বেশি দূরে নয়

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

বেশি দূরে নয়

 

কোথায় জয়েন করলেন?

সিয়াটলে।

সেখানেই সেটল করবেন?

জানি না। তবে থাকা তো আর হয় না। যেখানে যেখানে কোম্পানি কাজ পায়, সেখানেই ছুটতে হয়।

আর আপনার মা? তিনি কোথায় থাকবেন?

মায়ের কথা আর কী বলব। আমি কুপুত্র, তাই এই বুড়োবয়সে, যখন আমাকে তাঁর সবচেয়ে বেশি দরকার, তখন আমি তাঁর কাছে থাকতে পারি না। আর আমাকে ছাড়া মা-ও বড্ড অসহায় বোধ করত। সেইজন্য মাকে আমি সিয়াটলে একটা দোকান করে বসিয়ে রেখেছি। ছোটো গ্রসারি শপ এখন দেখছি, এই বাষট্টি বছর বয়সে মা দোকানটা নিয়ে দিব্যি মেতে আছেন। দোকান থেকে এক ব্লক দূরে আমাদের বাড়ি। কাজেই গাড়ি চালাতে না-জানলেও মা-র অসুবিধে হয় না।

আপনি গ্রিনকার্ড হোল্ডার না সিটিজেন?

গ্রিনকার্ড। সিটিজেন হওয়ার ইচ্ছে নেই।

ফিরে আসার ইচ্ছে আছে তাহলে?

যাওয়া বা ফেরার কথা ভাবি না। আমি তো সারা দুনিয়ায় দৌড়ে বেড়াচ্ছি। যাওয়া বা ফেরা কোনোটাই বুঝতে পারি না। আর এই ছোটাছুটি করতে করতে কোনো বিশেষ দেশ নয়, পৃথিবীটাকেই আমার বড্ড ভালো লাগে। গোটা পৃথিবীটাই যেন আমার দেশ।

বিশ্বদেব বলল, দ্যাটস এ নোবেল থট। আসলে পৃথিবীটাই তো আমাদের দেশ হওয়া উচিত। কিন্তু আমরা ছোটো করে ভাবি বলে যত গন্ডগোল।

হঠাৎ টুলুর দিকে চেয়ে অলোক বলল, আপনার রুগির কী খবর?

রুগি! কে রুগি বলুন তো!

আমি রাখীর কথা জিজ্ঞেস করছি।

রাখী ঠিক আমার আণ্ডারে নেই। মেডিসিনের লোকদের আণ্ডারে আছে। তবে অপারেশনের দরকার হলে অন্য কথা। কেন, আপনি কি রাখীকে চেনেন নাকি?

ঠিক সে-রকম চেনা নয়। উনি একটা দলের সঙ্গে পিকনিক করতে জঙ্গলে গিয়েছিলেন। আমরা তখন সেখানে তাঁবু মেলে কাজ করছিলাম। উনি কৌতূহলী হয়ে এসে আলাপ করেন।

শুধু আলাপ?

হ্যাঁ। উনি আমাদের মোড অফ অপারেশনস জানতে চেয়েছিলেন।

এটা কবেকার ঘটনা?

মাস খানেক আগে। তখনই মনে হয়েছিল কোনো কারণে উনি খুব আপসেট। বারবার অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিলেন।

টুলু অবাক হয়ে বলল, কেন আপসেট তা বলেছিল?

নট ইন সো মাচ ওয়ার্ডস। সদ্য চেনা কাউকে বলবেই বা কেন? আমিও ভদ্রতাবশে কৌতূহল দেখাইনি। শুধু বলেছিলাম, ওয়াচ ইওর স্টেপস। আপনি খুব আনমাইণ্ডফুল আছেন। উনি বলেছিলেন, হ্যাঁ, সেটা ঠিক কথা।

আর কিছু নয়?

না। শুধু বলেছিলেন, একজন লোক ওর জীবনটাকে নষ্ট করে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। কারো নাম বলেননি।

মাই গড! এসব তো আমরা জানতাম না।

 

খাওয়ার পর অলোক বিদায় নিতেই স্বস্তি ঘোষণা করল, লোকটা চালিয়াৎ, মোটেই সত্যি কথা বলেনি।

শর্মিলা অবাক হয়ে বলে, কী করে বুঝলি?

কেমন ক্যাবলা টাইপের দেখলে না! গুলগল্প ঝেড়ে গেল। পোশাক দেখলেই তো বোঝা যায়, একদম গোবরগণেশ। খোঁজ নিয়ে দেখো, মোটেই সিয়াটলে থাকে না।

বিশ্বদেব খুব শান্ত গলায় বলল, খোঁজ আমার নেওয়া হয়ে গেছে। আমি আজ সকাল দশটায় এদের দিল্লি অফিসে ই-মেইল করে অলোকের পজিশন জানতে চাই। তারা যে-জবাব পাঠিয়েছে, তাতে বলা হয়েছে, অলোক সিয়াটলে থাকে। গ্লোবাল ফ্রেণ্ডের রিসার্চ গ্রূপের সিনিয়র সায়েন্টিস্ট। আমেরিকায় ডক্টরেট করেছে।

স্বস্তি একটু লাল হয়ে বলল, তাহলেই-বা কী? মোটেই ভালো লোক নয়। কেমন যেন দেমাকি।

শর্মিলা হেসে ফেলে বলল, স্বস্তি, সত্যি করে বলো তো, ছেলেটাকে তোমার পছন্দ হয়ে যায়নি তো!

যা:, কী যে বল বউদি!

বলেই স্বস্তি পালিয়ে গেল।

বিশ্বদেব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ছেলেটা মন্দ নয়। বুঝলে রুচিরা, স্বস্তির জন্য ভাবছিলাম। কিন্তু এ-ছেলে তো সংসারধর্মই করতে পারবে না। সারাবছর বাইরে বাইরে থাকলে সংসার করবে কখন?

তা হোক? আমার অপছন্দ নয়।

শর্মিলা বলল, আমারও খুব পছন্দ বাবা।

টুলু ভ্রূ কুঁচকে কী ভাবছিল। বলল, আমি ভাবছি অন্য কথা।

বিশ্বদেব বলল, কী কথা?

রাখীর সঙ্গে ছোকরা আবার ঝুলে পড়েনি তো? রাখীর সুইসাইডের অ্যাটেম্পটে এ ছোকরারও অবদান থাকতে পারে। এ হয়তো রিফিউজ করেছে।

শর্মিলা অত্যন্ত দৃঢ়কন্ঠে বলে, হতেই পারে না।

কেন পারে না?

রাখী কখনো ওর প্রেমে পড়েনি।

বলতে চাও অন্য কারো প্রেমে পড়েছে?

হ্যাঁ।

সে কে?

সেটা বলা যাবে না।

হোটেলের ঘর। রমেন ভট্টাচার্য আর মৃন্ময়ী।

রমেন বলল, মৃন্ময়ী, আমি তোমাকে ব্ল্যাকমেল করতে আসিনি। এসেছি অফিসের কাজে। যদি প্রজেক্টটা হয়, তবে হয়তো আগামী দু-তিন বছর আমাকে এখানে ঘন ঘন আসতে হবে এবং বেশ অনেকদিন করে থাকতে হবে। সেটা কথা নয়। আসল কথা আমি সব জেনে এবং বুঝেও তোমার সঙ্গে একটা আপসরফায় আসতে চাই। তুমি ভেবে দেখো।

কীরকম আপসরফা চাও তুমি?

রিকনসিলিয়েশন।

সেটা কি সম্ভব! এতদিন পরে?

সেটাই তো ভেবে দেখতে বলছি তোমাকে।

আর রাখী?

রাখী আমার সন্তান নয় জানি। কিন্তু ওর প্রতি মায়া আছে।

আছে?

হাঁ। ওর দু-তিন বছর বয়স পর্যন্ত নিজের মেয়ে মনে করে ওকে ভালোবেসেছিলাম। কিন্তু বড়ো হওয়ার পর দেখলাম ওর মুখে আমার বা তোমার আদল নেই। তৃতীয় ব্যক্তির আদল। সেই ব্যক্তি বিশ্বদেব। তখনই আমি ডিভোর্স করি।

সব মনে আছে।

অভিযোগ তুমিও অস্বীকার করনি।

কেন করব? আজকাল ডি.এন.এ. টেস্টে সত্য গোপন থাকে না।

ঠিক কথা। কিন্তু এতগুলো বছর কেটে যাওয়ার পর ভেবে দেখলাম দুনিয়ায় একা বাঁচা যায় না। আমার তো কেউ নেই। তুমি-আমি দু-জনেই অনেক বদলে গেছি।

আমাকে কি তোমার আর বিশ্বাস হবে?

বললাম তো, এ-বয়সে মানুষের দায়বদ্ধতা এসে যায়। ভেবে দেখো।

বিয়ে করনি কেন?

ভয়ে। নতুন মানুষ এনে ফের যদি বিপাকে পড়ি?

নারীহীন জীবন?

তা বলতে পারি না। ওসব কথা থাক। আমি সন্ধির প্রস্তাব নিয়ে এসেছি।

আমি ভাবব, মেয়েটার জন্যে উদ্বেগে আমার মাথার ঠিক নেই।

জানি, মেয়েটা কি আমার কথা বলত?

খুব। তারপর ধীরে ধীরে অ্যাডজাস্ট করে নিল। তুমি কি ওকে নিজের মেয়ের মতো ভাবতে পারবে?

নিজের মেয়ে তো নেই, তাই সেটা বলা সম্ভব নয়। কিন্তু ওই তো বললাম, ওকে অ্যাকসেপ্ট করতে অসুবিধে হবে না।

 

সকালে বিশ্বদেব যখন বারান্দায় বসে খবরের কাগজ দেখছে, তখন রুচিরা এল, পরনে হাউসকোট।

তোমার সঙ্গে একটা কথা ছিল।

বলো।

ওই অলোক ছেলেটিকে তোমার কেমন লাগে?

ভারি ভালো।

কত মাইন পায় জান?

হঠাৎ এ প্রশ্ন কেন?

স্বস্তির জন্যে ভাবছি।

আরে স্বস্তি তো এখনও নাবালিকা।

তোমার নাবালিকা মেয়ের বয়স আঠারো পেরিয়েছে।

তাতে কী? বিয়ের কথা ভাববার বয়স তো নয়।

শোনো, স্বস্তি লেখাপড়ায় তেমন ভালো নয়, মন নেই। আমার মনে হয় ও বেসিক্যালি হাউসওয়াইফ টাইপ। ঘর-সংসার করার আগ্রহ বেশি।

স্বস্তি কি ওর প্রতি ইন্টারেস্টেড?

অ্যাপারেন্টলি না। বরং উলটোই।

কীরকম?

বউমাকে বলেছে, ছেলেটাকে ওর নাকি একটুও ভালো লাগে না। কেমন জংলি টাইপ, বোকা-বোকা, আনমনা, এইসব।

তাতে বোঝা গেল ওর পছন্দ নয়।

আবার উলটো বুঝলে। ওসব বলা মানেই ও ইন্টারেস্টেড। একটু বেশিই ইন্টারেস্টেড, সেটা ঢাকা দিতেই ওসব বলছে।

উঃ বাপ রে! এ তো দেখছি সাংঘাতিক ভুলভুলাইয়া!

এবার বলো, অলোক কত মাইনে পায়?

মাইনে তোমার মনোমতো না হলে কি পাত্র খারিজ?

না, তা নয়। ওকে আমার ভারি ভালো লেগেছে।

তাহলে মাইনে-ফাইনে গুলি মেরে বিয়ে লাগিয়ে দিলেই তো হয়। পুরুষমানুষ যেমন করেই হোক বউকে ঠিকই খাওয়াতে পারবে। কিন্তু কথা হল অলোকের মতটাও তো নেওয়া দরকার।

সেটার জন্যই তোমাকে লাগবে। ওর মতটা জেনে নাও।

বড্ড তাড়াহুড়ো করছ। অলোক সম্পর্কে আরও একটু খোঁজখবর নেওয়াও দরকার।

তাড়াহুড়ো করব কেন? প্রস্তাবটা দিয়ে রাখলাম। এখন খোঁজখবর যা করার তুমিই করো।

টুলু আর শর্মিলা কি জানে?

খুব জানে। শর্মিলাই তো আমাকে বলল, মা, স্বস্তি কিন্তু বেহেড।

নার্সিং হোমে রাত্রি বেলা একা ঘরে হঠাৎ রাখীর জ্ঞান সামান্য সময়ের জন্যে ফিরে আসে। কিন্তু চোখের দৃষ্টি শূন্য, কর্তব্যরত নার্স গিয়ে ডাক্তারকে খবর দেয়। ডাক্তার আসে।

মিস ভট্টাচার্য। কেমন আছেন?

রাখী জবাব দেয় না। চেয়ে থাকে।

ডাক্তার আরও কিছু প্রশ্ন করে। আঙুল দেখিয়ে কটা আঙুল জিজ্ঞেস করে। রাঘী নিরুত্তর।

কিছুক্ষণ পর রাখী ফের আচ্ছন্নতায় ডুবে যায়।

ডাক্তার চিন্তিত মুখে বলে, লস অফ মেমরি মনে হচ্ছে। নার্স, সাইকিয়াট্রিস্ট মুকুল সেনকে কল দিয়ে রাখুন।

সকালে মুকুল সেন আসে, আবার রাখীর জ্ঞান ফিরে এলে, মুকুল সেন কিছু প্রশ্ন করে। রাখী জবাব দেয় না। কিন্তু চারদিকে তাকায়। অস্থিরতা প্রকাশ করে।

মৃন্ময়ী এবং রমেন ভট্টাচার্য একসঙ্গে ঘরে ঢোকেন।

রাখী মৃন্ময়ীকে চিনতে পারে না। কিন্তু কিছুক্ষণ রমেনের দিকে স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে থেকে ফের আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে।

ডাক্তার মুকুল সেন বললেন, টেমপোরারি মেমোরি লস বলেই মনে হচ্ছে।

রমেন জিজ্ঞেস করে, চান্স অফ সারভাইভ্যাল কতটা?

মুকুল সেন বলেন, শি উইল কাম অ্যারাউণ্ড।

মেডিসিনের ডাক্তার বললেন, শি ইজ ইমপ্রুভিং, কনটিনিউয়াস ইসিজি চলছে। এখনও পর্যন্ত অ্যালার্মিং কিছু পাওয়া যায়নি। তবে হার্ট ইজ উইক।

ডাক্তাররা বেরিয়ে গেলে রমেন আর মৃন্ময়ী পরস্পরের দিকে তাকায়।

মৃন্ময়ী হঠাৎ বলে, রাখী তোমার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিল কেন বলো তো!

রমেন মাথা নেড়ে বলে, জানি না, তবে দেখলাম তাকিয়ে যেন চেনার চেষ্টা করেছিল। অথচ আমি ওর কেউ নই। ব্যাপারটা একটু অদ্ভুত।

বাড়ি চলো।

দাঁড়াও। সবে তো এলাম। আবার হয়তো জ্ঞান ফিরবে।

না। বাড়ি চলো। আমি একটা ডিসিশন নিয়েছি। তোমাকে বলা দরকার।

এখনই?

হ্যাঁ। আমার মন বলছে রাখীর জন্যে আর চিন্তা নেই। ও বাঁচবে। চলো, আমাদের কথাটা জরুরি।

চলো। নার্স, প্লিজ মেয়েটার ওপর নজর রাখবেন।

নার্স হেসে বলল, চব্বিশ ঘণ্টা নজর রাখা হচ্ছে। এটা আই.সি.ইউ., কাজেই নজর রাখাই নিয়ম। তার ওপর সাদা পোশাকের পুলিশও আছে বাইরে।

পুলিশ! পুলিশ কেন?

তা, জানি না। বোধহয় জ্ঞান ফিরলে ওকে ইন্টারোগেট করা হবে।

দু-জনে বেরিয়ে আসে।

মৃন্ময়ী বাড়িতে এসে প্রথমে রমেনের জন্য কফি করে আনে। তারপর কাছাকাছি বসে বলে, শোনো, তুমি হয়তো জানো না যে, রাখী বিশ্বদেবের ছোটো ছেলে বাবলুর প্রেমে পড়েছে।

রমেনের হাতের কফির কাপ খানিকটা চলকে যায়। সে অবাক হয়ে বলে, মাই গড! বায়োলজিক্যালি ওরা ভাই-বোন।

আমার মাথা চিন্তায়-চিন্তায় খারাপ হয়ে যাচ্ছে।

বিশ্বদেব জানে?

হ্যাঁ। কিন্তু জেনে কী হবে? আমি ছেলেটার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করছি। কিন্তু তাতে তো ঠেকানো যাবে না।

কী করতে চাও?

আমাদের এখানকার পাট তুলে দিতে হবে।

পারবে?

রাখীর জন্যে পারতেই হবে। দরকার হলে চাকরি ছেড়ে দেব। আর তোমার প্রস্তাবে রাজি। ভেবে দেখেছি। এটাই বেস্ট অলটারনেটিভ।

দাঁড়াও। আমি যে আমার কোম্পানির কাজে এখানেই পোস্টেড।

তাহলে তুমিও চাকরি ছাড়। আমাদের অন্য কোথাও চলে যেতে হবে।

তোমার ডিসিশনটা হেস্টি হয়ে যাচ্ছে। রাখী যদি যেতে না চায়?

ওর মেমরি কাজ করছে না। এখন যদি চলে যাই, তাহলে আপত্তি করতে পারবে না।

উদ্বেগে তোমার মাথা কাজ করছে না। মেমরি ফিরে এলে তখন ও মানবে কেন এই সিদ্ধান্ত।

আমি যে কিছুই ভাবতে পারছি না।

যেটা সবচেয়ে গুরুতর প্রশ্ন সেটা হল, রাখী সুইসাইড করতে চাইল কেন?

জানি না। সত্যিই জানি না। সুইসাইড বলে আমার মনে হয় না। ওকে কেউ খুন করতে চেয়েছিল।

কেন তা চাইবে?

ও তখন বাড়িতে একা ছিল। আমার মনে হয় কোনো চেনা মানুষ এসে ওকে ছাদে নিয়ে যায়। মাথায় কিছু দিয়ে মেরে অজ্ঞান করে মুখে বিষ ঢেলে দিয়ে চলে যায়।

মৃন্ময়ী, খুনের তো মোটিভ থাকবে। উদ্দেশ্যহীন খুন তো লজিক্যাল নয়।

তুমি ঠাণ্ডা মাথার লোক। তোমার কী মনে হয়?

কোনোভাবে ও হয়তো জানতে পেরেছে ওর বাবা কে।

তুমি, আমি আর বিশ্বদেব ছাড়া আর কেউ এ-কথাটা জানে না।

ঠিক বলছ?

হ্যাঁ।

রমেন মাথা নেড়ে বলে, অঙ্ক মিলছে না।

বিশ্বদেবের অফিসঘরে বিশ্বদেব আর অলোক মুখোমুখি।

বিশ্বদেব বলে, বাই দি ওয়ে, তুমি কি রমেন ভট্টাচার্যকে চেনো?

কেন চিনব না? উনি আমাদের বস। আগে তা এখানেই থাকতেন। ওঁর স্ত্রী এখনও—।

বিশ্বদেব হাত তুলে বাধা দিয়ে বলে, হ্যাঁ, হ্যাঁ জানি। রমেনের পজিশন কীরকম?

উনি সিনিয়র পোস্টে আছেন। ম্যানেজেরিয়াল র‌্যাঙ্ক।

শুনলাম সে এখানে এসেছে। আমার সঙ্গে এখনও দেখা হয়নি। উই ওয়ার ক্লোজ ফ্রেণ্ডস।

প্রজেক্ট হলে উনি এখানেই থাকবেন। ভেরি কমপিটেন্ট ম্যান।

হঠাৎ বিশ্বদেব প্রসঙ্গ পালটে বলে, শোনো অলোক, আজ রাতেও তুমি আমাদের সঙ্গেই খাবে।

আরে, তার কী দরকার? রোজ রোজ আপনার অন্ন ধ্বংস করতে যাব কেন?

তোমার মাসিমার ইচ্ছে।

উঠে দাঁড়ায় অলোক, বলে, ঠিক আছে। কিন্তু আমাকে এখন একটু সাইটগুলোতে যেতে হবে টিম নিয়ে। ফিরতে দেরি হবে।

হোক। আমরা অপেক্ষা করব।

একটু বাদেই রমেন ভট্টাচার্যকে মোটরবাইকের ক্যারিয়ারে চাপিয়ে পাহাড়ি অঞ্চলের রাস্তায় দেখা যায় অলোককে।

রমেন বলে, অলোক, প্লিজ সাবধানে চালাও। তোমার রাশড্রাইভ করার বদ অভ্যাস কেন?

অলোক তবু স্পিড কমায় না। এক জায়গায় বাইক দাঁড় করিয়ে সে তার প্ল্যান বোঝাতে থাকে।

রমেন দু-চারটি প্রশ্ন করে।

তারপর দু-জনে একটা গাছতলায় বসে।

অলোক জিজ্ঞেস করে, ভট্টাচার্যদা, বউদিকে ডির্ভোস করেছিলেন কেন?

রমেন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, সে অনেক কথা! সব শুনতে চেও না। মেয়েরা যখন ক্যারিয়ারকে বেশি গুরুত্ব দিতে থাকে, তখনই সংসারের ভিত আলগা হতে শুরু করে।

মৃন্ময়ী অত্যন্ত অ্যাকমপ্লিশড হেডমিস্ট্রেসবলে শুনেছি।

ঠিকই শুনেছ, তবে শি ওয়াজ নট দ্যাট অ্যাকমপ্লিশড হাউজওয়াইফ।

আপনি সেই পুরোনো মেল শোভিনিস্টের মতো কথা বলছেন।

না রে ভাই, সংসার বা পরিবার যদি গুরুত্বহীন ব্যাপার হত তাহলে মানুষ চিরকাল নোম্যাডস থাকত। পরিবার তৈরি হয়েছিল গুরুতর প্রয়োজনেই।

ফের বিয়ে করলেন না কেন?

ভয় হয়েছিল, দাম্পত্য বোধহয় আমার সইবে না। আমি অচল মুদ্রা।

এখনও তাই ভাবছেন?

হ্যাঁ। তবে আমি মৃন্ময়ীর সঙ্গে যোগাযোগ করেছি।

করেছেন? সেটা আগে বলবেন তো!

মৃন্ময়ীর একটা ক্রাইসিস যাচ্ছে, জানো বোধহয়? ওর মেয়ে—

অলোক অবাক হয়ে বলে, তার মানে? সে তো আপনারও মেয়ে!

কিছুক্ষণ থম ধরে বসে থেকে রমেন বলে, তোমাকে আমি খুব বিশ্বাস করি, তাই বলছি। মেয়েটি আমার নয়। কার তা জিজ্ঞেস কোরো না। কিন্তু মেয়েটাকে আমার কখনো ঘেন্না করতে ইচ্ছে হয়নি।

সরি ভট্টাচার্যদা, বোধহয় একটা সেনসিটিভ প্রসঙ্গ তুলে ফেললাম।

না যা সত্য তাকে কি আর চিরকাল চাপা দিয়ে রাখা যায়? মেয়েটা কেন সুইসাইড করতে চেয়েছিল সেটা জানা দরকার। আরেকটা কথা, মৃন্ময়ীর সঙ্গে আমার একটা বোঝাপড়াও হয়েছে।

সত্যি! কনগ্র্যাচুলেশনস।

ইট ইজ অ্যান অ্যাগ্রিমেন্ট ইন ক্রাইসিস। মৃন্ময়ীর বোধহয় এখন আমাকেই দরকার। আমারও দরকার মৃন্ময়ীকে। লাইক দ্যাট।

অন্যমনস্ক অলোক বলে, মানুষকেই তো মানুষের দরকার।

সন্ধ্যেবেলা নার্সিং হোমে রাখীর কেবিনে ঢুকল মৃন্ময়ী আর রমেন।

নার্স বলল, রাখীর আজ বিকেলে জ্ঞান ফিরেছিল।

মৃন্ময়ী: কিছু বলছিল?

হ্যাঁ, আজই প্রথম দু-একাটা কথা বলল। তবে বোঝা গেল না? শুধু দু-একবার বলল, ফোটো! ফোটো!

ফোটো! কীসের ফটো?

তা বলল না। কয়েকবার উঃ আঃ করেছিল। প্রায় দশ মিনিটের মতো জ্ঞান ছিল। তারপর ফের আগের অবস্থা।

মৃন্ময়ী রমেনের দিকে চাইল। রমেন মাথা নেড়ে জানায়, সেও ব্যাপারটা বুঝতে পারছে না।

কিছুক্ষণ রাখীর পাশে বসে তারা পরস্পর কথা বলল। রাখীকে নিয়ে স্মৃতিচারণ, রাখীর ছেলেবেলার কথা।

বেরিয়ে আসার পর মৃন্ময়ী বলল, হোটেলে না-থেকে বাড়িতেই এসে থাকো না কেন? আমি যে ভরসা পাই।

সেটা কি ভালো দেখাবে মৃন্ময়ী?

খারাপই বা দেখানোর কী আছে? আমরা তো স্বামী-স্ত্রীই ছিলাম। আবার হয়তো তাই হব।

তুমি এ-শহরের মান্যগণ্য মহিলা। তোমার কোনো বদনাম হলে দুঃখের ব্যাপার হবে। স্বামী-স্ত্রী হতে গেলে লোককে জানিয়েই হওয়া ভালো।

তাই হোক, দিনের কিছুটা সময় আমার কাছে থেকো। কী জানি, কেন তুমি আসার পর আমি প্রথমে একটু ভয় পেয়েছিলাম। এখন মনে হচ্ছে তুমি আসায় বেঁচেছি। জোর পাচ্ছি।

লোকে তোমাকে প্রশ্ন করছে না আমাকে নিয়ে?

না। লোকে তো রাখীর কথা জানে, তাই আমাকে বেশি বিরক্ত করতে চায় না। স্কুল থেকে ছুটিও নিয়েছি। ফোটোর কথা কেন বলছিল বলো তো!

বুঝতে পারছি না। খুব সংকোচের সঙ্গে, একটা কথা জিজ্ঞেস করব তোমাকে?

করোই না।

খারাপ ভাবে নিও না। অদম্য কৌতূহল থেকে বলছি।

বলো। কিছু খারাপ ভাবব না।

রাখীর সঙ্গে বিশ্বদেবের মুখের আদল ভীষণভাবে মিলে যায়, তাই না?

হ্যাঁ। কিন্তু ওকথা কেন?

জানতে চাইছি, এ-ব্যাপারে কেউ কি মিলটা লক্ষ করে তোমাকে কিছু বলেনি কখনো?

না। লোকে অত লক্ষ করে না আজকাল। আর মিলটা বোধহয় এখন আর ততটা নেই। রাখী বড়ো হওয়ার পর ওর চুল বড়ো হয়েছে, ভ্রূ প্লাক করে, মেকআপ নেয়। না, এখন চট করে আদল ধরা যায় না, খুব মন দিয়ে লক্ষ না করলে।

লোকে লক্ষ না করুক, রাখী কি লক্ষ করেছে?

না। রাখী আমার বন্ধুর মতো। সব কথা বলে। লক্ষ করলে বলত।

সেটাই বাঁচোয়া।

ভোর বেলা রাখী চোখ মেলেই বাবলুকে দেখতে পেল। চমকাল না, অবাক হল না। ব্যথাতুর মুখে একটু হাসল।

কেমন আছ রাখী?

ভালো।

আমি তোমার জন্যে ভেবে ভেবে পাগল হয়ে যাচ্ছি।

আমি ভালো আছি। বলেই ফের চোখ বুজল রাখী।

তোমার সঙ্গে একটু কথা বলা দরকার ছিল।

রাখী চোখ খুলল না। নিস্তেজ গলায় বলল, এখন কোনো কথা শুনতে আমার ইচ্ছে করছে না। আমি একটু চুপচাপ থাকতে চাই, তুমি এখন যাও।

যাচ্ছি। কিন্তু আমার কথাও একটু ভেব। আমি যে খাদের কিনারায় পৌঁছে গেছি।

জীবনে যা কিছু ঘটে তার সব কিছুর লাগাম আমাদের হাতে নেই। অন্যের পাপ এবং তার ফল আউট আমাদের বহন করতে হয়। তুমি যাও বাবলু, কে কোন খাদের ধারে দাঁড়িয়ে আছে, তা ভাবনার কোনো আগ্রহ নেই আমার। দয়া করে চলে যাও।

একটি অল্পবয়সী নার্স ঘরে ঢুকে বাবলুকে দেখে একটু ভ্রূ কুঁচকে বলল, এটা ভিজিটিং আওয়ার নয়। আপনি কী করে ঢুকে পড়লেন।

রাখী চোখ না খুলেই একটু টেনে টেনে বলল, রুপু, উনি হলেন নার্সিং হোমের মালিকের ছেলে। ওঁর নিয়ম-কানুন মানবার দরকার হয় না। বরং আপনার চাকরি যেতে পারে।

নার্সটি থতমত খেয়ে বলল, ওঃ সরি। আমি তো আপনাকে চিনতাম না।

বাবলু গম্ভীর মুখে বেরিয়ে গেল।

রুপু গরম জলে তুলো ভিজিয়ে রাখীর মুখ স্পঞ্জ করতে করতে বলল, চোখে জল কেন?

চোখের জলের পেছনে অনেক কারণ আছে রুপু। জীবন যে কত অদ্ভুত খেলা দেখায়!

তা খুব সত্যি।

বিষ খেয়েছিলাম, কিন্তু মরলাম না। কেন কে জানে! মরাও হল না, আবার এখন লোকের বিদ্রূপের পাত্রী হয়ে বেঁচে থাকার জ্বালা সইতে হবে।

ওসব কেন ভাবছেন? আমাদের কার জীবনে দুঃখ নেই বলুন তো, তবু বেঁচে থাকার জন্য কী না করতে হয় বলুন? মরলে জ্বালা জুড়োয় হয়তো, কিন্তু জীবনের সবটাই তো আর জ্বালা-যন্ত্রণা নয়। মাঝেমধ্যে আশ্চর্য সুখ, অবাক করা অভিজ্ঞতাও তো হয়। মাস দুই আগে এক মহিলার খুব সেবা করেছিলাম। যাওয়ার সময় উনি আমাকে একছড়া সোনার হার দিলেন জোর করে। বললেন, তুমি প্রফেশনাল নার্স, কিন্তু মেয়ের মতো সেবা করেছ। আমার নিজের ছেলে বিদেশে থাকে, কেবল টাকা পাঠিয়ে খালাস। আপনজনরা তো আপন হল না, তুমি পর হয়েও আপনজনের মতো সেবা করলে।

রাখী চুপ করে শুয়ে রইল, কথা বলল না।

সকাল আটটার পর রমেন আর মৃন্ময়ী এল। মুখে একটু খুশির ভাব।

তোকে নাকি আজ বিকেলে ছেড়ে দেবে।

জানি না।

তার মাথায় হাত রেখে মৃন্ময়ী বলে, খুশি হোসনি?

রাখী চোখ খুলে ম্লান একটু হেসে বলল, খুশি হব কেন? নার্সিং হোম থেকে ছাড়া পেলেই কি মুক্তি? কত কর্মফলের বন্ধন আমাদের আটকে রেখেছে, তা থেকে মুক্তি কোথায় বল!

মৃন্ময়ীর মুখটা শুকিয়ে গেল। চুপ করে কিছুক্ষণ বসে থেকে বলল, আমার দোষ, আমার অপরাধ তো স্খলন হওয়ার নয় মা। কিন্তু মানুষ তো কত প্রতিকূলতা নিয়েও বাঁচে। রমেন অবধি আজ আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। অথচ ওর সঙ্গেই তো আমি সবচেয়ে বড়ো বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলাম।

রাখী স্তিমিত গলায় বলে, তোমার দোষ বা অপরাধ নিয়ে আমি মাথা ঘামাচ্ছি না মা।

আমি শুধু ভাবি, আমার জন্ম অন্যের ইচ্ছাধীন, আমার কর্মফল অন্যের কর্মফলের পরিণতি, আমার স্বাধীন সত্তা বলে কিছু নেই। তাহলে আমরা স্বাধীনতার কথা বলি কেন? কত কত মানুষের রক্ত আমার শরীরে বল তো!

ওসব ভাবিস না মা। আমরা ঠিক করেছি, অন্য কোথাও চলে যাব। তোকে নিয়ে।

পালাবে? তা কেন মা? আমি কোথাও যাব না। এখানেই থাকব। এই শহরে জন্মেছি, বড়ো হয়েছি, এর প্রতিটি ইঞ্চি আমার চেনা। এ-জায়গা থেকে আমি পালাব কেন? যা সত্যি তার কাছ থেকে কি পালানো যায়? না সেটা উচিত?

মৃন্ময়ী আর রমেন পরস্পরের দিকে একবার তাকাল।

মৃন্ময়ী বলল, তাহলে কী করতে বলিস আমাদের?

কপালদোষে আমার দুটো বাবা, একজন জন্মদাতা, অন্যজন পালনকর্তা। জীবনটাকে নতুন ছকে, অন্য প্যাটার্নে আবার নতুন করে ভাবব মা। সে-জীবন অন্যরকম হবে, আর পাঁচজনের মতো নয়। আমি সত্যকে গোপন করব না, পালাব না, মরতে গিয়েও মরা যখন হল না, তখন নতুন আলাদা রকমের একটী জীবনযাপন করার চেষ্টা করতে হবে। তোমাকেও পালাতে দেব না, যা সত্য তা স্বীকার করে এখানেই থাকতে হবে তোমাকে, পারবে না?

মৃন্ময়ী কাঁদছিল। মেয়ের মাথায় আরেকবার হাত রেখে বলল, পারব।

 

 

খানিকটা দৌড়োতে হল শেষ দিকে। নইলে, মেচেদা লোকালটা ধরা যেত না। কিন্তু ট্রেনে উঠেই বুকটা বড়ো ফাঁকা ফাঁকা লাগছে মণিরামের। বাঁ বুকটা চেপে ধরে মণিরাম কঁকিয়ে উঠল,—গেছে রে প্রীতম!

প্রীতম গায়ে-পায়ে মানুষ। অত বড়ো দুটো ভারী ব্যাগ দু’হাতে নিয়ে মণিরামকে সাত হাত পিছনে ফেলে শেষের দু-নম্বর বগিতে উঠে পড়েছে। মেচেদা লোকালে তেমন ভিড় নেই। সিটে বসে প্রীতম পাশে জায়গা রেখেছে তবু। বলল, কী গেল?

মানিব্যাগটা। তেইশ বছরে এই প্রথম পকেটমারি। বুঝলি?

বউনি হল তা হলে! তা গেল কত?

টাকাটাই কি বড়ো কথা রে? গুমোর ভেঙে দিল যে।

টাকাটা কি ফ্যালনা নাকি?

তা ধর, সুখরামের গদিতে দেড় হাজার ঝেড়ে এলাম। কেশববাবু তিন-শো চল্লিশ। আগাম দিতে হল ধানুরামকে। নেই নেই করেও একুশ টাকা ছিল।

তাই বল। চোরেরও কি মুখরক্ষা হল? ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ!

মণিরাম ধপ করে বসে পড়ল পাশে। বুকপকেটের কাছটা এখনও ডান হাতে চেপে ধরে আছে। বিশ্বাস হচ্ছে না যেন।

কখন নিল বলতে পারিস? ভোজবাজির মতো উবে গেল যে!

ওসব না শিখে কি আর লাইনে নেমেছে গো! টেরই যদি পাবে, তা হলে সে আর পকেটমার কীসের? তবে আহাম্মক বটে। ফিরতি পথে মাল গস্ত করে করেও পকেটে পয়সা থাকে?

গাড়ি ছেড়েছে। কার্তিকের শেষ, এখন চলন্ত ট্রেনের হাওয়ায় গা শিরশির করে। আজ একটু মেঘলাও আছে বলে হাওয়াটা ঠাণ্ডা।

জানালাটা নামিয়ে দিবি নাক?

আমার মাল টেনে ঘাম হচ্ছে। একটু শুকোতে দাও, তারপর নামিয়ে দেবখন।

একুশটা টাকাই তো নয়, মেলা কুচো কাগজ ছিল। বগলামায়ের একখানা ছবি, পাঁচ-ছটা ঠিকানা, গোটা কয়েক ফোন নম্বর। বড়ো গুমোর ছিল। কোনও দিন পকেটমারি হয়নি আমার। প্রায় নিত্যি যাতায়াত এই তেইশ বছরে।

ওসব ভেবে খামোখা হা-হুতাশ করো কেন? টাকাই যখন তেমন যায়নি তখন দুঃখ কীসের? অল্পের ওপর দিয়ে বউনিটা হয়ে গেল। বরাবর তোমার বরাতের জোর তো দেখছি!

তোর নজরে নজরেই আমার এসব হয়েছে। বরাতের দেখলিটা কী রে শালা! মরছি নিজের জ্বালায়। বাজারে দেনা কত জানিস?

প্রীতম জানালাটা নামিয়ে দিয়ে বলল, ঠাণ্ডা হয়ে বোসো তো। দেনার কথা কাকে বলছ? মায়ের কাছে মাসির গপ্পো? দেনায় তোমার হাঁটুজল হলে আমার ডুবজল। বছর ঘুরতে কারবারটা যদি না দাঁড়ায়, তা হলে হাজতবাস কপালে আছে।

মণিরাম প্রীতমের অবস্থাটা জানে। রা কাড়ল না। ছোঁড়া পরিবার নিয়ে হয়রান হয়ে গেল। বাপ বিনোদকুমার একটা জীবন জুয়ো খেলে ভাগ্য ফেরানোর চেষ্টা করে এখন জবুথবু হয়ে বসে বসে বিড়বিড় করে।

মণিরামের বউ দীপির আবার প্রীতমকে ভারি পছন্দ। ননদ ফুলির জন্য দেখে রেখেছে। ফুলির ভাবগতিক অবশ্য বোঝা যায় না। লেখাপড়া নিয়ে ভারি ব্যস্ত। বিয়ের কথা বলতে গেলেই ঝেঁঝে ওঠে।

প্রীতম তার ভগ্নীপোত হলে মণিরামের ব্যাপারটা অপছন্দের হবে না। ছোকরা লড়িয়ে আছে বটে। বাপের এক পয়সার মুরোদ ছিল না। চারটে ভাইবোন যে কী কষ্ট করে বড়ো হয়েছে তা না দেখলে প্রত্যয় হয় না। শাকের ঝোল আর ভাত। কিংবা কখনো শুধু শাকের ঝোল, কখনো মেটে আলু, কচু-ঘেঁচু খেয়ে বড়ো হয়েছে। বাড়ি-জমি সব বেহাত হয়েছে। দেনায় বিনোদকুমার ভুরু অবধি ডুবে ছিল। প্রীতম মাধ্যমিকটা ডিঙিয়েই কাজে মেমে পড়ল। মণিরাম নিজে ব্যবসাদার বলে জানে, হ্যাপা কত। আর কত লোকের বায়নাক্কা বুঝে চলতে হয়। প্রীতম শুরু করেছিল চাল বেচে। এখন গঙ্গারামপুরে দু-দুখানা দোকান। ধারকর্জ আছে বটে, কিন্তু বুকের পাটা আর রোখ আছে বলে সব কাটিয়ে ভেসে উঠবে ঠিক।

মানিব্যাগটার কথা খানিক ভুল পড়ল লেবু-চা খেয়ে। প্রীতমই খাওয়ালো। বলল, মুখটা অমন আঁশটে করে রেখো না তো। পিছনের দিকে যত চাইবে তত এগোতে ঢিলে পড়বে।

ওরে, পকেটমারিটা বড়ো কথা নয়, আহাম্মকির কথাটাই ভাবছি। আমার বিশ্বাস ছিল, আমি হুঁশিয়ার মানুষ। ট্রেনটা ধরতে দৌড়োতে না হলে।

এবার থেকে গোঁজ করে নাও। অবিশ্যি যখন যাওয়ার তখন গোঁজও যাবে।

চেনা-জানা দু’চারজন উঠে পড়ল কামরায়। রাধাপুরে সুধীর হাজরা, বীরশিবপুরের কানাই মন্ডল, আরও দু’তিন জন এদিক-ওদিককার চেনা লোক। সুধীর পাশের ফাঁকা সিটে বসে বিড়ি ধরিয়ে তার শালার বিয়ের গল্প ফেঁদে বসল। কথায় কথায় পথটা কেটেও গেল, যেমন রোজই যায়।

উলুবেড়েতে নেমে কুতুবের দোকান থেকে দু-জনে জমা রাখা সাইকেল বের করল। ক্যারিয়ারে একখানা ব্যাগ নাইলনের দড়িতে বেঁধে, আর একখানা ব্যাগ হ্যাণ্ডেলে ঝুলিয়ে প্রীতম বলল, তুমি এগিয়ে পড়ো মণিরামদা। আমাকে সাইকেল ঠেলেই যেতে হবে। এ গন্ধমাদন নিয়ে তো সাইকেলে চাপার উপায় নেই।

চাপবখন। একটু হাঁটি চল তোর সঙ্গে। একখানা ব্যাগ আমার সাইকেলে চাপিয়ে দে না।

না গো মণিরামদা। তুমি হলে আয়েসি মানুষ। জীবনে মালপত্র বয়েছ কখনো।

ছেলেবেলায় বয়েছি। তখন তো বাবার এত ফাঁদালো কারবার ছিল না। তখন বাপ-ব্যাটায় বিস্তর বয়েছি।

তোমার হল আদরের শরীর। গদিতে পয়সা ফেলে চলে এলে। তারা মালপত্র ট্রাকে পাঠিয়ে দেবে। আমার তো তা নয়।

গঙ্গারামপুর অনেকটা রাস্তা। হেঁটে যাওয়ার কথা ভাবতেই মণিরামের গায়ে জ্বর আসে। কথাটা ঠিক, তার বেশি কষ্ট করার স্বভাব নয়। বাপের বড়ো কারবার থাকলে এইটে সুবিধে।

প্রীতম আগে আগে, কয়েক পা পিছিয়ে মণিরাম। ও দু-খানা ব্যাগের ওজন মণিরাম জানে। সাইকেলে চাপিয়ে নিয়ে যাওয়াও সহজ নয়। মণিরাম পেরে উঠত না। একটু ঝুঁকে ওই গন্ধমাদন ঠেলাওলার মতো নিয়ে চলেছে প্রীতম। একটা ভ্যান ভাড়া করতে পারত। কিন্তু ও তা করবে না। বরাবর নিজের মাল নিজেই বয়ে আসছে। পিছন থেকে দৃশ্যটা দেখে হিংসে হয় মণিরামের। কী পুরুষালি, শক্ত সমর্থ শরীর প্রীতমের। তার নিজের বড়ো বাবু শরীর। এই পঁয়ত্রিশ বছর বয়সেই তার একটু চর্বি জমেছে শরীরে, দৌড়ঝাঁপেও কমছে না। দীপি আজকাল বলে, কেমন ন্যাদস মার্কা হয়ে যাচ্ছ, কেন গো?

তুমি সাইকেলে চেপে এগিয়ে পড়ো মণিরামদা। আমার সঙ্গে ভদ্রতা কীসের?

একা একা এতটা পথ যাবি?

দোকা পাব কোথায়? নিত্যিদিন যাচ্ছি। রোজ তো আর তুমি থাকো না।

তা বটে। ফেরার সময় আজ আবার বিপিন ডাক্তারের বাড়ি হয়ে যেতে হবে। তোর বউদির ব্যথাটা কমছে না।

হ্যাঁ হ্যাঁ যাও।

দেখে বুঝে যাস। সন্ধ্যের পর দেখা হবেখন।

মণিরাম সাইকেলে চেপে বসল।

বয়সে পাঁচ-সাত বছরের বড়ো এই মণিরামদাদাকে প্রীতম পছন্দই করে। বহুবার মণিরাম তাকে ব্যবসার জন্য টাকা হাওলাত দিতে চেয়েছে। অভাবের দিনে সাহায্য করতে চেয়েছে। প্রীতম নেয়নি। নেওয়া জিনিসটার একটা অসুবিধে হল, লোকটার মুখোমুখি হলেই কেমন যেন অসোয়াস্তি হতে থাকে, যেন সমান সমান মনে হয় না। দুর্বল আর ছোটো লাগে নিজেকে। তবে হ্যাঁ, ব্যাংকের লোনটা পাইরে দিতে মণিরামদা জামিন না হলে মুশকিল ছিল। সেই লোন প্রাণপাত করে শুধতে হচ্ছে। আধাআধি হয়ে এসেছে এখন। বিকিকিনি একটু একটু করে বাড়ছে। রাতারাতি, শর্টকাটে যে কিছু হওয়ার নয়, তা প্রীতম ভালোই জানে। শর্টকাটে বড়োলোক হতে গিয়েই না তার বাপটা ডুবে গেল।

না, বাপের ওপর রাগ নেই তার। সব লোক কি সমান হয়? অপদার্থ হোক, জুয়াড়ি হোক, এই বাপটা তো তাকে বরাবর বুক দিয়ে ভালোবেসেও এসেছে। ভাতে টান পড়লে ‘বাইরে খেয়ে এসেছি’ বলে ছেলে-মেয়েদের মুখে গ্রাস তুলে দিত। মা যদিও দু-বেলা ঘর-বসা লোকটাকে উঠতে-বসতে উস্তম-কুস্তম অপমান করে, কিন্তু প্রীতমের বড্ড মায়া হয়। বাপটা খারাপ ছিল না তার, তবে বড্ড বোকা আর অদূরদর্শী। এখন মনস্তাপে কষ্ট পায়। মাঝে মাঝে ভেউ ভেউ করে কাঁদে।

বাপকে দেখে দেখে ছেলেবেলা থেকেই তার রোখ চেপেছিল, কিছুতেই বাপের মতো হবে না সে। সংসারকে বাঁচাতে হবে। মাধ্যমিকটা পাশ করার পরই সে লেখাপড়ায় ইস্তফা দিয়ে রোজগারের জন্য হন্যে হয়ে উঠল। তখন এই মণিরামদাদা পাশে না থাকলে গাড্ডায় পড়ে যেত সে। তেজেনবাবু চানাচুরের কারখানা খুলেছিলেন। প্রথমে সেটাই বাকিতে নিয়ে দোকানে দোকানে দিত সে। বিক্রি ভালো ছিল না। তার পরে বেকারির বিস্কুট সাপ্লাই দিতে লাগল। সেটাও ফেল মারল। কাঁচা সবজিও চলল না তেমন। বাজারের একটেরে গলির মধ্যে হীরু দাসের মনোহারী দোকান ছিল। সেটা মোটেই চলত না। হীরু দাস মারা যাওয়ার পর তার ছেলে সুধীর দোকানটা বেচে দিল। কিনল মণিরামদাদার বাবা সফলরাম। কিন্তু তার গোটা পাঁচেক দোকান, তার ওপর হোলসেল। হীরু দাসের দোকানটা কিনেও ফেলেই রাখতে হচ্ছিল। মণিরামদাদা তখন তার বাপকে বলে দোকানটা বন্দোবস্ত করে দিল প্রীতমকে। সফলরাম ছেলের মতো নয়। মায়াদয়া দেখানোর লোক নয়। পরিষ্কার বলে দিল, দানখয়রাত করতে পারব না বাপু, তবে তোর কাছ থেকে লাভও তেমন নিচ্ছি না। পাঁচ পারসেন্টে ছেড়ে দিচ্ছি। তবে তিন মাসের মধ্যে ডাউন পেমেন্ট।

ব্যাংকের টাকাটা পেয়ে ধার শোধ করে দোকানটা নিয়ে ফেলেছিল সে। গলির দোকান চলে না হয়তো। কিন্তু, দোকানি যদি ভালো হয় তবে তেপান্তরে দোকান দিলেও খদ্দের খুঁজে ঘুঁজে গিয়ে হাজির হয়। প্রীতম দাঁতে দাঁত চেপে তার গরিব দোকানটার পিছনে পড়ে রইল। বাছাই জিনিস, কম লাভ আর মিষ্টি কথা। এই সবই ছিল তার মূলধন। লোককে ঠকায় না, নিজেও না ঠকবার চেষ্টা করে।

 

 

সাইকেলের হ্যাণ্ডেলের দু-ধারে দুটো আর ক্যারিয়ারে আরও একটা পেল্লায় সাইজের ঠাস-ভর্তি নাইলনের ভারী ব্যাগ চাপিয়ে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে যে লোকটা সে হল গঙ্গারামপুর বাজারের ছোটো দোকানদার প্রীতম। সপ্তাহে দু-দিন বিকেল চারটে ছত্রিশের লোকালে এসে নামে। কুতুবের দোকানের পিছনে সাইকেলের খোঁয়াড় থেকে নিজের দীনদরিদ্র সাইকেলখানায় মালপত্র চাপিয়ে সেই গন্ধমাদন ঠেলতে ঠেলতে গঙ্গারামপুর পর্যন্ত যায়। কোনো দিকে তাকায় না। অত বোঝা টানলে কি আর মানুষ মানুষের মতো থাকে? হালের বলদের মতো হয়ে যায়। কিন্তু তাকালে, এই কার্তিকের বিকেলের মায়াময় আলোয় শিকদারবাড়ির বারান্দায় শেফালিকে ঠিক দেখতে পেত। প্রীতম শেফালিকে দেখতে পায় না বটে, কিন্তু শেফালি প্রীতমকে দেখতে পায় এবং দেখে। বলতে নেই, শত কাজ থাকলেও সপ্তাহে দু-দিন ঠিক সাড়ে চারটের লোকাল আসার সময়টায় শেফালি বারান্দায় এসে দাঁড়াবেই।

না, প্রীতম ঠিক মানুষ নয়, খানিকটা মানুষ, বাকিটা এক বলশালী, গোঁয়ার অবুঝ জন্তু। টালমাটাল সাইকেলখানাকে ওই ভারী মাল সমেত সামলানোর জন্য গায়ের জোর লাগে। প্রীতমের সেটা আছে। কিন্তু শুধু গায়ের জোর থাকলেই তো হবে না গো! তোমার আর কিছু নেই? চোখ নেই তোমার? দেখতে পাও না, তোমার জন্যই একটা তাজা বয়সের মেয়ে কেমন লাতন হয়ে, বিভোর হয়ে চোখ বিছিয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে? তাও তো রোজ তোমার দেখা নেই। সপ্তাহে মোটে দুটো দিন।

যত দূর দেখা গেল চেয়ে রইল শেফালি। কী চওড়া পিঠ, দু-খানা শাবলের মতো হাত, একটু কুঁজো হয়ে সাইকেল ঠেলে নিয়ে চলেছে। যেন এ ছাড়া ওর আর কোনো কাজ নেই দুনিয়ায়।

প্রীতম চলে গেলে শেফালির বিকেল ফুরিয়ে যায়। অনেকক্ষণ আর কিছুই থাকে না। সব ‘না’ হয়ে যায়।

সে যে খুব সুন্দরী মেয়ে তা নয়, আবার কুচ্ছিতও নয়। তাকে দেখে কেউ কখনো বলেনি, ‘বা:, কী সুন্দর মুখখানা’, বা বলেনি, ‘ইস কী কুচ্ছিত রে’! বড্ড মাঝারি মেয়ে সে। নিজেকে আয়নার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মাঝে মাঝে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বিচার করে দেখে সে। কখনো পছন্দ হয়, কখনো হয় না। কিন্তু চেহারা ছাড়া কি মেয়েদের আর কিছু নেই? শুধু দেখনসই হলেই হল?

‘পিউ স্টোর্স-এ সে এক-আধবার গেছে। প্রীতমের দোকান। চোখ তুলে দোকানির দিকে চাইতে সাহস হয়নি। পেনসিল, মাথার তেল বা ওইরকম কিছু কিনে কাঁপা হাতে দাম দিয়ে মুখ নীচু করে চলে এসেছে। তার বেশি এগোতে পারেনি কখনো। ওসব জিনিস পাড়ার দোকানেই পাওয়া যায়। তবু যে এত দূর কষ্ট করে যায় সে তা কি কেউ টের পায়, বোঝে?

আজও একটু সেজেই দাঁড়িয়ে ছিল শেফালি। কোনও কাজে লাগল না। মধুমিতাকে সে সব বলে। তার গলাগলি বন্ধু। মধুমিতা বলে, দাঁড়া না, ঠিক একটা ব্যবস্থা হবে। তবে প্রীতমদারা কিন্তু বড্ড গরিব। এখন অবশ্য ততটা গরিব আর নেই।

গরিব তো কী? গরিবরাই ভালো।

 

 

শেফালির হাবা ভাই সীতু ওই বসে আছে দাদুর কাছে। পুজোর ঘরের বারান্দায় মাদুর পেতে দাদু বসে আছে একটা হাঁটু বুকের কাছে জড়ো করে। সীতু হাফ প্যান্টের নীচে তার দুটো আদুর রোগা ঠ্যাং ঝুলিয়ে। পায়ের কাছে টাইগার কুকুর। এই ষোলো বছর বয়সেও বুদ্ধি খুলল না সীতুর। সারাক্ষণ কেবল বড়ো বড়ো দাঁত বের করে হাসে। একটা পচা স্কুলে সেই কবে ক্লাস থ্রিতে ভর্তি হয়েছিল, আজও সেই থ্রিতেই পড়ছে। সীতু কোনো দিন ফোরে উঠবে না, সবাই জানে। তবু মাসে মাসে বাবা ওর স্কুলের বেতন মিটিয়ে দেয়। তাই স্কুল থেকে ওকে তাড়ায় না। ওর যত ভাব দাদু আর টাইগারের সঙ্গে। এ বাড়িতে একমাত্র দাদুই যা ওকে কাছে ডেকে বসায়, কথাটথা কয়। আর টাইগার সারা দিন সীতুর পিছনে পিছনে ছায়ার মতো লেগে থাকে। বোকা বলে সীতুর তেমন বন্ধু নেই। খেলায়ও নেয় না কেউ ওকে। ও যে বোকা তা টাইগার বুঝতে পারে না, তাই ও টাইগারের সঙ্গেই ছোটাছুটি করে খেলে।

আর তার দাদু খুব একাবোকা মানুষ। যেন একটা ফেলে দেওয়া ন্যাকড়ার মতো এক ধারে পড়ে থাকে। ঠাকুরঘরের পিছন দিকটায় একটা খুপরি মতো আছে। ভারী ছোট্ট ঘর। একটা চৌকি এঁটে আর এক চিলতে জায়গা। তেল, মাজন সব জানালার তাকে। ব্যস ওতেই দাদুর হয়ে যায়। ঠাকুমা মারা গিয়ে অবধি দাদু পিছু হটতে হটতে ওইখানে গিয়ে ঠেকেছে। তাকে কারো মনেই পড়ে না। শেফালির পড়ে। দিনে একবার দুবার সে গিয়ে দাদুকে দেখে আসে। কথা কয়। তবে শেফালিরও তো কাজ আছে। ক্লাসের পড়া, মায়ের ফরমাস, একটু আড্ডা, একটু মনখারাপ করে বসে থাকা। এই মন-খারাপটা বড্ড ভালো জিনিস। রাজ্যের অভিমান উঠে আসে বুকে। নাক ফুলে ফুলে ওঠে। কান্না পায়। কার ওপর অভিমান তা বুঝতে পারে না। গোটা দুনিয়াটার ওপর, এই মানবী জন্মের ওপর, প্রীতমের ওপর। সব কিছুর ওপর অভিমান উথলে ওঠে যখন, তখন লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদতে যে কী ভালোই লাগে।

মেয়ে-জন্মের একটা বাধক হল, বাড়ি থেকে বেরোতে গেলেই কেউ-না-কেউ চোখ পাকিয়ে বলবে, অ্যাই কোথায় যাচ্ছিস? যেন নিজের ইচ্ছেয় কোথাও যাওয়ার নেই তার। এই যে কার্তিকের এই মায়াবী বিকেলে পশ্চিমের খুনখারাপি আকাশের তলায় এক মায়াজাল পাতা হয়েছে, এ কি তার জন্যই নয়?

জন্ম থেকেই দেখে আসছে শেফালি, তাদের এই জায়গাটা ভারি দুঃখী জায়গা। জায়গাটার যেন সব সময়ে মুখভার। কখনো হাসি ফোটে না মুখে। ক-দিন আগে রানাঘাটে মাসির বাড়িতে গিয়েছিল শেফালি। কী হাসিখুশি জায়গাটা। সব সময়ে যেন আহ্লাদে গড়িয়ে পড়ছে। মাঝে মাঝে সাহস করে বোম্বে রোডের দিকে বন্ধুদের সঙ্গে যখন যায় শেফালি, তখন মনে হয়, জায়গাটা যেন এক দুষ্টু-দুষ্টু পুরুষ মানুষ। লরির সার দাঁড়িয়ে আছে। ধাবায় কেমন ব্যস্তসমস্ত লোকজন। কেমন সাঁ করে অনেক দূর চলে যাচ্ছে চকচকে সব গাড়ি। বাবা যে কেন বাড়িটা ওদিকে করল না কে জানে। স্টেশনের এক-পাশটা বড্ড পান্তাভাত, ঝিমধরা।

মা একটু আসছি।

কোথায় যাচ্ছিস?

মণিমালাদের বাড়িতে।

দয়া করে তাড়াতাড়ি এসো।

সবাই জানে, সে খুব বেশি দূর যাবে না। তারা, মেয়েরা সব অদৃশ্য দড়িতে শক্ত করে বাঁধা। তাদের কোনো দূর নেই। কোনো অনন্ত নেই। এক বাঁধা অবস্থা থেকে আর এক বাঁধা পড়ার জন্যই তারা জন্মায়।

কী হল হেনার? তাদের বাড়ির সামনে ছোট্ট মাঠটায় এক শীতকালে বাহাত্তর ঘণ্টা সাইকেল চালিয়েছিল বিনোদ মাল। বাঁশের খুঁটিতে লাইট লাগানো, চব্বিশ ঘণ্টা মাইকে হিন্দি গান, চারদিকে ভিড়ের মধ্যে ঝালমুড়ি, ফুচকা, চানাচুর-বাদামের দোকান বসে গেল। বিনোদ সাইকেল চালাচ্ছে তো চালাচ্ছেই। ঘুম নেই, বিশ্রাম নেই। শেফালিও বন্ধুদের সঙ্গে দেখতে যেত। কিন্তু মজা লাগত না তার। কষ্ট হত রোগাপানা ছেলেটার জন্য। কী কষ্ট ক্লান্ত পায়ে প্যাডেল করে যাওয়ার মধ্যে! বিনোদের ওই কষ্ট আর পুরুষকার জানালার ফাঁক দিয়ে দিনরাত দেখত হেনা। তারও কষ্ট হত। আর হতে হতেই তার বুক উথলে উঠল। প্রাণ আকুল হল। হাউ হাউ করে কাঁদত। যে-দিন বাহাত্তর ঘণ্টা শেষ হল সে-দিন বিনোদকে কাঁধে নিয়ে পাড়া ঘোরালো ক্লাবের ছেলেরা। টাকার মালা পরানো হল। বিনোদের জয়ধ্বনিতে কান পাতা দায়। হেনা গিয়ে ছলছলে চোখে তার গলার সোনার চেনটা খুলে পরিয়ে গিয়েছিল বিনোদকে। প্রকাশ্যেই। তাতে একটা কানাকানি শুরু হয়েছিল। আর বাবার হাতে বিশ বছরের মেয়েটা খেয়েছিল বেদম মার। শেষে ওই বিনোদের সঙ্গে পালিয়ে গিয়েছিল হেনা। গিয়ে দেখল বিনোদের আরও একটা বউ আছে, দুটো বাচ্চা এবং হাঁড়ির হাল! বিনোদের সংসারের জন্য সময় নেই। সে কেবল এখানে-সেখানে সাইকেল চালিয়ে বেড়ায়। ওটাই তার রুজি-রোজগার। শখ আহ্লাদ দু-দিনেই মরে গিয়েছিল হেনার। এই বছরখানেক আগে কোলে একটা খোকা নিয়ে বাপের বাড়িতে ফেরত এসেছে।

মেয়েদের জীবনটাই ও-রকম। যতই ভালোবাসুক না কেন, পুরুষ জাতটাই তো বিশ্বাসঘাতকের জাত। হেনা আজকাল দুঃখ করে বলে, কী বয়স আমার বল! লেখাপড়া করতে পারতাম, গান গাইতে পারতাম। জীবনটাই মাটি হয়ে গেল। কেন যে পোড়া চোখে ওই সাইকেল চালানো দেখতে গিয়েছিলাম।

মেয়েদের জীবনটা এ-রকম। তা বোঝে শেফালি। সব বুঝেও ফের ফাঁদে পা দিতেও ইচ্ছে হয়। যতবার ঠকে যাক, ফের ঠকতে রাজি হয়ে যাবে হাসি-হাসি মুখ করে। তারা বড্ড বোকা। তার হাঁদা ভাই সীতুর সঙ্গে সত্যিই কি তার কোনো তফাত আছে?

কথাটা ভাবতে ভাবতেই সীতুর ডাক কানে এল, দিদি! এই দিদি! ফিরে দাঁড়িয়ে শেফালি বিরক্ত গলায় বলল, কী হল?

কোথায় যাচ্ছিস?

তাতে তোর কী?

মা ডাকছে।

কেন?

মায়ের হাওয়াই চপ্পলটা ছিঁড়ে গেছে। এক জোড়া কিনে আনতে বলল।

আমার কাছে পয়সা নেই। দৌড়ে গিয়ে মায়ের কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে আয়। আমি দাঁড়াচ্ছি।

সীতু সত্যিই দৌড়োল।

বুকটায় এক মুঠো আবির কে যেন ছড়িয়ে দিল হঠাৎ। ভিতরটা যেন রঙিন। এক জোড়া হাওয়াই চটি তাকে গঙ্গারামপুর অবধি নিয়ে যাবে। ওইখানে এক মানুষ জন্তু, এক শ্রমিক-পুরুষ, এক উদাস উদ্যমী তাকে হেলাফেলা করবে বলে বসে আছে নিজের দোকানে। চেনেও না তাকে। না চিনল তো বয়েই গেল। তবু কি আমি তোমার চোখের বালি না হয়ে থাকতে পারি? অবহেলা কি আজকের? সৃষ্টির প্রথম দিন থেকেই তো আমরা তোমাদের হেলাফেলার জিনিস! কখনো কখনো আদর করে বুকে তুলে নাও বটে, তার পরই শোঁকা ফুলের মতো ফেলে দাও, আর ফিরেও তাকাও না। তবু আমরা তো বার বার অচ্ছেদ্দা সয়েও তোমাদের জন্যই ফুটে থাকি।

ছুটতে ছুটতেই এল সীতু, তার পিছনে টাইগার, দিদি, আমাকে সঙ্গে নিবি?

শেফালি ভ্রূ কুঁচকে একটু দেখল। গায়ে একখানা হলুদ ডোরাকাটা জামা, পরনে হাফপ্যান্ট। রোগা ল্যাকপ্যাকে চেহারা। কী জানি একটু মায়া হল। বলল, চল।

মাঝখানে দুটো ঝুড়ি আর ধার ঘেঁষে দু-জনে বসা, তার মধ্যেই ঠেলে ঘেঁষটে ভ্যানগাড়িতে উঠে পড়ল ভাইবোন।

সীতু হাসছে, যেমন সব সময়ে হাসে।

শেফালি ধমক দিয়ে বলল, দাঁত বন্ধ কর তো। সব সময় হাসি আসে কেন তোর? লোকে বোকা বলবে না?

চপ খাওয়াবি দিদি?

টাইগার ভ্যানগাড়ির পিছনে ছুটছে। গঙ্গারামপুর অবধি যাবে। যাক। সীতু যে বোকা সেটা টাইগার বুঝতে পারে না। তাই সীতুর সঙ্গে থাকে সব সময়ে।

ইস্কুল থেকে ফিরে ভাত খাসনি?

খেয়েছি তো!

তবে আবার চপ কীসের?

খাওয়াবি না?

আচ্ছা খাস!

দিদি।

হুঁ।

আমাকে তোর স্কুলে ভরতি করে নিবি?

আমার স্কুলে! পাগল নাকি? আমাদের তো মেয়েদের স্কুল।

মেয়েরাই ভালো। ছেলেগুলো বড়ো পিছনে লাগে।

তুই তো বোকা, সবাই বোকাদের পিছনে লাগে।

তোর স্কুলে আমাকে নেবে না?

তাই নেয় কখনো? চুপ কর তো!

ঠোক্কর মারে যে! এই দ্যাখ না, মাথা ফুলে গেছে।

শেফালি গম্ভীর হয়ে রইল। সীতুটাকে নিয়ে সব জায়গায় যাওয়া যায় না। ভারি লজ্জা করে। অপ্রস্তুত হতে হয়।

চুপচাপ বসে থাক। বকবক করতে হবে না।

কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে সীতু ফের ডাকে, দিদি!

হুঁ।

তোর বিয়ে হবে না?

চুপ কর তো!

তোর কার সঙ্গে বিয়ে হবে জানিস?

কার সঙ্গে?

ফুটুদার সঙ্গে।

সে আবার কে?

আছে এক জন।

তোকে কে বলল?

আমি জানি।

ভ্যাট। কোথা থেকে এক ফুটুদা জুটিয়েছে। বোকা কোথাকার। অ্যাই ফুটুদাটা কে বল তো?

সে আছে।

মারব থাপ্পড়। কোন বদমাশের পাল্লায় পড়েছিস বল তো! খবরদার ওসব ফুটুদা-মুটুদাকে একদম লাই দিবি না।

ফুটুদা তো খুব ভালো।

তোর আবার ভালো মন্দ। একটু যদি বুদ্ধি থাকে।

গঙ্গারামপুরে নেমে পড়ল দু-জন। গঙ্গারামপুর এলেই বুকের ভিতরে কী যেন একটু চলকে ওঠে শেফালির। এ বড়ো দুষ্টু জায়গা। এ বড়ো পাগল জায়গা। এখানেই মরবে এক দিন শেফালি।

 

 

প্রীতমের পর দুটো বোন, তার পর ভাই। তার ভাইটা এখনও বড্ড ছোটো। বছর দশেক বয়স। তাই সদর রাস্তার দোকানটায় বাধ্য হয়ে পরের বোনটাকে বসায়। প্রথমে বাবা বিনোদকুমারকেই বসিয়েছিল। কিন্তু বাবা ব্যবসা করবে কী, লোক জুটিয়ে এমন আড্ডা বসাল যে, বিকিকিনি লাটে ওঠার জোগাড়। বাধ্য হয়ে সরস্বতীকে রাজি করালো। সে তো ভয়ে মরে, ও দাদা, আমি যে হিসেবে ভীষণ কাঁচা, কী করতে কী করে ফেলব।

প্রীতম বলল, ঠিক পারবি। শুধু লোকের সঙ্গে কথা কাটাকাটিতে যাবি না। পয়সা গুনতে পারিস তো, তা হলেই হবে।

কেউ যদি বদমাইশি করে?

মুখটা মনে রাখবি। তার পর আমাকে বলে দিবি।

এ তল্লাটে সবাই মোটামুটি প্রীতমকে সমঝে চলে। এক সময়ে সে এধারে নিজের শাসন কায়েম করেছিল। এখনও লোকে তাকে ঘাঁটায় না।

সরস্বতীর আজকাল কোনো অসুবিধে হয় না। স্কুলের পর এসে দোকান খুলে বসে এবং দিব্যি সামাল দেয়। দেখতে শুনতে ভালো বলে সরস্বতীর দোকানে খদ্দেরদের আনাগোনা একটু বেশি। ছেলে-ছোকরারা আসে, বুড়ো-ধুড়োরাও আসে। ছেলে-ছোকরাদের চোখ তেমন খারাপ নয়। তাদের চোখে একটু পুজোর ভাব থাকে। ষাট-সত্তর পেরোনো বুড়োদের নজর বড্ড খারাপ। যেন পোশাক ভেদ করে ভিতরের ন্যাংটোটাকে জরিপ করতে চায়। কী নোলা রে বাবা!

আজ অবধি অবশ্য দাদার কাছে কারো নামে নালিশ করতে হয়নি। এক রত্তি জায়গা তো, সবাই সবাইকে চেনে। এখানে কেউ ফস করে কিছু করে বসতে সাহস পায় না। তার ওপর দাদা হারমাদ লোক। তাকে সবাই ভয় খায়।

দোকানটা নতুন। মাত্র ছয় মাস হল খুলেছে। পাউরুটি, ডিম, চা-পাতা, বিস্কুট, টুথব্রাশ, টুথপেস্ট, মাথার তেল, ক্রিম, পাউডার, হজমিগুলি, ডট পেন, খাতা, পেনসিল, দিস্তা কাগজ, আঠা, বল, ফিনাইল, অ্যাসিড ইত্যাকার হাজারো জিনিস নিয়ে আগে হিমসিম খেত সরস্বতী। আজকাল খায় না। ধীরে ধীরে জিনিসপত্রের ওপর নিয়ন্ত্রণ এসেছে। চোখ বুজে দাম বলে দিতে পারে। পড়াশুনো একটু মার খাচ্ছে বটে, কিন্তু দোকান করতে সরস্বতীর কিছু খারাপ লাগছে না।

ওই দাদা এল। তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ায় সরস্বতী। সাইকেলটা দাঁড় করিয়ে ভারী ব্যাগ নামাচ্ছে প্রীতম। সরস্বতী তাড়াতাড়ি গিয়ে এক পাশটা ধরল।

প্রীতম বলল, ছাড়। মেয়েদের ভারী তুলতে নেই। প্রকান্ড এবং ভারী ব্যাগখানা দোকানে তুলে দিয়ে প্রীতম বলল, যতটা পারিস নামিয়ে সাজিয়ে রাখিস। বাকিটা আমি এক সময়ে সাজিয়ে দিয়ে যাব।

সরস্বতী ঘাড় কাত করে বলে, আচ্ছা।

তার দেখা শ্রেষ্ঠ পুরুষ আজ পর্যন্ত দাদা। কী সরল, শিশুর মতো নিষ্পাপ মুখ। পরিশ্রম ছাড়া কিছুই বোঝে না। নিজের পরিবারটি নিশ্চিত ভরাডুবির হাত থেকে বাঁচানোর জন্য দাদার এই জান কবুল লড়াই দেখলে পাষন্ডেরও চোখে জল আসবে। একখানা ভালো জামা-প্যান্ট নেই। ভালো জুতো নেই। আছে শুধু বাপ-মা আর ভাই-বোনকে আগলে থাকা।

দাদার প্রতি মায়ের মতোই গভীর এক ভালোবাসা আছে সরস্বতীর। দাদার মতো মানুষ হয় না। এই যে তাদের বাবা বিনোদকুমার সারাটা জীবন পরিবারটাকে ধীরে ধীরে সর্বনাশে নিয়ে যাচ্ছিল, তার জন্যও কখনো বাবার ওপর রাগ করে না তার দাদা প্রীতম। মা তো দিনরাত বাবাকে উস্তম-কুস্তম করে ছাড়ে। কিন্তু দাদা ঠিকই বাবার প্রিয় মাছ-তরকারি কিনে আনে। জামা-জুতো কিনে দেয়, সিগারেট-দেশলাইয়ের অভাব রাখে না। প্রীতম বলে, মানুষ যেমনই হোক আমি বিচার করার কে? জন্মদাতা বাপ বলে কথা, বাবা এক মস্ত জিনিস।

আপাত দৃষ্টিতে প্রীতমের শরীরে রাগ নেই। কিন্তু কখনো রাগলে যে সেই রাগ ভয়ংকর তাও সবাই জানে।

ল্যাকপ্যাক একটা হাফপ্যান্ট পরা ছেলে উঁকিঝুঁকি মারছিল।

কে রে? কী চাস?

ফুটুদা নেই?

ফুটুদাকে কী দরকার তোর?

ছেলেটা বড়ো বড়ো দাঁত বার করে হাসছে। কেবল হাসছে।

এমনি।

তুই কোন বাড়ির ছেলে?

ওই স্টেশনের দিকে। লক্ষ্মী রায়ের বাড়ি।

কী চাস?

এমনি। এলাম তো তাই।

দাদা যে এ দোকানে বসে না, তা জানিস না? মুদির দোকানে বসে। চিনি? ওই বাঁ-হাতে গলির ভিতরে।

ছেলেটা হেসেই যাচ্ছে।

অমন হাসছিস কেন? নাম কী তোর?

সীতানাথ। সীতু।

কোন ক্লাসে পড়িস?

থ্রি।

অ্যাঁ! থ্রি কী রে?

এ বাবা, এত বয়সে মোটে থ্রি! বছর বছর ডাব্বা মারিস বুঝি?

হ্যাঁ।

সরস্বতী হেসে ফেলল। এমন ভাবে হ্যাঁ বলল যেন গৌরবের ব্যাপার।

ফুটুদার সঙ্গে তোর কীসের দরকার?

এমনিই। দিদিকে খুঁজে পাচ্ছি না। তাই ভাবলাম ফুটুদার সঙ্গে একটু গল্প করি।

তাই বুঝি! তা তোর দিদি কে?

শেফালি। ক্লাস নাইন।

ও। তুই শেফালির সেই হাবা ভাইটা বুঝি?

হ্যাঁ?

হারাবে কোথায়? এইটুকু জায়গায় কি কেউ হারাতে পারে? ভালো করে খোঁজ। কোনো দোকানে বোধহয় কেনাকাটা করছে। পরশু ইঁদুর মারার ওষুধ আটার গুলিতে মাখিয়ে দোকানের মধ্যে ছড়িয়ে রেখেছিল সরস্বতী। আজ মাঝেমধ্যে পচা গন্ধ পাচ্ছে। চারটে ঘেঁষাঘেষি কাচের আলমারি, শো-কেস, বসবার টুল। মেঝেতে অ্যাসিড, ফিনাইল, ব্লিচিং পাউডারের শিশি আর প্যাকেটের সংকীর্ণ পরিসরে মরা ইঁদুর খুঁজে বের করা সহজ কাজ নয়। ফুরসুতই বা কোথায়? এই তো, পর পর চার জন খদ্দের আর একঝাঁক বাচ্চা মেয়ে এসে কত কী নিয়ে গেল। বিক্রি হওয়া জিনিসের নাম আর দাম খাতায় টুকতে টুকতে সরস্বতী বলল, অ্যাই, একটা কাজ পারবি?

কী কাজ?

করিস যদি বিস্কুট খাওয়াব।

বলো না, কী করতে হবে?

মরা ইঁদুর খুঁজে বের করতে হবে। তুই তো রোগা পটকা আছিস। ঠিক পারবি। দেখ না ভাই। ওই আলমারির তলায়-টলায় কোথায় আছে। অন্ধকারে কি দেখতে পাবি? দাঁড়া, একটা মোম জ্বেলে দিই।

আমি খুব ভালো দেখতে পাই। মোম লাগবে না।

সীতু দিব্যি হামাগুড়ি দিয়ে খুঁজতে লাগল আনাচ-কানাচ। একটু ভয় হল সরস্বতীর। শেফালি যদি জানতে পারে যে তার হাবা ভাইটাকে মরা ইঁদুর খুঁজতে লাগিয়েছে তা হলে কি দু-কথা শোনাতে ছাড়বে? ছেলেটা তো হাবা, ভালো-মন্দ বোঝে না। কিন্তু, হাবা লোক না থাকলে দুনিয়াটা কি চলে? ওই জন্যেই তো ভগবান দু-চারটে হাবা লোককে দুনিয়ায় পাঠান।

দু-হাতে দুটো মরা ইঁদুরের লেজ ধরে বের করে এনে তার মুখের সামনে দুলিয়ে একগাল হেসে সীতু বলল, এই দুটোই ছিল, আর নেই।

নাকে আঁচল চাপা দিয়ে সরস্বতী আর্তনাদ করে উঠল, উঁ:! ফেলে দিয়ে আয় না।

সীতুর ঘেন্নাপিত্তি নেই। নির্বিকার মুখে ইঁদুরদুটোকে নাচাতে নাচাতে দোকানের পিছনে গিয়ে ফেলে দিয়ে এসে বলল, কাক এসে নিয়ে গেল।

সরস্বতী বলে, ওই কোণে বোতলে জল আছে, হাত ধুয়ে নে তো। তোর বাপু একটুও ঘেন্নাপিত্তি নেই।

ইঁদুরের বিষ দিয়েছিলে তো? কাকদুটোও মরবে তা হলে।

মরুক গে। কাঠের বাক্সে সোডা আছে। একটু হাতে নিয়ে ঘষে ঘষে হাত ধুয়ে আয়।

সীতু বেশ বাধ্যের ছেলে। যা বলা হল, তাই করল। আসলে, বুদ্ধি নেই বলেই যে যা বলে তা শোনে।

দুটো ফুকিন বিস্কুট বয়ম থেকে বের করে দিল সরস্বতী। দোকান থেকে কাউকে বিনা পয়সায় কিছু দেওয়া বারণ। তাই নিজের ছোট্ট বটুয়া থেকে বিস্কুটের দাম নিয়ে ক্যাশবাক্সে রেখে দিল।

খা।

কুড়মুড় শব্দে বিস্কুট দাঁতে ভেঙে সীতু বলল, দিদি তো খাওয়াবে বলেছিল। কোথায় যে গেল!

মনোরঞ্জন মাইতি চানাচুরের প্যাকেট, পরিমল আদক ডিমসুতো, অনাদি দাস থিন অ্যারারুট আর দুটো মেয়ে স্যাম্পু আর সাবান কিনে নিয়ে গেল।

একটু ফাঁক পেয়ে সরস্বতী বলল, কী বলছিলি যেন?

কাউন্টারের বাইরে এক কোণে দাঁড়িয়ে হাঁ করে রাস্তা দেখছিল সীতু। দিদিকেই খুঁজছিল বোধহয়। হঠাৎ মুখ ফিরিয়ে সরস্বতীর দিকে চেয়ে বলল, তোমার ডান কাঁধে একটা টিকটিকি পড়বে।

অ্যাঁ! টিকটিকি পড়বে কেন রে?

পড়বে। দেখো।

দূর পাগল! এ ঘরে একটাও টিকটিকি নেই। আমি টিকটিকি ভীষণ ঘেন্না পাই, বাবা।

দিদিও পায়। ডান কাঁধে টিকটিকি পড়লে অনেক টাকা হয়।

দূর বোকা। আমার কাঁধে টিকটিকি পড়বে, তুই কী করে জানলি?

পড়বে।

আমার ভয় করে না বুঝি? ভয় দেখাচ্ছিস, না ইয়ারকি মারছিস?

টিকটিকি কামড়ায় না।

হ্যাঁ, তুই বড়ো জানিস কিনা!

ভিড়ের ভিতর থেকে একটা শ্যামলা মেয়ে দোকানের আলোয় এসে দাঁড়াল। বলল, এই হাঁদারাম, কোথায় ছিলি এতক্ষণ? কতক্ষণ ধরে আমি খুঁজে বেড়াচ্ছি তোকে।

ফুটুদার খোঁজে এসেছিলাম।

ফুটুদা! ফুটুদা কে?

সরস্বতী বয়মের আড়াল থেকে মুখ তুলে বলল, আমার দাদা। তোমার ভাই আমার সঙ্গে এতক্ষণ গল্প করছিল।

শেফালি তার বন্ধু নয়। এক ক্লাস নীচে পড়ে। তবে, চেনা।

শেফালি একটু জড়সড় হয়ে বলল, ও, এই দোকান তো প্রীতম

হ্যাঁ, দাদা সময় পায় না বলে আজকাল আমি বসছি।

শেফালি যেন একটু কেমনধারা হয়ে গেল। বলল, ও, তুমি প্রীতমদার বোন! আমি জানতাম না।

এসো না, আমাদের দোকান দেখে যাও।

এসেছি তো। সীতু তোমাকে বোর করছিল বুঝি?

না। তবে, ভয় দেখাচ্ছিল।

ওমা! তাই নাকি?

ঠিক এই সময় ঝপ করে সরস্বতীর ডান কাঁধে নরম মতো একটা কী যেন পড়ল। আর, পড়েই কিলবিল করতে লাগল।

ও মাগো, এটা কী! কী এটা

বলেই টুল থেকে লাফিয়ে উঠে কাঁধে একটা ঝটকা মারতেই তার ডান কাঁধ থেকে একটা টিকটিকি কাউন্টারের কাচের ওপর ছিটকে পড়ল।

অবিশ্বাস্য! অবাক চোখে চেয়ে ছিল সরস্বতী।

কী হল, কী পড়ল গায়ে? বলে তাড়াতাড়ি দোকানের পাদানিতে উঠে এল শেফালি।

সীতু বলল, টিকটিকি।

সরস্বতী কিছুক্ষণ কথা বলতে পারল না। তার পর হাঁফ-ধরা গলায় বলল, তোমার ভাইটা

ভাইটা কী করেছে?

বড় অদ্ভুত ছেলে তো! একটু আগেই বলেছিল, আমার ডান কাঁধে নাকি টিকটিকি পড়বে। কী করে বলল, বলো তো?

শেফালি হেসে বলে, ও তো কেবল আবোল-তাবোল বকে।

সরস্বতী বড়ো বড়ো চোখে এক বার সীতুর দিকে তাকিয়ে ফের শেফালির দিকে ফিরে বলল, তা হলে টিকটিকির কথাটা কী করে বলল, বলো তো! আমার এ দোকানে আমি একটাও টিকটিকি কখনো দেখিনি। আজই প্রথম

টিকটিকিটা ঝিম ধরে কিছুক্ষণ পড়ে থেকে তার পর ধীরে ধীরে শোকেস পার হয়ে দেয়ালে উঠে গেল। দু-জনেই দেখল দৃশ্যটা। সীতু নয়। সে বাইরের দিকে চেয়ে আছে। বিস্কুট খাচ্ছে আর হাসছে।

ও অত হাসে কেন?

ওটাই তো ওর রোগ। বকুনি খায় কত, তবু ওর হাসি সারে না। এই বোকাটা, চপ খাবি বলেছিলি না?

খাওয়াবি?

চল।

সরস্বতী এই দুই ভাইবোনের কথার মধ্যে পড়ে বলল, দাঁড়াও। আমার আজ খুব ইচ্ছে করছে তোমাদের দু-জনকে চপ খাওয়াতে।

শেফালি বলল, না, না। তুমি কেন খাওয়াবে?

খাওয়ালেই বা! এই সীতু, মাঝে মাঝে আমার কাছে আসবি তো। তুই যা সাংঘাতিক ছেলে, আমাকে আজ ভারি চমকে দিয়েছিস। এসো না শেফালি, দোকানের ভিতরে এসে বোসো। বসার জায়গা আছে। আমি চপের কথা বলে দিয়ে আসছি। ষষ্ঠীপদ দোকানের গরম চপ পাঠিয়ে দেবে।

দোকানের ভিতরে বসবার জায়গা আছে বললে ভুল হবে। একটা ওলটানো কাঠের বাক্স আছে। বোধহয় সেটাতে উঠে দাঁড়িয়ে সরস্বতী ডিং মেরে উঁচু তাকের জিনিস পাড়ে। ভাই-বোন তাইতেই ঘেঁষাঘেষি করে বসল। সরস্বতী চপের কথা বলেই ফিরে এসে বলল, এখুনি আসছে।

চপ খেতে খেতে কত গল্পই যে হল! সরস্বতীর মুখে শুধু তার দাদার কথা। দাদার মতো মানুষ যে হয় না, সেটা শতমুখে বলছিল। কথাগুলো হাঁ করে গিলছিল শেফালি। হ্যাঁ, শেফালি জানে, পৃথিবীর সেরা পুরুষ ও, প্রীতম। ও রকম আর একজনও চোখে পড়ল না তার। শেফালি এই দোকানঘরে বসে প্রীতমের গায়ের স্বেদগন্ধ পাচ্ছে। এই দেখার আনাচেকানাচে তার স্পর্শ। গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। চপের ডেলা গিলতে পারছে না। একখানা পেটুক ভাইটাকে দিয়ে দিল।

ফেরার সময় শেফালি বলল, অ্যাই, তুই টিকটিকি পড়ার কথা কী বলেছিলি?

জানতাম, তাই বলেছিলাম।

তুই তো কেবল আবোল-তাবোল বলিস।

না। আমি টের পেয়েছিলাম। মনে হল, তাই বলেছিলাম।

তুই তো বলেছিলি, ফুটুদার সঙ্গে নাকি হি: হি: হি: হি:

ঠিকই বলেছি।

কী ঠিক বলেছিস?

তোর তো ফুটুদার সঙ্গেই বিয়ে হবে।

—যা:, পাজি কোথাকার!

—দেখিস।

হঠাৎ সর্বাঙ্গ শিরশির করল তার। কাঁটা দিল গায়ে। সত্যিই কি সীতু কিছু টের পায়? ওর কথা সত্যিই ফলে? হে ভগবান

 

 

কার্তিক মাসে শীত করার কথা নয়। কিন্তু বিনোদকুমারের আজকাল শীত করে। তাই সে বিকেলে গায়ে একটা আলোয়ান চাপিয়ে বেরিয়েছে। সঙ্গে ছোটো মেয়ে বিম্ববতী। সামান্য সবজিবাজার, তাও আজকাল বইতে পারে না বিনোদকুমার। শরীরটা যে গেছে তা আজকাল বেশ মালুম হচ্ছে। তার নাম ছিল বিনোদবিহারী। পিতৃদত্ত নাম। যাত্রা-থিয়েটার যখন করত তখনই বিহারী ছেড়ে কুমার করে নিয়েছিল। ইচ্ছে ছিল শিশির ভাদুড়ি, উত্তমকুমারের লাইনে নিজেকে তুলে ধরবে। সংসারে-টংসারে মোটে মন ছিল না। বউটা ঘর আগলে পড়ে থাকত আর বিনোদকুমার ইচ্ছে-ঘুড়ি ওড়াতে বেরিয়ে পড়ত। আকাশে মই লাগানোর বৃথা চেষ্টায় জীবনটাই পড়ে গেল হাওলাতে। টাকাপয়সা যে কোন গাছের পাখি সেটা আজ অবধি বুঝতে পারল না সে, তার সঙ্গে চিরকাল ফেরেববাজি করে গেল ওই শালার টাকাপয়সা। জুয়োর লাক তার কিছু খারাপ ছিল না, শখ করে তাসে বসলে এক সময়ে বিশ-পঞ্চাশ টাকা আসত। কিন্তু যেই বরাত ফেরাতে কোমর বেঁধে বসল সেদিন থেকেই বরাতও বেইমানি শুরু করে দিয়েছিল।

ফের বিড়বিড় করছ বাবা?

থতমত খেয়ে বিনোদকুমার বলল, কই? এই তো চুপ করেই আছি।

ওম্মা গো; পষ্ট শুনলুম যে!

বিনোদকুমার আজকাল প্রায় সবাইকেই ভয় পায়। এমনকী এই এগারো বছরের মেয়ে বিম্ববতীকেও। মেয়েটা কটকটি আছে। তাকানোর মধ্যে মায়াদয়া নেই।

বিনোদকুমার বলল, বিড়বিড় নয়, ডায়ালগ বলছিলুম রে।

কীসের জায়ালগ?

কত নাটকের ডায়ালগ আজও মুখস্থ আছে। সেই সব মনে পড়ে তো, তাই।

মুখ চেপে বন্ধ করে রাখো। লোকে পাগল ভাববে।

তা ভাববে কেন? আমি কি পাগল? সবাই চেনে আমাকে।

চেনে বলেই তো মুশকিল। জোরে হাঁটো তো।

বিনোদকুমার এককালে পরগণার মাঠঘাট তো কম ঠ্যাঙায়নি। লম্বা লম্বা হাঁটাপথ পেরোতে হয়েছে। কখনো জলকাদা ভেঙেছে। কিন্তু এখন শরীরের মধ্যে একটা শীত ঘনিয়ে উঠেছে। হাত-পা যেন সিঁটিয়ে থাকে। তাতে জোরবল সবই খামতি পড়েছে।

তুই এগিয়ে হাঁট না। আমি ঠিক গিয়ে তোকে ধরে ফেলব।

না, তুমি ফের গিয়ে আড্ডায় বসে যাবে।

আড্ডা? না, না, সে আর কোথায়? গিরি মল্লিক মরে গিয়ে অবধি আর একটাও ঠেক নেই। বুঝলি? আড্ডা সব উঠে গেছে।

তোমাকে বিশ্বাস নেই। এসো আমার সঙ্গেসঙ্গে।

তার বউ মালতী মেয়েকে একা ছাড়বে না বলে সঙ্গে তাকে আসতে হয়। নিয়মমাফিক। বাজার করার টাকাগুলো পর্যন্ত তা হাতে দেয় না মালতী। সেটাও বিম্ববতীর কাছে। তাকে কেউ এখন আর বিশ্বাস করে না।

ফুটু না থাকলে বিনোদ সন্নিসি হয়ে যেত। একমাত্র ওই ছেলেটাই যা একটু মায়া করে তাকে। কিন্তু বিনোদ হাড়ে হাড়ে জানে, এই মায়াটুকু সে অর্জন করেনি, ওটুকু তার ছেলেরই গুণ। একেবারে বাতিল মানুষটাকেও বুঝি ভগবান একটু কিছু দেন, ওই মায়াটুকু।

উড়নচন্ডী মানুষের এই এক অসুবিধে। ঘরদোর ভালো লাগে না। সংসারের নিত্যদিনের দিন গুজরান বড্ড আলুনি লাগে। সকাল হল তো মশারি খোলো, বিছানা ঝাড়ো, ভাত বসাও, কুটনো কোটো, ফাঁকে ফাঁকে ক্যাট ক্যাট করে শতেক কাজ-অকাজের কথা শোনো আর চৌহদ্দির মধ্যে ঘুরপাক খাও। ঘর, উঠোন, বাগান ব্যস। তার পর সংসারের সীমানা শেষ। এই যে বাইরের দুনিয়াটার খোলামেলা সীমানাহীনতা এতেই বিনোদ আজও বড়ো স্বস্তি বোধ করে। তবে বয়স আর শরীরের অক্ষমতা তার একটা সীমানা বেঁধে দিয়েছে। লম্বা দড়ি পরানো আছে গলায়, খুঁটো টেনে রাখে।

হাঁফ ধরছে কেন রে?

কার হাঁফ ধরছে? তোমার?

জোরে হাঁটতে বলিস, আমি কি পারি?

একটু দাঁড়িয়ে দম নিয়ে নাও। বাজার তো এসে গেছে।

হাঁটুতে জোর নেই মোটে। শচীর দোকানে বরং একটু বসি।

ওমা! ও তো সেলুন। কুচি কুচি চুল উড়ছে সব সময়ে।

আমিও বরং খেউরিটা হয়ে নিই। গালে দাড়ি বিজবিজ করছে। ততক্ষণ একটু বসাও হবে।

তা হলে যাও, হলে দিদির কাছে গিয়ে দোকানে বসে থাকো। যাওয়ার সময় তোমাকে ডেকে নিয়ে যাব।

ওটা ভাঁওতাবাজি। সবজি বাজারের মতো ভ্যাতভ্যাতে জিনিস আর নেই। কাল শনিবার। তার বউ মালতী শনিবারটা হেঁসেলে মাছ ঢুকতে দেয় না। নিরামিষ কি গলা দিয়ে নামে বাপু? শনিবার এলেই তার মনটা নেতিয়ে পড়ে।

খদ্দের ছিল বলে একটু বসতে হল। তা হোক, বসাই তো চায় বিনোদ। বাজারে তার বিস্তর চেনা মানুষ। বয়সের মানুষরা অবশ্য আর গুনতিতে বেশি নেই। ফিফটি পারসেন্ট টেঁসে গেছে। যারা আছে তাদেরও অনেকেই খাড়া নেই। কেউ শয্যাশায়ী, কেউ বা মরো-মরো। দু-চার জন যা আছে, ঘোরাফেরা করে তাদের সঙ্গে এই জায়গাতেই যা দেখা হয়ে যায়।

বসে একটা সিগারেট ধরাল বিনোদ।

পাশে বসা লুঙি-পরা একটি হাড়গিলে লোক বিড়ি খাচ্ছিল। কাঁচা-পাকা চুল, গালে পাতলা দাড়ি, নাকের নীচে ভুঁড়ো গোঁফ। কয়েক বার তেরছা চোখে চেয়ে দেখল তাকে। তার পর হঠাৎ বলল, বিনোদ না?

বিনোদ একটু অবাক হয়। নাম ধরে ডাকে কে রে বাবা? বয়সের একটা সম্মান নেই?

কে হে তুমি?

আমি রজব আলি। বীরশিবপুর। মনে পড়ে?

তাই তো! রজবের সঙ্গে এক সময়ে বেশ মাখামাখি ছিল তার। আলকাপের দল ছিল রজবের। গলা দরাজ। কত আসর মাত করেছে।

বিনোদ বলে ওঠে, দিব্যি তরতাজা আছ তো! বুড়ো হওনি কেন?

আমাদের কি বুড়ো হলে চলে! খেটেখুটে খেতে হয়।

তবে আমি বুড়ো হলাম যে?

তাই নাকি? তোমার আমার তো একই বয়স। পঞ্চান্ন-ছাপ্পান্ন হবে। তা তুমি আগ বাড়িয়ে বুড়ো হতে গেলে কেন? কে মাথার দিব্যি দিয়েছিল?

বড়ো চিন্তায় ফেলে দিলে মিঞা।

কেন চিন্তাটা কীসের তোমার?

চিন্তা হবে না? ঘরে বসে বসে কেবল ভাবি, বুড়ো হচ্ছি, বুড়ো হচ্ছি। আর ভাবতে ভাবতে হাতে-পায়ে বুড়োটে ভাবও এসে গেল। এই যে হঠাৎ তোমাকে দেখছি, দিব্যি তরতাজা আছ। তাই মনের মধ্যে একটা টানা-হ্যাঁচড়া পড়ে গেল।

ওরে বাপু, বুড়ো তো আমারই আগে হওয়ার কথা। ছেলেগুলো মানুষ হল না তেমন। বড়োটা বোকাসোকা, মেজো জন ভ্যান চালায়, পরেরটা কী করে বেড়ায় আল্লা জানে, ছোটো জন ওর মধ্যেই একটু ভালো। মাধ্যমিক পাশ করে কলেজে যায়। আর তোমার দেখ, ছেলেখানা জব্বর দাঁড়িয়েছে। ফুটুর কথা সবাই বলাবলি করে। তোমার চিন্তা কীসের হে?

তাই ভাবছি। সব ওলট-পালট করে দিলে হে। এখন আবার ফিরে সব হিসেব-নিকেশ করতে হবে।

ওই দেখ। এতে আবার হিসেব-নিকেশের কী?

এই বয়স-কাল, অবস্থা-ব্যবস্থা। নিজেকে জরিপ করা বড়ো শক্ত কাজ হে, রজবভাই।

দাড়িটা আর কামানো হল না। গালে হাত বোলাতে বোলাতে উঠে পড়ল বিনোদ।

চললে কোথায় হে?

একটু দেখি, মেয়েটা কোথায় গেল। বাচ্চা মেয়ে দেখে দোকানিরা কী গছিয়ে দেয় কে জানে।

আসলে বিনোদের কেমন বেশ ঝরঝরে লাগছে একটু আগে যেন গা থেকে একটা ভেজা কম্বল সরিয়ে নিয়েছে কেউ। এখন আর শীত করছে না তেমন। গায়ের আলোয়ানটা খুলে ভাঁজ করে কাঁধে ফেলল সে।

ভিড়ের ভিতরে একটা রোগা ছেলে আর যুবতী মেয়ে যাচ্ছিল। ছেলেটা বলে উঠল, ওই দেখো দিদি, ফুটুদার বাবা।

মেয়েটা ভারি অবাক চোকে তাকাল বিনোদের দিকে। তাকানোটা ভারি ভালো লাগল বিনোদের। আজকাল তো আর কেউ তাকায় না। উচ্ছিষ্টের মতো পড়ে আছে এক ধারে।

না, দিনটা আজ ভালোই গেল।

বুক চিতিয়ে সপাটে খানিক হাঁটার পরই বিনোদকুমার বুঝল, বুড়োবয়সকে খুব বেশি পিছনে ফেলতে পারেনি। পোষা কুকুরের মতো গা শুঁকতে শুঁকতে পিছন পিছন আসছে। টের পেল, যখন হাঁফ ধরে যাওয়ায় মিষ্টান্ন ভান্ডারের সামনে দাঁড়িয়ে হাঁ করে দম নিতে হচ্ছিল। ওরে বাপু! যৌবনপ্রাপ্তি কি আর ছেলের হাতের মোয়া? বয়স তেমন ভাঁটিয়ে যায়নি, কিন্তু শরীরের জোয়ার নেমে গেছে। বয়সকালে নেশাভাঙও তো কম করেনি! তার ওপর এই ফুক ফুক রোজ ডজনখানেক সিগারেট ফোঁকা-এরও তো মাশুল আছে, নাকি?

মাশুল মেলাই দিতে হচ্ছে বিনোদকে। কতক জানিত কর্মফল, কতক অজানা। আটন গেট-এ তার এক জন মেয়েমানুষ ছিল, এক জন ছিল ফুলেশ্বরে। সব্বার নামও মনে নেই। পাপটাপ যখন করেছে, তখন পাপ জেনেই করেছে। তবে মনস্তাপ ছিল না। একটু-আধটু তো ওরকম হবেই বাপু! তখন বিনোদের চেহারাখানা কী ছিল বলো! নদের নিমাই করে কত বুড়োবুড়ির চোখে জল এনে ফেলেছিল। কত বুড়ি পালার পর পায়ের ধুলো নিয়ে যেত।

বিনোদ টের পেল, বয়সটা তার পায়ের গোছের কাছেই বসে আছে। তাড়ালেও যাবে না। অথচ হিসেবের বয়স তার হয়নি।

বিনোদ নাকি রে? এখানে দাঁড়িয়ে কী করছিস?

বিনোদ দেখল, সামনে সফলরাম। তা সফলই বটে। গঙ্গারামপুরের সব কটা টাকাওলা লোককে পাল্লার এক ধারে, আর সফলরামকে অন্য ধারে চাপালে সফলের দিকেই পাল্লা মাটিতে ঠেকবে।

এই মেয়েটির জন্য দাঁড়িয়ে আছি।

তা দাঁড়িয়ে থাকবি তো থাক না! বিড়বিড় করে কাকে গাল দিচ্ছিস?

বিড়বিড় করছে নাকি সে? ওই এক মুশকিল হয়েছে আজকাল। সে টের পায় না, কিন্তু লোকে দেখতে পায়। সে নাকি একা একা বিড়বিড় করে। তা করে হয়তো, কিন্তু সেটা টের পায় না কেন সেটাই বুঝতে পারে না বিনোদ।

গাল দিচ্ছি না দাদা, নানা কথা ভাবছি আর কী!

পষ্ট দেখলুম হাত-পা নেড়ে কথা কইছিস! বলি লোককে শাপ-শাপান্ত করিস না তো?

কী যে বলেন দাদা!

বিচিত্র কী! ঘর-বসা লোকের মনে মেলা গাঁদ জমে থাকে তো!

প্রকৃতির নিয়মেই বড়োলোকদের সামনে বিনোদ ভারি দুর্বল বোধ করে। মনের জোরটা পায় না। টাকার জোরের কাছে কোন জোরটাই বা খাটে বাপু? সে একটু হে: হে: করে বলল, ঘর-বসা না হয়ে উপায়ই বা কী বলুন? শরীরটা জুত-এর নেই।

তাই থাকে রে পাজি? তুই তো চিরকালের নষ্ট! এইটুকুন বেলা থেকে দেখে আসছি। তবে তোর কপালটা বড্ড ভালো।

সসম্ভ্রমে চুপ করে থাকে বিনোদ।

সফলরাম নিজেই বলে, তুই নষ্ট হলেও ছেলেটা তোর ভালো। তোর মতো লপেটা-বাবু নয়। করে-কর্মে দাঁড়িয়ে গেছে।

তা আপনাদের আশীর্বাদে।

এটা কলিযুগ জানিস তো। এ যুগে আশীর্বাদও ফলে না, অভিশাপও ফলে না। এ হল নগদা-নগদির যুগ, যেমন করবি তেমনি পাবি। জুয়োর ধান করে নেংটি-ঘটি সার করলি, এখনও চোখ খুলল না? আশীর্বাদ-টাশীর্বাদ সব বাজে কথা। ছেলেটা যে তোর মতো হয়নি সেইটেই তোর কপাল।

তা বিনোদ এসব কথাও বিস্তর শোনে। ঘরে, বাইরে, পথেঘাটে। বউ শোনায়, আত্মীয়স্বজন শোনায়, উটকো লোকও শোনায়। কিছু ভুলও শোনায় না। হ্যাঁ, তার ছেলেটা ভালো, আর সে খারাপ। তা বাপু, তাতে হলটা কী?

কী একটা কথা বলছিল সফলরাম, ধরতাইটা ঠিকমতো শোনেনি। কানের দোষই হবে বোধহয়। শেষটা শুনতে পেল, আমি বাপু রাজি হইনি।

কথাটা কী হচ্ছিল দাদা?

তোর ছেলের কথাই হচ্ছিল। আমার বউমা বলছিল, ফুলির সঙ্গে ফুটুর সম্বন্ধ করলে কেমন হয়! আমি বলে দিয়েছি, ও লাইনে মোটেই চিন্তা কোরো না। ছেলে ভালো হলে কী হবে, বিনোদেরই তো রক্ত। রক্তে রক্তে কোন বিষ অর্শায় তার ঠিক কী! তোর কাছে বলেছে কিছু?

ব্যাপারটা স্পর্ধারই সামিল। জিভ কেটে বিনোদ বলল, আজ্ঞে না, ওরকম কোনো কথা হয়নি মোটেই।

আর হবেও না। বারণ করে দিয়েছি। আগেভাগেই জানিয়ে রাখা ভালো, নইলে আবার একটা প্রত্যাশা থাকবে তো!

না, বিনোদের কোনো প্রত্যাশা নেই। বউ মানেই একটা ফ্যাকড়া, একটা বাধক। বউ-বাচ্চার জন্যই না বিনোদের দুই নৌকোয় পা রেখে জীবন কাটল! ঘন ঘন মাথা নাড়া দিয়ে সে বলে, না, না, তা হয় না।

ঘাড়ে দু-দুটো আইবুড়ো বোন, জুয়াড়ি বাপ, কে যে বউমাকে বুদ্ধিটা দিল কে জানে!

সফলরাম ঠোঁটকাটা লোক সবাই জানে। বিনোদের মোটেই রাগ বা অপমান হল না। সে দিব্যি হাসি-হাসি মুখ করে বলে, সে তো বটেই।

সফলরাম চলে যাওয়ার পরও খানিক দাঁড়িয়ে রইল বিনোদ। তার একটু ভয় হচ্ছে। ফুটু বিয়ে করলে তার নতুন বিপদ দেখা দেবে। বউ এসে যদি বাড়ি-ছাড়া করে, তা হলে তাকে এই বাজারেই ঘুরে ঘুরে ভিক্ষে করতে হবে।

ও বাবা!

চটকা ভেঙে বিনোদ দেখে, সামনে বিম্ববতী।

চল মা, বাড়ি চল। বাজার হয়েছে?

হ্যাঁ।

দে, একখানা ব্যাগ বরং আমাকে দে।

আমি পারব। তুমি চলো তো!

বুকটা ধকধক করছে। এখনও হাঁফটা পুরোপুরি কাটেনি। বয়স হয়েছে কী হয়নি, তা ঠিক বুঝতে পারছে না বিনোদ।

 

 

ডালের বস্তার ওপর টং-এ বসে এক্সারসাইজ খাতায় হিসেব করছিল প্রীতম। বাহ্যজ্ঞান নেই। হিসেব করতে তার বড়ো ভালো লাগে। আর ব্যবসার প্রাণ হল হিসেব। আগে হিসেবের কায়দাটা ভালো জানা ছিল না তার। মণিরাম শিখিয়েছে। বলেছে, হিসেবটা যদি ঠিকমতো করতে পারিস তো ভিত বেঁধে ফেললি। ওইখানে ভুলচুক করলে দর ফেলতে গড়বড় হয়ে যাবে। তা হলেই সর্বনাশ।

দোকান সামলাতে পরেশকে রেখেছে সে। মাইনে দিয়ে লোক রাখার মতো তালেবর সে এখনও হয়নি। পরেশ একরকম যেচে এসেই আগ বাড়িয়ে দোকানের ভার নিয়েছে। তার মুশকিল হল, থাকার জায়গা নেই। ট্রাকের খালাসি ছিল। গড়বড়ে জিনিস লোড হত ট্রাকে। ড্রাইভার আর তার এক অ্যাসিস্ট্যান্ট পুলিশের হাতে ধরা পড়ে যায়। আর সেই সময়টায় পেচ্ছাপ করতে নেমেছিল বলে বেঁচে যায় পরেশ। সেই থেকে পালিয়ে আছে। ঘনশ্যাম ব্যাপারি পাইকার। তারই কেমন একটু আত্মীয় হয় বলে ঘনশ্যামই এক দিন এসে গছিয়ে গেল। বলল, কটা দিন থাকতে দাও। ও বেচারার দোষ নেই, সাতে-পাঁচে ছিলও না, ফেঁসে গেছে ঝুটমুট। গন্ডগোল থিতু হলে ফিরে যাবে। চুরিটুরি করলে আমি জামিন আছি।

সেই থেকে পরেশ আছে। ছেলে কিছু খারাপও নয়। দু-বেলা ঘনশ্যামের বাড়িতেই খেয়ে আসে। দিনে পাঁচ টাকা করে হাঅলোকচ দেয় প্রীতম। সুবিধে হল, সে মাল আনতে গেলে দোকানটা চালু রাখে পরেশ। খদ্দের ফিরে যায় না। রাতে চাল-ডালের বস্তার ওপর শুয়ে ঘুমায়। কিন্তু মুশকিল একটাই। সর্বদা একখানা দুঃখী মুখ চোখের সামনে দেখতে প্রীতমের মোটেই ভালো লাগে না। চোখটাও যেন সব সময় কান্নার আগে ছলোছলো মতো হয়ে থাকে। কথা বিশেষ কয় না। ভারি চুপচাপ আর মনখারাপ। এইটেই কেমন যেন সহ্য হতে চায় না প্রীতমের।

চাপাচাপি করায় এক দিন কেবল বলেছিল, কত দূরে দূরে চলে যেতুম তো, সেইটে ভেবে কষ্ট হয়।

দুনিয়ায় হরেক রকমের চিড়িয়া, কার যে কীসের ওপরে টান তা বোঝে কার বাপের সাধ্যি। টাকা-পয়সার আমদানি নেই, ছুটি নেই, ভবিষ্যৎ নেই, শুধু দূরে দূরে যাওয়ার আনন্দ আবার কেমনধারা, কে জানে বাপু!

একটা রোগাভোগা চেহারার ছেলে উঁকিঝুঁকি মারছিল, বাইরেটা অন্ধকার হয়ে এসেছে বলে দেখা যাচ্ছিল না।

এটা কি ফুটুদার দোকান?

পরেশ কী বলল, বোঝা গেল না।

সীতু নাকি রে? বলে বস্তার ওপর থেকে নেমে এল প্রীতম।

ভেতরে আয়।

তুমি আর পিউ স্টোর্সে বোসো না?

দু-দুটো দোকান সামলানো কি সোজা? ওটাতে সরস্বতী বসে।

এ দোকানটাও তোমার?

হ্যাঁ, জিলিপি খাবি?

না, সরস্বতীদি তো খাইয়েছে?

তাই বুঝি?

দুটো।

প্রীতম হাসল। বোকা ছেলেটা অল্পেই ভারি খুশি হয়।

আমার হিসেবের খাতাটা একটু দেখে দে তো। দিবি?

দাও না।

প্রীতম ওকে এক্সারসাইজ খাতাটা ধরিয়ে দিল। সিল করা তেলের টিনের ওপর নিজেই একটা বস্তা ভাঁজ করে পেতে বসে গেল সীতু। সে আর কিছু না পারলেও যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগটা খুব পারে। কখনো ভুল হয় না। অন্য বিষয়ে ডাব্বা খেলেও অঙ্কে আশি নব্বই পায়।

প্রীতমের হিসেবে কখনো ভুল হয় না। তবু এক জোড়ার চেয়ে দু-জোড়া চোখ সব সময়েই ভালো। আর সীতুর যে অঙ্কের মাথা পরিষ্কার এটা সে ভালোই জানে। আর শুধু অঙ্কই নয়, সীতুর মধ্যে আরও একটা ব্যাপার আছে। সে যখন পিউ স্টোর্সে বসত তখন এক দিন জিলিপি খেতে খেতে সীতু বলেছিল, তোমার দাঁড়িপাল্লা নেই?

না, স্টেশনারি দোকান তো, তাই দাঁড়িপাল্লা লাগে না।

দাঁড়িপাল্লার দোকান আমার খুব ভালো লাগে।

সেই দাঁড়িপাল্লার দোকান হল এইটে। আর বলতে নেই, এই দোকানে প্রীতম মা লক্ষ্মীর পায়ের মলের শব্দও যেন শুনতে পায়। এই দোকান করেই সে ব্যাংকের টাকা প্রায় শোধ করে এনেছে।

ও সীতু?

উঁ!

দাঁড়িপাল্লার দোকানটা তো পছন্দ হয়েছে?

ও লোকটা কে?

ও পরেশ। কেন রে?

এমনি। ও আমাকে তাড়িয়ে দিচ্ছিল।

তাই নাকি? তোকে চেনে না তো, তাই। আর তাড়াবে না।

তোমার হিসেব ঠিক আছে। ভুল নেই।

খাতাটা প্রীতমের হাতে দিয়ে উঠে পড়ল সীতু।

কোথায় চললি?

দিদিকে খুঁজতে। নগেনের দোকানে ঢুকেছে।

ওই তো নগেনের দোকান। খুঁজতে হবে কেন, বেরোলেই দেখতে পাবি।

দিদি বেরোবে না। আমি বেরোলে, তার পর বেরোবে।

তাই নাকি? কেন রে?

কী জানি। বলল, তুই প্রীতমদার দোকানে গিয়ে বসে থাক। তুই বেরোলে আমিও বেরোবো।

তোর দিদিটা কে বল তো?

শেফালি। ক্লাস নাইন।

তা হবে, আচ্ছা আজ যা, আবার আসিস।

সীতু চলে গেলে প্রীতম চুপচাপ বসে রইল। সীতুকে দেখে নগেনের দোকান থেকে যে মেয়েটা বেরিয়ে এল তাকে এই সুঁঝকো আঁধারে ভালো দেখতে পেল না প্রীতম। এ দিকে একটু তাকিয়ে রইল মেয়েটা। তার পর সীতুর সঙ্গে চলে গেল।

সন্ধ্যের মুখে খদ্দেরের আনোগোনা বেড়ে গেল খুব। গলির দোকান হলে কী হয়, বিক্রিবাটা খুব ভালো। প্রীতমের কোনো দুঃখ নেই এখন।

পরেশের দোকানদারির অভিজ্ঞতা নেই। চটপটেও নয়। তাই সন্ধ্যের মুখটায় প্রীতমকেই হাত লাগাতে হয়। মুদির দোকানের বিক্রির হিসেব রাখা মুশকিল। শশী পাল কেরোসিন, ব্লেড আর ন্যাপথলিন নিয়ে গেল তো বাসন্তী আড়াই-শো সর্ষের তেল, কালোজিরে আর গোলা সাবান। নিত্যানন্দ একখানা ফর্দ ধরিয়ে দিয়ে হাওয়া হল তো শ্রীপতি এল কাঠকয়লা, গোরুর দড়ি আর শটিফুড কিনতে। হিমসিম অবস্থা।

ওরই মধ্যে টুলে বসে রোজকার মতো ফুট কেটে যাচ্ছে হরিপদ দাস, বলি, তোর কি মাথায় কোনো চিন্তাভাবনা নেই! দোকান করলেই হবে? সরস্বতীর তো বাপু সতেরো আঠারো হল, চেহারার চটক থাকতে থাকতে বিয়ে লাগিয়ে দে। সুমন্ত কি খারাপ পাত্তর রে? বারো বিঘে জমি, রাইস মিল, মুড়ি-কল। পছন্দ নয় তো, সুধীর রায়ও আছে। আদালতের বাঁধা সরকারি চাকরি। হোক পিয়োন, সরকারি চাকরি বলে কথা। বাগনানে পাকা বাড়ি।

কথা কওয়ার সময় নেই, কিন্তু শুনে যেতে হচ্ছে। তবে, প্রীতম বিরক্ত হয় না। হরিপদরও দোষ নেই। পেট চালাতে নানান ধান্দা করে বেড়াতে হয়। জমি-বাড়ির দালালি, ঘটকালি, দরখাস্তর মুসাবিদা, কাউকে ফেলে না প্রীতম, ‘দূর ছাই’ করে না, তার সর্বদা তূষ্ণী ভাব।

এক জন ঝাঁ চকচকে বউমানুষ এসে দাঁড়াল। শশব্যস্তে বসা থেকে উঠে পড়ল প্রীতম। বাপ রে! সাব ইন্সপেক্টর বরেন মজুমদারের বউ, বন্দনা মজুমদার।

চাওমিন আছে?

আছে বউদি।

লোকাল মেড নয় কিন্তু।

আজ্ঞে না, ব্র্যাণ্ডেড মাল।

আর সয়া সস, চিলি সস?

আছে বউদি।

মহিলার হাবভাবই অন্যরকম। এ জায়গার সঙ্গে মেলে না। যেমন চেহারার চেকনাই, তেমনই আদবকায়দা। জিনিসগুলো খুব তাচ্ছিল্যের সঙ্গে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল। তার পর বটুয়া খুলে দাম দিয়ে দিল।

আপনি আজকাল পিউ স্টোর্সে বসেন না?

না, আমার বোন বসে।

হ্যাঁ, সে দিন আইলাইনার চাইলাম, খুঁজেই পেল না।

কাচুমাচু হয়ে প্রীতম বলে, নতুন তো, তাই। আমি বরং বাড়িতে আইলাইনার পৌঁছে দেব।

দরকার নেই। আমি আনিয়ে নিয়েছি। আপনি যখন বসতেন তখন পিউ স্টোর্সে মেয়েদের খুব ভিড় হত। আজকাল হয় না। আপনি মেয়েমহলে বেশ পপুলার, তাই না?

প্রীতম লজ্জার হাসি হেসে বলল, মেয়েদের জিনিসপত্র রাখি তো, তাই।

মুখ টিপে একটু হেসে বন্দনা চলে গেল।

হরিপদ পিছন থেকে ফুট কাটল, জব্বর কাস্টমার পেয়েছিস।

সব কাস্টমারই সমান!

এম.এ.বি.টি., বুঝলি? কিন্তু আজও বাচ্চা বিয়োতে পারেনি।

মেয়েরা কি শুধু বাচ্চা বিয়োনোর যন্তর নাকি?

তা নইলে বিয়োবে কে? পুরুষমানুষ আর সব পারে, ওইটি পারে না। বুঝলি রে? যে-মেয়ে ওইটে পারে না, সে যতই তড়পাক, মেয়ে জন্মই বৃথা। পুরিয়ায় করে একটু ইসবগুল দে তো দেখি। আজ মোটে ক্লিয়ার হয়নি। পেটটা থম মেরে আছে।

ইসবগুল সস্তা জিনিস নয়, তাই প্রীতম শশী কবরেজের করা ত্রিফলার গুঁড়ো খানিকটা পুরিয়া করে দিয়ে বলল, এইটে মেরে দাও গে, সকালে বগবগ করে নেমে যাবে।

নির্বিকার মুখে পুরিয়াখানা জামার বুকপকেটে ঢুকিয়ে হরিপদ বলে, দু-দুটো কারবার ফেঁদে বসলি, আমদানিও তো ভালোই দেখছি। এইবেলা একটা পলিসি করিয়ে নিবি নাকি। ধর হাজার পঞ্চাশেক। প্রিমিয়ামও গায়ে লাগার মতো নয়।

প্রীতম একটু হেসে বলল, তুমি কি পোড়াচোখে আর কাউকে দেখতে পাও না? এখনও ভরপেট ভাতের পাকা ব্যবস্থা হয়নি, এর মধ্যেই ওসব লাখ-বেলাখ এনে ফেলছ?

ওরে, তোরও তো একটা ভবিষ্যৎ আছে, নাকি? বিয়ে করবি, সংসার হবে, তখন...

কে বলল আমার ভবিষ্যৎ আছে? ওসব আমার নেই। আমি শুধু আজকের দিনটা বুঝি। কাল ভোর হলে কালকের কথা ভাবতে লাগব। আগ বাড়িয়ে কবে কি হবে তা নিয়ে মাথা গরম করতে যাব কেন?

প্রীতমের গলায় একটু ঝাঁঝ ছিল, তাইতেই হরিপদ চুপ মেরে গেল। টোপটা খেল না। বেশির ভাগই খায় না। তা বলে চেষ্টার ত্রুটি রাখে না হরিপদ। কথা পালটে সে বলে, হ্যাঁ রে, মোদকের মধ্যে কি হেরোইন থাকে?

প্রীতম ভ্রূ কুঁচকে বলে, হেরোইনের দাম জানো?

কে যেন বলছিল, শশী কবরেজের মোদকে হেরোইন আছে।

তোমার মাথা।

আমিও তাই ভাবছি, হেরোইন থাকলে মোদক এত সস্তা হয় কি করে?

গোপাল মাইতি এসে একখানা বড়ো ফর্দ দাখিল করে বলল, মেপে রাখ, আধঘণ্টা বাদে নিয়ে যাব। তাড়া আছে।

প্রীতম আর পরেশ ভারি ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

হরিপদ আক্ষেপ করে আপনমনেই বলতে লাগল, আহাম্মক আর কাকে বলে? ওর নাকি আখের বলেই কিছু নেই। দুনিয়ার মানুষ আখের গোছানোর জন্য হাঁসফাঁস করে মরছে, তারা কি সব বোকা? দশ পনেরো বছর বাদে যখন গোছা গোছা টাকা পেতিস তখন বুঝতিস পলিসি কি জিনিস। তা না হয় না-ই করলি, শেয়ার বাজারেও লাগাতে পারিস কিছু। মন্দা বাজারে ধরলি, তেজি বাজারে ছাড়লি, গায়ে হাওয়াটি লাগল না, হাতে বাণ্ডিল বাণ্ডিল চলে এল।

কথা কমাও হরিদা। কথা বেশি কও বলেই তোমার হাওয়া বেরিয়ে যায়। আজ অবধি কাজের কাজ একটাও করে উঠতে পারলে না।

হরিপদ মোটেই রাগ করল না। নির্বিকার মুখে বলে, ওরে, এবার হাওয়া ঘুরবে, দেখিস।

তাই নাকি?

শাশুড়ি মরো মরো।

মরলে কি তুমি গিয়ে খন্যাডিহিতেই গেড়ে বসবে নাকি?

খন্যাডিহি ভালো জায়গা। ফুলের চাষ হয়। ফসলে আর কটা টাকাই বা থাকে। ফুলের চাষ সারাবছর। গতবারই তো শুনেছি শাশুড়ি চল্লিশ হাজার টাকার ব্যবসা করেছে। দেখাশুনো করার লোক থাকলে আরও হত।

প্রীতম জানে হরিপদ এ জায়গা ছেড়ে নড়বে না। শাশুড়ি মরলে খন্যাডিহি যাবে বটে, কিন্তু দু-দিনেই সব বেচেবুচে দিয়ে ফিরে আসবে। তারপর টাকাটা উড়িয়ে ফের এইরকম সন্ধ্যেবেলায় এসে তার দোকানে বসে লেজ নাড়বে। কিছু লোকই থাকে ওরকম, যারা উড়িয়ে যত সুখ পায় তত আর কিছুতে নয়। হরিপদর মধ্যে তার বাবা বিনোদকুমারের একটা আদল আছে। জলের লেখার মতো ভেসে যেতে বড়ো সুখ পায়। কিন্তু ঘটিয়ে তুলতে পারে না। কেউ জুয়ার বাজি ধরে, কেউ শাশুড়ির মরার জন্য অপেক্ষা করে, কেউ অদৃষ্টের ওপর বরাত দিয়ে বসে থাকে।

রাত ন-টা নাগাদ দোকানের ঝাঁপ ফেলল প্রীতম। বিক্রিবাটার টাকা গুণেগেঁথে ব্যাগে ভরল। তারপর উঠে পড়ল।

চলি হে পরেশ।

হুঁ।

সাইকেলখানার ওপর কম রগড়ানি যায় না। তবে প্রীতম জিনিসের সঙ্গে ভাবসাব করতে জানে। রোজ ভেজা ন্যাকড়া দিয়ে মোছে। তেল দেয়। তা ছাড়া দরকারমতো মেরামত করিয়ে নেয়। নিতাই পোদ্দারের কাছ থেকে সেকেণ্ড হ্যাণ্ড কিনেছিল। দিব্যি চলছে। আরও বছর দশেক চালিয়ে দেবে সে।

মোড়ের কাছে এসে দেখল সীতু শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে আছে।

কি রে, বাড়ি যাসনি?

রিকশা পাচ্ছি না যে!

কেন, রিকশার অনটন কীসের?

সীতু এক গাল হাসল, সব নাকি ধান তুলতে চলে গেছে। কাল সকালে ফিরবে।

তা হেঁটেই মেরে দে না। একটুখানি তো পথ।

দিদি পারবে না যে।

দিদি! তোর দিদি কোথায়?

ওই যে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে ফুচফুচ করে কাঁদছে। মা বকবে তো, তাই।

সাইকেল থেকে নেমে পড়ল প্রীতম। তাই তো! এরা তো বেশ আতান্তরেই পড়েছে। পথটা পুরুষের পক্ষে বেশি নয় বটে, কিন্তু মেয়েদের পক্ষে বোধহয় বেশিই। তা ছাড়া বিপদ আপদ ঘটতে পারে।

তুই সাইকেল চালাতে পারিস না?

পারি তো।

তাহলে দিদিকে চাপিয়ে নিয়ে চলে যা আমার সাইকেলে। ফেরত দিতে হবে না। কুতুবের দোকানে জমা করে দিস।

আমি জানতাম।

কী জানতিস?

আজ আমি তোমার সাইকেলটাতে চাপব।

কথাটা বিশ্বাস হয় প্রীতমের। সবাই বোকা বলে বটে, কিন্তু ছোঁড়াটার মধ্যে একটা কিছু আছে। ভগবান নানা বিচিত্র জিনিস দুনিয়ায় পাঠান, কার মধ্যে ঝাঁপি থেকে কী বেরোয় কে জানে বাবা।

ওপাশ থেকে শেফালি চাপাস্বরে ভাইকে বলল, না না, আমি তোর সাইকেলে চাপব না, ফেলে দিবি।

সীতু বলে, আচ্ছা, একটুক্ষণের জন্য উঠেই দেখো না।

না বাপু, তুই তো রোগা-ভোগা ছেলে।

চাপাচাপিতে নিমরাজি হল মেয়েটা। উপায়ও নেই। রাত হয়ে যাচ্ছে। দিদিকে রডে বসিয়ে কেৎরে মেৎরে উঠে পড়ল সীতু। কিন্তু সাইকেল টলোমলো করছে। দশ হাত যেতে-না-যেতেই ঝপাং করে রাস্তার গর্তে পড়ে কাত হল। দু-জনেই মাটিতে গড়াগড়ি।

প্রীতম গিয়ে সীতুকে তুলল। মেয়েটা লজ্জা পেয়ে নিজেই উঠে পড়ল টপ করে, ফেললি তো! হাঁদারাম কোথাকার!

ব্যথা পেয়েছিস দিদি?

না। লাগেনি।

তীক্ষ্ণ চোখে সাইকেলখানা পরখ করছিল প্রীতম। না, চোট হয়নি, ঠিকই আছে। বলল, সাইকেল ছাড়া তো উপায় নেই। সাড়ে ন-টা বেজে গেছে।

শেফালি কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে, ও তো পারবে না। আবার ফেলে দেবে।

ঠিক আছে, তোমরা দু-জন রড আর ক্যারিয়ারে বসে যাও আমি ঝট করে নামিয়ে দিয়ে আসছি। পারবে তো? ভয় করবে না?

শেফালি চুপ। সীতু বলল, খুব পারব। চল রে দিদি।

শেফালির আর কোনো আপত্তি হল না।

সীতু উঠল রডে, শেফালি ক্যারিয়ারে।

একটু একটু হিমেল বাতাসে আলোছায়াময় রাস্তায় সাইকেলখানা মসৃণ গতিতে ছুটছে। দুই শক্তিমান হাতে হ্যাণ্ডেল ধরা, চওড়া পিঠের আড়াল, শেফালির শরীর আর মন শিউরে শিউরে উঠছে। স্বপ্নের পুরুষ এত কাছে এলে কি বাঁচে কোনো মেয়ে? সে তো মরে যাচ্ছে! হে ভগবান, এটা যেন আবার স্বপ্ন না হয়। যা দুষ্টু তুমি, সুখ ভন্ডুল করে দিতে তোমার জুড়ি আর কে?

 

 

মধ্যরাতে যৌবন ফিরে পেল বিনোদকুমার। কালীচরণের ঠেক থেকে টলতে টলতে বেরিয়ে সে যৌবনটাকে বেশ টের পাচ্ছিল। মনটা একেবারে চলকে চলকে যাচ্ছে, কানায় কানায় ভরা সে। আকাশের দিকে তর্জনী তুলে সে ভগবানকে বলল, থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ...

আশপাশটা একটু দেখেও নিল বিনোদ। বুড়ো বয়সটা নেড়ি কুকুরের মতো পায়ে পায়ে লেগে আছে নাকি? না, নেই। বুড়ো বয়সটা তাড়া খেয়ে হাওয়া হয়েছে।

বিনোদের মনটা বড়ো খারাপ ছিল আজ। ওই যে সফল শালা কী কতগুলো কথা না হক শুনিয়ে দিল, কাজটা কি উচিত হয়েছে ওর? কত বড়ো কেওকেটা রে তুই? অ্যাঁ! বড়োলোক আছিস থাক না। তোর টাকায় পেচ্ছাপ করে এই বিনোদ।

ভিতরটা বড্ড গরম হয়ে ছিল বলে আজ আর কোনো আঁটশাঁট মানেনি সে। বউয়ের তোশকের তলা থেকে এক খাবলা টাকা তুলে নিয়ে সোজা চলে এল কালীর ঠেক-এ! সময়টা জলের মতো বয়ে গেল।

রাস্তাটা একটু দুলছে বলে হাঁটাটা তেমন সটান হচ্ছে না তার। ঝুলা পোলের মতো দুলবার দরকারটাই বা কি রে তোর? একটু থিতু হ না বাপু। আজ বাড়িঘরগুলোও মোটে স্থির হয়ে নেই। বড্ড পাশ ফিরছে। তা হোক, সবাই আনন্দে থাকুক বিনোদের মতো। বুড়ো বয়স ঝেড়ে ফেলে এই যে নতুন বিনোদ বেরিয়ে এল এটা কি টের পাচ্ছে লোকে?

আচ্ছা, সে যাচ্ছে কোথায়? সেই বুড়ি বউ আর বদ্ধ ঘরের দমচাপা বাড়িটায়? ওইরকম থেকে থেকেই তো বয়সের উইপোকা তার শরীরে বাসা বেঁধেছিল। যুবক বিনোদ ওই বুড়িটার কাছে যাবে কেন? সেটা তো নিয়ম নয় রে বাপু! এখন যেতে হলে কাঁচা বয়সের মেয়ের কাছেই যাওয়া ভালো। কিন্তু কারও কথাই মনে পড়ে না যে!

কুয়াশা চেপে ধরেছে চরাচর। সাদা ভূতের মতো চারদিক গুলিয়ে দিচ্ছে। রাস্তাঘাট বেভুল, উলটোপালটা। এরকম গোলমাল হলে বড়ো মুশকিল হয়।

ভেজা ধুতিটা ছ্যাঁত ছ্যাঁত করে লাগছে গায়ে। ধুতিটা ভেজা কেন তা বুঝতে পারছে না সে। বৃষ্টি পড়ছে কি? নাকি জলে নেমে পড়েছিল! কিন্তু এখন সে ডাঙা জমিতেই হাঁটছে বটে! ঘড়াৎ করে একটা ঢেকুর তুলে সে ফ্যাঁস-ফ্যাঁসে গলায় বলে, আজ বড়ো আনন্দ থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ

হাতে টর্চ নিয়ে বাবাকে খুঁজতে বেরিয়েছে সরস্বতী আর বিম্ববতী। মা বারণ করেছিল, যেতে হবে না। আমার তোশকের তলা থেকে টাকা চুরি করে নিয়ে গেছে, আজ মদ গিলে আসবে।

সরস্বতী আপত্তি তুলেছিল, বাবা তো ছেড়ে দিয়েছে মা!

শয়তান কি আর রং বদলায়? হাবভাব আমি ভালো বুঝছিলাম না। ঠিকই ফিরবে। যাবে কোথায়? মুরোদ জানা আছে।

তবু দু-বোন কিছুক্ষণ দেখে বেরিয়েছে। রাত দশটার পর গঙ্গারামপুরে আর কবরস্থানে তফাত নেই। তার ওপর আজ বড়ো দিক-ভুল কুয়াশা। হিম পড়ছে একটু একটু।

রাস্তায় উঠে দু-বোনে ভয়ে ভয়ে দেখল, দোকানপাট সব বন্ধ। আলো তেমন নেই। খাঁ খাঁ করছে। কাশীনাথের পাইস হোটেলটা খোলা। কিন্তু খদ্দের নেই তেমন। বাসন ধোয়ার শব্দ হচ্ছে।

হ্যাঁ রে দিদি, বাবা যদি মদ খেয়ে থাকে তাহলে কী করবি? আমার যে মাতালকে খুব ভয়!

দূর! মাতালকে ভয়, তা বলে বাবাকে তো নয়।

যদি আমাদের চিনতে না পারে!

মদ খেলে কি আর নিজের ছেলে-মেয়েকে চিনতে পারে না নাকি?

দু-জনে খুঁজল খানিক, তবে তেমন করে খুঁজতে সাহস হল না। রাতের দিকে মাতাল-বদমাশদেরই তো জো।

চল, বাড়ি যাই, দাদা এলে ঠিক বাবাকে খুঁজে আনবে।

সাইকেল চালিয়ে ফেরার সময়ে হঠাৎ প্রীতমের মনে হল, সীতুর দিদির মুখখানাই দেখা হয়নি তার। শেফালি না কি যেন নাম! মেয়ে নিয়ে তার কোনো চিন্তাভাবনা নেই। বিয়ের কথা ভাবে না, সংসার করার কথাও ভাবে না। তার এখন মেলা কাজ। ক্যারি করে নিয়ে এল, অথচ মুখ-চেনাই হল না এ একটা মজার ব্যাপারই হয়ে থাকল। কোথাও দেখলে চিনতেই পারবে না। কথাও কয়নি তার সঙ্গে বিশেষ।

বাড়ির সামনে এসে যখন নামল প্রীতম তখন এগারোটা বাজে। সাইকেলখানা সযত্নে দু-হাতে তুলে গ্রিলের বারান্দায় রাখার সময় সে গন্ধটা পেল। একটা মৃদু মেয়েলী গন্ধ সাইকেলখানার গায়ে লেগে আছে।

ঠিক করে দরজা খুলে সরস্বতী বেরিয়ে এল, দাদা, বাবা এখনও ফেরেনি।

সে কি! কোথায় গেল বাবা?

আমরা খুঁজে এলাম।

প্রীতম দাঁড়াল না। সাইকেলটা নামিয়ে পাঁই পাঁই করে চালিয়ে দিল।

খালের ওপর সাঁকোটায় বেভুল হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল বিনোদ। কোন দিকে যাবে ঠিক করতে পাচ্ছিল না। এখানে শুয়ে থাকলেও হয়। আর সেই কথাটাই নিজেকে বোঝাচ্ছিল সে। বাড়িঘর আবার কী, বউ-ছেলেপুলে আবার কি, সংসার আবার কী, আকাশে ভগবান আর নীচে এই তুমি, এ বই আর কিছু নেই। ঠেসে আনন্দ করো বাবা। যৌবন ফিরে পেয়েছ, আর চাই কি? একটা ভোজ দিয়ে দিও বরং। ব্যাপারটা সাব্যস্ত হওয়ার পর বিনোদ হেঁকে সবাইকে জানান দিল, অ্যাই, সবাই শুনে রাখো, কাল সবার ভোজের নেমন্তন্ন। বুঝলে! এই আমি খাওয়াব সবাইকে, সব্বাইকে, সব্বাইকে, কেউ যেন বাদ না যায়।

বিনোদের এই হাঁকটা শুনতে পেল প্রীতম। সাইকেলখানা গড়িয়ে কাছে এল, মদ খেয়েছ নাকি?

কে? কে রে?

বাড়ি চলো।

এক গাল হাসল বিনোদ, ও তুই! এই সব্বাইকে নেমন্তন্ন করে দিলাম , বুঝলি!

বেশ করেছ। এবার চলো।

আর গাঁইগুঁই করল না বিনোদ। সাইকেলখানায় হাত রেখে টাল সামলে সামলে হাঁটতে লাগল। কোথাও একটা যাচ্ছে সে। সেই বুড়ি বউ, সেই চেনা ছেলে-মেয়ে, সেই বদ্ধ ঘরের খাঁচা, সেই বুড়ো বয়স। ভালো লাগে না বিনোদের। গভীর রাতে বারান্দায় রাখা সাইকেলখানার গা থেকে একটা মিষ্টি মেয়েলি গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছিল বাতাসে। সাইকেলখানার বড়ো ধকল গেছে আজ। রোজই যায়। আজ এত ধকলের পরও মিষ্টি গন্ধ মেখে বড়ো ভালো লাগছে তার। নিথর ঘুমের মধ্যেও তাই সাইকেলটা মাঝে মাঝে ফিকফিক করে হেসে উঠছে।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন