১৩. সন্দীপনকে হারাবার পর

নিমাই ভট্টাচার্য

প্রিয়বরেষু ভাই রিপোর্টার,

সন্দীপনকে হারাবার পর হঠাৎ পৃথিবীটা বদলে গেল। শুধু আমার নয়, ডক্টর সরকারেরও। দুজনেই ঘরের মধ্যে বন্দী থাকতাম; একেবারেই বেরুতাম না। সারাদিন দুজনের কেউই কথা বলি না। খাবার টেবিলেও দুজনে মুখ নীচু করে খেয়েই উঠে পড়ি। শুধু তাই নয়, শোকে দুঃখে কেউই কারুর দিকে তাকাতে সাহস করি না। দুজনে দুজনের ঘরে চুপচাপ বসে থাকি; হয়তো শুয়ে পড়ি, কিন্তু কিছুতেই ঘুম আসে না। চোখের পাতা ভারি হয়ে এলেই চমকে উঠি। ওই সামান্য কটা দিনের সুখস্মৃতি যক্ষের ধনের মতো বুকের মধ্যে লুকিয়ে রাখি। বার বার সে স্মৃতি রোমন্থন করি।

কত রাত পর্যন্ত জেগে থাকি, তা বুঝতে পারি না, কিন্তু যতক্ষণ জেগে থাকি ততক্ষণই বুঝতে পারি ডক্টর সরকারও ঘুমোননি। মাঝে মাঝেই ওঁর পায়চারি করার শব্দ শুনতে পাই। যে ডক্টর সরকার প্রতি সন্ধেয় মদের বোতল নিয়ে বসতেন, সেই মানুষটা হঠাৎ মদ স্পর্শ করাও ছেড়ে দিলেন। তারপর দিন দশেক পরে উনি কিছু না বলেই সন্ধের সময় বেরিয়ে গেলেন। ফিরলেন মাঝ রাত্তিরের পর পাঁড় মাতাল হয়ে। আমি তো অবাক। আমাকে দেখেও যেন দেখলেন। আপন মনে এলোমেলো করে গাইছেন, কোথায় পাবো তারে, আমার মনের মানুষ যে রে…।

ওঁকে যত দেখি, আমার মন তত খারাপ হয়। চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে, কিন্তু জোরে। কাঁদতে পারি না। লুকিয়ে লুকিয়ে কাদি। কাঁদেন ডক্টর সরকারও। তিনি আমারই মতো চোরের মতো লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদেন।

এর দিন দশেক পরে ডিনার খেতে খেতে উনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, মা, একটা কথা বলবে? তোমার আর সন্দীপনের বিয়ের তারিখ কী ঠিক হয়েছিল?

আমি লুকোবার চেষ্টা না করে বললাম, না, বিয়ের কোনো কথা হয়নি, তবে আমরা দুজনেই জানতাম, আমরা বিয়ে করব।

অনেকক্ষণ উনি কোনো কথা বললেন না। তারপর আপন মনে একটু হেসে বললেন, তুমি নিশ্চয়ই এর আগে কাউকে ভালোবাসনি?

না।

উনি খুব জোর একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, লোকে বলে প্রথম ভালোবাসা কখনও সাকসেসফুল হয় না। কথাটা বোধহয় ঠিকই। তারপর উনি মুখ নীচু করে বললেন, আমি তো। সেই জ্বালাতেই সারা জীবন জ্বলে পুড়ে মরছি। তুমিও এ জ্বালা থেকে মুক্তি পাবে না।

এ কথার কী জবাব দেব-আমি চুপ করে বসে থাকি।

ডক্টর সরকার একটু শুকনো হাসি হেসে বললেন, জানো মা, ফার্স্ট লাভ সাকসেসফুল না হবার জন্যই আমি এত খারাপ হয়ে গেলাম। সহজ ভাবে মানুষের জীবন না এগুতে পারলেই পারভার্টেড হয়।

এইভাবে গড়িয়ে গড়িয়ে মাসখানেক পার হল। ডক্টর সরকার পুরোদমে কাজকর্ম শুরু করে দিয়েছেন। আমিও বাড়ির মধ্যে আর নিজেকে বন্দিনী রাখতে পারি না; বেরিয়ে পড়ি।

সেদিনও বেরিয়েছিলাম। একদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করতে করতে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে ঢুকে পড়লাম। বইপত্তর ওলটাতেই সারাটা দিন কেটে গেল। ঠিক বেরুবার মুখে একটি ভদ্রলোক এগিয়ে এসে আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটিতে পড়তেন কী? আপনার নামই কী কবিতা?…

হ্যাঁ।

আমি তন্ময় মুখার্জি।

আমি হাত জোড় করে নমস্কার করতেই উনি বললেন, আমিও আপনার কনটেম্পোরারি-তবে ইতিহাসের ছাত্র। তিনমাস হল এসেছি।

রিসার্চ করছেন?

রিসার্চ না, একটা পেপার লিখব বলে কাজ করছি। এটা শেষ করেই আমি স্টেটস এ চলে যাব।

কথা বলতে বলতেই বেরিয়ে পড়লাম। এলোপাথাড়ি ঘুরতে ঘুরতে স্ট্র্যান্ড-এ চলে এলাম। টেমস-এর পাড় দিয়ে কিছুক্ষণ পায়চারি করার পর দুজনেই বেঞ্চে বসলাম।

তন্ময় জিজ্ঞাসা করল, আপনি এখানে কী করছেন?

কিছু করছি না। ভাবছি একটা চাকরি-বাকরি করব।

কোথায়? কোনো ইউনিভার্সিটিতে…

না, না, কোনো ইউনির্ভাসিটিতে নয়। কোনো অফিস-টফিসে…

আপনার কী মাথা খারাপ?

কেন?

আপনি অফিসে চাকরি করবেন?

হ্যাঁ। আমি একটু হেসে বললাম, কোনো মতে দিনটা কেটে গেলেই আমি খুশি।

তন্ময় কি যেন ভাবল। তারপর জিজ্ঞাসা করল, কাল আপনার সঙ্গে দেখা হবে?

কেন জানি না আমি বললাম, হ্যাঁ হবে!

পরের দিনের অ্যাপয়েন্টমেন্ট করেই বাড়ি ফিরে এলাম।

সকল অধ্যায়

১. ০১. প্রিয়বরেষু ভাই রিপোর্টার
২. ০২. তোমার চিঠি পেলাম
৩. ০৩. আমার নিজের কথা বলার আগে
৪. ০৪. কলকাতা আসার মাস ছয়েক পরের কথা
৫. ০৫. এর আগের চিঠিটা পড়ে
৬. ০৬. পরের দিন ভোরবেলায়
৭. ০৭. সুপর্ণার সঙ্গে আমার বিশেষ
৮. ০৮. আলো আঁধারের খেলা
৯. ০৯. হঠাৎ একটা পুরনো দিনের কথা
১০. ১০. বিদেশের মাটিতে পা দিয়েই
১১. ১১. এরোগ্রামের চিঠিটা পড়তে পড়তে
১২. ১২. আমার কথা শুনলে
১৩. ১৩. সন্দীপনকে হারাবার পর
১৪. ১৪. পেঙ্গুইন বুকশপে একটু ঘোরাঘুরি
১৫. ১৫. পরের দুটো তিনটে দিন
১৬. ১৬. আমার ইচ্ছায় নয়
১৭. ১৭. তন্ময় তখনো অঘোরে ঘুমোচ্ছিল
১৮. ১৮. ইউনেস্কোতে বছর তিনেক
১৯. ১৯. আজিজুল প্যারিস ছেড়ে যাবার
২০. ২০. নবেন্দুবাবু প্যারিস থেকে প্রায়
২১. ২১. কোনো পুরুষের সঙ্গেই বিশেষ ঘনিষ্ট

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন