অঘোরবাবুর ট্যাঁকঘড়ি – হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত

শীর্ষেন্দু মুখােপাধ্যায়

অঘোরবাবুর ট্যাঁকঘড়ি – হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত

টোয়েন্টি থাউজেন্ড ওয়ান, টোয়েন্টি থাউজেন্ড টু… টোয়েন্টি থাউজেন্ড থ্রি…—’ফর্টি থাউজেন্ড!’ কিছুটা জেদের বসেই এবার দ্বিগুণ দর হেঁকে বসলেন অঘোর সান্যাল। তাঁর দর হাঁকা শুনে এবার একেবারে হাঁ হয়ে গেল উলটো দিকে যে দর দিচ্ছিল সেই যুবক। অঘোরবাবু লক্ষ করলেন বিস্ময়ে ছেলেটার চোয়াল ঝুলে পড়েছে!

নিলামঅলা তার হাতুড়ি ঠুকে আবার দর হাঁকতে যাচ্ছিলেন কিন্তু ছেলেটা হাত নেড়ে বুঝিয়ে দিল সে আর ডাক দেবে না। নিলাম শেষ হয়ে গেল। ছেলেটা অঘোরবাবুর পরিচিত। নাম, অর্জুন লাখোটিয়া। বয়স ছাব্বিশ-সাতাশ হবে। ওর বাবা গণেশ লাখোটিয়াও অঘোর সান্যালের বিশেষ পরিচিত। অঘোরবাবুর মতো গণেশ লাখোটিয়ারও ইম্পোর্ট-এক্সপোর্টের ব্যবসা আছে।

নিলাম শেষ হবার পর আশেপাশের ভিড়টা পাতলা হয়ে গেল। কিন্তু বিস্মিত অর্জুন তখনও তাকিয়ে আছে অঘোরবাবুর দিকে। সে যে প্রচণ্ড আশাহত তা বুঝতে অসুবিধা হল না অঘোরবাবুর। তার কাঁধে হাত রেখে সান্ত্বনা দেবার ভঙ্গিতে তিনি বললেন, ‘ডোন্ট আপসেট মাই বয়। নিলামের নিয়মই হল, কেউ জেতে কেউ হারে। এই যেমন গত মাসে তুমি আমাকে নিলামে হারিয়ে মিং আমলের ফ্লাওয়ার ভাসটা জিতে নিলে। ও রকম একটা ফুলদানির শখ আমার বহুদিনের ছিল। কী আর করা যাবে? নেক্সট টাইম হয়তো আবার তুমি জিতবে।”

ছেলেটা অঘোরবাবুর কথার কোনো জবাব দিল না। নিলামঅলার টেবিলে রাখা যে জিনিসটার নিলাম হচ্ছিল সেটার দিকে একবার তাকিয়ে কাঁধ থেকে অঘোরবাবুর হাতটা সরিয়ে ধীর পায়ে নিলামঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।

সে চলে যাবার পর পরিচিত বৃদ্ধ নিলামদার মন্তব্য করলেন, ‘অল্পবয়সি ছেলেতো। ব্যাপারটা ঠিক মেনে নিতে পারল না।’ তার কথায় ঘাড় নেড়ে সম্মতি প্রকাশ করে অঘোরবাবু এবার তাকালেন টেবিলে রাখা তার জিতে নেওয়া জিনিসটার দিকে। সেটা একটা চেনঅলা সোনার পকেট ওয়াচ। আগেকার দিনে যাকে লোকে বলত ‘ট্যাঁকঘড়ি’। খুব সুন্দর দেখতে খাঁটি বিলেতি জিনিস। নকশাতোলা বেশ বড়ো একটা চেরিকাঠের বাক্সর ভিতরে নীল মখমলের মধ্যে রাখা। ঘড়িটা আপাতত বন্ধ থাকলেও এখনও চলে। নিলামঅলার বক্তব্য অনুযায়ী ঘড়িটার বয়স নাকি প্রায় দুশো বছর। আর বাক্সটারও তাই।

পকেট থেকে চেক বই বের করে চেক লিখতে শুরু করলেন আঘোরবাবু। নিলামঅলা বাক্সটা বন্ধ করে দিয়ে সেটা ব্রাউন পেপারে মোড়াতে মোড়াতে বললেন, ‘বাড়ি গিয়ে ঘড়িটা চালু করে নেবেন। একবার দম দিলে ঘড়িটা আটচল্লিশ ঘন্টা চলে। একদম খাঁটি বিলেতি ঘড়ি। এক বুড়ো ‘অ্যাংলো’ পয়সার অভাবে বেচে দিয়ে গেল। ঘড়িটা নাকি উত্তরাধিকার সূত্রে কিছুদিন আগেই লন্ডন থেকে ওর হাতে এসেছে।’

চেক কেটে সেটা নিলামদারের হাতে ধরিয়ে বাক্সটা নিয়ে নিলেন অঘোরবাবু। তারপর তিনি যখন দোকানের বাইরে এগোতে যাচ্ছেন তখন জিনিসপত্রে ঠাসা আধো অন্ধকার নিলামঘরের মধ্যে কিছু দূরে একটা অদ্ভুত জিনিস দেখতে পেলেন তিনি। একটা পুরোনো পিতলের মূর্তির পায়ের কাছে শুয়ে তার দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বিরাট বড়ো একটা কালোরঙের অ্যালসেসিয়ান কুকুর! মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন অঘোরবাবু। তবে তা ভয়ে নয়। এ জাতীয় একটা কুকুর তার নিজের বাড়িতেও আছে। তিনি ভাবলেন নিলামদারকে একবার জিজ্ঞেস করেন যে, ‘কার কুকুর ওটা?’ এর পরক্ষণেই তার মনে হল, ওটা হয়তো নিলামদারের কোনো খদ্দেরের হবে। তিনি নিজেও তো বেশ কয়েকবার তাঁর কুকুরটাকে সঙ্গে নিয়ে এই নিলামঘরে এসেছেন। তেমনই হবে হয়তো। এ কথা চিন্তা করে কাজেই আর নিলামদারকে কিছু না-বলে সামনে এগিয়ে কাচের দরজার পাল্লা ঠেলে পার্ক স্ট্রিটের ব্যস্ত রাস্তায় নেমে পড়লেন অঘোরবাবু। কিছু দূরে রাস্তার পাশে দাঁড় করানো ছিল তার ফিয়েট গাড়িটা। গাড়ির দরজা খুলে ড্রাইভারের সিটে উঠে বসলেন তিনি। তাঁর রিস্টওয়াচে বেলা একটা বাজে। ক্যামাক স্ট্রিটে একটা কাজ সেরে গাড়ি নিয়ে তিনি যখন তার বাড়ির সামনে এসে ফটক খোলার জন্য হর্ন দিলেন তখন বেলা দুটো বেজে গেছে।

শহরের বাইরে বরানগরে গঙ্গারধারে প্রাচীর ঘেরা সাবেক আমলের দোতলা পৈত্রিক বাড়িতে পুরোনো কাজের লোক শিউসরণকে আর তার অ্যালসেসিয়ান টাইগারকে নিয়ে থাকেন ষাটোর্ধ্ব অঘোরবাবু। তিনি বিয়ে-থা করেননি।

হর্ন শুনে শিউসরণ দরজা খুলে দিল। গাড়ি নিয়ে ভিতরে ঢুকে পোর্টিকোতে ঘড়ির বাক্সটা হাতে নিয়ে নামতেই তাকে দেখে অন্য দিনের মতোই টাইগার ছুটে এল। অঘোরবাবুর একটু তফাতে এসেই হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল কুকুরটা। সন্দিগ্ধভাবে সে একবার তাকাল অঘোরবাবু হাতে ধরা বাক্সটার দিকে, তারপর গজরাতে শুরু করল। অঘোরবাবু তাকে ডাকলেন, কিন্তু সে কাছে এল না। তাই দেখে তিনি শিউসরণকে বললেন, ‘টাইগারের মেজাজটা আজ খারাপ বলে মনে হচ্ছে?’ শিউসরন জবাব দিল, ‘এতক্ষণতো ও ঠিকই ছিল। ওর মেজাজ কখন যে কী হয় বোঝা মুশকিল!’

অঘোরবাবু আর কথা বাড়ালেন না। কাঠের সিঁড়ি বেয়ে দোতলার শোবার ঘরে উঠে পোশাক পালটাতে শুরু করলেন। শিউসরণ খাবার দিয়ে গেল। দুপুরের খাওয়া সেরে ঘড়ির বাক্সটা বিছানায় রেখে শুয়ে পড়লেন অঘোরবাবু।

অঘোরবাবুর যখন ঘুম ভাঙল তখন প্রায় সাতটা বাজে। বাইরে অন্ধকার নেমেছে। বিছানাতে উঠে বসে বেড সুইচ জ্বালাতেই তাঁর চোখে পড়ল ঘড়ির বাক্সটার ওপর। কাগজের মোড়কটা খুলে বাক্স থেকে ঘড়িটা বার করে খুঁটিয়ে খুটিয়ে ঘড়িটা দেখতে লাগলেন তিনি। জিনিসটা যে অনেক পুরোনো তাতে সন্দেহ নেই। সোনার ডায়াল আর কাঁটাগুলো বাতির আলোতে ঝলমল করছে। ভালোভাবে নজর করতে ডায়ালের ঠিক মাঝখানে আরও একটা ব্যাপার চোখে পড়ল তাঁর। খুব সূক্ষ্মভাবে তিনটে জিনিসের ছবি খোদাই করা আছে সেখানে। একটা টুপি, একটা ছড়ি, আর একটা কুকুরের ছবি। ভালো করে খেয়াল না-করলে ঠিক ছবিগুলো বোঝা যায় না। নিলামদার বলেছিল ঘড়িটাতে একবার দম দিলে আটচল্লিশ ঘন্টা চলে। ঘড়িটা ভালো করে দেখে কাঁটা মিলিয়ে দম দেবার পর সুন্দর মৃদু টিকটিক ছন্দে ঘড়িটা যখন চলতে শুরু করল তখন কাঁটায় কাঁটায় ঠিক সাতটা বাজে। ঠিক সেই সময় অঘোরবাবুর মনে পড়ল, আজ রাত আটটাতে পার্ক স্ট্রিটের একটা বড়ো হোটেলে একটা পার্টি আছে। ব্যবসায়িক প্রয়োজনে এ ধরনের পার্টিতে তাঁকে মাঝেমাঝে যেতে হয়। ব্যবসায়ীরা আসে সেখানে। ব্যবসা সংক্রান্ত নানা বিষয় আলোচনা হয়। কাজেই আর সময় নষ্ট না-করে সেখানে যাবার জন্য তৈরি হতে উঠে পড়লেন তিনি। পোশাক পরার পর হঠাৎ তার মনে হল, ‘পকেট ঘড়িটাকে সঙ্গে নিয়ে যাই!’ এই ভেবে তিনি ঘর ছেড়ে বেরোবার আগে তার জহরকোটের নীচে পাঞ্জাবির বুকে পকেটে ভরে নিলেন সেটা।

অঘোরবাবু যখন পার্ক স্ট্রিটের সেই হোটেলে পৌঁছোলেন তখন একে একে অন্য অতিথিরাও সেখানে আসতে শুরু করেছেন। মিত্তির, চ্যাটার্জি, ঝুনঝুনঅলা, লাখোটিয়া, সিংঘানিয়া আরও অনেকে। এঁরা সবাই কলকাতার প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। বিরাট ঝাড়বাতি লাগানো আলোকোজ্জ্বল হোটেলের বলরুম ক্রমশ লোকজনের কথাবার্তা হাসিঠাট্টায় মুখরিত হয়ে উঠল। চ্যাটার্জির সাথে ব্যবসা সংক্রান্ত কিছু কাজের কথা সারার পর হঠাৎ গণেশ লাখোটিয়ার মুখোমুখি হয়ে গেলেন অঘোরবাবু। তাকে দেখেই লাখোটিয়া বললেন, ‘আপনার সঙ্গে আমার একটা পার্সোনাল কথা আছে মিস্টার সান্যাল।’

অঘোরবাবু বললেন, ‘বলুন?’

লাখোটিয়া একটু চাপাস্বরে বললেন, ‘আপনার কাছে আমার একটা রিকোয়েস্ট আছে। আজকে পার্ক স্ট্রিটের নিলামঘরে বিডিং-এর ব্যাপারটা আমি শুনেছি। ঘড়িটা না-পেয়ে অর্জুন খুব আপসেট হয়ে পড়েছে। ও আমার একমাত্র ছেলে। কোনো কিছু চেয়ে তা পায়নি এমন হয়নি। আমি আপনাকে ওই ঘড়ির দামের ওপর বাড়তি পাঁচ হাজার টাকা দিচ্ছি। ও ঘড়িটা আমার চাই।’

লাখোটিয়া তার শেষের কথাটা এমন ঢঙে বললেন তা ঠিক পছন্দ হল না অঘোরবাবুর। তিনি জবাব দিলেন, ‘ঠিক আছে আমি ভাবব আপনার কথা।’ লাখোটিয়া বললেন, ‘হ্যাঁ, ভাবুন।’

লাখোটিয়াকে পাশ কাটাবার জন্য এরপর তার থেকে বিদায় নিয়ে তিনি এগোলেন সামনের দিকে। অঘোরবাবু বলরুমের ঠিক মাঝখানে বড়ো ঝাড়বাতিটার নীচে গিয়ে দাঁড়াতেই তাকে দেখে এগিয়ে এসে মিত্তির বললেন, ‘কী মশাই, ভরদুপুরে আজ কুকুর নিয়ে কোথায় বেরিয়েছিলেন? আর সঙ্গের লোকটা কে ছিল?’

তার কথা শুনে অঘোরবাবু একটু অবাক হয়ে বললেন, ‘দুপুরে আমি বাড়ির বাইরে কিছুটা সময় ছিলাম ঠিকই, কিন্তু সঙ্গে তো কেউ ছিল না।’

মিত্তির বিস্ময়ের সুরে বললেন, ‘সে কী মশাই! আজ দুপুরবেলায় হাতে একটা প্যাকেট নিয়ে পার্ক স্ট্রিটে আপনি আপনার গাড়িতে উঠলেন। আর আপনার গাড়ির পিছনের দরজা খুলে গাড়িতে উঠলেন ছড়ি হাতে কালো পোশাক আর টুপি পরা একটা লোক। সঙ্গে অ্যালসেসিয়ানটা। কয়েক হাত দূর থেকে আমি তো স্পষ্ট দেখলাম! আপনাকে ডাকার আগেই আপনি গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেলেন।’ মিত্তিরের কথায় ‘কিন্তু, কিন্তু’, বলে অঘোরবাবু কী যেন বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু ঠিক তখনই তাঁর যেন মনে হল, তার বুক পকেটে রাখা ঘড়িটা যেন খুব জোরে টিকটিক শব্দে বাজতে শুরু করেছে। আর তারপরই কীসের একটা প্রচণ্ড ধাক্কায় মিত্তিরকে নিয়ে মাটিতে ছিটকে পড়লেন অঘোরবাবু। সঙ্গে সঙ্গে একটা কানফাটানো আওয়াজ আর ঝনঝন শব্দে কেঁপে উঠল ঘর! চিৎকার চেঁচামেচিতে ভরে উঠল বলরুম।

কয়েক মুহূর্তে পর লোকজন যখন অঘোরবাবুকে টেনে তুলল, তখন তিনি বুঝতে পারলেন আসল ব্যাপারটা। চারপাশে ঘরের মেঝেতে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য ভাঙা কাচের ঠুকরো! অঘোরবাবুর মাথার ওপরের বিশাল ঝাড়বাতিটা ভেঙে পড়েছে! ভাগ্য ভালো একজন ওয়েটার ব্যাপারটা শেষমুহূর্তে দেখতে পেয়ে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দেয় অঘোরবাবুকে। নইলে অতবড়ো ঝাড়বাতি মাথায় পড়লে আর দেখতে হত না। চোট অবশ্য তাঁর খুব একটা লাগেনি। সামান্য একটু হাতে লেগেছে। সবাই তাকে বলল, ‘খুব বেঁচে গেছেন মশাই!’

এরপর মিত্তিরের সাথে আর কোনো কথা হল না অঘোরবাবুর। দুর্ঘটনার কারণে পার্টিটাও তেমন জমল না। রাত দশটার আগেই সে-দিন বাড়ি ফিরে বিছানায় শুয়ে পড়লেন তিনি।

পরদিন বেশ ভোরেই ঘুম ভাঙল অঘোরবাবুর। রাতে ঘুমটা যেন কেমন ছেঁড়া ছেঁড়া হয়েছে তাঁর। সারারাত ঘুমের মধ্যে কেমন যেন অদ্ভুত একটা টিকটিক শব্দ শুনতে পেয়েছেন তিনি। ঘুমের ঘোরে বার দু-এক বিছানাতে উঠেও বসেছিলেন তিনি। অঘোরবাবু ঘুম থেকে ওঠার কিছুক্ষণের মধ্যে শিউসরণ চা নিয়ে এল। অন্যদিন এ সময় তার পিছন পিছন টাইগারও ওপরে উঠে আসে। বাঁধা নিয়ম। অঘোরবাবুর হাত থেকে দুটো বিস্কিট রোজ তার প্রাপ্য। আজ শিউসরণের সাথে টাইগার নেই। তাকে না-দেখে অঘোরবাবু বললেন, ‘কীরে টাইগার এল না?’

শিউসরণ জবাব দিল, ‘ওর মনে হয় শরীরটা খারাপ। কাল দুপরে আপনি বাড়িতে ফেরার পর সেই যে ও নিজের ঘরে গিয়ে ঢুকেছে, তারপর আর বাইরে আসেনি। রাতের খাবারও পড়ে আছে দেখলাম। সারারাত কুকুরটা গরগর করেছে।’

অঘোরবাবু শুনে বললেন, ‘দেখ, আজ ও ভালো হয় কিনা? নইলে কাল ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাস।’

চা পান শেষ হবার পর স্নানে গেলেন অঘোরবাবু। তারপর টিফিন সেরে পোশাক পরে নিলেন। পাঞ্জাবিটা গায়ে গলাবার সময় তিনি অনুভব করলেন ঘড়ির অস্তিত্বটা। একবার ঘড়িটা বার করে দেখলেন তিনি। খোলা জানলা দিয়ে আসা দিনের আলোতে ঝলমল করে উঠল ঘড়িটা। একদম নির্ভুল সময় দিচ্ছে সেটা। ঘড়িটা পকেটে নিয়েই তিনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লেন।

সারাদিন ব্যবসা সংক্রান্ত নানা কাজের চাপ ছিল। কাজের চাপে বুক পকেটে রাখা ঘড়িটার অস্তিত্ব ভুলেই গেলেন তিনি। দুপুরে বাড়ি ফেরা হল না তার। সন্ধ্যায় ব্যবসা সংক্রান্ত একটা বৈঠক ছিল। সেটা সেরে অঘোরবাবু ক্লান্ত শরীরে যখন বাড়ি ফিরলেন তখন রাত ন-টা বাজে। ওপরে শোবার ঘরে উঠে তিনি যখন পোশাক খুলতে যাচ্ছেন ঠিক তখন শিউসরণ এসে বলল, ‘বাবু, আপনার সাথে একজন অল্পবয়সি ভদ্রলোক দেখা করতে এসেছেন।’ এত রাতে আবার কে এল?’ আর নীচে নামতে ইচ্ছা করল না অঘোরবাবুর। একটু ইতস্তত করে তিনি বললেন, ‘ঠিক আছে, লোকটাকে ওপরে পাঠিয়ে দে।’ মিনিট দু-একের মধ্যেই সিঁড়িতে পায়ের শব্দ শোনা গেল। আর তার পরই যে ঘরে প্রবেশ করল তাকে দেখে একটু অবাকই হয়ে গেলেন অঘোরবাবু। অর্জুন লাখোটিয়া! তার পরনে লাল গেঞ্জি আর চোঙা প্যান্ট। চোখেমুখে প্রচণ্ড উত্তেজনার ভাব। টেবিলের কাছে দাঁড়িয়ে দরজার সামনে কয়েক পা ভিতরে আসা অর্জুনের উদ্দেশ্যে তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি এত রাতে?’ অর্জুন জবাব দিল, ‘আঙ্কল, আমি ওই ঘড়িটা নিতে এসেছি। কাল সন্ধ্যায় বাবার সাথে আপনার তো কথা হয়েছে। টাকাটা নিয়ে এসেছি আমি।’ এই বলে সে পকেটে হাত দিল সম্ভবত টাকা বার করার জন্য।

তার কথা শুনে অঘোর সান্যাল মৃদু অসন্তুষ্ট স্বরে বললেন, ‘তোমার বাবা আমাকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন ঠিকই। কিন্তু আমি বলেছি, ভেবে দেখব। দেবতো বলিনি! এ ব্যাপারে আমি কোনো সিদ্ধান্ত নিইনি। তেমন হলে জানাব।’

অর্জুন লাখোটিয়া বলল, ‘কিন্তু ঘড়িটা আমি নিয়ে যেতে চাই।’

অঘোরবাবু বললেন, ‘আমি তো তোমাকে বললাম, তেমন হলে তোমাকে জানাব।’

‘ঘড়িটা আমার আজই চাই এবং এখনই চাই। ওটা আমাকে দিন। আমি চেয়ে পাইনি, এমন কখনও হয়নি।’—এবার বেশ উদ্ধত রুক্ষ স্বরে কথাগুলো বলল অর্জুন।

তার কথা বলার ঢং দেখে মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল অঘোরবাবুর। তিনিও একটু রুক্ষ ভাবে বললেন, ‘তোমাকে যা বলবার তো বললাম। এখন তুমি যাও। অনেক রাত হয়েছে।’

অর্জুন গলার স্বর চড়িয়ে বলল, ‘আপনি আমাকে ঘড়িটা এখনই দেবেন। নইলে….’

‘নইলে কী?’ অঘোরবাবুও চিৎকার করে বলে উঠলেন। আর এর পরমুহূর্তেই তিনি দেখলেন অর্জুন তার পকেট থেকে বার করল একটা রিভলবার! তার নল সোজা তাক করা তাঁর দিকে।

হতভম্ব হয়ে গেলেন অঘোরবাবু। আর তার পরমুহূর্তেই অঘোরবাবুর যেন মনে হল তার বুক পকেটে রাখা ঘড়িটা বেশ জোরে টিকটিক শব্দে বাজতে শুরু করেছে! ঘাবড়ে গেলেও অঘোরবাবু মনে শক্তি সঞ্চয় করে বললেন, ‘তুমি কী আমায় ভয় দেখাচ্ছ? চালাও গুলি। ও ঘড়ি তোমাকে আমি দেব না।’

অঘোরবাবুর কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে অর্জুনের মুখটা যেন কেমন পালটে গেল। কাঁপতে লাগল তার হাত। আর কাঁপাকাঁপা হাতেই পরমুহূর্তে সে চালিয়ে দিল গুলি! অঘোরবাবু অনুভব করলেন একটা গরম হলকা তার কান ঘেসে বেরিয়ে গিয়ে দেওয়ালে বিদ্ধ হল। প্রচণ্ড শব্দ আর বারুদের কটু গন্ধে ভরে গেল ঘর। অর্জুন কিন্তু আর দাঁড়াল না। গুলিটা চালিয়েই আতঙ্কিত ভাবে ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে পালাতে শুরু করল।

গুলির শব্দ শুনে শিউসরণ ওপরে উঠে এল তখনও টেবিলের কাছে স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে আছেন অঘোরবাবু। শিউসরণই তাকে বিছানাতে এনে বসাল। ঘড়ির শব্দটা তখন আর কানে আসছে না অঘোরবাবুর। জলটল খেয়ে ধাতস্থ হতে বেশ কিছুটা সময় কেটে গেল। এমন একটা ঘটনা যে ঘটতে পারে তা ধারণাই ছিল না অঘোরবাবুর। এখন কী করা উচিত তা নিয়ে ভাবতে লাগলেন তিনি। তিনি কি পুলিশে খবর দেবেন? ব্যাপারটা ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না তিনি।

ভাবছিলেন অঘোরবাবু। ভাবতে ভাবতেই মিনিট কুড়ির মধ্যেই ফোনটা বেজে উঠল। টেবিলের কাছে গিয়ে রিসিভার তুলে অঘোরবাবু ‘হ্যালো’ বলতেই ওপাশ থেকে ভেসে এল আতঙ্কিত গণেশ লাখোটিয়ার গলা, ‘মিস্টার সান্যাল, আপনি অর্জুনকে ক্ষমা করে দিন। ও মা-মরা ছেলে। আমি ব্যবসার কাজে ব্যস্ত থাকি বলে ও অসৎ সঙ্গে বিগড়ে গেছে। আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি ও একাজ করবে না। ও যে আপনার কাছে গেছিল তা আমি জানতামই না। প্লিজ আপনি পুলিশে খবর দেবেন না। তাহলে আমার আর মানসম্মান থাকবে না। প্লিজ মিস্টার সান্যাল…।’

অঘোরবাবু তাকে থামিয়ে দিয়ে উত্তেজিতভাবে বললেন, ‘ও কী করেছে আপনি জানেন? ও গুলি করেছিল আমাকে! অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছি। একদম কান ঘেসে গেছে গুলিটা! ও আমাকে একটা ঘড়ির জন্য খুন করতে যাচ্ছিল!’ গণেশ লাখোটিয়া বললেন, ‘ঘড়িটার জন্য ও আপনাকে রিভলবার দেখিয়ে থ্রেট করে চরম অন্যায় করেছে। আপনি বিশ্বাস করুন মানুষ খুন করার মতো সাহস ওর নেই। আসলে আপনাদের কথাবার্তা চলার সময় আপনার কুকুরটা আপনার পিছনে এসে দাঁড়িয়ে ছিল। কুকুরে ওর দারুণ ভয়। আপনাকে নয়, কুকুরটা দেখেই ভয় পেয়ে ও গুলিটা চালিয়েছিল। তারপর পালিয়ে আসে।’ অঘোরবাবু বললেন, ‘কুকুর? কিন্তু…’

লাখোটিয়া বললেন, ‘আমার কথা বিশ্বাস করুন। প্লিজ আপনি পুলিশে খবর দেবেন না। অর্জুন আপনার কাছে মাফ চেয়ে আসবে। প্রয়োজনে আমি একলাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেব। সেই ফ্লাওয়ারভাসটাও গিফট করব। নিকেলসন কোম্পানির যে অর্ডারটার জন্য আপনি অনেক দিন চেষ্টা করছেন সেটাও পাইয়ে দেব। শুধু আপনি থানা-পুলিশ করবেন না…। এর পরই সম্ভবত যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে ফোনটা কেটে গেল। চেষ্টা করেও লাখোটিয়াকে আর ধরা গেল না। রিসিভার নামিয়ে রেখে অঘোরবাবু শিউসরণকে বললেন, ‘হাঁরে ওই ছেলেটা যখন ওপরে উঠেছিল তখন টাইগার কি ওপরে উঠেছিল?’

সে জবাব দিল, ‘না তো বাবু, সে তো ঘর ছেড়ে বেরোয়নি। যখন ওপরে শব্দ হল, তখন আমি তার ঘরে খাবার দিতে ঢুকে ছিলাম।’ জবাব শুনে নিজের মনে অঘোরবাবু বললেন, ‘আশ্চর্য! ছেলের অপরাধ ঢাকতে কি মিথ্যা বললেন গণেশ লাখোটিয়া?’

তিনি যা করবেন তা পরের দিন করবেন,—এই ভেবে শিউসরণকে সজাগ থাকতে বলে খাওয়া সেরে আর কিছু সময়ের মধ্যেই অঘোরবাবু বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়লেন। কিন্তু সেদিনও আগের রাতের মতোই একটা টিকটিক শব্দ ঘুমের ঘোরে শুনতে পেলেন অঘোরবাবু। এ দিনের শব্দ যেন আগের রাতের থেকে আরও বেশি তীব্র। শেষ রাতের দিকে ঘুম ভেঙে বিছানায় উঠে বসলেন তিনি। সঙ্গে সঙ্গে শব্দটা বন্ধ হয়ে গেল ঠিকই, কিন্তু অন্ধকার ঘরে অঘোরবাবু বুঝতে পারলেন সেই শব্দের অনুরণনটা যেন তখনও তার কানে জেগে আছে! বাকি রাতটা জেগেই কাটিয়ে দিলেন তিনি।

বিকালবেলায় নিজের ঘরে বসে ছিলেন অঘোরবাবু। সারাদিন তিনি বাড়ির বাইরে যাননি। শিউসরণ কুকুরটাকে একটু আগে নিয়ে গেছে ডাক্তারের কাছে। গতকালও সারা রাত কেঁদেছে কুকুরটা। রাতে ভালো ঘুম না-হওয়ায় শরীরটাও একটু খারাপ অঘোরবাবুর। সেদিন ঘড়িটা কিনে আনার পর থেকেই তাঁর স্বাভাবিক জীবনে কোথাও যেন একটা ছন্দপতন ঘটতে শুরু করেছে। কিন্তু ব্যাপারটা তিনি ঠিক ধরতে পারছেন না। পরপর দু-রাত ধরে সেই টিকটিক শব্দটা কি নিছকই তার মনের ভুল, নাকি অন্য কিছু? বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকার পর ঘড়িটা আবার ভালো করে দেখার জন্য পাঞ্জাবির পকেট থেকে ঘড়িটা বার করে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখলেন তিনি। সাড়ে পাঁচটা বাজে। তেমন কিছু সন্দেহজনক বিষয় ঘড়িটার মধ্যে তার চোখে পড়ল না। তিনি এরপর ভাবলেন যে ঘড়িটা তার বাক্সে পুরে আলমারিতে ঢুকিয়ে রাখবেন। এত দামি জিনিস বাইরে ফেলে রাখা বা সঙ্গে নিয়ে ঘোরা ঠিক হচ্ছে না। ঘড়ির বাক্সটা টেবিলে রাখা ছিল। সেটা তুলে এনে আবার খাটে বসলেন অঘোরবাবু। খুব সুন্দর বাক্সটা। এটারই দাম অন্তত হাজার দুই টাকা হবে। কাঠের কারুকার্য করা লম্বা ধরনের বাক্সটা অনেকটা গহনার বাক্সর মতো দেখতে। বাক্সটা খুলে অঘোরবাবু ঘড়িটা রাখতে যাচ্ছেন ঠিক তখনই তার মনে হল, বাক্সর নীল মখমলের চাদরের নীচ থেকে কী যেন একটা উঁকি দিচ্ছে। অঘোরবাবু মখমলের কোণটা সরাতেই তার নীচ থেকে বেরিয়ে এল, বিবর্ণ হয়ে যাওয়া একটা ভাঁজ করা কাগজ। সাবধানে কাগজের ভাঁজটা খুললেন তিনি। সম্ভবত সেটা ছিল একটা রাইটং প্যাডের পাতা। হলদেটে হয়ে যাওয়া কাগজে খুদে খুদে বিবর্ণ হয়ে যাওয়া ইংরেজি হরফগুলো পাঠ করার চেষ্টা করলেন তিনি। আর তা পাঠোদ্ধার করে হতভম্ব হয়ে গেলেন তিনি। আসলে সম্ভবত এটা একটা অসম্পূর্ণ চিঠি ছিল। সালটা লেখা আছে ‘উনিশশো দশ’। চিঠিটা যার উদ্দেশে লেখা তাঁর নাম জোনাথন হলেও লেখকের কোনো নাম নেই। সম্ভবত লেখক চিঠিটা শেষ করেননি বা করতে পারেননি। চিঠির প্রথম ক-টা লাইন অস্পষ্টতার জন্য পাঠ করা যাচ্ছে না। কিন্তু তার পর লেখা,—”ঘড়িটা এখন আমার সামনেই রাইটিং ডেস্কের ওপর রাখা। এক চরম মানসিক অস্থিরতার মধ্যে আমি এখন আছি। তুমি বলেছিলে—ডাকাতরা লন্ডনে এক রাজপথে রাত্রিবেলায় এই ঘড়িটা ছিনতাই করার সময়ই যাদুকর ফিলিপ আর তার কুকুরটাকে হত্যা করে। আর তার পর থেকেই নাকি সেই যাদুকর তাঁর কুকুরটাকে নিয়ে এই ঘড়িটাকে অনুসরণ করে। মৃত্যুর পরও তাঁর প্রিয় ঘড়ির মায়া কাটাতে পারেননি তিনি! এ ঘড়ি যার কাছে যায়, ঘড়িটা চালু করার আটচল্লিশ ঘন্টার মধ্যে তিনবার মৃত্যু এসে উপস্থিত হয় তার সামনে। প্রথম দু-বার মৃত্যু তার কাছে এসে সতর্ক করে দিয়ে যায়। সে আসার ঠিক আগের মুহূর্তে তীব্র টিকটিক শব্দে তার আগমনবার্তা জানান দেয় ঘড়িটা। আর তৃতীয়বার মৃত্যু নির্মম আঘাত হানে। এর আগে যাদের কাছে ঘড়িটা ছিল তারা কেউই আটচল্লিশ ঘন্টার বেশি ঘড়িটা চালিয়ে রাখতে পারেনি। যাদুকরের আত্মা কাউকে ভোগ করতে দেয় না এ ঘড়ি! জোনাথন, তোমার কথা আমি সেদিন বিশ্বাস করিনি। এখনও যে পুরোপুরি বিশ্বাস করছি তা নয়। গত পরশু রাত দশটায় এ ঘড়ি চালু করেছি আমি। কাকতালীয় ভাবেই তোমার কথা মিলতে শুরু করেছে। গতকাল দুপুরে আমার গাড়ি অ্যাক্সিডেন্ট করল, আর আজ সকালে বাড়ির সামনেই হাইভোল্টেজ বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে পড়ল আমার গা ঘেসে। দু-বারই আমি অল্পের জন্য মৃত্যুর থেকে রক্ষা পেয়েছি। আর কী আশ্চর্য, ঘটনা দুটো ঘটার ঠিক আগের মুহূর্তেই আমি শুনেছি আমার পকেটে ঘড়ির তীব্র টিকটিক শব্দ! আর আমার সোফার নাকি গতকাল রাতে আমার বাড়ির কম্পাউন্ডে একজন লোক আর তাঁর সাথে একটা কুকুরকে দেখেছে। এখন রাত দশটা বাজতে পাঁচ। অর্থাৎ আটচল্লিশ ঘন্টা হতে আর পাঁচ মিনিট বাকি। তোমার কথা সত্যি হয় তাহলে”…। এখানেই শেষ হয়ে গেছে।

লেখাটা পড়ে হতভম্ব হয়ে গেলেন অঘোরবাবু। এতে যা লেখা আছে তা কি সত্যি? সত্যি না-হলে ব্যাপারটা তার সাথেও মিলছে কীভাবে? ঘড়িটা চালু করার পর অঘোরবাবুও তো নিশ্চিত দু-বার মৃত্যুর মুখ থেকে রক্ষা পেয়েছেন। আর দু-বারই ঘটনা ঘটার ঠিক আগের মুহূর্তে তিনিও শুনতে পেয়েছেন তীব্র টিকটিক শব্দ। এ সবই কী কাকতালীয়? ঘড়িতে এখন ছ-টা বাজতে চলেছে। ব্যাপারটা যদি সত্যি হয় তাহলে আর এক ঘন্টার মধ্যেই মৃত্যু এসে হানা দেবে চূড়ান্ত আঘাত করার জন্য। ব্যাপারটা যেমন ঠিক তাঁর পুরোপুরি বিশ্বাস হচ্ছে না, তেমন উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।

সময় যত এগোতে লাগল ভিতরে তত উত্তেজিত হতে লাগলেন তিনি। আরও একটা ছন্দবদ্ধ শব্দ শুনতে পেলেন তিনি। সেটা তাঁর হৃৎপিণ্ডের শব্দ! হঠাৎ তাঁর খেয়াল হল, ‘আরে, ঘড়িটাকে বন্ধ করলেই তো এই বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচাল থেকে মুক্তি পাওয়া যায়!’ অঘোরবাবু চেষ্টা করলেন ঘড়িটা বন্ধ করার। কিন্তু কিছুতেই ঘড়িটা বন্ধ হল না। এবার বেশ ভয় পেয়ে গেলেন তিনি। কী করা যায় ঘড়িটা নিয়ে? ঘড়িটাকে তিন ফেলে দেবেন? এর পরক্ষণেই তার একটা বুদ্ধি এল মাথায়। তিনি টেলিফোনের কাছে উঠে গিয়ে ডায়াল করলেন একটা নির্দিষ্ট নম্বরে।

ফোনটা রিসিভ করলেন গণেশ লাখোটিয়াই। অঘোরবাবু তার উদ্দেশ্যে বললেন, ‘শুনুন মশাই, যা হবার তা হয়ে গেছে আমি আপনার ছেলেকে মাফ করে দিয়েছি। আর আমি ঠিক করেছি ঘড়িটা ওকেই দেব। আমি আজই বাইরে চলে যাব। আপনি এখনই, আধ ঘন্টার মধ্যে কাউকে পাঠিয়ে ঘড়িটা নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করুন। হ্যাঁ, আধ ঘন্টার মধ্যেই। লাখোটিয়া অবাক হয়ে বললেন, ‘কী বলছেন আপনি! আমিতো বিশ্বাসই করতে পারছি না! কাউকে আমি এখনই পাঠাচ্ছি। কিন্তু আপনি সত্যি বলছেন তো? আর টাকাপয়সা কী দিতে হবে যদি দয়া করে বলেন?’

অঘোরবাবু বললেন, ‘ওসব কথা পরে হবে। আপনি এখনই কাউকে পাঠান। আমার হাতে সময় একদম নেই।’ লাখোটিয়া বললেন, ‘ঠিক আছে এখনই কেউ যাচ্ছে আপনার কাছে’।

ফোন রেখে প্রতীক্ষা শুরু করলেন অঘোরবাবু। ঘড়ির কাঁটা যত এগোতে লাগল উৎকণ্ঠা তত বাড়তে লাগল তার। যেন মনে হতে লাগল এখনই যেন কিছু ঘটে যাবে। ঘড়িতে তখন পৌনে সাতটা বাজে, উৎকণ্ঠা তখন চরমে। ঠিক সেই সময় অঘোরবাবু দেখলেন একটা বাইক নিয়ে অর্জুন এসে দাঁড়াল তার বাড়ির সামনে। ঘড়িটা নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে তিনি নীচে নেমে এলেন। তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে অর্জুন মাথা নীচু করে বলল, ‘আমাকে আপনি মাফ করে দিন আঙ্কেল।’ অর্জুনকে আর কথা বাড়াতে না-দিয়ে অঘোরবাবু ঘড়িটা তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে তুমি এটা নিয়ে এখন যাও। পরে একদিন এসো। তখন কথা হবে।’ এই বলে ওপরে ওঠার জন্য পা বাড়ালেন। অর্জুন লাখোটিয়া যখন অঘোরবাবুর বাড়ি থেকে ঘড়িটা পকেটে নিয়ে তার বাইক স্টার্ট করল, তখন ঘড়িতে সাতটা বাজতে পাঁচ। ঠিক তখনই ঝুপ করে সন্ধ্যা নামল।

অর্জুন লাখোটিয়া ঘড়িটা নিয়ে চলে যাবার পর নিজের ঘরে ফিরে বেশ স্বস্তি বোধ করলেন অঘোরবাবু। কিছুক্ষণের মধ্যেই টাইগারকে নিয়ে ফিরে এল শিউসরণ। দু-দিন বাদে টাইগার আবার উঠে এল অঘোরবাবুর ঘরে। বেশ চনমনে দেখাচ্ছে তাকে। সে ল্যাজ নাড়তে লাগল। সারাদিন আজ বাড়িতেই ছিলেন অঘোরবাবু। তিনি টিভি খুলে বসলেন সারাদিনের খবর শোনার জন্য। রাত ন-টা নাগাদ টিভির পর্দাতেই তিনি খবরটা প্রথমে পেলেন—’আজ সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ টালা ব্রিজের কাছে পথ দুর্ঘটনায় অর্জুন লাখোটিয়া নামে এক যুবকের মৃত্যু হয়। হাসপাতালে মৃত্যুর আগে দুর্ঘটনার কারণ সম্বন্ধে সে জানিয়েছে যে দ্রুতগামী বাইকের সামনে হঠাৎই নাকি বিরাটাকার এক কুকুর এসে পড়ায় এই দুর্ঘটনা। নিহত অর্জুন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী গণেশ লাখোটিয়ার একমাত্র পুত্র।’

সকল অধ্যায়

১. ভূতের পাল্লায় – শক্তিপদ রাজগুরু
২. এ কী আজব গল্প – শৈলেন ঘোষ
৩. উপাস্য দেবতা – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়
৪. শিবেনবাবুর ইস্কুল – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৫. সাইকেল সাথি – শরদিন্দু কর
৬. ভুল হয় না ভূতের – বলরাম বসাক
৭. জটা তান্ত্রিকের খপ্পরে – হীরেন চট্টোপাধ্যায়
৮. শেষ বংশধর – শ্যামল দত্তচৌধুরী
৯. গাঁ-এর নাম ছমছমপুর – গৌর বৈরাগী
১০. হরিহরাত্মা – শিশির বিশ্বাস
১১. পাতালরেলের টিকিট – রতনতনু ঘাটী
১২. চ্যালেঞ্জ – সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়
১৩. ফ্যান – দেবাশিস সেন
১৪. মাস্টারমশাই – প্রচেত গুপ্ত
১৫. নরকের চলচ্চিত্র – সৈকত মুখোপাধ্যায়
১৬. আশ্চর্য চিঠি – সুকুমার রুজ
১৭. সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ি – কৃষ্ণেন্দু মুখোপাধ্যায়
১৮. এহসানের বাপ – দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য
১৯. তেরাখোলে এক রাত – দীপান্বিতা রায়
২০. ভূতের সঙ্গে মোকাবিলা – রাজেশ বসু
২১. ডবল রোল – উল্লাস মল্লিক
২২. অঘোরবাবুর ট্যাঁকঘড়ি – হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত
২৩. ভূতবাবার মেলায় – জয়দীপ চক্রবর্তী
২৪. বিভূতিবাবুর গল্প – বিনোদ ঘোষাল
২৫. ভয় পেয়ো না – দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন