকোনো মুহূর্তেই সুর থেকে বেসুরে চলে যেতে পারেন। বোধহয় সেই জন্যেই তড়িঘড়ি তাঁর সঙ্গে সুরেলা গলা মেলাল কাঁকন-
‘তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা, তুমি আমার সাধের সাধনা,
মম শূন্যগগনবিহারী।
আমি আপন মনের মাধুরী মিশায়ে তোমারে করেছি রচনা—
তুমি আমারি, তুমি আমারি,
মম অসীমগগনবিহারী…’
গান থামিয়ে আবার পূর্বপ্রসঙ্গে ফিরে গেলেন বাসবান্না, “তো এইরকম ! ওই ধরনের কল্পনাপ্রবণ পুরুষ তার আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে প্রেমিকাকে মনে মনে রচনা করে নেয় ৷’
কাঁকন বলল, “শুধু পুরুষের দিক থেকে বলছেন কেন? একটি কল্পনাপ্রবণ মেয়েও তো এইভাবেই তার নিজের ফ্যান্টাসির রঙে প্রিয় পুরুষকে মনে মনে গড়ে নিতে পারে। এই গানেও তো উদ্দিষ্ট ব্যক্তিটিকে রবীন্দ্রনাথ ‘শূন্যগগনবিহারী’ লিখেছেন পুংলিঙ্গে। তার মানে এই কথাগুলো যে বলছে, সে নারী। নারীর বয়ানে লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ।”
বাসবান্না হাসতে লাগলেন। হাসতে হাসতেই বললেন, ‘ঠিকই বলেছ, কাঁকন। পুরুষ হোক বা নারী বা তৃতীয় লিঙ্গের কেউ—যদি সে কোভালনের মতো অতি-কল্পনাপ্রবণ হয়, তাহলে প্রেমাস্পদ বা প্রেমাস্পদাকে ভালো করে বোঝার আগেই সে কল্পনা দিয়ে মনে মনে রচনা করে নেয়। এটাই বলতে চাইছি।’
কাঁকন বলল, ‘কিন্তু সেটা তো তার কল্পনা। বাস্তবে উলটোদিকের মানুষটা তো তার কল্পনামাফিক নাও হতে পারে।’
বাসবান্না বললেন, ‘না হতেই পারে তো! বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই হয় না। বাস্তব আর কল্পনা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মেলে না।’
আমি বললাম, ‘বাস্তব মানুষটার সঙ্গে ভালোবাসা আদানপ্রদান করতে গিয়ে কিংবা দৈনন্দিন ব্যবহার করতে গিয়ে তখন বেরিয়ে আসে, উলটোদিকের মানুষটা কল্পনার থেকে অনেক আলাদা । স্বপ্ন ভেঙে যায়। তখনই বাধে মুশকিল।’
বাসবান্না বললেন, ‘হ্যাঁ, মুশকিল বাধে। আবার মুশকিল মিটেও যায়, যদি কল্পনাপ্রবণ মানুষটি বাস্তবকে খানিকটা মেনে নিতে পারে। অনেকক্ষেত্রেই সেটাই হয়। প্রায়শই কল্পিত প্রেমাস্পদের তুলনায় বাস্তবের প্রেমাস্পদ মানুষটিকে বেশ আটপৌরে, বেশ সাধারণ বলেই মনে হয়। সেক্ষেত্রে বাস্তবতাটাকে মেনে নিতে পারলে মানুষ শান্তি পায়, সুখীও হয়।’
কাঁকন অমনি বলে উঠল, “কিন্তু কোভালনের ক্ষেত্রে তো উলটো হল–বাসবান্না সঙ্গে সঙ্গে কথা লুফে নিলেন, ‘হ্যাঁ, উলটো হল। বাস্তবের কন্নকী কোভালনের কল্পনার চেয়েও অনেক বেশি সুন্দর। অন্তত কোভালনের তাই-ই মনে হয়েছিল।’
কাঁকন জিজ্ঞেস করল, ‘কিন্তু তাতে তো কোভালনের খুশি হওয়ারই কথা ! বাস্তবের কন্নকী যদি কোভালনের কল্পনাকেও ছাপিয়ে যায়, যদি আশাতীত সৌন্দর্য, মাধুর্যের অধিকারিণী হয়ে থাকে, তাতে তো বরং খুবই সুখী হওয়ার কথা কোভালনের। উলটে বিষণ্ণ হল কেন?’
‘বিষণ্ণ হল, কেননা কোভালনের মতো মানুষেরা অতিশয় ফ্যান্টাসি-প্রবণ মানুষ হয় । এরা নিজেদের কল্পনাকে, নিজেদের কল্পনার শক্তিকে বাস্তবের চেয়েও অনেক অনেক অনেক বড়ো বলে মনে করে। এদের কাছে জীবন, জগৎ, প্রেম—সমস্তই কল্পনারই বর্ণালি-বিচ্ছুরণ। কখনও যদি এদের কল্পনা বাস্তবের কাছে হার মানতে বাধ্য হয়, তখন এরা বিষম আঘাত পায়—মনে করে, জীবনটা একেবারে অর্থহীন। তখন এরা প্রাণপণে বাস্তবকে অস্বীকার করতে থাকে এবং নিজের কল্পনার বৃত্তটাকে আরও বড়ো, আরও বড়ো করে তুলতে থাকে। বাস্তবের কাছে এরা কিছুতেই হার মানতে চায় না। দরকার হলে অন্য একটা আধার, অন্য কোনো ব্যক্তি খুঁজে বের করে, যাকে নিয়ে আরও বড়ো কোনো কল্পনার স্বপ্নে মেতে থাকা যায় । ‘
আমি বললাম, ‘কোভালনের ক্ষেত্রে সেই অন্য ব্যক্তি, অন্য আধার মাধবী। তাই না?’
‘হ্যাঁ, ঠিক ধরেছ,’বাসবান্না বললেন, ‘মাধবীই সেই অন্য আধার ।’
কাঁকন প্রশ্ন করল, ‘কিন্তু মাধবীও কি হবে আর কোভালনের হুবহু কল্পনামাফিক? তা তো হতেই পারে না । মাধবীরও তো স্বতন্ত্র বাস্তবতা আছে। সে তো আর কোভালনের স্বপ্ন মাত্র নয়। সে বাস্তব একজন মানুষ। সেই বাস্তব মাধবীও তো একদিন কোভালনের কল্পনাকে অস্বীকার করে বেরিয়ে আসবে। তখন কী করবে কোভালন?’
‘কী করবে বা কী করেছিল, সেটা জানতে আমাদের তাহলে আবার ওই গল্পটার কাছেই ফিরে যেতে হবে। ইলাঙ্গো আডিগলের রচনার কাছেই ফিরতে হবে আমাদের,’ বাসবান্না বললেন।
আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, বাসুদা। গল্পটার কাছেই বরং ফিরে যাই চলুন। কী হল, তারপর ? বাসবান্না বলতে আরম্ভ করলেন, ‘হ্যাঁ, যা বলছিলাম। … সেই রাত্রের পরে কোভালন যেন আরও বেশি করে মাধবীতে আসক্ত, নিমজ্জিত হল। বহুদিন সে আর বাড়িতেই ফিরত না। যেন এক অসম্ভব নেশায় সে ডুব দিয়েছে, ভয়ংকর সর্বনেশে এক খেলায় মেতেছে। অথচ কন্নকী বসে আছে তার প্রতীক্ষা নিয়ে, অন্ধকারে চুল খুলে স্তব্ধবাক নিশীথিনীর মতো। কন্নকী জানে, একদিন-না-একদিন কোভালনের ঠিক ভুল ভাঙবে… কোভালন ফিরবেই একদিন…’
কিন্তু কোভালন-কন্নকী-মাধবীর এই ত্রিভুজ থেকে অনেক দূরে এই পুষ্পহার নগরেরই অপর প্রান্তে একই সময়ে বাস করত আরেক দুখিনী নারী—নাম তার দেবান্দী। পতিপরিত্যক্তা সেও, সেজন্যেই বিষণ্ণ; কিন্তু তার বিষাদের ভিতর স্বামীকে ফিরে পাওয়ার অস্থিরতা ছিল না। কারণ, সে জানত, নিশ্চিতভাবেই জানত, তার স্বামী বীরমণি আর কখনও গৃহে ফিরে আসবে না। কোনো অবস্থাতেই নয় ।
গৃহ পরিত্যাগ করে চলে যাওয়ার আগে বীরমণি তার প্রিয়তমা দেবান্দীকে অন্তিম আলিঙ্গন দিয়ে বলে গেছিল, ‘সুচরিতে! আমার গার্হস্থ্য জীবনযাত্রায় তুমি মঙ্গলবৃষ্টি করেছিলে প্রতিদিন তোমার অকৃপণ নয়নসম্পাতে। আমাকে যথাসম্ভব পূর্ণতা তুমি দিয়েছ । তোমার কাছে আমার ঋণ অপরিশোধ্য। কিন্তু এই গৃহ, এই দেহই শেষ সত্য নয়। মানুষের ভিতর এক মৃত্যুহীন সত্তা আছে। হে সুতনু! তোমার মধ্যেও সেই সত্তা আছে, আছে আমার মধ্যেও। এই চরাচর সেই এক মৃত্যুহীন সত্তাতেই ওতপ্রোত। এর অন্বেষণই মনুষ্যজীবনের চরম সার্থকতা। আমার গৃহজীবন পরিসমাপ্ত হয়েছে। এবার আমাকে সেই অমরণীয় সত্তার সন্ধান করতে হবে নিজেকে সম্পূর্ণ নিঃস্ব করে দিয়ে। আমাকে অনুমতি দাও, কান্তিমতী। আমি চলে যাচ্ছি। আর কখনও এখানে ফিরে আসব না। তোমার জন্যে এই গৃহ, এই বিত্ত, এই সংস্থান—সমস্তই রেখে গেলাম। একদিন তোমার মধ্যেও এ পথের ডাক আসবে, সেদিন তুমিও চলে এসো। হয়তো এই চলার পথের ধারেই কখনও কোথাও আমাদের দেখা হবে।’
স্বামীর সঙ্গে আসন্ন বিচ্ছেদের সম্ভাবনায় বিলাপাতুর দেবান্দী বলেছিল, ‘জানি আমি, প্রিয়তম, তোমার পথরোধ করা আমার পক্ষে অনুচিত, অসম্ভব। আমিও মনে মনে জানতাম একথা যে, একদিন তুমি চলে যাবে। কিন্তু হে দেবদর্শন! যাওয়ার আগে আমাকে বলে যাও, তোমার অদর্শনকালে কী দিয়ে আমি আমার তাপিত হৃদয় জুড়াব ? কী নিয়ে আমি থাকব ?’
তখন বীরমণি বলেছিল, ‘ধর্মশাস্তার মন্দিরে আমার পাট; সেখানেই আমার নিত্য অধিষ্ঠান। তুমি প্রতিদিন ওই মন্দিরে গিয়ে শাস্তার উপাসনা কোরো। তোমার প্রেমের অর্ঘ্য আমি সেখানেই প্রত্যহ গ্রহণ করব।’*
বীরমণি চলে যাওয়ার পর থেকে প্রতিদিন ভোররাতে স্নান সেরে দেবান্দী তাই শাস্তার মন্দিরে চলে যেত, পূজা দিত শাস্তার। পূজা শেষ হলে নিজের সমস্ত দেহ-মন-প্ৰাণ নিবেদন করত শাস্তার চরণে। তারপরে মন্দির থেকে বেরিয়ে ঘরে ফেরার পথের পাশে একটি অশোকবৃক্ষের তলায় উপস্থিত হত দেবান্দী রোজ। এই তরুতলেই তার সঙ্গে তার স্বামী বীরমণির প্রথম দেখা হয়েছিল। বিবাহপূর্ব প্রণয়বেলায় প্রতিদিন অপরাহ্ণকালে সে ও তার স্বামী বীরমণি এই অশোকতলেই দেখা করত। আজ এই অশোক প্রৌঢ় হয়েছেন। প্রতিদিন মন্দির থেকে ফেরার পথে দেবান্দী তাই এই অশোকবৃক্ষের মূলে এক ঘটি জল ও দুয়েকটি পুষ্প নিবেদন করে আন্তরিক শ্রদ্ধার্ঘ্য জানাত। তারপর রোদ ওঠার আগে অবধি সে প্রতিদিন বসে থাকত এই অশোকতরুমূলে।
মনে পড়ত তার, এই তরুমূলে তাদের সেই প্রথম সাক্ষাৎ। তারপর কত বছর চলে গেছে যে ! মুগ্ধতার আবেশে বীরমণি সেই প্রথম দিনেই দেবান্দীকে বলেছিল, ‘তোমার চোখে পুষ্পের কোমলতা আছে, আর আমার চোখে আগুন। দেখো, যেন আমার এই আগুন তোমার ও কুসুমকে না পোড়াতে পারে!’
বীরমণি ছিল সত্যই সার্থকনামা। বলিষ্ঠ যুবাপুরুষ, শালপ্রাংশু তার দেহ আর প্রভাতের শিশিরের মতো স্বচ্ছ তার মনের আকাশ। দেবান্দীকে সর্বতোভাবে তৃপ্ত করেছিল বীরমণি। তাদের যুগ্মজীবনে কোনো আক্ষেপ ছিল না। দেবান্দী তাই নিত্য প্রার্থনা করত ঈশ্বরের কাছে, প্রতিটি নারীই যেন এমন স্বামী পায়।
একদিন গল্পচ্ছলে নিজের জন্মকথা বলেছিল বীরমণি। বলেছিল, সে নাকি দু-বার জন্মেছে।
একথার অর্থ কী, জানতে চেয়েছিল দেবান্দী। তখন বীরমণি শুনিয়েছিল এক অপরূপ রোমাঞ্চকর আখ্যান। সে-আখ্যানের অনেকটাই স্বর্গে-মর্তে নিবেশিত, আলোকে-আঁধারে মেশানো তার অভিপ্রায় ।
বীরমণি বলেছিল, যখন সে নিতান্ত অবোধ শিশু, তখন একবার তার পিতামাতা কাঞ্চিপুরে তীর্থযাত্রায় গিয়েছিলেন। বীরমণিকে রেখে গিয়েছিলেন তার সৎ-মায়ের কাছে। বীরমণির সেই বিমাতার নাম ছিল বল্লরী। একদিন শিশু বীরমণিকে দুধ খাওয়াতে গিয়ে বল্লরীর হল বিপত্তি। দুগ্ধপানকালে গলায় কফ জড়িয়ে দম আটকে শিশু বীরমণির মৃত্যু হয়। তখন বল্লরী সেই মৃত শিশু কোলে নিয়ে রোদন করতে লাগলেন। কী করবেন এখন তিনি? তীর্থযাত্রা থেকে তাঁর স্বামী ও সপত্নী ফিরে এলে কীই-বা জবাবদিহি করবেন?
মৃত শিশুটিকে কোলে নিয়ে ধর্মভীরু বল্লরী তখন নিকটস্থ মন্দিরে গেলেন। সেখানে এক কল্পবৃক্ষ ছিল। সেই কল্পবৃক্ষের কাছে শিশুটির প্রাণ ভিক্ষা করতে লাগলেন। কল্পবৃক্ষ কোনো উত্তর দিল না। ঐরাবত-মন্দিরে গিয়ে ঐরাবতের কাছে কাতর প্রার্থনা করলেন।
ঐরাবত নীরব হয়ে রইল। শুভ্রকান্তি বলরামের মন্দিরে গিয়ে হত্যে দিয়ে পড়লেন । সেখানেও কোনো প্রত্যাদেশ পেলেন না। একে একে সূর্যদেবতার মন্দির, কৈলাসপতির মন্দির, কার্তিকেয়-মন্দির, বজ্রধর ইন্দ্রের মন্দির, নগরের বহির্দেশে অবস্থিত আয়াণার দেবতার মন্দির, নির্গ্রন্থ জৈন মন্দির, চন্দ্রদেবতার মন্দির-সর্বত্র মৃত শিশু কোলে করে বল্লরী প্রার্থনা করতে লাগলেন। ‘হে দেবগণ, আমাকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করো। শিশুটির প্রাণ ফিরিয়ে দাও।’ কিন্তু কোথাও তাঁর প্রার্থনা সফল হল না। কোনো দেবতাই রোরুদ্যমানা বল্লরীর দিকে অনুকম্পাভরে একবার ফিরেও চাইলেন না।
তখন মৃত শিশুটিকে নিয়ে বল্লরী ইন্দ্রজালকুশল শাস্তার মন্দিরে উপস্থিত হলেন। সেখানেও সেই একই করুণ প্রার্থনা করতে লাগলেন। ‘হে ধর্মশাস্তা! আমি কী এমন অপরাধ করেছি, যার জন্যে আমার এমন ভোগান্তি? দয়া করে আপনি আমার কাতর প্রার্থনায় কর্ণপাত করুন। মৃত শিশুটির প্রাণ ফিরিয়ে দিন। দয়া করুন।’
এমন সময় এক অপরূপা সুন্দরী নারী সেখানে উপস্থিত হয়ে বল্লরীর উদ্দেশে সগর্জনে বলে উঠল, ‘ও রে প্রার্থনানিরতা! তোর সত্যিই কোনো দোষ নেই। কিন্তু শাস্তার উদ্দেশে কিছু উৎসর্গ না করলে শাস্তা প্রসন্ন হন না। কী এনেছিস তুই? শাস্তাকে তুই কী দিতে পারবি?’
বল্লরী বিহ্বল নেত্র মেলে উত্তর দিলেন, ‘মা গো! কিছুই তো আনতে পারিনি শাস্তার জন্য। কিছুই তো আমার নেই।’
তখন সেই নারী খলখল শব্দে হেসে উঠে বলল, ‘আছে, আছে, আছে। তোর এই মায়া আছে, এই আসক্তি আছে, এই মোহ আছে। দে, দে, এখনই দে!’ এই বলে সেই নারী ভয়ংকরী মূর্তি ধারণ করে বল্লরীর কাছ থেকে শিশুটির মৃতদেহ কেড়ে নিল ।
অট্টহাস্য করতে করতে ঘোরবর্ণা রূপ ধারণ করল সেই নারী। বুকফাটা চিৎকার করে বলে উঠল, ‘আমি ডাকিনী। আমি শ্মশানের মৃতদেহ ভক্ষণ করি।’ এই কথা বলতে বলতে সেই ভয়ংকরী রমণী শিশুটির মৃতদেহ কড়মড় শব্দে চর্বণ করে তাকে উদরস্থ করতে লাগল ।
এই বীভৎস দৃশ্যের আঘাতে বল্লরী জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন ।
তাঁর জ্ঞান যখন ফিরল, তখন তিনি অনুভব করলেন, চারিপাশে আকাশবাতাস যেন মধুগন্ধে ভরে গেছে। সেই ডাকিনী মূর্তিও কোথাও আর নেই। পরিবর্তে তাঁরই দিকে তাকিয়ে স্বয়ং ধর্মশাস্তা মৃদুমঞ্জুল হাসছেন।
শাস্তা বললেন, ‘বল্লরী, ওঠো! ভয় দূরীভূত হয়েছে। তোমার মোহ, মায়া, আসক্তি চলে গেছে । তুমি এখান থেকে উঠে চলতে শুরু করো। সম্মুখেই একটি কোকিলকূজিত বৃক্ষ পাবে। সেই বৃক্ষের তলায় তুমি শিশুটিকে জীবিত দেখতে পাবে। ওই শিশুটি স্বরূপত আমিই। তরুতল হতে শিশুটিকে তুলে নিয়ে তুমি গৃহে ফিরে যাও।’ এই বলে শাস্তা অন্তর্হিত হলেন ।
সচমকে ভূতল হতে উত্থিত হয়ে বল্লরী মন্দিরের সামনের বনপথ ধরে হাঁটতে আরম্ভ করলেন। কিছুদূর অগ্রসর হতেই ফুলে ফুলে ঢাকা একটি বনস্পতি চোখে পড়ল। সেই বনস্পতির পত্রান্তরাল হতে অজস্র কোকিল অবিরত কুহুতানে ভরিয়ে দিচ্ছে বনের আকাশ।
বল্লরী ভালো করে তাকিয়ে দেখলেন, তরুতলে শিশু বীরমণি জীবিত অবস্থায় পড়ে আছে। কী যেন আনন্দে পরিপূর্ণ হয়ে শিশু বীরমণি সাহ্লাদে হাত-পা ছুড়ছে !
শাস্তার প্রতি কৃতজ্ঞতায় অভিভূত বল্লরী দেবতার উদ্দেশে বারবার প্রণাম জানিয়ে পুনর্জীবিত শিশু বীরমণিকে কোলে তুলে নিয়ে সেদিন গৃহে ফিরেছিলেন।
এই কাহিনিটি বীরমণি তার প্রিয়তমা দেবান্দীকে বলেছিল। গল্প শেষ করে বীরমণি বলেছিল, ‘এবার বুঝলে তো প্রিয়ে, কেন আমার দু-বার জন্ম হয়েছে বলেছিলাম?’ সংশয় ও বিশ্বাসের মধ্যে দোলায়িত-চিত্ত দেবান্দী অপ্রস্তুত হেসে উত্তর দিয়েছিল, ‘হ্যাঁ, বুঝলাম !’
বীরমণি বলেছিল, ‘কিছুই বোঝোনি। মানুষের কি আর দু-বার জন্ম হয়?’
“তবে?” দেবান্দী অবাক হয়ে প্রশ্ন করেছিল।
‘তবে আর কী? দু-বার আমার জন্মই হয়নি। গলায় দম বেঁধে যে-শিশুটির মৃত্যু হয়েছিল, সে আমি নই। অন্য একটি শিশু। পরে সেই শিশুরই সদৃশ যে আরেকটি শিশুকে গাছতলায় আমার বিমাতা বল্লরী কুড়িয়ে পান, সেই শিশুটিই আসলে আমি । প্রকৃত প্রস্তাবে আমি হয়তো আমার পিতামাতার দ্বারা পরিত্যক্ত অবাঞ্ছিত কোনো সন্তান ছিলাম । এ ছাড়া আর কী বলি, বলো?’ শেষ কথাগুলো বলতে বলতে কণ্ঠস্বর ভারী হয়ে এসেছিল বীরমণির।
দেবান্দী তবু বলেছিল, ‘তাহলে বল্লরী-মা যে শাস্তার দর্শন পেয়েছিলেন?’
বীরমণি বলেছিল, ‘ওসব ধর্মভীরু বিমাতার বিপন্ন মনের স্বপ্ন। ওর কোনো সারবত্তা নেই ।’
কিন্তু তাই কী? যদি তাই-ই হত, তাহলে গৃহত্যাগ করে চলে যাওয়ার আগে বীরমণি কেন বলে গেল, ‘ধর্মশাস্তার মন্দিরে আমার পাট; সেখানেই আমার নিত্য অধিষ্ঠান। তুমি প্রত্যহ ওই মন্দিরে গিয়ে শাস্তার উপাসনা কোরো। তোমার প্রেমের অর্ঘ্যকুসুম আমি সেখানেই গ্রহণ করব?’
এ দুর্বোধ্য রহস্যের সমাধান করতে পারে না দেবান্দী। অশোকতরুমূলে বসে সে শুধু ভাবে আর ভাবে। তবে কি অতিলৌকিক কাহিনিটি কোনো-না-কোনোভাবে সত্য ? বীরমণি কি সেই সত্যের ইঙ্গিত পেয়েই গৃহত্যাগ করেছিল? কে জানে! কে তাকে এর উত্তর দেবে?
শুধু পথে পথে যখনই কোনো পরিব্রাজক ভিক্ষু, ক্ষপণক কিংবা কোনো ভ্রামণিকদের দেখা পেত দেবান্দী, তখনই আকুল হয়ে তাদের প্রণাম নিবেদন করে বলত, ‘তোমরা তো কত তীর্থে তীর্থে ঘুরে বেড়াও। কোথাও কোনো তীর্থস্থলে, কোনো প্রাচীনা নদীর তীরে কিংবা কোনো নিষুপ্ত গ্রামের মেঠোপথে তোমরা বীরমণি নামে কোনো সন্ন্যাসীকে কি দেখেছ? দ্যাখোনি? আচ্ছা, এর পরে যদি তাঁর কখনও দেখা পাও, তাহলে বোলো তো তাঁকে, দেবান্দীর পথ তাঁর পথের সঙ্গে মিলবে কোথায়? কত দিন পরে?’
কোনো কোনো রাত্রে সে একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখত। স্বপ্নটা ফিরে আসত তার কাছে বারবার। তার স্বামী বীরমণিকে স্বপ্নে দেখত না সে। বরং সে দেখত, কাজলকালো অন্ধকারের ভিতর কে একটি বেশ অল্পবয়েসি সুন্দরী মেয়ে মাথায় একঢাল চুল খুলে উদাস ভঙ্গীতে বসে আছে। মেয়েটির বড়ো বড়ো চোখের নীচে ফ্যাকাসে হয়ে আসা গালের উপর শুকিয়ে রয়েছে ম্লান অশ্রুরেখা। কত যুগের শিলীভূত সেই কান্না যে! অন্ধকারে চোখ জ্বেলে জ্বেলে মেয়েটি যেন কারও জন্যে অপেক্ষা করছে অনন্তকাল….
ঘুম ভেঙে উঠে দেবান্দী ভাবত, কে মেয়েটি? কার জন্যে অপেক্ষা করছে সে বসে বসে?
এইভাবে অগণ্য প্রাণের সুখ-দুঃখ, আশা-ভয়, ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে পুষ্পহার নগরীর জীবনস্রোত সদাই সম্মুখে বহে চলে। কন্নকী, কোভালন, মাধবী, ঊষসী, মাশাত্তুবান, মানাইক্কন, রাজা কারিক্কাল প্রভৃতি সেই বিরাট প্রাণের প্রবাহের থেকে তুলে নেওয়া কয়েক গণ্ডূষ জল মাত্র। এদের নিয়ে ইলাঙ্গো আডিগল মহাকাব্য শিলল্পদিকরম রচনা করেন ঠিকই, কিন্তু তাঁর কাব্যগ্রন্থের পূর্বপীঠিকা-উত্তরপীঠিকার বাঁধন ছাড়িয়ে যে অগণিত অনামিত প্রাণকণা কাবেরীর স্রোতস্থান প্রবাহের মতন অনন্তকাল ধরে পুষ্পহার নগরীর রাজপথ বেয়ে ধেয়ে চলে, তার হিসেব কে রাখে?
প্রতিদিন প্রভাতে উদয়গিরিতুঙ্গে সূর্য উঠে নিদ্রিতা নগরীর কপালে চুম্বন দিয়ে ঘুম ভাঙায়। ধীরে ধীরে জেগে ওঠে ব্যস্ত জনপদ। সূর্যের প্রথম কিরণমালা এসে পড়ে সমুন্নত সৌধগুলির অলিন্দে অলিন্দে, সমুদ্রতীরের পণ্যাগারসমূহের চূড়ায় চূড়ায়। নগরীর অজস্র উচ্চ মিনারের গায়ে যে-মৃগচক্ষুর মতো ঘুলঘুলি রয়েছে, সেসব অপরিসর বায়ুরন্ধ্রপথে আলোর বুলবুলিরা খেলা করতে নামে। পুষ্পহারের নানা স্থানে সমৃদ্ধ যবন*-বণিকদের দৃষ্টিনন্দন প্রাসাদশীর্ষে লুটিয়ে পড়ে দিনের প্রথম আলোর চেলাঞ্চল। দূর দেশ থেকে আলোকিত সমুদ্রপথ বেয়ে ভেসে ভেসে ব্যাপারীদের অর্ণবপোতগুলি একে একে বন্দরের ঘাটে এসে লাগে। রৌদ্রকরোজ্জ্বল রাজপথ ধরে পণ্যঘোষ পসারির দল সশব্দে ঘোষণা করে ফেরে, ‘চাই সিতশঙ্খ, মূলস্থানী মাটি, চাই ফুল-ধূপ-অগুরু-রঞ্জক!
নগরীর কোনো কোনো স্থানে তসর, পশম আর কার্পাসের আপণ–সেখানে সারা পথ জুড়ে শুধু রেশম, প্রবাল, চন্দন, সুগন্ধির সম্ভার; কোথাও-বা দুর্লভ অলংকার, নিখুঁত মুক্তা, রত্ন ও সুবর্ণের গণনাতীত বিপণি। এসব বিপণিতে দিবারাত্রি পরিশ্রম করে চলে দক্ষ শিল্পীর দল; ভারত সমুদ্রের লবণাম্বুজাত ফেনার ফুলের মতো সদাব্যস্ত, সদাকর্মমুখর অগণ্য শ্রমজীবী নরনারী। নগরীর অন্য ধারে শস্য ব্যাপারীদের পাড়া। সেখানে বিতানে বিতানে সাজানো ধান, চাল, বাজরা, ভুষি আর খড়ের বিপুল স্তূপ—নদীবক্ষা মারুদম, পার্বত্যপ্রদেশ কুরিঞ্জি, ঘন অরণ্যভূমি মুল্লাই—সমস্ত অঞ্চলের অসংখ্য
কিষান-কিষানির মাথার ঘাম পায়ে-ফেলা ছেদহীন, ক্লান্তিহীন পরিশ্রমের বিনিময়ে সঞ্জাত সোনার ফসল।
পুষ্পহার নগরীর রাজপথ দিয়ে গতিমান কত যে বিচিত্র মানুষের চলৎপ্রবাহ — বিচিত্র তাদের আকার, বিভিন্ন তাদের পেশা। কাপড়ের বোঝা কাঁধে ধোপা, সুগন্ধিত উষ্ণ পিষ্টকে পরিপূর্ণ বৃহৎ ধাতব পাত্র ঘাড়ে পাচক, ঢুলু ঢুলু অরুণনয়ন শৌণ্ড্রিক শুঁড়ি, আঁশটে সামুদ্রিক মাছের শকটে উপবিষ্ট ঘর্মাক্ত মৎস্যজীবী, লবণের স্থূলবপু আড়তদার, সুরসিক সুগায়ক পানবিক্রেতা, সুগন্ধির ব্যাপারী, সোনার বেনে, তেলের পসারি, সূত্রধর, চর্মকার, কর্মকার, কুম্ভকার, নিষাদ, ব্যাধ – অন্তহীন জীবিকার স্রোত। তারপর সেই সব মানুষেরা, যাদের হাতপায়ের আঙুল সূক্ষ্ম সুচারু, যারা কাপড় জরি শোলা দিয়ে ঘর-সাজানোর শৌখিন জিনিসপত্তর বানায়; উদাসনয়ন চাঁচর-কেশ শিল্পীরা—যারা বাঁশির পাগল, বীণার বাদক; আরও কত রকম কত কিসিমের কলাবিৎ—এরাই তো জমিয়ে রেখেছে মারুবুরুপক্কমের শীর্ণ গলি আর প্রশস্ত রাজপথ।
নগরীর অপর অংশের চিত্রটি ভিন্ন প্রকারের। সেখানে রাজমার্গ ধরে বহুবর্ণরঞ্জিত উড্ডীনকেতন শকটের স্রোত, পথের দুপাশে কোথাও কোথাও সুসজ্জিত বাজার, কোথাও কোথাও আবার পথিপার্শ্বে বিত্তবান শ্রেষ্ঠীদের উচ্চচূড় আবাস, ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের নিবাসস্থল, বৈদ্য ও জ্যোতিষীদের নিবিড় জমায়েত, তার থেকে আরও কিছু দূরে সূত, মাগধ, দেবদাসী, বারাঙ্গনা, নট, বিট, বিদূষকদের ঘনরঙ্গ পাড়া।
নগরের বাহিরে সৈন্যদের স্কন্ধাবার–সেখানে ভয়ালদর্শন অশ্বারোহী, গজারোহী, রথারোহী, পদাতিক সৈন্যদের গতিবিধি, তারই নিকটে তুরঙ্গ ও মাতঙ্গের নিত্য শব্দায়মান মন্দুরা। রথচক্রঘঘরে পরিপূর্ণ এই স্থান পট্টিণাপক্কম; এখানে সদাব্যস্ত সেনাধ্যক্ষ ও রাজকর্মীদের নিয়মিত গর্বিত পদক্ষেপ।
মারুবুরুপঞ্চম আর পট্টিণাপক্কম—এ দুয়ের মাঝখানে প্রশস্ত নগরস্থল; এইখানে সারা দিন হট্টমেলা—মধুচক্রে মধুকরদের নিত্য গুঞ্জরন—ক্রয়বিক্রয়নিরত গণনাতীত জনতার ধাবমান স্রোত ।
এদের উল্লেখ আছে মহাকাব্যের পুথিতে, এরা যেন ইলাঙ্গোর রচনার চালচিত্র নির্মাণ করে। তবু এদের প্রত্যেককে নিয়েই গল্প বলা যেতে পারে। এদের প্রত্যেকের জীবন থেকেই উঠে আসতে পারে বৃহদায়তন উপন্যাসের উপাদান।
এরা নানা বৃত্তিতে নিযুক্ত, সারা বছর ক্লেশকর কর্মসমুদ্রে নিমজ্জিত থাকে, কিন্তু চিত্তিরাই মাসে যখন চিত্রা নক্ষত্রের কাছে সরে আসে চাঁদ, যখন উৎসব শুরু হয়, তখন আর কাজের বাঁধন এদের বেঁধে রাখতে পারে না। তখন গৃহবধূরা দেবতার থানে সুপ অন্ন নিবেদন করে, তিলের নাড়ু, পলান্ন, তালের তাড়ি, পুষ্প, মাল্য, দীপ, ধূপে দেবতার অর্চনা চলতে থাকে সাড়ম্বরে মন্দিরে মন্দিরে। সকলের কুশল-প্রার্থনা, রাজার শ্রী-বিজয়-সমৃদ্ধি কামনা করে উৎসবে মেতে ওঠে সাধারণ মানুষ—কটিতে দু-হাত
রেখে এরা তুণাঙ্গাই নাচে আর সকলে মিলে গোল হয়ে হাতে হাত রেখে কুরাভাই নাচে ; এমনভাবে নাচগানে মেতে ওঠে তারা, দেখে মনে হয়, এরা আর বুঝি কোনোদিন কাজে ফিরবে না, ছুটির দেবতা বুঝি এদের শরীরে অনন্ত কালের জন্যে ভর করেছে। কিন্তু উৎসব শেষ হলেই আবার যে-কে-সেই; আবার উৎসবের চিহ্ন মুছে যে যার কর্মনিযুক্তিতে শান্ত হয়ে ফিরে চলে যায় । *
কিন্তু সে তো উৎসব শেষের কথা, এখন তো সমাসন্ন উৎসবের ঋতু—মহেন্দ্রের উৎসব। উৎসব-উদযাপনের আনন্দ ছড়িয়ে পড়ছে এখন সমস্ত নগরীর শরীরে, এক মন্দির থেকে অন্য মন্দির-প্রাঙ্গণে। কত যে মন্দির পুষ্পহারে। জন্মরহিত শিবের মন্দির, ষড়ানন সুব্রহ্মণ্যদেবের মন্দির, সিতশঙ্খের মতো শুভ্রকান্তি কৃষ্ণাগ্রজ বলদেবের মন্দির, মেঘবর্ণ শুভাঙ্গ শ্রীবিষ্ণুর মন্দির, জয়ছত্র ও মুক্তামালায় সুশোভিত উৎসব-দেবতা মহেন্দ্রের মন্দির। এই সব মন্দিরে আজ আনন্দের বন্যা—একদিকে যজ্ঞশালায় বৈদিক মন্ত্রের মন্দ্ৰ উচ্চারণ, অন্যদিকে পুরাণকথিত তেত্রিশ উপাস্য—অষ্ট বসু, দ্বাদশ আদিত্য, একাদশ রুদ্র ও দ্বিবিধ মরুৎ—সর্বত্র অর্চিত হচ্ছেন। জৈন ও বৌদ্ধ মন্দিরেও এসে লেগেছে উৎসবের আভা, সেখানেও উপাসক-উপাসিকাদের আনন্দ-কলতান। রাজার সর্ববিজয়ী রথের চূড়ায় মৎস্যচিহ্নিত জয়ধ্বজ উড্ডীন হয়েছে, কোথাও বায়ুপুরাণ থেকে সুর করে পাঠ ও ব্যাখ্যা করে চলেছেন কোনো কথকঠাকুর, কোথাও-বা বাঁশি, মৃদঙ্গ ও বীণার ঐকতান মধুর করে রেখেছে মন্দিরের আকাশ। সেই সুরে মিশে যাচ্ছে লোক-কবিদের কণ্ঠস্বর, নগরীর দিনরাত্রি মুখর হয়ে উঠেছে জনতার হর্ষধ্বনিতে আর সুরের সুগভীর মূর্ছনায়।
উৎসব আবদ্ধ থাকে না শুধু মন্দির-প্রাঙ্গণে। মন্দিরের চত্বর পেরিয়ে রাজপথে, গলিপথে, কাবেরীতীরে, সমুদ্রতটে—নগরীর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে উৎসব। আবির, গুলাল, মৃদঙ্গ, কলতান সব মিলেমিশে একাকার। তার মধ্যে রঙ্গপ্রিয় যুবক-যুবতীরা বেরিয়ে পড়েছে পথে পথে। আজ তাদের অবাধ মেলামেশা। আনন্দ তাদের আননে, চক্ষে, চিবুকে, ওষ্ঠে, বাহুতে, বক্ষে—সর্বাঙ্গে। তাদের মুখে আজ লঘু রসিকতা, পরিহাস আর তালপ্রধান লোকগান। সেসব গানের ভাষা প্রায়শই অশালীন, অন্তত সে-ভাষা খুব পরিশীলিত, শিষ্ট বা সুসামাজিক—এমন বলা চলে না
যেন এই প্রমত্ত তরুণ তরুণীদের দেখেই দক্ষিণে বাতাস ধেয়ে আসছে মহা কুতুহলে। উদ্যানের অর্ধস্ফুট সলজ্জ পুষ্পকোরকের মৃদু সুগন্ধ মিশে যাচ্ছে সে-বাতাসে। মলয় পবন বয়ে চলেছে পথের ধারের গাছগুলির গোলপাতা ঝুরুঝুরু কম্পিত করে, ঢুকে পড়ছে সর্বত্র—গৃহাবাসে, হর্ম্যে, সৌধে, প্রাসাদে। ধেয়ে চলেছে হট্টস্থ আপণগুলির ভিতর। এ বাতাস গায়ে মেখে নিচ্ছে জনতার কলরোল আর হর্ষধ্বনি, ধূপ, গুগ্গুল আর চন্দনের ঘ্রাণ। এ বাতাস তার সর্বাঙ্গে সোনালি উত্তরীয়ের মতো জড়িয়ে নিচ্ছে প্রেমিক-প্রেমিকাদের দুষ্টুমিভরা আলাপ, পরিহাস, প্রেমকলহ। প্রণয়ী-প্রণয়িনীর নীচু স্বরে উচ্চারিত গোপন সব কথা এ বাতাস বয়ে নিয়ে যাচ্ছে দুরন্ত গতিতে, রাষ্ট্র করে দিচ্ছে চারিদিকে। আসন্ন গ্রীষ্মের উত্তাপে উত্তপ্ত হয়ে এই দক্ষিণা বাতাস মধুকর-মধুকরীর সঙ্গে মিশে যাচ্ছে অবাধে । বসন্ত সমীরণের উদ্দাম সংসর্গে পুষ্পচ্যুত ভ্রমর-ভ্রমরী বীণার পঞ্চম সুরে গান ধরেছে আজ ।
এই ভিড়ের মধ্যে কোভালনও বেরিয়ে পড়েছে। পথ থেকে পথে বর্ণ, ছন্দ, গন্ধ, গীতে যেন মাতাল হয়ে কোভালন বুঝি আজ ফিরে পেয়েছে তার জীবনের সেই সব প্রথম যৌবনের দিন। এ মুহূর্তে কারও কথা মনে পড়ছে না তার। না কন্নকীর কথা, না মাধবীর কথা । সে এখন মিশে আছে উৎসব-আনন্দে যুবকদের মধ্যে। হাঁটতে হাঁটতে জনসমৃদ্ধ এক গলিপথের মুখে সে দেখল, কয়েকজন রঙ্গপ্রিয় যুবক তালবাদ্য সহকারে গান ধরেছে। তাদের লক্ষ্য পথপাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক রঙ্গিনী সুন্দরী। একজন পীতবাস যুবক তার কাঁধ-ছাপানো চাঁচরকেশে ঝাঁকি দিয়ে গান ধরল :
‘আ রে রে আকাশের চাঁদ রে
রাহুর ভয়ে পালায় দূরে…
’
তখন অন্য যুবকেরা ধুয়া ধরল গানের :
‘আ রে রে আকাশের চাঁদ
কোথায় যাবে?
(বলো) কোথায় যাবে, কোথায় যাবে, কোথায় গিয়ে মুখ লুকাবে ?’
আবার সেই পীতবাস যুবক :
‘কালো মেঘের পারা কেশের জালে
চাঁদ পড়ল বোধহয় ধরা…..
তাই তো তোমার মুখটি হল চন্দ্রাননা, শুনতে কি পাও ?’
অমনি অন্য যুবকেরা সমস্বরে :
‘শুনতে কি পাও, শুনতে কি পাও, শুনতে কি পাও, চন্দ্রাননা?
আ রে রে আকাশের চাঁদ রে
রাহুর ভয়ে পালায় দূরে…..
আবার সেই প্রথম পীতবাস গায়ক :
‘তোমার কপোল থেকে কুন্তলভার হঠিয়ে দিয়ে বাতাসপাখি
আঁকছে গালের উপর অরুশ চুম্বনেরই স্পর্ধা নাকি ?’
তখন অন্য যুবকেরা হল্লা করতে করতে গেয়ে উঠল হইহই করে :
‘কাজললতা চোখের পাতায়, নাকের পাটায় ও নাকছাবি,
চুমায় বাতাস, নাকি আমিই?—সেই কথাটাই এখন ভাবি !
আ রে রে চাঁদ কোথায় যাবে ?
(আ রে) কোথায় যাবে, কোথায় যাবে, কোথায় গিয়ে মুখ লুকাবে?’
গান শুনে মুখ টিপে হাসতে হাসতে রসিকা মেয়েটি ভিড়ের মধ্যে মিশে পালিয়ে গিয়ে বাঁচল। কোভালনও এই রঙ্গ দেখে প্রাণভরে হাসছিল খুব। যেন স্বয়ং ঋতুরাজ বসন্ত এই প্রাণবন্ত তরুণ-তরুণীদের রূপ ধরে আজ নগরীর প্রমোদ-কাননে বিহার করে চলেছেন । সারাদিন এইভাবে পথে পথে নানা রঙ্গে ঘুরে ঘুরে কখন যে সন্ধ্যা হয়ে গেল, টের
পেল না কোভালন। সজাগ যখন হল, তখন সন্ধ্যাকাল উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। আনন্দের ক্লান্তি তার সারা শরীরে। ধীরে ধীরে শ্রান্ত পায়ে সে মাধবীগৃহে যাত্রা করল।
মাধবীর কক্ষে উপস্থিত হয়ে দেখল, মাধবী আজ অপরূপ সেজেছে। দুই কর্ণপুটে সুনন্দিনী কর্ণমঞ্জরী আভরণ, নাসাপুটে নীল নাকছাবি। অপরূপ দেহলতা সে সাজিয়েছে কতরকম ফুলের গয়নায়। মুল্লাই ফুল, জুঁই ফুল, মইলাই ফুল, মাধবী ফুল, নীল পদ্ম, নীল অপরাজিতা, রাঙা কালুনির ফুল—কত বর্ণের, কত গন্ধের, কত রুচির পুষ্পাভরণ ! আজ মাধবী বড়ো রূপবতী, পুষ্পবতী। সুছাঁদ কৃষ্ণ কুন্তলে ধূপগন্ধ, বেণীতে যূথিকার মালা। কোমল চরণপল্লব রাঙিয়েছে অলক্তরাগে, পদাঙ্গুলিতে পরেছে উজ্জ্বল আঙটি, গুফে রত্নোজ্জ্বল শিঞ্জিনী। সুনিতম্বিনী মাধবী তার সুবিপুল শ্রোণীদেশে পরেছে সাতনরী চন্দ্রহার, নীলাম্বরে আবৃত করেছে তার হেমবর্ণ তনুরুচি, পুষ্পাভরণে সাজিয়েছে সুন্দর জঘন, মুক্তা-রত্ন-প্রবালরচিত অলংকারে রণিত তার দুটি বাহুলতা।
মাধবীকে দেখে অবাক হয়ে কোভালন বলল, ‘কোথাও কি যাবে তুমি আজ ? ‘
মাধবী মধুক্ষরা স্বরে উত্তর দিল, ‘না। এমনিই সেজেছি। আজ উৎসবের দিন।’
কোভালনের মাথায় দুষ্টুবুদ্ধি চাপল। রগড় জমানোর জন্যে বলল, ‘কেউ তোমার কাছে এসেছিল বুঝি আজ সন্ধ্যাবেলায় ?’
মাধবী ছদ্মবিষাদে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘কেন, আমরা মেয়েরা কি নিজেদের সুখের জন্যে প্রসাধন করতে পারি না? কে আর আসবে আমার কাছে? আমার যে নাগর, তাঁর তো সারাদিনে টিকিটিরও দেখা নেই! কোথায় গিয়েছিলে তুমি ?’
কোভালন অমনি সরল মনে উচ্ছ্বাসভরা স্বরে আজ সারাদিনের উৎসব-আনন্দের কথা বলতে লাগল। কেমন উৎসব চলছে সমস্ত নগরে, কেমন সারা দিনমান পথে পথে ঘুরে সে আনন্দ লুটেছে, এমনকি সেই সব প্রমত্ত যুবকদের রঙ্গরসিকতা অভিনয় করেও সে দেখাতে লাগল, তাদের গান গাইতে লাগল ।
শুনতে শুনতে অর্ধপথেই মাধবী ইচ্ছে করে কোভালনকে রাগিয়ে দেওয়ার জন্য দুই করতলে মুখ ঢেকে বলে উঠল, ‘এ মা ! ছি ছি ! তুমি ওই সব উচ্ছৃঙ্খল লোকেদের সঙ্গে মিশেছ সারাদিন?’
কোভালন সবিস্ময়ে বলল, ‘কেন, তুমি কি ওদের জানো? গিয়েছ কখনও ওদের উৎসবের মেলায়?’
‘যাইনি। তবে শুনেছি, ওরা কী করে।’
কোভালন কৌতূহলভরে হাসতে হাসতে বলল, “বলো তবে শুনি, তুমি কী শুনেছ! মাধবী আড়চোখে কোভালনের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়েই যেন কত গম্ভীর ভাব ধরে বলতে লাগল, ‘প্রমত্ত সব যুবা, এই চওড়া চওড়া কাঁধ, মুখে অশালীন ভাষা, অশ্লীল গান… সুন্দরী মেয়ে দেখলেই তাদের পেনে ছুটে যায়, জোর করে পেছন থেকে সুদৃঢ় বাহুতে জড়িয়ে ধরে। তারপর সামনে ঘুরিয়ে এনে বুকের মধ্যে চেপে ধরে রাখে। মেয়েদের স্তনপট্ট খুলে তাদের বুকের রক্তচন্দনের দাগ নিজেদের বুকে লাগায়। সারাদিন এই সব করে আর বোকা মেয়েগুলো ওদের গান শুনে মোহিত হয়ে যায়। সারারাতের এসব অমিতাচারে মেয়েদের শ্বেতপদ্মের মতন চোখগুলো ভোরে বন্ধুক পুষ্পের মতো লোহিতবর্ণ ধারণ করে। সেই দেখে প্রবীণ লোকেরা আক্ষেপ করে বলে, ইন্দ্রের পূজা দিয়েও যদি আমাদের মেয়েদের চক্ষুরোগ না সারে, তাহলে আর অন্য উপায় কী ? ”
মাধবীর বলার ধরন দেখে কোভালন উচ্চহাসে ফেটে পড়ল। মাধবী কিন্তু তার গম্ভীর ভাব ভাঙল না। ছদ্মগাম্ভীর্য নিয়ে বলতে লাগল, ‘তুমি এইসব যুবকদের সঙ্গে সারাদিন মিশেছ, কোভালন? ছি ছি! তোমার রুচি, তোমার শিল্পরুচির এত অধঃপতন! আমি ভাবতেও পারি না যে, শিল্পী কোভালন, কবি কোভালন, প্রেমিক কোভালন এমন একদল নিম্নরুচির মানুষের সঙ্গে সারাদিনমান কাটাচ্ছে!’
মাধবীর অভিনয় এত নিখুঁত, এমন চোখ ঘুরিয়ে, হাত ঘুরিয়ে সে কথাগুলো বলল যে, কোভালন ভাবল, সত্যিই বুঝি মাধবী তার শিল্পরুচিকে নিম্ন মানের বলে সন্দেহ করছে। কোভালনের মুখ আষাঢ়ের মেঘাচ্ছন্ন আকাশের মতন মলিন হয়ে গেল। সে ভাবছিল, মাধবী তাকে এত ছোটো ভাবল? তার রুচি, অভিপ্রায়কে এত সামান্য মনে করল? সে তো শুধু সরল মনে আজ উৎসবের আনন্দটুকুই নিতে গেছিল। উৎসব-আনন্দে নিমগ্ন যুবারা যে রুচিশীল নয়, সেকথা কি কোভালন জানে না ?
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে কোভালন উঠে দাঁড়াল। নীচু গলায় বলল, ‘আজ তবে আসি?’
কোভালনের মুখভাব দেখে প্রমাদ গণল মাধবী। হায়, কোভালন তার অভিনয় ধরতে
পারেনি! সে তাড়াতাড়ি তার দুই কোমল বাহুলতায় কোভালনের কণ্ঠ জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আসি বললেই হল? আসি বললেই যেতে দিচ্ছে কে? আজ কি সারাদিন আমি এমনি এমনি সেজে রয়েছি?’
কোভালন অভিমানভরে উত্তর দিল, ‘আমি আর রূপ, প্রসাধনকলা—এসবের কী বুঝি? আমার রুচি নিম্ন, আমার অভিপ্রায় অনুন্নত!’
মাধবী অমনি কোভালনের বুকের মধ্যে নিজের বিধুনিভ মুখখানি ঘষতে ঘষতে বলল, ‘তাই? রুচি নিম্ন? অপরিশীলিত? কই, তাহলে তোমার বুকের মধ্যে রক্তচন্দনের দাগ কই? মাধবী ছাড়া আর কাউকে বুকে জড়াতে ভালো লাগে না বুঝি?’ এই বলে মাধবী খিলখিল করে হাসতে লাগল ৷
এবার কোভালন বুঝতে পারল, এতক্ষণ মাধবী অভিনয় করছিল। তার পূর্বকৃত ভাবভঙ্গিমা মনে করে সেও মাধবীর সঙ্গে খুব হাসতে লাগল ।
কিছু পরে মাধবী বলল, ‘এমন উৎসবের রাত্রি ! আমরা কি সারারাত এই বদ্ধ ঘরের মধ্যে বসে থাকব? আজ আকাশে গোল থালার মতো চাঁদ উঠেছে। চলো, আমরা কোনো নির্জন সৈকতে যাই। বীণাখানি সঙ্গে নিয়ে যাব। সেখানে চাঁদের আলোর নীচে সমুদ্রের গর্জনের মধ্যে বসে তোমার কবিতা শুনব, গান শুনব। তোমাকে গান শোনাব । যাবে?’
সমুদ্রতটে যেন আজ রাত্রে আলোর মেলা বসেছে। শুধু সমুদ্রতটই নয়, তটে উপনীত হওয়ার পন্থাটিও সমানভাবে আজ আলোকিত। রাজমার্গ যেন নিজের দুপাশে প্রাসাদের পর প্রাসাদ সাজাতে সাজাতে চলেছে—সেসব প্রাসাদসৌধসমূহের প্রাকার, তোরণ, বলভী, দেহলী, ছাদ, আলিশায়, চূড়ায় আজ কত যে আলোর আলপনা! সুদৃশ্য প্ৰদীপ জ্বলছে গৃহের অঙ্গনে ভাস্বর শিখায়, প্রদীপগুলি সমস্ত ফুলের মালা দিয়ে সাজানো। মেয়েরা উঠোনে ছড়াচ্ছে ধান, পুষ্পরেণু আর মাঙ্গলিক অরুগু তৃণ। প্রদীপের চকিত আলোয় তাদের কঙ্কণ, নূপুর, কেয়ূর সব ঝকমক করে উঠছে মাঝে মাঝেই।
কিছুদূর এইভাবে যাওয়ার পরে পথটা হঠাৎ যেন দুপাশের হর্ম্যশ্রেণীকে ছুটি দিয়ে একা নিরালা হয়ে গেল। এখান থেকে পথ চলেছে নিভৃতে সৈকতের দিকে। সৈকতে আবার অন্য ধরনের আলোর মালা। যেন আজ রাতে গন্ধর্বলোকের সব রহস্যময়ী অপ্সরারা সমুদ্রবেলায় নেমে এসে চোখ টিপে হাসছে, দীপগুলি সেই সব অপ্সরাদের চোখ-টেপা হাসি। পসারিরা কুপি জ্বালিয়ে, পসরা সাজিয়ে বসেছে রাতের সমুদ্রতীরে এখানে ওখানে । রঞ্জক, চন্দন, ফুল, সুগন্ধি, মেঠাই, পিষ্টক, অলংকার বিক্রি হচ্ছে। এখান থেকে চোখ তুলে দূরের পানে রাখলে দেখা যায়, সামুদ্রিক মাছের সন্ধানে ভ্রাম্যমাণ ছোটো ছোটো নাওয়ের আলো আলেয়ার মতো কাঁপছে, অন্ধকার সমুদ্রের জল যেখানে জ্যোৎস্নাধোয়া অস্পষ্ট আকাশের সঙ্গে মিশেছে, সেই সুদূরে অবলীন দিগন্তরেখায়। কোথাও গগনচুম্বী বাতিঘর আলো ছড়াচ্ছে সাগরের জলের ওপর অনেক দূর অবধি । পৃথিবীর অন্য দিগন্ত থেকে যেসব জাহাজ বাণিজ্যের সন্ধানে জম্বুদ্বীপের এই পুষ্পহার নগরীতে এসে ভিড়বে, অন্ধকারে তাদের পথনির্দেশ করে চলেছে ওই আলোর ময়ুখ।*
সমুদ্রতীরে মধ্যে মধ্যে দৃষ্টিনন্দন ছাউনি সব; সেসব ছাউনির ভিতর থেকে গান, আলাপ কিংবা হাসিহল্লার শব্দ নিঃসৃত হচ্ছে। এসব ছাউনিতে যারা থাকে, তাদের পোশাক, তাদের ভাষা সবই বিচিত্র। এদেশীয় নয় তারা, প্রায়শই গ্রিক, রোমক, মিশরীয় অথবা মুর—দুর্বোধ্য ভাষায় কথা বলে উঠছে যেন তারা স্বপ্ন দেখতে দেখতে ছাউনির ভিতর।
কোথাও-বা দেশীয় রাজপুত্রেরা, শ্রেষ্ঠীতনয়েরা সঙ্গীসাথী নিয়ে এসেছে আজ রাতে প্রমোদবিলাসে। যবনিকার আড়াল থেকে ভেসে আসছে তাদের গানের সুর, নাচের বোল, হাসির হররা আর ঘুঙুরের আওয়াজ ।
এসবের মধ্য দিয়ে যেন স্বপ্নচালিত হয়ে মাধবী, কোভালন ও মাধবীর জনৈক পরিচারিকা বসন্তমালা বীণা হাতে হেঁটে যাচ্ছিল। কিছু দূর যাওয়ার পর মানুষের ভিড় আর ছাউনির সারি শেষ হয়ে গেল। এখন শুধু নক্ষত্রদীপিত রাত্রি আর নিঃশব্দ বালুচর। যোজনের পর যোজন বিস্তারিত বালির উপর জ্যোৎস্না-বিরহিণী নারীর গালের উপর বিশুষ্ক অশ্রুলেখার মতো চিকচিক করছে। আরও কিছু পরে কতগুলো বৃহদায়তন বাণিজ্যপোতের উঁচু উঁচু মাস্তুল দেখা গেল। কী জানি কোন ভিনদেশের জাহাজ সব বালির উপর দীর্ঘ গম্ভীর ছায়া ফেলে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সমস্ত স্থানটি যেন চন্দ্রাতুর, জ্যোৎস্নাবিষ্ট, নিঃশব্দ। জাহাজের ছায়া সব পেরিয়ে নির্জন সমুদ্রসৈকতে একটি পুন্নাই গাছের কাছে এসে ওরা স্থির করল, এবার এইখানে বসবে।
পথশ্রান্ত বসন্তমালার হাত থেকে বীণাখানি নিজ হাতে তুলে নিল মাধবী। বালির উপর শ্বেতবস্ত্রের শয্যা পাতল বসন্তমালা সেই পুন্নাই গাছের তলায়। সুকোমল শয্যার উপর গাছের ছায়া পড়েছে। সেই ছায়া-আঁধারের মধ্যে কোভালন আর মাধবী নিঃশব্দে মুখোমুখি বসল। ওদের মাঝখানে শায়িত নীরব বীণা। মাধবী আর কোভালনকে একা হতে দিয়ে দূরে সরে গেল বসন্তমালা। স্বামিনী মাধবী ও তার প্রেমিক পুরুষের প্রমোদের প্রহর থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে দূরে কোথাও কোনো চন্দ্রাহত বালুচরের উপর বসে সে হয়তো এখন একান্তে বসে ভাববে তার জীবনের মানে ।
পুন্নাই বৃক্ষের ছায়ার ভিতর কিছুক্ষণ ঘন নিঃশ্বাসের শব্দ ছাড়া অন্য আর কোনো শব্দ নেই, হয়তো শুধু চকিত স্পর্শ, হয়তো শুধুই দৃষ্টিবিনিময়। স্তব্ধতা যেন ধীরে ধীরে বাঙ্ময় হয়ে উঠছে। কিছুক্ষণ পরে মাধবী যুক্তকরে দেবী সরস্বতীকে প্রণাম জানিয়ে বীণার সূচীকর্ম-মণ্ডিত আবরণটি সরিয়ে একপাশে রাখল। বড়ো নিখুঁত বীণাটির গঠন; একদা এই বীণাই বাজাত নটী ইন্দুমুখী। ফুলের মালা দিয়ে সাজানো সেই বীণাখানি যেন কাজলনয়না কোনো কনে বউ। বীণা সযত্নে ঠিক সুরে বাঁধতে লাগল মাধবী, তারের কাছে সতর্ক কান পেতে। তার পদ্মরাগমণির আঙটিতে সাজানো দশ আঙুল বীণার তারে যেন এক ঝাঁক গুঞ্জরিত মধুকরীর মতন ওঠানামা করছিল। সুর বাঁধা শেষ হলে কোভালনের হাতে বীণাটি তুলে দিল মাধবী। স্মিত হেসে বলল, ‘আমার হৃদয়বীণা আজ সন্ধে থেকে তো অনেকক্ষণ ধরেই বাজিয়েছ তুমি, প্রিয় বাদক। এবার এই বীণা বাজাও। আজ আমি প্রথমে তোমার গান শুনব।’
কোভালন চটুল হেসে উঠে বলল, ‘অয়ি বাপটিয়সী নারী ! আমি তো আর তোমার মতো গাইতে পারি না। খুব পুরোনো একটা গান মনে আসছে। প্রাচীন কোনো অজ্ঞাতনামা কবির লেখা । জানি না, এ তোমার ভালো লাগবে কি না!’ এই বলে ধীরে ধীরে কোভালন গাইতে আরম্ভ করল—
‘কাবেরী, তোমার জয় হোক !
তোমার ভারতজয়ী অধিপতি চোলরাজ, যাঁর ভয়ে কাঁপিছে ত্রিলোক।
শ্বেতচ্ছত্র তাঁর অধিকার বিস্তারি দিকে দিকে আনে ন্যায়ালোক।
কাবেরী, তোমার জয় হোক !
বিজয়পথের পাশে রাজা যদি ভালোবাসে,
গঙ্গাকে পেয়ে যদি নৃপতির ভরে হৃদি,
তবু তুমি করিও না শোক।
কাবেরী, তোমার জয় হোক!
অন্য নারীর প্রতি পতি যদি হয় প্রীত,
তাতে সতী কভু কি গো হয় মনে বিচলিত ?
কন্যাকুমারী যদি হয় রাজ-পরিণীত,
যদি গায় নৃপতির মহিমার জয়গীত,
তবু তুমি করিও না শোক !
সতী কাবেরীর জয় হোক !”
উদাত্ত স্বরে গাইছিল কোভালন। তার কণ্ঠস্বর মাঝে মাঝে মিশে যাচ্ছিল সমুদ্রবাতাসের সঙ্গে। গান শেষ হতেই আবার ঝুপ করে নীরবতা নেমে এল পুন্নাই গাছের তলায় । মাধবী চুপ করে বসে কীসব ভাবছে দেখে কোভালন বলল, ‘ভালো লাগল না তোমার এ গান ?’
চিন্তামগ্নভাবে মাথা নেড়ে উত্তর দিল মাধবী, ‘না, তা নয়। সুর তো খুবই সুন্দর। আর তোমার গলাও আজ বেশ ভালো আছে। কিন্তু আমি ভাবছি অন্য কথা ।
‘কী? ‘
‘গানের কথাগুলো আমাকে বেশ ভাবাচ্ছে। ভালো লাগেনি কথাগুলো।’
‘কেন বলো তো?’
‘দ্যাখো, কাবেরী, গঙ্গা—এসব আমাদের দেশের বড়ো পবিত্র নদী। আমাদের চোখে এরা যেন ঠিক নদীও নয়। এরা যেন স্বর্গচতা দেবী। অথচ এই গানে চোলরাজকে কাবেরীর স্বামী হিসেবে কল্পনা করা হয়েছে। গঙ্গা যেন রাজার উপপত্নী। কন্যাকুমারী কত পবিত্র প্রাচীন তীর্থ। সেই তীর্থের সঙ্গে রাজার পরিণয় কল্পনা করা হয়েছে। এ আমার ভালো লাগেনি। রাজা তাঁর রাজকীয় ক্ষমতায় গাঙ্গেয় উপত্যকার কয়েকটি দেশ অধিকার করে নিয়েছেন বলেই তিনি গঙ্গা নদীর স্বামী হয়ে গেছেন? কিংবা কাবেরীর তীরবর্তী এই পুষ্পহারের অধিপতি বলেই তিনি কাবেরী নদীর স্বামী? এসব অত্যন্ত বাড়াবাড়ি। হয়তো কোনো নির্লজ্জ স্তাবক কবি রাজাকে খুশি করতে এমন গান লিখেছিলেন অতীতে।’
কোভালন তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ‘আরে, এ তো কবিতা। কবিতায় অতিশয়োক্তি অলংকার থাকবে না ?’
মাধবী বলল, ‘তবে কি তুমি বলতে চাও, কবিতার অতিশয়োক্তি বাস্তব সত্যকেও অতিক্রম করে যেতে পারে ?’
কোভালন কী একটা ভাবনার মধ্যে গিয়ে পড়ল যেন! অন্যমনস্ক হয়ে মাথা নেড়ে বলল, ‘না, তা নয়। তবু…’
মাধবী বলল, ‘আচ্ছা ধরো, ওকথা না হয় ছেড়েই দিলাম। কিন্তু এই গানে মূল কথাটা কী বলা হচ্ছে? রাজা যদি অন্য নারীতে আসক্তও হন, কিংবা যদি অন্য কোনো নারীকে বিবাহও করেন, তাহলেও হে কাবেরী, তুমি মন খারাপ কোরো না। তুমি বিচলিত হয়ো না। কেন? কেননা, তুমি হচ্ছ সতী স্ত্রী। স্বামী অন্য নারীতে আসক্ত হলেও সতী স্ত্রীলোকের মন খারাপ করা চলবে না। এ কেমন অবিচার ?’
‘অবিচার? কেন?’কোভালন প্রশ্ন করল।
‘কী আশ্চর্য! বুঝতে পারছ না? নাকি বুঝতে চাইছ না ? স্বামীর যা খুশি করার স্বাধীনতা থাকছে, অথচ অন্যদিকে স্বামীর সেই দ্বিচারিতার কারণে স্ত্রীর মন খারাপ করারও অধিকার থাকছে না! বলা হচ্ছে, স্ত্রী যেন সতীলক্ষ্মী হয়ে ঘরে বসে থাকে, স্বামী দ্বিচারী হলেও স্বামীর থেকে মন যেন সে না তুলে নেয়, তা নিয়ে যেন মন খারাপ না করে। এককথায় স্ত্রী যেন অবিচলিত পতিনিষ্ঠা বজায় রাখে । তাহলে স্বামীরই বা কোন অধিকার ছিল অন্য নারীর কাছে গিয়ে স্ত্রীর মন ভেঙে দেওয়ার?’মাধবীর কণ্ঠস্বরে উত্তেজনার আভাস দেখা দিল।
কিন্তু তার কথার কোনো উত্তর দিল না কোভালন । সে চুপ করে বসে রইল। আসলে এ মুহূর্তে সে প্রচুর ধন্দের মধ্যে পড়ে যাচ্ছে। একটা কথা সে আজ মাধবীর কাছ থেকে প্রথম থেকেই গোপন করে গেছে। মাধবীকে সে বলেছে, গানটা খুব প্রাচীন কোনো অজ্ঞাতনামা কবির লেখা। কিন্তু তা একেবারেই সত্যি নয়। আসল সত্যটা এই যে, এ গান কোভালনই লিখেছে সম্প্রতি। প্রাচীন কবিদের শৈলীতে কথাগুলো লিখে সে পুরোনো গানের সুরে বসিয়েছে। গানটা তো আসলে তার নিজেরই লেখা !
কিন্তু এ গানের প্রকৃত রচয়িতা কে, সেকথা না জেনেও মাধবী এ মুহূর্তে এমন কতগুলো প্রশ্ন তুলল, যাতে সেই প্রশ্নগুলোর তীক্ষ্ণ সূচীমুখ কোভালনের হৃদয়কে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিচ্ছে। কোভালন বসে বসে ভাবছিল, তাহলে কি সে এই রচনার মধ্যে কোথাও একটা আত্মপক্ষ সমর্থন করার চেষ্টা করেছে? কাবেরী নয়, কন্নকীর উদ্দেশেই সে এই কথাগুলো লিখেছে? মাধবীর সঙ্গে তার যে সম্পর্ক হয়েছে, তাতে কি সে ভেতরে ভেতরে অনুতপ্ত, অপরাধবোধগ্রস্ত? এবং তার পরেও সে কি চাইছে যে, সে নিজে যাই করুক, যত স্বেচ্ছাচারিতাই করুক, কন্নকী যেন অবিচলিত চিত্তে তার জন্যেই সতীত্বের পরাকাষ্ঠা হয়ে বসে থাকে? এ গীতিকাব্যের চোলরাজ কারিক্কাল কি আসলে সে নিজেই? গঙ্গা বা কন্যাকুমারী আসলে মাধবীরই প্রতীক? কাবেরী আসলে কাবেরী নয়, কাবেরী আসলে কন্নকী ?
কোভালনের সন্দেহ হতে লাগল, মাধবী মিথ্যেটা ধরতে পেরে যায়নি তো ? মাধবী কি বুঝে গেছে, এ কবিতা আসলে কোভালনের দ্বারাই রচিত? সেই জন্যেই মাধবী এতটা প্রতিবাদ করল? হঠাৎ একবার মনে হল কোভালনের, ও! তাহলে কি এখন মাধবীর কাছ থেকে তাকে পত্নীনিষ্ঠার পাঠ নিতে হবে ?
আবার মনে হল, নাহ্, মাধবী হয়তো এ কবিতা যে কোভালনেরই লেখা, সেই নিগূঢ় সত্যটি আঁচ করতে পারেনি। ও হয়তো এমনিই কবিতার সমালোচনা করছে। কবিতার সমালোচনা করছে, কোভালনের নয়। এমনভাবে মনকে প্রবোধ দিলেও ভেতরে ভেতরে সে খুবই অপ্রসন্ন হয়ে উঠতে লাগল মাধবীর প্রতি। যেন একটা তীব্র বিষের জ্বালা তার বুকের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। কিন্তু তার মনের সেই ভাব সে বাইরে প্রকাশ করল না।
কোভালনের স্তব্ধতা অবলোকন করে তার কাছ থেকে বীণাটি এবার নিজের কাছে টেনে নিল মাধবী। চম্পক-অঙ্গুলি বীণার তারে কিছুক্ষণ চালনা করতে লাগল গুনগুন করতে করতে । কোভালন চিন্তামগ্নতা থেকে জেগে উঠল তার সেই সুরের স্পর্শে। মুখ তুলে শুষ্ক স্বরে বলল কোভালন, ‘তুমি কিছু গাও, শুনি !’
আরও কিছুক্ষণ গুনগুন করে মাধবী গাইতে আরম্ভ করল—
‘কেমন করে জানব বলো সেই প্রেমিকের মন
(যার) কথা দিয়ে কথার খেলাপ সমস্ত জীবন?
সাগরতটে হাতের উপর রাখলে তুমি হাত,
কথায় কথায় ফুরিয়ে এল প্রহরজোড়া রাত।
সকাল হলেই এসব কথার ফুরিয়ে যাবে দাম,
ফুরায় খেলা, ফুরায় বেলা, জুড়ায় নাকো কাম।’
যেন গানটা শুনতে শুনতে আবার মস্তিষ্ক উত্তপ্ত হয়ে উঠতে লাগল কোভালনের। এসব কী গান আজ গাইছে মাধবী? এই স্তব্ধ নিশীথে উৎসবের অবসরে মাধবী কি তবে তাকে টেনে এনেছে এখানে এই সব শোনানোর জন্যেই? এমন কিছু মনে করানোর জন্যে, যা কোভালন ভুলে গেছে? এ তো তার পূর্বপরিচিতা মাধবী নয়, এ যেন অন্য কেউ, অপরিচিত কোনো ঘাতক।
গান শেষ হতেই ঈষৎ উষ্মাপূর্ণ কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল কোভালন, ‘কী হয়েছে তোমার আজ মাধবী? তোমাকে কোন কথা দিয়ে কথার খেলাপ করেছি আমি? তুমি কী বলতে চাইছ এই গানের মধ্যে ?’
কোভালনের উত্তেজনায় মাধবী অত্যন্ত অবাক হল । বলল, ‘কী আশ্চর্য! তোমাকে কোথায় কী বললাম ? এ তো একটা কবিতা, এ একটা গান। আর কিছুই নয়। এই রচনায় তুমি আসছ কোথা থেকে ? আমি মাধবীই-বা এলাম কোথা থেকে এ গীতল কবিতায় ?’
কোভালন নিজেকে সামান্য সংযত করে নিয়ে বলল, ‘ও আচ্ছা ! তাহলে এ কবিতায় কার বেদনা তুমি গাইলে এতক্ষণ ?’
এই প্রশ্নের সামনে অল্পক্ষণ নিরুত্তর হয়ে রইল মাধবী। তারপর নিজের ভিতরে তলিয়ে গিয়ে আত্মগত স্বরে বলতে লাগল, ‘বিশেষ কোনো একটি মেয়ের কথা আমি বলতে চাইনি এখানে । আমাদের পুষ্পহার নগরীর সব হতভাগিনী মেয়েদের কথাই বলতে চেয়েছি, যারা বিশ্বাস করে ঠকে যায়, যাদের সারল্য প্রতিদিন ব্যবহৃত হতে থাকে চতুর পুরুষদের হাতে। পুষ্পহারের বাইরে তো আমি যাইনি কখনও, তাই অন্যান্য স্থানের মেয়েদের ক্ষেত্রেও এমনই হয় কি না, জানি না। কিন্তু পুষ্পহার নগরীর মেয়েরা বড়ো অভাগিনী !
‘কেন এমন বলছ তুমি?’ কোভালন সন্দিগ্ধ স্বরে প্রশ্ন করল।
তপ্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলল মাধবী। তারপর বলতে লাগল, ‘আমরা পুষ্পহারের মেয়ে। আমাদের এখানে সকালবেলা হ্রদে তড়াগে পদ্মকলির ঘুম ভাঙে সতীর কপালের সিন্দূরকে সূর্য আর নটীর গলার মুক্তাকে শুকতারা বলে ভুল করে। এখানে আমাদের মেয়েদের নীলাভ নয়নকে নীলপদ্ম ভেবে ভুল করে গৃহস্থ ভ্রমর বিবাগী হয়ে যায়। আমরা এত সুন্দর, এই কি আমাদের দোষ? এই কি আমাদের পাপ? জীবনের এই সমুদ্রতটে তাই কি আমাদের সঙ্গে দেখা হয় সেই সব পুরুষের, যারা প্রথমে উপঢৌকন হাতে নিয়ে আমাদের সামনে উপস্থিত হয়, তারপরে হঠাৎ একদিন অপরিচিতের মতো আচরণ করতে শুরু করে, যাতে আমরা তাদের পেছনে পেছনে যাই, যাতে আমরা তাদের পেছনে পেছনে ভালোবাসা ভিক্ষা করে ফিরি অনুক্ষণ!’
কোন বেদনা আজ ভর করেছে মাধবীর মধ্যে, ভাবছিল কোভালন। কোভালনের সংসর্গে কী সে পাচ্ছে না? কোন অভাব তার পূরণ করতে পারছে না কিছুতেই কোভালন শরীর দিয়ে, মন দিয়ে ? আচ্ছা, মাধবী কি তার নিজের কথা বলছে, নাকি অন্য কারও কথা? তবে কি মাধবী কোভালন ছাড়া অন্য কোনো পুরুষকে সঙ্গোপনে ভালোবেসেছে, তারপর সম্প্রতি আঘাত পেয়েছে? যেসব কথা কোভালন জানে না? নাকি মাধবী কন্নকীর বেদনার কথা জানতে পেরেছে লোকমুখে? কন্নকীই কি কথা বলছে আজ এই মধ্যরাতে মাধবীর কণ্ঠকে আশ্রয় করে?
কোভালনের ভাবনার মধ্যেই মাধবী বলে যেতে লাগল, ‘আমরা এই পুষ্পহার নগরীর মেয়েরা কী নির্বোধ! জীবনের এই বেলাভূমিতে আমাদের স্বপ্নের বালি দিয়ে বানানো প্রাসাদ বারবার ভেঙে দিয়ে চলে যায় সমুদ্রের ঢেউ, বিলাসী পুরুষের আকস্মিক প্রত্যাখানের মতো। আমাদের প্রেমিক পুরুষেরা একদিন প্রেমভরে আমাদের গলায় যে-কুসুমহার পরিয়েছিল, তার পাপড়িগুলি আমরা সেই প্রত্যাখানের পর ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ছড়িয়ে দিই এই লবণাম্বুধৌত সৈকতে। ভাঙা বালির প্রাসাদের উপর তখন সেই ছিন্নভিন্ন পাপড়িগুলো দেখে পথিকেরা ভাবে যেন অজস্র মেয়েমানুষের স্বপ্নভাঙা চোখ তাদের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে রয়েছে।”
কোভালনের মনে হল, মাধবীকে আর নেওয়া যাচ্ছে না। তার কথাগুলো তির হয়ে যেন কোভালনের বুকের মধ্যে বিঁধছে। এ কি শব্দ, নাকি বিষাক্ত শায়ক? ওর প্রত্যেকটা কথা নির্ভুলভাবে কোভালনের বুকে এসে বিঁধছে। এমন হতে পারে, এই পুষ্পহারেরই কোনো নাগরিক কন্নকীর কথা, তাদের সংসারের অশান্তির কথা মাধবীর কাছে গিয়ে বলেছে, হয়তো কোভালন-কন্নকীর ঘর ভাঙার জন্য মাধবীর উপর দোষারোপও করেছে। সেসব কথায় আহত হয়ে মাধবী এখন তার বিষ উগরে দিচ্ছে। অথবা এমনও হতে পারে, অন্য কোনো ব্যক্তি গোপনে মাধবীর কাছে যাতায়াত করছে, যার কথা কোভালন জানে না। সেই ব্যক্তি হয়তো বলিষ্ঠ কোনো যুবক, সে হয়তো মাধবীকে খুব তৃপ্ত করেছে, মাধবীকে ভোগ করেছে গোপনে। তারপর শরীরের খেলা শেষ হলে সেই অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তি হয়তো মাধবীকে ঠকিয়েছে, ছেড়ে চলে গেছে। এসব হয়তো কিছুই জানতে পারেনি কোভালন এতদিন। তা না হলে প্রত্যাখাত মেয়েদের বেদনা আজ এই মধুযামিনীতে মাধবী কেন তার গানে প্রকাশ করতে গেল? কেন সেই অতলান্ত বেদনাকে সে বারবার রূপ দিচ্ছে তার মর্মভেদী কথায়? এসব নানা চিন্তা, নানা উদ্বেগ, নানা সম্ভব-অসম্ভব সন্দেহ কোভালনের মনে উঠতে লাগল। সংশয়ের বিষে যেন জ্বলে যেতে লাগল কোভালনের শরীর, মন মাধবীকে দেখে তার মনে হতে লাগল, আজ রাতে মাধবী যেন কোনো কবি নয়, শিল্পী নয়, নারী নয়। মাধবী যেন সেই ছদ্মবেশী নির্মম মৃত্যু, কোনো মৎস্যশিকারী জেলের মেয়ের রূপ ধরে মৃত্যু আজ এসে বসেছে কোভালনের মুখোমুখি। শাণিত শব্দের চাবুকে মাধবী যেন কোভালনের মনের সমস্ত আঁশ নির্মমভাবে ছাড়িয়ে নিচ্ছে। সেই যন্ত্ৰণা থেকে বুঝি মুক্তি পাওয়ার জন্যেই তীব্র বিদ্রূপের হাসি হেসে বলে উঠল কোভালন, ‘তোমাকে আজ তোমার লেখা সেই কবিতাটাই শোনাতে ইচ্ছে হচ্ছে, মাধবী। সেই যে তুমি লিখেছিলে…..
চোখের পাতার মতো নিমীলিত ওইখানে জেলেদের ঘর—
সমুদ্রতীরের রোদে শুষ্ক যেথা হয় রোজ জালের পিঞ্জর।
লবণাক্ত ঢেউ ভাঙে আলোড়িত বালুকাবেলায়,
ওইখানে মৃত্যু এসে বসে আছে যুবতীর রূপে আজ দু-পহরে ভরা অবেলায়।
…আমার এ মুহূর্তে মনে হচ্ছে, তুমি মাধবী—হ্যাঁ, তুমি, তুমিই সেই মৃত্যুরূপিণী !
আমাকে ক্ষতবিক্ষত করবার জন্যেই তুমি এসব কথা বলে চলেছ, না?’
গভীর আহত হয়ে বলে উঠল মাধবী, ‘ও! আমাকে তোমার এখন মৃত্যু বলে মনে হচ্ছে? এই অর্থে তো লিখিনি আমি কবিতাটা।’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, তাই মনে হচ্ছে,’বেপরোয়াভাবে বলতে লাগল কোভালন, ‘হ্যাঁ, তাই। আমি তোমার ভালোবাসাকে ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছি? নাকি তুমিই আজ এই রাত্রে পুন্নাই গাছের তলায় বসে আমার সুকোমল ভালোবাসার পুষ্পহারকে নির্মমভাবে কুটিকুটি করে ছিঁড়ে এই অন্ধকার সমুদ্রতটের উপর ছড়িয়ে দিচ্ছ? তুমিই তো আমার মৃত্যু। তোমার সঙ্গে দেখা হওয়ার আগে আমি আমার স্ত্রী কন্নকীকে নিয়ে জীবিত ছিলাম। তুমিই তো মৃত্যু—তোমার এই উত্তুঙ্গ চন্দ্রনিভ স্তন, তোমার এই শায়কের মতো তীক্ষ্ণ রক্তাভ নয়ন, তোমার এই বাঁকা ধনুকের মতো বিধ্বংসী ভ্রূলতা, বিদ্যুতের মতো তোমার সূক্ষ্ম ত্বরিত কটিদেশ, তোমার এই সুগন্ধিত কেশপাশ, এই শফরীর মতো চঞ্চল দৃষ্টি—এই তো আমাকে হত্যা করেছে রোজ! আর এইভাবে হত্যা করার পর ঘাতিকা তুমি আমাকে আজ বলতে এসেছ, কেন আমি কন্নকীর ভালোবাসাকে উপেক্ষা করে, তাকে দুঃখ দিয়ে তোমার কাছে এসেছি?’ কোভালনের কণ্ঠস্বর অত্যন্ত উত্তেজিত, অসুস্থ শোনাল।
বিস্ময়ে বিহ্বল মাধবী বলে উঠল, ‘তুমি ভুল করছ, কোভালন। ভুল বুঝছ। তুমি আমার কবিতাকে, আমার কথাকে ব্যক্তিগত অর্থে নিচ্ছ কেন? তোমাদের পারিবারিক সুখদুঃখের ভিতর আমি সামান্যা নটী মাধবী অনুপ্রবেশ করব—এমন কোনো দুঃসাহসিক অভিপ্রায় আমার ছিল না। তুমি কল্পনায় আমার বক্তব্যের উপর তোমার নিজের ধারণা আরোপ করে চলেছ। আমি এক অতি সাধারণ নৈর্ব্যক্তিক সত্য উচ্চারণ করতে চেয়েছিলাম।’
একথার উত্তরে কোভালন কিছু বলল না। কিন্তু আলোছায়ার ভিতর তার বিষণ্ণ মুখ, মনে হল, সে মাধবীর একটি কথাও আর বিশ্বাস করতে পারছে না। বহুক্ষণ চুপ করে থেকে যেন আপনমনে সে বলল, ‘কল্পনার বাইরে কি আছে ভাববার মতো এই জীবনে? সবই কি কোনো-না-কোনোভাবে স্বপ্ন নয়? আমি, তুমি, কন্নকী, বসন্তমালা, এই রাত্রি, দূরের ওই সমুদ্র—সবই কি আমাদের স্বপ্ন নয়? তবু বারবার সেই সুখস্বপ্ন ভেঙে কেন দেখা দেয় বাস্তবের অরুন্তুদ মুখ? অথবা সেই বাস্তব—সেও কি তবে অন্য কারও স্বপ্ন?’
এই কথা বলতে বলতে সে যেন হারানো কোনো সুরের মধুমতী জলে নামল। বড়ো বিষণ্ণ সুরে সে গুনগুন করে কী যেন গাইছিল আপনমনে। ধীরে ধীরে সেই গানের কথাগুলো শ্রাব্য হয়ে উঠল। মাধবী শুনতে পেল, কোভালন গাইছে :
‘ধীবরের কন্যা, তোর পরিবার প্রিয়জন গেছে দূরে সমুদ্রের জলে রুপালি মাছের দেশে শিকারীর বেশে তারা তুচ্ছ প্রাণ হত্যা করে চলে । তুই ধীবরের মেয়ে রূপের বিজুরি হেনে ঢুকেছিস চোখের ভিতরে, আমাকে অন্ধ করে কী সুখ যে পাস তুই মৃত্যু দিয়ে গড়া দেহঘরে ? হেমলতা, ক্ষীণকটি ভাঙে বুঝি সুবিপুল স্তব্ধ তোর ওই স্তনভরে!
ধীবরের কন্যা, তোর মৎস্যনিষাদ পিতা গেছে দূরে সমুদ্রের জলে রুপালি মাছেরা তার জালে রুদ্ধ শ্বাসবায়ু, জানে শেষে মৃত্যু কাকে বলে। তুই ধীবরের মেয়ে ঠোঁটে ঠোঁট রেখে গাঢ়, বেঁধেছিস কোন শ্বাসাঘাতে ? আমার সমুহ আয়ু শুষে নিয়ে তৃপ্ত হলি আজ বুঝি সাগরবেলাতে ? ক্ষীণকটি তোর যেন ভাঙে না ও কুচযুগ মুক্তাহারে সাজাতে সাজাতে !
ধীবরের কন্যা, তোর ডিঙি বেয়ে গেছে ভ্রাতা অতি দূরে সমুদ্রের জলে,
রুপালি মাছেরা তার দাঁড়ের আঘাতে মরে, মৃত স্বপ্ন ভাসে জলতলে।
তুই ধীবরের বোন ভুরুর বাঁকানো তরী বেয়ে এলি বল কোন আশে ? আমাকে বাহুর ঘেরে বেঁধে নিয়ে যাবি তুই কোন মুগ্ধ মৃত্যুর সকাশে? মূর্ছা না যায় যেন ক্ষীণকটি তোর ওই মেরুনিভ বক্ষোজ-বিলাসে!’
যেন সহসাই সমস্ত চুরমার হয়ে গেছে কোভালনের। যেন কোনো অতর্কিত মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে সে কথাগুলো বলছে। চলে যাওয়ার আগে তার অন্তিম হাহাকারের মধ্যেও যেন সে উচ্চারণ করে চলেছে আশীর্বচন—মাধবীর রূপ, মাধবীর ওই প্রাণঘাতী রূপ যেন চিরস্থায়ী হয়, অক্ষয় হয়। চিরকাল সম্মোহক, চিরবিভ্রম হয়ে থাকে যেন মাধবীর অপার্থিব রূপ। সেই রূপে যেন কোনো রূঢ় বাস্তবতা কোনোদিন হাত রাখতে না পারে!
নিঃশব্দে কাঁদছিল মাধবী। সে ভাবতে পারেনি, আজকের আনন্দসন্ধ্যার সহসা এমন করুণ পরিণতি হবে। কোভালনকে বিদ্ধ করবার জন্য সত্যিই কোনো কথা সে বলেনি। সে অন্য কথা বলতে চেয়েছিল, অন্য প্রসঙ্গ। কিন্তু সেসব কথা খুলে বলবার আগেই কোভালন তার স্বভাবজ কল্পনাপ্রবণতায় তার প্রত্যেকটি কথার ব্যক্তিগত অর্থ করেছে। মাধবী বুঝতে পারছিল, কোভালনের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর থেকে আজকের এই রাত্রি অবধি যে-স্বপ্নভুবন তারা দুজনে রচনা করেছিল, সহসা অদৃষ্টের আঘাতে আজ তা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেছে।
কোভালন তার উত্তরীয়ের প্রান্তে মাধবীর অশ্রু মুছিয়ে দিতে দিতে যেন নিজেকে সম্বোধন করে বলতে লাগল, ‘রে বিমূঢ় মরাল! থেকো না থেকো না এই রাজহংসীর কাছে। তুমি এর সঙ্গে ডানা মিলিয়ে ভেসে যেতে পারবে না জীবনের জলে। রে মোহান্ধ মরাল! থেকো না থেকো না এই রূপসী মরালীর কাছে। তোমাকে পরিত্যাগ করে সে অবলীলায় ভেসে চলে যাবে ফেনিল নীলাভ সমুদ্রের ঢেউ ভেঙে কোনো সুদূর দিগন্তে। এর কাছে থেকো না থেকো না তুমি আর !’
প্রিয় পুরুষের স্পর্শে বিহ্বল মাধবী অঝোর ধারায় কাঁদতে কাঁদতে কখন যেন অজান্তে গভীর আলিঙ্গনে বুকে জড়িয়ে ধরেছিল কোভালনকে। কিন্তু সম্বিৎ ফিরতেই নিজেকে সে ছাড়িয়ে নিল কোভালনের আশ্লেষ থেকে। কোভালনের দিকে তর্জনী তুলে অশ্রুপরিপ্লুত অভিমানভরা কণ্ঠে সে কোভালনের কথাগুলোরই জবাব ফিরিয়ে দিল, ‘রে বিমুগ্ধ মরাল ! যাও, চলে যাও এই তটভূমি থেকে। কাছে এসো না আর। দূরে থাকো, সুখে থাকো মাধবীকে ছেড়ে। যে-যন্ত্রণায় মথিত হচ্ছে আমার হৃদয়, তার কিছুই তুমি বোঝোনি । কোনোদিন বোঝোনি, কোনোদিন বুঝতে চাইবে না। চলে যাও স্বপ্নের এই উদ্যান থেকে বহু দূরে। যদি জানতে, কোন কষ্ট থেকে আমি—’
মাধবীর কথা শেষ হল না, তার আগেই কোভালন পুন্নাই গাছের তলায় পাতা সেই শুভ্র শয্যা থেকে নিঃশব্দে উঠে দাঁড়াল। আর একটি কথাও না বলে সে নেমে এল বালিতে। আর তার পরেই অনঙ্গ অন্ধকারের ভিতর নিঃশব্দে মিলিয়ে গেল কোভালন ।
পরের দিন সকালে অন্য দিনের তুলনায় অনেক বিলম্বে ঘুম ভাঙল মাধবীর। শয্যায় শায়িতাবস্থায় তন্দ্রাজড়িত দৃষ্টি মেলে সে তাকিয়ে দেখল, গবাক্ষপথে দিনের রূঢ় রৌদ্ররশ্মি লূতাতন্তুর মতো ঘরের মধ্যে প্রবেশ করছে। ধীরে ধীরে উপাধানে ভর দিয়ে সে শয্যার উপর কোনোমতে উঠে বসল। ক্রমশ স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর রূপে তার মনে পড়তে লাগল গতকালকের রাত্রির কথা। সেই অন্ধকার সমুদ্রতীর… কোভালন… গান… কবিতা… সেই সব উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়… ভুল বোঝাবুঝি…
কোভালন চলে যাওয়ার পর কিছুক্ষণ সে সেই পুন্নাই গাছের তলাতেই স্তব্ধ হয়ে ঠায় বসেছিল। ভেবেছিল, কোভালন হয়তো ফিরে আসবে। কিন্তু অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেও যখন কোভালন ফিরল না, তখন অন্য উপায় না দেখে সে আর বসন্তমালা বিষণ্ণ মনে গৃহে ফিরে এসেছিল।
এত বড়ো ভুল বুঝল কোভালন? উত্তোলিত হাঁটুর উপরে মুখ রেখে বসে বসে ভাবছিল মাধবী। একবারও আসল কথাগুলো কোভালন জানার চেষ্টা করল না? মাধবীও তাকে বুঝিয়ে বলার সুযোগ পেল না কোনোমতে। যদি একবার নিজের ব্যক্তিগত পারিবারিক সমস্যার বাইরে বেরিয়ে এসে কোভালন আন্তরিকতার সঙ্গে জানতে চাইত, ঠিক কী জন্যে মাধবী কাল এত বিষণ্ণ, এত উত্তেজিত ছিল, তাহলে এই ভুল বোঝাবুঝি কখনোই হত না। মাধবী তো কোভালনকে সেই কথাগুলো বলবার জন্যেই কাল রাতে সমুদ্রতীরে নিয়ে গিয়েছিল ! কিন্তু বলা হল না সেসব কোনো কথাই।
গত এক পক্ষকাল ধরে মাধবী বড়ো অশান্তির মধ্যে আছে। অশান্তি তার অঙ্গরক্ষিকা বসন্তমালাকে নিয়ে। বসন্তমালা আর ঊষসী—এরাই তার আশৈশব সহচরী। এখন এরা দুজনেই প্রধানত তার দেখাশোনা করে। ফলত, ওদের জীবনযন্ত্রণা তার নিজেরই জীবনযন্ত্রণার সমান ।
বসন্তমালা জন্মসূত্রেই বড়ো দুঃখী মেয়ে। বসন্তমালার মায়ের নাম ছিল বেদবল্লী। মাদুরাই থেকে অনেক হাতফেরত হয়ে বেদবল্লী এই বারাঙ্গনাপল্লীতে এসেছিল নটী ইন্দুমুখীর কাছে। এই পল্লীতেই জন্ম হয় বসন্তমালার কোনো পিতৃপরিচয় ছাড়াই।
অথচ বসন্তমালার মা বেদবল্লীর জীবনের প্রথম ভাগে সবই ছিল। ঘর ছিল, স্বামী ছিল, পরিবার ছিল, নিরাপত্তাও ছিল। বেদবল্লীর স্বামী উথিরান ছিল মাদুরাই নগরীর অধিবাসী, পাণ্ড্যরাজের বেতনভোগী এক কোশাগারকর্মী। বেদবল্লীর সঙ্গে বিবাহের কয়েক বছর পরে উথিরান অন্য এক নারীর প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে। তার সেই উপপত্নীর কাছেই দিনের পর দিন পড়ে থাকত উথিরান । পতিবিচ্ছিন্না বেদবল্লীর দিন কাটতে থাকে মহাদুঃখে। ধীরে ধীরে স্বামীর অনুপস্থিতিতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে বেদবল্লী। তারপর একদিন বেদবল্লীর জীবনেও আসে অন্য এক পুরুষ। নাম তার ধর্মশীলন ।
এসব কথা মাধবী তার পালিকা মা ইন্দুমুখীর কাছে শুনেছে। ইন্দুমুখী বলেছিল, বেদবল্লীর সঙ্গে ধর্মশীলনের ব্যাপারটা ধীরে ধীরে মাদুরাই নগরীতে কানাকানি হতে থাকে। অবশেষে একদিন উথিরানের কাছেই তারা ধরা পড়ে যায়। ‘ভ্রষ্টা’ নারীর নির্মম শাস্তি কী হতে পারে, তা নিয়ে যখন নগর জুড়ে রসালো আলোচনা-পর্যালোচনা চলছে, তখন এক রাত্রে বেদবল্লী ও ধর্মশীলন রাতের অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে মাদুরাই থেকে পালিয়ে যায় । তাদের উদ্দেশ্য ছিল চেররাজ্যে পালিয়ে যাওয়া। কিন্তু পথিমধ্যেই অত্যন্ত রহস্যজনকভাবে ধর্মশীলন নিহত হয়। কোনোমতে প্রাণ বাঁচিয়ে এ-লোক সে-লোকের হাত ধরে বেদবল্লী দিন কাটাতে থাকে সঙ্গোপনে। অবশেষে এক বারাঙ্গনাপল্লীর বিটের হাতে পড়ে গিয়ে বেদবল্লী এসে উপস্থিত হয় এই মহল্লায় ইন্দুমুখীর কাছে।
অতীতের সম্ভ্রান্ত পরিবারের রূপসী গৃহবধূ বেদবল্লী এখানে এসে দিনে দিনে লাজ, ভয় ভেঙে কালক্রমে শৃঙ্গারাঢ্যা বারাঙ্গনামুখ্যাদের অন্যতমা হয়ে ওঠে। গানবাজনা সে জানত না, কিন্তু তার হাতে পূর্বসঞ্চিত কিছু অর্থ ছিল। বেশ্যাবৃত্তির পাশাপাশি বেদবল্লী চড়া সুদে অন্যদের অর্থ ধার দিতেও শুরু করে। এ তল্লাটে সে শুধু রূপোপজীবিনীই ছিল না, ছিল কুসীদজীবিনীও। এই সুদের ব্যবসা থেকেই বেদবল্লী হয়ে ওঠে বিত্তবতী গণিকা শোনা যায়, ইন্দুমুখীর সঙ্গে তার ঈর্ষা ও প্রতিযোগিতার সম্পর্কও গড়ে ওঠে। কিন্তু সেই রেষারেষি স্থায়ী হল না, দয়াময় ভগবান বেদবল্লীর বিড়ম্বিত জীবনে পূর্ণচ্ছেদ টেনে দিলেন নিজের হাতে। দুরারোগ্য যৌন ব্যাধিতে পীড়িত হয়ে বেদবল্লী অকালে মারা যায়।
বেদবল্লীর মৃত্যুর পরেই তার পিতৃপরিচয়হীনা কন্যা বসন্তমালাকে আপন ক্রোড়ে টেনে নেয় ইন্দুমুখী। বসন্তমালা, ঊষসী আর মাধবী—এই তিনটি প্রায় সমবয়স্কা দুহিতাকে ইন্দুমুখী সস্নেহে পালন করতে থাকে। এদের মধ্যে মাধবী দিনে দিনে শশিকলার মতো রূপে গুণে প্রবর্ধিত হয়ে অন্যদের ছাড়িয়ে গেছে ঠিকই, কিন্তু ঊষসী বা বসন্তমালাও রূপে গুণে নিতান্ত উপেক্ষণীয়া নয়।
ওই রূপই কাল হল বসন্তমালার। গত দু-তিন মাস ধরে বসন্তমালার চারিদিকে সমস্যার কৃষ্ণ মেঘ ঘনীভূত হয়ে চলেছে। সমস্যার সূচনা রাজসভা থেকেই। মাস তিনেক আগে মাধবীর সঙ্গে বসন্তমালা গিয়েছিল রাজসভায়। সেখানে মাধবীর নৃত্যানুষ্ঠান ছিল। রাজা কারিক্কালের এক বিত্তবান নারীলোলুপ অমাত্য যশস্করণ; সেই যশস্করণের নজরে
পড়ে গিয়েছে বসন্ত। যশস্করণ এখন বসন্তমালাকে চিরস্থায়ীভাবে পেতে চায়। রাজার কাছে যশস্করণ বসন্তমালাকে রক্ষিতা হিসেবে পাওয়ার জন্যে আবেদন জানিয়েছে। রাজাও অমাত্যর এই ইচ্ছায় সম্মতি জানিয়েছেন। বসন্তমালার জন্য পৃথক প্রাসাদ নির্মাণ করছে যশস্করণ। রাজা অনুদেশ পাঠিয়েছেন মাধবীর কাছে, বসন্তকে কিছুদিনের মধ্যেই সেই প্রাসাদে পাঠিয়ে দিতে হবে।
প্রথমে এই প্রস্তাবে খুশিই হয়েছিল মাধবী। বিত্তবান মানুষের রক্ষিতা হয়ে থাকলে বসন্তমালার মতো অসহায়া মেয়ের একটা গতি হবে। অনিশ্চয়তা ও অনিরাপত্তা থেকে বাঁচবে বসন্ত। মাধবী প্রথমে এমনই ভেবেছিল। পরে যখন বুঝতে পারল, বসন্তমালার ক্ষেত্রে এই প্রস্তাবের থেকে অধিক দুর্ভাগ্যের বিষয় আর কিছুই হতে পারে না, তখন তার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। কেন? কী সমস্যা বসন্তমালার ?
কেননা, বসন্তমালা কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, মুখপুড়ির একজন প্রেমিক আছে। কাবেরীঘাটের এক যুবাবয়স্ক নাবিক। তার নাম আধান। ওদের দুজনের সম্পর্ক নাকি অনেক দিনের। আধান বলেছে, সে অচিরেই বসন্তমালাকে বিবাহ করে এই গণিকাপল্লী থেকে ওকে নিয়ে যাবে। ঘর বাঁধবে। এমতাবস্থায় আধানকে ছেড়ে যশস্করণের প্রাসাদে উঠে গিয়ে বাঁচবে কীভাবে বসন্তমালা? আধানের সঙ্গে সহজ সামাজিক জীবনে ফিরে যাওয়ার এত বড়ো সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাবে বসন্তর ?
যত শীঘ্র সম্ভব বসন্তমালাকে সঙ্গে নিয়ে আধানের সঙ্গে দেখা করেছে মাধবী। সব কথা শুনে এখন আধান পিছিয়ে যাচ্ছে। মাধবী প্রস্তাব দিয়েছিল, ওরা রাজা কারিক্কালের সকাশে দেখা করুক। মাধবী সেই সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করে দেবে। রাজসকাশে আধান ও বসন্তমালা ওদের সম্পর্কের কথা নিবেদন করুক। হয়তো তাহলে রাজা কৃপাপরবশ হয়ে যশস্করণের এই বসন্তমালাকে রক্ষিতা করে রাখার ইচ্ছাকে খারিজ করে দেবেন ।
কিন্তু আধান কোনোমতেই মাধবীর এই প্রস্তাবে রাজি হল না। তখন মাধবী ওদের দুজনকে বলল গুর্জরদেশে কিংবা অনুরাধাপুরে পালিয়ে যেতে। সে-ব্যবস্থাও মাধবী করবে, কথা দিল । আধান বলল, সে ক-টা দিন ভেবে দেখতে চায়। এই বলে আধান চলে গেল।
কিন্তু সেই যে গেল আধান, আর ফিরে এল না। মাধবী তার সীমিত সাধ্যে অনেক অনুসন্ধান করেছে আধানের। কিন্তু পুষ্পহারে তার হদিশ কেউ দিতে পারছে না। অবশেষে এ ব্যাপারে কোভালন যদি কিছু করতে পারে, এই আশাতেই বসে ছিল মাধবী। ভেবেছিল, নির্জন সমুদ্রতীরে বসে সে কোভালনকে বসন্তমালার এই সমস্যার কথাই বলবে। কোভালন শ্রেষ্ঠী মাশাতুবানের পুত্র। ওর অনেক বেশি যোগাযোগ আছে। কাবেরীতীরে ওদের অনেক অনুচর ঘুরে বেড়ায়। আধানের কী হল, সে এখন কোথায়, এসব খবর পারলে কোভালনই একমাত্র এনে দিতে পারে মাধবীকে।
কিন্তু এসব কোনো কথাই বলবার সুযোগ দিল না কোভালন। গতকাল রাত্রে মাধবী
কথা আরম্ভ করেছিল মাত্র। তার হৃদয় বেদনার্ত ছিল। বসন্তমালার দুর্ভাগ্যের কথা, বসন্তর মা বেদবল্লীর করুণ পরিণতির কথা, সেই সূত্রে এই নগরীর সব অসহায় মেয়েদের বেদনা তাকে বারংবার তাপিত করছিল। সেই কষ্ট তার কথাকে, তার গানকে বেদনাকরুণ করে রেখেছিল কাল। কিন্তু সেসব কথা, গান—সমস্ত কিছুকেই একান্ত ভুলভাবে বুঝল কোভালন। সব কথারই ব্যক্তিগত অর্থ বের করার চেষ্টা করতে লাগল। ভাবল, এসব কথা বা গানের ভিতর দিয়ে মাধবী বুঝি কোভালনের ব্যক্তিগত বা পারিবারিক অসততাকে ইঙ্গিত করতে চাইছে। কোভালনকে অপমান করতে চাইছে। ক্রুদ্ধ, উত্তেজিত হয়ে কোভালন পুন্নাই গাছের তলা থেকে উঠে মাধবীকে পরিত্যাগ করে চলে গেল।
মাধবীর মনে হচ্ছে এখন, দোষ তারও ছিল। সে কেন শেষ মুহূর্তে কোভালনকে ‘যাও, যাও’ বলে তাড়িয়ে দিল? ওকথা না বললে, কোভালন হয়তো চলে যেত না। একটা ছোট্টো অসতর্কতাজনিত ভুল। সব শেষ!
তবু সব হয়তো শেষ হয়নি। এখনও কোভালনকে ফেরানোর সুযোগ আছে, মনে হল মাধবীর । এমন কত প্রণয়-কলহ তো হয়ই তাদের মধ্যে। একবার চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে। বসন্তমালার কথা ভেবেও সে-চেষ্টা তার একবার করাই উচিত। মাধবীর মন বলছে, কোভালন নিশ্চয়ই ফিরে আসবে।
স্নান, প্রাতরাশ ইত্যাদি দ্রুত সমাধা করে তালীপত্র, লেখনী টেনে নিয়ে মাধবী কোভালনের উদ্দেশে পত্র লিখতে বসল। লাল রঙের গালা ও এক বিশেষ ধরনের আঁঠা দিয়ে তৈরি মসীতে পূর্ণ পাত্রটির দিকে তাকিয়ে তার মনে হচ্ছিল, এ যেন তার হৃদয়রুধির। মস্যাধারে বেণুদণ্ডের লেখনী নিমজ্জিত করে নিয়ে সে ভাবল একবার, কীভাবে আরম্ভ করবে। এতদিনে কখনও সে কোভালনকে কোনো পত্র লেখেনি। সে প্রয়োজনই পড়েনি এতদিন। অনেক ভেবে ‘প্রিয়তমেষু’ সম্বোধন দিয়ে পত্র আরম্ভ করল মাধবী।
‘প্রিয়তমেষু কোভালন,
বসন্ত এসেছে যুবরাজকুমারের মতো পৃথিবীকে শাসন করতে ইদানীং। পৃথিবীর প্রণয়ী, প্রণয়িনীদের পরস্পর কাছে টেনে আনছে ঋতুরাজ। যেন এক স্বেচ্ছাচারী কিশোর এই বসন্ত, কুসুমশর হেনে প্রেমিক-প্রেমিকাদের বুকে নিদারুণ আঘাত হানছে অবিরত । চাঁদ—সেও কম দুষ্টু নয়—সন্ধ্যাকাশে উদিত হয়ে বুকের ভিতর জাগিয়ে তুলছে ঐকান্তিক বাসনার ঝড়; ধীরে ধীরে সেই ঝড়কে অসহনীয় করে তুলছে প্রতি সায়ংকাল। তাই রতিমিলনের উত্তাপের পর যার প্রেমিক চলে গেছে দূরে, ফিরে আসতে দেরি করছে এত এত এত… অথবা প্রেমাস্পদ যাকে ছেড়ে চলে গিয়ে ভুলে গেছে প্রিয় নাম, পুষ্পধনু বসন্ত সেই অভাগিনীকে দয়া করবে না। চাঁদ সেই অভাগিনীর বুকে হানবে তীক্ষ্ণ কিরণরেখার শায়ক। তাকে পোড়াবে, কাঁদাবে, যন্ত্রণা দেবেই ।
প্রিয় যুবক, আমার ব্যথা বোঝো।
ইতি মাধবী।’
এর বেশি সে আর কিছু লিখতে পারল না। এমনিতেই তার চোখের জলে ভেসে যাচ্ছে তালীপত্র। অক্ষরগুলি আবছা অস্পষ্ট হয়ে যাবে। তদুপরি এ পত্রে বসন্তমালার সমস্যা লেখা যাবে না। কেননা কার হাতে যে এ পত্র গিয়ে পড়বে কে জানে !
তাড়াতাড়ি পত্রটি চাঁপাফুলের একটি মালার মধ্যে লুকিয়ে বসন্তমালার হাতে দিল মাধবী। বলল, যেভাবে হোক, বসন্তমালা এ পত্র যেন কোভালনের হাতে দেয় সন্ধ্যা নামার আগেই।*
কোভালনের সন্ধানে পত্রবাহিকা বসন্তমালাকে পাঠিয়ে দেওয়ার পর সমস্ত দিন মাধবী অপেক্ষা করতে লাগল। তার মনে হল, কোভালন এই পত্র পেয়ে নিশ্চয়ই তার মনোবেদনা অনুধাবন করতে পারবে। পত্রের উত্তর নয়, হয়তো পত্রটি পেয়ে কোভালন নিজেই এসে উপস্থিত হবে মাধবী-সকাশে।
হায় মাধবী! তুমি যদি জানতে, সম্পূর্ণ অজ্ঞাতসারেই তুমি কোভালনের হৃদয়ের কোন গভীর তন্ত্রীতে আঘাত করে ফেলেছ কাল রাতে! কল্পনা ও বাস্তবতা—এ দুই প্রতিষ্পর্ধী শক্তির কঠিন দ্বন্দ্বে কোভালনের যে-হৃদয় আজন্ম রুধিরাক্ত হয়ে চলেছে, তোমার অসচেতন কথার তির ঠিক সেই ক্ষতস্থানেই নিদারুণ আঘাত হেনেছে। তোমার এই পত্রবাহিত আবেগ এখন কি আর তার শুশ্রূষা করতে পারবে ?
বসন্তমালা পুষ্পহার নগরীর পথে পথে কোভালনকে প্রাণপণে খুঁজে ফিরতে লাগল সারা দিনমান। কিন্তু কোথায় কোভালন? বসন্তমালা খোঁজ নিয়ে দেখল, কোভালন কাল রাত্রে তার গৃহাবাসে ফেরেনি। কাবেরীতটেও কোভালন নেই। বসন্তমালা ভাবল, কোভালন নিশ্চয়ই তার বিপণিতে থাকবে। কিন্তু বিপণির সম্মুখে পৌঁছে সে তাকে দেখতে পেল না। বসন্তমালার ঐকান্তিক কাতরতা দেখে বিপণির একজন কর্মী জানাল, সমুদ্রতটের কাছে এক নির্জন স্থানে পরিত্যক্ত একটি নৌকার খোলের ভিতর কোভালনকে সে শুয়ে থাকতে দেখেছে।
সেই কর্মীটির কথা অনুসরণ করে অবশেষে দিনান্তে কোভালনের কাছে পৌঁছোতে পারল বসন্তমালা। দেখল, এক রাত্রের মানসিক ঝড়ে কোভালন যেন সম্পূর্ণ অন্য মানুষ হয়ে গিয়েছে। তার কেশপাশ বিস্রস্ত, বেশবাস অবিন্যস্ত, চক্ষু আরক্ত ভীষণ ।
বসন্তমালার হাত থেকে পত্রটি হাতে নিল কোভালন। পড়তে লাগল । ধীরে ধীরে তার মুখচোখ আরও কঠিন হয়ে উঠল। পড়া শেষ হলে সে বসন্তমালাকে বলল বিপণিতে যেতে। কোভালন এর উত্তর এখনই লিখে দেবে বসন্তমালার হাতে। তার জন্য কোভালনকে বিপণিতেই ফিরতে হবে।
বিপণিতে ফিরে মাধবীর পত্রের উত্তর লিখতে বসল কোভালন। নিজেকে ছিঁড়ে খণ্ড খণ্ড করে সে যেন মিশিয়ে দিতে লাগল পত্রের অক্ষরমালায়। পত্রের প্রথমে সে মাধবীকে নাম ধরে সম্বোধন পর্যন্ত করল না। পরিবর্তে সে এইভাবে লিখতে লাগল :
‘অয়ি নৃত্যপটিয়সী,
নৃত্যবিদ্যার সকল কলা, সমস্ত বিভঙ্গ তুমি জানো। প্রথমে তুমি নৃত্য প্রদর্শন আরম্ভ করেছিলে ‘কাকুডুবারি’ বিভঙ্গ দিয়ে। আমি বিমূঢ় কোভালন দেখেছিলাম তোমার ওই অপার্থিব মুখশ্রী, তোমার কপালের তিলক, তোমার মাথার ফুল, তোমার বিদ্যুতের মতো ভ্রূলতা, কুবলয়ের মতো তোমার আয়ত দুটি চোখ, কুমিল ফুলের চেয়েও সুকোমল তোমার নাসাপুটে সুশুভ্র মৌক্তিক আর কোভাই কুসুমের মতো তোমার ওই সুপুষ্ট ওষ্ঠাধর। আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম ।
তারপর তুমি আমার জীবনের মঞ্চোপরি একবার সম্মুখে অগ্রসর হয়ে পরমুহূর্তে পশ্চাতে পিছিয়ে গিয়ে ‘কাণ্ারি’ নৃত্য দেখাতে আরম্ভ করলে। নববর্ষার শ্যামগম্ভীর দামিনীর মতো অলকভারে তোমার চন্দ্রনিভ মুখকান্তি যেন চকিতে ঝলসে উঠল। আয়ত নয়নের শফরীসম চঞ্চল দুটি আঁখিতারা কটাক্ষবিদ্যুতের কশাঘাতে বিদ্ধ করল আমার হৃদয়। তোমার প্রবালরক্তিম ওষ্ঠের আড়াল থেকে মুক্তাশুভ্র দত্তপক্তি মায়াবিস্তার করল। আমি সম্মোহিত হলাম ।
তদনন্তর তুমি নানা ছদ্মবেশে, নানা ভূমিকায় অভিনয় করতে করতে ‘উল্বারি’নৃত্য দেখাতে লাগলে। তোমার চোখ দুটি হয়ে উঠল শায়কের মতন তীক্ষ্ণ, প্রাণভেদী। তোমাকে পেয়ে আমার আনন্দ, তোমাকে হারিয়ে আমার বেদনা—সমস্তই তুমি অপাঙ্গদৃষ্টিতে লক্ষ করে বঙ্কিম হাসলে। তুমি কত রূপে, কত ভূমিকায় যে অভিনয় করলে—কখনও অনুরাগজর্জর নায়িকা, কখনও বিরহবিধুর প্রেমিকা, কখনও প্রণয়ের বার্তাবহ দূতী, কখনও বিপ্রলব্ধা সতী—সকল ভূমিকাতেই তুমি অনন্যা। আমি অভিভূত হলাম।
এবার তুমি ‘পুরবারি’ নৃত্যের আঙ্গিকে অভিভূত আমাকে উপেক্ষা করতে লাগলে। আমি তখন তোমার নূপুরবিহীন চরণপল্লব, তোমার কাঞ্চীবিমুক্ত কটিদেশ, তোমার চন্দ্রহারস্খলিত উন্মুক্ত জঘন কামনা করছিলাম। আর ঠিক তখনই তুমি আমার সমূহ সংরাগ, সমস্ত উদগ্র বাসনাকে পদদলিত করে লীলাময় ঔদাসীন্যে আমাকে প্রত্যাখ্যান করলে। আমি আহত হলাম।
আহত আমি ফিরে গেলাম আমার নিভৃত বেদনা নিয়ে একা। তখন তুমি তোমার করুণরঙিন মুখ, ম্লান কপাল, শিথিল বেণীবন্ধ, বিপুল স্তনভারে নিপীড়িত কটির শীর্ণতা নিয়ে ‘কিলবারি’নৃত্যে বিলাপ করতে লাগলে। সেই বিলাপের বার্তা আমি শুনতে পেলাম দক্ষিণা বাতাসে, দেখতে পেলাম আমার অশান্ত কল্পনায়। আমি বিষণ্ণ হলাম।
আমার বিষণ্নতার কথা ভেবে ভেবে তুমি সতৃপ্ত হলে বোধহয়? তোমার মনোবেদনাকে তুমি প্রকাশ করতে লাগলে অন্যদের কাছে’তেরচ্চিবারি’র নৃত্যকৌশলে। তোমার ঊষসী, তোমার বসন্তমালা—সকলেই জানল অভাগা কোভালন তোমাকে প্রত্যাখ্যান করে অন্যায় করেছে।
হায় ! তারা জানল না, কে কাকে ফিরিয়ে দিয়েছে। কেননা এখন তো তুমি আরম্ভ
করেছ ‘কাটচিবারি’নৃত্য! বিরহের ভ্রমর এখন গুনগুন করছে তোমার কণ্ঠমালায়। তোমার দুঃখবেদনা দেখে কতজন এখন প্রকৃত তথ্য না জেনেই তোমাকে সান্ত্বনা জানাবে !
এরপর তুমি ‘এডুভুক্কোলবারি’ নৃত্য
করতে করতে মুর্ছিত হবে। তোমার বেদনা-আতুরতার অভিনয় দেখে হায় হায় করে উঠবে দর্শককুল। তারা জানবেও না, এসব ভান, এসব মিথ্যা অভিনয়। তারা তোমাকে তোমার কৃত্রিম সংজ্ঞাহীনতা থেকে জাগিয়ে তুলবার আন্তরিক প্রয়াস করবে। কিন্তু জাগবে তুমি তখনই, যখন তোমার ইচ্ছে হবে। তোমার এই অভিনয়কুশলতা, নৃত্যনিপুণতাকে আমিও শংসাবাদ না জানিয়ে পারছি না। সুষ্ঠু, স্তনসৌষ্ঠবা মাধবী, সুষ্ঠু তোমার পরিবেশনা !
তুমি কলানিপুণা নৃত্যশিল্পী। সুদক্ষা অভিনেত্রী তুমি, মাধবী! নৃত্যাভিনয়ের সমূহ করণকৌশলই তোমার জানা থাকবে—সেটাই তো স্বাভাবিক! শুধু মূর্খ আমিই মোহবশে এই কথাটা সম্পূর্ণ ভুলে গিয়েছিলাম যে, একদিন যাকে আমি গভীর আবেগে ভালোবেসেছিলাম, সে কোনো সাধারণ মেয়ে নয়; সে আসলে একজন দক্ষ অভিনেত্রী, একজন নৃত্যপটিয়সী নর্তকী—প্রতারণার সমস্ত ছলাকলাই সে নিপুণভাবে জানে !
ইতি
তোমার বিমুগ্ধ মরাল।’*
লেখা শেষ করেই পত্রটি বসন্তমালার হাতে তুলে দিল কোভালন। তারপরই আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে নিঃস্পৃহ পায়ে বিপণি ছেড়ে পথে নামল। কোথায় সে যাচ্ছে, কিছুই জানে না ।
আমরাই কি কেউ জানি, আমরা আসলে কোথায় যাই ?
গন্তব্য যখন স্থির থাকে না, তখন হাঁটতে হাঁটতে মানুষ খেয়াল করতে ভুলে যায়, কোন পথে সে কতক্ষণ ধরে হেঁটে চলেছে। কোভালনেরও তাই হল। তার পায়ের তলায় পুষ্পহার নগরীর সমস্ত পথ ফুরিয়ে গেল, পেছনে পড়ে রইল কাবেরীঘাট, সমুদ্রসৈকত। নগর পার হয়ে, কাবেরীর খেয়ায় পাড়ি দিয়ে, পরপারে বন্দর অতিক্রম করে, নগরের বহির্দেশস্থ পল্লীগুলি পেরিয়ে পেরিয়ে সে চলতে লাগল সারারাত। যেসব পথ দিয়ে দিনমানেও পথিকেরা দস্যুভয়ে হাঁটতে চায় না, মধ্যনিশীথের ভীষণ অন্ধকার সরিয়ে সরিয়ে উদ্ভ্রান্ত কোভালন সেই সব ভয়াবহ পথে দিশাশূন্য হেঁটে চলল। ভোর হওয়ার দুই দণ্ড আগে পথিপার্শ্বস্থ একটি অন্ধকার বটগাছের তলায় সে ক্লান্ত হয়ে বসে পড়েছিল, কখন ঘুম এসে তার পথশ্রান্ত শরীরকে অধিকার করে নিল, তা সে টেরও পেল না ।
ঘুম ভাঙল যখন, তখন চড়া রোদ উঠেছে। কোভালন দেখল, সে একটা আদিগন্তবিস্তৃত শ্যামশস্যবিমণ্ডিত ক্ষেত্রের ধারে নির্জন পথের পাশে এক বুড়ো বটতলায় পড়ে আছে। উঠে বসতে গিয়ে দেখল, সারা শরীরে অসম্ভব ব্যথা। কিন্তু তার অন্তরবেদনা তাকে মানসিকভাবে এতদূর অসাড় করে দিয়েছিল যে, অন্য সময় হলে যে-পথে সে এক পদও আর অগ্রসর হতে পারত না, শারীরিক যন্ত্রণাকে উপেক্ষা করে সে এখন সেই কষ্টকর পথ ধরেই এগিয়ে যাওয়া মনঃস্থ করল। যদিও সে আদৌ জানে না কোথায় যাবে, কোথায় গিয়ে শান্তি পাবে কিংবা শান্তিরও অধিক মূল্যবান জীবনপ্রশ্নের একটা কোনো নিরাবেগ উত্তর কোথায় আছে ।
মাঠের আলপথ ধরে হাঁটতে লাগল কোভালন। সমতল ক্ষেত্র ক্রমশ উচ্চাবচ ভঙ্গিলতা পাচ্ছে; যেন ধীরে ধীরে কোনো পার্বত্যপ্রদেশের দিকে এগিয়ে চলেছে ভূমিভাগ। কোভালনের সেদিকে নজর নেই। সে যন্ত্রচালিতবৎ মাথা নীচু করে হেঁটে চলছিল, বুক তার কর্মকারের ভস্ত্রার মতন শ্বাসাঘাতবেগে উঠছিল-পড়ছিল, তবুও সে থামছিল না । মাঝে মাঝে কোনো নাম-না-জানা পাখির ডাকে সে চমকে উঠছিল ঠিকই, কিন্তু তা ওই পর্যন্তই। কৃষিক্ষেত্রে কর্মরত কৃষকদের কোলাহল বা কৃষকরমণীদের উল্লাস-বিলাপ, কিংবা দূরের গ্রাম বা বনান্ত হতে ভেসে আসা সারমেয় বা জম্বুকের বিকট উল্লাপনধ্বনিতেও তার উদগ্র গতিশীলতা কোথাও ব্যাহত হচ্ছিল না।
মাঠ শেষ হয়ে বনভূমি এসে পড়ল। বনের মধ্য দিয়ে বিশীর্ণ মাটির পথ সংসারের সঙ্গে পরিচয়বিহীন কোনো অমলা কুমারীকন্যার শুভ্র সিঁথির মতন হয়ে দেখা দিল। দুপাশে জড়ীভূত অজস্ৰ অজ্ঞাতনামা গাছেদের অচল স্তব্ধতা, মধ্যে বনপথ এঁকেবেঁকে চলেছে, কোথাও বন্য শ্বাপদের হিংস্র হুহুংকার, পাখিদের কথাকলি আর অরণ্যের অন্তরালে গভীর গোপন অন্ধকারের বুকে জোনাকিদের ইতস্তত ওড়াউড়ি। কিছুদূর এগিয়ে কোভালন আধোমনস্কভাবে খেয়াল করল, এখানে কিছুক্ষণ আগে বৃষ্টি হয়ে গেছে; পথিপার্শ্বে তৃণমুখে, বনস্পতির শ্যাম পর্ণে বৃষ্টিবিন্দু এখনও বেপথুমান। বৃষ্টিরেণুসিঞ্চিত আর্দ্র বাতাস মাঝে মাঝে তরুশ্রেণীর সিক্ত পত্রসম্ভার সহসা এলোমেলো করে দিয়ে কোভালনের পথশ্রান্ত শরীরকে ছুঁয়ে যাচ্ছিল। তাতে শরীর আরাম পেলেও মন বেদনাভারে বিমর্ষ থাকায় সম্পূর্ণ স্বস্তিলাভ হচ্ছিল না কোভালনের কোনোমতেই।
ধীরে ধীরে বনের ঘনতা কমে আসতে লাগল, ক্রমশই প্রস্তরকঙ্করময় ঊষর কোনো পার্বত্যপ্রদেশের সমীপবর্তী হচ্ছিল কোভালন। কিছু পরে কোভালন দেখল, সে বনের প্রান্তে এক পাটল বর্ণের উত্তুঙ্গ গিরির সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছে। সেই পাহাড়টি যেন এক নগ্ন সন্ন্যাসীর নিরাবরণ সারল্য ও তপোস্তব্ধতা নিয়ে বিরাজমান। পাহাড়ের গা বেয়ে প্রস্তরনির্মিত সোপানশ্রেণী। কারা এই সোপান নির্মাণ করেছে? তবে কি পাহাড়চূড়ায় কোনো বসতি আছে? কিন্তু এমন সংসারবিচ্ছিন্ন প্রদেশে কার বসবাস করার সাধ হবে, সেকথা ভেবে ভেবে কোভালন কিছুই অনুমান করতে পারল না। সোপানমার্গ ধরে সে ধীরে ধীরে উপরে উঠতে লাগল ।
সোপানের প্রস্তরসমূহ বেশ উচ্চ, অমার্জিত ও রুক্ষ। মধ্যে মধ্যে সোপানের ফাটলে বন্য কাঁটাগাছ তীক্ষ্ণ অঙ্কুর বিস্তার করে রেখেছে। এবার সত্যিই কোভালনের কষ্ট হচ্ছিল, তার চরণ কুশাঙ্কুরের তীক্ষ্ণ স্পর্শে রুধিরাক্ত হয়ে উঠছিল এবং বক্ষে শ্বাসস্বল্পতা অনুভূত হচ্ছিল। অবশেষে প্রায় অর্ধঘটিকার শ্রমে আপাদমস্তক ঘর্মাক্ত কোভালন সোপান-আরোহণ সম্পন্ন করে উন্নত এক শিলাভূমির উপর এসে উপস্থিত হল।
কোভালন দেখল, এ শৈলগিরির শিখরচূড়া আকাশস্পর্শী হলেও পুরোবর্তী স্থান তুঙ্গভূমি নয়, বরং এখানে পাহাড়ের ঊর্ধ্বদেশে অনেকটা স্থান যেন পাথর কেটে তুলনামূলকভাবে সমতল করা হয়েছে। এখানে গাছপালা প্রায় একটিও নেই, কোথাও একটি তৃণগুল্মও তার অসংযমী উচ্ছ্বাস দেখাতে পারেনি, সমগ্র স্থলটি সবিশেষভাবে পরিষ্কৃত, সম্মার্জিত। আয়তাকার স্থানটির কেন্দ্রবিন্দুতে একটি প্রস্তরখোদিত অলংকৃত ঊর্ধ্বমুখী স্তম্ভ। সেই স্তম্ভ পেরিয়ে ওধারে আবার খাড়া পাহাড়ের রুক্ষ দেওয়াল উপরে উঠে গেছে। প্রস্তরময় দেওয়ালের গাত্রে চার-পাঁচ মানুষসমান উচ্চতায় খোদিত জৈন তীর্থংকরদের পাষাণমূর্তি। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ পদ্মাসনে উপবিষ্ট, কেউ কেউ আবার কায়োৎসর্গ ভঙ্গিমায় দণ্ডায়মান। সকলেই দিগম্বর, ঋজু, তপোকাঠিন্যপূর্ণ। অথচ তাঁদের ধ্যাননিমজ্জিত মুখশ্রীতে একবিন্দু কঠিনতা নেই, সকলের মুখই কেমন সরল, আনন্দময়, নির্ভার। এই সকল তীর্থংকরদের মূর্তিছাড়াও গিরিগাত্রে বহু বলিষ্ঠদেহ যক্ষও পুষ্পিতযৌবনা স্তনভরনমিতাঙ্গী যক্ষীদের চারুশীলিত শিলামূর্তিও চতুর্পার্শ্বে শোভমান ।
কোভালন দেখল, পাষাণের এই প্রাণহীন রাজ্যে সে নিজে ছাড়া আর একটিমাত্র প্রাণী ইতস্তত পরিভ্রমণ করে বেড়াচ্ছে। সেটি একটি সুদীর্ঘ কলাপযুক্ত সুন্দর ময়ূর। তীর্থংকর পার্শ্বনাথের দণ্ডায়মান মূর্তির উপরে একপাশে পাহাড়ের খাঁজের মধ্যে ময়ূরটি উঠছে। কখনও সেই উচ্চতা থেকে সুচিত্রিত বঙ্কিম গ্রীবা ঘুরিয়ে কোভালনকে একবার দেখে নিচ্ছে। ময়ূরটির মূর্ধা… সুবিস্তারিত পুচ্ছকলাপ…. বর্ণিল গ্রীবাদেশ… সর্ব অবয়ব মধ্যদিনের রৌদ্রে জরির পাড়-বসানো উজ্জ্বল নীলাভ শাটিকার মতো ঝিলমিল করে উঠছে। কখনও আবার ময়ূরটি লঘুভার হৈমন্তী পর্ণের মতন পাহাড়ের উপর থেকে ডানা ভাসিয়ে সামান্য উড়ে এসে নিম্নের পাষাণভূমিতে বসছে। কখনও তীক্ষ্ণ কেকারবে শৈলদেশের স্তব্ধ বায়ু আকুল করে তুলছে।
কিছুক্ষণ ওইখানে এইভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ক্রীড়ারত ময়ূরের কার্যকলাপ দেখে দেখে কোভালনের ক্লান্ত মন ঈষৎ সুস্থতা লাভ করল। এমন নির্জন স্থান তার কাছে অদৃষ্টপূর্ব। লক্ষ্যহীনভাবে হাঁটতে হাঁটতে সে এখানে হঠাৎ এসে পড়েছে। কোভালন আজন্ম লোকালয়ে বর্ধিত, জনবহুল নাগরিক জীবনেই সে চির-অভ্যস্ত। এতদিন মানুষের ভিড়ের মধ্যেই আকণ্ঠ ডুবে থেকেছে কোভালন । জীবনের যাবতীয় অভাব মেটাতে সে এতদিন অন্য সবার কাছে হাত পেতেছে, নির্জনতার কাছে নয়। বিত্তের জন্য সে বন্দরে গেছে, বিদ্যার জন্যে বিদ্যালয়ে। উল্লাসের জন্যে বন্ধুবৃত্তে, প্রেমের জন্যে গেছে সে নারীর কাছে। কল্পনার পরিতৃপ্তি পেতে সে গেছে কবিতার সমীপে, সুবিচার পাওয়ার আশায় গেছে রাজসকাশে। পাপভয়ে ও পুণ্যলোভে ঘুরেছে ধর্মসুবাসিত মন্দিরে মন্দিরে। কিন্তু এমন নির্জন প্রকৃতির কাছে সে কখনও এসে দাঁড়ায়নি। আবার এ স্থান তেমন কিছু শ্যামশ্রীবিমণ্ডিতও নয়। এখানে ভ্রমণপিপাসু মানুষকে প্রমোদ দেওয়ার জন্য, রূপমুগ্ধ কবিদের কবিতা রচনার উপাদান সরবরাহ করার জন্য পত্র-পুষ্প-কাকলির বিলাসসম্ভার নিয়ে চারিপাশে দাঁড়িয়ে নেই কোনো সুশ্যাম বনবীথি। বরং অত্যন্ত রুক্ষ এই পার্বত্যপ্রদেশ, কঠোর কৃচ্ছ্রসাধনের ভাব এই শৈলের সর্বাঙ্গে। এখানে অপরিমেয় আকাশ, তীব্র রোদ, কর্কশ কেকাধ্বনি। এই স্থানে সর্বগ্রাসী শূন্যতার, সর্বরিক্ততার ঐশ্বর্যই বিদ্যমান। জীবনের সমস্ত তথাকথিত সমৃদ্ধি, স্থূল ও সূক্ষ্ম সম্ভোগের উপচারকে অবজ্ঞাভরে সরিয়ে দিয়ে একা এক রুক্ষ পাষাণের স্তূপ নিরভ্র আকাশে যেন নির্ভয়ে সর্ববিজয়ী সম্রাটের মতো মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। মানুষের যাবতীয় সৌন্দর্যপ্রীতিকে তুচ্ছ করে দিয়ে, ক্ষুদ্র অহমিকার উদগ্র দুর্গকে হেলাভরে নস্যাৎ করে দিয়ে নিঃসঙ্গ এই পাহাড় আপনাতে আপনি তন্ময়, আপনাতে আপনি বিভোর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই অনাসক্ত মহাশূন্যতার দৃশ্যের সম্মুখে জীবনে প্রথমবার কোভালনের মন যেন শান্তির চকিত আভাস পেল। সেই শান্তি সুখ নয়, দুঃখও নয়। প্রেমও নয়, বিচ্ছেদও নয়। বাস্তব নয়, কল্পনাও নয়। ধর্মও নয়, কাব্য ও নয়। সকল দ্বৈতভানের অতীত তৃতীয় কিছু। কিন্তু সেই তৃতীয় বস্তুটি যে কী, কোভালন তখনই তা বুঝতে পারল না। শুধু অনুভব করল, যে প্রচণ্ড ঝড় আজ কয়েক দিন ধরে তার মনকে একেবারে বিধ্বস্ত বিপর্যস্ত করে দিয়ে যাচ্ছিল, যে-ঝড় মাথায় নিয়ে সে এতটা পথ অজ্ঞাতসারেই হেঁটে এসেছে, এখানে এসে সেই ঝড় হঠাৎ নিজের থেকেই কীভাবে যেন থেমে গেছে। হৃদয়ের দাহব্যথা সহসাই উপশান্ত হয়ে গেছে তার ।
এই ব্যাপারটা যে ঠিক কীভাবে হল, তা নিয়ে এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছিল কোভালন। তার চোখ দুটো খোলা ছিল, কিন্তু মস্তিষ্ক মনে যোজিত ছিল না। ফলত দৃষ্টিসংবেদী স্নায়ু বাইরের থেকে দৃশ্যাবলীর বার্তা এনে মস্তিষ্কের যে-দর্শনকেন্দ্ৰে সমৰ্পণ করছিল, সেই স্নায়ুকেন্দ্রে মন সংযুক্ত ছিল না । মন ঘোরানো ছিল ভিতরের দিকে। কিন্তু হঠাৎ উপরের পাহাড়ের গায়ে কিছু একটা নড়াচড়ার ছায়া অক্ষিপটে এসে পড়ায় প্রবল স্নায়বিক স্রোত মনকে জোরপূর্বক মস্তিষ্কের স্নায়ুকেন্দ্রে যোজিত করল; চমকে যেন আচ্ছন্ন দশা থেকে জেগে উঠল কোভালন ।
অন্যমনস্ক অবস্থা থেকে সে হঠাৎ সজাগ হয়ে উঠল। দেখল, পুরোবর্তী প্রস্তর স্তূপের অনেক উপরে পাহাড়ের খাঁজে ঝুলন্ত অলিন্দের মতন স্থানে দুজন মানুষের ছায়া যেন চকিতে একদিক থেকে আরেকদিকে সরে গেল। দুজন মানুষ ওই অলিন্দপথ দিয়ে পাহাড়ের ভেতরের দিকে কোথায় যেন ঢুকে গেল। দৃষ্টিবিভ্রম নাকি? নাকি সত্যিই ওখানে ওই উপরে মানুষের বসবাসোপযোগী কোনো স্থান বা গুহা আছে? চারিপাশের পরিবেশ ও গিরিগাত্রে পার্শ্বনাথ প্রভৃতি তীর্থংকরদের মূর্তি থেকে এর আগেই কোভালনের মনে হয়েছিল, এ স্থান জৈন সাধুদের মঠ। এখন গিরিকুহরের সম্মুখে ছায়ার মতো সঞ্চরণশীল মনুষ্যের মতো কিছু দেখে তার পূর্বকৃত অনুমান যে ঠিক ছিল, সেকথা আরও জোরের সঙ্গেই মনে হল। দুই করপুট মুখগহ্বরের দুইপাশে সংযুক্ত করে ঊর্ধ্বস্বরে ডাক পাঠাল কোভালন, ‘হো-ও-ও শ্রমণ-অ…, শ্রমণ-অ… ভো-ও-ও-ও!’
কিন্তু তার সেই আহ্বানধ্বনি পাহাড়ের গায়ে প্রতিফলিত হয়ে মাত্র ফিরে এল : ‘ও-ও-ও-ও!’ এ ছাড়া তার আহ্বানের আর কোনো উত্তরই এল না। এক পল পরেই নির্জন শৈলপ্রদেশে আগের থেকেও অধিকতর স্তব্ধতা নেমে এল ।
কোভালন ভাবছিল, পাহাড়ের অত উপরে সত্যিই যদি শ্রমণেরা থেকে থাকেন, তাহলে তাঁরা ওখানে গেলেন কীভাবে? উপরে যাওয়ার কি কোনো লুক্কায়িত পন্থা আছে ? কিন্তু অনেক অন্বেষণ করেও সেরূপ কোনো পন্থা সে আবিষ্কার করতে পারল না। এমন হতে পারে যে, কোভালন পাহাড়ের যেদিকে দাঁড়িয়ে আছে, তার বিপরীত দিক দিয়ে অন্য কোনো মার্গ আছে, যা অবলম্বন করে উপরে ওঠা যায়। কিন্তু এদিকে সেরকম কিছুই নেই। খুঁজতে খুঁজতে কোভালনের চোখে বরং অন্য একটি ব্যাপার ধরা পড়ল । যেখানে সে দাঁড়িয়ে আছে, সেখান থেকে সামান্য উপরে দুটি বিশাল আকারের প্রস্তরখণ্ড কোনো জলজন্তুর উপরের ও নীচের চোয়ালের মতন সম্মুখদিকে বিস্তৃত হয়ে রয়েছে। যেন পাথরের তৈরি বিশালাকার কোনো কুম্ভীর আনন ব্যাদিত করে বাইরের আকাশের দিকে চেয়ে আছে। কোভালনের মনে হল, পাথরের তৈরি ওই কুম্ভীরটার উত্তরাহনু আর অধরাহনুর মধ্যে প্রায় এক মানুষ প্রমাণ ব্যবধান আছে। তবে কি ওই কুমীরটার হাঁ-করা মুখের মধ্য দিয়েই ভিতরের দিকে যাওয়ার কোনো পন্থা বিদ্যমান? ওই পথ দিয়েই কি পূর্বদৃষ্ট ওই দুজন শ্রমণ উপরে গিয়েছেন? অথবা এ অন্য কোথাও যাওয়ার মার্গ ?
পরীক্ষা করবার জন্য পাথরের খাঁজে খাঁজে পা রেখে সেই কল্পিত কুমীরের চোয়ালের মধ্যে গিয়ে উঠে দাঁড়াতে পারল কোভালন। সেখান থেকে কয়েক পা অগ্রসর হয়ে দেখল, উপরে নীচে স্থাপিত সমান্তরাল দুই প্রস্তরের মধ্যবর্তী ব্যবধান ক্রমশ যেন বাড়ছে। এ নির্ঘাত কোনো গুহামুখ! ধীরে ধীরে কোভালন এক প্রশস্ত সুড়ঙ্গের ভিতর প্রবেশ করতে লাগল।
আরও কিছু দূর অগ্রসর হওয়ার পরে সে সম্মুখে একটি আলিম্পিত দ্বারপথ দেখতে পেল। সেই দ্বারপথের সুবৃহৎ কপাট অর্ধনিমীলিত হয়ে রয়েছে। দ্বার ভিতর থেকে কীলকের দ্বারা সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ করা নেই, প্রত্যুত কবাটের রন্ধ্রপথ দিয়ে মৃদু মৃদু প্রদীপের আলো যেন কোনো অজ্ঞাত জগতের আভাসের মতো চুঁইয়ে চুঁইয়ে বাইরে বেরিয়ে আসছে। তবে কি এখানে কোনো গুপ্ত কক্ষ আছে? সে-কক্ষটি কি বিজন? নাকি সেই কক্ষে কেউ গোপনে বসবাস করেন?
কোভালন ভেবেছিল, যে-পথ সে আবিষ্কার করেছে, তা ধরে পাহাড়ের উপরে পূর্বানুভূত সেই শ্রমণদের গুহায় গিয়ে উপস্থিত হতে পারবে। কিন্তু তা হল না । ব্যাদিত আনন কুম্ভীরের মুখগহ্বরের মতন এই পথ দিয়ে সে শুধু একটি নিভৃত কক্ষের দ্বারে এসে উপস্থিত হল। একটা সুবিপুল রহস্যের সম্ভাবনা অঙ্কুরে বিনষ্ট হল দেখে কিছুটা হতাশ হয়ে পড়ল কোভালন। ভাবল, ফিরে যাবে।
কিন্তু ফিরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে যখনই সে ঘুরে দাঁড়াতে গেল, ঠিক তখনই কক্ষের ভিতর থেকে একটি অতি সুন্দর কণ্ঠ বেজে উঠল। কে যেন ভিতর থেকে আপনমনে বলে উঠলেন, ‘পথ মাত্রেই অনেকান্ত। এই পথও তাই; অনেকান্ত। যেকোনো দিকেই তো চলে যেতে পারে পথ। তবু কখনও কখনও কোথাও কোথাও হয়তো পথিককে ক্ষণতরে বিশ্রাম নিতেই হয়। দ্বার উন্মুক্ত আছে। ভিতরে প্রবেশ করুন!’
ভয়ে ভয়ে সন্তর্পণে দ্বারকপাট অপাবৃত করে ভিতরে প্রবেশ করে কোভালন দেখল, মৃদু দীপশিখায় আলোকিত একটি গুহাকক্ষ অপরিসর। সেই কক্ষের পাষাণ মৃত্তিকার উপরে সম্পূর্ণ নগ্ন এক পুরুষ সমংকায়শিরোগ্রীব হয়ে বসে রয়েছেন। তাঁর সম্মুখস্থ উৎপীঠিকায় লিখনসামগ্রী—তালীপত্র, মস্যাধার ও মস্যাধারে নিমজ্জিত একটি ময়ূরপুচ্ছের লেখনী—রক্ষিত আছে। নগ্ন ব্যক্তিটি সম্ভবত এতক্ষণ তালীপত্রে কিছু রচনা করছিলেন, কোভালনের পদশব্দ পেয়ে রচনাকর্মে সাময়িক বিরতি দিয়েছেন। তাঁর পাশে মেঝের উপরে ময়ূরপালকে রচিত একটি ক্ষুদ্রাকার পাখা পড়ে রয়েছে। এ ছাড়া এ কক্ষে দেখার মতো বা বর্ণনা করার মতো আর কিছুই নেই ।
ময়ূরপাখাটি তুলে নিয়ে উৎপীঠিকার পুরোবর্তী ভূভাগ মার্জনা করে সেখানে কোভালনকে বসতে ইঙ্গিত করলেন সেই নগ্ন পুরুষ। কোভালন মৃত্তিকার উপরে উপবেশন করল। এতক্ষণে ভালো করে তাঁকে দেখবার সুযোগ হল ।
এ ব্যক্তি সম্পূর্ণ উলঙ্গ, অথচ তাঁকে দেখে কোনো সংকোচ বা বিস্ময়ের ভাব জন্মাচ্ছে না কেন, সেকথাই কোভালন ভাবছিল। সহসা নগ্ন পুরুষ দেখলে দ্রষ্টার মনে বিস্ময়, লজ্জা, সংকোচ, জুগুপ্সা, ভয় প্রভৃতি মানসিক বিকার উপস্থিত হয়ে থাকে। এমনকি দ্রষ্টা নিজে যদি পুরুষও হন, তা হলেও অনুরূপ ক্ষেত্রে একই প্রকার আত্মসংকোচের ভাব জন্মায়। অথচ এঁকে দেখে সেসব কিছুই মনে হচ্ছে না তো! এ ব্যক্তির নগ্নতা যেন আলোর মতো, হাওয়ার মতো, জলের মতই স্বতঃসিদ্ধ ও স্বাভাবিক। নিজের নগ্নতা নিয়ে এ ব্যক্তি একেবারেই কুণ্ঠিত নন, সম্ভবত সেই কারণেই তাঁর নগ্নতা অপর কারও মনে কোনো কুণ্ঠার ভাব উৎপন্ন করে না। কেমন সহজভাবে তিনি কোভালনকে কক্ষের ভিতরে আহ্বান করলেন, মেঝেতে বসতে বললেন, আগন্তুক ব্যক্তি তাঁকে নগ্ন অবস্থায় দেখে বিস্মিত বা আহত বোধ করবে, এ জাতীয় কোনো চিন্তাই তাঁর মনে উদিত হল না !
পুরুষটি দীর্ঘাকার, শিরোদেশ কেশশূন্য, চোখ দুটি আয়তকৃষ্ণ ও উজ্জ্বল। ওষ্ঠাধরে শিশুর সারল্যের সঙ্গে প্রাজ্ঞ ব্যক্তির দৃঢ়তা প্রকাশ পাচ্ছে। দেহকাণ্ড বলিষ্ঠ, অথচ লালিত্যযুক্ত। দুই কাঁধ যোদ্ধার মতন উন্নত, অথচ বাহু দুটি যোগীদের মতন আজানুলম্বিত সরল। নগ্ন পুরুষ মৃত্তিকার উপর সুখাসনে উপবিষ্ট, দুটি উন্মুক্ত করতল ক্রোড়ের উপর সরলভাবে ন্যস্ত। চরণদ্বয় দীর্ঘ পন্থা-অতিক্রমণের সামর্থ্যযুক্ত, অথচ পদাঙ্গুলিসমূহ অতিশয় সুকুমার। মানুষটির মুখাবয়বে সন্ন্যাসীসুলভ নিঃস্পৃহতা ও কঠোরতার ভাব আছে, অথচ তাঁর কপাল, নাসা, চিবুক প্রভৃতি বেশ কমনীয় । তাঁর দৃষ্টিতে কেমন একটা প্রবল উৎসুকতা ও কোমল কবিত্বের ভাব ফুটে উঠছে, অথচ তাঁর দুই নয়নের তারা চঞ্চল নয়; শান্ত, স্থির, অনপেক্ষ। এক কথায় অজস্র বিপরীত গুণাবলী একই সঙ্গে তাঁর নগ্ন সর্বাঙ্গে সর্বত্র স্ফুটমান ।
কোভালন জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনার পরিচয় ? এমন স্থানে রয়েছেন কেন ?’
নগ্ন পুরুষ উত্তর দিলেন, ‘আমি দিগম্বর-মতাবলম্বী নগ্ন ক্ষপণক। এ জৈন সন্ন্যাসীদের মঠ।’
‘এখানে কি অন্যরা কেউ থাকেন ?’
‘এই পাহাড়ের ভিতরে বহুতর গুহাবাস আছে। বহু সংগুপ্ত পন্থা। অন্যান্য সাধকেরা সেসব গুহায় অবস্থান করছেন। মোট পঞ্চাশজন ক্ষপণক এখানে তপোনিরত আছেন।’
‘পঞ্চাশ? সেকী! কিন্তু আমার যে মনে হল, এ স্থান প্রায় জনশূন্য !’ কোভালন বিস্মিত হয়ে গেল ।
‘আপনার মনে হওয়ার মূল্য এখানে খুবই কম। বল্মীক-স্তূপ বাহির থেকে দেখলে কীটশূন্যই মনে হয়।…ভালো কথা, আপনার পরিচয় কী, ভদ্র ? আপনাকে দেখে তো কোনো শ্রেষ্ঠীতনয় বলে মনে হয় !’
‘আপনার অনুমান নির্ভুল। আমি শ্রেষ্ঠী মাশাত্তুবানের পুত্র কোভালন। সম্প্রতি উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটতে হাঁটতে এস্থলে এসে উপস্থিত হয়েছি।’
নগ্ন ক্ষপণক একবার অপাঙ্গদৃষ্টিতে কোভালনকে আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করলেন। তারপর বললেন, ‘আপনি কি কোনো কারণে অত্যন্ত বিচলিত দশায় আছেন? আপনার চক্ষুদ্বয় আরক্তিম, পদদ্বয় রক্তাক্ত, বেশবাস ও কেশকলাপ বিস্রস্ত। যেন কিছুদিন হল আহার-নিদ্রা সম্পূর্ণ পরিত্যাগ করে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করেছেন।’
কোভালন প্রথমে কিছু বলল না। তারপরে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ধীরে ধীরে বলল, ‘প্রতারিত হলে মানুষ বিচলিত, অসুস্থই হয়, শ্ৰমণ !’
‘নিজেকে এভাবে প্রতারণা করার কারণ কী?’ নগ্ন ক্ষপণক প্রশ্ন করলেন।
কোভালনের ভ্রূলতা কুঞ্চিত হয়ে উঠল। সে উত্তরে বলল, ‘আমি নিজেকে প্রতারণা করেছি, নাকি অন্য কেউ আমাকে প্রতারণা করেছে—কীভাবে জানলেন ?’
‘অন্য কেউ প্রতারণা করে না। মানুষ সর্বদা নিজেই নিজেকে প্রতারণা করে ।
এ কেমন কথা ! কোভালন বিস্মিত সুরে বলল, ‘সেকী! সব সময়েই কি আর মানুষ আত্মপ্রতারিত হয় ? অন্যের দ্বারাও তো প্রতারিত হতে পারে। অনেক সময়েই অন্যরা আমাদের ঠকায়।’
নগ্ন ক্ষপণক শান্ত স্বরে উত্তর দিলেন, ‘না। অন্যরা উপলক্ষ্য মাত্র। মানুষ বস্তুত নিজেই নিজেকে প্রতারণা করে থাকে। সব সময়েই তাই-ই করে।’
‘কীভাবে?’
‘যেভাবে এখানে উপস্থিত হয়ে এই স্থানটিকে আপনার প্রায় জনশূন্য মনে হয়েছে, ঠিক সেভাবেই। এখনই যদি ডাকি, পঞ্চাশজন নগ্ন ক্ষপণক এই আবসথের সম্মুখে এসে উপস্থিত হবে। তখন আপনার পূর্বের ধারণা ভেঙে যাবে। পূর্বের ধারণা বা কল্পনা ভেঙে বাস্তব সত্য প্রকাশ পেলে যদি আপনার মনে হয়, আপনি প্রতারিত হয়েছেন, তাহলে সে তো আপনারই দোষ। কল্পনাও করেছিলেন আপনিই, বাস্তব সত্য কল্পনার বিরুদ্ধতা করলে নিজেকে প্রতারিত ভাবছেন—সেও আপনিই। এর জন্য কে দায়ী? এ স্থানের নির্জনতা দায়ী? শ্রমণদের নীরবতা দায়ী? নাকি প্রয়োজন পড়লে তাদের সঙ্ঘবদ্ধভাবে আত্মপ্রকাশ করা দায়ী? অন্য কেউ দায়ী নয় । দায়ী আপনিই। কল্পনাও আপনার। বাস্তব সত্যকে মেনে নিতে না-পারার অক্ষমতাও আপনারই।’
কোভালন কিছুক্ষণ কথাগুলো নিয়ে তলিয়ে ভাবতে লাগল। তারপর গম্ভীর হয়ে বলল, ‘আপনার উদাহরণ নির্ভুল। কিন্তু এ একটি অতি সাধারণ, গুরুত্বহীন উদাহরণ। মানুষের জীবন, সুখ-দুঃখ, আশা-হতাশা—এ সমস্ত ব্যাপার আপনার প্রদত্ত উদাহরণের মতো এত সাধারণ, এত গুরুত্বহীন ব্যাপার নয়। জীবন অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার।’ ‘মানলাম। কিন্তু সে তো সকলের জন্যেই সত্য। কেবল নিজের জীবনকেই অত গুরুত্ব দেওয়ার কারণটা কী? কেবল নিজের কল্পনাকেই অতখানি মূল্য দেওয়ার প্রয়োজনই-বা কী ? এই পৃথিবীতে কত অজস্র কীট প্রতি মুহূর্তে মরছে। কত প্ৰাণী, কত মানুষ প্রতিক্ষণে যমসদনে যাচ্ছে। তাদেরও কল্পনা আছে, জীবন আছে। তাদের জীবনের থেকে আপনার জীবন কীসে অধিকতর মূল্যবান?’ নগ্ন ক্ষপণক হাসতে হাসতে বললেন । তাঁর কথায় কোভালন পুনরায় চিন্তাসমুদ্রে ডুব দিতে যাচ্ছে দেখে তিনি বললেন, ‘আচ্ছা, একটা গল্প বলি, শুনুন!’
গল্প শোনার কথা শুনে কোভালন সব চিন্তা ফেলে উদগ্রীব হয়ে বসল। ক্ষপণক বলতে লাগলেন, ‘একে আপনি গল্প বলতে পারেন, আবার অনতি-অতীতের ঘটনাস্রোতও বলতে পারেন। এরাজ্যের পশ্চিমে চেররাজ্য আছে, জানেন? ‘
—তা জানি । তবে কখনও যাওয়া হয়নি,’কোভালন বলল ।
‘হ্যাঁ। তো সেই চেররাজ্যের এক রাজা ছিলেন; নাম তাঁর ইমায়াবরম্বন নেডুম চেরালাতান। এই চেরালাতান রাজার দুই পুত্র। জ্যেষ্ঠ পুত্রের নাম শেঙ্গুখুবান আর কনিষ্ঠ পুত্রের নাম…. হ্যাঁ, কনিষ্ঠ পুত্রেরও একটা নাম ছিল বই-কী… কিন্তু সেই নামটা কালক্রমে হারিয়ে যায়…লোকের মুখে মুখে কনিষ্ঠ রাজপুত্র ‘ইলাঙ্গো’ নামেই পরিচিত হন। ‘ইলাঙ্গো’-শব্দের অর্থ হল ছোটো রাজকুমার। রাজবংশের নিয়ম অনুযায়ী রাজার দেহাবসান হলে রাজ্য বড়ো রাজকুমার শেঙ্গুথুবানেরই পাওয়ার কথা। আর সেক্ষেত্রে ছোটো রাজকুমার ইলাঙ্গো তাঁর দাদা শেঙ্গুথুবানের সভায় মন্ত্রী, সেনাপতি বা অন্য কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদ পাবেন, এমনই জানা ছিল। ইলাঙ্গো অবশ্য এসব নিয়ে আদৌ মাথা ঘামাতেন না । কাব্য, সঙ্গীত, শিল্প, ইতিহাসের চর্চাতেই তিনি অহোরাত্র ডুবে থাকতেন। রাজ্যে নিরাপত্তার অভাব ছিল না। রাজা চেরালাতন প্রবল পরাক্রমের সঙ্গে রাজ্যশাসন করছিলেন। আর তাঁর অবর্তমানে দাদা শেঙ্গুখুবীনের ছত্রছায়ায় ভাই ইলাঙ্গো রাজকীয় পরিবেশে শিল্প-সাহিত্য-সঙ্গীতের চর্চা করে চলতে পারবেন, একথা বুঝেই ইলাঙ্গো সন্তুষ্ট, নিরুদ্বিগ্ন ছিলেন। কিন্তু একদিন হল এক বিপত্তি। রাজসভায় উপস্থিত হলেন এক আগন্তুক।’
‘আগন্তুক? অতিথি-আগন্তুকের আগমনে বিপত্তি হবে কেন? তিনি কি কোনো ভিনরাজ্যের রাজদূত ছিলেন ?’
‘বলছি। না, ভিনরাজ্যের কোনো রাজদূত নন। আগন্তুক ব্যক্তি একজন প্রসিদ্ধ জ্যোতিষী। সেই জ্যোতিষী রাজার কোষ্ঠী-গণনা করে বললেন, খুব শীঘ্রই রাজার মৃত্যুযোগ আছে। এবং রাজা চেরালাতনের দেহাবসানের পরে তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র শেঙ্গুখুবান নন, রাজ্যের রাজা হবেন কনিষ্ঠ পুত্ৰ ইলাঙ্গো।’
‘কিম্ অহো!’ কোভালন ঘটনার সম্ভাব্য পরিণতি ভেবে শঙ্কিত হয়ে উঠল। ‘হ্যাঁ, ব্যাপারটা শেঙ্গুথুবানের পক্ষে মর্মঘাতী। এই ভবিষ্যদ্বাণী শুনে শেঙ্গুখুবানের রাতে ঘুম উড়ে গেল। তিনি সব সময়ে বিষণ্ন হয়ে থাকছিলেন। ছোটো ভাই ইলাঙ্গোর প্রতি সন্দেহও তাঁর মনকে অসম্ভব পীড়া দিচ্ছিল। তবে কি ইলাঙ্গো পিতার দেহাবসানের পরে দাদা শেঙ্গুথুবানকে হত্যা করে সিংহাসনে আরূঢ় হবে? দাদার মনের এই অশান্তি ইলাঙ্গো টের পেলেন। তিনি দাদাকে চিন্তামুক্ত করার জন্যে রাজ্য ত্যাগ করে চিরতরে নিরুদ্দেশে চলে গেলেন।’
চমৎকৃত কোভালন বলল, ‘ওহ্! তারপরে কী ঘটল? শেঙ্গুখুবান রাজা হলেন ?’
‘হ্যাঁ, হলেন । রাজা চেরালাতনের মৃত্যুর পরে শেঙ্গুখুবান রাজা হন।’
‘আর ইলাঙ্গো ?’
“ইলাঙ্গো দেশে দেশে ঘুরে নানা দেশের ইতিহাস, সঙ্গীতের ইতিহাস, রাজনীতি, ধর্মনীতি, সমাজনীতির তথ্য সংগ্রহ করেন। তাঁর কথা বাইরের লোকে আর বেশি জানতে পারে না।’
‘অদ্ভুত পরিণতি!’
‘সেই তো ! তাহলে ইলাঙ্গো যেভাবে তাঁর নিজের ভবিষ্যৎ কল্পনা করেছিলেন, তার সঙ্গে বাস্তব মিলল কি ?
‘না, মিলল না,’ কোভালন বলল।
‘কিন্তু মিলল না বলেই ইলাঙ্গো ভেঙে পড়লেন না। নিজেকে প্রতারিত ভাবলেন না । তিনি তো প্রথম যৌবনে ভেবেছিলেন রাজপ্রাসাদে থেকেই শিল্প-সাহিত্যের চর্চা করে নিরাপদে জীবনের বাকি দিনগুলো কাটিয়ে দেবেন। কিন্তু সাংসারিক পরিস্থিতি এমন হয়ে দাঁড়াল যে, তাঁর মতো একজন রাজপুত্রকে অবশিষ্ট জীবন পথে পথে ঘুরে বেড়াতে হল। এবং তিনি সেটা সানন্দে মেনে নিলেন। তাই বলছি, নিজের কল্পনার সঙ্গে বাস্তবের সংঘাত হলেই ভেঙে পড়ার কিছু নেই। বাস্তবের মুখোমুখি হয়েই শান্তি পাওয়া যায় ৷ অনেক সময়েই দেখা যায়, বাস্তব-জীবন মনের কল্পনার থেকেও মহত্তর হয়, সুন্দরতর হয়। তবে সুন্দরই হোক, আর অসুন্দরই হোক, বাস্তবকে স্বীকার করে নিতে পারলে তবেই জীবনের অন্য দিগন্ত খুলে যায়।’
কোভালন ঈষৎ ক্ষুণ্ন মনে বলল, ‘ইলাঙ্গোর জীবনে কোন দিগন্তই-বা আর খুলেছিল?’
‘তা খুলেছিল বই-কী ! এইভাবে দেশে দেশে ঘুরতে ঘুরতে ইলাঙ্গোর সঙ্গে সমকালের এক বড়ো কবি শিত্তলৈ শাত্তানের সঙ্গে দেখা হয়। শাত্তান তখন ইলাঙ্গোকে একটি চিত্তাকর্ষক কাহিনির আভাস দেন। সেই কাহিনির উপরে ভিত্তি করেই ইলাঙ্গো এক দীর্ঘ মহাকাব্য লিখতে আরম্ভ করেন। মহাকাব্যটির নাম শিলল্পদিকরম। সেই শিলল্পদিকরম-ই ইলাঙ্গোর জীবনের অন্য দিগন্ত,’ এই বলে নগ্ন ক্ষপণক চপল বালকের মতো মৃদু মৃদু দুষ্টুমির হাসি হাসতে লাগলেন ।
ক্ষপণকের সেই হাসির অর্থ কী, সেদিকে মনোযোগ না দিয়ে কোভালন আলোচ্য বিষয়ে নিজের মনোভাব প্রকাশ করতে আগ্রহী হল। সে বলল, ‘তা হয়তো ঠিক। কিন্তু আমার কেন জানি মনে হয়, আমি চারপাশে যা দেখছি, যা শুনছি, যা যা অভিজ্ঞতা অর্জন করছি—সবই আমার মনের কল্পনার ফল। কল্পনার বাইরে যেন কিছুই নেই। সবই স্বপ্নের মতন মনসিজ। হয়তো এটা আমার একটা অদ্ভুত জটিল চিন্তা !’
ক্ষপণক বললেন, ‘হ্যাঁ, ইদানীং এমন একটি মত হাওয়ায় ভাসছে বটে! এই মতটি বৌদ্ধদের মত। সন্ধিনিমোচন সূত্র বলে একটি গ্রন্থও রচিত হয়েছে। ওই মত অনুযায়ী, সমস্ত কিছুই ব্যক্তির মনের কল্পনা। বাস্তব বলে আসলে কিছু নেই।’
কোভালন বলল, ‘আমি কিন্তু বৌদ্ধদের ওই মতের কথা জানি না। এ আমার ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গী। সমস্তই মন থেকে বেরিয়েছে—মনের বাইরে, কল্পনার বাইরে কিছুই নেই । এমনই আমার মনে হয় কেন যেন!’
ক্ষপণক ভারি স্নেহমধুর হাসি হেসে বললেন, ‘বেশ। তাই যদি হয়, তাহলে আপনার সেই কল্পনা যখন বাধা পায়, জীবনের ঘটনা বা চরিত্রগুলি যখন আপনার কল্পনা-অনুযায়ী না হয়ে, অন্যরকম কিছু হয়ে আত্মপ্রকাশ করে, তখন আপনি তাকে কী বলবেন ?’
কোভালন উত্তর দিল, ‘যদি বলি, সেগুলোও কল্পনা?’
‘কার কল্পনা? আপনার কল্পনা যে নয়, তা তো বোঝাই যাচ্ছে। আপনি কোনো নারীকে একরকমভাবে ভেবে রাখলেন। পরে দেখা গেল, সেই নারী আপনার কল্পনা-অনুযায়ী আচরণ করল না। তাহলে সেই নারী তো আপনার কল্পনাকে অতিক্রম করে গেল। এখন যদি সেই নারী অন্য কারও দ্বারা কল্পিত হয়ে থাকে, তাহলে সেই অপর ব্যক্তিটি কে, যে ওই নারীটিকে কল্পনা করেছে ?’
“তাহলে যদি এমন বলা যায় যে, আমরা সবাই ঈশ্বরের কল্পনা…..
তাহলে বলুন, ‘ঈশ্বর কে? ঈশ্বর কার কল্পনা?’
কোভালন কোনো উত্তর না দিয়ে চুপ করে থাকল। সে মনে মনে ভাবছিল, এই জৈন ক্ষপণক কীভাবে তার জীবনের সাম্প্রতিক কিছু সমস্যার কথা ইঙ্গিত করছেন? তবে কি এঁর কোনো অত্যাশ্চর্য শক্তি আছে?
উত্তর না পেয়ে ক্ষপণক পুনরায় বলতে লাগলেন, তার থেকে এভাবেও তো ভেবে দেখতে পারেন ! ধরুন, আপনি নিজেও আসলে বাস্তব কোনো মানুষ নন। আপনি একটি মহাকাব্যের কাল্পনিক চরিত্র। আপনাকে কোনো কবি কল্পনা করে চলেছেন। শুধু আপনাকেই না, আপনার চারপাশে যারা রয়েছে, চারপাশে যা যা ঘটছে বা ঘটবে, সবই সেই কবি কল্পনা করে লিখে চলেছেন। আবার একই সঙ্গে তাঁর কাব্যের চরিত্রদেরও তিনি খানিকটা খানিকটা করে কল্পনা করার শক্তি দিয়ে রেখেছেন। আপনাকেও সেই কল্পনার শক্তি দিয়েছেন। তাই আপনি চারিপাশের ব্যক্তি বা বস্তু সম্পর্কে কিছুকিছু কল্পনা করে ফেলছেন। কিন্তু পরে ঘটনাস্রোত পালটে যাচ্ছে। তখন আপনি দেখছেন, চারিপাশের বস্তুগুলি বা ব্যক্তিবর্গ আপনার কল্পনা-মাফিক নয়। অন্যরকম। সেই অন্যরকমটাও কিন্তু সেই কবি আগে থেকেই কল্পনা করে রেখেছেন…’
শুনতে শুনতে কোভালন বিব্রত বোধ করতে লাগল। তার নিজের চিন্তা যে জটিল প্রকৃতির, সেকথা সে বিলক্ষণ জানে। কিন্তু এই ব্যক্তির চিন্তাপ্রণালী তার থেকেও জটিলতর। কী করবে কী সে এসব কথা শুনে? বিরক্ত হয়ে সে উঠে দাঁড়াল। ক্ষপণকের উদ্দেশে নমস্কার জানিয়ে বিদায় নেওয়ার জন্য ক্লান্ত পায়ে গুহাকক্ষের দ্বারপথের দিকে অগ্রসর হল।
দ্বার অতিক্রম করে চলে আসবে, এমন সময় তাকে পিছন থেকে ক্ষপণক ডাকলেন, ‘শুনুন।’
কোভালন আধেক ফিরে দাঁড়াতেই তাকে সম্পূর্ণ অবাক করে দিয়ে ক্ষপণক হেসে বললেন, ‘আপনি কন্নকীর কাছে ফিরে যান। সে আপনার অপেক্ষায় আছে। সেখান থেকেই আপনার জীবনের অন্য দিগন্ত। অন্য অধ্যায়।’
কী আশ্চর্য! এই ক্ষপণক তার স্ত্রী কন্নকীর কথা জানলেন কীভাবে?
বিস্ময়-বিমূঢ় কোভালন কিছুক্ষণ কোনো কথাই বলতে পারল না। তারপর দ্বিধাকম্পিত স্বরে কোনোমতে প্রশ্ন করল, ‘আপনি কীভাবে আমার স্ত্রীর কথা…? আসলে আপনি কে বলুন তো, মহাত্মন?’
মসীপাত্র থেকে শিখিপুচ্ছের দীর্ঘ লেখনীটি তুলে নিয়ে শান্ত কণ্ঠে উত্তর দিলেন নগ্ন ক্ষপণক, ‘তেমন কেউ না । আমার নাম ইলাঙ্গো আডিগল; আমি আপনাকে রচনা করে চলেছি।’
আবার সেই স্বপ্নটা দেখছে আজ দেবান্দী। কে একটি অল্পবয়েসি মেয়ে গভীর অন্ধকারের মধ্যে চুল খুলে বসে কাতর স্বরে বিলাপ করছে। চারিপাশের অন্ধকার পটভূমিকা প্রাচীন দীপাধারে বহুকাল ধরে সঞ্চিত অঙ্গাররেখার মতো প্রগাঢ়, মেয়েটির সিন্দূরলিপ্ত সীমন্ত অস্তাচলগামী সূর্যের প্রস্থানপন্থার মতো পরিম্লান, তার আলুলায়িত কেশকলাপ যেন শ্রাবণসন্ধ্যার ঘনায়িত মেঘপুঞ্জ। মেয়েটির ক্রন্দনরোল যেন প্রতি মুহূর্তে তমসার স্তরে স্তরে পরিব্যাপ্ত হয়ে যাচ্ছে; অনাদি কালের অগণিত দুঃখভারাতুর মেয়েদের শোক সেই বিলাপের মধ্যে মিশে আছে। কবে যে সেই বিলাপ আরম্ভ হয়েছে, কেউ জানে না। কোনোদিন সে-বিলাপ শেষ হবে, এমনও কোনো নিশ্চয়তা নেই। দেখতে দেখতে ধীরে ধীরে মেয়েটির সমস্ত অবয়ব অন্ধকারের মধ্যে লীন হয়ে যেতে লাগল। শেষে কেবল নিরবয়ব তমিস্রা ছাড়া আর কিছুই কোনোদিকে অবশিষ্ট রইল না।
তারও কিছুক্ষণ পরে সেই শূন্যতার ভিতর, সেই কাজলকালো অন্ধকারের ভিতর যেন একটি একটি করে ফুটে উঠতে লাগল আলোর পুণ্ডরীক। আলো দিয়ে গড়া সেই সব শুভ্র কমলে পা ফেলে ফেলে কে যেন আসছেন বলে মনে হল দেবান্দীর। যেন এক আলোকিত আবির্ভাব। ক্ষণপরে অবয়ব স্পষ্ট হল। দেবান্দী দেখল, কাষায় পরিহিত মুণ্ডিতমস্তক এক শ্রমণ । তাঁর পরনের গৈরিক কাষায় উজ্জ্বল আলোর সঙ্গে যেন মিশে গেছে। ভালো করে চেয়ে দেখল দেবান্দী, শ্রমণ তার অতি পরিচিত। সেই শ্রমণ দেবান্দীর গৃহপরিত্যাগী স্বামী বীরমণি ছাড়া অন্য কেউ নন।
এতদিন পরে সহসা স্বপ্নের মধ্যে বীরমণিকে দেখতে পেয়ে পতিবিচ্ছিন্না দেবান্দীর মনে প্রভূত উল্লাস উপজাত হল। কিন্তু সে-উল্লাসের প্রকাশ সহজ হল না; তখনও তার মন পূর্বদৃষ্ট বিলাপরতা মেয়েটির শোকসংবিগ্নতার দ্বারা অধিকৃত হয়ে ছিল। মনে হল, হয়তো তার স্বামী বীরমণি ক্রন্দনরতা মেয়েটির কথা বলতে পারবে। ব্যাকুল হয়ে বীরমণিকে জিজ্ঞাসা করল দেবান্দী, ‘ওই মেয়েটি কে গো ? অমন করে কাঁদছে!’
বীরমণি উত্তর দিল, ‘ওর নাম কন্নকী। বণিক মানাইক্কনের কন্যা।’
‘ও অমন বিলাপ করছে কার জন্যে?’
‘কন্নকীর বিবাহ হয়েছে মাশাতুবানপুত্র কোভালনের সঙ্গে। কোভালনের জন্যেই অমন বিলাপ করে চলেছে কন্নকী।’
‘কেন? কোভালন কি মারা গিয়েছে? তাহলে কন্নকীর সিঁথিতে সিন্দুর দেখলাম যে !’ ‘না-না, মারা যায়নি। কোভালন চলে গিয়েছে ঘর ছেড়ে। ‘
‘তোমার মতন? বিবাগী হয়ে গেছে?’
“না, দেবান্দী। বিবাগী নয়। এক নর্তকীর প্রেমে পড়েছে কোভালন। সে-প্রেমও তাদের সফল হয়নি। তবে কোভালনও ঘরে ফেরেনি আর।’
‘ও ! তাই অমন করে কাঁদছে স্বামীর জন্যে?’
‘হ্যাঁ। কন্নকী তো কোভালন ছাড়া অন্য কাউকে ভালোবাসেনি। কোভালন বিপথে গেছে জেনেও কন্নকীর ভালোবাসা কন্নকীকে ছেড়ে যায়নি। তাই কোভালনের ফিরে আসার আশায় অন্ধকারের জঠরে বসে রোজ রাতে চুল খুলে কাঁদে মেয়েটা।’
‘কোভালন ফিরবে না ?’
‘ফিরবে। খুব শীঘ্রই ফিরবে। তুমি কন্নকীর একটা উপকার করতে পারবে, দেবান্দী ?”
‘হ্যাঁ। কী করতে হবে, বলো !’
‘এ পুষ্পহার নগরীতে বণিক মাশাত্তুবানের পুত্র কোভালনকে সকলেই চেনে। তাদের আবাস-স্থলও কারও অপরিজ্ঞাত নয়। তুমি কাল প্রভাতে সন্ধান নিয়ে একবার ওদের ঘরে যাও। কন্নকীকে বলো, সে যেন আর অধিক বিলাপ না করে। কোভালন খুব শীঘ্রই ঘরে ফিরে আসবে। কন্নকী যেন কোভালনের জন্য প্রস্তুত হয়।’
‘বেশ, কাল সকাল হোক, আমি অবশ্যই কন্নকীর কাছে যাব,’ এই বলে স্বপ্নের মধ্যেই চোখ মুছল দেবান্দী। তারপর মনে হল, এতদিন পরে দেখা হল, অথচ সে এখনও বীরমণির সংবাদ নিল না। তাড়াতাড়ি উন্মুখ হয়ে দেবান্দী বলে উঠল, ‘তুমি কোথায় চলে গেলে বলো তো? কোথায় আছ? আমি যে তোমাকে কতদিন দেখিনি!’
‘কেন, শাস্তার মন্দিরে যাও না প্রত্যহ ? সেখানে পূজা দেওয়ার সময় আমাকে দেখতে পাও না?’
‘পাই। কিন্তু সে অন্যরকম দেখা। তোমাকে এখন যেভাবে দেখছি, সেভাবে দেখতে পাই না তো ! তুমি কোথায় আছ?’
‘তোমাকে যে বলেছিলাম মানুষের শোকহীন মৃত্যুহীন সত্তার কথা—তোমার মনে আছে?’
‘হ্যাঁ। মনে আছে। তোমার সব কথা মনে আছে আমার,’ দেবান্দী বলল ।
‘আমি মানুষের সেই অমরণীয় সত্তার সন্ধান পেয়েছি, দেবান্দী। তার পর থেকেই সেই এক অদ্বিতীয় সত্তার জগদ্ব্যাপী বহুধা বিচিত্র প্রকাশ দেখতে পথে পথে ঘুরে বেড়াই । নৃপতি থেকে দরিদ্র ভিক্ষুক, নারী-পুরুষ, কুমার-কুমারী, যষ্টিনির্ভর জরাগ্রস্ত বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, কীট, পতঙ্গ, বনস্পতি থেকে বীরুৎজাতীয়—সর্বত্র সেই এক সত্তারই বহিঃপ্রকাশ। পথে পথে ঘুরে ঘুরে আমি তাকেই দেখে বেড়াই।’
‘আর আমি তোমাকে দেখতে পাব কবে? তুমি যে বলেছিলে, আমার সময় হলে, আমাকেও তোমার পথে নেবে। কোন পথের ধারে আবার মিলন হবে আমাদের ?’
‘তোমার তো এখনও সময় হয়নি, দেবান্দী। সময় হলে আমি নিজেই তোমাকে নিয়ে আসব এই পথে।’
‘তবু তোমার কুশল-সংবাদের জন্যে আমার প্রাণ যে ব্যাকুল হয়! তুমি আমাকে তোমার কুশল-সংবাদ পাঠাবে মধ্যে মধ্যে, কথা দাও ৷
‘আচ্ছা, বেশ, কথা দিলাম। আমি তো এক স্থানে বেশি দিন থাকি না, দেবান্দী। তবু আমি তোমাকে সংবাদ পাঠাব। এই কন্নকী-কোভালনকেই খুব শীঘ্রই গৃহত্যাগ করে পথে নামতে হবে। ওদের সঙ্গে আমার দেখা হবে। আমি ওদের হাত দিয়ে বিশেষ উপায়ে তোমার কাছে সংবাদ প্রেরণ করব।’
বলতে বলতে মৃদু হাসল বীরমণি। দেবান্দীর মাথায়, চিবুকে হাত রেখে আগের মতোই আদর করল। আশ্বস্ত করল দেবান্দীকে। তারপর আলোর ঢেউয়ের মধ্যে চিহ্নহীনভাবে মিলিয়ে গেল।
ঘুম ভেঙে গেল দেবান্দীর। আজ তার মন যেন আলোর তরঙ্গে ভরে আছে। অথচ তার চোখ দুটিতে টলমল করছে অশ্রুজলরেখা ।
সেদিন প্রাতঃকালে শাস্তার মন্দিরে পূজা দিয়ে ফিরবার পথে পরিচিত লোকমধ্যে কোভালনগৃহের অন্বেষণ করতে লাগল দেবান্দী। খুব বেশি অন্বেষণ করতেও হল না । মাশাত্তুবানতনয় কোভালনের গৃহের পথনির্দেশ পেয়ে গেল সে লোকমুখে।
কোভালনের গৃহে উপস্থিত হয়ে দেবান্দী দেখল, একটি অতিশয় সুশ্রী বধূ গৃহ-প্রাঙ্গণে ধান, পুষ্পরেণু ও মাঙ্গলিক অরুগু তৃণ ছড়াচ্ছে। মেয়েটিকে দেখেই দেবান্দী চিনতে পারল। আশ্চর্য! এ যে তার সেই স্বপ্নদৃষ্ট কন্যা। এখন অবশ্য স্নান সেরে সে সম্বতবাস ও বদ্ধকবরী সুন্দরী। তবু এরই মধ্যে মেয়েটির রাতজাগা অরুণবর্ণ চক্ষু, ব্যাকুল নয়নের দৃষ্টি তার অন্তরের ব্যথাকে ফুটিয়ে তুলছে।
দেবান্দীকে দেখে মেয়েটি অভিবাদন জানিয়ে প্রশ্ন করল, ‘আপনি কে, মা?’
দেবান্দী হেসে উত্তর দিল, ‘আমার নাম দেবান্দী। কাল রাতে স্বপ্নাদেশ পেয়ে আমি তোমার কাছে এসেছি। তুমি কি কন্নকী? কোভালনজায়া ?’
মেয়েটি বিষণ্ণ হেসে বলল, ‘হ্যাঁ, মা। আমিই কন্নকী। আপনি স্বপ্নে কী প্রত্যাদেশ পেয়েছেন? গৃহের ভিতরে এসে আমাকে বিস্তারিত বলুন।’
তখন দেবান্দী এ গৃহের অন্দরমহলে কন্নকীর দ্বারা আপ্যায়িত হয়ে ধীরে ধীরে তার স্বপ্নলব্ধ অভিজ্ঞতা নিবেদন করল। তবে স্বপ্নের মধ্যে সে যে তার স্বামী বীরমণির দর্শন পেয়েছিল, তার বিস্তারিত বর্ণনা করল না। শুধু বলল, এক দেবপ্রতিম ব্যক্তি স্বপ্নের মধ্যে এসে বলেছেন, কন্নকীর স্বামী কোভালন শীঘ্রই গৃহে ফিরে আসবে। কন্নকী যেন আর
অধিক বিলাপ না করে। এই বার্তা সেই দেবমানব আজ প্রভাতেই কন্নকীর কাছে পৌঁছে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। সেই জন্যেই দেবান্দী কন্নকীর কাছে এসেছে।
দেবান্দীর কথায় কন্নকী সবিশেষ আশ্বস্ত হল। তার চোখে-মুখে শান্তির ভাব ফুটে উঠল। কিন্তু ক্ষণপরেই আবার বিষাদমেঘে যেন ঢেকে গেল মেয়েটির মুখ। কী যেন ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলল কন্নকী ।
দেবান্দী জিজ্ঞাসা করল, ‘কী হল, মা? কোনো কারণে কি ব্যথা পেলে আমার কথায় ? আমি তো বললাম, তোমার স্বামী তোমার কাছেই ফিরে আসবেন।’
এ কথার উত্তরে কন্নকী প্রথমে কিছু বলতে পারল না। তারপর দেবান্দীর পীড়াপীড়িতে নিজের অবরুদ্ধ আবেগ সে প্রকাশ করল। কন্নকী কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘আমার স্বামী ফিরে এলেও আমার নিদারুণ কষ্টের উপশম হবে বলে আমার মনে হয় না, মা ! আমিও কাল রাতে এক ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন দেখেছি। কোনো এক প্রাচীন নগরীর জনাকীর্ণ পথে আমি আর আমার স্বামী হাত ধরাধরি করে যেন পাশাপাশি হেঁটে চলেছি। তারপর কী যেন হল… ভালো বুঝতে পারলাম না… সেই নগরীর কিছু মানুষ আমার স্বামীকে একটা বিশ্রী কোনো অপবাদ দিল… সেই মিথ্যা অপবাদে আমার স্বামী কোভালন অভিযুক্ত হলেন… আমি খুব কাঁদছি যেন… যেন একটা বৃশ্চিক আমাকে দংশন করেছে… আমি রাজসভায় উপস্থিত হয়ে সেই নগরীকে যেন অভিশাপ দিচ্ছি… তারপর কী যে হল…. আর কিছুই মনে নেই…’
দেবান্দী তার আঁচলের প্রান্তে কন্নকীর চোখ মুছিয়ে দিতে দিতে বলল, ‘কেঁদো না, মা ! সব স্বপ্ন সত্যি হয় না। এসব তোমার উদ্বিগ্ন মনের স্বপ্ন। তা ছাড়া আর কিছু নয়। এর কোনো সারবত্তা নেই। তোমার স্বামী ঠিকই তোমার কাছে ফিরে আসবেন। সুখের সংসার হবে তোমার, দেখো !’
কন্নকী অশ্রুপরিপ্লুত কণ্ঠে বলল, ‘তবে আমার কেন এত কষ্ট, মা? সব থেকে ও আমার কেন কিছুই নেই ?
দেবান্দী উত্তর দিল, ‘এ হয়তো তোমার পূর্বজন্মের কোনো কর্মফল। হয়তো বিগত কোনো জন্মে তুমি কোনো ব্রতপালনের প্রতিজ্ঞা করেছিলে; কোনো কারণে তা সম্পন্ন করে উঠতে পারোনি। সেই অসমাপ্ত ব্রতই তোমাকে হয়তো এ জন্মে এত কষ্ট দিচ্ছে।’
‘এই অসমাপ্ত কর্মের ফল কি কাটবে না?’ কন্নকী ব্যাকুল হয়ে উঠল।
‘কেন কাটবে না? কর্মের দ্বারাই কর্মের ফল কাটে, এমনও তো লোকে বলে। শোনো, কাবেরী যেখানে সমুদ্রে মিলেছে, সেই সাগরসঙ্গমে এক অতি পুণ্যক্ষেত্র আছে। সেখানে নেইথাল* ফুলে ভরা দুটি বড়ো বড়ো সরোবর আছে। সূর্যকুণ্ড আর সোমকুণ্ড। সেই কুণ্ড দুটিতে স্নান করে উঠে যদি কোনো মেয়ে সরোবরতীরে কামদেবের মন্দিরে পূজা দিয়ে দেবতার কাছে নিজের সর্বস্ব সমর্পণ করে দেয়, তাহলে স্বয়ং কামদেবের আশীর্বাদেই মেয়েটি চিরকাল স্বামীসোহাগিনী হয় ও জীবনান্তে স্বর্গসুখ লাভ করে। যাবে সেখানে? চলো, আমিও তোমার সঙ্গে যাব।’
একথা শুনে কন্নকী কিন্তু বলল, ‘না, মা। সেখানে আমি যেতে পারব না । হোন তিনি দেবতা বা গন্ধর্ব বা কিন্নর। তবু আমার স্বামী ছাড়া অন্য কাউকেই আমি আমার দেহ-মন-ইচ্ছা সঁপে দিতে পারব না। তাতে যত কষ্ট হয় হোক।’
দেবান্দীর মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। এমন ঐকান্তিকতা দেখে মুগ্ধ হল দেবান্দী। আহা, এমন মেয়ের ভালোবাসা তুচ্ছ করে কোভালন কি না অন্যত্র গিয়েছে ! হতভাগ্য কোভালন!
করাঙ্গুলি দিয়ে কন্নকীর ওষ্ঠপুট স্পর্শ করে অতি স্নেহকোমল স্বরে দেবান্দী বলল, ‘তোমার জয় হোক, মা! জয় হোক তোমার ভালোবাসার! তোমার এই জেদ, তোমার এই জোরই তোমার বিপথগামী স্বামীকে তোমার কাছে ফিরিয়ে আনবে। তোমার ভালোবাসায় যে-জোর আছে, কোনো স্বপনেরই সেই জোর নেই। তুমি তোমার স্বামীকে ফিরে পাবে। আর কান্নাকাটি কোরো না। কোভালন গৃহে ফিরে আসবেন শীঘ্রই । তখন কিন্তু স্বামীসুখ পেয়ে এই অভাগিনী দেবান্দীকে ভুলে যেও না, মা!
স্বামীসুখের কথা শুনে কন্নকী লজ্জা পেল। লজ্জারুণ মুখে সে উঠে দাঁড়িয়ে দেবান্দীর চরণ স্পর্শ করে আনত প্রণাম জানাল ।
মৌসুমপর্বে অবিরত ঝর্ঝরধারায় বারিপাত হয়ে চলেছে। এ এমন এক স্থান যেখানে চোলরাজ্যের শেষ এবং চেররাজ্যের সবেমাত্র আরম্ভ। দুই রাজ্যের মধ্যবর্তী এই পার্বত্য উপত্যকায় সুগভীর বনস্থলী, তারই ভিতর লুক্কায়িত এক প্রাচীন শিবক্ষেত্র। এখানে এসে পড়েছে কোভালন কিয়দ্দিবস হল । আপাতত এ শিবক্ষেত্রের এক জীর্ণ অতিথিশালার ভূশয্যায় সে আলস্যভরে পড়ে আছে।
একটি মাত্র ব্রাহ্মণ পরিবার এ শিবক্ষেত্রে বসবাস করেন, তাঁরাই নিত্য শিবপূজা করে থাকেন। অতিথিশালা নামমাত্র; বহু শতাব্দী পূর্বে হয়তো এ স্থানের জৌলুস ছিল, তীর্থের আকর্ষণে পুণ্যকামী মানুষ এখানে আসতেন। কিন্তু সেসব স্মরণাতীত কাল পূর্বের কথা । এখন সে-গৌরব নির্বাপিত, এখানে এখন আর কেউ আসেন বলে মনে হয় না। ফলত অতিথিশালাটিরও জরাজীর্ণ দশা। জলজঙ্গলের মধ্যে এই একটি বংশকঙ্কালপ্রকট কুটির কোনোমতে দাঁড়িয়ে আছে। অন্য উপায় না দেখে কোভালন এই পরিত্যক্ত কুটিরেই আশ্রয় নিয়েছে।ব্রাহ্মণকুল চেররাজ্যের নামমাত্র অনুগ্রহভোগী, দীর্ঘকাল তাঁরা অতিথিসেবার সুযোগ পাননি, কোভালনকে পেয়ে তাই সাতিশয় আহ্লাদিত। যদিও অত্রস্থলে কোভালনের কাছ থেকে ব্রাহ্মণগণ কিছু আশা করেন না, তবু যৎসামান্য সঞ্চয় থেকে কোভালন তাঁদের সাধ্যমতো দক্ষিণা দিয়েছে। কোভালনের জন্য প্রত্যহ তাঁরা সিধা প্রেরণ করছেন; কোভালন স্বপাক আহার করে ।
বাতায়নপথে অবিশ্রান্ত বৃষ্টির দিকে শূন্য চোখে তাকিয়ে আছে কোভালন। ওদিকে দেখার মতো কিছুই নেই; বৃষ্টির উত্তরীয় এখন আর স্বচ্ছ নয়, প্রবল বারিপাতের ফলে তা অনচ্ছ আবরণে প্রকৃতির সমস্ত শ্যামলিমাকে ঢেকে ফেলেছে। এতাদৃশ নৈসর্গিক কারণে দৃষ্টি অবরুদ্ধ হয়ে থাকায় কোভালন দেখে চলেছে তার নিজ মনের ছবি—কল্পনার নিপীড়ন, বাস্তবের প্রত্যাঘাত, অভিমানের তঞ্চকতা, বাসনার শ্বাসাবরোধ। সর্বোপরি এই কিছুদিন পূর্বে যে জৈন শ্রমণের সঙ্গে দেখা হল, সেই সাক্ষাৎকারের অভিজ্ঞতা তার মনে দুর্বোধ্য এক প্রহেলিকার মতো এখনও তাকে বিস্ময়বিমূঢ় করে রেখেছে। ক্ষপণকের প্রতি এক তীব্র আকর্ষণ এখনও সে অনুভব করছে।
আকর্ষণ নানা মানুষের প্রতি কম তো কিছু অনুভব করেনি কোভালন তার যাপিত আয়ুষ্কালে। বাল্যে সখাদিগের প্রতি আকর্ষণ কম কি ছিল? ক্রীড়াসক্ত বালক কোভালন সমবয়স্ক বালকদের সঙ্গ পরিত্যাগ করে এক দণ্ডও অবস্থান করত না। যৌবনে সমবয়স্ক যুবক বন্ধুদের সাহচর্য তাকে কত না আনন্দ দিয়েছে! সেসব যুবাসঙ্গ ছিল কবিতার মাধুর্যময় আকর্ষণের উপাদান ৷ প্রণয়ের আকর্ষণে সে নারীসঙ্গ কামনা করেছে; কখনও কন্নকীর প্রতি, কখনও মাধবীর প্রতি। সেই সঙ্গকামনার সঙ্গে মিশে গেছে তার মনের আসঙ্গকামনা। কিন্তু নির্জন গুহাবাসে দৃষ্ট জৈন ক্ষপণকের প্রতি যে-আকর্ষণ সে এখন অনুভব করছে, তার কাছে অন্যান্য আকর্ষণ—বন্ধুদের প্রতি টান, কবিতার প্রতি টান, নারীর প্রতি টান—সমস্তই বিস্বাদ, পানসে মনে হচ্ছে। বহু বছর আগে কিশোরবেলায় কাবেরীতীরের এক বৃক্ষতলে সেই যে এক ছিন্ন বস্ত্র, ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত, উন্মাদপ্রায় মানুষের সাক্ষাৎ পেয়েছিল কোভালন, একমাত্র সেই মানুষটির প্রতি তার যে-আকর্ষণ হয়েছিল, কেবল তারই সঙ্গে এই জৈন সাধকের প্রতি টানের কিছুটা হলেও তুলনা করা যায় ৷ কোভালন নিজেকে প্রশ্ন করেছে, কেন এই জৈন সাধকের প্রতি তার এতটা আকর্ষণ অনুভূত হচ্ছে? সে কি মানুষটির সংসারবিবিক্ত জীবনযাত্রার জন্য? সমাজরীতিকে অগ্রাহ্য করে তাঁর ওই নগ্নদেহে অবস্থানের জন্য? লোকটির ত্যাগপূত জীবনের জন্য? রহস্যময় গুহায় মানুষটি একপ্রকার লুক্কায়িত হয়ে আছেন—সেই জন্য? অথবা সমস্ত কিছু পরিত্যাগ করা সত্ত্বেও মানুষটি এখনও কাব্যরচনা পরিত্যাগ করেননি—সেই দুর্লভ চরিত্রবৈশিষ্ট্যের জন্য? কিংবা, মানুষটির প্রেমপূর্ণ, বুদ্ধিদীপ্ত, রহস্যময় আলাপকুশলতাই তাঁর প্রতি আকর্ষণের হেতু?
এতাদৃশ প্রতিটি প্রশ্নেরই নেতিবাচক উত্তর পেয়েছে কোভালন। এর কোনোটিই ক্ষপণকের প্রতি তার আকর্ষণের প্রত্যক্ষ হেতু হতে পারে না। কোভালন ভেবে ভেবে দেখেছে এই ক-দিনে, আসলে ক্ষপণকের কাছে এমন কিছু আছে, যার সংবাদ সে আজ অবধি কখনও পায়নি। সেই অজ্ঞাতপূর্ব বস্তুটি হচ্ছে ক্ষপণকের জ্ঞান, ক্ষপণকের প্রজ্ঞা । সেই জ্ঞান, সেই প্রজ্ঞা এমন একটা ভুবনের ইঙ্গিত দিচ্ছে, যে-ভুবনে কখনও পা রাখেনি কোভালন অদ্যাবধি। সেই প্রজ্ঞা, সেই জ্ঞান এমন একপ্রকার উত্তেজক সুরা পরিবেশনের প্রস্তাব দিচ্ছে, যে-সুরায় পরিপূর্ণ পানপাত্র সে কখনও ওষ্ঠাধরে স্পর্শ করেনি। সেই বোধি, সেই লোকোত্তর অনুভব এমন এক সুরসুন্দরীর দিকে ইশারা করছে, যার রূপমাধুরী কোভালন আজ অবধি কখনও প্রত্যক্ষই করেনি। সেই অদৃষ্টপূর্ব, অশ্রুতপূর্ব, অননুভূতপূর্ব জ্ঞানই ক্ষপণকের প্রতি কোভালনের আকর্ষণের মুখ্য কারণ। কিন্তু এত আকর্ষণ, এত টান উদ্ভূত হওয়া সত্ত্বেও সে দীর্ঘক্ষণ ক্ষপণকসঙ্গে থাকতে পারল না। কোভালনের পূর্বার্জিত সংস্কার ও তদনুপাতী অহংকার ক্ষপণকের প্রতি তার মনকে বিরূপ, বিরক্ত করে তুলল। সে চলে এল সেই নির্জন গুহা পরিত্যাগ করে। আরও কিছুক্ষণ থাকলে কী হত, বলা যায় না।
বিশেষত, ওই যে এক অদ্ভুত কথা—ওই কথাটাই কোভালনের মনে যাবতীয় অস্বস্তির জন্ম দিল। ক্ষপণক বলছিলেন, তিনিই নাকি ইলাঙ্গো আডিগল ! সত্যি নাকি? এবং তিনি একটি মহাকাব্য প্রণয়ন করে চলেছেন, যে-মহাকাব্যের মধ্য দিয়ে তিনি কোভালনকে রচনা করছেন, কোভালনকে সৃষ্টি করছেন। অর্থাৎ, কোভালন নাকি তাঁর রচিত একটি চরিত্র ছাড়া আর কিছুই নয়। শুধু কোভালনই নয়, কোভালনের জীবনে যা যা ঘটেছে, ঘটছে, ঘটবে—সবই নাকি তাঁরই রচনা। অর্থাৎ কোভালন ওই নগ্ন ক্ষপণকেরই চিত্ত-সমুদ্ভূত কল্পনা, আর কিছু নয়। কী উদ্ভট কথা! তার মানে কোভালনের নিজের কোনো বাস্তব অস্তিত্বই নেই? তার ইচ্ছা, কাম, ক্ষুধা, অহমিকা, বিষাদ—সমস্তই ক্ষপণকের দ্বারা কল্পিত ? নিজের স্বতন্ত্র বাস্তব অস্তিত্ব নেই—এর থেকে বড়ো অস্বস্তিকর চিন্তা আর কী হতে পারে? জীবনে এই প্রথম কোভালনের মনে হচ্ছে, কল্পনা জিনিসটা নিতান্তই বিরক্তিকর, বিস্বাদ। এতদিন সে অন্য ব্যক্তিবর্গ বা বস্তুনিচয়কে নিজের কল্পনার বহিঃপ্রক্ষেপ বলে মনে করত। এখন কেউ এসে বলছেন যে, সে কোভালন—সে নিজেই আসলে ওই ব্যক্তির কল্পনা ছাড়া আর কিছু নয়। এই কথা যদি সত্যি হয়, তাহলে তার থেকে অধিক অপমানজনক বিষয় আর কিছুই হতে পারে না। সে কোভালন—সে কি তাহলে ইলাঙ্গো আডিগলের মস্তিষ্কের ভিতরে বয়ে চলা একটা স্নায়ুতরঙ্গ মাত্র? তাহলে তো তার আর নিজের করার কিছুই নেই। নিশ্চেষ্ট হয়ে শুয়ে থাকুক। কিন্তু সে যদি নিশ্চেষ্ট হয়ে শুয়েও থাকে, তবে তার এই ‘শুয়ে থাকা’-ও ওই ক্ষপণকেরই কল্পনা। সে যদি উঠে বসে, যদি উঠে দাঁড়ায়, তবে সেই উত্থানও ক্ষপণকই কল্পনা করে চলেছেন। তার শোয়া, বসা, উঠে দাঁড়ানো, হাঁটা, ছোটা, থেমে যাওয়া—সমস্তই ক্ষপণকের কল্পনা।
না, না, না, এ কক্ষনো হতে পারে না। কোভালনের মন ভেতর থেকে একেবারে বিদ্রোহভরে হইহই করে উঠল। না, না, না, এ আমি কিছুতেই মানব না। আমি মাশাত্ত্ববানপুত্র কোভালন, আমার বাস্তব অস্তিত্ব আছে। আমি কন্নকীপতি কোভালন, আমার বাস্তব চাওয়াপাওয়া আছে। আমি মাধবী-অধর-মধুপ কোভালন, আমার বাস্তব কামনা, কামনার বাস্তব উপাদান, বাস্তব পরিতৃপ্তি আছে। আমি কাব্যনিকুঞ্জের মধুপানম গুঞ্জরমাণ ভ্রমরস্বরূপ কবি কোভালন, আমার কবিতার অবিশ্বাস্য শক্তি আছে। ওই নগ্ন ক্ষপণকের নিজস্ব কল্পনার ফলাফল হতে আমার বয়েই গেছে।
কোভালনের মন বাস্তবনিষ্ঠ হয়ে উঠবার জন্যে প্রাণপণে চেষ্টা করতে লাগল ৷ সমস্ত ব্যাপারটাকে উলটে দেবার প্রাণান্ত প্রয়াস করতে লাগল। সে মনে মনে বলে উঠল, নিশ্চয়ই ওই নগ্ন ক্ষপণক বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেছেন। নির্জনে দীর্ঘকাল থাকতে থাকতে ওঁর মস্তিষ্কবিকৃতি ঘটেছে। কোত্থেকে কোন এক ইলাঙ্গো আডিগলের কাহিনি সংগ্রহ করে নিজেকে সেই রাজ্যপরিত্যাগী রাজপুত্র বলে ভেবে চলেছেন। অমন নির্জন জায়গায় লোকসঙ্গরহিত হয়ে অহোরাত্র থাকলে এমনিতেই মাথার ব্যারাম হওয়া স্বাভাবিক! তার উপরে কিনা ওই উদ্ভট কল্পনা! পুথিতে কী জানি কীসব লিখছেন, আর পুথির সেই কাহিনিই হচ্ছে কোভালনের জীবন ! কোভালনের মন একবার ক্ষপণকের বক্তব্যের অনুকূলে
চিন্তা করছিল, বারবার সে মুখ তুলে অতিথিশালার এই ঘর, বাতায়নপথে দৃষ্ট অশ্রান্ত বারিধারা, কক্ষের ভিতর চারিপাশের বস্তুনিচয় দেখছিল, নিজের এই হস্ত-পদ-জানুউদর-বক্ষ স্পর্শ করছিল আর ভাবছিল, এ সমস্তই কি তাহলে সেই ক্ষপণক কল্পনা করে চলেছেন? এসব বাস্তব নয়? আবার পরমুহূর্তেই এতাদৃশ অত্যদ্ভুত চিন্তাকে তিরস্কার করে তার বিরুদ্ধে যুক্তি সাজাচ্ছিল। এইভাবে মানসিক দোলাচলের মধ্য দিয়ে যেতে যেতে শেষে কোভালন একেবারে স্থিরনিশ্চয় করে ছাড়ল যে, ক্ষপণক ভুল বলছেন। সে নিজে এবং এই সমস্ত বস্তুনিচয় প্রকৃতই বাস্তব; এসব কখনোই ক্ষপণকের কল্পনা নয় । কারও কল্পনা হতে পারে না। এই সমস্তই প্রখর, প্রবল, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বাস্তব!
এইভাবে ভাবতে ভাবতে সে যে আসলে একপ্রকার ভুল থেকে আরও গভীরতর ভ্রান্তির মধ্যে প্রবেশ করছিল, তা একেবারেই বুঝতে পারছিল না কোভালন। ‘বস্তু’ ও ‘ভাব’, ‘বাস্তব’ও ‘কল্পনা’—উভয়ই যে বিমূর্ত ধারণা মাত্র—সেকথা সে বুঝতে পারল না। মানুষ গাছ দেখেছে, বৃষ্টি দেখেছে, ঘর দেখেছে, ঘরের সামগ্রীগুলিকে দেখেছে, শরীর দেখেছে। ‘বস্তু’ কেউ দেখেনি। ‘বস্তু’আসলে একটি মানসিক ধারণা মাত্র। আসলে একটিই জিনিসকে ‘বস্তু’ অথবা ‘ভাব’ইত্যাকার পরিভাষায় চিহ্নিত করে থাকে মানুষ । কিন্তু যাকে মানুষ ‘বস্তু’-সংজ্ঞায় বা ‘ভাব’-সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করে থাকে, সেটি যে আসলে ঠিক কী, মানুষ তা জানে না ।
সে যাই হোক, এত কিছু চিন্তার পরেও, ক্ষপণকের সমস্ত চিন্তার ঐশ্বর্যকে নস্যাৎ করে দেওয়ার পরেও কোভালনের মনের মধ্যে ক্ষপণকের শেষ কথাটা যেন দূরাগত কোনো প্রাচীন দেবালয়ের আরতিঘণ্টার মতো ক্ষণে ক্ষণে বেজে উঠতে লাগল। ‘আপনি কন্নকীর কাছে ফিরে যান। সে আপনার অপেক্ষায় আছে ।… কন্নকীর কাছে যান। কন্নকী অপেক্ষায় আছে।’
কোভালন ভূশয্যা থেকে উঠে বসল। তার মনে হল, অনেক হয়েছে। এখন সে সবকিছু ভুলে গিয়ে কন্নকীর কাছেই ফিরে যাবে। পাঁচজন স্বাভাবিক মানুষ যে সহজ, সরল, রক্তমাংসল জীবন যাপন করে, এখন থেকে সেই জীবনই সে যাপন করবে। নিতান্ত অবিশিষ্ট সরল আটপৌরে জীবন হবে তার। পুষ্পহারে ফিরে যাবে সে; ব্যবসাবাণিজ্য বিষয়কর্মে সে আশিরনখর ডুবে যাবে এখন থেকে। কবিতা, কল্পনা, মাধবী, ক্ষপণক—অনেক অনেক হল। এসব এবার থাক। সে এখন থেকে পরিমাপযোগ্য বাস্তব হয়ে উঠবে। হ্যাঁ, এবার সে প্রখরভাবে বস্তুনিষ্ঠ হয়ে উঠবে। অর্থাৎ, সে নিরেট ওজনদার বস্তু হয়ে উঠবে।
হায় কোভালন! তেমন কেউ হতে পারেনি কখনও ।
সে আমরা যতই ‘হায়, হায়’ করি না কেন, কোভালন কিন্তু তার নবলব্ধ সিদ্ধান্তে বদ্ধপরিকর হয়ে উঠল। বৃষ্টি থামার অপেক্ষা করতে লাগল সে। একবার এই বর্ষণ সম্বৃত হলেই সে পুষ্পহারের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়বে, মনস্থির করল।
কিন্তু ফিরব বললেই ফেরা হয় না। তিনদিন পর বৃষ্টি স্থগিত হলে, আশ্রয়দাতা ব্রাহ্মণ-পরিবারটির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যখন পথে নামল কোভালন, তখন বুঝতে পারল, ফেরার পথ খুঁজে বের করা কত কঠিন। এখানে সে এসেছিল নানা পথ ঘুরে। উদ্দেশ্যবিহীনভাবে উদ্ভ্রান্ত মনে চলতে চলতে সে এখানে এসে পৌঁছেছিল। ফিরে যাবে ভেবে তো সে এখানে আসেনি। তাই কোনো পথচিহ্নও স্মৃতিতে ধরে রাখার চেষ্টা করেনি সে চলতে চলতে। এখন এই পথ তার কাছে সম্পূর্ণ নতুন, সম্পূর্ণ অজানারূপে পায়ের তলায় অসাড় হয়ে পড়ে রয়েছে। এখন একে-ওকে জিজ্ঞাসা করে পুষ্পহার নগরীর পথান্বেষণ করতে হবে তাকে। লোকমুখে সেই পথনির্দেশ বারংবার শুধাতে শুধাতে কত গিরি, কত দরী, কত অরণ্য, কানন, পর্বত, কৃষিক্ষেত্র পেরিয়ে পেরিয়ে কোভালন পুষ্পহারের সমীপবর্তী হতে লাগল।
এইভাবে প্রায় এক পক্ষকাল চলতে চলতে বহু পথ অতিক্রম করে একটি ক্ষুদ্র বনভূমিতে এসে পৌঁছল কোভালন। এই বন তেমন ঘন নয়, গাছের ফাঁক দিয়ে সূর্যের নরম আলো, নদীর ঝুরুঝুরু বাতাস এসে গায়ে লাগছিল। এ বাতাসের স্পর্শ কোভালনের আজন্ম পরিচিত, কাবেরীর নিঃশ্বাস ছাড়া এত মধুস্পর্শ কোনো নদীরই শ্বাসবায়ুতে পাওয়া সম্ভব নয়। কোভালন বুঝতে পারছিল, বনটুকু পেরোলেই কাবেরীর তটভূমি এসে পড়বে। বনের মধ্য দিয়ে পায়ে-চলা মাটির পথ; এ পথ এত সাদা, এত নির্মল, এত কোমল যে এই পথের উপর শুয়ে খানিকক্ষণ নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে নেওয়া যায়—মায়ের কোলে যেমন পরম নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ে শিশু। কিন্তু বনভূমি অতিক্রম করলেই কাবেরীর বিস্তার দেখতে পাবে ভেবে কোভালন কোথাও বিশ্রাম নিল না। ধীরে ধীরে প্রভাত মধ্যাহ্নের দিকে চলেছে, কোভালনও পথশ্রান্তিকে গ্রাহ্য না করে বনপথ ধরে সম্মুখে অগ্রসর হচ্ছে, এমন সময়ে তার সঙ্গে আরেকজন পথিকের দেখা হল।
সেই মানুষটি বনের অন্য কোনো দিক দিয়ে প্রসারিত আরেকটি বনপথ ধরে এগিয়ে আসছিল। বনের মধ্যে দুটি মাটির পথ একত্রে এসে মিলেছে। দুই পথের মিলনবিন্দুতে সেই অন্য মানুষটির সঙ্গে কোভালনের দেখা হল।
মাঝবয়েসি লোকটির নাম ইরাইম্মান। ঈষৎ স্থূল, খর্বাকৃতি চেহারা। পরনে একটি মলিন বস্ত্র, ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত। গায়ের রং একসময় সুগৌর ছিল, কিন্তু রৌদ্রে পুড়ে জলে ভিজে এখন তাম্রাভ বর্ণ ধারণ করেছে। মাথার চুল উসকোখুসকো। পিঠে একটা ভারী ঝাঁকা নিয়ে সে পথ চলছিল। আলাপ-পরিচয় হতে বোঝা গেল, ইরাইম্মান চেরদেশের বাসিন্দা। তার ভাষা ভিন্ন; মালয়ালম । কিন্তু প্রাচীন মালয়ালম ও প্রাচীন তামিল ভাষার ভিতর বহুতর সাদৃশ্য ও বহু শব্দসাম্য থাকাতে তার কথা বুঝতে কোভালনের তেমন অসুবিধে হচ্ছিল না।
ইরাইম্মান গ্রামে গ্রামে ঘুরে ঘুরে পিঠা বিক্রয় করে গ্রাসাচ্ছাদন করে থাকে। পিষ্টক-রন্ধন ও পিষ্টক-বিপণনই তার পেশা। পৃষ্ঠদেশের ঝাঁকাতে পিষ্টক প্রস্তুতির জন্য প্রয়োজনীয়
সামগ্রী—একটি মৃতখনিত্র, চকমকি পাথর, হণ্ডী, দর্বী, গুড়, চাউলের গুঁড়া, তিলের চূর্ণ, নারিকেলের ছাঁই প্রভৃতি আছে। এই সব নিয়ে গ্রামের হাটে বা পথে পথে সে ঘোরে। ক্রেতার দর্শন পেলে সে কোনো একটা স্থানে বসে পড়ে পিষ্টক বানিয়ে বিক্রয় করে। এই বনভূমির পশ্চিমে একটি গ্রামে গতকাল পিঠা বিক্রয় করে সে মূল্যের অতিরিক্ত কয়েক মুষ্টি সুগন্ধি চাউল পেয়েছে। তার নিজের সম্বল এতই কম; কিন্তু তা সত্ত্বেও সে কোভালনকে বারবার আজ দ্বিপ্রহরে তার সঙ্গে ভোজন করার জন্য পীড়াপীড়ি করতে লাগল।*
বনপথ সমাপ্ত হয়ে গেল একসময়, কাবেরীর শুভ্র তটভাগ এসে উপস্থিত হল। কোভালন দেখল, আবাল্য পরিচিত নদী কাবেরী তার আদিগন্ত বিস্তার নিয়ে মৃদুমন্দ গমনে সমুদ্রের উদ্দেশে চলেছে। বিস্তৃত ধূসর জলরাশির উপর মধ্যাহ্ন তপনের তেজ এসে পড়ে জলতলের অনেকখানি আনন্দোল্লসিত কপোলের মতন রজতোজ্জ্বল হয়ে রয়েছে। পরপারে জনপদের চিহ্ন-সব এ পার থেকে অতি ক্ষুদ্র শিশুতোষ ক্রীড়নকের মতন দেখাচ্ছে। নদীর উপর দিয়ে গগনবিহারী চিল মন্থর বেগে উড়ে চলেছে মীন শিকারের সন্ধানে।
ইরাইম্মান নদী দেখে বড়োই প্রফুল্ল। এখানেই সে রন্ধনের আয়োজন করবে, বলল । নদীতীরে খনিত্র দিয়ে বিবর খনন করে সেই বিবরের মুখে তিনদিক দিয়ে তিনটি ক্ষুদ্রাকার প্রস্তরখণ্ড স্থাপন করে অতি দ্রুত মহানস নির্মাণ করে ফেলল ইরাইম্মান। অগ্নিমন্থ চকমকি পাথর ঠুকে ঠুকে আগুন জ্বালল। তারপর মাটির হণ্ডীতে নদীজল নিয়ে এসে সঞ্চিত সেই কয়েক মুষ্টি চাউল হণ্ডীতে ফেলে দিয়ে অন্ন প্রস্তুত করতে লাগল। সমস্ত কাজটির মধ্যে তার এমন একটা প্রফুল্লতা, এমন একটা সজীবতা প্রকাশ পাচ্ছিল যে, দেখে মনে হচ্ছিল এ কাজ যেন তার প্রতিদিনের গদ্যময় কর্মের পুনরাবৃত্তি নয়। যেন আজই প্রথম সে অন্ন রন্ধন করতে শিখেছে। অন্ন প্রস্তুত হয়ে গেলে দুটি পরিষ্কৃত শালপত্রে সেই অন্ন, সঞ্চিত গুড় ও নারকেলের ছাঁই ঢেলে নিয়ে ওরা দুজন একটি শাল্মলী বৃক্ষের ছায়ায় আহার করতে বসল।
আয়োজন অতি সামান্য, কিন্তু তাদের এই সরল সুখের যেন কোনো ইয়ত্তা নেই। আহার করতে করতে কোভালন ভাবছিল, সুখ কত সহজভাবে মানুষের কাছে ধরা দিতে চায়। এই যেমন ইরাইম্মানের কাছে ধরা দিয়েছে। অথচ কোভালনের মতো নাগরিক মানুষ এই সহজ সুখকে নানা আয়োজনের আড়ম্বরপূর্ণ দেওয়াল তুলে বাধা দিয়ে চলে । নানা তত্ত্বকথার প্রাসাদ নির্মাণ করে নিজেদেরই সমূহ আয়ুষ্কাল জুড়ে প্রবঞ্চনা করে চলে । তাই সে-সুখ ধরা দেয় না আর জীবনে; ক্রমশ দূরের দিকচক্রবাল রেখার মতো পিছোতে পিছোতে শেষে হারিয়ে যায়।
কোভালন জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমার গ্রামদেশ কোথায়, ইরাইম্মান?’
উত্তরে ইরাইম্মান যে-স্থাননির্দেশ করল, চেররাজ্যের স্থানসমূহ সম্বন্ধে অজ্ঞতা থাকায়, কোভালন বুঝে উঠতে পারল না ।
কোভালন আবার প্রশ্ন করল, ‘গৃহে কে কে আছেন ?’
ইরাইম্মান হেসে বলল, ‘সবাই আছে। তবে মা-বাপ বুড়ো হয়েছে। আমার বউ, এক ছেলে আর এক মেয়ে—তারাও সেখানেই সব থাকে। এই বউ কিন্তু আমার দ্বিতীয় পক্ষের বউ। গত ওনাম পরবের আগে একে বিয়ে করেছি। প্রথম পক্ষের বউ মরে গেছে চার বছর হল। ছেলেমেয়ে সেই প্রথম পক্ষের। প্রথম পক্ষের বউয়ের নাম ছিল সাবিত্রী।’
‘সাবিত্রীর কথা মনে পড়ে না তোমার আর, না?’ কোভালন জিজ্ঞাসা করল।
‘মনে পড়বে না আবার ? খুব পড়ে। অমন ডাগর ডাগর চোখ। বড়ো ভালো মেয়ে ছিল সে। কিন্তু কী করব কপালের দোষ, হঠাৎ উদরাময় হয়ে সে মরে গেল।’
‘এই নতুন স্ত্রী কেমন? ভাব-ভালোবাসা হয়েছে?’
ইরাইম্মান হাসতে হাসতে বলল, ‘এ তো খুব ছোটো। আমার মেয়ের থেকে একটু বড়ো। ভাব-ভালোবাসা কী করে হবে? তাকে দেখলে স্নেহই হয়। স্নেহই করি, আদরই করি।’
‘গৃহে ফেরোনি কতদিন হল ?’
‘তা প্রায় তিনমাস তো হবে। আরও এক চাঁদ পরে দেশে যাব।’
‘মনকেমন করে না তোমার? এমন পথে পথে ঘুরছ!’
‘নাহ্, মনকেমন করে না। মন বলে কিছু আছে নাকি আমাদের? দেশে-গাঁয়ে বসে থাকলে বাপ-মা-বউ-ছেলে-মেয়েকে কে খাওয়াবে? আমাদের জমিজমাও নেই। প্রথম বয়সে এই পাককার্য শিখেছিলাম ভাগ্যিস ! গ্রামে গ্রামে ঘুরে ঘুরে এই করেই বেশ দিন চলে যাচ্ছে। কিছুদিন পরে পরে গাঁয়ে যাই। যা রোজগার হয়, কিছু কিছু গৃহে দিয়ে আসি, ‘ এই অবধি বলেই চমকে উঠে ইরাইম্মান বলল, ‘এই যা! গতকাল তিলতক্তি বানিয়ে ছিলাম, পুঁটুলিতে আছে। আপনাকে দিতে ভুলে গেছি। এখন দিলে খাবেন?
আরও খানিক নানারকম কথা হতে লাগল। দেশগাঁয়ের অবস্থা, ব্যবসাবাণিজ্যের সংবাদ, ধর্মকর্ম, চাষাবাদ। কথায় কথায় ইরাইম্মান জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনার বাড়ি কোথায় ?’
‘আমার গৃহ কাবেরীর পরপারে। পুষ্পহার জানো ?
‘নাম শুনেছি খুব। তবে যাইনি কখনও ।
‘যাবে আমার সঙ্গে ?’
‘নাহ্, ওদিকে এখন যাব না। কাবেরীর এদিকেই ক-টা গাঁয়ে ঘুরে ঘুরে এক চাঁদ পরে দেশে চলে যাব।… আপনি কি খুব বড়োলোক ?’
কোভালন হেসে বলল, ‘এমন মনে হচ্ছে কেন তোমার?’
‘না, বেশ ভারভারিক্কি চেহারা। বড়ো ঘরের ছেলে মনে হয় !…আচ্ছা, এখন পুষ্পহারের রাজা কে? উরুবাপ্পারার ?’
‘কী বলছ, ইরাইম্মান? রাজা উরুবাপ্পারার তো চল্লিশ বছর আগে মারা গেছেন। এখন তো রাজা তাঁর পুত্র কারিক্কাল। তিনিই এখন সমগ্র চোলমণ্ডলের রাজা !’
ইরাইম্মান অপ্রতিভ মুখে উত্তর দিল, ‘কিছু মনে করবেন না। চোলরাজ্যের ব্যাপারে আমি আসলে কিছুই জানি না। রাজা উরুবাপ্পারারের কথা আমাদের গাঁয়ের বামুনদের মুখে শুনেছিলাম, তাই বলে ফেলেছি। আপনি কি কিছু মনে করলেন?’
ইরাইম্মানের কথা শুনে কোভালনের হাসি পেল। এতে মনে করার কী আছে ? চোলরাজার নাম না জানা কি কোনো অমার্জনীয় অপরাধ? পরিবেশ সহজ করার জন্যে কোভালন বলল, ‘না-না। কিছু মনে করিনি। তোমাদের চেরদেশে রাজা এখন কে?
এবার যেন ইরাইম্মান একটা বলার মতো কিছু বিষয় পেল। উজ্জ্বল মুখে সে উত্তর দিল, ‘আমাদের রাজা এখন শেঙ্গুখুবান। খুব প্রতাপ ! বাঘে-গোরুতে এক ঘাটে জল খায় তেনার নামে!
‘শেঙ্গুবান’ নামটা শুনেই ভেতরে ভেতরে চমকে উঠল কোভালন। কিন্তু মনের সেই ভাব সে বাইরে প্রকাশ করল না। পরিবর্তে বলল, ‘শেঙ্গুখুবান রাজা হলেন কতদিন ?” ‘আগের বুড়ো রাজা চেরালাতন মরে যেতেই শেঙ্গুবান রাজা হয়েছেন। এদিকে তাঁর ভাই তো নিরুদ্দেশ!
কোভালনের বুক ঢিপ ঢিপ করতে লাগল। শুকনো মুখে সে প্রশ্ন করল, ‘শেঙ্গুখুবানের ভাই? আচ্ছা ! তা তিনি নিরুদ্দেশ হলেন কেন ?
‘আরে কোত্থেকে এক বুড়ো জ্যোতিষী এসে বুড়ো রাজার সভায় বলল, রাজা নাকি খুব শিগগিরি মরে যাবেন। আর তখন তাঁর সিংহাসনে বসবেন ছোটো রাজকুমার ইলাঙ্গো । এই শুনে তো বড়ো রাজপুত্তুরের কী মন খারাপ, কী মন খারাপ! কেননা, নিয়ম অনুযায়ী তো বড়ো রাজপুত্তুর শেঙ্গুখবানেরই সিংহাসন পাওয়ার কথা। এখন জ্যোতিষীর কথা যদি ঠিক হয়, তাহলে তো বুড়ো রাজার মৃত্যু হলে ভাই ইলাঙ্গো দাদা শেঙ্গুখুবানের কাছ থেকে রাজ্য কেড়ে নেবেন !’
‘তারপর?’
তারপর থেকেই শেঙ্গুথুবান তাঁর ভাই ইলাঙ্গোকে খুব সন্দেহের চোখে দেখতে লাগলেন। রাজবাড়িতে সারাদিন শুধু ফুসফুস, গুজগুজ। তা এই সব দেখে ছোটো কুমার ইলাঙ্গোর খুব অভিমান হল। তিনি খুব ভালো মানুষ। একদিন রাতের বেলায় ইলাঙ্গো আগুনের পাখা মেলে রাজপ্রাসাদের ছাদ থেকে কোথায় যেন উড়ে চলে গেলেন।’
কোভালন চোখ বড়ো বড়ো করে বলে উঠল, ‘বাব্বা! আগুনের পাখা আবার কোত্থেকে এল?’
‘কোত্থেকে আবার আসবে? ছোটো রাজকুমার ইলাঙ্গো ছিলেন সাধক মানুষ, তিনি কি যে-সে লোক? তাঁর কি কম ইদ্ধি ছিল? সেই ইদ্ধি দিয়ে তিনি আগুনের পাখা বানিয়ে উড়ে চলে গেলেন।’
একটা কঠিন বাস্তব সত্য সাধারণ মানুষের কল্পনার রঙে কেমন বর্ণিল হয়ে ওঠে, ইরাইম্মানের কথা শুনতে শুনতে ভাবছিল কোভালন। ইলাঙ্গো আডিগল সকলের অজ্ঞাতসারে গৃহত্যাগ করেছিলেন—সেই তথ্যটা মানুষের কল্পনায় আর গালগল্পের ঘোরে কখন যেন অগ্নিপক্ষে উড্ডীন রাজপুত্রের কাহিনিতে পর্যবসিত হয়েছে।
কোভালন প্রশ্ন করল, ‘তো তারপরে কী হল ?’
‘কী আর হবে? বুড়ো রাজা তো ক-দিন পরেই মরে গেলেন। তখন তো ইলাঙ্গো নিরুদ্দেশ। শেঙ্গুথুবানের আর কোনো ভয় রইল না। নির্ভয়ে দেশের রাজা হয়ে সিংহাসনে বসে পড়লেন বড়ো কুমার শেঙ্গুখুবান।’
‘তাহলে জ্যোতিষীর কথা সত্যি হল না যে?’
‘সত্যি কী করে হবে? ব্যাটা ভণ্ড জ্যোতিষী ! মাঝখান থেকে খামোখা ছোটো রাজকুমার ইলাঙ্গো দেশছাড়া হয়ে চলে গেলেন! বড়ো ভালো লোক ছিলেন গো!’ ইরাইম্মানের গলায় আক্ষেপের সুর ঝরে পড়ল।
কোভালন খুব সাবধানে প্রশ্নটা করল, ‘ইলাঙ্গোর কী হল, তোমরা কেউ জানো না?’
ইরাইম্মান উত্তর দিল, ‘নাহ্, তেনার খোঁজখবর আর আমাদের দেশে-গাঁয়ে কেউ পায়নি। তবে…’
‘তবে?’
‘তবে আমি তো জায়গায় জায়গায় ঘুরে বেড়াই। আমি শুনেছি, তিনি নাকি দিগম্বর সাধু হয়ে বেরিয়ে গেছেন। সত্যি-মিথ্যে জানি না, শুনলাম, তিনি নাকি এই চোলরাজত্বিতেই কোথাও কোনো একটা মঠে থাকেন !’
এই শেষ কথাটি যেন কোভালনের মনের মধ্যে বিদ্যুচ্চমকের মতো সহসা দীপ্তিমান হয়ে উঠল। সে বেশ চিন্তার মধ্যে পড়ে গেল। তার মানে, নির্জন সেই গুহাবাসের নগ্ন ক্ষপণক রাজ্যপরিত্যাগী চেররাজপুত্র ইলাঙ্গো আডিগল ছাড়া আর কেউই নন । তাহলে তো ওকথা তিনি বানিয়ে বলেননি। আচ্ছা, তবে কি তাঁর বাকি কথাও সত্যি?… তবে কি….?
কিন্তু কোভালনের সেই মগ্নতার ভিতরেই ইরাইম্মান বলে উঠল, ‘সে যাক গে যাক । বেলা পড়ে আসছে। আমাকে কিন্তু এবার যেতেই হবে। নদীর এই পারে একটা গাঁ আছে। সেখানেই আজ রাতটা…’
পুঁটুলি-টুটুলি বেঁধে ঝাঁকাঘাড়ে উঠে দাঁড়াল ইরাইম্মান। তার মুখে সেই সদা প্রসন্ন ভাবের আকর্ণবিস্তৃত হাসিটি লেগে রইল বিদায়বেলায়।
দিবসত্রয় অতীত হয়ে গেল, কোভালন গৃহে প্রত্যাবর্তন করেছে। কিন্তু তার এই ফিরে আসায় গৃহে যতটা উল্লাস দেখবে বলে সে আশা করেছিল, তার কণামাত্রও গৃহকর্ত্রী, গৃহপরিজন, পরিচারক, পরিচারিকা—কারও মধ্যেই দেখতে পায়নি। সকলেই বেশ নিশ্চুপ, প্রত্যেকেই গম্ভীরভাবে কোভালনের গতিবিধি লক্ষ করছে, কিন্তু কেউই নিজের থেকে মুখ ফুটে তার সঙ্গে কোনো কথা বলছে না। গৃহের অবস্থাও বেশ শ্রীহীন হয়ে পড়েছে। বেশ কয়েকজন দাস-দাসী অনুপস্থিত; সম্ভবত তাদের চিরতরে বিদায় দিয়েছে কন্নকী। এ গৃহের সদস্যরা ছায়ামানুষের মতো এ কক্ষ থেকে ও কক্ষে যাচ্ছে, যান্ত্রিকভাবে কাজ সারছে, তাদের নিজেদের ভিতরেও আগের মতন উচ্চকিত আলাপ তেমন শোনা যাচ্ছে না। কন্নকীর মুখ সমুদ্রঝটিকায় আক্রান্ত মেঘমলিন গগনের মতো বিপদসংকুল; কোভালনকে দেখে সামান্য স্বাগত-অভিবাদন জানিয়েই সে অন্যত্র সরে গেছে, অন্য কোনো প্রশ্ন বা অনুযোগ কিছুই সে করেনি। কোভালন লক্ষ করেছে, কন্নকী সমস্ত দিন ধরে কঠিন মুখে শ্রমসাধ্য গৃহকর্মে নিরত। আগে তার ওষ্ঠাধরে প্রায়শই যে-হাসিটি লগ্ন হয়ে থাকত, এখন সেই হাসি যেন একেবারে অদৃশ্য হয়ে গেছে। শুধু কোভালনই নয়, গৃহের অন্যান্য পরিজন, পরিচারক—কারও সঙ্গেই কন্নকী বাক্যালাপটুকুও করছে না।
গৃহে সকলের এমন হিমশীতলতা দেখে কোভালনও আর কথা বাড়ায়নি। সে দ্বিতলে তার নিজ কক্ষে চলে এসেছে। গৃহপরিচারকদের নির্দেশ দিয়েছে, তার আহার্য যেন এ কক্ষেই পরিবেশন করা হয়। স্নানান্তে কক্ষে ফিরে সে আবিষ্কার করেছে, এর মধ্যেই ব্যবহৃত বস্ত্রগুলি কেউ এসে নিয়ে গিয়েছে এবং তৎস্থলে পরিষ্কৃত নূতন পরিধেয় রেখে গেছে। বস্ত্রাদি পরিধান-সমাপনান্তে কক্ষের মেঝেতে উপবেশন করেই সে আহার সমাধা করেছে। আহারের পর তার বোধ হল, সমস্ত শরীর যেন ক্লান্তিতে একেবারে ভেঙে পড়ছে। পরিশ্রান্ত দেহের উপর যেন অন্তহীন নিদ্রা নেমে আসছে। আর কালক্ষেপ না করে সে পর্যঙ্কে শয়ন করেছে। তারপর কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে, বলতে পারে না ।
এই তিনদিনে বারবার ঘুম ভেঙে জেগে উঠেছে কোভালন, কিন্তু বাহিরে কোথাও যায়নি। প্রয়োজনীয় যৎসামান্য কর্ম ও আহারাদি সেরে পুনরায় নিদ্রাগত হয়েছে। বস্তুত, তার নিদ্রারই বিশেষ প্রয়োজন; সমস্ত শরীর পথশ্রম ও অন্যবিধ মানসিক বিপর্যয়ে একেবারে শ্রান্তির অন্তিম বিন্দুতে এসে পৌঁছেছে। বিশ্রাম না নিলে যেকোনো সময় তার বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়তে পারে।
তিনদিন পর আজ অবনত মধ্যাহ্নবেলায় তার ঘুম ভাঙল। প্রথমে সে বুঝতে পারল না, সে কোথায় শুয়ে আছে। সে কি পথের ধারে কোনো বৃক্ষনিম্নে ঘুমিয়ে পড়েছিল ? শেষবেলার রৌদ্রকিরণ মুখে এসে পড়ায় ঘুম ভেঙেছে? অথবা সেই শৈলোপরি জৈন সাধকদের আবাসস্থলে কঠিন শিলার উপর সে ঘুমিয়ে পড়েছিল? ক্ষপণক-পোষিত সেই ময়ূরটা কি তীক্ষ্ণ চঞ্চর আঘাতে তার চোখদুটো খুবলে নিয়ে চলে গেছে ? নাকি সেই চেররাজ্য ও চোলরাজ্যের সীমালগ্ন দেশের নির্জন অতিথিশালার ভূশয্যায় সে নিদ্ৰা গিয়েছিল? সারারাত অবিশ্রান্ত বৃষ্টিপাতের ঝর্ঝরশব্দে তার তন্দ্রাজড়িত স্মৃতিকোশ ভরে উঠেছে বুঝি ?
কিছুক্ষণ পরে সে টের পেল, আসলে সে কোথায় আছে। এই তার ব্যক্তিগত কক্ষ, পর্যঙ্কে কোমল শয্যায় সে শায়িত, উপরে ছাদসমীপে বলভী-সংলগ্ন সেই কপোতপালী। কপোতপালীতে আশ্রিত কপোতযূথ কোবুত্-কোবুত্ রবে এ নিঃশব্দ কক্ষের জরায়ু নিঃশেষে ভরিয়ে তুলছে। বহু দূরে কোনো বনস্পতির কাষ্ঠল কাণ্ডের উপর অদৃশ্য কোনো পাখির চঞ্চু-অবঘাতজনিত ঠক্ঠক্ শব্দ উঠছে। এ ছাড়া চরাচরে কোথাও আর কোনো শব্দ নেই। স্তব্ধ সুনির্জন দ্বিপ্রহর।*
শয্যার উপর উঠে বসল কোভালন। এ মুহূর্তে তার মন স্মরণভারাতুর। এই কয়েক মাস কীভাবে কীসব ঘটল, সমস্তই মনে আসছে ছিন্নভিন্ন। চিত্তবীথিকা বেয়ে গত মাস দেড়েকের অভিজ্ঞতাপুঞ্জ ক্ষণস্ফুরিত জোনাকিপক্তির মতো ক্রমাগত স্মৃতিদীপিত হয়ে চলেছে। প্রেমাস্পদা মাধবী… সাগরবেলা…. প্রিয়াবিচ্ছেদ… উদ্দেশ্যহীন বিভ্রান্ত অভিযাত্রা… ক্ষপণকদের স্তব্ধবাক মঠ… ইলাঙ্গো আডিগল… কল্পলোক … বস্তুসত্য … বনভূমে শিবক্ষেত্রে আতিথ্য… দূরবিসর্পী পথ…. পিষ্টকবিক্রেতা ইরাইম্মান …
ভাবতে ভাবতে দীর্ঘশ্বাস ফেলল কোভালন। তারপর হাঁটুর উপর থেকে মুখ তুলে হঠাতই তার মনে হল, গৃহের এই মূক নিস্তব্ধতার এবার একটা নিষ্পত্তি করা দরকার ।
এভাবে তো দিনের পর দিন চলতে পারে না। বিশেষত, সে যে সমস্ত অকুশল কর্ম থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিয়ে ফিরে এসেছে, সেকথা কন্নকীর সমূহ উপলব্ধি করা দরকার । পর্যঙ্ক থেকে নেমে কোভালন দ্রুত পদক্ষেপে কন্নকীর কক্ষের দিকে এল। দ্বার ভিতর থেকে অর্গলবদ্ধ ছিল না, কপাটিকা স্পর্শ করতেই খুলে গেল। ভিতরে প্রবেশ করে অবাক হয়ে গেল কোভালন। কক্ষের একপাশে যাবতীয় বস্ত্র, শয্যার সংস্তর, প্রাবরণ, স্থূলশাট, নিচোল প্রভৃতি স্তূপাকৃতি হয়ে পড়ে আছে; পর্যঙ্ক শয্যাশূন্য, উন্মুক্ত। কক্ষের অন্য দিকে মেঝের উপর বসে কন্নকী পেষণী সহায়ে তণূল চূর্ণ করছে। এমন শ্রমসাধ্য
কর্ম তো সে যেকোনো পরিচারক বা পরিচারিকাকে দিয়েই করাতে পারে। তাহলে নিজে এ কঠিন কাজ করছে কেন? চালের গুঁড়ায় তার কেশপাশ ধূসর হয়ে রয়েছে। কোভালন কক্ষে প্রবেশ করতে কন্নকী একবার মুখ তুলে দেখল মাত্র, তারপর আবার মুখ নীচু করে কাজের মধ্যে ডুবে গেল।*
পর্যঙ্ক সংস্তরশূন্য; তাই সেই স্তূপীকৃত বস্ত্রের উপরেই বসতে বাধ্য হল কোভালন । কন্নকী সেই একই ভঙ্গীতে মেঝেতে বসে তণ্ডুল চূর্ণ করে চলেছে। কোভালন অপেক্ষা করতে লাগল। কিন্তু তণ্ডূল-পেষণ সমাধা হলে পাত্রাদি গুছিয়ে নিয়ে কন্নকী এ কক্ষ থেকে চলে যেতে উদ্যত হল। দ্বার অতিক্রম করে চলে যাচ্ছে, এমন সময় পশ্চাদ্দিক থেকে তাকে কোভালন মৃদু স্বরে ডাকল, ‘কন্নকী—’
কন্নকী ফিরে দাঁড়াল। কোভালন বলল, ‘আমার কিছু বলার আছে। বোসো!’
মেঝেতে পাত্রাদি নামিয়ে রেখে কন্নকী কাষ্ঠপুত্তলিকাবৎ শূন্য পর্যঙ্কের উপর গিয়ে বসল। তার চোখে একটা নিরুত্তাপ, নিরুত্তেজ দৃষ্টি। কোভালন কী বলে, তা শোনার জন্য যেন সে নিরাবেগ ভঙ্গীতে অপেক্ষা করছে, এই মাত্র ।
কোভালন প্রশ্ন করল, ‘আমি আজ দেড়মাস পুষ্পহারে ছিলাম না, তুমি জানো ? কন্নকী সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল। অর্থাৎ, সে জানে।
কোভালন জিজ্ঞেস করল, ‘এত দিন আমি গৃহে ফিরিনি, তা সত্ত্বেও তুমি আমার সন্ধান করোনি?’
এবার কন্নকী মুখ খুলল, ‘বিপণিপালরা অনুসন্ধান করে বলেছেন, তুমি পুষ্পহারে নেই।’
কোভালন অধৈর্য স্বরে বলল, ‘আশ্চর্য! আমি নেই, তুমি জানো। অথচ কোথায় গেলাম না গেলাম, তা জানবার জন্য তুমি কোনো চেষ্টাও করোনি?’
কন্নকী নিরুত্তেজ স্বরে উত্তর দিল, ‘কেন করব? তুমি তো কারও অধীন নও । যেকোনো স্থানে যাওয়ার স্বাধীনতা তোমার আছে। যতদিন খুশি ততদিন, বাহিরে থাকার স্বাধীনতা আছে। যখন খুশি তখন, ফিরে আসার স্বাধীনতাও রয়েছে।’
‘কিন্তু আমার তো কোনো বিপদ হতে পারত!’
‘বিপদ হলে সে-সংবাদ আমার কাছে কোনো-না-কোনো উপায়ে এসে পৌঁছোত । তা ছাড়া বিপদ হবেই-বা কেন? তুমি সমর্থ, স্বাধীন, বিত্তবান, বলিষ্ঠ যুবক। স্তনন্ধয় শিশু তো নও । এবং তোমার অন্যান্য বন্ধুরাও আছে, যারা তোমার বিপদে সাহায্য করবে।’
কোভালন খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর আপন মনেই বলতে লাগল, ‘আমি পুষ্পহার ছেড়ে চলেই গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, আর কখনও ফিরব না।’
কন্নকীর ভ্রূলতা সামান্য কুঞ্চিত হল। কিন্তু সে মুখে কিছু বলল না। তবু তার সেই ভ্রূভঙ্গীর ভিতরে একটি অনুচ্চারিত প্রশ্ন ছিল। প্রশ্নটা অনুভব করতে পেরে কোভালন বলল, ‘আসলে… আমি খুব মর্মান্তিক আঘাত পেয়েছিলাম, কন্নকী। তাই এ নগরী পরিত্যাগ
করে চলে যাই। মনে হয়েছিল, আমার এই জীবন সম্পূর্ণ অর্থহীন হয়ে গিয়েছে। কোথায় যাচ্ছি, সেসব লক্ষ না রেখেই বহু বহু যোজন অতিক্রম করে অনেক দূরে পার্বত্যপ্রদেশে চলে গিয়েছিলাম আমি ।… তারপর একজন ব্যক্তি আমাকে গৃহে ফিরে আসতে বললেন।’
এতগুলো কথা বলল কোভালন, কিন্তু কন্নকী একটা প্রশ্নও করল না। কোন দুঃখে কোভালন নগর ত্যাগ করে চলে গিয়েছিল, কোথায় গিয়েছিল, কেই-বা তাকে গৃহে ফিরে আসতে বললেন—ইত্যাকার কোনো বিষয়ে অণুমাত্র কৌতূহল দেখাল না। অথচ কথাগুলো সে খুব মন দিয়ে শুনল, মনে হল। তারপর কোভালন অনেকক্ষণ চুপ করে আছে দেখে কন্নকী ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘আমি যাই; পাকশালায় অনেক কাজ বাকি পড়ে আছে।’
মেঝে থেকে তণ্ডুলচূর্ণে পরিপূর্ণ পাত্রাদি তুলে নিয়ে এ কক্ষ থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল কন্নকী। কোভালন কথঞ্চিৎ হতবাক হয়ে বসে রইল। তারপর হতাশ্বাস মনে সেও কন্নকীকক্ষ পরিত্যাগ করে স্বকক্ষে ফিরে এল।
শয্যায় শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগল কোভালন, কন্নকীর এতাদৃশ নীরবতা বা শীতলতার হেতু কী? অভিমান অবশ্যই একটা কারণ। অভিমান তো হওয়ারই কথা; সেকথা কোভালন বুঝতে পারছে। গৃহ-পরিত্যাগ করার আগে মাধবীকে নিয়ে তাদের দুজনের মধ্যে তুমুল বাদ-বিসংবাদ হয়েছিল। কন্নকী অনেক বিলাপ করেছিল। কোভালনকে মাধবীগৃহে যেতে বাধা দিয়েছিল প্রকারান্তরে। কিন্তু কন্নকীর সেকথা না শুনে সেই রাত্রেই সে মাধবীর কাছে যাওয়ার জন্য বেরিয়ে পড়েছিল পথে। তারপর মাসাধিককাল গৃহে ফেরেনি। এমতাবস্থায় কন্নকী কোভালনের সম্পর্কে নিঃস্পৃহ, শীতল হয়ে যাবে—এই কি স্বাভাবিক নয় ? অভিমান হওয়াও তো স্বাভাবিক অতিশয় !
কিন্তু শুধুই কি অভিমান? আর কিছু কি নয়? কোভালনের মন ক্রমাগত যেন কু-গাইতে লাগল। তার মনের তলদেশ থেকে যুক্তিসম্পর্কহীনভাবে একটা অশুভ সম্ভাবনার বোধ জেগে উঠছিল। তবে কি তার অনুপস্থিতিতে এ গৃহে এমন কিছু ঘটেছে, যা সে জানে না? সম্ভব-অসম্ভব অনেক কথাই তার মনে আসতে লাগল। প্রত্যাবর্তনের পর থেকেই দেখছে, এ গৃহের কক্ষগুলি কেমন মলিন, শ্রীহীন হয়ে রয়েছে। বহু দাস-দাসী অনুপস্থিত। কন্নকীকে আজকে খুব কাছ থেকে দেখল সে। কন্নকীর দেহলতা, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ থেকে যেন যাবতীয় লাবণ্য বিদায় নিয়েছে। তার চোখমুখ শুষ্ক, পাংশুবর্ণ। চোখের নীচে নিদারুণ ক্লান্তিও উদ্বেগজনিত কালো ছাপ পড়েছে। কন্নকী প্রসাধনহীনা, গাত্রে একটিও অলংকার নেই। প্রথমে সে ভেবেছিল, পেষণী দিয়ে তণ্ডুল চূর্ণ করছে, তাই হয়তো আভরণ খুলে রেখেছে। কিন্তু এখন আর তা মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে, এসবের যেন অন্য কোনো নিগূঢ় কারণ আছে। তণ্ডুল চূর্ণ করার কাজ সে নিজ হাতেই-বা করছে কেন? গৃহের ভৃত্য বা ভৃতিকারাও কেউ সহজ বাক্যালাপ করছে না। সবাই যেন কিছু একটা টের পেয়েছে, সবাই সব জানে কিন্তু মুখ ফুটে কেউই কিছু বলছে না। কী হয়েছে এ গৃহে এই দেড়মাসের মধ্যে ?
কিন্তু কী হয়েছে, সেকথা কোভালন জানবেই-বা কীভাবে? কন্নকী যদি এবপ্রকার নীরবতা অবলম্বন করে থাকে, তাহলে জানার অন্য উপায় কি কিছু আছে? না জানলে সমাধানই-বা খুঁজবে কী প্রকারে? এমন নানা কথা কোভালন নিজ মনে তোলাপাড়া করতে লাগল।
মধ্যাহ্ন অতীত হয়ে অপরাহুকাল উপস্থিত হল। কোভালন ভাবল, পুনরায় সে কন্নকীর কাছে গিয়ে কী হয়েছে সমস্ত ব্যাপার জানতে চাইবে, তাতে যা হয় হোক । এই কথা ভেবে সে শয্যা থেকে গাত্রোত্থান করতে যাচ্ছে, এমন সময় সহসা কক্ষদ্বার খুলে গেল। কোভালন চেয়ে দেখল, কন্নকী দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে। নিঃশব্দ, ম্রিয়মাণ !
কক্ষের ভিতরে এল কন্নকী। সামান্য দূরে দাঁড়িয়ে বস্ত্রপ্রান্তে করতল মুছতে মুছতে বলল, ‘তোমার একবার বিপণিতে যাওয়া উচিত। যদিও এখন আর বিপণিতে গিয়েও যে তেমন উপায় কিছু হবে, তা নয়। তবু যদি একবার যাও …’
কন্নকীর কথাগুলোর মধ্যে এমন একটা কিছু ছিল, যাতে ভয় ও আশঙ্কার একটা চোরা হিমশীতল স্রোত যেন অতর্কিতে কোভালনের মেরুদণ্ড বেয়ে নীচের দিকে নেমে গেল। আতঙ্কিত স্বরে জিজ্ঞাসা করল কোভালন, ‘বিপণিতে? কেন? সেখানে কী হয়েছে, কন্নকী ?’
সামান্য অগ্রসর হয়ে পর্যঙ্কের বাজু ধরে শিথিল ভঙ্গীতে দাঁড়াল কন্নকী । তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে চাপা গলায় বলল, ‘সর্বনাশ হয়ে গেছে, স্বামিন্! আমরা সর্বস্বান্ত হয়ে গেছি। ব্যবসায় সর্বস্ব চলে গেছে।’
একথার অর্থ যে কী ভীষণ, বণিকপুত্র কোভালন তা জানে। তবু অবস্থা কতটা সঙ্গিন, তা বুঝবার জন্য আকুল হয়ে সে প্রশ্ন করল, ‘কবে এমন হল? কীভাবে হল? আমাকে বিস্তারিত বলো!’
কন্নকী বলল, ‘তোমাকে আমি এ অবস্থার অগ্রিম ইঙ্গিত দিয়েছিলাম । কিন্তু তখন তুমি আমার কোনো কথাই শোনোনি। দিনের পর দিন বিপণিতে যাওনি। তোমার অনুপস্থিতির সুযোগে ব্যবসার অংশীদাররা তোমার পিতার মূলধন কুটিল উপায়ে সম্পূর্ণ আত্মসাৎ করে নিয়েছে। তোমার লভ্যাংশও তারাই ভাগবাটোয়ারা করে নিয়েছে। যে যার নিজের অংশ তুলে নিয়ে তারা অন্যত্র ব্যবসা ফেঁদে বসেছে। বণিক মাশাত্তুবানের ব্যবসা এখন একটি বিশালকায় সচ্ছিদ্র অর্ণবপোতের মতন সমুদ্রজলে নিমজ্জমান !
স্তব্ধবাক কোভালন মাথা নীচু করে বসেছিল। তলে তলে এত বড়ো সর্বনাশ করল তারা, যাদের সে চোখ বুজে বিশ্বাস করে চলেছিল! কিছু পরে তুষ্ণীম্ভাব কাটিয়ে বলল সে, ‘তুমি আগে থেকে কোনো খবর পাওনি? আমার বিপণিপালরা তোমাকে কোনো ইঙ্গিত দেয়নি এর?’
‘দিয়েছিল। এবং তোমার পিতার প্রবীণ সহচর কলানিধির দ্বারা বিপণির হিসাব আনিয়ে দেখতে গিয়ে আমি তো স্তম্ভিত হয়ে গেলাম! যে যখন পেরেছে, তোমার নাম করে যবন বণিকদের কাছ থেকে বিপুল অঙ্কের দ্রম্ম ঋণ নিয়েছে। তুমি নিজেও বিপণিকোশ থেকে সহস্র সহস্র কালাঞ্জু তুলে নিয়েছ। এই বিপুল ঋণ পরিশোধ করার আংশিক প্রয়াস আমি এখনও করে চলেছি। কিছু অলংকার বিক্রয় করেছি, কিছু অলংকার বন্ধক রেখেছি। তার বিনিময়ে যে-অর্থ পেয়েছি, তা দিয়ে আংশিক ঋণ পরিশোধ করেছি মাত্র। কিন্তু শেষ রক্ষা করতে পারব বলে আমার মনে হয় না। যে বিপুল ঋণ আমাদের স্কন্ধে রয়েছে, তার পরিশোধ করতে হলে হয়তো আমাদের এই বাসগৃহ পর্যন্ত বিক্রয় করে দিতে হবে। যখন খুশি তখন একেকজন খাতক বিপণিতে উপস্থিত হয়ে দাবি করছে যে, বিপণির কেউ না কেউ তাদের নিকট থেকে ঋণ নিয়েছে।’
কোভালন উত্তেজিত হয়ে বলল, ‘কিন্তু দাবি করলেই যে সে-দাবি মেটাতে হবে, এমন দায় তো আমাদের নেই!’
বড়ো ম্লান, বড়ো নিষ্প্রাণ হাসল কন্নকী। তারপর বলল, ‘আমি সেকথা জানি। বণিকঘরের মেয়ে আমি, শ্রেষ্ঠী মানাইক্কনের কন্যা। সেকথা আর জানব না? দাবি করলেই দাবি মেটাতে হবে, তা নয়। কিন্তু খাতকেরা প্রত্যেকেই ঋণপত্র নিয়ে এসে প্রমাণ দেখাচ্ছে যে! সেসব ঋণপত্রে আমাদের বিপণির মুদ্রাচিহ্নও অঙ্কিত আছে। এমনকি অনেক ঋণপত্রে তোমার স্বাক্ষর পর্যন্তও রয়েছে!’
কোভালন এতক্ষণে বুঝতে পারল, কী বিপদের মধ্যে সে এসে পড়েছে। কন্নকী সমস্ত কিছু যথার্থই বলছে। বিপুল অর্থ সে নিজে তো বিপণি থেকে নিয়েছিলই, তদুপরি নানা সময়ে বৈদেশিক বণিকদের কাছ থেকেও প্রচুর ঋণ করেছিল। এখন এ সমস্তই তার অমিতাচারের বিষফল হয়ে ফিরে আসছে।
পরিতাপে পাথর হয়ে কোভালন নিশ্চুপ বসে আছে দেখে কন্নকী ধীরে ধীরে বলতে লাগল, তুমি যদি সময় থাকতে আমার কথা একটুও শুনতে, তাহলে এই বিষম পরিস্থিতিতে আমাদের পড়তে হত না। দ্যাখো, আমি মাধবীর কথা তুলতাম না, সে তোমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। কিন্তু বাধ্য হয়েই কথাগুলো বলছি। তোমার এই মাধবী-সংসর্গ থেকেই আজ আমাদের এই নিদারুণ পরিণতি । এই সর্বনাশা আগুন নিয়ে খেলা তুমি বন্ধ করো এবার ! কোভালন ত্বরিতে বলে উঠল, “মাধবীর সঙ্গে আমার সব সম্পর্ক শেষ হয়ে গেছে,
কন্নকী! কিন্তু এখন শেষ হলেই-বা কী? যা হওয়ার তা তো হয়ে গেছে !
কন্নকী সামান্য ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করল, ‘শেষ হল কেন? কী হয়েছিল ?” কোভালন বলল, “আমি মাধবীকে যা ভেবেছিলাম, মাধবী তা নয়। সে বিশ্বাসঘাতিনী। সে শুধু একজন দক্ষ অভিনেত্রী, নর্তকী মাত্র ! ‘
‘তুমি এত নিশ্চিত হচ্ছ কী করে ?’ কন্নকী জিজ্ঞাসা করল।
‘সে আমার কাছ থেকে অনেক কিছু গোপন করে গেছে। এমন অনেক কিছু সে ঘটিয়েছে আমার চোখের আড়ালে, যার ইঙ্গিত এখন সে দিচ্ছে। আমি বুঝতে পেরেছি, সে আমার সঙ্গে এতদিন অভিনয় করে চলেছিল। অভিনয়, শুধু অভিনয়! আমার ১৯৮ | মূর্ছিত নূপুর
ভালোবাসাকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলে এখন সে আমাকে সচ্চরিত্র স্বামী হওয়ার উপদেশ দেয় ! হায়, আমি তাকে কী ভাবলাম, আর সে কী হয়ে গেল!’
কন্নকী বলে উঠল, ‘তুমি তো আমাকেও কী ভেবেছিলে আর আমিও কী হয়ে গেলাম, তাই না ?’
কোভালন চুপ করে রইল। কন্নকী বলে চলল, ‘তুমি কেন বুঝতে পারো না, তোমার ভাবনা-অনুযায়ী হয়ে ওঠার দায় আমাদের কারও নেই? শুধুমাত্র নিজের কল্পনার ঝোঁকে তুমি বুঁদ হয়ে থেকে—আমি এবং মাধবী—আমাদের দুটি মানুষের জীবনকে তুমি একেবারে নষ্ট করে দিলে। তুমি চিরকাল এমনই করবে। কল্পনার ঘোরে মত্ত হয়ে তুমি একেকটা মানুষের সঙ্গে সম্পর্কে জড়াবে, আর তারপর তোমার ধারণা বা কল্পনার সঙ্গে না মিললেই তুমি সেই সম্পর্ক ভেঙে দিয়ে বেরিয়ে যাবে। চুরমার করে দেবে তোমাকে যারা ভালোবাসবে তাদের… দাও, চুরমার করে ভেঙে দাও আমাদের… কিন্তু এইভাবে নিজেকেই যে শেষ করে দিচ্ছ তুমি, সেকথা এখনও বুঝতে পারছ না কেন ? …
কথাগুলো বলতে বলতে এতক্ষণের আটকে রাখা কান্নায় উদ্বেল হয়ে উঠল কন্নকী। তার সেই কান্নায় থরথর করে কাঁপছিল কোভালনও । মাথা হেঁট করে সে বসে রইল শয্যায়। আর পর্যঙ্কের বাজু আঁকড়ে দুরন্ত ঝড়ে ছিন্নডানা পাখির মতন কন্নকী হাহাকার করতে লাগল ।
একটু পরে শয্যা থেকে কোভালন উঠে দাঁড়াল। কন্নকীর কাছে সরে এসে তার হাতের উপর নিজের কম্পিত হাতখানি রেখে কোনোমতে বলল, ‘আমি কত বড়ো ভুল করেছি, জানি। তোমার প্রতি যে-অন্যায় আমি করেছি, জানি, তার ক্ষমা নেই। সব আমারই দুঃস্বভাবের দোষ। তবু এতকিছুর পর, এত অন্যায়ের পর আমাকে কি আরেকটিবার সুযোগ দেবে, কন্নকী ?’
সেকথার কোনো উত্তর না দিয়ে কোভালনের থেকে কন্নকী সরে গেল দূরে। কাঁদতে কাঁদতেই কক্ষ পরিত্যাগ করে সে চলে গেল হঠাৎ।
আর অধিক বিলম্ব না করে যত দ্রুত সম্ভব বিপণিতে এসে উপস্থিত হল কোভালন এতদিন পর হঠাৎ কর্তাকে দেখতে পেয়ে বিপণির কর্মীরা শশব্যস্ত হয়ে উঠল। কোভালন দেখল, বিপণিতেও অনেক কর্মী অনুপস্থিত। অনেকেই কাজ ছেড়ে দিয়ে পাওনাগণ্ডা মিটিয়ে নিয়ে চলে গেছে। তা ছাড়া গৃহে ও বিপণিতে ব্যয়সংকোচের জন্যেও যে অনেক পরিচারক ও কর্মীদের বিদায় দিতে হয়েছে, বুঝতে অসুবিধে হল না ।
বিপণিতে বসে হিসাব পরীক্ষা করতে বসল কোভালন। যতই হিসাব পরীক্ষা করতে লাগল, ততই তার মুখ আঁধার হয়ে উঠতে লাগল। কন্নকী একবিন্দুও বাড়িয়ে বলেনি। এ ব্যবসার সত্যিই অন্তিম দশা। হিসাবের প্রচুর গরমিল। নিজে সে বিপণিকোশ থেকে পর্যাপ্ত অর্থ তো তুলে নিয়েছেই, তদুপরি তার বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে আরও অনেকেই প্রভূত বিত্ত আত্মসাৎ করেছে। বিপণির প্রবীণ কর্মী কলানিধি তাকে জানালেন, কীভাবে কোভালনের পিতা মাশাত্তুবানের স্বাক্ষর জাল করে এক নকল ঋণপত্র দেখিয়ে অংশীদাররা সমস্ত মূলধন খেপে খেপে বিপণিকোশ থেকে তুলে নিয়েছে। এরা অনেকেই নিজেদের অংশ তুলে নিয়ে নগরীর নানা প্রান্তে পৃথক ব্যবসা ফেঁদে বসেছে, আবার অনেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করে পুষ্পহার ছেড়ে পালিয়েছে। এই সমস্যা সমাধানের প্রাণপণ প্রয়াস করেছেন বৃদ্ধ কলানিধি, এ নিয়ে বহু পরামর্শও করেছেন কন্নকীর সঙ্গে, কিন্তু ফল কিছুই হয়নি ।
ক্রোধে কোভালনের মুখ লাল হয়ে উঠল। এই সব প্রতারকদের বিরুদ্ধে রাজদ্বারে সে অভিযোগ জানাবে, রাজশক্তির সহায়তায় সে এই সব প্রতারকদের অবশিষ্ট জীবন কারাগারে বসবাসের বন্দোবস্ত করবে! এভাবে যতই উপর্যুপরি সে চিন্তা করতে লাগল, ততই তার মস্তিষ্কে তীব্র জ্বালাময়ী রোষাগ্নি লেলিহান শিখায় জ্বলে উঠতে লাগল। মাথা ঘুরছে তার, মুখ শুকিয়ে আসছে, সমস্ত শরীর প্রচণ্ড রাগে থরথর করে কাঁপছে। বিষম অসুস্থতা বোধ করতে লাগল কোভালন
কিন্তু একটু পরেই সে একথা বুঝতে পারল, এ সবই তার নিষ্ফল ক্রোধ, নিষ্ফল আক্রোশ। রাজদ্বারে অভিযোগ করলেই হল না, প্রতারকদের অপরাধ প্রমাণ করতে হবে। সেই প্রমাণ সংগ্রহ করা সহজ নয়, কারণ সে এতদিন বিপণিতে উপস্থিত ছিল না । প্রতারকদের অপরাধ প্রমাণ করতে না পারলে, মিথ্যা অভিযোগ করার দায়ে তাকে নিজেকেই রাজাদেশে চরম শাস্তি মাথা পেতে নিতে হবে। তা ছাড়া রাজদ্বারে অভিযোগ জানানো এবং সেই অভিযোগের যথাযথ নিষ্পত্তি—সমস্তই বহুল ব্যয়সাপেক্ষ। এ মুহূর্তে কোভালনের বিপণিকোশ তলানিতে এসে ঠেকেছে। এতদিন কন্নকী তার যথাসাধ্য করেছে, এখনও এ শূন্যগর্ভ ব্যবসার গুরুভার কন্নকীই অলক্ষিতে থেকে একা হাতে টেনে চলেছে। কিন্তু কন্নকী গৃহবধূ—বিপণিতে এসে বসে ব্যবসা পরিচালন করা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। বিশ্বস্ত কর্মচারীদের দ্বারা যতটা পেরেছে, করেছে। কিন্তু এখন একেবারেই নিরুপায় দশা। বিপর্যয়, যা হওয়ার হয়ে গেছে, এখন আর এ মুমূর্ষু ব্যবসাকে পুনর্জীবিত করে তোলা অসম্ভব।
কলানিধি বললেন, ‘তোমার অনেক অনুসন্ধান করেছিলাম আমি, বাবা! কিন্তু তুমি যে কোথায় গেছ, কাউকে বলে যাওনি। আমি বৃদ্ধ হয়েছি, আজকাল চোখে ভালো দেখি না যে, পথে বেরিয়ে পড়ব তোমার খোঁজে। সময় থাকতে যদি বউমার কথা একটু শুনতে…’
নিতান্ত আশাশূন্য মনে প্রায় টলতে টলতে বিপণি থেকে গৃহে ফিরল কোভালন মধ্যরাতে। সে সরাসরি দ্বিতলে নিজের কক্ষে চলে গেল। কক্ষ অন্ধকার, হয়তো সন্ধ্যাকালে এ কক্ষে দীপ জ্বালানো হয়েছিল, কিন্তু এক প্রহরের মধ্যেই প্রদীপ নিভিয়ে দেওয়া হয়েছে। অন্ধকারে কোনোমতে হাতড়ে হাতড়ে সে উৎপীঠিকার উপর আহার্য রক্ষিত আছে বুঝতে পারল, কিন্তু অন্নস্পর্শে তার আর প্রবৃত্তি হল না। পর্যঙ্কের উপর শূন্য মনে হাঁটুর উপর মাথা নামিয়ে চুপ করে বসে রইল কোভালন ।
কিছুক্ষণ পর সহসা কক্ষে যেন অন্য কারও উপস্থিতি টের পেল সে। বুঝতে পারল, কন্নকী এসে দাঁড়িয়েছে অন্ধকারের ভিতর। কিন্তু মাথা তুলবার ক্ষমতাটুকুও তার আর অবশিষ্ট ছিল না। অন্ধকারে ওইভাবে বসে থেকে থেকে নিতান্ত হৃতসর্বস্ব একটা মানুষের মতো কোভালন হাহাকার করে উঠল, ‘বিপণিতে গিয়েছিলাম। দেখলাম, সব শেষ। এখন আমার ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তিও ফুরিয়ে গেছে। আমি তোমার কথা না শুনে কী যে ভয়ানক ভুল করেছি, কন্নকী! নিজেকে নিজের হাতে শেষ করে দেওয়া ছাড়া আমার আর এখন অন্য কোনো উপায় নেই!
অন্ধকারে দীর্ঘশ্বাস ফেলল কন্নকী। তারপর বলল, ‘উপায় আছে।’ এই বলে সে অন্ধকারের ভিতর অগ্রসর হয়ে হাতড়ে হাতড়ে বর্তিকা খুঁজে নিয়ে প্রদীপ জ্বালল। অস্ফুট প্রদীপপ্রভায় কন্নকীকে দেখা গেল একটি ছায়ামূর্তির মতন ।
হতচকিত হয়ে মুখ তুলে শুষ্ক কণ্ঠে প্রশ্ন করল কোভালন, ‘উপায়? কী উপায় ? ”
কন্নকী চাপা গলায় বলল, ‘উপায়—যত সত্বর সম্ভব সঙ্গোপনে পুষ্পহার নগরী ছেড়ে চলে যাওয়া। এ ছাড়া খাতকদের উৎপাত থেকে বাঁচা আমাদের পক্ষে এখানে আর সম্ভব নয়।’
‘কোথায় যাব?’
‘এই চোলরাজত্ব ছেড়েচলো আমরা মাদুরাই চলে যাই! মাদুরাই পাণ্ড্যরাজার শাসনাধীন । সেখানে বসবাস করলে এই রাজ্যের লোকেরা আমাদের আর জ্বালাতন করতে পারবে না ।’
‘কিন্তু গ্রাসাচ্ছাদন? প্রতিবেশী পাণ্ড্যরাজ্যে আমার পরিচিত একটি লোকও নেই। কার সহায়তায় বেঁচে থাকব ?’
‘কারও সহায়তায় নয়। মাদুরাইতে আমরা আবার নতুন করে ব্যবসা আরম্ভ করব । ছোটো কোনো ব্যবসা।’
বড়ো বিষাদমাখা হাসি হাসল কোভালন। এত দুঃখেও হাসি পেল তার। বলল, ‘ব্যবসা? সে আর কীভাবে সম্ভব, কন্নকী? ব্যবসার জন্য মূলধন লাগে । কোথায় পাব সেই অর্থ? আমার বিত্তকোশ শূন্য; অর্থ নেই।’
প্রদীপবর্তিকাটি উজ্জ্বলতর করে তুলে কন্নকী বলল, ‘অৰ্থ আছে।’
কোভালন অবাক হয়ে গেল। বলল, ‘অর্থ? কীভাবে?”
সেই একইভাবে চাপা গলায় কন্নকী উত্তর দিল, ‘সব গেলেও আমার নূপুর দুটি এখনও যায়নি। সমস্ত খুইয়েছি, কিন্তু নূপুর দুটিকে আমি প্রাণপণে অভাবের গ্রাস থেকে আড়াল করে সযত্নে পেটিকায় তুলে রেখেছি। মনে আছে তোমার সেই রত্নখচিত নূপুর দুটোর কথা ? ও দুটো বেচে আমরা মাদুরাইতে ছোটোখাটো একটা ব্যবসা আরম্ভ করতে পারব।’
আবেগকম্পিত কোভালন অমনি বলে উঠল, ‘কী বলছ কী তুমি, কন্নকী? সেই নূপুর দুটি তো তোমার বাবা তোমাকে জন্মদিনে উপহার দিয়েছিলেন! সে-দুটি তোমার কাছে তোমার বাবার একমাত্র স্মৃতি ! তোমার শেষ অলংকার…’
কন্নকী বলল, ‘দ্যাখো, কোভালন! কোনো বাবা তার মেয়েকে যখন অলংকার দেন, তখন সে শুধু মেয়েকে সুন্দর করে সাজানোর জন্যেই নয়। মেয়ের অভাবের দিনে ওই অলংকারই তার মুখের গ্রাস, পরনের আচ্ছাদন জোগাবে, ওই অলংকারই হয়ে উঠবে অভাগিনী মেয়ের দুঃসময়ের আশ্রয়—একথা প্রত্যেক পিতাই জানেন। মুখ ফুটে তাঁরা কোনো দিন এ বিষয়ে কিছু বলেন না, কিন্তু একথা তাঁরা জানেন। আর সেই জন্যেই অনেক আগে থেকেই তাঁরা এ উপহার কন্যাদের দিয়ে থাকেন…’
কন্নকীর কথায় কোভালন আর নিজের হৃদয়াবেগ ধরে রাখতে পারল না । পর্যঙ্ক থেকে উঠে দাঁড়িয়ে সে কাঁদতে কাঁদতে কন্নকীকে জড়িয়ে ধরল।
নিতান্ত অসহায় শিশু অঝোর ধারায় কাঁদতে কাঁদতে যেভাবে জড়িয়ে ধরে তার মা-কে, ঠিক তেমনই।
কক্ষের অন্ধকার যেভাবে চারপাশ থেকে জড়িয়ে ধরে প্রদীপের বিশীর্ণ শিখাকে, ঠিক তেমনই।
অসহায় কল্পনা নিষ্ফল হয়ে গিয়ে অন্তিম বিন্দুতে প্রবল বাস্তবতাকে যেভাবে আশ্রয় করে, ঠিক তেমনই।
আর ঠিক এইখান থেকেই আমাদের কাহিনি আরম্ভ হল ।
বাসবান্নার এই শেষ কথাটার আঘাতে গল্পের স্বপ্নঘোর ভেঙে যেন সচমকে জেগে উঠলাম আমি আর কাঁকন। বিস্ময়াহত মুখে কাঁকন বলল, ‘এ কী বললেন আপনি? এই এতক্ষণ পরে আপনার এই কাহিনি আরম্ভ হল? তাহলে এতক্ষণ ধরে কী শুনছিলাম আমরা ?’
আমিও হাঁ হাঁ করে উঠলাম, ‘সত্যি, বাসুদা ! আপনি পারেনও বটে! এই এত কিছু বলার পরে আপনি বলছেন, এখান থেকে নাকি গল্পের শুরু? মানেটা কী, অ্যাঁ?”
বাসবেশ্বরণ হাসতে হাসতে তাঁর চোখের চশমাটা খুলে কাপড়ের প্রান্তে কাচ দুটো পরিষ্কার করতে লাগলেন। তারপর চশমা চোখে পরে নিয়ে কাঁকনের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কেন? তোমরাই তো ক্ষণে ক্ষণে আওড়াও যে, তোমাদের প্রিয় ফিল্ম-মেকার জাঁ লুক গোডার্ড বলেছেন, a story should have a beginning, a middle and an end, but not necessarily in that order !’
কাঁকন উত্তর দিল, ‘সে ঠিক আছে। কিন্তু গোডার্ড-এর ওই কথাটি আপনার এই গল্পকথনের ক্ষেত্রে কীভাবে প্রযোজ্য হতে পারে? আপনি তো এতক্ষণ গল্পটা একদম সাবেকি কায়দায় সময়ের অনুক্রম মেনে একধার থেকে বলে যাচ্ছিলেন। এখন হঠাৎ গোডার্ড-এর কথা টেনে আনছেন যে?’
আমিও কাঁকনের সঙ্গে যোগ দিলাম, ‘হ্যাঁ, ঠিকই তো! এখন গোডার্ডকে সাক্ষী মানলে হবে নাকি, বাসুদা ? আপনি কি এতক্ষণ গোডার্ডের কায়দায় টুকরো টুকরো আপাত-বিচ্ছিন্ন দৃশ্যমুহূর্ত তৈরি করে করে কথা বলছিলেন নাকি? এতক্ষণ একটানা গল্প বলে যাচ্ছেন এধার থেকে ওধার, এখন হঠাৎ জাঁ লুক…
শূন্যে দু-হাত তুলে আমাদের দুজনকেই নিরস্ত করে হাসতে হাসতে বললেন বাসবান্না, ‘আচ্ছা, বাবা, আচ্ছা ! গোড়ার্ডের কথাটা কাঁকনকে ক্ষ্যাপানোর জন্যে বলেছি। ওকথা বাদ দাও, কিন্তু তোমরা আমাকে একটা কথা বলো তো! ধরো, যদি আমাকে একটা গাছের গল্প বলতে হয়, তো আমি কোত্থেকে শুরু করব?’
আমি বললাম, ‘কোত্থেকে আবার? যখন থেকে গাছটাকে আমরা দেখছি, তখন থেকেই একটু একটু করে….
বাসুদা বললেন, ‘ঠিক। তার মানে গাছটির অঙ্কুরোদ্গম থেকেই গল্পটা শুরু করব, তাই না?’
কাঁকন বলল, ‘হ্যাঁ। তেমনটাই তো সাবেকি রীতি।’
বাসুদা বললেন, “কিন্তু একটু ভেবে দেখো তো! অঙ্কুরোদ্গমের আগে, মাটির নীচে গাছের বীজের যে প্রাণপণ প্রস্তুতি, যে সূক্ষ্ম অথচ বিপুল পরিবর্তন চলে সেই বীজের ভিতর, তার কথা না বললে এই অঙ্কুরোদ্গম কী আকস্মিক, কী অসম্পূর্ণ, কী অব্যাখ্যাত একটা ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায় !”
কাঁকন বলল, “তা দাঁড়ায় বটে! তবে ওইভাবে দেখলে ‘শুরু’ বলেও তো আসলে কিছু নেই। বীজের আগে আছে পূর্বতন আরেকটি গাছের বৃত্তান্ত। সমস্তই চক্রাকার । বৃত্তের শুরু কোথায়, আর শেষই-বা কোথায় ?”
বাসবান্না বললেন, ‘মানছি তোমার কথা। ঠিকই তো! আর ঠিক সেই জন্যেই তো গল্প বলতে গেলে যেকোনো একটা বিন্দু থেকে শুরু করলেই চলে তাহলে। বৃত্তের শুরুও নেই, শেষও নেই বলেই তো যেকোনো বিন্দু থেকেই বৃত্ত শুরু এবং যেকোনো বিন্দুতেই বৃত্ত শেষ হয়ে যেতে পারে। উপন্যাসের প্রথম অধ্যায়েই গল্প আরম্ভ করতে হবে, এই প্রথাগত ভাবনাটা তাহলে আর দাঁড়াচ্ছে কি, বলো ?’
আমি বললাম, ‘বাসুদা ! আপনি এখন যা বলতে আরম্ভ করবেন, সেটাকেই গল্পের ‘শুরু’ বলতে চান, বলুন গে। কিন্তু তার আগে বলুন তো আমাদের, এতক্ষণ ধরে তাহলে আপনি কী বলছিলেন ?’
বাসুদা দৃঢ় স্বরে জবাব দিলেন, ‘এতক্ষণ আমি যা বলছিলাম, তা ওই অঙ্কুরোদ্গমের আগে মাটির নীচে বীজের প্রাণপণ সংগ্রামের কথা। কোভালনের সংগ্রাম, কন্নকীর সংগ্রাম, মাধবীর সংগ্রাম। সেই সময়ের সমস্ত মানুষের সংগ্রাম। এত সূক্ষ্ম, এত অলক্ষিত অথচ এত অমোঘ সেই সংগ্রাম যে, শিলল্পদিকরম-এর কথাবস্তু ঠিক এইখান থেকেই, হ্যাঁ, ঠিক এই বিন্দুতে এসেই প্রকৃতপক্ষে অঙ্কুরিত হতে পারে। সেই জন্যেই একে আমি কাহিনির যথাযথ আরম্ভ বলতে চেয়েছি। অন্য কিছু নয়।’
কাঁকন যেন সমস্ত তর্ক ফিরিয়ে নিয়ে বলল, ‘আচ্ছা বেশ, ঠিক আছে। তাহলে এখন বলুন সেই সত্যিকারের আরম্ভকথা।’
কোলের উপর হাত দুটো জড়ো করে গুছিয়ে বসে চোখ বুজে বলতে লাগলেন বাসবান্না, ‘হ্যাঁ, ঠিক। এখান থেকেই এ কাহিনির শুরু। এমনকি এখান থেকেই এ কাহিনির শেষেরও শুরু বলতে পারো…’
বাসবান্না পুনরায় আরম্ভ করলেন এবং তাঁর সেই কাহিনি-কথনের সঙ্গে ধীরে ধীরে মিশে যেতে লাগলাম আমরা। প্রাচীনগন্ধী সেই বসবার ঘর, পিলসুজের উপর স্তিমিত আলো-বিকিরণকারী পিতলের প্রদীপ, জীর্ণ বুককেস, ঘরের নোনা ধরা দেওয়াল, এমনকি গল্পকথক নিজেও তাঁর মন্ত্র কণ্ঠস্বরের মধ্যে ক্রমশ মিলিয়ে যেতে লাগলেন….
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন