জানলাটা খুলবে না – প্রচেত গুপ্ত

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

লেখাটা প্রথমে চোখে পড়ল বুলুর। চাপা গলায় বলল, ‘দাদা, দেখেছিস?’ আমি খাটের উপর চিত হয়ে শুয়ে আছি। বেড়ানোর চোটে পা দু-টো টনটন করছে। ঘরে ঢুকেই ঝপাং করে শুয়ে পড়লাম। এ ঘরের খাটটা যেমন বড়ো, তেমনই উঁচু। টানটান করে সুন্দর বিছানা পাতা। এরকম উঁচু খাটে আগে কখনও শুইনি। আমাদের বালিগঞ্জের ফ্ল্যাটে খাটগুলো সব মেঝের সঙ্গে মেশানো। উঁচু খাটে শুয়ে আমার দারুণ লাগছে। পা দু-টো ঝুলছে। পায়ে ধুলো মাখা স্নিকার। কলকাতা হলে এটা ভাবতেই পারতাম না। বাইরের জুতো পরে ঘরে ঢুকলেই মা বকুনি দেন। এখানে বকুনির ভয় নেই। বড়োমামার এই শিমুলতলার বাড়িতে মা আসেনি। এসেছি শুধু আমি, আমার বোন বুলু আর বড়োমামা। পা দোলাতে দোলাতে এখন ভাবছি, কাল সকালে কী করা যায়। আচ্ছা, বাড়ির পিছন দিকে যে জঙ্গল-জঙ্গল জায়গাটা দেখতে পেলাম, ওখানে গেলে কেমন হয়? বেশ একটা অ্যাডভেঞ্চার হবে! তবে জায়গাটা খুব কাছে বলে মনে হয় না। বড়ো একটা মাঠ পেরোতে হবে। মাঝখানে একটি ঢিবি মতোও আছে। খানিকটা খানিকটা ঝোপঝাড়। কাউকে কিছু বলার দরকার নেই।

হাতে একটা গাছের ডাল নিয়ে সকালেই রওনা দেব। শিমুলতলায় এসে দেখছি, ধুলো, পাথর আর গাছের ডালের কোনো অভাব নেই। আর একটা জিনিসেরও অভাব নেই। সেটা হল অন্ধকার। একটু আগে ঝপ করে সন্ধে হয়েছে। বাপরে, কী অন্ধকার! এখানে ইলেকট্রিসিটি নেই বললেই চলে। যেটুকু আছে, তাতে টিমটিম করে আলো জ্বলতে পারে, আবার না-ও পারে। আমরা বিকেলে স্টেশনের দিকটায় বেড়াতে গিয়েছিলাম। বড়োমামার হাতে বড়ো একটা টর্চ ছিল। সেই টর্চ জ্বেলে ফেরা হল। বড়োমামা আমাদের বাড়ি পৌঁছে আবার একটু বাজারের দিকে গিয়েছেন।

বুলু আবার ডাকল, ‘দাদা, অ্যাই দাদা!’

আমি বিরক্ত গলায় বললাম, ‘কী হয়েছে?’

বুলু ফিসফিস করে উঠল, ‘এটা কী রে?’

আমি শুয়ে-শুয়েই বললাম, ‘কোনটা?’

বুলু কাঁপা গলায় বলল, ‘এই যে জানলায়। জানলায় কী যেন লেখা রে দাদা!’

জানলায় লেখা। বুলু কী আবোল-তাবোল বকছে? জানলায় লেখা থাকবে কেন? মাথার অনেক উপরে সিলিং। পুরোনো বাড়িতে এরকমই হয়। এই বাড়িটাও পুরোনো। বড়োমামা পঁচিশ বছর আগে বাড়িটা কিনেছেন জলের দরে। তারপর এক সময় সারিয়ে-টারিয়ে নিয়েছেন।

আমি বললাম, ‘কী যা-তা বলছিস বুলু? জানলায় লেখা থাকবে কেন? জানলা কী তোর স্কুলের ব্ল্যাকবোর্ড?’

বুলু কাতর গলায় বলল, ‘প্লিজ, একবার উঠে আয়!’

আমি অর্ডার করলাম, ‘আমি উঠতে পারছি না, কী লেখা আছে তুই চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে পড়।’

বুলু বলল, ‘আমি পড়তে পারছি না, আমার ভয় করছে।’

ভয় করছে! বুকের ভিতরটা ছাঁত করে উঠল। কী এমন লেখা, যার জন্য বুলুর ভয় করবে?

আমরা আজ সকালেই শিমুলতলায় এসে পৌঁছেছি। এখানে বেশ ঠাণ্ডা। স্টেশনের বাইরে এসে বড়োমামা একটা টাঙা ঠিক করলেন। টাঙায় একসঙ্গে অনেকরকম আওয়াজ হয়। ঘোড়ার খুরের খট খট, গাড়ির ঝমর-ঝমর আর ঘণ্টির টুং টুং। সব মিলিয়ে মজার একটা বাজনা যেন!

কুয়াশা-মাখা শুনশান রাস্তা দিয়ে আমরা বাড়িতে চলে এলাম অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই। পথে বড়োমামা জায়গাটা সম্পর্কে আমাদের একটু বলে দিলেন। এমন সময় ছিল, যখন দেওঘর, মধুপুর, শিমুলতলায় বাঙালিরা শখ করে বাড়ি তৈরি করত। সেই বাড়ি সারাবছর ধরে তালা-চাবি দিয়ে বন্ধ থাকত, শুধু পুজো বা শীতে কলকাতা থেকে লম্বা ছুটি কাটাতে সবাই আসত দলবেঁধে। আজকাল সেসব একেবারে কমে গিয়েছে। এলেও দু-চারদিনের বেশি কেউ থাকে না। অনেকে আবার একেবারেই আসে না। শিমুলতলার অনেক বাড়িই এখন বছরের পর-বছর বন্ধ থাকে। ঝোপঝাড়ে-ভরা পোড়ো বাড়ির মতো লাগে।

বড়োমামাও কম আসেন, কিন্তু বাড়িটা যত্ন করে রেখেছেন। সামনে অনেকটা জায়গাজুড়ে ফুলের বাগান। খোলা বারান্দায় বসলে মন জুড়িয়ে যায়। তবে আমাদের মনে হল, বাড়ির পিছনটাই বেশি সুন্দর। সেখানে আম, জাম, কাঁঠাল গাছে ঘেরা চমৎকার একটা কুয়োতলা আছে। এতদিন আমরা শুধু ছবিতেই কুয়ো দেখেছি। এই প্রথম আসল কুয়ো দেখলাম। জায়গাটা গাছের ছায়ায় শান্ত আর ঠাণ্ডা। একেবারে সত্যিকারের ছবির মতো। কপি-কলে বাঁধা দড়ি টেনে আমি আর বুলু বালতি করে জলও তুললাম। কুয়ো থেকে জল তোলা যে এরকম একটা উত্তেজনার ব্যাপার হতে পারে, আমরা ভাবতেও পারিনি। বাড়ির ঘরগুলোও অদ্ভুত। বড়ো বড়ো দরজা, জানলা, আর উঁচু-উঁচু ছাদ। এখন হ্যাজাগের আলোয় যেন আরও উঁচু লাগছে।

একটু আগে নটবরদা ঘরে হ্যাজাগ দিয়ে গিয়েছে। ঝলমলে আলো। আলোয় একটা রুপোলি-রুপোলি ভাব। নটবরদা এ বাড়ির মালি কাম কেয়ারটেকার কাম রাঁধুনি। মজার মানুষ। সারাক্ষণ মিটিমিটি হাসছে। সমস্যা শুধু একটাই, কানে বড্ড কম শোনে। একটা কথা বললে আর একটা কথা বোঝে।

নটবরদা টেবিলে হ্যাজাগ রেখে বলল, ‘খোকা-খুকু, সাবধান। কাছে যেও না বাপু। রাতে শোয়ার আগে নিভিয়ে দেব।’

এই কথা শুনে আমরা একচোট হাসলাম। আমরা খোকা-খুকু! আমার ক্লাস নাইন চলছে, বুলু পড়ছে সেভেনে। আমরা খোকা-খুকু হতে যাব কোন দুঃখে? কিন্তু একথা নটবরদাকে বলে কোনও লাভ হবে না। কী শুনতে কী শুনবে, তার ঠিক নেই।

কুয়োর মতোই হ্যাজাগ জিনিসটাও দেখছি মজার। সারাক্ষণ আওয়াজ করছে, ফসফস, ফসফস। যেন চাপা গলায় রাগ দেখাচ্ছে।

বুলু আবার ডাকল, ‘দাদা, তাড়াতাড়ি আয়।’

এবার তার গলা বেশি কাঁপছে। আমি খাট থেকে নেমে বুলুর পাশে এসে দাঁড়ালাম। ব্যাপারটা কী? আরে! সত্যি তো বন্ধ জানলার গায়ে একটা কাগজই তো বটে! ঠিক কাগজ নয়, একটা নোটিসের মতো। পিচবোর্ডের টুকরোয় কাগজ সাঁটা। পিচবোর্ডের দু-পাশে দড়ি দিয়ে বেঁধে জানলার গরাদের সঙ্গে ঝুলিয়ে দেওয়া আছে। সেখানে বড়ো বড়ো হরফে লেখা, ‘জানলাটা খুলবে না’।

আমি আর বুলু মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম। জানলাটা খুলবে না! এর মানে কী? জানলাটা খুলবে না কেন? সকালে তো জানলাটা খোলাই ছিল। খোলা জানলা দিয়েই তো আমরা বাড়ির পিছনের কুয়োতলা, ভাঙা পাঁচিল, তারপর ধু ধু মাঠ আর দূরের আবছা জঙ্গলটা দেখেছি। তাহলে? এই নোটিস কে লাগাল? নটবরদা? বড়োমামা? কখন লাগালেন?

শিরদাঁড়ার কাছটায় কেমন যেন শিরশির করে উঠল। নির্জন একটা বাড়ির, আরও নির্জন একটা ঘরের বন্ধ জানলায় এ কী রহস্যময় নোটিস! বুলু সরে এল আমার কাছে। তারপর আমার হাতটা ধরে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘দাদা, ভয় করছে।’

আমি বুলুর হাত সরিয়ে চাপা গলায় ধমক দিলাম, ‘ভয়ের কী আছে? বড়োমামাকে জিজ্ঞেস করলেই তো ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যাবে। নিশ্চয়ই বড়োমামাই লিখেছেন।’

বুলুকে ধমক দেওয়ার পিছনে কারণ আছে। বড়োমামা যদি বুঝতে পারেন আমরা ভয় পেয়েছি, তাহলে খুব বিচ্ছিরি হবে। আসলে এখানে আমি আর বুলু একরকম জোর করেই এসেছি।

গত সপ্তাহে বড়োমামা আমাদের ফ্ল্যাটে এসে বললেন, ‘শিমুলতলায় দু-দিনের জন্য যেতে হবে।’

মা বললেন, ‘কেন রে দাদা? এখন তো ছুটি-ছাটার কোনও ব্যাপার নেই।’

বড়োমামা বললেন, ‘ছুটি কাটাতে যাব না, কাজ আছে। আমি একাই যাচ্ছি। নটবর খবর দিয়েছে, বাড়ির পিছন দিকের পাঁচিলটা ভেঙে পড়েছে। মেরামতের ব্যবস্থা করতে হবে। আজকাল ওসব জায়গায় চোর-ডাকাতের খুব ঝামেলা বেড়েছে। পাঁচিলটা ঠিক না করলে বিপদ। কবে শুনব, দরজা-জানলা ভেঙে সব নিয়ে গিয়েছে।’

আমি আর বুলু বাবা-মায়ের সঙ্গে অনেক জায়গায় গিয়েছি। দিল্লি, মুম্বাই, গোয়া, কুলু-মানালি এমনকী নেপাল পর্যন্ত। কিন্তু শিমুলতলায় কখনও যাওয়া হয়নি। অথচ সেখানে বড়োমামার এমন একটা সুন্দর বাড়ি আছে।

বড়োমামার কথা শুনে আমি আর বুলু ঝুলে পড়লাম, ‘আমাদের পরীক্ষা হয়ে গিয়েছে, আমাদেরও নিয়ে যেতে হবে। আমরাও যাব। তুমি পাঁচিল সারাবে, আমরা বেড়াব।’

বুলুর বায়না আবার সাংঘাতিক। আমার ধারণা, কিছুদিনের মধ্যে ওর নাম ‘বায়নাকুমারী’ হিসেবে গিনেস রেকর্ড বুকে উঠে যেতে পারে। তবে শিমুলতলায় যাওয়ার বায়না মোটেও সহজ বায়না নয়। মা-বাবা, বড়োমামাকে রাজি করাতে যে আমরা দুই ভাইবোন কত কাকুতি-মিনতির মধ্যে দিয়ে গেলাম, তার সবটা আর বলছি না। যদিও শেষ পর্যন্ত ওরা রাজি হলেন। বড়োমামা শর্ত দিয়েছেন দু-টো। কথা শুনে চলতে হবে এবং কোনও কারণেই ভয় পাওয়া চলবে না।

আমি হেসে বললাম, ‘ভয় কেন পাব? ওটা কি ভূতেদের জায়গা নাকি?’

বড়োমামা বললেন, ‘ভূতেদের জায়গা নয়, তবে গা ছমছমে জায়গা তো বটেই। বাড়ি-ঘর, মানুষ সবই কম-কম। দিনের আলোয় খুব সুন্দর, কিন্তু রাতের অন্ধকারে দুম করে বদলে যায়। তখন ‘ভয় করছে’ বললে চলবে না।’

এখন দেখছি, কথাটা সত্যি। অন্ধকারে জায়গাটা বদলে গিয়েছে। জুতো খুলতে খুলতে আমি জানলার রহস্য ভেদ করার চেষ্টা করলাম। সকালে যে জানলাটা দিয়ে রোদ এসে ঘর ভরিয়ে দিল, সন্ধের পর সেটাই খুলতে নিষেধ! কেন? তাছাড়া এ ঘরে তো আরও একটা বড়ো জানলা আছে। কই, সেটায় তো কোনও নোটিস নেই! ওটা বড়ো রাস্তার দিকের জানলা, এটা মাঠ আর জঙ্গলের দিকের। এদিকে কোনও গোলমাল আছে? গোলমালটা কী? ভয়ের কিছু? সকালে ভয়ের নয়, রাতেই ভয়?

বুলু বলল, ‘দাদা, বড়োমামা মজা করছেন না তো?’

অসম্ভব! বড়োমামা মজার মানুষ, কিন্তু আমাদের ভয় দেখিয়ে মজা পাওয়ার মানুষ নন। সকালেই বড়োমামা বলেছিলেন, ‘তোমরা কি রাতে একা শুতে পারবে? ইচ্ছে করলে আমার সঙ্গে শুতে পার।’

আমি আর বুলু দু-জনেই কঠিন গলায় আপত্তি করেছিলাম। কলকাতায় আমরা একা-একাই শুই। সামান্য শিমুলতলায় দু-টো রাত শুতে পারব না? এখন মনে হচ্ছে, এ ঘরে রাত কাটানো কঠিন হবে। নটবরদা রান্নাঘরে। গুনগুন করে দেহাতি গান গাইছে আর হাতা-খুন্তি নাড়ছে। বেগুনি ভাজছে। শুনেছি রাতের মেনু হল, গরম ভাত, ডাল, বেগুনি আর চিকেন। নটবরদাকে গিয়ে ব্যাপারটা জিজ্ঞেস করব? কোনও লাভ নেই। ঠিকমতো শুনতেই পাবে না। ‘জানলা’ শুনতে হয়তো ‘আলনা’ বুঝবে। আমরা খাটের উপর পা গুটিয়ে বসে রইলাম। বড়োমামা না ফিরলে কিছু জানা যাবে না।

বন্ধ জানলাটার দিকে তাকাতে চাইছি না, তবু চোখ বার বার ওদিকেই চলে যাচ্ছে। হ্যাজাগের আলোয় দেয়ালের গায়ে আমাদের যে ছায়াগুলো পড়েছে, সেগুলো খুব লম্বা। এটা কি মনের ভুল? তাই হবে। ভয় পেলে মনে নানারকম ভুল হয়।

বুলু বলল, ‘দাদা, ভূত নেই তো?’ আমি চমকে উঠলাম। বানিয়ে বানিয়ে হেসে বললাম, ‘ভূত। দূর, ভূত কোথায় থাকবে?’ বুলু বলল, ‘জানলার ওপাশে।’

আমি বললাম, ‘বোকার মতো কথা বলিস না বুলু। ভূত যদি থাকত, দরজা-জানলা বন্ধ করে কি তাকে আটকানো যেত? আমার মনে হয়, ঠাণ্ডা হাওয়া আটকাতে বড়োমামা নোটিস ঝুলিয়েছেন।’

বুলু চোখ কপালে তুলে বলল, ‘ঠাণ্ডা হাওয়া! ওদিকটা তো উত্তর দিক নয় দাদা।’

আমি দাঁত কিড়মিড় করে বললাম, ‘হাওয়া কি শুধু উত্তরদিকেই থাকে? হাঁদা কোথাকার। এবার ভূগোলে গোল্লা পাবি। পোকামাকড়ের জন্যও হতে পারে। জংলি জায়গা তো।’

ভূগোলে গোল্লা পাবে শুনে বুলু দুঃখিত হল বলে মনে হল না। কাঁপা-কাঁপা গলায় বলল, ‘অন্য জানলাটা দিয়েও তো পোকামাকড় ঢুকতে পারে। কই, সেটায় তো কিছু লেখা নেই।’

আবার ধমক দিতে গিয়ে আমি চুপ করে গেলাম। সত্যিই তো, বুলুর যুক্তি ফেলনা নয়। শুধু এই জানলাটা খুলতেই বারণ কেন?

খেতে বসে বড়োমামা আমাদের প্রশ্ন শুনে একটু গম্ভীর হয়ে গেলেন। বললেন, ‘হ্যাঁ, ওটা আমারই লেখা। বোর্ডটা ওই জানলাটার জন্য সবসময় তৈরিই থাকে। নটবরকে বলেছিলাম, বিকেল থাকতে থাকতে যেন ঝুলিয়ে দেয়। মুখেও বলতে পারতাম, কিন্তু পাছে ভুলে যায়, তাই লিখে দেওয়া। জানলাটা তোমরা খোলোনি তো?’

আমি বললাম, ‘না খুলিনি, কিন্তু কেন? জানলার ওপাশে কী আছে?’

বড়োমামা একটু হেসে বললেন, ‘কিছু নেই।’

বুলু বলল, ‘তাহলে?’

বড়োমামা চুপ করে রইলেন।

আমি বললাম, ‘আমার তো কিছুই মাথায় ঢুকছে না।’

বড়োমামা এবার আরও গম্ভীর গলায় বললেন, ‘সবকিছু মাথায় ঢোকানোর দরকার কী? সকালেই আবার জানলা খুলে দেওয়া হবে। এটা শুধু রাতের জন্য ব্যবস্থা। চিন্তা নেই, নটবর ওই ঘরের ঠিক বাইরে বিছানা করে শোবে। তোমাদের কি ভয় করছে?’

খুবই ভয় করছে। তবু আমি শুকনো হেসে তাড়াতাড়ি বললাম, ‘মোটেই না! খোলা জানলা হলে তাও একটা কথা ছিল। বন্ধ জানলা নিয়ে ভয় করবে কেন? কিন্তু আমাদের জানতে ইচ্ছে করছে….।’

বড়োমামা মাথা নামিয়ে চিকেনে মন দিতে দিতে বললেন, ‘আজ নয়, ফেরার সময় সব বলব। চিন্তা করিস না, নটবরের একটা লাইসেন্সওলা বন্দুক আছে।’

বড়োমামা যে নোটিসের ব্যাপারটা এড়িয়ে যাচ্ছেন, সেটা স্পষ্ট।

আমরা চুপ করে খেতে লাগলাম। বন্দুকের কথা শুনে ভীষণ উত্তেজনা হচ্ছে। নটবরদা বন্দুক কেন রাখে? তার সঙ্গে বন্ধ জানলার কি কোনও সম্পর্ক আছে?

শিমুলতলার রাত কেমন? যে না থেকেছে, তাকে বোঝানো মুশকিল। চারপাশ চুপচাপ, ঘুটঘুটে অন্ধকার আর কনকনে শীত। হ্যাজাগ নিভিয়ে দেওয়া হয়েছে। ঘরের বাইরে নটবরদা একটা নিভু-নিভু হ্যারিকেন নিয়ে শুয়ে আছে।

ঘরের ভিতর আমি আর বুলু দু-জনেই লেপমুড়ি দিয়েছি। বড়োমামা বলেছেন, চিন্তার কিছু নেই। কিন্তু খুবই চিন্তা হচ্ছে। বন্ধ জানলার নোটিস, বড়োমামার প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়া, নটবরদার বন্দুক, শিমুলতলার নিঝুম রাত, সব মিলিয়ে রহস্য জমাট বেঁধে উঠেছে। আমি একবার লেপ থেকে উঁকি মেরে দেখলাম, অন্ধকারে জানলাটা যেন হাসছে।

পরদিন ঘুম ভাঙল ভোরে। খোলা জানলা দিয়ে ঘরে রোদ এসে পড়েছে। ঝকঝকে একটা সকাল। খাট থেকে নেমে জানলার পাশে এসে দাঁড়ালাম। নোটিস উধাও!

গরাদের ওপাশে কুয়োতলা। তারও পরে বাড়ির ভাঙা পাঁচিল টপকে যতদূর চোখ যায়, রুক্ষ মাঠ চলে গিয়েছে আবছা হয়ে থাকা জঙ্গলের দিকে। কালকের দুশ্চিন্তা নিমেষে উবে গেল। বুলুকে ডেকে বললাম, ‘দ্যাখ, দ্যাখ, কী সুন্দর।’

আরও একটা দিন আমরা শিমুলতলায় ছিলাম। দিনেরবেলায় খুব মজা করেছি। লাট্টু পাহাড়ে গিয়েছি, গরম ল্যাংচা খেয়েছি, মাঠে যত ইচ্ছে ছোটাছুটি করেছি, কুয়োর ঠাণ্ডা জলে স্নান করেছি।

নটবরদার কাছে বন্দুকটাও দেখতে চেয়েছিলাম। নটবরদা হেসে বলেছে, ‘সিন্দুক! আমি গরিব মানুষ, সিন্দুক কোথায় পাব?’

তবে সন্ধের পর থেকেই মনের ভিতর খচখচানি শুরু হল। যত রাত বাড়ল খচখচানি বাড়ল। ভাই-বোনে বালিশ-টালিশ নিয়ে সোজা বড়োমামার ঘরে চলে গেলাম। গল্প শোনার নাম করে উঠে পড়লাম তাঁর খাটে। বড়োমামা মুচকি হাসলেন।

তবে কথা রেখেছেন বড়োমামা। কলকাতায় ফেরার সময় ট্রেনেই বন্ধ জানলার রহস্য ফাঁস করে দিয়েছেন।

‘আসলে কী জানিস, এসব জায়গায় ডাকাতরা রাতের অন্ধকারে অনেক দূর দূর থেকে বাড়িগুলোর উপর নজর রাখে। খোলা জানলা-দরজা দিয়ে আলো দেখলেই বোঝে, কোন বাড়িতে লোক এসেছে। লোক আসা মানেই জিনিসপত্র, টাকা-পয়সাও এসেছে। তখন ওরা ডাকাতির একটা সুযোগ নেয়। ওই ঘরের জানলাটার পিছনেই মাঠ। মাঠ শেষ হলে জঙ্গল, ডাকাতদের আখড়া। তারপর আবার পিছনের পাঁচিলটা গিয়েছে ভেঙে। ঘরের আলো জঙ্গল থেকে দেখতে কোনও অসুবিধাই হত না। সেই কারণেই সন্ধের পর জানলা বন্ধ করে নোটিস ঝুলিয়ে দেওয়া। তোরা বোধহয় খেয়াল করিসনি, নটবরও কিন্তু আলো হাতে কুয়োতলায় যাচ্ছিল না। কাজকর্ম যেটুকু যা করার, অন্ধকারেই সারছিল। ডাকাতদের ভয় দেখানোর জন্য তার একটা বন্দুকও আছে, কিন্তু আবার গুলি নেই।’

বুলু অভিমানী গলায় বলল, ‘আমাদের আগে বললে না কেন?’

বড়োমামা বললেন, ‘শিমুলতলার ডাকাতরা ওঁত পেতে থাকে শুনে তোরা যদি ঘাবড়ে যাস, তাই বলিনি। কিন্তু না শুনেই যে এত ভয় পাবি, সেটা বুঝব কেমন করে? তবে দু-টো দিন বেশ একটা রহস্যের মধ্যে রইলি, খারাপ লাগল।’

আমরা ভাই-বোন জোরে মাথা নেড়ে বললাম, ‘মোটেই না।’

সকল অধ্যায়

১. ডিটেকটিভ – সুকুমার রায়
২. পরাশর বর্মা ও ভাঙা রেডিও – প্রেমেন্দ্র মিত্র
৩. প্রাপ্তিযোগ – লীলা মজুমদার
৪. ঘুমন্ত পুরী – ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য
৫. উদুদা পাহাড়ের অশরীরী দানব – সঙ্কর্ষণ রায়
৬. অকালকুষ্মান্ড – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ
৭. রহস্য যখন গভীরে – বরেন গঙ্গোপাধ্যায়
৮. হিরে চোর হবুচন্দ্র – অদ্রীশ বর্ধন
৯. ভরত ডাক্তারের ঘোড়া – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
১০. ব্রিফকেস রহস্য – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়
১১. মুক্তিপণ – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
১২. আমিই গোয়েন্দা – সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
১৩. মরণের মুখে – অজেয় রায়
১৪. রুবাইয়ের রূপকথা – নবনীতা দেবসেন
১৫. ব্যাঙ্ক ডাকাত আর লাফানো থলে – শেখর বসু
১৬. জলার ধারে আস্তানায় – সমরেশ মজুমদার
১৭. দিদিমার খেলাঘর – শ্যামল দত্তচৌধুরী
১৮. বর্ণপরিচয়ের প্রথম সংস্করণ – রতনতনু ঘাটী
১৯. জানলাটা খুলবে না – প্রচেত গুপ্ত
২০. ছোট রাজার পোষ্য – সৈকত মুখোপাধ্যায়
২১. ঠাকুরদার বন্দুক – কৃষ্ণেন্দু মুখোপাধ্যায়
২২. গভীর রাত্রে ব্রহ্মপুত্রে – দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য
২৩. রোডসসাহেবের হিরে – রাজেশ বসু
২৪. ভগবানের হাত – হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত
২৫. নতুন বন্ধু চিনু – জয়দীপ চক্রবর্তী

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন