২৫শে মার্চ – ৪

রবিন জামান খান

ঢাকা মেডিকেল মর্গ, ঢাকা
২৫শে মার্চ ১৯৭১
সময় : বেলা প্রায় ২টা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক মনিরুজ্জামানের ছোটবেলায় একবার পিঠে ফোঁড়া হয়েছিল। প্রথমে সে ঠিক গা করেনি। এরপর সেটা পেকে-টেকে একেবারে বাজে অবস্থা। স্বাভাবিকভাবেই এরপর তাকে ডাক্তারের ছুরির নিচে যেতে হয়। সেই বীভৎস যন্ত্রণা আর ডিসপেনসারির গন্ধ সেই যে তার ভেতরে একটা বাজে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, এরপর থেকে সে কোনোদিনই ডাক্তারের চেম্বারে বা হাসপাতালে স্বাভাবিক হতে পারেনি।

আর এই মুহূর্তে সে দাঁড়িয়ে আছে হাসপাতালের সবচেয়ে ভয়ংকর জায়গা, মর্গের সামনে। মনিরুজ্জামান মানুষটা ছোটখাটো, পরনে সাদা শার্ট আর গ্যাবাডিন প্যান্ট, চোখে আয়রন রিমের চশমা। তার বয়স মধ্য ত্রিশের কোঠায়। অত্যন্ত সাধাসিধে আর সুবোধ টাইপের চেহারা তার। তাকে দেখলে অপরিচিত কেউ কল্পনাও করতে পারবে না কী পরিমাণ তুখোড় বুদ্ধিমত্তা আর দুর্দান্ত সাহসী একজন মানুষ সে। পরিচিত মহলে তার সাহস আর বুদ্ধিমত্তা নিয়ে নানা ধরনের গল্প প্রচলিত আছে। এর মধ্যে একটি হলো মনিরুজ্জামানের ধমক খেয়ে একবার নাকি সুন্দরবনের এক রয়েল বেঙ্গল টাইগার হাগামুতা করে দিয়েছিল।

এহেন মনিরুজ্জাম হাসপাতালের মর্গের সামনে দাঁড়িয়ে ঘামছে, এই দৃশ্যটা মেনে নিতে তার নিজেরই খানিকা কষ্ট হচ্ছে। সে খুব আসহায়ভাবে পাশে দাঁড়ানো তার নিজের ছাত্রের দিকে ফিরে তাকাল। তার ছাত্র আবু খুব নিশ্চিন্ত মনে সুপুরি চিবাচ্ছে। মনিরুজ্জামানের খুব রাগ হলো। সেটা নিজের ওপর নাকি আবুর ওপর সে ঠিক বুঝতে পারছে না। তবে রাগের কারণটা সে ঠিকই জানে। যে কারণে তারা এখন মর্গের সামনে দাঁড়িয়ে আছে এবং যে কারণে তার প্রিয় বন্ধুর এই পরিণতি এর কারণটা সে নিজে। সে বাড়াবাড়ি আর পাগলামি না করলে হাফিজের এই পরিণতি হতো না।

“স্যার, কি ভয় পাচ্ছেন?”

“আ? কী বললি?”

“বলছিলাম, স্যার কি ভয় পাচ্ছেন?”

“তোর সাহস তো কম না? তুই জানিস না আমরা কী ভয়ংকর বিপদের মধ্যে আছি? তার ওপর দেশের কী অবস্থা? তারপরও তোর হাসি আসে কী করে?”

“ভুল হয়ে গেছে স্যার,” বলে আবু অন্যদিকে ফিরে তাকাল। তার আসলেই হাসি পাচ্ছে। যতদিন থেকে স্যারের সাথে তার পরিচয়, কখনো সে স্যারকে এতটা নার্ভাস হতে আর ভয় পেতে দেখেনি। তবে সেও বুঝতে পারছে পরিস্থিতির গুরুত্ব। তারা এতদিন ধরে যে কাজে একটু একটু করে সাফল্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল হঠাৎ করেই সেটার সম্ভবত অন্তিম পরিণতি হতে যাচ্ছে। পুরো ব্যাপারটার একদম কেন্দ্রের মানুষটা হঠাৎ এভাবে আত্মহত্যা করাতে এখন সেটা সম্ভবত বিনষ্ট হয়ে গেছে অঙ্কুরেই। আর যদি সেটা হয়ে থাকে তবে মনির স্যারের চেয়ে বেশি দুঃখ আর কেউ পাবে না। তবে তার চেয়েও বেশি খারপ হতে পারে যদি পুরো ব্যাপারটা পশ্চিম পাকিস্তানিরা টের পেয়ে গিয়ে থাকে।

শুরু থেকেই ওরা পুরো ব্যাপারটাকে খুব সুন্দর করে লুকিয়ে গেছে। কেউই জানতে পারেনি। না দেশের, না দেশের বাইরের। পুরো ব্যাপারটার কর্তা ছিলেন হাফিজ স্যার এবং মনির স্যার। আর তাদেরকে সাহায্য করেছে আবু নিজে স্যারের আরেকজন ছাত্র কবির। দিন দিন তারা একটু একটু করে সাফল্যের দিকে এগিয়ে গেছে, কেউ টেরটিও পায়নি। তাদের জন্য সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল দেশের পরিস্থিতি। সবকিছু ঠিক ছিল কিন্তু হঠাৎ করেই হাফিজ স্যার সুইসাইড করাতে সব শেষ হয়ে গেল।

আজও দুপুর পর্যন্ত সব ঠিক ছিল। মনিরুজ্জামান তার রোজকার ক্লাস শেষ করে টিচার্স রুমে, ফিরে আসে। সবাই গোল হয়ে বসে আলোচনা করছে। বিষয় একটাই— দেশের পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে। ইয়াহিয়া আর ভুট্টোর মতলব কী? এইসব। সাধারণত এইসব বিষয়ে মনিরুজ্জামান কখনোই যোগ দেয় না। কিন্তু আজ দিল। কারণ তার পরিস্থিতিটা বোঝা দরকার। একদিকে সে যে কাজে হাত দেয় সেটার জন্য আবার অন্যদিকে তার স্ত্রী সন্তানসম্ভবা, তাকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া উচিত কি না সেটাও বিবেচনা করতে হবে।

এমন সময় খবর এসে পৌঁছায় তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং ইতিহাস বিভাগের সাবেক শিক্ষক হাফিজুর রহমান নিজের রুমে গলায় ফাঁস দিয়েছে। এই খবরটা না শুনে যদি মনিরুজ্জামানের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ত তবুও সে কম চমকাত। কারণ কয়েকদিন আগেও তারা দুজনে গভীর রাত পর্যন্ত আলোচনা করেছে। তখনও সব স্বাভাবিক ছিল। এই কয়েকদিনে হঠাৎ কী এমন হলো যে হাফিজের গলায় দড়ি দিতে হলো। মনিরুজ্জামান তেমন কোনো উত্তেজনা দেখাল না খুব স্বাভাবিকভাবে দপ্তরিকে ডেকে তার পরের ক্লাসগুলো বাতিল করে দিয়ে খবর পাঠাল তার সহকারী দুই ছাত্র আবু আর কবিরকে। কবির ক্লাসে তার দেরি হবে, তাই আবু এসে পৌঁছতেই তারা দুজনে মনিরুজ্জামানের ওপেল গাড়িটা নিয়ে রওনা দেয় হাফিজের বাসভবনের দিকে।

হাফিজ পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া পল্টনে একটা পুরানো বাড়িতে একা বাস করত। একটা ছুটা কাজের লোক ছাড়া তার সাথে তেমন কেউ ছিল না। তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মানুষ বলতে ছিল বন্ধু মনিরুজ্জামান।

সে আর আবু পল্টনে হাফিজের বাড়িতে পৌঁছতে শুনল তার লাশ পুলিশে নিয়ে গেছে। সাথে সাথে তারা হাসপাতালের দিকে রওনা দিল। হাসপাতালে পৌঁছে শোনে ডিউটি ডাক্তার আর ডিউটি পুলিশ দুজনেই বাইরে গেছে। তাদেরকে ছাড়া লাশ দেখানো সম্ভব নয়। সেই থেকে তারা মর্গের বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে।

মনিরুজ্জামান আবুর দিকে ফিরে তাকাল, “আবু, তোর কি মনে হয় হাফিজ সুইসাইড করেছে?”

“স্যার আমার মনে হয় না হাফিজ স্যার সুইসাইড করেছেন। তিনি সুইসাইড করার মতো মানুষ ছিলেন না। এর পেছনে অন্য কোনো ঘটনা আছে।”

“অবশ্যই অন্য কোনো ব্যাপার আছে। দেখি ডাক্তার আসুক সে কী বলে।”

ডাক্তার এলো আরও আধা ঘণ্টা পর। তার সাথে একজন পুলিশ। মনিরুজ্জামান আবুকে নিয়ে সামনে এগোল। নিজের পরিচয় দেওয়ার পর ডাক্তার জানতে চাইল, “আপনি মৃত ব্যক্তির কে হন?”

“আমি ওর সবচেয়ে কাছের বন্ধু।”

“বন্ধু! দুঃখিত, আত্মীয়স্বজন কেউ না হলে ডেডবডি দেখতে দেওয়ার নিয়ম নেই।”

“দেখুন ওর আত্মীয়স্বজন বলতে কেউই নেই। কাছের মানুষ বলতে আমরাই আছি।”

“কিন্তু…”

“ঠিক আছে। তিনিই সঠিক লোক,” ডাক্তারের সাথের পুলিশ বলে উঠল। এই লোক সম্ভবত পূর্ব পাকিস্তানের নয়। তার চেহারা এবং কথার টান সেইরকমই বলে। কারণ এই দেশের পুলিশ বাহিনীতে পশ্চিম পাকিস্তানি পুলিশ ছাড়া এতটা দাপটের সাথে কথা কেউই বলতে পারার কথা না।

“আপনি আসুন আমার সাথে,” পুলিশ লোকটা মনিরুজ্জামানের দিকে তাকিয়ে ইশারা করল। তারা সবাই মর্গের দিকে এগোল। মর্গের ভেতরে ওষুধ আর অন্যান্য কেমিক্যালের গন্ধ মিলিয়ে একধরনের বোঁটকা গন্ধ। বমি চলে আসে।

তারা একটা টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। টেবিলের ওপর সাদা কাপড় দিয়ে কিছু একটা ঢেকে রাখা হয়েছে।

ডাক্তার ভদ্রলোক কাপড়টা সরাতেই মনিরুজ্জামানের প্রথম চোখে পড়ল হাফিজের চোখজোড়া। মানুষটা মারা গেছে তবুও তার চোখজোড়া যেন এখনও আগের মতোই প্রাণচঞ্চল। মৃত্যু তার চোখের সৌন্দর্য কেড়ে নিতে পারেনি। তবে অন্য সবকিছু খুবই বীভৎস। গলায় ফাঁস দিয়ে মরা মানুষের লাশ দেখা কখনোই খুব সুখকর ব্যাপার নয়। হাফিজেরটাও তাই। মৃতদেহটা দেখে মুখ কুঁচকে উঠল মনিরুজ্জামানের। আর পাশ থেতে আবু ওয়াক ওয়াক করে উঠল। ডাক্তার ঢেকে দিল মৃতদেহটা।

মনিরুজ্জমান বাইরে বেরিয়ে আসতে আসতে পুলিশ ভদ্রলোকের কাছে জানতে চাইল, “হাফিজ আত্মহত্যা করেছে সেটা আপনারা নিশ্চিত হচ্ছেন কীভাবে?”

“আমার তো মনে হয় সেটা আপনি আমাদেরকে আরও ভালোভাবে বলতে পারবেন।”

 “মানে?”

“দেখুন,” বলে সে মনিরুজ্জামানের দিকে একটা খাম এগিয়ে দিল। “এটা মৃতদেহের পাশেই পড়ে ছিল,” বলে সে একটু বিরতি নিয়ে বলল, “এতে আপনার নাম লেখা আছে।”

সত্যিই খামটার ওপর তার নাম লেখা এবং নিঃসন্দেহে এটা হাফিজের হাতের লেখা।

খামটা খুলতে ওটা থেকে বেরিয়ে এলো একটা সাদা-কালো ছবি। একদম ফ্রেশ ছবিটা দেখেই বোঝা যায় এটা সদ্যই ওয়াশ করা হয়েছে। একটা পা ভাঙা পাথরের ঘোড়ার ছবি। ছবিটার ওপরে পেনসিল দিয়ে হালকা করে লেখা ‘ট্রুথ ইজ অলওয়েজ ইন ফ্রন্ট অভ ইউ’। সে ছবিটা দেখছে হঠাৎ প্যাকেটের ভেতর থেকে কিছু একটা টুং করে মাটিতে পড়ে গেল। মনিরুজ্জামান জিনিসটা মাটি থেকে তুলে নিল। একটা কয়েন, ওটার একপাশে খোদাই করা একটা পা ভাঙা ঘোড়ার প্রতিকৃতি অন্যপাশে একটা অদ্ভুত সিম্বল।

সিম্বলটাতে দুই পাশ থেকে দুইটা সিংহ হাতে প্লাস চিহ্ন দেওয়া দুটো পতাকা ধরে আছে। তবে অবাক ব্যাপার সিংহ দুইটা এবং পতাকার ওপরে এমাথা থেকে ওমাথা পর্যন্ত ক্রশ চিহ্ন দেওয়া। যেন সিংহের এই প্রতীক চিহ্নটাকে কেটে ফেলা হয়েছে।

সকল অধ্যায়

১. ২৫শে মার্চ – পূর্বকথা
২. ২৫শে মার্চ – ১
৩. ২৫শে মার্চ – ২
৪. ২৫শে মার্চ – ৩
৫. ২৫শে মার্চ – ৪
৬. ২৫শে মার্চ – ৫
৭. ২৫শে মার্চ – ৬
৮. ২৫শে মার্চ – ৭
৯. ২৫শে মার্চ – ৮
১০. ২৫শে মার্চ – ৯
১১. ২৫শে মার্চ – ১০
১২. ২৫শে মার্চ – ১১
১৩. ২৫শে মার্চ – ১২
১৪. ২৫শে মার্চ – ১৩
১৫. ২৫শে মার্চ – ১৪
১৬. ২৫শে মার্চ – ১৫
১৭. ২৫শে মার্চ – ১৬
১৮. ২৫শে মার্চ – ১৭
১৯. ২৫শে মার্চ – ১৮
২০. ২৫শে মার্চ – ১৯
২১. ২৫শে মার্চ – ২০
২২. ২৫শে মার্চ – ২১
২৩. ২৫শে মার্চ – ২২
২৪. ২৫শে মার্চ – ২৩
২৫. ২৫শে মার্চ – ২৪
২৬. ২৫শে মার্চ – ২৫
২৭. ২৫শে মার্চ – ২৬
২৮. ২৫শে মার্চ – ২৭
২৯. ২৫শে মার্চ – ২৮
৩০. ২৫শে মার্চ – ২৯
৩১. ২৫শে মার্চ – ৩০
৩২. ২৫শে মার্চ – ৩১
৩৩. ২৫শে মার্চ – ৩২
৩৪. ২৫শে মার্চ – ৩৩
৩৫. ২৫শে মার্চ – ৩৪
৩৬. ২৫শে মার্চ – ৩৫
৩৭. ২৫শে মার্চ – ৩৬
৩৮. ২৫শে মার্চ – ৩৭
৩৯. ২৫শে মার্চ – ৩৮
৪০. ২৫শে মার্চ – ৩৯

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন